সম্পাদকীয়

  • লেখক: কল্পবিশ্ব
  • শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)

“বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি আধুনিক বাস্তবতার একটা নতুন সংজ্ঞা লিখে চলেছে শুধুমাত্র আমাদের প্রতিদিনের অস্তিত্বের বাহ্য পরিবর্তনগুলো দিয়ে নয় বরং আমরা নতুন করে কি ভাবব বা চিন্তা করব তার মধ্যে দিয়েও। নৌচনি ফ্যান্টাস্টিকা বা বিজ্ঞানভিত্তিক ফ্যান্টাসি এই ক্ষেত্রে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের চিন্তার মধ্যেই কি প্রথম সেই নতুন সূত্র বা আশ্চর্য মেশিনগুলো জন্ম নেয় না? নতুন দিনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির খবরের পাশাপাশি আমাদের ম্যাগাজিনে তাই নতুন দিনের এই বোধ বা মননের একটা রূপরেখা দেবার চেষ্টা থাকবে যাকে আমাদের সময়ের প্রেক্ষিতে আশ্চর্য বলেই প্রতীয়মান হয়।”

        ১৮৯৪ সালের ‘প্রকৃতি ও মানুষ’ (প্রিরোদা ই লিউয়িদি) পত্রিকার পঞ্চম বার্ষিকী সংখ্যার এই সম্পাদকীয় বক্তব্য থেকে সেই সময়কার রাশিয়ার পপুলার সাইন্সের নতুন দিনের লেখনীর বিন্যাস সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। এর প্রায় তিন দশক বাদে ১৯২৩ সালে লেখক ইয়েভগেনি জেমিয়াতিন, যার ডিস্টোপিয়ান আখ্যান ‘উই’ (রাশিয়ান – মাই) কে জর্জ অরওয়েল তার ল্যান্ডমার্ক উপন্যাস ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’ এর প্রেরণা বলে স্বীকার করেছেন, এই ধরণের লেখালেখিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এইভাবে, “এমন ধরণের রচনা যা আধুনিক চিন্তাশক্তি সম্পন্ন মানুষজনের মনোযোগ আকর্ষণ করে আর তাদের গভীর বোধে রেখাপাত করে।” তিনি একে আধুনিক রাশিয়ান গদ্যশৈলীর এক নিয়ামক বলেও দাবী করেন।

        এই বিশেষ ধরণের লেখনশৈলী রাশিয়ায় স্বীকৃতি পায় আমেরিকায় ১৯২৬ সালে বিখ্যাত সম্পাদক হুগো গার্ন্সব্যাক এর কল্পবিজ্ঞান হিসেবে আলাদা একটা ধারা উল্লেখ করার অনেক আগে। যেখানে ওই ১৮৯৪ এর সম্পাদকীয় কলাম লেখক এবং পাঠক উভয়ের তরফ থেকেই এক ধরণের আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত বোধের দাবী করেছেন সেখানে জেমিয়াতিন এর অভূতপূর্ব সম্ভাবনাকে অন্য এক মাত্রা দেবার কথা বলেছেন যে যাকে বিংশ শতাব্দীর সূচনায়  ‘ডিফ্যামিলিয়ারাইজেশন’ বলা হয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ হল যে পাশ্চাত্যে কল্পবিজ্ঞান ধারাটা বিশেষভাবে স্বীকৃত হবার অনেক আগে থেকেই রাশিয়ান সংস্কৃতির জনপ্রিয় বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলে তা এক গভীর চর্চার বিষয় এবং সেটার মধ্যে দিয়ে তাঁরা বিংশ শতাব্দীর নব্য বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করে এসেছেন এর সূচনালগ্ন থেকেই। এর মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, বলশেভিক বিপ্লব, শ্বেত আর লাল ফৌজ মিলে গৃহযুদ্ধ যার শেষে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সাম্যবাদী আদর্শে এক নতুন রাষ্ট্রের পত্তন।

        কল্পবিশ্বের এবারের সংখ্যা এই সোভিয়েত আমলের কল্পবিজ্ঞানকে ঘিরে। যে ধারার কল্পবিজ্ঞানের আখ্যান বা ন্যারেটিভে শুধুমাত্র যন্ত্র-সভ্যতার বাহ্য বিজয়কেতনই ঘোষিত হয়নি বরং এর প্রভাবে গড়া নতুন দিনের সমাজ রাজনীতির আবর্তে মানুষের বোধের যে বহুস্তরীয় পরিবর্তন তাকেও তুলে আনা হয়েছে রূপকের ছায়ায় যার আধার বিজ্ঞানের আধুনিক এবং স্পেক্যুলেটিভ ভাষ্য। এই সংখ্যায় সোভিয়েত আমলের অনেক কল্পবিজ্ঞানের অনুবাদ ছাড়াও বেশ কিছু প্রবন্ধের মধ্যে সেই সময়ের কল্পবিজ্ঞান চর্চার কিছুটা রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া রইল মৌলিক বেশ কিছু গল্প যা ওই সময়ের আবহকে তুলে এনেছে মুন্সিয়ানার সাথে। তাছাড়া অবশ্যই আছে নিয়মিত বিভাগ আর ধারাবাহিক লেখাগুলো। এই সংখ্যায় আমরা সাথে পেয়েছি রাশিয়ান সাহিত্যের উৎসাহী ব্লগার ও সংগ্রাহক শ্রী সোমনাথ দাশগুপ্তকে। শ্রী দাশগুপ্ত অতিথি সম্পাদকরূপে এই তিন মাস পরিশ্রম করে বেছে দিয়েছেন অনুবাদের উপযোগী গল্পগুলি, আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। শ্রীমতী রুমেলা দাসের অলংকরণে সেজেছে রাশিয়ান সংখ্যার প্রচ্ছদ, ধন্যবাদ জানাই তাকে কল্পবিশ্বের তরফ থেকে। আমরা আশা করব আগের মতো এবারের সংখ্যাতেও আমাদের এই অন্বেষণ আপনারা সাদরে বরণ করে নেবেন। কল্পবিশ্বের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ তার পাঠক/পাঠিকারা, যাদের যৌক্তিক মতামতে আমরা প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হয়ে আগামীর পথে এগিয়ে যাই আরো ভালো কিছু করার প্রত্যয় নিয়ে।  

        নতুন বছর সমাগত। বন্ধুরা এই নতুন দিনের ভোরে চলুন পুরোনো একটা সময়ের কিছু স্বাক্ষরকে নতুন আলোয় দেখে নিই আমরা!! 

Tags: কল্পবিশ্ব, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, সম্পাদকীয়

2 thoughts on “সম্পাদকীয়

  • January 1, 2018 at 12:55 pm
    Permalink

    অনেকদিন পর এত মনোগ্রাহী একটা সম্পাদকীয় পড়লাম। কমেন্ট না করে থাকা গেল না।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!