ইশরাকের মন্দির
লেখক: পবিত্র ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
সাদা রঙের এসইউভি-টা এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটা দমকা বাতাস রাস্তার ওপর জমে-থাকা ধুলোবালি উড়িয়ে নিয়ে গেল। বিকেলের এই শেষ সময়টা শহরের উপকণ্ঠে নীরবতা বিরাজ করে। সূর্যাস্তের শেষ চিহ্নগুলি শুষ্ক, পরিত্যক্ত জমির উপর ফেলেছে দীর্ঘ ছায়া। একটু দূরে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করে নিস্তব্ধতা ভাঙতে কারা এল, সেটাই যেন মাথা তুলে দেখছে সেটা। বাড়িটা পুরোনো, স্মৃতির পাতা থেকে বিলুপ্ত একটি ধ্বংসাবশেষ। ভেঙে-পড়া ইট এবং উপচে-পড়া আগাছার একটি ফাঁপা কাঠামো, জানালাগুলি অন্ধকার, যেন সেগুলোর ভেতর দিয়ে বাড়িটার আত্মা বেরিয়ে গেছে বহুকাল আগে।
দুই বন্ধু, কামাখ্যাচরণ ভট্ট এবং রাজেশ লাহা, নেমে দাঁড়াল গাড়ি থেকে। সিটের নীচ থেকে একটা বড়ো ব্যাগ বের করে কামাখ্যা দরজা বন্ধ করে গাড়ি লক করে। রাজা ততক্ষণে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দূরে বাড়িটার দিকে চেয়ে থাকে। এই বাড়িটাই? এটার কথাই বলছিল কামু?
কামাখ্যা ওরফে কামু এগিয়ে এসে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়াল, তারপর বন্ধুর হাতে একটা ঘুসি মেরে বলে, “তাহলে? শেষ পর্যন্ত গার্গীর গোঁয়ার বাপটাকে রাজি করিয়েই ফেললি।”
“সরকারি চাকারিটা না পেলে কোনোদিনই রাজি করাতে পারতাম না!” রাজা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল।
“আর বুড়োর চিন্তা কীসের! জামাই সরকারি চাকরি করে, এবার জামাইয়ের টাকায় ফুর্তি মারাবে! শালা লাক আছে বুড়োর!” কামু বলে ওঠে।
“এরকম বলিস না, ওঁর কি টাকার অভাব! বরং আমাকে ভাগ্যবান বল, গার্গীর মতো মেয়ে আমার স্ত্রী হতে চলেছে… না হলে এত বছর আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকা…”
কামুর নিজের হাতের তেলোর উলটো পিঠ দিয়ে কপাল মুছল। তারপর বলল, “তবে আমার কী মনে হয়, জানিস রাজা… চাকরিটা পেয়েই বিয়ে করাটা একটু তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে! আরে, তোর অভাবের জীবন শেষ হল। একটু তো এনজয় কর…”
রাজা অল্প হেসে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায়। কামুর এই কথার কোনো যথাযথ প্রতিক্রিয়া তার কাছে ছিল না। সে জানত, সে যা-ই বলবে, কামু সেটার পরিপ্রেক্ষিতেই তর্ক জুড়ে দেবে। কামু ছেলেটা এরকমই। আত্মবিশ্বাসী, উদ্ধত, উন্মত্ত। হাসি পেলে আকাশ কাঁপিয়ে হাসে, রেগে গেলে মাটিতে পা ঠুকে চিৎকার করে। তার চরিত্রের এই সূক্ষ্ম চিড়-খাওয়া অংশগুলো তার বিবাহবিচ্ছেদের পর প্রশস্ত ফাটলে পরিণত হয়েছিল।
পরিত্যক্ত বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা, একসময় সাদা শুভ্র মুখাবরণ এখন কালের তাণ্ডবে খসে পড়ছে, ছত্রাক আর পচন দখল করে নিয়েছে বাড়িটার গোটা শরীর। ঘুণে-খাওয়া কাঠের পাল্লাখানা, যেটা কোনোমতে তার ততোধিক রুগ্ণ কাঠামোর সঙ্গে টিকে-থাকা অবস্থায় কেঁপে উঠল কামুর হালকা ঠেলায়। রাজা দেখল, দরজার ওপারে একটা স্তব্ধ, স্যাঁতসেঁতে গন্ধে ভরা পরিবেশ তার সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। অদ্ভুত ভেজা দুর্গন্ধটা প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই তার নাকে এসে লাগল। সঙ্গে আরও কিছুর গন্ধ, মৃদু ঝাঁজালো কিন্তু যেন জীবন্ত কোনো কিছু।
“ওটা কীসের শব্দ?” রাজা ফিশফিশ করে বলে উঠল। কথাটা বলে সে নিজেই নিজের বোকামির জন্য লজ্জা পেল। শব্দটা আর কিছুই না, বাড়িটার কোনো এককোণ থেকে ভেসে-আসা ইঁদুরদের ডাক।
“ইঁদুরের ডাক প্রথম শুনছিস নাকি?” কামু ভুরু কুঁচকে তাকায়, “চলে আয়…” কথাটা বলতে বলতে সে চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢোকে। রাজা খেয়াল করেছে, তার বন্ধুর মাথা টলমল করছে। গাড়িতে আসতে আসতেই সে বেশ কয়েকটা বিয়ারের বোতল শেষ করেছে। এখন বোধহয় সেটারই প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
কামুকে অনুসরণ করতে করতে রাজা হঠাৎই এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল। দেওয়ালের কোণগুলোতে জমা-হওয়া অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, চিৎকারগুলো এখন আরও স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে। দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে যেন কোনো সতর্কবার্তা দিচ্ছে ওদের। রাজার মনে হচ্ছে, তাকে যেন কেউ পুরোনো কোনো কবরের ভেতর ফেলে ওপর থেকে মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে। গন্ধটাও যেন তার মন আর মস্তিষ্কে ভারাক্রান্ত করে দিচ্ছে, একটু পরেই যেন বাস্তব থেকে বিস্মৃত হয়ে পড়বে সে। কামু ইতোমধ্যে আরও ভেতরে চলে গেছে, তার পায়ের শব্দ এই ধ্বংসস্তূপটার আনাচকানাচে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
“ভাই রে, এগিয়ে আয়, তোর ইঁদুরে ভয় আছে জানলে আমি তোকে ডাকতাম না!” কামুর কণ্ঠস্বর ওপরের ল্যান্ডিং থেকে ভেসে এল। তার গলার সুর বিদ্রুপাত্মক, উত্তেজক।
অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে রাজা তার বন্ধুর দেখাদেখি উপরের তলায় উঠে গেল। কামু ওর জন্য ছাদে অপেক্ষা করছিল—“কী রে? এবার বল…” কামুর গলায় ‘কেমন দিলুম’ গোছের সুর। রাজার মুখে ততক্ষণে স্বস্তির একটা হাসি ফুটেছে। স্বপ্নেও সে ভাবেনি, এই দুর্গন্ধপূর্ণ অদ্ভুতুড়ে নোংরা বাড়িটার ছাদ থেকে সন্ধ্যার শহরের এক অসাধারণ রূপ দেখা যেতে পারে।
আলোগুলোকে দূর থেকে মিটমিট করতে দেখে যেন মনে হচ্ছে, আকাশের তারাগুলো যেন এসে মিশেছে মাটির সঙ্গে। বাড়িটার নীচতলার আর ওপরতলার মধ্যে প্রকৃতপক্ষেই আকাশ আর পাতালের তফাত।
কামু ইতোমধ্যে ছাদটার একদিকে একটা ভেঙে-পড়া স্তম্ভের ওপর বসে পড়েছে, ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সেটা মাটিতে রেখে, ভেতর থেকে একটা বিয়ারের বোতল করল সে। তীক্ষ্ণ ফোঁস শব্দ করে বোতল খাপমুক্ত হল।
“আজ কি শাম! দোস্তোঁ… তেরে নাম!” বোতল উঁচিয়ে কামু বলল। রাজা হেসে মাথা নাড়ল।
“তোর দিনগুলো হোক প্রেমে পূর্ণ আর রাতগুলো হোক ঝামেলামুক্ত। হে ঈশ্বর, আমি যেটা পাইনি, আমার এই বন্ধুকে সেটা দিয়ো কিন্তু।” আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকল কামু।
রাজা হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে একটা বিয়ারের বোতল তুলে নিল।
শান্ত চোখে রাজাকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে কামু বলে ওঠে, “নিজের কথা ভেবে এখন আমার নিজেরই করুণা হয়, জানিস তো…”
“মানে?” রাজা প্রশ্ন করে।
কামু হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে আন্তরিকতা ছিল না।
“সবাই ভাবে, আমিই ছিলাম সমস্যার মূলে, তুইও হয়তো তা-ই ভাবিস… তা-ই না?”
রাজা বুঝতে পারল, কামু তার ডিভোর্সের কথা বলছে।
“আরে ভাই… ছাড়-না… আবার এসব কেন…” রাজা আমতা আমতা করে।
“না রে… দোষ আমার ছিল। কিন্তু দোষ আমার একার ছিল না…। হ্যাঁ, আমি মদ খেতাম, রাগ দেখাতাম। কিন্তু পারমিতা?… সে তো আমাকে ভালোইবাসেনি কোনোদিন, তুই বল… আমি কি ভালো হওয়ার চেষ্টা করিনি? সে কি পারত না আমার পাশে একটু থাকতে? আমার এই লড়াইয়ে আমাকে সাপোর্ট দিতে পারত না?”
রাজা কী বলবে, বুঝতে পারছিল না। কামুর তার কণ্ঠস্বর ভেঙে আসছিল। নিজের বোতলটা কয়েক চুমুকেই শেষ করে দিয়ে আবারও একটা বোতল হাতে তুলে নেয় কামু।
রাজা তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইল। সান্ত্বনা দেবে নাকি নীরব থাকবে, সেটা ঠিক করতে পারছিল না। সন্ধ্যার চাপ তাদের মধ্যে ভারী হয়ে নেমে এল। কামুর ডিভোর্স হয়েছে প্রায় এক বছর হতে চলল, কিন্তু সেই দুঃখ তার মনে এখনও রয়ে গেছে, হয়তো রাজার বিয়ের আগাম সংবাদ তার পুরোনো ক্ষতটাকে উসকে দিয়েছে। মদের ঘোরটাও চড়ে বসেছে তার মাথার ওপর, যার কারণে পুরোনো ক্ষত থেকে রক্তপাত ঘটছে। একই সঙ্গে সে খেপে উঠছে এবং নিজের সম্ভাব্য একাকিত্বে ডুবে-থাকা ভবিষ্যতের চিন্তায় আশঙ্কিত হচ্ছে।
“তুই নিজেকে ভাগ্যবান বললি না রে।” দিগন্তের দিকে দৃষ্টিপাত করে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল কামু, “তোর মতে গার্গী… মিতার মতো নয়, বল? সে তোর পাশে থাকবে, তা-ই তো? তোকে একা একা পচতে দিয়ে ফেলে চলে যাবে না?”
“কামু, আমি কখনোই মনে করিনি, তোর একার দোষে তোদের বিয়েটা ভেঙেছে…” রাজা শান্তভাবে বলল, তারপর এগিয়ে গিয়ে কামুর পাশে বসে বলল, “আসলে দোষী কে, সেটা আমিও জানি না, কিন্তু যে সম্পর্ক টেকার নয়, সেটাকে আঁকড়ে ধরে থেকেও লাভ হয়, যতই চেষ্টা করিস-না কেন।”
কামু মাথা নীচু করে হাসল, তারপর মাথা নামিয়ে রেখেই বলল, “হ্যাঁ, চেষ্টা… চেষ্টার কোনো কসুর করিনি, ভাই… কিন্তু সব করেও খুব একটা দূর এগোতে পারিনি!”
এক মুহূর্তের জন্য তারা দুজনেই চুপ করে রইল। রাজা খেয়াল করল, ইঁদুরদের ডাক এখনও নীচ থেকে মৃদুস্বরে ভেসে আসছে, মাঝেমধ্যে বোধহয় তাদের দৌড়াদৌড়ির শব্দও শোনা আচ্ছে। অস্বস্তিকর পটভূমি!
নভেম্বর মাস, বাতাসে শীত-শীত ভাব। শিরশিরে হাওয়া ছাদ জুড়ে বয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে। নীচ থেকে বাড়ি থেকে ভেসে-আসা পচনের মৃদু গন্ধটাকেও বাতাসটা তার বন্ধু বানিয়ে সঙ্গে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হঠাৎই রাজার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। তাড়াতাড়ি সে ফোন বের করে দেখল, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার অ্যালার্ম বাজছে। সে নিজেই সেট করেছিল এই অ্যালার্ম, কিন্তু কেন করেছিল, সেটা আর এখন মনে পড়ছে না।
আকাশে চাঁদটা ভারিক্কি রূপ ধারণ করেছে, শুভ্র রুপালি আলো এসে পড়ছে কামুর মুখে আর পরিত্যক্ত বাড়ির ছাদে। মৃদু বাতাসে ছাদের কিনারে বেড়ে-ওঠা আগাছাগুলোর দোলানি দেখতে দেখতে রাজা মনে করার চেষ্টা করল, ঠিক কী কারণে সে অ্যালার্মটা সেট করেছিল।
“কী রে? বউ ফোন করেছে নাকি?” কামু জিজ্ঞেস করে।
“আরে না… কিছু না!”
“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি, তুই যে আমার সঙ্গে থাকবি, সেটা তো ওকে বলেও আসিসনি।… আর ভাই, বলবিই-বা কেন… আমি মাতাল, লম্পট! কিন্তু ভাই… এত কিছু করেও শেষরক্ষা হবে তো?”
রাজার কপাল কপালে ভাঁজ পড়ল। “কী বলতে চাইছিস?”
“আমি বলছি…” কামু অলসভাবে তার হাত নাড়ল, তার কণ্ঠস্বর আরও একটু তীব্র এবং অসংযত হয়ে উঠেছে। “আমি বলছি রাজা, তুই শিয়োর তো, গার্গী অন্য মেয়েদের মতো নয়?… তুই যে এত নিষ্ঠাভরে তাকে ভালোবাসিস, সেটার মূল্য তার কাছে আছে তো? তোর আড়ালে সে অন্য কারও সঙ্গে…”
“কামু…” রাজা গর্জে উঠল, শরীরটা টানটান করে উঠে দাঁড়াল সে, “গার্গীকে তোর অবাস্তব কল্পনার মধ্যে রাখিস না… রিকোয়েস্ট করছি…!”
“অবাস্তব?” কামু ব্যঙ্গাত্মক স্বরে কথাটা বলে আরেক চুমুক বিয়ার খেল, “আমি অবাস্তব কিছু ভাবছি না, রাজা। আমি শুধু সত্যিটাই বলছি। তুই কী মনে করিস, আমি এমন অনুভব করিনি, যখন আমি মিতাকে বিয়ে করেছিলাম? আমিও ভেবেছিলাম সে-ই আমার জন্য সঠিক। আমিই তার ধ্যানজ্ঞান। আমাকে ছাড়া সে আর কাউকে ভালোবাসে না… কিন্তু কী হল? সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল… আর ঠিক যেভাবে মিতা আমাকে ছেড়ে গেছে, ঠিক সেভাবে গার্গীও একদিন তোকে ছেড়ে যাবে।”
“কামু, তুই চুপ কর কিন্তু।” রাজা আবারও গর্জায়, তার দু-হাত শক্ত মুঠোয় বন্ধ।
“চুপ করব কেন বে?!” কর্কশ গলায় বলে ওঠে কামু। ছাদের ভাঙা দেয়ালে যেন তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল, “এই শালা দুনিয়াটা একটা নর্দমা… আর মেয়েরা সেই নর্দমার পোকা…। তারা যা চায়, ভুলিয়েভালিয়ে তোর থেকে নিয়ে নেয়, তারপর স্বার্থ ফুরোলেই, তোকে ছেড়ে চলে যায় পচে পচে মরার জন্য। সব্বাই… সব সমান… তুইও একদিন বুঝবি! প্রথমে এমন ভাব দেখাবে যেন সে তোকে কতই-না ভালোবাসে, তাদের গোটা পৃথিবীটাই তুই। আর তারপর… একদিন সে বোর হয়ে যাবে, তারপর তোর দিক থেক মুখ ফিরিয়ে নেবে। এটাই দস্তুর… সব সময় তা-ই হয়ে থাকে।”
রাজা অনেক কষ্টে নিজের ধৈর্য ধরে রেখেছিল। হাতের বিয়ারখানা নীচে নামিয়ে রেখে সে বলল, “কামু, তুই এবার থাম, তোর চড়ে গেছে, আর প্লিজ়, শেষবারের জন্য বলছি, আমার গার্গী তোর পারমিতা… বা তোর জীবনে দেখা আর কোনো মহিলার মতো নয়… হ্যাঁ, সেটা হতে পারে, পৃথিবীর সব মেয়েই খারাপ… কিন্তু গার্গী আলাদা!”
কামু ঠোঁট বেঁকিয়ে তাকাল, চোখ সংকুচিত করে সামনের দিকে ঝুঁকে সে বলল, “তাই নাকি? পৃথিবীর সব মেয়ে খারাপ হলেও তোর গার্গী ভালো? কেন, সে কি নেপচুন থেকে এসেছে! হাহা! আর যদি সত্যিই সে নেপচুন থেকেই হয়, তাহলেও সে একটা নারী… তোর পিঠে ছুরি সে মারবেই!”
“যথেষ্ট হয়েছে।” রাজা নীচুস্বরে কথাটা বলল, ক্রোধ বুকের ভেতরে ফুটতে শুরু করেছে, “ব্যাচেলর পার্টি দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।”
কামু উঠে দাঁড়াল। রাজার হাত ধরে সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল! কিন্তু তার আগেই এক শান্ত-স্মিত কণ্ঠ সেই উত্তেজনাময় পরিস্থিতিটাকে মন্দীভূত করে দিল।
“তোমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।”
দুজনেই আচমকা ঘুরে তাকাল। সিঁড়ির মুখে দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক বৃদ্ধ, তার দুর্বল দেহ অন্ধকার সিঁড়ির ছায়ার মাঝে আবছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে। তার দু-চোখ গর্তে ঢুকে গেছে, মুখটা এমনই ফ্যাকাশে যেন বহুদিন তার চেহারায় সূর্যের আলো পড়েনি। তার পোশাক পুরোনো হলেও মলিন নয়, সেই পোশাক দুর্বল শরীরটাকে পুরোনো দিনের আদবকায়দায় পেঁচিয়ে রেখেছে, তার কণ্ঠস্বর স্মিত হলেও একটা পরোক্ষ শক্তি নিহিত ছিল, একটা ভর বহন করছিল সেই কণ্ঠ।
রাজা আর কামু বৃদ্ধের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল, তারা বুঝতে পারল না, এই লোকটা কোথা থেকে এল বা কতক্ষণ ধরে তাদের দেখছে।
বৃদ্ধ এক কয়েক পা এগিয়ে এলেন, তার পা খালি, কিন্তু পদক্ষেপ দৃঢ়। “তোমাদের এখানে থাকা উচিত হচ্ছে না।” সে আবার বলল, তার গলা হালকা কাঁপছে, “তোমরা দেবতাকে বিরক্ত করছ। তাকে শান্তিতে ঘুমোতে দাও।”
কামু অবাক হয়ে চোখ পিটপিট করল, মদের নেশা এমনিতেই তার বিচারবুদ্ধি ধোঁয়াটে করে দিয়েছে। তার অভিব্যক্তি বিভ্রান্তি থেকে ক্রোধে বদলে গেল, “তুমি কী বললে, দেবতা? কে দেবতা… কীসের দেবতা?”
“এটা এক মন্দির।” বৃদ্ধ বললেন, তাঁর চোখ কামুর দিকে স্থিরভাবে নিবদ্ধ, “দেবতা ইশরাক এখানে বিশ্রাম করেন। তোমাদের এখনই চলে যেতে হবে, নইলে কিন্তু ইশরাক রুষ্ট হবেন।”
কামু উঠে দাঁড়াল, তার শরীরটা মদের নেশায় এখন বেশ টালমাটাল করছে। চোখে-মুখে কৌতুকের হাসি ফুটিয়ে সে বলল, “তুমি পাগল নাকি? এই জায়গাটা একটা ধ্বংসস্তূপ। এখানে কোনো দেবতা নেই, শুধু ইঁদুর আছে, তোমার ইশরাক কি ইঁদুরের দেবতা?”
কথাটা বলেই হোহো করে হেসে উঠল কামু।
বৃদ্ধ আরও দু-পা এগিয়ে এলেন। রাজা দেখল, বৃদ্ধের হাত কাঁপছে। সে মনে মনে আন্দাজ করল বৃদ্ধ বোধহয় কোনো পূজারি। এটা বোধহয় সত্যিই কোনো মন্দির। সে আরও দেখল বৃদ্ধ আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো দেখতে নয়, তাঁর কপাল চওড়া, গায়ের চামড়া কুচকুচে কালো এবং চোখ দুটো ঘোলাটে।
“অনুগ্রহ করে, তোমরা চলে যাও। দেবতা তোমাদের পছন্দ করছেন না।”
কামু মুখ বিকৃত করে ঠোঁটের কোণে ঠান্ডা হাসি ফুটিয়ে তুলল, “তুমি চাও, আমরা চলে যাই, তা-ই না বুড়ো? তোমার অপদার্থ দেবতার ভয়ে এই কামাখ্যাচরণ ভট্ট পালাবে?”
রাজা অনুভব করল, পরিস্থিতি খারাপ দিকে যাচ্ছে। তার বুক ধুকপুক করতে শুরু করে দিল।
“যদি আমার দেবতার নামে আর-একটা বাজে কথা বলো তাহলে আমি তোমার জিব টেনে ছিঁড়ে দেব!” স্পষ্ট ভাষায় বৃদ্ধ বললেন।
কামুর চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠল, “কামু, এটা করিস না।”
কথাটা বলে রাজা এগোতে যাবে, কিন্তু তার কিছু করার আগেই কামু এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধকে দিল জোরে এক ধাক্কা! একটা মুহূর্তের জন্য সময় থমকে গেল, দুর্বল দেহটা কয়েক পা পিছনে সরে গেল, তারপর কিছুক্ষণ টলমল করে সামলানোর চেষ্টা… তার বিস্মিত চোখে রাজাকে একঝলক দেখে নিয়ে সিঁড়ির পাশ দিয়ে সোজা নীচে পড়ে গেলেন তিনি। পড়ার পরের শব্দটা শুনে রাজার মনে হল যেন নীচের মেঝেটা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। দুজনে ছুটে গিয়ে সিঁড়ির পাশে মুখ বাড়িয়ে দেখল, কিন্তু কাউকেই তারা দেখতে পেল না। ছাদ থেকে পড়ে বৃদ্ধ যেন অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন।
একটা ভারী নীরবতা যেন ঘনীভূত হয়ে নেমে এল। তবে সেটাও কিছুক্ষণের জন্যই ছিল। হঠাৎই নীচ থেকে উঠে আসতে লাগল ইঁদুরের কর্কশ আওয়াজ, আগের চেয়ে আরও জোরে। ইঁদুর নয়, যেন বাড়িটা নিজেই জেগে উঠেছে।
কামু স্থির দাঁড়িয়ে ছিল, যেখানে বৃদ্ধ পড়ে গিয়েছিল, নীচু হয়ে সে সেদিকটাতেই তাকিয়ে। তার মুখ ফ্যাকাশে, মাতলামি আর সাহস এখন উধাও, তার জায়গায় এখন তার চোখে-মুখে ভয়ের আভাস।
“চল, একবার নীচে গিয়ে দেখি।”—কথাটা বলে কামু সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল, রাজাও তার পিছন পিছন যন্ত্রচালিতের মতো নেমে গেল।
ওরা দেখল, বৃদ্ধ যে জায়গায় পড়েছেন, সেখানে মেঝে বলে কিছু নেই, বিরাট একটা ফাটল এবং তার নীচে অন্ধকার, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। মেঝেতে এত বড়ো ফাটল আছে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় খেয়াল করেনি।
“বুড়ো সোজা পাতালে গিয়ে পড়েছে।” কামু মাথা নেড়ে বলল, “উদ্ধার করে আনার কোনো রাস্তাই নেই!”
“হে ভগবান…” রাজা ফিশফিশ করে বলল, তার গলা কাঁপছে, “কামু… তুই কী করলি এটা?”
কামু গলাধঃকরণ করল, তার নিশ্বাস অগভীর। “আরে, আমি কী করব? বুড়োটাই তো আমাকে খেপিয়ে দিল।” তারপর বিড়বিড় করে আরেকটা কী যেন বলল, যেন নিজেই নিজেকে স্তোক দিল।
“কামু, তুই বুঝছিস না!” রাজা পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল মুছতে মুছতে বলল, “বুড়োটা যদি মারা যায়, আমি বিপদে পড়ে যাব… আমার নতুন সরকারি চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে!”
“তুই একা বিপদে পড়বি, আমি পড়ব না, আমার জেল হবে না… আমারও ব্যাবসা লাটে উঠবে না?” কামু চোখ বড়ো বড়ো করে বলল।
“তাহলে এখন কী করবি, বল?” রাজা জিজ্ঞেস করে।
কামু একটু ভেবে নিয়ে বলল, “পালাই, চ!”
“পালাবি?” রাজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ, তা ছাড়া আবার কী!” কামু বলে, “চুপচাপ কেটে পড়ি, চ! এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কেউ আমাদের আসতে দেখেনি… কেউ যেতেও দেখবে না!”
“আর… এই বুড়োর বডিটা কী হবে?” রাজা জিজ্ঞেস করে।
“সে যা হবার হবে, ওঁত ভেবে কাজ নেই। এখন পালাতে হবে…!” রাজার কাঁধে হাত রেখে কামু কথাগুলো বলে দিল।
সেই রাতে রাজা বিছানায় শুয়ে দু-চোখ এক করতে পারল না। ছিল, ছাদের দিকে তাকিয়ে। তার মনের ভিতর ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। সন্ধ্যার ঘটনাগুলো বারবার তার মনে ভেসে উঠছিল। বিয়ার খাওয়া, কামুর সঙ্গে তর্কাতর্কি, বৃদ্ধের আগমন আর তারপর সেই ধাক্কা… ভয়ংকর সেই শব্দ। সব শেষে বৃদ্ধ লোকটির দেহ অন্ধকারের গভীরে হারিয়ে যাওয়া।
ঘুমোনোর অনেক চেষ্টা সে করল, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই বৃদ্ধের পড়ে যাওয়া, আর বিশেষ করে পড়ার আগে ওর সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার দৃশ্যটা তার সামনে জ্বলজ্বল করতে লাগল, এক অবিরত ছায়ার মতো চিন্তাগুলো তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। আরও একটা ব্যাপার তার সঙ্গে লেগে ছিল… ইঁদুরের উচ্চস্বরে চিৎকার! বুড়োটা পড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই চিৎকার করে উঠেছিল ওরা, সোৎসাহে, সোল্লাসে, নতুন কিছু পাওয়ার আনন্দে।
পরিত্যক্ত বাড়ি ছেড়ে আসার পরও সেই চিৎকার রাজাকে তাড়া করছিল। আর সেই পচা গন্ধটা, সেটাও তার নাকে লেগে ছিল, সেই দুর্গন্ধ-মাখা বিশাক্ত বাতাসটাও যেন তাকে বাড়ি পর্যন্ত অনুসরণ করে চেলে এসেছে… পারফিউম, রুম ফ্রেশনার সব কিছু ব্যবহার করে ফেলেছে সে, গন্ধটা যেতেই চাইছে না।
অনেকক্ষণ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে, কম্বল মাথার ওপরে টেনে দিয়ে পৃথিবী থেকে নিজেকে আড়াল করে এবং আরও অনেকরকম চেষ্টাচরিত্র করে অবশেষে ঘুম তাকে গ্রাস করল, তবে সেটাও শান্তিপূর্ণ হল না।
স্বপ্নটায় রাজা নিজেকে মাটির তলায় একটা গুহার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল, একই রকম ঠান্ডা আর স্যাঁতসেঁতে। বাতাসটা পচনের গন্ধে ভারী হয়ে তার নাক-গলা-বুক জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করল সে, কিন্তু কোনো কাজ হল না। গন্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠছিল, প্রতিমুহূর্তে আরও অসহনীয় হয়ে উঠছিল।
তার চারপাশে কী সব নড়াচড়া করছে। অন্ধকারের মধ্যে কারা যেন নিজেদের মধ্যে কানাকানি করছিল। কয়েক পা এগিয়ে যাওয়ার পরেই কীসে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল, আর তারপরেই বিছানার ওপর উঠে বসল সে।
“বাপ রে! কী ভয়ংকর স্বপ্ন রে!” স্বগতোক্তি করল রাজা, “আজ কামু হতভাগার কথা না শুনলেই…!”
কথাটা শেষ করতে পারল না রাজা। কথা বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে সে বিছানার পাশে সুইচটা চেপে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল… আর আলো জ্বলার সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখের কথা মুখেই রয়ে গিয়েছিল…
—ইঁদুর। শত শত, হয়তো হাজার হাজার ইঁদুর, মেঝে জুড়ে ছুটোছুটি করছে, তাদের ছোটো ছোটো নখ সিমেন্টের উপর আঁচড় কাটছে, দাঁত ঘষছে। চিৎকার করতে গিয়েও গলায় ভেতর যেন সব কিছু দলা পাকিয়ে গেল তার… আরে, শুধু তো ইঁদুর নয়… আরও আছে… একটা মানুষ বা বলা ভালো, একটা দেহ…
ঘরের মাঝখানে সেই বৃদ্ধ লোকটিকে দেখতে পেল সে… হাত-পা তার বেঁকে আছে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে আর চোখ দুটো খোলা, সিলিং-এর দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে। মুখটা হাঁ করে রেখে যেন নিঃশব্দে চিৎকার করার চেষ্টা করছেন। তাঁর দেহ ছিল প্রাণহীন, কিন্তু তা-ই বলে ইঁদুরগুলো তাঁকে ছেড়ে দেয়নি…
কালো, লোমশ শরীরগুলো বৃদ্ধ লোকটিকে ঘিরে কম্বলের মতো ঢেকে ফেলল, ছোটো ছোটো দাঁত কেটে বসছে বৃদ্ধের শরীরে। রাজা স্তব্ধ আতঙ্কে দেখল, ইঁদুরগুলো খেতে শুরু করেছে বৃদ্ধের হাত, পা, মুখ। মেঝেতে রক্তের ধরা ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে, কিন্তু ইঁদুরগুলোর সেদিকে হুঁশ নেই। হিংস্র ক্ষুধায় বৃদ্ধকে ছিঁড়ে ফেলছিল ওরা, তাদের চিৎকার রাজার ছোটো ঘরটিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
রাজা আবারও চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু তার গলা ধরে এসেছিল, যেন কোনো শক্ত দড়ির ফাঁস সেটিকে আটকে রেখেছে। সে পিছন বিছানা থেকে নামতে চাইল, দৌড়ে পালাতে চাইল, কিন্তু তার হাত-পা যেন নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছিল। কে যেন তার কানে কানে বলল, “এক-পা-ও নড়িস না! একচুলও নড়িস না! নড়লেই কিন্তু ওরা তোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে!”
রাজা ভয়ে নড়তে পারল না। নিশ্বাসটুকু পর্যন্ত নিতে পারল না।
হঠাৎ বৃদ্ধ লোকটার মাথা নড়ে উঠল। রাজার বুকের ভেতর যেন একটা ধাক্কা লাগল। ধীরে ধীরে, যন্ত্রণাকাতর ভঙ্গিতে লোকটা মাথা ঘুরিয়ে রাজার দিকে তাকালেন, বড়ো বড়ো, শূন্য চোখ দুটো দিয়ে রাজাকে দেখতে থাকলেন তিনি।
একসময় শুকনো ফাটা ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল…
“তোমাদের চলে যাওয়া উচিত ছিল। কেন গেলে না? কেন? কেন? আহ্… অ…!”
কথা শেষ করতে পারলেন না বৃদ্ধ… একটা ইঁদুর তার পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে এল, তার শরীরটা রক্তে ভেজা, চোখগুলো রাজার দিকে নিবদ্ধ! অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে।
রাজা বিছানার কোণে সরে এসে বসল। হাত বাড়িয়ে চাদরটা খোঁজার চেষ্টা করল সে, কিন্তু কোথায় কী! গন্ধটা এসে আবার তাকে আঘাত করল, এবার আরও তীব্র, গর্ভে নিহিত অসংখ্য মৃতদেহবিশিষ্ট সমুদ্রের যেন বিশাল এক ঢেউ তার ওপর আছড়ে এসে পড়ল। বিষাক্ত বাতাসের মধ্যে নিশ্বাস নেওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। হাঁপাতে লাগল সে অল্পক্ষণের মধ্যেই।
হঠাৎই সে তার বুকে তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা অনুভব করল। হাত দিয়ে বুকের বাঁদিকটা চেপে ধরার পরেই তার মনে কিছু একটা তার চামড়ার নীচে নড়ে উঠল। মুহূর্তের মধ্যেই আতঙ্ক তাকে গ্রাস করল… এবং সে নিজের বুকটা চিরে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল… ভেতরে যা-ই থাকুক-না কেন, সেটাকে বাইরে বের করে আনার চেষ্টা করতে লাগল! এদিকে ওর চামড়াটা ফুলে উঠল, জীবন্ত যে জিনিসটা তার শরীরের ভেতরে আটকে আছে, সেটা বুঝি এবার চামড়াটা ফেড়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে… হ্যাঁ… তা-ই হল… ইঁদুর… এটাই ছিল ওর শরীরের ভেতরে।
চিৎকার করে উঠে রাজা ছিটকে বিছানা থেকে মেঝেতে পড়ে গেল… ইঁদুরগুলো নিমেষের মধ্যে তার বুকের ওপর উঠে পড়ে আঁচড়াতে লাগল, রাজা মরিয়া হয়ে নিজেকে মুক্ত করার বিফল প্রচেষ্টা করল। বৃদ্ধের শরীরটা ছেড়ে এখন ইঁদুরগুলো পেয়ে বসেছে রাজাকে, নতুন তাজা রক্তের নেশায় মত্ত হয়ে উঠল তারা। তার বুকের ভেতর পাঁজর ভেদ করে আরও গভীরে ঢুকে যেতে লাগল। রাজাও সেই বৃদ্ধের মতো মুখ খুলে রইল… কিন্তু শব্দ বের করতে পারল না! তার দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে এল, এবং সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রইল। অন্ধকারে ইঁদুরগুলো ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে ফেলল।
চিৎকার করে, এবার সত্যিই রাজা ঘুম থেকে উঠে বসল, তার কপাল, বুক ঘামে ভেজা। নতুন ফ্ল্যাট, সাউন্ডপ্রুফ ঘর, তাই তার চিৎকারের শব্দ পাশের ঘর থেকে বাবা-মা শুনতে পায়নি। সচকিতে চারদিক ভালো করে দেখে নিল সে। সে যে সত্যিই এতক্ষণ একটা দুঃস্বপ্নের জগতে বন্দি ছিল, এবং শেষ পর্যন্ত সত্যিই সে বেরিয়ে আসতে পেরেছে—এটা ভেবে অল্প অল্প স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে লাগল সে। বুকের ধুকপুকানিটা তখনও হয়ে চলেছে…
বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল রাজা। জানলাটা খুলে, বাইরের স্নিগ্ধ বাতাস নিতে লাগল। স্বপ্নটা তাকে যেন এখনও রেখেছে, গেঁথে গিয়েছে তার স্মৃতিতে। এখনও যেন মনে হচ্ছে, ইঁদুরগুলো তার চামড়ার নীচে শরীরের ভেতর কিলবিল করছে, তাকে ভেতর থেকে কামড়াচ্ছে।
হঠাৎই… হাওয়ার একটা ঝাপটা এসে তার মুখে লাগল… আর সেই সঙ্গে তার নাকে এসে আঘাত করল সেই গন্ধটা… রাজা বুঝল, তার হাত কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে…
গন্ধটা যেন হঠাৎই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। শুধু তার স্বপ্নে নয়। বাস্তবেও সেটা একই রকম তীব্র, অপ্রতিরোধ্য।
সে তার ঘরের চারপাশে তাকাল, আতঙ্ক বাড়ছিল। কী যেন একটা দৌড়ে চলে গেল না? ওটা কী? ইঁদুর? তারা কি ওর পিছন পিছন ঘুরে বেড়াচ্ছে? সে বিছানার নীচে, ঘরের কোণগুলোতে খুঁজল, কিন্তু কিছুই পেল না। ইঁদুরের কোনো চিহ্নই ছিল না।
তবুও, গন্ধটা রয়ে গেছে। পচা, বীভৎস, শ্বাসরুদ্ধকর।
বিছানার কিনারায় এসে বসে পড়ল রাজা, মাথাটা দু-হাতে চেপে ধরে বসে রইল। মনটাকে শান্ত করে ভাবার চেষ্টা করছিল সে! কী ঘটছে, তা বোঝার চেষ্টা করছিল। এতক্ষণ ধরে সে যা সব দেখল—বৃদ্ধ লোকটা, ইঁদুরগুলোর তাঁকে ছিঁড়ে খাওয়া—তারপর ওকে…! এটা তো শুধু একটা স্বপ্ন। সেটাই হতে হবে। কিন্তু কেন? এটা এতটা বাস্তব মনে হল?
আর এই গন্ধটা যাচ্ছে না কেন?
সেই রাতের পর আরও তিনটে দিন পেরিয়ে গেল, কিন্তু রাজা এখনও তার মাথার গভীরে বসে-কা অস্বস্তিকর অনুভূতি থেকে মুক্তি পেতে পারেনি। অফিসে বলে দিন পাঁচেকের ছুটি নিয়েছে। গার্গীকেও জানিয়েছে শরীরটা ভালো নেই, একটু একা থাকবে। গার্গী একটু টেনশন করলেও শেষমেশ রাজার অনুরোধে ফোন রেখে দেয়। বাবা-মা-ও চিন্তা করবেন বলে গোঁজামিল দিয়ে সে বলেছে, ক-দিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করবে। তার সরকারি অফিসে যে ওয়ার্ক ফ্রম হোম বলে কিছু নেই, সেটা ওঁরা জানেন না, তাই মিথ্যেটা পার পেয়ে গেল।
সে ভেবেছিল, এই ক-দিন ভালো করে একটু ঘুমোবে, কিন্তু তার উপায় ছিল না। যতবার চোখ বন্ধ করেছে, কেবলমাত্র সেদিনের ঘটনাগুলো দেখতে পেয়েছে। আর ইঁদুরের দুর্গন্ধটা তো আছেই তাকে সর্বক্ষণ ঘিরে, জামা-প্যান্ট, বেডশিট সব থেকেই যেন গন্ধটা বের হচ্ছে। কিন্তু সে এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেনি। গার্গীকে তো না-ই, এমনকি কামুর সঙ্গেও এই ক-দিনে কথা হয়নি ওর। তবে কামু নিজেই শেষ পর্যন্ত আজ দুপুরে ফোন করে তার সঙ্গে বাইরে কোথাও দেখা করতে চেয়েছে। খুব নাকি দরকারি একটা কথা আছে। ইচ্ছা না-থাকা সত্ত্বেও রাজা তার সঙ্গে সন্ধ্যায় দেখা করতে রাজি হল। সে জানে, রাজি না হয়ে উপায় নেই, কামু নাছোড়বান্দা!
এখন সন্ধ্যা সাতটা। রাজা বসে আছে ‘ওভার দ্য টপ’-এ, ছোটো একটা রুফটপ কাফে, ওর ফ্ল্যাট থেকে সামান্য দূরে। হাতে এক কাপ কফি, কামুর জন্য অপেক্ষা করছে। জায়গাটা প্রায় ফাঁকা, কয়েকজন অতিথি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে, হালকা কথাবার্তার শব্দ পুরো পরিবেশটিকে ভরিয়ে রেখেছে। রাজা মোবাইলের উপর আঙুল ঠুকতে ঠুকতে নিজের মনকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছিল।
কয়েক মিনিট পর কামু এল। রাজা দেখল, এই ক-দিনে কামুর চেহারায় খানিক পরিবর্তন হয়েছে। আগের সেই বেপরোয়া ডাকাবুকো ভাবটা আর নেই। তার চোখ গর্তে ঢুকে গিয়ে, চোখের নীচে গাঢ় কালি জমেছে, মুখ শুকনো আর বেশ কয়েক দিনের না-কামানো দাড়ি তার দু-গালে একটা রুগ্ণ ছাপ এনে দিয়েছে। তার সেই স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাসী ভাবটা যেন হারিয়ে গেছে, আর তার জায়গায় এসেছে বিধ্বস্ত, ভয়ার্ত একটা মানুষ। ভয় যেন ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
চারদিকে একবার সচকিতে দেখে নিয়ে ধড়াস করে বসে পড়ল সে, রাজাকে প্রায় না দেখেই তার সামনে রাখা কফির কাপটা তুলে নিয়ে একটা বড়ো চুমুক দিল।
বেশ কিছুক্ষণ তাকে লক্ষ করল রাজা, উদ্বেগ তার মনের ভেতর খোঁচা দিতে লাগল। শেষ পর্যন্ত বলেই উঠল, “কামু… তোকে এত খারাপ দেখাচ্ছ কেন? কী হয়েছে?”
কী হয়েছে, সেটার একটা আন্দাজ ছিল রাজার, তাও কামুর মুখে সে শুনতে চায়।
কামু প্রথমেই রাজার দিকে চোখ তুলে তাকাল না। একদৃষ্টে সে চেয়ে রইল কফির কাপের দিকে, তার হাত একটু একটু কাঁপছিল। একটা লম্বা বিরতির পর মুখ খুলল সে, কণ্ঠস্বর ছিল নীচু, ক্লান্ত।
“সেই বাড়িটা, সেই বুড়ো… সেই রাত… সেই থেকে প্রতিরাতে একই স্বপ্ন দেখছি… সেই বুড়োটকে… আমি ধাক্কা দিয়েছিলাম… সে মেঝেতে পড়ে থাকে আর ইঁদুরের দল তাকে ছিঁড়ে খুবলে খাচ্ছে!…”
কথা বলতে বলতে থেমে গেল কামু, তার চোখ ভয়ে ভয়ে চারপাশে ঘুরতে লাগল, যেন সে ভাবছে, বুড়ো লোকটা এখানেই হাজির হবে।
রাজার এদিকে ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছিল। সে আন্দাজ করেছিল, কামু হয়তো তার দেখা স্বপ্নটাই দেখছে, কিন্তু কথাটা কামুর মুখে শুনে আর তার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ দেখে একটা স্থবিরতা অনুভব করছিল সে। কিন্তু সে চুপচাপ বসে রইল, কামুকে কথা বলতে দিল।
“প্রতিরাতে আমি ঘুম থেকে উঠে ইঁদুরের গন্ধ পাই, রাজা! সেই… সেই পচনের গন্ধ। মনে হয়, ওরা আমার ঘরেই আছে। আমার বিছানার নীচে! আমি শ্বাস নিতে পারি না, দম বন্ধ হয়ে আসে। চিন্তাভাবনাটাও যেন কেমন ঘেঁটে যায়।”
“তুই ডাক্তার দেখিয়েছিস?” রাজা শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করে।
“নাহ্… ডাক্তার, কী করবে ডাক্তার? ডাক্তার কী করবে?” হঠাৎই যেন খেপে উঠল কামু, “আমি… আমি জানতে চাই, রাজা। আমাকে আবার যেতে হবে। আমি আবার যাব সেই মন্দিরটায়… জানতে হবে, ওই বুড়ো লোকটা সত্যিই মারা গেছে কি না, সত্যিই সে মারা গেছে… নাকি এটা আমার মাথার ভ্রম।”
কামুর কথা শুনে রাজার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল। কামুর বর্ণনা তার নিজের দুঃস্বপ্নের মতোই স্পষ্ট ছিল, যেটা সে মরিয়া হয়ে ভুলে থাকতে চাইছিল। তার হাসিখুশি জীবনটা একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছে বাড়িটা। এই অবস্থায় সেখানে আবার ফিরে যাওয়ার কথা ভাবলেই তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল। জায়গাটা ইতোমধ্যেই তার কাছে জলজ্যান্ত দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে; বাস্তবে আবার সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে চাইছিল না সে।
কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে রাজা বলল, “কামু, আমরা সেদিন মদ খেয়েছিলাম, নেশা মাথায় চড়ে গিয়েছিল। যা ঘটেছে, সেটা একটা… ভুল। কিন্তু সেখানে ফিরে গিয়ে কোনো সমাধান হবে না। বরং আরও খারাপ হবে।”
“রাজা… একটু বোঝ… আমাকে সেখানে যেতে হবে। গিয়ে যখন দেখব, বুড়ো সেখানে মরে পড়ে আছে… আমার মন শান্ত হবে…” শেষের কথাগুলো প্রায় ফিশফিশ করে বলল।
“বুড়ো মরে পড়ে আছে দেখলে তোর মন কেন শান্ত হবে?” রাজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
নেকড়ে বাঘের মতো খ্যাঁস খ্যাঁস করতে করতে কামু বলল, “আমার মনে হয় ওই বুড়োটা মানুষ নয়… আমার মনে হয়, ওই বুড়োটা সেদিন মরেইনি! আমার মনে হয়, ওই বুড়োটা আমার মাথার সঙ্গে খেলছে…!”
“কিন্তু কেন? এসব করে ওর লাভ কী?” রাজা প্রশ্ন করে।
“ওই যে… আমরা ওর মন্দিরে ঢুকে ওর ঘুম নষ্ট করেছিলাম!’’ কামু বলল।
“ওর মন্দির? ওই বুড়োটার মন্দির নাকি?” জিজ্ঞেস করল রাজা।
এবার কামু অদ্ভুত চোখে রাজার দিকে তাকাল, তারপর উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে হাসতে হাসতে বলল, “আরে, ওই বুড়োটাই মন্দিরের দেবতা! ওই বুড়োটাই ইশরাক!”
“আরে, তুই এত শিয়োর হচ্ছিস কী করে?” রাজা বলে ওঠে, “তোর ধারণা তো ভুলও হতে পারে!”
কামু সামনের দিকে ঝুঁকল, তার চোখে সেই আগের মতোই আতঙ্কের আভাস: “আমার ধারণাটা ভুল… সেটা নিশ্চিত করতেই আমি মন্দিরটায় যেতে চাই। একবার জাস্ট গিয়ে যদি দেখি৷ বুড়ো এখনও মরে পড়ে আছে, তাহলেই আমার সমস্ত ভয় কেটে যাবে। বুঝে যাব, যা দেখছি, সব আমার মনের ভুল!… আসলে আমি চাইলে একাই যেতে পারি, কিন্তু সাহস হচ্ছে না! আমি চাইছিলাম, তুই যদি আমার সঙ্গে একটু…”
“তুই একটা বদ্ধপাগল!” কামুর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল রাজা, “সেই বুড়ো দেবতা ইশরাক হোক আর না-ই হোক, আমি আর ওই বাড়িতে যাব না। আর যদি সে বুড়ো সাধারণ মানুষ হয়েও থাকে, তোর কী ধারণা, তার ডেডবডি এখনও সেখানে পড়ে আছে? বডি পচনের গন্ধে এতদিনে এলাকার লোকজন পুলিশ ডেকে বডি সরিয়ে ফেলেছে!”
কামু হয়তো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু রাজা তাকে আর কিছু বলতে দিল না।
“সরি ভাই, আমি উঠলাম।” কথাটা বলে রাজা উঠে দাঁড়াল, “তাও যদি তোর মনে হয়… তুই একা যেতে পারিস, আমি আর কোনোমতেই ওই বাড়িটায় যাচ্ছি না! নিকুচি করেছে…!”
কথাটা বলে কাফের টেবিলে একটা একশো টাকার নোট রেখে বেরিয়ে গেল রাজা। দরজার দিকে তাকিয়ে বোকার মতো বসে রইল কামু।
পৌনে আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরে এল রাজা। মা-কে এক কাপ চা করতে বলে নিজের ঘরে ফিরে চুপচাপ বসে ছিল সে। কামুর সঙ্গে কথোপকথন তার মনে তখনও দুশ্চিন্তার ঝড় তুলে ঘুরপাক খাচ্ছিল। একবার স্নান করে আসবে কি না ভাবছে সে, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। কামু ফোন করছে ভেবে বিরক্ত মুখে ফোনের দিকে তাকিয়ে রাজা দেখল, স্ক্রিনে গার্গীর নাম ভাসছে। এক মুহূর্তের জন্যই যেন ভয়ের কুয়াশার মধ্যে তার মনে এক টুকরো উষ্ণতা এনে দিল এই নামটা।
“হ্যালো…!” গার্গীর কণ্ঠে সেই চিরপরিচিত উজ্জ্বলতা, “বাবা তোমার সঙ্গে কাল দেখা করতে চাইছেন।”
“কেন?” রাজা সংক্ষেপে প্রশ্ন করল।
“আরে কী আবার, তোমার আঙুলের মাপ নেবেন, wedding ring-এর জন্য।” জলতরঙ্গের মতো বলল গার্গী, “তা ছাড়া ড্রেসের মাপজোখ নেবেন। অনেক প্ল্যান আছে ওঁর। বিয়ে নিয়ে উনি খুবই এক্সাইটেড।”
ক্ষণকালের স্বস্তিটা মুহূর্তের মধ্যেই কেটে গিয়ে বুকটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল। ‘wedding রিং’ কথাটা কানে যেতেই হঠাৎ করে অনেক কিছু মনে পড়ল তার। এত কিছুর মধ্যে সে তো ভুলেই গিয়েছিল কথাটা…
wedding ring! বিয়ের আংটি! গার্গীর জন্য সে-ও একটা বানিয়েছিল, হিরে-বসানো চব্বিশ ক্যারেটের জিনিসটা প্রায় দু-লাখের কাছাকাছি দাম। সেই কবে থেকে টাকা জমাচ্ছে সে গার্গীর আঙুলে সেই আংটিটা গলিয়ে দেওয়ার স্বপ্নে!
গার্গী আরও কিছু একটা বলছিল, কিন্তু রাজা তার মুখের ওপর বলল, “গার্গী, বাবু, আপাতত ফোনটা রাখছি।”
“কেন? কী হয়েছে?” গার্গী আকাশ থেকে পড়ল, “আমার কথা আছে, রাজা…!”
রাজা গলা পরিষ্কার করে বলল, “হ্যাঁ, আরে… কাল আসছি তো… আঙ্কলের সঙ্গে দেখা করব। তখন কথা হবে!” সে কথাগুলো একপ্রকার জোর করে মুখ থেকে বের করে আনল, তার মন তখন অন্য কোথাও: “আমি তোমাকে পরে ফোন করছি, ঠিক আছে?”
ফোন রাখার পর সে সোজা উঠে দাঁড়াল, উদ্বেগের একটা ঢেউ তার মধ্যে দিয়ে বয়ে গেল। তার চোখ ঘরের চারপাশে ছুটে বেড়াতে লাগল, সেই ছোটো মখমলের বাক্সোটা গেল কোথায়? গার্গীর রিংটা ছিল সেটার মধ্যে। স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন বিকেলে জুয়েলারসের দোকান থেকে আংটিটা নিয়ে পকেটে রেখেছিল সে। সেদিন… সেদিন সন্ধ্যায় সে দেখা করেছিল কামুর সঙ্গে! গিয়েছিল সেই অভিশপ্ত বাড়িটায়…
মা এসে চা দিয়ে গেলেন। মনের সমস্ত উদ্বেগ চাপা দিয়ে বসে রইল সে। চা রেখে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর, রাজা ঝড়ের মতো ঘরের তল্লাশি নিতে থাকল। ড্রয়ারটা তছনছ করল, আলমারি ওলট-পালট করল, তাক খালি করল, পকেট চেক করল। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না।
প্রতিমুহূর্তে তার আতঙ্ক বাড়ছিল। স্পষ্ট মনে করতে পারছিল গয়নার দোকান থেকে আংটি নেওয়ার মুহূর্তটা, রিংটা আলোয় ধরে দেখার সময় দোকানের লোকটার প্রশংসাসূচক কথা।
চট করে ফোন বের করে সে দোকানে ফোন করল। কোনোভাবে আংটিটা ফেলে এসেছে কি না জানতে চাইল। কিন্তু যা ভেবেছিল, ঠিক তা-ই। সেখান থেকে তাকে জানিয়ে দেওয়া হল, আংটি সে সেদিন নিয়েই গেছে।
ফোন রেখে বিছানার ওপর বসে পড়ল রাজা। কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে তার। কামুর সঙ্গে সেই রাতের টুকরো টুকরো স্মৃতি তার মাথায় ঘুরতে লাগল… সেখানে পৌঁছোনো, মদ খাওয়া, তর্কবিতর্ক, তারপর বুড়ো লোকটা… কামুর তাকে জোরে ধাক্কা…
আর তারপর মনে পড়ল… যখন বুড়ো লোকটা ধাক্কা খেয়ে সশব্দে আছাড় খেয়ে পড়ল… ঠিক তার কয়েক মুহূর্ত পরেই, কামুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে, পকেট থেকে রুমাল বের করে সে তার কপালের ঘাম মুছেছিল। স্পষ্ট বুঝতে পারল, রুমাল বের করার সময় আংটিটা সেখানেই পড়ে গেছে… আংটিটা সেই বাড়িতেই হারিয়েছে সে। সেই জায়গা, যেখানে নিজের অজান্তে হলেও, কামু খুন করে এসেছে… সে জায়গা, যেটা ওর স্বপ্নে বারবার ফিরে আসছিল।
“শান্ত! শান্ত, রাজা, শান্ত!” গভীর শ্বাস নিয়ে, নিজের নার্ভ শান্ত করার চেষ্টা করল রাজা। সে গার্গীকে এটা বলতে পারবে না—অন্তত এখনই না। কিন্তু আংটিটা ছাড়া সে আগামীকাল গার্গীদের বাড়ি উপস্থিত হতে পারবে না। ওর ইচ্ছা ছিল, গার্গীর বাড়ি গিয়ে একবার আংটিটা ওকে দেখিয়ে আসবে… আর তা ছাড়া নতুন করে আংটি বানানোর মতো টাকা নেই তার কাছে। বিয়ের অনুষ্ঠান, জামাকাপড়, আরও নানা কাজে সমস্ত টাকা ধরা আছে… আর সব থেকে বড়ো কথা, এত দামি একটা আংটি এইভাবে হারিয়ে ফেলতে পারবে না সে… একটাই উপায় ছিল, সেই অভিশপ্ত জায়গায় আবার যাওয়া।
কিছুক্ষণ ভেবে মনস্থির করে নিল রাজা। চোয়াল শক্ত করে ফোনটা তুলে নিল এবং কামুর নম্বরে ডায়াল করল। কয়েক সেকেন্ড রিং করার পর কামু ফোন ধরল, তার কণ্ঠস্বর সেই আগের মতোই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত।
“রাজা? বলে ফেল…” কামু তার কাছ থেকে খারাপ কিছু শোনার অপেক্ষাতেই ছিল।
“আমি… আমি মনে হয়, ওই বাড়িতে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হারিয়ে এসেছি।”
“গুরুত্বপূর্ণ জিনিস?” কামু শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী জিনিস, ভাই?”
রাজা তাকে সব কথা খুলে বললাম। সে কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “তুই শিয়োর, আংটিটা সেদিন তোর সঙ্গে ছিল?”
“আরে হ্যাঁ! আমি দোকানে ফোন করেছিলাম, তারাও কনফার্ম করেছে, আমি রিং নিয়ে গেছি!” রাজা মরিয়া হয়ে বলল।
কামু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কবে যাবি?”
“আজ এখনই…!”
“কাল সকালে গেলে হত না?” কামু উপদেশের সুরে বলল।
“একেবারেই না, ভাই! এক লাখ বিরাশি হাজারের আংটি! আমায় এখনই যেতে হবে! তুই না যাস… আমায় একাই…!”
“আরে থাম তুই! একা কেন যাবি! তুই মোড় মাথায় দাঁড়া, আমি গাড়ি নিয়ে আসছি!”
বাতাসটা আর্দ্রতায় ভারী হয়ে ছিল, রাজা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল বাড়িটার দিকে। রাস্তা জনশূন্য, শুধু পরিত্যক্ত বাড়িটা প্রতিদিনের মতোই ছায়াকালো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল। কামু গাড়িটা পার্ক করে, তার পাশে এসে দাঁড়াল। বাইরে থেকে নীরব কিন্তু ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত, তার মুখে চাঁদের ম্লান আলো এসে পড়েছে। একটু অপেক্ষা করে, রাজা চুপচাপ মরচে-পড়া লোহার গেটটার দিকে এগিয়ে গেল।
রাজার মনে হল যেন এই ক-দিনে বাড়িটা আগের চেয়েও একটু বেশি ক্ষয়ে গেছে। এই ক-দিনে বাড়ির আত্মাটা যেন আরও পচে গেছে। কয়েক পা যেতে-না যেতেই গভীর থেকে যেন ক্ষীণ একটা চিৎকার ভেসে এল, সেই সঙ্গে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ইঁদুরের দৌড়োনোর অব্যর্থ শব্দ।
রাজার গলা শুকিয়ে গেল। সে চেষ্টা করল নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার। আংটিটার কথা, গার্গীর কথা, আর সেই বুড়ো লোকের কথা—সব মিলিয়ে মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিল ওর। পচা একটা গন্ধ তার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে অবশ করে ঢুকে যাচ্ছিল তার স্নায়ুর মধ্যে।
বাড়িটা ঠিক যেমন তারা রেখে গিয়েছিল—ভেজা, নোংরা আর পচনের দুর্গন্ধে ভরা, তেমন তো ছিলই, কিন্তু সেই সঙ্গে যেন আরও কিছু একটা যুক্ত হয়ে ছিল… অপার্থিব কিছু একটা। অদৃশ্য কারও একটা উপস্থিতি যেন টের পাচ্ছিল ওরা। মনে হচ্ছিল, দেয়ালগুলো যেন তাদের দেখছে, শ্বাস নিচ্ছে, তাদের কোনো একটা ভুল পদক্ষেপের অপেক্ষা করছিল।
“আংটিটা কোথায় হারিয়েছে বলে তোর মনে হয়?” কামু জিজ্ঞেস করে।
রাজা বলে, “তুই বুড়োকে ধাক্কা মারলি, তারপর ছুটে নীচে এলি, আমিও চলে এলাম। তারপর দু-চারটে কথা বলেই, আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলাম।”
“ও হ্যাঁ!” এবার কামুও বলে ওঠে, “তুই বললি, লোক জানাজানি হলে তোর সরকারি চাকরি নিয়ে সমস্যা হয়ে যাবে!”
রাজা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে!
“তাহলে তো সেই মেঝের ফাটলটার কাছে চল, ওখানেই হয়তো পড়ে আছে তোর আংটি।”
রাজা বলল, “কিন্তু… সেই বুড়ো লোকটার মৃতদেহটা কী হল, বল তো? সেটা বোধহয় কেউ সরিয়ে নিয়ে গেছে! না হলে তো পচা গন্ধে মাথা খারাপ হয়ে যেত! নির্ঘাত পুলিশে এসে লাশ বের করে নিয়ে গেছে!”
কামু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “হতেও পারে, আবার না-ও পারে!”
“মানে?” রাজা জিজ্ঞেস করে।
“এখন এত মানে ভেবে কাজ নেই! চল, তোর জিনিস খুঁজি!”
দুই বন্ধু এগিয়ে চলল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তারা বাড়িটার একতলার সেই জায়গাটার কাছে চলে এল। কামু এগিয়ে গিয়ে মেঝের ফাটলটাকে দেখতে লাগল। টর্চ জ্বালিয়ে নীচে দেখতে লাগল। রাজাও তার পিছনে এসে উঁকি মারল। কিচকিচ করে খুব মৃদু ইঁদুরের ডাক শোনা যাচ্ছে, কিন্তু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। আলো যেন ফাটলের ভেতর পড়ে অন্ধকারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
রাজা কিছুক্ষণ সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলে উঠল, “আমি খুঁজতে শুরু করলাম। তোর দেখা হয়ে গেলে তুইও একটু তল্লাশি করিস!”
কথাটা বলেই রাজা মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে মেঝেতে ফেলে দেখতে লাগল। মাটির ওপর ঘাস গজিয়েছে। এর মধ্যেই কামু এগিয়ে এসে বলল, “তুই এই সাইডটা দেখ, আমি ওই সাইডটা দেখি!” এই বলে সে অন্যদিকটায় টর্চ মেরে মেরে দেখতে লাগল।
একতলাটা অনেকটা জায়গা নিয়ে। প্রায় মিনিট দশেক একটা দিক খোঁজাখুঁজির পরও যখন কিছুই পাওয়া গেল না, তখন রাজা অসহায়ভাবে কামুর দিকে তাকাল।
“পেলি ভাই…?”
কামুও নিরুপায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে না-সূচক মাথা নাড়াল। রাজা কী করবে, বুঝতে পারল না।
“আচ্ছা চল তো, ওইদিকটা দেখি!” কামু অন্য একটা দিক দেখিয়ে বলল।
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!” রাজা প্রায় কেঁদেই ফেলল।
“আরে এসেছি যখন, ভালো করে খুঁজে নিই, চ! তুই যা ওদিকে!” কামু টর্চের ইশারায় রাজাকে একটা দিক দেখিয়ে দিল।
মোবাইলের আলো ফেলে রাজা সেদিকটা এগিয়ে গেল। কিছুটা এগিয়ে সে একটা দেওয়ালের সামনে এসে দাঁড়াল। নীচতলাটা এতটা বিস্তৃত, সেটা আগের দিন এসে বোঝেনি সে। চারদিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাটির দিকে তাকাতে যাবে এমন সময়… মোবাইলের আলোটা গিয়ে পড়ল সামনের দেওয়ালে…
বাড়ির বাকি দেওয়ালগুলোর মতো এটা নয়… এটা একটু অন্যরকম। এটার গায়ে একটা দেওয়ালচিত্র আঁকা। দেওয়ালটা বেশ উঁচু, এবং চিত্রটাও দেয়ালের নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, ভাঙা ছাদের ফাটল দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ে দেওয়ালচিত্রটাকে উজ্জ্বল করে তুলেছিল। অনেক দিনের পুরোনো ছবিটা, সময়ের কালে অনেকটা ক্ষয়েও গিয়েছিল, কিন্তু তাও, এই আলোতেও সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
এক বিশালবপু, বিকৃতমূর্তি অবয়ব। তার মাথায় চুল নেই, চোখ দুটো বড়ো বড়ো, কানের লতি দুটো ঝুলে পড়েছে, এবং মুখে অক্টোপাসের মতো অজস্র শুঁড়! অদ্ভুত এই দেবতা দু-হাতের একটায় ধারণ করে আছেন একটি মানুষের মাথা এবং অন্য হাতে একটা… রাজা কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখল… একটা মস্তিষ্ক!
রাজা আরও অবাক হয়ে দেখল, দেবতাটি সিংহাসনে বসে আছেন, এবং সিংহাসনের নীচে ঝাঁকে ঝাঁকে ইঁদুর, সিংহাসনটা বলতে গেলে ইঁদুরের ওপরেই বসে আছে! ইশরাক, এই সেই দেবতা, যার কথা বুড়ো লোকটা বলেছিল। গোলাকার চোখ পাকিয়ে সে যেন রাজার দিকেই দেখছে, আর তার মুখ থেকে ঝুলতে-থাকা শুঁড়গুলো যেন ওর দিকেই এগিয়ে আসছিল। কিন্তু সব থেকে আশ্চর্যজনক ছিল ইশরাকের দু-হাতে ধরা ওই মাথা আর ওই মস্তিষ্কটা… রাজা আরও ভালো করে দেখল ইশরাকের হাতের তালুর ওপর মানুষের মাথাটা বসানো। আর মাথাটার চোখ দুটো বন্ধ। যেন মানুষটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে…
হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠল, তাকে তার আচ্ছন্নতা থেকে টেনে বের করে আনল ফোনের বাজনা। রাজা চোখের পলক ফেলল, মুহূর্তের মধ্যে বিভ্রান্তি কাটিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। সেই গয়নার দোকান থেকে ফোন আসছে…
“হ্যালো?” নিজের গলা নিজের কাছেই উদ্ভ্রান্তের মতো শোনাল।
“মিস্টার লাহা? রায়চৌধুরী জুয়েলারস থেকে বলছিলাম!” মহিলাকণ্ঠ বলে ওঠেন।
“হ্যাঁ বলুন!” চাপা গলায় বলল রাজা।
“স্যার, আপনি একটু আগে বোধহয় ফোন করেছিলেন, জিজ্ঞেস করছিলেন, আংটিটা আমাদের দোকানে ফেলে এসেছিলেন কি না?”
“হ্যাঁ… হ্যাঁ, করেছিলাম!”
“স্যার, আপনি ভুলে গেছেন… আপনি সেদিন আংটিটা নিয়ে জাস্ট বেরিয়ে যাওয়ার পর, আবার ফিরে এসে আমাকে বললেন, আংটির মডেলটা চেঞ্জ করে অন্য মডেলটা দিতে, আসলে স্যার, দুটো মডেল নিয়ে আপনি কনফিউজ় হয়েছিলেন… শেষ পর্যন্ত ঠিক করতে পারছিলেন না!”
“ও তার মানে… তার মানে আংটি আপনাদের কাছেই আছে, তা-ই তো?”
“হ্যাঁ, স্যার। আপনার পছন্দের মডেলটা তখন আমাদের কাছে ছিল না, বলেছিলেন আপনাকে… সেটা আজ আশার কথা ছিল! এইমাত্র এসেছে… আপনি আগামীকাল এসে দেখে নিয়ে যান প্লিজ়! আগের মডেলটাও দেখবেন… দুটো পাশাপাশি মিলিয়ে যেটা পছন্দ নেবেন।”
“কিন্তু আজ সন্ধ্যায় আমি যখন ফোন করলাম, তখন এক ভদ্রলোক বললেন…!”
“হ্যাঁ আসলে, উনি জানতেন না, আপনি আংটিটা ফেরত দিয়ে গেছেন। ব্যাপারটা বেশি কেউ জানত না। তাই একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে! সরি স্যার, কিছু মনে করবেন না!”
মনটা খুশিতে ভরে উঠেছিল রাজার। মহিলাকে ঠিক কী বলে ধন্যবাদ দেবে, সেটাই ভাবছে, এমন সময়… তার চোখ চলে গেল ইশরাকের দিকে এবং সব কিছু স্পষ্ট হতে শুরু করল…
আংটি এখনও দোকানে? কিন্তু সেটা সে ভুলে গেল কী করে? সত্যিই তো! সেদিন দোকান থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবারও সে ফিরে গিয়েছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, দ্বিতীয় যে অপশনটা ওরা দেখিয়েছিল, সেটা গার্গীর আঙুলে বেশি মানাবে। আর তাই দোকানে ফিরে যায় সে…
“কিন্তু… আমি… এটা ভুলে গেলাম কী করে…” তার গলা থেমে গেল, আর তার মনে বিভ্রান্তি ভিড় করতে শুরু করল।
তার চোখ দেওয়ালচিত্রের দিকে নিবদ্ধ, আর এবার ইশরাকের ঠিকরে বেরিয়ে-আসা চোখ আর চারদিকে ছড়িয়ে-থাকা শুঁড়ের রাশি দেখে মনে হল, সেই দেবতা যেন ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে… একটা ব্যঙ্গাত্মক, বিদ্রুপের হাসি। শুধু তা-ই নয়, সেই হাসির সঙ্গে মিশে আছে বিদ্বেষের ঝিলিক, যেন তার সেই বিস্ফারিত চোখ দুটো, রাজাকে নিয়ে উপহাস করছে।
মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠান্ডা শিহরন বয়ে গেল, বুকের ভেতর দামামা বাজতে লাগল। সে বুঝতে পারল, দোকানে গিয়ে আংটি ফেরত দেওয়ার কথাটা ইশরাক তাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল নিজের মায়াবলে।
স্বপ্নগুলো… প্রতিরাতে ইশরাক তাকে বারবার একই স্বপ্ন দেখিয়েছে। সে আর কামু এই বাড়িতে আসছে, মদ খাচ্ছে, ঝগড়া করছে, তারপর বৃদ্ধ পূজারির আগমন, কামুর তাকে ধাক্কা দেওয়া, এবং রাজার পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল মোছা! দেবতা ইশরাক তার চিন্তাগুলোকে বুনেছিল, সেগুলোকে বিকৃত করেছিল, তার অবচেতন মনে ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে, আংটি এই বাড়ির ভেতরে কোথাও সে ফেলে এসেছে!
আর এত কিছু সে করেছে ওদেরকে আবার এই মন্দিরে ফিরিয়ে আনার জন্য…
কিন্তু কেন? সম্ভবত কামু তার পূজারিকে হত্যা করেছে… আর সেটার প্রতিশোধ নিতেই… অথবা তাদেরকে দেবতার পছন্দ হয়েছে, আর তাই তাদের নিয়ে কেবলমাত্র খেলা করছে সে…
কামুকেও নানাভাবে ভারাক্রান্ত করে দিচ্ছিল ইশরাক, কিন্তু রাজাকে ছাড়া সে-ও এখানে আসতে চাইবে না, সেটা জানত এই দেবতা, আর তাই রাজার মনেও একটা ভ্রান্ত ধারণার সঞ্চার করে দুজনকেই এখানে টেনে আনল সে…
রাজা অবাক হয়ে ইশরাকের দু-হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল… একটা ঘুমন্ত মানুষের মাথা আর অন্য হাতে একটা মস্তিষ্ক! অর্থাৎ ঘুমন্ত মানুষের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে সে… অবিশ্বাস, দুঃস্বপ্ন আর বিভ্রান্তির দেবতা… ইশরাক!!!
একটা বিকট চিৎকারে ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল রাজার…
“কামু? ওটা কামুর গলা না?” কথাটা বলতে বলতে সে একবার দেওয়ালটির দিকে তাকাল! ওটা কী? রক্ত? ইশরাকের মুখে রক্ত লেগে নাকি? এতক্ষণ তো ছিল না?
আবারও চিৎকার করে উঠল কামু! মরণ চিৎকার!
কামুকে আর দেখা যাচ্ছে না! ইঁদুরের দল তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ছেঁকে ধরেছে, কেবল তার যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ পুরোনো বাড়িটার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে। কামুর রক্তে উন্মত্ত হয়ে তার দেহের মাংস কেটেকুটে খাচ্ছিল ইঁদুরগুলো। বন্ধুর এই অবস্থা দেখে গলা শুকিয়ে গেল রাজার। চিৎকার করে সাহায্য চাইবে, সেই শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলল! কামুকে বাঁচানোর কথা তার মাথাতেই এল না, সে বেরোবার পথ খুঁজতে লাগল! কিন্তু বের হবার পথ কই? চারদিকে কেবলই ইঁদুর… মেঝেতে পা ফেলা যাচ্ছে না! গায়ে উঠে আসতে চাইছে ওরা… এমনকি… এমনকি… ইঁদুরগুলো ঘনসংবদ্ধ হয়ে দেওয়ালে উঠে পড়েছে, মিশমিশে কালো একটা চাদরে যেন ঢেকে দিয়েছে চারদিক!… দরজাটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! ইঁদুরগুলো চারদিক ঘিরে ফেলেছে! তাদের কিচকিচ শব্দ আর দুর্গন্ধে রাজার মন এবং মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল…
কামুর চিৎকার ততক্ষণে গোঙানিতে পরিণত হল… রাজা বুঝতে পারল পালাবার পথ নেই… ইঁদুরের দল কামুকে ছেড়ে এখন চারদিকে ছোটাছুটি করতে করতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে… কয়েক পা পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হোঁচট খেয়ে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল… উন্মত্ত ইঁদুরের দল এবার ছেঁকে ধরল তাদের দ্বিতীয় শিকারটিকে…
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, পবিত্র ঘোষ
