অদ্রীশ বর্ধন ও তাঁর কল্পবিজ্ঞানের গল্প “হাঙরের কান্না”
লেখক: গৌরব চন্দ্র পাল
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
Science Fiction এই আধুনিক সাহিত্য ধারাটির জন্ম পাশ্চাত্যে; ঊনবিংশ শতাব্দীতে৷ Science ও Fiction এই দুই বিপরীত ধর্মী শব্দের সমন্বয়ে “Science Fiction” শব্দবন্ধটির জন্ম৷ Science কথাটির অর্থ বিজ্ঞান বা সত্যানুসন্ধান৷ আর Fiction কথার অর্থ কল্পনা৷ অর্থাৎ “Science Fiction” হল কল্পনা ও বিজ্ঞানের যথার্থ সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক নতুন সাহিত্যিক ধারা৷ যার বাংলা প্রতিশব্দ “কল্পবিজ্ঞান“৷ আর এই বাংলা প্রতিশব্দ “কল্পবিজ্ঞান” শব্দবন্ধের জন্মদাতা হলেন প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক শ্রী অদ্রীশ বর্ধন মহাশয়৷
পাশ্চাত্যে প্রথম সায়েন্স ফিকশন কাহিনির রচয়িতা হলেন বিখ্যাত কবি পি. বি. শেলির স্ত্রী মেরি শেলি৷ তাঁর লেখা “ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন” প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালে৷ কিন্তু তখনও ‘সায়েন্স ফিকশন‘ কথাটি মানুষের অজানা ছিল৷ মেরি শেলির ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন প্রকাশের ৩৩ বছর পর ১৮৫১ সালে Willam Wilson তাঁর “A Little Earnest Book upon a Great Old Subject” নামক একটি প্রবন্ধ বইয়ে ‘Science Fiction’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন৷ কিন্তু তখনও ‘সায়েন্স ফিকশন‘ কথাটি সেভাবে প্রচলিত হয়নি৷ ১৯২৯ সালে হিউগো গার্নসব্যাক কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা ‘সায়েন্স ওয়াণ্ডার স্টোরিজ‘ প্রকাশ করেন তখন পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলির ধরন বোঝাতে ‘সায়েন্স ফিকশন‘ কথাটি ব্যবহার করেন৷ তখন থেকেই পাশ্চাত্যে ‘সায়েন্স ফিকশন‘ শব্দবন্ধটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়৷ বাংলা সাহিত্যে প্রথম কল্পবিজ্ঞানের রচনা হিসেবে ধরা হয় জগদীশচন্দ্র বসুর “নিরুদ্দেশের কাহিনী” কে৷ রচনাটি প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে৷ যদিও তার পূর্বে জগদানন্দ রায় রচনা করেছিলেন “শুক্রভ্রমণ“৷ তবে গল্পে স্বপ্নে শুক্রগ্রহে বেড়াতে যাবার কথা থাকলেও তা কল্পবিজ্ঞান হয়ে ওঠেনি৷ তারপর থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক গল্প, বিজ্ঞান-নির্ভর গল্প, বিজ্ঞান-ভিত্তিক গল্প ইত্যাদি নামে বিভিন্ন রচনা প্রকাশিত হলেও কল্পবিজ্ঞান নামটি বাংলায় তখনও ব্যবহৃত হয়নি৷ ১৯৬৩ সালে “সায়েন্স ফিকশন” এর বাংলা প্রতিশব্দ “কল্পবিজ্ঞান” শব্দবন্ধটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন অদ্রীশ বর্ধন৷ তিনি আকাশ সেন ছদ্মনামে “আশ্চর্য!” নামক পত্রিকা প্রকাশের সময় “কল্পবিজ্ঞান” কথাটি প্রয়োগ করেন৷ আর এটিই বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞানের প্রথম পত্রিকা ৷ সেই সময় থেকেই কল্পবিজ্ঞান নামটিই চলে আসছে৷ আধুনিক এই সাহিত্য ধারাটি বাংলায় দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে৷ প্রেমেন্দ্র মিত্র, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, পরশুরাম, লীলা মজুমদার, হেমেন্দ্র কুমার রায়, সত্যজিৎ রায়ের মত বিখ্যাত লেখকরা এই ধারাকে সমৃদ্ধ করে তোলেন৷ সেই ধারাতেই অদ্রীশ বর্ধনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য৷
অদ্রীশ বর্ধন বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় করে তোলেন৷ “আশ্চর্য!” পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় এইচ. জি. ওয়েলসের ‘টাইম মেশিন‘ এর অনুবাদ করেন৷ এরপর তিনি একের পর বিদেশি কল্পবিজ্ঞান কাহিনির অনুবাদ করতে থাকেন৷ তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সত্যজিৎ রায়ের যৌথ উদ্যোগে ‘সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব‘ প্রতিষ্ঠা করেন৷ কিছুদিন পর নানা সমস্যায় “আশ্চর্য!” পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়৷ বন্ধ হয়ে যায় ক্লাবটিও৷ ১৯৭৫ সালে আবার নতুন করে ‘ফ্যানট্যাসটিক‘ পত্রিকা শুরু করেন৷ সমালোচক আত্রেয়ী সিদ্ধান্ত তাঁর রচনাগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন – মৌলিক রচনা, অনূদিত রচনা ও সম্পাদিত রচনা৷ মৌলিক রচনাগুলির মধ্যে অন্যতম হল– প্রফেসর নাটবল্টু সমগ্র, বিশ্ববিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন, গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ রুদ্র, কিশোর সায়েন্স ফিকশন, অমানুষিকী, পাতায় পাতায় রহস্য, আমার মা সব জানে, মিলকগ্রহে মানুষ ইত্যাদি৷ অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – টার্জন সমগ্র, কেস অফ চালর্স ডেক্সটার ওয়ার্ড, সায়েন্স ফিকশনের দানব মিউজিয়াম ইত্যাদি৷ সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সবুজ মানুষ, ফ্যানট্যাসটিক, সেরা কল্পবিজ্ঞান অমনিবাস, আজগুবি গল্প, ছোটদের সেরা কল্পবিজ্ঞান ইত্যাদি৷
অদ্রীশ বর্ধন কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখেছেন প্রচুর, যা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ৷ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – রোনা, কালোচাকতি, সাগর দানব, বেলুন পাহাড়ের বিচিত্র কাহিনী, রঙিন কাচের জঙ্গল, উল্কা, বৈজ্ঞানিক কুমারটুলি, মলিকিউল মানুষ ইত্যাদি৷ এরকমই একটি কল্পবিজ্ঞানের বিখ্যাত গল্প “হাঙরের কান্না“৷ তাঁর সম্পাদিত ‘ছোটোদের সেরা কল্পবিজ্ঞান‘ গ্রন্থে গল্পটি সংকলিত হয়৷ এখন বিবেচ্য গল্পটি কতটা কল্পবিজ্ঞান হিসাবে সার্থক হয়েছে৷ গল্প শুরু হয়েছে সুজিত নামক একটি ছেলে তার দিদির বাড়ি বেড়াতে যায়৷ জামাইবাবু ফরেস্ট অফিসার৷ জামাইবাবু বনের নেকড়েদের ট্র্যানকুলাইজার দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে গলায় রেডিও ট্রান্সমিটার লাগানো বেল্ট পরিয়ে ছেড়ে দেন এবং রেডিও সিগন্যাল ফলো করে নেকড়েদের সমন্ধে তথ্য সংগ্রহ করেন৷ এক দলছুট নেকড়ের গলায় ট্র্যান্সকুলাইজার পরিয়ে দেন এবং রেডিও সিগন্যাল ফলো করে সুজিত ও জামাইবাবু এক নির্জন জায়গায় পৌঁছে যান৷ সেখানে এক অদ্ভুত নীরবতায় সুজিত ও জামাইবাবু বুঝতে পারেন এক ভয়ঙ্কর জায়গায় চলে এসেছেন৷ যেখানটা মৃত্যুপুরীর মত স্তব্ধ ‘তবুও যেন মৃতের রাজত্ব নয়‘৷ কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাদের লক্ষ্য রাখছে৷ এরকম এক গা ছমছমে রহস্যময় পরিবেশ দিয়ে গল্প শুরু হয়েছে৷ যেহেতু গল্পটি কিশোরদের জন্য রচিত তাই কোনো জটিলতায় না গিয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করার জন্য এরকম গা ছমছমে পরিবেশের সৃষ্টি করেছেন৷ আসলে তাঁর কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিগুলিতে বিজ্ঞানের জটিলতা খুব একটা দেখা যায় না৷ তাঁর কল্পবিজ্ঞানে বিজ্ঞান অপেক্ষা কল্পনার প্রাধান্য থাকে বেশি৷ এই গল্পও তার ব্যতিক্রম নয়৷ তিনি গ্রন্থের শুরুতেই ভূমিকাংশে বলেছেন -“কিন্তু যে–সব গল্পে স্কুলমাস্টারি হয়েছে— বিজ্ঞান নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে গল্পগুলোকে ছিবড়ে অথবা শুকনো খটখটে করে ফেলা হয়েছে— সে সব গল্প যারা পড়েছে— তারা কল্পবিজ্ঞানের নাম শুনলেই ভয় পায়৷ ছোটোদের গল্প হোক গল্পের মতোই—“৷ তাই তিনি গল্পে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মত জটিলতায় যাননি, কেবল বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দিকটি তুলে ধরেছেন৷ তাই তারপর গল্পে দেখা যায় সেই নির্জনবনে এক বুড়ো অথচ দুষ্ট বিজ্ঞানীর ডেরায় চলে যায় সুজিত ও সুজিতের জামাইবাবু৷ যে বুড়ো বিজ্ঞানী তিনযুগ ধরে সাধনা করেছে প্রজননবিদ্যা নিয়ে৷ সুজিতদের নিয়ে এবার এক্সপেরিমৈন্ট করতে চান৷ জামাইবাবুর সঙ্গে নেকড়ের ও সুজিতের সঙ্গে হাতির বিয়ে দিয়ে নেকড়ে–মানুষ ও গণেশের মতো প্রাণীর জন্ম দিতে চান৷ কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠে না৷ জামাইবাবু বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বুড়ো বিজ্ঞানী ও তাঁর সাকরেদ গরিলা সুন্দরী টুনটুনিকে বোকা বানিয়ে, পায়ের কাছে লুকিয়ে রাখা ছোট্ট বন্দুক দিয়ে গরিলাকে হত্যা করে এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে বিজ্ঞানীকে অজ্ঞান করে দেয়৷ খাঁচা ভর্তি নেকড়ের কাছে জ্ঞানহীন বুড়ো বৈজ্ঞানিককে ফেলে দিয়ে সেখান থেকে তারা পালিয়ে যায়৷ গল্প এখানেই শেষ৷
কল্পবিজ্ঞান কাহিনির বৈশিষ্ট্যগুলি প্রায় সবই ফুটে উঠেছে খুব সুন্দর ভাবে৷ যেমন কল্পবিজ্ঞানে লেখক আগামী দিনের কথা বলবেন৷ বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার ও নতুন প্রযুক্তির কথা বলবেন৷ ‘হাঙরের কান্না‘ গল্পেও দেখা যায় এক বুড়ো দুষ্টু বিজ্ঞানী যে তিন যুগ ধরে সাধনা করেছেন প্রজননবিদ্যা নিয়ে৷ ল্যাবরেটরিতে টেস্টটিউব বেবী বানানোর কথা বলেছেন এক যুগ আগে৷ এমনকি বুড়ো বিজ্ঞানী জানায় “আমি এখন কোথায় এগিয়ে গিয়েছি ধারণাও করতে পারবি না৷ মানুষ মেয়ে বিয়ে না করেও বাচ্চার বাবা হচ্ছি৷ আমার বাচ্চা জন্মাচ্ছে কখনো হাঙরের পেটে, কখনো বোয়ালের পেটে, কখনো কুমীরের পেটে৷” আর সুজিতের সঙ্গে হাতির বিয়ে দিয়ে গণেশ জন্মায় কিনা দেখতে চান৷ সুজিত ভয় পেলেও জামাইবাবু রসিকতা করে বলেন-‘দূর বোকা! এক্সপেরিমেন্ট ইজ এক্সপেরিমেণ্ট৷ কত বড় একটা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে ভাবতে পারিস? গণেশের বাবা হবি তুই৷ কম ভাগ্যের কথা?’ আর এখানেই বৈজ্ঞানিক সম্ভাব্যতার পাশাপাশি মিশে যায় মজার আবহ৷ গল্পে টুনটুনি নামে এক বিশাল চেহারার গরিলা সুন্দরীকে পাওয়া যায়৷ যার মাথায় ডলফিনের ব্রেন লাগানো যা মানুষের আই–কিউ থেকে বেশি৷ আর এই রকম বৈজ্ঞানিক ঘটনা (রিকমবাইন্যান্ট জীন) কে কেন্দ্র করেই কাহিনি অাবর্তিত হয়ে পরিণতি লাভ করেছে৷ যা কল্পবিজ্ঞানের গল্প হিসাবে সার্থক হয়ে উঠেছে৷
গ্রন্থঋণঃ
১) অদ্রীশ বর্ধন, ছোটদের সেরা কল্পবিজ্ঞান(সম্পাদিত), শশধর প্রকাশনী, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯২৷
২) সাহিত্যতক্কো, বসন্ত ১৪২১, বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান, সম্পাঃ উদয় রতন মুখার্জী, তৃতীয় বর্ষ, ষষ্ঠ সংখ্যা৷
Tags: গৌরব চন্দ্র পাল, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, প্রবন্ধ
সাহিত্যতক্কো পত্রিকাটি কোথায় পাবো বলতে পারেন? কল্পবিজ্ঞান বিষয়ে আরও কোনও পত্রিকা থাকলে নাম যদি বলেন বা কোথায় পাবো যদি জানান খুব উপকৃত হব।
কল্পবিজ্ঞান বিষয়ক আর কোনো পত্রিকা এই মুহূর্তে প্রকাশিত হচ্ছে না। আগে আশ্চর্য, বিস্ময় ও ফ্যান্টাসটিক – এই তিনটি প্রিন্টেড পত্রিকা প্রকাশিত হত। ইদানিং কালে পরবাসীয়া পাঁচালী নামক ওয়েব পত্রিকাতেও প্রচুর কল্পবিজ্ঞান প্রকাশ পেয়েছে।