সাইবারপাঙ্ক ধারা – সাহিত্য ও সমাজ
লেখক: ময়ূখ বিশ্বাস
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
“সাইবারপাঙ্ক ধারা উত্তর-আধুনিক কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের একটি ধারা।‘উন্নততর প্রযুক্তি ও তার প্রভাবে জীবনের অবমূল্যায়ন’ এই ধারার প্রধান চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। ”
-উইকিপিডিয়া
‘সাইবারপাঙ্ক’ বা ‘অপযান্ত্রিক’ ধারা প্রথম সাহিত্যে উঠে আসে 1983 সালে; আমেরিকান লেখক ব্রুস বেথকে নিজের একটি গল্পের নাম দেন ‘সাইবারপাঙ্ক’। সেটা থেকে এই ধারাটি নিজের নাম পায়। ধারাটিকে জনপ্রিয় ও আলোচ্য বিষয় করে তোলে 1984 সালে প্রকাশিত উইলিয়াম গিবসনের স্প্রল(sprawl)ট্রিলজি।
প্রচলিত ‘ইউটোপিয়ান কল্পবিজ্ঞান ধারা’, জুল ভার্ন, এইচ. জি. ওয়েলস, আর্থার সি. ক্লার্ক, আইজ্যাক অ্যাসিমভ প্রমুখ সাহিত্যিকেরা যেটা চর্চা করেছেন, তার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল – ‘ভবিষ্যতে যান্ত্রিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতি কিভাবে মানুষের জীবনযাপন সহজতর এবং আনন্দময় করে তুলবে তার একটি বৈজ্ঞানিক ও যুক্তি-সম্পন্ন ব্যাখ্যান।’ অপযান্ত্রিক ধারাটি অন্যদিকে তুলে ধরে প্রযুক্তিগত উন্নতি কিভাবে কিছু মুষ্টিমেয় মানুষকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে তোলে; এবং সঙ্গত কারণে তার ফলে প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত সাধারণ মানুষ সেই মুষ্টিমেয় কয়েকজনের ক্ষমতার লোভের ভুক্তভোগী হয়।
অপযান্ত্রিক ধারার গল্পে বারেবারে উঠে আসে হ্যাকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মহাকর্পোরেশন এবং যন্ত্র ও মানুষের প্রযুক্তিগত মেলবন্ধন। মানুষ কখনোই নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে খুশি ছিল না; সীমা অতিক্রম করার জন্যই প্রযুক্তির প্রচলন হয়েছে, যা মানুষকে ভীষণভাবে যান্ত্রিক করে তুলেছে। সৃজনশীলতা থাকছে শিকেয় তোলা, অনুকরণ ও ভোগবাদী মানসিকতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। অপযান্ত্রিক ধারার সাহিত্য চেষ্টা করেছে মানুষের সামনে তা তুলে ধরার। সাহিত্যগুলি জনপ্রিয় হয়েছে, কিন্তু সাফল্য আসেনি। মানুষ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে এমন এক ভবিষ্যতের দিকে যেখানে মূল্যবোধ বিচার হবে যন্ত্রের মাপকাঠিতে।
“সাইবারপাঙ্ক ধারার নায়কেরা সবাই সমাজ থেকে বাইরে, একঘরে, এবং একলসেঁড়ে(Loner)। তারা এমন একটা সমাজে বাস করে যেখানে দৈনন্দিন জীবন চালিত হয় দ্রুততালে(rapidly) চলা প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের হাতে;সমাজ এগোয় একটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত তথ্যভাণ্ডারের ঘেরাটোপে থেকে এবং মানুষ নিজের দেহ উন্নত করে ইচ্ছামত ও প্রয়োজনমত। ”
– লরেন্স পারসন
1940-1950 সালের কল্পবিজ্ঞানে কল্পনা করা ‘ইউটোপিয়ান সমাজ’ উপেক্ষা করে অপযান্ত্রিক ধারা তুলে ধরে এক ‘ডিস্টোপিয়ান সমাজ’, যেখানে মানুষের লোভ ও স্বার্থপর কৌতূহল সমাজকে নিয়ে যায় অবক্ষয়ের পথে। উন্নতি যদি মানবিক গুন প্রকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তবে তাকে উন্নতি বলা যায় কিনা এই প্রশ্ন অপযান্ত্রিক ধারার সাহিত্যে উঠে আসে বারেবারে। এই ধারার নায়কেরা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, প্রতিবাদ করে ‘উন্নতির লক্ষে, উন্নতির পথে’ এই ভীষণ লোভী ও মানবিকতা-হীন দর্শনের। এই ধারা প্রশ্ন তোলে মানুষের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা ও সার্থকতা নিয়ে। মানবপ্রকৃতির অন্তর্লীন বিপ্লবের চেতনা ফুটে ওঠে লেখকদের লেখায়।
1984 সালে উইলিয়াম গিবসনের “নিউরোম্যান্সার(Neuromancer)” প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে তার ব্যবহার করা শব্দ সাইবার-স্পেস(Cyberspace, প্রথম পাওয়া যায় “বার্নিং ক্রোম”,1982 গল্পে) প্রবল জনপ্রিয়তা পায়। উপন্যাসটি অপযান্ত্রিক ধারাকে জনসমক্ষে তুলে নিয়ে আসে এবং ধারাটির ভিত পোক্ত করে। এর পরে আর দুটি বই “(Count Zero, 1986)” এবং “মোনালিসা ওভার ড্রাইভ (Mona Lisa Overdrive, 1988)” নিয়ে সম্পূর্ণ হয় “স্প্রল ট্রিলজি”। গিবসন উঠে আসেন প্রথম সারির কল্পবিজ্ঞান লেখকদের তালিকায়। এরপর প্রকাশিত হয় “দি ডিফারেন্স ইঞ্জিন(The Difference engine, 1990)”, যেটি একটি “স্টিমপাঙ্ক” ধারার উপন্যাস; “ ব্রিজ ট্রিলজি(Virtual Light,1993 ; Idonu,1996 ; All tomorrow’s Parties,1999)”; এবং “প্যাটার্ন রিকগনিশন( Pattern Recognition,2003)”, “স্পুক কান্ট্রি (Spook Country,2007)” ও “জিরো হিস্ট্রি(Zero History, 2010)”.
উইলিয়াম গিবসন যা শুরু করেছিলেন 1984 সালে, তা দ্রুতগতিতে এগোয় নবীন লেখক-গোষ্ঠীর হাত ধরে। নীল স্টিফেনসন, ব্রুস স্টারলিং, ফিলিপ কে. ডিক প্রমুখ আমেরিকান লেখক এবং কাতসুহিরো ওটোমো, শিরো মাসামুনে প্রভৃতি জাপানী লেখক তাদের মধ্যে অন্যতম।
নীল স্টিফেনসনের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস “দি বিগ ইউ (The big U, 1984)” এবং দ্বিতীয় উপন্যাস “জোডিয়াক (Zodiac, 1988)” তাকে পরিচিতি দেয় অপযান্ত্রিক ধারার লেখক হিসাবে। তিনি প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন 1992 সালের “স্নো ক্ল্যাশ (Snow Clash)” উপন্যাসে; যেখানে অপযান্ত্রিক ধারা, মেমেটিক্স(Memetics), কম্পিউটার ভাইরাস ও সুমেরিয়ান পুরাণ মিলেমিশে যায় জটিল ও উগ্র আর্থসামাজিক সমস্যার সঙ্গে। এর পরে তিনি লিখেছেন আরও অজস্র উপন্যাস ও ছোটগল্প (সম্পূর্ণ তালিকা দেওয়ার পরিসর হল না) যা তাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তুলে দিয়েছে। বহু অপযান্ত্রিক ধারার পাঠক তাকে এই ধারার ভগবান(“God of Cyberpunk Fiction”) বলে দাবী করেন। আমি এর বিচার পাঠকদের বিবেচনার উপর ছেড়ে দিলাম। জাপানী মাঙ্গা শিল্পী কাতসুহিরো ওটোমোর “আকিরা(Akira 1982)” এবং শিরো মাসামুনের মাঙ্গা “ঘোস্ট ইন দি শেল(Ghost in the Shell, 1989)” অপযান্ত্রিক ধারাকে জনপ্রিয় করে তোলে জাপান ও সমগ্র বিশ্বে।
এই লেখকেরা কল্পনার বাঁধ ভেঙ্গে দেন বৈজ্ঞানিক যুক্তির সাহায্যে। তারা কল্পনা করেন এমন এক পৃথিবীর যেখানে প্রত্যেকটি মানুষ একে অপরের সঙ্গে যুক্ত একটি পৃথিবীব্যাপী বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে(যা এখন বাস্তবায়িত হয়েছে), তাদের কল্পনায় ঘুচে যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মানুষের প্রভেদ, মানুষ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয় প্রকৃতিদত্ত নিখুঁত কিন্তু দুর্বল দেহ, ব্যবহার করে প্রযুক্তি নির্মিত শক্তিশালী ও সহজে পরিবর্তনশীল কৃত্রিম দেহ। যান্ত্রিকতা সেখানে প্রশংসিত, মানুষ হওয়া অবমাননীয়। বাংলা সাহিত্যে এই ধারা নিয়ে মহম্মদ জাফর ইকবাল, হুমায়ূন আহমেদ এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেছেন অনবদ্য উপন্যাস ও গল্প।
মহম্মদ জাফর ইকবালের প্রথম একটি গল্প সঙ্কলন “কপোট্রনিক সুখ-দুখঃ(1976)” সম্পূর্ণ অপযান্ত্রিক ধারার না হলেও বাংলা ভাষায় যে প্রথম এই ধারার প্রচেষ্টা, সেটা স্বীকার করতেই হয়। এরপর “যারা বায়োবট(1993)”, “নিঃসঙ্গ গ্রহচারী(1994)”, “ত্রিনিত্রি রাশিমালা(1995)”, “মেৎসিস(1999)”, “ত্রাতুলের জগৎ(2002)” প্রমুখ উপন্যাস(তালিকা অসম্পূর্ণ) বাংলা ভাষায় অপযান্ত্রিক ধারাকে প্রতিষ্ঠা করে অনবদ্য রূপে, এবং পাঠকের কাছে রেখে যায় একটি বেয়াড়া প্রশ্ন, “যান্ত্রিকতা কি মানবিকতারই একটি অংশ? নাকি একটি রোগ?”
হুমায়ূন আহমেদ এর কল্পবিজ্ঞান অপযান্ত্রিক ধারায় পড়ে কিনা, তা নিয়ে পাঠকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে, কিন্তু তার “ইরিনা”, “দ্বিতীয় মানব”, “ফিহা সমীকরণ”, “ইমা” প্রভৃতি উপন্যাস বারে বারে তুলে ধরে যন্ত্র-সভ্যতায় মানুষ ও মানবিকতার অবস্থানগত সংকট, এবং তার নিষ্ঠুর ও লোভী অবমূল্যায়ন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর “বনদেবী ও পাঁচটি পায়রা” একটি নিখুঁত ও অনবদ্য অপযান্ত্রিক উপন্যাস, যা যন্ত্র-সভ্যতার অমানবিক পরিস্থিতি ও মনুষ্যত্বের অবমূল্যায়ন কে পাঠকের সামনে তুলে ধরে। এছাড়াও, তার বহু ছোটগল্পে (“3000 বছর পরে” গল্প-সঙ্কলন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য) অপযান্ত্রিক ধারা উঠে এসেছে বারে বারে। তাদের লেখায় বারেবারে ফুটে উঠেছে একটাই আকুতি – মানুষের তৈরি যন্ত্র যেন শেষে মানুষের মনিব ও বিধাতা না হয়ে দাঁড়ায়। যদি হয় তবে শেষের সে দিন হবে ভয়ংকর।
অপযান্ত্রিক ধারা জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে সেটি মানবসমাজের উপর এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। একদিকে শিল্পী এঁকেছেন অজস্র ছবি, অন্যদিকে ভাস্কর বানিয়েছেন অনবদ্য ভাস্কর্য। স্থপতি বানিয়েছেন এবং বানাচ্ছেন অবিশ্বাস্য সব স্থাপত্য(টোকিওর ‘শিবুইয়া স্কোয়ার’, বার্লিনের ‘সোনী সেন্টার’, হংকং এর ‘সাইবারপোর্ট’)। অপযান্ত্রিক ধারা অনুসরণ করে সিনেমা হয়েছে অজস্র যা মানুষের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে(ঘোষ্ট ইন দি শেল, ম্যাট্রিক্স ট্রিলজি ও ইনসেপসন তার মধ্যে অন্যতম)। সুরকার পেয়েছেন নতুন সুরের ভাবনা। আধুনিক দেশসমূহের অধিবাসীদের চিন্তাধারা ও দর্শন অনেকটাই এই অপযান্ত্রিক ধারা প্রসূত। কিন্তু আধুনিক জাপান পিছনে ফেলে দিয়েছে সবাইকে। তারা নিজেদের দেশটাকেই সম্পূর্ণরূপে সাজিয়েছে অপযান্ত্রিক ধারার কল্পনাকে ভিত্তি করে। টোকিওর শিবুইয়া স্কোয়ার দেখলে কল্পবিজ্ঞান সিনেমার সেট মনে হয়; জনপ্রিয় করে তোলে জাপান ও সমগ্র বিশ্বে।
নবীন পাঠকেরা যারা কল্পবিজ্ঞান পড়ছেন বা পড়েছেন, কিন্তু অপযান্ত্রিক ধারার সাহিত্য সেভাবে পড়া শুরু করেননি, তাদের প্রতি অনুরোধ, শুরু করুন মহম্মদ জাফর ইকবাল ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর লেখা দিয়ে। এবং জোগাড় করে পড়ে ফেলুন “ঘোস্ট ইন দি শেল” মাঙ্গা। প্রথমেই উইলিয়াম গিবসন বা নীল স্টিফেনসন ধরলে অতিরিক্ত বৈজ্ঞানিক ও অপযান্ত্রিক অপভাষা(Jargon) পড়ায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। যারা আত্মবিশ্বাসী, তারা অবশ্যই পড়ুন এবং উপভোগ করুন। কিন্তু ভাল না লাগলে বা বুঝতে সমস্যা হলে প্রাবন্ধিকের সমালোচনা করুন, লেখকদের নয়; পাঠকদের প্রতি এটি আমার বিনম্র প্রার্থনা।
1981 সালে প্রকাশিত উইলিয়াম গিবসনের ছোটগল্প ‘দি জার্নসব্যাক কন্টিনিউয়াম’ সরাসরি ব্যঙ্গ করে তার পূর্বসূরি ‘ইউটোপিয়ান কল্পবিজ্ঞান ধারা’কে, যার ফল হয় সুদূরপ্রসারী। ‘ইউটোপিয়ান কল্পবিজ্ঞান ধারা’ এখন মৃতপ্রায়(যে কোনো শিক্ষিত মানুষ বর্তমান যুগে তার অসারতা ধরতে পারবেন)।ধারাটি চর্চা করেন নবীন কল্পবিজ্ঞান লেখকেরা; হাত পাকানোর জন্য। অভিজ্ঞ লেখকেরা তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগান এমন এক সমাজের কল্পনায় যেখানে মানুষই মুখ্য, কারণ মানুষ সেখানে বড় কম। যন্ত্রমানব ও যান্ত্রিক মানবে ভরে গেছে সেই পৃথিবী। তারাই কি মানুষের ভবিষ্যৎ? ভবিষ্যতের গর্ভেই এর উত্তর লুকনো আছে।
Tags: দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, প্রবন্ধ, ময়ূখ বিশ্বাস, সাইবারপাঙ্ক ধারা – সাহিত্য ও সমাজ, সুপ্রিয় দাস