অর্থতৃষ্ণা

  • লেখক: সুমিত বর্ধন
  • শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর) ও সুমিত বর্ধন

য়ুরোপের যুদ্ধের সময় নানা টানাপোড়েনের দরুন কলকাতায় দ্রব্যমূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। তার উপর আবার চাকরির বাজারেও মন্দার ভাঁটা লেগে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। এই দুয়ের ধাক্কায় বহু লোকে তাদের কলকাতার পাট চুকিয়ে দেশের বাড়িতে পাড়ি দিলে, কলকাতার অনেক ভাড়াবাড়ি খালি হয়ে পড়ে। আমি আর ধূর্জটি সেই সময়ে আমাদের আমহার্স্ট স্ট্রীটের পুরনো মেসবাড়িটা ছেড়ে, বড় রাস্তা থেকে একটু ভেতরে নেবুতলার মাঠের কাছে একটা নতুন বাড়িতে উঠে আসি।

     ভাড়ার খুব একটা সাশ্রয় হয়নি বটে, কিন্তু তিনতলায় বড় বড় দুখানা ঘর, টানা বারন্দা, আর উপরি পাওনা চারতলার চওড়া ছাত, আর তার সংলগ্ন চিলেকোঠার ঘরখানা আমাদের কাছে একটা পুরো রাজত্ব হাতে পাওয়ার থেকে কম হয়নি। তিনতলা ঘরের একটিতে আমরা শুই, অন্যটি বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহার হয়, ধূর্জটির মক্কেল এলে ওই ঘরেই বসে। তবে আমাদের বেশীরভাগ সময় কাটে চারতলার চিলেকোঠার ঘরটাতেই। এটাই ধূর্জটির লাইব্রেরী বনাম ল্যাবরেটরী এবং সারা কলকাতা ঘুরে খুঁজে আনা যতরকম অদ্ভুত জিনিষের তোষাখানা। ইয়ালির নখ, গেণ্ডাবেরুণ্ডার পালক, সাইক্লপ্সের আইকর, কুকুল্কানের বিষ, সে সংগ্রহে বাদ নেই কিছুই।

     আজ রবিবার, কাজের তাড়া নেই। হেমন্তের রোদটা পর্যন্ত যেন ছাদের ওপর আয়েস করে লুটিয়ে রয়েছে। নেবুতলার মাঠে ছেলেদের ফুটবল খেলার হৈচৈয়ের সাথে মিশছে ছাদের পাঁচিলে রোদ মেখে বসা কাকের অলস ডাক। প্রাতরাশের টোস্ট আর অমলেটের পালা শেষ করে পেয়ালাটা দুহাতে ধরে সুগন্ধি দার্জিলিং চায়ের স্বাদ উপভোগ করছি তারিয়ে তারিয়ে।

     ধূর্জটির অবশ্য চায়ের সৌখীনতার বড় একটা বালাই নেই, সে দুধ চিনি বিহীন মসীবর্ণ চায়ের গেলাস হাতের মুঠোয় ধরে নাক ডুবিয়েছে খবরের কাগজে।

     প্রাতরাশের প্রসাদ প্রত্যাশী একটা কাক পাঁচিল থেকে চৌকাঠের বাইরে লাফিয়ে নেমে এসে ডেকে উঠল কা-কা শব্দে। তার দিকে পাঁউরুটির একটা টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে তাকালাম ধূর্জটির দিকে।

     – কি? তেমন কাজের খবর কিছু পেলে?

     – হ! আর কাজের খবর!

     একটা বিরক্তির আওয়াজ করে কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল ধূর্জটি।

     – এই যে নিজেই দেখ না। একদম ওপরের দিকেই রয়েছে খবরটা।

     চোখ রাখলাম কাগজে। গতকাল রাতে ডালহৌসী স্কোয়ারে ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের শোরুমে চুরি হয়ে গেছে। চোর অফিসের সিন্দুক ভেঙে আগের দিনের বিক্রির সমস্ত টাকা হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দিয়েছে।

     – ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের নামটা আগে শুনেছি। এরা ঘড়িকলের যন্ত্র বানায় না?

     – হ্যাঁ! যন্ত্রবাদ্য, কলগোলাম, ডিফারেন্স এন্‌জিন্‌। বেঙ্গল আর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে এদের একেবারে একচেটিয়া ব্যবসা। রাজা মহারাজা, সরকারী এজেন্সী, বড় বড় মার্চেন্ট ফার্ম; সব এদের কাস্টমার।

     – বাপরে! এখানে চুরি করা তো সরাসরি বাঘের গুহায় সিঁধ কাটতে যাওয়া দেখছি! তা এটাও কাজের খবর নয় বলছ? একটা বড় মক্কেল পেয়ে যেতে হাতে। দেখবে নাকি একবার গিয়ে?

     ফের একটা বিরক্তির আওয়াজ করল ধূর্জটি,

     – ধুত্তোর বড় মক্কেল! এই ছিঁচকে চুরি ধরার জন্যে ধূর্জটি শীলের প্রয়োজন নেই, বিটের পাহারাওলাই যথেষ্ট।

     সিঁড়িতে ভারী বুটের আওয়াজে ছেদ পড়ল ধূর্জটির কথায়। খুব নিকটজন ছাড়া অন্য কারোর এই চারতলার ছাদের ঘরে আসার এক্তিয়ার নেই, সুতরাং বুটের আওয়াজে অনুমান করে নিতে অসুবিধে হল না, যে হেমের আগমন ঘটেছে।

     হেম অর্থাৎ হেমচন্দ্র বসু ধূর্জটির বাল্যকালের সহপাঠী, তবে ইদানীং তার পরিচিতি ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টের একজন জাঁদরেল ইন্সপেক্টর হিসেবে।

     মুচকি হেসে বললাম,

     – হেম এসে পড়েছে! তুমি যাব না বললেই হবে?

     ধূর্জটি ব্যাজার মুখে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে পা রাখলো হেম। আমার হাতে ধরে থাকা কাগজটা তার পুলিসের সন্ধানী চোখ এড়াল না।

     – যাক, খবরটা তোমাদের চোখে পড়েছে দেখছি। চলো তৈরি হয়ে নাও, নিচে মোটর দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি।

     ধূর্জটি আমতা-আমতা করতে লাগল,

     – দেখ এটা তো মামুলি চুরি বলে মনে হচ্ছে, আমি খামোখা গিয়ে কি করব?
– চুরিটা মামুলি হতে পারে, তা বলে তো ফরিয়াদি তো আর মামুলি নয়। ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের দোকানে চুরি হওয়াটা, তা সে যাই চুরি হোক, মোটেই কোন ছোটখাট ব্যাপার নয়। খোদ কমিশনার রেজিনাল্ড ক্লার্ক সাহেব নিজে খোঁজ খবর রাখছেন। চলো, চলো।

     ধূর্জটির কোন ওজর আপত্তি ধোপে টিকলো না। পুলিসের মোটরে আমাদের যেতে হল ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের শো-রুম অবধি।

     উঁচু পাঁচিল ঘেরা ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের বিশাল দোতলা বাড়ির সামনের রাস্তা পুলিসে ছয়লাপ। লালপাগড়ি পাহারাদারেরা তো রয়েছেই, মোটরবাইক সওয়ার দু-একজন গোরা সার্জেন্টও নজরে পড়ল।

     – একটা সামান্য চুরির পর এমন বিশাল বন্দোবস্ত।

     গাড়ি ততক্ষণে থেমেছে বাড়ির মূল ফটকের সামনে। হাতে ধরা টুপিটা মাথায় বসাতে বসাতে মুচকি হাসল হেম।

     – ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের সর্বপ্রথম খদ্দের হলেন সরকার বাহাদুর। বড় লাটের কাউন্সিল, পোস্ট-মাস্টার জেনারেল, মিলিটারি, বাদ নেই কেউ। অতএব বুঝতেই পারছো! চলো।

     ফটক থেকে কয়েক কদম ভেতরে হেঁটে পেতলের ফ্রেমে আঁটা কাঁচের বিশাল দরজা ঠেলে খুলল হেম।

     শোরুমের ভেতরে পা রাখতেই মনে হল যেন হঠাৎ পথ ভুলে স্বয়ং বিশ্বকর্মার যন্ত্রশালায় ঢুকে পড়েছি। মাথার ওপরের বেলজিয়ান গ্লাসের ঝাড়লণ্ঠনের আলো ছড়িয়ে পড়েছে শোরুম জুড়ে। সে আলোয় ঝলসে উঠছে পেতল, তামা, ব্রোঞ্জ আর ইস্পাতে গড়া নানান অদ্ভুতদর্শন যন্ত্রের পালিশ করা চেহারা। ঘড়িকলের প্যাঁচানো স্প্রীং, দাঁতকাটা চাকা আর তক্‌লি চলার টিকটক, খুটখুট, কড়কড়, নানান আওয়াজে তুলে তারা কাজ করে চলেছে বিরামহীন ভাবে। কোথাও জ্যোতিষযন্ত্রের পেতলে গড়া সৌরমণ্ডল জটিল আবর্ত্তে কষে চলেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অঙ্ক, কোথাও দম দেওয়া যন্ত্রবাদ্য সুরেলা আওয়াজ তুলছে আপনা-আপনিই, আবার কোথাও ডিফারেন্স এন্‌জিন অসংখ্য দাঁত কাঁটা পেতলের চাকায় দুরূহ হিসেবের সমাধান কষে উগরে দিচ্ছে লম্বা কাগজের ফালিতে ছেপে।

     আর শোরুমের এক কোণে হুকুমের অপেক্ষায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে পেতল ব্রোঞ্জের ধাতুর চাদরে মোড়া কলগোলামের সারি।

     আমার তো চোখ আটকে গেলই, খেয়াল করলাম ধূর্জটিও একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে তাদের মানুষের আদলে গড়া ধাতব চেহারাগুলোর দিকে।

     তারও দোষ নেই, এর আগে দু-একটা বিলিতি ম্যাগাজিনে ছবি দেখে থাকলেও চাক্ষুষ কলগোলাম দর্শন আমাদের এই প্রথম।

     তাদের আগাপাস্তলা পেতলে তৈরি শরীরে ব্রোঞ্জের বিচিত্র জ্যামিতিক নক্সা, হাঁটু, কনুই আর আঙ্গুলের গ্রন্থিতে আঁটা ইস্পাতের কব্জা, মুখের কাছে তামার জালের জাফরি, চোখের জায়গায় ঘোলাটে কাঁচের আবরণ। বুকে শিকের গরাদ বসানো মোটা কাঁচের পোর্টহোল। তার পেছনের আধো-অন্ধকারে আবছা নজরে আসে ঘড়িকলের ছোটবড় গিয়ার, পিস্টন, শাফট আর অন্যান্য বলযন্ত্রের ব্যস্ততা।

     পকেট থেকে নোটবই পেন্সিল বের করে দু-একটা কি লিখে নিয়ে আমার দিকে ফেরে ধূর্জটি,

     – যুদ্ধের অনেক কিছুই খারাপ, বুঝলে যতীন, কিন্তু দু-একটা ভালো দিকও বোধহয় থাকে। যুদ্ধের সময়ে বিজ্ঞানের যতটা অগ্রগতি হয় অন্য সময়ে ততটা হয় না।

     – কেন বলছ একথা?

     চোখ তুলে কলগোলামের সারির দিকে ইঙ্গিত করে ধূর্জটি।

     – এদের কথাই চিন্তা কর। মহাযুদ্ধের সময় য়ুরোপের দেশে দেশে কর্মঠ লোকের আকাল। ছেলে, বুড়ো, জোয়ান সব ফ্রন্টে লড়তে চলে গেছে। দেশের বাকি কাজ চলে কি করে? অতএব এইসব যন্ত্রচালিত দাসেদের উদ্ভাবন। যুদ্ধ না হলে এদের প্রয়োজনই হত না।

     – স্যার! নমস্কার!

     শোরুমের ভেতরের দিক থেকে যে কখন একজন অল্প বয়সী ছোকরা এগিয়ে এসেছে খেয়াল করিনি। পরণে সুতির হাতকাটা কামিজ আর কালো প্যান্ট। মাথার চুলে টেরি কাটা।

     – স্যার আমি গৌরচাঁদ। শোরুমের ফ্লোর ইনচার্জ। ভেতরে আসুন স্যার। জেনারেল ম্যানেজার ফিনলে সাহেব অপেক্ষা করছেন।

     গৌরচাঁদের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে হাতটা সামনের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে ধূর্জটি প্রশ্ন করল,

     – সব যন্ত্রপাতি চলছে যে? আপনাদের রবিবারেও শোরুম খোলা?

     – হ্যাঁ। আমাদের সপ্তাহে সাতদিনই খোলা। এসব যন্ত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ, কোন কাস্টমারের কখন কি প্রয়োজন হবে তো জানা নেই।

     – দোকান বন্ধ হয় কটার সময়ে?

     – সাধরণতঃ রাত আটটায় বন্ধ হয়, তবে কখনো কখনো জরুরি মেরামতির কাজ থাকলে, কি আচমকা কোন বরাত পেলে, তার পরেও দোকান খোলা থাকে।

     – কালকেও কি দোকান দেরিতে বন্ধ হয়েছিল?

     – না, কালকে আটটাতেই দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

     – চুরি টের পেলেন কখন?

     – রাত তিনটে নাগাদ আমাদের দরোয়ান শোরুমের ভেতরে আওয়াজ পেয়ে ফিনলে সাহেবকে খবর দেয়। সাহেব সাথে সাথে এসে দরজা খুলে সব তল্লাসি করেন, কিন্তু ততক্ষণে চোর তার কাজ শেষ করে ভেগে পড়েছে। চলুন স্যার, বাকিটা ফিনলে সাহেবের থেকে শুনে নেবেন।

     খেয়াল করলাম কথা বলতে বলতে এসে দাঁড়িয়েছি নেমপ্লেট বসানো দরজার সামনে।

     ভেতরে টেবিলের পেছনে একজন মাঝবয়েসী ইংরেজ বসেছিলেন, আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। পরণে টুইলের কোট আর কালো নেকটাই। মাথায় ছোট ছোট করে ছাঁটা বাদামী রঙের চুল। ধূসর চোখে উদ্বিগ্নের ছাপ সুস্পষ্ট।

     হেম পরিচয় করিয়ে দিলে ধূর্জটির সঙ্গে করমর্দন করলেন।

     – স্প্লেন্ডিড ওয়ার্ক!! ইউ ডিড দেয়ার ইন দ্যাট ফ্রেজার হাউস মার্ডার কেস ধূর্জাটি। আমি সেইজন্যে পুলিসকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেছিলাম যাতে তদন্তে তোমাকে সঙ্গে নেয়। প্লীজ টেক আ সিট‌ জেন্টেলমেন।

     চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম আমরা।

     ফিনলে সায়েব বিচক্ষণ পেশাদার মানুষ। তাঁর মুখ থেকে আগের রাতের ঘটনার সারসংক্ষেপ শুনতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না।

     শোরুমের প্রবেশপথ দুটো। সামনেরটা দিয়ে আমরা ঢুকেছি। কাস্টমাররা এই পথেই যাওয়া আসা করে থাকে। এর ঠিক বিপরীতে, অর্থাৎ বাড়ির একদম পেছন দিকে আর একটা দরজা আছে। এই দরজা দিয়ে মাল দেওয়া নেওয়া করা হয়। এ বাদে আর একটা দরজা আছে ছাদে ওঠার, সেটা সাধারণতঃ বন্ধই থাকে। রাত্রে দোকান বন্ধের সময়ে পেছনের দরজটা ভেতর থেকে বন্ধ করে তারপরে সামনের দরজটা তালা দেওয়া হয়। তালার একটা চাবি থাকে ফিনলে সাহেবের কাছে, আর অন্যটা গৌরচাঁদের কাছে, যাতে প্রয়োজন মত দুজনের যে কেউ একজন অফিস খুলতে পারেন। সবাই বেরিয়ে গেলে কম্পাউণ্ডের লোহার ফটক ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে যায়। দুজন পাহারদার আছে, সারা রাত তারা পালা করে একজন ফটকে পাহারা দেয়, আর একজন কম্পাউণ্ডের চারপাশে টহল দেয়।

     গতকাল রাতে পাহারার দায়িত্বে ছিল জানকীনাথ সিং আর মণিলাল রাই। দুজনেই বিশ্বস্ত কর্মচারী, ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে বহুবছর ধরে কাজ করছে। রাত তিনটে আন্দাজ পেছন দিকে টহল দেবার সময় মণিলাল বাড়ির ভেতরে কিছু পড়ার আওয়াজ পায়। জানলা সব বন্ধ, তবু তারই মধ্যে একটার খড়খড়ি তুলে তার ফাঁকে চোখ রাখতে দেখে ঘরের মধ্যে একটা আবছা আলো জ্বলছে। মণিলাল হাঁক পাড়তে আলোটা নিভে যায়। এরপর আরো দু-একবার হাঁকাহাঁকি করে সাড়াশব্দ না পেয়ে মণিলাল জানকীনাথকে পাহারায় রেখে বাইসাইকেলে করে সদর স্ট্রীটে ফিনলে সাহেবের বাসায় খবর দেয়। ফিনলে সাহেব মোটরে মণিলালকে বসিয়ে নিজে ড্রাইভ করে এসে শোরুমের তালা খোলেন। এরপর জানককীনাথ আর মণিলালকে সঙ্গে নিয়ে শোরুমের পেছনের দরজার দিকে যান। দেখতে পান একটা টেবিল উল্টে যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে পড়ে আছে মাটিতে। পেছনের দরজার তালা টেনে দেখেন, তালা অক্ষতই আছে, দরজাও বন্ধ।

     শোরুমের একতলাটা তন্নতন্ন করে খুঁজে কাউকে না পেয়ে ফিনলে এবার দোতলায় ওঠেন। এইখানে তাঁর চোখে পড়ে টাকা রাখার ঘরের দরজা খোলা। ঘরের ভেতরে পা রাখতেই দেখতে পান আয়রন চেস্টের ডালা খোলা, ভেতরে রাখা নোটের তাড়াও উধাও।

     একতলার দুটো দরজাই বন্ধ, বাড়িতে ঢোকার আর একটি মাত্র প্রবেশপথ, তিনতলার ছাদের দরজা। অতএব কালক্ষেপ না করে তিনি তিনতলার সিঁড়ি ধরে ওপরের দিকে দৌড়লেন। সিঁড়ির শেষে পৌঁছে দেখলেন তাঁর আশঙ্কা অমূলক নয়, ছাদের দরজাও খোলা। দরজা পার হয়ে ফিনলে ছাদে গেলেন। বৈদ্যুতিক টর্চের আলো ফেলে চারিদিকে খুঁজলেন, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। চোর যেন হাওয়ায় কর্পূরের মতন উবে গেছে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ধূর্জটি।

     – আমি একটু ঘুরে দেখতে চাই। আর আপনার কর্মচারীদের কাছ থেকেও কয়েকটা কথা জানতে চাই।

     গৌরচাঁদের দিকে তাকালেন ফিনলে।

     – অফ কোর্স! গৌর উইল শো ইউ এরাউণ্ড।

     ফিনলে সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা সবাই।

     – আগে কোথায় যেতে চান?

     ধূর্জটির দিকে তাকিয়ে গৌরচাঁদের প্রশ্ন।

     – পেছনে যেখান থেকে আওয়াজ এসেছিল আগে সেই জায়গাটা দেখতে চাই।

     – এইদিক। আসুন।

     শোরুমের প্রবেশপথের উল্টোদিকে হাঁটা দিলাম আমরা।

     আলোয় ঝলসে ওঠা যন্ত্রের সারি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে দেওয়ালের গায়ে একটা দু-পাল্লার চওড়া দরজা।

     – এটা আমাদের যন্ত্র সারাইয়ের জায়গা। বাড়তি মালও এইখানে জমা করে রাখা হয়।

     দরজা ঠেলে পেছনের ঘরটায় পা রাখতেই এক ঝটকায় যেন অনেকটাই নেমে এল শোরুমের দীপ্তি। বাহারি ঝাড়লণ্ঠন নয়, এখানে ছাদ থেকে ঝোলানো আটপৌরে বৈদ্যুতিক বাল্ব। অবশ্য উল্টোদিকে বড়বড় কয়েকটা জানলা থাকায় ঘরে আলোর অভাব নেই।

     একখানাই লম্বা ঘর। পরপর সাজানো তাক আর টেবিল। সব টেবিলের পেছনেই একহাত উঁচু খোপকাটা কাঠের তাক বসানো, খোপের মধ্যে নানা টুকিটাকি যন্ত্রাংশ। তাকেও জড় করে রাখা নানা যন্ত্রপাতি।

     যেখান দিয়ে ঢুকেছি তার উল্টোদিকে আর একটা দরজা। সেটার ওপর একবার দৃষ্টি রেখে গৌরচাঁদের দিকে ফিরল ধূর্জটি।

     – এটা কি বাইরে যাবার রাস্তা?

     – হ্যাঁ এটার পেছনেই কম্পাউণ্ড। লরিতে করে মাল এলে এর পেছনেই দাঁড়ায়।

     – আর মণিলাল আওয়াজ কোথা থেকে পেয়েছিল?

     – এই যে, এইদিকে।

     ঘরের একদম ডানপ্রান্তে আমাদের নিয়ে গেল গৌরচাঁদ। একদিকে একটা যন্ত্রপাতি ছড়ানো টেবিল, অন্যদিকে বই আর পাকানো কাগজ বোঝাই একটা সেল্‌ফ। টেবিল থেকে কিছু যন্ত্রাংশ ছড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, এর আওয়াজই মণিলাল গত রাতে শুনে থাকবে।
টেবিলের উল্টোদিকে একটা খোলা জানলার দিকে ইঙ্গিত করল ধূর্জটি।

     – এই জানলার খড়খড়ি দিয়েই?

     ঘাড় নাড়ল গৌরচাঁদ,

     – হ্যাঁ, কাল রাতে এটা বন্ধ ছিল, মণিলাল এটারই খড়খড়ি তুলে ভেতরে আলো দেখতে পায়।

     টেবিলটা খুঁটিয়ে দেখে ধূর্জটি, নিচু হয়ে একবার দেখে নেয় মাটিতে পড়ে থাকা যন্ত্রের টুকরোগুলোকেও।

     – এ সব কে ব্যবহার করে?

     তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে ঘাড় নাড়ে গৌরচাঁদ।

     – কেউ না। এগুলো সব বাতিল। নানান যন্ত্রের বিগড়ে যাওয়া টুকরো-টাকরা। যন্ত্র সারাইয়ের পরে রয়ে গেছে, যদি কখনো কোন কাজে লাগে।

     – আর এই সেলফের সব কাগজপত্র?

     – ওগুলো সব নির্দেশ-পঞ্জিকা। যন্ত্র সারানোর সময়ে অনেক সময়ে মিস্ত্রীদের কাজে লাগে।

     জানলা দিয়ে বাইরের দিকে একবার তাকায় ধূর্জটি।

     – চলুন বাইরেটা দেখে আসি।

     দরজার বাইরে কম্পাউণ্ডটা অনেকটা চওড়া। একপাশে উঁচু করে রাখা প্যাকিং বাক্সের স্তূপ। অন্যদিকে তেলের ড্রাম, জল দেবার হোসপাইপ, দড়িদড়া আর চটের খালি বস্তা। বোঝাই যায় জায়গাটা মাল খালাস করার কাজে ব্যবহার হয়।

     বাড়ির বাইরে বেরিয়ে মাথা উঁচু করে ছাদের দিকটা দেখে ধূর্জটি।

     – ছাদে ওঠার জন্যে বাইরের দিকে কোন সিঁড়ি আছে?

     মাথা নাড়ে গৌরচাঁদ।

     – না, একটাই সিঁড়ি। বাড়ির ভেতরে।

     কম্পাউণ্ড ধরে হেঁটে আমরা ফেরত আসি শোরুমের সামনে। আর একবার ওপর দিকে তাকিয়ে দেখে ধূর্জটি।

     – বাড়ির গায়ে কোন পাইপ দেখছি না।

     সায় দেয় গৌরচাঁদ।

     – হ্যাঁ আমাদের দোতলায় কোনরকম জলের ব্যবস্থা নেই। একতলায় দামী যন্ত্রপাতি থাকে, কয়েক ফোঁটা জল পড়লেও মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

     – অফিসের শৌচালয়?

     – সব একতলায়।

     ওপরের দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ কী চিন্তা করে ধূর্জটি।

     – চলুন, ওপরে চুরির জায়গাটা দেখি।

     ফের শোরুমের ভেতরে পা রাখি আমরা। বিচিত্র দর্শন যন্ত্রের সারি পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসি দোতলায়।

     দোতলা জুড়ে একটা বিশাল হলঘর। ঘর জুড়ে পরের পর টেবিল চেয়ার সাজানো। টেবিলের ওপর কাগজ, ফাইল আর লেখার সরঞ্জাম দেখে বোঝা যায় এটা কর্মচারীদের দৈনন্দিন কাজের এলাকা। দু-একটা টেবিলে টাইপরাইটারও চোখে পড়ল।
হলঘরের দুপাশে দরজার সারি। প্রত্যেকটাতে ইয়েল-লক বসানো।

     – এই ঘরগুলো?

     গৌরচাঁদের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল ধূর্জটি।

     – কয়েকটা কাস্টমারদের আপ্যায়নের ঘর। বাকিগুলোর কোনটা রেকর্ড রুম, কোনটা সাহবদের কমন রুম। আর এছাড়া শেষের ঘরটা ক্যাশরুম।

     – চুরিটা তো ওই ঘরেই হয়েছে?

     – হ্যাঁ।

     – চলুন দেখি।

     বাঁদিকের সারির একদম শেষ ঘরটা ক্যাশরুম। দরজা হাট করে খোলা রয়েছে।

     দরজার ইয়েল লকটা ঝুঁকে দেখে ধূর্জটি। পকেট থেকে একটা আতস কাঁচ বের করে পরখ করে খুঁটিয়ে।

     ঘরের ভেতরটা অনাড়ম্বর, সাজসজ্জাবিহীন। ফাইল আর হিসেবের খাতাপত্র রাখার সেল্‌ফ, টেবিল চেয়ার আর একটা আয়রন সেফ। সেফের ডালা খোলা, তার অভ্যন্তরটা এই দরজা থেকেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

     টেবিলের পেছনে একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে। পরনে মিলের ধুতি আর লংক্লথের কামিজ। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। চোখে মুখে একটা উদভ্রান্তের মতো ছাপ।

     আলাপ করিয়ে দিল গৌরচাঁদ।

     – আমাদের ক্যাশিয়ার নবকুমার বাবু।

     ডালা খোলা আয়রন সেফটার দিকে তাকায় ধূর্জটি,

     – এই সেফটা থেকে চুরি হয়েছে?

     – হ্যাঁ স্যার!

     কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর নবকুমারবাবুর।

     – কি কি খোয়া গেছে?

     – বিশ হাজার টাকা নগদ ছিল। তার পুরোটাই চুরি গেছে।

     – আর কিছু?

     – না। দু-একটা মূল্যবান দলিল আর কিছু কোম্পানীর শেয়ারের কাগজও ছিল। সেগুলোতে হাত পড়েনি।

     নিচু হয়ে সিন্দুকটা আতসকাঁচ দিয়ে পরীক্ষা করে ধূর্জটি।

     – হেম একবার দেখ। পাকা হাতের কাজ। সিন্দুক এমন ভাবে খুলেছে যে বোঝাই যাচ্ছে না চাবি ছাড়া খোলা হয়েছে।

     ঝুঁকে সিন্দুক পরীক্ষা করে হেমও। চিন্তার ভাঁজ পড়ে তার কপালে।

     উঠে দাঁড়ায় ধূর্জটি,

     – ছাদটা দেখি চলুন।

     ক্যাশরুমের একটু পরেই অপ্রশস্ত সিঁড়ি উঠে গেছে ছাদ অবধি। সিঁড়ির মাথায় দরজার দুটো পাল্লাই খোলা। খোলা দরজা দিয়ে নজরে আসে ঝকঝকে নীল আকাশ আর রোদ মাখা ছাদ।

     দুপাল্লার দরজা। মাঝখানে আড়াআড়ি হুড়কো, তাতে তালা পরানো।

     কিন্তু সে তালা খোলার কোন চেষ্টাই করা হয়নি।

     অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তালাটা অক্ষত অবস্থায় যেমন লাগানো ছিল, তেমনই লাগানো রয়েছে। কেবল কোন রহস্যময় কারণে হুড়কোর আড়াআড়ি দণ্ডটা মোমের মত গলে দুফাঁক হয়ে গেছে। হুড়কোর ঠিক ওপরে দরজার গায়ে একটা চাকতির আকারে ফুটো। ফুটোর চারপাশ পুড়ে কালো হয়ে আছে। যেন কোন গনগনে আগুন দিয়ে দরজার কাঠটা পুড়িয়ে ছ্যাঁদা করা হয়েছে।

     আতস কাঁচ দিয়ে দরজার ফুটো আর দু-টুকরো হয়ে যাওয়া হুড়কোটাকে ভাল করে পরখ করে ছাদে উঠে গেল ধূর্জটি। খেয়াল করলাম তার কপালে জমে উঠেছে চিন্তার রেখা।

     পরিষ্কার ছাদে হেমন্তের রোদটুকু ছাড়া আর দেখার বিশেষ কিছু নেই। সাধারণ গৃহস্থ বাড়ির ছাদে যেমন দেখা যায় কাপড় মেলার দড়ি কিম্বা ফুলগাছ। এখানে সে সব কিছুই নেই।

     – গৌর, ছাদে কে ওঠে?

     – কেউ না স্যার। কেবল সপ্তাহে একবার ঝাড়ুদার এসে ঝাঁটপাট দিয়ে চলে যায়।

     – ঝাড়ুদার একাই আসে ছাদে?

     – না, আমাদের স্টোরকীপার মুকুন্দবাবুর কাছে চাবি থাকে, তিনি এসে দরজা খুলে দেন, আবার কাজ হয়ে গেলে তালা লাগিয়ে দেন।

     – পাঁচিলে ওগুলো কি?

     আগে খেয়াল করিনি, এবার ধূর্জটির কথায় লক্ষ করলাম, ছাদের পাঁচিলে কয়েক হাত অন্তর অন্তর লোহার আংটা বসানো আছে।

     – নিউ ইয়ারে ছাদে সাহেবেদের পার্টি হয়। সামিয়ানা টাঙাতে সুবিধে হবে বলে আঙটাগুলো পোঁতা হয়েছে।

     ফের আতস কাঁচ বের করল ধূর্জটি।

     – আমাদের যা দেখার দেখা হয়ে গেছে। কেবল তোমাদের রাতের পাহারাদারদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে। তুমি গিয়ে আগে মণিলালকে পাঠিয়ে দাও।

     আতসকাঁচ দিয়ে এক-একটা আংটা খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ধূর্জটি।

     একটু পরেই সিঁড়িতে শোনা যায় ভারী জুতোর শব্দ। ছাতে যে এসে দাঁড়ায় তার বয়স বেশী না হলেও একজোড়া পাকানো গোঁফ তার চেহারাটা ভারিক্কি করে তুলেছে। পরনে তকমা আঁটা উর্দি, মাথায় পাগড়ি।

     – সাব!

     পাঁচিলের আংটা ছেড়ে এগিয়ে আসে ধূর্জটি।

     – তুমি মণিলাল?

     – জী সাব।

     – কাল রাত্রে কী হয়েছিল?

     মণিলালের বয়ানের সঙ্গে আমরা আগে ফিনলে সাহেবের থেকে যা শুনেছি তার বিশেষ তারতম্য হল না। রাতে টহল দেওয়ার সময় মণিলাল বাড়ির ভেতর থেকে কিছু পড়ার আওয়াজ পায়। তারপর খড়খড়ি ঈষৎ তুলে উঁকি দিয়ে দেখে ভেতরে কোন ম্লান আলো জ্বলছে। বার দুয়েক হাঁকাহাঁকি করে কোন সাড়া না পেয়ে সে তখন জানকীনাথকে পাহারায় রেখে বাইসাইকেলে করে ফিনলে সাহেবেকে খবর দিতে যায়।

     মণিলালের কথা শেষ হতে ঘাড় নাড়ে ধূর্জটি।

     – হুঁ! আচ্ছা মণিলাল, আওয়াজ পাবার পর তুমি একবারও ওপরের দিকে তাকিয়েছিলে কি?

     – ওপরের দিকে? না সাব! আওয়াজ নিচে হচ্ছে, আমি ওপরের দিকে তাকিয়ে কি করব? আর দুটো দরজাই বন্ধ আছে কিনা দেখে নিয়ে আমি আর বেশীক্ষণ দাঁড়াইনি, সাহেবকে খবর দিতে ছুটেছিলাম।

     – হুঁ, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি গিয়ে জানকীনাথকে পাঠিয়ে দাও।

     জানকীনাথের পরণেও একই রকমের উর্দি, তবে বয়স হয়েছে। মুখের গোঁফদাড়ি পরিষ্কার করে কামানো। তার থেকেও বিশেষ কিছু জানা গেল না। মণিলাল বেরিয়ে যাবার পর সে ছুটে ছুটে বাড়িটা বেড় দিয়ে পাহারা দিয়েছে, পাছে দুটো দরজার কোন একটা দিয়ে চোর পালানোর চেষ্টা করে।

     কিছুক্ষণ কি চিন্তা করে ধূর্জটি।

     – পেছনের দরজাটা কেউ খোলার চেষ্টা করেছিল?

     – না সাব। মণিলাল বেরিয়ে যাবার পর আর পেছনের দিকে থেকে কোন আওয়াজ পাইনি।

     – ওপর দিকে দেখেছিলে, কিছু দেখতে পাও কিনা?

     – জী সাব। যেদিকটা টাকা রাখার ঘর সেদিকের জানলার খড়খড়িতে দু-একবার আলো ফেলেছিলাম। কিন্তু কিছু দেখতে পাইনি।

     – আর ছাদে? ছাদে কিছু দেখতে পেয়েছিলে?

     – না সাব। ছাদ অবধি টর্চের আলো পৌঁছয় না। ফির কাল অমাবস কা রাত ভি থা। বিলকুল অন্ধেরা। ছাদে কিছু দেখতে পাইনি।

     – একদম কিচ্ছু না? দেখে না থাক, কোন আওয়াজ শুনেছিলে? ঠিক করে ভেবে দেখে।

     – নেহি সাব! কুছ ভি নেহি দেখা, শুনা ভি নেহি। সির্‌ফ্‌ —

     কি একটা বলতে গিয়েও কেমন থতমত খায় জানকীনাথ।

     – কি? কি জানকীনাথ?

     সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করে ধূর্জটি।

     – সাব, আমার মনের ভুলও হতে পারে। কিন্তু –

     – কিন্তু?

     – কিন্তু, মণিলাল সাহেবকে নিয়ে ফেরত আসার একটু আগে, আমি যখন ওপরের দিকে একাবার টর্চের আলো ফেলছিলাম, মনে হল একটা কালো মেঘ নিচু দিয়ে উড়ে গেল।

     একটা খুশির ঝলক খেলে যায় ধূর্জটির মুখে। যেন সে কোন একটা জটিল অঙ্ক সমাধান করে ফেলেছে।

     – ঠিক আছে জানকীনাথ। তুমি যেতে পারো। দরকার হলে আবার তোমায় ডেকে পাঠাব।

     – জী সাব!
সেলাম করে চলে যায় জানকীনাথ।

     উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

     – কিছু বুঝলে?

     মৃদু হাসে ধূর্জটি,

     – তা কিছুটা বুঝেছি বৈকি যতীন! হেম, সিন্দুকের আর দরজার চাবি যে খুলেছে সে তো দেখছি ওস্তাদ কারিগর। একটা আঁচড় পর্যন্ত ফেলেনি। কেউ আছে নাকি এ্ররকম পুলিশের সন্ধানে।

     মাথা নাড়ে হেম।

     – হ্যাঁ আছে। তবে একজন নয়। এইরকম দুজনের নাম আছে পুলিসের খাতায়।

     – এমন পাকা হাতের কারিগর একজন নয়, একেবারে দু-দুজন! বলো কি!

     – হ্যাঁ বলাই আর নিতাই হালদার! দুই ভাই। পুলিস সেরেস্তায় দুজনের নামেই চুরির অনেক রেকর্ড আছে।

     চোখ কপালে তোলে ধূর্জটি।

     – বাপরে! মাসতুতো ভাই কোন ছার। এতো দেখছি চোরে চোরে সহোদর ভাই!

     – যা বলেছ। বছর ছয়েক আগে দুই ভাই মিলে রাত্রে একটা গয়নার দোকানে চুরি করতে ঢোকে। দোকানের দরোয়ান কোনভাবে টের পেয়ে চেঁচামিচি জুড়ে দিতে দুজনেই দোকানের পেছনের পাঁচিলে টপকে পালানোর চেষ্টা করে। তবে বলাই পালিয়ে যেতে পারলেও নিতাইয়ের পাঁচিল থেকে পড়ে গিয়ে পা ভাঙে, তাকে পুলিসের পাহারাওলারা ধরে ফেলে।

     – ওঃ! আর বলাই?

     – বলাইকে ধরা যায়নি। খুব সম্ভব সে কলকাতা ছেড়ে হায়দ্রাবাদ পালায়।

     মাথা নাড়ে ধূর্জটি।

     – স্বাভাবিক। নিজামের রাজ্যে গা-ঢাকা দিয়ে থাকলে ইংরেজের পুলিসের নজর এড়ানোটা সহজ। আর নিতাই?

     – নিতাই ভাঙা পা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিন্তু তার জখম এমন ছিল যে, তার পা পুরোপুরি সারেনি, সে একরকম খোঁড়াই হয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর তার চুরির দায় জেল হয়।

     কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে ধূর্জটির।

     – তা এই দুই মহাত্মা ইদানীং কোথায়?

     – বলাই এখনো ফেরার। নিতাইয়ের জেলের সাজা শেষ হয়ে সে কয়েকদিন আগে ছাড়া পেয়েছে।

     ছাদে ওঠার দরজাটার দিকে চোখ তুলে ইঙ্গিত করে ধূর্জটি।

     – দরজার ফুটো আর গলে যাওয়া হুড়কোর রহস্য আশা করি তোমাকে বোঝাতে হবে না।

     মুখ গম্ভীর হয়ে গেল হেমের।

     – ক্যালরিক!

     কিছু বুঝতে না পেরে আমি হেমের মুখের দিকে তাকালাম।

     – ক্যালরিক! সেটা কি জিনিষ?

     – সোজা কথায় বলতে গেলে উত্তাপের নির্য্যাস! যার ওপর পড়বে পুড়িয়ে গলিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।

     ঘাড় নাড়ল ধূর্জটি।

     – বিশুদ্ধ দাহক, কোন কিছুকে রেয়াত করে না। একসাথে দু-এক ফোঁটার বেশী মজুতও করা যায় না।

     সায় দিল হেম।

     – বিপজ্জনক বস্তু। পাকা অ্যালকেমিস্ট ছাড়া অন্য কারোর পক্ষে বানানো কঠিন। সরকারী লাইসেন্স ছাড়া এ জিনিস বানানো বা কেনাবেচার নিয়ম নেই।
অবাক হলাম।

     – কিন্তু এমন জিনিস চোরেদের হাতে পড়ল কী করে?

     মুখ কালো হয়ে গেল হেমের।

     – মহাযুদ্ধের পর অনেক নিষিদ্ধ বস্তুই অবাঞ্ছিত লোকজনের হাতে গিয়ে পড়েছে। তার ফল তো দেখতেই পাচ্ছো। কিন্তু সে সব পরে ভাবলেও চলবে, আপাততঃ আমাদের কাজ এই চুরির কিনারা করা।

     সূর্য মাথার ওপরে উঠে গেছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে রোদের তাত আড়াল করে পশ্চিম দিগন্তে কি দেখার চেষ্টা করে ধূর্জটি।

     – কি দেখছ ধূর্জটি?

     আমার কথার উত্তর না দিয়ে হেমের দিকে তাকায় ধূর্জটি।

     – হেম, স্ট্র্যান্ড রোডে গঙ্গার পূবপাড়ে যে মালগুদামগুলো আছে সেগুলো একবার খানাতল্লাসী করে দেখা। চোরকে হয়ত পাওয়া যাবে না কিন্তু কিছু সূত্র মিললেও মিলতে পারে।

     – স্ট্র্যান্ড রোডের মালগুদাম!
অবাক প্রশ্ন হেমের,

     – কিন্তু কেন? ওখানে কি এমন আছে?

     হাত তুলে বাধা দেয় ধূর্জটি।

     – এখন নয় হেম। আমার সবটুকুই অনুমান মাত্র। যদি কিছু পাওয়া যায় তখন সব খুলে বলব। আমরা বাড়িতেই অপেক্ষা করবো, যদি কিছু পাও খবর দিও।
নিচে নেমে আসি আমরা। মোটরে চড়ে বসে হেম, পুলিস লরিতে লাফিয়ে ওঠে লালপাগড়ি কন্সটেবলরা। ফট্‌ফট্‌ শব্দ তুলে ছুটতে থাকে গোরা সার্জেন্টদের মোটরবাইক, তাদের অনুসরণ করে পুরো পুলিস বন্দোবস্তটাই।

     কয়েক মূহুর্তের মধ্যে ফাঁকা হয়ে যায় ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের সামনের রাস্তা।

     আমার কাঁধে হাত রাখে ধূর্জটি।

     – চলো যতীন, বাড়ি যাই। আপাততঃ আমাদের কাজ কেবল অপেক্ষা করা।

     একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরে আসি আমরা।

     দুপুরের রোদটা অনেকটাই ঢলে এসেছে। খাওয়াদাওয়া সেরে আমি বৈঠকখানার একটা আরামাকেদারায় গড়াচ্ছি। ধুর্জটি ফরাসের ওপর আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। দৃষ্টি তার শূন্যে নিবদ্ধ, মুখে কথা নেই। কেবল মাঝে মধ্যে তার তর্জনীটা হাতে ধরা সিগ্রেটের টিনের ওপর টকটক করে আওয়াজ তুলছে।

     চোখটাকে ধীরে ধীরে কব্জা করে ফেলা ভাতঘুমটাকে তাড়ানোর জন্যে ধূর্জটির কাছে থেকে একটা সিগ্রেট চাইব কিনা ভাবছি, সিঁড়িতে ভারী বুটের আওয়াজ পাওয়া গেল।

     এক লহমায় কেটে গেল ধূর্জটির চিন্তার ঘোর, সে লাফ মেরে উঠে এক টানে খুলে ফেলল দরজা।

     দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এক লালপাগড়ি কন্সটেবল।

     – সাব নে এত্তেলা ভেজা হ্যায়। নিচে মোটর খাড়া হ্যায়।

     অফিস পাড়া ছাড়িয়ে পুলিসের মোটর ছুটল স্ট্র্যান্ড রোডের দিকে।

     গঙ্গার পাড়ে সার দেওয়া গুদামঘর। তারই একটার সামনে এসে দাঁড়াল আমাদের মোটর। গুদামের দরজার সামনে পুলিসের জমায়েত। তাদের একজন আমাদের দেখে এগিয়ে এলো সামনে।

     – সাব অন্দর হ্যায়।

     ভেতর থেকে হেমের গলা ভেসে এল,

     – ধূর্জটি, যতীন, ভেতরে চলে এসো।

     দরজার ভেতরে পা রেখেই থতমত খেলাম। ভেবেছিলাম ভেতরে ঢুকে দেখব আধো অন্ধকার একটা ঘর, বিনা জানলার মালগুদাম সাধারণতঃ যেমন হয়ে থাকে। কিন্তু চৌকাঠ পেরিয়ে খেয়াল করলাম ঘরের আলোর কোন খামতি নেই, পশ্চিমের পড়ন্ত রোদ তেরচা হয়ে লুটিয়ে পড়ছে গুদামঘরের মেঝেতে।

     কারণটা আবিষ্কার করতে সময় লাগলো না। বিশাল আকারের ঘরটার অর্দ্ধেকটা ছাদ নেই, মাথার ওপরে ঝকঝক করছে নীল আকাশ। অনুপস্থিত ছাদের কড়ি, বরগা, টালি, সুরকি সব স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে রয়েছে ঘরের মাঝখানে। সে স্তূপের এখানে ওখানে সবুজ পাতা মেলেছে দুএকটা ছোট গাছ।

     স্তূপের এক পাশে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে কি লক্ষ করছিল হেম, আমাদের দিকে নজর পড়তে ইশারা করে কাছে ডাকল।
শ্যাওলা পড়া উঁচুনিচু মেঝে পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম হেমের পাশে।

     – এই দেখ!

     ইমারতি আবর্জনার স্তূপের পেছনে থাকার জন্যে আগে চোখে পড়েনি, এখন দেখতে পেলাম মেঝেতে ভেঙে পড়ে রয়েছে একটা ক্ষুদে এয়ারশিপ। তার ছাতার মতন শিক বসানো কালো ডানাদুটো মুচড়ে বেঁকে গেছে, বেতের সওয়ারী টুকরীতে ফাটল ধরেছে, পেতলের পাইপ আর যন্ত্রপাতি জায়গায় জায়গায় তুবড়ে গেছে। আর বেলুনটা গ্যাস মুক্ত হয়ে একটা বিশাল কালো চাদরের মত ছড়িয়ে আছে মেঝের অনেকখানি জায়গা জুড়ে।

     টুকরির কাছে বেলুনের কাপড়ের একটা অংশ হাতে ধরে উঁচু করে দেখাল হেম।

     – দেখেছ?

     দেখলাম কাপড়ের অনেকখানি ছেঁড়া।
– দেখি।

     আতসকাঁচ বের করে কাপড়ের ছেঁড়াটা খুঁটিয়ে দেখল ধূর্জটি। লক্ষ করলাম, তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে, কিন্তু মুখে সে কিছু বলল না।

     মাথার ওপরে আঙুল তুলে ইঙ্গিত করল হেম,

     – ওই ছাদের ফাঁক দিয়ে নামার সময়ে কিছুর খোঁচা লেগে ফেঁসে গিয়ে থাকবে। তারপর সটান মাটিতে আছড়ে পড়ে। এদিকটা এসো।

     হেমের পেছন পেছন মাটিতে লুটিয়ে থাকা বেলুনের কাপড়টার পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে গেলাম। ভাঙা সওয়ারী টুকরি থেকে কয়েক হাত দূরেই মাটিতে চিত হয়ে পড়ে আছে একটা মানুষের নিষ্পন্দ দেহ। পরণে তেলচিটে জিনের প্যান্টুলুন আর রঙচটা কামিজ। মাথার চুল রক্তে ভিজে জবজব করছে, খানিকটা রক্ত চুঁইয়ে পড়েছে মাটিতেও।

     চোখ তুলে ইঙ্গিত করল হেম,

     – সনাক্ত করা হয়ে গেছে। নিতাই হালদার।

     নিচু হয়ে আতসকাঁচ দিয়ে নিতাই হালদারের শরীরটা খানিকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে ধূর্জটি।

     – চুরির টাকাটার কিছু হদিস পেলে?

     মাথা নাড়ল হেম।

     – হ্যাঁ। পুরো টাকাটাই পাওয়া গেছে। টুকরির ভেতর একটা থলেতে রাখা ছিল।

     উঠে দাঁড়ায় ধূর্জটি। ইমারতি আবর্জনার স্তুপটার কাছে গিয়ে কি দেখতে থাকে মন দিয়ে।

     – বাঃ! চোর বামাল দুটোই পাওয়া গেছে।

     মৃদু হাসে হেম,

     – তা যা বলেছ। মামলাটার এত তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি।

     অন্যমনস্ক ভাবে কি চিন্তা করে ধূর্জটি

     – নিষ্পত্তি! পুরোটা নিষ্পত্তি হল কি? এখনো কয়েকটা প্রশ্ন রয়ে গেল যে!

     হেসে ধূর্জটির পিঠ চাপড়ে দিল হেম।

     – আরে অত খুঁতখুঁত কোরো না। জানি তোমার মাথায় কি ঘুরছে। নিতাইয়ের খোঁজ পাওয়া গেল, কিন্তু বলাই কোথায়? কিন্তু ও সমস্যার উত্তর ধীরে সুস্থে খুঁজলেও চলবে। চলো, মোটর তোমাদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসবে। আজ আর হবে না, আমি কাল আসব। এত তাড়াতাড়ি রহস্যের কিনারা কী করে করলে, রিপোর্ট লেখার আগে সে সবের খুঁটিনাটি তোমার থেকে শুনে নিতে।

     পরের দিন বিকেলে হেমের আবির্ভাব হল। হাতে দুটো খাম। একটাতে স্বয়ং পুলিশ কমিশনার রেজিনাল্ড ক্লার্ক সাহেবের সই করা সুপারিশ পত্র, আর অন্যটাতে ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের তরফ থেকে পারিশ্রমিকের একটা চেক। সে চেকের অংকটা এমনি বড়, যে ধূর্জটির মাস ছয়েক কোন মক্কেল না পেলেও চলে যাবে।

     কুঞ্জ টিপাইয়ের ওপর খাবারের প্লেট সাজিয়ে দিয়ে গেছে। আলুর ফ্রেঞ্চ বল আর গুল-কাবাব। সঙ্গে একটা বিরাট থার্মোফ্লাস্কে চা।

     ধোঁয়া ওঠা ফ্রেঞ্চ বলে কামড় দিয়ে গরম থেকে জিভ বাঁচিয়ে হেম প্রশ্ন করল,

     – এবার খুলে বলো তো, কি করে বুঝলে যে চোরকে গঙ্গার পাড়ে কোন গুদামে পাওয়া যাবে?

     চায়ে চুমুক দিল ধূর্জটি।

     – ঠিক বুঝে ফেলেছিলাম বললে সত্যের অপলাপ হবে। বরং বলতে পার অনুমান করেছিলাম।

     – আহা, তাই নয় হল। কিন্তু সেই অনুমানেই বা পৌঁছলে কী করে?

     – দেখ, ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের বাড়িটা তো দেখেছ? বাড়ির গায়ে জলের পাইপ বা ধরে ওপরে ওঠার মতন কোন অবলম্বন নেই। তাছাড়া পাহারাওলারা রাতে বাড়ি ঘিরে টহল দেয়। কেউ দেওয়াল বেয়ে উঠতে গেলে তাদের নজরে পড়ে যাবে। সুতরাং যে বা যারা চুরি করতে এসেছিল, তারা আকাশ পথেই এসেছিল। এখন মানুষ যেহেতু উড়তে পারে না —

     – গরুড় পারে!

     আমি মাঝখানে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলাম।

     আমার দিকে অবাক চোখে তাকাল ধূর্জটি।

     – যতীন, তোমার ছেলেমানুষিগুলো আর গেল না। গরুড়রা যোদ্ধার জাত। কোন গরুড় কোথাও চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে কখনো শুনেছ? ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের শোরুমে কোন গরুড় হানা দিলে, লুকিয়ে চুরিয়ে তালা কেটে ঢুকতা না। দরওয়ানদের কচুকাটা করে দরজা ভেঙে যা নেবার লুটে নিয়ে যেত।

     নিজের বোকামিতে লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইলাম।

     – আর তাছাড়া –

     চায়ের কাপে ফের চুমুক দিল ধূর্জটি।

     – আর তাছাড়া কোন গরুড় হলে তার ডানার শব্দ পাওয়া যেত। তোমাদের মনে থাকবে জানকীনাথ আর মণিলাল দুজনেই বলেছে সে রাতে তারা ওই জিনিস পড়ার শব্দের পর আর কোন আওয়াজ শোনেনি।

     ফ্রেঞ্চ-বলের পালা সাঙ্গ করে গুল-কাবাবে মন দিল হেম।

     – বেশ! বলে যাও!

     – চুরির ধরণ দেখে তোমাকে জিজ্ঞেস করে নিতাই হালদারের কথা জানতে পারলাম। সেই সঙ্গে এও জানলাম যে তার একটা পা জখম। অর্থাৎ দেওয়াল বেয়ে চুরি করতে ওঠা তার সাধ্যের বাইরে। আমার ধারণা আরো দৃঢ় হল। চোর নিচে থেকে ওপরে ওঠেনি। সে আকাশপথেই এসেছিল, এবং এসেছিল কোন নিঃশব্দ যানে, যার আওয়াজ নিচের পাহারাদাররা পায়নি। কিন্তু কোন যান? এরোপ্লেন নিশ্চয়ই নয়, তার আওয়াজও পাহারাদারদের কানে যেত।
হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল।

     – জানকীনাথ বলছিল সে একটা মেঘের মতন কি দেখেছে!

     মৃদু হাসল ধূর্জটি,

     – তোমার মনে আছে তাহলে! হ্যাঁ জানকীনাথের কথাতেই আমার সংশয় অনেকটা কেটে গেলে। চোর এসেছিল কোন ক্ষুদে এয়ারশিপে চড়ে। তার আওয়াজ তো নেই, তার ওপর গায়ে কালো রঙ লাগানো ছিল যাতে পাহারাদারদের চোখে না পড়ে। এছাড়া ছাদের পাঁচিলে বসানো আংটাগুলো খুঁটিয়ে দেখে আর একটা জিনিস আমার নজরে পড়ে।

     গুল-কাবাব শেষ করে ফ্লাস্ক থেকে কাপে চা ঢালে হেম।

     – কি দেখেছিলে?

     – দেখেছিলাম সবকটা আঙটাতেই একটা হাল্কা ধূলোর প্রলেপ রয়েছে, কেবল একটা ছাড়া। খুব সম্ভব হাওয়া ভেসে থাকা এয়ারশিপকে দড়ি দিয়ে ঐ আঙটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল।
     নিজের ঠোঁটে একটা সিগ্রেট লাগিয়ে নিয়ে আমার দিকে টিনটা বাড়িয়ে ধরে ধূর্জটি। টিন থেকে সিগ্রেট টেনে নিতে নিতেই প্রশ্ন করি,

     – কিন্তু এয়ারশিপ গঙ্গার ধারে মালগুদামেই পাওয়া যাবে তুমি জানলে কি করে?

     – এয়ারশিপই পাওয়া যাবে জানতাম বললে সেটা বাড়িয়ে বলা হবে। এয়ারশিপ বা চোরাই টাকা পেয়ে যাওয়াটা আমাদের কপালের জোর। কিন্তু অনুমান করেছিলাম যে গঙ্গার পাড়ে চোরেরা কিছু একটা সূত্র ফেলে যাবে।

     – কেন?

     মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে সশব্দে ধোঁয়া ছাড়ে ধূর্জটি। নীলচে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যায় কড়িকাঠের দিকে।

     – দেখো, কলকাতার আকাশে বিনা অনুমতিতে এয়ারশিপ ওড়ানোটা সহজ নয়। মহাযুদ্ধের সময় যে সব নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল সেগুলো সব এখনো বহাল আছে। এয়ারশিপ কারোর চোখে পড়লে হুলুস্থূল বেঁধে যাবে। লালবাজার থেকে একেবারে কাতারে কাতারে বেরিয়ে আসবে পুলিস। সুতরাং এয়ারশিপ যেখান থেকেই এসে থাকুক, জায়গাটা ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কাসের অফিস থেকে বেশি দুরে নয়।

     – সে রকম জায়গা তো অনেকই আছে?

     – হ্যাঁ তা হয়ত আছে, কিন্তু এয়ারশিপ যেখান থেকে এসেছে, সেখানে এয়ারশিপটাকে লুকোনোরও একটা ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

     সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকায় হেম,

     – কি আশ্চর্য! এ কথাটা আমার মাথায় আসেনি কেন! ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীট থেকে স্ট্র্যান্ড রোড বেশি দূরে নয়, আর স্ট্র্যান্ড রোডের মালগুদামে একটা ছোট এয়ারশিপ লুকিয়ে রাখাটাও সহজ।

     মাথা নেড়ে সায় দেয় ধূর্জটি,

     – হ্যাঁ। এছাড়া আরো কয়েকটা সুবিধে আছে। গঙ্গা দিয়ে বজরায় মাল বওয়ার রেওয়াজ কমে যাওয়ার পর থেকে ওই রাস্তায় অনেকগুলো গুদাম পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তাছাড়া মাল ওঠা নামানোর সুবিধের জন্য গুদামগুলোতে গঙ্গার দিকে চওড়া দরজা বসানো থাকে – সেখান দিয়ে এয়ারশিপ ঢোকানো বা বার করাটাও সোজা।

     মুচকি হাসে হেম,

     – হ্যাঁ, কেবল দরজা দিয়ে না ঢুকিয়ে ভাঙা ছাদ দিয়ে নামতে যাওয়াটাই নিতাই হালদারের কাল হল। খোঁচা লেগে এয়ারশিপ ফুটো হয় গিয়ে প্রাণটা হারাতে হল। যাক, মামলাটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দেওয়ার জন্যে তোমাকে আর এক প্রস্থ ধন্যবাদ। আজ উঠি। গিয়ে রিপোর্ট লিখতে বসতে হবে।
বাধা দিল ধূর্জটি।

     – বলাই হালদার…

     – বলাইয়ের কোন খোঁজ পেলেই তোমাকে জানাব। এখন আসি।

     সিঁড়িতে হেমের জুতোর শব্দ মিলিয়ে যাবার পর খেয়াল করলাম, ধূর্জটি কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে মগ্ন হয়ে রয়েছে চিন্তায়। স্বভাবসিদ্ধ ভাবে তার তর্জনীটা টকটক আওয়াজ তুলছে সিগ্রেটের টিনে।

     হেসে ফেললাম।

     – এতো দেখছি জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না। কেস তো মিটে গেল। আবার চিন্তা কিসের?

     ঘাড় নাড়ল ধূর্জটি।

     – না হে যতীন। অনেক প্রশ্নের উত্তর বাকি রয়ে গেছে। নিতাইয়ের মত একজন সদ্য জেলছুট চোর কি করে একটা আস্ত এয়ারশিপ জুটিয়ে ফেলল, সে ক্যালরিকই বা কোথা থেকে পেল, বলাই হালদারের ভূমিকাই বা কি, এসবের উত্তর না পেলে কেসটা মিটে গেছে মন থেকে মেনে নিই কি করে। আর তাছাড়া আরো একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে।

     – কোনটা?

     – এয়ারশিপের ছেঁড়া জায়গাটা দেখে আমার মন হয়েছিল ওটা কিছুর খোঁচা লেগে ছেঁড়েনি। ধারালো কিছু দিয়ে কাটা হয়েছে। না যতীন, আমার কেমন মনে হচ্ছে এ নাটক এখনো শেষ হয় নি। এর পরের অঙ্ক এখনো বাকি আছে।


     ধূর্জটির অনুমান মিথ্যে হল না। মাসখানেকের মধ্যেই উঠে গেল দ্বিতীয় অঙ্কের যবনিকা।

     হেমন্ত বিদায় নিয়ে শীত এসেছে। সন্ধ্যে ঘন হয়ে রাত নামলেই ঠাণ্ডার প্রকোপ বাড়ে, কুয়াশার চাদরের আড়ালে নিস্তেজ হয়ে আসে রাস্তার গ্যাসবাতি, পথিকের সংখ্যা কমে ক্রমে নিঝুম হয়ে আসে পথ। বন্ধ দরজা জানলার আড়ালে শহর নিজেকে গৃহবন্দী করে ফেলে তাড়াতাড়িই।

     অন্যদিনের মত আজকেও এই সময়টাও আমরা বৈঠকখানার আশ্রয় ছেড়ে শোবার ঘরের বিছানায় আস্তানা নিয়েছি। ধূর্জটি থ্যাকার্স ডিরেক্টরি থেকে তার নোটবইতে কি সব টুকছে, আর আমি একটা গল্পের কয়েকটা লাইন লিখে চিন্তার খেই হারিয়ে কলম হাতে হাঁ করে কড়িকাঠ গুনছি। রাত বেশি হয়নি, কিন্তু তাও সব নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে, নিচের রাস্তায় মানুষজনের সাড়াশব্দ বিশেষ পাওয়া যায় না। রান্নাঘর থেকে বাসনের টুংটাং শব্দের সঙ্গে ভেসে আসছে কুঞ্জর রান্নার সুঘ্রাণ।

     গল্পের পরের লাইনটা মাথার মধ্য খুঁজে না পেয়ে এক কাপ চা চাইব কিনা ভাবছি, বাইরের দরজায় কে সজোরে কড়া নাড়ল।

     ধূর্জটির দিকে তাকালাম।

     – এই শীতের রাতে আবার কে এল? হেম নাকি?

     মাথা নাড়ল ধূর্জটি,

     – হেম নয়। রাস্তায় মোটরের আওয়াজ পাইনি।

     না হেম নয়। কুঞ্জ এসে একটা চিরকুট দিল। ডাক্তার মেজর প্রভাত রঞ্জন আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। তক্ষুণি যেতে হবে।

     আমি আর ধূর্জটি মুখ চাওয়াচায়ি করলাম। মেজর প্রভাতরঞ্জনকে আমরা চিনি। মিলিটারি থেকে অবসর নিয়ে ইদানীং প্রাইভেট প্রাক্টিস করেন, নেবুতলার মাঠের অপরপারেই তাঁর চেম্বার। ডাক্তার হিসেবে পাড়ায় সুনাম আর দুর্নাম দুইই আছে। হাতযশের জন্যে সুনাম, আর মেজাজের জন্যে দুর্নাম। লোকে ঠাট্টা করে বলে, ডাক্তার প্রভাতরঞ্জনকে দেখালে ওষুধ খাওয়ার আর প্রয়োজন হয় না, তাঁর ধমকের চোটেই রোগ শরীর থেকে পালিয়ে যায়। একই পাড়ায় থাকি, সুতরাং মৌখিক আলাপ নেই, তা নয়। কিন্তু রাতের বেলায় হঠাৎ এই জরুরী তলবের মানে বুঝতে পারলাম না।

     আর কিছু না হোক অন্ততঃ কৌতূহল নিরসনের জন্যেই পুলওভার, র‍্যাপার আর পশমের টুপিতে আপাদমস্তক ঢেকে আমরা পা বাড়ালাম মেজর প্রভাতরঞ্জনের চেম্বারের দিকে।

     নির্জন রাস্তায় মানুষের সাড়াশব্দ বিশেষ নেই। কেবল বাড়িঘরের বন্ধ দোরকপাটের ফাঁক থেকে চুঁইয়ে পড়ছে আলো। নেবুতলার মাঠ টপকে আমরা এসে দাঁড়ালাম প্রভাতরঞ্জনের ডাক্তারখানার সামনে।

     আমার দিকে চোখ তুলে ইঙ্গিত করল ধূর্জটি,

     – দেখেছ?

     রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে দু-দুখানা মোটর। তাদের একটার চেহারা আমাদের পরিচিত। মাস-খানেক আগেই এটাতে চাপিয়েই হেম আমাদের ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে নিয়ে গিয়েছিল।

     – পুলিসের মোটর না?

     প্রশ্ন করলাম বিস্মিত স্বরে।

     ভ্রু কুঁচকে গেল ধূর্জটির।

     – হ্যাঁ। চলো।

     ডাক্তারখানার ভিজিটর্স রুম ফাঁকা। টুলে বসে থাকা আর্দালী আঙুল তুলে ভেতরের চেম্বারের দিকে দেখালো,

     – ডাক্তারসাব অন্দর হ্যায়।

     চেম্বারে স্পিরিটের ঝাঁঝালো গন্ধে মিশেছে তামাকের কটু বাস। ছোট ঘরটাতে টেবিলের পেছনে দাঁতে পাইপ কামড়ে যিনি বসে আছেন তাঁকে আমরা চিনি। প্রশস্ত কাঁধ, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, এই শীতেও পরনের টুইডের কোটের সবকটা বোতাম খোলা। ইনি আমাদের পাড়ার সর্বজনশ্রদ্ধেয় ডাক্তারসাহেব মেজর প্রভাতরঞ্জন।

     ডাক্তারের টেবিল আর কলাই করা সাদা বেসিনের মাঝখানের স্বল্প পরিসরে জড়সড় হয়ে বসে থাকা হেমও আমাদের পরিচিত।
অপরিচিত কেবল ঘরে উপস্থিত তৃতীয় ব্যক্তিটি। টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁটের ওপরে সরু গোঁফের রেখা, মুখের গৌরবর্ণ পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। পরণে ফার বসানো অলস্টার আর ধূসর ট্রাউজার্স।

     মুখ থেকে পাইপ নামালেন ডাক্তার প্রভাতরঞ্জন,

     – বসো।

     – ডাক্তারসাহেব, এত রাতে?

     চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতেই প্রশ্ন করে ধূর্জটি।


     ঘরে উপস্থিত তৃতীয় ব্যক্তির দিকে চোখ তুলে ইঙ্গিত করেন ডাক্তার প্রভাতরঞ্জন,

     – দরকারটা ঠিক আমার নয়। দুলমিগড় এস্টেটের কুমারবাহাদুর সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ সরকার আমার বিশেষ পরিচিত, তোমার সঙ্গে ওনার কিছু কথা আছে।
অপরাধ অনুসন্ধানী হিসেবে ধূর্জটির নামডাক কম নেই, তার কাছে কোন বড়মানুষের প্রয়োজন থাকতেই পারে, কিন্তু সরাসরি আমাদের বাসায় না এসে এখানে কেন?

     আমার মুখের বিস্ময়ের ছাপটা বোধহয় সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের নজর এড়ায়নি, হেমের দিকে তাকালেন তিনি,

     – দেখুন, পুলিশের তরফ থেকে হেমবাবুরা যা তদন্ত করার তা করছেন। কিন্তু হেমবাবুর কাছে আপনার কথা জানতে পেরে মনে হল এই ব্যাপারে আপনাকেও সঙ্গে রাখাটাও প্রয়োজন। তবে আমি যে আপনার কাছে এসেছি এটা পাঁচকান হোক আমি চাই না। মেজর প্রভাতরঞ্জন আমার অনেকদিনের পরিচিত, তাই মনে হল গোপনীয়তার খাতিরে ওনার ডাক্তারখানাটাই আপনার সঙ্গে দেখা করার উপযুক্ত জায়গা।
ধূর্জটির মুখের মৃদু হাসিটা নজর এড়াল না।

     – হেম, কিছু না জেনেও অনুমান করতে পারছি, খুব সম্ভব বলাই হালদারের আবির্ভাব ঘটেছে।

     গম্ভীর মুখে ঘাড় নাড়ল হেম,

     – তা একরকম বলতে পারো। তবে আবির্ভাব না বলে তিরোধান বলাটাই ভাল।

     – মানে?

    – মানে বলাই হালদার খুন হয়েছে।

    – খুন! কবে?

    – মাস দেড়েক আগে।

     – কোথায় খুন হল?

     – আমার এস্টেটে। দুলমিগড়ে।

     হেম নয়, উত্তর এল সৌমেন্দ্রনারায়ণের কাছ থেকে।

     – দুলমিগড় এখান থে্কে প্রায় চারশ মাইল উত্তর পশ্চিমে। বেশিরভাগটাই জঙ্গল আর পাহাড়, তবে কয়েকটা ছোট গ্রামও আছে। মাস দেড়েক আগে একজন গ্রামবাসীর গরু পালিয়ে যায়। জঙ্গলে গরু খুঁজতে গিয়ে তার চোখে পড়ে ঝোপের মধ্যে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে। এরপর আমার কাছে খবর যায়। আমি পুলিসে খবর দিই।

     – দেহটা যে বলাই হালদারের বোঝা গেল কি করে?

     পকেট থেকে একটা ফটোগ্রাফ বের করল হেম।

     – ছবি দেখে। বলাই হালদার ফেরার হয়ে যাওয়ার পর তার এই ফটোগ্রাফখানা সব থানাতে পাঠানো হয়েছিল। দুলমিগড়ের পুলিশ তাই দেখেই সনাক্ত করে।

     – মৃত্যুর কারণ?-ভারী কোন কিছু দিয়ে মাথাটা থেঁতলে দেওয়া ছিল। এছাড়া শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন ছিল না।

     – কিন্তু কিছু মনে করবেন না কুমারবাহাদুর, এটা ছাড়াও আরো কিছু অঘটন নিশ্চয়ই ঘটেছে। তা না হলে শুধু একটা ফেরারী চোরের মৃত্যুর রহস্যভেদ করতে রাতবিরেতে আপনি এই অধমকে স্মরণ করতেন না।

     দু-আঙুলে মাথার রগদুটো একবার টিপে ধরলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,

     – ঠিকই বলেছেন। আমার এস্টেটে এটা একমাত্র অপরাধ নয়। গত মাসে আরও একটা খুন হয়। তার কোন কিনারা এখনো পুলিশ করে উঠতে পারেনি। আর যে মারা গেছে তার মৃত্যুর দায় বোধহয় খানিকটা আমার ওপরেও বর্তায়।

     – আপনার ওপর? কেন?

     একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – কারণ যে খুন হয়েছে, তাকে আমিই দুলমিগড়ে ডেকে এনেছিলাম। আমার কাজে দুলমিগড় না এলে মানুষটা হয়ত প্রাণ হারাত না।

     – কাকে ডেকে এনেছিলেন?

     – বলছি। আমার একটা কলগোলাম আছে। ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কস থেকে বছরখানেক আগে কেনা। এতদিন ভালই চলছিল। হঠাৎ গতমাসে বিগড়ে গিয়ে উল্টোপাল্টা আচরণ করতে শুরু করল। কখনো আচমকা হাত-পা ছোঁড়ে, কখনো জিনিসপত্র আছড়ে ভাঙে। বাধ্য হয়ে গোলাম বন্ধ করে দিয়ে কলকাতায় ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে তার করলাম। দিন কয়েকের মধ্যেই ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কস থেকে পীতাম্বর গোমেজ নামে এক মেকানিক তার যন্ত্রপাতি সমেত এসে হাজির হল। বেশী বয়েস নয়, কিন্তু কাজের হাতটি পাকা। দিন-দুয়েকের মধ্যেই গোলাম ঠিক করে ফেলল।

     – গোলামের কী সমস্যা হয়েছিল আপনাকে জানিয়েছিল?

     – সেটাই তো রহস্য। এমনিতে ছোকরা বেশ হাসিখুশী, কিন্তু গোলামের কী হয়েছিল আমি প্রশ্ন করতেই গম্ভীর হয়ে গেল। বলল আর একবার দেখে তবে বলবে।

     ভ্রু কুঁচকাল ধূর্জটি।

     – পরে জিজ্ঞেস করেছিলেন?

     মাথা নাড়লেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,

     – না। তার আর সুযোগ পেলাম কোথায়? পরের দিন সকাল বেলায় পীতাম্বর এসে বলল তাকে কলকাতার অফিসে একটা তার করতে হবে, সে একবার পোস্ট-অফিসে যাচ্ছে। আমাদের পোস্টাপিস বেশ খানিকটা দূরে, স্টেশনের কাছাকাছি। আমি সঙ্গে লোক দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পীতাম্বর রাজী হল না। বলল সে স্টেশনের রাস্তা চেনে, নিজে নিজেই চলে যাবে। বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল, কিন্তু পীতাম্বর ফিরল না। পোস্টাপিসে লোক পাঠালাম। পোস্টমাস্টার বললেন সকাল থেকে তার করার জন্য কেউ আসেনি। লোক লাগিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম, সন্ধ্যে নাগাদ রাস্তার থেকে বেশ খানিকটা দুরে জঙ্গলের ভেতরে পীতাম্বরের খোঁজ পাওয়া গেল। দেহে প্রাণ নেই, মাথাটা থেঁতলানো।

     পকেট থেকে সিগ্রেটের টিন বের করে সিগ্রেটে অগ্নিসংযোগ করে ধূর্জটি। লক্ষ করি তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে।

     – বলাই হালদারের হদিস পাওয়া গেলেও রহস্যটা যে আরো জটিল হয়ে উঠল হেম!

     সায় দিল হেম।

     – হ্যাঁ তা তো হলই। বোঝাই যাচ্ছে যে বলাই আর নিতাই কেবল ক্যাশ চুরি করার জন্যে ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে হানা দেয়নি। ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে খরিদ্দাররা সব বড়মানুষ। পরে তাদের ঘরে চুরি করাটাও বোধহয় দুই ভাইয়ের মতলব ছিল। খুব সম্ভব শোরুম থেকে খরিদ্দারদের নাম-ঠিকানার তালিকাও তারা যাবার আগে হাতিয়ে নিয়ে যায়। আর সেই সূত্র ধরেই বলাই দুলমিগড় হাজির হয়। কিন্তু বলাইকে খুন কে করল? তাহলে বলাই আর নিতাই ছাড়া কি এই চোরের দলে আরো কেউ আছে?

     ফের মাথার রগদুটো একবার টিপে ধরলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – ধূর্জটিবাবু, মাত্র কয়েক বছর আগে আমাদের বাড়িতে পিশাচের পালের আচমকা হানায় আমার পরিবারের অর্ধেক সদস্য প্রাণ হারায়। সুতরাং আমার জমিদারীতে পরপর দুটো খুন হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে ঝড়ের পূর্বাভাসের মতনই ঠেকছে।

     বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না।

     – পিশাচ হানা! কিন্তু পিশাচেরা তো দল বেঁধে মানুষকে আক্রমণ করে না। যদি না –

     হঠাৎ মাথায় একটা চিন্তা ভেসে উঠতেই থেমে গেলাম মাঝপথে।

     আমার অসম্পূর্ণ কথায় সায় দিল ধূর্জটি,

     -যদি না কোন পিশাচসিদ্ধ তাদের প্ররোচিত করে থাকে। কুমারবাহাদুর, কে এই কাজ করেছিল বুঝতে পেরেছিলেন?

     মাথা নাড়লেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – না ধূর্জটিবাবু। বুঝতে পারিনি। মহাযুদ্ধের সময় আমি মিলিটারিতে যোগ দিয়েছিলাম। যখন বাড়িতে পিশাচ পড়ে তখন আমি মেসোপটেমিয়ায়। জেনারেল টাউনসেণ্ডের ফৌজে সামিল হয়ে নাসিরিয়ার যুদ্ধে লড়াই করছি। সন্ধ্যের সময় পিশাচের দল পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকে পড়ে সবাইকে নির্বিচারে টুঁটি কামড়ে হত্যা করতে শুরু করে। চিন্ময়ী না থাকলে হয়ত কেউই প্রাণে বাঁচত না।

     – চিন্ময়ী কে?

     এই প্রথম সামান্য এক চিলতে হাসি ফুটলো সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের ঠোঁটে,

     – আমার স্ত্রী। বিয়ের পর আমি চিন্ময়ীকে সখ করে বন্দুক চালানো শিখিয়েছিলাম। সেই বিদ্যাটা এই বিপদের মুখে কাজে লেগে যায়। আমার সংগ্রহে একটা আমেরিকান উইঞ্চেস্টার রিপিটার রাইফেল আছে। পিশাচ পড়ার পর শাড়ির আঁচলে এক আঁজলা টোটা বেঁধে চিন্ময়ী সেই রাইফেল হাতে বাড়ির কিছুর কাজের লোকজন আর আমার ছোটভাই উপেন্দ্রকে নিয়ে ছাদে আশ্রয় নেয়। সঙ্গে আমাদের এস্টেটের পেয়াদা মাহিন্দার সিং। ছাদে ওঠার সিঁড়িটা অপ্রশস্ত, দু-একজনের বেশী ওঠার জায়গা নেই। মাহিন্দারের তলোয়ার আর চিন্ময়ীর বন্দুকের দাপটে পিশাচেরা অনেক্ষণ সিঁড়িতেই আটকে থাকে, ছাদে পা রাখতে পারে না।

     তামাকের ধোঁয়ায় ঘরের আলো ঝাপসা হয়ে এসেছে। শীতের নিঝুম রাত্রে দেওয়াল-ঘড়ির টিকটিক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের বর্ণনা শুনতে শুনতে আমি অন্য কোন এক জগতে হারিয়ে গেলাম, আমার মানসপটে যেন একখানা ছবি ফুটে উঠল। কোন এক আরণ্যক প্রদেশে এক গৃহলক্ষ্মী তাঁর পরিজনের প্রাণ রক্ষার্থে মরণপন লড়াই করছেন। শ্বদন্ত মেলে হুহুঙ্কারে ছুটে আসছে উন্মত্ত পিশাচের দল। নীলাভ ধূসর তাদের বর্ণ, জ্বলন্ত অঙ্গারের মত রক্তলাল চোখ, অঙ্গে হাড়ের ভূষণ। বরনারীর আঁচলটি কোমরে জড়িয়ে বাঁধা, মুহুর্মুহু অগ্নিবর্ষণ করছে তাঁর হাতের বন্দুক, মাটিতে ঝরে পড়ছে খালি কার্ত্তুজের খোল, আছড়ে পড়ছে পিশাচের প্রাণহীন দেহ।

     ধূর্জটির অবশ্য কল্পনার জগতের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই, সে ভ্রু কোঁচকায়।

     – কিছু মনে করবেন না কুমারবাহাদুর। কিন্তু পিশাচের প্রাণশক্তি মানুষের চাইতে অনেক বেশি। একদম মর্মস্থলে বারংবার আঘাত না পেলে তাদের সহজে মৃত্যু হয় না। একটা বন্দুকের ভরসায় তাদের বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব না।

     মাথা নেড়ে সায় দিলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ

     – ঠিক বলেছেন। পিশাচদের হয়ত আটকানো যেত না। কিন্তু গুলি চালাতে চালাতে চিন্ময়ীর হঠাৎ নজরে পড়ল আমাদের বাড়ির ফটকের কাছে কেউ একজন মাথার ওপর দুহাত তুলে দুর্বোধ্য স্বরে কিসব মন্ত্রপাঠ করছে। মন্ত্রোচ্চারণ করা ব্যক্তি যে কোন পিশাচসিদ্ধ, মন্ত্রবলে পিশাচদের আক্রমণ করতে প্ররোচনা দিচ্ছে, চিন্ময়ীর বুঝতে অসুবিধে হয়নি। মুহূর্তমাত্র কালক্ষেপ না করে সে রিপিটার রাইফেল থেকে ঘনঘন কয়েকটা ফায়ার করে। সবগুলো না হলেও একটা বা দুটো গুলি লক্ষভ্রষ্ট হয় না, চিৎকার করে পিশাচ-সিদ্ধ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পিশাচেরাও যেন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দুদ্দাড় করে ছুটে পালায়।

     – পিশাচসিদ্ধকে সনাক্ত করা গিয়েছিল?

     দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – না। পিশাচরা পালিয়ে যাবার পর চিন্ময়ী যখন নিচে নেমে আসে তখন বাড়িময় রক্তগঙ্গা বইছে। বেশির ভাগ লোকই মৃত্যু বরণ করেছে। এস্টেটের কর্মচারীরা ছাড়াও মারা গেছেন আমার বাবা, কাকা আর কাকীমা। যারা মারা যায়নি, তারাও সাঙ্ঘাতিক আহত, প্রায় মৃত্যুর দোড়গোড়ায়। রাতটুকু কাটে কিনা সন্দেহ। সে দিন আর কারোর পক্ষে অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়নি। পরের দিন সকালে ফটকের কাছে খানিকটা রক্তের ছিটে নজরে এলেও কোন মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। হয় পিশাচসিদ্ধের দেহ তার সঙ্গীরা সরিয়ে নিয়ে গেছিল, অথবা সে মরেনি, জখম হয়েছিল কেবল, সে অবস্থাতেই পালিয়েছে। সে কে ছিল, কেন আমার পরিবারকে আক্রমণ করেছিল, আজও তার রহস্য ভেদ হয়নি।

     মুখ থেকে পাইপ নামালেন মেজর প্রভাতরঞ্জন।

     – ধূর্জটি, সৌমেন তোমার কাছে কেন ছুটে এসেছে বুঝতে পেরেছ? ওর পরিবারের ওপর দিয়ে একবার ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার ও আর কোন ঝুঁকি নিতে চায় না।

     পায়ের কাছে থেকে একটা খবরের কাগজের মোড়ক তুলে এনে টেবিলের ওপর রাখেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – আপনার মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে আপনার কাছে না গিয়ে কেন গোপনে প্রভাতের চেম্বারে ডাকিয়ে আনলাম। আমার জন্যে আপনি যাতে কোন বিপদে না পড়েন তাই এই সতর্কতা।

     – আপনার এই রকমটা ভাবার কারণ?

     – ধূর্জটিবাবু, আমি ব্রিস্টল হোটেলে উঠেছি। গতকাল সারাদিন আমি কাজের প্রয়োজনে বাইরেই ছিলাম। সেই ফাঁকে এটাকে কেউ আমার বিছানায় ছেড়ে যায়।

     কাগজের মোড়কটা খোলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। ভেতরে একটা কাঁচের বয়েম। আর বয়েমের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে হাতদুয়েক লম্বা কেঁচোর আকারের কীট। গায়ের বর্ণ তার আগুনের মতন লাল।

     বয়েমটা হাতে তুলে নিয়ে দেখে ধূর্জটি। একটা বিস্ময়ের আওয়াজ বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে।

     – এটা তো দেখছি অল্‌ঘই খর্খই। গোবি মরুভূমির মৃত্যুকীট। ভয়ঙ্কর বিষাক্ত। মুখ থেকে বিষ ছোঁড়ে। বিষের একফোঁটা শরীরের কোথাও লাগলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। আপনি খুব জোর বেঁচে গেছেন।

     – আমি ফ্রণ্টে লড়াই করেছি ধূর্জটিবাবু, বিপদের মুখে আমার স্নায়ুগুলো সাধারণ মানুষের থেকে দ্রুত কাজ করে। লেপ উল্টে এটাকে দেখতে পেয়েই আমি লাফ দিয়ে একপাশে সরে যাই। এটা মুখ দিয়ে বিষ ছোঁড়ে বটে, কিন্তু তার পুরোটাই লক্ষভ্রষ্ট হয়। দ্বিতীয়বার আক্রমণ করার আগেই টেবিলে একটা ফলকাটা ছুরি ছিল সেটা দিয়ে এটাকে বিছানায় গেঁথে ফেলি।

     উঠে দাঁড়ান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – ধূর্জটিবাবু, আমি জানি আপনার আরো প্রশ্ন আছে। কিন্তু আজ নয়। আপনার বাকি প্রশ্নের উত্তর আমি দুলমিগড়ে দেব। আজ উঠি।

     উঠে দাঁড়ায় ধূর্জটিও।

     – আমাকে দু-তিনদিন সময় দিতে হবে। হাতে কয়েকটা কাজ আছে।

     – কোন অসুবিধে নেই। আপনি আপনার কাজ শেষ করেই আসুন। কেবল আসার একটা তার করে দেবেন, আপনার জন্যে স্টেশনে মোটর রাখা থাকবে। আজ আসি। নমস্কার।


     গাড়ি যখন ঘণ্টাখানেক লেট করে দুলমিগড়ে এসে থামল তখন সকালের কুয়াশা কাটিয়ে সূর্যটা পূবের আকাশ বেয়ে অনেকখানি ওপরে উঠে গেছে। কিন্তু তবুও প্ল্যাটফর্মে পা রাখতেই কলকাতার সঙ্গে ঠাণ্ডার প্রভেদটা একেবারে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।

     নেমে ধূর্জটির মুখের দিকে একবার তাকালাম। সে যে সেই সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে আমাদের মোলাকাতের পর থেকে মুখে কুলুপ এঁটেছে, তার মুখ দিয়ে আর একটা কথাও বার করাতে পারেনি। সে সেই সাতসকালে ‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরী যাচ্ছি’ বলে বেরোতো, রাত্রের আগে তার আর টিকিটি দেখা যেত না। আর দেখা হলে দু-একটা মামুলি হুঁ-হাঁ ছাড়া তার মুখ থেকে কিছুর শোনার সৌভাগ্য হয়নি।

     – কি হে? তার করে দিয়েছিলে তো? মোটর কোথায়?

     প্ল্যাটফর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা হুড খোলা শেভ্রোলে গাড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখাল ধূর্জটি,

     – ওই তো! ওটাই হবে।

     গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম বটে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।

     – গাড়ি রয়েছে বটে। কিন্তু নিতে আসার লোক কই?

     – হবে কোথাও আশেপাশে!

     বেডিং সুটকেস নামিয়ে রেখে এদিক ওদিক চাইছি, পাশ থেকে কেউ গলা খাঁকারি দিল।

     – বাবু শুনছেন?

     আগন্তুকের পরনে আধময়লা ধুতি আর কামিজ, উর্ধ্বাঙ্গে জড়ানো একটা রং জ্বলে যাওয়া জীর্ণ র‍্যাপার। পরিশ্রম ক্লিষ্ট মুখে উৎসুক চাহনি।

     – আপনারা কি সরকার বাড়ির অতিথি?

     – হ্যাঁ! আপনি কি আমাদের নিতে এসেছেন।

     – আরে না না। আপনাদের চিত্ত নিতে এসেছে। আপনাদের ট্রেন আসতে দেরি হচ্ছিল দেখে পোস্টাপিসে কি একটা কাজে গেল।

     এতক্ষণ খেয়াল করিনি, একটু দূরেই পোস্ট-অফিসের একতলা বাড়িটা নজরে পড়ল।

     এক পা এগিয়ে এল ধূর্জটি।

     – তুমি?

     – আজ্ঞে আমি গোপাল সমাদ্দার। ওই মণিহারী দোকানটা আমার।

     আঙ্গুল তুলে দেখায় গোপাল। পোস্ট-অফিসের ঠিক বিপরীতে একটা হতশ্রী চেহারার বাড়ি। ইঁটের দেওয়াল, করগটের চাল।

     – কিছু যদি মনে না করেন, একটা নিবেদন ছিল। এই ঠাণ্ডায় কেন মিছিমিছি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন? চিত্তর হয়ত আসতে সময় লাগবে, ততক্ষণ আপনার আমার দোকানে এসে বসতে পারেন।

     আমি আপত্তি জানাতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই ধূর্জটি দেখি অমায়িক হেসে নিজেই দোকানের দিকে পা বাড়িয়ে দিল।

     – আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। ভালই হয় তাহলে।

     হতভম্ব হয়ে আমি ধূর্জটির পিছু নিলাম, সঙ্গে গোপাল সমাদ্দার।

     দোকানটা ছোট বটে, কিন্তু মালে বোঝাই। প্রায় ছাদ অবধি বাক্স-প্যাঁটরায় ঠাসা, দেওয়ালে বসানো তাকেও থরে থরে নানান জিনিসপত্র।

     সপ্রশংস দৃষ্টিতে চারদিকে একবার চোখ বোলায় ধূর্জটি।

     – বাঃ! তোমার দোকানে তো প্রচুর জিনিস মজুত দেখছি।

     সলজ্জ হাসি হাসে গোপাল।

     – হ্যাঁ। স্টেশন পোস্টাপিসের কাছে তো, লোকের আনাগোনা লেগেই থাকে। খদ্দের ধরে রাখতে এটা ওটা সবই রাখতে হয়।

     – তোমার দোকানে কিছু না পাওয়া গেলে? আর দোকান নেই এখানে?

     মাথা ঝাঁকায় গোপাল।

     – না বাবু, এখানে আর কোন দোকান নেই। তবে আমার কাছে না থাকলেও, ফরমায়েশি জিনিস আমি কলকাতা থেকে আনিয়ে দিই। আমার কাছে থেকে খদ্দের খালি হাতে ফিরে যায় না।

     – বাঃ! তা তোমার বাসা কোথায়?

     গোপালের মুখের হাসিটা কেমন ম্লান হয়ে এল।

     – একা মানুষ, আলাদা বাসা করে আর কি করব? তা ছাড়া দোকানের ঝাঁপ সেই সাতসকালে খোলে, আর রাতবিরেতে বন্ধ হয়। আমি এই দোকানের পেছনের ঘরখানাতেই থাকি। আসুন না।

     খেয়াল করলাম দোকানের পেছনের দেয়ালে একটা দরজা। দরজায় পাল্লা নেই, কেবল একটা তেলচিটে কাপড় পর্দার মতন করে টাঙ্গানো।

     গোপালের পেছনের ঘরে পা রাখলাম আমি আর ধূর্জটি। ঘরের একপাশে একটা তক্তাপোষ, তাতে একটা ময়লা চাদর পাতা। এক কোণে জলের কুঁজো, কয়েকটা থালাবাসন আর একটা তোলা উনুন। দেওয়ালে টাঙানো দড়িতে কয়েকটা অপরিচ্ছন্ন জামাকাপড়। ঘরের সর্বত্র দারিদ্র আর অবহেলার ছাপ স্পষ্ট।

     – বসুন বাবু।

     তক্তপোষের নড়বড়ে চেহারাখানা দেখে আমি বসব কি বসব না ইতস্ততঃ করলেও, ধূর্জটির সে বিষয়ে কোন বিকার দেখা গেল না। সে পায়ের ওপর পা তুলে আয়েস করে বসে পড়ল।

     – তা গোপাল, তুমি অনেক রাত্তির অবধি দোকান খোলা রাখ?

     – হ্যাঁ বাবু। কিন্তু কয়েকদিন ধরেই ভাবছি এবার থেকে তাড়াতাড়িই দোকান বন্ধ করে দেব। দিনকাল ভাল নয়, দু-দুটো খুন হয়ে গেছে। কটা পয়সার জন্যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে লাভ কি?

     – ঠিক বলেছ। তা খুনের ব্যাপারে জানো নাকি তুমি কিছু?

     – ওই লোকের মুখে যেটুকু শোনা ততটুকুই। শুনেছি জঙ্গলে দুটো মানুষের লাস পাওয়া গিয়েছিল। সারাদিন দোকান সামলাতেই কেটে যায়, অত খোঁজ রাখার সময় কোথায় বাবু!

     – তা তোমার এ দোকান কদ্দিনের গোপাল?

     – বেশী দিনের না। বছর খানেক হবে। আগে এলাহাবাদে একটা কারখানায় মিস্ত্রীর কাজ করতাম। মাইনে মন্দ পেতাম না।

     – তা ছাড়লে কেন সে কাজ?

     – সে কি আর সাধ করে ছেড়েছি? একদিন চিৎ হয়ে একট মেসিনের পায়ার বল্টু ঠিক করছি, ওপর থেকে একটা ভারী শিক পড়ে পেটে গেঁথে গেল।

     – সে কি!

     – হ্যাঁ বাবু। অনেকদিন হাসপাতালে থাকার পর নিরাময় হলাম বটে, কিন্তু তখন আর কারখানায় কাজ করার মত শরীরে বল নেই। হাতে যে কটা টাকা ছিল, তাই দিয়ে এই দোকানটা দিলাম।

     কথা বলতে বলতে হঠাৎই সামনের দেওয়ালে চোখ পড়ে ধূর্জটির।

     – তোমার কি বইয়েরও সখ আছে নাকি হে গোপাল?

     লক্ষ করি দেওয়ালে একটা তাকের ওপর সাজানো বইয়ের সারি।

     ম্লান হাসে গোপাল,

     – না না বাবু। আমি বইয়ের আর কি বুঝি! এলাহাবাদে আমি এক মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে থাকতাম, বইগুলো তাঁর। তিনি কলকাতায় চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমায় দিয়ে যান। আমায় খুব স্নেহ করতেন, তাই রেখে দিয়েছি।

     উঠে দাঁড়িয়ে দু-একটা বই উল্টেপাল্টে দেখে ধূর্জটি।

     – বাঃ বেশ ভাল অবস্থাতেই আছে দেখছি। দেখ যতীন।

     ধূর্জটির হাত থেকে নিই বইটা। মরক্কো লেদারে বাঁধানো, সোনার জলে নাম লেখা। বেচারের ‘ফিজিকা সাবটেরানিয়া’।

     – হ্যাঁ সত্যিই, বেশ যত্ন করে রাখা বই। বেচবে নাকি গোপাল?

     – না বাবু। ভালবেসে দেওয়া জিনিস, অনেক অভাবেও বিক্রি করিনি।

     আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে তাকে তুলে রাখে গোপাল।

     – কিছু যদি মনে না করেন বাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আপনারা কি ওই খুনের ব্যাপারেই এখান এসেছেন?

     দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে আসে ধূর্জটির,

     – হঠাৎ এ কথা কেন বলছ গোপাল?

     কেমন থতমত খায় গোপাল।

     – না আপনি একটু আগেই আমার কাছে খুনের কথা জানতে চাইছিলেন কিনা, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।

     ধূর্জটি ফের কি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বাইরে থেকে কার হাঁক শোনা গেল।

     – গোপালদা, ও গোপালদা।

     যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল গোপাল।

     – চিত্ত এসে গেছে। চলুন।

     গোপালের দোকান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসি আমরা।

     চিত্তর পরণে খাকি ট্রাউজার্স আর অলিভ গ্রীন পুলোভার। পুলোভারের নিম্নাংশ প্যান্টের মধ্যে গোঁজা। পায়ে ভারী বুট, কোমরে কালো রঙের চওড়া বেল্ট। বেল্টের একপাশে বাঁধা হোলস্টার থেকে উঁকি মারছে পিস্তলের বাঁট। বাঁটে বাঁধা কর্ডের দড়ির অন্যপ্রান্ত গলায় ঝোলানো। প্রায় মিলিটারি সাজপোষাক বললেই চলে।

     – কিছু মনে করবেন না স্যার। পোস্টাপিসে একটু দেরি হয়ে গেল।

     হাত নেড়ে নিতাইকে বিদায় জানায় ধূর্জটি,

     – আরে না না। আমাদের কোন অসুবিধে হয়নি। আমরা দিব্যি গোপালের সঙ্গে গল্প করছিলাম।

     গাড়িতে উঠে বসি। জঙ্গল ঘেরা আলোছায়া মাখা পথ ধরে ছুটতে থাকে মোটর। কিছুক্ষণ চলার পর মোটর বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁক নেয় একদিকে, জঙ্গলটাও ক্রমে পাতলা হয়ে আসে। আর তার একটু বাদেই মোটর এসে দাঁড়ায় একটা লোহার ফটকের সামনে।

     মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করি। ফটকের দুপাশের প্রাচীর কমপক্ষে দুমানুষ উঁচু, মাথায় তার কাঁটাতারের কুণ্ডলী। বাইরে থেকে কিছু দেখার উপায় নেই।

     ধীরে ধীরে খুলে যায় ফটক, মোরাম বেছানো পথ ধরে আমাদের গাড়ি ঢোকে ভেতরে।

     পথের দুপাশে ফুলের বাগান আর ঘাসের লন। তাদের মাঝে উড়ে বেড়ায় রংবেরঙের প্রজাপতি। পথের মাঝে বসানো মার্বেলের ফোয়ারা। তার জলনিক্কণে সুর মিলিয়ে ডেকে চলে কোন নাম না জানা না পাখি।

     আর এসবের সঙ্গে কুৎসিত ভাবে বেমানান হয়ে পথের একপাশে একটা মাচার ওপর থেকে মাথা উঁচিয়ে থাকে একটা জাম্বুরকের কালো নল।

     পথের শেষে দোতলা উঁচু বাড়ি। তার সামনের সিঁড়ি থেকে নেমে এলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। পরনে ফ্লানেলের ট্রাউজার্স আর ভারী কার্ডিগান।

     – আসুন আসুন। পৌঁছতে কষ্ট হয়নি তো?

     গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যায় ধূর্জটি,

     – না না। ট্রেন ঘন্টাখানেক লেট ছিল কেবল। এ ছাড়া আর কোন কষ্ট হয়নি।

     বাড়ির ভেতরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,

     – আসুন।

     মূল দরজা পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে পা রাখি। চারমহলা বাড়ি। মাঝের চকমিলান উঠোনকে প্রাচীরের মতন ঘিরে রেখেছে বাড়ির চারটে অংশ। একতলায় উঠোন ঘিরে দালান, দোতলায় টানা বারন্দা। মাথার ওপর শীতের নির্মেঘ নীল আকাশ।

     উঠোনে দাঁড়িয়ে কিঞ্চিৎ ইতস্ততঃ করেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – এতটা পথ এসেছেন, আপনারা কি আগে খানিকটা বিশ্রাম করে নেবেন?

     মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখে নেয় ধূর্জটি।

     – বিশ্রাম তো অবশ্যই নেব, কিন্তু তার আগে আপনাদের বাড়ির চতুর্দিকটা একটু দেখে নিতে চাই।

     হাত তুলে একে একে ইঙ্গিত করেন সৌমেন্দ্রনানারায়ণ। বাড়ির একটা মোটামুটি আন্দাজ পাই আমরা।

     যেদিক দিয়ে আমরা ঢুকেছি একতলার সেই সামনের দিকটা এস্টেটের সেরেস্তা আর মহাফেজখানা। দিনের বেলাটা সৌমেন্দ্রনানারায়ণ এখানেই কাটান। এর বিপরীতে পরপর কয়েকখানা ঘর, এস্টেটের কিছু কর্মচারীদের থাকার জায়গা। বাঁদিকে অনুরূপ আরো কয়েকখানি ঘর। এস্টেটের কাজে এসে কাউকে রাত্রিবাস করতে হলে তাদের এই ঘর খুলে দেওয়া হয়। ডানদিকে ভাঁড়ার, রসুই আর এস্টেটের কর্মচারীদের আহারের ঘর।

     – বুঝতেই পারছেন, আমাদের বাস একেবারে জঙ্গলের মধ্যে। অতএব এই সুবিধাটুকু দিতেই হয়।

     ওপরের দিকে একবার তাকায় ধূর্জটি,

     – একতলাটা তাহলে আপনার কাজের এলাকা।

     – তা একরকম বলতে পারেন। কাজের বাইরে আমার বাসস্থান দোতলায়। চলুন।

     সিঁড়িতে পা রাখে ধূর্জটি,

     – আপনার ড্রাইভার চিত্তর সাজপোষাক একেবারে মিলিটারির মতন।

     মৃদু হাসেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – চিত্ত মিলিটারিই। কর্পোরাল চিত্ত দাস। মেসোপটেমিয়ায় ফৌজে ছিল, যুদ্ধের পর আমিই সঙ্গে করে নিয়ে আসি। তবে মাঝেমধ্যে গাড়ি চালালেও চিত্ত ড্রাইভার ঠিক নয়, এস্টেটের নজরদার। এস্টেটের সুরক্ষার দায়িত্বটা সব চিত্তর।

     দোতলায় অনেকগুলো ঘর। বেশ কয়েকটা শোবার ঘর আর একটা আলাদা খাবার ঘর ছাড়াও দোতলার অনেকখানি জুড়ে রয়েছে যে ঘরটা তাকে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ লাইব্রেরী বলে ডাকলেও সেটাকে সংগ্রহশালা বললে অত্যুক্তি হয় না।

     টানা লম্বা ঘরখানার একদিকে সারি সারি গরাদহীন উঁচু জানলা। জানলা দিয়ে আসা রোদের আলো লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে বেছানো রঙিন গালিচার ওপর। জানালার পাশের দেওয়ালে পরের পর টাঙানো নানান বিচিত্র দর্শন পশু করোটি। ঘরের অন্যদিকে বই বোঝাই তাক উঠে গেছে মেঝে থেকে ছাদ অবধি। ঘরের মেঝেতে বসানো রয়েছে পেতলের জ্যোতিষযন্ত্র আর দু-একটা টেলিস্কোপ, একপাশে একটা কাঠামোয় টাঙানো একটা ইয়েতির কঙ্কাল।

     মুগ্ধ দৃষ্টিতে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখে ধূর্জটি,

     – আপনার বিজ্ঞান চর্চায় বেশ আগ্রহ আছে দেখছি!

     সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের হাসির শব্দটা ঘরময় ছড়িয়ে যায়।

     ভুল ভাবছেন! বিজ্ঞানচর্চা কেন, কোন পড়াশোনাতেই আমার তেমন কোন আগ্রহ নেই।

     অবাক হয় ধূর্জটি।

     – তবে!

     – যা দেখছেন সব আমার বাবা আর কাকার সংগ্রহ। কলকাতায় আপনাকে বলা হয়নি, এইবার আমাদের পারিবারিক ইতিহাস খানিকটা বলি। আমার ঠাকুর্দা কুমার নরেন্দ্রনারায়ণ সরকার ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন, বহু মার্চেন্ট ফার্মের সঙ্গে তাঁর লেনদেন ছিল। নরেন্দ্রনারায়ণের দুই পুত্র। আমার বাবা নৃপেন্দ্রনারায়ণ আর কাকা নগেন্দ্রনারায়ণ। এনারা দুজনেই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন, বিজ্ঞানে দুজনেরই প্রগাঢ় আগ্রহ ছিল। দুজনেই ফাদার লাফঁর কাছে বহুকাল বিজ্ঞান শিক্ষা করেছিলেন।

     – কিন্তু শহর ছেড়ে এত দুরে এমন সংগ্রহশালা আর লাইব্রেরী খুলতে গেলেন কেন দুজনে?

     – উপায় ছিল না বলে। বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে দুভাই এমন মশগুল ছিলেন যে ঠাকুর্দার ব্যবসায়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। বহু চেষ্টা করেও দুজনকে ব্যবসায় ঢোকাতে না পেরে অবশেষে নরেন্দ্রনারায়ণ এই জমিদারীটা কিনে দুজনকে এর দায়িত্বে পাঠিয়ে দেন। তাঁর মনে হয়ত আশা ছিল যে কলকাতা থেকে দুরে থাকলে দুই ভাইয়ের ঘাড় থেকে বিজ্ঞানের ভূত নেমে যাবে।

     হেসে ফেলল ধূর্জটি,

     – সে আশা যে সফল হয়নি তা এই ঘরখানা দেখলেই বোঝা যায়।

     – তা হয়ত হয়নি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে পরিবারে কয়েকটি পরপর অঘটন ঘটল। প্রথমে ঠাকুর্দা দেহ রাখলেন। তারপর আমার ছোট ভাই উপেন্দ্রনারায়ণের জন্মের সময় মা মারা গেলেন। উপেন একটু বড় হতে বোঝা গেল সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নয়, তার বুদ্ধিবৃত্তি কিছুটা কম। এ সবের ধাক্কায় বাবা কেমন আনমনা হয়ে পড়লেন, সব ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি বিজ্ঞানচর্চায় মন দিলেন। কাকা কাকীমা নিঃসন্তান ছিলেন, তাঁরা উপেনকে নিজের মত করে মানুষ করতে লাগলেন। উপেনের দায়িত্ব পেয়ে কাকা আরো বিষয়ী হয়ে পড়লেন, বিজ্ঞান ভুলে জমিদারী নিয়ে পড়লেন।

     – আর আপনি?

     – আমি? আমি ছেলেবেলায় কিছুটা দুর্দান্ত প্রকৃতির ছিলাম, বইয়ের চাইতে বন্দুক বেশি প্রিয় ছিল। সুতরাং বয়স হতেই মিলিটারিতে নাম লেখালাম।

     ধূর্জটি ফের কি প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, তার আগেই সংগ্রহশালার অন্যদিক থেকে ভারী পায়ের আওয়াজ ভেসে এল। সঙ্গে একটা যান্ত্রিক ঘর্ঘর আওয়াজ।

     আওয়াজের উৎস বুঝতে দেরি হল না। হ্যাঁচকা টানে পায়ের পর পা ফেলে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে এক কলগোলাম। তার দুচোখের ঘোলাটে কাঁচের পেছনে বৈদ্যুতিক আলোর নীলাভ সাদা প্রভা, পেতলের শরীর থেকে ছিটকে যাচ্ছে জানলা দিয়ে আসা সূর্যের আলো, দুপাশে ছড়ানো হাতের ধাতব আঙুলগুলো সাঁড়াসির মতন বাঁকানো।

     মানবের তৈরি দানব।

     মৃদু হাসেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,

     – উপেন ভাব জমাতে এসেছে।

     কলগোলামের দিকে তাকায় ধূর্জটি।

     – এটা আপনি কি কোন বিশেষ কাজের জন্যে কিনেছিলেন?
না। জন্ম থেকেই উপেন খুব একটা স্বাভাবিক নয়। তার ওপর পিশাচের আক্রমণে কাকীমার মৃত্যু হওয়ার পর তার অবস্থার আরো অবনতি হয়, কথা বলাই বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কথা না বললেও লক্ষ করতাম ও বাবার যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে খুটখাট করে। ওর মন ভোলানোর জন্যেই কলগোলামটা কিনেছিলাম। এখন ওটা ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী।

     আমাদের কাছে এসে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে কলগোলাম, তার বুকের পোর্টহোলের পেছেন একটা হলদেটে আলো বার কয়েক জ্বলে নিভে ওঠে। তারপর একটা যান্ত্রিক শব্দ তুলে বুকের একটা চেরা ফোকর থেকে একফালি কাগজ বেরিয়ে আসে।

     কলগোলামের বুক থেকে কাগজটা ছিঁড়ে নিয়ে আমাদের দিকে বাড়িয়ে ধরেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – উপেনের দেওয়া নাম। ওর সঙ্গীকে কলগোলাম বলে ডাকাটা উপেনের মোটে পছন্দ নয়।

     কাগজটাতে চোখ রাখি। কালো কালিতে ইংরেজী অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘রঘু’।

     – উপেন! উপেন!

     ডাক পাড়েন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     খানিকটা দুরে একটা কাঁচের আলমারির পেছন থেকে একটা কিশোর মুখ উঁকি মারে। এক মাথা চুল। গভীর কালো দুটো চোখ।

     – উপেন। এনাদের সঙ্গ রঘুর আলাপ হয়ে গেছে, তুমি রঘুকে নিয়ে যেতে পার।

     সন্ত্রস্ত চাহনি নিয়ে আমাদের দিক ধীর পায়ে এগিয়ে আসে উপেন। তার বাঁহাতে ধরা এক তাড়া ক্ষুদে ক্ষুদে ছক কাটা কার্ড।

     আমার আর ধূর্জটির একবার ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে তাড়া থেকে একটা কার্ড টেনে বের করে উপেন। লক্ষ করি কার্ডের ছকে ইতস্ততঃ কিছু ফুটো করা করা রয়েছে। হাত উঁচু করে উপেন কার্ড ঢুকিয়ে দেয় কলগোলামের বুকের চেরা ফোকরটাতে।

     একটা শব্দ তুলে সচল হয় কলগোলাম, একটা হাত বাড়িয়ে হাত ধরে উপেনের। তার পর পেছন ফিরে উপেনের সঙ্গে হাঁটা দেয় লাইব্রেরীর অন্যদিকে।

     এক অপরিণত কিশোরের নিশ্চিন্ত মনে এক যন্ত্র দানবের হাত ধরে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকি বিস্ময়ে।

     – উপেনের হাতের কার্ডগুলো কি হলেরিথ কার্ড?

     খেয়াল করি সৌম্যেন্দ্রনারায়ণকে প্রশ্ন করছে ধূর্জটি।

     – হ্যাঁ কলগোলামকে ওই দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

     – কলগোলামকে কি উপেন ছাড়া আর কেউ কখনো হলেরিথ কার্ড ব্যবহার করে চালায়?

     – না ধূর্জটিবাবু। এবাড়ির লোকেজন কলগোলামের কাছে ভয়ে ঘেঁসতে চায়না, তাকে চালানো তো দুরের কথা। আমার ভয় নেই বটে, কিন্তু কলগোলাম চালানোর বিদ্যে আমার সাধ্যের বাইরে। এ বাড়িতে রঘুর উপেন ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় মালিক নেই।

     ঘরের বাইরে পা বাড়ায় ধূর্জটি, কপালে তার চিন্তার ভাঁজ।

     – বাড়ির ছাদটা একবার দেখতে চাই।

     – চলুন। চিত্ত ছাড়াও মিলিটারি থেকে আর একজনকে নিয়ে এসেছিলাম। তার সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে।
ছাদটা খালি, কোন জিনিষ নেই। কেবল পাঁচিলের ধারে পর পর বসানো গোটাকতক তোড়াদার জাজেল, তাদের বিশাল লম্বা নলগুলো বাইরের দিকে তাক করা।

     ঘাড় বেঁকিয়ে একটা জাজেলের মাছি বরাবর চোখ রাখে ধূর্জটি।

     – দুরপাল্লার বন্দুক।

     জাজেলের বাঁটে আলতো চাপড় মারেন সৌমেন্দ্রনানারায়ণ,

     – হ্যাঁ। পুরনো অস্ত্র বটে কিন্তু খুব কাজের।

     পাঁচিল দিয়ে নিচে ঝুঁকে দেখে ধূর্জটি।

     – আসার সময় নিচে একটা জাম্বুরকও চোখে পড়ল।

     – হ্যাঁ। পুরনো কায়দার হাত কামান, পাল্লাও বেশী নয়, কিন্তু ছর্‌রা ভরে দাগলে একসাথে দশ-বিশজনকে পেড়ে ফেলতে পারে।

     – এ সব ব্যবস্থা নিশ্চই আপনার করা?

     – হ্যাঁ। মেসোপটেমিয়া থেকে ফিরে এসে আমি এগুলো বসাই, বাড়ির পাঁচিলটাকে আরো উঁচু করে দিই। আর চিত্ত আর রামসহায়কে সঙ্গে করে নিয়ে এসে বাড়ি আর এস্টেটের পাহারার দায়িত্ব দিই।

     – চিত্তকে তো দেখেছি। রামসহায়?

     – আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।

     ছাদের এক কোনে একটা ছোট ঘর। তার দিকে মুখ করে ডাক দেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – রামসহায়! রামসহায়!

     ঘর থেকে ধীর পায়ে একজন গরুড় বেরিয়ে আসে। উচ্চতায় কমপক্ষে সাতফুট হবে, চওড়া কাঁধের থেকে বেরিয়ে আসা ডানা দুটো প্রায় মাটি ছুঁয়েছে। পরণে সাদা চাপকান আর পাজামা। হলুদ রঙের কোমরবন্ধের একপাশে তলোয়ার বাঁধা, অন্যদিকে একটা দুনলী হাওদা পিস্তল গোঁজা। পিস্তলের নলগুলোর দৈর্ঘ্য একহাতের কম হবে না। মাথার কাঁচা পাকা চুল আর ডানার পালকের ইতস্ততঃ কালো দাগে বয়সের ছাপ সুসপষ্ট।

     – জী হুজুর!

     ধূর্জটির দিকে তাকান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – রামসহায় আমার সঙ্গে ফৌজে ছিল। গরুড় পল্টনে। রামসহায়, এনারা কলকাতা থেকে এসেছেন।

     – সেলাম হুজুর।

     আমাদের দিকে ফিরে কুর্ণিশ করে রামসহায়।

     রামসহায়ের পেছনের ঘরটার দিকে তাকায় ধূর্জটি,

     – এই ঘরটাও বোধহয় আপনিই তুলিয়েছেন।

     – হ্যাঁ রামসহায় ঘরটাতে বসে। তাছাড়া ওখানে কয়েকটা বন্দুক আর কিছু গুলি বারুদও মজুত করা আছে।
ধূর্জটি আবার কি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ আমার নজরে পড়ল দুরে একটা টিলার মাথায় একটা প্রখর আলো থেকে থেকে ঝলসে উঠছে।

     বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না।

     – কি ওটা?

     আলোর দিকে তাকালেন সৌমেন্দ্রনানারায়ণ।

     – ও কিছু না। হেলিওগ্রাফ।

     ভ্রু কোঁচকাল ধূর্জটি।

     – হেলিওগ্রাফ! কোন মাপজোকের কাজ চলছে নাকি?

     – হ্যাঁ। সুকুমারবাবু বোধহয় কিছু জরিপের কাজ করছেন।

     – সুকুমারবাবু কে?

     আলোর ঝলকানির দিকে তাকান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – সুকুমার ঘোষাল। ভূবিজ্ঞানী। আমার বাবার বিজ্ঞানচর্চার সময়কার বন্ধু। দুজনের মধ্যে এমন প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল যে একবার ঠিকই করেছিলেন চাকরিবাকরি ছেড়ে দিয়ে এই জঙ্গলে এসে বাড়ি বানিয়ে থাকবেন। বাবা কোনমতে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরৎ পাঠান।

     – কোথায় চাকরি করতেন সুকুমার বাবু ?

     – উনি পশ্চিমে কোন একটা কলেজে পড়াতেন। সেখানেই টুকটাক কিছু গবেষণার কাজও বোধহয় করতেন। মাঝে মধ্যে সময় সুযোগ পেলে ছুটি নিয়ে আমাদের এখানে আসতেন। কিন্তু একবার হঠাৎ ওনার মাথায় কি ঝোঁক চাপল, বাবাকে এসে বললেন চাকরি ছেড়ে দিয়ে একেবারে পাকাপাকি ভাবে এখানে এসে থাকবেন।

          – এখানে মানে আপনাদের এই বাড়িতেই।

     – না না। যেখান আলো ঝলসাচ্ছে, সেই টিলাটার নাম পিংলা পাহাড়। ওই পাহাড়ের জমিটা বাবার কাছে কিনতে চেয়েছিলেন ওখানে বাড়ি বানিয়ে থাকবেন বলে। বাবা চাকরি ছাড়তে মানা করে অনেক করে বুঝিয়ে ফেরৎ পাঠান।

     – উনি দুলমিগড়ে ফের এলেন কবে?

     – বাবার মৃত্যুতে সুকুমারবাববু মনে খুব আঘাত পান। কলেজের প্রফেসারি ছেড়ে দিয়ে গোলকুণ্ডায় একটা চাকরি নিয়ে একরকম অজ্ঞাতবাসেই চলে যান। আমার সঙ্গে তেমন কোন যোগাযোগ ছিল না। কয়েকমাস হল জমিজঙ্গল জরীপ করার একটা সরকারী কাজ পেয়ে দুলমিগড়ে এসেছেন।

     – এই বাড়িতেই থাকেন?

     – না। উনি লোকজন নিয়ে জঙ্গলেই তাঁবু খাটিয়ে থাকেন। তবে বিকেলের দিকে নিয়মিত আসেন। চা খান, খবরের কাগজ পড়েন, আমার সঙ্গে দু-একটা পুরনো দিনের গল্প করেন, তারপর ফেরৎ চলে যান।

     – ওনার সঙ্গে একটু আলাপ করা যাবে?

     – অবশ্যই যাবে। আজ বিকেলে একসঙ্গে চা খেতে বসলেই হল। আপনার এখন ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন, দুপুরের খাবারটা আমি আপনাদের ঘরেই পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। বিকেলে সুকুমারবাবু এলে আপনাদের ডেকে নেব।

     দোতলার একটা ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। ঘরের জানলা গিয়ে চোখে আসে দিগন্ত জোড়া বনানী, প্রকৃতির গভীর নিঃশ্বাসের মতন বাতাস তার মধ্যে দিয়ে ছুটে যায় মর্মর ধ্বনিতে, সঙ্গে বয়ে আনে নানান পাখির কুজন লহরী।

     প্রকৃতির এই শ্যামল অঞ্চলছায়ে যে পরপর ঘটে গেছে নির্মম নৃশংস হত্যালীলা সেটা যেন বিশ্বাস করতে মন চায় না।

     – কি বুঝলে?

     জানলার বাইরের শোভা দেখতে দেখতেই প্রশ্ন করলাম ধূর্জটিকে।

     – বিশেষ কিছুই এখনো বুঝে উঠতে পারিনি, তবে এই কাহিনির কোন কিছুই যে সোজা নয় সেটুকু বোধহয় বুঝতে পারছি।

     – কেন?

     – ভেবে দেখ! এই কাহিনিতে চোরে এয়ারশিপ চেপে চুরি করতে আসে, জঙ্গলে হেলিওগ্রাফের আলো ঝলসায়, কলগোলামকে হাত ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় অপরিণত বালক, কামান বসানো দুর্ভেদ্য দুর্গের মত বাড়ি পাহা্রা দেয় গরুড়ে। কোন কিছুই তোমার সহজ মনে হচ্ছে যতীন?

     এর পর থেকে ধূর্জটির মুখ থেকে আর একটা কথা বের করাতে পারলাম না। সে চিৎ হয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে রইল, তার হাতের আঙুল সিগ্রেটের টিনের ওপর টক্‌টক্‌ শব্দ তুলে চলল।

     দুপুরের আহারের পর আরামকেদারায় বসে থাকতে থাকতে চোখটা কখন বুজে এসে বুঝতে পারিনি। ঘুম ভাঙল ধূর্জটির ডাকে।

     – আরে ওঠ ওঠ, রহস্য ভেদ করতে এসে এমন ঘুমোল চলে?

     ধড়ফড় করে উঠে পড়লাম,

     – কি হয়েছে?

     ধূর্জটির মুখে মৃদু হাসি,

     – কি আর হবে। চায়ের ডাক এসেছে, চলো।

     সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে এলাম। চকমিলান উঠোনের একপাশে বেতের টেবিল চেয়ার পাতা রয়েছে, টেবিলের ওপর চায়ের সরঞ্জাম। সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ একটা চেয়ারে বসে ছিলেন, আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন।

     – আসুন, আসুন। সুকুমারবাবু বোধহয় সেরেস্তা থেকে আজকের খবরের কাগজটা আনতে গেছেন, এখনি এসে পড়বেন। ওই তো।

     দেখলাম সেরেস্তা থেকে বেরিয়ে উঠোন পেরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন একজন প্রৌঢ় মানুষ। একরাশ কাঁচাপাকা চুল, আবক্ষ কাঁচাপাকা দাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের গোল চশমা, পরণে বুশ জ্যাকেট। শান্ত, সৌম্য চেহারা।

     – নমস্কার! আপনিই ধূর্জটিবাবু। সৌমেন বলছিল বটে আপনি আসবেন। বসুন বসুন।

     টেবিল ঘিরে বসি আমরা সবাই। টেবিলে একটা খবরের কাগজ আর একটা বই নামিয়ে রাখেন সুকুমার বাবু। বেয়ারা এসে পেয়ালায় চা ঢালে, কুকিজ্‌ ভরা প্লেট এগিয়ে দেয়।

     চায়ে চুমুক দেন সুকুমারবাবু,

     – কি বিপদ দেখুন দিকি! নৃপেনের মতন এমন অজাতশত্রু মানুষ আমি আজন্ম দুটি দেখিনি। অত বড় বাড়ির ছেলে অথচ কাউকে কোনদিন দুটো কড়া কথা বলতে শুনিনি। মুখে হাসিটি সর্বদা লেগে থাকত। তার ওপর এমন আক্রমণ কে করল, কেন করল আজও বুঝে উঠতে পারি নি। আর সৌমেন সেই পিতৃশোকের দুঃখ ভুলতে না ভুলতে আবার দু-দুটো খুন।

     নিজের চায়ের কাপে আলগোছে চামচ নাড়ে ধূর্জটি।

     – শুনলাম নৃপেন্দ্রনারায়ণ আর আপনি খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন?

     – সে আর বলতে। নৃপেন আমার ভাইয়ের মতন ছিল। একবার তো ঠিকই করেছিলাম কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এইখানে পাকাপাকি এসে থাকব। কেবল গবেষণায় মন দেব।

     – থাকলেন না কেন?

     হাসলেন সুকুমারবাবু

     – নৃপেন ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিল যে। বলল ‘শুধু গবেষণা করলেই হয় না। সঙ্গে মানুষকে শেখাতেও হয়। এই যে এতগুলো ছাত্রকে পড়াচ্ছ এতে বিজ্ঞানচর্চার প্রসার কি কম হচ্ছে? এটাও একটা দায়িত্ব।‘

     – আপনি মেনে নিলেন?

     ফের হাসলেন সুকুমারবাবু,

     – নৃপেনের কথা কি ফেলতে পারি? কথাটা ভুল তো কিছু বলেনি সে। তাছাড়া ঝোঁক নেমে গেলে ঠাণ্ডা মাথায় আর একটা কথা ভেবে দেখলাম। নৃপেনের জমিদারি আছে, তার চাকরির প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমি চাকরি ছেড়ে দিলে খাব কি? খালি পেটে তো আর গবেষণা হয় না!

     চায়ের কাপ তুলে নেয় ধূর্জটি।

     – আপনাদের মতন এমন বন্ধুত্ব এযুগে বিরল। আপনার আর নৃপেন্দ্রনারায়ণের গবেষণার বিষয়ও কি একইরকম ছিল।

     কৌতূকের ছোঁয়া লাগে সুকুমারবাবুর চোখে।

     – আমাদের সব বিষয়ে মিল থাকলেও এই একটা বিষয়ে বেজায় গরমিল ছিল ধূর্জটিবাবু। আমরা দুজনে একসঙ্গে ফাদার লাফঁর কাছে কাজ শিখলেও, ধীরে ধীরে আমাদের গবেষণার জগৎগুলো আলাদা হয়ে পড়ে। আমি আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম ভূবিজ্ঞানের দিকে, আর নৃপেন ভালবেসে ফেলল নক্ষত্রলোককে।

     – নক্ষত্রলোক? মানে নৃপেন্দ্রনারায়ণের ঝোঁক ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকে?

     – ঝোঁক ছিল বললে কম বলা হবে ধূর্জটিবাবু। এই পোড়া দেশে না জন্মালে নৃপেনের নাম জগতের বিখ্যাত নক্ষত্রবিদদের সঙ্গে ঠাঁই পেত। বহুরূপ নক্ষত্র আর যুগল নক্ষত্রের ওপর তার অনেক গবেষণা পত্র বিলেতের জার্নালে ছাপা হয়েছে। করিমুণ্ড রাশিতে আকিলা নবনক্ষত্র সেই প্রথম দূরবীনে প্রত্যক্ষ করে।

     মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। নৃপেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুতে কেবল সৌম্যেন্দ্রনানারায়ণের পিতৃবিয়োগই হয়নি, বঙ্গজননী হারিয়েছেন তাঁর একজন বৈজ্ঞানিক সুপুত্রকেও। এ ক্ষতি অপূরণীয়।

     একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধূর্জটি।

     – আপনাকে দু-একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি সুকুমারবাবু। কিছু মনে করবেন না।

     – না-না। বলুন।

     – এ বাড়িতে যখন পিশাচ পড়ে, তখন আপনি কোথায়?

     – এলাহাবাদে। হারকোর্ট বাটলার কলজে শিক্ষকতা করছি তখন।

     – নৃপেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর খবর পেলেন কি করে।

     – খবরের কাগজ থেকে। প্রথমটা বিশ্বাস করতে মন চায় নি। তারপর সৌমেনকে তার করললাম। সেও জানাল নৃপেন আর নেই।

     – খবরটা জানার পর কি করলেন?

     – দু-চারদিন কিছুই করি নি। করার ক্ষমতা ছিলা না। দুঃখে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর মনে হল নৃপেনই যখন নেই আর গবেষণা, পড়ানো এসব করে আর কি হবে। একা মানুষ, দায় দায়িত্ব নেই, চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন আপনমনে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। কিছুদিন বাদে মনের অবস্থা কিছুটা ঠিক হল। খবরের কাগজে গোলকুণ্ডার খনিতে ভূবৈজ্ঞানিকের পদের জন্যে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। সেই চাকরিটা জুটিয়ে গোলকুণ্ডা চলে গেলাম।

     বেয়ারার বাড়ানো প্লেট থেকে একটা কুকি তুলে নেয় ধূর্জটি,

     – এখানে বোধহয় আপনি মাসখানেক আগে এসেছেন।

     – হ্যাঁ। তবে ঠিক এই দুলমিগড় আসব বলে আসি নি। এই অঞ্চলটা জরিপ করার জন্যে সরকার থেকে লোক খোঁজা হচ্ছিল। গোলকুণ্ডার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এই কাজে ভিড়ে গেলাম। উত্তরদিক থেকে জরিপ করতে করতে মাসকয়েক আগে দুমলিগড় এসে পৌঁছেছি। তবে এখানকার মেয়াদও ফুরিয়ে এল, আর দিনকয়েকের মধ্যে লোকজন নিয়ে দক্ষিণে সরে যাব।
চুপ করে যান সুকুমারবাবু, কেমন অন্যমনস্ক ভাবে তুলে নেন খবরের কাগজটা। কেমন একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে টেবিলে।

     বোধহয় প্রসঙ্গ পাল্টাতেই হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে বেয়ারাকে নিম্নস্বরে কিছু বলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। অতিথি কামরার দিকে হাঁটা দেয় বেয়ারা।

     – পুরনো কথা যখন উঠল, তখন আর একজন লোকের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়েই দিই।

     – কে সৌমেন?

     খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে প্রশ্ন করেন সুকুমারবাবু।

     – গিরিজাপ্রসাদ। জেমস ট্রেডার। বাবা টেলিস্কোপের লেন্স বানানোর জন্যে মাঝে মধ্যে ওর থেকে হিমালিয়ান কোয়ার্টজ কিনতেন। সেই থেকে যাতায়াত।

     চশমার ফাঁক দিয়ে তাকান সুকুমারবাবু,

     – তোমাকেও কি টেলিস্কোপের নেশায় ধরেছে নাকি?

     হাসেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – আমার যে ওইসব বিষয়ে কোন আগ্রহ নেই তা আপনি ভালাই জানেন। না, গিরিজাপ্রসাদ আমার কাছে অন্য দু-একটা কাজে এসেছিল।

     উঠোন পার হয়ে বেয়ারা একজনকে নিয়ে আসে। স্থূল, বামনাকৃতি চেহারা, উচ্চতা চারফিটের ওপর হবে না। মাথায় রেশমের পাগড়ি, হাতে রূপোর বালা। পায়ে জরীর কাজ করা নাগরা জুতো। গলার রূপোর হাঁসুলিতে বেজীর প্রতিকৃতি। কুবেরী যক্ষ।

     – প্রণাম হুজুর।

     – বসো গিরিজাপ্রসাদ।

     খবরের কাগজটা নামিয়ে রাখেন সুকুমারবাবু।

     – বাড়ি কোথায় তোমার গিরিজাপ্রসাদ?
– কসৌল সে অউর থোড়া আগে হুজুর। দুটো পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে হয়। লেকিন বাড়ি ওই নামেই। বছরে বার-দুয়েক যাওয়া হয়। বাকি সময় তো সারা দেশ ঘুরে ঘুরে কেটে যায়।

     কসৌল! মনের মধ্যে নীলাকাশের পটভূমিতে আঁকা তুষার ধবল গিরিচূড়ার একটা ছবি ভেসে উঠল। উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারলাম না।

     – কসৌল! খুব সুন্দর জায়গা তো গিরিজাপ্রসাদজী! চোখ তুলেলই নীল আকাশ আর সাদা পাহাড় দেখা যায়।
মৃদু হাসে গিরিজাপ্রসাদ।

     – আরে বাবুজী, আসমান মে উতনা দেখনে লায়েক হ্যায় হি কেয়া! বড়ে হুজুর ভী আঁখো মে দূরবীন লাগাকে আসমানকে তারে ঢুণ্ডতে থে। উনসে ভী ম্যায়নে কহা থা, হুজুর, কভি আসমান ছোড়কে আপনে আসপাস কে জমীন কে নিচে ভি দেখিয়ে, কেয়া কেয়া নজারা দিখাই দেগা আপকো।

     সৌম্যেন্দ্রনারায়ণও হাসেন।

     – আমরা যদি যক্ষদের মতন খালি চোখেই মাটির তলাকার খবর জানতে পারতাম তাহলে আর তোমার আর পসার হত না গিরিজাপ্রসাদ!

     – ওহ্‌ ভী সচ্‌ হ্যায় হুজুর। ইন্সান আপনি নজরিয়া সে দুনিয়া কো দেখতে হ্যায়, অউর যক্ষ উনকি। ভগবান আশুতোষ এক এক জনকে এক এক রকম দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।

     টেবিল থেকে বইটা তুলে একবার পাতা উল্টে রেখে দেয় ধূর্জটি।

     – গিরিজাপ্রসাদজী কি অনেকদিন হল সফরে বেরিয়েছেন ?

     – হ্যাঁ বাবুজী। সুরাটে কিছুদিন থাকতে হয়েছিল। তারপর সেখান থেকে জুনাগড়, পুনা। এবার এখান থেকে কলকাতা হয়ে মাদ্রাজ চলে যাব।

     – এখানে কি কোন বিশেষ কাজে এসেছিলেন?

     – হাঁ। হুজুরাইন গয়না গড়াবেন, তাই তাঁর থেকে কয়েকটা জহরতের ফরমাস নেওয়ার ছিল।

     ধূর্জটির দেখাদেখি আমিও বইটা একবার হাতে নইয়ে দেখি। চামড়ায় বাঁধানো, বহু ব্যবহারে দীর্ণ। স্টাহ্‌লের ‘ফান্ডামেন্টা কিমিয়া’।

     উঠে দাঁড়ান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – ভাল কথা মনে করিয়েছ গিরিজাপ্রসাদ। চল, চিন্ময়ী হয়ত অপেক্ষা করছে। ধূর্জটিবাবু, কিছু মনে করবেন না, আমাকে উঠতে হল। আপনারা সুকুমারবাবুর সঙ্গে বসে গল্প চালিয়ে যান।

     দোতলার সিঁড়িতে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ আর গিরিজাপ্রসাদ উঠে যেতে সুকুমারবাবুও টেবিল থেকে তাঁর বইটা হাতে করে উঠে দাঁড়ান।

     – আজ আমিও উঠি। বেশ খানিকটা পথ যেতে হবে। কাল তো আছেন, ফের দেখা হবে। আজ আসি। নমস্কার।

     বাইরের দরজার বাইরে সুকুমারবাবুর চেহারাটা আড়াল হয়ে যাবার অনেক্ষণ পরেও ধূর্জটি নিজের জায়গায় বসে রইল চিন্তামগ্ন মুখে। শেষে আমায় তাগাদা দিতে হল।

     – কি হল। সারারাত এখানে বসে থাকবে নাকি?      

     – চলো!

     সুকুমারবাবুর ফেলে যাওয়া খবরের কাগজটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে দোতলার পথ ধরে ধূর্জটি।


     সেদিন রাতটুকু ধূর্জটিকে বিরক্ত করি নি, কিন্তু সকালেই প্রাতরাশের পরেই চেপে ধরলাম।

     – কিছু বুঝতে পারছ?

     গম্ভীর মুখে একটা সিগারেট ধরায় ধূর্জটি।

     – দেখ ষড়যন্ত্রের জাল যে অনেকদিন ধরে বেছানো হয়েছে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। পিশাচ পড়া, ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের দোকানে চুরি, পীতাম্বর আর বলাইয়ের খুন, এ সবই এক সুতোয় বাঁধা। কিন্ত এ সবের উদ্দেশ্য কি, কোন লক্ষ্যে নেপথ্যের হোতা একের পর এক এইসব অপরাধ করে চলেছে তা এখনো বুঝে উঠতে পারি নি।

     – খানিকটা তো বোঝাই যাচ্ছে। নিতাই আর বলাই দুজনে মিলে এয়ারশিপে চেপে ইন্ডো ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে চুরি করে সিন্দুকের টাকা আর একটা বড়মানুষ খদ্দেরদের একটা লিস্ট চুরি করে। কিন্তু ফেরার সময় এয়ারশিপ ভেঙে পড়ে নিতাই মারা পড়ে, বলাইও ভয় পেয়ে পালায়। কিন্তু লিস্টটা তার কাছে থেকে গিয়েছিল, সেইটা থেকে দুলমিগড় এস্টেটের নাম পেয়ে এখানে চুরি করতে আসে।

     সিগ্রেটের টিনে টকটক আওয়াজ তোলে ধূর্জটির আঙ্গুল। তামাকের নীলচে ধোঁয়া পাকে খেয়ে উড়ে যায় জানলা দিয়ে।

     – হতে পারে। অসম্ভব নয়। কিন্তু তাহলেও অনেকগুলো প্রশ্ন থেকে যায়। পীতাম্বর গোমেজ খুন হল কেন? বলাইকেই বা কে মারল?

     – হয়ত পীতাম্বরও চুরির সঙ্গে জড়িতে ছিল, ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে কোনরকম অশান্তির জেরে বলাইয়ের দলের লোকজন তাকে আর বলাইকে, দুজনকেই খুন করে।

     – উঁহুঁ! তোমার যুক্তিতে গলদ আছে। পীতাম্বরের সঙ্গে যদি বলাই কি নিতাইয়ের যোগসাজস থাকত, তাহলে অত পরিশ্রম করে তাদের তালা ভাঙতে হত না, পীতাম্বরই তাদের ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিত। তাছাড়া পীতাম্বরের দুলমিগড় আসাটাও কাকতালীয়। কলগোলাম না বিগড়োলে পীতাম্বরের ডাক পড়ত না। আর মেরামত করতে ইন্ডো ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্স থেকে অন্য কোন মিস্ত্রীকেও পাঠাতে পারত। পীতাম্বররই যে আসবে যে আসবে তার কি নিশ্চয়তা ছিল? আমার মনে হয়, বলাইয়ের সঙ্গে যোগসাজস নয়, পীতাম্বরের নজরে এমন কিছু পড়েছিল, বা সে এমন কিছু জেনে ফেলেছিল যে তাকে সরিয়ে দেওয়াটা জরুরী হয়ে পড়েছিল।

     – কিন্তু কি দেখে ফেলেছিল পীতাম্বর?

     – সেটাই তো রহস্য।

     – আর বলাইকেই বা খুন করল কে?

     – খুব সম্ভব এই নাটকের নেপথ্যের গোপন নায়কটি। কিন্তু সে যে কে এখনো সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।

     একটা ছোট রঙিন পাখি জানলায় এসে বসে সুরেলা আওয়াজ তুলে ফের উড়ে যায়। তার পাখনার হাওয়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় তামাকের ধোঁয়া। সিগারেটের শেষ অংশটুকু ছাইদানে গুঁজে দেয় ধূর্জটি।

     – চলো। একটু বেরনো যাক। পীতাম্বর আর বলাই যেখানে খুন হয়েছিল সে জায়গা দুটো একবার দেখে আসি। যদি মাথার জট কিছুটা খোলে।

     সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ আমাদের একা ছাড়তে রাজী হলেন না।

     – পীতাম্বরের বেলায় যে ভুল করেছি সে ভুল আমি আর দ্বিতীয়বার করছি না। চিত্ত আপনাদের সঙ্গে যাবে। তাছাড়া চিত্ত জায়গাটা চিনিয়ে দিলে আপনাদের সুবিধে হবে।

     মোটরে উঠতে যাচ্ছি, পেছন থেকে একটা পরিচিত গলার আওয়াজ পেলাম।

     – নমস্কার বাবু!

     মাথ ঘুরিয়ে দেখে আশ্চর্য হলাম। স্টেশনের দোকানী গোপাল সমাদ্দার। মলিন পোষাক, হাতে একটা চামড়ার সুটকেস।

     – তুমি? এখানে? কোন কাজে নাকি?

     – আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু। আমি এই সেরেস্তায় কাগজ কালি যোগান দিই, সেই কাজেই এসেছিলাম। আপনারা কি বেরোচ্ছেন কোথাও?

     – হ্যাঁ আমরা –

     – একটু বেড়াতে বেরোচ্ছি।

     আমাকে মাঝপথেই থাইমিয়ে দেয় ধুর্জটি।

     – ঘুরে আসুন বাবু। জঙ্গলে খুব সুন্দর পাখি আছে।

     মোটর ছেড়ে দেয়। ঝুঁকে প্রণাম করে গোপাল।

     – আগে কোথায় যাবেন স্যার?

     গাড়ি চালাতে চালাতেই প্রশ্ন করে চিত্ত।

     একটু চিন্তা করে নেয় ধূর্জটি।

     – পীতাম্বর যেখানে খুন হয়েছিল সেখান চলো আগে।

     – ওটা স্টেশনের দিকে।

     – চলো।

     স্টেশনের দিকের রাস্তায় মোটর ছোটে।

     কিছুদুর যাবার পর এক জায়গায় মোটর দাঁড় করায় চিত্ত।

     – স্যার এইখান থেকে খানিকিটা ভেতরে পীতাম্বরের দেহ পাওয়া গিয়েছিল।

     – দেখে আসি, চলো

     ঝোপঝাড় ঠেলে জঙ্গলের খানিকটা ভেতরে নিয়ে যায় চিত্ত।

     – এই যে স্যার, এইখানটা। এই গাছটার নিচে পড়ে ছিল পীতাম্বর।

     চারপাশটা একবার চোখ বুলোয় ধূর্জটি। এখানে ঝোপঝাড় কিছুটা পাতলা। গোটা তিনেক বড় গাছ হাত কয়েক ফাঁক রেখে দাঁড়িয়ে আছে। নাকে আসে কোন বুনো ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ।

     – পুলিশ জায়গাটার তল্লাসী নিয়েছিল?

     – হ্যাঁ স্যার, পুলিশ শুধু নয়, আমাদের লোকজনও চারিদিকে খোঁজাখুঁজি করেছিল, কোন কিছু পায় নি।

     – তুমি পীতাম্বরের দেহটা দেখেছিলে?

     – হ্যাঁ স্যার। ঠিক আগের খুনটার মতনই। সারা শরীরে কোন চোট নেই, কেবল মাথাটা থ্যাঁতলানো।

     – হুঁ।

     গম্ভীর হয়ে যায় ধূর্জটি।

     – চলো। বলাই যেখানটা খুন হয়েছিল সে জায়গাটা একবার দেখে আসি।

     মোটর ছুটিয়ে বেশ খানিকটা দুর যাবার পর, বাঁধানো বড় রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মেঠো পথ ধরে চিত্ত। সে পথও কিছুটা যাবার পর একটা ঢিবির কাছে এসে ফুরিয়ে যায়।

     মোটরের ইঞ্জিন বন্ধ করে চিত্ত।

     – বাকি পথটুকু হেঁটেই যেতে হবে স্যার।

     – চলো।

     মোটর থেকে নামে ধূর্জটি।

     পায়ে হেঁটে ঢিবিটা পেরোই। এখানে বড় গাছের সংখ্যা কম। উঁচু ঝোপগুলো প্রায় একমানুষ সমান উঁচু হয়ে উঠে আছে, তাতে কোথাও থোকা থোকা সাদা হলুদ ফুল ফুটেছে। আমাদের শরীরের ধাক্কায় ফুলগুলো টুপটাপ করে ঝরে পড়ে, দু-একটা পাখি তীক্ষ্ণ শিষে আপত্তি জানিয়ে ডানার ঝটপট শব্দে উড়ে যায় ঝোপ ছেড়ে।
ঝোপগুলোর ফাঁকে অল্প একটু ফাঁকা জায়গা। সেখানে এসে দাঁড়ায় চিত্ত।

     – স্যার, লাসটা এখানেই পাওয়া গেছিল।

     চারদিকে একেবার তাকায় ধূর্জটি।

     – হুঁ। যে এখানে খুন করে লাসটা ফেলে গিয়েছিল, সে এই জঙ্গলের খুঁটিনাটি সসন্ধে ওয়াকিবহাল। লাস এখানে পড়ে থাকলে বাইরে থেকে টের পাওয়ার উপায় নেই।

     – হ্যাঁ স্যার। গ্রামের একটা লোক গরু খুঁজতে এসে দৈবাৎ লাসটা দেখতে না পেলে, কয়েকদিন বাদে আর চিহ্ন পাওয়া যেত না, শেয়াল কুকুরে কোথায় টেনে নিয়ে যেত।

     – মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল জানো?

     – পীতাম্বরের মতনই স্যার। মাথারে একপাশটা ভারী কিছু দিয়ে থ্যাঁতলানো।

     – এখানেও বোধহয় লাসের লাসে আশেপাশে কিছু খুঁজে পাওয়া যায় নি।

     – না স্যার! আমরা তো কিছু দেখতে পাই নি। তাছাড়া –

     খানিকটা ইতস্ততঃ করে চিত্ত।

     ভ্রু কোঁচকায় ধূর্জটি,

     – তাছাড়া কি চিত্ত?

     – স্যার পীতাম্বরের দেহে আশেপাশে কিছু না পেলেও তার পকেটে ব্যক্তিগত দু-একটা জিনিষ ছিল। কিন্তু বলাইয়ের লাসের পকেটে কিচ্ছু পাওয়া যায় নি।

     – হুঁ। মানে সব রকম তথ্য প্রমাণ খুনি লোপাট –

     – স্‌স্‌স্‌ –

     হঠাৎ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করে চিত্ত। লক্ষ করি সেখানে একমানুষ উঁচু ঝোপটা অল্প অল্প নড়ছে।

     বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডটা লাফিয়ে ওঠে। কেউ কি লুকিয়ে রয়েছে ঝোপের ভেতরে? কি তার উদ্দেশ্য? আড়ি পেতে আমাদের কথা শোনা? নাকি আমাদের আক্রমণ করা?

     খাপ থেকে পিস্তল বের করে উঁচিয়ে ধরে চিত্ত। নিম্নস্বরে বলে,

     – আমার পেছনে চলে আসুন।

     জড়সড় হয়ে দুজনে চিত্তর শরীরের আড়ালে এসে দাঁড়াই।

     বন্ধ হয়ে যায় ঝোপের পেছনের নড়াচড়া। লুকিয়ে থাকা ব্যক্তি কি বুঝতে পেরেছে আমরা তার উপস্থিতি টের পেয়েছি?

     পিস্তল ধরা ডানহাত সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরে চিত্ত।

     – কে আছ বেরিয়ে এসো। নইলে কিন্তু গুলি চালাব।

     কোন সাড়াশব্দ নেই।

     মাটি থেকে কয়েকটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ঝোপের মধ্যে ছুঁড়তে থাকে চিত্ত। একবার। দুবার। তিনবার। একটা জান্তব আওয়াজ ভেসে আসে খোপের ভেতর থেকে, জোরে জোরে দুলে ওঠে ঝোপটা। আর আচমকাই ক্রুদ্ধ গর্জন করে শিঙ বাগিয়ে ঝোপঝাড় ভেঙে আমাদের দিকে ছুটে আসে একটা বুনো মোষ।

     – পালান!

     সেই ধেয়ে আসা কৃষ্ণকালো পেশীর পাহাড়ের সামনে থেকে লাফ দিয়ে সরে যেতে যেতে চেঁচিয়ে ওঠে চিত্ত।
মূহুর্তমাত্র মাত্র দেরি না করে ঝোপের মধ্যে দিয়ে দৌড় লাগাই। হাতে-পায়ে কাঁটার খোঁচা লাগে, শরীরের ওপর বেতের মতন আছড়ে পড়ে গাছের ডাল, তবুও প্রাণের ভয়ে দৌড়তে থাকি না থেমে।

     দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে খানিকটা দৌড়োনোর পর বুঝতে পারি আমার পেছনে কোন পশু তাড়া করে আসছে না, গাছের পাতার শব্দ আর দু-একটা পাখির ডাক ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। একটা উঁচু গাছের নিচে হাঁটুতে দুহাত রেখে নীচু হয়ে হাঁপাতে থাকি।

     – স্যার! স্যার!

     কোথাও দূর থেকে চিত্তর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।

     হাঁপাতে হাঁপাতেই উত্তর দিই।

     – এই যে, এখানে!

     ঝোপ ঠেলে উদয় হয় চিত্তর

     -যাক! আপনার কিছু হয়নি!

     সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শ্বাস নিই,

     – ধূর্জটি? ধূর্জটি কোথায়?

     চিত্ত ধূর্জটিকে দেখেনি। মোষের তাড়া থেয়ে পালিয়ে আসার পর আমাকেই প্রথম খুঁজে পেয়েছে সে।

     গলা তুলে চিৎকার করতে থাকি,

     – ধূর্জটি! ধূর্জটি!

     বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর একটা ক্ষীণ আওয়াজ আসে,

     – এখানে!

     আওয়াজ লক্ষ করে ঝোপঝাড় ঠেলে এগোই আমি আর চিত্ত।

     একটু বাদে নজরে পড়ে একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আছে ধূর্জটির জুতো পরা পা দুখানা।

     উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে যাই। ধূর্জটির চোট লাগেনি তো?

     দেখি মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে ধূর্জটি। গায়ে মাথায় লেগে রয়েছে ছেঁড়া পাতা, গালের দু-একটা জায়গায় ছড়ে গেছে, কিন্তু মুখে একটা অদ্ভূত হাসি।

     হাত ধরে টেনে তুলি।

     – কি, লেগেছে কোথাও?

     মাথা নাড়ে ধূর্জটি,

     – না লাগেনি তেমন। পা পিছলে ঝোপের মধ্যে বসে পড়েছিলাম কেবল।

     একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলি,

     – একটা অভিজ্ঞতা হল, যা হোক।

     – যা বলেছ। চলো যাওয়া যাক।

     মুখের সেই অদ্ভূত হাসিটা নিয়েই মোটরে চড়ে বসে ধূর্জটি।

     হাসির রহস্যটা বুঝতে পারি আমাদের ঘরে ফিরে। ঘরের দরজটা বন্ধ করে কামিজের পকেট থেকে দুটো দলা পাকানো কাগজের টুকরো টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখে।

     -মোষের তাড়া খাওয়াটা শাপে বর হয়েছে। না হলে এটা পেতাম না।

     – কি এটা।

     – খবরের কাগজের কাটিং। খুব সম্ভব বলাইয়ের পকেটে ছিল। খুনি প্রমাণ লোপাট করার জন্যে বোধহয় দূরে ছুঁড়ে ফেলেছিল। একটা ঝোপের পাতার ফাঁকে আটকে পড়েছিল। পালাতে গিয়ে ঝোপের ভেতরে আছড়ে না পড়লে এটা চোখে পড়ত না।

     একটা কাগজ তুলে নিয়ে চোখ বোলাই। মাস ছয়েক আগেকার খবর। হায়দ্রাবাদে নিজামের খাস অ্যালকেমিস্টের কিমিয়াখানায় চুরির বিবরণ। কি চুরি গেছে তার কথা বিশদে না থাকলেও, নিজামত থেকে চোর ধরার জন্যে নগদ পুরষ্কার ঘোষণার কথা রয়েছে।

     কাগজটা নামিয়ে রাখি।

     – ইন্ডো ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের চুরিতে ক্যালরিক ব্যবহারের রহস্যটা এবার বোঝা গেল তাহলে। খুব সম্ভব বলাইয়েরই কাজ।

     – হুঁ! ঠিক ধরেছ। তবে –

     ধূর্জটির মুখে আবার সেই রহস্যময় হাসিটা ফুটে ওঠে।

     – তবে অন্য কাগজটাও দেখ একবার।

     দ্বিতীয় কাগজটা তুলে নিই।

     এবং চোখ বুলিয়ে খানিকটা আশ্চর্য হই।

     – এতো দেখছি ইন্ডো ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের চুরির খবর। এয়ারশিপ ভেঙে পড়া, নিতাইয়ের মৃত্যু, চুরির টাকা উদ্ধার, সব খবরই রয়েছে দেখছি।

     – কিন্তু যতীন, প্রশ্ন হল এই খবরটা বলাই পকেটে করে বয়ে বেড়াচ্ছিল কেন?

     – দুটো খবরই একই কারণে পকেটে রেখেছিল। খুব সম্ভব বলাই নিজের চুরি ডাকাতির খতিয়ান রাখতে পছন্দ করে। একরকম আত্মম্ভরিতা বলতে পারো।

     মুখের হাসিটা আরো দুর্জ্ঞেয় হয়ে ওঠে ধূর্জটির।

     – তা হতে পারে। আবার নাও হতে পারে।

     – কিচ্ছু বুঝলাম না।

     একটা সিগ্রেট ধরিয়ে চিৎ হয়ে শোয় ধূর্জটি।

     – পুরোটা কি আমিই বুঝেছি যতীন! শুধু এটুকু বুঝতে পারছি যে এই সরকারবাড়ি ঘিরে বহু যত্নে যে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতা হয়েছে, বলাই তারই বলি হয়েছে। এই নাটকে বলাই মূল কুশীলবদের কেউ নয়, পার্শ্বচরিত্র মাত্র। নিজের মাত্রা না বুঝে পা ফেলতে গিয়েই খুব সম্ভব তার প্রাণহানি হয়েছে।

     সিগ্রেটের টিনে টকটক আওয়াজ তোলে ধূর্জটির আঙুল

     – এর বেশী আর কিছু আমার কাছে এই মুহূর্তে পরিষ্কার নয়। আপাততঃ আমাকে মস্তিষ্কের গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে চিন্তার জট ছাড়াতে হবে। সুতরাং বৎস, তিষ্ঠ ক্ষণকাল এবং আমাকে ভাবতে দাও।

     কিন্তু বেশীক্ষণ ভাবার অবকাশ পেল না ধূর্জটি। দুপুরের আহারাদি খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে সেরে নিয়ে সে আবার সিগ্রেটের টিন হাতে শোওয়ার তোড়জোড় করছে, দরজায় কে টোকা দিল।

     দরজা খুলে দেখলাম একজন ভৃত্যগোছের লোক।

     – বাবু, হুজুর আপনাদের নিচে ডাকছেন।

     নিচের উঠোনে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়েছিলেন সৌমেন্দ্রনানারায়ণ।

     – আপনাদের বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্যে দুঃখিত ধূর্জটিবাবু। কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে।

     – কি হয়েছে?

     – গিরিজাপ্রসাদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!

     – সে কি?

     – হ্যাঁ। দুপুরের আহারের পর একটা কাজের জন্যে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। আমার লোক ডাকতে গিয়ে দেখে ঘরে নেই। একে তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম দুপুরে নাকি সে খেতেও আসে নি। সকালবেলা তাকে একবার বাড়ির কম্পাউন্ডে ফোয়ারার কাছে দেখা গিয়েছিল, তারপর থেকে তাকে আর কেউ দেখে নি।

     একট ইতস্ততঃ করে ধূর্জটি,

     – কিছু মনে করবেন না কুমারবাহাদুর। গিরিজাপ্রসাদ ব্যবসায়ী মানুষ। হয়তো আপনার সঙ্গে লেনদেনের কোন শর্ত তার পছন্দ হয়নি। আপনাকে সরাসরি না বলতে সংকোচ হচ্ছিল বলে সে চুপিসাড়ে আপনার অজান্তে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।

     গম্ভীর হয়ে যান সৌমেন্দ্রনানারায়ণ।

     – প্রথমটা আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু না ধূর্জটিবাবু, গিরিজাপ্রসাদ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়নি। খুব সম্ভব সে কোন বিপদে পড়েছে। নিজের চোখেই দেখবেন আসুন।

     লম্বা পায়ে উঠোন পার হয়ে একটা অতিথি কামরার দিকে এগিয়ে যান সৌমেন্দ্রনানারায়ণ। ঠেলে খুলে ধরেন ঘরের দরজা।
     – গিরিজাপ্রসাদকে খুঁজে না পেয়ে আমি ওর ঘরখানা দেখতে এসেছিলাম। দেখলাম ওর সমস্ত জিনিসপত্রই পড়ে রয়েছে। দেখুন।

     নিরাভরণ ঘর। একপাশে একটা তক্তপোষ পাতা, তার মাথার কাছে একটা টুলের ওপর গেলাসে ঢাকা দেওয়া জলের কুঁজো। অন্যদিকে মেঝের ওপর জড়ো করে রাখা কয়েকটা ট্রাঙ্ক আর একটা বেডিং।

     ঘরের ভেতরে দুপা এগিয়ে গিয়ে অঙ্গুলিনির্দেশ করেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     – অন্য জিনিষ তবুও না নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই বাক্সটাতে গিরিজাপ্রসাদের সমস্ত দামী জহরৎ থাকে। এটা না নিয়ে সে যায় কোথায়?

     দেখলাম একটা ট্রাঙ্কের পাশে মাটিতে বসানো রয়েছে একটা অদ্ভূত চেহারার ছোট বাক্স। গায়ে পেতলের বেড়, ডালায় সিংহের মুখের আকারের তালা, দুপাশে পেতলের হাতল।

     ভাল করে দেখব বলে বাক্সটা তুলতে গেলাম, কিন্তু পারলাম না। বাক্সটা দৈর্ঘ্য প্রস্থে হাতখানেকের বেশি হবে না, কিন্তু অসম্ভব ভারী। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও সেটাকে বিন্দুমাত্র নড়াতে পারলাম না।
পেছন থেকে আপত্তি জানায় ধূর্জটি।

     – উঁহু! ছেড়ে দাও যতীন। যক্ষরা তাদের দৌলতপেটি গরিমা সিদ্ধাই দিয়ে অসম্ভব ভারী করে রাখে। সঠিক মন্ত্রপাঠ না করলে ওটাকে নড়ানো সম্ভব নয়।

     সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের দিকে ফেরে ধূর্জটি।

     – আপনি ঠিকই বলেছেন কুমারবাহাদুর। গিরিজাপ্রসাদ একেবারে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে তার জিনিসপত্র এভাবে ফেলে যেত না।

     – আর এটাও দেখুন ধূর্জটি বাবু।

     ঘরের একটা কোনের দিকে নির্দেশ করেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

     মেঝেতে তক্তপোষের একটা পায়ার কাছে খানিকটা ছাই পড়ে রয়েছে।

     ঝুঁকে পড়ে আতসকাঁচ দিয়ে ছাইটা পরীক্ষা করে ধূর্জটি।

     – কাগজ। খানিকটা কাগজ পোড়ান হয়েছে।

     – কিন্তু কেন?

     বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন সৌমেন্দ্রনানারায়ণ।

     উত্তর না দিয়ে ঝুঁকে পড়ে তক্তপোষের তলাটা একবার দেখে ধূর্জটি, তারপর হাত বাড়িয়ে কি একটা বের করে আনে।

     – খুব সম্ভব কেউ চিঠি লিখে গিরিজাপ্রসাদকে ডেকে পাঠায়। চিঠিতে গোপনীয় এমন কিছু ছিল, যার জন্যে গিরিজাপ্রসাদ চিঠিটা নিজেই পুড়িয়ে ফেলে।

     তক্তপোষের তলা থেকে বের করে আনা জিনিষটা আতসকাঁচ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ধূর্জটি, তারপর বাড়িয়ে ধরে আমার দিকে।

     একটা আধপোড়া কাগজের টুকরো। তার চারপাশ পুড়ে গেছে, বাকি অংশটুকুতে কেবল অতিকষ্টে ‘গম’ শব্দটুকু পড়া যায়।

     – ‘গম’!

     এবার আমার বিস্মিত হবার পালা।

     মুখে বিরক্তির আওয়াজ তোলে ধূর্জটি।

     – ওটা অন্য কোন শব্দের অংশ।

     – কি শব্দ? দুর্গম? সুগম?

     বাইরে কোথাও থেকে কয়েকটা উচ্চকণ্ঠ কানে আসে। উত্তেজিত স্বরে কারা যেন কিছু আলোচনা করছে।
মাথা ঝাঁকায় ধূর্জটি।

     – শব্দটা কি সেটা পরে ভাবলেও চলবে। এই মুহূর্তে আমাদের কাজ গিরিজাপ্রসাদকে খুঁজে বের করা। কুমারবাহাদুর, আপনি কি লোক লাগিয়েছেন গিরিজাপ্রসাদকে খুঁজতে?

     – অবশ্যই, গিরিজাপ্রসাদকে পাওয়া যাচ্ছে না জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে তিলমাত্র দেরি না করে চারপাশে লোক পাঠিয়ে দিয়েছি।

     ভারী জুতো পায়ে ছুটে আসার একটা শব্দ কানে আসে। উঠোন দিয়ে কেউ দৌড়ে আসছে।

     একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ধূর্জটি।

     – গিরিজাপ্রসাদকে সুস্থ শরীরে পাওয়া গেলেই ভাল। কিন্তু যে ভাবে তাকে চিঠি লিখে গোপনে ডেকে পাঠানো হয়েছে, সে কোন ঘোর বিপদে না পড়ে থাকে।

     জুতোর শব্দ আরো কাছে আসে। দরজার দুদিকে দুহাত রেখে ঘরের মধ্যে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে চিত্ত।

     – স্যার! গিরিজাপ্রসাদ খুন হয়েছে।

     অকুস্থল বেশী দুরে নয়। সরকার বাড়ির ফটক থেকে হয়ে মাইলখানেক হবে। জঙ্গলের মধ্যে একটা গাছের তলায় ঠেস দিয়ে বসে গিরিজাপ্রসাদের দেহ। চোখ দুটো খোলা, মুখে একটা অদ্ভুত বিস্ময়ের ছাপ। নাগরা জুতো পরা পা দুটো সামনের দিকে ছড়ানো, গলার রূপোর হাঁসুলি ডুবে গেছে গাড় কালচে রক্তে। মাথার একপাশ তোবড়ানো। ডিমের খোলায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করলে যেমন তুবড়ে ভেতরে ঢুকে যায়, গিরিজাপ্রসাদের মাথার ডানদিকটাও তেমনি কোন ভয়ঙ্কর আঘাতে ভেঙে ভেতর দিকে ঢুকে গেছে।

     – মাথায় কি পাথর দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল?

     প্রশ্ন করি বিস্মিত কন্ঠে।

     গিরিজাপ্রসাদের মাথার ক্ষতটা পরীক্ষা করে ধূর্জটি।

     – হতে পারে। কিন্তু যে শক্তিতে আঘাত করা হয়েছে, তাতে হয় পাথরটা প্রকাণ্ড ভারী অথবা আঘাতকারীর শরীরে অসুরের মতন বল আছে।

     গিরিজাপ্রসাদের দেহটা পরীক্ষা করতে থাকে ধূর্জটি। কয়েক পা এগিয়ে আতস কাঁচে চোখ রেখে পরীক্ষা করে গাছের গুঁড়িটা।

     – পুলিসে খবর দেওয়া হয়েছে?

     মাথার ওপরে কর্কশ আওয়াজ করে চক্কর কাটে কয়েকটা কাক। সে দিকে একবার তাকান সৌমেন্দ্রনানারায়ণ।

     – হ্যাঁ কোতয়ালীতে লোক পাঠিয়েছি।

     দূরে কোথাও গর্জন করে একটা মোটর এসে থামে। তারপর জঙ্গল ঠেলে কয়েকজন কন্সটেবল সঙ্গে করে এগিয়ে আসেন একজন পুলিস ইন্সপেক্টর।

     ইন্সপেক্টরের নাম শিউলাল দ্বিবেদী। মৃতদেহটা একবার পরীক্ষা করে ধূর্জটির সঙ্গে করমর্দন করেন।

     – লালবাজার থেকে আপনার আসার কথা আমাকে তার করে জানানো হয়েছিল। কিন্তু নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আপনি না ডাকলে না যেতে।

     গিরিজাপ্রসাদের প্রাণহীন দেহের দিকে একবার তাকায় ধূর্জটি।

     – হ্যাঁ, আপনাকে এবার বোধহয় দু-একটা কাজের জন্য প্রয়োজন হতে পারে। যদি কালকে একবার সময় করে আসতে পারেন তো ভালো হয়।

     – অবশ্যই যাব। এমনিতেও আমাকে নিয়মমাফিক কয়েকটা জবানবন্দী নিতে হবে।

     গিরিজাপ্রসাদের দেহ তুলে নিয়ে যায় কন্সটেবলরা। কসৌলের কুবেরী যক্ষের শেষ চিহ্ন হয়ে পড়ে থাকে কেবল ঘাসে লেগে থাকা রক্তের দাগটুকু।

     বিমর্ষ মনে ফিরে আসি। দূরদেশের বণিক গিরিজাপ্রসাদকে কেন অনর্থক প্রাণ হারাতে হল কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না।

     বেলা পড়ে এসছে। দিনের শেষ সোনালী রোদটুকু আঁচলের মত ছড়িয়ে রয়েছে বাড়ির উঠোনে। রোদে শরীর রেখে মাথার ওপরের আকাশটা একবার তাকিয়ে দেখে ধূর্জটি।

     – যতীন, গিরিজাপ্রসাদ প্রাণ দিয়ে আমার কাজটা খানিকটা সহজ করে দিয়ে গেল। এই ষড়যন্ত্রের জালের কেন্দ্রবিন্দুতে যে ঊর্ণনাভটি বসে আছেন, তিনি যে কে, সেটা বোধহয় বুঝতে পেরেছি।

     – কে ধূর্জটি?

     আকাশের দিকে মাথা তুলে লম্বা শ্বাস নেয় ধূর্জটি।

     – না যতীন! সে কে এখনই তা প্রকাশ করতে পারব না। সন্দেহ যত দৃঢ় হোক, প্রমাণ না থাকলে গোপন

     আততায়ীটির টিকিও ছুঁতে পারবো না।

     ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি পেছন থেকে ডাক পড়ল।

     – বাবু।

     দুপুরবেলায় যে কাজের লোকটি ডাকতে এসেছিল সে।

     -বাবু, হুজুর হুকুম করেছেন এখন থেকে তাঁকে না জানিয়ে কেউ যেন বাড়ির বাইরে পা না দেয়। আপনাদের

     কোথাও যাওয়ার থাকলে আপনারা হুজুরকে জানাবেন।

     খবর দিয়ে লোকটি চলে যাচ্ছিল, ধূর্জটি তাকে পেছন থেকে ডাকল।

     – শোনো!

     – বলুন বাবু।

     – তোমাদের উপেন দাদাবাবু কোথায়।

     – আজ্ঞে তিনি আর কোথায় থাকবেন। সকাল থেকে লাইব্রেরী ঘরেই আছেন।

     – আর তার কলগোলামটা? রঘু?

     – ওই পেতলের দানোটা? ও ওই উপেন দাদাবাবুর সঙ্গেই আছে। দাদাবাবু তো ওটাক এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করে না।

     – আচ্ছা! তাহলে সারাদিনই দুজনেই লাইব্রেরীতে ছিল!

     কেমন আশ্বস্ত মনে হল ধূর্জটিকে।

     – আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু!

     দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে অভ্যেস মতন বিছানায় চিৎ হয় ধূর্জটি। তার ঠোঁটের কোনে একটা অদ্ভূত হাসি।

     – বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। এইবারে ঘুঘু তব বধিব পরান।

     একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলি।

     – কিচ্ছু বুঝলাম না।

     সিগ্রেট ধরিয়ে কড়িকাঠের দিকে ধোঁয়া ছাড়ে ধূর্জটি। হাতের আঙুল তার টক্‌টক্‌ শব্দ তোলে সিগ্রেটের টিনে।

     – ক্রমশঃ প্রকাশ্য বৎস, ক্রমশঃ প্রকাশ্য। কিন্তু আপাততঃ আমি স্পিকটি নট।

উপন্যাসের শেষ অংশ পড়তে ক্লিক করুন এখানে 

Tags: উপন্যাস, তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), সুমিত বর্ধন

19 thoughts on “অর্থতৃষ্ণা

  • April 2, 2018 at 1:24 pm
    Permalink

    এরকম অনায়াসকৃত ইউনিভার্স বিল্ডিং বাংলাভাষায় আজ অবধি কোনও গল্পে পাই নি। বাংলা জঁর ফিকশনে এই গল্পটা একটা মাইলস্টোন হয়ে থাকবে। সুমিতদাকে কুর্নিশ এইরকম একটা গল্প উপহার দেওয়ার জন্য।

    Reply
    • April 3, 2018 at 11:31 pm
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ । আপনাদের উৎসাহ স্পেকুলেটিভ ফিকশন নিয়ে লিখে চলার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিল ।

      Reply
  • April 3, 2018 at 4:20 am
    Permalink

    বাংলা ভাষায় এমন রোমাঞ্চকর, কল্পনার পালে উড়ান বেয়ে চলা রহস্যকাহিনী খুব বেশী আসেনি। সময়ের প্রেক্ষিতটাও আশ্চর্য বিশ্বাসজনকভাবে উঠে এসেছে।

    Reply
    • April 3, 2018 at 11:29 pm
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ সন্দীপন । আপনাদের উৎসাহ এই জন্র নিয়ে লেখার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিল ।

      Reply
  • April 3, 2018 at 6:20 am
    Permalink

    অর্থতৃষ্ণা পড়লাম। আমি ভাগ্যবান যে বাংলায় এমন একটা স্টিমপাংক কাম অল্টারনেট হিস্ট্রির পটভূমিতে থ্রিলার পড়তে পেলাম।
    এর আগে যখনই ইংরেজিতে এসব পড়েছি, মনে-মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেবেছি, “আমাদের দেশে হবে সেই লেখা কবে, যাকে পড়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সবে!” অ্যাদ্দিনে তেমন জিনিস পেলাম। লেখককে আভূমি সেলাম।

    Reply
    • April 3, 2018 at 10:34 pm
      Permalink

      এই দীর্ঘ লেখাটি যে সময় নিয়ে পড়েছেন এবং উৎসাহ দিইয়ে চলেছেন , এতে প্রচলিত বিষয়ের বাইরে গিয়ে লেখার আগ্রহ আরো বেড়ে গেল । অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

      Reply
  • April 3, 2018 at 7:57 am
    Permalink

    ফাট্টাফাট্টি – তাত্ত্বিক দিক নিয়ে আলোচনা করবার মতো জ্ঞানগম্যি নেই – তবে আলাদা আলাদা জনর কে একসাথে পেশাই-মারাই করে এরকম একশন প্যাকড ডিটেকটিভ টল স্টোরি মনে হয় ডিটেকটিভ ডি ছাড়া আর কোথাও দেখিনি| লেখককে লম্বা করে সাব্বাস!

    Reply
    • April 3, 2018 at 11:14 pm
      Permalink

      গল্পের এই সৃষ্টিছাড়া বিষয় সত্ত্বেও যে আপনাদের ভাল লেগেছে, বাংলায় স্পেকুলেটিভ ফিকশনের যে একটা জায়গা অবশ্যই আছে এই ধারণ্টা আরো দৃড় হল ।

      Reply
  • April 3, 2018 at 8:11 am
    Permalink

    লেখকে কুর্নিশ এরকম একটা গল্প বলার জন্য। alternate history এবং স্টিমপান্ক থ্রিলার, দুর্ধর্ষ world building, নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়। বাংলায় এরকম লেখা আগে আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি।

    Reply
  • April 3, 2018 at 11:25 pm
    Permalink

    বাংলায় স্পেকুলেটিভ ফিকশন লিখলে কেউ আদৌ পড়বে কিনা, সে নিয়ে একটা তর্ক বিতর্ক কল্পবিশ্বের শুরু থেকেই জারী ছিল । স্পেকুলেটিভ ফিকশনেরও বাঙালী পাঠকের মনে একটা জায়গা আছে, আপনাদের ভাল লাগাটাতে সেই বিশ্বাসটা মজবুত হল ।

    Reply
  • April 5, 2018 at 1:29 pm
    Permalink

    এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম… বিষয়বস্তুর ওপর দুর্দান্ত রিসার্চ, টানটান প্লট, রহস্যের জাল বিস্তার ও গোটানোয় মুন্সিয়ানা, ইত্যাদি অসাধারণ লেখনীশক্তির পরিচায়ক। আমি কল্পবিজ্ঞান ভীষণ ভালোবাসি, যদিও স্টিমপাঙ্ক বলতে কেবল টিম পাওয়ার্সের “আনুবিস গেটস” বাদে কিছুই পড়িনি। “অর্থতৃষ্ণা” শুধু আপনার লেখা ভবিষ্যতে পড়তে পাওয়ার চাহিদাই তৈরী করেনি, স্টিমপাঙ্ক বিষয়টা সম্বন্ধে নতুন করে কৌতূহলী করে তুললো।

    দুটো বিষয়ের একটু সমালোচনা করবো: (১) সুকুমারবাবুর চরিত্রচিত্রণ আরেকটু ডিটেইল্ড হলে ভালো লাগতো; এরকম দুর্ধর্ষ দুশমন বড্ডো অল্প চাপেই নিজের মুখোশ খুলে ফেললো, ইটা ঠিক জমলো না। (২) ত্রাসপশুর চোরাচালানের ব্যাপারটা হঠাৎই গল্পের শেষদিকে দু’বার উল্লিখিত হয়; এটাও আরেকটু আরেকটু ডিটেইল্ড হলে ভালো লাগতো।

    তবে মাইরি বলছি, ধূর্জটির পরবর্তী অ্যাডভেঞ্চারের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রইলাম।

    Reply
    • April 6, 2018 at 1:44 pm
      Permalink

      পুরোপুরি একমত।

      Reply
  • April 6, 2018 at 5:19 am
    Permalink

    এক কথায় অসাধারণ একটি লেখা পড়লাম। ছত্রে ছত্রে নিজেকে ওদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছি কলকাতা থেকে দুমলিগড়ে।
    মেজর প্রভাতরঞ্জন চরিত্র কি আপনার ঠাকুরদার আদলে গড়া?

    পরের অ্যাডভেঞ্চারের অপেক্ষায় রইলাম।

    Reply
  • April 6, 2018 at 8:59 am
    Permalink

    এই উপন্যাসটা পড়ে সত্যি সত্যি কথা বন্ধ হতে যায়। এত সুন্দর, এত স্মার্ট অথচ এতো সহজ! সময়টা যেন লেখকের খেলার বিষয়। এই ভাবে অবলীলায় পিরিয়ড পিস লিখতেও কাউকে দেখিনি। কলগোলাম, এই নতুন শব্দটাও যেন কত চেনা।
    এরকম আরো লেখার আবেদন রইলো। যদিও জানি এরকম লেখা সহজ নয়।

    Reply
  • April 10, 2018 at 1:52 pm
    Permalink

    সুমিত বর্ধন মহাশয়ের লেখা আগে কখনো পড়ার সুযোগ হয়নি। বাংলায় এইরকম থ্রিলার আজকের দিনে কমই পাচ্ছি। ঠিক কি বা কতটা বলা উচিৎ জানিনা, তবে এক কথায় ‘অসাধারণ’। ধূর্জটির কাহিনী আবার পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

    Reply
  • April 21, 2018 at 8:12 am
    Permalink

    সুমিত বাবু , পরবর্তী গল্পে আপনি আরো কিছু অলৌকিক চরিত্র রাখতে পারেন । যেমন বহুরূপী, যারা যেমন ইচ্ছা রূপ ধারণ করতে পারে ও সিনেমাতে অভিনয় করে‌ । গরুড়রা তাদের অপছন্দ করে । কোনো বহুরূপীর খুনের তদন্ত নিয়ে গল্প হতে পারে । কলগোলামদের ইনফ্রারেড রশ্মি দ্বারা নিয়ন্ত্রন করা যায় কিনা তার গবেষণা সংক্রান্ত ‌। ইনিগমা মেশিন ও টুরিং যন্ত্র ইত্যাদি ।

    Reply
  • September 26, 2018 at 4:13 am
    Permalink

    পড়ব বলে বুকমার্ক করে রাখলেও ভুলে গিয়েছিলাম। তাই বেশ দেরি হয়ে গেল পড়তে। বলা বাহুল্য অসম্ভব ভাল লাগল এ উপন্যাস। অনেক বিদগ্ধ জন ইতিপূর্বে মন্তব্য করেছেন। আমি ভেতো বাঙালি পাঠকের প্রতিনিধি হিসেবে বলতে পারি, এই ধরণের উপন্যাস বাংলায় জনপ্রিয় না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল, এমন প্লটে বা বিষয়ে লিখতে গেলেই দাঁতভাঙ্গা কঠিন কঠিন বিদেশী শব্দের প্রাচুর্যে ভরিয়ে দেওয়া হয়। পড়ে বোঝার উপায় থাকে না সেটা আদৌ বাংলা গল্প নাকি ইংরেজি গল্পের অনুবাদ। পুরো বিষয়টা একসময় এতটা জটিল হয়ে যায় যে লেখা ছেড়ে ডিসপ্রিন খুঁজতে হয়। আপনার এই কাহিনীর ভাষায় একদম আটপৌরে বাংলার গন্ধ মাখামাখি হয়ে আছে। তরতর করে পড়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় কোথাও এতটুকু হোঁচট খেতে হয় না। ফেলুদা-ব্যোমকেশীয় ঢঙে শুরু করে কখন যে আপনি স্পেকুলেটিভ ফিকশন বা স্টিম পাঙ্কে গল্পকে নিয়ে ফেলেন সেটা কমেন্টগুলি পড়ার আগে পর্যন্ত বোঝা মুশকিল। এমন গোত্রের লেখা বাংলায় লিখতে হলে অবশ্যই এমনভাবে তাকে বাঙালিয়ানায় জারিত হতে হবে। মরকত নন্দিনী উপন্যাস থেকে আপনার লেখার প্রতি একটা ভাললাগা জন্মেছিল, এখন আমি পুরোপুরি ফ্যান হয়ে গেলাম আপনার কলমের।

    Reply
  • December 21, 2018 at 1:11 pm
    Permalink

    khub bhalo laglo,ei rokam choritro gulo niye ar keu bodh hoy lekhen ni,apnar kach theke erokom lekha aro chai

    Reply
  • May 26, 2020 at 9:17 am
    Permalink

    সুন্দর লিখেছেন, গড়্গড়িয়ে পড়ে নিলাম । টানটান উত্তেজনা আছে । রহস্যটাও শেষ পর্যন্ত গেছে রহস্যের মোড়কে । তারসাথে অনেক কিছু নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হলাম ।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!