অপার্থিব মেধার সন্ধানে

  • লেখক: সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী
  • শিল্পী: আন্তর্জাল

ফের্মি প্যারাডক্স

পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে – এ ধারণা নিশ্চয়ই প্রাচীন – না হলে পৌরাণিক কাহিনীতে দেবতা বা রাক্ষসের আবির্ভাব হত না। স্বর্গ বা পাতাল ভিনগ্রহ বলে চিহ্নিত না হলেও মর্ত্যলোক বা আমাদের পৃথিবীতো নয়। দেবতারা কি গ্রহান্তরের মানুষ – এই সব ভাবনা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই – কিন্তু যখন লাল মঙ্গল গ্রহটা দেখি মনে পড়ে এইচ জি ওয়েলসের লেখা ‘ওয়ার অফ দা ওয়ার্ল্ডস’। টেলিস্কোপে মঙ্গল গ্রহ দেখে তার ম্যাপ করতে গিয়ে ১৮৭৭ সালে ইটালির বৈজ্ঞানিক জিওভানি ভার্জিনিও শিয়াপারেলি মঙ্গলের মাটিতে কিছু সরু রেখা ও কালচে ছোপ দেখে সন্দেহ করেছিলেন যে, রেখাগুলি হল উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরী জলের নালা বা খাল আর ছোপগুলি সমুদ্র। ১৮৯৪ সালে আমেরিকান বৈজ্ঞানিক পার্সিভাল লোয়েলও নাকি টেলিস্কোপে মঙ্গলের তৃণভূমি ও মরুভূমি দেখতে পেয়েছেন এবং ধারণা করেন যে মঙ্গলের উত্তরমেরুতে যে বরফের টুপি আছে সেখান থেকে জল খাল দিয়ে আসে চাষ আবাদের জন্য এবং সেখানে উন্নত সভ্যতা বিরাজ করছে। সম্ভবতঃ এরই ফলশ্রুতি ১৮৯৮ তে লেখা কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস এইচ জি ওয়েলসের ‘ওয়ার অফ দা ওয়ার্ল্ডস’ – বিকট দর্শন মঙ্গলবাসীদের পৃথিবী আক্রমণ। শুরু হল কল্পবিজ্ঞানে ভিনগ্রহের অধিবাসীদের আবির্ভাব। গত একশ বছরেরও বেশী সময় ধরে এই ভিনগ্রহীদের নিয়ে কত যে গল্প, উপন্যাস, চিত্র, কমিকস, চলচ্চিত্র এমন কি হাল আমলে ভিডিও গেমস-এর সৃষ্টি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কল্পনা, স্বপ্নজগৎ, গল্প, সিনেমা চিত্তবিনোদনের জন্য ঠিক আছে কিন্তু বাস্তব কি বলছে? পেয়েছি কি আমরা অন্ততঃ একটা ভিনগ্রহীরও সন্ধান? না কি ‘আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে’! এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের বক্তব্য কি? সেটা জানতেই এক রবিবার সকালে এসেছিলাম প্রফেসর ভট্টের বাড়িতে। প্রফেসর মহাকাশ ভট্ট – আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট। বিদেশেই প্রায় সারাজীবন কাটিয়েছেন। একসময়ে নাসাতেও কয়েকবছর ছিলেন। এখন আমার প্রতিবেশী। লম্বা দোহারা চেহারা, চোখে পুরু কালো ফ্রেমের হাই পাওয়ারের চশমা, এক মাথা সাদা চুল আর তার সাথে মানানসই সাদা দাড়ি। একজন ফরাসী মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। বছর চারেক আগে স্ত্রীবিয়োগ হলে প্রফেসর ভট্ট সব ছেড়ে অবসর নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। দুই ছেলে আমেরিকাতেই থেকে যায়। উনি বছরে একবার করে ছেলেদের কাছে যান। কয়েকমাস থেকে আবার ফিরে আসেন।       

     এখানকার পৈতৃক বাড়িটা নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছেন। সংসার বলতে দুটো চাকর, একটি রান্নার ঠাকুর, ড্রাইভার আর বাগান দেখার জন্য মালী। প্রায়ই আমি আসি ওনার সাথে গল্প করার জন্য। ওনার ড্রয়িং রুম, বেড রুম, স্টাডিরুম শুধু বই আর বিদেশী বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নালে ঠাসা। শুধু বিজ্ঞান নয় – ভারতীয় ও পাশ্চাত্ত্য দর্শনেও ওনার অগাধ জ্ঞান। বিদেশে থাকতেই বিজ্ঞান ও দর্শনের ওপর একটা বই লিখেছিলেন – ‘আই অ্যাম ইনফিনিটি’ – নিউ ইয়র্কের এক নামকরা প্রকাশনা সংস্থা রেডিয়াম হাউস এটি প্রকাশ করে। এক সময়ে বইটি বেস্ট সেলার ছিল। আমাকে এক কপি উপহার দিয়েছিলেন। পড়েছিলাম – ভাল বুঝতে পারি নি। এখন আর একটা বই লিখছেন – ‘ফ্রম সিঙ্গুলারিটি টু ইনফিনিটি’। রেডিয়াম হাউসই প্রকাশ করবে।    

     আমরা স্টাডি রুমেই বসলাম। বয়স্ক সহকারী ধরণীকে ডেকে জলখাবার আর কফি স্টাডিতেই দিতে বললেন – স্যার আবার চাকর বলাটা পছন্দ করেন না।  আমি বললাম – “আচ্ছা স্যার এই যে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে কত কোটি কোটি তারা রয়েছে – তাদেরও তো আমাদের পৃথিবীর মতন গ্রহ থাকা স্বাভাবিক আর সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব নিশ্চয়ই আছে এমনকি আমাদের মতন বা আমদের থেকেও উন্নত সভ্যতা বিরাজ করতে পারে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত অন্য গ্রহে কোনও রকম প্রাণ থাকার আভাষটুকুও পাওয়া গেল না। বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজারের ওপর অসৌর গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন। তাদের মধ্যেও কি কোন প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায় নি? তা হলে কি ধরে নিতে হবে শুধুমাত্র পৃথিবীতেই প্রাণ আছে?”  

     ইতিমধ্যে কফি আর স্যান্ডউইচ এসে গেছে। স্যার আমাকে একটা প্লেট হাতে ধরিয়ে নিজেরটা নিলেন। খেতে খেতেই আলোচনা চলতে লাগল। স্যার বললেন – “তুমি যে প্রশ্নটা করলে অর্থাৎ ভিনগ্রহে প্রাণ থাকার প্রবল সম্ভাবনা অথচ কোনরকম প্রমাণের একান্ত অভাবের এই আপাত বিরোধীতাকে বলা হয়ে থাকে ‘ফের্মি প্যারাডক্স’। ফের্মির নাম তো জান – নোবেল পুরস্কার পাওয়া বিখ্যাত ইটালিয়ান বৈজ্ঞানিক এনরিকো ফের্মি, যিনি অ্যাটমিক রিএক্টরের উদ্ভাবক। যদিও এই প্যারাডক্স ফের্মির নাম দিয়ে চালানো হয়, ফের্মি নিজে কিন্তু এরকম ভাবে কোন মন্তব্য করেননি বা গবেষণাও করেননি। আসল ঘটনাটা তোমায় বলি, এটা জানা দরকার। ১৯৫০ সালের মে মাসের কথা, ফের্মি তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বছরে কয়েক সপ্তাহের জন্য তাঁর প্রাক্তন কর্মস্থল লস অ্যালামস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে পরামর্শদাতা রূপে আসতেন। একদিন দুপুরে তাঁর তিন সহকর্মী এমিল কোনোপিনস্কি, এডোয়ার্ড টেলার আর হার্বার্ট ইয়র্কের সাথে ফুলার লজ নামে একটা বাড়িতে লাঞ্চে যাবার পথে ‘দা নিউ ইয়র্কার’ ম্যাগাজিনের কার্টুনিস্ট অ্যালান ডনের আঁকা একটা কার্টুন নিয়ে কথা বলছিলেন। কার্টুনটা ছিল এক দল ভিনগ্রহী ইউফো থেকে নেমে এসে নিউ ইয়র্কের রাস্তা থেকে ডাস্টবিনগুলো চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।     

     এইসময়ে তাঁদের মধ্যে খুবই সাধারণভাবে মহাকাশ ভ্রমণ, ভিনগ্রহী ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তারপরে অবশ্য আলোচনার প্রসঙ্গ পালটে যায়। খাবার টেবিলে ফের্মি হঠাৎ দুম করে প্রশ্ন করেন – “Where is everybody?” উপস্থিত সকলে হেসে ওঠেন ও ধরে নেন যে ফের্মি ভিনগ্রহীদের কথা বলছেন। পরবর্তীকালে ফের্মির এই ধারণাটা ফের্মি প্যারাডক্স রূপে খ্যাত হয়। এর মূল বক্তব্যটা আমি তোমাকে একটু বলি।       

     আমাদের মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মধ্যে কোটি কোটি পৃথিবীর মতন বাসযোগ্য গ্রহ থাকতেই পারে। দেখ আমাদের এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই খুব কম করে হলেও দশ হাজার কোটি তারা আছে। তুমি যদি একটুও না থেমে মিনিটে একশ করে গুণে যাও তোমার সময় লাগবে এক হাজার নয়শ দুই বছর ছয় মাস। কাজেই বুঝতে পারছ সংখ্যাটা কত বড়। তাদের কম করে গড়ে যদি একটা করেও গ্রহ থাকে তা হলেও দশ হাজার কোটি গ্রহ আছে। এদের এক শতাংশ আমাদের পৃথিবীর মতন গ্রহ হয় তবে তার সংখ্যা একশ কোটি। এদের মধ্যে ধরে নেওয়া যাক এক শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি গ্রহে প্রাণ আছে। তারও এক শতাংশে যদি আমাদের মতন বুদ্ধিমান জীবন ও প্রযুক্তিগত সভ্যতা বা তার থেকেও উন্নত সভ্যতা থেকে থাকে তো তার সংখ্যাও এক লক্ষ। তাদের মধ্যে কেউ না কেউ অতি দূরপাল্লার আন্তর্তারকা ভ্রমণের উপায় আবিষ্কার করবে ও কাছাকাছি কোন তারার বাসযোগ্য গ্রহে উপনিবেশ স্থাপন করবে। কালক্রমে এই ঔপনিবেশিকরা অন্যান্য গ্রহে তাদের নিজস্ব উপনিবেশ স্থাপন করার জন্য অভিযান করবে এবং ছায়াপথের প্রতিটি বাসযোগ্য গ্রহেতে না পৌঁছানো পর্যন্ত প্রক্রিয়া ক্রমাগত চলতে থাকবে। এই প্রক্রিয়ায় যদি কয়েক কোটি বছরও লাগে অসুবিধা নেই কারণ আমাদের গ্যালাক্সির প্রায় তেরশ কোটি বছর বয়সের তুলনায় এই সময়টা কিছুই নয়। এ রকম যদি ঘটে থাকে তবে আমাদের পৃথিবীতে ইতিমধ্যেই এক বা একাধিক ভিনগ্রহীর পদার্পণ হতোই এবং তার প্রমাণও যথেষ্ট পাওয়া যেত। আজ পর্য্যন্ত যখন সে রকম কোন প্রমাণই আমরা পাইনি তা হলে কি আমাদের একমাত্র পৃথিবী ছাড়া এই গ্যালাক্সিতে আর কোথাও কোন রকম বুদ্ধিমান জীব নেই?      

      এই তত্ত্বটাকে ফের্মি প্যারাডক্স বলে চালান হলেও, না ফের্মি এটার অবতারণা করেছেন, না এটা একটা প্যারাডক্স। আসলে এর প্রবক্তা ছিলেন আমেরিকার কলোরাডোর ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফিয়ারিক রিসার্চের জনৈক জ্যোতির্বিদ মাইকেল হার্ট। তিনি ১৯৭৫ সালে নানারকম যুক্তির জাল বিস্তার করে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে পৃথিবীতে মানুষ যেমন বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে উপনিবেশ স্থাপন করেছে সে রকম বহির্বিশ্বে কোথাও বুদ্ধিমান সত্ত্বা থাকলে তারা এতদিনে সমস্ত গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে পড়ত এবং আমাদের পৃথিবীতেও আসতো। যেহেতু তারা কেউ আমাদের পৃথিবীতে কোনদিন আসে নি সেই হেতু পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও তাদের অস্তিত্ব নেই। তাঁর গবেষণাপত্রটি পড়লে তাঁর যুক্তিগুলো খুব একটা সবল গ্রহণযোগ্য বলে আমার অন্তত মনে হয় না। আমাদের পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও কোন উন্নত বুদ্ধিমান প্রাণের অস্তিত্ব নেই – এই সিদ্ধান্তের সাথে হার্ট আরও দুটি অনুসিদ্ধান্ত করেন। প্রথমটি এই যে ব্যাপকভাবে ভিনগ্রহীদের অনুসন্ধান চালান হচ্ছে এটা নিছক সময় ও বিপুল অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। আর দ্বিতীয় সুদূর ভবিষ্যতে একমাত্র আমাদের পৃথিবীর সংস্কৃতির পরম্পরাই গ্যালাক্সির সমস্ত বাসযোগ্য গ্রহে ছড়িয়ে পড়বে। ১৯৮০ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক টিপলার আরও জোরাল যুক্তি দিয়ে হার্টের বক্তব্যকে সমর্থন করেন। মজার কথা হচ্ছে হার্ট তার প্রবন্ধে কোথাও ফের্মির নাম উল্লেখ করেন নি। অপার্থিব মেধা নিয়ে ফের্মির ওই সেদিনের এক লাইনের কথা ছাড়া আর কোথাও কোনও বক্তব্য বা রচনা পাওয়া যায় নি। ১৯৬৩ সালে কার্ল সাগানের একটি প্রবন্ধের পাদটিকায় শুধু ফের্মির এই এক লাইনের কথাটার উল্লেখ আছে। ভিনগ্রহীদের অস্তিত্ব ও তাদের সাথে যোগাযোগের বিষয়ে গত অর্ধশতাব্দীতে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে কার্ল সাগানের নাম এক নম্বরে থাকবে। টিপলার ধরেই নিয়েছিলেন ফের্মির মতন প্রথম সারির বিজ্ঞানীও ভিনগ্রহীদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। সে সময়ে অর্থাৎ ষাট-সত্তর-আশীর দশকে একদিকে যেমন কার্ল সাগান, জিল টার্টার, ফ্রাঙ্ক ড্রেক, চার্লস টাউনস, ফিলিপ মরিসন, জিউসেপি ককোনি জোর কদমে অপার্থিব মেধার সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন অপরদিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল হার্ট ও ফ্রাঙ্ক টিপলার এবং জর্জ সিম্পসনের মতন বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানীদের বক্তব্য ছিল একমাত্র পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। টিপলার এর সাথে ফের্মির মতন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর নামটা জুড়ে দল ভারী করে নিলেন। অ্যামেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মহাকাশ সংক্রান্ত গবেষণার প্রধান সংস্থা ন্যাশনাল এরোনটিকস এন্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেসন বা নাসা। ভিনগ্রহী অনুসন্ধানের গবেষণার জন্য নাসার প্রকল্প ছিল SETI বা Search for Extra-terrestrial Intelligence। বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সময় ব্যায় করেও কিন্তু কুড়ি বছরেও কোন রকম অপার্থিব মেধার সংকেত পাওয়া গেল না। ১৯৮১ সালে উইসকনসিনের ডেমোক্র্যাট সিনেটর উইলিয়াম প্রক্সমাইয়ার টিপলারদের মত সমর্থন করে এই অবাস্তব প্রকল্পের জন্য জনগণের প্রদত্ত করের টাকার অপচয় হচ্ছে বলে শেষ পর্য্যন্ত নাসার SETI প্রকল্পটি বন্ধ করান। পরে ১৯৮৩ সালে আবার কার্ল সাগানের উদ্যোগে SETI প্রকল্প নতুন করে শুরু হয় কিন্তু ফলাফলের ব্যর্থতা, নানাজনের বিরূপ মন্তব্য ও বিশেষতঃ নেভাডার  ডেমোক্র্যাট সিনেটর রিচার্ড ব্রায়ানের উদ্যোগে নাসার এই অপার্থিব মেধা সন্ধানের প্রকল্পটি একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়।  

     ১৯৫৪ সালে ক্যান্সার রোগে ফের্মির মৃত্যু হয়। এর প্রায় তিরিশ বছর পরে লস অ্যালামস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী এরিক জোনস ফের্মি সেদিন ঠিক কি বলেছিলেন তার অনুসন্ধান করার প্রচেষ্টা করেন। ফের্মির সেদিনের তিন আলোচনা সঙ্গী এমিল কোনোপিনস্কি, এডোয়ার্ড টেলার আর হার্বার্ট ইয়র্ক তখনও জীবিত। জোনস তাঁদের কাছে ইমেইল পাঠিয়ে জানতে চান ফের্মি তাঁদের সাথে এ বিষয়ে কি আলোচনা করেছিলেন। তিন জনই তাঁদের স্মৃতি থেকে সেদিনের ঘটনার বিবরণ জোনসকে জানিয়েছিলেন।     

     আমেরিকা থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান জার্নাল ‘আস্ট্রোবায়োলজি’ মার্চ ২০১৫ সংখ্যায় তথ্য বিশ্লেষক, লেখক ও জ্যোতির্বিদ রবার্ট গ্রে ফের্মি প্যারাডক্সের ওপর একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এরিক জোনসের রিপোর্ট ও এই বিষয়ের ওপর প্রকাশিত তৎকালীন বিবিধ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছিল তাঁর আলোচনার ভিত্তি। ‘ফের্মি প্যারাডক্স’ কথাটি প্রথম ব্যাবহার করেন ডি জি স্টিভেনসন ১৯৭৭ সালে তাঁর ব্রিটিশ ইন্টারপ্ল্যানেটরি সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে অর্থাৎ ফের্মি মারা যাবার তেইশ বছর পরে। আসলে এই তত্ত্বটি যিনি প্রথম বিশদ ভাবে আলোচনা করেন তিনি বিজ্ঞানী মাইকেল হার্ট – রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির জার্নালে ১৯৭৫ সালে। কার্ল সাগান তাঁর এক গবেষণা পত্রের পাদটিকায় ফের্মির প্রশ্নটিকে “Where are They?” বলে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে ফের্মির প্রশ্নটি অধিকাংশ লোকে “Where are They?” বলে জানে। এই ফের্মি প্যারাডক্সকে বিষয় করে অনেক সেমিনার, কনফারেন্সও হয়েছে।  

     এমিল কোনোপিনস্কি, এডোয়ার্ড টেলার আর হার্বার্ট ইয়র্ক তাঁদের স্মৃতি থেকে সেদিন কি আলোচনা হয়েছিল তা এরিক জোনসকে ইমেইলে জানিয়েছিলেন যার প্রতিলিপি জোনস তাঁর রিপোর্টে দাখিল করেছিলেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে যে ফের্মি কথাটা বলেছিলেন – “Where is everybody” এবং তিনজনেই সেটা উল্লেখ করেছেন। তিনজনের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে ফের্মি কখনোই ভিনগ্রহীদের অস্তিত্বে সন্দেহ প্রকাশ করেন নি। তিনি বরং আলোচনা করেছিলেন আন্তর্তারকা ভ্রমণের সম্ভাব্যতা নিয়ে। এডোয়ার্ড টেলার যাঁকে ‘ফাদার অফ হাইড্রোজেন বম্ব’ বলা হয় – তিনি বলেছিলেন যে আলোচনাটা মূলতঃ হয়েছিল মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে। ফের্মি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন –“টেলার, তুমি কি মনে কর? আগামী দশ বছরের মধ্যে কোন বস্তুর আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে যাবার সম্ভাবনা কতটা?” টেলার বলেছিলেন সম্ভাবনাটা দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। আলোচনাটা হাল্কা চালেই হয়েছিল – এ কথা সে কথার মাঝখানে ফের্মি হঠাৎ দুম করে বলে বসেন – “Where is everybody?” ফের্মির বলার আকস্মিকতায় সকলে হেসে উঠেছিল এবং এটা সবাই ধরে নিয়েছিল যে ফের্মি ভিনগ্রহীদের সম্বন্ধেই কথাটা বলেছেন।   

     হার্বার্ট ইয়র্ক জানিয়েছিলেন যে ফের্মি এর পরে কিছু সম্ভাব্যতার হিসেব করতে থাকেন যেমন আমাদের পৃথিবীর মতন কত গ্রহ থাকতে পারে, তাদের মধ্যে কতগুলিতে প্রাণ এবং কতগুলিতে মানব থাকা সম্ভব, তাদের মধ্যে আবার কতগুলিতে উন্নত প্রযুক্তিগত সভ্যতা থাকতে পারে ইত্যাদি। গণনার ভিত্তিতে তিনি বলেছিলেন যে – ইতিমধ্যেই ভিনগ্রহীদের পৃথিবীতে আসা উচিৎ ছিল এবং তাও অনেকবার। কিন্তু এ পর্য্যন্ত কোন ভিনগ্রহীর পৃথিবীতে না আসার কারণ, আন্তর্তারকা মহাকাশভ্রমণ সম্ভব নয়। যদি সম্ভব হয়ও তারাদের মধ্যে দূরত্ব এতটাই বেশী যে সে প্রচেষ্টা করা অর্থহীন। অথবা কোন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক সভ্যতা এ জাতীয় ঘটনা ঘটানোর মতন তত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এমিল কোনোপিনস্কি জানিয়েছিলেন যে উনি যখন পার্টিতে যোগদান করেন তখন ফ্লাইং সসার নিয়ে কথা হচ্ছিল এবং উনি এই প্রসঙ্গে দা নিউ ইয়র্কার কাগজের কার্টুনটার কথা তুলেছিলেন। সেখান থেকে আলোচনাটা ওঠে যে ফ্লাইং সসারের গতি আলোর গতি থেকে বেশী করা সম্ভব কি না”।  

     আমি বললাম – “স্যার তা’ হলে তো দেখা যাচ্ছে যে পরবর্তীকালে ‘ফের্মি প্যারাডক্স’ বলে যে তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠা পেল তা’ ফের্মির আসল বক্তব্যের সাথে মিলছে না”।

     প্রফেসর ভট্ট বললেন – “সেটাই তো তোমাকে বলতে চাইছি, কোথাও ফের্মি বলেননি যে ভিনগ্রহীদের কোন অস্তিত্ব নেই। ফের্মির আসল বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করে তাঁর নাম দিয়ে দিব্যি একটা তত্ত্ব চালান হ’ল। বরং এটার নাম হওয়া উচিৎ ছিল ‘হার্ট-টিপলার যুক্তি’ যেখানে তারা স্পষ্টভাবে বলেছেন যে পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও মানুষের মতন বুদ্ধিমান প্রাণী নেই। কাজেই সেখানে প্যারাডক্স কথাটা কোথা থেকে আসছে? জানি না এর পেছনে কোন রাজনীতির খেলা চলেছিল কি না। হার্ট বা টিপলারের থেকে ফের্মির বক্তব্যের গুরুত্ব অনেক বেশী। তাই ফের্মির নামে এই তত্ত্বটি চালনোর ফলে সিনেটর প্রক্সমাইয়ার ও সিনেটর ব্রায়ানের পক্ষে সুবিধাই হয়েছিল নাসার উদ্যোগ ও অর্থানুকূল্যে SETI প্রকল্পটিকে কবরে পাঠানোর। তাই তোমাকে প্রথমেই আমি বলেছি এই যাকে ‘ফের্মি প্যারাডক্স’ বলে এত হৈচৈ করা হয়ে থাকে তা’ আসলে, না ফের্মির, না কোনও প্যারাডক্স।   

     এই প্রসঙ্গে অবশ্য আরও একজনের কথা বলতে হয়। তিনি বিখ্যাত রাশিয়ান রকেট বিজ্ঞানী ও অ্যাস্ট্রোনটিক তত্ত্বের অগ্রদূত কন্সটান্টিন সিওলকোভস্কি। ১৯৩০ সালে তিনি এই ধরণের এক প্যারাডক্সের কথা বলেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন – মহাকাশ ভ্রমণ সম্ভব ও অন্যান্য তারাদের গ্রহে নিশ্চয়ই প্রাণের অস্তিত্ব আছে। তবে আপাতবিরোধ হিসাবে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে অপার্থিব মেধাবী জীবন যদি সত্যিই থাকে তবে তারা এতদিনে নিশ্চয়ই পৃথিবী ভ্রমণে আসত অথবা তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোন না কোন রকম সংকেত পাঠাত। এই অসঙ্গতির সমাধান হিসাবে তিনি বলেছিলেন যে ভিনগ্রহীদের আসার সময় এখনই ফুরিয়ে যায়নি আর যদি কোন সংকেত তারা পাঠিয়েও থাকে আমাদের বর্তমান যান্ত্রিক পদ্ধতি তাকে গ্রহণ করার পক্ষে খুব দুর্বল। সিওলকোভস্কির দ্বিতীয় যুক্তিটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তিনি এ কথা বলেছিলেন ১৯৩০ সালে কিন্তু আমাদের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের সিগন্যাল প্রেরণ বা গ্রহন পদ্ধতির প্রভূত উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও আজও এই ২০১৭ সালে আমরা কোন ভিনগ্রহীদের পাঠান কোন সংকেত এখনও ধরতে পারিনি। তার অবশ্যই অনেক কারণ আছে”।  

     আমি বললাম – “আচ্ছা স্যার মেনে নিলাম ভিনগ্রহীদের থাকা সম্ভব। কিন্তু এই আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই তো প্রায় কমপক্ষে দশ হাজার কোটি তারা আছে। কিন্তু এর মধ্যে কোন তারার গ্রহে আমাদের মতন মানুষ আছে তা কি করেই বা বুঝব আর কিভাবেই বা তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারব – এ সম্বন্ধে খুব জানতে ইচ্ছে করে”।

     স্যার বললেন – “বেশ তো – এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। তবে আজ নয় – আমি কয়েকদিন একটু ব্যস্ত থাকব। আবার পুনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা থিসিস পাঠিয়েছে। ওটাও দেখে রিপোর্ট পাঠাতে হবে। তুমি সামনের রবিবার এসো। তখন এ নিয়ে অনেক কথা বলা যাবে”। 

[ক্রমশ]

Tags: অন্তর্জাল, অপার্থিব মেধার সন্ধানে, দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, প্রবন্ধ, ফের্মি প্যারাডক্স, সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!