ফেক
লেখক: সন্দীপ চৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ক্যাব থেকে নেমে গুগ্ল ম্যাপ চেক করল ম্যারিয়ম। এই জায়গাটাই। কিন্তু এখানে কোনো ফ্ল্যাটের চিহ্ন নেই। ডান হাত তুলে সূর্যের আলো থেকে নিজের চোখ আড়াল করে চারপাশে তাকিয়ে দেখল ম্যারিয়ম। শুধু এখানেই কেন, এখান থেকে শ-দুয়েক মিটার, অর্থাৎ যতটা ম্যারিয়ম দেখতে পাচ্ছে, তার মধ্যেও বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট তো দূরের কথা, দুটো মানুষ থাকার মতো ছোটোখাটো ফ্ল্যাটও নেই। থাকার মধ্যে রয়েছে দুটো খাবারের জায়গা, একটা গারাজ, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু দোকান, এবং কয়েকটি পরিত্যক্ত একতলা বাড়ি। অথচ এই জায়গাটার নাম নাকি ম্যাগনোলিয়া ভ্যালি। ম্যারিয়ম নিশ্চিত, এখানে সে একটা ঘাসফুলও খুঁজে পাবে না। একই নামের আরও জায়গা থাকতে পারে একটা শহরে?
হর্নের শব্দ শুনে পিছন ফিরে চাইল ম্যারিয়ম। তার ক্যাবের ড্রাইভার জানালা দিয়ে হাত বের করে ইশারা করছে। জানতে চাইছে, আর কতক্ষণ? অর্থাৎ, এখন ওরও তাড়া রয়েছে। অথচ এয়ারপোর্টে গাড়ির মধ্যে বসে লোকটা ঘুমোচ্ছিল। ম্যারিয়ম ওকে না ওঠালে আজকে সন্ধে অব্দি সম্ভবত ঘুমিয়েই কাটত ওর।
ড্রাইভারকে হাত দেখাল ম্যারিয়ম। বিড়বিড় করে বলল, কিছুক্ষণ দাঁড়াও, যা এক্সট্রা লাগে, দেব। শুনতে না পেলেও এই ধরনের শারীরিক ভাষা দেখা এবং তার অর্থ বোঝার অভিজ্ঞতা আছে ড্রাইভারের। সে গাড়িটাকে রাস্তার একপাশে সাইড করল। তারপর নিজের মাথার পিছনে দু-হাত তুলে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসল।
নিজের হাতের ফোনের দিকে চাইল ম্যারিয়ম। শেষ অব্দি ফোনই করতে হবে হ্যারিকে? তাহলে আর সারপ্রাইজ় বলে কিছু থাকবে না। সে ভেবেছিল, হ্যারির সামনে উপস্থিত হয়ে ওকে চমকে দেবে। কিন্তু এখন ফোন করা ছাড়া উপায়ই-বা কী?
হ্যারির কাছে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া অব্দি কতরকম দৃশ্যের কল্পনা করে এসেছে ম্যারিয়ম। ওকে দেখে হ্যারির প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, সেটা চিন্তা করেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে বারবার। এখন ও হ্যারিকে ফোন করলে পুরো মজাটাই মাটি। ওর কপালটাই এমনি—যতটা খারাপ কল্পনা করা সম্ভব, তার চেয়েও খারাপ কিছু ঘটে তার জীবনে।
নিজেকে সামলাল ম্যারিয়ম। এসব ও কী ভাবছে? সারপ্রাইজ় দেওয়া না হলে না হবে, সে হ্যারির হাসিমুখ নিজের সামনে দেখতে পাবে, তার মাথায় হাত বোলাবে, অনেক রাত অব্দি তার সঙ্গে পুরোনো দিনের কথা বলবে—এরপর আর তার অভিযোগ কীসের? সে আগে এরকম ছিল না। বয়স যত বাড়ছে, তত সিনিক্যাল হয়ে উঠছে সে।
ধীর পদক্ষেপে রাস্তার একপাশে গিয়ে দাঁড়াল ম্যারিয়ম। তারপর হ্যারিকে ডায়াল করল। দ্বিতীয়বার রিং হতেই ফোন ধরল হ্যারি।
‘মম, কী ব্যাপার? আজকে এতটা ভোরে?’
‘তুই কোথায়?’
‘কেন, বাড়িতে?’
কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না ম্যারিয়ম। ওপাশ থেকে হ্যারি বার দুয়েক ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’ করল।
‘আমি এখানে এসেছি, হ্যারি। কিন্তু তোর বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না। তুই এসে নিয়ে যা আমাকে।’
ওপাশ থেকে কয়েক মুহূর্ত কোনো শব্দ শোনা গেল না এরপর। কল ড্রপ হল নাকি—ঠিক যখন এই সন্দেহটা ম্যারিয়মের মনে উদয় হতে যাচ্ছিল, তখন আবার হ্যারির স্বর শোনা গেল, ‘এখানে মানে?’
‘তোর শহর ক্যালিফোর্নিয়ায় এসেছি। আমি এখন ম্যাগনোলিয়া ভ্যালির সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তোর বাড়ি কোথায়? তুই এসে নিয়ে যা আমাকে।’ কেন বুঝতে পারছে না ম্যারিয়ম, কিন্তু তার স্বর ভারী হয়ে আসছে। এবার কি চোখে জল আসবে নাকি? কিন্তু কান্না পাওয়ার মতো তো কিছু হয়নি।
নিজেকে সামলাতে কয়েক মুহূর্ত নিল ম্যারিয়ম। যখন সংবিৎ ফিরে পেল, তখন বুঝল যে, তার হাতের ফোন ইতিমধ্যে ডেড হয়ে গেছে। কেটে গেল? নাকি হ্যারি ফোন কেটে দিল? অবশ্য ম্যারিয়মকে নেওয়ার জন্যে এখানে আসতে হলে ওকে ফোন কাটতেই হবে। নিশ্চয়ই তা-ই। ওকে নিতে আসছে হ্যারি। আসুক। যত তাড়াতাড়ি পারে, ও আসুক। আর এক মুহূর্ত এখানে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না ম্যারিয়মের। নানান দুশ্চিন্তা উঠছে তার মনে।
কেন কে জানে, পিছন ফিরে ক্যাবের ড্রাইভারটার দিকে চাইল ম্যারিয়ম। লোকটা একদৃষ্টিতে ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে। ভ্রূ সামান্য কোঁচকানো। ও কি ম্যারিয়মের দিকে ওভাবে চেয়ে রয়েছে নাকি অন্যমনস্ক হয়ে কিছু চিন্তা করছে?
নিজের চোখ ফিরিয়ে নিল ম্যারিয়ম। কোথায় আছে হ্যারি? এখনও আসছে না কেন? প্রায় বারো বছর পর ম্যারিয়ম নিজের ছেলেকে চাক্ষুষ দেখবে বলে জীবনের সঞ্চয়ের একটা বড়োসড়ো অংশ ব্যয় করে আজ এখানে এসেছে। কিন্তু বারো বছরের সেই প্রতীক্ষা তার এতটা অসহ্য মনে হয়নি। আর এক মুহূর্ত দেরি সহ্য হচ্ছে না তার।
হ্যারিকে আবার ফোন করতে যাচ্ছিল ম্যারিয়ম, কিন্তু তার আগেই তার ফোনটা বেজে উঠল। নিশ্চয়ই হ্যারি। অন্য কোথাও খুঁজছে তাকে। মোবাইল স্ক্রিনে কার নাম্বার, সেটা দেখার অব্দি ধৈর্য নেই এখন ম্যারিয়মের। সে তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরল।
‘হ্যালো, আপনি ম্যারিয়ম ডেভিস বলছেন?’ একটা স্ত্রীকণ্ঠ ভেসে এল।
অস্ফুট গলায় ম্যারিয়ম ‘হ্যাঁ’ বলল। এটুকু বলতেও তার গলা কেঁপে উঠল।
‘আপনি যেখানে আছেন, সেখানেই অপেক্ষা করুন। আমার বড়োজোর সাত থেকে আট মিনিট লাগবে ওখানে পৌঁছোতে। প্লিজ়, ওখান থেকে নড়বেন না।’ এতটা বলে ম্যারিয়মের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোন কেটে দিল মেয়েটি।
হ্যারির জায়গায় তাহলে এই মেয়েটি আসছে ওকে নিতে? হ্যারি সম্ভবত কোনো কাজে ব্যস্ত রয়েছে তাই মেয়েটিকে পাঠাচ্ছে, নিজেকে বোঝাল ম্যারিয়ম। কিন্তু মেয়েটি কে? কিছুদিন আগে অব্দি হেমলতা নামের ভারতীয় মেয়ের সঙ্গে ও থাকত। কিন্তু সেই সম্পর্ক ভেঙে গেছে মাস দুয়েক আগে। এখন তো হ্যারি একাই থাকে। মেয়েটা অবশ্য হ্যারির প্রতিবেশী বা বন্ধুও হতে পারে। অথবা হয়তো কাজ করে ওর বাড়িতে।
কিন্তু ম্যারিয়মের মন শান্ত হল না। হ্যারির ফোন কেটে দেওয়া এবং তার পরপরই একটি অপরিচিত মেয়ের ফোন—সব কিছু স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না তার। সে কি হ্যারিকে না জানিয়ে হুট করে চলে এসে ভুল করেছে?
হে ঈশ্বর! সব কিছু যেন ঠিক থাকে। ওর মনের আশঙ্কা যেন অমূলক প্রমাণিত হয়।
কিন্তু আশঙ্কাটা কী? কোনো মা-ই সম্ভবত নিজের ছেলের সম্বন্ধে তার যা যা আশঙ্কা রয়েছে, সেটা শব্দে প্রকাশ করতে পারে না। চায় তো না-ই। ওগুলো অবচেতেনেই থাক, খুঁড়ে বের করতে চায় না ম্যারিয়ম।
হে ঈশ্বর! সবার ওপর করুণা করো। সবাই যেন ভালো থাকে। বিড়বিড় করে এই প্রার্থনা করতে থাকে ম্যারিয়ম।
একটা ক্যাব উলটোদিক থেকে এসে রাস্তার ওপাশে থামল। পিছনের জানালা থেকে একটা মেয়ের মাথা উঁকি দিল, ‘মিসেস ডেভিস?’
মাথা নাড়ল ম্যারিয়ম। মেয়েটার বয়স বেশ কম—বড়োজোর বাইশ-তেইশ বছর হবে। মাথায় একমাথা কোঁকড়ানো চুল। মুখশ্রী সাদামাটা। মেয়েটা ক্যাব থেকে নামল। বাহ্, বেশ লম্বা তো মেয়েটি!
ম্যারিয়মের সামনে এসে মাথা ঝাঁকাল মেয়েটি, ‘হাই! আমি এলিজা। আপনি প্লিজ় আমার সঙ্গে চলুন।’
‘কোথায়?’
‘আপাতত একটা অফিসে গিয়ে কিছুক্ষণ বসব। তারপর…’ কথাটা যেন ইচ্ছে করেই শেষ করল না মেয়েটি।
‘কিন্তু হ্যারি… মানে হ্যারিয়ট কোথায়? আমি ওর কাছে যাব। তা ছাড়া, তুমি কে? আমি তোমার সঙ্গে যাব কেন?’
অপ্রস্তুতের হাসি হাসল এলিজা, ‘ব্যাপারটা একটু জটিল, তাই আমাদের একটা নির্জন জায়গায় বসা প্রয়োজন। আপনি পরিশ্রান্ত, সম্ভবত উদ্বিগ্নও। এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আপনার মনে যেসব প্রশ্ন উঠছে, তার কোনোটারই উত্তর পাবেন না। প্লিজ়, আমার সঙ্গে চলুন।’
এবার ধৈর্য ভাঙল ম্যারিয়মের, ‘মেয়ে, আমি ছয় হাজার কিলোমিটার দূর থেকে জীবনের সব সঞ্চয় খরচ করে নিজের ছেলেকে দেখতে এসেছি। কিন্তু আসার পর থেকে একের পর এক এমন ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অথচ গতকাল রাত্রেই আমি ওর সঙ্গে ভিডিয়ো কলে…’
ম্যারিয়মকে কাঁদতে দেখে দু-পা এগিয়ে এল এলিজা। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল। সে জানে, একটু পর ভদ্রমহিলা শান্ত হবেন। তারপর ও যেখানে যেতে বলবে, ওর সঙ্গে যাবেন। এ ছাড়া ওঁর কাছে কোনো উপায় নেই।
ম্যারিয়ম একটু শান্ত হলে তার কাঁধে আলতো করে স্পর্শ করল এলিজা, ‘ম্যা’ম, ওটা সম্ভবত আপনার ক্যাব। আপাতত ওটাকে ছেড়ে দিন। প্রয়োজন পড়লে আবার ডেকে নেবেন, ক্যাবের অভাব নেই এখানে। আপনার সঙ্গে লাগেজ রয়েছে নিশ্চয়ই? চলুন, নামিয়ে নিয়ে আসি।’
উত্তর না দিয়ে এলিজার পিছনে পিছনে এল ম্যারিয়ম। তারপর ক্যাবের ভাঁড়া মিটিয়ে দিয়ে এলিজার সামনে এসে দাঁড়াল। এখন মেয়েটাকে প্রশ্ন করতেও তার ভয় করছে, কারণ সে জানে না, কোন সত্য অপেক্ষা করছে তার জন্যে। কিন্তু সত্য থেকে পালিয়েও বা সে যাবে কোথায়?
এলিজা ম্যারিয়মের হাত থেকে ব্যাগ দুটো নিয়ে তার ক্যাবের ডিকিতে রাখল। তারপর গাড়ির গেট খুলে ম্যারিয়মকে তার ভেতরে বসিয়ে সে নিজেও বসল। কোনো প্রশ্ন না করে গাড়ি স্টার্ট করল ড্রাইভার। আনমনে বাইরের দিকে চেয়ে রইল ম্যারিয়ম সারা রাস্তা জুড়ে। হ্যারির চিন্তা তো আছেই, তার মনে এখন আরও একটা চিন্তা দানা বেঁধেছে—সে এবার কোথায় থাকবে? তার মাত্র হাজার দেড়েক ডলার সম্বল, যা দিয়ে ফেরার টিকিটও কাটতে পারবে না ও। হোটেলেও থাকতে গেলে বড়োজোর এক সপ্তাহ টিকবে টাকাটা। তারপর সে কী করবে?
কিছু স্মৃতি ভিড় করল তার মনে। যখনই সে হ্যারির কাছে আসার প্রসঙ্গ তুলেছে, হ্যারি সেটা এড়িয়ে গেছে। কখনও খরচের কথা বলেছে, কখনও-বা আবহাওয়ার অনিশ্চয়তার প্রসঙ্গ তুলেছে। ও কি এমন কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত, যার জন্যে সে প্রকাশ্যে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারছে না? কী ধরনের কাজ? কিন্তু আজকেও তো ওর ফোন ধরেছে হ্যারি। ওটা যে ওরই কণ্ঠস্বর ছিল, তাতে কোনোরকম সন্দেহ নেই ম্যারিয়মের। তাহলে?
কিচ্ছু বুঝতে পারছে না ম্যারিয়ম। শুধু এটুকু সে বুঝেছে যে, কোথাও একটা বড়োসড়ো গণ্ডগোল রয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর একটা ছোট্ট বাংলো বাড়ির সামনে দাঁড়াল গাড়িটা। চারপাশে তাকিয়ে ম্যারিয়ম বুঝল বেশ সম্ভ্রান্ত এলাকা এটা। প্রশস্ত পথের পাশে ছোটো ছোটো প্লটে স্বাধীন বাড়ি। কয়েকটায় বেশ সুন্দর সুন্দর বাগান রয়েছে। আবার তার বুকে আশা দানা বাঁধতে লাগল। এইখানে থাকে নাকি হ্যারি? তাহলে তো বেশ ভালো জায়গাতেই আছে ও।
‘কাম ম্যা’ম!’ গাড়ির গেট খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে এলিজা। ম্যারিয়ম নামল। এলিজা বাঁ হাত বাড়িয়ে সামনে বাড়িটার দরজার দিকে ইঙ্গিত করল। ম্যারিয়ম পিছন ফিরে যে গাড়িটায় তারা এসেছে, সেটার দিকে তাকাল।
এলিজা বুঝতে পেরে বলল, ‘আপাতত আপনার জিনিসপত্র গাড়িতেই থাক।’
এলিজার পিছন পিছন বাড়িটার দিকে পা বাড়াল ম্যারিয়ম। বাড়িটায় ঢোকার পর একটা ছোটো রুমের মধ্যে তাকে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে ঢুকে গেল এলিজা।
রুমটায় তিনটে মাঝারি সাইজ়ের সোফা সাজানো রয়েছে। টেবিলের ওপর কয়েকটা ম্যাগাজ়িন গুছিয়ে রাখা। সুস্বাস্থ্য কীভাবে বজায় রাখতে হয়, তার বিষয়ে ম্যাগাজ়িন। রুমের এককোনায় জল বিতরণের মেশিন রাখা রয়েছে। জানালা-দরজার সামনে মেরুন রঙের পর্দা। দেওয়াল জুড়ে একটা বরফ-ঢাকা পাহাড়ের ছবি।
সোফায় বসে হ্যারিকে ফোন করার চেষ্টা করল ম্যারিয়ম। আউট অব রিচের বার্তা শোনা গেল অন্য প্রান্ত থেকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ম্যারিয়ম। একটু আগে তার মনে যে আশা জেগেছিল, সেটা এখন আর নেই। নিজের নিশ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দিল ম্যারিয়ম। এতে উদ্বিগ্নতা কমে, মন নিয়ন্ত্রিত হয়।
অপেক্ষা করতে করতে তার মনে হল, এই ধরনের অনুভূতির সম্মুখীন সে এর আগেও হয়েছে। তার স্তনের অপারেশনের পর সে যখন বায়োপ্সি রিপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করছিল, সেই সময়। তার টিউমারে সেদিন মারাত্মক কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেন জানি, এই স্মৃতি আশ্বস্ত করল ম্যারিয়মকে।
‘প্লিজ় কাম!’
এলিজার গলার স্বরে চমকে উঠল ম্যারিয়ম। সে বুঝতে পারল, তার চোখ লেগে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্যে। অপ্রস্তুত হয়ে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর এলিজাকে অনুসরণ করে ভেতরে একটা কামরার মধ্যে ঢুকল।
‘বসুন।’
এই কামরাটায় আলো বেশ কম বলে ম্যারিয়মের চোখ অভ্যস্ত হতে কিছুক্ষণ সময় নিল। তারপর ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে সে একটা টেবিলের সামনে রাখা দুটো চেয়ারের মধ্যে একটা দখল করল। অন্যটায় এলিজা বসল।
টেবিলের অপর প্রান্তে এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা বসে রয়েছেন। ভদ্রমহিলার মুখে হাসি ছড়ানো থাকলেও তার মধ্যে কোনোরকম উষ্ণতা নেই। ম্যারিয়মের সারা শরীর শিরশির করে উঠল। এখানে তার এক মুহূর্তের জন্যেও থাকতে ইচ্ছে করছে।
‘ইনিই হ্যারিয়টের মা, মিসেস ম্যারিয়ম ডেভিস।’ মৃদুস্বরে এলিজা বলল।
ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন। তারপর কিছু না বলে চেয়ে রইলেন ম্যারিয়মের চোখের দিকে। দমবন্ধ হয়ে আসছে ম্যারিয়মের। আর থাকতে না পেরে সে বলে উঠল, ‘আমি হ্যারিয়টের সঙ্গে দেখা করতে চাই। প্লিজ়, আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন।’
‘আপনি ভাগ্যবান যে আপনি হ্যারিয়টের মা, মিসেস ডেভিস। ওর মতো ছেলে যদি আমার হত তাহলে আমি অত্যন্ত গর্ব অনুভব করতাম।’
কোনো কথা বেরোল না ম্যারিয়মের মুখ থেকে। সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ভদ্রমহিলার মুখের দিকে। ভদ্রমহিলার চোখে সে খুঁজতে চাইল ভরসার চিহ্ন। খুঁজে পেল না ম্যারিয়ম। সে অনুভব করল, সে নিশ্বাস নিতে পারছে না।
‘কিন্তু আপনি এখানে না এলেই ভালো হত। হ্যারিয়টের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক তো বজায় ছিলই, তা-ই না? প্রায় রোজই আপনারা কথা বলতেন, একে অপরকে দেখতে পেতেন। সেটা কি যথেষ্ট ছিল না?’
যথেষ্ট? এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ম্যারিয়ম? মা-ছেলের মধ্যে সম্পর্কে কতটা অব্দি স্বাভাবিক, কোথায় গিয়ে সীমা অতিক্রান্ত হয়, তার হিসেব তাকে কে শেখাবে?
ম্যারিয়ম কোনোরকমে বলল, ‘আমি তো ওর মা।’
ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন। এখন আর তার মুখে হাসি নেই। বরং তার জায়গায় বিষণ্ণতা উঁকি মারছে তার চোখ দিয়ে। বিষণ্ণতা এবং ক্লান্তি। নাকি ম্যারিয়ম নিজের অনুভূতির ছায়া দেখতে পাচ্ছে তার চোখে?
‘হ্যারিয়ট আমাদের কাছে আসে প্রায় এগারো বছর আগে, তা-ই না এলিজা?’ এলিজার সম্মতিসূচক মাথা নড়ানো দেখে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তার হাতে বেশি সময় ছিল না। কিছুদিন আগেই সম্ভবত ডিভোর্স হয়েছিল ওর। কোনো সন্তানও ছিল না। এই দুটোই ওর পরিস্থিতিতে ঈশ্বরের লুকোনো আশীর্বাদ বলা যেতে পারে। ওর একমাত্র চিন্তা ছিল নিজের মা-কে নিয়ে। অর্থাৎ আপনাকে নিয়ে।’
এগারো বছর আগের ঘটনা জেনে কী করবে ম্যারিয়ম? তখন হ্যারির ডিভোর্স হয়েছিল, তা সে জানে, কিন্তু পরবর্তীকালে সে ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠেছিল। ডিভোর্সের পর বেশ কয়েকটি সম্পর্কে জড়িয়েছিল হ্যারি, যদিও কোনোটাই শেষ পর্যন্ত বিয়ে অব্দি গড়ায়নি।
‘তার চিন্তা ছিল, তার অবর্তমানে আপনি কীভাবে বাঁচবেন…’
‘আপনি কী উলটো-পালটা বলছেন তখন থেকে?’ টেবিলের ওপর ভর দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে এল ম্যারিয়ম, ‘হ্যারির অবর্তমানে মানে? কিছুক্ষণ আগেও ওর সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। দিন দুই আগে ভিডিয়ো কলে একে অপরকে দেখেছি আমরা। সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছে ও। আমি জানি না আপনাদের উদ্দেশ্য কী। বিশ্বাস করুন, আমার কাছে প্রায় কোনো টাকাই নেই। কিন্তু যা-ও বা আছে, তার সব কিছু আপনারা নিয়ে আমাকে আমার হ্যারির কাছে পৌঁছে দিন। এমনকি গাড়িতে যে ব্যাগ রাখা রয়েছে, তাও আমার চাই না। প্লিজ়, আমি আপনাদের কাছে ভিক্ষা চাইছি—আমাকে আমার ছেলের কাছে…’
এতটা বলে ভেঙে পড়ল ম্যারিয়ম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল দু-হাতের চেটোয় নিজের মুখ ঢেকে। হা ঈশ্বর! এ কোন দুঃস্বপ্নের মধ্যে তুমি আমাকে এনে ফেললে?
দুজন মহিলার মধ্যে কেউই কোনো কথা বলল না কিছুক্ষণ। তারা অপেক্ষা করতে লাগল ম্যারিয়মের প্রকৃতিস্থ হওয়ার। এই ধরনের ক্লায়েন্টের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের এই প্রথম। তাই এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে কী করতে হয়, সেই বিষয়ে কোনো রুল বুক নেই তাদের। তবে ভদ্রমহিলাকে কিছুটা সময় দিতে হবে—এটুকু বুঝতে পারছে।
কিছুক্ষণ পর ম্যারিয়মের ফোঁপানি থামলে ওর পিঠে আলতো করে হাত রাখল এলিজা। তারপর আবার অপেক্ষা করতে লাগল। অল্প সময় পর মাথা তুলল ম্যারিয়ম। এলিজার মনে হল, এই মহিলাকে সে এর আগে দেখেনি। কয়েক মুহূর্ত আগে যে ম্যারিয়মকে সে দেখেছিল, তার সঙ্গে এই মহিলার কোনোরকম মিল নেই। আচমকা ওর বয়স বেড়ে গেছে বেশ কয়েক বছর। হয়ে উঠেছে রুগ্ণও। একটু আগে ওর চোখে যে ভয়, যে উদ্বেগ, যে আশা দেখা যাচ্ছিল, এখন তার জায়গায় দু-চোখ জুড়ে হতাশা এবং ক্লান্তি। যেন দু-চোখের পিছনের আলোর সুইচ কেউ অফ করে নিবিয়ে দিয়েছে।
সামনে বসে-থাকা ভদ্রমহিলার দিকে চেয়ে রইল ম্যারিয়ম। সে এখন সত্যের জন্যে তৈরি। দেখা যাক, জিশু তাকে শেষজীবনে কোন পরীক্ষার মধ্যে ফেলতে চাইছেন?
ভদ্রমহিলা পুনরারম্ভ করলেন, ‘হ্যারিয়ট আমাদের কাছে যেদিন এসেছিল, তার আগের দিনই ডাক্তার তাকে জবাব দিয়ে দিয়েছিল। আমার সঙ্গেই তার কথা হয়েছিল। অত্যন্ত সুপুরুষ ছিল হ্যারিয়ট। ওকে দেখে কল্পনা করতেও কষ্ট হচ্ছিল যে, সে তার শরীরে প্রাণঘাতী রোগ বয়ে বেড়াচ্ছে। ওকে এখানে দেখে আমরা কিছুটা আশ্চর্যই হয়েছিলাম, কারণ আমাদের ক্লায়েন্টরা সাধারণত আমাদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে আসে না, ফোনের মাধ্যমেই যা আলাপ-আলোচনা হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে ভিডিয়ো কল। কিন্তু সে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চায় বলে জানিয়েছিল। তার জন্যে অতিরিক্ত ফি-ও নিয়েছিলাম আমরা।
প্রাথমিক আলাপ পর্ব মিটে যাওয়ার পর সে নিজের অসুখের কথা জানিয়েছিল আমাকে। বেশ জটিল ধরনের ব্লাড ক্যানসার, ডাক্তার ওকে ছয় থেকে নয় মাস সময় দিয়েছে।’ এতটা বলে ভদ্রমহিলা থামলেন। ম্যারিয়মের প্রতিক্রিয়ার জন্যে অপেক্ষা করলেন কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু ম্যারিয়মের মধ্যে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
‘হ্যারিয়ট বলেছিল, সে মানসিকভাবে নিজের মৃত্যুর জন্যে তৈরি। তার একমাত্র চিন্তা তার মা। সে জানিয়েছিল, ও ছাড়া আপনার আর কেউ নেই। ও চলে গেলে আপনি বেঁচে থাকতে পারবেন না। তাই ওকে বাঁচতে হবে। যে-কোনো উপায়ে বাঁচতে হবে।’
সামান্য চঞ্চল হল ম্যারিয়মের দু-চোখের মণি। মানুষ তার ইচ্ছাশক্তির জোরে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। ক্যানসার এবং অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে ডাক্তারকে ভুল প্রমাণ করে বেঁচে থাকার নজির প্রচুর রয়েছে।
‘আপনি হয়তো ভাবছেন, ও এত জায়গা থাকতে আমাদের কাছে কেন এসেছিল। এবার আমাদের কাজ সম্বন্ধে কিছুটা আভাস দিই আপনাকে। আমরা মূলত প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের নানান সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করি। আমাদের বিশেষ দক্ষতা কৃত্রিম সঙ্গী সৃষ্টি করায়। যদিও নামটার সঙ্গে আমরা একমত নই, কিন্তু মিডিয়াতে সেটা এই নামেই প্রচলিত বলে জিজ্ঞেস করছি—আপনি কি “ফেক বাডি”র বিষয়ে শুনেছেন? অথবা ভার্চুয়াল কম্প্যানিয়ন?’
মাথা নাড়ল ম্যারিয়ম। শুনেছে। এর অর্থ এমন একজন বন্ধু, যার বাস্তবিক কোনো অস্তিত্ব নেই, শুধুমাত্র কম্পিউটারে তৈরি কৃত্রিম জগতে রয়েছে। অথচ তার সঙ্গে আপনি অনলাইনে কথা বলতে পারেন, ভিডিয়ো চ্যাট করতে পারেন। নানান বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন, পরামর্শ চাইতে পারেন। প্রয়োজনে সে আপনাকে সান্ত্বনা বা সহানুভূতি জানাবে। আপনার চাহিদা, আপনার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই ভার্চুয়াল চরিত্রকে গড়ে তোলা হয়। অর্থাৎ সে এমন একটা মানুষ, যে রক্তমাংস দিয়ে গড়া নয়, তার উপস্থিতি শুধুমাত্র একজন মানুষের মনের জগতে।
সাধারণত কমবয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই ধরনের বন্ধুর চাহিদা বেশি। এমন বহু ছেলেমেয়ে রয়েছে, যাদের পৃথিবীতে কোনো মানুষ-বন্ধু নেই, আত্মীয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই। তারা এই ধরনের কৃত্রিম বন্ধুর সাহায্যে নিজের একাকিত্ব দূর করে।
ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন, ‘মোটামুটি সঠিক ধারণাই রয়েছে আপনার। হ্যারিয়ট চেয়েছিল আপনার জন্যে একটা ওইরকমই একটা ভার্চুয়াল সঙ্গী তৈরি করতে। সেই সঙ্গী হুবহু ওর মতো হবে। ওর কথাবার্তা, আচার-আচরণ এমন হবে, যাতে ওর সঙ্গে কথা বলার সময়, ওকে ভিডিয়োতে দেখার সময় আপনার মনে হয়, আপনি নিজের ছেলের সঙ্গে কথা বলছেন। এমনকি ওর আবেগও ও নিখুঁত অনুকরণ করতে পারবে। অর্থাৎ আমরা আপনার জন্যে কৃত্রিম হ্যারিয়ট সৃষ্টি করব, যে আসল হ্যারিয়টের অবর্তমানে আপনার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে।’
কৃত্রিম? ভদ্রমহিলার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে দেওয়ালে টাঙানো অয়েল পেন্টিংটার দিকে তাকাল ম্যারিয়ম। তার নিশ্চয়ই বুঝতে ভুল হচ্ছে কোথাও। সে বারবার মাথা ঝাঁকাতে লাগল। তার ছেলে ফেক নয়। তাদের সম্পর্ক ফেক নয়। সে নিজে ফেক মা নয়। ‘না না না’—এই একটা শব্দ বারবার তার মনের মধ্যে রিপিট হতে লাগল।
‘হ্যাঁ, মিসেস ডেভিস! প্রায় গত দশ বছর ধরে আপনি যাকে নিজের ছেলে বলে জেনে এসেছেন, সে আসলে আমাদের তৈরি একটা কৃত্রিম চরিত্র। আপনার ছেলে নিজের শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছে আজ থেকে দশ বছর চার মাস আগে। এই ফাইলে ওর ডেথ সার্টিফিকেট, ওর উইলের প্রতিলিপি এবং আমাদের সঙ্গে ওর এগ্রিমেন্টের কপি রয়েছে। আর্থিক দিক দিয়ে আপনার কোনোরকম অভাব যাতে না হয়, তার ব্যবস্থা করে গেছে আপনার ছেলে। ওর সমস্ত সম্পত্তি একটা ট্রাস্টের অধীনে রয়েছে। তারা ওর উইলে দেওয়া নির্দেশ মেনে সেই অর্থ ব্যয় করে। আমাদের সার্ভিসের ফি-ও প্রত্যেক মাসে ওদের কাছ থেকেই আসে। অবশ্য আর আমাদের সার্ভিসের প্রয়োজন নেই আপনার। আপনি ট্রাস্টের সঙ্গে এবার সরাসরি সম্পর্ক করতে পারেন, তার নাম্বারও এই ফাইলে পাবেন।’
টেবিলের ওপর রাখা ফাইলটা এতক্ষণ লক্ষ করেনি ম্যারিয়ম। এবার করল। যন্ত্রচালিতের মতো সেই ফাইল খুলে সে কয়েকটা পাতা ওলটাল। একটা ফর্মের ওপর হ্যারির ছবি দেখে সেই ছবির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ম্যারিয়ম।
হ্যারি নেই! দশ বছর ধরে নেই। এই কথাটা সে কীভাবে বিশ্বাস করবে? এই সেদিনও তারা দুজনে মিলে কত হেসেছে, গল্প করেছে, শেষে অভিমান করে ফোন রেখে দিয়েছে ম্যারিয়ম।
কিন্তু এবার সে কী করবে? কোথায় যাবে এখান থেকে?
এলিজার দিকে চেয়ে ছোট্ট করে নড করলেন ভদ্রমহিলা। কিছু না বলে ম্যারিয়মের পাশের চেয়ার ছেড়ে এলিজা উঠে গেল।
ম্যারিয়মের মস্তিষ্ক তার স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে লাগল। গত কয়েক বছরে হ্যারি ওর সঙ্গে কতবার ঝগড়া করেছে ছোটোবেলাকার ঘটনা টেনে। কতবার ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন রেখে দিয়েছে। নিজের কুকুর, নিজের বন্ধুর সঙ্গে ভিডিয়োতে আলাপ করিয়েছে। এই তো সেদিন ড্রাইভ করতে করতে কথা বলেছে ম্যারিয়মের সঙ্গে। ম্যারিয়ম আঁতকে উঠেছে ওর আচমকা ব্রেক কষার শব্দে।
এই সব কিছু ফেক? এতটা ফেক সম্ভব?
ম্লান হেসে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘হ্যারিয়ট আমাদের কাছে আসার পর প্রায় মাস ছয়েক মোটামুটি সুস্থ ছিল। এই সময়ে আপনাদের মধ্যে যা কথা হয়েছে, যা ভিডিয়ো কল হয়েছে, তার সবটাই আমাদের কাছে আছে। ইন ফ্যাক্ট, সে নিজেই আমাদের সেগুলো রেকর্ড করে দিয়েছে। সেই ভিত্তিতেই আমরা আমাদের প্রোগ্রাম এমনভাবে গড়ে তুলেছি, যাতে ওর অবর্তমানে আপনার মনে কিছুমাত্র সন্দেহ না জাগে। শুধু হ্যারিয়টই নয়, ওর বন্ধু, ওর বাড়ির প্রত্যেকটি অংশ, ওর ব্যালকনির গাছ, ওর কুকুর, বাউন্টি গার্ডেন, যেখানে ও মর্নিং ওয়াক করত—সব কিছুই আমাদের প্রোগ্রামের সৃষ্টি। আমি বারকয়েক আপনাদের কথোপকথন শুনেছি; সত্যি বলতে, আমারই বিশ্বাস করতে কষ্ট হত, আপনার সঙ্গে এমন একজন কথা বলছে, যার বাস্তবিক অস্তিত্ব নেই।
‘কিন্তু অন্যদিক দিয়ে দেখতে গেলে ব্যাপারটা অতটাও অসম্ভব নয়, যতটা আপনার মনে হচ্ছে। আজকাল এমন সিনেমা তৈরি হচ্ছে, যেখানে দর্শক একজন বা একাধিক চরিত্রের কাজকর্ম, স্বভাব, হাবভাব ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে, বাকি সিনেমাটা সেই চরিত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এআই প্রোগ্রামের ওপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে ধরে নিন, আপনি নিজে হচ্ছেন সেই চরিত্র। আপনাকে কেন্দ্র করে হ্যারিয়ট এবং তার আশপাশের জগৎ আমরা গড়ে তুলেছি, আপনার সঙ্গে আপনার ছেলের যা কথাবার্তা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই জগতে ক্রমাগত পরিমার্জন করে এসেছে।’
অসংখ্য স্মৃতির টুকরো ভিড় করল ম্যারিয়মের মনে—কয়েকটিতে শুধু দুজনের কথাবার্তার স্মৃতি, কয়েকটিতে কিছু বিচ্ছিন্ন দৃশ্যের স্মৃতি। সব সাজানো? দশ বছরের বেশি সময় ধরে সে এমন একটা সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বেঁচে রয়েছে, যার কোনো অস্তিত্ব নেই?
বহু বছর আগে মহাকাশবিজ্ঞানের ওপর লেখা বই পড়ে ম্যারিয়ম কল্পনা করত, সে মহাশূন্যে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার আশপাশে কোনো আলো নেই, কোনো শব্দ নেই, কোনো কিছু তার শরীরকে স্পর্শ করে নেই। এই পরিস্থিতিতে সে কীভাবে বুঝবে, সে বেঁচে রয়েছে? তার অস্তিত্ব রয়েছে? আজকে আবার যেন সেই অনুভূতি ফিরে এসেছে তার কাছে। এই যে এখন সে বসে রয়েছে, তার সামনে বসে ভদ্রমহিলা কথা বলছেন, এই টেবিল, এই ফাইল—এসবেরও যে অস্তিত্ব রয়েছে, তার প্রমাণ কোথায়? এ-ও হয়তো একটা ফেক বিশ্ব, তার অনুভূতিও ফেক অনুভূতি। হয়তো আরও একটা ভার্চুয়াল প্রোগ্রামের অংশ সব কিছু।
‘মিসেস ডেভিস, আপনি হয়তো মনে করছেন, এতদিন ধরে আপনি প্রতারিত হয়েছেন। একটু অন্যভাবে চিন্তা করে দেখুন। আপনার ছেলে এতদিন ধরে আপনার সঙ্গে বেঁচে ছিল। আপনারা নিজেদের মধ্যে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-অবসাদ ভাগ করে নিতে পারতেন। ওর সঙ্গে আলাপ করার সময় আপনার মধ্যে যে অনুভূতি জেগে উঠত, তার মধ্যে কিন্তু কোনোরকম ভেজাল ছিল না। সব চেয়ে বড়ো কথা, এতদিন আপনি যে বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে ছিলেন, সেই বিশ্বাস আপনার ছেলেই আপনার মনে জাগিয়ে রাখতে চেয়েছিল। এটাই ওর শেষ ইচ্ছে ছিল। পুরো ব্যাপারটা যদি এভাবে দেখেন, সেক্ষেত্রে আমাদের কাজ হয়তো আপনার কাছে ততটা অসম্মানের মনে হবে না।’
ভদ্রমহিলার কথার কোনো উত্তর দিল না ম্যারিয়ম। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে, যে-কোনো মুহূর্তে সে ঘুম থেকে জেগে উঠবে নিজের মোবাইলের অ্যালার্মের শব্দে। হয়তো-বা হ্যারির ফোনের শব্দে। তখন আবার সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। যেভাবে মানুষ রাত্রে দেখা দুঃস্বপ্ন ভুলে যায়, ঠিক সেইভাবে সে গত কয়েক ঘণ্টার স্মৃতি ভুলে যাবে। হ্যারির সঙ্গে পরের বার কথা বলার সময় তারা হাসাহাসি করবে এই দুঃস্বপ্নটা নিয়ে। নিজের চোখের কোণের জল মুছতে মুছতে হ্যারি হাসিমুখে বলবে, ‘ওহ্ মা! তুমি পারো বটে। শেষ পর্যন্ত আমাকেই ফেক বানিয়ে দিলে?’
একটা বাজনার শব্দে ম্যারিয়মের চিন্তাসূত্রে ছেদ পড়ল। বাজনাটা খুব চেনা এবং কাছাকাছি কোথাও থেকে তার শব্দ আসছে। ম্যারিয়ম বিভ্রান্ত হয়ে এদিক-সেদিক চাইল।
‘আপনার মোবাইল বাজছে।’ ভদ্রমহিলা শান্তস্বরে বললেন।
তার মোবাইল? ঠিকই তো, এটা তো তারই মোবাইলের রিংটোন। নিজের ব্যাগ হাতড়াল ম্যারিয়ম। মোবাইল বের করে তার স্ক্রিনের ওপর চোখ রাখল।
হ্যারির কল!
হাত কাঁপছে ম্যারিয়মের। তার ভয় হচ্ছে, মোবাইলটা হাত ফসকে পড়ে না যায়। সে কোনোরকমে ফোনটা ধরে সেটা নিজের কানের কাছে নিয়ে এল, ‘কে হ্যারি? হ্যারি বলছিস? হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি। কোথায় তুই? আমি তখন থেকে… তুই প্লিজ় আমার কাছে একবার…’
তাকে মাঝপথেই থামাল হ্যারির কণ্ঠস্বর, ‘মা, সম্ভব হলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আমি তোমাকে কষ্ট থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। জানি না, সফল হয়েছি কি না। হয়তো আমি এই পদক্ষেপ না নিলে এর চেয়ে কম কষ্ট পেতে। সরি, মা।’
কোনো কথা বেরোল না ম্যারিয়মের গলা থেকে। তিনি ফোনটাকে কানে চেপে ধরে ফোঁপাতে লাগলেন। হ্যারির গলার স্বর তিনি শুনছেন। যে স্বর তাকে জানাচ্ছে, সে আর বেঁচে নেই।
‘মা, কেঁদো না প্লিজ়। তুমি তো জানো, তোমার কান্না কতটা যন্ত্রণা দেয় আমাকে। আচ্ছা, একটা কাজ করো দেখি। ফোনটার ভিডিয়ো অন করো।’
না। বারবার মাথা নাড়তে লাগল ম্যারিয়ম। সে আর প্রতারণার শিকার হবে না। সব কিছু জানার পর সে কিছুতেই কম্পিউটারের সৃষ্টি-করা একটা কৃত্রিম ছবিকে নিজের ছেলে বলে মেনে নেবে না।
‘প্লিজ় অ্যাকসেপ্ট ভিডিয়ো!’ মৃদুস্বর ভেসে এল তার মোবাইল থেকে।
‘মা, প্লিজ়…’
ফোনটাকে নিজের মুখের সামনে এনে ভিডিয়ো অ্যাকসেপ্ট করল ম্যারিয়ম। অচিরেই তার সামনে ফুটে উঠল হ্যারির অবয়ব। নিজের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও। পাশে পান্ডার ছবিওয়ালা একটা কফির মগ রাখা রয়েছে। ব্যালকনির পিছনে বাগানের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। মৃদু বাতাসে মাথার চুল উড়ছে হ্যারির।
‘মা, এবার চোখের জল মুছে ফ্যালো। ইশ্, একদিনে কী অবস্থা হয়েছে তোমার। কালকেই কত হাসিখুশি ছিলে।’
‘সে তো তোকে দেখব বলে…’ গলা বুজে এল ম্যারিয়মের।
‘দেখছ তো।’
‘তুই তো…’ কথাটা শেষ করতে পারল না ম্যারিয়ম।
‘ফেক?’ হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল হ্যারি।
আচমকা পরিবর্তন হল ম্যারিয়মের মুখের ভাবে। তার গলার পেশি টানটান হয়ে উঠল, কণ্ঠস্বর কঠিন হয়ে উঠল, ‘ফেকই তো। আমার ছেলের রূপ ধরে ঠকিয়ে এসেছিস আমাকে দশ বছর ধরে। তুই আমার ছেলে নোস, আমি তোকে চিনি না। আমাকে আর ফোন করিস না।’
চোখ ঝাপসা হয়ে এল ম্যারিয়মের। কোনোরকমে সে ফোনটা কেটে দিয়ে সেটাকে নামিয়ে রাখল সামনের টেবিলের ওপর। তারপর মোবাইলটার দিকে চেয়ে ম্যারিয়ম বসে রইল চুপ করে।
এর মধ্যে কখন যেন এলিজা এসে আবার ওর পাশে বসেছে। সে মিসেস ক্লার্কের দিকে চাইল। মিসেস ক্লার্ক নড করলেন। আর কিছু করার বা বলার নেই তাদের। এবার ম্যারিয়মকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে।
‘ম্যা’ম, বাইরে যে ক্যাবটা দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেটা আপনাকে একটা হোটেলে নিয়ে যাবে। সেখানে একটা রুম তিন দিনের জন্যে বুক করা রয়েছে আপনার নামে। আর এই কার্ডটা রাখুন। এখানে দেওয়া নাম্বারে জানালেই আপনার ফেরার টিকিট বুক করে দেওয়া হবে। আপনি বরং এই নাম্বারটা নিজের ফোনে সেভ করে রেখে নেবেন। আপনার প্রয়োজনীয় সব কিছুই এখানে জানালে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনার নামে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বাস্থ্যবিমা করানো আছে। আপনার নামে বেশ কিছু টাকাও রেখে গেছে আপনার ছেলে। প্রয়োজনমতো সেটা ব্যবহার করতে পারবেন আপনি।’ এতটা বলে উঠে দাঁড়াল এলিজা।
ম্যারিয়মও উঠে দাঁড়াল। তাকে টেবিলের ওপর রাখা ফাইলটা ধরিয়ে দিল এলিজা। তারপর বাইরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে এল।
গাড়িটা ম্যারিয়মকে নিয়ে চোখের দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে নিজের পকেট থেকে হ্যারিয়টের মোবাইল বের করল এলিজা। এই মোবাইলটা এতদিন সে-ই ব্যবহার করত হ্যারিয়টের হয়ে। আজকে উনিশ তারিখ। মাস শেষ হয়ে গেলে ফোনটার কানেকশন কেটে দেবে তারা। এখনও কেটে দেওয়া যায়, কিন্তু মিসেস ক্লার্কের সঙ্গে আলোচনার পর সে ঠিক করেছে, এই মাসটা অন্তত থাক। হয়তো মিসেস ডেভিস নিজের মতো পরিবর্তন করে আবার নিজের ছেলেকে ফোন করবেন। ফেক জেনেও তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলবেন।
সত্যিই কি ফেক? ভদ্রমহিলা গত কয়েক বছর যে হ্যারিয়টের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন, সে তো তাঁর ছেলের আদলেই তৈরি। তার কথাবার্তার ধরন, তার স্বভাব, তার অবয়ব—সব কিছুই তো আসল হ্যারির আদলে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাঁর ছেলে বেঁচে থাকলেও হয়তো এই কথাগুলিই সে বলত নিজের মায়ের সঙ্গে। হয়তো তাঁদের সম্পর্কও এই পথেই এগোত। মিসেস ডেভিস যদি আজকে এখানে না আসতেন, সেক্ষেত্রে হয়তো এই কৃত্রিম সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই তাঁর অবশিষ্ট জীবন কেটে যেত।
সেদিন আর কাজে মন বসল না এলিজার। বাড়িতে ফিরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল সে। আর শুয়ে শুয়ে একটা অদ্ভুত চিন্তা গ্রাস করল এলিজাকে। ধরে নেওয়া যাক, মিসেস ডেভিস কোনোদিন জানতে পারলেন না যে তাঁর ছেলে আর বেঁচে নেই। এবং নিজের শেষজীবনে তিনিও ছেলের একাকিত্ব দূর করার জন্যে নিজের দেশে অনুরূপ একটা সার্ভিস গ্রহণ করলেন তাদের মতো একটা প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানির কাছ থেকে। সেক্ষেত্রে কি অনন্তকাল ধরে মা-ছেলের সম্পর্ক বজায় থাকবে ভার্চুয়াল জগতে?
আচমকা এলিজার বিছানার পাশের টেবিলে রাখা মোবাইল বেজে ওঠায় তার চিন্তাসূত্রে ছেদ পড়ল। হ্যারিয়টের মোবাইল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে তার স্ক্রিনের দিকে নির্নিমেষে চেয়ে রইল এলিজা।
মম কলিং!
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সন্দীপ চৌধুরী
