জীবনদাতা

  • লেখক: অভীক সরকার
  • শিল্পী: সুপ্রিয় দাস

১৪ই এপ্রিল, ৩০১৬:

     আজ অনেকদিন পর আমার মায়ের সঙ্গে খেলতে এলাম পার্কে। তোমরা জিজ্ঞেস করতেই পারো, অনেকদিন পরে কেন? আমার মতন দশ বছরের বাচ্চার তো রোজই পার্কে আসা উচিৎ, তাই না? আসলে মা আমাকে নিয়ে আসতে লজ্জা পায়, তাই আর রোজ আসা হয় না। মা অবশ্য মুখে কিছু বলে না, বলতে পারার কথাও নয়। কিন্তু আমি সব বুঝতে পারি, তাই তো মা বলে আমার হেবি ব্রেইন, কোনও ইনডিউসড ইন্টেলিজেন্স এর কোর্স ছাড়াই। অবশ্য বেরোলে কেউ তেমন কিছু বলে না, সবাই সভ্য ভদ্র মানুষ, কিন্তু আমি জানি যে আমার মা চট করে বাইরে বেরোতে খুব অপ্রস্তুত বোধ করে, সে একলাই হোক বা আমাকে নিয়ে। 

     

     অবশ্য মায়ের কিন্তুমিন্তুর কারণটা আমি জানি। 

     আমি আর আমার মা, আমরা কেউই কথা বলতে পারি না। শুনতে পারি, বুঝতে পারি। কিন্তু বলতে পারি না। আমরা বোবা।

     এই যুগে এটা যে ভাবাই যায় না সে তো তোমরা বোঝোই। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর কোর্স তো আমাদের মতন বাচ্চাদের এখন থেকেই পড়ানো হয়। আমি অবশ্য স্কুল যাই না। মা-ই ঘরে পড়ায়। যা বলছিলাম, জেন্ট-ইঞ্জের কল্যাণে এখন কানা, খোঁড়া, অন্ধ বাচ্চা জন্ম নেয়ই না। যাদের পয়সা আছে, তারা তো কাস্টমাইজড বাচ্চা নেয়। এই তো পাশের সোসাইটির নিলসিয়েন কাকু, ডাক্তার বাচ্চা নিলো। যদিও স্যামাঞ্জন মোটে জেন্ট-ইঞ্জ বোঝে না, আর মেড-লাইফ পড়ে না, তবুও। ও শুধু মেন্টালটিউবে গান শোনে।

     আমি আর মা কি করে বোবা হলাম বোঝা খুব শক্ত, জানো? আসলে মানুষের ডিএনএ-র সব মিস্ট্রি এখনও জানা যায় নি নাকি, মা একদিন বলছিলো। খুব অল্প কিছু পার্সেন্ট মতন নাকি এখনও ডিকোড করা বাকি আছে। তাই হঠাৎ করে দু একটা  আমাদের মতন এরকম বায়োলজিক্যালি ডিফেক্টিভ ইউনিট জন্মে যায়। তা ধরো সারা পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ছ’জন পোলিও, এগারো জন থ্যালাসেমিয়া, জনা দশেক অন্ধ (মানে ব্লাইন্ড, সরি, মা অন্ধ বলতে বারণ করেছিল, ভুলে গেছি, হি হি), প্রায় পঞ্চাশ জন মতন অটিস্টিক বা ইমোশনালি আনস্টেবল (উফ, কি শক্ত শব্দ বাবা) লোক আছে, আর বোবা লোকজন আছে দুইজন।

     আমি আর মা।

     মা জানতো যে আমিও ওইরকম হবো, জানো? আজকাল জিন-ম্যাপিং করানো থাকে তো সবার। তাই তো মা বিয়ে-টিয়ে করেনি। কিডসফ্যাকটরি থেকে আমাকে বানিয়ে নিয়ে এসেছিল। সেখানে নাকি আমার বাবার ভালোবাসা ডিপকোল্ডস্পেসে ছিল, ছোট্ট একটা টিউবে। সেটাকে মায়ের পেটে বসিয়ে দিতেই নাকি আমি হই, হি হি। কি কিউট না স্টোরিটা? তবে মা কিছুতেই বাবার সঙ্গে দেখা করতে দেয় না। বলে বাবা নাকি হারিয়ে গেছে, মিথ্যে বলে মা, তাই না? 

     ও, একটা মজার কথা তো বলাই হয়নি তোমাদের। আমি আর মা নিজেদের মধ্যে কি করে কথা বলি বলতো? হাত আর ঠোঁট নেড়ে, কিম্মজা না? অবশ্য অন্য লোকদের জন্যে হ্যাণ্ডট্যাব থাকেই, তাতেই নিজেদের মনের কথা বাঁহাতের চামড়ার স্ক্রিনে ফুটে ওঠে, আর সামনের লোকের কথাও ফুটে ওঠে। তবে ওরকম একটা গ্যাজেট হাতে বেঁধে ঘোরাটা ব্যাড লাগে না? বোবা লোকও আর দেখা যায় না, তাই এসবের ব্যবহার উঠেই গেছে। আমার জন্যে তো হ্যাণ্ডট্যাব পাওয়াই যাচ্ছিলো না। শেষে সায়েন্স অ্যান্ড টেক মিউজিয়ামের কিউরেটর অনেক পুরনো ফাইল রি-ডিকোড করে, হিস্টরিলিসিস করে  এটা বানিয়ে দিয়েছেন। এটা অন করে বেরোলেই লোকে বোঝে যে আমরা কথা বলতে পারি না। আর কেমন করে যেন তাকায়, এইসান রাগ ধরে না। কিছু বলে না যদিও, ভদ্র-সভ্য লোক সব্বাই। আর বেশি অবাক হওয়াটা ব্যাড ম্যানার্স, মা বলেছে। তবুও লজ্জা লাগে না? তাই তো মা বেশি বেরোয় না। না একা, না আমাকে নিয়ে।

     আগেই বলেছি না, যে আমি আমার মা বাড়িতে হাত আর ঠোঁট নেড়ে কথা বলি? অ্যানসিয়েন্ট টাইমে নাকি যারা আমাদের মতন ছিল, তারা নাকি এইভাবেই কথা বলতো। একে বলে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ, প্রিহিস্টোরিক যুগে নাকি এসব শেখাবার স্কুল ছিল। হ্যাণ্ডট্যাবের যুগে সে সব বন্ধ হয়ে যায় আগেই। মা অনেক অ্যানসিয়েন্ট স্ক্রিপচার ডেটামেমরিড করিয়ে এগুলো শিখেছে, আর আমাকে শিখিয়েছে। আমরা ছাড়া এই ল্যাঙ্গুয়েজ আর কেউ জানে না। সমস্ত ওল্ড স্ক্রিপচার্স মায়ের কাছেই। আর কেউ শিখতেও পারবে না, হি হি হি, মজার না?.

     ওই দ্যাখো মা ডাকছে, লিলিতা আন্টি হেসে হেসে কি যেন বলছে মা কে। যাই দেখে আসি।

৩০শে জুলাই, ৩০১৬:

     আজ আমার মন খারাপ। মা বকেছে। স্কুলে ভর্তি করতে যেতে কে বলেছিল বলো? বাড়িতেই পড়ছিলাম তো দিব্যি। স্কুল থেকে যদি বলে যে ডিফেক্টিভ চাইল্ডদের জন্যে ওরা সিলেবাস পাল্টাতে পারবে না,  সেটা কি আমার দোষ? মা টাও কি বোকা দেখো। উইন্ডো-শিল্ড খুলে বৃষ্টি দেখছে আর কাঁদছে। মা কাঁদলে আমার ভালো লাগে, বলো? যাই,  মা কে একটু আদর করে আসি কেমন? 

১ জানুয়ারি,  ৩০২২:

     আরেকটা ক্লান্তিকর নিউ ইয়ার। আবার সেই একঘেয়ে ননসেন্স নাচ গান, চেঁচামেচি, হেঁড়ে গলায় হল্লা। আজকাল একটু বিরক্তিকরই লাগে। তাও নিজেরা আয়োজন করলে বুঝতাম। এখন সব উৎসবই কান্ট্রি, স্টেট বা লোকাল এরিয়া কমান্ডের আয়োজনে হয়। সেখানে লোকজন হাস্যকর রকমের লোকদেখানো আনন্দ করে। দেখে রাগও ধরে, হাসিও পায়।

     হিস্ট্রিতে পড়েছি যে পাঁচশো বছর আগের বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবারই কথা ছিল। এই ছোট্ট গ্রহটাকে উড়িয়ে দিতে কি লাগে, দু তিনটে ট্রাইনিট্রিয়াম বোমা ছাড়া? সৌভাগ্যবশত যারা যুদ্ধ করছিল, রুশেশিয়ান কনফেডারেট আর ইউরোমেরিকা অ্যাক্সিস, কেউই অত দূর যায়নি। তবে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি, পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি লোক মারা যায়। তারপর না খেয়ে আর মহামারীতে উজাড় যায় আরও বেশকিছু দেশ। আর ততদিনে সমুদ্রের জল বেড়ে আইসল্যান্ড আর গ্রিনল্যান্ড জলের তলায়, দক্ষিণ ইউরোপিয়ান ল্যাণ্ডপ্লেসও তাই। তবে রুশেশিয়ারও ক্ষতি কম হয়নি। সাউথইস্ট এশিয়ার প্রায় পুরোটাই জলের তলায় ভেসে যায়, শুধু তাতেই সত্তর কোটির কাছাকাছি লোক  মারা গেছিল।  সব মিলিয়ে বড় কর্তাদের বড় ধরণের টনক নড়ে। ফলে তখন সব বড় বড় নামকরা রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের মধ্যে বসে এই সেন্ট্রাল কমান্ডের ব্যাপারটা চালু করতে বাধ্য হয়। 

     এই সেন্ট্রাল কমাণ্ডের হেড কোয়ার্টার প্রাচীন শহর জেরুজালেম।  

     সেই থেকে সারা পৃথিবী জুড়ে এখন শাসন করে সেন্ট্রাল কমান্ড। তাদের বিপুল প্রতাপ, ঈশ্বর বললেই চলে। তার অধীনে কন্টিনেন্ট কমান্ড, আবার কন্টিনেন্ট কমাণ্ডের অধীনে কান্ট্রি কমান্ড। এই হতে হতে শহর জুড়ে সিটি কমান্ড আর তাদের অধীনে কয়েকটা করে লোকাল কমান্ড। দেশ বিদেশ বলে কিছু নেই, তাই সেনাবাহিনী বলে কিছু নেই। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনী আছে, লোকপ। তাদের দাপট দেখলে অবশ্য মাঝেমধ্যে বেশ রাগই ধরে।

     মজাটা হলো কি, সেই থেকে জীবনযাত্রার বেশ কিছু অংশ আর আমাদের হাতে রইলো না, কমাণ্ডের হাতে চলে গেলো, যেমন বিভিন্ন উৎসব, জীবনযাত্রার ন্যূনতম উপকরণ ইত্যাদি।

     

     আর পৃথিবীর সবাইকে আয়, সামর্থ্য, ক্ষমতা, কমিউনিটিতে তাদের অবদান ও প্রয়োজন ইত্যাদি দেখে চার ভাগে ভাগ করে ফেলা হলো, সাব-নর্মাল, নর্মাল, প্রিভিলেজড আর সুপার। প্রত্যেকের কাছে সেই অনুযায়ী কার্ড আছে। এই ডিজিটাল কার্ড ছাড়া বেঁচে থাকাই মুশকিল। এটাই এখন সবার আইডেন্টিটি, সবার পরিচয়। 

     যেমন ধরুন আমি আর মা, আমাদের কার্ড সাব-নর্মাল। আমাদের কি আর সাধ্য আছে যে দোকানে গিয়ে ইচ্ছেমতন যা কিছু কিনবো? না হোটেলে গিয়ে খাবো? আমরা হলাম সাব-নর্মাল কার্ড হোল্ডার, সাব-হিউম্যানদের মতই প্রায়। নর্মাল কার্ড হোল্ডার আর আমরা, আমরা কেউই র‍্যাশনের বাইরে কেনাকাটা করতে পারি না। নিজেদের পছন্দমত কিছুই কিনতে পারি না, সে পছন্দের বডি-ক্লিন জেল হোক বা সোল-সাইকেল, কি হোভারকার। আমাদের পড়াশোনা লোকাল এডুসেন্টারে, মেডিসার্ভিস হয় লোকাল হেলথপয়েন্টে। জামা জুতো থেকে শুরু করে র‍্যাশনড খাবার, বেডর‍্যাপার, বডি-ক্লিন জেল, সবই কমান্ড থেকে সাপ্লাই দিয়ে যায়। এমনকি খাওয়ার জল অবধি।

     একদিক দিয়ে অবশ্য ভালো, না খেয়ে কাউকে মরতে হয় না। 

     আর যাদের প্রিভিলেজড বা সুপার কার্ড আছে? আহা তারা হলো গিয়ে সমাজের মাথা। তাদের জন্যেই তো সব সুবিধা গো! ইচ্ছেমতন দামী স্টাডি-ভার্সিটিতে পড়াশোনা করার সুবিধা, ইচ্ছেমতন খাবার সুবিধা,  স্পেশাল মেডিসার্ভিস, ফি বছরে স্পেশাল দামি হোভারকার, দামি জামা, জুতো, স্পেশাল সুগন্ধি বডিফ্র‍্যাগ….

     মাঝে মধ্যে খুব রাগ হয় কার্ড-বন্দী এই দুনিয়ার ওপর। গত সপ্তাহেই আমার ষোল বছরের জন্মদিন গেলো। মা গেছিলো পাশের বিল্ডিং এর সুসাহনিভাই-এর কাছে, যদি চুপিচুপি ওর প্রিভিলেজড কার্ডটা নিয়ে আমার জন্যে একটা সস্তা মেন্টালকল কেনা যায়। এখনকারটা দশ বছরের পুরনো কি না! 

     

     এই নোংরা লোকটার কি অবিশ্বাস্য স্পর্ধা, মাকে বলেছে বোবা মায়ের বোবা ছেলে মেন্টালকল দিয়ে কি করবে? বরং লোকাল কমান্ডকে বলে আরো দুটো ফ্রি হ্যাণ্ডট্যাব চেয়ে নিই না কেন? 

     সারা রাত মা আমাকে জড়িয়ে কেঁদেছিল। বিশ্বাস করুন, বোবা মায়ের কান্নাও আপনাদের মায়ের কান্নার মতন।

৫ই জুন,  ৩০২৬:

     অবিশ্বাস্য!  অভূতপূর্ব!  অসাধারণ!  

     খবরটা পেলাম আজ লোকাল লাইব্রেরিতে আমার কোর্স করতে গিয়ে। লাইব্রেরিতে লোকাল এডুকম থেকে আমার জন্যে একটা থ্রিডির‍্যাক্টিভ কিউবিকল বানিয়ে দিয়েছে। কনসোলটা মাথা গলিয়ে পরে নিলেই হলো। সব কোর্স হ্যাণ্ডট্যাব হয়ে ফ্যামিলিএডুমেমএ জমা হয়ে যায়। কোর্স-ওয়ার্কও ওইভাবেই জমা নেয়। 

     আজ থ্রিডি এনক্লোজারে ঢুকতেই সে কি হই-হট্টগোল! সবাই চেঁচাচ্ছে, হাসছে, লাফাচ্ছে, একে অন্যের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে, সে এক অনবদ্য দৃশ্য! মনোকেল চালিয়ে আসার সময়েই অবশ্য দেখেছিলাম সব জায়গায় একটা খুশিখুশি ভাব। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষী,মানে লোকপগুলোর পাথুরে মুখে অবধি মৃদু হাসি। ব্যাপারটা এবার বোঝা গেলো! 

     পুরো ব্যাপারটা শুনে অবশ্য আমিও সবার মতই খুব উত্তেজিত। আহা, জেন্ট-ইঞ্জিনিয়ার ইয়ুয়ানচন্দ্রার জয় হোক। এই যুগের তিনিই শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক। 

     শুনেছি আজ থেকে হাজার বছর আগের সায়েন্সোলজাররা, যেমন আর্থার সি ক্লার্ক বা আইজাক আসিমভরা, বলেছিলেন মানুষের অন্য গ্রহে পাড়ি জমানোর কথা, সমুদ্রের তলায় থাকার কথা। যদিও এখন সেটা আমরা চাইলেই পারি, কিন্তু দরকার হয় নি। পর পর তিনটে বিশ্বযুদ্ধের ফলে এখন পৃথিবীর জনসংখ্যা দুশো কোটির বেশি না। ল্যাণ্ডমাস গত পাঁচশো বছরে অনেক কমে গেলেও দুশো কোটি লোকের জন্যে যথেষ্ট। যথেষ্ট ফরেস্ট-প্লেসও বাঁচিয়ে রাখা আছে। মানুষ সবাই ছোট ছোট শহরে থাকে, সিটি-সেন্টার বলি আমরা, ভিলেজগুলোতে শুধু রোবট দিয়ে চাষবাস হয়, সেন্ট্রাল কমাণ্ডের এগ্রিডিটি ডিপার্টমেন্টের কড়া নজরে। আগেই বলেছি, প্রায় সব রিসোর্সই র‍্যাশনড। ফলে না খেয়ে কেউ মরে না। 

     শুধু একটা জিনিস মানুষ পারতো না। 

     চিরযৌবন। ইচ্ছেমতন একটা বয়েসে অনেকদিন আটকে থাকা। মৃত্যুকে পিছিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা।

     এইবার সেটা পারবে!  

     ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। মা’ চিরদিনই আমার কাছে এইরকম থাকবে? ইয়া হুউউউউ। যত দামিই হোক, যতই পাউরোই লাগুক, আমাকে এই টেকনোলজি পেতেই হবে, পেতেই হবে, পেতেই হবে! 

১০ই জুন,  ৩০২৬:

     নাহ, যতটা ভেবেছিলাম, ততটা আনন্দের খবর নয়।

     জেন্ট-ইঞ্জিনিয়ার  ইয়ুয়ানচন্দ্রা যেটা আবিষ্কার করেছেন, সেটা একধরণের ইলেক্ট্রো-কেমিক্যাল কমপাউণ্ড। একটা প্রেশারাইজড কিউবিকলে ঢুকে একটা শট নিতে হয়। এক একটা শটে মানুষ তার বর্তমান অবস্থায় একশো বছর বাঁচতে পারে। একশো বছর পর আরেকটা শট, আরও একশো বছর। মানে যে কেউ চাইলে প্রতি একশো বছর অন্তর শট নিয়ে নিয়ে আদি অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারে।

     এতটা অবধি ঠিক ছিল, কিন্তু এর পরেই যেটা শুনলাম তার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

     প্রচুর পাউরো ছাড়াও আরও একটি জিনিস লাগে এই লাইফ-শটের জন্যে, আরেকটি মানুষের প্রাণ!!!

     আরেকজন জীবিত মানুষের শরীর থেকে তার ইলেক্ট্রো-কেমিক্যাল লাইফজিস্ট বার করে সেই নিয়েই লাইফ-শট তৈরি হয়। বৃদ্ধ, যুবক, পুরুষ, মহিলা, সুস্থ, নীরোগ সব চলবে, শুধু জীবিত হওয়া চাই। বলা বাহুল্য যে লাইফজিস্ট বার নেওয়ার পর কারও বেঁচে থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। 

     মানে একটি প্রাণসংহার না করে কেউ একশো বছর বেশি তার জীবন বাড়াতে পারবে না। কেউ যদি পাঁচশো বছর বাঁচতে চাও তো পাঁচটা প্রাণ! 

     ল’ অফ কনজার্ভেশন অফ লাইফ! 

     আশা করি সেন্ট্রাল কমান্ড এইসব শোনা মাত্র এই সর্বনাশা আবিষ্কারের অ্যাপ্লিকেশন অ্যাপ্রুভাল প্রত্যাখ্যান করবেন। একজন মানুষের জীবনের বিনিময়ে আরেকজনের বেশিদিন বেঁচে থাকার মতন ঘৃণ্য টেকনোলোজিতে কোনও সভ্য মানুষেরই সায় থাকা উচিৎ নয়।

৫ই অগাস্ট,  ৩০২৬:

     খারাপ খবর। সারা দুনিয়া জুড়ে এত অনুরোধ উপরোধ সব বিফলে গেলো। সেন্ট্রাল কমাণ্ডের টেকঅ্যাড কমিটি পৃথিবীজোড়া অসন্তোষ উপেক্ষা করে লাইফ-শটকে বৈধ ঘোষণা করেছে! লেখাটা লিখে আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না। অন্যের প্রাণ কেড়ে নিজের বিলাসী জীবন কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে ভোগ করার এই জঘন্য বর্বর স্বার্থপর আবিষ্কার এরা অ্যাপ্রুভ করলো কি করে? মানবতাবাদ বলে কি আর কিছুই অবশিষ্ট নেই?

     ইঞ্জিনিয়ার চন্দ্রাকে দোষ দিই না, উনি বৈজ্ঞানিক, বোধহয় গত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক। ওঁর কাজ আবিষ্কার করার, আবিষ্কার করেছেন। সেন্ট্রাল কমাণ্ডের প্রধান অ্যাডমিনিস্ট্রেটররা কি করছেন? তাঁরা না বিশ্বনেতা? ফার্স্ট কমান্ডেন্ট গোয়েলস্ফাইন কি করছেন? তিনি তো আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাঁকে তো ভালো লোক বলেই জানতাম। তিনিও চুপ করে আছেন? 

     সোশ্যাল-প্লেস মাইন্ড-বুক ভেসে যাচ্ছে ছিছিক্কারে, বিদ্রূপে আর কমিক-স্ট্রিপে। সারা দুনিয়া জুড়ে মাইণ্ডবুকে ঝড় উঠেছে বুঝতে পারছি। যাই, একবার কলইন করে দেখি, কেসটা কি? 

২৯শে সেপ্টেম্বর, ৩০২৬:

     ব্যাপার আরও ঘোরালো হয়ে উঠেছে।

     আজ খবরে প্রকাশ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ওষুধের কোম্পানি মেড্র‍্যাগন এই আবিষ্কার কিনে নিয়েছে। আরও বড় খবর হলো যে সই করার পর থেকেই ইঞ্জিনিয়ার চন্দ্রাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। না তাঁর বিলাসবহুল লাইভমেন্টে, না তাঁর ওয়ার্ক-স্পেসে। লোকপ বাহিনীর টপঅপস ডিভিশন নামানো হয়েছে ওঁর খোঁজে।

     

     এদিকে মাইণ্ডবুকে ছিছিক্কারে আর কান পাতা যাচ্ছে না। প্রায় সবাই মনে করছে মেড্র‍্যাগন আর সেন্ট্রাল কমান্ড মিলে গুম করেছে লোকটাকে। বিপুল পাউরো ঢেলেছে নাকি মেড্র‍্যাগন, এই লাইফ-শট টেকনোলজি কেনার জন্যে। যাতে করে ম্যাজিশিয়ান চন্দ্রা পরে আর কোনোভাবেই না বাগড়া দিতে পারেন, তাই এরা আর ঝুঁকি না নিয়ে লোকটাকে হাপিশ করে দিয়েছে। 

     ওদিকে মা ডাকছে, ওয়ার্ল্ডভিশনে সেন্ট্রাল কমাণ্ডের নতুন কি সম্প্রচার শুরু হবে যেন। যাই, শুনে আসি। 

৩০শে সেপ্টেম্বর, ৩০২৬:

     সারা দুনিয়া স্তব্ধ। এরকমও হয়? ছিঃ। নিজেকে মানুষ বলতে আর ইচ্ছে করছে না। 

     মেড্র‍্যাগন ঘোষণা করেছে যে তারা সেন্ট্রাল কমাণ্ডের সমস্ত কমান্ডেন্টদের ফ্রিতে লাইফ-শট দেবে। তারপর সমস্ত সিটিজেনদের জন্যে এই ‘সুবিধা’ দেওয়া শুরু হবে। তবে যথারীতি প্রিভিলেজড আর সুপার কার্ড-প্রাপ্তদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তারা কোথা থেকে জীবনদাতা আনবে সেটা তাদের ব্যাপার। কি নির্লজ্জ ঘুষখোরদের কাজকারবার! 

     এতেই শেষ নয়। 

     সেন্ট্রাল কমান্ড ঘোষণা করেছে তাদের কমান্ডেন্টদের জন্যে লাইফজিস্ট নেওয়া হবে মৃত্যু-দণ্ডাজ্ঞা পাওয়া আসামীদের থেকে! এবং এখানেই আমার তীব্র আপত্তি আছে। এদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল এদের অপরাধের শাস্তি হিসেবে। এদের প্রাণ কি সেন্ট্রাল কমান্ডের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নাকি? কি নৃশংস, কি নির্মম, কি হৃদয়হীন পাষণ্ড এরা!

     তবে এর বিনিময়ে নাকি সেই অভাগাদের পরিবার পরিজনদের এককালীন কিছু পাউরো ধরিয়ে দেওয়া হবে। আহা, কর্তাদের দয়ার প্রাণ! 

     মাইণ্ডবুক পুরো ফুঁসছে, দিকে দিকে এই সেন্ট্রাল কমাণ্ডের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেওয়া চলছে। ওয়ার্ল্ডভিশনেও ইতিউতি বিক্ষোভের খবর পাওয়া যাচ্ছে। লোকপগুলো অবশ্য বিরামহীন ভাবে পেটানোর জন্যে বিখ্যাত।

১৫ই নভেম্বর, ৩০২৬:

     আজ লাইফ-শটের প্রথম সার্থক প্রয়োগ হলো। নিলেন ফার্স্ট কমান্ডেন্ট গোয়েলস্ফাইন। তাঁকে অবশ্য খুবই অসুস্থ ও কৃশ দেখাচ্ছিল। লাইফ-শট নেওয়ার পর উনি পৃথিবীর সবার শুভবুদ্ধির উপর আস্থা রেখে এবং বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতি কামনা করে ভাষণ দিলেন। 

     অসুস্থ লাগছে। মা আজ সারাদিন কিছু খায় নি, চুপচাপ শুয়ে আছে। দেখি কিছু খাওয়ানো যায় কি না।  আমারও খেতে ইচ্ছে করছে না যদিও। 

     আজকের দিনটা মানবসভ্যতার ইতিহাসে নিশ্চিতভাবে একটা কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। 

১৫ই নভেম্বর, ৩০৩১:

     আজ লাইফ-শট টেকনোলোজির পাঁচ বছর হলো। প্রতি সপ্তাহে একজন করে কমান্ডেন্টকে দিয়ে দিয়ে প্রায় আড়াইশো জনের সেন্ট্রাল কমান্ডেন্ট বাহিনী আজ সম্পূর্ণভাবে লাইফশটেড। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামীও আর কেউ নেই। তাদের ‘স্যাক্রিফাইটার’ উপাধি দেওয়া হয়েছে। 

     নাহ। কোত্থাও কোনও ঝুট-ঝামেলা নেই। মাইণ্ডবুক এখন অন্য কিছু নিয়ে চঞ্চল। ওয়ার্ল্ডভিশনে এখন স্ট্রোবো খেলার নতুন সিজনের কম্পিটিশন সম্প্রচার চলছে।

     আকাশ নীল। মৃদু হাওয়া বইছে। নিচে বাচ্চারা খেলছে। মা বোধহয় কার সঙ্গে কথা বলছে। অনেকদিন পর মা’কে হাসতে দেখলাম। আকাশ বাতাসে পরম শান্তি। 

     ইঞ্জিনিয়ার চন্দ্রাকে আজও খুঁজে পাওয়া যায় নি।

     আজ রাতে ওয়ার্ল্ডভিশনে সেন্ট্রাল কমান্ডের নতুন কি একটা ঘোষণা আছে। দেখি কি বলে।

১৬ই নভেম্বর, ৩০৩১:

     সারা পৃথিবী রাগে ফুঁসছে। কাল রাত থেকেই বিভিন্ন জায়গায় বিপুল পরিমাণে লোকপ মোতায়েন করা হয়ে হয়েছিল, কিন্তু তাতেও আটকানো যাচ্ছে না। লেজার-শক, লাইট-ক্যানন, উইণ্ডব্লাস্ট, কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না উগ্র হয়ে পড়া প্রতিবাদীদের।

     কাল রাতে সেন্ট্রাল কমান্ড জানায় যে এবার থেকে সমস্ত সুপার কার্ড হোল্ডারদের লাইফ-শট দেওয়া হবে। এবার থেকে আর সপ্তাহে একজন নয়। রোজই দেওয়া হবে। আপত্তি তাতেও ছিল না। ঘোষণার পরবর্তী অংশ শুনেই আগুন জ্বলে ওঠে।

     সেন্ট্রাল কমান্ড ঘোষণা করেছে যে এবার থেকে সুপার কার্ড হোল্ডারদের জন্যেও জীবনদাতা সেন্ট্রাল কমান্ডই জোগাড় করে দেবে। আর জীবনদাতা জোগাড় হবে যেসব লোক ডেথ-উইশ লিস্টে নাম লিখিয়েছেন, বা যাঁদের আর বাঁচার আশা নেই এমন লোকেদের মধ্যে থেকে। পরে আর কাদের কাদের এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় তা বিবেচনা করে দেখা হবে!  

     মানে পাঁচ বছর আগে যা ঘোষণা করা হয়েছিল তা আর বৈধ রইলো না! সুপার কার্ড-হোল্ডাররা কমিউনিটির বড় বড় মাথা, তাঁদের জীবনদাতা খুঁজে বেড়াবার মতন তুচ্ছ কাজে ব্যস্ত থাকলে চলে? সদাশয় সেন্ট্রাল কমান্ডই সেই গুরুদায়িত্ব নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন! 

     ব্যক্তিগত স্বার্থে কমিউনিটির সার্বিক ক্ষমতা ব্যবহার করার এরকম নির্লজ্জ অপচেষ্টা শেষ কবে হয়েছে কে জানে! সেন্ট্রাল কমাণ্ডের কমান্ডেন্টদের লাইফ-শট দেওয়ার জন্যে জীবনদাতা খুঁজে দেওয়াটা তাও মানা যায়, হাজার হোক তাঁরা সিটিজেন-কমিউনিটির মাথা। সেন্ট্রাল কমান্ড কারও একার নয়, সবার। কিন্তু এটা কি? কিসের খেলা চলছে পর্দার আড়ালে? 

৩১শে মার্চ, ৩০৩৯:

     কাল রাতে পিতরসেফাস এসেছিল, রেজিস্টেন্সের একজন মেম্বার। অনেক কোডেড আলোচনা হলো। হ্যাণ্ডট্যাবে নয়, লিখে। সেন্ট্রাল কমাণ্ডের নজর এড়িয়ে এখন কোনও ডিজিকমে এইসব আলোচনা চলতেই পারে না। অগত্যা প্রাগৈতিহাসিক পদ্ধতিই ভরসা। 

     গত আট বছর ধরে ধীরে সেন্ট্রাল কমান্ড আরও বিভিন্ন আইনকানুন জারি করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট। এই বর্তমান সেন্ট্রাল কমান্ড আজীবন এই ক্ষমতা ভোগ করে যেতে চান, লাইফ-শট ছিল তার প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। এর পরপরই সেন্ট্রাল কমান্ডকে অপরিবর্তনীয় ঘোষণা করা হয়েছে, ভোটাভুটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গ্লোবাল অ্যাডভাইজরি কমিটিতে শুধুমাত্র কর্তাভজা কিছু সুপারকার্ডহোল্ডারদের নেওয়া হয়েছে। বাকিদের সমস্তপ্রকার ভোটাধিকার নিষিদ্ধ।

     এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় সেন্ট্রাল কমাণ্ডের বিরুদ্ধে গোপনে বিদ্রোহীরা সংগঠিত হতে শুরু করেছে। কয়েক জায়গায় বিক্ষিপ্ত হামলাও হয়েছে। জবাবে আরও প্রতিশোধ-পরায়ণ হয়েছে সেন্ট্রাল কমান্ড, আরও হিংস্র। সেন্ট্রাল কমান্ডের চোখে এখন যাবতীয় অবাধ্যতা আর বিদ্রোহের একটাই শাস্তি,  মৃত্যুদণ্ড! 

     এইসব মৃত্যুদণ্ড যাতে দ্রুত কার্যকর করা যায় তার জন্যে বিশেষ জাস্টিস্কোর্টও বসানো হয়েছে। কে না জানে, মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামীদের তো একটাই ভবিতব্য,  অনিচ্ছুক জীবনদাতা হওয়া। 

     আমাদের এই এলাকার রেজিস্টেন্সে আমাকে বাদ দিয়ে আরো বারোজন আছে। যেমন এই পিতরসেফাস, তারই ভাই আঁদ্রুসেফাস, আলফাপুত্ত, ইয়ুদাসিওট ইত্যাদি।  

     পিতরসেফাস বেরিয়ে যাচ্ছিল আলোচনা-শেষে। এমন সময় ওর মেন্টালকলে মেরিডিলিওনের ফোন, “এখুনি ওয়ার্ল্ডভিশন খোলো, সেন্ট্রাল কমাণ্ডের নতুন আদেশ”, বলেই ফোন কেটে দিলো।

     দ্রুত হাতে ওয়ার্ল্ডভিশন অন করলো পিতরসেফাস।

     দশ মিনিটের একটা মেসেজ। বুঝে গেলাম, আমার আর আমার মায়ের বেশিদিন আর নেই।

১৪ই এপ্রিল, ৩০৩৯:

     আমি আর মা চুপ করে বসে আছি। ঘর অন্ধকার করে। 

     মা আমার হাত ধরে আছে। মায়ের এই ছোঁয়াটা আমি চিনি। মা বলতে চাইছে খোকা ভয় পাস না,  আমি আছি তো। কিন্তু আমি জানি এবার শুধু মা কেন, কারো পক্ষেই কিছু করা আর সম্ভব না। 

     গতকালের ঘোষণায় সেন্ট্রাল কমান্ড বলেছে যে এবার থেকে সমস্ত জন্মগত ভাবে শারীরিক ত্রুটিযুক্ত লোকজনকে “সমাজের পক্ষে অবাঞ্ছনীয় বলে ধরা হলো এবং তাদের জীবন-দাতাদের সম্ভাব্য লিস্টে গণ্য করা হবে”। মানে এক-এক ধাক্কায় আমাদের মতন সত্তর-আশি জন জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী লোকজন জীবনদাতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলাম আর কি! কারণ আমরা সমাজের বোঝা! আমাদের থাকা না থাকার কোন মূল্যই নেই, আর যদি থাকেও বা, তাতে কার কিই এসে যায়?

১লা জুন, ৩০৩৯:

     তিরিশ-জন, তিরিশ-জন মানুষ। জোয়ান বুড়ো, ছেলে মেয়ে, ওয়েস্টার্ন হেমিপ্লেসের  কি ইস্টার্ন হেমিপ্লেসের। এদের মধ্যে দুটোই  মিল। এক, এরা সবাই শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী ছিলেন, আর দুই আজ এঁরা কেউ বেঁচে নেই। 

     লোকাল রেজিস্টেন্সের সবাই অবশ্য অনেকবার বুঝিয়েছিল। সারা পৃথিবীজোড়া সেফআউটস আছে ওদের। বলেছিল পালিয়ে যেতে, যদ্দিন এই রাক্ষসদের হাত এড়িয়ে থাকা যায়। আমি শুনেই নাকচ করে দিয়েছি। মায়ের বয়েস হয়েছে, এই পলাতকের জীবন বেশিদিন সহ্যই করতে পারবে না। আর আমারও তেত্রিশ বছর বয়েস হলো। এই বোবা জীবন নিয়ে কতদিন আর পালিয়ে বেড়াবো?  আর এই দুই বোবা মা ছেলের জন্যে রেজিস্টেন্সকে এত ঝুঁকির মধ্যে ফেলাটাও কোনও কাজের কথা নয়।

     দরজায় কেউ সিগন্যাল দিচ্ছে। দেখি কে এলো।

১৩ই জুন,  ৩০৩৯:

     সেদিন আলসেবিদিয়াস এসেছিলেন, ইস্টইণ্ডিয়ানাল্যাণ্ডের লোকপ বাহিনীর হেডকপ।

     এমনিতে লোক ভালো। মুখে যেন মধু ঝরছে সবসময়। এসে আমি কেমন আছি, মা কেমন আছেন, ইত্যাদি দু-একটা খেজুরে আলাপের পর দ্রুত আসল প্রসঙ্গে ঢুকে গেলেন। প্রসঙ্গটা অবশ্য আন্দাজ করতে আমার অসুবিধা হয় নি। শুধু ভাবছিলাম এত সাবধানতা নেওয়া সত্ত্বেও এরা জানলো কি করে? 

     এনার কথাতেই অবশ্য উত্তরটা পেয়ে গেলাম। সেদিন যে কাগজের টুকরোটায় আমি আর পিতরসেফাস কথা লিখে রাখছিলাম, সেটা পোড়ানোর বদলে ছিঁড়ে ময়লা ফেলার ব্যাগে ফেলা হয়েছিল, সেটাই কাল হলো। এরা অনেকদিনই তক্কেতক্কে ছিল, কাগজের টুকরোটাকরা গুলো নিয়ে পাজলডিকোড করতে ওদের কম্পিউটার বোধহয় সেকেন্ডের ভগ্নাংশের বেশি সময় নেয় নি।

     অনেক ধানাইপানাই করে যখন বুঝলেন যে এতে চিঁড়ে ভিজবে না, তখন একটা টোপ ফেললেন, যদি রেজিস্টেন্সের বাকি মেম্বার্সদের নাম ঠিকানা বলে দিই, তবে আমার আর আমার মায়ের নাম জীবন-দাতার লিস্ট থেকে বাদ দেওয়া হবে! 

     আমি বোধহয় একটু জোরেই হেসে ফেলেছিলাম। তেত্রিশ বছর বয়সী একটা ছেলে এইরকম শিশুভোলানো কথা বিশ্বাস করে দলের সঙ্গে বেইমানি করবে, এটাও যে উনি ভাবতে পেরেছেন দেখে হাসিই পাচ্ছিলো। মা কে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে বললাম কথাটা। মা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজেই জবাব দিলো, “এই জন্তুটাকে যেতে বল, ঘরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।”

     ভদ্রলোক খানিকক্ষণ জুলজুল করে দেখলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন যে হাত পা ঠোঁট নেড়ে আমরা কি করছি? আমিও সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের কথাটা বলে দিলাম। ইনি বোধহয় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের নামই শোনেননি,  শোনার অবশ্য কথাও নয়। খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে থেকে ফের স্বাভাবিক গলায় সেই একই প্রশ্নে ফিরে গেলেন। আমার এবার বেশ বিরক্ত লাগছিল। ফলে একটু কড়া করেই বলতে হলো যে কোনও ধরণের রেজিস্টেন্সের সঙ্গে আমার কোনোদিনই কোনও সম্পর্ক ছিল না। ওই কাগজের টুকরো ওঁরা কোত্থেকে পেয়েছেন সে নিয়ে আমার কোনও আইডিয়া নেই। আমি কোনরকমভাবে কোনও হেল্প করতে পারবো না।  

     ভদ্রলোক চলে গেলেন বটে, কিন্তু যে চাউনিটা দিয়ে গেলেন, সেটা সুবিধার নয়। 

২৯শে জুন, ৩০৩৯:

     অবেক্ষণ পর বহুকষ্টে বাঁ চোখটা খুলতে পারলাম। সারা শরীরে ব্যথার ছোবলে টাটিয়ে আছে। হাঁটু আর কনুইগুলোতেই মেরেছে বেশি, সামান্য নড়াচড়াতেই মনে হচ্ছে মরে যাবো। ঠোঁটের বাঁদিকটা ফেটেছে বিশ্রীভাবে, সে বুঝতেই পারছি। জিভে নোনা ঠেকছে এখনও। 

     মা কে ওরা কাল নিয়ে গেছে, কোন এক বড়লোক ট্রেডিং-মাস্টারের স্ত্রীর লাইফ-শটের জন্যে। আমরা অবশ্য তৈরিই ছিলাম, কিন্তু ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটবে, বুঝিনি। আমি সাধ্যমতো মারপিট করেছিলাম অবশ্য, ফলাফল তো সারা শরীরে। ষোলোজন সশস্ত্র লোকপের সঙ্গে পেরে ওঠার কথাও ছিল না। 

     শুধু মাথার পেছনে লেজারশকটা খেয়ে যখন পড়ে যাচ্ছি, তখন অজ্ঞান হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে মায়ের চোখে চোখ পড়ে গেছিল। দেখলাম, সেই চোখে নিজের জন্যে মায়ের একটুও ভয় নেই, শুধু আমাকে মার খেতে দেখার কষ্ট আর আতঙ্কটা আছে।

     তোমাকে আর দেখতে পাবো না, তাই না মা? এতক্ষণে বোধহয় তুমি মরেও গেছো, তাই না? খুব কষ্ট হয়েছিলো গো মা? ব্যথা লেগেছিলো? 

     দুঃখ কোরো না মা, আমিও আসছি। বেশিদিন আর নেই।

 ১লা জুলাই, ৩০৩৯:

     আজ মা কে শেষ বারের মতন দেখলাম, ক্রিমেশনস্টেশনে। সাদা ডেথ-স্যুটে ঢাকা শরীরে শুধু মুখটুকু জেগে আছে আমার বুড়ি মায়ের। অসীম প্রশান্তির চিহ্ন সারা মুখে। আহা, কত কথাই না বলার ছিল মায়ের সঙ্গে, কত কথাই আর বলা হলো না। আর কখনও বলা হবেও না।

     একটু পরেই মায়ের বডিটা জ্বলন্ত ক্রিমেশনওভেনে ঢুকে যাবে। ছাই হিসেবে যেটুকু থেকে যাবে উড়িয়ে দেওয়া হবে কাছের কোনও ফরেস্ট-প্লেসে। 

     আজ আমি কাঁদছিলাম, হাউ হাউ করে কাঁদছিলাম। লোকপগুলো পাথরের মতন মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। বোবা মানুষের কান্না, কেই বা আর শোনে? 

১০ই সেপ্টেম্বর, ৩০৩৯:

     এরা বোধহয় ভেবেছে আমি পালিয়ে যাবো। চারিদিকে লোকপ বসিয়ে রেখেছে পাহারা দিতে। র‍্যাশন কালেক্ট করতে গিয়ে সেটা টের পেলাম।

     র‍্যাশন নিয়ে ফিরে আসছি, দেখি উত্তরের আকাশ কালো হয়ে আসছে। মেঘ নয়, মানে মেঘের কালো নয়। যেন আকাশটাই কেউ দখল করে নিচ্ছে। কি জানি কি বিষয়-বৃত্তান্ত।

১৫ই সেপ্টেম্বর,  ৩০৩৯:

     অ্যালিয়েন অ্যাটাক! পৃথিবীর ওপরে! আতঙ্কে থরথর কাঁপছে সারা পৃথিবী। 

     সেদিন উত্তরের আকাশ যে কালো হয়ে উঠতে দেখেছিলাম, ওটা আর কিছু নয়। অ্যালিয়েন স্পেস-শিপ আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছিলো। টাইম-স্পেস বাঁকিয়ে ওয়র্মহোল তৈরি করা, যা আজ অবধি আমাদের কাছে সায়েন্স ফিকশন হয়েই থেকে গেছে, সেই টেকনোলজি কাজে লাগিয়ে এরা হঠাৎ করে পৃথিবীর দোরগোড়ায় এসে হাজির! এত অল্প সময়ে ওজোন স্তরের ওপর অদৃশ্য জালের মতন ছেয়ে থাকা প্রোটেক্টিং স্যাটেনেট পেরিয়ে এরা যেভাবে চক্ষের নিমেষে হানা দিয়েছে তাতে আরও বোঝা যায় যে এদের টেকনোলজি আমাদের থেকে বহুগুণে উন্নত।

     এত দিনে সারা পৃথিবী জুড়েই ওদের কয়েক হাজার ইন্টার-গ্যালাক্টিক স্পেস-শিপ। সারা আকাশ জুড়েই, যেদিকে তাকাও না কেন সেদিকেই। বিষণ্ণ অমোঘ নিয়তির মত তারা জুড়ে আছে এই গ্রহের সমস্ত আকাশ, সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড। যেন অসহায় এই পৃথিবীকে দেখে ঠাট্টাতামাসা করতে এসেছে।

     মানে এরা যদি চায় আমাদের নির্মূল করে বসতি গড়তে, আমাদের চান্স খুবই কম। যাক, তাতে আমার আর কি। যত তাড়াতাড়ি মায়ের সঙ্গে দেখা হয় ততই মঙ্গল। আমার এতে আর কিছু এসে যায় না।   

২০শে নভেম্বর,  ৩০৩৯:

     সারা পৃথিবীজুড়ে চাপা দমবন্ধ করা একটা আবহাওয়া।

     এদের টেকনোলজি যে আমাদের থেকে বহুগুণে উন্নত, সে আর বলে দিতে হয় না। পৃথিবীর সমস্ত মারণাস্ত্র লঞ্চ করার সিস্টেম এরা মুহূর্তে লক করে দিয়েছে। পৃথিবীর যাবতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখন ঠুঁটো জগন্নাথ।

     মুশকিল হচ্ছে এদের কি দাবি, কেন এসেছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সেন্ট্রাল কমাণ্ডের আধুনিকতম কমিউনিকেশন সিস্টেম অনেক চেষ্টা করেও কোনও যোগাযোগ করতে পারছে না। কোনও উত্তর, কোনও সিগন্যাল, কিছুই নেই। মনে হচ্ছে কয়েক হাজার পাহাড় যেন নির্বাক নিয়তি নির্দিষ্ট অভিশাপের মতই এই পৃথিবীর আকাশ জুড়ে জমে আছে।

     যাক,  আমার কি, গোল্লায় যাক এই পৃথিবী,  যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। 

৩০শে নভেম্বর,  ৩০৩৯:

     আজ নাকি তেনাদের কেউ প্রথমবারের জন্যে দর্শন দিলেন। সারা পৃথিবীর সমস্ত নিউজ-ফিড আজ জেরুজালেমের রাস্তায়। স্বাভাবিক, পৃথিবীর এই এত হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবার কোনও ভিনগ্রহের জীব এই মাটিতে পা রেখেছে। তাদের দেখতে কেমন এই নিয়ে মানুষের কৌতূহল হওয়াটা স্বাভাবিক। দুনিয়ার বোধহয় আজ এমন মানুষ একটিও নেই যে ওয়ার্ল্ডভিশন খুলে বসেনি। 

     যদিও শেষে বোঝা গেলো সে গুড়ে বালি। স্পেস-শিপ থেকে তারা নেমে এসেছিলো অদ্ভুত দর্শন এক যানে। জেরুজালেমের রোবটিক্স ফিল্ডের মাঠে নেমে তারা ঢুকে পড়ে তাদের জন্যে বিশেষ ভাবে নির্মিত কালো কাঁচ-ঢাকা হোভারকারে। তারপর সেই হোভারকার সোজা ঢুকে যায় কোরকমান্ড অফিসে। পুরো ব্যাপারটা এত গোপনীয় রাখা হয় যে কেউই তাদের টিকিটিরও দেখা পায় নি।

     এদিকে আলোচনা কি হলো, কি এদের চাহিদা, কি পেলে এরা বিদায় হবে, বা আদৌ বিদায় হবে কি না এই নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সবাই খুবই উত্তেজিত। লোকপগুলোকেও দেখছি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে। সমস্ত এডুসেন্টার, স্টাডিভার্সিটি, হেলথ-পয়েন্ট, ওয়ার্ক-ক্লাউড সব বন্ধ। সারা পৃথিবীজুড়ে একটা ফিসফিসে ভয়ের আবহ ছড়িয়ে আছে যেন। হাজার হাজার গুজবে মাইণ্ডবুকে ছেয়ে যাচ্ছে, প্রত্যেকটার বিবরণ আগেরটার চাইতে অনেক ভয়াবহ।

     আজ রাতে স্বয়ং গোয়েলস্ফাইন ওয়ার্ল্ডভিশনে ভাষণ দেবেন। ওই শুরু হলো বোধহয়। দেখি কি বলে।

২রা ডিসেম্বর, ৩০৩৯:

     কিংকর্তব্যবিমূঢ় বলে একটা শক্ত শব্দ শিখিয়েছিল মা, ছোটবেলায়। সারা পৃথিবীর এখন সেই দশা। এরপর কি করা হবে কেউই কিছু বলতে পারছে না।

     সেদিন ভিনদেশীদের সঙ্গে কোনও কথাই হয়নি সেন্ট্রাল কমাণ্ডের। না, অন্য কোনও কারণ নয়, ভাষার অভাব। মানে পৃথিবীর কোনও মাইণ্ডরিডার, লিঙ্গুইস্টিকা কোন কিছু দিয়েই তাদের সঙ্গে কমিউনিকেট করা যাচ্ছে না। ফলে বিফল মনোরথ হয়ে তারা কাল চলে গেছে, এবং তার আগে শরীরী ভাষায় যেটা প্রকাশ করে গেছে, তার মানে আর যাই হোক বন্ধু-ভাবাপন্ন তাকে কিছুতেই বলা চলে না।

     অজান্তেই আমার মুখে হাসি চলে এলো। আমার মা’কে ওরা টেনে নিয়ে গেছিলো না দীর্ঘজীবন লাভের জন্য? আরও কত লোকের মা, বাবা, সন্তান, আত্মীয়পরিজন, ভালোবাসার লোককে এই সেন্ট্রাল কমান্ড মেরে ফেলেনি যাতে করে সমাজের কিছু মুষ্টিমেয় ক্ষমতাশালী লোক যেন অনেক অনেক বছর বাঁচে?  কোথায় গেলো এতশত ষড়যন্ত্র, এত নিবিড় নিষ্পেষণ, অসহায় লোকের এত কান্না? আজ তোমাদের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কে বাঁচাবে সেন্ট্রাল কমান্ড? কোন লাইফ-শট? 

     হা হা করে সেই অন্ধকার ঘরে বসে আমি হাসতেই লাগলাম, হাসতেই লাগলাম।

২৫শে ডিসেম্বর, ৩০৩৯:

     দুপুরবেলা যখন কান্ট্রি কমাণ্ডের লাইট-জেট থেকে জেরুজালেমে নামলাম তখন বেশ লালচে মিঠে ঠাণ্ডা চারিদিকে। নেমেই দেখি একটা দামি হোভারকার দাঁড় করানোই আছে, তাতেই চারজন টপঅপসের অফিসার আর আমাকে নিয়ে কোরকমান্ড অফিসের দিকে রওনা  আলসেবিদিয়াস, ইস্টইণ্ডিয়ানাল্যাণ্ডের লোকপ বাহিনীর হেডকপ। 

     আজ সকালে যখন ভদ্রলোক প্রায় জোর করেই আমার অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকেন, চারজন গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারার লোকপ নিয়ে তখনও আমার ব্রেকফাস্ট শেষ হয় নি। ঢুকেই ধরে-বেঁধে সোজা গাড়িতে চালান করার সময় আমি তো যেমন অবাক তেমন বিরক্ত। আজকেই কারও জীবনদাতা হতে হবে জানি, তা ধরে-বেঁধে নিয়ে যাওয়ার কি আছে? আরও আশ্চর্যের কথা যে তোরা দুদিন পর বাঁচবি কি বাঁচবি না তার ঠিক নেই, এখন আবার কার লাইফ-শট নেওয়ার বাই উঠলো?

     একবারই শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম যে যাচ্ছি কোথায়। উত্তর এসেছিল, “জেরুজালেম”,এবং তাতে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। 

     কোরকমান্ড বিল্ডিংটা দেখতে গোল গম্বুজের মতন, আর বেশ ঠাণ্ডা। ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম এখানেই কি অপারেশন? সেন্ট্রাল কমান্ডের সবারই ত লাইফ-শট সেই কবেই নেওয়া। তবে? 

     ভুলটা যখন ভাঙলো, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তখন আমি অবাক হওয়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি।

     বিল্ডিঙের একদম টপ ফ্লোরে যে বিশাল ঘরটায় আমাকে এনে হাজির করা হলো, এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায় যে এটাই সর্বোচ্চ কমান্ডান্টদের মিটিং রুম। রুমের চারিদিকে থ্রিডি ভিশনস্পেস, যে কোনও ঘটনার, যা চারিদিকে ঘটছে, তার ক্ষুদ্র ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছায়া ফুটে ওঠে। দেওয়ালে বিশাল স্ট্রিং-স্ক্রিন, পৃথিবীর বাইরের যাবতীয় খবর ধরার জন্যে। এখন অবশ্য সেই স্ক্রিন জুড়ে শুধু…..

     ঘরের মধ্যিখানে ভাসমান টেবিল। তার চারিধার ঘিরে পৃথিবীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা, সবারই মুখে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট।

     টেবিলের একদম মাথায় যে লোকটাকে দেখছি, তাঁকে আমি অনেকবার ওয়ার্ল্ডভিশনে দেখেছি।

     কমান্ডান্ট-ইন- চিফ গোয়েলস্ফাইন। 

     আমি সত্যি বুঝে উঠতে পারলাম না, আমাকে কেন এখানে আনা হয়েছে।

     শুরুটা গোয়েলস্ফাইনই করলেন, ওঁর সেই বিখ্যাত ওজস্বী কিন্তু সামান্য সানুনাসিক স্বরে, 

     “মাই বিলাভেড সিটিজেন, আমাদের মধ্যে আজ আপনাকে স্বাগত”।

     আমি হতচকিত অবস্থায় শুনতে লাগলাম, “আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে? কি বিপুল বিপদের মধ্যে আমরা সবাই এই মুহূর্তে বাস করছি?” মাথা নাড়তে নাড়তে প্রথমবার খেয়াল করলাম যে ভদ্রলোকের ভাষার উপর দখল  অসামান্য।

     “আপনি নিশ্চয়ই এও অবগত আছেন যে কয়েকদিন আগে আমাদের মধ্যে আর ভিনগ্রহীদের মধ্যে যে আলোচনার সূত্রপাত হয় তা শুরুতেই ভেঙে যায়?”

     মাথা নাড়লাম। জানি তো বটেই।

     “আপনি কি জানেন তার কারণ কি?”

     

     “দুই পক্ষেরই বোধ্য এমন ভাষার অভাব”, বলে নিজেই চমকে গেলাম। এমন শুদ্ধ ভাষায় শেষ কবে কথা বলেছি আমি? এটা আমারই হ্যাণ্ডট্যাব তো? 

     “চমৎকার। এবার বলুন তো, মাননীয় নগর-সভ্য, আপনার কাছে যদি আপনার এই মাতৃভূমি, এই পৃথিবী কিছু সাহায্য চায়, আপনি কি সেই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করবেন? আপনি কি চান না মানবসভ্যতার উদ্ধারকারী হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতে?”

     আরেকটু হলেই হাততালি দিয়ে ফেলছিলাম। অসামান্য বাকপটু এই ভদ্রলোক। তবে বক্তৃতা যতই ভালো দাও, তোমাদের বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে আমার বয়ে গেছে। তবুও নিছক কৌতূহলে জিজ্ঞেস করি, মানে হ্যান্ডট্যাবে ফুটে ওঠে “কি ধরণের সাহায্য, মাননীয় কমান্ডান্ট-ইন-চিফ?” 

     ভদ্রলোক থামলেন। তারপর হাতের ইশারায় বাকি কমান্ডান্টদের যেতে বললেন। খানিকক্ষণ বাদে ঘর খালি হলে খর্বকায় কৃশ ভদ্রলোকটি আমার কাছে এগিয়ে এলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “মাননীয় নগর-সভ্য, এই ভিনজাতীয় হানাদারেরা একটা ভাষাই বোঝে, যেটা একমাত্র আপনি ছাড়া এই পৃথিবীর দুশো কোটি জনগণের মধ্যে আর কেউ জানে না।”

     উত্তরোত্তর আশ্চর্য হচ্ছিলাম আমি, “মাননীয় চিফ, আমার জ্ঞানত এমন কোনও ভাষা আমি জানি না,  যা আর কেউ…….” 

     “সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ”, প্রায় চাপা ভুতুড়ে গলায় বললেন কমান্ডান্ট ইন চিফ,  “দে অনলি স্পিক অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ, যেটা এই মুহূর্তে আপনি ছাড়া আর কেউ জানে না আমাদের মধ্যে, মাননীয় নগর-সভ্য”।

     মুহূর্তের মধ্যে মাথাটা ঘুরে গেলো। তাই এত তোড়জোড়, আমাকে এখানে নিয়ে আসা। সেদিন থেকেই এরা জানতো, আর খোঁজাখুঁজি চলছিল। আলসেবিদিয়াস দেখেছিলেন আমাকে আর মা’কে…

     চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো মায়ের কথা মনে পড়তেই। নাহ, এদের সাহায্য করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই।

     “মাননীয় চিফ। আশা করি অবগত আছেন যে এই পৃথিবীতে আমার নিজের বলতে একজনই ছিলেন, আমার মা। শুধুমাত্র বোবা বলে….. ” 

     গোয়েলস্ফাইন দ্রুত এসে আমার হাত ধরলেন, “জানি নগর-সভ্য। এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ অবহিত। কিন্তু আমাদের, কয়েকজন মুষ্টিমেয় লোকেদের পাপের জন্য সমগ্র মানব সভ্যতাকে কি আপনি ধ্বংসের মুখে ফেলে দিতে চান? চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন নগর-সভ্য, এরা কি আপনার কেউ নয়?” 

     গোয়েলস্ফাইনের হাতের ইশারায় মুহূর্তে জ্বলে উঠলো চারিদিকের সমস্ত থ্রিডি ভিশনস্পেস। সেখানে দেখলাম অগুনতি মানুষের মুখ, আফ্রিকানাস, ইউরোমেরিকান, রুশেশিয়ান। বৃদ্ধ অধ্যাপক, তরুণ চাকুরে,  সাব নর্মাল প্রৌঢ় বাপ, প্রিভিলেজড আদুরে মেয়ে, দোকানদার থেকে শিক্ষক, লোকপ থেকে দরিদ্র হোভারকারচালক সবাই যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চুপ হয়ে, নিস্তব্ধ হয়ে, আমারই মতন বোবা হয়ে। যেন লক্ষ লক্ষ চোখ বলতে চাইছে…

     মিটিং রুমের কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে বিকেলের শেষ রোদ এসে যেন লুটিয়ে পড়লো আমার পায়ে। প্রায় শেষ হয়ে আসা দিনের আলোয় যেন এক অলৌকিক মন্ত্রের মতন  গোয়েলস্ফাইনের কথা আমার হ্যাণ্ডট্যাবে ফুটে উঠলো, “ইসরপুত্ত, আজ এদের দিকে তাকাও, এই লক্ষ মানুষের দিকে তাকাও। দেবে না, দেবে না তুমি এদের জীবন ফিরিয়ে? প্রতিশোধ কি তোমার বিবেক অন্ধ করে ফেলবে ইসরপুত্ত….” 

     আমি আর কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমি, মরিয়মের সন্তান ইসরপুত্ত, মায়ের আদরের যিশু, কি করবো? কি করবো আমি? প্রতিশোধের যে আগুন বুকে দাউদাউ করে জ্বলছে তাতে এদের ছারখার হতে দেবো? নষ্ট হয়ে যেতে দেবো এই গ্রহকে? নাকি এই ইসরপুত্ত যিশু হয়ে উঠবে দুশো কোটি লোকের শেষ ভরসা, একমাত্র আশ্রয়, মহত্তম মানুষ? 

     শেষ জীবনদাতা!  

Tags: অভীক সরকার, কল্পবিজ্ঞানের গল্প, জীবনদাতা, দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সুপ্রিয় দাস

5 thoughts on “জীবনদাতা

  • December 31, 2017 at 2:21 pm
    Permalink

    অসাধারণ বললে কম বলা হয়।
    ডিসটোপিয়ান সোসাইটি নিয়ে ভাবেনি এমন পাঠক নেই, কিন্তু তার সাথে রাষ্ট্রের পরবর্তী ধাপ,তার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আর প্রিভিলেজড ডেফিনিশনের ভ্রান্তি – সব মিলিয়ে দারুণ।
    প্রসংগত চীনে প্রস্তাব চলছে সিটিজেনদের প্রোডাক্টিভিটির ওপর ভিত্তি করে প্রায়রিটি দেওয়ার গ্রেডেশন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে।

    Reply
  • July 22, 2018 at 12:04 am
    Permalink

    কী আর বলব! ভাষাহীন হয়ে রইলাম গল্পটা পড়ে। ক্লাসিক জিনিস বস, ক্লাসিক জিনিস। বাংলায় এমন লেখা পড়তে পাওয়াও যে আমাদের কত বড়ো ভাগ্য…
    পরের লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

    Reply
  • December 21, 2018 at 6:13 pm
    Permalink

    concept to osmayno botei,choritro o bhasha sob e darun,mane khub khub bhalo galpo,khub e high standard.
    prosenjit

    Reply
  • April 11, 2020 at 3:15 pm
    Permalink

    অসাধারণ💯💯💯💯

    Reply
  • September 1, 2020 at 11:20 pm
    Permalink

    Excellent .

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!