২০৩০ : স্বগতোক্তি
লেখক: রনিন
শিল্পী: সূর্যোদয় দে
ঠকাং… ঠক… ঠকাং… ঠক… ঠকাং…
একটা আশ্চর্য ছন্দ ওই শব্দে। ভয়ানক বিরক্তিকর এবং একঘেয়ে সুর। যেন কোনও বিপদের পূর্বাভাস।
ওরা এসে গেছে। এখানেও। আমার পিছু নিয়ে, আমাকে তাড়া করে। ওদের ধাতব পদশব্দ বলছে ওরা আমায় ছাড়বে না সহজে। প্রতিমুহূর্তে আমার ঘরে ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। কিন্তু উপায়?
আচ্ছা, একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিই ঠিক কতদূরে আছে ওরা; সংখ্যায় কতজন? কী দরকার! মাথাটা বার করলেই যদি ওরা গুলি ছোঁড়ে? ওদের কাছে কি বন্দুক আছে? থাকতেই পারে অবশ্য। ওরা কি আমাকে এখানে লুকোতে দেখেছে নাকি অন্ধকারে এলোমেলো খুঁজে মরছে? যাই হোক না কেন, এই দেওয়ালের আড়াল ছেড়ে এখুনি পালতে হবে। ওদের থেকে অনেক দূরে।
এ কী? হঠাৎ সবকিছু এমন শান্ত হয়ে পড়লো কেন? তবে কি ওরা হাল ছেড়ে দিয়েছে? তবে কি ওরা শেষ অব্ধি আমাকে না পেয়ে খালি হাতেই চলে গেছে?
‘অনুপ্রবেশকারীকে খুঁজে বার করো, এখুনি!-’
না, যায়নি! খানিক দূরেই পরিষ্কার বাংলায় ওদের বেতার নির্দেশ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
হ্যাঁ, বাংলায়। মানে পরিবেশ পরিস্থিতির বাহ্যিক পরিবর্তন হলেও আমি এখনও বাংলার মাটিতেই দাঁড়িয়ে আছি। জায়গাটা তাহলে….কি জানি!
তবে যেটুকু বুঝতে পারছি , আমি এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে দাঁড়িয়ে নেই। মাত্র ত্রিশ বছর বারো মাস বারো দিন বাইশ ঘণ্টা এগারো মিনিট তেরো সেকেন্ড… চোদ্দ সেকেন্ড… পনেরো সেকেন্ড…
‘সময় বহিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়…’ দাদুর বলা কথাটা হঠাৎ মাথায় এল কেন?
চারিদিকে এতটা নৈঃশব্দ্যই বা কেন? যদি পাহারাওয়ালাদের নজর এড়িয়ে ভাঙা দেওয়াল পেরিয়ে সামনের বারান্দায় পৌঁছতে পারি একবার …
মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখেই নিই ওদের অবস্থান।
‘কন্ট্রোল-রুম… অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়েছে… পরবর্তী নির্দেশ- ’
এক মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময়, হৃৎপিণ্ডের গতি যেন থেমে গেল হঠাৎ। শয়তানটা দাঁড়িয়ে আছে একদম আমার গা ঘেঁষে, শীতল প্রাণহীন নীল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে শিকারের দিকে। ওর মুখের ধাতব পেশিগুলো এই অন্ধকারেও চক চক করছে রীতিমত। নর-করোটির বীভৎসতা ওর দুচোখে।
‘পালাও-!’ মাথা থেকে নির্দেশ ছড়িয়ে পড়ল আমার শিরা-উপশিরায় রক্তের গতি বাড়িয়ে। পালাতেই হবে, আমার মস্তিষ্ক থেকে স্নায়ুকোষ বেয়ে নির্দেশ এল পায়ের পেশিতে। সবকিছু ভুলে অন্ধকার জানালার মধ্যে দিয়ে ভাসিয়ে দিলাম শরীর, ‘কটাস!’ যন্ত্রমানবের হাত মুঠো বন্ধ করার শব্দটা আমার কান এড়ায়নি তার মধ্যেও।
হাওয়ায় শরীর ভাসছে। ভাসাই উচিৎ কারণ পরিত্যক্ত বহুতল বাড়ির কোনও এক তলার ভাঙা জানালা থেকে ঝাঁপ মারলে শরীরটা নিচে মাটিতে আছড়ে পড়বেই। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জোরে। মৃত্যুও হবে। সেটা একদমই কাম্য নয়। তাই একটা অবলম্বন দরকার। এখুনি। এই মুহূর্তে।
পেয়েছি!
দড়ি? না, তার। অব্যবহৃত তার। মাকড়সার জালের মত এখানে ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছে তারগুলো। আমার শরীরের ভারে সেটা আবার ছিঁড়ে গেছে, ছিন্নপ্রান্ত হাতের মুঠোয় ধরে অপেক্ষা করছি মাটিতে আছাড় খাবার জন্য। না খেলাম না, মাটি থেকে মাত্র একহাত উপরে থেমে গেল আমার শরীর।
যাক খুব বাঁচান বেঁচেছি এই যাত্রায়। কিন্তু দড়ির প্রান্ত ধরে প্রবল গতিতে আমার শরীর এগিয়ে যাচ্ছে কংক্রিটের দেওয়াল লক্ষ করে। আমি দুহাত দিয়ে মাথাটাকে ঢাকার চেষ্টা করতেই হাত ফসকে গেল। ধাক্কাটাও এড়াতে পারলাম না, ছিটকে পড়লাম পথের ধারে। পা দুটো কাঁপছে উত্তেজনায়, তাই উঠে দাঁড়াতে গিয়েও টাল খেলাম।
বেঁচে গেলাম এ যাত্রায়। খুব জোর পালিয়েছি ‘ওদের’ হাত থেকে। নিজের পিঠ নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।
‘পলাতক আমাদের সামনে-’
এ কি? একজন নয়, দু-জন নয়, একসঙ্গে অনেকগুলো যন্ত্রমানুষ আমার দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। ও, ওরা তাহলে সত্যিই সশস্ত্র!
‘পালাও!-’ আবার নির্দেশ পাঠাচ্ছে আমার মগজের কন্ট্রোল-রুম। কিন্তু কোথায়? মগজ নিরুত্তর। ‘বাড়িতে ফিরতে হবে, মা-র ঘুম থেকে ওঠার আগে-’ মস্তিষ্ক যখন নিরুত্তর তখন তার হয়ে উত্তর দিল মন। মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখটা কেমন জ্বলছে?
মগজ এবার সজাগ হয়ে উঠেছে। ‘নর্দমা-’ পথের ধারে সমান্তরালভাবে এগিয়ে যাওয়া অন্ধকার খোঁদল আবিষ্কার করে মস্তিষ্ক নির্দেশ দেয় আমায়।
নর্দমা? পুতিগন্ধময়, ময়লা নর্দমা? মন বিদ্রোহ করে উঠলেও ওদের বন্দুকগুলোকে অগ্রাহ্য করে সেদিকেই ঝাঁপ মারি চোখ নাক বন্ধ করে।
‘পালিয়েছে…’ ওদের শেষ কথাগুলো আর শোনা হল না।
‘ঝপাস’ করে একটা শব্দ হবে আর তার পরেই আমি ডুবে যাব কালো কাদার পাঁকে। সেরকমই ভেবেছিলাম প্রথমে। কিন্তু সেটা হল না। তার বদলে খটখটে শুকনো কংক্রিটের মেঝেতে ডান হাঁটু ঠুকে যেতেই যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলাম। হাড় ভাঙল নাকি? হাঁটুর ধারটা কেমন জানি ভেজা ভেজা লাগছে। রক্ত? ঝরুক। যে করেই হোক দৌড় জারি রাখতে হবে, দাঁড়ানো চলবে না। কোনদিকে যাচ্ছি? কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
শ্বাসপ্রশ্বাসে এত কষ্ট কেন? এত ঘামছিই বা কেন? কী আশ্চর্য, এইটুকু সময়ে কম ধকল গেল নাকি? ঘামাটা স্বাভাবিক। কিন্তু বাতাসের ভারী ভাবটা? সে তো স্বাভাবিক নয়?
ওসব না ভেবে মাথা নিচু করে দৌড়োতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘কাজ’ সেরে ঘড়ির কাছে পৌঁছতে হবে। ঘড়ি, যার আসল নাম, ‘আই সি’। ইন্টার-রিভার্স ক্রোনোমিটার। দাদুর জীবনের একমাত্র ‘মাস্টার পিস’। মৃত্যুর আগে গোপনে আমার হাতে দিয়ে গেছিলেন তাঁর সবথেকে দামি উপহার। ব্যবহারের উপায় জানিয়ে বলেছিলেন, ‘সামলে রাখিস কিন্তু, ওর মধ্যে আমার সব অস্তিত্ব লুকিয়ে আছে-’, দাদুর হাসিমাখা ম্লান মুখখানা আবার কেন স্মৃতি ভেসে আসছে!
কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুতেই মনে পড়ছে না ঘড়িটা পড়ল কোথায়? নিশ্চয় চামড়ার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গিয়েছিল আমার হঠাৎ পতনে। যদি ওটা না পাওয়া যায়? ঘড়ি ছাড়া তো ঘরে ফিরতে পারবো না! পরের ব্যাপার পরে দেখা যাবে। এখন ভাবি, এই পরিত্যক্ত অন্ধকার পথে কোথায় চলেছি আমি? মাটির আরও গভীরে? যন্ত্র-মানুষ গুলো কোথায় গেল? ওদের পায়ের শব্দ তো আর পাচ্ছি না! হয়তো এখনও ওরা আমাকে অনুসরণ করছে, শুধু আমিই ওদের দেখতে পাচ্ছি না? একটু থামা দরকার। একটু বাতাস দরকার। ফুসফুস দু-টো কাদায় ওঠা মাছের মত খাবি খাচ্ছে, জিভ শুকিয়ে কাঠ। একটু বিশ্রাম দরকার। কিন্তু থামলেই যদি ওরা আমার ঘাড় মটকে দেয়? আর পারছি না যে!
এটা তো ডিসেম্বর মাস, তাই না? ডিসেম্বর মাসে ঠাণ্ডা পড়ে শহর জুড়ে। সকাল বেলায় হালকা সাদা কুয়াশার চাদর থাকে, রাতে আলতো কনকনানি। ঘুমের সময় লেপের ওম। বছর ভর গরমের দুরাচার সহ্য করার পর একটুখানি ঠাণ্ডার পরশ। সেটাই তো হওয়া উচিৎ। তার বদলে এমন থমকে যাওয়া বাতাস, দমবন্ধ করা এমন ভ্যাপসা গরম? ত্রিশ বছরের পরে ঋতুবদলের নিয়ম পাল্টাতে পারে কিন্তু এতটা?
খিদে পাচ্ছে। কী যে করি!
শেলী ঠাট্টা করে বলে আমার নাকি ‘রাক্ষুসে’ খিদে। মা বলে ‘ও সবার থেকে ‘একটু’ বেশি খায় -’, তাও বেশ গর্বের সঙ্গে। সে যাই হোক, আমার খিদে পাচ্ছে। আর সেটাই এখন আমার একমাত্র অনুভূতি। আচ্ছা, ফ্রিজে তো ফ্রাইড মোমো রাখা আছে, তাই না? সেটা খেতে গেলে এই মুহূর্তে দুটো বাধা আছে। এক, শোয়ার ঘর থেকে বসার ঘর অব্ধি শুধু যেতেই হবে না, তারপর মাইক্রোওয়েভে সেটা গরম করতে হবে। দুই, আমাকে ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে ঠিক ত্রিশ বছর বারো মাস বারো দিন আগে পৌঁছতে হবে। প্রথম বাধা পেরোতে গেলে আলসেমি কাটাতে হবে, দ্বিতীয়টা পেরোতে গেলে ঘড়িটাকে খুঁজে পেতে হবে। না পেলে কি হতে পারে? জানি না। তবে সব কটা সম্ভাবনাই বেশ ক্ষতিকর এবং ভয়াবহ। সব থেকে ভয়াবহ মা-কে হারানো, সেই সঙ্গে হারিয়ে যাবে শেলী, বাপন, ঘুঘু, পুতুল আরও সবাই। হারিয়ে যাবে শহরটা। হারিয়ে যাবে আমার অস্তিত্বটাই।
‘দাঁড়িয়ে থেকো না-‘ মন আর মগজ একসঙ্গে যেন চিৎকার করে উঠলো। আবার দৌড় শুরু। কোনদিকে চলেছি জানি না, কিন্তু থামা চলবে না। বাতাসে এমন ধুলো জমা ঝাঁজ কেন সেটাও জানি না, তবুও ছুটে চলতে হবে। আলোর রেখা না? আরে! মিটমিটে বাল্বের আলোয় দেখা যাচ্ছে লোহার সমান্তরাল ট্র্যাক! মাটির নিচে! পাতাল রেল! এই মেট্রো রেলে চেপেই তো প্রতিদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরি! এটা কোন স্টেশন? মাটির ওপরে পৌঁছনোর পথটা পেলে…শব্দ হল কি কোনও?
ক্ষীণ আলোর আভাস আসছে ডান দিক থেকে, নিশ্চয় ওদিকেই পথ। দেওয়ালে টিম টিম করে জ্বলছে আরেকটা বাল্ব। উফ। সিঁড়ির ধাপ দেখতে পাইনি, আবার লাগলো পায়ে। রক্ত বেরোচ্ছে কি? বেরোক, একবার ঘড়িটা খুঁজে পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা, যন্ত্র-পুলিশ গুলো কোথায়? ওরা তাড়া করছে না কেন? না কি করছে?
উফ, মুক্তি! হা করা অন্ধকার গহ্বরের মুখ চুইয়ে বাইরের তরল অন্ধকার দেখা যাচ্ছে। ওই তো আকাশ। যদিও চাঁদের আভাস ঘন ধোঁয়ায় ঢাকা। তার আড়াল থেকে নীলচে আলোর ঝলকানি। ওই তো আরেকটা চমক। আরেকটা ঝলক আকাশের অন্য কোনে। মেঘ জমেছে? মেঘের রং কি ওরকম ধূসর ধোঁয়ার মত?
আমাদের বিয়াল্লিশ-তলা ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকেও চাঁদ দেখা যায়, মানে যেত। গোল থালার মত ঝকঝকে চাঁদ।
‘পৃথিবীটা বড্ড সুন্দর রে,’ গলায় আবেশ ঝরে পড়ছিল দাদুর। রাধানগর বিচে নীল জলের মধ্যে খেলতে থাকা লাল হলুদ কমলা মাছগুলোকে দেখতে দেখতে দাদু মায়া জড়ানো গলায় বলেছিল, ‘এই ঢেউয়ের দুনিয়া পেরলেই অতল গভীরে এক অন্য দুনিয়া, নাম না জানা কত রং বেরঙ্গি প্রাণীদের মেলা সেখানে। পাহাড়ে যেমন ফুলের বাগিচায় উড়ে উড়ে বেড়ায় অজস্র প্রজাপতি তেমনি ওদের ছোট্ট ছোট্ট পাখনাতেও আছে মন ভালো করা রঙের বাহার, জঙ্গলে যেমন আছে সবুজের সমারোহ তেমনি জলের তলাতেও নরম সবুজের মাখামাখি-‘ দাদু আমাকে রূপকথার গল্প শোনাতে চাইছিল যেন।
‘ওদের ভবিষ্যৎ, ওদের ভালো মন্দের দায় কিন্তু আমাদের ওপর। বুঝলি?’
না বুঝিনি, তবু মাথা নেড়েছিলাম। ‘ওদের থাকা না থাকাটা আমাদের জন্য খুব দরকারি। তোর জন্য দরকারি। অনাগত সবার জন্য ভীষণ দরকারি। ওদের কথা ভুলিস না। ভুলবি না তো?’ দাদু প্রশ্ন করেছিল, আমিও দুদিকে কলের পুতুলের মত মাথা নাড়িয়েছিলাম। হাতের মুঠোয় প্রজাপতি রঙা মাছগুলোকে ধরতে চেয়েছিলাম।
হাতের মুঠোয় এ কি ধরে ফেললাম? বিছে নাকি? এ কি? প্রাণীটার চোখদুটোর জায়গায় নীল আলো জ্বলছে কেন? হুড়মুড়িয়ে ছুটে পালালো বিছের মত দেখতে প্রাণীটা। কিন্তু পালাবার আগে ছোট্ট কয়েকটা যান্ত্রিক শব্দ করে গেল।
‘চকাস-‘ ফ্ল্যাশ বাল্বের মত ঝলকানি আর সেই সঙ্গে একখানা পরিষ্কার ঘোষণা, ‘পলাতকের ছবি, বর্তমান অবস্থান-পাতাল রেল, সেন্ট্রাল-‘
হে ঈশ্বর!
আরে, ওই তো! ভেঙে পড়া লোহার ডাণ্ডা দুটোর মাথায় কিছু লেখা। সবুজের ওপর সাদায় লেখা অক্ষর। ধুলো ময়লায় ঢাকা, কয়েকটা অক্ষর মুছে গেছে। সে, ল? কি হতে পারে অক্ষরটা? ‘সেন্ট্রাল’? বিছের মত দেখতে প্রাণীটা সেই কথাটাই বললো না? তার মানে সোজা এই পথ ধরে গেলেই মহাত্মা গান্ধী রোড। বাড়ি এবং সেই সঙ্গে ঘড়ি। কিন্তু এ কি অবস্থা! এ কি সত্যিই কলকাতা? বাংলার রাজধানী? দেশের কালচারাল ক্যাপিটাল? মানুষ কোথায়? কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু কি হয়েছে? যুদ্ধ? হতে পারে। অথবা দূষণ? অথবা দুটোই? সবকটা বহুতল ধ্বসে পড়েছে, যেন আধ-খাওয়া বিস্কুটের মত। পরিত্যক্ত, অন্ধকার। বাতাস ভারী, শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। দরদর করে ঘামছি। আরিব্বাস! ওগুলো কি? যেন আলোর রেখা দেখলাম দুটো ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে? ভালো করে দেখতে গেলে বাঁদিকের গলিপথ ধরতে হবে, এদিকে আমি জি রোড কিন্তু বেশি দূরে নেই আর। রিস্ক নেবো একটা? এসেই তো গেছি। এতটা তো ফাটকাই খেললাম, আরেকটুতে ক্ষতি কি? দেখাই যাক না। কিন্তু যদি ধরা পড়ি? ধুস বেশি ভাববো না। ভবিষ্যৎ দেখতেই তো এসেছি। যাক, কেউ দেখতে পায়নি। পথ জনশূন্য যদিও, তবুও যন্ত্র-পুলিশের হাত এড়ানো জরুরি। ওহ, আসলে ওটাই এখনকার ‘এপার্টমেন্ট’? কত তলা হবে? আমরা থাকি বিয়াল্লিশ তলায়, মানে থাকতাম। এতো দূর থেকেও আকাশ ফুঁড়ে বেরোনো কংক্রিটের স্তম্ভ পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, আমাদের এপার্টমেন্ট এর এক তৃতীয়াংশও হবে না উচ্চতায়। খুপরি, অজস্র, অসংখ্য। সেগুলো থেকে উজ্জ্বল আলো দেখা যাচ্ছে। গোটা শহরের মানুষ কি ওখানেই থাকে একসঙ্গে? তাহলে কি ওখানেই আস্তানা নিয়েছি আমি আর মা? আমার বয়েস এখন কত হবে? আঠেরোর সঙ্গে ত্রিশ যোগ করলে দাঁড়াবে, আটচল্লিশ। মায়ের বয়েস? বাষট্টি। আমি তাহলে এখন, কি যেন বলে সবাই? ‘প্রৌঢ়’? আমি, মা, শেলী আমরা সবাই কি এখন ওখানেই ঠাঁই নিয়েছি? আমরা কি সত্যি আছি ওখানে? না কি…..
জানা দরকার। জানতেই তো এসেছি। মেডিকেল এন্ট্রান্সের রেজাল্ট বেরিয়েছিল, মার খুব ইচ্ছে ডাক্তার হই ভবিষ্যতে। ভবিষ্যতে? হাসি পেল, অনিচ্ছাকৃত ভাবে। ভবিষ্যতেই তো দাঁড়িয়ে আছি। মার স্বপ্ন কি সত্যি হয়েছে? খুব ইচ্ছে করছিল এই উত্তরটা খুঁজে দেখতে, তাইতো দাদুর দেওয়া ঘড়িটা হাতে নিয়ে বসেছিলাম। যে ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবাই এতো পরিকল্পনা করে, সেটাই একবার চাক্ষুষ করতে চেয়েছিলাম। অনেকটা ব্যাক ট্র্যাক করে অঙ্ক মেলানোর মত লেগেছিল ব্যাপারটা। কি দেখলাম? ভয়ঙ্কর দৃশ্যপট। আমাদের সবার ভবিষ্যৎ।
‘হাত…… ওপরে …’ সম্পূর্ণ যান্ত্রিক শব্দ।
শোনা আর অবস্থার গুরুত্ব বোঝার মাঝে যে কয়েক ভগ্নাংশ সময়ের ফারাক, তার মধ্যেই পা দুটো সচল হয়ে পড়েছে। রিফ্লেক্স। কি আশ্চর্য, আমি তো এদের কোনও ক্ষতি করিনি। কেন আমাকে তাড়া করছে এভাবে?
হাতে ঘড়ি পরে, ডিজিট গুলোকে ত্রিশ বছর এগিয়ে দিতেই হঠাৎ সব কেমন অন্ধকার হয়ে গেছিলো। তারপরে পতন। এতো জোরে পড়েছিলাম, শরীরের সব যন্ত্রগুলো যেন একসঙ্গে বিদ্রোহ করে উঠেছিল। মাথায় একটা ধাক্কা। যখন মাটিতে উঠে বসলাম তখনি লক্ষ্য করলাম, হাতের ঘড়িটা উধাও। নিশ্চয় স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেছে, ডায়ালটা ঠিক আছে? ঠিক না থাকলে? কথাটা ভাবতেই মেরুদণ্ড বেয়ে শিহরণ নামল। শেলী যখন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ীর মত প্রশ্ন করে, ‘বলত আজকের দিনটা কেন ইম্পরট্যান্ট?’ আমার বেশ ভয় করে, জানি কোনও একটা গুরুত্বপূর্ণ তারিখ ভুলে গেছি বেমালুম। ওর জন্মদিন? না কি আমার নিজের? আমি জানি আমার ভুলে ওর মুখের হাসি মিলিয়ে যাবে হঠাৎ করে। আমাদের বার্তালাপ বন্ধ থাকবে বেশ কয়েকদিন। সেসব কথা ভাবলেই মন জুড়ে অস্বস্তি জেগে ওঠে। শেলীর মুখে লেগে থাকা হাসিটাও খুব দরকারি। তাই আমি ভয় পাই।
ঠিক তেমনি ভয় পেলাম ঘড়িটা হারিয়ে। সবে অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে খুঁজতে যাবো, ঠিক তক্ষুনি এসে দাঁড়ালো যন্ত্র-পুলিশ। ঘিরে ধরল। সেই শুরু, সেই থেকে নিরন্তর পালাচ্ছি।
উফ।
আবার পড়েছি। ফুটপাথের উঁচু স্ল্যাব দেখতে পাইনি। এতো অন্ধকার! কিন্তু কেন?
মনে হচ্ছে জিনসের নিচে হাঁটুর দিকটায় ছড়ে গেছে, কেমন যেন জ্বালা করছে। করুক। একবার নতুন যুগের নতুন মানুষদের আস্তানায় উঁকি মেরেই পালাবো ১৪/১ এম জি রোডে আশাপূর্ণা এপার্টমেন্টের দিকে। যে করেই হোক খুঁজে পেতে হবে ঘড়ির ডায়াল খানা। যদিও শুধু ঘড়ি হাতে পেলেই হবে না… সেই সঙ্গে দরকার…
থাক সেসব এখন, আগের কাজ আগে করে নিই, পরের কাজ নিয়ে ভাববো পরে।
‘হ্যাঁ… শুনতে পাচ্ছি… পরিষ্কার…’ সেই একই বেতার শব্দ। কোথা থেকে আসছে? পাচিলের আড়াল থেকে? যন্ত্র-পুলিশ। ধুস, অন্য পথ খুঁজতে হবে।
‘পালিয়েছে… সবাই খুঁজছে… বাইপেডালরা ওর পিছু নিয়েছে। একখানা হেক্সপড এইমাত্র ছবি পাঠিয়েছে পলাতকের-‘
বাইপেডাল, মানে ওই লোহার খুলি-ওয়ালা দু’পেয়ে যন্ত্র গুলো? আর হেক্সপড, ওই যান্ত্রিক বিছে?
হ্যাঁ পাঁচিলের ঠিক পিছন থেকে আসছে শব্দটা। কেউ আমার ব্যাপারেই কথা বলছে মনে হচ্ছে!
লোকটা আমার দিকে পিছন করে দাঁড়িয়ে আছে। না দাঁড়িয়ে না, বসে আছে। একটা কিছুর ওপর, যার থেকে কয়েকটা ছোট ছোট আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে।
‘ভাঙা বিল্ডিং গুলোর কাছ থেকেই উদয় হয়েছে ছেলেটা… হ্যাঁ ছেলে… মেল… পুরুষ… বয়েস? ষোলো কি কুড়ির মধ্যে… শক্তপোক্ত চেহারার… আশ্চর্য… মুখে মাস্ক নেই… জামাকাপড় বেশ পুরনো… না না পুরনো বলতে ছেঁড়াখোঁড়া নয়… কি বলবো… ওল্ড ফ্যাশনড… প্রায় ষাট সত্তর বছর আগেকার প্যাটার্ন…’
হ্যাঁ, আমার কথাই বলছে। মর্কট! ষাট সত্তর বছর? মাত্র তিরিশ বছর! একটু এগিয়ে যাই। আরেকটু। এটা কি? ‘ডেঞ্জার’ লেখা একটা বোর্ড? সঙ্গে কাঠের ডাণ্ডা। অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগতে পারে।
‘খুঁজছি… পেলেই… আঃ’
আ মোলো যা! মাথায় হেলমেট থাকা সত্ত্বেও যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়লো, মরে গেলো নাকি? ভাগ্যিস বাইকটার স্ট্যান্ড ফেলা ছিল। না হলে সবকিছু নিয়েই পড়তো হুড়মুড়িয়ে। হ্যাঁ, ভদ্রলোক বাইকের ওপর বসে ছিলেন। এখন তিনি মাটিতে ধরাশায়ী। বাইক? অনেকদিন আগে একখানা কনসেপ্ট বাইক দেখেছিলাম। এটা সেরকমই। মাথায় কিছু পরিকল্পনা পাচিলের আড়াল থেকেই ঘনিয়ে উঠছিলো। এই বিকৃত-দর্শন বাহনটা নিয়েই তদন্তে যাওয়া যাক। কিন্তু চালায় কিভাবে? ‘অন্/ অফ’। ওতেই কাজ হবে আশা করি।
বুম!
ভাগ্যিস অভ্যাস বসে ব্রেক চেপে ছিলাম। জন্তুটা যেন নাছোড়বান্দা হয়ে গর্জে উঠলো। উফ, ভুলে গেছি। পুলিশটার কোমরে টর্চের মত কিছু বাঁধা আছে, মাথায় আছে হেলমেট। টর্চটা পরে ঘড়ি খুঁজতে লাগতে পারে, হেলমেটটা আত্মপরিচয় লুকোতে কাজে লাগতে পারে।
এবার আবার অন/ অফ বোতাম।
বুম!
না, এবার আর ব্রেক চাপবো না।
আমি দিশেহারা। ক্লাচ গিয়ার ছাড়া বাইক। পেট্রল নয়, গাড়ি চলে ইলেক্ট্রিসিটি তে। এক্সিলারেটর বাড়ালে গাড়ি কয়েক ভগ্নাংশ সময় নেয় নির্দেশ বুঝতে। পেট্রল ট্যাঙ্কের জায়গায় হলুদ হরফে লেখা, ‘এটম’ তার নিচে লেখা, লিথিয়াম পলিমার। শুধুমাত্র ডান হাতের হ্যান্ডলে ব্রেক। কি গতি! ভাগ্যিস টর্চের সঙ্গে সঙ্গে রাতপ্রহরীর মাথার হেলমেটটা নিয়েছিলাম। হেলমেটের মধ্যে শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছেনা, ইনহেলার গোছের কিছু আছে? হবে হয় তো। উফ কি গতি। উড়ছি নাকি? একটানা যান্ত্রিক শব্দ, কিন্তু খুব মিহি। হেডলাইট নেই। মানে আছে, কিন্তু দুটো নিয়ন আলোর চাকতি। ফাঁকা অন্ধকার রাস্তা। কিন্তু সম্পূর্ণ অন্ধকারও না। এখানে ওখানে ইতিউতি হ্যালোজেন আলো। রাস্তা চড়াই হচ্ছে, বাড়ছে আলোর সংখ্যা। কেন? এবার রাস্তা মসৃণ, খাড়াই। ডিজিটাল সংখ্যা জানান দিচ্ছে, গাড়ির গতি উর্ধ্যমুখী, হলুদ দাগ ছাড়িয়ে লালের দিকে যাচ্ছে সূচক। একশো নব্বুই। সংখ্যাটা দেখতেই এক্সিলারেটর ছেড়ে দিলাম। অজানা ভয়। অভ্যাস। সর্বনাশ। উড়ালপুল হঠাৎ শেষ হয়ে আসছে দ্রুত। শেষ হয়নি। কেউ যেন উপড়ে নিয়েছে বাকিটা। রিফ্লেক্সের দুহাতে চেপে ধরেছি ব্রেক। কি ভয়ানক শব্দ।
গাড়ি টায়ার পিচ ঘষটে এগিয়ে চলেছে। বাইকের সঙ্গে আমিও এগিয়ে চলেছি ভয়ানক পরিণতির দিকে। এগিয়ে যাচ্ছি খামোখা শেষ হয়ে যাওয়া প্রান্তটার দিকে। এখন থেকে পতন মানে মৃত্যু নিশ্চিত।
শব্দ থামল। গাড়িও।
চোখ খুললাম ভয়ে ভয়ে। বুকের মধ্যে চলতে থাকা ধুকপুকানি হেলমেট ছাপিয়ে কানে বাজছে নাকি? ভাগ্যিস ঠিক সময়ে থেমেছি। নিচে অন্তহীন অন্ধকার। সামনে বেশ খানিকটা দূরে সেই আকাশে উঠে যাওয়া আলোকিত মিনার। গায়ে তার ছোট ছোট আলোর খুপরি। কয়েক’শো কিংবা কয়েক হাজার?
মানুষের ঠিকানা। গোটা শহর এখন ওখানেই আশ্রয় নিয়েছে। আচ্ছা, এতখানি পথে কোনও গাছ নজরে পড়লো না? কোনও পার্ক? কিংবা কোনোকিছু সবুজ? সবকিছুই কালো। ঠিক কিরকম কালো? গলা পিচের মত। অন্ধকারও। মিনারের চারপাশে বেশ কিছুটা আলোর রোশনাই। বাকিটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, পরিত্যক্ত। কিছু কিছু বিদঘুটে যান সেখানে ঢুকছে কিংবা বেরোচ্ছে। কয়েকটা ছোট্ট ছোট্ট কপ্টার সেখানে ঘুরপাক খাচ্ছে। ইতস্তত একটা দুটো মানুষের শরীর, তাদের সবার মুখে মাস্ক। মাস্ক থেকে বেরোনো নল পোশাকের অন্তরালে বিলীয়মান। এতো দূর থেকে সেটুকুই শুধু দেখা যাচ্ছে। মানুষের এই যাতায়াত বোঝাচ্ছে আরও এরকম জনপদ আছে কোথাও? দূর থেকে লাউড স্পিকারের ঘোষণাও শোনা যাচ্ছে। খুব অস্পষ্ট।
‘যাত্রীদের জানানো হচ্ছে যে, আবহাওয়া দপ্তর জানাচ্ছে আজ ধুলো-ঝড়ের সম্ভাবনা প্রবল। নিজেদের সুস্থ রাখতে মাস্ক ব্যবহার করুন। মনে রাখবেন, আপনার স্বাস্থ্য আপনার পরিজনদের সম্পদ- ‘
ভবিষ্যৎ? না, এখানে আর থাকার মানে হয়না। ফিরতে হবে। বেশিক্ষণ লাগবে না, আশা করি।
অনেক কষ্টে ভারী যন্ত্রটাকে দু’চাকার ওপর দাঁড় করলাম অবশেষে। এবার কি গাড়িটা চলবে? বোতাম চেপেই দেখি না হয়। আবার শব্দ হল, বুম। গাড়ি চলছে ঢালুর দিকে। ফেলে আসা সেই চার মাথার মোড়। লোকটা নেই। এবার বাঁ দিকে। আবার চার মাথার মোড়। সোজা। আবার বাঁ দিক। ওই তো। আশাপূর্ণা এপার্টমেন্টের ভাঙাচোরা শরীর। ঘড়িটাকে পাওয়া যাবে কাছেই কোথাও। বাইক বন্ধ, যান্ত্রিক মিহি গোঙানি থেমে গেছে। চারিদিক অসম্ভব রকমের শান্ত। গাড়িটাকে ঠেলে অন্ধকারে লুকিয়ে রাখতে হবে। কি ভারিরে বাবা! টর্চ দরকার। ওটা ফেলা যাবে না।
আমি প্রথমবার পড়েছিলাম একখানা ধসে পড়া ফ্ল্যাটের ভাঙা দেওয়ালের ওপর? সেখান থেকে সোজা সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে মাটিতে। একটা ভাঙা কংক্রিটের স্ল্যাব ছিল সেখানে। তার মানে ঘড়ি আছে এখানেই কোথাও। টর্চের আলোয় কি জোর! ফুটপাথের ওপর ধূসর ধুলোর মোটা পরত। কয়েকটা ভাঙাচোরা ইটের টুকরো। তার পাশেই ভেঙে পড়া বারান্দার চাঙড়। ওটা কি? দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া দোকানের শাটার। কেন? কি ঘটেছিল? এই তো। ঘড়ির একটা ছেঁড়া স্ট্র্যাপ। কিন্তু ডায়াল? আছে নিশ্চয় এখানেই কোথাও আছে। আবার বুকের ধুকপুকানি। ছেড়া কাপড়, টিনের পাত্র, ধুলো মলিন খেলার পুতুল।
কোথায়? কোথায়? কোথায়?
এটা কি? ভাঙা স্ল্যাব, আরেকটা। অপেক্ষাকৃত পাতলা। নিচে হাত ঢুকছে না। টিক টিক টিক। ঠিক শুনছি? হ্যাঁ, শব্দ আসছে, ক্ষীণ। টিক টিক টিক। আরেকটু, আরেকটু হাত বাড়ালেই পেয়ে যাবো ডায়ালটা। আরেকটু। উফফ! না, স্ল্যাবটা সরাতেই হবে। বেশ ভারী। আগে টর্চটাকে রাখি প্রথম স্ল্যাবের ওপর। এইবার। ধপাস। ঠেলতে গিয়ে স্ল্যাবটাকে নিয়ে পড়লাম সোজা। না, লাগেনি। ওই তো। কাঁচের ডায়াল চকচক করছে। একি! কাঁচটা ভেঙে গেছে। তবে পুরোটা না, যাক বাঁচলাম। কাঁটাগুলো ঘুরছে একদম ঠিকঠাক ভাবে। ভাগ্যিস স্ল্যাবের তলায় গিয়ে পড়েছিল, নাহলে যন্ত্র পুলিশগুলোর হাতে পড়ত।
কি? স্ল্যাবের গায়ে কি যেন লেখা আছে। সিমেন্টের ওপর খোদাই করা। বাংলায় লেখা। টর্চের আলো সোজা পড়ছে লেখাগুলোর দিকে, তাই চোখে পড়লো।
‘আশাপূর্ণা এপার্টমেন্টের মৃত বাসিন্দাদের উদ্দেশ্যে… সং ২০৩০’
আমি কি পড়ে যাচ্ছি। ‘মৃত’? মানে, মা, আমি, শেলী, আমরা সবাই? হাত পা কাঁপছে নাকি?
‘ওই তো… আলো… ঘিরে ফেলো…’ যান্ত্রিক নির্ঘোষ। ‘গুলি করতে পারো… অনুপ্রবেশকারী সশস্ত্র…’ আরেকদিক থেকে এলো শব্দটা।
‘পালাও, আলোটা নেবাও আগে’
মস্তিষ্কের নির্দেশ। কিন্তু কোথায় পালাবো? উদভ্রান্ত মনের প্রশ্ন। ‘সিঁড়ি বেয়ে যতটা ওপরে ওঠা যায়-‘ মস্তিষ্কের উত্তর। মনও মেনে নেয়।
ঘড়ির ডায়াল হাতের মুঠোয় আছে তো? হ্যাঁ আছে। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ…সিঁড়ি ভাঙছি তো ভাঙছিই। পা টন টন করছে। মাথাটা কেমন ভারী ভারী লাগছে। ঘামছি দর দর করে। আরও দূরে পৌঁছতে হবে, ওদের নাগালের বাইরে। এই অন্ধকার কালো ধুলো মলিন ভবিষ্যতের হাত থেকে দূরে। আরও দূরে। শেষ। পালাবার পথ। সামনে হাঁ করে আছে অন্ধকার। নিচে সিঁড়িতে কারো গলা শোনা যাচ্ছে না? না, মনের ভুল। তাড়াতাড়ি করতে হবে। হাতে বেশিক্ষণ সময় নেই। ধুলোর মধ্যেই বসতে হবে। সামনে ভাঙা বারান্দা, পিছনে অন্ধকার সিঁড়ি। মনোযোগ দিতে হবে। সমস্ত স্নায়ুকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে। ভাবতে হবে।
‘শিল্পীরা কিভাবে ছবি আঁকেন জানিস? মন দিয়ে, কল্পনা দিয়ে। গাছ? কেমন হবে গাছ? গাছে কটা ডাল থাকবে? ডালে পাতাগুলো কিভাবে সাজানো থাকবে? গাছে কি ফুল ফুটেছে? না কি ফল? ডালে কি পাখি বসেছে? পাখির গায়ের রং কি? হলুদ না নীল? গাছের নিচে কি কেউ বসে আছে? একটার পর একটা প্রতিকৃতি শিল্পী স্মৃতি থেকে তুলে আনেন আর কাগজের ওপর সাজান। ওটাকে বলে ডিটেইলিং। ডিটেইলিং ঠিক হয় যদি স্মৃতি টাটকা থাকে তবেই। ঠিক সেভাবেই সবকিছু মন দিয়ে ভাবতে হবে। প্রতিটা ডিটেলস। যত অনুপুঙ্খ হবে তোর স্মৃতি তত সহজে পৌঁছতে পারবি তোর আগের অবস্থানে।’ দাদু বলতেন। চোখ বন্ধ করে সেটাই ভাবার চেষ্টা করছি। সিঁড়ি বেয়ে ওদের উঠে আসার শব্দটা কানে এসে পৌঁছচ্ছে।
তাহলে সবকিছু কি ভাবে শুরু হয়েছিল? ভাবা যাক।
মা বলেছিল, ‘কাল সকালের মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলিস। আর যাই কর তোর দাদুর মত বিজ্ঞানী হতে যাস না। তোর বাবার মত আর্মিতেও নাম লেখাবার দরকার নেই। সবাই মেডিক্যাল পড়ার সুযোগ পায় না, তুই পেয়েছিস, ভেবে দেখিস একটুখানি।’
আমি উত্তর দিইনি। নাকি দিয়েছিলাম? না দিইনি। বাবা যুদ্ধ থেকে ফেরেনি, দাদু গবেষণা নিয়ে কাজ করতে করতে শেষ বয়সে পাগল হয়ে গেছিলেন কপর্দকশূন্য অবস্থায়। মার যন্ত্রণা তাই আমিও বুঝি। এরপর মা কি করেছিল? ‘ফ্রিজে ফ্রাইড মোম আছে, খিদে পেলে খেয়ে নিস।’ খুব দুঃখী গলায় বলেছিল। মার চোখের দিকে তাকাতে ভয় হচ্ছিল। আমি কোথায় তাকিয়েছিলাম? খোলা বারান্দার দিকে। বিয়াল্লিশ তলা থেকে দূরে বঙ্কিম সেতুর ডগার আলোটা দেখা যায়। কেমন জ্বলছে আর নিবছে। আমি কিছু ভাবছিলাম। কি ভাবছিলাম? শেলীর কথা? শেলীর কথাই। ভাবছিলাম, এই এপার্টমেন্টের ঠিক তেরোখানা ফ্লোর নিচে এখন ও কি করছে? টিভি দেখছে? না কি আমার মতোই ভবিষ্যতের চিন্তায় একলা জেগে বসে আছে অন্ধকার ঘরে? কি নিয়ে পড়াশোনা করবে সেই নিয়ে ভাবতে গিয়ে ওর মুখের হাসি কয়েকদিন ধরেই ম্লান দেখেছি।
‘গুড নাইট, গোগোল।’ মা গোগোল বলে ডেকেছিল নাকি শুধুই গুড নাইট? মা গম্ভীর থাকলে গোগোল বলেই ডাকে। পর্দাগুলো উড়ছিল, ঘর অন্ধকার। বারান্দা থেকে হু হু করে আসছিল গঙ্গার হাওয়া।
তারপর?
তারপর ভাবতে বসেছিলাম, দাদুর ঘড়িটা আলমারির লুকোনো কোন থেকে বার করে অনেকক্ষণ দেখছিলাম সম্মোহিতের মত। কোনোদিন ব্যবহার করিনি ওটা। সময়কে চিরে আগুপিছু যাতায়াতের ধারণাটা বরাবরই বিপজ্জনক লেগেছিলো আমার। কিন্তু ওটাকে হাতের মুঠোয় বন্দি করে আবার শান্ত হয়ে বসেছিলাম খাটের ওপর। ভাবছিলাম। একটা অসম্ভব সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল মাথায়। মনের মধ্যে সব দ্বিধাদ্বন্দ্বগুলো আস্তে আস্তে খসে পড়ছিল যেন। দেখাই যাক না ভবিষ্যৎটা কেমন! এরকমও তো হতে পারে ঘড়িটা নেহাত দাদুর মতিভ্রমের নমুনা? নিজের ভবিষ্যৎ একবার নিজের চোখে দেখে নিলে কি ক্ষতি? কৌতূহল সমস্ত যুক্তিকে হেলায় সরিয়ে দিয়েছিল, আমি অজান্তে ঘড়ির পাশের দেয়ালে মোচড় দিতে শুরু করেছিলাম। কত বছর পরের ‘আমাকে’ খুঁজবো? আমার বাবা যে বয়সে হারিয়ে গেছিলেন, সেই বয়সে? আটচল্লিশ। কাঁটাগুলোকে সাজিয়ে চাপ দিয়েছিলাম দ্বিতীয় বোতামে। তারপর? একটা বিরতি। ধপাস করে পতন। ভাঙা বহুতল থেকে পালানোর প্রচেষ্টা, যন্ত্র-মানবদের সামনে এসে পড়া, ভয়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় আত্মগোপন। সেখান থেকে তার ধরে আবার ঝাঁপ….ধূর!
কিছু একটা যেন মনে করতে পারছি না ঠিকঠাক। কি যেন ভুলে যাচ্ছি। কি ভুলছি? এদিকে ঘড়ির ডায়ালে কাঁটাগুলো ঘুরে যাচ্ছে।
টিক… টক… টিক… টক…
কি ভুলছি? ধাতব শব্দ আরও এগিয়ে আসছে, পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি ওদের পায়ের আওয়াজ।
কি ভুলছি? কিছু ভাবছিলাম কি? বাবার যুদ্ধে যাওয়ার কথা? না কি বাবার সেখান থেকে না ফেরার কথা? কি ভাবছিলাম? অনেক দিন আগে দেখা একটা ভিডিওর কথা? যেটার কথা আমি সময় পেলেই ভাবি। তেজস্ক্রিয় বিকিরণে ক্ষয়ে যাওয়া একটা নিষ্পাপ ডলফিনের কথা ভাবছিলাম কি? বছর কয়েক আগে তার ছবি বারবার টিভিতে দেখানো হত। হয়তো না। তাহলে? এর মধ্যেই হঠাৎ শেলীর ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ওর মুখটা হঠাৎ কেমন বিকৃত হাসি নিয়ে যন্ত্র-মানুষদের রূপ নিলো। তারপর হেসে উঠলো। না না, আমাকে ভাবতেই হবে। হয়তো সেই ছবিটার কথা ভাবছিলাম, যেটা দেশে বিদেশে পুরস্কার পেয়েছিল? সমুদ্রের বুকে ভেসে আসা তিমি মাছেদের মৃতদেহের মিছিল। সাদা কালো। উহু, ওটাও না। সেই শব্দটা কেমন যেন কানের গোঁড়ায় বাজছে। যেটা প্রায়ই আমাকে ঘুম থেকে তুলে দেয়। গাছের গোঁড়ায় কুড়ুল মারার শব্দ। একের পর এক আঘাতের শব্দ। কি ভয়াবহ! একটা খুন, যেখানে কেউ আর্তনাদ করে না। দাদু চিৎকার করছে দুহাত তুলে। ‘ওদেরও জীবন আছে,’ দাদু পাগলের মত আউড়ে যাচ্ছে কথাটা। উফ। আর পারছি না। ভাবতে পারছি না।
‘সাবধান… ঘাপটি মেরে আছে এখানেই কোথাও…’ ওরা আসছে।
ভাবতে হবে। কি যেন মনে পড়ছে না। হে ঈশ্বর। কি যেন ঠিক মনে করতে পারছিনা। একটা শব্দ? মহিলার গলা? ঘোষণা? টিভির? ওটা কোথায় চলছিল? আমার ঘরে তো নয়। বসার ঘরে। মা বোধহয় টিভি বন্ধ না করেই ঘুমোতে গেছিল।
‘প্রধানমন্ত্রী এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেছেন। এর উপযুক্ত উত্তর দেওয়া হবে শিগগিরই, তিনি দাবি করেছেন। এদিকে য়ুরোপ থেকে সন্ত্রাসবাদী হামলা ঠেকাতে মার্কিনরা তাদের কমান্ডো বাহিনী পাঠিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে।’ নাটকীয় বিরতি। আরও কিছু বলেছিলেন টিভির সুন্দরী সংবাদ পাঠিকা। কি বলেছিলেন?
‘এইখানে… ওই তো… সাবধান…’ কাছে আসছে শব্দ।
‘অনুপ্রবেশকারী কিন্তু সশস্ত্র… নড়াচড়া করলে গুলি করতেই হবে…’
কি বলছিলেন ঘোষিকা?
মাথা তুললেন তিনি, দর্শকদের উদ্দেশ্যে চোখ তুলে তাকালেন। বললেন, ‘বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়ছে। যুদ্ধের বাতাবরণে বিশ্ব-পরিবেশ আলোচনা স্থগিত রাখার ডাক দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, পরিবেশবিদদের মতে এর জন্য বিশাল ক্ষতি হতে পারে আমাদের আবহাওয়ার…’
‘হ্যাণ্ডস আপ…’ আলোগুলো দলবদ্ধভাবে এগিয়ে আসছে। যন্ত্র পুলিশের বেতার ঘোষণার বিরক্তিকর কোলাহল কানের কাছে নিশ্বাস ফেলছে।
তারপর? তারপর সব অন্ধকার।
*****
‘বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, দূষণের মাত্রা না কমালে খুব শিগগিরই বিশ্বজুড়ে দেখা দিতে পারে নানারকম ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ইতিমধ্যেই চীনের কয়েকটি শহরে পানীয় জলের মাত্রা-ছাড়া অভাব দেখা দিয়েছে, খরা দেখা দিয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কয়েকটি এলাকাতেও-‘
ঘোষিকা বলে চলেছেন। আমি বসে আছি খাটের ওপরে। পর্দা উড়ছে, বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে বঙ্কিম সেতুর মাথায় জ্বালা আলোর কম্পন। হওয়া আসছে গঙ্গার বুক থেকে, আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটাই তো ভাবছিলাম?
আমি ফিরেছি তাহলে? নিরাপদে।
আচ্ছা, অদৃশ্য হবার ঠিক আগে যন্ত্র-পুলিশগুলো কি বলছিল?
‘অনুপ্রবেশকারীর মাথায় আক্রান্তের হেলমেট…’
আরে, সত্যি তো। এখনো পরে আছি হেলমেটখানা। উফ, তাড়াহুড়োয় একদম মনে ছিলোনা। ‘এটম’ হেলমেটের মাথায় লেখা। ঈশ! ভুল করেছি। সময়ের খাতায় একটা ‘গ্লিচ’ জমা পড়লো। যাই হোক, সেটা নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে।
শরীরে ব্যথার অনুভূতি নেই কিন্তু মাথায় চেপে বসা ভারী চিন্তার ক্লান্তি আছে। দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িতে বাজে দশটা বারো, কিন্তু ‘আই সি’ বলছে সময়টা দশটা বেজে এগারো মিনিট। ‘আই সি’ ভুল হতে পারে না। দাদুও না।
এবার একটু ঘুমোই।
*****
মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, সূর্যের আলো চোখে পড়ছে। ঘড়ি আর হেলমেটটা আশা করি লুকিয়ে রেখেছিলাম ঘুমিয়ে পড়ার আগে?
‘কি রে কি ভাবলি? কিছু ঠিক করলি?’ সেই এক প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ,’ উত্তর শুনে মার চোখে মুখে একটা প্রশ্নের ছায়া দেখলাম। সূর্যের আলোয় বারান্দা ভেসে যাচ্ছে, রোদের তেজ কম, ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রবাহ ধুইয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমার ঘরটাকে। নিচে সবুজ পার্কে বাচ্চাগুলো খেলেছে নিশ্চয়, আমাদের নিচের তলার কাকিমা নিজের ছেলেকে ডাকছেন। রাস্তায় এখনো গাড়িঘোড়া কম। কত বাজে? কি দরকার জেনে? গঙ্গার বুকে স্টিমার যাচ্ছে। বঙ্কিম সেতুর মাথার আলোটা দেখা যাচ্ছেনা আর। কি সুন্দর। পুজো আর কত দূর?
‘গোগোল?’
‘ডাক্তারি পড়বো না মা,’ যাহ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো শেষ অব্ধি। মার চোখের দিকে তাকাতে পারছি না আর।
‘ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেখছিস একবার?’ মার গলা চড়ছে নাকি?
‘দেখেছি। তাই বলছি।’
‘তা কি করবি শুনি?’ মা দিশেহারা। ‘গবেষণা করব। দাদুর মত। সব কিছু পাল্টে একটা নতুন পৃথিবী গড়তে হবে মা।’
‘সব দিক ভেবে দেখছিস?’ মার হতাশ গলা।
এবার মায়ের চোখের দিকে তাকাতেই হবে।
‘দেখেছি -‘ এই যাহ বিষণ্ণ হাসিটা চেপে রাখতে পারলাম না আর।
‘কোথায় চললি?’ মার প্রশ্ন।
‘কলেজের ফর্ম তুলতে -‘ দরজা বন্ধ করে দিই।
হ্যাঁ, ভেবেছি, সবার কথা ভেবেছি। আমার, তোমার, শেলীর কথা। আমাদের কথা। আমাদের ভবিষ্যতের কথা। সত্যি তো কি করবো? কিভাবে করবো? যাই করিনা কেন হাতে সময় মাত্র চারবছর। অন্তত কংক্রিটের স্ল্যাবের গায়ে লেখা মৃত্যু পরোয়ানায় সেরকমটাই লেখা আছে। এই কটা বছরে পারবো না সবাইকে নিরাপদ করতে? পারতেই হবে। আর যদি তা না পারি, তাহলে…
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, ক্লাই-ফাই, তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, রনিন, সূর্যোদয় দে
রনিন-বাবু, দারুন লেখা|
Dhonyobad, Sumitda!!!!
গল্পটা পড়ে বেশ ভালো লাগলো। গতি,ভাষার ব্যবহার, destopian ভবিষ্যৎ এবং সম্পর্কের অপূর্ব মেলবন্ধন। সঙ্গে সুযোগ্য প্রচ্ছদ
Sohombabu, dhonybad 🙂
গল্পটার ভাষা খুবই সুন্দর।
অসাধারণ একটা গল্প।খুব ভালো লাগল।
বেশ টানটান উত্তেজনাপূর্ণ লেখা। খুব ভাল লাগল।