চলচ্চিত্র সমালোচনা – কিন্‌ জা জা (১৯৮৬)

  • লেখক: সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
  • শিল্পী:

মেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুই সুপার পাওয়ারের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তাপ তখন প্রায় ঠান্ডা হয়ে আসছিল। রেগন সাহেব তার স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্সিভ বা ‘স্টার ওয়র্স’ প্রজেক্ট নিয়ে মানুষের মনে ভয়ের আবহ তৈরী করে দিতে পেরেছিলেন বেশ সাফল্যের সঙ্গে। সেই সময় ১৯৮৬ সাল নাগাদ তদানীন্তন সোভিয়েত আমলে মস ফিল্ম স্টুডিও থেকে ‘কিন্‌ জা জা’ নামে একটা ছায়াছবি তৈরী হয়। গেয়র্গি দানিয়েলা পরিচালিত এই সিনেমাটা আদতে ছিল কল্পবিজ্ঞানধর্মী একটা মজার ছবি। যদিও সাধারণ কল্পবিজ্ঞান চলচ্চিত্র বলতে আমাদের মনে যে ছবিটা উঠে আসে মানে হলিউডের আবহে চোখ ধাঁধানো সেট ডিজাইন বা স্পেশাল এফেক্টের ব্যবহারের যে স্মার্টনেস্‌ আমরা ভেবে নিতে পারি তার প্রায় কোন কিছুই ছিল না এই ছবিতে। নিতান্ত কম বাজেটে তৈরী এই ছবিতে কল্পবিজ্ঞানের আড়ালে মানবসমাজের চিরকালীন ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে নিয়ে শ্লেষাত্মক একটি ছবি তুলে ধরা হয়েছিল।

     ছবির গল্প শুরু হয় মস্কোর জমজমাট ‘কালিনিন প্রস্পেক্ট’ (এখন আরবাট এভিনিউ) চত্বরে যেখানে কাজের দিনে তখন ব্যস্ত লোকজন যাতায়াত করছে। সেখানে প্রচন্ড ঠাণ্ডার মধ্যে খালি পায়ে, শতচ্ছিন্ন কোট গায়ে একজন মানুষ পথচলতি সবাইকে অনুরোধ করতে থাকে এই গ্রহের নম্বর বা অন্ততঃ যে স্পাইরাল নক্ষত্রপুঞ্জের অংশ এই গ্রহ তার নম্বর তাকে বলে দেবার জন্য। নিতান্ত পাগল ভেবে অনুকম্পায় শেষমেশ দুজন তাকে উদ্ধার করে কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দেবার জন্য এগিয়ে আসে। এরা হল ভ্লাদিমির ম্যাসকভ (আঙ্কল ভোভা) আর গেদেভান। নেহাত ঘটনাচক্রেই সেই সময় এরা ওই ব্যস্ত সড়ক দিয়ে পার হচ্ছিল। দুজনের কেউ কাউকে আগে চিনত না। ম্যাসকভ ছিল মস্কোর একজন কনস্ট্রাকসন্‌ ফ্যোরম্যান আর গেদেভান জর্জিয়া থেকে আসা সংগীতের এক ছাত্র যে বেহালা শিখছিল। যাইহোক, সেই ভবঘুরে লোকটার কাছে গেলে সে তাদের একটা ছোট্ট যন্ত্র দেখিয়ে বলে ওই যন্ত্রটা আসলে একটা টেলিপোর্টেশন ডিভাইস যার নাম ‘ট্রাভেলার’। ওটার সাহায্যেই সে নাকি এই পৃথিবীতে এসে পড়েছে আর এখন ফেরত যাবার জন্য ঠিকঠাক স্থানাঙ্ক জানাটা তার কাছে খুব জরুরী নাহলে সে কিছুতেই তার গ্রহে ফিরতে পারবে না। এই কথায় তাকে সত্যিকারের পাগল ভেবে নিয়ে ওই যন্ত্রের মধ্যে একটা লাল বোতাম টিপে দেয় ম্যাসকভ ওই লোকটির বারণ সত্ত্বেও। মুহুর্তের মধ্যেই তাদের সামনে পরিচিত দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়ে এক ধু-ধু মরুভূমির মধ্যে এসে পড়ে তারা। ব্যাপারটার আকস্মিকতায় দুজনেই তখন হতভম্ব। তবে কি পাগল পাগল লোকটা সত্যি কথাই বলেছিল নাকি এই পৃথিবীর মধ্যেই কোন এক মরুভূমিতে এসে পড়েছে সেটা ভাবতে ভাবতে তারা এদিক ওদিক হাঁটতে থাকে। অনেক পরে তারা জানতে পারে যে সেই জায়গাটা আসলে ‘প্লুক’ নামে এক বালিময় গ্রহ যা ‘কিন জা জা’ নক্ষত্রপুঞ্জের অংশ। এই ছবির মূল কাহিনী আসলে তাদের দুজনের আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাওয়ার গল্প।

প্লুকের অধিবাসীরা

     ওই গ্রহের অধিবাসীরা দেখতে মানুষের মতো হলেও তাদের জীবনশৈলী বেশ বর্বর আর একটা কঠোর জাতিবিদ্বেষ ঘিরে আছে ওই ‘অনুন্নত’ সমাজে। তাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা মূলতঃ টেলিপ্যাথিক মানে দুজনের মনের কথা তারা বুঝে নিতে পারে কিছু না বলেই। এছাড়াও মোটে হাতে গোনা কয়েকটা শব্দ আছে তাদের অভিধানে। এর মধ্যে ‘কুহ্‌’ এই শব্দ দিয়েই বেশিরভাগ মনের ভাব তারা প্রকাশ করতে পারে। বাকী প্রায় সবকিছু হল ‘কিয়োহ্‌’ যেটা প্রায় গালাগালির নামান্তর। যাইহোক, টেলিপ্যাথির সাহায্যে ওখানকার মানুষ বা প্লুকিয়ানরা বেশ তাড়াতাড়িই কাজ চালানোর মতো রাশিয়ান আর জর্জিয়ান ভাষা শিখে নেয় ওদের দুজনের কাছ থেকে। প্লুকিয়ান সমাজ দুটো শ্রেনীতে বিভক্ত, ‘চ্যাটলানিয়ান’ আর ‘প্যাটস্যাক’। ‘ভিসেতর’ নামে প্রায় ফ্ল্যাশ লাইটের মতো দেখতে একটা ছোট যন্ত্র থেকে চ্যাটলানিয়ান লোকেদের গায়ে যখন একটা অদৃশ্য রশ্মি তাক করে মারা হয় তখন একটা কমলা আলো জ্বলে ওঠে ওই যন্ত্রে আর প্যাটস্যাকদের বেলায় এই আলোর রঙ হয় সবুজ। প্লুক আসলে একটা চ্যাটলানিয়ান গ্রহ মানে প্যাটস্যাকরা সেখানে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক আর সেভাবেই তাদের সঙ্গে ব্যবহার করা হয় সেখানে। কিন জা জা নক্ষত্রপুঞ্জে কিছু গ্রহ আছে যেখানে আবার প্যাটস্যাকরাই সর্বেসর্বা। ম্যাসকভ আর গেদেভান এই দুজনকে ওই ভিসেতর যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হলে তারা দুজনেই প্যাটস্যাক শ্রেনীর লোক বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ওখানে সবচেয়ে মহার্ঘ্য জিনিস হল দেশলাই কাঠি বা আরো ভালো করে বলতে গেলে দেশলাই কাঠির মাথায় থাকা বারুদের রাসায়নিক সামগ্রী। ওই গ্রহে একমাত্র যে লোকেরা অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে তারা হল এক্লিওপস্‌। এই শব্দটা আসলে পুলিশ বানানটাকে উল্টো করে দিলেই চলে আসে। প্লুকিয়ান সমাজের একচ্ছত্র নেতা হলেন ‘পেঝে’। সবাই চেষ্টা করে তাকে তোয়াজ করে চলতে। কোনরকম অশ্রদ্ধার ছিটেফোঁটা প্রকাশ পেলেও গারদে পোরা হবে এটাই সেখানকার আইন। সেখানে মূল জ্বালানী হল ‘লুট’ বলে একরকম তরল যেটা আবার জল থেকেই তৈরী হয়। তাই জল ওই গ্রহের খুব দামী জিনিস।

ম্যাসকভ আর গেদেভান

     সারা ছবিটা জুড়ে নানারকম অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে দিয়ে যখন পেঝেকে সরাসরি মোকাবিলা করা হবে তখন শেষে দেখা যাবে যে সে আসলে এক  অতি নিরীহ আর প্রায় নির্বোধ চ্যাটলানিয়ান। তার নাম করে আসলে অন্যেরা এই কঠিন নিয়ম কানুন চালিয়ে আসছে। একেবারে শেষে আবার আর এক আকস্মিক ঘটনায় তারা দুজন ফিরে আসে মস্কোর ওই রাস্তায় সেই একই জায়গায়। মুহুর্তের জন্য তারা ভুলে যায় প্লুক অভিযানের সমস্ত ঘটনা। ঠিক তখন একটা বড়ো ট্রাক্টর সেখান দিয়েই পার হচ্ছিল যার হেডলাইট থেকে একটা কমলা আলো জ্বলতে থাকে। ওই দৃশ্য দেখে ম্যাসকভ আর গেদেভানের মুখ থেকে আপনা থেকেই একটা শব্দ বেরিয়ে আসে, ‘কুহ্‌’। ছবির একেবারে শেষ ফ্রেমে ম্যাসকভ বা আঙ্কল ভোভা ওপরে আকাশের দিকে তাকায়। মেঘের চাদর পেরিয়ে সেখান থেকে তখন একটা গানের সুর ভেসে আসছিল। দুজন প্লুকিউয়ান ‘ভিফ’ আর ‘বি’ এই গান শুনিয়েছিল ওদের।

এক প্লুকিয়া3ন উড়োজাহাজের সামনে দাঁড়িয়ে ম্যাসকভ আর গেদেভান  

     সারা পৃথিবীতে কল্পবিজ্ঞান চলচ্চিত্রের অনুরাগীদের কাছে এই ছবি প্রায় কাল্টের মর্যাদা পেয়েছে। মিনিমালিস্টিক সেটআপে সাই-ফাই গল্পের বিন্যাস সব সময় সার্থক হয়ে ওঠে না। সেক্ষেত্রে এই ছবির গল্প বলার ক্ষেত্রে একেবারে নিছক উদ্ভট মজার মধ্যে দিয়েও গভীর এক তাত্ত্বিক দর্শনকেই রূপকার্থে যেভাবে প্রকাশ করা হয়েছে তা প্রশংসনীয় বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই অভিমত। কাল্পনিক প্লুকিয়ান সমাজের ছবিতে আসলে আমাদের সমাজের এক সমান্তরাল রূপকেই তুলে ধরা হয়েছে সেল্যুলয়েডের ফ্রেমে। আর নানা মজার আবহে আসলে সমাজের নানা দ্বন্দ্বকেই প্রকাশ করা হয়েছে সিনেমার ভাষায়। সমাজতন্ত্রের প্রায় পতনের সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে তাই আজ আমরা এই ছবিকে মনে রেখেছি।

Tags: কিন্-জা-জা', চলচ্চিত্র সমালোচনা, প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!