গ্রন্থ সমালোচনা – নিউ ইয়র্ক ২১৪০ – কিম স্ট্যানলি রবিনসন
লেখক: কুনাল কর্মকার
শিল্পী: অন্তর্জাল
উপন্যাস – নিউ ইয়র্ক ২১৪০
লেখক – কিম স্ট্যানলি রবিনসন
জঁর – সায়েন্স ফিকশন
সাব-জঁর – ক্লাইমেট ফিকশন (ক্লাই-ফাই)
উপন্যাসটি ২০১৮ ইউগো পুরষ্কারের জন্য মনোনীত।
অফিস টাইম। স্কাইব্রিজ দিয়ে মানুষগুলো এগিয়ে চলেছে কর্মস্থলের দিকে। বাতাসে ভাসছে সমুদ্রের সোঁদা গন্ধ। লঞ্চে বড্ড ভীড়। বড়লোকদের স্পীডবোটগুলো পাশ দিয়ে ঢেউ তুলে এগিয়ে চলেছে। শহরটা জলমগ্ন নিউ ইয়র্ক। সালটা ২১৪০। সুপার ভেনিসের তকমা ঝুলিয়ে বহুতল বাড়িগুলি একেকটি ধাপের সন্ধান দেয় যেন। জলের গভীরতা কমবেশি পঞ্চাশ ফুট। ভবিষ্যতের মহানগরটি কিন্তু আজকের মতোই প্রাণবন্ত। হয়তো বা আজকের থেকেও বেশি। সীমাহীন মৃত্যু, শরনার্থী সংকট, সামাজিক ভাঙন পেরিয়ে এক নতুন সমাজ-সংস্কৃতি রচিত হয়েছে, বাজার অর্থনীতির অনন্ত লোভের হাত ধরে।
বড়লোকদের দুনিয়াটা আলাদা, তবে মধ্যবিত্ত ও গরিবদের বসবাস জলমগ্ন ভগ্নস্তুপ আর পুরানো বহুতল অফিস বিল্ডিং-এর মধ্যে কমিউন করে। ছাদের ওপর চলে চাষ-আবাদ, আছে পশুখামারও। বিদ্যুতের জন্য সোলার সেল। শুরু হয়েছে ফ্রী ওপেন ইউনিভার্সিটি, ফ্রী ট্রেড স্কুল। শিল্পকলা জগতে চলছে নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্ট। এইসবের মধ্যে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে, চরম অসাম্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, মানুষ খুঁজছে বাজার সর্বস্বতাকে উপড়ে ফেলে নতুনভাবে বাঁচার পথ।
এই নিউ ইয়র্ক দুঃখবিলাসী নয়, বরং গরমকালে ‘একসময়ের রাজপথে’ চলে সার্ফিং, শীতকালে বরফ হয়ে যাওয়া জলপথে হাঁটতে হাঁটতে পুরানো দিনের কল্পনা করে নাগরিকরা, আর বরফে ফাটল ধরার আওয়াজ জানান দেয় বসন্ত এসে গেছে।
কিম স্ট্যানলি রবিনসনের উপন্যাসগুলো বরাবরই বৃহৎ প্রেক্ষাপট রচনা করে; এটিও তার ব্যাতিক্রম নয়। প্রায় সাড়ে ছশো পৃষ্ঠা জুড়ে লেখক শুধু নিউ ইয়র্কের কথাই বলেননি, তুলে ধরেছেন সারা পৃথিবীর বিপন্নতা। এক জলমগ্ন পৃথিবী, যেখানে জলজ প্রাণীরা লুপ্তপ্রায়। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে ভয় লাগে, যে মাত্রায় দূষণ অব্যাহত, তাতে আমাদের উত্তরপুরুষরা আদৌ বাঁচতে পারবে তো? না, উপন্যাসটি মোটেই সাবটেল নয়, বরং পাঠককে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে আজকের অবিমিাশ্রকারীতার ভবিষ্যৎ পরিনাম দেখাতে।
গল্পের গঠনশৈলী বেশ জটিল। লেখাটির মূলে আছে দুটি উপকাহিনি। একটি বিবৃত করে নিউ ইয়র্কের ওপর আছড়ে পড়া ‘সুপার সাইক্লোন’ এবং তার থেকে উদ্ভুত আর্থ-সামাজিক সংকট। অপরটি ‘মেটলাইফ বিল্ডিং’কে হোস্টাইল টেকওভার এর বিরুদ্ধে কমিউনের বিভিন্ন শ্রেণীর বাসিন্দাদের একত্র হয়ে লড়াই। এই চরিত্রগুলিই হচ্ছে উপন্যাসের মূল আকর্ষণ।
আছে অপহৃত হয়ে যাওয়া দুই কম্পিউটার হ্যাকার, আছে সেই রহস্যের তদন্তকারী পুলিস ইন্সপেক্টর, আছে দুই কিশোর যারা হঠাতই তিনশো বছর আগে ডুবে যাওয়া স্বর্ণমুদ্রা বোঝাই জাহাজের খোঁজ পায়। এই কমিউনেরই বাসিন্দা জনপ্রিয় পরিবেশপ্রেমী ভিডিও ব্লগারও লড়াইয়ে সামিল। সঙ্গে রয়েছেন সোশ্যালি আওয়্যার লবিস্ট এবং বিল্ডিং ম্যানেজারও। আর আছেন এক ফাটকাবাজ হেডজফান্ড ম্যানেজার এবং অনামি তথা রসিক নাগরিক যিনি প্রায় সূত্রধরের কাজ করে চলেন পুরো উপন্যাসটিতে।
এই মানুষগুলির সংগ্রাম, আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলিকে নিয়েই লেখক একটি বৃহৎ মোজেইক তৈরি করেছেন যার মধ্যে ফুটে উঠেছে নিউ ইয়র্কের এক অপরূপ ছবি।
কিমের লেখার সার্থকতা এখানেই যে অ্যাপোক্যালিপটিক ব্লিকনেস উপন্যাসটিকে স্পর্শ করতে পারেনি। তার নিউ ইয়র্ক আজকের মতোই হই-হট্টগোলের এক আশাবাদী কল্পলোক।
পুনশ্চঃ হার্ড সাই-ফাই প্রেমীদের জন্য আছে বিজ্ঞান তথা ইঞ্জিনিয়ারিং এর বহুল তথ্য। ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং সাই-ফাই প্রেমীদের জন্যেও রসদ প্রচুর, তাই দেরি না করে পড়া শুরু করে দিন।
Tags: কিম স্ট্যানলি রবিনসন, গ্রন্থ সমালোচনা, তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, নিউ ইয়র্ক ২১৪০
দারুণ সমালোচনা