ফারেনহাইট ৪৫১ (নির্বাচিত অংশ)
লেখক: রে ব্র্যাডবেরি; ভাষান্তর: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ন’টা নাগাদ হালকা খানিক খাবার নিয়ে খেতে বসেছিল মন্টাগ। তখন হঠাৎ সদর দরজাটা মিলড্রেডের নাম ধরে চিৎকার করে উঠল। মিলড্রেড পার্লার ছেড়ে এমন জোরে সদরের দিকে ছুট দিল যেন কোনো জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে পালাচ্ছে। খানিক বাদে দরজা দিয়ে ঢুকে এসে মিসেস ফেল্প্স্, আর মিসেস বাওয়েল্স্ও হাতে একটা করে মার্টিনির গ্লাস ধরে তেড়েফুঁড়ে সেই আগ্নেয়গিরির ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়লেন। খাওয়া থামিয়ে মন্টাগ সেদিকে কান খাড়া করল। সেখানে তখন যেন একগাদা রাক্ষুসে ঝাড়লন্ঠনের হাজারো সুরের টুংটাং ভেসে উঠেছে। সেখানে বসে থাকা অতিথিদের চেশায়ার ক্যাট-হেন হাসিগুলো যেন ঘরের দেয়ালগুলোকে ছ্যাঁকা দিচ্ছে। আর সেই শব্দের স্রোতকে টপকে বারবার তাদের চিল চিৎকার ভেসে আসছিল সেখান থেকে।
মুখের না গেলা খাবার চিবোতে চিবোতেই মন্টাগ উঠে গিয়ে পার্লারের দরজায় দাঁড়াল।
“আহা সবাইকে কী ভালোই না দেখাচ্ছে, তাই না?”
“কী ভালোই না দেখাচ্ছে।”
“এই মিলি, তোমাকেও তো দিব্যি দেখাচ্ছে।”
“দিব্যি।”
“সব্বাইকেই দারুণ দেখাচ্ছে।”
“দারু-উ-উ-ণ!”
মন্টাগ খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে অতিথিদের দেখল। তার কানে ফেবারের ফিসফিস ভেসে আসছিল, “ধৈর্য ধরো হে…”
“জবাবে মন্টাগ যেন নিজের মনেই ফিসফিস করে উঠল, “আমার বাড়িতে ফেরাটাই উচিৎ হয়নি। টাকাটা নিয়ে সোজা তোমার ওখানে চলে গেলেই ঠিক হত।”
“কাল এলেও চলবে। উপস্থিত সাবধান।”
“এই শো’টা কী দুর্ধর্ষ, তাই না গো!” পর্দার দিকে ইশারা করে মিলড্রেড চিৎকার করে উঠল হঠাৎ।
“দুর্ধর্ষ।”
একটা দেয়ালের পর্দায় এক মহিলা একইসঙ্গে হা হা করে হাসছিলেন আর কমলার জুস খাচ্ছিলেন ঢকঢক করে। মন্টাগের মাথায় একটা পাগলাটে চিন্তা উঠে আসছিল সেদিকে তাকিয়ে— মহিলা একইসঙ্গে অট্টহাসি আর জুস খাওয়াটা সামলাচ্ছেন কী করে? উলটোদিকের দেয়ালে একটা এক্সরে মুভি চলছে। সেখানে মহিলার দুর্ধর্ষ গলাটা বেয়ে জুসটার তাঁর দুর্ধর্ষ পাকস্থলীতে নেমে যাওয়াটা দেখানো হচ্ছে। আর তার পরেই তিনটে দেয়াল জোড়া ছবি মিলে ঘরটা একটা রকেটে চেপে মেঘের মধ্যে উড়ে গেল। তারপর সেখান থেকে সেটা আবার একটা লেবু রঙের সমুদ্রে ডুবে গেল। সেখানে নীল মাছেরা লাল আর হলুদ মাছদের ধরে ধরে মুখে পুরে চলেছে। এক মিনিট বাদেই ফের দৃশ্য বদলে গেল। এইবার দেয়াল জুড়ে তিনটে সাদা রঙের কার্টুন মানুষ একে অন্যের হাত-পা’গুলো কেটে কেটে ফেলছে আর কাটবার তালে তালে তুমুল অট্টহাসির শব্দ উঠছে চারদিক থেকে। দু-মিনিট বাদেই কার্টুনরা উধাও হয়ে গিয়ে ঘরটা হয়ে গেল জেটগাড়ি ছোটাবার একটা অ্যারেনা। সেখানে একগাদা জেটগাড়ি প্রচণ্ড জোরে ছুটতে ছুটতে বারবার একে অন্যের গায়ে ঢুঁ মারছে পিছিয়ে যাচ্ছে তারপর ফের ঢুঁ মারছে। প্রত্যেকটা ঢুঁ মারবার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িগুলো থেকে মানুষের শরীর ছিটকে উঠে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে।
“এই মিলি, দেখলে… দেখলে! উফ্ফ্!”
“দেখছি তো! দে-এ-এ-খ—ছি – তো-ও-ও…”
মন্টাগ পার্লারের এপাশের দেয়ালটার গায়ে হাত বাড়িয়ে মেইন সুইচ থেকে প্লাগটা এক টানে খুলে ফেলল। এক মুহূর্তের মধ্যে সব ছবিগুলো মুছে গেল ওয়ালভিশন থেকে। যেন ক্ষ্যাপাটে, ছটফটে মাছে ভরা কোনো ক্রিস্টালের পাত্র থেকে কেউ হঠাৎ সবটা জল ঢেলে ফেলে দিয়েছে।
তিন মহিলা আস্তে আস্তে ঘুরে দেখলেন এবার মন্টাগের দিকে। তাঁদের তিতিবিরক্ত মুখে মন্টাগের ওপরে রাগ আর অসীম বিরক্তি চাপা থাকছিল না।
“তা যুদ্ধটা কখন শুরু হবে বলে মনে হচ্ছে?” মন্টাগ শান্ত গলায় কেটে কেটে জিজ্ঞাসা করল, “মানে আপনাদের কর্তাদের তো দেখছি না… তাই মনে হল…”
“ওহ কর্তারা? তাঁরা তো আসেন আর যান, আসেন আর যান,” মিসেস ফেল্প্স্ জবাব দিলেন, “আয়ারাম গয়ারাম ফিনিগান হা হা।৬
“গতকাল আর্মি থেকে ফের পিট-কে ডেকে পাঠাল। ফিরবে আগামী হপ্তায়। অন্তত আর্মি থেকে সেরকমই তো বলল। বলে আটচল্লিশ ঘণ্টার যুদ্ধ হবে বড়োজোর। তারপরেই সবাই ফের বাড়ি। মানে, বেজায় ছোটো যুদ্ধ। কাল পিট ফোন করল। ওরা বলল আগামি হপ্তায় নাকি ফিরে আসবে। বেজায় ছোট্ট…”
তিনজন মহিলাই বড়ো বিব্রত মুখে কাদারঙের নিষ্প্রাণ দেয়ালগুলোর দিকে বারবার ঘুরে দেখছিলেন।
“আমার অবশ্য ও নিয়ে বিশেষ দুশ্চিন্তা নেই, “মিসেস ফেল্প্স্ ফের কথা বলে উঠলেন, “ওসব দুশ্চিন্তা-টুশ্চিন্তা যা করার সে পিট-ই করুক।” বলতে বলতেই হি হি করে হেসে উঠলেন তিনি, “ওসব দুশ্চিন্তা-টিন্তা করার ভার পিট-এর ওপরেই ছেড়ে দিয়েছি আমি। আমি বাবা ওসব করতে পারব না। আমার দুশ্চিন্তা-টিন্তা কিছু নেই।”
“ঠিক ঠিক,” মিলি ঘাড় নাড়ল, “ওসব চিন্তভাবনার কাজটা বুড়ো পিট-এর ঘাড়ে থাকাই ভালো।”
“লোকে বলে, নাকি যুদ্ধে সবসময় অন্যের বর মরে।”
“কথাটা ঠিকই। কারণ, লোক মরার খবর যা শুনেছি আজ অবধি তাতে যুদ্ধে মরেছে এমন একটাও চেনা নাম কানে আসেনি। তাই বলে কি মানুষ মরে না! মরে। এই তো গত সপ্তাহে গ্লোরিয়ার বর বাড়ির ছাদ থেলে লাফ দিয়ে সুইসাইড করল। কিন্তু যুদ্ধে লোক মরা? উঁহু…”
“যুদ্ধে লোক মরে না।” মিসেস ফেল্প্স্ও তাদের কথাবার্তায় সায় দিয়ে দিলেন। তারপর মাথা নেড়ে বলেন, “পিট আর আমি তো সবসময়ই বলি, ওসব চোখের জলটল যেন না বেরোয়। ওর, আমার, দুজনেরই তিন নম্বর বিয়ে এটা। কেউ কারো ওপরে কোনো ব্যাপারে নির্ভর করি না। আমরা তো লোকজনকে সবসময় বলি, স্বনির্ভর হও। স্বাধীনভাবে বাঁচো। পিট তো আমায় বলেই রেখেছে, যদি যুদ্ধে গিয়ে আমি মারা যাই তাহলে একদম কান্নাকাটি করবে না। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা বিয়ে করে ফেলবে। মনের মধ্যে আমার চিহ্নও রাখবে না।”
“কথাটা শুনে একটা অন্য জিনিস মনে পড়ে গেল,” মিলড্রেড হঠাৎ বলে উঠল, “কাল রাতে দেয়ালে ‘ক্লারা ডাভ-এর পাঁচ মিনিটের প্রেম’ দেখলে নাকি কেউ। একটা মেয়েকে নিয়ে গপ্পো। সে…”
মিলির মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল মন্টাগ। অনেক ছোটোবেলা একটা অদ্ভুত গির্জায় গিয়েছিল সে। সেখানে সার সার দাঁড় করানো সন্তদের মূর্তি। এই মুহূর্তে মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে সেই মূর্তিগুলোর মুখগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। রঙিন নারীপুরুষের দল। চুনির মতো লাল লাল ঠোঁট। মন্টাগ সেই মূর্তিগুলোর দিকে চোখ রেখে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল সেই গির্জায়। তাদের সঙ্গে কথাও বলেছিল। অজানা ধর্মটাকে বোঝবার চেষ্টা করেছিল। বড়ো বড়ো শ্বাসে জায়গাটার ধুলো, তার বাতাসে ভেসে থাকা কড়া সুগন্ধকে ফুসফুসে টেনে নিয়েছিল বারবার, যদি তাতে ওই রঙিন মানুষজনের একটু স্পর্শ মিশে যায় তার রক্তে, যদি তাতে এই অজ্ঞেয় মূর্তিগুলোর অস্তিত্বের একটু ছোঁয়া লাগে তার চেতনায়— এই লোভে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও মন্টাগ সেই মূর্তিদের একটুও বুঝতে পারেনি। অথবা, এ যেন ভিনদেশি কোনো দোকানে ঘুরেফিরে দেখা। সেখানে তার দেশের মুদ্রা অচল। দোকানের জিনিসপত্র, তার কাঠ, প্লাস্টার, মাটি এই সবকিছুই তার অজানা, তাদের হাতে ধরলেও কোনো সাড়া জাগে না তার মনে।
নিজের বাড়ির এই ঘরটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে-মুহূর্তে ঠিক এই অনুভূতিটাই হচ্ছিল মন্টাগের। চেনাপরিচিত কোনোকিছুই যেন নেই সেখানে। আছেন কেবল তিনজন অজানা মহিলা। চেয়ারে বসে বসে অনবরত এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ছেন, ক্ষণে ক্ষণে সিগারেট জ্বেলে ধোঁয়া উগড়ে দিচ্ছেন, একে অন্যের রঙ করা চুল আর ঝলমলে নেলপালিশ পরা আঙুলগুলো ঘাঁটছেন। তাঁদের ঘিরে থাকা অতল নৈঃশব্দের ছোঁয়ায় মুখগুলো কেমন ভূতগ্রস্তের মতো দেখায়। মন্টাগের খাবারের শেষ টুকরোটা গিলে নেবার আওয়াজ পেয়ে এবারে তাঁরা একসঙ্গে মন্টাগের দিকে ফিরে দেখলেন। কান খাড়া করে তার এলোমেলো নিশ্বাসের শব্দ শুনলেন খানিক। তাঁদের পেছনে, মরা দেয়ালগুলোকে ঘুমন্ত কোনো দৈত্যের কপালের মতো দেখায়। ঘুমন্ত দানবের কপাল— তার স্বপ্নরা এই মুহূর্তে ধুয়েমুছে গেছে সেখান থেকে। মন্টাগের মনে হচ্ছিল, এই ফাঁকা কপালগুলোকে এই মুহূর্তে ছুঁয়ে দেখলে আঙুলের ডগায় হয়তো হালকা নুনের স্বাদ উঠে আসবে। অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ্য আর তাদের সামনে ছড়িয়ে থাকা তিনজন মহিলার অশ্রূত উত্তেজনার কাঁপুনি… এই দুই মিলে স্বপ্নহীন ঘুমন্ত সেই কপালগুলোয় স্বেদবিন্দুর জন্ম দিয়েছে। হয়তো খুব বেশিক্ষণ এই নৈঃশব্দ্য, এই উত্তেজনার ভার আর সইতে পারবে না তারা। হিসহিসিয়ে উঠে ফেটে চূরমার হয়ে যাবে কোনো বিস্ফোরণে।
অনেক কষ্টে নিজের ঠোঁটগুলোকে একটু নাড়াল মন্টাগ, “আসুন একটু কথাবার্তা বলা যাক।”
তিন মহিলা একসঙ্গে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে ঘুরে তাকাল তার দিকে।
“ছেলেপুলে কেমন আছে মিসেস ফেল্প্স্?”
“আপনি তো জানেন মশাই, আমার ছেলেপুলে কিছু নেই। কোনো সুস্থমস্তিষ্ক মানুষেরই থাকে না আজকাল।” মিসেস ফেল্প্স্ রাগত গলায় বলে উঠলেন। কিন্তু ঠিক কেন যে ভেতরে ভেতরে এই রাগটা হচ্ছে সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
“আমি কিন্তু তা মোটেই বলব না,” মিসেস বাওয়েল্স্ বলে উঠলেন হঠাৎ, “আমার তো দু-দুটো বাচ্চা। দুটোই সিজারিয়ান অবশ্য। বাচ্চা আনার জন্য কে অত নর্মাল ডেলিভারির কষ্ট করে! তবে হ্যাঁ। বাচ্চা জন্মানো দরকার। নইলে মানুষ জাতটাই উধাও হয়ে যাবে যে! তা ছাড়া অন্য মজাও আছে। মাঝেমধ্যে বাচ্চাগুলো ঠিক বাপ-মায়ের মতো দেখতে হয়। সেটা নজরে পড়লে ভালোও লাগে একটু একটু। তবে হ্যাঁ। সেজন্য জন্ম দেবার কষ্টটা সইবার কোনো মানে নেই। বাচ্চা হবার সময় আমার ডাক্তার বলে, আরে তোমার পাছা তো বেশ শক্তপোক্ত হে। সিজারিয়ান করার দরকার হবে না। জোরসে চেপে ধাক্কা দাও, বেরিয়ে যাবে। কিন্তু আমি ওসব কথায় কানই দিইনি। পরিষ্কার বলে দিয়েছি আমার দ্বারা ওসব হবে-টবে না, ছুরি চালিয়ে বের করে এনে দাও।”
“সিজারিয়ান হোক বা না হোক, বাচ্চাকাচ্চা মানেই সর্বনাশ। তোমার মাথাটা গেছে। নইলে কি আর কেউ এমন সব কথা বলে!”
“আরে না না, আমি তো বাচ্চাগুলোকে দশ দিনের মধ্যে ন’দিনই স্কুলে রেখে দি। বাড়িতে রাখি মাসে কুল্লে তিনটে দিন। ভেবো না তাতেও খুব একটা সমস্যা হয়। ধরে নিয়ে গিয়ে পার্লারে বসিয়ে ওয়ালভিশানের সুইচ টিপে দিলেই হল। অনেকটা কাপড় কাচার মতো। মেশিনে কাপড়চোপড় ঢুকিয়ে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দাও, ব্যস। ঝামেলা শেষ।” বলতে বলতেই যেন মনশ্চক্ষে দৃশ্যটা দেখে মুচকি মুচকি হেসে উঠলেন মিসেস বাওয়েল্স্। তারপর ফের বলেন, “বাচ্চারা ভারী অদ্ভুত হয় জানো? এই গালে এসে চুমু খাচ্ছে তো এই লাথি মারছে। অবশ্য দরকারে আমিও উলটে লাথি কষিয়ে দিই বইকি!”
কথাটা শুনে তিন মহিলাই হা হা করে হেসে উঠলেন একসঙ্গে। হাঁ করা মুখগুলোর ভেতরে তাঁদের জিভগুলো দেখতে পাচ্ছিল মন্টাগ।
মিলড্রেড একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর মুখ তুলে মন্টাগকে তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে, “এসো, একটু পোলিটিকস নিয়ে কথা বলা যাক। ওতে মন্টাগ খুশি হবে।”
“বেশ বেশ,” মিসেস বাওয়েল্স্ মাথা নাড়লেন, “গতবার তো আমি ভোটও দিয়েছি। প্রেসিডেন্ট নোব্ল্কেই ভোট দিলাম, মানে ওঁকেই তো ভোটটা দেয় সবাই! আহা এমন সুপুরুষ প্রেসিডেন্ট এদেশে আর আসেনি গো!”
“আর ওঁর উলটোদিকে যে লোকটা দাঁড়িয়েছিল! অ্যাঃ!”
“যা বলেছ! বেঁটে বক্কেশ্বর একটা। আর চোখমুখেরও যা ছিরি! ভালো করে দাড়িটাও কামাতে জানে না। চুল আঁচড়ানো তো দূর অস্ত!”
“হেরো পার্টিটা কেন যে একে দাঁড় করাল কে জানে! একটা লম্বাচওড়া সুপুরুষ লোকের সঙ্গে ওরকম বেঁটে, বিচ্ছিরি দেখতে লোককে কেউ কখনো ভোট লড়তে পাঠায়! তা ছাড়া লোকটা ভালো করে কথাও তো বলতে জানে না। বিড়বিড় করে জড়িয়েমড়িয়ে কীসব বলত, আমি তার অর্ধেক শুনতেও পেতাম না। আর যেটুকু শুনতে পেতাম তার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতেও পারতাম না।
“শুধু তাই না। কী বিচ্ছিরি রকম মোটা বলত লোকটা! সে নাহয় হলি, কিন্তু ভুঁড়িটা ঠিকমতো ঢাক! একটু ভেবেচিন্তে জামাকাপড় পর! তা নয়, যা খুশি সব জামাকাপড় পরে ঘোরে। ওর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে উইনস্টন নোব্ল্ যে বিশাল ব্যবধানে জিতবে সেটা বুঝতে বৈজ্ঞানিক হতে হয় না। হাঃ। এমনকি নামগুলোও খেয়াল করে দ্যাখো। সেখানেও কার জেতবার কথা আর কার হারবার কথা সেটা পরিষ্কার টের পাবে। মনে মনে নামদুটো দশ সেকেন্ড নাড়াচাড়া করো— উইনস্টন নোব্ল্ বনাম হিউবার্ট হোয়াগ। তাহলেই কার জেতবার কথা সেটা আন্দাজ করতে পারবে।”
“ধেৎ। যত আজেবাজে কথা। ওই নাম আর ভুঁড়ি বাদে নোব্ল্ আর হোয়াগ-এর ব্যাপারে আর কী কী জানেন সেটা বলুন শুনি!”
“সবই জানি। মাসছয়েক আগে দুজনকেই তো ওয়ালভিশানে দু’বেলা দেখাত। একটার দিনরাত নাক খোঁটবার দৃশ্য দেখে দেখে পাগল হবার জোগাড় হয়েছিল আমাদের।”
“তাহলে? এবার কী বলবেন মিস্টার মন্টাগ? এরকম একটা লোককে কোনো সুস্থ মানুষ ভোট দেবে?”
মিলড্রেড হাসি হাসি মুখে মন্টাগের দিকে তাকাল এইবার। তারপর বেশ উৎফুল্ল গলায় বলে, “ওগো, তুমি এবারে এঘর ছেড়ে একটু ওদিকে যাও না! কেন আমাদের এমন নার্ভাস করে দিচ্ছ?”
মন্টাগ পার্লার ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে গিয়েও আটকে গেল মিলড্রেড, কারণ কয়েক মুহূর্তের ভেতর মন্টাগ ফের সে ঘরে ফিরে এসেছে। আর, এবারে তার হাতে একটা বই ধরা!
“গাই…”
“ধুত্তোর, যত্তোসব… যা খুশি হোক, আমি কেয়ার করি না…”
“আপনার হাতে ওটা কী বলুন তো?” মিসেস ফেল্প্স্ একটু ঘাবড়ে যাওয়া গলায় প্রশ্ন করে উঠলেন, “বই বলেই মনে হচ্ছে তো! আমি তো ভাবতাম এসব বিপজ্জনক জিনিসপত্র নিয়ে স্পেশাল ট্রেনিং আজকাল ফিল্মের মাধ্যমেই দেয় হয়!” বলতে বলতে এক মিনিট থেকে চোখ পিটপিট করে নিয়ে তিনি ফের যোগ করলেন, “বুঝেছি! অগ্নিপুরুষদের কাজকর্মের তাত্ত্বিক দিকটা নিয়ে পড়াশোনা করছেন, তাই তো?”
“তত্ত্ব! হাঃ…” মন্টাগ জবাব দিল, “এটা হল কবিতার বই।”
“মন্টাগ! তুমি…” মিলড্রেডের ফিসফিসে গলাটা তাকে বাধা দিতে চেয়েছিল।
“চুপ করে থাকো তুমি মিলি। একদম চুপ,” বলতে বলতেই মন্টাগ টের পাচ্ছিল, তার সম্পূর্ণ অস্তিত্ত্বটা যেন একটা ঘুরন্ত গর্জনের শব্দে বদলে যাচ্ছে…মাথার ভেতরে হাজারো ভোমরার অসহ্য গুঞ্জন, সেখানে আকাশ চিরে উড়ে যায় যেন অজস্র যোদ্ধাজেট…
“মন্টাগ প্লিজ… কী করছ তুমি একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবো… কোরো না মন্টাগ… প্লিজ…”
“আমায় থামতে বলছ? আর এতক্ষণ ধরে একদল রাক্ষস আরেকদল রাক্ষসের ব্যাপারে যা যা বলছিল সে-সব তোমার কানে যায়নি? হা ভগবান! নিজেদের নিয়ে, নিজেদের সন্তানদের নিয়ে, নিজেদের স্বামীদের নিয়ে যেসব কথা বলে গেল এরা এতক্ষণ ধরে… নিজের কানে না শুনলে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না।”
“উঁহু। আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই, যুদ্ধ বিষয়ে আমি একটি শব্দও কিন্তু উচ্চারণ করিনি,” মিসেস ফেল্প্স্ বেশ শান্ত গলায় মন্টাগের কথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন।
“এবং, কবিতার বিষয়ে জানাই, আমি এটিকে চরমতম ঘৃণা করি,” মিসেস বাওয়েল্স্, তাঁর সুচিন্তিত মতামত জ্ঞাপন করলেন।
“হুঁ। ‘চরমতম ঘৃণা!’ তা, কখনো এক লাইনও কবিতা পড়েছেন মিসেস বাওয়েল্স্?”
“মন্টাগ!” তার কানে ফেবারের গলাটা খরখর করে উঠল এবারে, “চুপ করো। এভাবে বোকার মতো সবকিছু নষ্ট করে দিও না।”
ততক্ষণে তিন মহিলাই উত্তেজিত হয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন।
“বসুন আপনারা!”
ফের বসে পড়লেন তাঁরা। তারপর বসে বসেই মিসেস বাওয়েল্স্ ক্ষীণ গলায় বললেন, “আ…আমি বাড়ি যাব!”
“কী আরম্ভ করেছ তুমি মন্টাগ! মাথা ঠান্ডা করো…” ফেবারের গলার শব্দটা মন্টাগের কানে মিনতি করছিল।
“মিস্টার মন্টাগ, তুমি তোমার ওই ‘বই’টা থেকে কি একটুখানি আমাদের পড়ে শোনাতে চাইছ! তা শোনাও না! চটপট শুনিয়ে দাও!” বলতে বলতে মিসেস ফেল্প্স মাথা দোলালেন একটু, “মনে হয় খুব ইন্টারেস্টিং কিছু হবে। তাই না?”
“বলছ কী তুমি? এ তো ভয়ঙ্কর বে-আইনি কাজ!” মিসেস বাওয়েল্স্ জবাবে আর্তনাদ করে উঠলেন।
“আহা। মিস্টার মন্টাগের কথাটা একটু ভাবো! উনি তো একটুখানি পড়তে চাইছেন! বেশি না। একটুখানি! আমি ঠিক বুঝতে পারছি। আর আমরা যদি ভালো মেয়ে হয়ে একটুক্ষণ শুনি, তাহলেই মিস্টার মন্টাগ খুশি হয়ে যাবেন। তারপর আমাদের ছুটি। আমরা ফের নিজেদের ইচ্ছেমতো আমরা আনন্দ-টানন্দ…” বলতে বলতেই চারপাশের মড়া দেয়ালগুলোর দিকে খানিক নার্ভাস চোখে তাকিয়ে দেখে নিলেন মিসেস ফেল্প্স্।
“মন্টাগ, তুমি যদি প্রকাশ্যে আইন ভেঙে ওখানে বই থেকে পড়া শুরু করো, আমি কিন্তু কানেকশন কেটে দেব, এই বলে দিচ্ছি,” তার কানের সবুজ পোকাটা ঝনঝন করে বলে উঠল, “কী লাভ হবে তোমার এসব করে? কী পাবে তুমি বলো তো!”
“ভয় দেখাব। ভয়ের চোটে চোখে অন্ধকার দেখিয়ে ছাড়ব এদের।”
মন্টাগের কথাগুলো কানে যেতে মিলড্রেড হঠাৎ এদিক-ওদিক ঘুরে দেখল, “কার সঙ্গে কথা বলছ তুমি গাই?”
মন্টাগের কানে তখন যেন শব্দের ধারালো ছুঁচ সটান মাথায় গিয়ে বিঁধছে, “শোনো মন্টাগ। যা কীর্তি করেছ তার থেকে উদ্ধার পাবার একটাই উপায় আছে। এতক্ষণ যা করলে সেটাকে ইয়ার্কি ফাজলামি বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করো। তোমার মাথায় গড়বড় হয়েছে এমন সন্দেহটা এদের মন থেকে তাড়াতে হবে প্রথমে। সেটা করবার পর শান্ত পায়ে হেঁটে হেঁটে গিয়ে দেয়ালের ভেতরে রাখা চুল্লিতে বইটাকে বেশ নাটকীয় ভঙ্গীতে ছুঁড়ে ফেলে দাও।”
দেখা গেল, মিলড্রেডও ব্যাপারটা এই পথেই সামলাবার কথা ভাবছে। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলে, “আসল ব্যাপারটা বলি শোনো। প্রত্যেক বছর অগ্নিপুরুষরা একটা করে ছাপা বই বাড়িতে নিয়ে আসতে পারে, যাতে আগেকার দিনে কী বোকা বোকা সব কাজ হত সেটা বাড়ির লোককে হাতেকলমে দেখানো যায়; বুঝিয়ে দেয়া যায় এসব খারাপ জিনিস চোখে দেখলেও মানুষ কতটা নার্ভাস হয়ে যেতে পারে, কীভাবে এসব জিনিস মানুষকে মানুষের মাথা খারাপ করে দেয়। আজ রাতে গাই সেই ব্যাপারটাই তোমাদের সামনে একেবারে হাতেকলমে করে দেখাচ্ছে। এবারে ও এই ‘বই’ থেকে একটুখানি তোমাদের পড়ে শোনাবে, যাতে তোমরা বুঝতে পারো কীসব যা তা উলটোপালটা কথা আগেকার দিনে এই বই দিয়ে শেখানো হত। আর, একবার সরাসরি সেগুলো কানে গেলে আর কোনোদিন আমরা কেউ বই নিয়ে মাথা ঘামাব না। তাই না মন্টাগ! তুমি তো সেজন্যই এই বিশ্রী, বে-আইনি জিনিসটাকে খুব অনিচ্ছা থাকতেও আমাদের ভালোর জন্য কষ্ট করে…”
“হ্যাঁ।”
মন্টাগ কথাটা বলবার সঙ্গে সঙ্গে মিলড্রেড হাসিমুখে তার হাত থেকে বইটা ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে তার পাতা উলটোতে উলটোতে একজায়গায় থেমে গিয়ে বলে, “এইখানটা পড়ো। না না, এইখানটা নয়… এই যে… এই… এইখানটা। উফ্ফ্ এইখানটা যা মজার না! আজ তুমি আমাদের এইখানটা খানিক পড়ে শোনাবে। জোরে জোরে পড়ো, জোরে জোরে পড়ো…” বলতে বলতে বান্ধবীদের দিকে ঘুরে সে যোগ করল, “শুনে দেখো কেবল। একটা শব্দেরও মানে বুঝতে পারবে না। সব বেশ হযবরল সসেমিরা টাইপ কথাবার্তা। পড়ো গাই। পড়ে শোনাও।”
সামনে খুলে ধরা পাতাটার দিকে তাকিয়ে দেখল মন্টাগ। তার কানে একটা মাছি গুণগুণ করে উঠল, “অগত্যা। পড়ো…”
“লেখাটার নামটা কী গো?”
“ডোভার বিচ।” মন্টাগের মুখটা কেমন অবশ ঠেকছিল নিজের কাছে।
“বেশ বেশ। তা এবারে বেশ আস্তে আস্তে ধরে ধরে পড়ো তো! আমরা শুনি।”
বড়ো গরম লাগছিল মন্টাগের। শরীর বয়ে যেন তাপপ্রবাহ চলছে তার। এবং শৈত্যপ্রবাহ। যেন একটা ধূ ধূ মরুভূমির মধ্যে তিনটে চেয়ারে তিনজন শ্রোতা আর তাঁদের সামনে সে একলা দাঁড়িয়ে। একটু একটু দুলছে সে। অপেক্ষা করছে। সামনে চেয়ারে বসা মিসেস ফেল্প্স কখন তাঁর গাউনের নীচেটা চাপড়েচুপড়ে সমান করে নিয়ে একটু স্থির হয়ে বসবেন, মিসেস বাওয়েল্স্-এর চুলে আঙুল বোলানো কখন শেষ হবে তারই অপেক্ষা করছে। আর তারপর, আস্তে আস্তে, নীচুগলায়, একটু থেমে থেমে সে পড়তে শুরু করল। তারপর এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যেতে যেতেই তার গলাটা দৃঢ় হয়ে উঠতে শুরু করল ক্রমশ। সেই ধূ ধূ, শূন্য মরুভূমি জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল তার উদাত্ত গলার স্বর, সেই উত্তপ্ত শূন্যতার বুকে বসে থাকা তিনজন মহিলাকে ঘিরে পাক খেয়ে চলল কিছু শব্দ…
এ সাগর বিশ্বাসের,
ভরা জোয়ারের কালে কী উজ্জ্বল স্রোত বয়ে যেত
পৃথিবীর কূলে কূলে
এখন কেবল শুনি অন্ধকারে পশ্চাদপসারী
প্রবল ভাটার টান
রাতের নিঃসঙ্গ হাওয়া যে পথে গিয়েছে
সেই পথ ধরে সে-ও চলে যায়
রেখে যায়
দীর্ঘ বালিয়াড়ি, উলঙ্গ বর্জ্যের স্তূপ পার্থিবের
তিন মহিলার চেয়ার তিনটে থেকে কিঁচ কিঁচ শব্দ উঠছিল।
মন্টাগ কবিতার শেষ পংক্তিগুলো বলে উঠল—
এসো প্রেম, আজ শুধু সত্য কথা হোক
তোমাতে আমাতে।
এ পৃথিবী যাকে চিরকাল স্বপ্নপুরী, রূপময় আনন্দের ধারা,
চিরযুবা- এই ভেবে হৃদয়ে ধরেছি
আসলে সে স্বপ্নহীন, প্রেমহীন
আলোহীন, শান্তিহীন অনিশ্চিত অন্ধকার ভূমি
এখানে ব্যথায় শান্তির প্রলেপ নেই, আছে যুদ্ধ আছে পলায়ন
এখানে আঁধার রাতে যুদ্ধ করে নির্বোধ বাহিনী
মিসেস ফেল্প্স্ কাঁদছিলেন। মরুভূমির মাঝখানে বসে থাকা অন্য দুই মহিলার চোখের সামনে তাঁর কান্না ক্রমশ আরও উচ্চকিত হয়ে উঠছিল। কান্নার ঝোঁকে তাঁর মুখটা যেন তুবড়ে যাচ্ছিল সেই মুহূর্তে। মিলড্রেড আর মিসেস বাওয়েল্স্ তাঁর ছোঁয়া এড়িয়ে স্তম্ভিতের মত বসে ছিল। এ অবস্থায় কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না তারা। মিসেস ফেল্প্স ডুকরে ডুকরে উঠছিলেন বারবার। ব্যাপার দেখে মন্টাগ নিজেও একটু হকচকিয়ে গিয়েছে তখন।
খানিক বাদে একটু ধাতস্ত হয়ে মিলড্রেড বল, “শ-স-স- ক্লারা… এভাবে কাঁদে না। কী হল তোমার হঠাৎ?”
মিসেস বাওয়েল্স্ সটান উঠে দাঁড়ালেন এবারে। তারপর মন্টাগের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলেন, “হল তো? জানতাম এরকমই কিছু একটা বাধবে। আমি সবসময় এইটাই বলি সবাইকে। কবিতা মানেই চোখের জল, সুইসাইড, কান্না, মন খারাপ, অসুখ… যত্তসব গ্যাদগেদে ব্যাপার। আজ একেবারে চাক্ষুষ তার প্রমাণ দেখলাম। আপনি লোক সুবিধের নন মিস্টার মন্টাগ। একেবারেই সুবিধের নন।”
ফেবার তার কানে ফের একবার হুল ফোটাল, “এবার…”
মন্টাগ টের পেল তার শরীরটা পেছন ঘুরে দেয়ালের গায়ের চুল্লির দরজাটা খুলে ধরে তার পেতলের গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে বইটাকে ভেতরের আগুনে ছুঁড়ে দিয়েছে।
“ফালতু কয়েকটা শব্দ… ফালতু… ফালতু… বিশ্রী, কষ্ট দেয়া কতকগুলো শব্দ!” বলতে বলতেই মাথা নাড়ছিলেন মিসেস বাওয়েল্স্, “কেন যে মানুষ মানুষকে কষ্ট দেবার জন্য মরতে এসব বানায়! যেন কষ্টের কোনো অভাব আছে পৃথিবীতে। কেন যে লোকজনকে জ্বালাবার জন্য এসব জঘন্য জিনিস…”
ওদিকে মিলড্রেড তখন মিসেস ফেল্প্স্কে নিয়ে ব্যস্ত। তার একটা হাত ধরে টানতে টানতে সে বলে যাচ্ছে, “ক্লারা, এই ক্লারা, একটু হাসো এবারে! এসো সুইচ টিপে আমাদের ‘পরিবার’টাকে চালিয়ে দাও দেখি। এই যে… চালাও চালাও… আর এসব কান্না টান্না নয়। একটু হাসা যাক এবারে। ভালো বুদ্ধি দিই তোমায়- পার্টি করবে একটা?”
“না,” মিসেস বাওয়েল্স্ জবাব দিলেন, “আমি এখন সোজা বাড়ি ফিরে যাব। তোমরা যদি আমার বাড়িতে আসতে চাও, আমার পার্লারে বসে আমার ‘পরিবার’-এর সঙ্গে মিশতে চাও তো আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি আর কখনো এই ক্ষ্যাপা অগ্নিপুরুষের পাগলখানায় পা দিচ্ছি না।”
“যান। বাড়ি চলে যান,” মন্টাগ মিসেস বাওয়েল্স্-এর দিকে ঠান্ডা চোখে তাকাল, “গিয়ে একা একা বসে আপনার স্বামীদের কথা ভাবতে থাকুন। প্রথমজন ডিভোর্স করল, দু’নম্বর জন জেট ক্র্যাশে মরল, তিন নম্বর জন নিজের মাথায়… যান যান… গিয়ে বসে বসে আপনার দশ-বারোটা গর্ভপাতের প্রত্যেকটার কথা মনে করুন, আপনার ওই সিজারিয়ান সেকশনের স্মৃতিচারণ করুন, নিজের পেটের বাচ্চাদুটো আপনাকে কেমন ঘেন্না করে সেটাও ভাবুন গিয়ে। আর তারপর চিন্তা করে দেখুন, কেন এমন হল? এগুলো ঘটা আটকাবার জন্য আপনি ঠিক কী কী করেছেন সারা জীবনে। যান, বাড়ি যান। চলে যান আপনি।” বলতে বলতে মন্টাগের গলা চড়ে উঠছিল, “ভালো চান তো ভালোয় ভালোয় রওনা হন, নইলে আমিই এক লাথিতে তোমায় দরজা দিয়ে সটান রাস্তায় বের করে দেব এই বলে দিলাম।”
দরজাটা সজোরে বন্ধ হয়ে যেতে বাড়িটা খালি হয়ে গেল। ওয়ালভিশনের ঘরে ঠান্ডায় মন্টাগ একা দাঁড়িয়ে রইল। দেয়ালের পর্দাগুলোয় ময়লা বরফের রঙ।
বাথরুম থেকে জলের আওয়াজ উঠছিল। দরজার আড়ালে মিলড্রেড তার ঘুমের বড়ির শিশিটা হাতে নিয়ে ঝাঁকাচ্ছে। জলের শব্দ পেরিয়ে তার আওয়াজ মন্টাগের কানে এসে লাগছিল।
“তুমি একটা আকাট মুখ্যু মন্টাগ… গাধা, একটা আস্ত গাধা তুমি…”
“চুপ করো,” বলতে বলতে মন্টাগ কান থেকে সবুজ বুলেটটা বের করে এনে সেটাকে পকেটে ঠুসে দিল। পকেট থেকে গুনগুন করে সেটা তখনও বলে চলেছে, “গাধা… গাধা…”
সম্পূর্ণ উপন্যাসটি বই আকারে কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে শীঘ্রই!!
Tags: অনুবাদ উপন্যাস, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, রে ব্র্যাডবেরি, সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা