প্রফেসার হচপচ
লেখক: বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
জেনিদি আখ খেতে খেতে বলল, “প্রফেসার হচপচ যে অত বড়ো বিপদে পড়বেন, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।”
আমি হাঁ হয়ে তাকিয়ে পড়লাম জেনিদির মুখের দিকে।
মে মাসের সকালবেলা। আমাদের প্রকাণ্ড উঠোনে প্রকাণ্ড সবেদা গাছটার ছায়ায় বসে কথা হচ্ছে। জেনিদি একটা চেয়ারে পা তুলে বসে আখ চিবুচ্ছে, আমি তার মুখোমুখি আরেকটা চেয়ারে বসে আছি। চারদিকে কড়কড়ে রোদ। ফুরফুর করে দখিনা বাতাস বইছে। আশপাশের গাছগাছালি থেকে পাখির কিচিরমিচির ভেসে আসছে।
“প্রফেসার হচপচকে তো চিনিস, চিনিস না?” আখের ছাল-ছেলা রসালো শক্ত রুপোর মতো ডাঁটাটা মটাস করে ভেঙে চিবুতে চিবুতে বলল জেনিদি।
আমি লোকটার চেহারা মনে করার চেষ্টা করছি। জেনিদি বলল, “মনে করে দেখ! ঠিক এক বছর আগে কুঁজো একজন বয়স্ক ভদ্রলোক প্রতিদিন সকালে আমার ল্যাবরেটরির সামনে এসে বসে থাকতেন… ওই যে আধা-কোঁকড়ানো ধুলোটে চুল, কাঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফে ভরতি মুখমণ্ডল, কাচের গুলির মতো টলটলে চোখ, খুব পুরু চশমা পরতেন, ফ্রেম ভাঙা, পাটের দড়ি দিয়ে চোখের সঙ্গে বেঁধে রাখতেন, আরে যাকে পাগল ভেবে তুই ছুট দিয়েছিলি, মনে করে দেখ! সেই লোকটা।”
উঠোনের ধারে নারকেল গাছের গোড়ায় আমার পায়রাগুলো চরে বেড়াচ্ছে। আমি নাকের ডগা মেসেজ করতে করতে সে দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল!
“ওহ্হো! ওই যে খুব ময়লা একটা কোট পরে থাকতেন! কোঁচকানো সুট! প্রতিদিন একই ড্রেস পরে আসতেন, গা-টা কাঁপত সারাক্ষণ—ওই লোকটা?”
“আরে হ্যাঁ রে!” হুসুত করে আখের এক ঢোঁক রস গিলে বলল জেনিদি, “এতক্ষণ লাগে চিনতে!”
“কিন্তু সে তো হাবাগোবা ভিখিরি টাইপের লোক! তার আবার কীসের বিপদ!”
জেনিদি আখের বড়ো একটা ছাল চটাং করে দাঁতে তুলে কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, তারপর ফুহঃ করে ছালটা ফেলে বলল, “জীবনহানির!”
“জীবনহানির!”
“হ্যাঁ।” জেনিদি আখ খাওয়া আপাতত বন্ধ রাখল। বেশ দৃঢ়ভাবে বলল, “প্রফেসার হচপচ একজন পণ্ডিত মানুষ। পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি ইনটারেস্টিং একটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। মানুষ যেমন জীবনমৃত্যু, পরকাল, ঈশ্বরের অস্তিত্ব—এসব নিয়ে ভাবে, বিশ্বপ্রকৃতি নিয়ে অন্য প্রাণীর ভাবনা কী, তা জানাই ছিল তার গবেষণার বিষয়। তার ভাবনার ভিত্তিটা বেশ চমৎকার!” জেনিদি মটাস করে আরেক খণ্ড আখ কামড়ে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, “প্রফেসার হচপচের ধারণা, মানুষের জ্ঞান ও কল্পনায় বিশ্বপ্রকৃতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রহস্যগুলো ধরা সম্ভব নয়; অন্য প্রাণীর ভাবনায় তা ধরা পড়ে, যেটা জানতে পারলে আমাদের উপকার হবে। আপাতত তিনি ইঁদুর, বিড়াল, কুকুর, কবুতর আর গোরুর ভাবনা মানুষের বোধগম্য করে তোলার জন্য গবেষণা শুরু করেছিলেন। একটি যন্ত্রও আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল বনেবাদাড়ে ঘুরে কার্যকর কোনো প্রাণীর ভাবনা রেকর্ড করা। যন্ত্রটির কার্যপদ্ধতি ও সঠিকতার মাত্রা নিয়ে তিনি একটি আর্টিক্ল লিখেছিলেন; এবং নেচার জার্নালে তা পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তারা ছাপায়নি। অবশ্য সেজন্য তার বিন্দুমাত্র কোনো অনুযোগ ছিল না। তিনি তার যন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করতে আসতেন।” জেনিদি আখ চিবুতে লাগল।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, এ পর্যন্ত জেনিদির দুটো গবেষণাপত্র নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। একটি এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল লাইফ ফাইন্ডিং বিষয়ে, অন্যটি পরমাণুর ডিটেইল স্ক্যান সংক্রান্ত। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’ এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল লাইফ ফাইন্ডিং যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য ইতিমধ্যে জেনিদিকে সম্মানিত করেছে। আইনস্টাইন সাহেব যে কালো কলমটি ব্যবহার করতেন, সেটি এখন জেনিদির ডেস্কে। নাসা জেনিদিকে তাদের সঙ্গে কাজ করার অফার দিয়েছিল, কিন্তু সে তা ফিরিয়ে দিয়েছে। কারণ, গ্রাম ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে থাকা জেনিদির পক্ষে সম্ভব নয়। গাছগাছালি, পাখির কলতান, ফাঁকা মাঠের পরে একলা একটা বাবলা গাছের ছায়ায় বসে কলাই খাওয়া, গোরু চরে বেড়াবে পাশে—এরকম পরিবেশেই জেনিদির চিন্তা খোলে। নিজের বাড়িতেই একটা ল্যাবরেটরি বানিয়েছে। কী নেই সেখানে! সুচ, আলপিন থেকে শুরু করে সুপারকম্পিউটার পর্যন্ত—সব রয়েছে।
জেনিদি বলল, “গত বছরই প্রফেসার হচপচ তার যন্ত্রের একটা ভাঙা অংশ আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা নাকি একটা রিসিপটর। ডেটা কালেক্টরগুলো কয়েকটা ইঁদুরের মস্তিষ্কে বেঁধে দিতে পারলেই নাকি যন্ত্রটিতে ভাষা ফুটে উঠবে। প্রথমে সংগীতের সুরের মতো, পরে ফ্রিকোয়েন্সি বিশ্লেষণ করে টেক্সট উঠবে। টেক্সটের ভাষা ইংরেজি ও বাংলা। এজন্য হচপচ একটি অ্যান্টেনাও বানিয়েছিলেন। বেশ শক্তিশালী। পাঁচশো মাইল পর্যন্ত নাকি কাজ করবে সেই অ্যান্টেনা। কালেক্টরগুলো প্রথমে সিগন্যাল পাঠাবে অ্যান্টেনাতে, রিসিপটরটি ওই অ্যান্টেনা থেকেই তা গ্রহণ করবে। আমি অবশ্য অতটা গুরুত্ব দিইনি। যন্ত্রাংশটা আমার ল্যাবরেটরি রুমের একটা আলমিরাতে তুলে রেখেছিলাম। হচপচের বিশ্বাস, পাহাড়ি ইঁদুর বেশি কল্পনাপ্রবণ। ঘর-জ্বালানি ছুঁচো ইঁদুরের ওপর বেশ হতাশ ছিলেন তিনি। যা-ই হোক, সেই পাহাড়ি ইঁদুর খুঁজতে গিয়েই বেচারা পড়লেন ভীষণ বিপদে।”
জেনিদি আখের টুকরোগুলো সব শেষ করে ফেলেছে। একটা পাত্রে মা পাকা পাকা কয়েকটা সবেদা দিয়ে গিয়েছিলেন আগে। সেগুলো এখন পড়ে আছে।
জেনিদি শুরু করল, “আমেরিকা যাওয়ার ঠিক দু-দিন আগে, একদিন আমাকে সারারাত জেগে কাজ করতে হয়েছিল। ল্যাবরেটরি রুমেই ছিলাম। আমার এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল লাইফ ফাইন্ডিং যন্ত্রের সঙ্গে গ্রাউন্ড প্রসেসিং মেশিনের কানেকটিভিটি জোরদার করার জন্য খুব জটিল একটা ট্রানজিস্টার বানাচ্ছিলাম। রাত তখন আন্দাজ দুটো কিংবা তার একটু বেশি হবে, অদ্ভুত একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। দোয়েল পাখির শিসের মতো, চাপা, কিন্তু বেশ সুরেলা, মাঝেমধ্যে আবার ফিশফিশে আওয়াজের মতো লাগছে। ট্রানজিস্টার তৈরিতে আমি মগ্ন ছিলাম, শব্দটা অনেকক্ষণ ধরেই হচ্ছিল, আমার খেয়ালে আসেনি। ঘরে চাপা একটা পতপত আওয়াজ হলে আমার টনক নড়ল। ভাবলাম, ঘরে তো অনেক যন্ত্রপাতি—একটা না একটা থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে। কিন্তু আমার ভুল ভাঙল, যখন আওয়াজটা টো টো করে বেশ জোরালো হল, সঙ্গে সেই দোয়েলের শিসের মতো আওয়াজটাও কানে ঘা দিতে লাগল। রাতে আমি ল্যাবরেটরি রুমের জানালা খুলে রাখি, তুই তো জানিস! পাশে যে বাতাবিলেবুর গাছটা রয়েছে, ভাবলাম, সেখান থেকে পাখির আওয়াজ আসছে। কিন্তু আমার অনুমান খাটল না। ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম, আলমিরার দিক থেকে আওয়াজটা আসছে। আলমিরা খুলে দেখলাম, প্রফেসার হচপচের সেই যন্ত্রটি নড়ছে, আর আওয়াজের উৎসটাও সেই যন্ত্র। এতদিন যন্ত্রটার কথা মনেই ছিল না। ধুলো জমে গেছে। আমি হাতে করে সেটা বাইরে নিয়ে এলাম। বেশ ঝাঁকুনি হচ্ছিল। সেই আওয়াজটাও কেমন বাধো-বাধো ঠেকল, নেটওয়ার্ক দুর্বল হলে মোবাইলে যেমন কথা কেটে কেটে যায়, তেমন। আমার মাথায় তখন একটা বুদ্ধি খেলল! আমি সিগন্যাল বুস্টার বানিয়েছিলাম, সেটা অন করে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম স্ক্রিনে লেখা উঠল: ‘তাড়াতাড়ি কাট, জোরে জোরে কাট, অটল বাড়ার আগে হামোলটা সরে যেতে পারবে’! এই লেখা আমাকে শুধু আশ্চর্যই করল না, প্রফেসার হচপচের ওপর শ্রদ্ধাবোধ বাড়িয়ে দিল। সেই সঙ্গে খানিকটা অপরাধবোধ হতে লাগল, তাকে আমি গুরুত্ব দিইনি বলে। লেখাটার অর্থ উদ্ধারে নেমে পড়লাম, দুটো শব্দ আমার কাছে অস্পষ্ট, একটা ‘অটল’ আর একটা ‘হামোল’। ‘অটল’ শব্দটা কিছুটা পরিচিত, পাহাড় বোঝাতে, কিংবা অনড় বোঝাতে ব্যবহার হয়। কিন্তু এই বাক্যে তেমন অর্থ দাঁড়ায় না। সঠিক অর্থ উদ্ধারের জন্য খুব করে ভাবতে লাগলাম, কিন্তু পেরে উঠছিলাম না। অপেক্ষা করছিলাম, আরও কিছু লেখা ভেসে ওঠে কি না, তাহলে হয়তো কোনো ক্লু পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু শুধু ওই একটি লেখাই বারবার ভেসে উঠছে। ভাবলাম, সিগন্যালটার উৎসস্থল জানতে পারলে অর্থ উদ্ধার সহজ হবে। আমি একটা লোকেশন ট্র্যাকারও বানাচ্ছিলাম। চাঁদের গায়ে বসানো আমার একটি যন্ত্রের মাধ্যমে সেটা কাজ করবে—এমনই ইচ্ছা ছিল, কোনো উপগ্রহ কোম্পানিকে টাকা দিতে চাই না। এক পূর্ণিমা রাতে আমার লেজ়ার প্রক্ষেপণ যন্ত্রের মাধ্যমে অতি হালকা ও ছোট্ট একটা কনট্রোলার চাঁদের গায়ে ফুটিয়ে দিয়েছিলাম। কাজও করছিল, কিন্তু মুশকিল হল, চাঁদ এক জায়গায় থাকে না, মুভ করে। আর মুভ করে বলে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের হেরফের হয়। সেজন্য সময়েরও বেশ হেরফের হয়। সময়ের হেরফের হলে লোকেশন ট্র্যাকার সঠিক অবস্থান জানাতে পারে না। তাই সময়ের জটিল হিসেব কষার জন্য একটা স্পেস ওয়াচ বানানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নানা কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি।… অবশ্য তা-ই বলে আমার যন্ত্রে যে একেবারে কাজ হচ্ছে না, তা নয়। বরং কাজের ধরন পালটে গিয়ে অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। সেটাও বেশ ইনটারেস্টিং! কোনো নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি চ্যানেল চিনতে পারলে তার আগা ও মাথার অবস্থান বলে দিতে পারে, কম্পনের সাহায্যে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল যেমন জানতে পারা যায়, অনেকটা তেমন। তাই আমি এর নাম দিয়েছি ‘ফ্রিকোয়েন্সিসকো মিটার’। যা-ই হোক, তাড়াতাড়ি আমি যন্ত্রটিতে একটা ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফায়ার ইনস্টল করে নিলাম, তারপর প্রফেসার হচপচের দেওয়া যন্ত্রটির সিগন্যাল-ফ্রিকোয়েন্সি মেপে একটা ফাইবার দিয়ে তা আমার যন্ত্রটির সংশ্লিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি গ্রুপের সকেটে ঢুকিয়ে দিলাম। দেখি, কাজ হচ্ছে! প্রথমে ‘ডিরেকশন’ বাটন চাপলাম, দেখলাম, ট্র্যাকারের কম্পাস-কাঁটা দক্ষিণ-পুবমুখো ঘুরে স্থির হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা লাল রেখা পিটপিট করে ভেসে উঠল, সেটা সিগন্যালের আগমনপথ! আমি ‘গো’ বাটন চাপতেই কম্পাস-কাঁটা সেই লাল রেখা, অর্থাৎ আগমনপথের ওপর দিয়ে চলতে লাগল। শেষ বিন্দুতে এসে থামলে, জায়গাটি চিনতে পেরেই আঁতকে উঠলাম! বান্দরবনের জর্দানপাড়া! খুনখারাপি থেকে শুরু করে ভয়ংকর ভয়ংকর ঘটনা ঘটে এই পাহাড়ি জঙ্গলে! প্রফেসার হচপচ প্রায়ই বলতেন, ‘পাহাড়ি ইঁদুরদের ভাবনা পরিষ্কার।’ সর্বনাশ! বুঝতে অসুবিধা হল না, হচপচ ওই জর্দানপাড়ার পাহাড়ি জঙ্গলে ইঁদুর খুঁজতে গিয়েছেন, এবং ওখানে তাঁর কিছু একটা ঘটেছে! অনেকক্ষণ পরে হচপচের যন্ত্রে একটা মারাত্মক লেখা উঠল: ‘হামোলটা মরে যাচ্ছে’! এ কথার অর্থ পরিষ্কার বুঝতে না পারলেও স্থির থাকতে পারছি না। সাংঘাতিক কিছু ঘটছে বলে মনে হচ্ছে। কী করা যায়, ভাবছি। জায়গাটি জ়ুম করে পরিষ্কার হয়ে নিলাম। ঘন জঙ্গল। জঙ্গল ফুঁড়ে লম্বা একটা গাছ। এর বেশি আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কী করা যায়, ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা বুদ্ধি এল! ভাবলাম, বান্দরবনের পুলিশ সুপারকে কাজে লাগানো যায়! ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার ক্যালিফোর্নিয়াতে পরিচয় হয়েছিল। প্রশিক্ষণের জন্য তিনি ক্যালিফোর্নিয়াতে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় আমার সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। বেশ তাগড়া চেহারা। হিল ট্রাক্সে পোস্টিং ইচ্ছে করেই নিয়েছিলেন। নাম জামালউদ্দিন। ফোন নম্বরটিও আমাকে দিয়েছিলেন। খুঁজে খুঁজে সেটি বেরও করলাম। কিন্তু অত রাতে তাঁকে ফোন করতে আমার সংকোচ হচ্ছিল। সম্পূর্ণ ধারণার ওপর নির্ভর করে একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে অনুরোধ করা ঠিক হবে কি না ভাবছিলাম; এবং মনে দ্বিধা রেখেই ফোন করলাম। তিনি আমার কথা শুনেই বললেন, ‘ম্যাডাম, ওই এলাকায় ক-দিন ধরে গণ্ডগোল হচ্ছে, আমি এক্ষুনি দেখছি! যোগাযোগটা ভালো আছে, অন্য এলাকায় হলে নৌযান কিংবা হেলিকম্পার লাগত, জর্দানপাড়ায় যেতে তা লাগবে না, কাজেই আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা নিচ্ছি!’ আমি সুপার সাহেবকে লোকেশনের একটা ইমেজ মেইল করে পাঠিয়ে দিলাম। ঘণ্টা দুই পরে তিনি নিজেই আমাকে ফোন করে যা জানালেন, তাতে আমি শুধু চমকে উঠলাম না, আমার সমস্ত জ্ঞানের সীমা ভয়ানকভাবে কম্পিত হতে লাগল।”
এ পর্যন্ত বলে জেনিদি ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেল। আমি একটা পাকা সবেদা ভেঙে তার দিকে বাড়িয়ে ধরলেও নিল না। ইঙ্গিতে রেখে দিতে বলল, পরে খাবে।
“পুলিশ সুপার ফোন করে বিস্তারিত বললেন। আমার ফোন রেখেই তিনি ফায়ার সার্ভিস আর বান্দরবন সদর থানার ওসি-কে কল করে দলবল নিয়ে বের হতে বললেন। তিনি নিজেও বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। এসপি বাংলোর সামনে তাঁর জিপ আর ফোর্স প্রস্তুত। জিপে উঠতে যাবেন, এমন সময় হেডলাইটের আলোয় লক্ষ করলেন, বাংলোর পথের দু-পাশে ঘাস-পাতার মধ্যে বড়ো বড়ো সব পাহাড়ি ইঁদুর উঁকি দিচ্ছে। গাড়ির শব্দ শুনেই তারা সব ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে রাস্তায় উঠে আগে আগে ছুটতে লাগল। তাদের চেহারায় শশব্যস্ত অবস্থা। ইঁদুরগুলো সংখ্যায় শ-খানেক হবে। তাদের কেউ কেউ ছুটতে ছুটতে পিছন ফিরে তাকিয়ে মুখ খিঁচিয়ে কী যেন বলছে, আবার ছুটছে। মূল রাস্তা ধরে কিছু দূর চলার পর একটা বাঁক ঘুরতে হয়। ইঁদুরগুলো ঠিক সেই বাঁকের কাছে দাঁড়িয়ে জিপের দিকে ফিরে মুখ উঁচু করে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করছে! তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাঁক ঘুরে জিপটির যে পথে যাওয়ার কথা, সেই পথে নামার জন্য ঝুল কাটছে। এসপি সাহেবের মনে হল, এই ইঁদুরগুলো তাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। ড্রাইভার এবং ফোর্স ইঁদুরগুলোর এই কাণ্ড দেখে তো অবাক! পথের সেই বাঁক ঘুরে এসপি সাহেবের জিপটি জর্দানপাড়ার পথে নামতেই ইঁদুরগুলোর চেহারায় স্বস্তিভাব ফুটে উঠল। তারা আবার ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে আগে আগে ছুটতে লাগল। পথিমধ্যে থানার আর্মড ফোর্স এবং ফায়ার সার্ভিস টিমের দেখা পেলেন এসপি সাহেব। জর্দানপাড়ায় ঢুকে ইঁদুরের দেখানো পথেই চলতে লাগলেন তাঁরা। পাহাড়ি জঙ্গলের কাছাকাছি আসতেই গাড়ি থামিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকলেন জঙ্গলের পথে। পথ বলতে কিছু নেই, আগান-বাগান, ছোটো ছোটো খাদ ইত্যাদিতে ভরা। চলতি পথে কোথাও দাঁড়িয়ে পড়লে, সঙ্গে সঙ্গে ইঁদুরগুলোও ছুট থামিয়ে পিছন ফিরে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে। আবার চলতে লাগলে তারাও ক্যাঁচ ক্যাঁচ থামিয়ে এগোতে থাকে। খানিক দূর এগিয়েই প্রগাঢ় অন্ধকারময় জঙ্গলের দেখা মিলল। সার্চলাইটের আলোয় এসপি সাহেব দেখলেন, আমার ছবিতে যেমন একটা উঁচু গাছ দেখা যায়, সামনের জঙ্গলের মাথা ফুঁড়ে ঠিক তেমন একটা গাছ দেখা যাচ্ছে, ইঁদুরগুলোও ওই গাছের গোড়ার দিকে যাচ্ছে। এখানে তিনি অ্যাকশন নিলেন। ফোর্স দিয়ে চারদিক ঘিরে ফেললেন, আর অন্য একটা টিম নিয়ে ইঁদুরগুলোর পথ ধরলেন। এর আগে অবশ্য তিনি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের কাউন্টার টেররিজ়্ম ইউনিটকে প্রস্তুত থাকতে অনুরোধ করেছিলেন। তারা হেলিকপ্টার থেকেও আক্রমণ চালাতে সক্ষম। কাছাকাছি আসতেই তিনি এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়লেন, আর ঠিক সেই সময় ঝুপঝাপ করে এদিক-ওদিক কারা যেন ছোটাছুটি করতে লাগল। চারদিকে ঘিরে-থাকা ফোর্স গুলি ছুড়ে তাদের কয়েকজনকে আটক করল। তারা সবাই কুকি নামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোক। ইঁদুরগুলো সেই গাছের গোড়ায় একটা খাদের পাশে দাঁড়িয়ে ভীষণ ক্যাঁচ ক্যাঁচ শুরু করে দিল, যেন তাদের কেউ এই খাদে পড়ে গেছে—উদ্ধার করতে হবে! কিন্তু খাদে জোলো মাটি ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। তবে এটা পরিষ্কার বোঝা গেল, কিছুক্ষণ আগেও এখানে জল ছিল। ধৃত কুকিরাও বেশ খানিকটা হতভম্ব হয়ে খাদের ভেতরে তাকিয়ে থাকল। ওদিকে ইঁদুরগুলো নাছোড়। তারা অনবরত ডেকেই যাচ্ছে। লাইটের জোরালো ফোকাস ফেলে তাই ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা ভালো করে খুঁজতে লাগল। হঠাৎ তারা দেখতে পেল, খাদের তলার এককোণে কিছু একটা নড়ছে! ফায়ার সার্ভিসের একজন লোক সাহস করে খাদে নেমে একটা সুড়ঙ্গপথের মুখ আবিষ্কার করল। ঘাস, পাতা-লতায় মুখটা আটকানো! হঠাৎ সেই ঘাস ঠেলে বের হল মানুষের একটা হাত! ফ্যাকাশে, গোটানো চামড়ার রক্তশূন্য একটা হাত দেখে লোকটা ভয়ে আঁতকে উঠল বটে, কিন্তু তার পরপরই সবাই নেমে তৎক্ষণাৎ মানুষটিকে উদ্ধার করল। যে মানুষটিকে উদ্ধার করা হল, তিনি আর কেউ নন, প্রফেসার হচপচ! ভীষণ জেরবার অবস্থা! হাঁপাচ্ছেন, কথা বলতে পারছেন না, এসপি সাহেব জানালেন, হাতে অ্যান্টেনা ধরনের কিছু একটা রয়েছে, ওটা কিছুতেই ছাড়ছেন না। তাঁরা দ্রুত তাঁকে বান্দরবন সদর হাসপাতালে ভরতি করালেন। অবস্থা এখন স্থিতিশীল।”
জেনিদি এ পর্যন্ত বলে আবার এক গ্লাস জল খেল।
“আমার ল্যাবরেটরি রুমে প্রফেসার হচপচের যন্ত্রে যে টেক্সট ভেসে উঠেছিল, আসলে সেটা ইঁদুরের ভাষা। হচপচ কয়েকটা পাহাড়ি ইঁদুরের মাথায় ডেটা কালেক্টর মেশিন স্থাপনের জন্য জর্দানপাড়ার ওই পাহাড়ি এলাকায় ঘোরাঘুরি করছিলেন। প্রায় তিনশো ইঁদুরের মাথায় তিনি কালেক্টর মেশিন লাগিয়ে ফেলেছিলেন। ইচ্ছে ছিল, অন্তত চারশো ইঁদুরের মাথায় মেশিন লাগাবেন। এর মধ্যে ওখানের ‘কুকি’ নামের ক্ষুদ্র এক নৃগোষ্ঠীর একদল নিপীড়িত মানুষ আরেকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কতিপয় মানুষের ফাঁদে পড়ল। সেই আরেকটি নৃগোষ্ঠী নতুন একটা ধর্মের গোড়াপত্তন করেছে সবে, তাদের ইচ্ছে, কুকিদের এই বাপে-খ্যাদানো মায়ে-খ্যাদানো লোকগুলোকে তাদের নতুন ধর্মের অনুসারী বানাবে। তারা কুকিদের ভালো ভালো খেতে দিয়ে বোঝাল যে, ভিন্ন গোষ্ঠীর পাঁচজন মানুষকে জলে ডুবিয়ে মারতে হবে। কারণ, ভিন্ন গোষ্ঠীর লোক নাকি শয়তান; আর কমপক্ষে পাঁচজন শয়তান মারলেই কেবল ঈশ্বর সহায় হবেন। নতুন ধর্মের ঈশ্বরের নাকি এমনই ইঙ্গিত তারা বুঝতে পেরেছে। কুকিরা অবশ্য চারজনকে মেরে ফেলেছিল। পঞ্চম মানুষটিকে তারা খুঁজছিল। ঠিক সেই সময় প্রফেসার হচপচের দেখা পেল। একা একা পাগলের মতো পাহাড়ের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মোক্ষম সুযোগ! এমনিতেই হচপচ বৃদ্ধ, দুর্বল শরীরের লোক। খুব সহজেই তারা তাকে পাঁজাকোলা করে ধরে ওই খাদের গর্তে ফেলে জল ঢেলে দিল। কিন্তু হচপচ তো ইঁদুরদের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছেন, বলা যায়, একপ্রকার ইঁদুরদের উপকারই করছেন। পাহাড়ি ইঁদুর সম্ভবত অকৃতজ্ঞ নয়। হচপচ যেসব ইঁদুরের মাথায় মেশিন সেট করেছিলেন, তাদের একটা অংশ হচপচকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল! আরেকটা অংশ এসপি সাহেবকে ডাকতে গিয়েছিল!… প্রফেসার হচপচকে উদ্ধারের মেকানিজ়্মটা বেশ অদ্ভুত ছিল, হচপচ নিজেই সেটা এসপি সাহেবকে বলেছিলেন। অবশ্য এক্ষেত্রে হচপচের ভাগ্যও কিছুটা সুপ্রসন্ন ছিল। খাদের গর্তের তলায় সুড়ঙ্গপথের মুখ ছিল। পাথরের চাঁই পড়ে মুখটা আটকানো। পাহাড়ি মাটি—গাছের গুঁড়ি, শিকড়, পাথর, নানা ফসিল পচে মাটির ভেতরটা ফাঁপা। সুড়ঙ্গটা প্রায় পাঁচ ফুট ব্যাসের। খাদের ওই গর্তের তলা থেকে সেটা অল্প কিছু দূর গিয়ে মাটির গভীরেই ধসে তৈরি হওয়া পাতালমুখো আরেকটা বড়ো গর্তের কিনারে মিশেছে। ধর, জল ভরতি একটা ড্রাম, এই ড্রামটিই হল খাদের গর্ত, যেখানে হচপচকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এবার ড্রামের তলায় মোটা একটা নলের কথা চিন্তা কর; এই নলটিই হল সুড়ঙ্গ। ইঁদুরেরা এবার করল কী! উদ্ধার অভিযান চালানোর জন্য পরিবেশ করে নিল, মানে দাঁড়ানোর জায়গা, জলে যাতে না ডুবতে হয়, তেমন জায়গা বের করা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে নিল, এ বিষয়ে পরে সব আন্দাজ করতে পারবি! চারশো ইঁদুর তিন-চারটে দলে ভাগ হয়ে দ্রুত সুড়ঙ্গের মুখ থেকে পাথরটা আলগা করে দিল, অবশ্য এ সময় হচপচও চেষ্টা করেছিলেন। তুই এভাবে ভাবতে পারিস যে, ড্রামের তলায় নলের মুখে কাপড় গোঁজা ছিল, সেটা সরানো হল।… পাথর সরানোর সঙ্গে সঙ্গে জলের তোড় সুড়ঙ্গপথে ঢুকে গেল। সেই তোড়ে হচপচও সুড়ঙ্গে ঢুকে গেলেন। সব কিছু কিন্তু খুব দ্রুত ঘটছে, এই ধর বিশ সেকেন্ডের মধ্যে! হচপচের তখন প্রায় যায়-যায় অবস্থা!… সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকতেই হচপচ দম নিতে পারলেন, স্বস্তি পেলেন! সেটা আরেকটা আশ্চর্যের ব্যাপার! ইঁদুরেরা এ ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিল।… ট্র্যাকারের ছবিতে যে গাছটা দেখা গিয়েছিল, ওই সুড়ঙ্গপথের ওপরের মাটিতে ছিল গাছটি। সুড়ঙ্গের ওপরের দেওয়ালে শিকড়-টিকড়ও বেরিয়ে ছিল। ইঁদুরেরা গাছের তলা দিয়ে সরু একটা গর্ত খুঁড়ে সোজা নীচে সুড়ঙ্গের গায়ে জুড়ে দিয়েছিল। জোড়ার মুখটা একটু বেশি জায়গা নিয়ে করেছিল। হচপচ বসে থেকে তাঁর মাথাটাকে সেখানে রাখতে পেরেছিলেন, আলো-বাতাসও ঢুকছিল কিছুটা, জল ছিল না, খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু ওইভাবে ওই স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার মাটির গভীরে হচপচ বেশিক্ষণ থাকতেও পারতেন না, তার ওপরে এসব জায়গায় আবার মাটি ধসের ভয় থাকে। যা হোক, পরে বুঝতে পারলাম, হচপচকে উদ্ধারের সময় উদ্বিগ্ন ইঁদুরেরা নিজেদের মধ্যে যেসব কথাবার্তা বলেছিল, আমার ভাষায় হচপচের যন্ত্রে তা-ই শুনেছিলাম। এখন আমি ইঁদুরের ওই ভাষা বুঝতে পারছি! লেখা উঠেছিল: ‘তাড়াতাড়ি কাট, জোরে জোরে কাট, অটল বাড়ার আগে হামোলটা সরে যেতে পারবে’! আসলে ‘অটল’ মানে জল, আর ‘হামোল’ মানে মানুষ। তার পুরো অর্থ এরকম দাঁড়ায়: ‘তাড়াতাড়ি কাট, জোরে জোরে কাট, জল বাড়ার আগে মানুষটা সরে যেতে পারবে’। বুঝলাম, ইঁদুরেরা জলকে ‘অটল’, আর মানুষকে ‘হামোল’ বলে। ‘তাড়াতাড়ি কাট, জোরে জোরে কাট’ বলতে তারা দ্রুত ওপর-নীচ, মানে গাছের তলা থেকে মাটির গভীরে গর্ত খুঁড়ে হচপচকে শ্বাসপ্রশ্বাসের সুবিধা করে দেওয়ার কথা বোঝাচ্ছে।”
জেনিদি কথা শেষ করে মোটা মোটা চোখে ভাবতে লাগল।
জেনিদিকে প্রশ্ন করলাম, “হচপচকে জ্যান্ত উদ্ধারের পর ওই যন্ত্রে কিছু দেখলে?”
জেনিদি পাকা সবেদাগুলোর ওপর এক পাক চোখ বুলিয়ে বলল, “দেখলাম, লেখা উঠেছে: ‘হিহিহি, হামোলটা খুব ভালো’।”
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী
