ঈশ্বরের বাগান
লেখক: প্রদীপ কুমার বিশ্বাস
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
অনেক দূর থেকে আমার নাম ধরে কে যেন ডাকছে। চোখ খোলবার জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হল সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের পর কাঁচা ঘুমের চোরাবালিতে ডুবে যেতে থাকা চেতনাকে টেনে আনতে।
তারার চাঁদোয়ার তলায় গাছের ডালে বাঁধা হ্যামকে আমি কোন কারণে শুয়ে আছি এটা মনে আসতে অবশ্য সেকেন্ড খানিকের বেশি লাগল না।
সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম পাশের ডালে বাঁধা হ্যামক থেকে চাপা গলায় আমার নাম ধরে ডাকছে আমার বন্ধু যীশু।
আমি সাড়া দিতেই যীশু বললে “তোকে ঘুম থেকে না তুলে আর পারলাম না। কপাল ভাল থাকলে আবার হয়ত দেখতে পাবি”।
পাহাড়তলির ঝরনার ধারে কোনও বন্য প্রাণী দেখেছে যীশু, নেকড়ে কিম্বা লেপার্ড নয়তো? নাইট ভিশন বাইনোকুলারে চোখ লাগাতে যাচ্ছি এটা আন্দাজ করেই যীশু বললে “নাইট ভিশন লাগবে না, খালি চোখেই দেখতে পাবি”।
পাহাড়তলির আরো নিচে এঁকে-বেঁকে চলা নদীর উত্তর পাড়ের জঙ্গলে জোনাকির টুনি বাল্ব জ্বলছে আর নিভছে। আকাশ আলো করে একটা বড় আকারের উল্কা চলে গেল সেই জঙ্গলের দিকে, যেন কোনও ফাইটার প্লেন আলোর জ্বলা নেভা সঙ্কেত পেয়ে নেমে যাচ্ছে গোপন বিমান ঘাটিতে।
আমি বললাম “যীশু, সারা রাত জেগে থাকলে এ রকম অনেক দেখতে পাবি। কিন্তু কাল সারাদিন অনেক বড় ধকল …”।
যীশু বললে “শুধু ধূমকেতু দেখবার জন্য তোমাকে ঘুম থেকে তুলি নি”।
“তাহলে?”
যীশু বললে “অবাক করে দেওয়ার মতো এক ব্যাপার দেখলাম। ধূমকেতু বা উল্কা কি মাটির বুক থেকে আকাশে উঠে হারিয়ে যেতে পারে?”
“আমার চিন্তা হচ্ছে তোর জন্য। মনে হচ্ছে তোর কাপ নুডলে বোধ হয় ভাং …”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই যীশু বললে “আমি যা দেখেছি তাই বলছি। খানিক আগে, ওই পশ্চিম কোন থেকে একটা উজ্জ্বল নীল রঙের আলো, অনেকটা বড় ধূমকেতুর মত দেখতে, আকাশে উঠেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হারিয়ে গেল”।
আমি এবার একটু চিন্তায় পড়লাম “ওটা কি দেওয়ালির রাতে আকাশে ওঠা রকেট বাজির মত?”
“একদম না। ধূমকেতুর মত, শব্দহীন, ধোঁয়াহীন আর এত তাড়াতাড়ি সেটা আকাশে মিলিয়ে গেল যে তোকে ডাকবার সময়ই পেলাম না”।
একটা বড় পেঁচা আমাদের গাছের দিকে আসছিল, আমরা ওর শিকার নই বুঝতে পেরেই হয়ত শেষ মুহূর্তে ডানা ঝটপটিয়ে পালিয়ে গেল।
যীশু যা দেখেছে সেটা এক ধরনের বড় মাপের হাউই বাজি হতে পারে। এদিকে মিলিটারির কোনও ক্যাম্প হয়ত আছে। শুনেছি রাতের আধারে দুশমন কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে কিনা সেজন্য ওরা এ রকম হাউই বাজি ছাড়ে। কিন্তু ও যা দেখেছে তা কিন্তু মিলিটারির ট্রেসার রকেটের সাথে সবটা মিলছে না।
এটা যদি নিছক নৈশ মিলিটারি রুটিন না হয় তবে কাল জঙ্গলের মধ্যে ওষধি গাছের সমীক্ষা করতে গিয়ে মুস্কিলের মধ্যে পড়তে হতে পারে আমাদের।
কাল সকালে জঙ্গলে কাজ শুরু করার আগে সার্ভের জন্য ভাঁজ করে রাখা লম্বা রেঞ্জ-রডের মাথায় একটা বড় সাদা পতাকা নিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
এ কথা অবশ্য এখনি যীশুকে বলে লাভ নেই। এই প্রথম এত গভীর বনে এসেছে, এমনিতেই মনে অনেক ভয় চেপে রেখেছে, শুনলে বাকি রাতটা জেগেই কাটিয়ে দেবে।
ওর হ্যামকের দিকে চেয়ে মনে হচ্ছে আর একটা ওই রকম রকেট দেখবার আশায় তারায় ভরা আকাশের দেকে চেয়ে থাকতে থাকতে এইবার ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
মনে সদ্য চেপে বসা উদ্বেগটা তাড়াবার জন্য আজকের পুরো দিনটার ঘটনাগুলোর কথা ভাবতে শুরু করলাম। এটা না করলে ঘুম আসবে না।
বন্দর শহর থেকে চারশো কিলোমিটার দূরে সারি সারি পাহাড় আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা ধুমডিলাতে আমরা এসেছি একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির হয়ে কয়েকটা ঔষধি গাছের বিশাল আকারের উৎপাদন যোগ্য জমি,মাটি এবং জল-হাওয়ার সমীক্ষা করতে।
আমি উদ্ভিদ এবং পরিবেশ বিজ্ঞানী আর যীশু ভূতত্ত্ববিদ এবং উপগ্রহ চিত্র বিশেষজ্ঞ। উপগ্রহ চিত্র এবং পরিবেশ বিশ্লেষণ করে নানারকম বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা দুজনে একমত হই যে ওষুধ কোম্পানি যা খুঁজছে তা হয়ত আছে এই ধুমডিলাতে।
এবার সেখানে গিয়ে আরও কিছু খুঁটিনাটি এবং মাটির গুণাগুণ জানতে হবে। ওষুধ কোম্পানি এক কথায় রাজি হয়ে গেল এই অভিযানের পুরো খরচ বহন করতে। সপ্তাহ খানেকের রসদ আর কাজের জন্য দরকারি সব যন্ত্রপাতি আমাদের দুটো ঢাউস সাইজের ব্যাকপ্যাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ধুমডিলার পথে।
ধুমডিলা স্টেশন চত্বর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে জি পি এসের সহায়তায় আমরা বিকেল গড়াবার অনেক আগেই এই এলাকার মন্দার পাহাড়ের চুড়াতে পৌঁছে গেলাম।
ধুমডিলাতে রেললাইন গেছে দুই সারি পাহাড়ের মাঝের উপত্যকা দিয়ে এলুমিনিয়াম খনিজ বক্সাইট পাহাড়শ্রেণীর দিকে।
এখানে আসার আগে উপগ্রহ চিত্রে সব কটা পাহাড় দেখার পর আমরা অনেক কারণেই স্থির করেছিলাম যে প্রথম দিনে মন্দার পাহাড়ের চুড়োতে পৌঁছে গেলে পুরো অঞ্চলটা যেমন সংক্ষেপে ও তাড়াতাড়ি চেনা-জানা যাবে তেমনি চুড়োর কাছের পাহাড়ি ঢালে বেশ মজবুত দেখে কোনো উঁচু গাছের মগডালে হ্যামক টাঙ্গিয়ে রাত্রিবাস করা যাবে।
হ্যামক মানে শক্ত নাইলন দিয়ে বানানো বরফি কাটা জালের দোলনার মতো বিছানা। এর দুই প্রান্তে মোটা লাঠির সাথে বাঁধা লম্বা দড়িগুলো বড় গাছের পাশাপাশি ডালে বেঁধে দিলেই বড় দোলনা মতো বিছানা তৈরি। আরামে শোবার জন্য এতে হাল্কা ফোমের গদির আস্তরণ লাগানো থাকে। জংগলের মধ্যে রাত কাটাবার জন্য উঁচু গাছে বাঁধা হ্যামক এক অন্যতম নিরাপদ আশ্রয়।
মন্দার পাহাড় চুড়োতে পৌঁছেই কাজের কাজ করে নিয়েছে যীশু। কাঠকুটো জোগাড় করে ঝরনার জলে চা আর কাপ নুডল বানিয়ে নিয়েছে।
খাওয়ার সাথে সাথে দুজনে বাইনোকুলার দিয়ে পাহাড়তলি আর তার চার পাশ দুজনে দেখছিলাম, ম্যাপের সাথে মিলিয়ে নেওয়ার সাথে সাথে মনে গেঁথে নেওয়াও চলছিল।
জঙ্গলে কাজ সুরু করবার আগে এই পড়াটা করে রাখলে বনের গোলকধাঁধাতে হারিয়ে যাবার ভয় থাকে না, কাজের সময়ও নষ্ট হয় না। অনেকটা ক্লাসে যাবার আগে পড়াশোনা করে নিয়ে যাবার মত।
রাতের অন্ধকার ঘনাবার আগেই জঙ্গলের নানাদিক থেকে একের পর এক বাঁদরের দল এসে পাহাড়তলির গাছগুলোতে চড়তে লাগল। মনে হচ্ছে এই গাছগুলোই এদের রাত্রের আশ্রয়।
একটু পরে, হ্যামকে শুয়ে, গাছে গাছে জোনাকির টুনি বাল্বের দেওয়ালি দেখবার সাথে নাইট ভিশনেও নজর রাখছিলাম ঝরনার দিকে শুঁড়ি পথটায় আর তার আশে পাশে।
এই সময়টায় এই পথে কোনও না কোনও জন্তু জানোয়ারের দেখা পাবার কথা। সেটা না হলেও অন্তত তাদের আওয়াজ তো শোনা যাবে।
কিন্তু অনেক রাত অবধি, থেকে থেকে ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শুনতে পেলাম না। কে জানে বাঁদরের পাল ছাড়া এ জঙ্গলে আর কেউ কি নেই ?
কিন্তু ইন্টারনেট দেখাচ্ছে এখানে প্রচুর হরিণ, কিছু নেকড়ে আর বুনো শুয়ার তো আছেই কখনো কখনো লেপার্ডেরও দেখা মেলে। তারা সব গেল কই?
এ ছাড়াও এখানে অরণ্যের কোলে বাস করা লোকবসতিও আছে। দিনের বেলায় এদের জঙ্গলের ভেতরে আসতেই হয় কিন্তু তারা সবাই ফেরে বিকেল বা তার একটু আগে।
শুঁড়ি পথটা তাদেরই পায়ে চলা পথ কিন্তু আজ তাদের কাউকে কেন দেখা গেল না? পাথুরে এই অঞ্চলটা এবং তার আশপাশ প্রায়ই দুর্ভিক্ষ আর অনাহারের কবলে পড়ে। তাহলে তারা সব কি নিজেদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে দলে দলে আশে পাশে বক্সাইট খনি এলাকায়? নিশ্চিত খাবার আর রোজগারের আশায়?
যীশুর মধ্যে বেশ কিছুটা ছেলেমানুষি ভাব আছে। সকালে পাহাড়তলির সার্ভে শুরু করার আগে ওকে বলতেই হল যে রেঞ্জ রডের মাথায় লাল পতাকার জায়গায় সাদা পতাকা লাগাতে কেন বাধ্য হলাম।
সব শুনে ভয় পেয়ে বেশ মিইয়ে গেল কিন্তু একটু পরেই পাহাড়ি ঝরনাটার কাছে আতা আর পেয়ারার গাছ দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।
পাথর থেকে রূপান্তরিত হয়ে মাটির জন্ম। ভূবিজ্ঞানী যীশুর মতে ওষধি গাছগুলো যে মাটিতে জন্মায় সে মাটির জন্মদাতা পাহাড়-চুড়োর কালো রঙের পাথরের স্তর যেটা পাহাড়তলিতে এসে নেমে চলে গেছে দক্ষিণ পূর্ব কোনে।
কাল বিকেলে মৈনাক পাহাড় থেকে ঠিক ওই দিকেই দেখতে পেয়েছি কয়েকটা ওষধি গাছ কিন্তু এর তলায় যে পরগাছা গুল্ম জন্মায় তা দেখা যায় নি। এই গুল্ম আশ্রয়দাতা ওষধি বৃক্ষের কাছ থেকে বেঁচে থাকবার রসদ পায় আর তার বদলে ওষধি বৃক্ষের মুলে থাকা বিষাক্ত কিছু খনিজ লবণ নিজে শোষণ আর রূপান্তরিত করে উভয়েরই গ্রহণযোগ্য করে তোলে। ওষুধ কোম্পানির কাছে অবশ্য এই গুল্ম আগাছা ছাড়া আর কিছু নয়।
যীশুর হ্যাভেরস্যাকে সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা পেয়ারা আর আতা দিয়ে পথচলতি প্রাতরাশ আর এখানকার এখনো অবধি দেখা ওষধি গাছেদের নিয়ে আলোচনা করতে করতে এগোই দক্ষিণ পুরব দিকে।
এ দিকের মাটি কালচে আর ছাই রঙের এবং বেশ সরেস। সে কারণেই ছোট বড় গাছের সংখ্যাও বেশি। সার্ভে, ওষধি গাছের অবস্থান আর মাটির নমুনা সংগ্রহ, একসাথে চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। আগে আর একটু এগিয়ে মানুষ-সমান এক ঘাস বনের কাছে আমরা থমকে দাঁড়ালাম।
জঙ্গলে মানুষ-সমান ঘাস বনে বিপদ যখন তখন হতে পারে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য কাঁধের ব্যাকপ্যাকটা মাটিতে নামিয়ে রেখে দুটো ডিজেল ভেজানো কাপড় দিয়ে তৈরি মশাল, গ্যাস লাইটার, ঘাস কাটার জন্য বড় তরোয়াল আর মানুষ মুখো মুখোশ পরে তৈরি থাকলাম।
ঘাস বনে লুকিয়ে থাকা বাঘ আক্রমণ করতে পারে পেছন থেকে। হাতে জ্বলন্ত মশাল আর মাথার পেছনে বাঁধা মুখোশ এ রকম বিপদ থেকে অনেকটাই রক্ষা করে।
যীশু তরোয়াল নিয়ে কোপাতে কোপাতে একটু এগিয়ে গেছে আর তার সামান্য পরে ঠিক ওর পাশে আমিও ঘাস কোপাচ্ছি। কিন্তু হঠাৎ করে বিনা হাওয়াতে ঘাসবনে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে একটা আলোড়ন দেখে আমি আর যীশু থমকে দাঁড়ালাম।
যে যার মশাল জ্বালতে যাব, দেখি দূরে একটা বড় ওষধি গাছের কাছে আমাদের পথ অবরোধ করে এক পুরো আরণ্যক পরিবার দাঁড়িয়ে আছে। আমরা একটুও ভয় না পেয়ে চটপট ব্যাকপ্যাক থেকে হাতড়ে হাতড়ে বড় বড় বেশ কিছু পাকা পেয়ারা আর আতা সেদিকে হরির লুঠের মতো ছুঁড়ে দিতেই ওদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পরে গেল।
এর পর আর কেউ কাউকে ভয় পেলাম না। আমরা আর ওরা, মানুষের বর্তমান বংশধর আমরা আর ওরা আমাদের পূর্বপুরুষদের অস্তিত্বের বাহক কপি বাহিনী। কাল ঠিক সন্ধের মুখে একপাল বাঁদর বাহিনীকে পাহাড়তলির গাছগুলোতে চড়তে দেখেছিলাম। এরা যে সেই বাহিনী না তাদের বন্ধু বান্ধব সেটা বোঝা না গেলেও আমি এদের ঘাসবনের মধ্যে গাছগুলোতে চড়তে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে এগোতে থাকলাম।
যীশু আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে দেখে বললাম “ঘাসবনের মধ্যে আমাদের নজর না চললেও উঁচু গাছে চড়ে থাকা বাঁদর বাহিনীর নজর এড়িয়ে কারো পক্ষেই লুকিয়ে থাকা অসম্ভব। সে রকম কিছু দেখলেই ওরা চিৎকার করে আমাদের সাবধান করে দেবে”।
আমাদের কপি বন্ধুরা গাছে গাছে দোল খেতে খেতে আমাদেরকে ঘাস বনটা পার তো করে দিলই এমন কি এর তারপরও আমাদের সঙ্গ ছাড়ল না। মনে হচ্ছিল ওরা আমাদের সমীক্ষার কাজ বেশ আগ্রহ সহকারে শুধু যে দেখছে তাই নয়, আমরা কি খুঁজছি আর কি করতে চাইছি তা হয়ত আন্দাজ করে নিয়েছে।
বস্তুত পক্ষে ওরা দোল খেয়ে খেয়ে পাহাড়ি নদীর ধারে না গেলে ওষধি গাছগুলোর এত বড় বিশাল প্রাকৃতিক উদ্যান হয়ত আমাদের নজর এড়িয়ে যেত।
গাছের নিচে যথারীতি রয়েছে সেই বন্ধু গুল্ম, নেওয়া দেওয়া করে দু জনেই বেশ হৃষ্টপুষ্ট আর সতেজ সবুজ। আমাদের নমুনা সংগ্রহের কাজ যা একটু আগে হতাশার সঙ্গে ঢিমেতালে চলছিল তা এবার লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলল।
একটু পরেই ওষধি গাছগুলোর তলায় বিশাল এলাকা জুড়ে এক সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির গুল্মের দেখা পেলাম যা আজ অবধি কোনও উদ্ভিদ বিজ্ঞান গবেষক খুঁজে পেয়েছেন বলে মনে হয় না।
খালি চোখে হাতে নেড়েচেড়ে মনে হল এই সব ওষধি গাছের তলায় যে গুল্ম সাধারণত: জন্মায় তার তুলনায় এই গুল্ম অনেক উন্নত শ্রেণীর। এই গুল্ম আর তার সঙ্গে লেগে থাকা মাটির অনেক নমুনা আর ছবি নেবার সাথে সাথে, পুরো এলাকা টা জি পি এসে চিহ্নিত করে নেওয়া হল।
নদী থেকে জাপানি বাস্কেট-জাল দিয়ে ধরা পেল্লায় সাইজের পাঙ্গাশ মাছ সামান্য নুন মাখিয়ে আগুনে ঝলসে দুপুরের খাওয়া তো হল কিন্তু আগুন দেখে আমাদের পথ প্রদর্শক শাখা-মৃগেরা ভয় পেয়ে আমাদের উপর বেজায় চটে গেল।
নিজেদের মধ্যে কিচ কিচ করে কিছু বলাবলি করেই কোথায় যে পালাল বুঝতে পারলাম না। কিন্তু ওরা যে আশেপাশেই থেকে আমাদের জব্দ করবার ছক কষছে, সেটা যখন বুঝলাম তখন আমরা বেশ প্যাঁচে পড়ে গেছি।
খাওয়ার পর একটু জিরিয়ে নেওয়াই কাল হল। চোখ খুলতেই দেখি আমাদের দুজনের প্রাণ ভোমরা, সঙ্গের সেই ব্যাকপ্যাক দুটো উধাও। আমাদের জিপিএস, ম্যাপ এখনো অবধি নেওয়া মাটির নমুনার ব্যাগ এই সব এই দুটো ব্যাগে রাখা ছিল। বনের মধ্যে চোর ছ্যাঁচড় আবার কোথা থেকে এলো।
একটা লম্বা গাছ থেকে খি খি আওয়াজ শুনে দেখি সেই বাঁদরের দল ফিরে এসেছে। ভাগ্যিস আমাদের বাইনোকুলার দুটো ব্যাকপ্যাকে রাখব রাখব করেও শেষ অবধি প্যান্টের বেল্টে আটকানো ছিল।
বাইনোকুলার লাগিয়ে সেই লম্বা গাছের দিকে তাকাতেই নজরে এলো পাশের একটা গাছের মগডালে আমাদের ব্যাগ দুটো ঝুলছে। সে গাছের কাছে যেতেই দুটো বড় হনুমান সেগুলো নিয়ে চলে গেল দুরের আর একটা গাছে আর তার পিছু পিছু বাকি দলবল।
এভাবে ওরা আমাদের ব্যাগ সমেত এক গাছ থেকে অন্য গাছে দোল খেতে খেতে এগিয়ে যায় আর আমরাও মাটিতে এক গাছ থেকে অন্য গাছের দিকে দৌড়াতে থাকি।
দিনের আলো নরম হয়ে আসার সাথে ক্ষীণ হয়ে আসছে ব্যাগ দুটো ফিরে পাবার আশা। এতক্ষণ প্রায় সমতল জায়গাতে ওদের এই লোফালুফির খেলাটায় আমাদের সামিল হতে হচ্ছিল।
এবার সামনে এলো উঁচু গাছে ভরা একটা ছোট পাহাড়। ওরা সেই দিকেই গেল দেখে আমাদেরও ওই পাহাড়ে চড়া ছাড়া উপায় আর কিছু রইল না।
তবে, অন্ধকার হয়ে আসছে, এসব জঙ্গলে পাহাড় কিন্তু খারাপ আস্তানা নয়। তবে আমাদের হ্যামক দুটো যে ব্যাকপ্যাকে ভাঁজ করে রাখা আছে সেটা তো এখন হনুমানজির সাঙ্গপাঙ্গদের কাছে।
মনে হচ্ছে ব্যাকপ্যাক দুটো আজ ফিরে পাবার আশা খুব কম। চার পাশে কাঠকুটো জ্বেলে কোনও রকমে কোনও গাছের তলায় রাত কাটিয়ে সকালেই যা হোক কিছু ভাবা যাবে।
তখনো তো জানি না, পাহাড়ে চড়বার পর আমাদের জন্য একের পর এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে।
পাহাড় চুড়োয় পৌঁছে আমরা একটা বড় গাছের তলায় একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম, বাঁদরের দল সামনের গাছেই ছিল। আমরা দুজনে এখানেই রাত কাটানো যায় কিনা সেই জন্য একটু চারদিক দেখে নিচ্ছিলাম। ঘাড় ঘোরাতেই দেখি কপি বাহিনী সেই গাছ বা তার আশে পাশের কোনও গাছেই নেই।
যীশু এ বারে হতাশ হয়ে মাটিতে বসে পড়ল। আমি কিন্তু হাল না ছেড়ে, পাহাড়ের ঢালের দিকে এগিয়ে গেলাম। এখানে অনেক দূর অবধি উপত্যকার জঙ্গল দেখা যায়। দুরবিন দিয়ে উপত্যকার গাছ গুলো দেখতে দেখতে ঠিক দক্ষিণ পুরব দিকে নজর আটকে গেল।
দু পাশে ছোট ছোট টিলার সারির মাঝখানের বিশাল জায়গা জুড়ে অনেক কুটিরে ঘেরা একটা পুরো গ্রাম দেখা গেল, এমনকি আমাদের লাল রঙের ব্যাকপ্যাক দুটোর হদিস মিলল।
গ্রামের মধ্যে একটা বড় গাছের মগডালে ঝুলছে উজ্জ্বল লাল রঙের আমাদের দুটো ব্যাকপ্যাক কিন্তু যারা আমাদের এতক্ষণ নাচিয়ে বেড়িয়েছে তারা কেউ আশে পাশে নেই।
সব শুনে যীশু দারুণ উৎসাহে আমার অনেক আগে পাহাড় থেকে নেমে সেই গ্রামের দিকে প্রায় দৌড়েই চলেছে। গ্রাম মানে কিছু লোকের সাথে দেখা হবে, একটা নিরাপদ রাতের আস্তানা তো মিলবেই, গ্রামের লোকেরা খুব একটা নির্দয় না হলে তারা শাকভাত যা খায় সেরকম একটা খাবার তো মিলবেই।
আমরা পাহাড়তলি আর নদীর ধার ছেড়ে গ্রামটির পায়ে চলা রাস্তায় এসে পড়লাম। কিন্তু পড়ন্ত বেলার নিঝুম গ্রাম দেখে মনে হচ্ছে কেমন যেন রহস্যময় লাগছে এই গ্রাম আর গ্রামের লোকজনদের।
এই সময়টায় গ্রামের পথে গরুছাগল চরিয়ে ফেরা রাখালদের, নদী থেকে জলের কলসি বালতি নিয়ে ফেরা গাঁয়ের মহিলাদের, হাল-বলদ নিয়ে ফেরা চাষিদের কারো দেখা যাচ্ছে না বা পোষা হাঁস মুরগির কোনও কলরব শোনা যাচ্ছে না।
গ্রামে ঢুকতেই গোবর দিয়ে নিকানো মাটির চওড়া বেদী দিয়ে ঘেরা এক বিশাল অশ্বত্থ গাছ। সেই গাছের দু ধারে কুটীরের বেশ লম্বা সারি চলে গেছে অনেক দূর।
গ্রামের দিকে কুটিরের বাইরেই রাখা থাকে জ্বালানি কাঠের ঢের। মাটির উনুনে সারাদিনে যা পায় আঁধার ঘনিয়ে আসবার আগেই তা রান্না করা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এই গ্রামে কোনও কুটিরেরই বাইরে না আছে জ্বালানি কাঠের ঢের বা কাঠের ধুয়োর কোনও গন্ধ।
সব দেখে শুনে জনপ্রাণীর লেশমাত্র নেই বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু যদি কোন পরিত্যক্ত গ্রাম হয় তবে তা ধূলি ধূসরিত না হয়ে এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কি করে হল ?
দুজনেই এবার বসে পড়ি গাছের ছায়াঘেরা সেই মাটির বেদীতে, ক্লান্তি আর হতাশা আমাদের ঘিরে ধরে। চোখ প্রায় বন্ধ হয়েই এসেছিল, কার যেন পায়ের আওয়াজ আসছে,কিন্তু চারদিকে ভাল করে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না।
হঠাৎ দেখি দক্ষিণ পুরব কোনের একটা টিলা থেকে এক জন দীর্ঘকায় ব্যক্তি নামছেন। পরনে খ্রিস্টান যাজকদের মতো আলখাল্লা, তবে সাদা রঙের নয়, উজ্জ্বল কমলা রঙের। এই রঙের আলখাল্লা পরা আমি কোনও যাজক আগে দেখি নি।
এক মুহূর্ত আগে ওই টিলার মাথা থেকে পা অবধি দেখে নিয়েছি, যদি কোনও গাছের মগডালে আমাদের লাল রঙের হ্যাভারস্যাক দুটোর একটাও যদি ঝুলতে দেখি।
তখন কিন্তু কোনও কিছুই নজরে আসে নি। অবাক লাগছে এ রকম বেশভূষার একজন দীর্ঘকায় ব্যক্তি তাও টিলা থেকে নামছেন, হাতে দুটো ঢাউস সাইজের লাল ব্যাগ, আমাদের দুজনেরই কারো নজরে পড়ল না কেন?
উনি একটু কাছে আসতে দেখলাম ওনার মাথার পেছন দিকে মুকুট মতো দেখতে একটা জিনিস, তা থেকে রেডিওর এরিয়ালের মতো একটা লম্বা ধাতব কাঠি বেরিয়ে এসেছে।
শুধু তাই নয়, আমাদের লাল রঙের ভারি ব্যাকপ্যাক দুটো ওনার ডান কাঁধে অবহেলার সাথে ঝুলছে এবং সেগুলো নিয়ে উতরাই পথে নেমে আসতে কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হয় না আর আমরা নিজের নিজের ভারি ব্যাকপ্যাক সামলাতে হিমসিম খাই। ব্যাকপ্যাক দুটো আবার ফিরে আসছে দেখতে পেয়ে যীশু তো আনন্দে লাফিয়ে উঠলো।
উনি আমাদের কাছেই এসে পড়েছেন, আলখাল্লার বাইরে শুধু ওনার পাকা কমলা লেবুর মত উজ্বল হলুদ বর্ণের মুখ আর হাত দেখা যাচ্ছে। এই রকম গায়ের রঙ পৃথিবীর কোনও অংশের মানুষের আছে কি ? ফিসফিসিয়ে এই কথা আমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা যীশুকে বলবার জন্য ঘাড় ঘোরাতেই দেখি আর এক দৃশ্য।
উনি আসছেন টের পেয়ে সব কটা কুটির থেকে গ্রামের মেয়ে, পুরুষ, কচি কাঁচা শিশুর পাল পিল পিল করে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে অশ্বত্থ-তলার বেদীর কাছে। অথচ আমরা যুক্তিসংগত কারণেই ভাবতে শুরু করেছিলাম যে এই গ্রাম অন্তত এখন জনশূন্য, কিন্তু তা নয়।
আমাদের হতবাক করে দিয়ে ওরা দেবভাষা সংস্কৃতে এক সুললিত সুরে সবাই গান গেয়ে উঠলো, স্পষ্টতই সেই যাজক পুরুষকে উদ্দেশ্য করে অভিবাদন সঙ্গীত হবে বোধ হয়।
একটু পরে যাজক আর গ্রামবাসীদের মধ্যে এবং ওদের নিজেদের মধ্যে কথা বার্তা শুনে বুঝলাম সংস্কৃত ওদের মাতৃভাষা। যাজক ওদের এই ভাষা শিখিয়েছেন বলে মনে হয় না।
যীশু ওদের সংস্কৃত হাঁ করে গিলছে দেখে আমি ওকে ধীর গলায় বলি “কর্ণাটকের শিবমজ্ঞার কাছে মাত্তুর গ্রামের লোক, উড়িষ্যার শ্যামসুন্দরপুর ছাড়াও রাজস্থান আর মধ্যপ্রদেশের কিছু অজ গাঁয়ের লোক ও দেবভাষায় কথা বলে। এ অঞ্চলের লোকেও দেখছি তাই”
এই যাজক দেখছি বহুভাষী। ওদের সাথে সামান্য কথা বলেই, আমাদের সাথে পরিষ্কার বাংলায় সৌজন্য বিনিময় করে ব্যাগ দুটো দিয়ে বিনীত স্বরে বললেন “আপনাদের ব্যাগ দুটো ফেরত দিতে পেরে খুব আনন্দ লাগছে। এ দুটোতে আপনাদের ম্যাপ, জিপিএস ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিন। এগুলো না থাকলে সমীক্ষা আর নমুনা নেবার কাজ চালানো মুস্কিল হত”।
ব্যাগ দুটোর গায়ের ডিজিটাল তালা খোলা একেবারে অসম্ভব। উনি এ-দুটোর ভেতর কি আছে জানলেন কি করে?
জিপিএস চালু করেই আমি বুঝতে পারলাম আমরা এখন মৈনাক পাহাড় বা ধুমডিলা থেকে বেশ দূরে। এই পড়ন্ত বিকেলে আর কোথাও থাকার জায়গা খোঁজার চাইতে আজ রাতটা এখানে থাকাই ভাল।
গ্রামবাসীদের তেলচুকচুকে স্বাস্থ্যবান চেহারা দেখে মনে হয় না ওরা অনাহার বা অপুষ্টিতে আছে। তবু কেন জানি না মনে হচ্ছে এদের কাছে পয়সা দিলেও খাবার বোধ করি জুটবে না।
আমাদের মনের কথা বুঝতে পেরেই যাজক বললেন “আপনারা ইচ্ছে করলে টিলার চুড়োতে আমার ঘরে থাকতে পারেন। আপনাদের সঙ্গের টিন ফুড দিয়ে রাতের আহার করে নিতে পারেন”।
শুনে যীশু সোৎসাহে বলে ওঠে “আমাদের খাবারে তেল- মশলা থাকে না, টিন ফুড আমরা শুধু একটু ফুটিয়ে নিই। আপনি খেয়ে দেখবেন খারাপ লাগবে না”।
হাত তুলে নিষেধের ভঙ্গিতে উনি বললেন “সূর্য ওঠবার সাথে সাথেই আমি স্বপাক খাবার খেয়ে নিই। সারাদিনে তারপর সামান্য জল ছাড়া আর কিছু খাবার দরকার হয় না”।
গ্রামবাসীরাও ওনার কথা শুনে যে ভাবে মাথা নাড়ছিল তাতে মনে হচ্ছিল ওরাও যেন সেই ভাবেই খায়। যাক এক হিসেবে ভালই হল, ওদের শাকপাতা না খেয়ে আমাদের স্বপাক খাবার খাওয়া অনেক ভাল।
তবে এই যাজক-বেশী বিদেশী গুরুজীর প্রসাদ পেলে ভালই হতো। যাক কাল সকালে উনি কিরকম স্বপাক বানান সেটা তো দেখতেই পাব আর তার থেকে প্রসাদ ও পাওয়া যাবে।
যীশু অবশ্য ওনাকে শুধু বিদেশী বলে মানতে নারাজ। পাহাড়ি টিলায় চড়বার রাস্তায় ও এই নিয়ে অনেক কিছু বলছিল বটে। সারাদিনে ধকলের পর ওসব আর আমার মাথায় ঢুকছিল না।
টিলার চুড়ায় উঠবার ঠিক আগের বাঁকের মুখে এসে কতকগুলো ছোট ছোট ধাতব প্লেট টাঙ্গানো দেখে থমকে দাঁড়ালাম দুজনে। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে অন্যান্য অংশ দেখে মনে হল এগুলো নিঃসন্দেহে সোলার প্লান্টের প্যানেল। তখন আমরা জানতাম না আরো অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করছে।
টিলার চুড়োয় পাশাপাশি দুটো বেশ বড় কুটির। উনি এখানে ফিরে এসে দুটোর মধ্যে কোনও একটিতে হয়ত আমাদের থাকতে দেবেন। ব্যাগ দুটো বড় কুটীরের বারান্দায় নামিয়ে দেখি, সামান্য দূরে, পাথরের ফাটলের ফাঁক দিয়ে জলধারা বয়ে যাচ্ছে। একটা ক্ষুদ্র ঝরনা বলা যায় তাকে।
সারাদিনের ক্লান্তির পর নাওয়া খাওয়ার জন্য প্রকৃতির নির্মল বদান্যতায় দুজনেরই মন আনন্দে নেচে উঠলো। সেদিকে যাবার পথে আর একটা জিনিষ চোখে পড়ল।
ঝরনার ঠিক কাছেই এক বিশাল ছাতা আকাশের দিকে মুখ করে টাঙ্গানো তাতে কিম্ভুতকিমাকার আকৃতির যন্ত্র লাগানো। নি:সন্দেহে এটা কোনও উঁচু মানের ভি-স্যাট জাতীয় এন্টেনা।
টিলাতে উঠতেই সোলার প্লান্ট আর এখন এই এন্টেনা, এই দুইয়ে মিলিয়ে এই যাজকের ব্যাপার-সাপার কিন্তু এ বার আমারও সুবিধের ঠেকছে না।
ঝরনার জলে গা ভিজিয়েই কাঠ-কুটো জ্বেলে খাবারের জোগাড় হচ্ছিল। যীশু বললে “তুমি খাবারগুলো তৈরি কর ততক্ষণে আমি একটু আসছি, পাঁচ মিনিটও লাগবে না আমার” আমাকে আর কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই ও দেখি কুটীরের দিকে হন হন করে এগিয়ে গেল, কি দেখতে কে জানে।
সূর্যাস্ত কিছুক্ষণ আগে হয়ে গেলেও দিনের আলো তখনো আছে। খাওয়া শেষ করে যীশু বললে “আমি কুটীরের দিকে গিয়ে কি দেখলাম তাতে পরে আসছি কিন্তু তার আগে তুমি বল এই যাজক সম্পর্কে তোমার কি ধারনা?”
আমি বলি “আমার মনে হচ্ছে উনি যাজকের বেশধারী একজন রহস্যময় মানুষ”।
যীশু বললে “তুমি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ কিনা জানি না, ওনার আকৃতি, গায়ের রঙ এসব দেখে মনে হয় উনি ভারতীয় তো ননই হয়ত উনি এক বিরল শ্রেণির বিদেশী মানব কিম্বা তাও হয়ত নন”।
আমি অবাক হয়ে বলি “তার মানে ?”
যীশু এক বার আকাশের দিকে তাকিয়ে আমাকে বললে “নৃতত্ত্ব নিয়ে আমার সামান্য কিছু পড়াশোনা আছে। করোটি, মাথার চুলের রকমভেদ, গায়ের রঙ, অন্যান্য দৈহিক গড়ন-ভেদের ভিত্তি নিয়ে ককেশীয় থেকে নিগ্রোবাটু অবধি পৃথিবীর মানুষের যে শ্রেণী বিভাগ আছে আমার মনে হয় তার মধ্যে উনি পড়ছেন না”।
“কি বলতে চাস তুই, উনি মানুষ ছাড়া আর কি ?”
“সেটা আমি না বলতে পারলেও আমরা যদি মেনে নিই যে উনি পৃথিবীর মানুষ নন তাহলে অনেক কিছু মিলে যায়”।
“তুই কি বলছিস রে ! মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর”।
“চোখে অদ্ভুত রঙের গগলস পরে থাকায় চোখের মনি বা তার রঙ আমি দেখতে পাই নি। কিন্তু ওনার অদ্ভুত আকারের শরীরের গড়ন, পাকা কমলা লেবুর মত গায়ের রঙ, সামনের দিকে এগিয়ে আসা অদ্ভুত আকৃতির কান দুটো, চোখে অদ্ভুত রঙের গগলস, মাথার পেছনে মুকুট আর তাতে লাগানো কাঁটার মতো অ্যান্টেনা এসবই ওনাকে ভিন গ্রহের মানুষ বলে ধরে নিলে মিলে যায়। এছাড়া আর একটা জিনিষ কি লক্ষ্য করেছিস?”।
চুড়ো থেকে নিচের গ্রামটাকে আর একবার দেখে নিয়ে যীশুর দিকে তাকিয়ে আমি বললাম “তুই যেটা বলতে চাইছিস তা আমিই তোকে বলব ভাবছিলাম। টিলার চুড়ো তে উঠেই আমার একটা খটকা লেগেছে। একটু আগেই উনি যে নিজের সকাল সকাল স্বপাক আহারের কথা বললেন সেই আহার বানাবার কোনও উনুন, বাসনপত্র, চালডাল কিছুই নজরে এলো না”।
যীশু বললে “তার একটাই কারণ ভিন গ্রহের প্রাণীদের খাদ্য বা তা তৈরি করবার পদ্ধতি আমাদের থেকে আলাদা। হয়ত সেটা এতটাই ভিন্ন যে তা বানাতে উনুন বা রাঁধার বাসন তো লাগেই না এমন কি সেটা খেতেও বোধ করি থালা, বাটি, চামচ কিছুই লাগে না।
ভিন্ন গ্রহের মানুষের স্বপাকের রকম সকম আমরা কি করে বুঝব? এ ছাড়া ওনার ছোট কুটিরটাতে উঁকি দিয়ে এমন কিছু দেখে এসেছি যা শুনলে তুমি লাফিয়ে উঠবে”
“সেটা কি রকম”?
“পুরো কুটিরটাই আসলে একটা রীতিমতো হাই-ফাই ল্যাব। মনে হল যে গুল্ম তুমি ওষধি গাছগুলোর নিচে খুঁজছিলে সেগুলো থেকে উনি কিছু একটা বানাচ্ছেন। সোলার প্লান্ট ওনার ল্যাবের যন্ত্রপাতি গুলো কে সচল রাখে। ভিন গ্রহ থেকে উনি এসেছেন ওই গুল্ম থেকে কোনও ওষুধ বানানর জন্য”।
ঘরের মধ্যে বাজ পড়লেও আমি এতটা অবাক হতাম না। কিন্তু অত সহজে আমি তো মানব না “মেনে নিচ্ছি সুদূর গ্রহ থেকে উনি এসেছেন ওই গুল্ম নিয়ে রিসার্চ করতে। কিন্তু ওনার মহাকাশ যান টি কোথায়? এরকম একটা বিশাল জিনিষ আমাদের কারো বাইনোকুলারে ধরাই পড়ল না। কিন্তু তুই তো আবার কাল রাতেই একটা উল্কা মতো কিছুকে আকাশে চলে যেতে দেখেছিস। সেটাই কি ওনার মহাকাশযান ছিল? ওনাকে না নিয়েই চলে গেল?”।
“আপনারা এই রকম ভাবতেই পারেন। আমাদের প্রযুক্তি সম্পূর্ণ আলাদা। অন্যান্য গ্রহের মতো আমাদের মহাকাশ যান কোথাও অপেক্ষা করে না”। আমাদের দিকে চেয়ে সুমিষ্ট স্বরে পরিষ্কার বাংলায় যিনি বললেন কথাগুলো, তিনি আর কেউ নন, একটু আগে দেখা কমলা রঙের যাজক মহাশয়।
আমরা হতভম্ব হয়ে ওনার কথা শুনছি বললে ভুল হবে, গিলছি বলা উচিত। আমাদের হতভম্ব হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওনাকে এই পর্ণকুটিরের কাছে অকস্মাৎ দেখা অবধি আমাদের হতভম্ব হয়ে থাকার রেশ চলছেই। ঘটনাটা এই ভাবে ঘটল।
আমি যীশুর দিকে তাকিয়েই কথা বলছিলাম। হঠাৎ দেখি সোনার বরন যাজক পর্ণকুটিরের ঠিক সামনে, যীশুর একটু পিছনে। এটা কি করে হয়? আমি তো ওই দিকে চেয়েই যীশুর সাথে কথা বলছিলাম। যীশুর চাইতে দীর্ঘদেহী এ রকম একজন অদ্ভুত দর্শন মানুষ আমার নজরে পড়বে না তাও আবার চোখের ঠিক সামনে। উনি এবার আমাদের থেকে একটু দূরে এসে বসলেন আর যা বললেন তাতে মনে হয় আমাদের কথা সবই শুনেছেন।
সূর্য অস্তমিত প্রায়, কিন্তু উনি ওনার চোখের সেই অদ্ভুত উজ্জ্বল হলুদ রঙের গগলস খুললেন না।
ওনাকে যাজক বলাটা আর ঠিক হবে না, উনি তো দেবদূত। আমরা ওনাকে এখন থেকে যাজক বলে আর ভাবব না, দেবদূত বলে ধরে নেব।
ওষধি গাছের সরেজমিন অনুসন্ধানে এই গ্রহে এসে পোঁছালেও সংস্কৃতটাও তো দেবদূত ভালই জানেন। কে জানে যে লোক থেকে উনি এসেছেন সেখানে হয়ত এটাই মাতৃভাষা। সাধে কি আর সংস্কৃতকে দেবভাষা বলে।
শেষ কিরণ বিন্দু চলে যেতেই আকাশ থেকে অন্ধকার লাফিয়ে নেমে আসছে। শুকনো কাঠকুটো জোগাড় করাই ছিল তাতে আগুন ধরাতে যাব এমন সময় দেবদূত বললেন “একটু আলোর ব্যবস্থা করা যাক”।
এই বলে উনি আলখাল্লার ডানদিকের হাতাটা কনুইয়ের একটু উপরে সরাতেই, চোখে পড়ল সবুজ রঙের বড় স্ফটিক বসানো সোনার মান-তাসা মত গয়না। গয়নায় দেবদূতের বাম হাতের আঙ্গুল ছোঁওয়া পড়তেই দুটো কুটিরেই ভোরের আলোর চেয়ে একটু উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠলো।
উনি ওনার শান্ত সুমধুর কণ্ঠে বললেন “আপনারা দুজনেই বিজ্ঞানী। এই আলো দেখে নিশ্চয় তেমন কিছু অবাক হন নি। টিলাতে ওঠবার মুখেই আপনারা নিশ্চয় সৌর শক্তির প্যানেলগুলো দেখেছেন তবে সৌর শক্তির বেশিটাই আমার ল্যাবের কাজেই লাগে”।
যীশু একবার আমার দিকে তাকিয়ে দেবদূতকে বলে “সুদূর গ্রহান্তর থেকে এখানে এসে আপনি কি কোনও জটিল গবেষণা করছেন?”
ওনার উত্তর দেবার আগেই আমি বলে ফেলি “আপনাদের গ্রহ তো আমাদের চাইতে অনেক উন্নত। সেখানে বসে গবেষণা করলেন না কেন ?”
দেবদূত বললেন “বলছি সেই কারণ, কিন্তু তার আগে কতগুলো কথা শুরুতেই জানিয়ে রাখি। আমি কোনও বিজ্ঞানী নই। পরম প্রভু যিনি সব গ্রহগুলি নির্মাণ করেছেন, আমি তাঁর অনুগৃহীত একজন সাধারণ পর্যটক মাত্র। আপনাদের জানাই যে আমাদের শরীর সচল রাখতে যতটা শক্তির প্রয়োজন তা আমাদের গ্রহ-বাসীরা সবাই সূর্যকিরণ, সামান্য পরিমাণ জল ও তাতে মিশে থাকা খনিজ লবণের সাহায্যে মিটিয়ে নি”।
আমি বিস্মিত হয়ে বলি “আপনাদের মানব শরীর সালোকসংশ্লেষ করতে সক্ষম? আপনাদের শরীরের কোষে ক্লোরোপ্লাস্ট কি ভাবে জন্মাল? এটা তো শুধু উদ্ভিদেরই হতে পারে”।
উনি বললেন “আমি আপনার মত পণ্ডিত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী নই। এইটুকু মাত্র জানি যে আমাদের গ্রহে, জন্মের ঠিক পরেই, সদ্যোজাতকে বেশ কিছু সময়ের জন্য আর একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার হাতে যে সবুজ মনি খচিত বলয়টি দেখছেন প্রথমেই এটি লাগানো হয় হাতের কনুইয়ের ঠিক ওপরে। বয়েস এগোবার সাথে সাথে এই বলয় আপনা থেকেই বাড়তে থাকে। এই বলয় লাগিয়ে দেওয়া ছাড়াও আর একটি প্রক্রিয়া করা হয়। এর ফলে চামড়ার ঠিক নিচে একটি বিশেষ আস্তরণ গজায়। বলয়টি আমাদের সব প্রকারের স্থানান্তরে কাজে লাগে আর চামড়ার নিচের স্তরের আস্তরণ সূর্যের আলো থেকে খাদ্য তৈরি করে”।
যীশু বললে “আপনার এই স্থানান্তরের ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝলাম না”।
দেবদূত বললেন “আপনারা এই যে হঠাৎ হঠাৎ আমাকে দেখছেন, এটা এই বলয়ের জন্য সম্ভব হচ্ছে। বলয়ের একটি বিশেষ অংশে আঙ্গুল একটি ছন্দে বাজালেই সে জেনে যায় আমি কোন স্থানে যেতে চাই। প্রায় আলোর গতিবেগে আমি সেখানে পৌঁছে যাই”।
আমি বলি “আচ্ছা আপনি যে আমাদের সম্বন্ধে অনেক কিছুই জেনে গেছেন সেটা কি আপনার আর কোনও শক্তি?”
উনি স্মিত হাস্যের সাথে বলয়ের দিকে চেয়ে বললেন “এই বলয় আমাকে অচেনা কোনও কিছু সামনে এলেই তার সম্পর্কে সব কিছু এমন কি তার মনের মধ্যে কি ভাবনা আছে তাও আমাকে বলে দেয় আর তার ভাষাও আমাকে শিখিয়ে দেয়। কিন্তু চেনা ব্যক্তি বা বস্তুর ব্যাপারে কিন্তু এটি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাজ করে না। তাদের থেকে বিপদ হতে পারে এমন হলে তবেই এই বলয় সেই কাজ করে”।
বোঝা গেল উনি আমাদের লাল ব্যাগ দুটোর ভেতরে বা আমাদের সম্পর্কে এত কথা জানলেন কি করে ? উনি যে শুধু আমাদের মনের সব কথা জেনে নিতে পারেন তাই নয় আমাদের ভাষা বুঝে ফেলতে এবং তাতে অনর্গল কথা বলতে ওনার বিন্দুমাত্র অসুবিধা শুরু থেকেই হচ্ছে না। আর হয়ত উনি সাবধান করে দিলেন যে আমরা কোনও চালাকির চেষ্টা করার অনেক আগেই উনি জেনে ফেলবেন।
যীশু দেখি ওনার খুব ভক্ত হয়ে গেছে। ও বললে “তাহলে গ্রহান্তরে যাওয়া আসা আপনার ইচ্ছের ব্যাপার”।
উনি মাথা নেড়ে বলেন “একদম নয়। আমাদের ক্ষমতা শুধু গ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ”।
আমি বলি “তাহলে এখানে এলেন কি ভাবে ?”
দেবদূত তারায় ভরা আকাশকে দেখতে দেখতে বললেন “পরম-প্রভু মাঝে মাঝেই আমাদের মধ্যে কয়েকজনকে বেছে নেন অন্য গ্রহে গিয়ে তাঁর বিভিন্ন রকমের ইচ্ছে পূরণের জন্য। আমি সাধারণ মানুষ, আমাকে দিলেন পৃথিবী পর্যটন করে পৃথিবীর সুখ দুখ জেনে আসতে। ওনার ইচ্ছায় আমার হাতের এই বলয়ে এক বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হল যার ইঙ্গিতে এক নীল রঙের শক্তি-গোলক আমাকে বেষ্টন করে। সেই গোলক আমাকে এখানে পৌঁছে আবার ফিরে গেছে”।
যীশু বললে “নিজের গ্রহ থেকে যোগাযোগ হারিয়ে থেকে গ্রহান্তরে এসে আপনার অসুবিধে হয় না?”
দেবদূত বললেন “আমার কাজে সহায়তা করবার জন্য আমাদের গ্রহের কিছু অন্য গোলক সবসময় আমার সাথে যোগাযোগ রেখে চলে। আমার দরকার হলে এদের স্মরণ করি, এরা আবির্ভূত হয় আবার আমার প্রয়োজনে যেখানে যাবার সেখানে চলে যায়। আবার আমাদের গ্রহ থেকেও এই গোলক-যান আসে আমার কাছে কোনও কিছু দেবার হলে সেটা দিয়ে চলে যায়।”
যীশু এবার আমার দিকে তাকাল। কাল রাতে ও যে উজ্জ্বল ধূমকেতুকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নামতে এবং কিছু পরে আবার ফিরে যেতে দেখেছে সেটা তাহলে এই ব্যাপার। আর নিজের গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ করবার জন্য ঝরনার পাশে ওই ছাতার মতো দেখতে বস্তুটা তাহলে এন্টেনা।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন “কাল রাতে আমার কাছে গোলক যান কি কারণে এসেছিল আর কি নিয়ে ফেরত গেল তা বলছি এবার। কিন্তু তার আগে কিছু কথা আপনারা শুনে নিলে ভাল হয়”।
সন্ধ্যের অন্ধকার বেশ জাঁকিয়ে বসেছে, দ্বিতীয়ার চাঁদের আলো তার কাছে হার মেনে ম্লান হয়ে আছে। কুটীরের বাইরে দূর উপত্যকার দিগন্ত অবধি কালো কালি ঢালা। আকাশের নিচে সারি সারি লম্বা চওড়া গাছে গাছে জোনাকির টুনি বাল্বের জ্বলা নেভা চলছে। তবে গ্রহান্তরের প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের কুটিরে তখন সৌরশক্তির স্নিগ্ধ চাঁদের আলো।
বাইরের প্রকৃতির এই অপরূপ সুন্দর রূপের দিকে তাকাতে তাকাতে দেবদূত বললেন “বৈচিত্র্যময় এই সুন্দর পৃথিবী, নীল গোলকে প্রদক্ষিণ করতে করতে, পরম প্রভুর ইচ্ছায় নেমে পড়লাম ঘন অরণ্য আর পাহাড়ে ঘেরা এই ধুমডিলাতে। সেই সময় পর পর দুই বছর অনাবৃষ্টির দরুন খরার কারণে অনাহারে বন্যপ্রাণী আর মানুষ দলে দলে পালাতে শুরু করেছে, নেহাত অসহায় আর দুর্বলেরা রয়ে গেছে”।
এই অঞ্চলে প্রায়ই এই রকম হয়ে থাকে, দুই বছর আগে এরকম একটা অনাহার অনাবৃষ্টির খবর সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছিল কিন্তু একটু আগে এই গ্রামের লোকদের তেল চুক চুকে চেহারা দেখে সে কথা মনেই হচ্ছে না।
উনি বলতে শুরু করলেন “এখানের অসহায় স্থানীয়দের অনাহারে মৃত্যু দেখে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। করুণ প্রার্থনা জানালাম পরম প্রভুকে যাতে এই অসহায় মানুষদের ক্ষুধার কষ্ট দূর হয়। মনে হয় তিনি কথাটা শুনলেন। সেই রাত থেকে পরপর তিনদিন বৃষ্টি হল। জঙ্গলে কাঠের ওপর প্রচুর ব্যাঙের ছাতা আর তার কিছুদিন পর সামান্য কিছু শাকসবজি আর কন্দ-মুল খেয়ে এদের প্রাণ বাঁচল”।
আমি বললাম “এই বছর তো দেশ জুড়ে অনাবৃষ্টি। আর কিছুদিন পরে তো এখানের মানুষজনকে অনাহার থেকে বাঁচাবার জন্য তো আপনাকে আবার সেইরকম প্রার্থনাই করতে হবে”।
“না, পরম প্রভুর করুণায় শরীরের কোষে, কোষে, শক্তি জোগান দেবার জিনিসের জন্য ওদের কাউকেই আর প্রকৃতির দয়ার ওপর নির্ভর করতে হবে না”।
যীশু এতক্ষণ হাঁ করে গিলছিল ওনার কথা। সেই অবস্থাতেই বলল “তার মানে ওদের খাবার জোটাবার আর চিন্তা নেই। আপনাদের গ্রহ থেকেই তার ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে”।
আমারও মনে হল কিছুটা এইরকমের ব্যাপার হলেও হতে পারে। সেইজন্যই বোধ হয় কারো ঘরের বাইরে জ্বালানি কাঠের ঢের রাখা নেই। তখন বিকেল শেষ হতে বেশী বাকি ছিল না। কারো বাড়িতেই কিন্তু উনুনে আঁচ পড়ে নি, তাহলে তো আর কিছু না হোক জ্বলন্ত কাঠের ধুয়োর গন্ধ তো পাওয়া যেত।
তবে এটাও সম্ভব যে সবাই বোধ হয় সোলার কুকার ব্যবহার করে আর এনার দেখাদেখি একবারই খায়। কিন্তু এটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে এখানের গ্রামবাসীদের রান্না করে খেতে হয় না। যীশুর সাথে আমার এই সব কথা হচ্ছিল। শুনে উনি একটু মৃদু হাসলেন “আপনারা কিছুটা ধরেছেন বাকিটা আপনাদের বলে দেই। আপনাদের কাছে আগাম মাফ চেয়ে কিছু বলতে চাই, যদি অনুমতি দেন”।
আমরা দুজনেই হাঁ হাঁ করে উঠি “না ! না ! এ আপনি কি বলছেন”।
যীশু গদগদ গলায় বলে “এটা তো আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আপনি আপনার ভাবনা নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করতে চাইছেন”।
দেবদূতের গলাটা এবার আর্দ্র আর সিক্ত হয়ে এলো যেন “আপনারা দু জনে উচ্চশিক্ষিত বিজ্ঞানী। ভেবে দেখেছেন কি আপনাদের এই পৃথিবীতে বার বার এত অনাহারের মূল কারণটি কি?”
আমি বলি “আমি শুনেছি এটি একটি জটিল ব্যাপার এবং মূল কারণটি নিয়ে মতভেদ আছে জ্ঞানী ব্যক্তিদের মধ্যে”।
সামান্য থেমে দেবদূত বললেন “আমাদের গ্রহে বিজ্ঞানীরা সময়ের সাথে মানুষের খাদ্যের উৎস পরোক্ষ থেকে প্রত্যক্ষে পালটে দিয়েছেন। আপনাদের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি সে দিকে কোনো চেষ্টাই করে নি। এর ফলে পৃথিবীতে শুধু যে প্রকৃতির খামখেয়ালে বেশ কিছু মানুষ অনাহারে আছে তাইই নয় আর অনেক সমস্যার সাথে পুরো প্রাণীজগতকে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে এমন কি আপনাদের যে একে অন্যকে মেরে ফেলবার জন্য যে যুদ্ধগুলো হয় তার আসল কারণ কিন্তু এই খাদ্য জোগান আর মজুতের”।
যীশু ভূ-বিজ্ঞানী ওর হয়ত স্মরণে নেই প্রাথমিক স্কুলের বইয়ের কথা। আমি ওকে মনে করিয়ে দিই যে উদ্ভিদ রবিকিরণ আর প্রকৃতি থেকে কারবন-ডাই-অক্সাইড, সামান্য পরিমাণ খনিজ মিশ্রিত জল থেকে নিজের খাবার তৈরি করে নেয়। সেজন্য তার খাবার উৎস প্রত্যক্ষ।
কিন্তু বাকি প্রানীজগৎ হয় উদ্ভিদকে সরাসরি খায় কিম্বা যারা তৃণভোজী তাদেরকে খায় বা গৃহপালিত তৃণভোজীদের থেকে কিছু খাবার যেমন দুধ ইত্যাদি খায়। সেজন্য তাদের খাদ্যের উৎস পরোক্ষ।
সব শুনে যীশু বলে “এতে তো আমাদের কিছু করার নেই। ভগবান আমাদের শরীরের সব যন্ত্রপাতি যে ভাবে গড়েছেন সে ভাবেই তো চলতে হবে”।
আমি বলি “আমার মনে হয় আমাদের শরীরের আভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া, সূর্যকিরণ থেকে খাবার তৈরি ব্যাপারটার সাথে মানাবার জন্য নয়।”
দেবদূত বললেন “কাল ভোরবেলায়, এখানের গ্রামবাসীদের যোগাভ্যাসের সময়ে সম্মিলিত সূর্য-প্রণাম দেখতে পাবেন। এই প্রণামেই এরা সারাদিনের খাদ্য পেয়ে যায়। এর পর ওরা শুধু ঝরনার জল পান করে। কারো ঘরেই চাল, গম বা শাকসবজি দেখতে পাবেন না”।
যীশু করজোড়ে সেই দেবদূতের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে বলে “ঈশ্বর ঠিক লোককেই পাঠিয়েছেন সন্দেহ নেই কিন্তু কিছুটা যদি আভাস যদি দেন এ অসম্ভব কিভাবে সম্ভব হল?”
দেবদূত আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন “আমি এখানের মানুষের জন্য রবি কিরণ থেকে নিজের খাবার তৈরির সম্ভাব্য উপায় ভাববার জন্য আমার গ্রহের বিজ্ঞানীদের অনুরোধ করেছিলাম। গুল্ম আর ওষধি গাছের কথা শুনে ওনারা দুটোরই মজ্জা তৈরি করে পাঠিয়ে দিতে বললেন”।
যীশু বললে “এ দুটো মিলিয়ে কোনো নতুন প্রজাতির উদ্ভিদ তৈরি হবে?”।
“না, না” উনি বাইরের আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে বলেন “এর সাথে এখানের অনেক রকম শস্য বীজ পাঠিয়েছিলাম। ওনারা এসব মিলিয়ে নতুন একটা গুল্ম বানাবার কাজ শুরুও করে দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রধান বিজ্ঞানী এক সহজ উপায় খুঁজে বার করলেন”।
দেবদূত আমাদের দুজনকে যেন আবিষ্ট করে রেখেছেন আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত ওনার কথা শুনছি।
“বহু শতাব্দী আগে এই ভারতেই ধ্যানস্থ মুনি ঋষিরা বায়ু আর সূর্যকিরণ আহার করে তাদের সাধনা চালিয়ে যেতেন। প্রধান বিজ্ঞানী আর তার সহযোগীরা খুঁজে বার করলেন যে সেটা কিভাবে সম্ভব হত”
আমি মাথা নেড়ে বলি “শুনেছি প্রথমে তাঁরা বৃক্ষের পত্র ভোজন করতেন। সাধনার প্রাথমিক স্তর পার হলে তখন তাঁরা ভোরের প্রথম রবিরশ্মি আসার সাথে সাথে সূর্য প্রণাম করতেন। ঊর্ধ্ববাহু হয়ে দুই হাতের দ্বারা রবিকিরণকে গ্রহণ করে পরে আর্দ্র বায়ুকে গ্রহণ করতেন”।
দেবদূত আমার কথা শুনে বলেন “আপনার অনেক কিছুই জানা আছে। আমাদের গ্রহের মহাকাশচারীরা যারা সেই সময় ভূ-গোলকে ভারতে এসেছিলেন তাঁরা পুরো ব্যাপারটা বিস্তারিত ভাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন এবং হিমালয়ের এক গুহা থেকে সাধন প্রণালীর প্রামাণ্য পুঁথিপত্র উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন আমাদের গ্রহে”।
যীশু কিছুটা যেন অবিশ্বাসের সুরে বলে “সেই সুপ্রাচীন যুগেও আপনাদের মহাকাশ যান ছিল”।
দেবদূত বলেন “অবাক হবেন না। আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আপনাদের তুলনায় অনেক উন্নত আর সুপ্রাচীন”।
আমি যীশুকে নিষেধ করবার একটা সাংকেতিক ইশারা করতে গিয়ে দেবদূতের সব জেনে বুঝে ফেলবার ক্ষমতার কথা ভেবে আর করলাম না। অবশ্য উনি অসীম ক্ষমাশীল। যীশুর অবিশ্বাসে কিছু মনে করেন নি।
আগের মতই সুমধুর কণ্ঠস্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “প্রাচীনকালে সাধনা-রত মুনি ঋষিদের পত্র আহারের যে কথা আপনি বললেন, আমাদের কাছে থাকা সূত্র অনুযায়ী তা এক গুল্মের ক্ষুদ্র পত্র ও ফুলের রেণু। এই আহার, সুরু করার কিছু দিনের মধ্যে, হাতের তালুতে এক বিশেষ ধরনের কোষ এবং তার আজ্ঞাবাহক অসংখ্য পরিবাহী কোষ জন্মায়”।
আমি বলি “এই বিশেষ ধরনের কোষ কি তাহলে কি ক্লোরোপ্লাস্ট?
দেবদূত হাসলেন “আমার জ্ঞান সীমিত, আমাদের বিজ্ঞানীরা আপনাকে এর উত্তর দিতে পারবেন। তবে এটা জানি যে সূর্যের প্রথম রশ্মিটির পৃথিবীতে প্রবেশের সাথে সাথে মুনিঋষিরা সূর্য-প্রণাম সুরু করতেন আর সেই সময় তাদের হাত দুটির নতুন কোষগুলি সুরু করে দিত সালোক সংশ্লেষ দিয়ে শ্বেতসার তৈরি করা “।
আমি বলি “তাহলে ধ্যানরত মুনি ঋষিদের হাত আর গাছের পাতার সাথে অনেকটা মিল আছে”।
দেবদূত বললেন “সবটা নয় কিছুটা আলাদা। ওনাদের হাতে সালোক সংশ্লেষ সুরু হওয়া মাত্র, তার সাথে যুক্ত নতুন পরিবাহী কোষ অনেকটা অন্ননালীর মত পাকস্থলীতে সেই শ্বেতসার পৌঁছে দিত। তবে আন্দাজ করা হয়েছে যে ওঁরা এর সাথে জলও পান করতেন”।
একটা বিপ বিপ আওয়াজ আসতেই দেবদূত তার মাথার পেছনে মুকুটের মত জিনিসটা তে আঙ্গুল ছোঁয়াতেই মুকুটে লেগে থাকা চুলের কাঁটাটা সোজা হয়ে আর লম্বা হল।
দেবদূত আমাদের কাছে ইঙ্গিতে অনুমতি নিয়ে দূরে সরে যেতেই আমি কিছু ইশারা করার আগেই যীশু এগিয়ে এসে চুপিচুপি বলে “ওনার গ্রহ থেকে কল এসেছে”। ভাগ্যিস এখনো আমাদের মধ্যে ইশারায় কথা বলার অভ্যাসটা চালু আছে আমি সেই কোড ইশারায় বলি “জোরেই বল আর আস্তেই বল উনি সব শুনতে পাবেন”।
দেবদূত আমাদের কাছে ফিরে এসে এবারে অনুনয়ের সুরে বলেন “আজ মাঝ রাতে গোলক যান আসবে। পরীক্ষাগারে এখন যে অনুসন্ধান চালাচ্ছি তাকে উন্নত করবার জন্য আমাদের গ্রহ থেকে কিছু জিনিস আসবে।। অনুগ্রহ করে আপনারা তখন ছোটো কুটীরে বিশ্রাম করবেন। গোলক যানের দিকে তাকাবেন না, এর তেজস্ক্রিয় রশ্মিতে আপনাদের চোখের ক্ষতি হতে পারে”।
ল্যাবে কি নিয়ে অনুসন্ধান চলছে সেটা ত যীশু উঁকি মেরে দেখে এসেছে, সে প্রসঙ্গ চাপা দেওয়াই ভাল। আমি বললাম “আপনি বৈদিক যুগের মুনি ঋষিদের সূর্য-রশ্মি থেকে আহার নিয়ে কিছু বলছিলেন”।
উনি বললেন “দুঃখের বিষয়, আপনাদের পৃথিবীতে বৈদিক যুগের অবসানের সাথে এই গুল্ম বিলুপ্ত হয়ে গেল। আমাদের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে থাকলেন আমার পাঠানো গুল্ম, ওষধি গাছের নির্যাস আর শস্যদানা নিয়ে সেই লুপ্ত গুল্ম আবার তৈরি করা যায় কি না”।
আমি বললাম “সেই গুল্মই কি আজ রাতে আসছে?”
উনি হেসে মাথা নেড়ে বললেন “আজ রাতের কথা পরে বলছি। আমার গুল্ম পাঠানোর সময়েই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে থাকা অন্য আর একটি গোলক যানের অভিযাত্রীরা হিমালয়ের পাদদেশের গভীর অরণ্য থেকে বৈদিক যুগের মুনি ঋষিদের পত্র ভোজনের সেই লুপ্তপ্রায় গুল্ম কে খুঁজে পেলেন। পরে এখানেই, ঈশ্বরের এই বাগান থেকে সেই বিশেষ ওষধি গুল্ম অনেক পাওয়া গেল।”
যীশু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল “আমরা কিন্তু আসবার সময় ওষধি গাছগুলোর তলায় এক সম্পূর্ণ নতুন ধরনের গুল্ম দেখতে পেয়েছি। তাহলে এগুলো সেই লুপ্তপ্রায় গুল্ম। এরই পাতা আপনি গ্রামবাসীদের খাওয়ালেন আর তারা …”
দেবদূত ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন “প্রথমে আমি এটা খাইয়েছি হনুমান বাহিনীকে। এরাই আপনাদের নতুন বন্ধু”।
আমি হেসে ফেলি “ওই বাঁদররা আপনারও বন্ধু”।
এই প্রথম বার উনি এক বার ভ্রু কুঞ্চিত করে একটু বিরক্ত সুরে বললেন “আমরা হনুমানকে গভীর শ্রদ্ধা করি কেননা ওঁরা আমাদের পূর্বপুরুষ এবং সবসময় বিপদ থেকে উদ্ধার করেন”।
আমি মাফ চেয়ে নেবার আগেই দেবদূত বলতে সুরু করেন “আমি যখন আসি এখানে, সেই সময়ে অনাবৃষ্টিতে বেশির ভাগ গাছপালা শুকিয়ে গেছে। হনুমানদের খাবার খুব কষ্ট। রোজ ভোরবেলাতে আমার দেখাদেখি এনারাও আমার সাথে সূর্যপ্রণাম করতে আসেন ধুঁকতে ধুঁকতে। আমাদের নতুন কৃষি প্রযুক্তিতে পাহাড়ের উপত্যকায় সেই লুপ্তপ্রায় গুল্ম খুব তাড়াতাড়ি পরিণত হয়ে যায় আর তাতে ফুল ধরে। এই গুল্ম আর তার ফুলের রেণু প্রথমে এই হনুমানের দলকে নিবেদন করি”।
যীশু একটু যেন ভয় আর কুণ্ঠা মেশানো সুরে সাথে বলে “তা ওনারা সেটি গ্রহণ করলেন তো ? শুনেছি তেতো জিনিস ওনারা খান না”।
দেবদূত তাঁর স্বভাব সিদ্ধ গলায় বলেন “জিভের স্বাদ আমার তেমন জানা নেই, কিন্তু বর্ণনায় আছে এই গুল্মের পাতা আর ফুলের রেণু এক সাথে গ্রহণ করলে এক দিব্য-গন্ধি অম্লমধুর স্বাদের অনুভব হয়। শরীরের প্রতি রোম তখন পুলকিত হয়ে ওঠে”।
আমি বলি “এমনি আর কোনো গুল্মের পাতা আর ফুলের কথা আমার জানা নেই”।
দেবদূত একবার আবার তারায় ভরা আকাশের দিকে তাকালেন “মনে হয় স্বয়ং পরম প্রভু নিজ হাতে একে গড়ে এই বিরল গুন এর মধ্যে ঢেলে দিয়েছেন। হয়ত তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এই গুল্মের পাতা আর ফুল জঠর ক্ষুধা মেটানোর সাথে সাথে ঐশ্বরিক অনুভূতি এবং তাঁদের যে উদ্দেশে এই মানব জন্ম তা উজ্জীবিত করতে সাহায্য করবে”।
আমরা বিস্ময় আর শ্রদ্ধা মেশানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি দেবদূতের দিকে আর ওনার কথা শুনছি “ওষধি গুল্ম খাবার এক সপ্তাহ পরেও হনুমানদের রোজকার মত খাবারের খোঁজে বেরিয়ে যেতে দেখে বুঝলাম ওষধি গুল্মে হয় কাজ হয় নি আর নয়তো আর কিছু সময় নেবে। একদিন ওদের দলপতি আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের জঙ্গল থেকে বিরাট বিরাট আকারের মেটে আলু বয়ে নিয়ে যেতে দেখে কথাটা আর জিগ্যেস না করে থাকতে পারলাম না”।
মেটে আলু নামে আলু হলেও আসলে বিশাল আকৃতির গোলাকার কন্দ-মুল, মাটি থেকে খুঁড়ে বার করতে হয়। এখানের জঙ্গলে এদিকের লোকেরা খাদ্যাভাবে একে সাধারণত: পুড়িয়ে খায়।
দেবদূত বললেন “আমাকে অবাক করে হনুমান দলপতি বললেন যে এসব ওনারা নিয়ে যাচ্ছেন অনাহারে থাকা গ্রামবাসীদের এবং তাদের শিশুদের জন্য। বেশ কয়েক দিন থেকে তাঁদের নিজেদের জন্য সারাদিনে কয়েকবার ঝরনার জল ছাড়া আর কিছু খাবার দরকার হয় না”।
কথা বলার ফাঁকে আকাশের দিকে উনি মাঝে মধ্যেই দেখছেন। তাই দেখে আমি বলি “আপনি বোধ হয় এখন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। আমরা না হয় …”
উনি হাত তুলে আমাদের দিকে চেয়ে বলেন “তার এখনো অনেক দেরি আছে। বুঝলাম ওষধি গুল্ম সঠিক কাজ করেছে। সালোক সংশ্লেষে তাঁদের জঠর ক্ষুধার সাথে সাথে মানসিক উন্নতি ও ঘটেছে”।
যীশু বলে “এবার বুঝলাম যে হনুমান দল আমাদের এতটা সাহায্য কেন করল যদিও শেষটায় একটু মজা করলেও আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে অনেক কিছু শেখবার আর জানবার জন্য। কিন্তু গ্রামবাসীদেরও এটা দিতে পারতেন তো?”
দেবদূত আমাদেরে দুজনের দিকে একবার তাকালেন একটা হতাশার লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “সে সময়ে কয়েকজন গ্রামবাসী আমাকে চমৎকারী সাধু ভেবে কিছু পাবার আশায় রোজ আসতেন। ভাবলাম এদের ওপর এবার এই ওষধি গুল্মে কতটা কাজ হয় দেখা যাক। বস্তুত: রোজ সকালে আমার এবং হনুমান দলের এক সাথে সূর্য পূজো আর তারপর গুল্মের ফুল আর পাতা খাওয়া ওরা লক্ষ্য করেছে”।
দেবদূত আমাদেরকে বললেন যে প্রথমে তাঁর এই সব ভক্তদের তিনি এই সূর্যপ্রণাম শেখান এবং প্রসাদ বলে গুল্মের পাতা ও ফুল খেতে দেন। তখন খাদ্যের অভাবে গ্রামের ঘরে ঘরে চলছে অনশন। দেবদূতের ভক্তদের মুখে প্রসাদ খাবার সুফল শুনে গ্রামবাসীরা দলে দলে তাঁর কাছে প্রসাদ খাবার জন্য ভিড় লেগে গেল। উনি এর জন্য তৈরিই ছিলেন।
এই অঞ্চলের উপত্যকা জুড়ে ঈশ্বরের বাগানে হনুমান বাহিনীর দেখভাল এবং গ্রহান্তর থেকে পাঠানো অত্যাধুনিক কৃষি বিজ্ঞানের আশীর্বাদে গুল্মের অভাব ছিল না। কিন্তু দেবদূত এবার বিষণ্ণ হয়ে থামলেন।
ওনার মুখভাব দেখে মনে হোল এখানের মানুষের ওপর গুল্ম আর তার ফুলের রেণুর পরীক্ষা হয়ত বিফল হয়েছে। আমি যীশুকে ইশারা করলাম ওনার কাছে আর কিছুক্ষণ কাটিয়ে উঠে পড়তে।
আমরা দুজনে ছোটো কুটীরের উদ্দেশ্যেই যাবার জন্য ওনার কাছে আজ্ঞা চাইব চাইব করছি এমন সময় উনি দীর্ঘ নীরবতা কাটিয়ে বলে উঠলেন “এখানের মানুষ এখন রোজ সূর্যপ্রণাম করে আর সালোকসংশ্লেষ থেকে তার প্রয়োজনীয় আহার পেয়ে যায়। গুল্মের পাতা ও ফুল এখন তাদের খাবার দরকার হয় না। অনাহারে কাউকে কষ্ট পেতে হয় না। গুল্মের ফুল, পাতা বা রবিরশ্মি হনুমান দলের অন্যকে সেবার মনোভাবকে জাগরূক করে দিলেও তাদের চাইতে বুদ্ধিমান এবং উন্নত সভ্যতার এখানের গ্রামের লোকদের মানসিক জাগরণ করতে পারল না”।
আমরা দু জনেই ওনার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। দেবদূত বললেন “সালোক সংশ্লেষের দ্বারা পাওয়া বিশুদ্ধ খাদ্য আত্মাকে ঐশ্বরিক স্পন্দন অনুভব করতে এবং তার জন্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য পালন করতে প্রেরণা দেয়। আপনাদের গ্রহে গাছকেই দেখুন। এই খাদ্য তার ঈশ্বর চেতনা কে এত জাগ্রত করে তুলেছে যে তাদের আচরণ আপনাদের প্রাচীন কালের মুনি ঋষিদের মত। নিজেদের মধ্যে লড়াই-ঝগড়া বা অন্য প্রাণীদের ক্ষতি করা দূরে থাক, সে সবাইকে আশ্রয়, খাদ্য দিয়ে নিঃস্বার্থ সেবার সাথে প্রাণীজগৎ কে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে, এমনকি মরনের পর নিজ দেহ দান করে যায়”।
আমি বলি “সেই একই উপায়ে পাওয়া খাদ্যের গুন এখানের গ্রামবাসীরা কেন পেল না ?”
দেবদূত আমাদের দিকে তাকিয়ে করুন হাসি হাসলেন “পরম প্রভু তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে অপরের কল্যাণ আর সেবা করবার জন্যই নানা গুন দিয়েছিলেন। এই গ্রহে মানুষ তার বেশি সময়টা শুধু নিজের খাদ্য সংগ্রহের জন্য ব্যয় করার দরুন পরম প্রভুর দেওয়া গুনগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গেল। কয়েকজন ব্যতিক্রমী মানব নির্জন বনে গিয়ে পেয়ে গেলেন সেই গুল্ম যার সাহায্যে তাঁদের প্রচলিত খাদ্যের দরকার হল না এবং তাঁরা ঐশ্বরিক অনুভূতির সাথে সাথে মানব কল্যাণ আর সেবাতে ব্রতী হলেন।”
আমি বলি “এই গ্রামের মানুষ তো সেই সাধারণ মানুষের মধ্যেই পড়ে”
দেবদূত বললেন “আমাদের বিজ্ঞানীরা মনে হয় এই সমস্যাটার গোঁড়ায় গিয়ে তার সমাধান করতে হয়ত সক্ষম হয়েছেন।”
যীশু সাগ্রহে দেবদূতকে জিজ্ঞেস করলে “সেই সমাধান নিয়েই কি আজ রাতে আপনাদের গ্রহ থেকে গোলক যান আসছে? কিন্তু আপনাদের বিজ্ঞানীরা এক দূর গ্রহের মানব সমাজের জন্য যে ভাবে কাজ করলেন তা ভাবা যায় না।”
দেবদূত আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন “আমাদের খাদ্যাভ্যাসের জন্য অন্যের কল্যাণ করা এখন আমাদের সহজাত অভ্যাস। আমাদের বিজ্ঞানীরা এই গ্রহের শস্যদানা আর ওষধি গুল্ম দিয়ে এক নতুন উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছেন যা খুব সহজে জন্মাবে আর এই গ্রহের মানুষের সেই সুপ্ত গুন কে আবার জাগিয়ে তুলবে। এই গ্রহের মানুষ বুঝতে পারবে যে সে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। শুধু খাদ্য আহরণ করে বেঁচে থাকার জন্য তার জন্ম হয় নি। এই জাগরণের পরই তাদের শরীরে সালোকসংশ্লেষ করবার জন্য কোষগুলি জেগে উঠবে। এই জাগরণ যার যত শীঘ্র হবে তার সালোকসংশ্লেষ কোষগুলি তত তাড়াতাড়ি জেগে উঠবে”
যীশু বলে “আপনাদের এই আবিষ্কারের ফল কি শুধু এই প্রায় অনাহার পীড়িত অঞ্চলের জন্য?”
দেবদূত বললেন “এবারের প্রয়াস যদি সফল হয় তবে তা এই গ্রহের সব স্থানের মানব জাতি এবং পুরো পৃথিবীর কল্যাণের জন্য দরজা খুলে দেবে। এই পাহাড়তলির গ্রাম থেকে মানুষজনেরা খাদ্যের নিশ্চয়তা পেয়ে আর নিজ গৃহে অলস স্বার্থপরের মত বসে থাকবে না। তারা আমাদেরই মত পৃথিবীর সব প্রান্তেই ভ্রমণরত হবে আর এই উদ্ভিদের বীজ ছড়িয়ে দেবে। এই গ্রহের মানুষ নিজেদের মধ্যে হানাহানি ভুলে সমগ্র জীব জগতের কল্যাণে ব্রতী হবে আর সভ্যতা কে অনেক আগে এগিয়ে দেবে।”
আমরা ধুমডিলা থেকে ফিরে আসার পরই সেখানে সুরু হয় মেঘ ফাটা বৃষ্টি আর তার ফলে হড়কা বান আসে এই পাহাড়ি এলাকায়। ধ্বংস হয়ে যায় এখানের সব কিছু। লহমার মধ্যে গ্রামকে গ্রাম ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়।
মেঘ ফাটা প্লাবনের সেই রাতে উপগ্রহ চিত্রে এক রহস্যময় চিত্র দেখা যায়। একের পর এক নীল রঙের গোলক আকাশে উঠে ধূমকেতুর মত হারিয়ে যাচ্ছে।
আমি আর যীশু জানি সেই প্লাবনে ধ্বংস হয়ে গেছে পাহাড়ি নদীর কোলে মাইলের পর মাইল জুড়ে ঈশ্বরের বাগান আর ভিনগ্রহ থেকে আসা নতুন বীজ থেকে সদ্যজাত সহস্র সহস্র সেই বহুমূল্য গুল্ম যা এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে খাদ্য জোগানের সংগ্রাম থেকে মুক্তি দিয়ে মানবজন্মের সত্যকার উদ্দেশ্যকে রূপায়িত করতে পারত।
মহাপ্লাবনের রাতে সেই দেবদূত হয়ত কোনো গোলকে পাড়ি দিয়ে তাঁর কাজ অসমাপ্ত রেখেই হয়ত ফিরে গেছেন তাঁর বাস-গ্রহে। কিন্তু এই গ্রহের মানুষের ক্ষুধা আর হানাহানি থেকে মুক্তি অপেক্ষা করে রইল তাঁর শীঘ্র ফিরে আসার জন্য।
Tags: ঈশ্বরের বাগান, গল্প, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, প্রদীপ কুমার বিশ্বাস