বাঙ্ময়
লেখক: সুমিত বর্ধন
শিল্পী: রূপক ঘোষ
অ্যাপার্টমেন্টের লিফটের বাঁদিকের দেওয়ালটায় সার দিয়ে লেটারবক্স। রঙ চটে, তুবড়ে তাদের বেশিরভাগেরই দৈন্যদশা। ফ্ল্যাটের নম্বরটুকু শুধু কোনমতে পড়া যায়।
অন্যদিন অরিন্দম এদিকে ফিরেও তাকায় না, সোজা লিফটে উঠে যায়। কিন্তু আজ একটা সরু গলায় ‘অরিন্দম, চিঠি, চিঠি’ ডাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল তাকে।
আটান্ন তলার বোস সাহেব নিজের লেটারবক্স থেকে চিঠি বের করছিলেন, মাথা ঘুরিয়ে বললেন,
– ছিলেন না, নাকি? কদিন হল আপনার চিঠি এসে পড়ে আছে, এদিকে এলেই শুনতে পাই।
-না, অফিসের ট্যুরে গিয়েছিলাম।
স্লটে বুড়ো আঙ্গুল রাখে অরিন্দম, খট শব্দে খুলে যায় লেটারবক্স।
একটাই খাম। বন্ধু বাসবের চিঠি।
খুলতেই বাসবের গলা তারস্বরে ফেটে পড়ে।
‘কিরে শুয়োর, শালা অনেক ওপরে উঠে গেছিস না কি বে ? কোন খোঁজ খবর রাখিস না, পোস্টের উত্তর দিস না! শোন , পরের রবিবার আমার বাড়িতে পার্টি, সবাই আসছে, তুইও আসবি। আর না যদি আসো, তবে —-’
এরপর আরো উঁচু স্বরে গোটা পাঁচেক শ’কার ব’কারের ফিরিস্তি।
লিফটের দরজা কখন খুলে গেছে, সেন কাকীমা লিফট থেকে পা বাড়িয়েছেন অরিন্দম খেয়াল করেনি। চিঠির শেষদিকের শ’কার ব’কারগুলো যে সবই তাঁর কানে ঢুকেছে সেটা তাঁর অগ্নিদৃষ্টি দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না। তাঁর ‘অসভ্য’, ‘অভদ্র’ ইত্যাদি কয়েকটা মন্তব্য আর বোস সাহেবের তির্যক হাসিতে কান গরম হয়ে ওঠে অরিন্দমের, বাসবের চিঠিটাকে কোনমতে পকেটে পুরে তাড়াতাড়ি লিফটে উঠে পড়ে সে।
লিফটের মেন্টেনেন্স হয় খুব সামান্যই। কোনে পানের পিক, মেঝেয় ইতস্ততঃ ছড়ানো পরিত্যক্ত কাগজের টুকরো। ঘোলাটে আলো পড়া নোংরা দেওয়ালে মারা নানান হ্যাণ্ডবিল। অরিন্দমের উপস্থিতি টের পেতেই সরু, মোটা নানান গলায় চিৎকার শুরু হয়ে যায় তাদের। ‘আকর্ষণীয় ডিস্কাউন্ট, এ সুযোগ হারাবেন না’, ‘হাউস ক্লিনিং, হাউস কিপিং, রিপেয়ারিং – আপনার গেরস্থালীর যা কিছু প্রয়োজন’, ‘অল্প সুদে লোন, আজই অ্যাপ্লাই করুন।’
হ্যাণ্ডবিলগুলোকে টেনে ছেঁড়ার তীব্র ইচ্ছেটাকে কোনমতে দমন করে অরিন্দম। দরজা খোলার সাথে সাথে ছিটকে বেরিয়ে আসে লিফট থেকে।
ফ্ল্যাটের দরজার চাবিতে হাত রাখতে সেটাও একপ্রস্থ জ্ঞান দিতে শুরু করে দেয়। ‘দীপ্তেন দেখা করতে এসে দুবার ঘুরে গেছে। পরশু ইলেকট্রিসিটি বিল দেবার শেষ তারিখ। জলের চার্জ এ মাস থেকে বাড়ছে।’
কথা বাড়াতে না দিয়ে দড়াম করে এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে ফেলে অরিন্দম।
ভেতরে ঢুকতে আর এক প্রস্থ বকবকানি। প্রথমে দেওয়ালের কনসোলটা।
‘রূপসা, কার্তিক মামা আর পুলকেশদার থেকে না দেখা পোস্ট তিনটে। ক্রেডিট কার্ডের স্টেটমেন্ট এসেছে। দুটো সিনেমা ডাইউনলোড করা হয়ে গেছে।’
শেষ হতে না হতে এবার ফ্রিজটা।
‘দুধ শেষ। চারদিন আগের খাবারটা মনে হচ্ছে নষ্ট হয়ে গেছে। জলের বোতল খালি।’
মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে বাথরুমে ঢোকে অরিন্দম। একনাগাড়ে জল ছেটাতে থাকে চোখেমুখে।
-{ ২ }-
কনসোলের ‘উঠে পড়, উঠে পড়’ চিৎকারে ঘুম ভাঙে অরিন্দমের। বেলা হয়ে গেছে, বারন্দার খোলা দরজা দিয়ে রোদের আলো এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। ঝকঝকে নীল আকাশে মন্থর গতিতে ভেসে যাচ্ছে রঙবেরঙের ব্লিম্প – কোনটার নিচে প্যাসেঞ্জার কেবিন, কোনটার নিচে মালের কন্টেনার। তাদের পাশ কাটিয়ে আকাশে চক্কর মারে দু-একটা চওড়া ডানার রাজ-চিল।
ডানা ঝাপটানোর শব্দ তুলে একটা কাক এসে বসে বারন্দার রেলিঙে। ঘাড় ঘুরিয়ে দুবার তাকায় অরিন্দমের দিকে। তারপরেই বাজনার আওয়াজ তুলে ভেসে আসে বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল ‘আপনার পুরনো অ্যাপার্টমেন্টে হাঁপিয়ে উঠছেন? জায়গা কম? আলো বাতাস নেই? তাহলে – ’
অরিন্দম খেয়াল করে কাকটার ঘাড়ের কাছে চকচক করছে একটা বার্তা-ব্যাণ্ড।
ধৈর্যচ্যুতি হয় তার। একটা বই তুলে ছুঁড়ে মারে বারন্দার দিকে। কর্কশ চিৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে উড়ে যায় কাক। হাওয়ায় মিলিয়ে যায় জিঙ্গলের রেশ।
কিচেনেটের দিকে আর পা বাড়ায় না অরিন্দম , ফের ফুড প্রসেসরের বকবকানি শুনতে হবে। জামাকাপড় পালটে বেরিয়ে আসে ফ্ল্যাট থেকে। সিঁড়ি বেয়ে দুটো তলা ওপরে উঠলে চওড়া ছড়ানো টেরাস। সেখানে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে একটা ব্লিম্পকে থামায়।
-কোন দিকে?
-সেন্ট্রাল পার্ক।
সেন্ট্রাল পার্ক অরিন্দমের অফিসের উল্টোদিকে। কিন্তু তাও উঠে পড়ে অরিন্দম। লিফটের হ্যাণ্ডবিলের চিৎকার শোনার থেকে পনেরো মিনিট বেশী ট্র্যাভেল টাইম বরঞ্চ ভালো।
-{ ৩ }-
সেন্ট্রাল পার্কের ব্লিম্প টাওয়ারের লিফটটা অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হলেও অরিন্দমের প্রত্যাশা পূরণ হল না। লিফটে নোংরা হ্যাণ্ডবিল আটকানো নেই বটে, কিন্তু তার জায়গা নিয়েছে বেশ কয়েকটা বিজ্ঞাপনের পোস্টার। টাওয়ারের ওপর থেকে নিচে সাবওয়ের ট্রেন স্টেশন অবধি অরিন্দমকে তাদের পণ্যের জয়গান শুনতে শুনতে যেতে হল। ‘সুন্দর চুলের জন্যে – ’ , ‘ভাল জুতো মানেই – ’ , ‘আপনাকে গরমের দিনে ঠাণ্ডা রাখবে।’
ট্রেনের প্ল্যাটফর্মেও চলতে থাকে বিজ্ঞাপনের বাক্যস্রোত। দেওয়ালে, থামে লাগানো বিজ্ঞাপন। আর তাদের কাছাকাছি আসলেই তারা নানা সুরে কথা বলতে আরম্ভ করে – ‘সমস্ত কেনাকাটার একমাত্র ঠিকানা – ’ , ‘ইন্সিওরেন্স আপনার জীবনে আনে সুরক্ষা – ’ , ‘একান্তে নির্জনতা উপভোগ করুন আমাদের রিসর্টে –।’
শেষের বিজ্ঞাপনের আওয়াজটা কানে যেতে থমকে দাঁড়ায় অরিন্দম। দেওয়ালে আঁটা বিজ্ঞাপনে একটা সমুদ্র সৈকতের ছবি। নীল আকাশের নিচে গাঢ় নীল সমুদ্র। তীরে ঝাউ বনের সবুজ।
বিজ্ঞাপন থেকে ভেসে আসে ঢেউয়ের শব্দ আর পাতার মর্মর ধ্বনি। তন্ময় হয়ে শোনে অরিন্দম।
হুড়মুড় করে প্ল্যাটফর্মে ঢোকে ট্রেনটা। তার যান্ত্রিক আওয়াজে চাপা পড়ে যায় বিজ্ঞাপনের শব্দের হাতছানি।
ট্রেন থেকে নেমেও রেহাই নেই। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই ভেসে আসে নানান বিজ্ঞাপনের ধ্বনি মিশ্রণ। ফুটপাথের দোকানটা চেঁচায় ‘রোল ! রোল ! গরম চিকেন রোল !’। বড় দোকানের শোকেসটা আওয়াজ তোলে, ‘সেল, সেল। পঞ্চাশ পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে জীনসের প্যান্ট।’ বাসের স্ট্যাণ্ডটা জোরে জোরে বলে ‘পরের বাস দুটো বেজে পনেরো মিনিটে –।’
অতিষ্ঠ হয়ে অফিসের দিকে একরকম দৌড়তে শুরু করে অরিন্দম।
অফিসে পৌঁছে কাজে হাত দেবার আগে স্টেশনের বিজ্ঞাপনে দেখা রিসর্টের সাইটটা খুঁজে বের করে অরিন্দম। অনলাইনে বুকিং করে নিয়েই বসকে একটা তিনদিনের ছুটির অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে দেয়।
-{ ৪ }-
কেবল ঢেউয়ের গর্জন আর বাতাসের সাথে গাছের পাতার খেলা করার শব্দ। আর কোন আওয়াজ নেই। লম্বা নিশ্বাসে সমুদ্রের নোনা বাতাসের সাথে নির্জনতাটাকেও বুকের মধ্যে পুরে নেবার চেষ্টা করে অরিন্দম। মন্থর পায়ে হাঁটে বালির ওপর দিয়ে।
সূর্য অস্ত যাবার সময় হয়ে এসেছে। আকাশের নীলে অল্প অল্প করে লাগছে লালের ছোঁয়া। বসে সূর্যাস্ত দেখার জন্যে একটা বেঞ্চের দিকে পা বাড়ায় অরিন্দম। আকাশ আর সমুদ্রের লাল নীলের খেলার দিকে চোখ রেখে আরামে বেঞ্চে এলিয়ে দেয় শরীরটা।
সাথে সাথেই ফিসফিস করে ওঠে বেঞ্চটা।
‘মন ভরে সূর্যাস্ত দেখুন। আর তারপরে চলে আসুন আমাদের রেস্টো বারে। মন জুড়ানো মিউজিক আর মনোরম পানীয় – ’
বিছে কামড়ানোর মত ছিটকে যায় অরিন্দম। লম্বা লম্বা পায়ে সরে যায় বেঞ্চ থেকে দূরে। এসে দাঁড়ায় অনেকটা দূরে জলের কিনারায় একটা পাথরের পাশে।
ফিসফিস করে ওঠে পাথরও ‘পথের ক্লান্তি? আমাদের ম্যাসাজ পার্লারে – ’
মাথার মধ্যে কি একটা ফুটতে আরম্ভ করে অরিন্দমের। প্রায় একরকম ছুটতে ছুটতেই চলে আসে রিসর্টের রিসেপশনে। সামনে দুহাত তুলে প্রশ্ন করে কর্কশ কণ্ঠে,
-মজা পেয়েছেন নাকি? এর নাম নির্জন সৈকত? এখানেও সেই একই মাথা খারাপ করা বকবকানি?
কোন উত্তর না দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে থাকে রিসেপশনিস্ট। বরং কথা বলে ওঠে রিসেপশনে রাখা ফুলদানিটা – ‘প্রিয়জনের জন্যে সেরা উপহার ফুল। আমাদের ফ্লাওয়ার শপে পাবেন –।’
কথা বলে সোনালী গিলটি করা টেবিল ঘড়িটাও – ‘যাবার সময়ে বাড়িরে লোকের জন্যে উপহার নিয়ে যেতে চান ? আসুন আমাদের গিফট শপে –।’
টেবিলে রাখা গোছা করে রাখা ক্যাটালগও কথা বলে – ‘আমাদের ট্র্যাভেল ডেস্কে –’
অরিন্দমের মাথার মধ্যে ফুটতে থাকা জিনিসটার বিস্ফোরণ ঘটে। চোখের সামনে নেমে আসে একটা লাল রঙের পর্দা। এক টানে মাটিতে ছড়িয়ে দেয় ক্যাটালগগুলো।
-আরে , আরে কি করছেন?
রিসেপশনের পেছন থেকে ভেসে আসে চিৎকার।
ভ্রুক্ষেপ না করে ঘড়িটা মাটিতে ছুঁড়ে মারে অরিন্দম। মেঝের পালিশে কাঁচ আর যন্ত্রের টুকরোর অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট ফুটিয়ে তার নশ্বর জীবনে ইতি টানে ঘড়ি।
-এই! এই! সিকিউরিটি, সিকিউরিটি। ধরো ধরো।
ফুলদানিটাকে আছড়ায় অরিন্দম। অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের ওপর এবার ফুলের ইকেবানা।
পেছন থেকে কারা এসে জাপটে ধরে অরিন্দমকে। ধস্তাধস্তির মধ্যে তার চোখের সামনের লাল পর্দাটা লাল থেকে লাল, আরও গাঢ় লাল হতে হতে একসময় কালো হয়ে যায়।
কোন এক নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যায় অরিন্দম।
-{ ৫ }-
চোখের পাতার ওপর চাপানো যেন কয়েক কিলো ওজন। বহু কষ্টে চোখ খোলে অরিন্দম। ঘোলাটে দৃষ্টি স্বচ্ছ হতে সময় লাগে আরো কয়েক মিনিট।
তারপর মাথা ঘুরিয়ে দুদিকে দেখে বুঝে উঠতে আরো কিছুক্ষণ।
সে শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। তার দুপাশে সার বাঁধা খাটে শুয়ে বসে আরো অনেকে।
-ঘুম ভেঙেছে?
পাশ থেকে সামনে এগিয়ে আসে কেউ। গায়ে সাদা কোট। গলায় স্টেথোস্কোপ।
-কি হয়েছিল আমার?
-একটা নার্ভাস ব্রেকডাউন বলতে পারেন। নিন উঠে পড়ুন।
-আমি –
-আরে উঠুন, আপনি ঠিকই আছেন। শুয়ে থাকলে সারার অসুখ এ নয়। আস্তে আস্তে নামুন, মাথা ঘুরতে পারে।
-আপনি – ?
-আমি আপনার ডাক্তার। ডক্টর সুবীর বিশ্বাস। অবশ্য কেবল আপনার না। এনাদের সব্বার।
হাতটা ঘুরিয়ে পুরো ওয়ার্ডটা দেখালেন ডক্টর বিশ্বাস।
ডাক্তার সুবীর বিশ্বাসের পেছন পেছন হাঁটতে থাকে অরিন্দম। ওয়ার্ড ছাড়িয়ে এসে পড়ে করিডোরে।
-ওয়ার্ডে বাকি যাদের দেখলাম তারাও –?
-হ্যাঁ সবারই এক অসুখ। আপনার মতনই। নার্ভাস ব্রেকডাউন। তবে আপনার প্রকোপটা কম। কিছুটা অল্পের ওপর দিয়েই গেছে। আসুন।
একটা ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন ডক্টর বিশ্বাস। পেছনে অরিন্দম।
ভেতরে চওড়া টেবিল পাতা। দেওয়ালে নানান চার্ট। একপাশে বইয়ের তাক। টেবিলে জার্নাল আর বইয়ের স্তূপ।
বোঝাই যায় এটা ডক্টর বিশ্বাসের অফিস।
-বসুন!
চেয়ার টেনে নিয়ে টেবিলের সামনে ডক্টর বিশ্বাসের মুখোমুখি বসে অরিন্দম।
সাথে সাথে টেবিলের ওপর রাখা ঘড়িটা বলে ওঠে ‘এখন সময় সকাল –।’ ফুলদানীটা বলে ‘জল কমে এসেছে।’ ডেস্ক-ক্যালেণ্ডারটা বলে ‘আজ বিকেল তিনটের সময় মেডিক্যাল বোর্ডের মিটিং –।’
অরিন্দমের চোখের সামনে আবার একটা লাল পর্দা নেমে আসতে থাকে। তার মনে হয় কেমন একটা অদম্য ক্রোধ তার শিরদাঁড়া বেয়ে ক্রমশঃ জমা হচ্ছে মাথার ভেতর।
হাতটা নাড়েন ডক্টর বিশ্বাস। থেমে যায় সব কথা বলা।
হাল্কা হয়ে আসে অরিন্দমের চোখের সামনে লাল পর্দাটা। মিলিয়ে যায় শিড়দাঁড়া দিয়ে উঠতে থাকা রাগটা। স্বাভাবিক হয়ে আসে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস।
-কি হচ্ছে আমার বলুন তো?
-ডাক্তারি ভাষাটা আপনি বুঝতে পারবেন না। সোজা বাংলায় বললে রণোন্মত্তা।
-রণ উন – !
হাসেন ডক্টর বিশ্বাস।
-হ্যাঁ রণোন্মত্তা ! বাংলাটাও বোঝা গেল না? আচ্ছা বোঝাই তাহলে। এই ছবিটা দেখুন।
টেবিলে রাখা একটা ছবি অরিন্দমের সামনে বাড়িয়ে ধরলেন ডক্টর বিশ্বাস। ঝুঁকে পড়ে দেখল অরিন্দম। আদিম মানুষের ছবি।
এটা তো আদিম মানুষ মনে হচ্ছে।
-কাছাকাছি গেছেন। তবে আদিম মানব ঠিক না। বরং বলতে পারেন অর্ধমানব। ইনি আমাদের প্রায় বিশ লক্ষ বছর আগেকার পূর্বপুরুষ – হোমো ইরেক্টাস। চার পা ছেড়ে সবে দু পায়ে হাঁটতে শিখেছেন।
আঙুল দিয়ে প্রথম ছবির নিচে আরো দুটো ছবি দেখালেন ডক্টর বিশ্বাস।
-এই হোমো ইরেক্টাসের থেকে আদিম মানুষের এই দুটো প্রজাতি বেরোয়। প্রথমটার বংশধর আমরা, আর দ্বিতীয়টা অবলুপ্ত হয়ে গেছে।
চেয়ার ছেড়ে ওঠেন ডক্টর বিশ্বাস। তাক থেকে দুহাতে কি তুলে এনে সন্তর্পণে নাবিয়ে রাখেন টেবিলের ওপর।
দু-দুটো মানুষের মাথার খুলি। একটা বড়। অন্যটা তার তুলনায় বেশ ছোট। বড়টার ওপর হাত রাখেন ডক্টর বিশ্বাস।
-এই দেখুন। এটা হচ্ছে আধুনিক মানুষের মাথা। মাথার পেছনটা কেমন উঁচু হয়ে আছে দেখেছেন? এটাকে বলে অক্সিপিটাল বান।
বড় খুলিটা নামিয়ে রেখে ছোটটা তুলে নেন ডক্টর বিশ্বাস।
-এবার এইটা দেখুন। এটা মানুষের লুপ্ত প্রজাতির মাথা। কি দেখছেন?
-সাইজে ছোট।
-বেশ। আর?
-মাথার পেছনের উঁচু জায়গাটা –
-অক্সিপিটাল বান।
-হ্যাঁ। ওটা নেই।
-ঠিক। আমাদের খুলি বড়। মানে আমাদের ব্রেনের সাইজ বড়। এছাড়াও আমাদের মাথায় একটা বিশেষ অংশ আছে, যেটা এই লুপ্ত প্রজাতির ছিল না।
-কিন্তু এর সাথে –
-বলছি। দাঁড়ান। এটা রেখে আসি।
করোটি দুটো তাকের ওপর ফেরৎ রাখলেন ডক্টর বিশ্বাস। একপাশে একটা বড় জানলা, ছিটকিনি খুলে তারা পাল্লা দুটো ঠেলে দিলেন বাইরের দিকে।
এক ঝলক ভিজে হাওয়া জানলা দিয়ে বয়ে নিয়ে আসে কোন একটা অজানা ফুলের সুবাস আর পাখির ডাক। চেয়ারে এসে বসেন ডক্টর বিশ্বাস।
-আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন ধীরে ধীরে সভ্য হচ্ছে, তখনকার কথাটা চিন্তা করুন। পৃথিবী এক দীর্ঘ তুষার যুগের কবলে। চাষবাস সম্ভব নয়, জীবন ধারণের একমাত্র উপায় শিকার।
-সে সময়কার জন্তু-জানোয়ারগুলো তো খুব বড় হত।
-হ্যাঁ, শরীর যত বড়, শরীরে তত বেশী তাপ সঞ্চয় করা যায়। শীতের হাত থেকে বাঁচতে তত সুবিধে। পৃথিবীতে তখন বিশাল আকারের ম্যামথ, গণ্ডার, ভাল্লুক, বাঘ এই সব মেগাফনার রাজত্ব।
বুঝিবা ডক্টর বিশ্বাসের কথায় সায় কোথায় জোরে একটা বেল বেজে উঠল।
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন ডক্টর বিশ্বাস।
-আপাততঃ এই পর্যন্তই। খাবার সময় হয় গেছে, চলুন। বাকিটা বিকেলে।
-{ ৬ }-
বিকেলে অবশ্য ডক্টর বিশ্বাসের দেখা পাওয়া গেলা না। পরের দিন একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল তিনি শহরে গেছেন, কবে ফিরবেন জানা নেই।
-স্যার কখন আসেন আর কখন যান আমরাই জানি না, তো আপনাকে কি বলব?
পরের দিন দুপুর বেলার দিকে অরিন্দমের চোখটা খানিক বুজে এসেছে, পাশ থেকে হাল্কা গলায় কেউ ডাকল।
-ভাই শুনছেন?
পাশের বেডের পেশেণ্ট। প্রৌঢ় মানুষ। চোখে মুখে গ্লানি আর অবসাদের ছাপ স্পষ্ট
ওয়ার্ডের পেশেন্টদের এক একজনের অবস্থা এক একরকম। কেউ থেকে থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, কেউ আপনমনেই সারাক্ষণ বিড়বিড় করে বকে। এনাকে অবশ্য অরিন্দম শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আর মাঝে মধ্যে জামার হাতায় চোখের গড়ানো জল মোছা ছাড়া গত দু-দিন আর কিছুই করতে দেখে নি।
-আমাকে একটু জল এনে দেবেন বাইরের কুলার থেকে ? আমি নিজেই যেতাম, কিন্তু – !
অরিন্দম খেয়াল করল প্রৌঢ় মানুষটির হাতটা হ্যাণ্ডকাফ দিয়ে বেডের ফ্রেমের সাথে আটকানো।
বাইরে থেকে নিয়ে এসে জলের গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরল অরিন্দম।
-আপনার নামটা জানা হল না।
-গৌতম। গৌতম দেবনাথ।
-আপনার -?
-আমার কি হয়েছিল আমি নিজেই জানি না ভাই। চোখের ওপর কেমন একটা লাল ঘোরের মতন নেমে এল। তারপর – তারপর আর কিছু মনে নেই। সবাই বলছে আমি নাকি আমার বউ আর ছেলেকে ছুরি দিয়ে –
কথা শেষ না করে ডুকরে কেঁদে উঠলেন গৌতম দেবনাথ।
মনের মধ্য একটা অজানা আতঙ্ক নিয়ে নীরবে সরে এল অরিন্দম।
-{ ৭ }-
মন্থর গতিতে কটা দিন কাটে অরিন্দমের। তার কোথাও যেতে আসতে বাধা নেই বটে, কিন্তু বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের কোন উপায় নেই।
সত্যি কথা বলতে কি হাসপাতালের পরিবেশ মনে হয় একশো বছর পিছিয়ে আছে। এখানে ঘড়ি কথা না বলে ঢং ঢং করে বাজে, দরজা কোন কথা না বলে নীরবেই খোলে বন্ধ হয়, প্যান্ট্রির ফুড প্রসেসরও একটা পিং আওয়াজ তুলে ক্ষান্ত হয়, অনর্থক বাক্যব্যয় করে না।
হাসপাতালের পেছনে একটা ঘাসে ছাওয়া মাঠ। বিকেলের দিকে সেখানে একটা বেঞ্চে এসে বসে অরিন্দম।
না, বেঞ্চ বোবাই থাকে। তাকে কিছু শোনানোর চেষ্টা করে না। বরঞ্চ দু-একটা পাখি উড়ে এসে বসে নিজেদের ভাষায় অরিন্দমকে গান শুনিয়ে যায়। গলা তাদের বার্তা ব্যাণ্ডের ফাঁস থেকে মুক্ত।
হাসপাতালটা শহর থেকে অনেক দূরে। দিগন্তের ওপর আবছা দেখা যায় শহরের উঁচু টাওয়ারগুলো। নীল আকাশ বেয়ে উড়ে যায় সেখানে থেকে আসা বিশাল তিমির মত মালবাহী ব্লিম্পগুলো।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। আকাশের গাঢ় হয়ে আসা নীলের পটভূমিকায় শব্দ বলতে কেবল পাখিদের ঘরে ফেরার কলতান। প্রকৃতির সৌন্দর্যে মগ্ন অরিন্দম খেয়াল করলো তার পাশে বেঞ্চে এসে কে বসেছে।
ডক্টর সুবীর বিশ্বাস।
-আপনি ছিলেন না কদিন?
-নাঃ! হঠাৎ যেতে হল।
-কেন?
-আর কেন ? মেডিক্যাল এমার্জেন্সি। আপনার ব্রেকডাউন অল্প মাত্রায় হয়েছিল, কিন্তু এক একজনের ওপর এর প্রভাব সাংঘাতিক হয়। সেই রকম একজনের চিকিৎসার জন্যে যেতে হল।
ব্রেকডাউনের ফল যে মারাত্মক হতে পারে অবশ্য এই দিন কয়েকের মধ্যেই অরিন্দম বুঝে গেছে। বিশেষতঃ গৌতম দেবনাথকে দেখে।
মাথা নাড়লেন ডক্টর বিশ্বাস।
-এটা একেবারে মহামারীর মত ছড়াচ্ছে। সরকার থেকে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা না নিলে–
-ওই যে কি বলছিলেন, রণো না কি?
-হ্যাঁ রণোন্মত্তা। কদ্দূর কথা হয়েছিল আমাদের আগে দিন?
-ওই তুষার যুগের বিশাল পশু।
-হ্যাঁ। সে যুগের মানুষ তখন পুরোদস্তুর শিকারি। কিন্তু অত বড় পশু শিকার করতে গেলে একসাথে দল বেঁধে করতে হয়। এবার মনে করুন চার-পাঁচজনে মিলে একটা বড় ম্যামথকে ঘিরে ধরেছে। সবাই দূরে দূরে আছে, চেঁচিয়ে কথা বললে শিকার টের পেয়ে যাবে। এখন যদি কোন মতে নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করা যায়, তাহলে টিমওয়ার্কটা বেটার হয় , শিকারকে কব্জা করতে সুবিধে হয়।
-সেই থেকে আমাদের এই মনে মনে কথা বলার সূত্রপাত?
-ঠিক বলেছেন। কিন্তু কি জানেন? এর উদ্ভব হয়েছিল শিকারের প্রয়োজনে। এটার বেশি ব্যবহার করলেই তখন মস্তিষ্কের ধারণা হয় যে একটা সাংঘাতিক লড়াই হতে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের একটা অংশ তখন মানুষটাকে একেবারে মারমুখী করে তোলে। এই অবস্থাটার একটা ডাক্তারি নাম আছে বটে, কিন্তু আমি নাম দিয়েছি রণোন্মত্তা – লড়াই করার উন্মাদনা।
-আমারও তাহলে -।
-হ্যাঁ আপনারও ওই অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্যে নয়। চিন্তার কিছু নেই, ভাল হয়ে যাবেন। এখন ভেতরে চলুন, অন্ধকার হয়ে গেছে।
-{ ৮ }-
সেদিন রাত্রে অরিন্দমের ঘুমের মধ্যেই মনে হল অনেক লোকের চেঁচামেচি আর দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ পাচ্ছে। কিন্তু ওষুধ খাওয়া ঘুমের ঘোর, কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফের ঘুমিয়ে পড়ল সে।
সকালে নজরে পড়ল পাশে গৌতম দেবনাথের বিছানাটা খালি।
দুজন অ্যাটেন্ডেন্টকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পাওয়া গেল না। গম্ভীর মুখে ঘাড় নেড়ে উত্তর না দিয়েই তারা সরে গেল।
শেষ পর্যন্ত ডক্টর বিশ্বাসের দরজাতেই টোকা মারল অরিন্দম।
-আসতে পার?
-হ্যাঁ , বলুন।
-আমার পাশের বেডের গৌতম দেবনাথ –
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর বিশ্বাস।
-কাল রাতে মারা গেছে। টেরাস থেকে পড়ে গিয়ে।
-টেরাস থেকে পড়ে! সেকি !
বিস্ময়ের সুর অরিন্দমের গলায়।
-কাল রাতে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাদের কোন স্টাফ ভুল করে তার ডাইরিটা বাথরুমে ফেলে এসেছিল। সেটার আওয়াজে ক্ষেপে গিয়ে প্রথমে অ্যাটেন্ডেন্টদের আক্রমণ করল, তারপর আমাকে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠে টেরাসে একটা ব্লিম্প বাঁধা ছিল, সেটার দিকে তেড়ে যেতে গিয়ে, টাল সামলাতে না পেরে একেবারে নিচে।
দুহাতে মাথাটা চেপে ধরে চেয়ারে বসে পড়ল অরিন্দম।
-কিন্তু আমাদের এই অসুখ হল কি করে?
-প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যাওয়ার খেসারত দিচ্ছি আমরা।
-প্রকৃতির নিয়ম? কোন নিয়ম?
-বলছি। আচ্ছা বলুন তো আমরা কত রকম ভাবে কথা বলি?
-দুভাবে। মনে মনে আর জোরে জোরে।
-বেশ। এবার বলুন আপনি মনে মনে কার কার সাথে কথা বলতে পারেন।
-বাবা মা, কয়েকজন নিকট আত্মীয়, দু-একজন ক্লোজ ফ্রেণ্ড।
-মানে যারা আপনার খুব কাছের মানুষ তাদেরই সাথেই তো?
-হ্যাঁ।
শরীরটা চেয়ারে হেলিয়ে দিলেন ডক্টর বিশ্বাস।
-এই যে আপনি জোরে জোরে কথা বলা বললেন সেটা আসলে কি ? আপনি মুখ আর জিভ দিয়ে হাওয়ায় শব্দের তরঙ্গ তুলছেন। সেই তরঙ্গ আবার আমার কানের পর্দায় আঘাত করছে, আমি শুনতে পাচ্ছি। এই তো?
-হ্যাঁ ঠিক।
-আর যাকে আপনি মনে মনে কথা বলেন সেটা?
-সেটা – সেটা কি করে হয় ঠিক জানি না।
চেয়ার ছেড়ে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন ডক্টর বিশ্বাস। বাইরে কোথাও একটা পাখি ডাকছে, আপন মনে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন তার দিকে।
-ডাক্তারি ভাষা হয়ত বুঝতে অসুবিধে হবে। দর্শনের ভাষায় বলি বরঞ্চ। আমাদের কথা বলার যে প্রক্রিয়া তাকে বলে বাক। এর চারটে ধাপ আছে। প্রথমে আপনার অবচেতন মনে একটা ইচ্ছার উদ্রেক হল। ধরুন আপনার আম খাবার শখ হল। এই ধাপটাকে বলে পরা। তারপরে আপনার মনের মধ্যে একটা আমের ছবি ভেসে উঠল। এই ধাপের নাম পশ্যন্তি। মানে আপনি বস্তুটকে মানস চক্ষে দেখতে পেলেন। তার পরে ‘আম’ শব্দটাকে আপনি মনের মধ্য গঠন করলেন। এই ধাপের নাম মধ্যমা। শেষ ধাপে আপনি মুখে ‘আম’ শব্দটা উচ্চারণ করলেন। একে বলে বৈখরী। চলতি ভাষায় জোরে বলা।
-আর মনে মনে কথা বলা?
-মধ্যমা। মধ্যমাকে আমরা চলতি কথায় বলি মনে মনে কথা বলা।
-কিন্তু সেটা তো আমরা সবার সাথে বলতে পারি না।
-ঠিক কথা। মধ্যমার ব্যবহার মানুষ আয়ত্ত করেছিল শিকারের প্রয়োজনে। শিকার যারা করতে যেত তারা সব এক পরিবারের বা গোষ্ঠির মানুষ। সেইজন্যে মধ্যমার ভাষা বুঝতে গেলে কারোর সাথে বেশ কিছুদিন কাটাতে হয়। আপনি আর আমি যদি মধ্যমায় কথা বলতে চাই তাহলে আমাদেরকে বছরখানেক এক সাথে কাটাতে হবে। তা না হলে আমাদের বৈখরীই ভরসা।
-কিন্তু কেন ?
-মনে করুন আমাদের দুজনের কাছে একটা করে সেতার আছে। আমি যদি আমার সেতারটা আপনার সাথে একসুরে বাঁধতে চাই, আপনার সুরটাকে আমাকে খানিক্ষণ শুনে বুঝতে হবে। অর্থাৎ আপনার সেতারের সুরের ফ্রিকোয়েন্সিটা আমি বুঝব , তবে নিজেরটাকে মেলাতে পারব।
পাখির ডাক বন্ধ হয়ে গেছে, তবুও ডক্টর বিশ্বাসের দৃষ্টি আটকে বাইরে দিকেই।
-প্রাকৃতিক নিয়মে এই মেলানোটা হতে সময় লাগে। কিন্তু যন্ত্রের তো আর সে সীমাবদ্ধতা নেই। গত পঞ্চাশ বছরে আমরা নানা প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ফেললাম, সেই সব গ্যাজেট বৈখরী ছেড়ে সোজা আমাদের সাথে মধ্যমাতে কথা বলতে লাগল। যে ক্ষমতাটা মাঝে মধ্যে ব্যবহারের জন্যে সৃষ্টি, সেটা যথেচ্ছ ব্যবহার হতে লাগল। তার ফল হচ্ছে এই। নার্ভাস ব্রেক ডাউন, মারমুখী ব্যবহার, হিংস্র উন্মাদনা, সব হু হু করে ছড়িয়ে পড়ছে।
-{ ৯ }-
পরের দিন সকালে ট্রলি নিয়ে অরিন্দমকে নিতে এল দুই অ্যাটেণ্ডেন্ট।
-আমি হেঁটেই যেতে পারব।
-নিয়ম নেই। নিন শুয়ে পড়ুন।
শুয়ে থাকা অরিন্দমকে নিয়ে হাতের ঠেলায় গড়িয়ে চলে ট্রলি। করিডোরের পর করিডোর পারে হয়ে এসে থামে নানা যন্ত্রপাতি ঘেরা একটা ঘরে।
একজন এগিয়ে আসে। হাতে হেলমেটের মতন একটা জিনিষ, তার থেকে নেমে এসেছে গোছা গোছা তার। অভ্যস্ত হাতে অরিন্দমের মাথায় পরিয়ে দিয়ে টেনে দেয় থুতনির স্ট্র্যাপ।
-এবার একটা ইঞ্জেকশন দেব।
হাতে একটা ছুঁচ ফোটানোর জ্বালা অনুভব করে অরিন্দম। চোখটা কেমন ভারি হয়ে আসে। তার মধ্যেই খেয়াল করে তার হাত পা কেউ স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকে দিচ্ছে।
ডক্টর বিশ্বাসের মাথাটা ঝুঁকে আসে তার মুখের ওপর।
-আমরা আপনার কয়েকটা টেস্ট করব। ঘাবড়াবেন না। ঘুমনোর চেষ্টা করুন।
আরো ভারী হয়ে বন্ধ হয়ে আসতে চায় অরিন্দমের চোখের পাতা। কিন্তু হঠাৎই তার মাথার মধ্যে যেন শুরু হয়ে যায় একসাথে বহু কণ্ঠে কথা বলা।
‘আজ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে –’, ‘- ব্যাঙ্কের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করার প্রক্রিয়া –’ , ‘কালকের আবহাওয়া- ’ , ‘- সজল কাজল মেঘের –।’
সমস্ত শরীর টানটান হয়ে ওঠে অরিন্দমের, ছটফট করে ছাড়াতে চায় হাতে পায়ের বাঁধন। গলা দিয়ে উঠে আসে একটা জান্তব চিৎকার। আর তারপর একটা অন্ধকারে তলিয়ে যায় তার চেতনা।
-{ ১০ }-
আগের দিনের মতই ভারী চোখের পাতাটা অতি কষ্টে টেনে খোলে অরিন্দম।
সেই যন্ত্রপাতি লাগানো ঘরেই সে শুয়ে আছে। তবে হাতে পায়ের বাঁধনগুলো খোলা, মাথার হেলমেটটাও নেই।
পাশে একটা চেয়ারে বসে ডক্টর বিশ্বাস।
-উঠে পড়েছেন ? একটা জিনিষ মাপার জন্যে আপনাকে একটু কষ্ট দিতে হল
-কি মাপলেন ?
-মধ্যমা ব্যবহারের সময় আপনার ব্রেনের ওয়েভ প্যাটার্ন। এবার এটা মাথায় পরে দেখুন তো !
অরিন্দমের দিকে একটা হেডব্যাণ্ড বাড়িয়ে ধরেন ডক্টর বিশ্বাস।
-কি এটা ?
-প্রোটেকশন। আপনার ব্রেনে ওয়েভের সাথে মেপে ক্যালিব্রেট করা। পরে নিন, তারপর বলছি।
মাথায় ব্যাণ্ডটা লাগানোর সাথে সাথেই একটা মার্কেটিং ক্যাটালগ অরিন্দমের সামনে মেলে ধরলেন ডক্টর বিশ্বাস।
-কিছু টের পাচ্ছেন ?
-না ! কিচ্ছু না ?
-বেশ। এবার ব্যাণ্ডটা খুলুন।
হেডব্যাণ্ড খোলার সাথেই বক্তৃতা আরম্ভ করে দিল ক্যাটালগ ‘– আমাদের সুবিশাল স্টোরে আপনি পাবেন-।’
চমকে পেছন দিকে ছিটকে গেল অরিন্দম। আরও কি করতো বলা যায় না, কিন্তু ক্যাটালগ ভাঁজ করে ফেললেন ডক্টর বিশ্বাস, থেমে গেল বিজ্ঞাপনের আওয়াজ।
-এবার বুঝলেন? এটা এবার থেকে আপনার সর্বক্ষণের সঙ্গী। সবসময়ে পরে থাকবেন।
বেশ কয়েকটা মিনিট লাগল অরিন্দমের বুকের ভেতরের হাতুড়ির আওয়াজটা থামতে। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে তুলে দেখল হেডব্যাণ্ডটা।
-এটা – ?
-কোন গ্যাজেট আপনার সাথে মধ্যমা ব্যবহার করে কথা বলতে চাইলে এটা আটকাবে। যন্ত্র ছাড়া আমরা অচল। যন্ত্রের ব্যবহার তো আর বন্ধ করা যাবে না, সুতরাং প্রয়োজন মত খুলে নেবেন, আবার কাজ হয়ে গেলে পরে ফেলবেন। যেন অহেতুক মধ্যমা ব্যবহার না হয়।
-{ ১১ }-
হাসপাতাল থেকে ফের জীবনের ব্যস্ততায় ফিরে যাবার সময়। চলে যাবার আগে ডক্টর বিশ্বাসের সঙ্গে একবার দেখা করতে এল অরিন্দম।
অরিন্দমের ধন্যবাদটা হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলেন ডক্টর বিশ্বাস।
– আর ছাড়ুন ওসব কথা। আপনি ভাল থাকবেন, সাবধানে থাকবেন। ব্যাণ্ডটা সবসময় পড়ে থাকবেন। কোন রকম অসুবিধে হলেই সাথে সাথে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
বেরিয়ে যাচ্ছে অরিন্দম, টেবিলে রাখা আদিম মানবের ছবিটার দিকে নজর গেল তার।
-একটা কথা মনে এল। হোমো ইরেক্টাসের অন্য প্রজাতিটা লুপ্ত হয়ে গেল কেন ?
-বিবর্তনের নিয়মে। আমাদের সাথে পাল্লা দিতে পারে নি বলে। দুটো প্রজাতির খুলি তো দেখেছেন। লুপ্ত প্রজাতিটির মাথায় অক্সিপিটাল বান ছিল না। এটা থেকে অনুমান করা হয় যে খুব সম্ভবতঃ মস্তিষ্কের যে অংশে মধ্যমাতে কথা বলার ক্ষমতা থাকে, সেটা ওদের ছিল না। কেবল বৈখরীতেই ওদের কাজ চালাতে হত। মধ্যমার ক্ষমতা থাকাতে আমাদের পূর্বপুরুষরা শিকার বেশি পেত, অতএব সার্ভাইভাল অফ দি ফিটেস্টের লড়াইটা তারাই জেতে।
হাত বাড়িয়ে ছবিটা তুলে নিল অরিন্দম।
-এটা আমার কাছে রাখতে পারি ?
-নিশ্চই। নিয়ে যান। দেখলে আমাদের কথা মনে পড়বে আপনার।
-{ ১২ }-
সাদা মেঘের পাশ কাটিয়ে নীল আকাশে বিলম্বিত লয়ে ভেসে যায় ব্লিম্প। নিচে সরে সরে যায় সবুজের নানান আলপনা।
গদি মোড়া চেয়ারে আধশোয়া হয়ে ডক্টর বিশ্বাসের কাছ থেকে চেয়ে আনা ছবিটা দেখতে থাকে অরিন্দম। বিশ্রামের মন্থর অলসতায় নিজের মনে বুনে চলে কল্পনার নানা জাল।
কেমন হত এই পৃথিবীটার চেহারা, যদি মানুষের কথা বলার জন্যে কেবল থাকত বৈখরী, মধ্যমা নয়? মানুষ, যন্ত্র কেউই পারতো না মনে মনে কথা বলতে?
কেমন হত, যদি তারা নয়, বিবর্তনের দৌড়ে জিতে যেত হোমো ইরেক্টাসের অন্য বংশধারাটি?
কেমন হত, যদি আজ পৃথিবীর মালিক হত নিয়েনডারথাল নয়, হোমো সেপিয়েন্স?
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, রূপক ঘোষ, সুমিত বর্ধন