সিনেমার পর্দায় মজার সায়েন্স ফিকশন
লেখক: রাকেশকুমার দাস
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
আমরা বোধ করি সবাই সায়েন্স ফিকশনের প্রথম স্বাদ পাই সিনেমার মাধ্যমেই। ছাপার অক্ষরের আগে সিলভার বা অ্যামোলেড স্ক্রিন আমাদের সেই স্বাদ চাখিয়ে দেয়। মনে আছে ‘সাই-ফাই’ এবং ‘সাইবর্গ’—এই দুটি শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম যখন ‘টার্মিনেটর টু’ সিনেমাটি মুক্তি পায়। প্রফেসর শঙ্কুর সঙ্গে আলাপ হতে তখনও ঢের দেরি। আমেরিকা ও ইউরোপের সিনেমাওয়ালারা খুব তাড়াতাড়ি এই ঘরানাটির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা টের পান, পাশাপাশি সৃজনশীলতা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবেও এর বিশাল সম্ভাবনা অনুভব করেন। তাই সিনেমাতেও সায়েন্স ফিকশন (সিনেমা জগতের কথ্যভাষায় ‘সাই-ফাই’) বিশেষ জনপ্রিয় একটি জনরা। আর প্রায়ই সিনেমাওয়ালারা সাই-ফাইকে পরিবেশন করেন অন্যান্য জনরার মশলা মিশিয়ে। যেমন সাই-ফাই হরর, সাই-ফাই অ্যাকশন, সাই-ফাই কমেডি ইত্যাদি। কল্পবিশ্বের এই সংখ্যা যেহেতু হাস্যরসাত্মক কল্পবিজ্ঞান তাই কারোর বুঝতে আর বাকি নেই যে আজ আমরা মূলত সাই-ফাই কমেডি নিয়েই কথা বলব। কমেডি বললেই একটা সমস্যা চলে আসে। থিয়েটারের ভাষায় কমেডি মানে মিলনান্তক নাটক, অর্থাৎ যেখানে কাহিনীর শেষটা প্রধান চরিত্রদের জন্য সুখকর এবং আনন্দদায়ক হবে। কমেডির আরেকটা অর্থ হয়—হাস্যোদ্দীপক; অর্থাৎ যা দর্শককে হাসায়। সেই হাসি খিলখিল বা মুচকি হতে পারে, বা নিখাদ ব্যঙ্গ হতে পারে যা হাসানোর বদলে খোঁচাও মারতে পারে। আমরা এই আলোচনাতে ‘হাস্যোদ্দীপক’ অর্থের কমেডি সিনেমাকেই প্রাধান্য দেব। তবে আমরা সেটাকে একটু বিস্তার করে এটা বলতে পারি যে হাস্যরসের মাত্রাভেদে যে সব সিনেমায় কাহিনি ও চরিত্ররা দর্শকদের হালকা বা উৎফুল্ল মেজাজে রাখে, প্রধান চরিত্ররা বিপদে পড়লেও দর্শক খুব বেশি চিন্তিত হয় না সেই সব সিনেমাই আমাদের এখানে উপজীব্য। তবে আগেই সাবধান করে রাখি, এর ব্যতিক্রম যে হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
সাই-ফাই জনরার মধ্যে অনেক সাবজনরা এবং ট্রোপ দেখা যায়, যেমন এলিয়েন ইনভেসন, টাইম ট্রাভেল, স্পেস ড্রামা, রোবট/মনস্টার, সুপারহিরো, অ্যাপোক্যালিপ্টিক, ডিসটোপিয়ান ইত্যাদি—এদের বেশির ভাগের সঙ্গেই কমেডি দিব্যি মিলেমিশে থাকতে পারে। সিনেমাওয়ালারা এরকমই কিছু সায়েন্স ফিকশনের জনপ্রিয় ট্রোপ নিয়ে কাল্পনিক পরিস্থিতিতে মজার মজার ঘটনাদৃশ্য ও সংলাপ নির্মাণ করেন, কখনো এমন কিছু কাল্পনিক প্রযুক্তির কথা শোনান যা মজার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, বা কখনো জনপ্রিয় কোন গল্প বা সিনেমাকে প্যারোডি বা স্পুফ করে সিনেমা বানান।
মজার সাই-ফাই সিনেমা নিয়ে বলতে গেলে এমন একটা ছবি নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে যা শুধু সাই-ফাই বা কমেডি নয়, সমস্ত রকম সিনেমার জন্যেই একটি মাইলফলক, তবে সাই-ফাই এবং ফ্যান্টাসি সিনেমা এর থেকে যতটা অগ্রগতি পেয়েছে তার কোনো তুলনা হয় না। যারা সিনেমার ইতিহাস নিয়ে সামান্য খোঁজখবর রেখেছেন তারা প্রথম দর্শনেই উপরের ছবিটা চিনে ফেলবেন। এটি সিনেমার ইতিহাসের একদম প্রথমযুগের ছবি ‘লে ভয়াজ দান্স লা লুন’ বা ‘এ ট্রিপ টু দ্য মুন’ (১৯০২) ছবির বহুল পরিচিত একটি দৃশ্য। এটি নির্মাণ করেন ফরাসি সিনেমানির্মাতা জর্জ মেলিয়েস। এই ভদ্রলোকের সম্পর্কে কিছু না বললে হয়তো একটু অন্যায় হবে। জর্জদের পারিবারিক ব্যাবসা ছিল জুতো তৈরির, কিন্তু জুতো সেলাইয়ের থেকে অঙ্কনশিল্পে তার বেশি মন ছিল। আক্ষরিকভাবেই স্কুল-কলেজে তাঁর “অঙ্কের খাতা ভরা থাকত আঁকায়”। উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে গেলে আরেক নেশা পেয়ে বসে। প্রবাদপ্রতিম জাদুকর হবেয়ার-হুদান (Robert-Houdin) এর জাদু দেখে মুগ্ধ হয়ে স্টেজ ম্যাজিক শিখতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে হুদানের মৃত্যুর পর তাঁর জাদু দেখানোর থিয়েটারটি কিনে নেন, সেটিকে সংস্কার করে নিজের শিল্প ও সৃজনশীলতা দিয়ে অনেক নতুন ম্যাজিক তৈরি করে দেখানো শুরু করেন। ঘটনাক্রমে এর পর মোশন পিকচার এর সঙ্গে পরিচিত হন। লুমিয়ের ব্রাদার্সের ‘অ্যারাইভাল অব এ ট্রেন’ দেখে প্রবল উৎসাহিত হয়ে তাদের সিনেম্যাটোগ্রাফ নামক মুভি ক্যামেরাটি কিনতে চান। তারা সেটি বিক্রি না করলে মেলিয়েস ‘অ্যানিম্যাটোগ্রাফ’ নামক একটি ফিল্ম প্রোজেকশন যন্ত্র সংগ্রহ করেন, সেটাকেই রিভার্স-ইঞ্জিনিয়ারিং করে ক্যামেরা বানিয়ে নেন। এরপর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার সময় কিছু মধুর দুর্ঘটনা ঘটে যার ফলে ট্রিক ফোটোগ্রাফির বেশ কিছু পদ্ধতি তার সামনে উন্মোচিত হয়, যেমন সাবস্টিটিউশন স্প্লাইস (যে পদ্ধতিতে ফিল্মের একটি সময়ে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল উন্মোচিত করে ছবি নেওয়া হয়, ও পরে অন্য অংশটি উন্মোচিত করে ছবি নেওয়া হয়। একই ব্যক্তি দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করা, কোনো কিছুকে অদৃশ্য করে দেওয়া, বা কোনো কিছুকে অনেক ছোটো বা বড়ো করে দেওয়া এই পদ্ধতিতে করা সম্ভব হয়), মাল্টিপল এক্সপোজার, টাইম-ল্যাপ্স, ডিসল্ভ এফেক্ট ইত্যাদি। বোঝাই যাচ্ছে সাই-ফাই বা ফ্যান্টাসি ছবির কাল্পনিক প্রেক্ষাপট গড়ে তোলার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর এই উদ্ভাবনা। জাদুর কৌশল তো তার জানা ছিলই, তার সঙ্গে এই ট্রিক ফোটোগ্রাফি জুড়ে অনেক স্পেশাল এফেক্ট দেওয়া চলমান-ছবি নির্মাণ করেন। জাদুর পাশাপাশি এইসব অবাক-করা চলমান-ছবি দেখাতে শুরু করেন তাঁর প্রদর্শনে। স্পেশাল এফেক্টের জনক বলা হয় তাঁকে। এর সঙ্গে তিনি শুরু করলেন চলমান ছবিতে একাধিক সিন জুড়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গল্প বলা। এই প্রচেষ্টারই সফল একটি রূপায়ণ দেখি আমরা ‘এ ট্রিপ টু দ্য মুন’ (১৯০২) ছবিতে। জুল ভের্নের ‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’ কাহিনিকে একটু মজার ছলে পরিবেশন করেন এই ছবিতে। একলাফে অনেকটা সাবালক হয়ে পড়ে সিনেমা, সেই সঙ্গে তৈরি হয় সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসি সিনেমা তৈরি হওয়ার ভিত্তিপ্রস্তর।
এর প্রায় ত্রিশ বছর পর, যখন পূর্ণদৈর্ঘ্যের সবাক ছবি আসা শুরু হয় তখন এক-এক করে বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসি নভেলগুলি পর্দায় আসতে শুরু করে। যেমন, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন, ড্রাকুলা, ইনভিজিবল ম্যান। কল্পবিজ্ঞানের আরেক দিকপাল এইচ-জি ওয়েলসও এলেন হাস্যরসে, তবে সরাসরি নয়। তাঁর গল্প থেকে তৈরি হওয়া ‘ইনভিজিবল ম্যান’ এর সিরিজে একটি ছবি আসে ‘ইনভিজিবল ওম্যান’ (১৯৪০) বলে, সেটি কমেডি ছিল। লরেল-হার্ডির মতো বিখ্যাত কমেডি জুটি অ্যাবোট এবং ক্যাস্টেলো এই বিখ্যাত গল্পগুলির আঙ্গিকে কিছু সিনেমা তৈরি করেন। তবে এই সাদা-কালো জমানায় যে ছবিটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল গল্পের অভিনবতায় এবং মজায়, সেটি হল ‘দা অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর’ (১৯৬১)। নিজের বিয়েতে যেতেই ভুলে যায় এমন এক প্রফেসর তৈরি করে ফেলেন এমন এক পদার্থ, যেটা কোন শক্ত যায়গায় ধাক্কা খেলে শক্তি উৎপন্ন করে, তাতে তার ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়— আগের থেকেও অনেক বেশি লাফায় জিনিসটা। এর নাম দেওয়া হল ফ্লাবার (ফ্লাইং রাবার), যেটা দিয়ে ওড়ার কিছুটা ব্যবস্থা করা গেল। উড়ে উড়ে বাস্কেটবল খেলা থেকে গাড়িশুদ্ধু উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার এই প্রযুক্তি উপযুক্ত যায়গায় বেচা নিয়েই সমস্যার সৃষ্টি, সেটা নিয়েই মজাদার এই ছবি। দু-বছর পর এই ছবির সিকোয়েল আসে ‘সন অফ ফ্লাবার’ বলে। ডিজনি এই ছবির রিমেক করে ১৯৯৭ সালে যার নাম ‘ফ্লাবার’, তাতে ভুলোমনের প্রফেসরের ভূমিকায় অভিনয় করেন রবিন উইলিয়ামস। নাইন্টি’স কিডদের অনেকেরই ছোটবেলার অন্যতম প্রিয় সিনেমা এই ফ্লাবার। সাই-ফাই কমেডিতে প্রফেসার বলতে আরেকজনের কথা মনে পড়ে, নাটি প্রফেসর। ইনি আবার নিজের আবিষ্কার করা সিরাম খেয়ে দুর্বল, ভীতু থেকে একেবারে হ্যান্ডসাম হাংক বনে যান। ‘দা নাটি প্রফেসর’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৩ সালে, ১৯৯৬ সালে আবার এটি রিমেড হয় (সঙ্গে সিকোয়েল), যাতে এডি মার্ফি নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন।
আমরা যদি সত্তরের জমানায় ঢুকি, দেখতে পাব যে মেরি শেলির যুগান্তকারী চরিত্র ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন এবং তার সৃষ্ট মনস্টারকে কেন্দ্র করে সিরিয়াস অর্থাৎ হরর ছবি ইতিমধ্যে অনেক হয়ে গেছে। তবে কমেডিতে এইবার একটি মোক্ষম ছবি তৈরি হল যা দর্শককে একেবারে মাতিয়ে দিল। ছবির নাম ‘ইয়ং ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ (১৯৭৪), পরিচালক মেল ব্রুকস—যিনি পরে স্পেসবল, ড্রাকুলা: ডেড অ্যান্ড লাভিং ইট ও রবিনহুড: মেন ইন টাইটস এর মত সুস্বাদু স্পুফ বানাবেন। ছবির প্রধান চরিত্র ফ্রেডেরিক ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন—যিনি পিতা ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের কৃতকর্মে অত্যন্ত লজ্জিত, পারলে বাপের সঙ্গে সম্পর্কও অস্বীকার করেন। ইনিও বিজ্ঞানী, তবে বাবার কাজকে মোটেও আমল দেন না। হঠাৎই একদিন উত্তরাধিকার সূত্রে ট্রান্সিলভ্যানিয়ায় একটি ক্যাসল লাভ করেন যেখানে তিনি খুঁজে পান বাবার লুকানো ল্যাবোরেটরি, এবং সেই বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্টের কাগজপত্র। অনুগত অ্যাসিস্ট্যান্ট আইগর আর ইঙ্গাকে নিয়ে লেগে পড়েন মরা মানুষ জ্যান্ত করতে। মজাদার সংলাপ, কাণ্ডকারখানা আর অভিনয় দর্শককে মাতিয়ে রাখে। জিন ওয়াইল্ডার এবং মার্টি ফেল্ডম্যানের কমিক-অভিনয় ছবির বিশেষ প্রাপ্তি। সাই-ফাই কমেডির তালিকায় এটি ক্লাসিকের জায়গা দখল করবে।
এই সময়েই মুক্তি পায় উডি অ্যালেন পরিচালিত এবং অভিনীত স্লিপার (১৯৭৩)। শোনা যায় তিনি ছবির মূল আইডিয়াটা পেয়েছিলেন এইচ-জি ওয়েলসের “হোয়েন দ্য স্লিপার ওয়েকস্” নামক একটি ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস থেকে। ছবিতে দেখা যায় একজন সাদামাটা ক্ল্যারিনেটবাদক মাইলস মনরো একটি ছোটোখাটো অপারেশন করানোর জন্য হাসপাতাল গেলে তার শারিরীক বিপর্যয় ঘটে, ডাক্তাররা তাকে ক্রায়োজেনিক স্লিপে পাঠিয়ে দেয়। এর প্রায় দুশো বছর পর তাকে আবার জাগিয়ে তোলে ডাক্তাররা। ইংল্যান্ড সেই সময় ‘দা লিডার’ বলে ডিকটেটরের শাসনে চলছে। তার বিরুদ্ধে যে বিপ্লবমুখী কর্মসূচি চলছে সেখানে মাইলসকে একান্তই দরকার, কারণ একমাত্র তারই কোন বায়োমেট্রিক তথ্য সরকারের কাছে নেই—তার পক্ষে সহজ হবে গোপন প্রোজেক্ট সম্পর্কে তথ্য চুরি করে আনা। মাইলসের ভূমিকায় অভিনয় করতে উডি অ্যালেন তাঁর অনবদ্য অভিনয়প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। কখনো আসল মাইলস হয়ে ডেডপ্যান হিউমার-সংলাপ বলছেন, কখনো রোবট সেজে বা ফোলানো-পোশাক পরে স্ল্যাপস্টিক ফিজিক্যাল কমেডি, কখনো মগজধোলাই হয়ে যাওয়ার পর নারীসুলভ অভিনয়—উডি অ্যালেন বলতে গেলে একাই নানা অবতারে জমিয়ে রাখেন। স্লিপার সাই-ফাই কমেডির লিস্টে সেরার তালিকায় থাকবে নির্দ্বিধায়।
আটের দশকের উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে ‘দ্য ম্যান উইথ টু ব্রেইনস’ (১৯৮৩) । বিখ্যাত অভিনেতা ও কমেডিয়ান স্টিভ মার্টিন অভিনয় করেন এক ব্রেন সার্জনের ভূমিকায় যিনি প্রেমে পড়েন জারে রাখা একটি মহিলার ব্রেনের সঙ্গে—তার সঙ্গে টেলিপ্যাথির দ্বারা কথা বলে। ১৯৮৪ সালে মুক্তি পায় ‘দি আইস পাইরেটস’। এ এক এমন সময়ের গল্প যখন পৃথিবীতে জল দুষ্প্রাপ্য, এবং বরফের টুকরোই বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মিথ্রাদেবীর মন্দিররক্ষকরাই জলের নিয়ন্ত্রণ করেন আর ডাকাতের দল তৈরি থাকে বরফ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। পরের বছর মুক্তি পায় এই ঘরানার অন্যতম বিখ্যাত ছবি বিখ্যাত পরিচালক রবার্ট জেমেকিস পরিচালিত ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’ (১৯৮৫)। গল্পে মার্টি ম্যাকফ্লাই নামে একটি ছেলে প্রতিবেশি বিজ্ঞানি ‘ডক’ এর বানানো টাইমমেশিন চড়ে পৌঁছে যায় অতীতে, উদ্দেশ্য অতীতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়ে আসা কমবয়েসি ডককে। ফিরে আসার জন্য প্লুটোনিয়াম না থাকায় মার্টির ভরসা সেই কমবয়েসি ডক। এদিকে আরেক বিপত্তি। ঘটনাচক্রে তার কমবয়েসি মা তারই প্রেমে পড়ে যায়, অথচ তার বাবার সঙ্গে মায়ের বিয়ে না হলে তো তার নিজেরই অস্তিত্ব সংকটে! এই নিয়েই নানা মজাদার কাণ্ডকারখানা। অন্যতম সেরা ফিল্ম ট্রিলজিতে অভিনয় করেন মাইকেল জে ফক্স (মার্টি) এবং ক্রিস্টোফার লয়েড (ডক)। ১৯৮৬ সালে মুক্তি পায় ‘শর্ট সার্কিট’। একটি প্রোটোটাইপ মিলিটারি রোবট যান্ত্রিক দুর্ঘটনায় আংশিক বিকল হয়ে পড়ে এবং ঘটনাচক্রে সেটি বাইরে চলে এসে একটি মেয়ের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেখানে যে জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পারে। যার ফলে নিজে মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে কাঁটা হয়ে থাকে, এবং কাউকে হত্যা করতে সে নারাজ হয়। এই আলোকপ্রাপ্ত অধুনাভীতু রোবটকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া নিয়েই মিলিটারি, বিজ্ঞানী, কিশোরী এবং তার গুণ্ডা বয়ফ্রেন্ড—সবাইকে নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড। দেখা না থাকলে আজই দেখে নিন মিষ্টি এই ছবিটি। আরেকটি ছবি লোকমুখে আলোচিত হয় সেই সময়ের, তার নাম ‘ইনারস্পেস’ (১৯৮৭)। মিনিয়েচারাইজেশন পদ্ধতিতে একটি যান সমেত মানুষকে ছোটো করে একটি পোকার রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করানোর প্ল্যান ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের, কিন্তু প্রযুক্তিচোরদের ঝামেলায় সেই ছোটো হয়ে যাওয়া ব্যক্তি প্রবেশ করে অন্য একটি ব্যক্তির দেহে। অতঃপর আবিষ্কার হয় এই দুই ব্যক্তি নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারছে। অতঃপর শুরু হয় বদমাইশদের প্ল্যান ভেস্তে দিয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসার লড়াই। ত্রুটি থাকলেও বেশ উপভোগ্য এই ছবি, বিশেষ করে দেহের ভিতর থেকে মদ খাওয়ার দৃশ্যটি বেশ মজার। সাই-ফাই কমেডিতে একই সঙ্গে সবচেয়ে উদ্ভট আর মৌলিক বলে মনে করা হয় সেই ছবিটি হল ‘দি অ্যাডভেঞ্চার অব বাকারু বানজাই এক্রস দ্য এইটথ ডাইমেনশন’। ১৯৮৪ সালে লো বাজেট মুভিটি বক্স-অফিসে প্রচণ্ড ফ্লপ হয়, অথচ পরে সাই-ফাই ফ্যানেদের কাছে এটি কাল্ট মুভি হিসেবে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়। গল্পে বাকারু বানজাই সুদর্শন বিজ্ঞানী, রকস্টার, অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী এবং জাতীয় নায়ক। তার আবিষ্কৃত ওভারথ্রাস্টার যন্ত্র দিয়ে কঠিন বস্তুর মধ্য দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় সে, কিন্তু এই পরীক্ষায় অন্য একটি ডাইমেনশন থেকে ভিনগ্রহী জীবের নমুনা নিয়ে আসেন। এদিকে মানসিক রোগী হয়ে বন্দি বিজ্ঞানী লিজার্দো এই যন্ত্র দখল করতে বেড়িয়ে পড়ে, সেই সঙ্গে প্রকাশিত হয় পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘটে চলা কিছু ঘটনা যাতে প্ল্যানেট টেন বলে একটি গ্রহের দুই যুযুধান গোষ্ঠী জড়িত। বাকারু কি পারবে এই দুই গোষ্ঠীর কোন্দল থেকে উলুখাগড়া পৃথিবীকে বাঁচাতে? ছবিতে মজা রয়েছে হালকা পরতে, কখনো স্যাটায়ারে, কখনো অ্যাবসার্ডিটিতে, কখনো বা হাস্যকর রূপায়ণে। ১৯৮৭-তেই ইয়ং ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন খ্যাত মেল ব্রুকস বানায় আরেকটি চরম মজাদার ছবি, নাম ‘স্পেসবল্স’। গল্প সম্পর্কে কিছু না বলে বরং এটা বলা যায় যে ছবিটি মূলত স্টার ওয়ার্স সিরিজের স্পুফ। তবে স্টার ট্রেক সমেত অন্যান্য সাই-ফাই ও বিখ্যাত মুভিরাও ছাড় পায়নি সেই মজার হাত থেকে। হাস্যরসের মাত্রায় বিচার করলে এই ছবি একেবারে টইটম্বুর, হাসতে হাসতে পেটে খিল পড়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। স্পুফ বা প্যারোডি মুভির মধ্যে এটি অন্যতম সেরা একটি উদাহরণ।
এরপর আসা যাক আরেক মজার ছবির কথায়—ডিজনির ‘হানি, আই শ্রাংক দ্য কিডস’ (১৯৮৯)। বিজ্ঞানী বাবার আবিষ্কার করা যন্ত্রের পাল্লায় পড়ে অতি ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে তার ছেলে-মেয়ে এবং পাশের বাড়ির সঙ্গীরা। এরই সিকোয়েল ‘হানি, আই ব্লু আপ দ্য কিডস’ (১৯৯২) এর বিপরীতমুখী যন্ত্রের প্রকোপে তারা আকারে বড়ো হয়ে যায়। শেষ সিকোয়েল ‘হানি, আই শ্রাংক আওয়ারসেল্ভস’ (১৯৯৫) ছবিতে বিজ্ঞানী ওয়েন, তার স্ত্রী, ভাই ও ভাইয়ের বউ ছোটো হয়ে যায় অসাবধানতাবশত শ্রিংকিং মেশিন বন্ধ না করায়। বোঝাই যাচ্ছে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার আগে তাদের বিস্তর ঝামেলা ও বিপদ পেরোতে হবে, আর এই নিয়েই যত মজা। ১৯৮৯ তে আরেকটি ট্রিলজি সিরিজের সূচনা হয় ‘বিল অ্যান্ড টেড’স এক্সেলেন্ট অ্যাডভেঞ্চার’, ছবির মাধ্যমে, যেখানে দুইজন ছাত্র ভবিষ্যত থেকে পাঠানো একটি টাইম মেশিনে করে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে কলেজে হাজির করে তাদের ইতিহাসের রিপোর্ট অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে।
নয়ের দশকে প্রচুর সাই-ফাই কমেডি সিনেমা মুক্তি পায়। এলিয়েন ইনভেশন স্পুফ ও কিছুটা ডার্ক স্যাটায়ারিক্যাল ‘মার্স অ্যাটাক’ (১৯৯৬), একাধিক ক্লোন নিয়ে জেরবার হওয়ার গল্প নিয়ে মাইকেল কিটন অভিনীত ‘মাল্টিপ্লিসিটি’ (১৯৯৬), ফ্লাবার, নাটি প্রফেসর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ফ্লাবার নিয়ে তো আগেই কথা হয়েছে, মাল্টিপ্লিসিটিও বেশ উপভোগ্য মুভি৷ কাজের চাপে পরিবারকে সময় দিতে না পারার যন্ত্রণা কাটাতে ভদ্রলোক এক পরিচিত বিজ্ঞানীকে দিয়ে করালেন নিজের ক্লোন। তারপর সংসারের কাজে সাহায্যের জন্য আরেকটি ক্লোন। এই দুই ক্লোন মিলে সাঁট করে আরেকটা ক্লোন বানায়। আঁচ করাই যাচ্ছে কি পরিমাণ বিপর্যয় হতে পারে এদের গোপন রেখে পরিবার আর চাকরি সামলানো! মজার ছবি হিসেবে ক্লোন নিয়ে এই ‘ভ্রান্তিবিলাস’ বেশ উপভোগ্য। আর রয়েছে ‘গ্যালাক্সি কোয়েস্ট’ (১৯৯৯)। স্টার ট্রেকের মতো একটি টিভি সিরিজের অভিনেতারা ঘটনাক্রমে জড়িয়ে পড়ে আন্তঃনক্ষত্র ঝামেলায়। হয়েছিল কি,কিছু সাদাসিধা এলিয়েন পৃথিবীর স্টার ট্রেকের মতো অনুষ্ঠানকে সত্যঘটনা বলে ধরে নেয় এবং তারা নিজেদের সমাজ, প্রযুক্তি সব সেই অনুষ্ঠান অনুকরণ করে বানায়। তারা যখন দারুণ এক সমস্যায় পড়ে বাঁচার আর কোনো রাস্তা দেখে না, তারা পৃথিবীতে এসে তাদের শরণাপন্ন হয় এবং অভিনেতাদের আসল অ্যাস্ট্রোনট ভেবে নিজেদের স্পেসশিপের দায়িত্ব দিয়ে দেয়। সেই অভিনেতারা কি পারবে স্পেসশিপ চালাতে? বা সেই আন্তঃনক্ষত্র ঝামেলার সুরাহা করে শরণাপন্নদের বাঁচাতে? এজন্য দেখতে হবে গ্যালাক্সি কোয়েস্ট। এই দশকের আরেক সেরা সিনেমা হল ‘মেন ইন ব্ল্যাক’ (১৯৯৬)। মেন ইন ব্ল্যাক হল একটি গোপন নজরদারী সংস্থা যারা মানুষের মাঝেই লুকিয়ে থাকা এলিয়েনদের নিয়ন্ত্রণ করে আর বদমাইস এলিয়েনদের খুঁজে বের করে নিকেশ করে। এই সংস্থারই দুই অফিসার এজেন্ট কে ও এজেন্ট জে’র ঘাড়ে দায়িত্ব পড়ে কিছু অপরাধের তদন্ত করার, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অনেক বড়ো এক চক্রান্ত উন্মোচন হয় যাতে পৃথিবীকে বাঁচানোর দায়িত্বটাও তাদের নিতে হয়। এম-আই-বি (মেন ইন ব্ল্যাক) ফ্র্যাঞ্চাইজির চারটে সিনেমা আছে। প্রথমটির মতো দ্বিতীয়টিও অবশ্যদ্রষ্টব্য। শেষের ছবিটি (মেন ইন ব্ল্যাক: ইন্টারন্যাশনাল, ২০১৯) এজেন্ট কে ও এজেন্ট জে’র অ্যাডভেঞ্চার নয়, একই ইউনিভার্সে নতুন চরিত্র নিয়ে বানানো।
সায়েন্স ফিকশন সাহিত্যে হাস্যরসের কথা আলোচনা করলে যে বইটি অবিসংবাদিতভাবে সবার প্রথমে এসে পড়ে সেটি হল ডগলাস অ্যাডামসের ‘দ্য হিচহাইকার’স গাইড টু দ্য গ্যালাক্সি’। যদিও প্রথমে এটি বেতারনাট্য হিসেবে লেখা হয়। পরে এটি ‘পাঁচখণ্ডে বিভক্ত ট্রিলজি’ নভেল হিসেবে বেরোয়। ২০০৫ সালে এই কাহিনি সিনেমা হিসেবে পেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। পৃথিবীতে অজ্ঞাতবাসে থাকা ভিনগ্রহী ফোর্ড প্রিফেক্ট আসলে তথ্য সংগ্রহ করার কাজ করে একটি মহাবিশ্বকোশের জন্য, যার নাম দ্য হিচহাইকার’স গাইড টু গ্যালাক্সি। সে ও তার খাঁটি পার্থিব বন্ধু আর্থার ডেন্ট পৃথিবী ধ্বংসের ঠিক কয়েক মুহূর্ত আগে চড়ে বসে এক মহাকাশযানে। অতঃপর জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজতে তারা বেরিয়ে পড়ে আন্তঃনক্ষত্র অভিযানে। নভেলের মতো সিনেমাটি ততটা প্রভাবশালী এবং সফল না হলেও, মজার সাই-ফাই সিনেমার তালিকায় থাকার জন্য যে যথেষ্ট উপকরণ রয়েছে তার প্রধান কারণ লেখক ডগলাস অ্যাডামসের অনন্য অসাধারণ হিউমার। হিচহাইকার যদি দর্শকদের নির্মল হিউমারের আনন্দ দিয়ে থাকে, তবে ঠিক এর পরের বছর সোশাল স্যাটায়ার হিসেবে মুক্তি পায় ‘ইডিওসিটি’ (২০০৬)। যদিও মুক্তি পায় শুধু নাম কা ওয়াস্তে, নির্মাতারা আসলে ছবিটি পেক্ষাগৃহে মুক্তি দিতে চাননি। ছবিতে যেভাবে ভোগবাদ, বুদ্ধিবৃত্তির অবক্ষয়, পুঁজিবাদ, অশিক্ষা ইত্যাদির বহুল প্রসার নিয়ে ঠাট্টা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন কোম্পানি আসল নামে সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে, তা অনেক মহলকেই চটিয়ে দিতে পারে এই আশংকা করে খুব সামান্য পরিসরে ছবি প্রকাশ পায়। কিন্তু এটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং কাল্ট ফলোয়িং পায় যখন এটি ইন্টারনেটে সুলভ হয়। ছবির পরিসর ‘স্পেকুলেটিভ’ হলেও বাস্তবের সঙ্গে এমন ওতপ্রোত ভাবে জড়ান যে মুচকি হাসার পাশাপাশি আপনাকে যথেষ্ট ভাবাবে। সমাজে যারা শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল তারা দেখা গেছে খুব ভেবেচিন্তে সন্তান গ্রহণ করে। তাদের সন্তানের সংখ্যাও খুব কম হয়। অপরপক্ষে অশিক্ষিত, নির্বোধ স্তরের মানুষেরা গণ্ডায় গন্ডায় বাচ্চা দিয়ে যাচ্ছে। এইভাবেই একদিন পৃথিবীতে সুশিক্ষিত বুদ্ধিমানরা বিলুপ্ত হয়, আর যত নিরেট, গাম্বাটরা দেশ চালাতে থাকে। এরকমই এক ডিস্টোপিক পৃথিবীতে এসে পরে জো ও রিটা। এরা খুবই সাধারণ নিম্নমেধার মানুষ ছিল, কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল এদের ক্রায়োজেনিক স্লিপে রেখে দিতে—যখন এদের মেধার উপযুক্ত কোনো কাজ আসবে তখন এদের ব্যবহার করবে। কিন্তু নানা কারণে সেই প্রজেক্ট ধামাচাপা পড়ে যায়, এদের কথাও লোকে ভুলে যায়। দুশো বছর পর ময়লার ঢিপিতে অ্যাভালান্স আসায় এরা বেরিয়ে পরে, এবং সেই নিরেট-নির্বোধ অধ্যুষিত সমাজে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে অতীতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। স্যাটায়ার হিসেবে হাস্যরসের মাত্রা খুবই যথাযথ, এক মুহূর্তের জন্যেও বিনোদনের ঘাটতি হয় না। ছবিটি দেখতে দেখতে এইচ-জি ওয়েলসের টাইম মেশিন উপন্যাসের কথা মনে পড়ে যায় যেখানে সমাজের বিত্তবান মানুষেরা পরিশ্রম না করে করে দুর্বল ইলয়তে পরিণত হয়েছিল। আর সাট্যায়ারের কথা যখন উঠলই, আরেকটি ছবির কথা মনে পড়ে যায়। এটি অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক—‘ডোন্ট লুক আপ’ (২০২১)। এটি সায়েন্স ফিকশন খুব একটা নয়, তবে অ্যাপোক্যালিপ্টিক থিমকে যদি ‘স্পেকুলেটিভ ফিকশন’-এর আওতায় ধরা যায় তবেই এটি এই আলোচনায় আসতে পারে। আসন্ন ধূমকেতুর সঙ্গে সংঘর্ষে পৃথিবীর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে সমাজের উচ্চশ্রেনীর মানুষের কার্যকলাপের একটি ছদ্ম-গম্ভীর বিবরণ ছবিটি।
দুই সায়েন্স-ফিকশনপ্রেমী বন্ধু কমিক-কনে যোগ দিতে গিয়ে সত্যি সত্যি এক এলিয়েনের দেখা পায়। এফ-বি-আই এর হাত থেকে সেই এলিয়েনকে বাঁচানোর জন্য সুদীর্ঘ পথ জুড়ে চলে চোর-পুলিশ খেলা। মাঝে যোগ দেয় আরও অনেক মানুষ।
শেষ পর্যন্ত কি এলিয়েন বন্দি হবে না নিজের গ্রহে ফিরে যেতে পারবে সেই এলিয়েন? উত্তরটা হয়তো সবাই আন্দাজ করতে পারছে, কিছু এর মধ্যে যে সব ঘটনা ঘটছে সেগুলো উপভোগ করতে দেখতে হবে ‘পল’ (২০১১) ছবিটি। সাইমন পেগ ও নিক ফ্রস্ট জুটি কমেডি ছবির জন্য বিখ্যাত। এরা অভিনয় ছাড়াও এই সিনেমার গল্পটাও লেখেন। এদের আরেকটি ছবি এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য—‘দ্য ওয়ার্ল্ড’স এন্ড’ (২০১৩)। লেখক ও পরিচালক এডগার রাইটস এর বিখ্যাত করনেটো ট্রিলজির শেষ ছবি এটি। ছবিতে দেখা যায় কয়েকজন মধ্যবয়স্ক বন্ধু ফিরে আসে তাদের শৈশবের শহরে, তাদের অসম্পূর্ণ একটি আশা পূরণ করতে। তাদের লক্ষ্য ছিল এক রাতে পরপর ১২টি পাব থেকে মদ্যপান করে জীবন উদযাপন করা। কিন্তু শহরে ফিরে এসে তারা কিছু গড়বড় টের পায় এবং এক গোপন ভয়ঙ্কর চক্রান্ত তাদের সামনে উন্মোচিত হয়ে ধীরে ধীরে। এ নিয়েই ছবির গল্প। অভিনয়ে সাইমন পেগ, নিক ফ্রস্ট ছাড়াও রয়েছে মার্টিন ফ্রিম্যান, রোজামুন্ড পাইক। কমেডির আড়ালে কিছু বক্তব্য লুকানো থাকে ছবিতে, যেমন যতই লাভজনক হোক না কেন নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারার অন্য কোনো বিকল্প হতে পারে না। আর কমেডি ছবি যে সবসময় হ্যাপি এন্ডিং হবে, এই ফর্মুলার মুখে ঝামা ঘষে দেয় এই ছবি।
এত সব গেল হলিউডি কথা। আমদের দেশে কি কিছুই নেই এরকম? সায়েন্স ফিকশন নিয়ে সেরকম কোনো কাজ দেখা না গেলেও ইনভিজিবিলিটি ব্যাপারটা বলিউডের সিনেমাওয়ালাদের কিন্তু বেশ আকর্ষণ করে। অশোককুমার সাদাকালো যুগে মিস্টার এক্স, আধি রাত কে বাদ বলে এরকম দুটি ছবিতে অভিনয় করেন। এগুলি ক্রাইম থ্রিলার টাইপের হলেও কমেডি ছবিতে অদৃশ্য মানুষের অভিনয় করেন তাঁরই সুযোগ্য ভ্রাতা কিশোরকুমার মিস্টার এক্স ইন বোম্বে (১৯৬৪) ছবিতে। ছবিতে একজন বিজ্ঞানী অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি ও ইনভিজিবিলিটি সলিউশন তৈরি করেন। তারই মেয়ের প্রেমে আঘাত পেয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়ে নায়ক অদৃশ্য হওয়ার ওষুধ খেয়ে ফেলে। তারপর কীভাবে সে কামিনী, কাঞ্চনের সঙ্গে নিজের দেহের অপাসিটি ফিরে পেল সেটা জানতে হলে ছবিটা দেখতে হবে। ভারতের অন্যতম সেরা ছবি মিস্টার ইন্ডিয়াও (১৯৮৭) এই গোত্রেরই মুভি। এই ছবি নিয়ে নতুন করে আর কিছুই বলার নেই। অনিল কাপুর, শ্রীদেবী, অমরীশ পুরি অভিনীত ছবিটি একদম বলিউডি মশালায় রাঁধা, রোমান্স, কমেডি, থ্রিলের উপাদেয় সমন্বয়। ২০০৩ সালে ‘ফান্টুশ’ বলে একটি সিনেমা বেরোয় যেখানে চুরি যাওয়া হিরের খুঁজে পেতে প্রধান চরিত্ররা টাইম-স্পেস-ফোকরে পড়ে অতীতে খোদ হিরের মালিক সম্রাটের দরবারে চলে যান। ২০১০ সালে ‘অ্যাকশন রিপ্লে’ বলে একটা ছবি আসে যেটি মূলত ব্যাক টু দা ফিউচারের বলিউড রিমেক। ২০১৫ সালে তামিল ভাষার ছবি ‘ইন্দ্রু নেত্রু নালাই’ টাইম মেশিন নিয়ে একটি মজার একটি গল্প বলে। ভবিষ্যত থেকে একটি টাইম মেশিন এখনকার চেন্নাইতে এসে পড়ে, সেটিকে হস্তগত করে দুজন রীতিমতো ‘হারানো দ্রব্য গ্যারান্টি সহকারে ফিরাইয়া দেওয়া হয়’ শীর্ষক বিজ্ঞাপনে জ্যোতিষীর ব্যাবসা ফেঁদে বসে। এমনই একটি কেসে কিছু ঘটনার ফলে খুন হতে হতে বেঁচে যায় এক কুখ্যাত ক্রিমিনাল, তারই বাটারফ্লাই এফেক্টে মারাত্মক গোলমাল শুরু হয় তাদের জীবনে। এছাড়া আছে হালকা মেজাজের মালয়ালম ছবি ‘অ্যান্ড্রয়েড কুঞ্জাপ্পন ভার্সন ৫.২৫’ (২০১৯), যেখানে একগুঁয়ে বাবার দেখভাল করতে ছেলে এনে দেয় একটি অ্যান্ড্রয়েড। বাবা ধীরে ধীরে অ্যান্ড্রয়েডটিকে আপন করে নিতে থাকলেও যেটা জানা ছিল না কারোর সেটা হল অ্যান্ড্রয়েডের গোপন ইতিহাস। এটি আগাপাশতলা কমেডি বা প্রখর সায়েন্স ফিকশন—কোনোটাই নয়। ভালোবাসা, বিশ্বাস, অনুভূতি, সেন্টিমেন্ট ইত্যাদির উপর বানানো সোশাল ড্রামা বলা যেতে পারে। তবে বিষয়ের ব্যপ্তির কথা মাথায় রেখে এটিকে আলোচনায় না ঢুকিয়ে পারা গেল না।
বাংলা সিনেমাই বা বাদ যায় কেন? বাংলায় আছে প্রখ্যাত পরিচালক তপন সিনহার একটি সিনেমা ‘এক যে ছিল দেশ’ (১৯৭৭)। ছবিতে দেখতে পাই অ্যামেরিকা-ফেরত বিজ্ঞানী অবনী টাকে চুল গজানোর ওষুধ তৈরি করতে গিয়ে দুর্ঘটনাক্রমে ট্রুথ সিরাম জাতীয় একটি পদার্থ তৈরি করে ফেলেন যা শরীরে গেলে মানুষ নিজের যাবতীয় অন্যায় আর পাপ কাজ হড়হড় করে স্বীকার করে নেয়। নামজাদা অভিনেতাদের অভিনয়গুনে সমৃদ্ধ ছবিটি দারুণ মজাদার, অথচ ছবিটি একটি সোশাল স্যাটায়ার যা সমাজের নানাস্তরের চিরন্তন দুর্নীতির হাল-হকিকত হালকা রঙে এঁকে যায়।
আলোচনায় হয়তো অনেক ভালো ছবি বাদ পড়ে গেল অজ্ঞতার কারণে। আশা করছি পাঠকবর্গ সেই সব বাদ পড়া ছবিগুলির কথা যথাস্থানে উল্লেখ করে সবাইকে জানতে সাহায্য করবেন। জামা থাকলে জামার সোজা দিক, উলটো দিক দুটোই থাকে। উলটো জামা পরে ফেলার কাণ্ডে হাসতে শেখায় এই হাস্যরস বা কমেডি। জীবনের কঠিন পথেও এরকম হাসির উপকরণ খুঁজে হাসতে শিখে নিতে পারলে তার চেয়ে ভাল কি আর হতে পারে? হ্যাপি ওয়াচিং।
তিন ক্লাসিক |
ইয়ং ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন |
ব্যাক টু দা ফিউচার ট্রিলজি |
মেন ইন ব্ল্যাক ট্রিলজি |
তিন অবশ্য-দ্রষ্টব্য |
স্লিপার |
স্পেসবলস |
ইডিওসিটি |
লেখক যে প্রচুর সিনেমা দেখেছেন তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। খুব ভালো লেখনী, বাংলায় পাতালঘর সিনেমাটি ছিলো হাস্যরসে ভরপুর একটি কমেডি। অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী। খুব ছোটবেলায় টিভিতে দেখা (১৯৮৫) জনি সোকো এন্ড হিজ ফ্লাইং রোবট ও ষ্টার ট্রেক খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো ছোটদের কাছে রামায়ণ মহাভারতের পাশাপাশি। লেখকের কাছ থেকে এই এরকম আরও লেখা পাবার আশায় রইলাম 🙏🏻
অনেক ধন্যবাদ মতামতের জন্য। সত্যি পাতালঘরটা থাকা উচিৎ ছিল৷ সিরিজ ইচ্ছে করেই বাদ রাখা হয়েছে।
ভালো লেখা। এইরকম প্রবন্ধগুলোর একটা সচিত্র সংকলন পরে করা গেলে বেশ হয়।
অনেক ধন্যবাদ ঋজুবাবু।