কৌটো
লেখক: রাজকুমার রায়চৌধুরী
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
(তন্ময় পুরকায়স্হর জবানবন্দি, অনুলিখন রাজকুমার রায়চৌধুরী)
প্রথমেই বলে রাখি আমার নাম তন্ময় পুরকায়স্থ৷ আমি কেমিস্ট্রিতে এমএসসি পাশ করে একটা মোটামুটি নামী কোম্পানিতে চাকরি করি৷ বাঁকুড়া জেলার একটি গ্রামে আমাদের বাড়ি৷ বাড়িতে বাবা-মা আর এক বোন থাকে৷ তবে কাজের চাপে বছরে দু-একবারের বেশি গ্রামে যাওয়া হয়ে ওঠে না৷ আমি বিয়ে করিনি৷ যাদবপুরের কাছে একটা দু’কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকি৷ ভাড়া কোম্পানিই দেয়৷ রিটায়ারমেন্টের আর দশ বছর বাকি আছে৷ শান্তিনিকেতনে একটা ফ্ল্যাট বুক করেছি৷ চাকরি থেকে মুক্তি পেলে ওখানেই বাকি জীবনটা কাটাব ভাবছি৷ সাহিত্যচর্চার অভ্যেস আছে৷ আর রিটায়ার করার পরও কনসালটেন্সির যথেষ্ট সুযোগ থাকবে৷ দেশের বাড়িও কাছে হবে৷
(২)
কয়েক দিন হল একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করছি৷ একটা কৌটোয় মৌরি-জোয়ান ভর্তি ছিল৷ এখন একটা দানাও নেই৷ কৌটো বন্ধ অবস্থাতে আছে৷ আর একটা কৌটোয় কয়েকটা বিস্কুট ছিল৷ কৌটৌ সমেত উধাও৷ না, অন্য কেউ নেবে না৷ আমি খুব অগোছালো৷ টাকাপয়সা এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে থাকে৷ কিছুই মার যায়নি৷ কৌটোরও কি খিদে থাকে? কে জানে!
(৩)
বিস্কুটের কৌটোটা আবার নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। তবে বিস্কুটের কোনও চিহ্ন নেই৷ ভালো করে নেড়ে দেখলাম৷ ওটাতে যে কোনও কালে বিস্কুট ছিল, মনে হয় না৷ একেবারে নতুন কৌটোর মতো৷ কিন্তু গত কয়েক মাসে আমি নতুন কোন কৌটো কিনিনি৷ কাজের মহিলা প্রমীলাকে জ্ঞিজ্ঞেস করেছি৷ আমি একা থাকি৷ রান্নাঘরের নাড়িনক্ষত্রের খবর ও রাখে৷ কিন্তু ও যা বলল তাতে অবাক হলাম৷ বিস্কুটের কৌটোয় ও হাত দেয়নি৷ কিন্তু ও-ও নাকি দেখেছে, দু-একটা কৌটো মাঝে মাঝেই তাদের জায়গায় থাকে না! পরে আবার ঠিক জায়গায় ফিরে আসে৷ ওর মতে, স্যারের খুব ভুলো মন৷ একবার নাকি আমি শোবার ঘরের খাটের তলায় চায়ের কৌটো রেখেছিলাম৷ ও তুলে এনে আবার ঠিক জায়গায় রেখেছে৷ আমি ভুলো মন থেকে কি পাগল হয়ে যাচ্ছি! এই বয়সে অ্যালঝাইমার হওয়া আর্শ্চয কিছু নয়৷ কিন্তু আমি এখনও মাইকেলের দুটো কবিতা মুখস্ত বলতে পারি৷ ত্রিকোণমিতির সব ফর্মুলা জানি৷ এমনকী, তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বাঁদরের ওঠানামার অঙ্ক করতে পারি৷ আমি ভাবলাম, একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখি। তার পর না হয় ডক্টর জগৎপতি জোয়ারদারের সঙ্গে দেখা করা যাবে৷ ডঃ জোয়ারদার আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির উপর ভালো কাজ করেছেন৷ এখন কগনিটিভ সায়েন্স নিয়েই মেতে আছেন৷ প্যারানর্মাল ব্যাপার স্যাপারে আগ্রহ আছে৷ অবশ্য উনি আধিভৌতিক কিছুতে বিশ্বাস করেন না৷
(৪)
আমার এক্সপেরিমেন্টটা খুব সহজ৷ যে ক’টা কৌটো রান্নাঘরে ছিল, একদিন রাতে সব ক’টাতে কিছু না কিছু জিনিস রেখে দিলাম৷ কোনওটাতে চিনি, কোনওটাতে চাল বা নুন ইত্যাদি৷ পরদিন সব ক’টা কৌটো খুলে খুব ভালো ভাবে দেখলাম কোনও জিনিস উধাও হয়েছে বা পরিমাণ কমেছে কি না৷ সব কৌটোয় একটা নম্বর দেওয়া ছিল৷ দেখলাম চারটে কৌটো ছাড়া আর সব ঠিকঠাক আছে৷ চারটের মধ্যে একটা উধাও হয়েছে৷ বাকি তিনটির মধ্যে দুটি স্হান বদল করেছে৷ কিন্তু তিনটেই খালি৷ এই চারটে কৌটোই অন্যদের থেকে আলাদা, চৌকো সিলিন্ডারের মতো৷ বেসটা একটা বর্গক্ষেত্র৷ উচ্চতা বর্গক্ষেত্রের একটা বাহুর থেকে সামান্য বেশি৷ মেপে দেখলাম, ১৭ সেমি৷ কৌটোগুলো স্বচ্ছ, কিন্তু কাচ বা প্লাস্টিকের নয়৷ হয়তো বিশেষ ধরনের পলিমার বা মেটাল৷ পরের দিন দেখলাম, খোয়া যাওয়া কৌটোটা আবার ফিরে এসেছে একদম খালি অবস্থায় ৷
(৫)
আমি অলৌকিক বা তন্ত্রমন্ত্র— এসব কিছুতে বিশ্বাস করি না। যদিও আমার প্রতিবেশী শঙ্করীপ্রসাদ শূর মনে করেন, তান্ত্রিকদের নাকি এসব কৌটো চালাচালির ক্ষমতা আছে৷ আমি ভাবলাম, অনিমেষ এসব ব্যাপারে হেল্প করতে পারে৷ অনিমেষ প্রেসিডেন্সিতে আমার সহপাঠী ছিল৷ ও অবশ্য ফিজিক্স অনার্স নিয়ে পড়ত৷ মেদিনীপুরের ছেলে৷ দু’জনেই নাটক পাগল ছিলাম, তাই বন্ধুত্ব হতে দেরি হয়নি। অনিমেষ মানে অনিমেষ আদক৷ ইংল্যান্ডের একটি নামী কলেজ থেকে পিএইচডি করে দেশে ফিরে একটি নাম করা প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ প্রফেসর৷ ডঃ জোয়ারদারের কাছে যাওয়ার আগে অনিমেষের কাছে গিয়ে দেখি, যদি ও এই রহস্যের কোনও সমাধান করতে পারে৷ অনিমেষের অফিসেই ফোন করলাম৷ ভাগ্যক্রমে ওকে পেয়ে গেলাম৷ দু’দিন আগেই ফ্রান্স থেকে ফিরেছে। আমার কাছে কৌটোর গল্প শুনে বলল, যেন কালই আমি ওর বাড়িতে যাই৷
(৬)
শুভস্য শীঘ্রম৷ এই শনিবারই ওর বাড়ি গেলাম৷ অনিমেষ ফ্রান্স থেকে টার্কিশ কফি এনেছে৷ কফি তৈরির মেশিন ওর বাড়িতে অনেক দিন ধরেই আছে৷ আমি যখন বিকেলে ওর বাড়িতে পৌঁছেছি, তখন বিকেল পাঁচটা৷ বাইরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে৷ এই সময় গরম কড়া কফি মন্দ লাগে না৷ অনিমেষ প্রথমেই প্রশ্ন করল, ‘কৌটোগুলো কোথায় পেলি?’
‘গড়িয়াহাটের এক দোকান থেকে।’
‘রাস্তার দোকান?’
আমি বললাম, ‘ঠিকই ধরেছিস৷ তবে রাস্তার দোকান হলেও বেশ বড়৷ খুব ভালো চায়ের কাপ পাওয়া যায়৷ দোকানি তো বলে, মালয়েশিয়ার মাল৷ আমি কৌটোগুলো দেখে এত মুগ্ধ হয়েছিলাম, যে ক’টা ছিল সব কিনলাম৷ প্রচুর দাম চাইছিল৷ দরাদরি করে কিছু কম দামে কিনলাম৷ কৌটোগুলো যে সস্তার নয় তা হাতে ধরেই বুঝতে পেরেছিলাম৷’
আমি কৌটোগুলো একটা ঝোলাব্যাগে পুরে এনেছিলাম। অনিমেষ কৌটোগুলো ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখল৷ ওর টেবিলের উপরে একটা ছোট টর্চ ছিল৷ প্রত্যেকটা কৌটোর ভিতর টর্চের আলো ফেলে ভিতরগুলোও দেখে নিল৷ তারপর টর্চটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘মালটা চোরাই মাল।’
‘কোনটা, তোর টর্চটা না আমার কৌটোটা?’ অনিমেষ হেসে বলল, ‘হয়তো দু’টোই৷ টর্চটা শিলং থেকে কিনেছি৷ তবে এই কৌটোগুলো চোরাই, কোনও সন্দেহ নেই৷’
‘বলিস কীরে! তাহলে তো পুলিশে ধরবে।’
অনিমেষ রহস্যময় একটা হাসি হেসে বলল, ‘বোধহয় না৷ কারণ কেউ তো পুলিশে নালিশ করেনি বা করবেও না।’
‘একটু ঝেড়ে কাশ তো।’
‘দেখ আমার মনে হচ্ছে কৌটোগুলো টেলি ট্রান্সপোর্ট পরীক্ষার গিনিপিগ… বলতে পারিস।’
‘টেলি ট্রান্সপোর্ট? মানে স্টার ট্রেক গল্পের বিম ডাউন আর বিম আপ। কিন্তু এ তো নিছক কল্পবিজ্ঞান!’
‘না, আমরা অত দূর যেতে পারিনি। তবে কয়েক বছর আগে একটা ফোটনকে টেলি ট্রান্সপোর্ট করে অন্য জায়গায় পাঠানো সম্ভব হয়েছিল৷ নামকরা একটি ফিজিক্সের জার্নালে পরীক্ষার পুরো বিবরণ ছাপা হয়েছিল।’
‘সেটা আমি দেখেছি, কিন্তু ম্যাক্রো লেভেলের কোনও বস্তুর উপর এরকম কোনও পরীক্ষার কথা গুগল সার্চ করে পাইনি।’
আমার কথা শুনে অনিমেষ একটু হেসে বলল, ‘পাবি কী করে? যেসব দেশে এসব কাজ হচ্ছে সেসব দেশের সরকার কড়া নির্দেশ দিয়েছে এসব বিষয়ে কোনও পেপার ছাপানো যাবে না, সাংবাদিকদের কোনও কথা বলা যাবে না৷ সমস্ত দেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীর হাতে ব্যাপারটা চলে গেছে৷ তুই যে কৌটোগুলো এনেছিস, তা মালয়েশিয়ার নয় আমাদের দেশের৷ অবশ্য এগুলো তৈরি হয়েছে সুইডেনে।’
‘সে কীরে? তাহলে আমাদের দেশের কোনও গবেষণাগার থেকে এগুলো চুরি গেছে৷’
‘ঠিকই ধরেছিস৷ আমাদের দেশেরই একটি গোপন ল্যাবরেটরি থেকে এগুলি চুরি গেছে৷ এগুলির ওপর টেলি ট্রান্সপোর্টেশনের এক্সপেরিমেন্ট চলছিল।’
‘আমার তো মনে হচ্ছে এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল।’
আমার কথা শুনে অনিমেষ বলল, ‘একটু বেশি সাকসেসফুল।’
‘তার মানে?’
‘তাহলে শোন৷ ডঃ মৃণাল তালুকদার এবিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ৷ আমাদের দেশে যে ল্যাবরেটরিতে এই কৌটোগুলোর টেলি ট্রান্সপোর্ট নিয়ে ল্যাবে কাজ হচ্ছে, উনি সেখানকার সিনিয়র সায়েন্টিস্ট৷ আমার সঙ্গে ওনার কয়েকটা জয়েন্ট পেপার আছে৷ তবে সবই থিয়োরেটিক্যাল৷ ওনার মুখে শুনেছি কৌটোগুলোকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানো যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় যাবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না৷ কিছুদিন পরে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে কিন্তু সেই ফিরে আসাটা কেউ কন্ট্রোল করতে পারছে না৷ আমরা দেখাবার চেষ্টা করছিলাম থিয়োরেটিক্যালি এটা সম্ভব কি না৷ কিন্তু ডঃ তালুকদার মনে করেন কৌটোগুলো টাইম ট্র্যাভেল করছে।’
‘সে কীরে! তাহলে তো কৌটোর সাহায্যে অতীতেই ফিরে যাওয়া যেতে পারে৷ আমার খুব দরকার৷ কয়েকটা ভুল শোধরানো যেত।’
আমার কথা শুনে অনিমেষ হো হো করে হাসল, ‘এখনই তা পারবি না।’
‘কেন?’
তোর অভিজ্ঞতা শুনে এখন বুঝতে পারছি কৌটোগুলো দু-একদিনের বেশি টাইম ট্র্যাভেল করতে পারছে না।’
‘কী করে বুঝলি?’
‘দেখ, তুই হয়তো একটা কৌটোতে মৌরি রাখলি৷ কৌটোটা কিছুক্ষণ আগের সময়ে পিছিয়ে গেল, যখন ওটাতে কোনও মৌরি ছিল না৷ সেই সময় যদি টেলি ট্রান্সপোর্ট করে তোর বাড়িতে ফেরত আসে তাহলে তুই কৌটো দেখবি, কিন্ত মৌরি পাবি না।’
‘কিন্তু রাস্তার যে দোকান থেকে কৌটোগুলো কিনেছি সেই দোকানেও তো এসব ঘটতে পারত৷ দোকানদার খুব শিক্ষিত নয়৷ ও হয়তো ভাবত ভৌতিক ব্যাপার৷ কৌটোগুলো হয়তো বিক্রি করত না।’
‘এটা একটা ভালো পয়েন্ট। তবে আমার মনে হয় এই টেলি ট্রান্সপোর্টের জন্য এনার্জি লাগে৷ তোর বাড়িতে নানা রকম ইলেকট্রিক্যাল আর ইলেকট্রনিক গ্যাজেট আছে, সেসব গ্যাজেট থেকেই হয়তো এনার্জি সংগ্রহ করে। আর একটা পয়েন্ট হল, দোকানদার সারাক্ষণ কৌটোগুলোর উপর নজর রাখছিল তাই হয়তো কৌটোগুলো নড়াচড়া করার সুযোগ পায়নি।’
‘কোয়ান্টাম জেনো এফেক্ট?’
আমার প্রশ্ন শুনে অনিমেষ অবাক হল না, ‘ঠিক তাই, তা ছাড়া কত জিনিস আমরা জানি না।’
আমি ওকে আমার এক্সপেরিমেন্টের কথা বললাম৷ কৌটোগুলো কতক্ষণ উধাও হয়ে ছিল, কোনগুলো ভিতরে রাখা জিনিস সমেত ফিরে এসেছে সব কিছু আমি একটা খাতায় লিখে রেখেছিলাম৷ খাতাটায় লেখা তথ্যগুলো দেখে অনিমেষ বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ল৷
‘শোন আমার মনে হয় কৌটোগুলো খুব দূরে যাচ্ছে না। হয় রান্নাঘরেই থাকছে বা বাড়ির আশপাশে৷ আর টাইম ট্র্যাভেলও একদিন বা দু’দিনের বেশি করতে পারছে না৷ তবে বেশি শক্তি পেলে সত্যিই হয়তো উধাও হয়ে যেতে পারে৷ তুই এক কাজ কর৷ তোর ঝোলা থেকে কৌটোগুলো যে এখনও উধাও হয়নি, তার কারণ ওরা যথেষ্ট এনার্জি সংগ্রহ করতে পারেনি৷ তোর বাড়িতে যত ইলেকট্রিক্যাল আর ইলেকট্রনিক গ্যাজেট আছে, সব ক’টা অন করে রাখ কয়েক ঘণ্টার জন্য৷ আর দুটো কৌটো একটা বড় কৌটোর মধ্যে রাখবি, অন্য দুটো যেমন আছে তেমনই থাকবে।’
অনিমেষের কথা শুনে আমার একটা কথা মনে এল৷ আসলে অনেক দিন ধরেই এই প্রশ্নটা আমার মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ আমি বললাম, ‘দেখ অনিমেষ, টাইম ট্র্যাভেল স্পেস ট্র্যাভেলা ছাড়া হয় না। অথচ কোনও সায়েন্স ফিকশনে আমি এই নিয়ে বিশেষ কিছু আলোচনা দেখিনি।’
অনিমেষ আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল৷ তারপর বলল, ‘তুই কী বলতে চাইছিস আমি বুঝেছি। ধর আমি এই ঘরেই এক বছর আগে ফিরে এলাম৷ আমার মনে হবে, আমি তো একই জায়গায় ফিরে এসেছি। সুতরাং কোনও স্পেস ট্র্যাভেল করিনি। কিন্তু মহাবিশ্বে পৃথিবী তো কোটি কোটি মাইল অতিক্রম করেছে। তাই টাইম ট্র্যাভেল আর স্পেস ট্র্যাভেল আলাদা করা যায় না৷ আইনস্টাইনকে আর একবার স্যালুট করতে হচ্ছে৷ যাই হোক, আমি যা বললাম সেই এক্সপেরিমেন্টগুলো করবি৷ আর সাবধানে থাকবি৷ একা এক্সপেরিমেন্ট করবি না। কাউকে সঙ্গে রাখবি।’
‘তুই একথা কেন বলছিস? কৌটো টাইম ট্র্যাভেল করলে আমার কি বিপদ হতে পারে?’
‘সাবধানের মার নেই।’
আমি বুঝলাম অনিমেষ কিছু জানে যা আমাকে এখন বলবেনা ৷
(৭)
আমি এখন নার্সিং হোমে৷ বাড়ির কাছেই নার্সিং হোমটা৷ ঠিক কী হয়েছিল, পুরোটা আমার মনে নেই৷ অনিমেষের কথামতো আমি অফিসের দেবরাজ সমাজপতিকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম কৌটোর উপর শেষ এক্সপেরিমেন্টটা করার আগে৷ দেবরাজকে বেশি অনুরোধ করতে হয়নি। ও সায়েন্স ফিকশন ও প্যারানর্মাল গল্পের পোকা৷ এসব বিষয়ে হলিউডের যত সিনেমা আছে সব দেখেছে৷ আজ সোমবার৷ গত শুক্রবার আমার সঙ্গে সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে এসেছিল৷ চা-বিস্কুট খেয়ে আমরা এক্সপেরিমেন্ট শুরু করলাম৷ কৌটোগুলো প্রথমে ভাল করে লক্ষ করলাম৷ না, কেউ তার নিজের জায়গা থেকে সরেনি৷
অনিমেষের কথামতো দুটো কৌটোকে একটা বড় কাচের জারে রেখে ছিলাম৷ অনিমেষ বলেছিল, ইলেকট্রিক্যালি নন কন্ডাকটর কোনও কন্টেনারে রাখতে৷ প্রথম দু’দিন কিছুই ঘটেনি৷ তৃতীয় দিনে আমি একটা কৌটো খালি করে গোলামরিচ ঢেলে হাতটা ঢুকিয়ে গোলমরিচে চাপ দিয়ে ঠেসে ভরবার চেষ্টা করছিলাম। তারপর আমার কিছু মনে নেই ৷
জ্ঞান ফিরলে দেখি, আমি নার্সিং হোমের আইসিউতে আছি৷ দেবরাজ আমাকে এখানে ভর্তি করিয়েছে৷ আমার কবজি থেকে ডান হাতটা উধাও! আশ্চর্যের কথা হল কোনও রক্তপাত হয়নি৷ আমাকে যিনি দেখছেন তিনি হলেন খ্যাতনামা সার্জেন ডঃ রাজমুন্সী৷ উনি প্রথমেই বললেন, ‘আপনার হাত যিনি কেটেছেন তিনি খুবই দক্ষ সার্জেন৷ রক্তপাত খুব কম হয়েছে৷ কিন্তু কেন তিনি আপনার হাত অপারেশন করলেন বুঝতে পারছি না৷ আপনার কি কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। আর কাটা হাতটাই বা গেল কোথায়?’
এর পর যা বললেন, তাতে আমি খুব আশ্চর্য হলাম না৷ দেবরাজকে নাকি পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়ে আট ঘণ্টা জেরা করেছে৷ তবে পরে ছেড়ে দিয়েছে৷ পুলিশ নিজের থেকেই এফআইআর করেছে। তবে তাতে দেবরাজের কোনও নাম নেই৷ আর মিলিটারির এক মেজর এসেছিলেন৷ আমাকে এখনই বাড়ি যেতে বলেছেন। নার্সিং হোমের কোনও আপত্তি নেই। তবে আমাকে একটা বন্ডে সই করতে হবে৷
(৮)
আমি বাড়ি ফিরে এসেছি। দেবরাজ আর অনিমেষের সঙ্গে এর আগেই কথা হয়েছে৷ আমার বাড়িতে রোজ দেবরাজ একবার করে আসবে৷ আমি দেবরাজের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম৷ ছেলেটি ভাল৷ বলল, ‘স্যার, অনিমেষবাবু বলেছেন আপনার হাত আপনি ফেরত পাবেন। কিন্তু অপেক্ষা করতে হবে৷ হাতসমেত আপনার কৌটো ফেরত এলেই সব কৌটোগুলি ওনার কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন।’
আমি বললাম, ‘খবর কাগজ বা টিভির লোকগুলো আমার হাতের ব্যাপারে কিছু জানে?’
‘না স্যার, হাসপাতালের লোকদের অনিমেষবাবু জানিয়েছেন, এটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা। অনেকে কৌতূহল দেখালেও কৌটোর সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক আছে কি না কেউ জানে না৷’
আমি দেবরাজের কথায় ভরসা পেলাম৷ এখন শুধু অপেক্ষা, কবে হাত ফেরত আসে৷
Tags: কৌটো, তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, রাজকুমার রায়চৌধুরী
মরেচে! এবার থেকে কৌটো কিনতে গেলে সাবধানে দেখেশুনে কিনব।