প্রহর

  • লেখক: ড. সাম্য মণ্ডল
  • শিল্পী: সুপ্রিয় দাস

(১)

আমার সামনে একদিকে দিগন্তবিস্তৃত সফেন নীল জলরাশি, অপর প্রান্তে ধূসর সবুজ স্থলভাগের ক্ষীণ রেখা। আমার জন্মভূমি, আমার স্বদেশ। প্রায় ছ-টি মাসের সুদীর্ঘ জলবাসের পর একটাই প্রতীক্ষা থাকে সবার মনে, ঠিক কবে বাড়ি ফিরতে পারব। শেষের কয়েকটি দিনের অন্তহীন অপেক্ষার প্রহর যেন ফুরাতেই চায় না। আমরা সমুদ্র যাত্রীরা, একে অপরকে এই বলে আশ্বাস দিই যে আর তো মাত্র ক-টা দিন। তারপরই মুক্তি এই জলজীবনের বন্দিদশা থেকে…

     আজ পাঁচ-পাঁচটি দিন হয়ে গেল, স্বভূমির এত কাছে থেকেও আমরা জাহাজঘাটায় নোঙর করবার অনুমতি পাইনি! কোন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় এখনও তীরের অদূরেই অবিরত ভেসে আছি নীল জলে। মৃদুমন্দ স্রোতের ঠেলায় জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে আমি-সহ এই কার্গো শিপের আরও আটাশ জন ক্রু মেম্বারদের মনও অনবরত দোদুল্যমান। সবারই চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ সুস্পষ্ট। ব্যতিক্রম শুধু একজন, মি. নিকলসন। প্রায় বছর তিনেক দেখছি এই মানুষটিকে। ইস্পাত-কঠিন মুখের অভিব্যক্তিতে অন্তরের অনুভূতি বোঝা অসম্ভব। স্বল্পভাষী, দৃঢ় চরিত্র। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানি যে, এই মুহূর্তে আমাদের সকলের ভবিষ্যৎ নিয়ে যিনি সর্বাধিক চিন্তিত তিনি স্বয়ং আমাদের ক্যাপ্টেন, মি. জ্যাক নিকলসন।

     “স্মিথ, স্মিথ… তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?”

     “কে?… ও ডেরেক। সরি, আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। তুমি কি আমায় ডাকছ?”

     “ইটস ওকে, জলদি তৈরি হয়ে নাও। ওদের বোট এসে গিয়েছে। এবার আমাদের বেরোতে হবে।” বার্তাটুকু দিয়েই ডেরেক দ্রুত পায়ে অন্যদিকে চলে গেল।

     না, এটা কোনও শুভ সংবাদ নয়। এটার মানে হল, আমাদের সামনের আরও কয়েকটা দিন এভাবেই জলবন্দি হয়ে থাকতে হবে। এখনই শেষ হচ্ছে না এই নির্বাসন পর্ব।

     ডেরেক এইমাত্র যে বোটের খবর দিয়ে গেল, সেটা আমাদের উদ্ধার করতে আসার জন্য নয়। ওতে রয়েছে আমাদের আগামী পাঁচ-ছয় দিনের রসদ। রান্নার সরঞ্জাম, টুকিটাকি দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী। এটা মানতেই হবে, যতই আমাদের স্থলভূমিতে প্রবেশের পথে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকুক-না কেন, আমাদের সুখ-সুবিধার দিকে সরকার এবং আমাদের শিপিং কোম্পানি উভয়ই অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে খেয়াল রেখে চলেছে। বরঞ্চ স্বাভাবিকের থেকে অন্তত দশগুণ বেশিই বলা চলে। প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ডকে স্ট্যাটাস রিপোর্ট পাঠাতে হচ্ছে। তাতে যেমন জাহাজের অবস্থান, মালপত্রের হিসেবনিকেশ রয়েছে। তেমনই রয়েছে জাহাজের প্রতিটি ক্রু মেম্বারের হেলথ স্ট্যাটাস। দৈনিক অন্তত এক দু-বার করে বিশেষ কিছু স্ক্রিনিং-এর মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের। যেটুকু ন্যূনতম মেডিক্যাল ফেসিলিটি শিপে থাকার কথা তার বাইরেও গত তিন-চার দিনে আরও নতুন নতুন অত্যাধুনিক হেলথ চেক-আপ ইকুইপমেন্টস পাঠানো হয়েছে।

     “স্মিথ, তুমি তৈরি তো?”

     ইতিমধ্যে আমি পোশাক পরিবর্তন করে ফেলেছিলাম। ডেরেকও দেখলাম তৈরি। মাথাসহ সমগ্র শরীর আবৃত করা, উজ্জ্বল কমলা রঙের এই বিশেষ পোশাকটিও আমাদের ইতিমধ্যে পাঠানো হয়েছিল। এটা না পরে জাহাজ ছাড়ার অনুমতি পাওয়া যাবে না। ওকে এখন কোনও মহাকাশচারী অভিযাত্রীর মতো দেখতে লাগছে। অন্য সময় হলে এমন একটা অদ্ভুতুড়ে পোশাক পরার জন্য নিশ্চয়ই আমরা পরস্পরের সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কি জুড়ে দিতাম। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই। আমরা সকলেই হাই অ্যালার্ট জোনে রয়েছি এখানে। সরাসরি দেখতে না পাওয়া গেলেও, সকলেই জানি, কোস্ট গার্ডের সতর্ক দৃষ্টি চব্বিশ ঘণ্টাই আমাদের ওপর নিয়োজিত রয়েছে। এক চুলও ভুল করবার উপায় নেই।

     “ক্যাপ্টেন তোমাকে স্মরণ করেছেন, বেরোনোর আগে একবার অবশ্যই ওঁর সঙ্গে দেখা করে এসো। আমি ততক্ষণ আমাদের বোটটা জলে নামাবার ব্যবস্থা করছি।”

     “ঠিক আছে। তুমি প্রস্তুতি নাও, আমি দ্রুত ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে ঘুরে আসছি।”

     এই বলে আমি ক্ষিপ্র পদক্ষেপে মি. নিকলসনের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। আন্দাজ করা মুশকিল নয়, তাকে এখন কোথায় পাওয়া যেতে পারে। দিনের বেশিরভাগ সময়টা এখন ওঁকে মেইন কন্ট্রোল রুমেই কাটাতে হচ্ছে।

 

(২)

এম ভি শার্লট। গত তিন বছর ধরে এটাই আমার দ্বিতীয় গৃহের ঠিকানার নাম। বর্তমানে আমি এই শিপের হেড শেফের পোস্টে রয়েছি। সম্মান ও সাম্মানিক দুটোই বেড়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু সব সময়ই এমনটা ছিল না আমার জন্য। মি. নিকলসন ডাউন-টাউনের একটা ছোট্ট অখ্যাতনামা রেস্তরাঁ থেকে যখন আমাকে এখানে তুলে নিয়ে আসেন, কী ছিল আমার যোগ্যতা? সবেমাত্র কিছুদিন হল সেখানের কিচেনে টুকিটাকি রান্নার দায়িত্ব হাতে পেয়েছিলাম। তার আগের অতীত বড়ই ধূসর, অন্ধকারের ছায়ামাখা।

     গর্বের সঙ্গে দেওয়ার মতো বংশ-পরিচয় আমার কোনও কালেই ছিল না। জন্মের পর যখন বোধবুদ্ধি-সম্পন্ন হলাম, তখন নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম একটা অরফ্যানেজ হোমে। পড়াশোনায় মনোযোগ ছিল না একদমই। যৌবনের দোরগোড়ায় পা রাখতে না-রাখতেই ভিড়ে গিয়েছিলাম একাধিক অসামাজিক সংগঠনের সঙ্গে। নির্বিচারে একটার পর একটা অসাধু ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম ক্রমশ। টুকটাক সাজা-র পরোয়া করিনি কখনও। একবার পালাতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে বিশ্রীভাবে আহত হয়ে গেলাম। প্রায় মারাই যাচ্ছিলাম হসপিটালে। কিন্তু একজনের বিশেষ সেবা-যত্ন আর প্রার্থনার জোরেই বোধহয় সেবার নিশ্চিত মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে এলাম। হ্যাঁ, প্রায় সেলুলয়েডের মতোই আমার অতীত জীবন।

     টানা দু-বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। জেল এর আগেও খেটেছি, কিন্তু এবার যে অভিনব বিষয়টি যুক্ত হয়েছিল, সেটা ছিল মুক্তির দিনটার জন্য অধীর প্রতীক্ষা। হ্যাঁ, আমি। শহরের কুখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম আমিই, এবার দ্রুত নিজের অতীত ভুলে এক সংশোধিত নতুন জীবন শুরু করার জন্য সাগ্রহে প্রতিটি দিন গুনতাম। মাসে মাত্র দুটি দিনই মিলত প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি। আগে কেউ ছিল না, কিন্তু এখন সেই দুটি দিনের মাত্র কুড়ি মিনিটের সীমিত সময়ের জন্য ছটফট করত আমার প্রাণ। ছুঁতে না পারি, পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়েই বেশিরভাগ সময় চলে যেত…

     জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমেই যেটা করলাম সেটা হল, চার্চে গিয়ে পরস্পরের সঙ্গে জীবনের সমস্ত সুখে-দুঃখে অন্তিম ক্ষণ পর্যন্ত থাকার অটুট অঙ্গীকার। ডাউন-টাউনের রেস্তোরাঁর কাজটাও এরপরই নেওয়া। অতীতে হয়তো সামান্য কিছু পুণ্য করেছিলাম, তাই লর্ড জেসাস আমাকে এই জীবনেই দ্বিতীয়বার সসম্মানে বাঁচার সুযোগ দেন। জানি না, মি. নিকলসন আমার মধ্যে কী দেখে সুযোগটা দিয়েছিলেন! আজও তাই যখনই ওই বিশাল বটবৃক্ষের মতো মানুষটির সামনে দাঁড়াই, সম্মানে আর কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নত হয়ে আসে প্রতিবার।

     কানে হেডফোন লাগিয়ে মি. নিকলসন গভীর মনোযোগ সহকারে কিছু একটা বার্তা শুনছিলেন, আমাকে দেখে হেডফোনটা সরিয়ে রাখলেন।

     “এই যে স্মিথ, তৈরি হয়েই এসেছ দেখছি। বেশ বেশ। শোনো, ডক থেকে আজকে যে বোটটা পাঠানো হচ্ছে তাতে যে শুধু কুকিং সরঞ্জামই আছে তাই নয়, এ ছাড়াও একটা বিশেষ ইন্সট্রুমেন্ট পাঠানো হচ্ছে। আমাদের ব্লাড স্যাম্পল চেক করার জন্য একটা অত্যাধুনিক অ্যানালাইজার মেশিন। জিনিসটা যথেষ্ট ভারী ও বেশ ডেলিকেট। তুমি একা ডেরেকের সাহায্যে সেটা জাহাজে আনতে পারবে না। তাই আমি জেরেমিকেও আজ বলেছি তোমাদের সঙ্গে যেতে। হয়তো এতক্ষণে ও বেরোনোর জন্য প্রস্তুতও হয়ে গিয়েছে। ওরা মাঝপথেই অপেক্ষা করছে, তাই তোমরা বন্দরের বেশি কাছে যেও না একদম। আশা করি বুঝতে পেরেছ।”

     “ঠিক আছে ক্যাপ্টেন।”

     “ওকে দেন, সময় নষ্ট না করে এখনই বেরিয়ে পড়। মেসেজ এসে গিয়েছে অলরেডি।” মি. নিকলসন আবার কানে হেডফোন তোলার জন্য উদ্যত হচ্ছিলেন, কিন্তু আমাকে তখনও চলে যেতে না দেখে একটু বিস্মিত হলেন। “তুমি কি কিছু বলতে চাও?”

     গত দু-তিনদিন ধরে আমাদের সবার মনে যে একটাই প্রশ্ন দিনরাত উঁকি দিচ্ছে এবার আর সেটা না করে থাকতে পারলাম না। মনে একটু সাহস আর জিভে একটু শক্তি সঞ্চয় করে বলেই ফেললাম শেষ পর্যন্ত।

     “এভাবে আর কতদিন ক্যাপ্টেন?…”

     আমার কথায় প্রথমেই মি. নিকলসন মুখে কোন অভিব্যক্তি দেখা গেল না। হয়তো উনি এই রকমই কিছুর প্রত্যাশা করেছিলেন বা হয়তো ইতিমধ্যেই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। জবাবের পরিবর্তে ওঁর কাঁচাপাকা দাড়ির আড়ালে এক-চিলতে হাসি ফুটে উঠল। যা বেশ বিরল। কিন্তু এই হাসিতে কেন জানি আশ্বাসের বদলে বিষণ্ণতার রেশটাই বেশি পরিস্ফুট বলে আমার মনে হল।

     এক রাশ উদ্বিগ্নতা আর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমি যখন ডেকে পৌঁছলাম ততক্ষণে জেরেমি আর ডেরেক দু-জনেই বোটের পাশে তৈরি হয়ে এসে গিয়েছে। আমাকে দেখেই জেরেমি হইহই করে উঠল। খেয়াল করলাম, ডেরেকের মুখেও হালকা খুশির রঙ লেগে রয়েছে।

     জেরেমি ওরফে জিম এই মুহূর্তে জাহাজে আমার সব থেকে ভালো বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম। জিম আমাদের জাহাজের সেকেন্ড ইন কমান্ডিং অফিসার। আমার থেকে যোগ্যতা এবং পদমর্যাদায় অনেক ওপরে। কিন্তু সদালাপী, পরিহাস-প্রিয় এই মানুষটিকে দেখে সেটা কখনও বোঝার উপায় নেই। জিম ভীষণ খাদ্য-রসিকও বটে। আর সেই সূত্রেই ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার শুরু। প্রায়ই এটা-সেটা বানিয়ে দেওয়ার ফরমায়েশ নিয়ে আসে আমার কাছে। শীতের দিনে হট চকলেট আর গরমে কতবার যে ওর প্রিয় ব্যানানা স্মুদি বানিয়ে দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। গত ক-দিন এই প্রাণোচ্ছল মানুষটিকেও ধীরে ধীরে কেমন বৃন্তচ্যুত গোলাপের মতো ঝিমিয়ে পড়তে দেখছিলাম। এখন আবার ওর সেই চির পরিচিত চনমনে রূপ দেখে আমার মনেও পুলকের সঞ্চার হল।

     “স্মিথ, তোমারই অপেক্ষা করছিলাম এতক্ষণ। একটা দারুণ জিনিস আছে তোমাকে দেখাবার জন্য।” বলতে বলতে নিজের হাতের সেল ফোনটা তুলে ধরল আমার সামনে, “এই একটু আগেই ক্যাথি পাঠিয়েছে এই ছবিটা। উফফ! কত সাধ্য-সাধনা করতে হয়েছে এটা পাওয়ার জন্য তা ঈশ্বরই ভালো জানেন।”

     মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে দুটি মুখ। জিমের স্ত্রী ক্যাথরিন ও তাদের দু-মাসের শিশুকন্যার ছবি। মেয়ে হওয়ার সুখবর আমরা আগেই পেয়েছিলাম। ক্যাপ্টেনের উপস্থিতিতে সেই আনন্দ আমরা ইতিমধ্যেই স্পেশাল পানীয় সহযোগে সেলিব্রেটও করেছি। কিন্তু ছবি এই প্রথম দেখলাম। পরিকল্পনা ছিল, বন্দরে পৌঁছালে আমরা সবাই মিলে প্রচুর উপহার নিয়ে জিম আর ক্যাথির প্রথম সন্তানের শুভ কামনার জন্য একদম ওদের বাড়িতেই উপস্থিত হব। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবেই বাদ দিতে হয়েছে।

     “বলো তো কী নাম রেখেছি মেয়ের?” জিম উচ্ছ্বাসের সঙ্গে প্রশ্ন করল।

     “উমম… নিশ্চয়ই শার্লট রাখোনি—”

     “হা হা হা… এজন্যেই তোমাকে এত ভালোবাসি স্মিথ। তোমার মাথায় যদি এই বিদঘুটে ঢাকনাটা না থাকত তাহলে এক্ষুনিই তোমায় একটা চুমু খেতাম।” জিম আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

     “ভাগ্যিস মুখটা ঢাকা আছে, নাহলে ক্যাথির জন্য জমিয়ে রাখা ভালবাসা তুমি আমার ওপরেই উপুড় করে দিতে—” আমিও হাসতে হাসতে জবাব দিলাম।    

     কথা বলতে বলতে আমরা তিনজনেই বোটে উঠে বসেছিলাম। আরেকজন ক্রু-মেম্বার ধীরে ধীরে হাতল ঘুরিয়ে আমাদের নীচের দিকে নামিয়ে দিতে লাগল। আমি মৃদুভাবে জিমকে বললাম, “মোবাইলটা সঙ্গে করেই নিয়ে যাচ্ছ তাহলে… জাহাজ থেকে যে আমাদের কিছু নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই, তা নিশ্চয়ই তুমি ভুলে যাও নি?”

     জিম মাছি তাড়ানোর মতো করে নাকের সামনে থেকে হাত নাড়ল, “আরে রাখো তো তোমার রুলস-রেগুলেশন। এই ফোনটা এখন আমি একদণ্ডও কাছ-ছাড়া করছি না। গত পাঁচদিন ধরে যে বন্দরের সামনে দাঁড়িয়েও জাহাজ থেকে বেরোতে পারছি না তার কোনও সুবিচার হয়েছে? কীসের নিয়ম… নিয়ম আমি মানি না—” এরপর ওর গলায় উত্তেজনার আঁচ খানিক প্রশমিত হলে, ফের বলতে শুরু করল, “বাড়ির এত কাছে থেকেও নিজের সন্তানের প্রথম ঝলকটুকু দেখারও অনুমতি নেই! আমার মতো হতভাগ্য পিতা আর ক-জন আছে বলতে পারো! কে জানে আদৌ ওদের মুখ দেখা আর এ জন্মে কপালে আছে কি না…!” বলতে বলতে জিমের শেষ কথাগুলো ধরে এলো।

     সহসা আমার বুকের ভিতরেও বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো ভয়ের শিহরণ খেলে গেল। আমরা প্রত্যেকেই যতই নিঃস্পৃহ থাকার চেষ্টা করি-না কেন, সত্যিটা বেশ ভয়ংকর। এই জাহাজের সব থেকে নীচের এক অন্ধকার হিমঘরে, গাঢ় নীল রঙের এয়ার টাইট সেলোফেন ব্যাগে মোড়া রয়েছে তিন তিনটি টাটকা লাশ! আমাদেরই প্রিয় সহকর্মী। মাত্র কয়েকদিন আগেই যাদের সঙ্গে হাসি মজা হুল্লোড় করতে করতে সোনালি পানীয়ের গ্লাস শেয়ার করে একে ওপরের অফুরান স্বাস্থ্য কামনা করেছিলাম! হা ঈশ্বর! এখন তারাই কবরের শেষ মাটিটুকুও কবে পাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই…!

     আরও একজন হতভাগ্য এখনও মৃত্যুর সঙ্গে অবিরাম পাঞ্জা লড়ে চলেছে। নীচেরই আরেকটা কেবিনে স্পেশাল মেডিক্যাল অবজারভেশনে রাখা হয়েছে তাকে। আগের তিনজনও ওখানেই ছিল অসুস্থ হওয়ার পর। পরিসংখ্যান বলছে সংক্রমণের পর থেকে আজ অব্ধি কেউই জীবিত ফিরে আসেনি সেই অভিশপ্ত ঘর থেকে!

 

(৩)

ভীষণ রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা অবাঞ্ছিত শিপিং ডিলে ছাড়া, যে কোনও কার্গো শিপেরই নির্দিষ্ট সফর সূচির বাইরে কোথাও অকারণ ডকিং করার অনুমতি নেই। সুনির্দিষ্ট অজুহাত ছাড়া সেই নিয়মের ব্যত্যয় হলে শিপিং কোম্পানিগুলিকে তার জন্য ভারী অঙ্কের জরিমানাও গুনতে হয় শুনেছি।

     আমি ক্রুজে জয়েন করার পর থেকে তেমন কোনও বড়সড় গড়বড় দেখিনি। মি. নিকলসনের কড়া নজরদারিতে সব কিছুই ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়মের ঘেরাটোপে বন্দি ছিল। এবারই ঘটেছে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এক ভয়ংকর সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের সামনে পড়ে যায় আমাদের জাহাজ। অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট ইমেজিংয়ের মাধ্যমে সেই ঝড়ের পূর্বাভাষ আগেই ছিল ক্যাপ্টেনের কাছে। মাঝ সমুদ্রে সরাসরি ঝড়ের মোকাবিলা করার চেয়ে কিছুটা অগভীর জলের দিকে চলে যাওয়াটা বেটার মনে করে একটা অজানা দ্বীপের দু-কিলোমিটারের কাছাকাছি নোঙর ফেলার আদেশ দেন মি. নিকলসন। দ্বীপের খুব বেশি কাছে যাওয়ারও বিপদ রয়েছে, তাই সেদিকেও সঠিক হিসেবনিকেশ করা হয়েছিল।

     প্রায় চার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে ঝড়ের উদ্দাম তাণ্ডবলীলা। কালো মেঘের আঁধার আর বৃষ্টির প্রাবল্য যখন পুরোপুরি বিদায় নিলো, ক্রুজ তার নির্ধারিত শিডিউলের প্রায় সাত ঘণ্টা পিছনে চলে গিয়েছে। বাড়তি পাওনা হিসেবে, বেশ কিছু এরিয়েল রিসিভার আর ট্রান্সমিটারের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন হয়ে গিয়েছিল। ঠিক না করলে ন্যাভিগেশন আর কমিউনিকেশনে যথেষ্ট সমস্যা হত। শিপের ইঞ্জিনিয়াররা দ্রুত মেরামতির কাজে লেগে গেলেন। ক্যাপ্টেন আরও তিন ঘণ্টা সময় বরাদ্দ করলেন সমস্ত সমস্যা মিটিয়ে পুনরায় সেইল করার জন্য।

     যে দ্বীপটির কাছাকাছি আমরা নোঙর ফেলেছিলাম, দেখেই বোঝা গিয়েছিল যে সেটা সম্পূর্ণ জনবিরল। স্যাটেলাইট-ইমেজে তার অস্তিত্ব আছে বটে, কিন্তু ল্যাটিচিউড, লঙ্গিচিউডের দিক নির্দেশ ছাড়া আর কোনও নাম নেই। এটা কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগরেই এমন অনেক ছোটখাটো স্থলভূমির অস্তিত্ব আছে। অমসৃণ খাড়াই পাহাড়, পানীয় জলের অপ্রতুলতা, বিষাক্ত সাপ আর পোকামাকড়ের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র এই দ্বীপগুলির অধিকাংশই মনুষ্য বসবাসের উপযোগী নয়। আয়তনেও যে বিরাট কিছু হয়, তাও নয়। মাঝে মাঝেই বেখেয়ালি সমুদ্রের তাণ্ডবে হঠাৎই একদিন চিরকালের মতো ফের সমুদ্রের বুকেই হারিয়ে যায়।

     আমাদের সামনের দ্বীপটিও তার কিছু ব্যতিক্রম নয় বলেই মনে হয়েছিল। যদিও বাইনোকুলারে দেখে দ্বীপের সি-বিচটা বারবার ক্রু মেম্বারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। দ্বীপে নামার কোনও প্রশ্নই ছিল না, এমনিতেই ঝড়বৃষ্টির কারণে আমরা অনেকটাই নির্ধারিত সময়ের পিছনে চলেছি। কিন্তু শেষমেশ কয়েকজন দুঃসাহসী নাবিক অনেক কষ্টে ক্যাপ্টেনকে রাজি করিয়ে সেখান থেকে কিছু সময়ের জন্য ঘুরে আসার অনুমতি জোগাড় করে ফেলে। শর্ত একটাই, জাহাজের মেরামতির কাজ শেষ হওয়ার আগেই ফিরে আসতে হবে, আর কোনও মতেই বাহাদুরি দেখিয়ে দ্বীপের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাবে না।

     এ সবই প্রায় হপ্তা দুয়েক আগের ঘটনা। আমি এতসব দুঃসাহসিক অভিযানের বিন্দুবিসর্গ জানতাম না। ঝড় থামতেই সোজা প্যান্ট্রিতে গিয়ে ডিনারের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিলাম। যে পাঁচজন ক্রু মেম্বার দ্বীপটিতে গিয়েছিলেন তারাও নির্ধারিত সময়ের আগেই শিপে ফিরে আসেন।

     প্রথম দু-দিন কোনও সমস্যা হয়নি। তৃতীয় দিনে একজন নাবিক হঠাৎই অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। প্রচণ্ড পেটে ব্যথা, ডিসেন্ট্রি আর তারপর ধুম জ্বর। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছিল ফুড পয়জনিং অথবা সি-সিকনেস। যেমনটা প্রায়ই দেখা যায়। আমাদের শিপের মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং প্যারামেডিকরা যখন মোটামুটি ব্যপারটা সামলেই নিয়েছিলেন ঠিক তখনই আমাদের সকলকে বিস্মিত করে আরও নতুন দু-জন সেই একই উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথম জনের শারীরিক অবস্থার তখন আরও অবনতি ঘটেছে। শ্বাসকষ্ট আর খিঁচুনি শুরু হয়ে গিয়েছে। বলাই বাহুল্য, এরা সকলেই সেই অজানা দ্বীপটিতে পাড়ি দিয়েছিলেন।

     ক্যাপ্টেন জোর তদন্ত শুরু করে দিলেন। ওরা সকলেই অবশ্য স্বীকার করল যে ওখানে কোনও অজানা কিছুর স্পর্শ বা স্বাদ-ভক্ষণ করেনি। কিন্তু তাও ওই দ্বীপ থেকেই যে মারাত্মক ‘কিছু একটা’ সংক্রামিত হয়েছে সেটা বুঝতে কারোর বাকি রইল না। আতঙ্ক আরও তীব্র হল যখন সেই একই রোগ লক্ষণগুলি একে একে কমবেশি বাকি ক্রু মেম্বারদের মধ্যেও দেখা গেল! সকলেই যে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ল এমনটাও নয়। কিন্তু আমাদের সকলের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও সেই প্রথম তিন অসুস্থ নাবিককে বাঁচানো গেল না!

     দ্রুত খবর ছড়িয়ে গেল চারপাশে। এমভি শার্লটকে আর কোনও দেশের বন্দরেই ডকিং-এর অনুমতি দেওয়া হল না। শিপিং কোম্পানি থেকে আদেশ এল, রসদ ও জ্বালানি শেষ হওয়ার আগেই অবিলম্বে দেশে ফিরে আসার। কিন্তু আজ পুরো বারো দিন হল নিজের দেশের জল-সীমানা অতিক্রম করা সত্ত্বেও স্থলভাগে পা দেওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়নি। নীল সেলোফেন ব্যাগের সংখ্যা তিন থেকে বেড়ে পাঁচ হয়ে গিয়েছে। আরও বড় দুঃসংবাদ, আমার প্রিয় সহকর্মী জিমও দু-দিন হল নীচের মেডিক্যাল ফেসিলিটিতে বন্দি! শুনলাম প্রচণ্ড জ্বর আর খিঁচুনি নিয়ে ছটফট করছে; মাঝেমাঝেই বিড়বিড় করে ভুল বকছে।

     ক্যাপ্টেনসহ আমরা হাতে গোনা কয়েকজন এখনও লক্ষণ হীন আছি। যেটুকু খবর পেলাম আমাদের প্রত্যেকেরই ব্লাড স্যাম্পলে নতুন ধরণের এক প্রাণঘাতী ভাইরাসের হদিস মিলেছে। সিম্পটোমেটিক ট্রিটমেন্ট ছাড়া আপাতত এর কোনও চিকিৎসা নেই। যদিও আমরা সবাই কেন একসঙ্গে অসুস্থ হইনি সেই কারণ এখনও অজ্ঞাত। তবে এটা সকলেই বুঝে গিয়েছি হয়তো এভাবেই আমাদের কোয়ারেন্টাইন দশা থেকেই তিলে তিলে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। দেশের লক্ষাধিক জনসংখ্যার নিরাপত্তার কাছে এই ক-টা সামান্য নাবিকের জীবনের আর কী-ই বা মূল্য আছে!

     আজ পড়ন্ত বিকেলে মি. নিকলসনের জন্য ওঁর প্রিয় একটা পানীয় বানিয়ে ডেকে অপেক্ষা করছিলাম। সহসা বিপরীত দিকে প্রচণ্ড চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে সেদিকে দৌড়ে যেতেই ভয়ে আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম।

     না-জানি কী করে জিম নীচের মেডিক্যাল ফেসিলিটি থেকে সবার অলক্ষ্যে এক ফাঁকে বেরিয়ে ডেকে চলে এসেছে। আনমনে প্রলাপ বকতে বকতে হাতল ঘুরিয়ে উঠে পড়েছে একটা লাইফ বোটে। দ্রুত সেটা নেমে যাচ্ছে জলের দিকে।

     আমার প্রিয় বন্ধুকে এই অবস্থায় দেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারলাম না। এ কী চেহারা হয়েছে সুপুরুষ জিমের! আমি জানি ও এখন ঘোরের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু তাও সে ভোলেনি তার প্রিয় ক্যাথিকে… সে ছুটে চলেছে তার নবজাতক সন্তানের শুধুমাত্র একটিবারের স্নেহ-চুম্বন নিতে…

     হঠাৎ পেছন থেকে মি. নিকলসনের বজ্রনির্ঘোষ আওয়াজ শুনে আমরা সকলেই সচকিত হয়ে উঠলাম। ওঁর হাতে একটা উদ্যত রিভলভার! যেটা আজ অব্ধি উনি কখনও ব্যবহার করেছেন বলে শোনা যায়নি।

     “ফিরে এসো জেরেমি, ঈশ্বরের দোহাই ফিরে এসো… না-হলে আমি কিন্তু গুলি চালাতে বাধ্য হব।”

     মি. নিকলসনকে এত ভেঙে পড়তে কখনও দেখিনি। ওঁর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র কিন্তু সেই হাত আর সমগ্র শরীর কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমরা সবাই ওঁর কাছে পুত্রসম। মরে গেলেও উনি জিমের ওপর কখনও গুলি চালাতে পারবেন না। এদিকে জিম বোট নিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে। যেহেতু সুস্থ-মস্তিষ্কে নেই, তাই ও ভাবতেই পারছে না নিজের সঙ্গে সঙ্গে কী ভয়ানক মহামারীর বীজ নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সবার স্বদেশের দিকে। অবিলম্বেই কিছু একটা করা দরকার।

     সবাইকে চমকে দিয়ে এবার আমি মি. নিকলসনের হাতের আলগা বাঁধন থেকে রিভলভারটা এক টানে বের করে নিলাম। প্রায় এক দশক পর এই জিনিস স্পর্শ করছি। চেম্বারটা খুলে দেখে নিলাম একবার। হ্যাঁ, লোডেড আছে। আমার সমগ্র স্নায়ুমণ্ডলী অতীতের অভ্যাসের কারণে সংযত হয়ে এলো ধীরে ধীরে। এই মুহূর্তে যে মানুষটি দ্রুত দেশের মাটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সে কোনও দায়িত্ববান স্বামী নয়; নয় কোনও স্নেহপরায়ণ পিতা; আর না আমার প্রাণাধিক প্রিয় মিত্র। সে শুধুই একজন মারণ রোগের প্রাণঘাতী ধারক।

     পর-মুহূর্তেই শেষ বিকেলের নিস্তব্ধতা চিরে আমার হাতের আগ্নেয়াস্ত্র বিকট শব্দে গর্জে উঠল।

     ঠিক পরপর তিনবার।

Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, ড. সাম্য মণ্ডল, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সুপ্রিয় দাস

One thought on “প্রহর

  • October 11, 2020 at 2:00 pm
    Permalink

    ভয়াবহ ও মর্মান্তিক। বর্তমান বিশ্বের মারণ ত্রাস কে আবারো উপলব্ধি করলাম। কি ভয়ংকর এই দিন, এই মৃত্যু। পৃথিবী আবারো মহামারী মুক্ত হোক, সেজে উঠুক তার পুরোনো রূপ রস গন্ধে। লেখক কে আন্তরিক শুভকামনা। এবং তিনি একাধারে একজন চিকিৎসকও, কি প্রবল দুর্যোগ বহন করে চলেছেন তা বুঝি, রইল ঐকান্তিক শুভেচ্ছা। আপনারা জয়ী হন।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!