সময়ের আতঙ্কে
লেখক: সুমন সেন
শিল্পী: সুমন দাস
ছোটোছোটো বাচ্চাদের কম্পিউটার শেখায় মৃদুল। পড়াশুনা বেশিদূর করতে পারেনি সে। কোনও রকমে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছিল। ভাগ্যিস কম্পিউটারের ব্যবহারটা ভালো করে শিখে নিয়েছিল! তাইতো আজ কোনও রকমে তার হাত-খরচটা উঠে আসে।
বাচ্চাদের খুব যত্ন করে শেখায় ও। তাই এ ব্যাপারে পসারটা বেশ ভালোই জমেছে। এছাড়াও কম্পিউটার হার্ডওয়্যার-এর কাজ, মোবাইল ফোন সারানো – ইত্যাদি কাজ করে মৃদুল। মাস গেলে মোটামুটি হাজার তিনেক টাকা চলে আসে তার হাতে। তাছাড়া সরকারি চাকরী পাবার প্রাণপণ চেষ্টা করে সে। দোকান থেকে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, রিজনিং – এর বই কিনে পড়ে সে। রীতিমত অঙ্ক এবং ইংরেজি অভ্যাস করে চাকরীর পরীক্ষার জন্য।
সব কিছুই ভালো চলছিল। তবে মাস দেড়েক আগে একটা অভাবনীয় কাণ্ড হয়ে গিয়েছে তার সঙ্গে। তার বাকি জীবনটুকু পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে তার পর থেকে।
প্রতিদিনের মতই সেদিনও মৃদুল বসেছিল দোকানে। দোকান বলতে তার বাড়িতেই একপাশে ছাউনি দিয়ে একটা ছোটো ঘর বানিয়ে নিয়েছিল সে। রাস্তার উপরই ছিল বাড়ি, তাই খরিদ্দারও জোগাড় হয়ে যেত বেশ। কিছু টুকিটাকি কাজ ছিল, সেগুলিকেই একে একে সেরে ফেলার চেষ্টা করছিল। ঠিক তখনই এল লোকটা। লোকটাকে সে আগেও বহুবার দেখেছে, কাছাকাছিই কোথাও থাকে। তবে তার সঙ্গে তেমন পরিচিতি নেই মৃদুলের। লোকটার মোবাইল ফোনটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। একটা উদ্ভট নামের লোকাল কোম্পানির ফোন। সমস্যা হল ফোনের কন্টাক্ট লিস্টটা খুললেই হ্যাং করে যাচ্ছে সেটটা।
“সফটওয়্যার মারতে হবে কাকা। আমার কাছে রেখে যাও, তিনদিন পর এসে নিয়ে যাবে। আড়াইশো টাকা লাগবে।” –মৃদুল বলল।
“তিনদিন!” –একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল লোকটা। তারপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, এদিক ওদিক তাকিয়ে – কিছু একটা ভেবে বলল, “করে দাও… আর কি করব।”
ফোনটা পরের দিনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। টেস্ট করার জন্য ফোনটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিল মৃদুল। হঠাৎ কি মনে হল – ফোনের ক্যালেণ্ডারটা খুলে দেখল। ২১ তারিখ আজ। ‘৩ তারিখ রাজীবের মাহিনা হয়ে যায়। প্রতিবারই তার এক সপ্তাহের মধ্যে সেটা মিটিয়ে দেয় রাজীব। কিন্তু এ’বার কি ব্যাপার? ২১ তারিখ হয়ে গেল, এখনও সে মাইনেটা দিল না কেন? ভুলে গেছে হয়তো, একবার মনে করিয়ে দিতে হবে। প্রায় ছ’মাস ধরে তার কাছে কম্পিউটার শিখছে রাজীব, এই সেপ্টেম্বর মাসেই প্রথম ভুল হল।’ ভাবতে ভাবতে সে ফোনের ক্যালেন্ডারটার ৩ তারিখের উপর গিয়ে ও.কে. বাট্ন-টা চেপে দিল। হঠাৎই তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা কাঁপুনি বয়ে গেল যেন। যা ঘটল – তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাল না মৃদুল। আবার তার আগের ভাবনায় মনোনিবেশ করল।
সময়টা একবার দেখে নিলো সে। ‘দুটো বেজে গেছে!’ এইরকম সময়ে কোনওদিন দোকান খোলা রাখে না সে। তাড়াতাড়ি দোকানটা বন্ধ করে, ঘরের দিকে এগোল। ঘরের দরজায় এসেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। যা দেখছে – তার সম্ভাব্য কোনও কারণও খুঁজে পাচ্ছে না সে। সে দেখতে পাচ্ছে – তার চোখের সামনে তারই মতন আরেকটি ছেলে, তার চেয়ারে বসে, তারই কম্পিউটার চালাচ্ছে। ছেলেটি যেই জামাটা পরে রয়েছে – সেটাও তার।। মৃদুল জোরে চীৎকার করতেই যাচ্ছিল – ‘ওই, কেরে তুই?’ বলে। কিন্তু কিছু একটা ভেবে আওয়াজ করল না। খুব আস্তে আস্তে উল্টোদিকের জানালাটির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল – ছেলেটির কার্যকলাপ দেখার জন্য। যত দেখছে – তত অবাক হয়ে যাচ্ছে মৃদুল। ছেলেটি যেন তারই একটা প্রতিমূর্তি। তার হাব-ভাব, কার্যকলাপ – সব কিছুতেই যেন সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ কম্পিউটার স্ক্রিনের ডানদিকে লাল রং এর ক্যালেণ্ডার গ্যাজেট-টার উপর চোখ পড়ল মৃদুলের। উইন্ডোজ-৭ যবে থেকে সে কম্পিউটারে ইন্স্টল করেছে – তবে থেকে সে স্ক্রিনে লাগিয়ে রেখেছে ওই ক্যালেন্ডার গ্যাজেট-টি। আজ সেটার দিকে তাকিয়ে সে যেন ‘হাঁ’ হয়ে গিয়েছে। ওতে দেখাচ্ছে – আজ ৩ তারিখ। এটা কি করে সম্ভব? এইমাত্র সে দোকান থেকে দেখে আসল – আজ ২১ তারিখ! পকেট থেকে নিজের মোবাইল ফোনটা বের করে নিল। নাহ্! এতেও দেখাচ্ছে আজ ৩ তারিখ। তাল-গোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার মাথা। ৩-২১-২১-৩ – এসবের মধ্যে তার একটা ডুপ্লিকেট কপি বসে রয়েছে তার কম্পিউটারে! ভালো করে কম্পিউটারটার দিকে দেখল মৃদুল। ছেলেটি ফটোশপে একটা ছবি এডিট করছে। ‘আরে…!’ এটা তো সে নিজেই বানাচ্ছিল – সপ্তাহ তিনেক আগে। একজন কাস্টমারের বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে লাগানোর কথা! কিন্তু সেই হিসেবে – মৃত্যুবার্ষিকী তো ১৬ তারিখে চলে গিয়েছে!
আচমকা একটা খেয়াল ভর করল তার মনে – ‘তবে কি…?!’ দৌড়ে গিয়ে সে আবার দোকান খুলল। সেই মোবাইল ফোনটা বের করল – যেটিতে সফ্টওয়্যার মারতে হয়েছে। ক্যালেণ্ডার খুলে ২১ তারিখে গিয়ে ও.কে. বাটন-টা চেপে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পা থেকে মাথা পর্যন্ত আবার সেই কাঁপুনি। এবার নিজের ফোনে তারিখটা দেখে নিলো – ২১। পাশ থেকে চলতে থাকা একটা লোককে ডেকে সে বলল, “গোপাল কাকু, আমাকে একটু চিমটি কাটো তো। জোরে…”
লোকটা একটু অবাক হয়ে – চিমটি কেটে দিয়ে চলে গেল। মৃদুল আরও দু’-চার বার অন্যান্য তারিখের উপর গিয়ে ও.কে. বাটন চেপে দেখল। অবশেষে তার ঠোঁটের কোণায় ফুটে উঠল হাসি। সে ঠিকই সন্দেহ করেছিল – ‘তার হাতে ঘটনাক্রমে একটা ছোট্ট টাইম মেশিন চলে এসেছে!’
প্রথমটা খুব খুশিই হয়েছিল সে। এ-সবের কথা তো শুধুমাত্র গল্পেই পড়ে এসেছে সে, সত্যিই যে এরও অস্তিত্ব হতে পারে – তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না মৃদুলের! ফোনটার আসল মালিক এসেছিলেন তিনদিন পর। কিন্তু, ফোনটা তার হাতে নষ্ট হয়ে যাবার অজুহাত দেখিয়ে – মৃদুল সেটিকে ফেরত দেয়নি আর। তার বদলে অবশ্য একটা ভালো কোম্পানির নতুন মডেলের হ্যান্ড-সেট দিয়ে দেয় সে ক্ষতিপূরণ হিসেবে। লোকটাও বিশেষ তর্ক করেননি, তিনি হয়তো খুশিই হয়েছিলেন নতুন ফোন পেয়ে।
ভালোই চলছিল প্রথম কটা দিন। গণ্ডগোল শুরু হল কিছুদিন পর থেকে। সেদিন বিকেলে রাজীবের কম্পিউটার ক্লাস ছিল মৃদুলের বাড়িতে। এখন মাইক্রোসফট এক্সেল শিখছে রাজীব। SUM, AVERAGE, IF – ইত্যাদি ফর্মুলার কাজ শিখেছে। কাজ হিসেবে – তাকে এবার স্কুলের রেজাল্ট তৈরি করতে দেবে মৃদুল। কি দেখে বানাতে দেবে – মাথায় আসছিল না তার। হঠাৎই কি মনে হল – নিজের ফাইল-পত্র থেকে তার উচ্চমাধ্যমিকের মার্কশিটটা বের করে দিল। রাজীবকে সেটা দেখে মাইক্রোসফট এক্সেল-এ রেজাল্ট বানাতে হবে। রাজীবকে কাজটা বুঝিয়ে দিয়ে, নিজের একটা বিশেষ কাজে বাইরে গেল মৃদুল।
রাজীব মন দিয়ে তার কাজ করতে থাকে। মার্কশিটটা যাতে হাওয়ায় না উড়ে যায় – সেজন্য পাশ থেকে একটা চীনেমাটির মূর্তি তুলে সেটির উপর চাপিয়ে রাখে সে। হঠাৎ ঘটে যায় অঘটনটা। মূর্তির নীচ থেকে মার্কশিটটা সরাতে গিয়ে – সেটি মাঝখান দিয়ে ছিঁড়ে যায় অনেকটা। প্রমাদ গোনে রাজীব। স্যার এসে তাকে খুব বকাবকি করবে! এখন সে কি করবে মার্কশিটটা নিয়ে – কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না!
হঠাৎই একটা বুদ্ধি আসল তার মাথায়। মার্কশিটের বাকি অংশটাও কুটি-কুটি করে ছিঁড়ে ফেলল সে। এরপর একটা পলিথিন ব্যাগ যোগাড় করে, তাতে টুকরোগুলো ভরে – কম্পিউটার টেবিলের পিছনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। মৃদুল ফিরে আসে কিছুক্ষণ পরেই। রাজীবের কাছে মার্কশিটটা ফেরত চাইতে – সে বলে, “হাওয়ায় উড়ে গেছে এইমাত্র।”
মৃদুল তন্নতন্ন করে সারা ঘর খোঁজে, কিন্তু কোথাও পায়না মার্কশিটটা। প্রমাদ গোনে সে। তার সরকারী চাকরীর পরীক্ষাতে লাগবে এটা। এইতো স্টাফ সিলেকশন কমিশন-এর একটি পরীক্ষা দিল সে। দুটো রাউন্ডে সে পাশ করে গেছে। আগামী মাসে আছে ইন্টারভিউ, তখনই লাগবে মার্কশিটটা। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সে পেল না সেটা। তখনই মনে পড়ল তার ছোট্ট টাইম মেশিনের কথা! এটা পাবার পর থেকে অবশ্য সব ব্যাপারে চিন্তা অনেকটা কমে গিয়েছে তার। ফোনটা বের করে আধঘণ্টা আগের টাইম সেট করে ও.কে. বাটন চেপে দিল সে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাঁপুনির মাধ্যমে সে পৌঁছে গেল আধঘণ্টা আগের সময়ে।
রাজীবকে মার্কশিটটা দিয়েই মৃদুল তার কাজ সারতে বাইরে গেল। বেশি সময় নিলো না এইবার, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলো। এসে যা দেখল, তাতে অবাক হয়ে গেল সে। সে দেখল: চীনামাটির মূর্তির নীচ থেকে রাজীব মার্কশিটটা বের করার সময় – সেটি মাঝখান দিয়ে ছিঁড়ে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়েই রাজীব পাশে রাখা একটি পলিথিন ব্যাগ বের করে, বাকি মার্কশীটটা ছিঁড়তে উদ্যত হয়। মৃদুল দৌড়ে গিয়ে রাজীবের হাত থেকে মার্কশীটটা নিয়ে নেয় এবং তাকে সজোরে একটা চড় মারে। রাজীবের যে ‘তড়কা’ নামক একটা রোগ আছে – সেটা মৃদুলের জানা ছিল না। তার চড় খেয়ে রাজীবের দাঁতে দাঁত লেগে যায়। সে মেঝেতে পড়ে ছটফট করতে থাকে। বেগতিক দেখে মৃদুল রাজীবকে কোলে তুলে তার বাড়িতে যায়। রাজীবের এরকম অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে পড়েন তার মা। মৃদুল ভয়ে ভয়ে সত্যি কথাটা স্বীকার করে নেয়। সে যাত্রা রাজীবকে তার বাড়িতে দিয়ে – নিজের বাড়িতে চলে আসে মৃদুল।
পরের দিন সকালে এক ভ্যান পুলিশ আসে মৃদুলের বাড়িতে। আগের দিন রাতে নাকি প্রচণ্ড জ্বর এসেছিল রাজীবের, আর তার জেরেই মারা যায় সে। রাজীবের মা-বাবা কেস করে দিয়েছে মৃদুলের নামে। তার জন্যই পুলিশ এসেছে আজ। আবার প্রমাদ গুনল মৃদুল। আগামী মাসে তার ইন্টারভিউ। পুলিশি ঝামেলায় পড়লে তার আর চাকরীটাই পাওয়া হবে না।
পকেট থেকে টাইম মেশিনওয়ালা ফোনটা বের করে – ক্যালেন্ডারের আগের দিনের টাইম সেট করে, ও.কে. বাটন চেপে দিল সে। আবার কাঁপুনির মাধ্যমে উপস্থিত হল অতীতে।
যথা রীতি রাজীব এলো ক্লাস করতে। এইবার মৃদুল তাকে মার্কশিটটাই দিল না। তার বদলে – খাতায় লিখে দিল রাজীবের এম.এস. এক্সেল-এর কাজ।
আর কোনও ঝামেলা হয়নি সে যাত্রা। রাজীব তার কাজ সম্পূর্ণ শেষ করে, মৃদুলকে দেখিয়ে বাড়ি চলে যায়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মৃদুল। আর ঝামেলায় পড়বে না সে। ভবিষ্যতকে সে পাল্টে দিয়েছে। পকেট থেকে তার টাইম মেশিনটা বের করে – একবার চুমু খেয়ে নিলো মৃদুল।
সত্যিই আর কোনও ঝামেলাতে পড়েনি সে। প্রায় মাস-খানেক কেটে গিয়েছে তারপর। আজ তার ইন্টারভিউ-এর তারিখ। তবে দেরী হয়ে গিয়েছে বড্ড। যেই ট্রেনটা ধরার কথা ছিল – সেটা হয়তো পাবেনা সে। সমস্ত কিছু রেডি করে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে, খুব জোরে সাইকেল চালাতে শুরু করল মৃদুল। হঠাৎই দেখল – একটি বাচ্চা ছেলে ও তার মা রাস্তার একপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে। বাচ্চাটির মা কিছুটা এগিয়ে গেছে, এবং বাচ্চাটি তার পিছুপিছু যাচ্ছে। মৃদুলের সাইকেলের গতি এতটাই তীব্র ছিল যে – ব্রেক কষেও সে সাইকেলটা থামাতে পারল না, এবং পাশ কাটিয়েও যেতে পারল না। সাইকেলের হাতল সোজা গিয়ে লাগল বাচ্চাটির মুখে। ছিটকে পড়ল বাচ্চাটি। মৃদুলও সাইকেল নিয়ে উল্টে পড়ল রাস্তার উপর। সোজা হয়ে সামনের দিকে যেতেই সে দেখল – ততক্ষণে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গিয়েছে জায়গাটিতে। এই প্রথমবার সে বাচ্চাটির মুখ ভালোভাবে লক্ষ্য করল। সর্বনাশ! এ যে রাজীব, তার কম্পিউটার ছাত্র! রাজীবের মা দৌড়ে এসে মৃদুলকে ধরল।
“তাড়াতাড়ি একটা টোটো বা অটো ডাকো মৃদুল, দেখ ছেলেটার কি অবস্থা করেছ…” –খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন রাজীবের মা।
রাস্তার উপর পড়ে রয়েছে রাজীব, মুখের একপাশটা রক্তাক্ত। রাস্তাতেও বেশ খানিকটা রক্ত জমা হয়েছে। পাশ থেকে যেতে থাকা একটা অটো দাঁড় করিয়ে, রাজীবকে কোলে তুলে, তার সাইকেল ওখানেই ফেলে রেখে – হাসপাতালের উদ্দেশ্যে চলল মৃদুল।
সেইদিন মৃদুলের ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া আর হল না। এইবার বিরক্ত হয়ে পড়েছে সে। ছেলেটি যেন তার জীবনকে ধ্বংস করে দেবার জন্যই জন্মেছে। সে যতবারই অতীতকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে, ততবারই ব্যর্থ হয়েছে এই ছেলেটির জন্য। প্রতিবারই এই ছেলেটা তার চাকরী পাবার আগের মুহুর্তে এসে সবকিছু বানচাল করে দিয়ে চলে যায়। মৃদুল কিছুতেই পারছেনা – নিজের জন্য সুন্দর-সুষ্ঠু একটা ভবিষ্যৎ প্রস্তুত করতে। এখন একটা আতঙ্ক চলে এসেছে তার মনে – স্বপ্ন ভাঙ্গার আতঙ্ক!
সারা রাত ঘুম হল না তার। ক্রমাগত ভেবেই চলেছে – ‘কিভাবে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যায়!’ ‘যদি বাচ্চাটাকেই তার জীবন থেকে সরিয়ে ফেলা যায় – তাহলে কেমন হয়?!’ –অবশেষে একটা উপায় বের করেছে সে।
রাজীব প্রতিদিন বিকেলে মাঠে খেলতে আসে। এই সুযোগে মৃদুল তাকে ডেকে নিয়ে আসল – কাছেই একটা পুকুর ঘাটে, কম্পিউটার পরীক্ষার ব্যাপারে কথা বলার বাহানায়। তারপর, সুযোগ বুঝে এক ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দেয় তাকে। মৃদুল জানত রাজীব সাঁতার জানে না। কিন্তু পুরো ঘটনাটি চোখে পড়ে যায় একজন প্রতিবেশীর। তিনি দৌড়ে গিয়ে জলে ঝাঁপ দেন এবং রাজীবকে বাঁচিয়ে ফেলেন। রাজীবের মা-বাবাকে সমস্ত ঘটনাটি খুলেও বলেন তিনি। অ্যাটেম্প্ট টু মার্ডার এর কেস হয় মৃদুলের নামে।
দিনে দিনে হতাশ হয়ে পড়ছে মৃদুল। কোনও ভাবেই সে পাল্টাতে পারছে না ভবিষ্যৎ। নিজের পরিণতি দেখার জন্য বহুবার টাইম মেশিনের সাহায্যে ভবিষ্যতেও গিয়ে দেখেছে সে। কখনো নিজেকে দেখেছে জেলে; কখনো বা হাসপাতালে – হাত পা ভেঙ্গে পড়ে রয়েছে; আবার কখনো ছোটো একটা অন্ধকার ঘরে আটকা পড়ে আছে – যেখানে আলোর বিন্দুমাত্র নেই, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ, কাউকে ডাকলেও সাড়া পাওয়া যায় না।
অতীতে গিয়ে, ভবিষ্যতে গিয়ে – বহুবার বহুভাবে সে পরিস্থিতিটাকে ঘোরানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবারই। সে এবং তার চাকরীর মাঝখানে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে রাজীব নামক ছেলেটি। যার থেকে কিছুতেই পরিত্রাণ নেই মৃদুলের। একই জীবন প্রতিদিন কাটাতে কাটাতে উদাস হয়ে পড়েছে সে। তার যেন একটাই কাজ – নিজের ভবিষ্যতকে পরিবর্তন করা। অথচ দিন দিন নৈরাশ্য ঘিরে ধরছে তাকে। তার শিরায় শিরায়জেঁকে বসেছে বিষণ্ণতা। আর পারছে না সে এইরকম জীবন কাটাতে। টাইম মেশিন ওয়ালা ফোনটাও ছুঁড়ে জলে ফেলে দিয়েছিল একদিন। অথচ পরমুহুর্তেই সে নিজেকে দেখেছে – অন্য একটা দিনে, অন্য একটা সময়ে, অন্য এক জায়গায় ফোনটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফোনটাও যেন তার পিছুছাড়ছে না। ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সবকিছু যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে তার কাছে। কোনটা যে সঠিক কালের মৃদুল – তা সে নিজেও জানে না এখন। সে বুঝতেই পারছে না – এই টাইম সাইকেলটা সে ভাঙ্গবে কিভাবে?!
অবশেষে একদিন, একটা দশতলা বিল্ডিং এর ছাদে গিয়ে – রাস্তা বরাবর এক ঝাঁপ দিল মৃদুল। ভেবেছিল সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু পরমুহুর্তেই দেখতে পেল – সে ফোনটা হাতে নিয়ে, তার দোকানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফোনে আজকের তারিখটা দেখা যাচ্ছে – ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
Tags: তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সময়ের আতঙ্কে, সুমন দাস, সুমন সেন
Darun lekha. Simple kore bola complicated story. Ekdom desi science fiction. WOW.
অনেক ধন্যবাদ!
লেখা টি একটি আদর্শ কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী যেখানে টাইম মেসিনের কল্পধারনা কে কাজে লাগানো হয়েছে । কিন্তু কাহিনী কতগুলো বৃত্তের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে, অন্যমাত্রাতে বা কাহিনীর ডাইমেনসনকে নানা লেভেলে নিয়ে যাবার খুব সুন্দর সুযোগ ছিল।
পরম প্রাপ্তি। আপনার কথা মাথায় রেখে কাজ করার চেষ্টা করব। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
Nice chilo
অনেক ধন্যবাদ।