স্মৃতিমধুর

  • লেখক: সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়
  • শিল্পী: সুমন দাস

সকালের ভারী ট্র্যাফিকের মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়িটা ধীরগতিতে চলছিল। আশপাশের গাড়িগুলো খুব জোরে হর্ন বাজাচ্ছে, ট্র্যাফিক লাইটগুলো দ্রুত রঙ পাল্টাচ্ছে। কিন্তু আমাদের গাড়ির পেছনের সিটে নির্জীবভাবে পড়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারলাম, ওই একটি নাম আমার মাথার মধ্যে বারবার ঘুরে চলেছে।  

     শীলা! শীলা!

     গোঁ-গোঁ শব্দ করে উঠলাম আমি।

     সাগর উদ্বিগ্নভাবে ড্রাইভারের সিট থেকে মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখল, “সোনা, মাথাটা খুব যন্ত্রণা করছে, না?”

     রাস্তার আলোটা লাল হয়ে গেল, দাঁড়িয়ে পড়ল আমাদের গাড়িটা। আমি মাথায় হাত দিয়ে ঢাউস ব্যান্ডেজটার অস্তিত্ব অনুভব করলাম। ব্যথা নেই, কেবল একটা ভোঁতা অনুভূতি। সাহস পেয়ে সোজা হয়ে যেই বসতে গেছি, আর যাবে কোথায়, যন্ত্রণায় মনে হল মাথাটা ছিঁড়ে পড়বে। একগাদা স্টিলের বাসনকোসন মাটিতে ফেলে দিলে যেমন শব্দ হয়, মনে হল মাথার মধ্যে সেইরকম ঝনঝন শব্দ করে শিরাগুলো যেন ফেটে পড়ছে।

     মুখ দিয়ে শুধু “উঃ-উঃ” ছাড়া আর কোন শব্দ বেরলো না আমার।

     “আর কয়েক মিনিট, তুলি,” সাগর সান্ত্বনা দিল, “একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করো। এবার যখন উঠবে, তখন দেখবে, আমরা ডাক্তারের কাছে পৌঁছে গেছি।”

     মাথা নেড়ে বোঝাতে চাইলাম যে আমি বুঝেছি, কিন্তু ওইটুকুও যেন করতে পারার মতো অবস্থা নেই আমার। তাই চোখের পাতা একবার বন্ধ করে বলতে চাইলাম, চেষ্টা করে দেখছি। গাড়ি আবার চলতে শুরু করল।

     আধো-ঘুমে আবার শুনতে পেলাম সেই বন্দুকের চেনা আওয়াজটা। আর তারপরেই কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, “শীলা!”

     এ যেন ঠিক স্বপ্ন দেখছি আমি; কিন্তু মাঝে মাঝে স্বপ্নগুলোকে এত জীবন্ত লাগে!

     সাগর বলল, “আমরা এসে গেছি, তুলি। উঠে পড়ো, সোনা।”

     গাড়ি থেকে বেরোতে আমাকে সাহায্য করল ও। মাথার ভেতরটা যেন বোমার মতো ফেটে পড়বে, কিন্তু আমি যতটা সম্ভব যন্ত্রণা উপেক্ষা করে সামনের দিকে তাকালাম। সামনের বিশাল বিল্ডিংটার গায়ে সাদা অক্ষরে লেখা আছে ‘স্মৃতিমধুর’; লেখার গায়ে আবার ধূসর ছায়ার ডিজাইন করা। ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে একটা কাচের দরজা পর্যন্ত। একটা ধূসর ইউনিফর্ম পরা লোক আমাদের দরজা খুলে দিল।

     সাগরের কাঁধে ভর দিয়ে আমি ঢুকলাম ভেতরে।

     বিরাট হলঘরটায় ডিসইনফেক্ট্যান্ট আর রুম ফ্রেশনারের লেবু-লেবু গন্ধ। চার দেওয়ালে মানুষের মস্তিষ্কের বড় বড় ছবি ঝুলছে। একটা বড় প্ল্যাকার্ডে দেখলাম একটা মানুষের মাথার খুলির কার্টুন আঁকা; খুলিটার উপরদিকটা খোলা, তার ভেতর ব্রেনটাকে দেখতে লাগছে একগাদা মজার মজার কেঁচো যেন একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে আছে। তার নিচে মজার ফন্টে লেখা আছে, “আপনার স্মৃতিগুলি মধুর; আমরা তাদের অসীম যত্ন নিই।”

     সেন্ট্রাল ডেস্কে বসা মেয়েটি সাগরকে দেখে একগাল হেসে জিজ্ঞাসা করল, “বলুন স্যার, আপনাদের জন্য কী করতে পারি?”

     “আমার নাম সাগর দত্ত। ডক্টর সাহার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল আমার স্ত্রীর।”

     মেয়েটা কম্পিউটারে কিছু একটা দেখে নিয়ে বলল, “মিসেস তুলিকা দত্ত, তাই তো? পুরনো পেশেন্ট। দ্বিতীয়বার দেখাচ্ছেন, না?”

     সাগর মাথা নাড়ল।

     দ্বিতীয় বার? যাব্বাবা, প্রথম বারেরটা আমার একদম মনে পড়ছে না কেন?

     আমার হতভম্ব মুখটার দিকে তাকিয়ে সাগর বলল, “তুলি, অ্যাক্সিডেন্টের পরে প্রথমবার যখন তোমাকে এখানে এনেছিলাম, তখন তোমার জ্ঞান ছিল না।”

     লক্ষ্মীমেয়ের মতো মাথা নাড়লাম আমি, কিন্তু ওইটুকুতেই মাথার মধ্যে এমন যন্ত্রণা পাকিয়ে উঠল যে মুখ দিয়ে একটা “উঃ” বেরিয়ে গেল।

     রিসেপশনিস্ট বলল, “কিছুক্ষণ আপনারা অপেক্ষা করুন। আরও দুজন পেশেন্টের পর আপনাদের ডাক পড়বে।”

     আমি বসে রইলাম লবিতে; সাগর বাইরে গেল সিগারেট খেতে। দুটো ছেলে বসেছিল আমার পাশে, তাদের আড়চোখে একবার দেখে নিলাম আমি। যে ছেলেটা অপেক্ষাকৃত কমবয়সী, তার গালে লাল লাল ফুটকি ফুটকি দাগ, চোখের দৃষ্টি শূন্য।

     আমাকে তাকাতে দেখে তার সঙ্গী বড় ছেলেটি একটু হাসল। আমি পালটা হাসতে সে বলল, “ও আমার ভাই। অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে আর কিছুই মনে করতে পারে না বেচারা। তবে এখানের ডাক্তাররা খুব ভালো। ওঁরা বলেছেন, ওর আবার স্মৃতি নতুন করে তৈরি করতে হবে।”

     “তৈরি করতে হবে?”

     “হ্যাঁ, ওর নাকি স্মৃতি বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই, প্রায় পুরো সাদা কাগজের মতো হয়ে গেছে। ডাক্তাররা ঐ কাগজে ঠিকঠাক স্মৃতি এঁকে দেবেন, আর যদি খারাপ কোনও স্মৃতি থাকে, তাকে মুছে দেবেন।”

     আর কিছু না বলে আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।

     ‘স্মৃতিমধুর’। নামটি কিন্তু ভারী সুন্দর।

 

***

ডক্টর সাহার মুখটা দেখতে আমার বেশ কৌতূহল হচ্ছিল, কিন্তু ভদ্রমহিলা সবসময় মুখে ডাক্তারি সবুজ মাস্ক পরে আছেন। সেই কারণেই তাঁর বয়স আন্দাজ করাও অসম্ভব। সাগরের সঙ্গে তাঁর চেম্বারে ঢুকতে তিনি আমার দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর নার্সকে হুকুম করলেন, “লিলি, মিসেস দত্তকে ঐ সিটে শুইয়ে দাও।”

     মোটাসোটা নার্সটি এসে আমার হাত ধরে একটু হেসে বলল, “কোনও ভয় নেই, ম্যাডাম। আমি এখানে নতুন হতে পারি, কিন্তু আমার কাজ আমি ভালোই জানি। একদম টেনশন করবেন না।”

     মেয়েটিকে আমার বেশ ভালো লাগল।

     যে বিশাল আরামদায়ক সবুজ রঙের চেয়ারটায় সে আমাকে শুতে সাহায্য করল, তাতে গা এলিয়ে দিতেই কেন জানি না আমার দাঁতের ডাক্তারের চেয়ারের কথা মনে পড়ে গেল। এটাতে অবশ্য আরও অনেক তার-টার লাগানো আছে, সেগুলো আবার বেরিয়েছে অদ্ভুত দেখতে সব যন্ত্র থেকে। পাশেই একটা বড়সড় এলইডি মনিটর আছে, যদিও সেটা এখন চলছে না। আমি দেখলাম, সাগর নার্ভাসভাবে ডাক্তারের দিকে তাকাচ্ছে, আর তিনিও ওকে দেখছেন, যেটা আমার কাছে একটু অদ্ভুত ঠেকল।

     ওরা বোধহয় জানে যে আমার মারাত্মক কোনও একটা রোগ হয়েছে, কিন্তু আমাকে বলতে চাইছে না।

     নার্স লিলির সাহায্যে আমি আস্তে আস্তে আমার মাথাটা ঘাড়ের নিচের কুশনে রাখলাম। সিলিং থেকে সাদা ধোঁয়াটে আলোটা আমার চোখে এসে পড়ছে, কিন্তু খারাপ লাগছে না।

     ডক্টর সাহা উঠে আমার কাছে এলেন। সাগর তাকিয়ে রইল।

     আমার মাথার মধ্যে আবার সেই বন্দুকের আওয়াজটা শুনতে পেলাম আমি; দুটো রগে তীব্র যন্ত্রণার একটা ঝলক খেলে গেল। কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠল, “শীলা!”

     আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?

     উঠে বসতে গেলাম, পারলাম না। সাগর উৎকণ্ঠিতভাবে চেয়ে আছে।

     নার্স লিলি বলল, “মিসেস দত্ত, আপনার হাজব্যান্ডকে কিছু বলবেন?”

     “হ্যাঁ।”

     হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকল নার্স। ও আসতে ডাক্তার আর নার্স একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। সাগর এসে আমার হাত ধরে নরম গলায় বলল, “কী হয়েছে, তুলি?”

     “সাগর, শীলা কে?”

     একবারের জন্য পলক পড়ল ওর, তারপরেই দেখলাম, মুখ একদম স্বাভাবিক। ও বলল, “সে আবার কে? নামটাই তো প্রথম শুনছি। কী সব বলছ তুমি?”

     “সাগর, ওই নামটা আমি বার বার শুনতে পাচ্ছি আমার মাথার ভেতরে। আমার স্বপ্নে আমি শুনছি কেউ যেন ওই নামটা ধরে চিৎকার করছে। জানো, আমার মনে হচ্ছে, অ্যাক্সিডেন্টের আগে আমি ওই নামে কাউকে চিনতাম।”

     সাগর বলল—যদিও গলাটা তার খুব একটা জোরালো মনে হল না— “এমনও তো হতে পারে, এসব তোমার মাথার খেয়াল। আঘাতটা কিন্তু বেশ জোরেই তোমার মাথায় লেগেছিল। হতেই পারে, তার ফলেই তোমার ব্রেন এমন সব জিনিস তোমাকে এক্সপেরিয়েন্স করাচ্ছে, বাস্তবে যেগুলো হয়তো কখনওই হয়নি।”

     আর কিছু না বলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। মনের মধ্যে জানি না কেন একটা কাঁটা খচখচ করতে লাগল, ও যেন আমার কাছে কিছু লুকোতে চেষ্টা করছে।

     ও আবার বলল, “ভয় পেয়ো না, সোনা। এগুলোকে বেশি পাত্তা দিও না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

     ডক্টর সাহা বললেন, “মিস্টার দত্ত, এবার আপনি দয়া করে বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। এঁর মেমোরি রেস্টোরেশান সেশন শেষ হলে আপনাকে ডাকব।”

     আমার হাতে অল্প একটু চাপ দিয়ে মুখে একটা দুর্বল হাসি নিয়ে ও বাইরে বেরিয়ে গেল।

     আমার চোখটা আবার চলে গেল সিলিং-এর ধোঁয়াটে আলোটার দিকে। ডক্টর সাহা এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন।

     “আপনার স্বামী আপনাকে খুব ভালোবাসেন, তাই না?”

     আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম, “তাই তো মনে হয়।”

     পেন্সিলের মতো সরু একটা টর্চ নিয়ে তিনি বললেন, “সোজা আলোর দিকে তাকান। মুখ তুলে রাখুন।”

     কিছুক্ষণ আমার চোখ পরীক্ষা করে তিনি বললেন, “এখনও আপনার মাথায় সিভিয়ার যন্ত্রণা হচ্ছে, মিস্টার দত্ত বললেন।”

     আমি মাথা নাড়লাম। মনের মধ্যে একটা চিন্তা চলছে, ডাক্তারকে সেই স্বপ্নের কথাটা বলব কি বলব না।

     “আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চাইছেন, মিসেস দত্ত?” ডাক্তার সাহা প্রায় অন্তর্যামীর মতো জিজ্ঞাসা করলেন।

     আমি বললাম, “আমাকে ‘তুলি’ বলতে পারেন, ডক্টর। হ্যাঁ, আমি অনেকক্ষণ আপনাকে একটা কথা বলি-বলি করেও বলতে পারছি না।”

     “নিঃসংকোচে বলুন।”

     আমি বললাম, “একটা স্বপ্ন আমি বার বার দেখছি, ডক্টর।”

     “কী স্বপ্ন?”

     “এটাকে ঠিক ‘স্বপ্ন’ বলা যায় কি না, তাও জানি না। কিন্তু আমি প্রায়ই একটা বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি মাথার মধ্যে, আর তারপরেই কে যেন চিৎকার করে বলছে, ‘শীলা!’”

     ডক্টর সাহার মাস্কপরা মুখটা এগিয়ে এল কাছে, “শীলা কে, তুলি?”

     “আমি জানি না। আমার হাজব্যান্ডকে জিজ্ঞাসা করলাম, ও-ও জানে না। কিন্তু আমি আমার স্বপ্নে বার বার ওই নামটা শুনি।”

     ডক্টর সাহা আমার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মনে হল, আমার কথা তিনি বিশ্বাস করেছেন। মাস্কের উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে কেবল তাঁর চোখদুটো। মনে হল, কত যুগ যেন তিনি ওইভাবেই আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

     আমার নার্ভাস লাগা শুরু হল। অস্বস্তিও লাগছে। তিনি কিন্তু স্থিরভাবে, নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

     থাকতে না পেরে আমিই অবশেষে বললাম, “কিছু গন্ডগোল হয়েছে নাকি, ডক্টর?”

     দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, “তুলি, আমি জানি শীলা কে।”

     আমার হতভম্ব মুখের দিকে একবার দেখে নিয়ে তিনি আবার বললেন, “সে তোমার স্বামীকে পাগলের মতো ভালোবাসত।”

 

***

“তোমার স্বামী আমাকে পুরো গল্পটাই বলেছে।”

     বিরাট, সবুজ চেয়ারটায় আমি শুয়ে আছি সিক্সটি ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে। ডক্টর সাহা দাঁড়িয়ে আছেন আমার পাশে। মোটা নার্সটির দিকে ফিরে তিনি বললেন, “লিলি, তুমি এখন যাও। আমি পরে তোমাকে ডাকব।”

     চকিতে নার্স লিলি একবার আমার মুখের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু না বলে বেরিয়ে গেল বাইরে। ডক্টর সাহা আবার আমার দিকে ফিরলেন।

     আমার মনে হল, আমার বুকের খাঁচার মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা যে ড্রাম বাজাচ্ছে, তার আওয়াজও বুঝি উনি শুনতে পাবেন। কপাল থেকে ঘামটা মুছে নিলাম হাতের পাতায়।

     সাগরের জীবনে তাহলে আরেকটি নারী আছে!

     ডক্টর সাহা বললেন, “সাগর আমাকে আমার যা যা জানার ছিল, সবই বলেছে। এই শীলা মেয়েটির মানসিক সমস্যা ছিল; সে ভাবত, সে-ই সাগরের আসল বউ, আর তোমার সঙ্গে সাগরের পরকীয়া চলছে।”

     “এসব কী আজেবাজে কথা!”

     “যা বলছি, মন দিয়ে শোনো, তুলি। সাগর আমাকে সব বলেছে, কারণ সে জানে একমাত্র এই উপায়েই তোমার প্রপার ট্রিটমেন্ট করা যাবে। ডাক্তারের কাছে কি কিছু লুকানো উচিত?”

     আমি দুর্বলস্বরে বললাম, “না। কিন্তু এর সঙ্গে আমার ট্রিটমেন্টের কী সম্পর্ক?”

     ডক্টর সাহা একটু থেমে বললেন, “সম্পর্ক আছে। সাগর যখন গতবার তার নিজের মেমোরির সমস্যা নিয়ে এখানে এসেছিল, তখন ওর চিকিৎসা আমিই করেছিলাম।”

     “আমার মতো সমস্যা ওর-ও হয়েছিল?”

     “তোমার যে সমস্যা তার থেকে অনেক কঠিন সমস্যা ওর হয়েছিল। নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য কখনও কখনও মানুষকে খারাপ কোনও স্মৃতি মুছে ফেলতে হয়। ওর সমস্যাটা ছিল সেই ধরণের।”

     “কীরকম খারাপ স্মৃতি?”

     “ওর চোখের সামনে ওর স্ত্রী একজনকে খুন করেছিল।”

     মাথার মধ্যে যন্ত্রণাটা যেন ‘দপ’ করে জ্বলে উঠল।

     আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই ডক্টর তাঁর হাতটা আমার কপালে রাখলেন, “শান্ত হও, তুলি। যত খারাপ বা যত অসম্ভবই লাগুক, তোমার ডাক্তার হিসাবে বলছি, কথাগুলো তোমার শোনা দরকার। বুঝতে পেরেছ?”

     প্রায় ফিসফিস করে আমি বললাম, “হ্যাঁ।”

     ডক্টর সাহা বলে চললেন, “খুব খারাপ কোনও স্মৃতি যখন কাউকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, তখন আমরা সেই বিশেষ স্মৃতিটিকে মেমোরি সিস্টেম থেকে বাদ দিয়ে দিই। এই স্মৃতি নিষ্কাশন করাতেই সাগর গতবার আমার কাছে এসেছিল। সেটাকে আমরা একটা ভিডিয়ো ফাইল হিসেবে ডাটাবেসে সেভ করে রেখেছি। শীলা নামটা কেন তোমার চেতনায় বার বার ফিরে আসে, সেটা বোঝার জন্য তোমাকে একবার ভিডিয়োটা দেখতে হবে।”

     আমার চেয়ারের পাশের এলইডি মনিটরটা তিনি অন করলেন। বললেন, “কিছু ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত এতে আছে ঠিকই, কিন্তু দেখলেই পুরোটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।”

    ভিডিয়ো শুরু হতেই নিজেকে দেখতে পেলাম আমি—নগ্ন অবস্থায় শুয়ে আছি সাগরের শরীরের নিচে। সত্যি বলতে কি, সাগরের শরীরের অল্প কিছু অংশই দেখা যাচ্ছে; ক্যামেরার ফোকাস আমার উপরে। মনে হল, ঠিক যেন ফার্স্ট পার্সন কোনও ভিডিয়ো গেমের কোনও দৃশ্য দেখছি।

     ডক্টর সাহা বললেন, “এটা সাগরের মেমোরি। ও যেমনটি দেখেছে, আমরাও ঠিক তেমনটিই দেখছি।”

     মনিটরে নিজের মুখের উত্তেজিত হাসিটা দেখে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল এই অপরিচিত মহিলার সামনে। নিজের প্রশ্রয়মেশানো কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম, “উঃ, কী শুরু করেছ বলো দেখি!” সাগর হেসে উঠল। আর তখনই দড়াম করে দরজাটা খুলে গেল।

     লাফ দিয়ে সাগর নেমে গেল মাটিতে, আমি তাড়াতাড়ি বেডশীটটা টেনে নিলাম গায়ে। যে মেয়েটা ঘরে ঢুকেছে, তার ডান গালে এত্ত বড় একটা আঁচিল, আর কটা চোখদুটো জ্বলছে অঙ্গারের মতো। সাগর গভীর ভাবে শ্বাস টানল, আর তার দৃষ্টি—বা ক্যামেরার ফোকাস—গিয়ে পড়ল মেয়েটার ডান হাতে। সেখানে একটা রিভলভার ধরে রয়েছে সে।

     ডক্টর সাহা আমার কানে কানে বলে দিলেন, “ঐ যে, ঐ মেয়েটাই শীলা।”

     আমরা আবার তাকালাম মনিটরের দিকে।

     চাপা গর্জন করে উঠল শীলা, “আমি জানতাম, তুমি আবার এই কুত্তীটার সঙ্গে নষ্টামি শুরু করেছ।”

     “শীলা, আমার কথা শোনো,” সাগরের গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, সে মাথা ঠান্ডা রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে।

     “তোমার নোংরা মিথ্যেকথাগুলো শোনার আর কোনও ইচ্ছা নেই আমার, সাগর।” শীলার চোয়াল শক্ত, দেখে বোঝাই যাচ্ছে সে কী করবে ঠিক করে এসেছে। রিভলভারটা সে তাক করল সাগরের দিকে, “প্রথম বুলেটটা তোমার জন্য, দ্বিতীয়টা এই কুত্তীটার।”

     ও ট্রিগার টানার আগেই আমি মনিটরে নিজেকে দেখলাম ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। আমার আঘাতটা গিয়ে পড়ল ওর মাথায়, আর ও পড়ে গেল মাটিতে, অস্ত্রটা ছিটকে গেল হাত থেকে।

     অন্য কেউ নড়ার আগেই আমি ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে নিলাম সেটা, আর পলকের মধ্যে শীলার বুকের দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে দিলাম।

     সাগর চিৎকার করে উঠল, “শীলা!”

     সবুজ চেয়ারে শুয়ে আর আমি দেখতে পারছিলাম না। চোখ সরিয়ে নিয়ে  কেঁদে ফেললাম আমি, “প্লিজ, ডক্টর, প্লিজ এটা বন্ধ করুন।”

     ডক্টর ভিডিয়োটা ‘পজ’ করে দিয়েছিলেন। বললেন, “ডোন্ট ওরি, তুলি। একবার এদিকে তাকাও।”

     আমি আবার সাহস করে তাকালাম। মনিটরে যে দৃশ্যটা থমকে আছে, সেটার মতো বিচিত্র কিছু আমি যেন জীবনে দেখিনি।

     বুককেসের ঠিক পাশেই মেয়েটি মরে পড়ে আছে, একটা হাত তার বুকের উপরে। আঙুলগুলোর ফাঁক দিয়ে একটুখানি রক্ত দেখা যাচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে আমাকে—সম্পূর্ণ নগ্ন, রিভলভার তাক করে আছি মরদেহটার দিকে!

     আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। “আমি…আমি কিভাবে এসব করে ফেললাম? আর এত ঘটনা…আমি কিচ্ছু মনে করতে পারছি না কেন?”

     ডক্টর সাহা তাঁর সবুজ মাস্কের পেছনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “মেমোরি লস খুব ট্রিকি থিং, তুলি। কিন্তু তুমি আর একটু দেখো ভিডিয়োটা। তাতে তোমার ব্রেনে স্মৃতি পুনর্গঠনের কাজটা সহজ হবে।”

     তিনি আবার ‘প্লে’ বাটনটা টিপে দিলেন। নিজেকে আবার এমন সব কাজ করতে দেখলাম, যেগুলোর একটাও আমার মনে নেই। দেখলাম, আমি সাগরকে বোঝাচ্ছি যা হয়েছে ভালোই হয়েছে, ও হতচ্ছাড়ি মরেছে ঠিক হয়েছে, এখন আমাদের লাশটা গায়েব করে ফেলতে হবে। দেখলাম আমি কোথা থেকে একটা বস্তা জোগাড় করে এনে বডিটার পায়ে সাগরের একটা পুরনো ডাম্বেল বেঁধে দিলাম। তারপর ওটাকে বস্তায় ভরে গাড়ির ট্রাংকে ভরে চালিয়ে নিয়ে গেলাম নদীর ব্রিজ পর্যন্ত। দেখলাম, আমি বস্তাটা বার করে এনে নির্জন ব্রিজ থেকে ওটা ফেলে দিলাম নদীতে। অনেকগুলো গোল গোল তরঙ্গ তুলে জিনিসটা ভুস করে ডুবে গেল। সাগরের হাত কাঁপছিল, তাই ফেরার পথে আমিই ড্রাইভ করছিলাম, আর ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম যে, এই ভালো হয়েছে; ওই পাগলীর হাতে গুলি খেয়ে মরা বা পুলিশের হাতে খুনের দায়ে ধরা পড়ার চেয়ে এই হাজার গুণে ভালো হয়েছে। আর তখনই সর্বনাশটা হয়ে গেল। কথা বলতে বলতে আমি খেয়াল করিনি যে বামদিকে বাঁকতে হবে। প্রচন্ড শব্দ করে কিসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গাড়িটা উলটে গেল…সাগরের চিৎকার…অন্ধকার…।

     ভিডিয়ো যখন শেষ হল, বুঝতে পারলাম, আমি কাঁদছি।

     ডক্টর সাহা মনিটরটা অফ করে দিলেন। শুনতে পেলাম তিনি দরজা খুলে ডাকলেন, “মিস্টার দত্ত, একবার ভেতরে আসুন।”

     সাগরের পদশব্দ এগিয়ে এল; আমার পাশে বসে ও আমার একটা হাত তুলে নিল নিজের হাতে। যা দেখেছি, তার একবর্ণও আমার মনে পড়ছে না ঠিকই, কিন্তু স্বচক্ষে যা দেখলাম, তা অবিশ্বাস করি কী করে? ওর হাতটা ধরে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁদতে লাগলাম আমি।  “আমি একটা খুনী, সাগর! আমি একটা খুনী!”

     সাগর কোমল ভাবে বলল, “কেঁদো না, সোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

     “আমি জেলে যেতে চাই না,” কাঁদতে কাঁদতে বললাম আমি।

     “কে যেতে দিচ্ছে তোমায়?” সাগর আলতো হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, “ডক্টর সাহা আমার পুরনো বন্ধু। উনি কাউকে এসব বলবেন না।”

     ডাক্তারের ডাকে নার্স লিলি এসে আমাকে চেয়ার থেকে উঠতে সাহায্য করল। সাগর বল, “আমি আপাততঃ ওকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, ডক্টর। দু’সপ্তাহ পরে আবার আসব।”

     ডক্টর সাহা মন দিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখছিলেন, লিলি নীরবে তাকিয়েছিল সেই দিকে। সাগরের কথা শুনে তিনি মুখ তুলে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন তাঁর সবুজ মাস্কের পেছন থেকে। তারপর ওর হাতে প্রেসক্রিপশনটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “তুলি, মানুষের তৈরি জেলখানার থেকেও খারাপ জেলখানা আছে। আমরা তাকে বলি, ‘স্মৃতি’।”

     যখন আমরা স্মৃতিমধুরের বাইরে এসে দাঁড়ালাম, তখনও আমার কানে কথাগুলো বাজতে লাগল।

 

***

পরের ক’টা দিন যে কিভাবে কাটল, সে আর বলার নয়। সাগর খেয়াল রাখছিল আমি ডাক্তারের দেওয়া ওষুধগুলো খাচ্ছি কি না আর ঠিকঠাক ঘুমোচ্ছি কি না। এমনকী ও আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ারও চেষ্টা করছিল। “হ্যাঁ, তুমি ওকে মেরেছ, লাশ হাওয়া করেছ, সবই ঠিক। কিন্তু ভেবে দেখো, এছাড়া আমাদের দু’জনকেই বাঁচাতে তুমি আর কী-ই বা করতে পারতে? তুমি একদম ঠিক কাজ করেছ, সোনা।”

     কিন্তু ও যতই বলুক, আমার অন্তরে আমি জানি, একটা মানুষকে খুন করা কখনও ঠিক কাজ হতে পারে না।

     চোখ বন্ধ করলেই এখন মনিটরে ‘পজ’ করা সেই দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছি। শীলা মরে পড়ে আছে মেঝেতে, একটা হাত তার বুকের উপর, আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে, আর আমি দাঁড়িয়ে আছি সোজা ওর বুকের দিকে বন্দুক তাক করে।

     প্রশ্নটা অনেকক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, অবশেষে করেই ফেললাম, “শীলার সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা ঠিক কতটা ছিল, সাগর?”

     সাগর ভ্রূ কুঁচকে বলল, “যতটা উকিল আর মক্কেলে থাকতে হয়, ঠিক ততটাই। বছর কয়েক আগে একটা ল্যান্ড-ডিসপিউট কেসে ওকে কিছুটা সাহায্য করেছিলাম আমি। সবসময় কথা হয়েছে আমার অফিসে বসে, একবার একসঙ্গে লাঞ্চ করেছিলাম, ব্যাস। কিন্তু পাগলীর মাথার মধ্যে যে এতকিছু ছিল, কে জানত!”

     ভীষণ অস্থির লাগছে আমার। আমার মধ্যেও যে একটা খুনী লুকিয়ে ছিল, আমিই কি জানতাম?”

     সাগর অফিস চলে গেল; আমি চুপচাপ বিছানায় পড়ে রইলাম। মাথার মধ্যেকার ভিডিয়ো প্লেয়ারে ওই দৃশ্যটাই বার বার প্লে হতে লাগল। আমি জানি, ওসব কথা বেশি ভাবা আমার একদম উচিত নয়, কিন্তু যখনই দু’চোখ বন্ধ করি, আমি শুনতে পাই সাগর চিৎকার করে উঠছে “শীলা!” আর তারপরেই বন্দুকের আওয়াজ; তারপর দেখতে পাই শীলার মৃতদেহ পড়ে আছে মাটিতে।

     নিজের প্রতি নিজের যে এতখানি ঘেন্না হতে পারে, আমি আগে জানতাম না।

     বাইরে বিকেলটা কী শান্ত। জানালা দিয়ে প্রায় জনশূন্য রাস্তার দিকে চেয়ে রইলাম আমি। মাঝেমধ্যে দু’একটা গাড়ি যেই চলে যাচ্ছে, অমনি মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ির ট্রাংকে কীভাবে শীলার দেহটা লোড করেছিলাম।

     খালি বাড়িতে বিছানায় পড়ে থাকাটা যেন অসহ্য লাগছে। জোর করে উঠে পড়ে ঘরগুলোয় ঘুরে বেড়াতে লাগলাম ভূতের মতো।

     ভূতই বটে! অতীতের ভূত!

     ডক্টর সাহার শেষ কথাগুলো মনে পড়ে গেল, “তুলি, মানুষের তৈরি জেলখানার থেকেও খারাপ জেলখানা আছে। আমরা তাকে বলি, ‘স্মৃতি’।”

     আমিই তো সেই জেলখানার বন্দী—আমার নিজের স্মৃতির কালকুঠরী থেকে বেরনোর উপায় জানা নেই আমার।

     একসময় বডি-বিল্ডিং-এর শখ হওয়ায় বাড়ির পেছনে একটা ছোটখাটো জিম করেছিল সাগর, ঘুরতে ঘুরতে ঢুকলাম গিয়ে সেখানে। দুটো ডাম্বেলের একটা দেখি পড়ে আছে। দ্বিতীয়টা নিয়ে কী করেছি, সে আমিই জানি।

     হাঁটতে হাঁটতেই জিনিসটা নজরে পড়ল আমার। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লাম ওখানে। এ জিনিস এখানে কী করে এল?

     দ্বিতীয় ডাম্বেলটা!

     আমি ভালোই জানি, ডাম্বেল এক জোড়ার বেশি সাগরের ছিল না। ম্যাজিক দেখে বাচ্চারা যেমন বোকার মতো তাকিয়ে থাকে, আমিও তেমনই তাকিয়ে রইলাম।

     দুটো ডাম্বেলকেই ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখলাম দুটোর উপরেই দীর্ঘদিনের অব্যবহারে পুরু ধুলো জমেছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বহুকাল ওদের কেউ ছুঁয়েও দেখেনি। তাহলে?

     পুরো ব্যাপারটা এতটাই গোলমেলে যে আবার আমার মাথা ধরে গেল। বেডরুমে ফিরে এসে বিছানায় থম হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। আমার স্মৃতিটা বোধহয় আবার কোনও গোলমাল পাকাচ্ছে। আমি নিজেও জানি, মানসিক অবস্থা আমার খুব একটা ভালো নয়।

     কিন্তু প্রশ্নটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছে না—এই ডাম্বেলটা কোথা থেকে উদয় হল?

     সাগর কি এখনও আমার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছে?

     নিশ্চয়ই আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ব্যাপার মিস করে যাচ্ছি। আমার মাথার যন্ত্রণা আর স্মৃতিলোপ—এই দুটো মিলে আমার বুদ্ধিটাকে বোধহয় কিছুটা ভোঁতা করে দিয়েছে।

     আর ভিডিয়োর ওই দৃশ্যটা! কী একটা যেন গলদ আছে ওতে। কিন্তু সেটা যে কী, কিছুতেই বুঝতে পারছি না।

     মাথা ঠান্ডা করে একটু ভাবতেই একটা অদ্ভুত প্রশ্ন মনে এল। সাগর আমাকে প্রথমবার স্মৃতিমধুরে নিয়ে গিয়েছিল কেন?

     কী যেন বলেছিল ও?

     “তুলি, অ্যাক্সিডেন্টের পরে প্রথমবার যখন তোমাকে এখানে এনেছিলাম, তখন তোমার জ্ঞান ছিল না।”

     কিন্তু আমাকে ও ওখানে নিয়ে গেল কেন? আমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল; আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। সাধারণ কোনও হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে ও আমাকে ওখানে নিয়ে গেল কেন? ও কী করে জানল যে আমার স্মৃতিলোপ হয়েছে?

     অসম্ভব। ওর পক্ষে এটা জানা অসম্ভব।

     মনে পড়ে গেল, ডক্টর সাহা কীভাবে বার বার ইঙ্গিতপূর্ণভাবে ওর দিকে তাকাচ্ছিলেন। ওই মহিলা নিশ্চয়ই এমন কিছু জানেন যা আমি জানি না।

     ঘরের মধ্যে ছটফট করে বেড়াতে লাগলাম আমি। কী লুকোচ্ছে ওরা আমার কাছ থেকে?

     যে আয়রন সেফে সাগর তার অফিসের দরকারি কাগজপত্র রাখে, সেটার দিকে আমার নজর পড়ল। সেফটা খুললাম আমি; নিজেই অবাক হয়ে দেখলাম যে লক-কম্বিনেশনটা আমার এখনও মনে আছে। কিন্তু খুলতেই যে বস্তুটি নজরে পড়ল, সেটি দেখতে পাওয়ার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

     সামনেই রাখা আছে রিভলভারটা।

     আমি নিশ্চিত, এটাই দেখেছিলাম ভিডিয়োতে শীলার হাতে। এ জিনিসটা আমাদের ফ্যামিলি সেফে কী করছে? কে রাখল এটা এখানে?

     উত্তরটা মোটেই কঠিন নয়। আমি ছাড়া আর একজনই তো জানে সেফের কম্বিনেশন।

     আমার মন বলছে, সেফের মধ্যে আরও বিস্ফোরক জিনিস আছে।

     এবার বেরলো একটা ফাইল, তার মধ্য থেকে বেরলো একটা ইন্সুরেন্স পলিসি; পলিসি হোল্ডারের নাম মিসেস শীলা দত্ত।

     মিসেস দত্ত! হে ভগবান!

     টাকার মূল্য? বারো লাখ।

     নমিনি কে? মিস্টার সাগর দত্ত।

     আমি ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। শীলার ব্যাপারে ও যা কিছু আমাকে বলেছে, সব মিথ্যা।

     আমার স্বামী একটা জলজ্যান্ত মিথ্যাবাদী!

     ও শীলাকে বিয়ে করেছে আর আমাকে মিথ্যা বলেছে। ও আমাকে স্মৃতিমধুরে নিয়ে গেছে আর আমাকে মিথ্যা বলেছে। ও মার্ডার ওয়েপনটা বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে আর আমাকে মিথ্যা বলেছে। ভগবান! আর কী কী মিথ্যা বলেছে ও আমাকে?

     রাগে, দুঃখে, অভিমানে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। সামনের টেবিলে রাখা চাইনিজ ফুলদানিটা তুলে আছাড় মারলাম মেঝেতে, চূর্ণ হয়ে গেল জিনিসটা।

     তারপর আমার চোখ পড়ল টেবিলের উপর আমাদের স্বামী-স্ত্রীর বাঁধানো ছবিটায়।  দু’জনে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছি দাঁত বার করে। গোয়ায় আমাদের প্রথম হানিমুনে তোলা হয়েছিল ছবিটা। আমি হাসতে হাসতে মুখ বাঁকিয়েছি আর সাগর আমাকে জড়িয়ে আছে পেছন থেকে। দেখেই যেন মাথায় খুন চেপে গেল।

     মিথ্যাবাদী কোথাকার!

     লাফ দিয়ে ওটা তুলে নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারলাম মাটিতে। ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙার শব্দটা মনের মধ্যে যেন একটা দানবীয় তৃপ্তি এনে দিল। আমাদের দাঁত বার করা মুখদুটো ভাঙা কাঁচের মধ্য থেকে যেন আমাকে ভেংচি কাটতে লাগল।

     ফ্রেমটাতে এখনও কাঁচ লেগে আছে। সাবধানে ওটা হাতে নিলাম আমি, কাঁচের ভাঙা টুকরোগুলো ঝেড়ে ফেললাম মাটিতে। ছবিটা উলটে দেখতেই চোখে পড়ল সাগরের হাতের লেখায় দুটো নাম। ছবিটা বাঁধানো ছিল বলে এতদিন চোখে পড়েনি।

     লেখা আছে, “সাগর-শীলা!”

     আমার ছবিতে শীলার নাম কেন?

     মনে হল, কেউ যেন তলপেটে অতর্কিতে জোর একটা লাথি কষিয়েছে আমাকে।

     গালের উপর জল শুকিয়ে গেছে। আর আমার কান্না পাচ্ছে না,  তার জায়গা নিয়েছে একটা অজানা ভয়।

     “সাগর-শীলা?” আমাদের দু’জনের ছবিতে?

     আমি বুঝতে পারছি, একটা অকল্পনীয় মিথ্যার জালে জড়িয়ে পড়েছি আমি। আর আমার স্বামীরত্নটি হচ্ছে সে জালের কেন্দ্রে ঘাপটি মেরে বসে থাকা মাকড়সা। সে দেখছে, অসহায় পোকাটা কীভাবে নিজেকে এই জালে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলে।

     স্মৃতির জালে… মিথ্যার জালে!

     দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমি। সাগরের ফিরতে দেরি আছে এখনও; আমাকে আর একবার স্মৃতিমধুরে যেতে হবে।

     ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সঙ্গে সঙ্গে। ধূসর ইউনিফর্ম পরা সেই লোকটাই দরজা খুলে দিল। মানুষের মস্তিষ্কের ছবিভরা ঘরটার প্রান্তে যেখানে রিসেপশনিস্ট মেয়েটি বসেছে, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। সে পেশাদারী একটা হাসি হেসে বলল, “বলুন ম্যাম, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?”

     আমি বললাম, “আমার নাম মিসেস তুলিকা দত্ত। আমি ডক্টর সাহার পেশেন্ট। আমি জানি আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই, কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের জন্য কি ওঁর সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে? বিশ্বাস করুন, খুব জরুরি দরকার।”

     রিসেপশনিস্ট মেয়েটি সহানুভূতির সঙ্গে মাথা নাড়ল, “একটু ওয়েট করুন ম্যাম। আমি দেখছি, কী করতে পারি।”

     ফোনে কিছুক্ষণ কথা বলে সে বলল, “ডক্টর সাহা আপনার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছেন। ভেতরে চলে যান।”

     কিন্তু ভেতরে যাওয়ার আগেই দেখলাম সেই মোটাসোটা নার্স লিলি আমার দিকে আসছে। আমি হাসলাম, কিন্তু সে হাসল না, চাপা গলায় বলল, “মিসেস দত্ত, ভেতরে যাওয়ার আগে মনে রাখবেন, এমন অনেক ব্যাপার আছে যেগুলোর সম্বন্ধে আপনি কিছুই জানেন না।”

     নিজের মনেই হাসলাম আমি। সত্যিই তো, এতসব ব্যাপারের কতটুকুই বা জেনে উঠতে পেরেছি?

     “ব্যাপারগুলো কী, বললে ভালো হয়,” বললাম বটে, কিন্তু এর সঙ্গে আমি এখন কথা বলতে চাইছি না। আমার সর্বসত্তা এখন চাইছে ডক্টর সাহার সঙ্গে দেখা করতে।

     নার্স লিলি বলল, “অনেক এমন ব্যাপার এখানে চলছে যেগুলো এই ইন্সটিটিউশনের পলিসির বিপক্ষে।”
আমার বিরক্ত লাগছিল। আমি বললাম, “এক্সকিউজ মি, আমাকে এখনই একবার ডক্টরের সঙ্গে দেখা করতে হবে।”
নার্স লিলির মুখটা যেন পাথরে কোঁদা। সে বলল, “আপনার ভালোর জন্যই বলছিলাম। যাই হোক, মনে রাখবেন, এমন অনেক চোখ আছে, যেগুলো স্বয়ং ডাক্তারও দেখতে পান না। আর ওইটুকুই আপনার ভরসা।”

     আমাকে পেরিয়ে একটা কেবিনের দরজা খুলে ঢুকে গেল সে। এক পলকের জন্য দেখতে পেলাম, ভেতরে একটা কম্পিউটারের সামনে এক গম্ভীর মুখের ভদ্রলোক বসে আছেন। তারপর লিলি দরজা বন্ধ করে দিল। চোখে পড়ল, দরজার উপর লেখা আছে, ‘ডাইরেক্টর’।

     ডক্টর সাহার চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি।

     ঘরের ভেতরে তিনি তাঁর চেনা সবুজ মাস্ক পরে চেয়ারে বসে ছিলেন। মুখের বাকি অংশ দেখা যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু চোখদুটো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, আমাকে দেখে তিনি সত্যিই অবাক হয়েছেন।

     “কী হয়েছে, তুলি? মাথার যন্ত্রণাটা বেড়ে গেছে নাকি? ওষুধগুলো কি ঠিকঠাক খাচ্ছ না?”

     শান্তভাবে গিয়ে তাঁর পেছনে দাঁড়ালাম আমি, হ্যান্ডব্যাগ থেকে রিভলভারটা বার করে নলটা ঠেকালাম তাঁর ঘাড়ে।

     “একদম আওয়াজ নয়, ডক্টর সাহা। নয়তো সারাজীবনে আর কোনওদিন আওয়াজ করার সুযোগ পাবেন না।”

 

***

প্রথম কথা যেটা ডক্টর সাহার মুখ দিয়ে বেরলো, সেটা হল, “আমি না, আমি না, পুরোটাই সাগরের প্ল্যান! প্লিজ, আমাকে মেরো না!”

     ফ্রেম থেকে খুলে আনা ফটোটা টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে বললাম, “এটা কী?”

     এক পলকে জিনিসটা দেখে নিয়ে আক্ষেপের ভঙ্গিতে তিনি বললেন, “সাগরটা একটা ওভার-কনফিডেন্ট বোকা। ঘর থেকে আগেই এগুলো ওর সরিয়ে ফেলা উচিত ছিল।”

     আমি চাপা গর্জন করে বললাম, “আমার সঙ্গে গেম খেলবেন না, ডক্টর সাহা। আমি বুঝে গেছি, ভিডিয়োটা পুরো নকল ছিল। ডাম্বেলটা এখনও ঘরে পড়ে আছে। এই রিভলভারটাও ঘরেই ছিল। আর, আমি কোন হাতে এটা ধরে আছি, দেখতে পাচ্ছেন তো?”

     বুঝতে তাঁর দু’সেকেন্ড সময় লাগল। তারপর উত্তেজিতভাবে বললেন, “ওঃ, তুমি তো বাঁ-হাতি! সাগরটা এত বোকামি করবে, ভাবতেই পারিনি।”

     “শীলাকে গুলি করার দৃশ্যটা ভাবতে ভাবতেই বুঝতে পারলাম, ভিডিয়োটা ফেক। ওতে দেখাচ্ছিল, আমি ডানহাতে বন্দুক ধরে ফায়ার করছি। খুব ভুল হয়ে গেছে, না?” মহিলার ঘাড়ের উপর সজোরে মাজলটা চেপে ধরলাম আমি।

     কাঁদো কাঁদো স্বরে ডক্টর সাহা বললেন, “প্লিজ, আমাকে মেরো না!”

     নিজের মাথা ঠান্ডা রাখার ক্ষমতা দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। বললাম, “কথা দিতে পারছি না। তবে আপনি বোকার মতো কিছু না করলে আপনার বিপদ হওয়ার চান্স কম। এবার ব্যাপারটা খুলে বলুন দেখি।”

     ডক্টর সাহা গড়গড়িয়ে বলে চললেন, “আসলে আমি আর সাগর মিলে স্মৃতিমধুরের অ্যাডভান্সড সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভিডিয়োটা বানিয়েছিলাম। সাগর আমাকে এনে দিয়েছিল তোমাদের বাড়ির কয়েক হাজার স্ন্যাপশট আর আমি অ্যানিমেশনটা করেছিলাম। এর আগে এখানে স্মৃতি হারিয়ে ফেলা রোগীদের স্মৃতি তৈরি করার জন্য আগেও এরকম প্রো-লেভেলের কাজ করেছি আমি। সাগর এসে যখন আমাকে বলল, ওর এই কাজটা যদি করি, তাহলে আমরা বড়লোক হয়ে যাব, আমি আর তখন নিজেকে সামলাতে পারলাম না। সাগর… কী ভালোবাসে আমাকে ও জানো?” বলতে বলতে তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

     “বাজে কথা ছাড়ুন,” আমার গলার স্বর কঠোর হয়ে উঠল, “শীলাটা তাহলে কে?”

     চুপ করে রইলেন তিনি।

     কী সন্দেহ হতে টান মেরে তাঁর মুখের মাস্কটা খুলে নিলাম আমি। এই তো!

     যে মেয়েটিকে আমি ফেক ভিডিয়োতে গুলি করে মেরেছিলাম, এ তো হুবহু সেই মুখ। এমনকী ডান গালে তিলটি পর্যন্ত হুবহু মিলে গেছে।

     “তাহলে আপনিই আসলে শীলা?”

     একটু হেসে মাথা নাড়লেন তিনি, “না, আমি তুলি, তুলিকা সাহা। তুমিই হচ্ছ আসল শীলা, বোকা মেয়ে। মিসেস শীলা দত্ত, সাগর দত্তের স্ত্রী। তোমার স্বামী তোমাকে মাথায় মেরে অজ্ঞান করে দেওয়ার পর গত দু’সপ্তাহ ধরে তোমার ‘তুলি’ হওয়ার স্মৃতি তোমার ব্রেনে ইঞ্জেক্ট করা হচ্ছে।”

     আমি শক্ত করে টেবিলটা ধরে নিজেকে স্থির রাখলাম। দুটো রগে প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হল। বন্দুকটা এখনও ওঁর দিকে তাক করে রেখেছি বটে, কিন্তু বুঝতে পারছি, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ কমে আসছে।

     ডক্টর সাহা বললেন, “এ কাজটাকে আমরা এখানে বলি ‘মেমোরি পেইন্টিং’। একটা ক্যানভাসে পুরনো একটা ছবিকে হোয়াইটওয়াশ করে তাতে আবার নতুন ছবি এঁকে দেওয়ার মতোই ব্যাপারটা। অবশ্য তোমার কেসটায় হোয়াইটওয়াশিং আর নতুন পেইন্টিং এর কাজটা ঠিকমতো করা যায় নি। এটা সময়সাপেক্ষ কাজ। পার্ফেক্ট মেমোরি পেইন্টিং করতে এক বছর সময় লাগে, কিন্তু তোমার বেলায় আমরা পেয়েছি মোটে দু’সপ্তাহ। খুব গোপনে করতে হয়েছে কি না। স্মৃতিমধুরের ডায়রেক্টর জানেনই না যে এখানে আমরা সম্পূর্ণ হেলদি মেমরির একজনের ব্রেনে পেইন্টিং করছিলাম।”

     “ইন্সুরেন্সের টাকাটার জন্য, তাই না?”

     অদ্ভুত একটা হাসি খেলে গেল ডক্টর সাহার মুখে, “ঠিক ধরেছ। কিন্তু তোমার স্বামী মনে হয় আমার থেকে বেটার এক্সপ্লেন করতে পারবে ব্যাপারটা।”

     আমার পেছনের দরজাটা যে কখন খুলেছে, আমি বুঝতেই পারিনি। পেছন ফেরার আগেই আমার মাথায় ভারী কী একটা জিনিস এসে পড়ল। রিভলভারটা আমার হাত থেকে ছিটকে পড়ল, আর আমি গড়িয়ে পড়লাম মেঝের উপর। ডক্টর সাহা সঙ্গে সঙ্গে ওটা কুড়িয়ে নিলেন।

     আমি পড়ে আছি নিঃসাড়ে। সাগরের কন্ঠস্বরটা যেন ভেসে এল বহুদূর থেকে, “হ্যালো, শীলা।”

     রিসেপশন থেকে যেই ডক্টর সাহাকে জানিয়েছিল যে আমি এসেছি, উনিও নিশ্চয়ই সঙ্গে সঙ্গে সাগরকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছিলেন।

     আমার অসাড় দেহটা ধরে ওরা আমাকে বসিয়ে দিল সে বিশাল, সবুজ চেয়ারটায়। সাগর আমাকে শক্ত করে বাঁধল। অনুভব করলাম, আমার মাথায় অনেকগুলো ইলেক্ট্রোড আটকে দেওয়া হচ্ছে। সাগর বলল, “ঐ স্লো-পয়জনিং পিলগুলো খেয়ে মরলেই ভালো করতে, শীলা। বেকার এত ঝামেলা করতে হত না।”

     আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। আমি যে একসময় এই মানুষটাকে ভালো বেসেছিলাম ভাবতেই আমার গা গুলোচ্ছে।

     ও হাসছে। মাকড়সাটা তৈরি।

     “তোমরা এখন কী করবে?” কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, মাথায় যন্ত্রণা করছে।

     ডক্টর সাহা বললেন, “তোমার জন্য ছোট্ট একটা দুর্ঘটনার ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের।”

     ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। ওরা আমাকে কোনমতেই ছেড়ে দেবে না। আমি অনেক কিছু জেনে ফেলেছি। তার উপর ওদের সেই টাকাটা চাই।

     ঢোঁক গেলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না।

     সাগর বলল, “তুলি তোমার ব্রেনে ছোট্ট একটু কাজ করবে,  তারপর তোমাকে ছেড়ে দেব।”

     “কী কাজ?”

     “ও তোমার ব্রেনকে নির্দেশ দেবে এই সন্ধ্যার ট্র্যাফিকে ভরা রাস্তায় এলোমেলো ছুটে বেড়াতে। সেই টেকনোলজি ওর হাতে আছে। আমি বুঝতে পারছি সোনা, উপায়টা ভালো নয়। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট হওয়াটা ইন্সুরেন্স মানি আদায়ের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক।”

     হঠাৎ সেই দুই ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। কী যেন বলেছিল ছেলেটা? “ডাক্তাররা ওই কাগজে ঠিকঠাক স্মৃতি এঁকে দেবেন, আর যদি খারাপ কোনও স্মৃতি থাকে, তাকে মুছে দেবেন।”

     এরাও আমার সঙ্গে ওইরকমই কিছু একটা করতে যাচ্ছে। আমার এই ‘আমি’টাকে মুছে দিয়ে অন্য একটা আমিকে এঁকে দেবে আমার মাথার মধ্যে—এমন একটা ‘আমি’ যে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে থাকবে এই ভরা ট্র্যাফিকের মধ্য দিয়ে, যতক্ষণ না কোনও দ্রুতগামী গাড়ি এসে…

     তুলির মুখটা আমার এত কাছে চলে এসেছে যে আমি তাঁর মুখের পিপারমিন্টের গন্ধ পাচ্ছি। একটু আগে তাঁর সেই ভয়ার্ত ভাবটা এখন বেমালুম উধাও হয়ে গেছে। তার জায়গা নিয়েছে শত্রুনিধনের পৈশাচিক আনন্দ।

     চাপা গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে তিনি বললেন, “আমার সাগরের সঙ্গে এক বিছানায় তুমি শুয়েছিলে না? ওটা তোমার চিরকালের মতো ভুলে যাওয়া দরকার।”

     আমার চেয়ারের পাশের কন্ট্রোল প্যানেলে একটা সুইচ টিপলেন তিনি।

     মাথার মধ্যে ইলেকট্রিক কারেন্টের মৃদু শক লাগল একবার, কিন্তু তারপরেই চেম্বারের দরজাটা হাট করে খুলে গেল, ভেতরে এসে ঢুকল সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী।

     একটা রুক্ষ্ম কন্ঠে আদেশ এল, “হাত তোলো!”

     আমার চেয়ারের পাশে ওরা দু’জন দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক মড়ার পাশে দুটো শকুনের মতো। অবাক হয়ে শূন্যে হাত তুলল ওরা।

     তারপর দেখতে পেলাম নার্স লিলির বিশাল চেহারাটা দৌড়ে কন্ট্রোল প্যানেলে এসে একটা সুইচ বন্ধ করে দিল। মাথার মধ্যে যে মৌমাছির মতো গুঞ্জনটা হচ্ছিল, সেটা বন্ধ হয়ে গেল।

 

***

এতক্ষণ এত ভয়ংকর সব ঘটনা দেখলাম, তারপরে নার্স লিলি যে স্মৃতিমধুরের ডায়রেক্টরের মেয়ে—এ খবরটা আর খুব একটা আশ্চর্য করল না।

     গম্ভীরমুখো ডায়রেক্টর নিজে আমার কাছে এসে বললেন, “আমাদের একজন স্টাফ আপনার সঙ্গে যা করেছে, তার জন্য আমরা আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি, মিসেস দত্ত। আপনার পুরনো স্মৃতি যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা আমাদের যথাসাধ্য করব, কথা দিচ্ছি।”

     “এদের দু’জনের কী হবে?”

     লিলি বলল, “ওদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ। অ্যাটেম্পটেড মার্ডার তো আছেই, সেই সঙ্গে আন-অথরাইজড মেমোরি পেইন্টিং এবং নিষিদ্ধ মেডিকেশন প্রেস্ক্রাইব করার মতো ক্রাইমও আছে। আগের দিন ডক্টর সাহা আপনাকে যে ওষুধগুলো লিখছিলেন, সেগুলো দেখেই বুঝেছিলাম, উনি বিপজ্জনক কিছু করতে চান। তখনি বাবাকে বলে ওঁর অজান্তে চেম্বারে সিসি ক্যামেরা বসানো করিয়েছি। আজ এখানে যা কিছু হয়েছে, পুরোটাই গোপন সিকিউরিটি ক্যামে ধরা আছে।”

     ওদের বাপ বেটিকে যখন ধন্যবাদ দিচ্ছি, তখন দেখলাম, সাগর আর তুলিকাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কেন জানি না, গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়ালাম আমি।

     তুলিকা কিচ্ছু বলল না, কিন্তু সাগর বলে উঠল, “শীলা, তুমি কি ভুলে গেলে কত সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি?”

     আমি হাসলাম। সেই বরাবরের ওভার কনফিডেন্ট বোকা সাগর!

     বললাম, “সাগর, আমার যে কিচ্ছু মনে পড়ছে না।”

Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ডিটেকটিভ সায়েন্স ফিকশন, সুমন দাস, সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়

16 thoughts on “স্মৃতিমধুর

  • August 17, 2019 at 8:48 am
    Permalink

    দুর্দান্ত! প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের জন্য একেবারে আদর্শ কল্পবিজ্ঞান ও রহস্যের মিশেল। পরের গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।

    Reply
    • August 17, 2019 at 12:47 pm
      Permalink

      আপনার মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ, ঋজুবাবু। ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগল।

      Reply
  • August 17, 2019 at 9:28 am
    Permalink

    বাঃ। একটা সাধারণ কনসেপ্ট কে অসাধারণ ভাবে রিপ্রডিউস করেছ। আর গল্পের ডিকটেশনটিও চমৎকা।

    Reply
    • August 17, 2019 at 12:48 pm
      Permalink

      Thank you Sir for your opinion.

      Reply
  • August 18, 2019 at 7:09 am
    Permalink

    রহস্য এবং কল্প বিজ্ঞানের যথার্থ মিশেল ! খুব ভাল লাগলো পড়ে !

    Reply
    • August 18, 2019 at 10:08 pm
      Permalink

      You are an inspiration , Sir. Thank you.

      Reply
  • August 18, 2019 at 5:05 pm
    Permalink

    khub bhalo,jodio ektu predicatble

    Reply
    • August 18, 2019 at 10:05 pm
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য।

      Reply
  • August 20, 2019 at 10:15 am
    Permalink

    এই সংখ্যার একটি অন্যতম সমৃদ্ধ গল্প। আরও চাই।

    Reply
    • August 21, 2019 at 8:57 am
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ আপনাকে । এই ভাল লাগাটুকুই আমার পরম প্রাপ্তি।

      Reply
  • August 20, 2019 at 12:43 pm
    Permalink

    খুব ভালো লাগলো। কনসেপ্টটাও দারুন।

    Reply
    • August 21, 2019 at 8:59 am
      Permalink

      আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুবই আনন্দিত হলাম। অনেক ধন্যবাদ, ম্যাম।

      Reply
  • August 22, 2019 at 2:19 am
    Permalink

    স্মৃতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কথা বললেই eternal sunshine of the spotless mind এর কথা মনে পড়ে। এই গল্পটা পড়েও বেশ লাগল। অপরাধ, রহস্যের সঙ্গে কল্পবিজ্ঞানের মশলার পরিমিত ব্যবহারে একটা গতিময় কাহিনি।

    Reply
    • August 22, 2019 at 3:21 am
      Permalink

      আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগল।

      Reply
  • August 24, 2019 at 11:43 am
    Permalink

    বাহ, বেশ ভালো লাগলো, ব্রেন…খুব ভালো কনসেপ্ট

    Reply
    • August 24, 2019 at 10:15 pm
      Permalink

      Glad to hear it, Mam. Thank you.

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!