৪২ এর খপ্পরে – একটি কল্পবিশ্ব ইভেন্ট
লেখক: গ্রুপ ইভেন্ট
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
৪২ এর খপ্পরে – একটি কল্পবিশ্ব ইভেন্ট
“৪২ আপাতদৃষ্টিতে একটি সামান্য ছোট্ট নম্বর, পাঁচে না থাকলেও সাতে আছে যদিও! তা সেই সংখ্যাকেই দুম করে রাজার আসনে বসিয়ে, ডগ্লাস অ্যাডামস সাহেব তার বিখ্যাত বই ‘দ্যা হিচহাইকারস গাইড টু দ্যা গ্যালাক্সি’তে বলে বসলেন,- প্রাণ, বিশ্বজগৎ আর সমস্ত কিছুকে নিয়ে যে পরম প্রশ্ন তার উত্তর হল ৪২! তারপর বহু বছর ধরে বহু পণ্ডিত খোঁজার চেষ্টা করেছেন সেই পরম প্রশ্নকে, কিন্তু কেউ একমত হননি। আমরাও কল্পবিজ্ঞান গ্রুপের সদস্যদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কি এই ৪২ এর রহস্য? কেন বিশ্ব ব্রম্ভান্ডে এত গুরুত্ব এই সংখ্যাটির। জবাবে পেয়েছি কল্পবিজ্ঞান/ফ্যান্টাসি থেকে হাস্যরসাত্মক একঝাক অনুগল্প! সব গল্পের মধ্যে একটাই মিল শুধু, অসামান্য কল্পনাশক্তির প্রয়োগে বন্ধুরা গড়ে তুলেছেন দারুন সব থিয়োরি!”
।।১।।
সাতটা তো বোঝা গেল। স্লাইট এক্সপ্যান্ড করেছি। বাকি রইল ৭, ৬ আর ১ -এর গুণ। সৃষ্টির তিন ফ্যাক্টর – গোটা সৃষ্টিকর্ম, তার অ্যাকটিভ অংশ আর তার প্যাসিভ অংশ। (৭ দিন, ৬ দিন আর একদিন) তাদের গুণ করার মাধ্যমে স্রষ্টা এক গভীরতর অঙ্কের ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন কি? আপাতদৃষ্টিতে ওভারল্যাপিং ফ্যাক্টর হলেও আসলে তারা অন্য কোন লেভেলে ইনডিপেন্ডেন্ট? আর তাই গোটাটাকে বুঝতে গেলে তাদের ইউনিয়ন চাই? ৭ -এর মধ্যেই তাহলে ৪২ নেস্টেড থাকে?
– দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
***
।।২।।
৪২-এর সাইফি ব্যাখ্যা দেওয়ার বদলে আমি বরং একটা গল্প বলি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফট গানের ঠেলায় সুন্দরবনে পড়ে যাওয়া একটা ফ্লাইং সসারের বাসিন্দারা বছর পাঁচেক পর তেভাগা আন্দোলনে পুলিশের গুলি থেকে বাঁচার জন্যে শহরে আসে। ‘বিয়াল্লিশ’ সিনেমায় বিকাশ রায়ের অভিনয় দেখে তারা ফিদা হয়ে যায়। পরে তাদেরই একজন ডগলাস অ্যাডামস-এর মাথায় এই সংখ্যাটা গুঁজে দিয়ে যায়।
-ঋজু গাঙ্গুলি
***
।।৩।।
আমি আর একটু লিটারারি-জঁর স্পেসিফিক বিশ্লেষণ দিচ্ছি বক্তব্যটির স্বার্থে যদিও তা আদৌ সেই অর্থে ‘কল্পবৈজ্ঞানিক’ নয়। The Hitchhiker’s Guide to the Galaxy একটা স্যাটায়ার-কমেডি-অ্যাবসারড-ফ্যান্টাসি-এস এফ হাইব্রিড যেটা আমাদের সেন্স অফ জেনেরিক আইডেন্টিটিকে ডিসরাপ্ট করে। সেটা মিস্টার অ্যাডামসের উদ্দেশ্যও ছিল।
ব্রিটিশরা পোস্ট ওয়ার পিরিয়ডে একটা অদ্ভুত স্লাই, ডিসপ্যাশনেট, ডিসএনগেজড, সিনিকাল সেন্স অফ হিউমার ডেভেলপ করে যেটার উৎস বারনারড শ আর বেকেটের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। রাজনৈতিক – সামাজিকভাবে ডিসল্যুশন ওফ এম্পায়ার আর আমেরিকান সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভুত্ব এটার জন্য দায়ী।
তা সে যাই হোক, অ্যাডামস নিজেই এই পারটিকুলার নাম্বারটাতে কোনও বিশেষ তাৎপর্য অ্যাটাচ করতে চাননি। এখানে, আমার মনে হয়, একটা সুইফটিয়ান (Swiftian) পদ্ধতিতে দ্য জোক ইজ অন আস; আমরাই এর টার্গেট, আমরা যারা প্রত্যেক পরিঘটনার পেছনে একটা গভীরতর তাৎপর্য বা কনোটেশন খুঁজে বার করার চেষ্টা করি। এটা একটা নিছক আরবিট্রারি সংখ্যা যেটার নিজস্ব কোনও গুরুত্ব নেই, যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনও এস্টিমেটেড বা হাইপোথেটিক্যাল গুরুত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে পড়ে পাঠক সেটা খুঁজতে আরম্ভ করে এইটা ভেবে যে সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে যায় না! এইরকম ন্যারেটিভ ফাঁদ কিন্তু জোনাথন সুইফট এবং হেনরি ফীল্ডিং (টম জোন্স-এ) অনেক আগেই পাতা শিখিয়ে গেছেন।
– দিগন্ত ভট্টাচার্য্য
***
।।৪।।
বিয়াল্লিশের প্যাঁচে পড়ে নাটবল্টু চক্র-
কয়েকটা নাট খুলেই গেল, কোমর হল বক্র।
সময়ের ওই জন্মারম্ভে বিয়াল্লিশের চাপে,
ব্রহ্মা হলেন আদিকণা – সৃষ্টি করেন মাপে।
বিয়াল্লিশের ফাঁদে পড়ে কল্পবিদের সারি-
দিলেন কত ব্যাখ্যান তার নাড়িয়ে সাদা দাড়ি।
বাইনারি তে দশের সারি, রামধনুরও জন্ম
জানতামই এসব নাকি বিয়াল্লিশের কর্ম।
জীবন কি আর বিয়াল্লিশেই আটকে থাকতে পারে??
প্রশ্নখানায় উত্তর খুঁজে মরছে বারে বারে।
চল্লিশে তেই তরুন বিবেক ইহলোকের মায়া –
কাটিয়ে যান -সেখানেও কি বিয়াল্লিশের ছায়া??
মন্বন্তর চোখে ভাসে বিয়াল্লিশের নামে –
কল্পলোকের স্বপ্ন ভেজে, বুভুক্ষারই ঘামে।
– সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
।।৫।।
ডি প্রাইম তার গবেষণাগারে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন। তৃতীয় মাত্রার মহাবিশ্বের এই সিমুলেশনটা কিছুতেই স্টেবল হচ্ছে না। লাইফ আর আন্টি লাইফ ইকুয়েশন দুটো ব্যালেন্স করতে একটা র্যান্ডমনেস প্রয়োজন। সামনের খোলা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে একটা শূন্যস্থান, র্যান্ডমনেসের বীজ। এই সংখ্যাটির উপরেই নির্ভর করবে এই জগতের সমস্ত জড় ও জীবিত প্রাণীর ভাগ্য। প্রতি মুহূর্ত এতগুলি সম্ভাবনা থেকে বেছে নেওয়া হবে একটিকে। সংখ্যাটি খুব ছোট হলে কোন বৈচিত্র্য থাকবে না মহাবিশ্বে, আবার খুব বড় হলে সবকিছুতে ভীষণ রকম সাম্যের অভাব দেখা দেবে। সেই ক্ষেত্রে পরীক্ষা শেষ হবার আগেই ধ্বংস হয়ে যাবে সিমুলেনশন। চোখ বন্ধ করে ভাবতে ভাবতে ডি-এর মনে পড়ে গেল প্রেমিকা জি প্রাইমের মুখটা। সমস্ত নবম মাত্রায় ওইরকম সুন্দরী আর কাউকে দেখেননি ডি। বিশেষ করে জি-এর ৪২টা চোখের খ্যাতি সারা বিশ্ব জুড়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মত ডি-এর আঙুল বসিয়ে দিল ৪২ সংখ্যাটা ইকুয়েশনের মধ্যে।
– দীপ ঘোষ
***
।।৬।।
দশমিক পদ্ধতি = দশটা ইউনিক কাউন্টিং ক্যারেকটার ও তারপর তাদের গ্রুপ সংখ্যা ও তারপর যেকোন একটা করে ক্যারেকটার দিয়ে গণনা এগোনো। এই হিসেবে ৬ টাইম ৯ হল ৫ গ্রুপ ১০ (তাকে লিখি ৫) ও তারপরে একটা ক্যারেকটার (৪). এবারে তেরোমিক একটা সিস্টেম ডিফাইন কর। তাতে তেরোটা ইউনিক ক্যারেকটার ও তারপর তার গ্রুপ সংখ্যা ফলোড বাই ১৩টা ক্যারেকটারের একটা। এই ১৩ ভিত্তিক পদ্ধতিতে ৬x৯ হবে চার গ্রুপ ১৩ (তাকে লিখি ৪) ফলোড বাই দা ক্যারেকটার ২, মানে ৪২. এবারে করো দেখি ৬x৬ = ২২.
– দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
***
।।৭।।
আদমের ছোট্ট ফেরিযানটির ইঞ্জিন সচল হয়ে উঠেছে। আর দেরি নেই। শেষবারের মত স্বর্গগ্রহের বাতাসে বুক ভরে নিতে গিয়ে তার চোখে জল এল। মনিটারে ত্রিমাত্রিক ঈশ্বরচিত্রের করুণাঘন চোখদুটির দিকে চেয়ে সে প্রশ্ন করল, সৃষ্টির মূল প্রশ্ন একটিই। হে পিতা, বলে দিন, কবে আমাদের বন্দিদশা থেকে উদ্ধারের পথ হবে। ঈশ্বর হেসে বললেন ৪২। সঙ্গেসঙ্গে যানটি উড়াল দিল বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছেড়ে প্রান্তিক এক নক্ষত্রমণ্ডলের এক অকিঞ্চিৎকর কারাগ্রহের পথে।
ঈশ্বর মিথ্যা বলেন না। আদমের ৪২তম প্রজন্মে ঈশ্বরপুত্র পৃথিবীতে এলেন। তারপর… (ওল্ড টেস্টামেন্ট নিউ বটল)
– দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
***
।।৮।।
(১)
কি বিদঘুটে অন্ধকার স্পেস ফোল্ড রে বাবা! ক্রি-এর পারসেপশন ম্যানিফেস্টারে ভেসে ওঠে এই অনুভূতিটা। আর এশনেরই বা সারা শব্দ নেই কেন? সেই ত তাকে কয়েক ন্যানোপিরিয়ড আগে এখানে আসতে বলল। কি নাকি ডাইমেনশনাল ক্রস-ওয়ের ধারে একটা প্রাইমর্ডিট্রন পাকড়াও করেছিল। প্রাইমডিট্রনরা খুব চালাক। সহজে ওদের ধরা যায় না। নিজেদের অস্তিত্ব গোপন করে সারা স্পেস-ময় নানা উদ্ভট জিনিষ সংগ্রহ করে বেড়ায়। তবে হতভাগারা বড্ড ভীতু ধরা পড়লেই নিজেদের কাইনেটিক স্টেবিলিটি হারিয়ে থমকে যায়। তবে প্রাইমর্ডিট্রনদের থামানো বেআইনি। কেন এই নিয়ম ক্রি জানে না। তবে তার আর এশনের এটা একটা খেলা। প্রাইমর্ডিট্রনদের সংগ্রহ থেকে নানারকমের জাঙ্ক আদায় করে তবে তাদের ছাড়ান দেওয়া। এশন মেসেজ করেছে আজ নাকি যা পাওয়া গেছে তা একেবারে জম্পেশ। এরকম জিনিষ নাকি প্রাইমর্ডিট্রনদের সংগ্রহেও আর দ্বিতীয়টি নেই।
এরই মধ্যে ক্রি টের পেল যে এশন-এর আবির্ভাব হয়েছে। এশন এসেই এক পিকোপিরিয়ডের মধ্যে ক্রি-এর জ্ঞানকোষে সমস্ত তথ্য জানিয়ে দিল। সে যা পেয়েছে সেটা হল একটা অদ্ভুত আকৃতিযুক্ত বস্তু! এটার শক্তি নাকি বিশাল! কিন্তু এটা কি কাজে লাগবে তা এশনকে এটার পূর্বতন মালিক বলে নি। তারাও নাকি এই নিয়ে অনেক ভেবেছে কিন্তু কোন কূলকিনারা করতে পারে নি। ক্রি খানিকটা হতাশ হল। এত কিছু আশা করে শেষে কিনা এই নাম না জানা ব্যবহার না জানা জঞ্জালটা এশন নিয়ে এল!
এশন কিন্তু হাল ছাড়ল না। প্রাইমর্ডিট্রনের ঝুলি থেকে যখন বেরিয়েছে তখন এ সাধারণ জিনিষ হতেই পারে না। আর তা ছাড়া এটাকে ঘিরে থাকা ডাইমেনশনাল বেন্ড বলে দিচ্ছে যে এটা সাধারণ জিনিষ নয়। যাই হোক অনেক ভেবেও যখন কিছু বেরচ্ছে না তখন এটা নিয়ে খানিক মজাই করা যাক। ক্রি-ও টের পেল তার মনের ভাব।
ব্যাস আর যায় কোথায়। শুরু হয়ে গেল তাদের প্রিয় খেলা। খেলাটা হল এশন বস্তুটাকে একটা ফোর্স ফিল্ড দিয়ে ঠেলে দেবে। ক্রি তার স্ট্রাইকার ম্যাটার বিম দিয়ে প্রহার করে বস্তুটাকে এশানের কাছে ফেরত পাঠাবে। যদি এশন সেটা এই স্পেস ফোল্ড-এর মধ্যে আটকে রাখতে পারে ত এশনের জয়। নয়ত ক্রি জিতবে। দুই ক্ষেত্রেই ক্রি আর এশনের এক পয়েন্ট করে হবে। তাদের জগতে সব খেলার শেষ ফলাফলে সবার পয়েন্ট সমানই হয়। জয় পরাজয়ের নিষ্পত্তি হয় প্লেজার ইন্ডেক্স দিয়ে। অর্থাৎ খেলে কে কতটা আনন্দ পেল। যার প্লেজার ইন্ডেক্স খেলার শেষে বেশি হবে, সেই জিতবে। যাই হোক খেলা চলতে লাগল। খেলতে খেলতে ক্রমে তারা বুঝতে পারল যে এই বস্তুটার ভর ও আকৃতি যেন এই খেলার জন্যই মেপে তৈরি। আজ অব্ধি এক একটা পয়েন্টে তাদের প্লেজার ইন্ডেক্স এতটা করে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে নি। এভাবে একচল্লিশ পয়েন্ট খেলা হবে। তার পরে তুলনা করা হবে দুজনের প্লেজার ইন্ডেক্সের। এখানে একচল্লিশই সমস্ত হিসেবের মূলক।
(২)
দেখতে দেখতে একচল্লিশ পয়েন্ট হয়ে গেল। দুজনেই চরম আনন্দিত। এবং তুলনা করে দেখা গেল দুজনেই এই খেলাটায় সমান আনন্দ লাভ করেছে। এটা প্রায়ই হয়ে থাকে। এবং এটা তারা মেনেও নেয়। দুজনেরই কেন জানি না মনে হল এই গেমে প্লেজার ইন্ডেক্স সমান রাখা ঠিক হবে না। অন্য গেমে যাই হোক, এই গেমে সাম্যতা রাখা সম্ভব নয়। এই বস্তুটার যেন নিজস্ব প্রচণ্ড শক্তিশালী সত্ত্বা আছে আর তা চাইছে না যে এই গেম এখানেই শেষ হোক। তারা দুজনেই সম্মত হল যে একবার অন্তত খেলার আইন ভেঙে আর একটা পয়েন্ট খেলা দরকার। এই খেলার অসম পরিণতিই ভেদ করবে এই আজব বস্তুর রহস্য। ক্রি ফিরে গেল নিজের স্পেস ফোল্ডের এক প্রান্তে। তার এনার্জি হারভেস্টার দিয়ে আশপাশের ডাইমেনশনগুলো থেকেও শক্তি শুষে নিয়ে চার্জ করতে থাকল তার স্ট্রাইকার ম্যাটার বিম। ফিল্ডের অন্য প্রান্তে তখন এশন তার নিজের মধ্যে অন্তঃস্থ হয়ে তার গহনে সুপ্ত তাদের আইনে নিষিদ্ধ শক্তিগুলোকেও জাগিয়ে তুলে সৃষ্টি করেছে এক বিপুল ফোর্স ফিল্ড। সেই ফোর্স ফিল্ডের ঠেলায় অকল্পনীয় গতিতে বস্তুটি ছুটে চলল ক্রি-এর দিকে। কিন্তু ক্রি-ও প্রস্তুত ছিল তার স্ট্রাইকার বিমের প্রচণ্ড প্রহার নেমে এল সেই ছুটন্ত প্রহেলিকার ওপর।
দুম!
ক্রি আর এশন দুজনেই হতচকিত হয়ে গেল। তাদের সম্মিলিত চরম শক্তির প্রয়োগ সহ্য করতে না পেরে বস্তুটা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে! সেই ফাটা বস্তুর থেকে বের হওয়া অদ্ভুত ধরনের বিকিরণ তাদের দুজন কে অবাক করে দিয়ে সেই স্পেস ফোল্ডকে ছিন্নভিন্ন করে ছড়িয়ে পড়ল সব দিকে। কয়েক ন্যানোপিরিয়ডে আর সেটার কোন চিহ্নই রইল না।
কয়েক ন্যানোপিরিয়ড স্তব্ধ হয়ে রইল তারা। তার পরে শান্ত ভাবে ফিরে চলল নিজেদের ডেরায়। এই আজব বস্তুর রহস্যটা রহস্যই থেকে গেল! তবে আর যাই হোক, খুঁটিয়ে দেখলে একচল্লিশের আইন তাদের ভাঙতে হল না। নয়ত তাদের আলফার কাছে জবাবদিহি করতে হত মনে হয়।
আড়াল থেকে সব লক্ষ্য করা প্রাইমর্ডিট্রনদের চেতনা তখন সাফল্যের আনন্দে আত্মহারা। বেয়াল্লিশ ত হয়েই গেছে রে বোকার দল!
বেয়াল্লিশের ফাঁদে এই নির্বোধ ক্রি-এশনকে ফেলা না গেলে এই কসমিক ডিম ফুটিয়ে মহাবিশ্বকে বার করা কি কোনদিন সম্ভব হত!
– সুপ্রিয় দাস
***
।।৯।।
৪২
তখন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না । কিছুরই না ।
সবুজ ঘাসের দেশ, জোনাকির রঙ, শিশিরের শব্দ, রৌদ্রের গন্ধ, কিচ্ছু না ।
কিছু থাকা মানে তো অস্তি? না, সেটা বলার মত অবস্থা ছিল না।
তবে কি কিছুই ছিল না? ন অস্তি? নাস্তি?
না ! তাও বলার উপায় ছিল না। নাস্তি কি করে অস্তি হয়? নাহ্। নাস্তিও ছিল না।
নাস্তিই যখন নেই, তখন মৃত্যু কি করে থাকে? না, মৃত্যু ছিল না।
আর মৃত্যুই যখন ছিল না, অমৃত বা কোথায় থাকে? না, অমরত্বও ছিল না।
তবে? তবে কি ছিল?
ছিল শুধু ঘোর অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের গভীরে, অতলে, অন্তরে, বাহিরে, আরো অনেক অনেক অন্ধকার।
বিরামহীন অন্ধকার।
অনন্ত।
অস্তিত্বের অস্তিত্ব নেই। তাই অন্ধকার অবিচল। গতিহীন। যাবে কোথায়? ন গচ্ছতি। নগ।
নাগ।
কি ঢেকে রেখেছে সে অন্ধকার?
কে বলবে? কেউই তো নেই উত্তর দেবার!
তারপরে কে জানে হঠাৎ, হ্যাঁ একদম হঠাৎ, শিহরিত হয়ে উঠল অন্ধকার। তার কম্পিত গহন থেকে ফেনিল বুদবুদের মত ওপরে ভেসে উঠল একটুকরো বাসনা।
শিহরণের পর শিহরণের লহর খেলে গেল সেই অন্ধকারে। তার অন্তর থেকে উদঘোষিত হল এক অনাহত গম্ভীর ওঙ্কারধ্বনি। আর তার বুকে চকিতে ডালপালা মেলে সেই এতটুকু বাসনা পরিণত হল কামনার আবেগে।
বীৰ্য্যমসি বীৰ্য্যং, বলমসি বলম, ওজোহসি ওজঃ!
কামনার আহবানে সাড়া দিয়ে অন্ধকারের অন্দরে জাগরিত হল শক্তি।
সৃষ্টি! সৃষ্টি করতে হবে!
সৃষ্টি করতে তো প্রয়োজন মৌলিক উপাদান?
কি সেই মৌল?
সংখ্যা।
না। যে কোন সংখ্যা নয়। মৌলিক সংখ্যা। প্রাইম নাম্বার।
চাই জোড়ায় জোড়ায়। চাই যমজ প্রাইম। ইন আর ইয়াং। শুরু এবং শেষ। আলফা এবং ওমেগা।
গোনো।
(৩,৫), (৫,৭), (১১,১৩), (১৭,১৯), (২৯,৩১), (৪১,৪৩)…
হ্যাঁ ৪১, ৪৩। এই দুটো।
৪১। এইটা হোক চিৎ। ধীশক্তি। কন্সাসনেস। পুরুষ।
৪৩। এইটা হোক জড়। ম্যাটার। বস্তু। প্রকৃতি।
চিৎ আর জড়। পুরুষ আর প্রকৃতি। দুয়ে মিলে হোক সৃষ্টি।
৪১ আর ৪৩-এর গড় ৪২।
৪২ !
৪২ হোক সৃষ্টি নির্মাণের বীজ সংখ্যা। ৪২ চিদ জড় গ্রন্থি। ৪২ প্রকৃতির দর্পণে পুরুষের প্রতিফলন।
৪২ ।
অসতো মা সদগময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়। লেট দেয়ার বি লাইট।
– সুমিত বর্ধন
============================================
ঋণস্বীকার : নাসদীয় সুক্ত, সাংখ্য , পৌরাণিক কাহিনী, আর কিছু এলোমেলো ভাবনা 🙂
***
।।১০।।
মিলোক গ্রহের ২০০ কোটি বাসিন্দা আজ চোখ রেখেছে রাতের আকাশে। আকাশের ঠিক মাঝখানে জ্বলছে ৪২টি উজ্জ্বল তারা। ঠিক রাত ১২টা থেকে শুরু হবে মহাবিশ্বের ভাগ্য নিয়ে ভোট। এতদিনে সবাই জেনে গেছে এই বিশ্বে সব মিলিয়ে ৪২টি বুদ্ধিমান জাতি সৃষ্টি করা হয়েছে, আর তাদের দেখা এবং ঠিক পথে চালানোর জন্যে আছেন ৪২ জন ভগবান বা দিকপ্রদর্শক। বিবাদটা প্রায় ৩০০ বছর আগে শুরু হয়েছিল যখন ২৩ নম্বর গ্রহের প্রধান আ-সোকে ৯ নম্বর গ্রহের রানি সিও অপমান করে। সিওর দাবী ছিল আ-সোর রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতি সম্পূর্ন ভুল। সেই থেকে শুরু ঝগড়া। ৫০ বছরের মধ্যে ৯ নম্বর গ্রহ আণবিক অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে ২৩কে। নিরুপায় ২৩ শরণাপন্ন হয় তাদের ঈশ্বরের। খামখেয়ালি ২৩ নম্বর ঈশ্বরের অঙ্গুলিহেলনে ধংস হল রানি সিওর বাহিনী। সিও আহ্বান করলেন ৯ নম্বর দেবতাকে। পরের ২০০ বছর একে একে বাকি ৩৯টি গ্রহ এবং তাদের ভগবানও জড়িয়ে পড়ল এই মহাবিশ্ব ব্যাপী লড়াইএ। একমাত্র মিলোকের মানুষেরা দূরে থেকেছে এসব থেকে, তাদের দিকপ্রদর্শকও চিরকাল দূরে থেকেছেন এই বিশ্বজুড়ে চলা ক্যাওস থেকে। তবে এই অশান্তিতে ক্লান্ত ৪২ জন ঈশ্বর ঠিক করেছেন আজ রাতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, এই রণক্লান্ত মহাবিশ্বকে ধ্বংস করে নতুন করে গড়ে তোলা হবে কিনা। একজন ঈশ্বর বিরোধিতা করলেও তা আর সম্ভব নয়। অনেক আশা নিয়ে মিলোকবাসিরা তাকিয়ে আছে শেষ উজ্জ্বল তারাটির পানে। দিকে দিকে তখন অসীম অন্ধকার।
– দীপ ঘোষ
***
।।১১।।
৪২-অন্তিম হিসাব
মাননীয় ডগলাস অ্যাডামসের প্রতি এক অযোগ্য শ্রদ্ধার্ঘ্য-
দাঁত বার-করে থাকা মাছওলার কথায় নিবারণবাবু আবারও ভীষণই অবাক হলেন। সকাল থেকেই তাঁর অবাক হওয়ার পালা চলছে। নিবারণবাবুর জীবন এমনিতে খুব-একটা ঘটনাবহুল নয়। কাজেই অবাক-টবাক হওয়ার অভ্যেস তাঁর অনেকটাই চলে গেছিল। কিন্তু আজ; দু’ হাজার আঠেরোর দোসরা ফেব্রুয়ারীর সকাল থেকেই কিছু অদ্ভুত, খাপছাড়া ঘটনা ঘটে চলেছে।
রামপুরহাট কলেজের ফিজিক্সের সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর নিবারণ সমাজপতির জীবন ছকে বাঁধা, ঘড়ির কাঁটা-র মত। কলেজ যাওয়া, ছাত্র পড়ানো, খাওয়া, শোওয়া, সবই তাঁর নিয়মমাফিক হয়। তাঁর পরিষ্কার মনে আছে আগের রাতে তিনি অনেকক্ষণ কাজ করে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মোবাইলে আটটার সময় অ্যালার্ম দিয়েছিলেন। অথচ মোবাইল যখন চিৎকার করে উঠল তখন ধড়মড় করে উঠে পড়ে স্ক্রিনে চোখ রেখে দেখলেন সকাল ছ’টা সাত! কিচ্ছু বুঝতে না পেরে তিনি বাথরুমে দাঁত মাজতে গিয়ে দেখলেন দামী গ্লিস্টারের বদলে পেপসোডেন্টের একটা ছোট্ট টিউব, যার দামের দিকটা তাঁর চোখে আগে পড়ল যেহেতু প্যাকেটটা সেভাবেই ঘোরানো ছিল, বিয়াল্লিশ টাকা! কি কান্ড! এই পেস্ট এখানে কে রাখল? বাথরুম থেকে বেরিয়ে অভ্যাসবশেই ঘড়ির পাশে টাঙিয়ে রাখা আদ্যিকালের থার্মোমিটারটাতে চোখ পড়ল তাঁর। কি সব্বোনাশ, শীত শেষের শিরশিরে ঠাণ্ডায়, যেখানে রীতিমত চাদর জড়িয়ে সকালে বেরোতে হয়, তখন দেখাচ্ছে কিনা ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস! নাঃ, থার্মোমিটারটা গেছে। বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখলেন গিন্নী র’চা খাচ্ছেন আর বুল্টু দিদিমার কোলে মাথা দিয়ে গপ্প করছে। সকালবেলায় বাড়ির বড়রা সবাই র’চা-ই খায়, এই অভ্যেসটা তিনিই ধরিয়েছেন সক্কলকে। তাঁকে দেখে বুল্টু গুড মর্নিং জানিয়ে বলল, “জানো দাদু, আমাদের এখানে একটা নতুন বাসরুট চালু হয়েছে কাল!”
“তাই নাকি রে?” তিনি খবরটা জানতেন না। “হ্যাঁ গো, এস ডি ৪২!” নিবারণবাবু সংখ্যাটা সম্পর্কে সচেতন হতে-না-হতেই হাতে কাগজ নিয়ে খোকা বেরিয়ে এল। নতুন চাকরি জয়েন করার আগে ক’দিন ছুটি নিয়ে বাড়িতেই আছে। সফট ওয়্যার টেকনিশিয়ান আর এঞ্জিনিয়ারদের এই এক সুবিধা, এখান ছাড়ো, ওখান জয়েন করো, পেমেন্ট সর্বদাই নেগোশিয়েবল। আজ হঠাৎ এত সক্কাল-সক্কাল সবাই উঠে পড়েছে দেখে তাঁর একটু অবাকই লাগল। “তা তোমাদের নতুন অফিস কোথায় হল?” প্রশ্নটা করে একটু লজ্জাই পেলেন তিনি, ছেলের নতুন এমপ্লয়মেন্ট সম্পর্কে একটু বেশী খোঁজ-খবর রাখা তাঁর উচিত ছিল। তবে তিনি তাঁর নিজের দুনিয়ায় থাকেন, নিজের পড়াশোনা নিয়ে। বাড়ির লোক এতে অভ্যস্ত হয়ে আছে। ছেলে বলল, “চন্ডীগড়, সেক্টর ৪২।” তাঁর আবারও ধন্দ লাগল একটু। “আরেব্বাস, এ তো ব্যাপক কান্ড! দেখেছো এটা?” খোকার চোখ কাগজে। নিবারণ বাবু তখনো পেপার হাতে পাননি, জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে জানতে পারলেন এই প্রথম ডলারের বিনিময়ে টাকার দাম এতোটা নেমেছে। “এক ডলার এখন বিয়াল্লিশ টাকা! ভাবতে পারো?” অস্বস্তি এড়াতে ক্রোড়পত্রটা হাতে তুলে নিলেন তিনি। প্রথম পাতা জুড়েই অ্যামাজনের বিশেষ ছাড়ের সুবিশাল বিজ্ঞাপন; প্রায় পাঁচশোর ওপরে ঘরোয়া প্রোডাক্টস, প্রত্যেকটা আইটেম বিয়াল্লিশ টাকা!
হাতে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি; বাজার করাটা যদিও ঠিক তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। তবুও গিন্নি বলে দিলেন কি কি আনতে হবে। রাস্তায় বেরিয়ে দেখলেন পাড়ার একটা ছেলে দেওয়াল সাদা রঙ করে তার ওপরে লাল হরফে বিরাট করে ৪২ লিখছে। মাথাটা একটু ঘুরে গেল তাঁর। কাছে গিয়ে যখন জানতে চাইলেন কি হচ্ছে, ছেলেটা পুচ করে গুটখার থুতু ফেলে জানাল বেরোজগারী এবং অপশিল্পায়নের বিরুদ্ধে পরের হপ্তা থেকে অমুক দলের বিয়াল্লিশ জন সক্রিয় সদস্য-সদস্যা বিয়াল্লিশ দিনের জন্য ধর্নায় বসবে। বাজারেও অন্যমনস্ক থাকার সুযোগ পেলেন না তিনি। পিঁয়াজ বিয়াল্লিশ টাকা কিলো, গতকাল অব্দি যেটা কিনা, দোকানদার বিনীতভাবে জানাল, সাঁইত্রিশ টাকা কিলো যাচ্ছিল। এই দাম বাড়ায় বিরক্তির কোনও কারণ নেই, কারন, সৌভাগ্যক্রমে উচ্ছে চৌষট্টি টাকা থেকে পড়ে গিয়ে বিয়াল্লিশ টাকা কিলোদরেই যাচ্ছে! ভালো কুচোচিংড়ি দেখলেন তিনি, কিছুক্ষণ আগে একুশ টাকা পিস দুটো লাউ কিনেছেন, ভালো যাবে। অনেকটাই আছে, মাছওলাও চেনা, সে একগাল হেসে জানাল যে সে চুরাশি টাকায় পুরোটা ছেড়ে দিচ্ছিল, কিন্তু আর এক দাদা এর অর্ধেকটা নেবেন; কাজেই হাফ সে নিবারণবাবুকে দিতে পারে বিয়াল্লিশ টাকায়। এই সময়েই গোটা ব্যাপারটার ক্রম এবং প্যাটার্ন তাঁর সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে আরম্ভ করে। এর আগেই হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু নিবারণ বাবু কঠোর নাস্তিক, কড়াধাতের মানুষ, আকস্মিক-অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপারে তাঁর খুব-একটা আস্থা নেই। নাতির একশো আটষট্টি টাকার কমপ্ল্যান কিনে যার সাথে বিয়াল্লিশ টাকার একটি প্লাস্টিকের ওয়াটার বটল ফ্রি, তাঁর মাথায় এল যে বিয়াল্লিশকে চার দিয়ে গুণ করলেই একশো আটষট্টি পাওয়া যায়। সাবধানে বাড়ি ফিরলেন তিনি, মাথা ঝিমঝিম করছিল। বুল্টু তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে ভয়ানক উত্তেজিতভাবে জানাল যে নতুন চাকরিটাতে তার বাবা প্রত্যেক বছরে বিয়াল্লিশটা ছুটি পাবে!
নিজের ঘরে টেবিলে বসে আনুপূর্বিক ভাবতে আরম্ভ করলেন নিবারণবাবু, এর মধ্যে তাঁর কানে এসেছে বাড়ির ডোমেস্টিক হেল্প রাণুর ক্যানক্যানে গলা- “বিয়াল্লিশ বার আমায় ডেকোনি বাপু! হাতে বিয়াল্লিশ রকমের কাজ, কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরব বলতে পারো?” বা পুত্রবধূর অধৈর্য শাসানি, “তোমার জন্য কি মাসে বিয়াল্লিশ রকমের ব্রেকফাস্ট হবে, বুল্টু?” এবং ছেলের “তুই ম্যাথে পঞ্চাশে বিয়াল্লিশ পেলি কি করে? ছেড়ে এসেছিস না ভুল করেছিস?”
নিবারণবাবু ভাবছিলেন, কিন্তু কিছু ধরতে পারছিলেন না। হতে পারে পুরোটাই র্যানডম, কিন্তু প্রকৃতি একটা নির্দিষ্ট ধরনের র্যানডমনেস রিপিট করতে পছন্দ করে না, এটা তিনি আজীবন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা স্টাডি করে বুঝেছেন। তাঁর জীবনের কয়েকটাই কাজ। পড়া, বোঝা আর… আর নিবারণ সমাজপতির একটা স্বপ্ন আছে। বিগত কত বছর ধরে সেই অলীক, মরীচিকার মত স্বপ্ন তাঁকে দিয়ে রাতভর জটিল অঙ্ক কষায়, স্টাডি করায়। তাঁর মত মফস্সলের একটা কলেজ-মাস্টারের এই স্বপ্ন জানতে পারলে সুশিক্ষিত মানুষেরাও তাঁকে উন্মাদই বলবে, এই আশঙ্কায় তিনি এমনকি নিজের ছেলেকেও কিছু বলেননি এ ব্যাপারে। সে-ও শিখেছে যে কাজ নিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করলে বিশেষ উত্তর পাওয়া যাবে না। যেটা তাঁকে দিনে, রাতে, উঠতে-বসতে, খেতে-ঘুমোতে সর্বদা ভাবায়, যার জন্য এত অনুরোধ-লোভ দেখানো সত্ত্বেও তিনি প্রাইভেট ট্যুইশন আরম্ভ করেননি, তা হল টি ও ই। থিওরি অফ এভরিথিং। যে কাজ এখনও হয় নি, যাকে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার হোলি গ্রেইল বলা যায়, অর্থাৎ গ্রাভিটেশনকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম আর ন্যুক্লিয়ার স্ট্রং এবং উইক ফোর্সের সাথে অন্বিষ্ট করা এবং এক অভিন্ন বিশ্বতত্ত্বের অবতারণা; এই হল তাঁর লক্ষ্য। তিনি যে এতগুলো বছর ধরে এই লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যেই কাজ করে আসছেন, খাতার-পর-খাতা ইকোয়েশনসে ভর্তি করে ফেলছেন, প্রচুর পয়সা খরচ করে ফিজিক্সের পেইড অনলাইন জার্নালগুলোতে সাবস্ক্রাইব করে লেটেস্ট ফাইন্ডিংস পড়াশোনা করছেন, একথা মাঝে-মধ্যে নিজের কাছে স্বীকার করতেই লজ্জা লাগে। আন্তর্জাতিক মানের কাটিং-এজ ল্যাব, গবেষণার প্রয়োজনীয় উপকরণ, এসব কিচ্ছুই তাঁর নেই, তাঁর শুধু আছে এক অদম্য স্পৃহা, নিরলস পরিশ্রমের ক্ষমতা ও ধৈর্য এবং দাঁতে-দাঁত চেপে লড়াই করে যাওয়ার এক হার-না-মানা মানসিকতা। তাঁকে ভূতের মত তাড়া করে বেড়ায় ফিজিক্সের এই অপারগতা; ফিজিক্সের বিরুদ্ধে মহাজগতের এই যুদ্ধে নিজেকে একজন নাইট বলে মনে হয় তাঁর! এই তত্ত্ব জানা মানবজাতির ভবিতব্য, অস্তিত্বের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া অব্দি মানবজাতির মুক্তি নেই, আর এই প্রশ্নের সন্তোষজনক সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত অন্যান্য প্রশ্নের সমাধানও হবে না। মানুষ একটা সুবিশাল কনসেপচুয়াল লিপ-এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হয় তাঁর, সামনে বাধা শুধু দুর্ল্যঙ্ঘ প্রাচীরের মত এই প্রশ্নটা।
একথা স্বীকার করতে গেলেও তাঁর গায়ে কাঁটা দেয়, কিন্তু তাঁর মনে হয়েছে যে তিনি অনেকটাই এগিয়েছেন। তাঁর সবসময়ই মনে হয়েছে কেবল পরীক্ষা করে, অঙ্ক কষে, এ প্রশ্নের সমাধান হবে না। এর জবাব পেতে গেলে কিছু অনড় পূর্বানুমাণ, যাকে লাতিন ভাষায় এ প্রায়রি বলে, তাদের আলাদাভাবে ভাবতে হবে। তিনি সময়কে বেছে নিয়েছিলেন। রিলেটিভিটি দেখিয়ে গেছে স্পেস কলয়েডীয় দ্রবণের মত, তিনি কল্পনা করেছিলেন টাইম তার মাঝে রিপলস। অনাদ্যন্ত প্রবাহিত এক অনিঃশেষ ঢেউ, যার প্রতিটা কন্সটিট্যুয়েন্ট খুব পাতলা, অনন্তভাবে বিস্তৃত এক-একটা ইউনিট যাদের নিজেদের মধ্যেকার ব্যবধান অকল্পনীয়ভাবে কম, প্লাঙ্ক স্পেসের থেকেও সংকীর্ণ। তাঁর মনে হয়েছিল এই কল্পনে গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ-ফাংশনের সাথে টাইম-স্পেস কে তিনি মিলিয়ে দিতে পারবেন, এবং সেখান থেকে বাকি কাজ। টাইমকে একটা ফিজিক্যালিটি বা করপোরিয়াল ডাইমেনশন দেওয়ার পর থেকে কাজটা অসম্ভব বলে তাঁর কখনো মনে হয়নি। নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন তিনি, কিন্তু প্রত্যেক সময় সাফল্য, গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশনটি ধরাছোঁয়ার ঠিক বাইরেই থেকেছে। তাঁর মনে হয়েছে যেমনভাবে একটি পূর্বানুমাণকে তিনি আলাদা ভাবে ভেবেছিলেন গবেষণার প্রথমে, ঠিক তেমন আর একটি বিশেষ এলিমেন্ট চাই এই ইকোয়েশন কে সম্পূর্ণ করতে। তাঁর বিশ্বাস, কোনও পরিঘটনাই একটা জিনিস ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না, আর তা হল যে বোধ এবং বোধি ঘটনাটিকে অভিজ্ঞতার জায়গায় নিয়ে আসছে সেটা। চৈতন্য বা চেতনাবোধ, তার সাবজেকটিভ ডাইমেনশনস এবং পোটেনশিয়াল, যাকে আরিস্ততল ‘এন্টেলেকি’ বলে গেছেন, তার কোনও একটা কম্পোনেন্ট থাকতেই হবে হিসেবের মধ্যে। দ্রষ্টা ব্যতীত দ্রষ্টব্যের কোনও অস্তিত্ব যেহেতু কল্পনা করা যায় না, ব্যক্তিচেতনাকে কোনও না কোনও ভাবে হিসেবের মধ্যে আনতেই হবে। এরপর তাঁর এটাই মাথায় এসেছে যে আইনস্টাইনের কসমোলজিক্যাল কন্সট্যান্টের মত তাঁর প্রয়োজন একটি ‘কনশাসনেস কন্সট্যান্ট’। ঠিক এই জায়গাতে এসে তিনি বিগত সাতটি বছর দাঁড়িয়ে আছেন। মগ্নচৈতন্য-কে কিভাবে একটি ধ্রুবক-এর জায়গায় আনা যায়, গাণিতিক সূত্রে প্রকাশিতব্য কাঠামোয় আনা যায়, এ নিয়ে তিনি ভাবেন।
আর তারপর আজকের এইসব ঘটনা! কিন্তু এ কী ঘটনা? এর ব্যাখ্যা কি? কেন এটা হচ্ছে? কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্ক থাকতেই হবে, এমন মাথার দিব্যিই বা কে দিয়েছে? কয়েকটা আকস্মিক ঘটনাকে কেন তিনি পারস্পরিক- সম্পর্কযুক্ত একটা অর্থপূর্ণ ফরম্যাট দিচ্ছেন? ধুস্। ভুলভাল। মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলে কলেজ যাওয়ার জন্য স্নান করতে উঠলেন, এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল। ফোন ধরতেই ওপার থেকে প্রকাশবাবুর শশব্যস্ত গলা, “এই যে স্যর, শুনেছেন? হিস্ট্রির পিণাকেশ কাল রাতে মারা গেছে!”
“অ্যাঁ?” পিণাকেশ তাঁর খুবই কাছের, খুবই শ্রদ্ধা করে।
– “কখন? কি করে?”
– “এই তো, গতকাল ন’টা দশের দিকে স্যর, আচমকাই হার্ট বন্ধ! হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ ট্রাই করা হয় হার্টকে যদি একবার অপারেশন্যাল করা যায়, কিন্তু… ভাবতে পারেন? মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়স!”
আর বিশেষ কিছু শুনছিলেন না নিবারণবাবু, তিনি নিশ্চিত যে ঘটনাটা ঘটেছে ঠিক ন’টা নয়ে; যেহেতু ২৪ ঘন্টা সময়ের ফরম্যাটে রাত ৯টা মানে ২১ আওয়ারস, মিনিটের হিসেবে সেটা ধরলেই আর একটা ২১, অর্থাৎ দুটো একুশ, অর্থাৎ…! আচমকাই তাঁর মনে পড়ে গেল আজকের তারিখের কথা। দু’হাজার আঠেরোর দোসরা ফেব্রুয়ারী। অর্থাৎ ০২.০২.২০১৮। ০২, ০২, ২০ আর ১৮ কে যোগ করতে গিয়ে তিনি মাথার চুল খামচে ধরে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। নিজেকে মূর্খ আর অসহায়, দুই-ই লাগছিল। কলেজ আর যাবেন না বলে ঠিক করলেন, ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলেন তিনি। বাড়ির লোক এ আচরণ বিলক্ষণ চেনে; তারা কেউই এমতাবস্থায় দরজায় এসে খুটখাট করে না।
কেউ কি তাঁকে কিছু জানাতে চাইছে? এটাই সবথেকে বড় প্রশ্ন। কেন চাইছে-র থেকেও কিভাবে এইভাবে চাওয়াটা জানাচ্ছে, এটা বেশী বিস্ময়কর। একটা প্রশ্নের উত্তর পেলে অন্যটাও আপনা-আপনি পাওয়া হয়ে যায়। আজ সকালের ছ’ সাতে বিয়াল্লিশের অ্যালার্ম থেকে আরম্ভ করে যেভাবে এই সংখ্যাটা তাঁর সামনে বারবার উঠে এসেছে বা আনানো হয়েছে… ব্যাপারটা ভাবতেই তিনি শিউরে উঠলেন। কারো পক্ষে এসব করা, যার মধ্যে অসম্ভব কিছু রিয়ালিটি- এবং অবশ্যই টাইম ম্যানিপুলেশনের জায়গা আছে, স্বাভাবিক বুদ্ধিতে অন্তত অসম্ভব। এটা মানবীয় ক্ষমতার বাইরে। তিনি স্থির চোখে চেয়ে রইলেন তাঁর কাজের টেবিলের ওপরকার স্তূপীকৃত ফাইলগুলোর দিকে। তাঁর এতাবৎ কাল পর্যন্ত করা যাবতীয় কাজ এগুলোর মধ্যেই আছে। এর প্রত্যেকটা কাগজের ওপরের প্রতিটি আঁচড়ের পেছনে এই বিশ্বাস কাজ করে এসেছে যে কার্য-কারণ সম্পর্ক অমোঘ, এবং তা সর্বদাই বিজ্ঞাননির্ভর। অতিপ্রাকৃত, যুক্তিবোধের অতীত কোনও কিছুই দুনিয়াতে ঘটে না। আজ কি তিনি এ সমস্ত কিছু পুড়িয়ে ফেলবেন? জ্বালিয়ে দেবেন তাঁর সারাজীবনের স্বপ্ন, আড়াই দশকের পরিশ্রম? কি লাভ এসব রেখে, যখন দেখাই যাচ্ছে যে বাস্তবের অনেক পরত তাঁর বোধ-কে চিরকাল ফাঁকি দিয়ে এসেছে! এক উন্মাদ ইচ্ছা তাঁকে পেয়ে বসল। সত্যিই যদি কোন মহানতর শক্তি-নিয়ন্তা থেকে থাকে, তাঁর আত্মসমর্পণে লজ্জা নেই। কিসের লজ্জা? তিনি বিজ্ঞানের উপাসক, আর বিজ্ঞান মানে সত্য। কোনও মহাশক্তি যদি সত্য হয়, তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা মানে তো সত্যকেই এড়িয়ে যাওয়া! কিন্তু কেন এভাবে? কেন একটা সংখ্যা? একটা সংখ্যার জন্যই কি তাঁর স্বপ্নপূরণ থমকে নেই? কনশাসনেস কন্সট্যান্ট-কে ধ্রুবকের আকারে প্রকাশিত করে ইকোয়েশনে ফেলতে গেলে তো তার একটা সাংখ্যিক মান দরকার! সেটার অভাবেই তো…
সাংখ্যিক মান! নিউমেরিক্যাল ভ্যালু! নিবারণবাবু দু’হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলেন। তিনি কি পাগল হয়ে যাচ্ছেন? এ কি করছেন তিনি? ওপরের ফাইলটা খুলে গত সাত বছর ধরে আটকে-থাকা ইকোয়েশনটা টেনে বার করে আনলেন। তারপর বিশেষ কোনও কিছু না ভেবে চৈতন্য-ধ্রুবকের সাংখ্যিক মান বিয়াল্লিশ ধরে অঙ্কটা কষতে আরম্ভ করলেন। কষতেই থাকলেন। আর আটকাল না…
তাকে জানা যায় না, বোঝা যায় না, মাপা যায় না। স্থান-কালে, প্লাঙ্ক স্পেস থেকে ইন্টার-গ্যালাকটিক স্পেসে তার গতি অবাধ। তার জ্ঞান অসীম, ক্ষমতা কোনোপ্রকার বহিঃশক্তির দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত, বোধ অনাদ্যন্ত, চৈতন্য সর্বব্যাপী। অন্তহীন মাত্রার এই মহাবিশ্বে তার একটাই উদ্দেশ্য, আরও, আরও মাত্রায় নিজের চৈতন্যকে বিস্তৃত করা, করেই যাওয়া, যাতে করে অন্তহীন এই বহুবিশ্ব অন্তহীনভাবে জ্ঞান ও চৈতন্যময় হয়ে ওঠে। অর্বুদাধিক কাল ধরে এই কাজ সে করে চলেছে। তার বার্ধক্য নেই, ক্লান্তি নেই, বিশ্রামের প্রয়োজন নেই, বিনোদনের ইচ্ছা নেই, তাৎক্ষণিক তৃপ্তিবোধ নেই। এই কল্পে, এই মাত্রায় একটি মাঝারি আকৃতির ছায়াপথের অন্তর্গত একটি সাধারণ সৌরজগতে তার এক অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ আরব্ধ কাজ ছিল। অকল্পনীয়রকম প্রাচীন কালে, মহাবিস্ফোরণের মাত্র ১৪০০ কোটি বছর পরে এই সৌর পরিবারেরই একটি উদীয়মান চেতনা ও বুদ্ধিসম্পন্ন গ্রহবদ্ধ জীবকূলের মধ্যে থেকে একজন পরাক্রমশালী চিন্তাবিদ মহাবিশ্বের মূল চারটি শক্তিকে এক করে দেখিয়েছিলেন। সেই মহা-গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি অনাগত-ভবিষ্যতের গর্ভে তার সৃষ্টিকে সম্ভব করে তুলেছিল। কিন্তু জৈবনিক কারণেই সীমাবদ্ধ মেধা ও বোধসম্পন্ন জীবটির পক্ষে গাণিতিক প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় একটি বিশেষ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিল না। ফলে তাকে স্থান-কাল এবং বাস্তবতার গঠনে কিছু অকিঞ্চিৎকর পরিমার্জন-পরিবর্তন ঘটিয়ে এই সমাধানটি জীবটিকে দিয়ে করিয়ে নিতে হত। এই নির্দিষ্ট কার্য-কারণ চক্রটি সম্পূর্ণ করা সাম্প্রতিক বহু কল্পে ও মাত্রায় তার করে-ফেলা কাজগুলির মধ্যে একটি সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ কাজ ছিল। অনন্ত প্রাণময় সেই ব্যাপ্ত অস্তিত্ব এক বিস্মৃতপ্রায় তৃপ্তিবোধে একটি সম্পূর্ণ প্লাঙ্ক মুহূর্তকাল নিজেকে বিশ্রাম দিল।
-দিগন্ত ভট্টাচার্য্য
Tags: ঋজু গাঙ্গুলী, গ্রুপ ইভেন্ট, দিগন্ত ভট্টাচার্য, দিগন্ত ভট্টাচার্য্য, দীপ ঘোষ, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয় দাস, সুমিত বর্ধন