ক্যুগেল ব্লিৎস
লেখক: ডঃ দিলীপ রায়চৌধুরী
শিল্পী:
সন্ধ্যেবেলায় হাওড়া স্টেশনটা একটা সমুদ্রের মতো। এক একটা ট্রেনের গায়ে যেন মানুষের ঢেউ আছড়ে পড়ছে, থার্ডক্লাশ কামরাগুলো প্লাটফর্মে ঢোকবার আগেই ভর্তি হয়ে যায়।
উঁচু ক্লাসের কামরাগুলো ত’ রিজার্ভ করা, সে সব কামরায় হাত দেয় কার সাধ্য। কাজেই লোলুপ নয়নে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর উপায় কি!
অফিসের কাজে কলকাতার বাইরে যাচ্ছি। পরের পয়সায় নবাবী করার এরকম সুযোগ আর কোথায় পাবো! ভাবতেও ভালো লাগছে ভীড় পোয়াতে হবে না। কেবল রিজার্ভ করা ফার্স্ট ক্লাস কামরা খুঁজে নিতেই যা ধকল। এইটুকুতেই একেবারে গলদঘর্ম। রেল কোম্পানীর লোকগুলোর মেজাজও যেন তেতে আছে। গাড়ীর নম্বর ও সিট নাম্বার বলেই খালাস, তারপর তোমরা মর হাতড়িয়ে!
কুলিগুলো না থাকলে আরো আধঘণ্টা ঘুরতে হত। কামরা ত পাওয়া গেল। এখন সহযাত্রী কে দেখি? লোয়ার বার্থখানা দেওয়া হয়েছে কোন এক ডক্টর এস রায় কে, ওপরের বার্থে বিছানা বিছিয়ে নিতান্ত সন্দিগ্ধচিত্তে অপেক্ষা করতে লাগলাম কতক্ষণে আমার সহযাত্রী এসে পৌঁছান। মনে মনে ভাবলাম যদি খুঁতখুঁতে খিট্খিটে লোক হয় তবে সমঝিয়ে দেওয়া যাবে আমি কে! একটু আগেই এসে পড়েছি। কুলিদের বিদায় দিয়ে একখানা রকেট সিরিজের বই নিয়ে বস্লাম। রেলের নিয়ম অনুযায়ী আলবৎ রাত সাড়ে নটা পর্যন্ত এখানে বস্বো।
রেস্তোরাঁ গাড়ীর বেয়ারাটা এসে জিগ্যেস করে গেল খড়গপুরে খাবার দিয়ে যাবে কিনা। ট্রেনে চড়লেই আমার ভীষণ ক্ষিদে পায়। একটা ইংরেজী খানার অর্ডার দিয়ে হৃষ্টমনে গল্পের বইয়ে ডুবে গেলাম। কতক্ষণ পড়েছি জানি না। হঠাৎ খেয়াল হল ট্রেন ছাড়বার সময় হয়েছে। সাড়ে সাতটা বাজ্তে আর কয়েক মিনিট মাত্র বাকী আছে, অথচ ডক্টর রায়ের দেখা নেই। যাক্, ভদ্রলোক তাহলে আর এলেন না। এখন বেশ হাত পা ছড়িয়ে যাওয়া যাবে রাত্তিরটা।
বাঁশি বেজে গেছে। লাল আলো হলুদ হয়ে সবুজ ছুঁয়েছে। এমন সময় কুলির মাথায় দুটো বড় বড় কাঠের বাক্স চাপিয়ে একজন ভদ্রলোক পড়ি-কি-মরি করে ছুটে আস্ছেন। চোখে চশমা, প্রশস্ত ললাট, কেমন যেন চেনা চেনা চেহারা। আরে এ তো আমাদের সেন্ট জেমস কলেজের পুরাণের অধ্যাপক সুশোভন রায়। ওঁরা যখন করিডরে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। কুলি দুটো দমাদম বাক্সগুলো আমার কামরায় নামিয়ে দিয়ে লাফিয়ে নেমে গেল। সুশোভন বাবু কামরায় ঢুকে জানালা দিয়ে ওদের পয়সা প্লাটফর্মে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। ঝন্ ঝন্ করে পয়সাগুলো প্লাটফর্মে ছড়িয়ে গেল।
গোটা ঘটনাটা এত হঠাৎ ঘটে গেল যে সম্বিত ফিরতে দেখি বাক্স দুটোয় কামরাটা আধখানা জোড়া, তারি মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে সুশোভন বাবু কি যেন খুঁজছেন।
‘স্যার কি হারালো?’
‘অ্যাঁ, এই মানিব্যাগটা যে কোথায় ফেল্লাম, এই তো এক্ষুনি ওদের পয়সা দিলাম। কি মুস্কিল, ওর মধ্যে যে টিকিট পত্তর সব আছে।’
‘সে কি স্যার, এই ত’ বাঙ্কের ওপর!’
‘আরে সত্যিই ত’। কি বলে যে আপনাকে …… কিন্তু আপনাকে মানে তোমাকে বড় বড় চেনা চেনা লাগ্ছে।’
‘আমি সঞ্জয়, ১৯৫৬ সালে সেন্ট জেম্স কলেজে আপনার ছাত্র ছিলাম।’
‘তাইত! দেখ ভাই কিছু মনে কোর না তোমার চেহারা আনেক পাল্টেছে। বেশ মোটাসোটা হয়েছ। তা বেশ, এখন কি করা হয়?’ – হঠাৎ সুশোভন বাবু ভাববাচ্যে আশ্রয় নিলেন।
‘একটা সওদাগরী অফিসে কাজ করি। তাদের পয়সায় বোম্বাই যাচ্ছি কাজে। আপনি?’
‘আমি যাব ক্যাম্বেতে। বোম্বে থেকে গাড়ী বদল করে আহ্মেদাবাদ। সেখান থেকে আনন্দ – তারপর মিটার গেজের ট্রেনে ক্যাম্বে পুরো চার দিন যাবে রাস্তায়।’
এক নিমেষে যেন পুরো টাইমটেবলখানা মেলে ধরলেন আমার সাম্নে। তারপর গুজরাটের ঐ এলাকার ভূগোল, ভূসংস্থান ইত্যাদি ইত্যাদি শুন্তে শুন্তে কখন যে খড়গপুরে পৌঁছে গেছে কে জানে।
‘সাব্, খানা!’ – দেখি বেয়ারাটা খাবার এনে হাজির করেছে। ভীষণ লজ্জা করতে লাগলো, তখন যদি জানতাম আমার সহযাত্রী ডক্টর এস রায় হচ্ছেন পূজ্যপাদ অধ্যাপক সুশোভন বাবু, তবে ডবল খানা অর্ডার করতেও ত’ পারতাম। সুশোভন বাবু বোধ হয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। বল্লেন, ‘আরে আমি খেয়ে এসেছি হে, হ্যাঁ সত্যি বলছি। আমি বরং তোমার সঙ্গে এক পেয়ালা কফি খাবো।’
খাওয়ার পর কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে দুজনে বসে আছি। জানালা দিয়ে হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মনে হয় বৃষ্টি হচ্ছে। দু এক বার বিদ্যুৎ চম্কালো। অন্ধকার আকাশের বুক চিরে আলোর ঝিলিক্ দিয়ে গেল।
‘জানালা টা বন্ধ করে দিই, স্যার?’
‘উঁ, না, থাক না, বেশ ত ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে’ – কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে কি একটা ভাবছিলেন সুশোভন বাবু – ‘কোন দিন ভেবে দেখেছ সঞ্জয়, এই ঝোড়ো বিদ্যুৎ প্রবাহ কত মারাত্মক হতে পারে?’
‘বজ্রাঘাতে প্রাণহানির কথা বলছেন স্যার না অন্য কিছু বিপদের কথা?’ – যেন গল্পের গন্ধ পেলাম সুশোভন বাবুর কথায়।
‘কিছুদিন আগে গুজরাতের ক্যাম্বে এলাকায় এক মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। জানো বোধ হয় ওখানে পেট্রোলিয়াম তেল খননের কাজ চলছে। এই রকমই এক আগলা-মেঘলা সন্ধ্যায় এক রাশিয়ান ইঞ্জিনীয়ার আর জন দুই ভারতীয় ভূতত্ত্ববিদ্ তেলের খনির পাশে একটি ছোট বাংলোয় তেল মেশানো কাদা পাথর পরীক্ষা করছিল। অকস্মাৎ সেখানে এক প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে। সেই বাংলোটা কে যেন এক ফুৎকারে চূর্ণ করে বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায় তিন মাইল দূরে। মানুষগুলোর চিহ্ন পর্যন্ত নেই। দূরে যারা কাজ করছিল তারা বিস্ময় ও আকস্মিক শক্ কাটবার পর রিপোর্ট করেছে যে আকাশ থেকে যেন একটা জ্বলন্ত আগুনের স্তম্ভ তড়িৎ বেগে মাটিতে নেমে আসে। তারপর জানালা দিয়ে বাংলোটার ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর চারিদিকে কেবল ধোঁয়া আর ধুলো!’
ট্রেন চলতে শুরু করেছে। এতক্ষণ খামখা গর্জনের পর আকাশ থেকে নেমেছে বৃষ্টির ঢল। জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। এরকম বাদলা আবহাওয়ায় আষাঢ়ে গল্প মন্দ জম্বে না, এই ভেবে বেশ আরাম করে বস্লাম, আমার মুখের ছোট বাঁকা হাসিটা বোধ করি মাষ্টার মশায়ের চোখ এড়ায়নি।
‘ও, তুমি ভাবছো আমি গাঁজাখুরি গল্প বলছি। এরকম ঘটনা বিদেশেও ঘটেছে আগে। দাঁড়াও।’- সিটের ওপর রাখা ফোলিও ব্যাগটা থেকে উনি একতাড়া দেশী-বিদেশী খবরের কাগজ বার করলেন-
‘এই যে, লন্ডনের ডেলী মেল: তেসরা অক্টোবর ১৯৩৬ নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন শহরের উপকণ্ঠে একটি বাড়ীতে এক ভদ্রলোক লক্ষ্য করেন এইরকম একটি অগ্নিপিণ্ড আকাশ থেকে অকস্মাৎ বেরিয়ে প্রথমে টেলিফোনের তার জ্বালিয়ে দেয়, তারপর একটি জানালায় আগুন ধরায় তারপর ঘরের ভেতরে এক বাল্তি জলের মধ্যে মিলিয়ে যায়। নিমেষে বাল্তির জল টগবগ্ করে ফুটতে থাকে। এমনকি কুড়ি মিনিট বাদেও ঐ জলে হাত ডোবানো যায়নি।’
সুশোভন বাবুর গলায় ঈষৎ উত্তেজনার আভাস দেখে আমি একটু লজ্জিত হয়ে বল্লামঃ ‘কে বল্লো আপনাকে আমি অবিশ্বাস করছিলাম। তেলের খনির চৌহদ্দীতে এত অসংখ্য কারণে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যে আমি গোড়ায় অতটা সিরিয়াসলি ধরিনি। এখন অবশ্য একটু কৌতূহলী হয়ে পড়ছি। তাহলে আকাশের ব্জ্রস্তম্ভের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করা তো সহজ নয়।’
‘সহজ নয়ই তো। তাহলে আর আমাকে এত দৌড়াদৌড়ি করতে হবে কেন। এই ফটোখানা দ্যাখো আমেরিকার নিউ মেক্সিকোর লস এ্যালামোয় ডক্টর ম্যাথিয়াস ফটো তুলে দেখিয়েছেন যে মাঝেমাঝে আকাশে একধরণের উড়ন্ত অগ্নিগোলক বা জার্মান ভাষায় যাকে বলে ক্যুগেল ব্লিৎস দেখা যায়। এদের উৎপত্তির কারণ: বিদ্যুৎ প্রবাহে বাতাসের কোনো অংশ তড়িৎ বিশিষ্ট বস্তু কণায় রূপান্তরিত হলে সেই স্বল্প অংশ উচ্চশক্তি বিশিষ্ট প্লাজমায় পরিণত হয়।’
প্লাজমা কথাটা আমি আগেও শুনেছি। কিন্তু এইরকম একজন জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়ার কাছ থেকে রোজ তো আর শোনা যায় না। সুশোভন বাবু নিজের উৎসাহে বলে চলেছেন:
আমরা সাধারনভাবে কঠিন, তরল ও বায়বীয় তিন জাতের বস্তুর চরিত্র জানি। পরমাণু স্বাভাবিক অবস্থায় প্রোটন, ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি, সে গ্যাস ই হোক আর শক্ত পাথর ই হোক এখন গ্যাসের মধ্যকার ইলেকট্রনগুলো যদি খোসা ছাড়ানোর মতন করে ছাড়িয়ে নেওয়া যায় এবং তারপরও ঐ সব প্রোটন ও ইলেকট্রনগুলো এক পেঁজা তুলোর মত অবস্থায় থাকে তাকেই আমরা বলবো প্লাজমা। এর উত্তাপ অসাধারণ এবং শক্তিও অসীম।
পৃথিবীতে প্লাজমার তাপ সইবার মতো কোন বস্তু নেই। তাই ল্যাবরেটরীতে প্লাজমা সৃষ্টি করতে গেলে অনর্থ ঘটবে। আগে তাপ সইবার মতো ধাতু কি পাথর খুঁজে বার না করতে পারলে কোন উপায় নেই। কাজেই ঊর্ধ্বাকাশে ছাড়া প্লাজমা দুনিয়ার চৌহদ্দীতে কখনও দেখা যায়নি।
রাত সাড়ে এগারোটার গাড়ীটা টাটানগর পৌঁছানোর পর দেখি ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে এসেছে। মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি উনিও ক্লান্ত। হবেই না বা কেন? সন্ধ্যের সময় যেরকম হুড়োহুড়ি করতে হয়েছে। অবশ্য ওর সাথে গল্প করলে হয়তো আজ রাত অনায়াসে কেটে যেত। উনিই আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন, বললেন: ‘তাহলে এবার শুয়ে পড়া যাক সঞ্জয়। সারাদিন তোমার আমার দুজনেরই কম ধকল ও দৌড়াদৌড়ি যায় নি তো!’
উনি বালিশে মাথা ঠেকাতেই বাতি নিভিয়ে দিলাম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না, চোখ মেলে দেখি ট্রেনটা দাঁড়িয়ে। রোদে চারিদিক ভরে গেছে। মাষ্টার মশাই গাড়ীতে নেই। তাড়াতাড়ি বাঙ্ক থেকে নেমে বুঝলাম বিলাসপুর স্টেশন। সকাল সাড়ে আটটা বাজে। চায়ের জন্য হাঁকডাক লাগিয়েছি এমন সময় সুশোভন বাবু কামরায় ফিরে এলেন। গম্ভীর মুখ, হাতে একখানা খবরের কাগজ।
‘স্যার, ভীষণ ঘুমিয়ে পরেছিলাম। আপনার কিরকম ঘুম হোলো?’
সে কথার জবাব দেবার জন্য মাষ্টার মশাইকে বিশেষ ব্যগ্র দেখলাম না। চুপ করে এসে বস্লেন, তারপর খবরের কাগজখানা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
খবরের কাগজের প্রথম পাথার খবর দেখে আমার মাথা ঘুরে গেল। ওয়ার্ধার কাছে ত্রিকালেশ্বর বলে একটা জায়গায় কয়লার খনিতে একটা প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। ঠিক মেইন লিফটের সামনে হাওয়ায় গুঁড়ো কয়লার ঝড় উঠেছিল। হঠাৎ একটা বোমা ফাটার আওয়াজ এবং সেই সঙ্গে ত্রিশজন শ্রমিক নিশ্চিহ্ন। লিফ্টের মুখটা জখম হওয়ায় প্রায় আড়াইশো শ্রমিক মাটির তলায় আটকে পড়েছে। আশপাশের সমস্ত জায়গা থেকে লোকেরা ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কারণ তারা দেখেছিল বিস্ফোরণের ঠিক আগেই যেন আকাশ থেকে উজ্জ্বল এক আলোক স্তম্ভ দেবতার অভিশাপের মত সরাসরি মাটির দিকে নেমে আসছে। কারো কারো মতে স্তম্ভটি দৈর্ঘ্যে প্রায় পাঁচ ফুট হবে। বোম্বাই থেকে উদ্ধারকারী দল ওয়ার্ধা হয়ে ত্রিকালেশ্বরের দিকে ছুটছে।
মাষ্টারমশাই অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর জিগ্যেস করলেন: ‘আমাদের ট্রেন কখন ওয়ার্ধা পৌছবে?’
‘স্যার, সিডিউল্ড টাইম অনুযায়ী বিকেল সাড়ে পাঁচটায় নাগপুর, তারপর সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ওয়ার্ধা। কিন্তু কেন, আপনি কি ভাবছেন ……’
‘হুঁ, না, ভাবছি না আর, ঠিকই করে ফেলেছি। ওয়ার্ধার এই ঘটনা সম্পর্কে খোঁজখবর ভাল করে না নিয়ে ক্যাম্বে যাওয়ার কোন মানে হয় না। খনি এলাকা গুলোয় বার বার বিস্ফোরণ ঘটছে। এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়।’
সাড়ে এগারোটায় গাড়ী রায়পুর পৌঁছলো। স্টেশন মাষ্টারের কাছে সুশোভন বাবু নিজের পরিচয় দিলেন। তারপর দিল্লীতে একটা ফোন করলেন। কি কথা হলো জানি না। সামনে থাকাটা ঠিক শোভন মনে করিনি। একারণে ট্রেনটা কিছু লেইট হয়ে গেল। আমাদের সহযাত্রীরা ইতিমধ্যেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। আমাদের ঘোরাঘুরি দেখে কিছু লোক সন্দিহান। আমরাই গাড়ীটা লেইট করে দিয়ে মজা দেখছি – এই ভাব!
‘স্যার, কিছু খেলে হতো না?’
‘হুঁ, ঠিক কথা; আজ রাত্তিরে কি জুট্বে ঠিক্ নেই। আচ্ছা, অর্ডার করেছ নাকি?’
‘আমি বুঝতে পেরেই আগে দুটো ননভেজিটারিয়ান লাঞ্চ আনতে বলে দিয়েছি নেক্সট স্টেশনে।’ তারপর আরও কিছুক্ষণ আমরা চুপচাপ। বেগতিক দেখে আমি খবরের কাগজের অন্যপাতাগুলোর দিকে মন দিলাম। বোম্বে এলফিনস্টোনে কি ছবি হচ্ছে, ভেনিস রেস্তোরাঁয় কে গান গাইছে এইসব খবর দেখে আবার প্রথম পাতায় ফিরে এসেছি। হঠাৎ একটা ছোট্ট খবর দেখলাম। আরে! আগে ত’ জানতাম না যে পরশু বোম্বাইএ একটা পার্শী ছুটির দিন। কাল শনিবার এগারোটায় ট্রেইন পৌঁছবে। তারপর রবি ও সোমবার কিছুই করার নেই ম্যারিন ড্রাইভ যাওয়া ছাড়া। মনটা খিঁচড়ে গেল।
মাস্টারমশায় হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভাঙলেন-‘আচ্ছা সঞ্জয়, তুমি তো কেমিস্ট্রি পড়েছ? অক্সিজেন গ্যাসের আয়োনাইজেশান পটেন্শিয়াল সম্পর্কে তোমার নিশ্চয় কিছু আইডিয়া আছে।’
একটু লজ্জিত হয়ে বললাম: ‘স্যার, আইডিয়া তো আছে তবে জ্ঞান বড়ো একটা নেই!’
হো হো করে হেসে উঠ্লেন সুশোভন বাবু। এতক্ষণে জমা চিন্তার মেঘ যেন ভ্রু থেকে কিছুটা উড়ে গেল, ‘বেশ বলেছ! কিন্তু আমি কেবল ভাবছি সাধারণতঃ ঝোড়ো বিদ্যুতের প্রভাবে বাতাসে এক মেগাজুলের বেশী শক্তি সঞ্চারিত হয় না। কয়লাখনি কি তেলের খনিতে বিস্ফোরণ ঘটানোর মত শক্তি আসবে কোথা থেকে?’
‘স্যার, তাহলে বোধহয় ওগুলো ঝোড়ো আকাশের বিদ্যুৎ গোলক ‘ক্যুগেল ব্লিৎস’ নয়। তার চেয়ে মারাত্মক আর কিছু!’
‘ঠিক ধরেছ! চরিত্রে ওরা বিলেত কি আমেরিকায় দেখতে পাওয়া বিদ্যুত গোলকের মতই- প্লাজমায় গঠিত। কিন্তু বজ্র বিদ্যুৎ নয় তার চেয়ে আরও অনেক বেশী তীব্র রশ্মির বিকীরণে এই মারাত্মক প্লাজমাস্তম্ভ সৃষ্টি হয়েছে।’
‘স্যার, আমি যতদূর জানি মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাব এই ধরণের আয়ন সৃষ্টি করতে পারে, তবে কি …’
‘না! না! কসমিক রে’র ব্যাপার এটা নয়। মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাব বড়ো বিস্তৃত ও ক্ষীণ। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে এই বিকীরণ স্বল্প এলাকা জুড়ে তীব্র ও বাঘের নখের মত তীক্ষ্ণ।’
গাড়ীর গতি মন্থর হয়ে এলো। স্টেশন আসছে। এতক্ষণে বেশ খিদেও পেয়েছে, চাঙ্গাও লাগছে।
‘তাহলে কি এটা প্রাকৃতিক, নৈসর্গিক স্বাভাবিক ঘটনা নয়?’
‘উর্ধাকাশে গিয়ে ভাল করে সন্ধান না করে সঠিক বলবার উপায় নেই। তবু আমার মনে হয় এই ধরণের মারাত্মক বিদ্যুৎ স্তম্ভ মেঘলোকের ওপারে কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি- কোনও বুদ্ধিমান শত্রুর আমাদের শিল্পপ্রয়াসকে বাণচাল করে দেওয়ার অপচেষ্টা।’
স্টেশনে খাবার এসে গেল। খেতে খেতে বল্লাম ‘মাষ্টার মশায়! আমিও আপনার সঙ্গে ওয়ার্ধায় ব্রেক জার্নি করছি।’
‘সেকি হে! তুমি অফিসের কাজে যাচ্ছো। আমার এই পাগলামির মধ্যে জড়িয়ে পড়বে কেন? না হে, ও কোরো না।’
বুঝলাম মুখে খুঁতখুঁত করলেও মাষ্টারমশায় একটা সঙ্গী পেলে নিতান্ত দুঃখিত হবেন না। বল্লামঃ ‘স্যার যেরকম ভয়ের কথা বলছেন আপনাকে একা ছেড়ে দিতে পারি না। ভাগ্যচক্রে যখন দেখা হয়েই গেল, দেখি ভাগ্য আমাদের দুজনকে কোন্ দিকে নিয়ে যায়। তাছাড়া কাল, পরশু দুদিন তো ছুটি। ত্রিকালেশ্বরে যদি আপনাকে আটকে যেতে হয় ত’ আমি না হয় পরশু সন্ধ্যেবেলা বোম্বে চলে আসবো।’
‘সে জন্য চিন্তা নেই সঞ্জয়। এয়ার ফোর্সের যে উড়োজাহাজ খানা এয়ার ভাইস-মার্শালের কাছে চেয়ে পাঠিয়েছি সেখানা পেলে পরে আমরা দুজনেই প্লেনে বোম্বাই ফিরতে পারবো।’
‘কিন্তু উড়োজাহাজ! ওয়ার্ধায় কি এয়ারস্ট্রিপ আছে?’
‘সে চিন্তা আমাদের নয়। ওরা বন্দোবস্ত একটা কিছু করবে।’
রাত আটটা নাগাদ ট্রেইন ওয়ার্ধা পৌঁছালো। আমার সঙ্গে মালপত্তর বিশেষ কিছু ছিল না। মাষ্টারমশায়ের মোটঘাট, কাঠের বাক্স সব কুলিদের দিয়ে ধরাধরি করে নামালাম। অসম্ভব ভারী বলতে হবে। কি জানি কি আছে ওগুলোয়?
স্টেশন মাষ্টার ও তাঁর সঙ্গে এয়ারফোর্সের ব্লু ইউনিফর্ম পরা জনা দুই উচ্চপদস্থ কর্মচারী আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। সুশোভন বাবু রায়পুর থেকে দিল্লীতে যে ফোন করেছিলেন তারই ধাক্কায় এত লোকলস্কর এসে হাজির।
‘প্রফেসর রায়, আমি এয়ার ভাইস মার্শাল সিন্হা। হ্যাঁ, আমিও বাঙালী। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আপনাকে সবরকম সাহায্য করতে বলেছেন। অবশ্য না বললেও আমি এগিয়ে আসতাম। আপনি বোধহয় জানেন না গোটা ক্যাবিনেট কিভাবে আপনার অনুসন্ধানের পিছনে উদগ্রীবভাবে তাকিয়ে আছেন। আর সেই সঙ্গে সমগ্র দেশ।’
সুশোভন বাবু বিনয়ী লোক। এইসব কথাবার্তায় একটু সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কি ধরণের প্লেন এনেছেন?’
‘একটা টার্বোজেট ভাইকাউন্ট আছে। আর একখানা জেটও আছে, আপনি কত ওপরে যেতে চান?
‘বেশী নয়, ত্রিশ হাজার ফুট নাগাদ গেলেই হবে, তবে আপনাদের এ্যান্টি-এয়ার ক্রাফ্ট ও এ্যান্টি-মিশাইল গান্ বসানোর বন্দোবস্ত আছে তো?’
‘নিশ্চয়ই, সে ইনস্ট্রাক্শান আমরা আগেই পেয়েছি, কখন বেরোতে চান?’
‘আর দেরী করে কি লাভ কি! ভালো কথা, পরিচয় করে দিই। এই মিশনের স্পেশ্যাল সায়েন্টিফিক এ্যাডভাইজার ডক্টর সঞ্জয় বোস, কই, সঞ্জয়!’ আমি কিছু বলবার আগেই আমার সম্পর্কে সুশোভন এয়ার ভাইস-মার্শাল কে কত কই যেন বলে গেলেন। ভেবে আর কি হবে! সিকিউরিটির প্রয়োজনে এই পরিচয়ই বোধহয় সবচেয়ে নিরাপদ।
আমরা স্টেশন থেকে এয়ার ফোর্সের জীপে করে সোজা রেস্ট হাউসে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য। সেখানে জামাকাপড় বদলে সুশোভন বাবু ঐ ভারী কাঠের বাক্স একটা খোলালেন, ওর মধ্য থেকে কি সব যন্ত্রপাতি একটা কিট্ ব্যাগে ভরে নিলেন। সবশুদ্ধু পনেরো মিনিট হবে।
‘মিস্টার সিন্হা, উই আর রেডী! আপনারা উড়োজাহাজে কোথায় নামলেন?’
‘কাছেই একটা খেলার মাঠে মেকসিফট এয়ারস্ট্রিপ বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক্।’
রাত্রির অন্ধকারে আমাদের জীপ ছুটে চল্লো। ওয়ার্ধা শহরের বাইরে একটা বিরাট ফুটবল খেলার মাঠে বিমান দুটো পড়ে রয়েছে। আমরা তিনজন ছাড়াও আমাদের সঙ্গে পাইলট ক্যাপ্টেন গাদকারী রয়েছে। ভারী সুন্দর ভদ্রলোক এবং বেশ অভিজ্ঞও বটে।
ঠিক রাত দশটায় আমরা ছোট বিমানটায় উঠ্লাম। সিন্হা এবং সুশোভনবাবু পেছনের দিকে বস্লেন।ছোট এ্যান্টি-এয়ার ক্রাফ্ট ও এ্যান্টি মিশাইল কামান দুটো ছাড়াও আরও কি সব অদ্ভুত যন্ত্রপাতি বাইরের দিকে মুখ করে রাখা হলো।
গর্জন করে জেট বিমান মাটি ছাড়িয়ে হাউইএর মতো সোজা ওপরে উঠে গেল। প্রথমে পাঁচ হাজার ফুট, পরে আরও ওপরে, দশ হাজার ফুট ওপরে এবং সেখান থেকে সোজা পশ্চিমমুখো চল্তে চল্তে আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে লাগলো।
আমি বসেছিলাম পাইলট গাদকারীর ঠিক পেছনেই। মেঘ-লোকের মধ্য দিয়ে চলেছি। বোঝবার উপায় নেই কোথায় যচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কে যেন সবকিছু কালি দিয়ে মুছে দিয়েছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। খালি একটানা জেটের গর্জন। রেডারে দিক নির্ণয় করে বোঝা যাচ্ছে আমরা এখনও পশ্চিমেই যাচ্ছি। প্লেনের ভিতর প্রেশার বাড়ানোর বন্দোবস্ত থাকায় অস্বস্তি বিশেষ কিছু হচ্ছিল না। সবাই যেন একটু স্লথ-কেমন যেন ঘুম ঘুম ভাব!
সুশোভনবাবু কিন্তু একটা বিশেষ রেডার যন্ত্রের স্ক্রীনের দিকে নিবিষ্ট চিত্তে তাকিয়ে উদ্গ্রীব হয়ে কি যেন খুঁজছেন!
আমরা এতক্ষণে প্রায় ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে উঠেছি। ক্যাপ্টেন গাদকারী হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বল্লেনঃ ‘মিস্টার সিন্হা, আমরা এইভাবেই কি সোজা এ্যারাবিয়ান সি’র দিকে যাবো, না এখন ফিরতে বলেন?’
সুশোভনবাবুই একথার জবাব দিলেন; ‘ক্যাপ্টেন, আপনি উত্তরমুখো আহ্মেদাবাদের দিকেই চলুন।’
আমাদের বিমান ডানদিকে মোড় নিলো। রাত প্রায় দেড়টা। এতক্ষণে অন্ধকার একটু তরল হয়েছে দিগন্তে বিস্তৃত আলোর ছোঁয়া লেগে।
মিঃ সিন্হা একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢেলে বল্লেনঃ ‘আসুন, ডক্টর বোস, একটু গলা ভিজিয়ে নেবেন। ডক্টর রায়, আপনি যা খুঁজছেন তা আজ সারারাতই খুঁজতে হবে। কাজেই জেগে থাক্তে হলে কফি’র মতো জিনিষ হয় না।’
সুশোভনবাবু একমনে রেডারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
‘শিগ্গির মিস্টার সিন্হা কফি রাখুন। এদিকে আসুন,’ – মাস্টারমশায়ের গলায় চাপা উত্তেজনার আভাস।
রেডার পর্দার ওপরে দেখা যাচ্ছে প্রায় তিনশো মাইল উত্তরে একটা উড়োজাহাজ। চট্পট আমরা রেডিও মারফৎ বোম্বাই ও আহ্মেদাবাদের বিমানপোতের সঙ্গে যোগাযোগ করলুম।
‘হেলো, বোম্বাই – আঙ্কলেশ্বরের ওপরে একটা উড়োজাহাজ, আমাদের কোনো ইউনিটের কি? কি বল্লেন, আমাদের কিছু নয়। আর ইউ পজিটিভ?’
‘হেলো, আহ্মেদাবাদ – হ্যাঁ আমি ক্যাপ্টেন গাদ্কারী আপনাদের দিকেই আস্ছি। উত্তরে আঙ্কলেশ্বরের দিকে একটা প্লেন দেখতে পাচ্ছি। আপনাদের ওখানকার কি? আপনারা কিছুই জানেন না! কোন খবরও পান নি।’
কয়েক মিনিট আমরা সকলে চুপ। তারপর সুশোভনবাবু বললেনঃ ‘সময় নষ্ট করে লাভ নেই। উত্তরে এগিয়ে যান ক্যাপটেন গাদকারী। মিঃ সিন্হা পরশু ওদের টারগেট্ ছিল ত্রিকালেশ্বরের কয়লা খনি এলাকা আর আজ আঙ্কলেশ্বরের তেলের খনি এলাকা!’
কিন্তু ওরা কারা! মনের মধ্যে ভাবনা ও অজানা ভয় পাক খেতে লাগলো। উড়োজাহাজ ছুটে চলেছে। প্রথমে যা ছিল রেডারে সামান্য একটা বিন্দু মাত্র তা ক্রমে রূপ নিতে লাগলো – বেশ বড় একটা বিমান হবে। আমাদের লক্ষ্য করেছে কিনা জানি না একটা এলাকা জুড়ে চক্রাকারে পাক খাচ্ছে।
আমরা বেশ কাছে এসে পড়েছি। উত্তেজনায় মাথা ছিঁড়ে পড়ছে। এখন কি হবে? ওদের মতলব কি?
অন্ধকার তখন যথেষ্ট পাতলা হয়ে এসেছে। আমরা বিস্ময়ে লক্ষ্য করলুম সেই অচেনা উড়োজাহাজ থেকে তীব্র সার্চলাইটের মতো রক্তাভ আলোর রশ্মি পড়তে লাগলো আকাশের একটা এলাকা জুড়ে। আকাশের সেই এলাকাটা হঠাৎ যেন বিচিত্র ফস্ফোরাসের মত জ্বলতে লাগলো!
সুশোভনবাবু চেচিঁয়ে উঠলেনঃ ‘মাই গড! দে আর ইউজিং লেজার লাইট্নিং!!’
সে কথার অর্থ সম্যক্ উপলব্ধি করবার আগেই দেখি সেই সার্চলাইটের আলো মিলিয়ে গেছে। তার জায়গায় একটা বৈদ্যুতিক আলোক স্তম্ভ! চোখের নিমেষে কি যেন হয়ে গেল। সুশোভনবাবু কি একটা যন্ত্রের বোতাম টিপ্লেন। অকস্মাৎ আলোক স্তম্ভটা চারিদিকে ছড়িয়ে গেল। সমস্ত আকাশটা তীব্র আলোয় ভরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে এ্যান্টিএয়ার ক্রাফট্ কামানের একটানা ট্যাট্-ট্যাট্-ট্যাট্ শব্দ। মিঃ সিন্হা মোটেই সময় নষ্ট করেন নি। ওদের বিশালাকায় বিমানখানা গোঁৎ খেয়ে ঘুড়ির মতো ঝাঁঝড়া হয়ে পড়তে আরম্ভ করলো। মাটিতে পড়বার আগে একটা প্রচণ্ড আওয়াজ করে ফেটে পড়লো। সকালের শান্ত আকাশ সেই বিস্ফোরণে কেঁপে কেঁপে উঠলো।
আবার যখন সকলের সম্বিৎ ফিরলো তখন দেখি ক্যাপটেন গাদ্কারী বোম্বাই মুখো চলছেন।
মিঃ সিন্হা রুমালে ঘাম মুছতে মুছতে বললেনঃ ‘আমরা প্লেনটাকে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি ডক্টর রায়! কিন্তু আপনাদের কাছে অনুরোধ এখন আমার কাছে জানতে চাইবেন না প্লেনটা কাদের। ডিপ্লোম্যাটিক কারণে আপনাদের বলতে পারবো না। খালি জেনে রাখুন ওটা আমাদের সীমান্তের ওপারের শত্রুদের। কিন্তু আপনি কি কৌশলে আঙ্কলেশ্বর তেলখনিটাকে বাঁচালেন সেটা জানবার অদম্য কৌতূহল হচ্ছে।’
সুশোভনবাবু বললেনঃ ‘কিন্তু তার আগে আপনার ঐ কফি কিছুটা চাই।’
কফিতে গলা ভিজিয়ে নিয়ে সুশোভনবাবু শুরু করলেনঃ ‘আগেই বলেছি বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা শুনেই আমার মনে হয়েছে আমাদের শত্রুপক্ষ নিশ্চয়ই ঐ বৈদ্যুতিক আলোক স্তম্ভ কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি করেছে। তড়িৎ প্রবাহ আকস্মিকভাবে বাতাসের মধ্যে দিয়ে গেলেই বাতাসের অণু পরমাণুগুলো আয়নে পরিণত হয়। মেঘ থেকে পৃথিবীতে তড়িৎ পরিচলনের ফলে এঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু এর চেয়েও মারাত্মক ব্যাপার ঘটে যখন তীব্র লেজার (LASER) রশ্মি ফোকাস করে বাতাসের মধ্য দিয়ে পাঠানো হয়।’
মিষ্টার সিন্হা বাধা দিয়ে বল্লেনঃ ‘এই লেজার জিনিষটা ত’ ঠিক বুঝতে পারছি না।’
সুশোভনবাবু কুণ্ঠিত হয়ে পড়লেন: ‘আমারই দোষ, আমার মনে হয়েছিল আপনারা বোধহয় জানেন। লেজার বা ইংরেজি LASER কথাটা এসেছে Light Amplification by Stimulated Emission of Radiation থেকে – সংক্ষিপ্ত করার জন্য আদ্যক্ষর নিয়ে। গোলাপী রুবী কৃষ্টালের ওপর আলো ফেল্লে তা থেকে তীব্র এক ওয়েভ লেংথের আলোক রশ্মি ক্যামেরার সাটার দিয়ে আট্কে রেখে হঠাৎ ছাড়লে অত্যন্ত তীব্র লক্ষ লক্ষ ওয়াট শক্তির আলোক রশ্মি খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও পাওয়া যায়। সেকেন্ডের একশো কোটি ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে এই তীব্র রশ্মি বাতাসের মধ্যে পড়লে এক অসহ্য উত্তপ্ত প্লাজমা সৃষ্টি করতে পারে।
অবশ্য উপযুক্ত চৌম্বকক্ষেত্র ছাড়া এই প্লাজমাকে ধরে রাখা কষ্টকর। এবারেও ঐ প্লাজমার স্তম্ভ নিমেষে আঙ্কলেশ্বরের তেলের খনিতে বিস্ফোরণ ঘটাত। কিন্তু আমি তাড়াতাড়ি ডিগাউসিং করে চৌম্বকক্ষেত্র নষ্ট করায় প্লাজমা স্তম্ভ থেকে ছড়িয়ে পড়ে।
ভাগ্যিস বুদ্ধি করে ডিগাউসিং বা চৌম্বকক্ষেত্র নষ্ট করবার যন্ত্রপাতি সঙ্গে এনেছিলাম। আমার অনুমান এতটা ঠিক হবে ভাব্তে পারিনি।
কিন্তু মিঃ সিন্হা, প্রতিরক্ষা দপ্তরের সকলকে বল্বেন আমরা যেন সজাগ থাকি। ওরা হয়তো আবার আস্বে।’
দিগন্ত লাল হয়েছে। তাকিয়ে দেখি আমাদের বিমান সান্তাক্রুজ বিমানঘাঁটির ওপর চক্কর দিচ্ছে।
কঃসঃ – ক্যুগেল ব্লিৎস গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল আশ্চর্য! ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সংখ্যায়। লেখকের কন্যা শ্রীমতী যশোধরা রায়চৌধুরীর অনুমতিক্রমে এখানে প্রকাশিত হল।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, ক্যুগেল ব্লিৎস, ডক্টর দিলীপ রায়চৌধুরী, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা