এ অনন্ত চরাচরে – দ্বিতীয় পর্ব
লেখক: সুমন দাস
শিল্পী:
আশ্চর্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেন্মাশ্চর্যবদ্ বদতি তথৈব চান্যঃ।
আসচর্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ।।২৯।।
কেহ ইহাকে আশ্চর্যবৎ কিছু বলিয়া বোধ করেন, কেহ ইহাকে আশ্চর্যবৎ কিছু বলিয়া বর্ণনা করেন, কেহ বা আশ্চর্যবৎ কিছু, এই প্রকার কথাই শুনেন। কিন্তু শুনিয়াও কেহ ইহাকে জানিতে পারেন না।
~ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – ২য় অধ্যায়
জলের মাছ কি জলকে জানতে পারে? কিম্বা সাগর-পুকুর-নদী-খাল-বিলের বর্ণনা করতে পারে? তার কাছে আকাশ-মাটি-ফুল-ফল কল্পনার বস্তু নয়? ঠিক তেমনই স্থান-কাল-পাত্রের মধ্যে থেকে আমরা কি স্থান কাল’কে জানতে পারি? জানার চেষ্টা কি বৃথা নয়?
না। তার কারণ, একমাত্র মানুষই পারে নিজেকে অতিক্রম করতে। মানুষ পারে চিন্তা করতে। মানুষ পারে সসীম হয়েও নিজের মধ্যে অসীমকে অনুভব করতে।
আজ আমরা তেমনই কিছু জানব। এমন কিছু যা আগে কম শুনেছি, বা জেনেছি, বা আভাস পেয়েছি। মহাকাশ-বিদ্যার ক্ষেত্রে কিন্তু এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ, এক এক ধাপ করেই মানুষ ছাদে ওঠে। ছাদে উঠে আকাশ দেখার পর, দুর্ভাগ্য সিঁড়ির কথা আর মনে থাকে না…
আসুন সেরকমই তিনটি ব্যাপারে আজ কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করা যাক।
(i)
প্লুটোর একটা চাঁদ আছে – থুড়ি উপগ্রহ। তার নাম শ্যারণ (Charon)। ১৯৭৮ সালে আবিষ্কৃত হওয়া এই উপগ্রহটিকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের শেষ নেই। সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে এক সংঘর্ষে এই উপগ্রহটির উৎপত্তি। কুইপার বেল্ট, যাকে আমরা গ্রহাণুপুঞ্জ বলি, তো তার থেকে একটি টুকরো এসে প্লুটোকে ধাক্কা মারে। ফলে প্লুটোর বহিঃ-অংশের একটি টুকরো প্লুটো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জন্ম দেয় এই শ্যারণের। ১১১২ কিলোমিটার ব্যাসের এই উপগ্রহটির সাইজে প্লুটোর অর্ধেক। মজার ব্যাপার হল প্লুটো নিজের অক্ষে এবং শ্যারণ প্লুটোকে প্রদক্ষিণ করতে মোট সময় নেয় ৬.৩৮৭ দিন। মানে প্লুটোর একটা দিক সবসময় শ্যারণের দিকে মুখ করে থাকে। তো এই ধুসর বর্ণের শ্যারণের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে অসংখ্য বলিরেখা – উপত্যকা ও শৈলশিরা-শ্রেণী; সবমিলিয়ে ক্যাটাভেরাস দেখতে। এখন, নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন এর কারণ হল পুরাকালে এখানে ছিল অতল জলের সাগর, যাকে বলে সসাগরা সাগর। জুলাই মাসে ‘নিউ হরাইজন’ শ্যারণের পৃষ্ঠদেশের যে ছবি পাঠিয়েছিল, তাতে দেখা যাচ্ছে এই চাঁদটি অভ্যন্তরের উষ্ণতা হ্রাসের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে অনেক উপত্যকার সৃষ্টি হচ্ছে ক্রমাগত, যার নীট ফল – গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকেও লজ্জা দেবে। এর একটি ফাটলের গভীরতা ৭.৫ কিমি, এবং দৈর্ঘ্য ১৮০০ কিমি, যা সৌরজগতের আর কোন গ্রহ, উপগ্রহ বা গ্রহাণুপুঞ্জের নেই। তবে এই আবিষ্কারের ফলে কীভাবে একটি গ্রহে বা উপগ্রহ ধীরে ধীরে বরফ-পূর্ণ হয় এবং তার কী ইম্প্যাক্ট পড়ে, নাসা তা আরও ভালোভাবে জানতে পারবে আশা করে।
(ii)
একদিন এ বিশ্বের সমাপ্তি ঘটবে – সবাই জানে। কিন্তু কবে? কখন? কিভাবে? এ নিয়ে মতদ্বৈধ বর্তমান – কিন্তু ভয় নেই। নতুন প্রেডিকশন অনুসারে তা ঘটবে সূর্যের মৃত্যুর কয়েক লক্ষ কোটি বছর পর। সোজা কথায় প্রায় দশ বিলিয়ন বছর পরে। এর মধ্যে সূর্যের মৃত্যু ঘটতে এখনো পাঁচ বিলিয়ন বছর বাকি। তবে বিশ্বের সমাপ্তি নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। এই বিশ্বের জন্ম হয়েছে হোয়াইট হোল থেকে – আমরা অনেকেই জানি। কীভাবে? কৌতূহলীরা আমার আগের পর্বে এর বিস্তারিত কথা পড়ে নিতে পারেন। তো এই স্বেত-গহ্বর একটি কৃষ্ণ-গহ্বরের ফল মাত্র – এরকমই এখন বলা হচ্ছে। যদিও হকিং-এর মতন বিজ্ঞানী তাকে মেনে নিতে নারাজ। কারণ হকিং রেডিয়েশন। বিজ্ঞানী হকিং প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, হোয়াইট হোল থেকে হকিং রেডিয়েশন বের হয়ে আসা অসম্ভব। তার কারণ? অংক কষে এর কূল পাওয়া যাচ্ছে না। আর কে না জানে, রিলেটিভিস্টিক ফিজিক্সে বা এস্ট্রোফিজিক্সে অঙ্কের মূল্য কতখানি। তাই হোয়াইট হোল এখন কয়েকজন বিজ্ঞানীর কথার কথা মাত্র। তবুও এই তত্ত্ব যদি মেনে নেওয়াও যায়, তাহলে বলতে হবে যে সমস্তটা মিলিয়ে এখনও আমাদের হাতে ঢের ঢের সময় আছে। ততদিনে না মানব প্রজাতি ফৌত হয়ে যায়। আর তার সম্ভাবনা অনেক জোরালো, যদি না পাশাপাশি গ্রহে বসতি স্থাপন করা না সম্ভবপর হয়ে ওঠে, কিম্বা ‘হাইপারড্রাইভ’ দিয়ে মানুষ এক বিশ্ব থেকে নিজদেরকে অন্য বিশ্বে স্থানান্তর না করতে পারে।
(iii)
এক রহস্যময় বিস্ফোরণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসেছিলেন কয়েক দশক ধরে। Fast radio bursts (FRBs) – মহাকাশে ঘটে যাওয়া কয়েক মিলি-সেকেন্ডের এই বিস্ফোরণের তীব্রতা সূর্যের সারাদিনের অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার বিকিরিত মোট শক্তির তীব্রতার সমান। কিন্তু কোথা থেকে কীভাবে এই বিস্ফোরণ ঘটল তার কোন হাল হদিশ ছিল না এতদিন। ১৮ই এপ্রিল ২০১৫ তে পার্কস রেডিও টেলিস্কোপে আবার এইরকম একটা বিস্ফোরণ ধরা পড়ে। এই বিস্ফোরণের ঝলকানির রেশ মিলিয়ে যেতে সময় লেগেছিল ছ’দিন! ফলে ধৈর্য ধরে এর উৎস সন্ধানে যেতে পেরেছেন তামাম বিশ্বের বিজ্ঞানীরা। ছয় বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের এক উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সি থেকে এর আগমন। এতে কী উপকার হবে? এই মহাবিশ্বের মাপ নেওয়া আরও সহজ হয়ে পড়ল এতে করে।
কিভাবে ধরা গেল? যখনি এই বিস্ফোরণের রেডিও তরঙ্গ আসে, আগে উচ্চ-তরঙ্গ আসে, তারপরে নিম্ন-তরঙ্গ। আর দুই তরঙ্গের আপাত পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করেই ধারণা করা হয় এই বিস্ফোরণ সম্পর্কে। এই বিস্ফোরণ কোথা কোথা থেকে আর আসতে পারে? বিজ্ঞানীরা চোখ রেখেছেন বিভিন্ন পালসারে, ধ্বংস-প্রায় নিউট্রন তারকায়, অদৃশ্যমান কৃষ্ণগহ্বরে।
তো সব মিলিয়ে এই তিন আশ্চর্য খবর আমি পেশ করলাম। খুব কম মানুষই এই তিনটি খবর জনসমক্ষে পেয়েছে। কারণ মহাকর্ষ তত্ত্ব, বা প্ল্যানেট এক্স – সব খবরকে ঢাকা দিয়ে দিয়েছে। কি বললেন? ও দুটো কি ব্যাপার? শুনেছেন, কিন্তু আরও জানতে চান?
আসব আসব – ধীরে, বন্ধু ধীরে… এতএব…
“গতে, গতে, পারগতে, পারসংগতে, বোধি স্বাহা”
“go, go, go beyond; go thoroughly beyond. Perfect realization!”
Tags: এ অনন্ত চরাচরে, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সুমন দাস