সম্পাদকীয়

  • লেখক: অতিথি সম্পাদক যশোধরা রায়চৌধুরী ও কল্পবিশ্ব সম্পাদকমণ্ডলী
  • শিল্পী:

জানলাম রণেন ঘোষ আর নেই। কল্পবিজ্ঞানের অক্লান্ত লেখণী, সমস্ত জীবন এই কাজে ঢেলে দিয়ে নিজের প্রকাশনা করেছেন কল্পবিজ্ঞানকে ঘিরে৷ কল্পবিশ্ব গ্রুপের নতুন ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়েছেন সাদরে, আশ্রয় দিয়েছেন। একবার মাত্র ফোনে কথা হয়েছিল, কত স্নেহ ঝরে পড়েছিল তাঁর গলায়। তিনি থেকে যাবেন আমাদের সবার মনে তাঁর অসংখ্য সৃষ্টি আর নবীন প্রজন্মের মাধ্যমে।


কঙ্কাবতী কল্পবিজ্ঞান লেখেনি? লিখেছে তো!

(১)

মনে পড়ে, কঙ্কাবতীর কথা? ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সৃষ্টি, সেই মেয়েটি, যাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে বলে তার খুব দুঃখ, নৌকোয় চেপে পাড়ি দিল জলে, তারপর টুপ করে ডুবে গিয়ে মাছেদের দেশে উপস্থিত। মাছেরা কঙ্কাবতীকে পেয়ে খুব খুশি, “ জলচর জীব-জন্তুগণ মহাসমারোহে একটি সভা করিলেন। তপস্বী মাছের দাড়ি আছে দেখিয়া, সকলে তাঁহাকে সভাপতিরূপে বরণ করিলেন। কঙ্কাবতীকে লইয়া কি করা যায়-  অনেক বক্তৃতার পর, চতুর বাটা মাছ প্রস্তাব করিলেন, –এস ভাই! কঙ্কাবতীকে আমরা আমাদের রাণী করি।

     সকলেই বলাবলি করতে লাগিল যে, ভাই! কঙ্কাবতী আমাদের রাণী হইলে, আর আমাদের কোনও ভাবনা থাকিবে না। বঁড়শী দিয়া আমাদিগকে কেহ গাঁথিলে হাত দিয়া কঙ্কাবতী সূতাটি ছিঁড়িয়া দিবেন। জেলেরা জাল ফেলিলে ছুরি দিয়া কঙ্কাবতী জালটি কাটিয়া দিবেন। কঙ্কাবতী রাণী হইলে আর আমাদের কোনও ভয় থাকিবে না।

     কঙ্কাবতী বলিলেন, আমার শরীরে সুখ নাই, আমার মনেও বড় অসুখ। তাই এখন আমি তোমাদের রাণী হইতে পারিব না।”

     বাঙালির “অ্যালিস”, কঙ্কাবতীর কথা লেখার ভারটা কেন যে এক দাপুটে পুরুষ কলমকেই নিতে হয়েছে বরাবর!  কল্পনার পাখায় সওয়ার হয়ে মেয়েরা কি তবে কোনওদিন নিজেদের বাস্তবতাকে কল্পনার বাস্তবতায় রূপ দিতে পারবে না? পারেনি? কঙ্কাবতীরা কোনওদিন কল্পবিজ্ঞান লিখবে না?

(২)

সমস্ত সাজানো রইল। টবে রাখা উজ্জ্বল স্টিলের গাছ,

জাদুপাখি, মায়াফল, ছোট-ছোট সৌরকাচ

কৃত্রিম সবুজ কোষে নিরন্তর সালোকসংশ্লেষ…

জল তো দেওয়ার কোনও দায় নেই, যদি ইচ্ছে হয়, বেশ

মাঝে-মধ্যে ঝেড়ে মুছে রেখো বালি-ধুলো।

তুমি এত ভুলো…

সপ্তাহান্তে দূরে-টুরে যেতে হলে রকেটে-জ্বালানি

ঠিকমতো নিও কিন্তু। ভয় করে, তোমাকে তো জানি।

ড্রয়ারে চাবিটা রাখছি। মিলির রিমোট।

রোবটমানবী ভেবে অগ্রাহ্য কোরো না। ওর চোখ নাক ঠোঁট

আমারই আদলে তৈরি, মনে রেখো। রোজ চার্জ দিও।

আমার অবর্তমানে ও-ই দেখেশুনে নেবে

ঘরদোর,  গৃহস্থালি,  লৌকিকতা, প্রেম-ট্রেম…যা যা করণীয়।

আপাতত চলি।

সুদূর কৈশোর থেকে কোনও এক অনুজ্জ্বল স্কুলবাস, মফসসল গলি—

রাস্তা ভুলে, স্থান-কাল-পাত্র ভুলে, শুধুমাত্র আমাকেই নিতে

এসে গেছে। তোমাদের দৃপ্ত পৃথিবীতে

আমার ফুরলো দিন। থাকার উপায় নেই আর।

অন্য কোনও দেশ-কালে দেখা হবে কখনও, আবার।

(চলে আসার আগে – রাকা দাশগুপ্ত)

     কবিতা লেখেন রাকা দাশগুপ্ত। অন্যদিকে তিনি পদার্থবিদ্যার কৃতী ছাত্রী ও আপাতত শিক্ষকতাও করেন। এই যে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে কবিতাকে মেলানো, এতে আশ্চর্য হব কি, আমরা? নাকি এটা জানি বলেই মেনে নেব যে এই দুই ক্ষেত্রেই কল্পনাশক্তির অত্যন্ত জরুরি অবদান আছে। আর এই কবিতায় যেন সেই দুই দিক এসে মিলে যায় এক কল্পবিজ্ঞান বা সাই-ফাই কাহিনিতে।

     এভাবেই বাংলা ভাষার লেখকেরা বারে বারেই করে চলেন কল্পবিজ্ঞানের চর্চা, বিজ্ঞানের ছোঁয়া লাগা ফ্যান্টাসি বা কল্পকাহিনির সঙ্গে মেলান ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদের উদবেগ। কখনও ইউটোপিয়া বা কখনও ডিসটোপিয়া নির্মাণ করতেই থাকেন নানা কাহিনিতে।

     তবু যে কেন অপবাদ জোটে, বাংলায় ভালো কল্পবিজ্ঞান লেখাই হয় না, তার ওপর আবার মেয়েদের কলমে?

     এই অপবাদ কেন? আমরা তো জানি, একদা পাশ্চাত্যে মেরি শেলি প্রথম লিখেছিলেন বিজ্ঞানের ব্যবহার নিয়ে এক প্রবল ডিসটোপিয়া, যে গল্প পৃথিবীবিখ্যাত হয়েছিল। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। যাকে বলা হয় ইংরেজি কল্পবিজ্ঞানের পূর্বসূরী। যেখানে বিজ্ঞানের কথা এসেছে মানবমুক্তির সূত্রে, বিজ্ঞানের অপব্যবহারের বিষময় ফলের পূর্বাভাষ ও এসেছে।

     আমরা এও জানি যে, ইংরেজিতে লেখা হলেও ভারতের বুকে বেগম রোকেয়াই প্রথম বাঙালিনী, যিনি এক ইউটোপিয়ার কল্পনা করে কাহিনি বয়ন করেছিলেন, সুলতানাজ ড্রিম। তাহলে?  সেও তো এক কল্পবিশ্ব, এক কল্পবিজ্ঞানই! সেখানে দুনিয়ার যুদ্ধবাজ পুরুষদের মর্দানা মহলে আটকানোর ফলে এক যুদ্ধহীন শান্তিময় বিশ্বের কল্পনা করে ফেলেছিলেন বেগম রোকেয়া সেই কবেই।

     তারপর তো কত জল বয়ে গেল আমাদের সব ক-টি নদী দিয়ে।  কত না কঙ্কাবতীর কলম তো নিশপিশ করেছিল ক্রমাগত কোনও না কোনওভাবে আশপাশের এই জগতকে দেখে এর প্রত্যুত্তরে এক প্রতি-বিশ্ব তৈরি করতে।

     লীলা মজুমদারের কলমে অথবা বাণী বসুর কলমে কল্পবিশ্ব আর ফ্যান্টাসি ফিকশন তো কম পাইনি আমরা।

     তবু, কল্পবিশ্ব ওয়েবম্যাগ যা ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছে, পেয়েছে এদেশ ও বিদেশের নানা কল্পবিজ্ঞান পিপাসুদের আগ্রহ আর উঠে এসেছে বার বার সংবাদ মাধ্যমে, চেয়েছিল নতুন করে অ্যাডাল্ট কল্পগল্প লিখুন আমাদের নতুন কঙ্কাবতীরা। নজর থাকুক নতুন আরও কিছু লীলাকলমের দিকে, আরও কিছু মেয়ে এগিয়ে আসুন স্পেকুলেটিভ ফিকশন নিয়ে। এ যুগের কঙ্কাবতীরা যেন নিজেরাই নিজেদের কাহিনিটি লেখেন… এই ছিল আমাদের বাসনা। আমাদের ডাকে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়ে এক গোছা মেয়েলেখক লিখে ফেললেন দু আড়াই মাসের মধ্যে বেশ কটি গল্প। অনেকেই জীবনে এই প্রথম লিখলেন কল্পবিজ্ঞানের ছোঁয়ালাগা গল্প বা নিছক কল্পগল্প। বেশ কিছু গল্প বাংলায় লেখা হয়েছে কিন্তু কয়েকটি ইংরেজিতে লেখা গল্পকেও বাঙলায় অনুবাদ করে নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য সুকন্যা দত্তের কাহিনি যযাতিয় লালসায়… বা রিমি বি চ্যাটার্জির কল্পগল্প মেরিলিন।

     এই সংখ্যায় যে প্রমীলা বাহিনী ছবি এঁকে, গল্প টাইপ করে অথবা প্রুফ চেক করে আমাদের সাহায্য করেছেন তাঁদের নাম।

     অসামান্য প্রচ্ছদ এঁকে সংখ্যাটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলেছেন শ্রীমতী পম্পা প্রধান। 
     ছবি এঁকে সাহায্য করেছেন –
     তৃষা আঢ্য
     অমৃতরূপা কাঞ্জিলাল
     অনুষ্টুপ শেঠ
     বাণী ভট্টাচার্য
     দীপিকা মজুমদার
 
     এ ছাড়াও অন্যান্য কাজে সাহায্য করেছেন –
     দেবস্মিতা মিত্র
     প্রিয়াংকা দাস
     সুচন্দ্রা সরকার
     সিফন বণিক
     কৃষ্ণা রক্ষিত

     সেই তোড়া সাজিয়ে দেওয়া হল। পেশ করা হল পাথকের দরবারে। দেখুন কেমন লাগে।

Tags: চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সম্পাদকীয়

6 thoughts on “সম্পাদকীয়

  • April 10, 2019 at 8:00 pm
    Permalink

    একটি অসাধারণ সম্পাদকীয়। এরকম কম পড়তে পাওয়া যায়। ব্রেভো!

    Reply
  • April 10, 2019 at 8:22 pm
    Permalink

    সত্যিই অসাধারণ! আর সত্যিই এমন সম্পাদকীয় খুব কম পড়েছি।

    Reply
  • April 10, 2019 at 8:42 pm
    Permalink

    অসাধারণ সম্পাদকীয় । অসাধারণ নির্মাণ এই সংখ্যা । শুধু মেয়েদের কলমে, মেয়েদের ছবি,যত্নে একটা কল্পবিজ্ঞান সংখ্যা। রাকা দাশগুপ্তের কবিতাটা যে কি ভালো লাগলো!

    Reply
  • April 10, 2019 at 9:52 pm
    Permalink

    খুব ভালো লাগল। প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

    Reply
  • April 11, 2019 at 7:12 am
    Permalink

    Wonderful editorial……

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!