এই নশ্বর জীবনের মানে
লেখক: মোহনা দেবরায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ঘরে ঢুকেই মেজাজটা তিতকুটে হয়ে গেল পদ্মর। লোকটা আবার চুল্লু টেনে ঢুকেছে আজ। নিজে তো কোনো কাজ করবে না, শুধু বউয়ের পয়সায় মাল খাবে। ওকে দেখামাত্রই নোংরা গালাগাল করে উঠল লোকটা। তারপর নীচু গলায় ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, কিছু খাবার আছে কি না ঘরে।
আমল না দিয়ে হাতের প্লাস্টিকের প্যাকেটগুলো নামিয়ে রাখতে রাখতে খাটের এককোণে চোখ পড়ল। এক টুকরো কাগজ। জানলাটা খোলা ছিল। কেউ ফেলে দিয়ে গেছে, মনে হয়। পদ্মও ফেলেই দিতে যাচ্ছিল জিনিসটা। কী মনে হওয়াতে ভাঁজটা খুলল।
বাংলা ভাষাটা পড়তে পারে সে। চিরকুটের মধ্যে গোটা গোটা অক্ষরে বাংলায় লেখা:
“পদ্ম, মোটা এক্সট্রা টাকা রোজগারের ইচ্ছে থাকলে বুধবার রাত দশটা নাগাদ ভবেশের গলির তিন নম্বর বাড়ির নীচটায় চলে আসবে। কথা দিচ্ছি, লোকসান হবে না।”
সেটার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে ঠোঁট কামড়ায় পদ্ম। একবার মনে হয়, ফেলে দেয়। পরক্ষণেই নিজের বেওড়া স্বামীটার দিকে তাকায়। রিকুর কথা মনে হয়। সবে ক্লাস থ্রি-তে উঠেছে। আজকাল পড়াশোনার যা খরচ! বাপটা তো কোনো কর্মের নয়! তার ওপর ভরসা করা চলে না।…
কাগজটা ব্লাউজ়ের ভেতর সাবধানে গুঁজে রাখে।
***
“তেরা মুঝসে হ্যায় পহলে কা নাতা কোই
ইউঁ হি নহিঁ দিল লুভাতা কোই
তেরা মুঝসে হ্যায় পহলে কা নাতা কোই
ইউঁ হি নহিঁ দিল লুভাতা কোই
জানে তু ইয়া জানে না
মানে তু ইয়া মানে না…”
ছেলেটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিল অদ্বিতীয়া। কোন ডিপার্টমেন্ট, খোঁজ লাগাতে হচ্ছে। ফ্রেশার, নাকি সিনিয়র, সেটাও জানে না। তবে ফেস্ট একাই মাতিয়ে দিয়েছে। সন্ধের দিকে একজন সেলেব্রিটি সিঙ্গার আসবে। কিন্তু অডিয়েন্স তো একেই স্টেজ থেকে নামতে দিচ্ছে না!
ছেলেটা গায় ভালোই। কয়েক জায়গায় সুর নড়ছে, তবে সেটা ধরার মধ্যে নয়। নয়, কারণ ছেলেটার চেহারা।
ছেলেটাকে দেখতে দেবদূতের মতো। রীতিমতো রোগা। লম্বা। পেটানো স্বাস্থ্য। মাথায় একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া কালো চুল। সারা মুখে দাড়ি-গোঁফের চিহ্নমাত্র নেই। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। স্টেজে ওঠার সময় নাম অ্যানাউন্স করেছে, চিরন্তন। পদবি বলেনি। ডিপার্টমেন্ট, সেমেস্টার কিছুই বলেনি।
অদ্বিতীয়া নিজে ফ্রেশার। কিন্তু ইতিমধ্যেই ফিজ়িয়োলজির ডিপার্টমেন্টাল সেনসেশনে পরিণত হয়েছে সে। পড়াশোনা, গান, গিটার, আবৃত্তি—সর্বত্রই প্রতিভা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে তার। তার ওপর একটা চোখধাঁধানো রূপ তো আছেই। কিন্তু এই ছেলেটা…।
ভাবনার মধ্যে ডুবে-যাওয়া অদ্বিতীয়া আচমকাই অনুভব করে, অনেকগুলো জোড়া চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও এদিক-ওদিক তাকায় দ্রুত। গান কখন যেন থেমে গেছে। স্টেজের দিকে তাকাতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। চিরন্তন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দু-চোখে একরাশ আমন্ত্রণ।
পাশ থেকে পৃথ্বী ঠেলা দিয়ে বলে, “যা-না ভাই! কী কিউট ছেলেটা! আমাকে ডাকলে তো আমি একবারে চলে যেতাম!”
ওহ্ এই ব্যাপার! ছেলেটা ওকে স্টেজে ডেকেছে! বেশি স্মার্ট সাজছে নাকি! মাথায় আগুন জ্বলে যায় অদ্বিতীয়ার। ততক্ষণে চিরন্তনের অনুরোধ কানে এসেছে, “প্লিজ় সেনোরিটা! মে আই হ্যাভ দ্য প্লেজার?”
মুচকি হাসে অদ্বিতীয়া। যেচে ঘাড়ে বাঁশ নিতে চাইছে। নিক! আজ একেবারে সেঁকে দেবে। কেন যে ছেলেটার ওপর এত রাগ হচ্ছে, সেটাও বোঝে না অদ্বিতীয়া। বোঝার চেষ্টাও করে না। স্টেজে উঠে যায়।
“মে আই হ্যাভ আ গিটার?” স্টেজে উঠে এদিক-ওদিক তাকিয়ে প্রশ্নটা করে ফ্যালে।
চিরন্তন সসম্মানে নিজের গলা থেকে গিটারটা খুলে ওর গলায় পরিয়ে দিতে যায়। শেষ মুহূর্তে খপ করে ধরে ফ্যালে অদ্বিতীয়া। এতটাও সহজ নয়, কাকা!
গিটারটা গলায় গলিয়ে একটা অপরিচিত কর্ডে স্ট্রাম করতে শুরু করে ও। চিরন্তনের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, ছেলেটা এখনও গানটা ধরার চেষ্টা করছে। মাথাটা অল্প অল্প নড়ছে তার। পায়েও তাল পড়ছে সমানে। আবার একটা মুচকি হাসি হেসে গানটা গাইতে শুরু করে অদ্বিতীয়া। অন্তরা থেকে:
“পটভূমিকায় শহিদ মিনার,
নাগরিক চাঁদ উঠেছে আবার।
বনলতা সেন শোনাবে কে আর?
সেই আমি আজ তুমিহীনা।
আমার দু-চোখে চোখ রেখে দ্যাখো,
বাজে কি বাজে না মনোবীণা।…”
এই লাইনটা গাইতেই চিরন্তনের মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে। মাইক্রোফোনের সামনে এগিয়ে আসে সে। পরের দুটো লাইন দুজনে একসঙ্গে গায়:
“ভালো করে তুমি চেয়ে দ্যাখো
দ্যাখো তো চিনতে পারো কি না!…”
***
নামধাম জোগাড় করা গেছে। না, ছেলেটা ঠিক কলেজের কেউ নয়। রিসার্চ করছে। ফিজ়িয়োলজিরই। মাঝেমধ্যে কলেজে আসে বিভিন্ন কাজেকর্মে। ল্যাবটা ব্যবহার করে। নাম চিরন্তন ভদ্র।
ছেলেটার পদবি যে মোটেই সার্থক নয়, তার প্রমাণ কিছুদিন পরে পায় অদ্বিতীয়া। করিডরে একদিন হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে যায় দুজনের। পোড়খাওয়া ফ্লার্টদের মতো মাথাটা সামনের দিকে একটু ঝুঁকিয়ে তাকে অভিবাদন জানায় চিরন্তন। অদ্বিতীয়া একটু হেসে এড়িয়ে যেতে চাইছিল, ছেলেটা পিছন থেকে ডাকে, “আপনি কি আমার ওপর কোনো কারণে অসন্তুষ্ট হয়েছেন, ম্যাডাম?”
অদ্বিতীয়া দাঁড়িয়ে পড়ে। আজ একে একটা ভালোমতো শিক্ষা দেওয়া দরকার। দু-চোখে দুটো ছোটো ছোটো আলো জ্বালিয়ে নিয়ে বলে, “আপনার ওপর অসন্তুষ্ট হওয়ার জন্য, আমার আপনাকে বা আপনার আমাকে যতখানি চেনা দরকার, তার দশ শতাংশও আমরা একে অপরকে চিনি না। তাই এত বড়ো অ্যাজ়াম্পশনটা আপনি করছেন কী করে? একটু বেশি অ্যারোগ্যান্ট হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা?”
এত তীব্র আক্রমণ সামনেও চিরন্তন মোটেই দমে যায় না। যেন খুব দুঃখ পেয়েছে—এইভাবে মাথা নেড়ে বলে, “ওরে বাবা! একটু-আধটু নয়, আপনি তো বিশাল খেপেছেন আমার ওপরে, দেখছি! কেন দিদিভাই? সেদিন হঠাৎ করে আপনাকে স্টেজে গাইতে ডেকেছিলাম বলে?”
কথাগুলো মজার ছলে বলা হলেও, ভেতরে কোথাও একটা অকপট আন্তরিকতা রয়েছে—অনুভব করতে পারে অদ্বিতীয়া। মনটা সামান্য নরম হয় তার। এই প্রথম একটু অবাকও লাগে। সত্যিই তো, এত রাগই-বা হচ্ছে কেন ছেলেটার ওপর অকারণ? সেদিন স্টেজে ছেলেটাকে বেশি প্যাঁচে ফেলা যায়নি। সেইজন্য কি? কিন্তু অদ্বিতীয়া তো ঠিক এতটা নীচ মানসিকতার নয়! তা ছাড়া চিরন্তনের গানের স্টক সত্যিই দুর্দান্ত। রীতিমতো সমীহ করার মতো। সংগীতের বোধও একেবারে হেলাফেলা করার মতো নয়। তার ওপর তো আর বিরক্তি থাকার কথা নয়! এবার তো খানিকটা হলেও শ্রদ্ধা জন্মানো উচিত! ছেলেটা তার কোনো বেড়ে-রাখা ভাতে ছাই দেয়নি!
এইসব যখন ভাবছে, ততক্ষণে চিরন্তন দ্বিতীয় প্রস্তাবটা দিয়ে ফেলেছে, “আচ্ছা, সে রাগ হয়েছে, মানলাম না হয়। কিন্তু সেটা একটু কমানোর সুযোগ কি দেবেন?”
একটা হাল-ছেড়ে-দেওয়া হাসি হেসে মাথা নাড়ে অদ্বিতীয়া, “রাগ যদিও হয়নি, কিন্তু প্রস্তাবটা কী, বলুন!”
“পাশেই একটা দুর্দান্ত কাফে আছে, নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন। আমার মোটামুটি চারটের মধ্যে ল্যাবের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আপনার যদি ছুটির পর বিশেষ কাজ না থাকে…”
“ছুটির পর আমার কাজ থাকুক বা না থাকুক, ভদ্রবাবু…” ছেলেটাকে জ্বালানোর জন্য ইচ্ছে করেই এই সম্বোধনটা করে অদ্বিতীয়া, “প্রথম ডেটে আমি কাফেতে যেতে খুব একটা পছন্দ করি না।” চোখ নাচিয়ে বলে ও।
“ডেট!” ছেলেটার দু-চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়, “কী কুল মাইরি আপনি! কীর’ম সোজাসুজি বলে দিলেন!”
“আমি সব কিছুই সোজাসুজি করতে পছন্দ করি।” অদ্বিতীয়ার মুখে একটা প্রিমিয়াম দুষ্টুমির হাসি খেলে যায়।
“আচ্ছা তাহলে বলুন, কোথায় যেতে চান।” ছেলেটা জিজ্ঞেস করে।
“ওই কাফে থেকে পাঁচ মিনিট উত্তরদিকে হেঁটে গেলেই আর-একটা দারুণ জায়গা আছে। গেছেন কখনও?”
“ওটা তো একটা বিখ্যাত নাইটক্লাব!”
“এগজ়্যাক্টলি! আপনি অ্যালকোহলিক?”
দুটো আঙুল স্যালুটের ভঙ্গিতে কপাল ছোঁয় চিরন্তনের, “আপনার জন্য সব কোহলিক হতে রাজি আছি, দেবী! দেখা হচ্ছে তাহলে! টাইম?”
“এটা আপনিই বলুন!”
“সাড়ে সাতটা?”
“ওকে, ডান!”
***
বার কাউন্টারে ছেলেটাকে আবিষ্কার করে অদ্বিতীয়া। জিন্সের ওপর টি-শার্ট আর তার ওপর গলানো ওভারসাইজ়ড শার্ট। জিন্সটার কয়েক জায়গা একটু ছেঁড়া—স্টাইল বলতে এইটুকুই। মুখের সামনে একটা ড্রিংক নিয়ে বসে আছে। বিয়ার জাতীয়।
এসে ওর পাশে ঝপাস করে বসে পড়ে বলে, “বিয়ার খাচ্ছেন?”
চিরন্তনের ঠোঁটে হালকা হাসি জেগে ওঠে ওকে দেখে, “পান করছি।”
বারটেন্ডার সামনে এসে দাঁড়াতেই নিজের অর্ডারটা দিতে যাচ্ছিল অদ্বিতীয়া। ওর হাতের ওপর একটা হাত রেখে চিরন্তন বলে, “মে আই?”
চোখ কুঁচকে যায় অদ্বিতীয়ার, “আপনি কী করে জানবেন, আমি কোন ড্রিংকটা অর্ডার করব? নাকি ফোর্স করছেন আমাকে?”
“কোনোটাই না। আমি কেবল আমার পছন্দটা আপনাকে একবার চেখে দেখতে অনুরোধ করছি। ভালো না লাগলে, খাবেন না। নিজের পছন্দমতো কিছু বলে দেবেন। ইট’স অল অন মি।”
অদ্বিতীয়া কী বলবে, ভেবে পায় না। ছেলেটার অডাসিটি ক্রমাগতই অবাক করে চলেছে ওকে। ও শুধু বলে, “প্রথম ডেটে এসে আমি আমার ডেটের পয়সায় মদ খাব! এত কিছু অ্যাজ়িউম করছেন কী করে আপনি আমার ব্যাপারে?”
“আচ্ছা, আমাকে অন্তত একবার অর্ডারটা দেওয়ার সুযোগ দিন!” বলে ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই কী একটা খটোমটো নামের ড্রিংক অর্ডার করে চিরন্তন। অদ্বিতীয়া বসে থাকে মুখ গোঁজ করে।
খানিক পরে দুটো লম্বা গ্লাসে অর্ডার আসে। কমলা গোছের একটা পানীয়। হঠাৎ ছেলেটার ফোন বাজতে শুরু করে।
সে চমকে উঠে প্রথমে ফোনটা হাতে নেয়। সঙ্গে সঙ্গেই আওয়াজটা বন্ধ হয়ে যায়। ফোনটা ঢুকিয়ে রাখে পকেটে আবার।
অদ্বিতীয়া সেদিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে একটু অপ্রস্তুত হেসে বলে, “অ্যালার্ম। ওষুধ খাওয়ার। ঘড়ি ধরে না খেলে কাজ করে না।” এই বলে পকেট থেকে একটা ক্যাপসুল বের করে, ড্রিংকের সঙ্গেই খেয়ে ফ্যালে।
কীসের ওষুধ বলে না। অদ্বিতীয়াও জিজ্ঞেস করতে পারে না।
নিজের ড্রিংকটার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকায় ও। আঠেরো বছর হওয়ার দিন থেকেই মদ্যপান শুরু করেছে। অন্তত ছয়-আটবার তো হয়েই গেছে। কিন্তু আজকে একটু সোবার থাকবে, ভেবেছিল। এই ক্লাবটায় এর আগে দুবার এসেছে, দুবারই বান্ধবীদের সঙ্গে। সত্যি কথা হল, জীবনে আদত ডেট অদ্বিতীয়ার এটাই প্রথম। সেজন্য একটু চোখ-কান খোলা রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন…। যাক গে, মরুক গে! খেতে যেমনই হোক, দু-চুমুক খাওয়ার পর বলে দেবে, খেতে পারছে না। এইসব ভাবতে ভাবতে একটা ছোটো সিপ নেয় ও।
এবং নিয়েই চমকে ওঠে।
এত অসাধারণ ড্রিংকটা এর আগে কখনও খায়নি কেন?
আর তার চেয়েও বড়ো কথা, ছেলেটা জানল কী করে, এটা অদ্বিতীয়ার ভালো লাগবে?
ভয় লাগলেও ড্রিংকটা ফেলে দেওয়ার কথা ভাবতে পারে না ও। আর-একটা বড়ো সিপ নেয়।
ছেলেটা চোখে উৎকণ্ঠা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন বুঝে নিতে চাইছে, কতটা ভালো লেগেছে ওর।
“আপনার চয়েসের তারিফ করতেই হয়। এটা আমার জীবনে খাওয়া অন্যতম সেরা ড্রিংক।”
চিরন্তনের মুখে একটা আলো-করা হাসি ফুটে ওঠে, “আঃ! শুনেও শান্তি!”
“কিন্তু আপনি আমাকে একটা কথা বলুন তো…”
“বলুন!”
“আপনি হঠাৎ আমাকে ইমপ্রেস করার পিছনে এরকম আদা-জল খেয়ে পড়লেন কেন?”
ছেলেটার মুখটা এবার একটু লালচে হয়। সেটা ফ্লার্টিং নয়, অদ্বিতীয়া বোঝে। ওর আচার-আচরণ আনাড়ি রকমের হলেও, কোথায় যেন একটা ভীষণ অকপট সত্যি রয়েছে ছেলেটার মধ্যে।
“আমার খুব প্রিয় লেখকের একটা লাইন মনে পড়ে গেল আপনার কথা শুনে। এগজ়্যাক্ট শব্দগুলো মনে নেই, তবে কথাটা ছিল এইরকম: ‘আমাদের সবার মনেই বোধহয় একটা ভালো লাগার সুইচ থাকে। সেটা কারও কারও বেলায় অন হয়ে যায়। যেমন আপনার বেলায় হয়ে গেছে।’”
অদ্বিতীয়া মুখ টিপে হেসে বলে, “অনীশ দেব। গল্পটাও খুব সুন্দর ছিল। ‘ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলে’ বা এই জাতীয় কিছু নাম।”
“আপনি পড়েছেন!” চিরন্তনের চোখে বিস্ময়।
“অ্যাপারেন্টলি আমাদের মধ্যে যতটা আমরা জানি, তার চেয়ে বেশি মিল।” গ্লাসের মধ্যে চোখ নামিয়ে রেখে অদ্বিতীয়া বলে।
“আপনি কখনও অনুভব করেছেন ব্যাপারটা?” অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞেস করে চিরন্তন।
“কোন ব্যাপার? এই মিলটা?”
“না। এই… ভালোবাসার অনুভূতিটা।”
ছড়িয়ে হেসে ফ্যালে অদ্বিতীয়, “নাহ্! এর আগে আমি সেভাবে প্রেমে পড়িনি। কাউকে তেমন ভালোবেসেছি বলেও মনে পড়ে না।”
ওর চোখে চোখ রেখে খুব অদ্ভুতভাবে হাসে চিরন্তন। তারপর গাঢ়স্বরে বলে, “পড়ে না?”
“না। আপনি?”
“হ্যাঁ। একবারই। একজনকেই। পাগলের মতো।”
খানিক চুপ করে থাকে দুজনেই।
“আচ্ছা, আপনার বয়স কত?” অদ্বিতীয়া জিজ্ঞেস করে।
চিরন্তন হাসে, “কত মনে হয় দেখে?”
“চব্বিশ-পঁচিশ।”
“হ্যাঁ, ওরকমই। আচ্ছা, একটা অনুরোধ আছে।”
“হুঁ?”
“এই আপনি-আজ্ঞেটা এবার বন্ধ করা যায়?”
মাথা নাড়ে অদ্বিতীয়া, তারপর চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়ে ডান্স ফ্লোরের দিকে তাকায়। একটা মৃদু গান চলছে। বেশির ভাগ কাপ্ল আলতো আলিঙ্গনে জড়িয়ে রেখেছে উভয় উভয়কে। হঠাৎ চিরন্তনের দিকে তাকায় অদ্বিতীয়া, “তুমি নাচো?”
“চেষ্টা করি বই-কি মাঝেমধ্যে!”
“কোথায়? বাথরুমে?” মাথাটা হালকা-হালকা লাগে অদ্বিতীয়ার।
চিরন্তন আবার হাসে। ছেলেটা একটু বেশি হাসে। তবে এখন যেন হাসিটা আরও বেশি সুন্দর লাগছে ওর। অদ্বিতীয়ার কি নেশা হচ্ছে?
ড্রিংক শেষ করে দুজনেই ডান্স ফ্লোরের দিকে এগিয়ে যায়।…
প্রিয় একটা গান বাজছে। সাধারণত নাইটক্লাবে এইসব গান বাজে না। যদিও এখন কেউ আপত্তি করছে না:
“সুন তো জ়রা মদহোশ হাওয়া
তুঝসে কহনে লগি…”
নাচতে নাচতে দুজনের শরীর খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল। চিরন্তনের চোখে সাইকেডেলিক আলো ক্রমাগত প্রতিফলিত হয়।
বোধহয় নেশাটা একটু চড়েই গেছে। কেমন যেন ঘোর লাগছিল অদ্বিতীয়ার। বাতাসটা কেমন ভারী আর গরম হয়ে উঠেছে। এসি-টা বন্ধ করে দিয়েছে নাকি? আস্তে আস্তে গোটা জগৎ যেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ওর আশপাশ থেকে। চোখের সামনে শুধু এক-আকাশ তারার মতো ফুটে আছে গোল চশমায় ঢাকা দুটো চোখ… অনাদি-অনন্তকাল ধরে। আর তার ওপর দিয়ে কেবল সরে সরে যাচ্ছে লাল সবুজ বেগুনি নীল হলুদ আলো…
“অনন্যা!”
অদ্বিতীয়া চমকে যায়। শব্দটা চিরন্তনের ঠোঁট থেকেই বেরিয়েছে। কিন্তু…
“অনন্যা!”
এবার যেন আরেকটু জোরে। দিশেহারাভাবে তাকায় অদ্বিতীয়া। কাকে ডাকছে চিরন্তন?
“শুনতে পাচ্ছ না অনন্যা? চিনতে পারছ না? অনন্যা… অনন্যা… অনন্যা…”
গোটা ডান্স ফ্লোরে শুধু অদ্বিতীয়া আর চিরন্তন মুখোমুখি। আর কেউ নেই। ওরা নাচছে। গানটা বেজেই চলেছে…
“কে অদিতি উয়ো জো বিছড়তে হ্যায়
এক না এক দিন ফির মিল জাতে হ্যায়;
অদিতি জানে তু ইয়া জানে না
ফুল ফির খিল জাতে হ্যায়।…”
“অনন্যা!!!”
“বলো!”
ধড়ফড় করে জেগে ওঠে অদ্বিতীয়া। বুকের ভেতরটা তেষ্টায় শুকিয়ে কাঠ। ও কোথায়? চিরন্তন কোথায়? এইমাত্র তো…। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে, অদ্বিতীয়া নিজের বাড়িতেই। মানে নিজের মেসে। অনেক রাত অবধি নাইটক্লাবে কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত চিরন্তনই ওকে ড্রপ করে দিয়ে গেছে।
নাইটক্লাবের কথাটা মনে হতেই দুটো গালে একটা লালচে ভাব ফুটে ওঠে। আনমনে নিজের ঠোঁটটা একবার চেটে নেয়। এখনও একটা অচেনা স্বাদ লেগে আছে। অচেনা কি?
কিন্তু এটা কি ধরনের স্বপ্ন দেখছিল অদ্বিতীয়া? কোন নামে সাড়া দিল ও? অদ্ভুত!
উঠে আরেকটু জল খেয়ে নেয়।
***
পরদিন আবার করিডরে দেখা হয়ে যায় চিরন্তনের সঙ্গে। হেসে চোখ নামিয়ে নেয় অদ্বিতীয়া। নিজের এইদিকটা তার জানা ছিল না। বরাবর নিজেকে এসে ডাকাবুকো, সপাট মেয়ে বলেই মনে করে এসেছে। হঠাৎ করেই কীসের ছোঁয়ায় যেন গলগলে হয়ে গেছে সেই মেয়ে। আর সব চেয়ে সর্বনাশের কথাটা হল, বিষয়টা অদ্বিতীয়ার খারাপও লাগছে না।
কিন্তু মাথা নামিয়ে নিতে গিয়েই একটা বাজে ব্যাপার হয়। চোখ নামাতে নামাতে ও লক্ষ করে, পায়ের নীচের মার্বেলের মেঝে হঠাৎ কোন জাদুতে যেন মোজ়াইকের হয়ে গেছে। আবার চোখ তোলে ও। চারপাশটা কেমন বদলে গেছে। ওর ডানদিকে একটা ল্যাবরেটরি ছিল, আর বাঁদিকে খানিকটা দূরে একটা সেমিনার হল। কিন্তু কোথায় কী! ওর ডানদিকে এখন সারি দিয়ে পরপর তিনটে ক্লাসরুম। বাঁদিকটা বারান্দা। আর সেই বারান্দা দিয়ে…
না, ক্যাম্পাসের পিছনের পার্কিং শেড নয়, দেখা যাচ্ছে, যতদূর চোখ যায় ঢেউখেলানো সবুজ।
এই দৃশ্য অদ্বিতীয়ার কলেজের বাইরের নয়। কিন্তু এই দৃশ্যটা খুব চেনা। এমনকি এই পায়ের তলার মোজ়াইক, ডানদিকে কাঠের দরজাওয়ালা ক্লাসরুম—এগুলোও খুব চেনা। কিন্তু অদ্বিতীয়া নিশ্চিত, এই জন্মে এসব কখনও দেখেনি ও।
আবার মাথাটাকে নীচের দিকে নামায়। না, এই তো মার্বেলের মেঝে! আবার মুখ তোলে।
কই! সবই তো ঠিক আছে! ল্যাবরেটরি, সেমিনার হল… চিরন্তন। তাহলে হঠাৎ…?
সারাদিন ঠিকমতো খাওয়া হয়নি, নাকি এত দ্রুত মাথা ওপর-নীচ করার জন্য, নাকি অন্য কোনো কারণে—বলা যায় না, তবে অদ্বিতীয়ার মাথাটা হঠাৎ প্রচণ্ড ঘুরে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে ও বুঝতে পারে, চিরন্তনের মুখের হাসিটা উদ্বেগে বদলে যাচ্ছে, এবং শেষ কয়েকটা পা দৌড়ে আসে সে। মুহূর্তেই দুটো বলিষ্ঠ হাতের ওপর গোটা শরীরের ভার পালকের মতো ছেড়ে দেয় ও।
এরপর অদ্বিতীয়ার আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান ফিরতে প্রথম যে মুখটা চোখে পড়ে, ঠোঁট দুটো তারই নাম বিড়বিড় করে ওঠে, “চিরন্তন!”
কলেজের সিক রুম। চিরন্তন ছাড়াও একজন অ্যাটেন্ড্যান্ট এবং ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসার দাঁড়িয়ে আছেন।
“উফ, কী ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে অদ্বিতীয়া!” হাঁপ-ছাড়া সুরে বলেন প্রফেসার, “ভাগ্যিস চিরন্তন ছিল! কেউ তো এমনিতে যায় না ওইদিকটায়! ল্যাবে যারা ছিল, তারা কত ঘণ্টা পরে বেরোত, কোনো ঠিক নেই। কী হয়েছিল, বলো তো? খাওনি ঠিকঠাক?”
অদ্বিতীয়া কী উত্তর দেবে, ভেবে পায় না। ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে। চিরন্তন এগিয়ে এসে একটা হাত বাড়িয়ে দেয়, “এখন ঠিক লাগছে?”
ওর বাড়িয়ে-দেওয়া হাতটা ধরার বদলে হাতের একটা বিশেষ ব্যাপারের দিকে চোখ চলে যায়। একটা কালো দাগ। কবজির অনেকটা জুড়ে। মাথাটা আবার কেমন টলমল করে ওঠে, বসে-থাকা অবস্থাতেই। যেন এক্ষুনি আবার অজ্ঞান হয়ে যাবে।
চিরন্তন বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। নিজের কবজির দিকে একঝলক তাকিয়েই হাতটা গুটিয়ে নেয় ও। তারপর খুব নিয়মমাফিক সুরে বলে, “গেট ওয়েল সুন! আমি যাই, ল্যাবে সবাই ওয়েট করছে!” বলে আর অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে যায়।
ম্যামও বেরিয়ে যান। অ্যাটেন্ড্যান্ট মেয়েটি সব দেখেশুনে মুচকি মুচকি হাসে। তারপর অদ্বিতীয়ার দিকে এগিয়ে এসে নীচু গলায় বলে, “এই ছেলেটার সঙ্গে প্রেম করার জন্য কলেজের কত মেয়ে যে পাগলা হয়ে গিয়েছিল, ভাবতে পারবে না! এখনও পাগলাই আছে। আমি বলছি না তুমি লাকি, কিন্তু ঘটনা হচ্ছে তুমি সত্যিই লাকি!”
কথাটা শুনেই মাথায় গনগনে তাজা আগুন জ্বলে ওঠে অদ্বিতীয়ার। ইচ্ছে করে এই মেয়েটিকেই ধরে সপাটে দুটো দিয়ে দেয়। কী আস্পর্ধা!
পরক্ষণেই যেন হুঁশ ফেরে ওর। এগুলো কী ধরনের বাচ্চা-বাচ্চা ভাবনাচিন্তা! চিরন্তন ওর থেকে অন্তত বছর ছয়-সাতের বড়ো। তার রোমান্টিক অ্যাফেয়ারের সংখ্যা অনেক বেশি হবে—এটা তো খুবই স্বাভাবিক!
আর কিছু না বলে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বেরিয়ে যায়।
ল্যাপটপ খুলে গম্ভীর মুখে নিজের বিছানায় বসে ছিল অদ্বিতীয়া। হঠাৎ ফোনটা বাজতে শুরু করে। পৃথ্বী।
“হ্যাঁ বল!”
“কী করছিস ভাই?”
“এই তো… জে কে আর-র পিপিটি বানাচ্ছি।”
“আরে ধুর! ওটা কষ্ট করে বানাচ্ছিস কেন? এআই-কে বল-না!”
“এআই-কে?”
“ওরকমভাবে বলছিস কেন? এআই-এর নাম শুনিসনি তুই? দু-দিন আগেও তো কখন হাগতে যাবি, সেটাও ওকে না জিজ্ঞেস করে যেতিস না!”
“ও হ্যাঁ… এআই-এর হেল্প নেওয়ার অপশন ছিল, না? উফফ! মনে এল না কেন? কী যে হয়েছে-না আজকাল…!” মাথাটা টিপে ধরে হতাশ গলায় বলে অদ্বিতীয়া।
“কী আবার হবে, ভাই! চিরন্তন! চিরন্তন! সবই চিরন্তন! হরি হে… দীনবন্ধু…!”
মেজাজটা তেতো হয়ে যায়, “ফালতু ইয়ারকি মারিস না পৃথ্বী! কী বলার জন্য ফোন করেছিলি, বল!”
“তেমন কিছু ডেফিনিট নয়! একটু খেজুরি করতে চাইছিলাম। থাক, তুই এখন ব্যস্ত আছিস…।” পৃথ্বীর গলায় অভিমান লুকোনোর কোনো চেষ্টা নেই। কিন্তু অদ্বিতীয়ারও ইচ্ছা করে না সেই অভিমান ভাঙানোর পিছনে পরিশ্রম খরচ করতে। চুপচাপ ফোন কেটে দেয় ও।
একটা অচেনা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ওরা দুজন। সরু সরু গলিঘুঁজি। বারবার বাঁক নিচ্ছে। প্রতিটা বাঁকের মুখে এসে অদ্বিতীয়ার মনে হচ্ছে, এবারেই চিরন্তনকে হারিয়ে ফেলবে ও। আর যতবার এই কথা মনে হচ্ছে, ততই ছেলেটার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরছে। চিরন্তনের হাতের চাপও বাড়ছে ওর হাতের ওপর।
কিন্তু তাও, একটা মোড় পেরোনোর পর, আচমকাই চিরন্তন অদৃশ্য হয়ে যায় ওর পাশ থেকে।
উদ্ভ্রান্তভাবে চারদিকে তাকায় অদ্বিতীয়া।
“চিরন্তন! চিরন্তন!”
কোথায় চিরন্তন! কেউ কোনো সাড়া দেয় না। অদ্ভুত শ্বাসরুদ্ধকর নীরবতা।
“চিরন্তন! কোথায় তুমি? আমার ভয় করছে! দিস ইজ় নট ফানি!”
কারও সাড়াশব্দ নেই।
এবার মরিয়া হয়ে গলির পর গলি পেরিয়ে ছুটতে শুরু করে অদ্বিতীয়া।
“চিরন্তন! চিরন্তন!”
ওর চিৎকারের ফাঁকা প্রতিধ্বনি এসে ধাক্কা দেয় ওর কানে। কোথায় গেল চিরন্তন! ওকে ফেলে কেন চলে গেল? একটা দমবন্ধ-করা অভিমান আকার নিতে থাকে বুকের মধ্যে।
হঠাৎই থেমে যেতে হয়। সামনে গলির মুখ থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া এসে ঢুকছে গলির ভেতরে। থমকে দাঁড়িয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যায় অদ্বিতীয়া। তারপর ফেলে-আসা পথ ধরে ছুটতে শুরু করে।
কিন্তু সেদিকেও… আগুনের হলকা। ধোঁয়ার লকলকে জিব।
এবার আতঙ্কে দিশেহারা লাগে ওর! চিরন্তন কেন চলে গেল ওকে ফেলে! কোনদিকে পালাবে, বুঝতে না পেরে গলির গায়ে প্রতিটা বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে অদ্বিতীয়া।
কোনো লাভ হয় না।
সব ক-টা দরজা বজ্র-আঁটুনি দিয়ে বন্ধ। যেন অনাদি-অনন্তকাল ধরে বন্ধই হয়ে আছে ওরা। বন্ধই থাকবে। কারও জন্য খোলার হুকুম নেই ওদের।
“চিরন্তঅঅঅঅঅন!!!”
মরিয়া আকুলতা নিয়ে চ্যাঁচায় অদ্বিতীয়া। দূরে কার যেন অতি ক্ষীণ সাড়া পাওয়া যায়, “অনন্যাআআআ!”
সেইদিক লক্ষ করে ছুটতে শুরু করে ও। হঠাৎ মুখের কাছে কেউ যেন বলে ওঠে, “অদ্বিতীয়া? আর ইউ উইথ দ্য ক্লাস? অদ্বিতীয়া… ক্যান ইউ হিয়ার মি? অদ্বিতীয়া!!!”
ঝনঝন করে দিবাস্বপ্ন ভেঙে যায়। ক্লাসরুম। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন জে কে আর। গোটা ক্লাস তাকিয়ে আছে। আর তাকিয়ে আছে… ওই প্ল্যাটফর্মের ওপর থেকেই… একজোড়া অতি পরিচিত চোখ।
ওকে দেখেই স্বপ্নটা এসেছিল, অনুভব করে অদ্বিতীয়া। ওর চাউনির মধ্যে অপরাধবোধ স্পষ্ট। কী করছে ওর সঙ্গে চিরন্তন?
জে কে আর সামান্য ঝুঁকে পড়েছেন ওর ডেস্কের দিকে, “দেয়ার ইউ আর!… হ্যাঁ ক্লাস, যেটা বলছিলাম… এই হল চিরন্তন। কলেজের অ্যালামনি নয়, কিন্তু নানানভাবে কলেজের সঙ্গে যুক্ত। রিসার্চ করছে। ভীষণ ব্রাইট স্টুডেন্ট। অ্যাজ়ওয়েল অ্যাজ়, আ ফ্যাবিউলাস টিচার। সেটা অবশ্য তোমরা বুঝতেও পারবে। আজ থেকে আমার চারটে ক্লাসের মধ্যে দুটো ও নেবে। আমি পার্সনালি তোমাদের অ্যাশিয়োর করছি, ইউ উইল এনজয় এভরি বিট অব ইট। উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট!”
আরও কিছুক্ষণ চিরন্তনের গুণগান করে জে কে আর বেরিয়ে যান। অদ্বিতীয়া অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। ওদের ক্লাস নেবে! চিরন্তন! এখন চিরন্তনের ছাত্রী হতে হবে ওকে! কখনোই না! কয়েক বছর পরে জন্মেছে, তাতে কী হয়েছে, চিরন্তনের থেকে কোনো অংশে কম নয় ও!
বাহানা দেখিয়ে বাইরে চলে আসে ও। চিরন্তন যেন গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে—এইভাবে মাথা নাড়ে।
***
একটা শিউলি গাছের নীচে রবীন্দ্র সরোবরের জলের দিকে মুখ করে বসে ছিল ওরা দুজন।
বিশেষ কথা বলছিল না কেউই। গাছের সব ফুল সকালেই ঝরে গেছে। কোনো কোনোটা গাছের মধ্যেই পাতার ওপর পড়ে আছে। মাঝে মাঝে এলোমেলো হাওয়াতে সেগুলো টুপটাপ করে পড়ছে চারপাশে।
হঠাৎ তিন-চারটে ফুল একসঙ্গে এসে পড়ে চিরন্তনের মাথায়, পাশে। নরম হাসল অদ্বিতীয়া। ও জানে, এখন চিরন্তন কী করবে। যদিও ওর সঙ্গে এই প্রথম রবীন্দ্র সরোবর আসা, তবু জানে অদ্বিতীয়া। বিগত কিছুদিনে অনেকবার ঘটেছে এই ঘটনা। এখন আর এসব নিয়ে অবাক হতে ইচ্ছে করে না।
চিরন্তন যত্ন করে কয়েকটা ফুল কুড়িয়ে নেয়। অদ্বিতীয়া দেখছে না। কিন্তু ও জানে, তিনটে—ঠিক গুনে গুনে তিনটে ফুল হাতে নিয়েছে ও। এবার অদ্বিতীয়ার বিনুনিটা আলতো করে এগিয়ে আনবে সামনের দিকে। তারপর ঠিক গুনে গুনে দুটো করে ভাঁজ অন্তর গুঁজে দেবে ফুলগুলো।
অন্যথা হয় না কোনোটারই।
অদ্বিতীয়া মুখ তোলে, “তোমায় এত চিনি কেন আমি? তুমি কী, চিরন্তন? তুমি কে?” তারপর সরোবরের দিকে চোখ ফেলে আপন মনে বলতে থাকে, “আজকাল কাজ করতে পারি না, পড়াশোনা করতে পারি না। কেবল মাথার ভেতর কিছু অযাচিত ভিডিয়ো ক্লিপ প্লে হতে থাকে। সব ক-টা ক্লিপের মধ্যে একটা জিনিসই কমন—তুমি। আমরা দুজনে পাহাড়ে বেড়াচ্ছি, সমুদ্রে বেড়াচ্ছি, বৃষ্টিতে ভিজছি, খুনশুটি করছি, মাথায় জলপটি দিচ্ছি, পিঠে মাসাজ করে দিচ্ছি, আর…”
চিরন্তন আলতো করে ওর মুখটা নিজের দিকে ফেরায়। তারপর বলে, “আর?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে অদ্বিতীয়া, “আর একসঙ্গে বসে কাজ করছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একটা বিল্ডিং। সে বিল্ডিং আমি চিনি না। আমরা ছাড়াও আরও অনেক লোক আছে সেখানে। অবিরাম পরিশ্রম করে যাচ্ছি আমরা।”
বলতে বলতে আনমনেই তার একটা হাত নিজের হাতে তুলে নেয় অদ্বিতীয়া।
হাতের পাতার ওপর বেখেয়ালে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলে, “কত বলিরেখা পড়েছে! খুব চাপ না এই হাত দুটোর ওপর?”
চিরন্তন একবার আলগোছে নিজের হাতের দিকে তাকায়। তারপর অদ্বিতীয়ার দিকে তাকায়। তারপর আস্তে আস্তে বলে, “গোটা শরীরের ওপরেই খুব চাপ। একটা অংশ বাদে!”
মুহূর্তে মাথার ওপর একটা চাঁটি এসে পড়ে, “কথায় কথায় অকারণ অসভ্যতা করার অভ্যেসটা আর গেল না, বলো!”
“নাহ্!”
খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পরে হঠাৎ নড়েচড়ে বসে অদ্বিতীয়া, “এই এক মিনিট! কী বললাম আমি?”
চিরন্তন উত্তর দেয় না। ওর দিকে তাকায়ও না। অদ্বিতীয়া নিজেই আপন মনে বলে চলে, “আবার! আবার! কেন এরকম হচ্ছে, চিরন্তন? কেন আমার কেবলই মনে হচ্ছে, তোমাকে আমি বহুকাল ধরে…”
ওকে কথাটা শেষ করতে দেয় না চিরন্তন। একটা হাত আলতো করে রাখে ওর ঠোঁটের ওপর। নিজের মুখটা নামিয়ে আনে ওর মুখের খুব কাছে, অদ্বিতীয়ার মুখের ওপর রাখা ওর হাতের সঙ্গে প্রায় ঠেকিয়ে। তারপর ফিশফিশ করে, খুব গাঢ়স্বরে বলে, “এত ভাবে না।”
তারপর হাতটা সরিয়ে দেয় মাঝখান থেকে।
***
ফোনটা কিছুতেই রিসিভ হচ্ছিল না। এই নিয়ে প্রায় একশোবার। পাগল পাগল লাগে। আঙুলে ব্যথা করছে, চোখ জ্বালা করছে। যেন শরীরে একটা আস্ত কাঁকড়াবিছে ঢুকে পড়েছে। ছটফট করে বেড়াচ্ছে অদ্বিতীয়া। ওর রুমমেট ওকে দুই-একবার বোঝানোর চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। সব প্রশ্নের উত্তরেই একই জবাব, “তুই বুঝতে পারছিস না… প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা টানা… না একটা ফোন, না একটা মেসেজ। কালকে খুব ইম্পরট্যান্ট একটা ক্লাস ছিল। কিন্তু কলেজেও আসেনি। মাঝখানে দেখা করার কথা ছিল, কিন্তু কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। দেয়ার মাস্ট বি সামথিং ভেরি রং!”
“আমার মনে হয়, তুই ওভারথিংক করছিস।”
“আমি ওভারথিংক করছি না, অলিভিয়া! কিছু একটা হয়েছে! হয়েছেই! তোকে লিখে দিচ্ছি আমি।”
“বেশ তো… এতই যখন টেনশন করছিস, ওর বাড়িতে যা একবার। চক্ষুকর্ণের বিবাদ মিটিয়ে আয়।”
ঠোঁট কামড়ায় অদ্বিতীয়া। এই কথাটা তার অন্তত হাজারবার মনে হয়েছে। কিন্তু…
অবশেষে নিজের অসহায়তাটা প্রকাশ করেই ফ্যালে ও, “ওর বাড়ির ঠিকানা জানি না আমি।”
“সেটা কোনো সমস্যা নয়। ও কলেজ ফেস্টে গেয়েছিল না? সাধারণত যারা পারফর্ম করে, তাদের একটা আলাদা ডেটাবেস থাকে। তোদের ডিপার্টমেন্টের একজন ছিল না ভলান্টিয়ার? তাকে ফোন কর। যদি আসল কারণটা বলতে কমফর্টেবল ফিল না হয়, বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা বলে দিবি।”
উত্তর না দিয়ে ফোন হাতে তুলে নেয় অদ্বিতীয়া।
বাড়িটার চেহারা দেখে বিস্ময়ের সীমা থাকে না।
উত্তর কলকাতার একটা গলির গলির তস্য গলির মধ্যে। জরাজীর্ণ হাড়-বের-করা চেহারা। দেওয়ালে নোনা। বাইরে পড়ন্ত সন্ধের আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝুলছে একটা উলঙ্গ হলুদ বাল্ব। একটা আদ্যিকালের কলিং বেল। একরাশ ইতস্তত ভাব নিয়ে সেটাতেই চাপ দেয় অদ্বিতীয়া।
“আসছি!” একটা খ্যারখেরে গলা। কিছুক্ষণ পরেই দরজাটা খুলে যায় হাট হয়ে।
লুঙ্গি আর গেঞ্জি-পরা একটা মাঝবয়সি লোক। মাথার সামনে থেকে চওড়া টাক। কুতকুতে দুটো চোখে মাখানো সন্দেহ।
“কাকে চাই?”
“চিরন্তন রায়চৌধুরী আছে?”
ভ্রূ দুটো গভীরভাবে কুঁচকে যায় লোকটার, “আপনার পরিচয়?”
“আমি ওঁর… স্টুডেন্ট। ছাত্রী। আছেন উনি?”
“আসুন… ভিতরে আসুন।” দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় লোকটা।
ভিতরে একটা মস্ত খোলা উঠোন। তাকে ঘিরে তিনদিকে উঠেছে কাঠামো। বারান্দা থেকে ঝুলছে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা।
একটা অন্ধকার সিঁড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে লোকটা বলে, “সোজা উঠে যান। উঠেই ডানদিকের প্রথম ঘরটা।”
অদ্বিতীয়া পা বাড়াতে যাচ্ছিল। লোকটা পিছন থেকে ডাকে, “শুনুন!”
“হ্যাঁ, বলুন!”
“দরকারের থেকে বেশি দেরি করবেন না।”
মুখে কথা ফোটে না ওর। মাথা ঝাঁকিয়ে ওপরে উঠে যায়।
দরজাটা ভেজানা ছিল। ভেতর থেকে হলুদ আলোর সরু রেখা এসে পড়ছিল অন্ধকার-হয়ে-আসা বারান্দায়। তবু একবার নক করে অদ্বিতীয়া, “চিরন্তন, তুমি আছ ভেতরে?”
কোনো উত্তর আসে না। আরও কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে দরজার ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে অদ্বিতীয়া।
ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সঙ্গে সঙ্গেই, ভেতরের দৃশ্যটা দেখে, নাকি মোটা মোটা দেওয়াল আর জীবনে রোদ্দুর না-পাওয়া ছাদের নীচের এই ঘরের ভেতরের তাপমাত্রার জন্য, সেটা অদ্বিতীয়া কোনোদিনই বলতে পারবে না—গোটা শরীরটা হিহি করে কেঁপে যায় ওর।
ঘরে আসবাবের বাহুল্য নেই। একটা খাট, একটা রাইটিং টেবিল, একটা বইয়ে ঠাসা আলমারি। ঘরের দু-দিকে দুটো হলুদ বাল্ব। কয়েকটা মথ উড়ছে তাদের চারপাশে। কয়েকটা অন্যান্য পোকাও।
কিন্তু খাটের ওপর যে শুয়ে আছে… তাকে হয়তো কোনো এক কালে অদ্বিতীয়া… কিন্তু…
বিছানা থেকে বলিরেখাসর্বস্ব, কাঁচাপাকা চুলের প্রৌঢ় দেহটা নিয়ে উঠে বসে চিরন্তন, “আমি জানতাম, তুমি আসবে, অনন্যা!”
“চিরন্তন!” ফিশফিশ করে শুধু এইটুকু কথাই উচ্চারণ করতে পারে ও।
“মনে অনেক প্রশ্ন আসছে, জানি। বোসো। চা খাবে?”
চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়ে অদ্বিতীয়া। তখনই দ্বিতীয় অভিঘাতটা এসে লাগে।
খাটের পাশের সেই নড়বড়ে টেবিলের ওপর ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবি। সাদা-কালো নয়, তবে বেশ পুরোনো ছবি।
ছবিতে চিরন্তনকে দেখা যাচ্ছে। আর তার পাশে বসে আছে ওটা… হ্যাঁ, ওটা অদ্বিতীয়া ছাড়া আর কেউ নয়। সমুদ্রের ধারে তোলা ছবি। পিছনে ঢেউ ভাঙছে। দুজনের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ওদের থেকে সুখী এই মুহূর্তে দুনিয়ায় আর কেউ নেই।…
ছবিটা দেখে নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে অদ্বিতীয়ার।
“তোমার মনে পড়ছে সব।” শূন্য গলায় বলে চিরন্তন, “পড়বে। পড়ারই ছিল।”
“কিন্তু আমি… আমি কে? আমি কি তোমার গত জন্মের…? পুনর্জন্ম বলে কি সত্যিই আদৌ কিছু… আর তুমি! তুমিই-বা, কে চিরন্তন? তোমার বয়স এতদিন… আমার… আমার সব কিছু কেমন ঘেঁটে যাচ্ছে! আমি কি আরেকটা স্বপ্ন দেখছি?”
চিরন্তন দু-দিকে মাথা নাড়ে, “না। তুমি আজ পর্যন্ত যা যা দেখেছ, তার কোনোটাই পুরো স্বপ্ন নয়। হ্যাঁ… বলতে পারো তুমি আমার গত জন্মের প্রেয়সী এবং স্ত্রী। তবে, গত জন্ম বলতে তুমি যা বোঝো, বিষয়টা এখানে ঠিক সেরকম নয়…”
“হেঁয়ালি রেখে সোজা কথায় বোঝাবে প্লিজ়? তুমি আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছ, চিরন্তন?”
“পারছি। হয়তো ওইটুকুই আমি এখন শুধু বুঝতে পারছি। বলছি। সবটাই বলছি তোমাকে। বিশ্বাস করা-না-করা তোমার ব্যাপার।
“আজ থেকে প্রায় উনত্রিশ বছর আগে আমাদের আলাপ। একই সঙ্গে আন্ডার গ্র্যাজুয়েশন, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে নেট দিলাম। এর মাঝে বিয়েটা সেরে নিলাম অবশ্যই। তারপর একই সঙ্গে একই ইন্সটিটিউটে ঢুকলাম দুজন পিএইচডি করতে। হ্যাঁ… তুমি আর আমি এই রাজ্যের অত্যন্ত সম্মাননীয় একটা ইন্সটিটিউশনে জেরোন্টোলজি নিয়ে রিসার্চ করতাম। বার্ধক্যের বিজ্ঞান। আমরা দুজনেই একটা সিরাম ডেভেলপ করছিলাম, যাতে এজিংটাকে স্লো ডাউন করে দেওয়া যায়।”
“যযাতি!” ফিশফিশ করে বলে অদ্বিতীয়া।
“হ্যাঁ। প্রোজেক্ট যযাতি। খুব কনফিডেনশিয়াল। আস্তে আস্তে সব মনে পড়ছে তোমার।”
“ফ্র্যাগমেন্টস।”
“এত সাবধানতা অবলম্বন সত্ত্বেও এই যযাতি ডেভেলপ করাকালীন ফার্মা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে অনেক রকমের থ্রেট আসত আমাদের কাছে।”
“খুন, রেপ। রেপ এবং খুন।”
“এগজ়্যাক্টলি! কিন্তু আমরা হাসাহাসি করতাম সেগুলো নিয়ে। তুমি আর আমি। অনন্যা আর চিরন্তন। সবাই আমাদের মেড ফর ইচ আদার বলত। দুজনেরই একই রিসার্চের ফিল্ড, এত পরিমাণ ট্যালেন্ট। অবশ্য চিরকাল জীবনে আর সব কিছুর মতোই তুমি এখানেও আমাকে অনেকটা ছাপিয়ে গিয়েছিল।
“তারপর সেই দিনটা এল। সেই রাতটা।
“আমরা লং ড্রাইভ করে ফিরছিলাম। গভীর রাত্রি। হঠাৎ গাড়ির একটা চাকা পাংচার হয়ে গেল।”
“…তুমি টায়ার রিপ্লেস করছিলে, আমি আলো ধরে ছিলাম। হঠাৎ কয়েকটা ছায়ামূর্তি আমাদের ঘিরে ফেলল। তাদের কারও মুখ দেখা যায় না। কিন্তু মুখের ভাষা শুনে বুঝতে পারছিলাম ওরা কারা।”
“আমাদের ফেরত যাওয়ার সুযোগ দিল না ওরা। আমাকে মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে দিল।”
“…তারপর চড়ে বসল আমার ওপর। একজন… দুজন… তিনজন। আমি আগাগোড়া তোমাকে চিৎকার করে ডেকে যাচ্ছিলাম। সেবার ইন্সটিটিউশনের ফাংশনে তুমি আর আমি একটা গান গেয়েছিলাম, মনে আছে? তেরা মুঝসে হ্যায় পহলে কা নাতা কোই…? ওটাই ওরা গাইছিল আগাগোড়া সময় ধরে। দুই-একজনের গলা আমি চিনতেও পেরেছিলাম। কলেজের জুনিয়র। খুব ভালো পড়াশোনায় ছিল প্রত্যেকেই।”
“আমার যখন জ্ঞান ফিরল, ততক্ষণে তোমার বডিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ভেগে গেছে ওরা। জানি না কেন, আমায় কিছু করেনি। হয়তো বুঝতে পেরেছিল, তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষে যযাতি সফলভাবে এগজ়িকিউট করা সম্ভব নয়। কিংবা হয়তো ভেবেছিল, আমি মরে গেছি। আমি কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে তোমার কাছে এগিয়ে গিয়ে আগুন নেবানোর চেষ্টা করলাম।”
“…আর তাতেই অমন বিচ্ছিরিভাবে কবজিটা পোড়ালে বুঝি?”
চিরন্তন উত্তর দেয় না। অদ্বিতীয়া জিজ্ঞেস করে, “তারপর?”
“আগুন আমি নিবিয়ে ফেলতে পেরেছিলাম। তোমার শরীরে বার্ন খুব বেশি ছিল না। কিন্তু ট্রমা… ট্রমা এত বেশি পরিমাণ ছিল যে, সেটাই তোমাকে বাঁচতে দিল না।”
“কিন্তু আমার বডি চিতায় তোলার আগে তুমি কিছু কাজ করলে, তা-ই তো?”
“আমার মাথায় রোখ চেপে গিয়েছিল, অনন্যা… যযাতি আমি শেষ করবই! আর তোমার সঙ্গেই করব! যত সময় তাতে লাগে, লাগুক! কিন্তু তার জন্য… আমাকে রিসার্চের কাজটা কয়েক বছরের জন্য স্থগিত রাখতে হল। ব্যক্তিগত খরচে একটা অন্য জিনিস নিয়ে পড়লাম। ঘটিবাটি বেচার দশা হল। সস্তায় এই ঘরটা ভাড়া নিয়ে এসে উঠলাম।”
“ক্লোনিং।”
“ক্লোনিং। তোমার শরীরের নানান জায়গা থেকেই নষ্ট না-হওয়া ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করেছিলাম। এমনকি…”
“এমনকি আমাদের রিসার্চের স্বার্থে যে ওভামটা আমি ডোনেট করেছিলাম, সেটাও নিলে তুমি।”
“ওটাই আমার সব চেয়ে বেশি কাজে লেগেছে… তোমাকে রিবিল্ড করতে। কিন্তু তার সঙ্গে আরও একটা জিনিস দরকার ছিল।”
“যযাতির একটা কাজ চালানোর মতো ভার্সন।”
“একদম! যাতে কিছুটা হলেও, অন্তত তোমার বয়সের কাছাকাছি থাকতে পারি।” অপ্রস্তুত হাসে চিরন্তন।
“কিন্তু যেটুকু ডেভেলপ করা গিয়েছিল, সেটা কেবল অল্প সময়ের জন্য কাজ করত।”
“এবং ভুলভাবে কাজ করত। এজিং স্লো করতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু এটা শুধু বয়সটা বাইরে থেকে দেখতে খানিকটা কমিয়ে দিত।”
“তবু তুমি নিয়মিত নিয়ে গেলে ওটা। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর। আর পৃথিবীর কাছে…”
“বছর তিরিশের যুবক হয়ে রইলাম।”
“তারপর… আমি তাহলে আমার মা-বাবার সন্তান নই?”
“না। নও। আমার এই এক্সপেরিমেন্টের কথা শুধু আমার ইন্সট্রাক্টর জানতেন। এখনও আমি যেটুকু সুযোগসুবিধে পাই, ওঁরই জন্য। উনি আমাকে কোনোদিন কিছুতে বাধা দেননি। আমার ওপর জানি না কেন, অগাধ বিশ্বাস ছিল ওঁর। স্যার ওপরমহলের কিছু চেনাজানা কাজে লাগিয়ে একজন সারোগেটের বন্দোবস্ত করে দেন। সেই মহিলার নাম ছিল পদ্ম। প্রেগন্যান্ট থাকাকালীন তার সমস্ত দেখভালের দায়িত্ব ছিল আমার। তারপর স্যারেরই অ্যারেঞ্জমেন্টে তোমার মা-বাবা তোমাকে অ্যাডপ্ট করেন। তোমার মা স্যারের ভাগনি। ওঁর অনারেই আমি, তুমি এখন যে কলেজে পড়ো, তার ল্যাবটা ব্যবহার করতে পারি। আমি আসলে এখন আলাদা কোনো রিসার্চ করছি না, যদিও কাগজপত্র সবই আছে। সবটাই স্যারের সৌজন্যে। অনেক বয়স হয়েছে এখন। সেদিন উনি শুধু আমার ডিসিশন শুনে আমার দু-কাঁধে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন, ‘তোর যা ইচ্ছে হয়, কর চিরন্তন! শুধু যযাতিকে ফেইল করাস না!’”
“অগ্নিদাদু…”
“হ্যাঁ, তোমার অগ্নিদাদু। উনিই আমার স্যার।”
“তারপর?”
“তারপর অপেক্ষা। অনন্ত অপেক্ষা। তোমার বড়ো হওয়ার অপেক্ষা। প্রতিমুহূর্তে তোমার ওপর নজর রাখতাম। ইতিমধ্যে আমি আবার যযাতির ওপর কাজ করা শুরু করি। কিন্তু বুঝতে পারি, তোমায় ছাড়া একান্তই সম্ভব না। তোমার মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল, তুমি এই কলেজে ভরতি হও। কারণ ওরকম ইচ্ছে হওয়ারই নির্দেশ ছিল তাঁর ওপর। ওখান থেকে আমার কাজ করার সুবিধা, তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়ারও।”
“কালকে কলেজে এলে না কেন?”
একটা হাল-ছেড়ে-দেওয়া হাসি হেসে চিরন্তন নিজের দিকে নির্দেশ করে বলে, “আর যেতে পারব বলে মনে হয় না। দেখতেই তো পাচ্ছ, যত দিন যাচ্ছে, সিরামের ইফেক্ট কমছে। আফটার অল, জিনিসটা খুবই জোড়াতাপ্পি-দেওয়া ছিল। সে আর আগের মতো কাজ করছে না। অনেক ঘনঘন নিতে হয় এখন। আমার পয়সাও শেষ। এখন আমার বয়স এমনিতে উনপঞ্চাশ। আমাদের দুজনেরই সাতাশ বছর বয়সে অনন্যার মৃত্যু হয়। তারপর কিছুদিন সময় লেগেছে ক্লোনড এমব্রায়োটা রেডি করতে… আমার একত্রিশ বছর বয়সে তুমি জন্মাও। যা-ই হোক, কম অত্যাচার তো আমি করিনি শরীরের ওপর। তাই দেখতে একটু বেশিই বৃদ্ধ লাগে। আর তা ছাড়া…?”
হঠাৎ করেই চুপ করে যায় চিরন্তন।
লম্বা সময় দুজনের কেউই কোনো কথা বলে না। মাথার ওপর পাখাটা শুধু ঘুরতে থাকে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে। সেই নীরবতা ভেঙে একসময় অদ্বিতীয়া বলে ওঠে, “তাহলে আমার এই গোটা জীবনটা… এর এতটুকুও আমার নিজের নয়, তা-ই তো? সবটাই অন্যের ইচ্ছেতে, অন্যের পারপাস ফুলফিল করার জন্য। এমনকি আমি কাকে বেছে নেব জীবনে, সেটাও আমার জন্মের আগে নির্ধারিত। আমার স্মৃতিগুলো পর্যন্ত আমার নিজের নয়। কোনো এক জিনিয়াস বিজ্ঞানীর ডিএনএ-তে সঞ্চিত হয়ে-থাকা কিছু তথ্য।”
চিরন্তন মাথা নীচু করে বসে থাকে। অনেকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে বলে, “তুমিই সেই জিনিয়াস বিজ্ঞানী, অনন্যা!”
“ডোন্ট ইউ ডেয়ার কল মি দ্যাট!” চেয়ারটাকে ঠেলে প্রায় তিন ফুট দূরে সরিয়ে দিয়ে অদ্বিতীয়া উঠে দাঁড়ায়। সারা শরীর কাঁপছে ওর, “আমি অনন্যা নই। আমি অদ্বিতীয়া। এটা একটা গল্প। এটা একটা দুঃস্বপ্ন। তুমি আমার জীবনের কেউ নও, চিরন্তন রায়চৌধুরী!”
এইটুকু বলেই ঝড়ের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ও। চিরন্তন বসে থাকে নির্বাক ছায়ামূর্তি হয়ে।
পরদিন সকালেই অবশ্য চিরন্তনের ফোনে মেসেজ আসে, “অনন্যার একটা ব্যক্তিগত রিসার্চ ছিল না? যেটা সে নিজের খরচায় করছিল এবং যেখানে সে কাউকে অ্যালাও করত না? তোমাকেও না…?”
উত্তর টাইপ করে চিরন্তন, “হ্যাঁ, ছিল।”
“তার কাগজপত্র কোথায় আছে?”
“সব আমার কাছেই রাখা আছে।”
“তুমি দেখেছ সেসব?”
“না। তোমার জন্য রেখে দিয়েছি।”
একটু পরে উত্তর আসে, “সন্ধেবেলা নিতে আসব। বাড়ি থেকো।”
***
মাস তিনেক পর…
চিরন্তনের ঘরে দুজনেই বসে আছে চুপচাপ।
“তুমি তাহলে এটাই বলতে এসেছিলে?”
“হ্যাঁ চিরন্তন। এটাই। আমি ফিজ়িয়োলজি পড়ছি ঠিকই, কিন্তু আমারও যে ভবিষ্যতে জেরোন্টোলজি নিয়েই ইনটারেস্ট জন্মাবে, এমন তো কোনো কথা নেই। সারাজীবন অন্যের এক্সপেক্টেশন বয়ে বেঁচে বেড়াতে পারব না আমি। আর এটাও তো হতেই পারে যে, আর সব কিছু কাজ করলেও অনন্যার মতো জিনিয়াস আমি দেখাতে পারলাম না নিজের কেরিয়ারে!”
“এই তাহলে আমাদের শেষ দেখা?”
“শেষ দেখা!” বলে হাতটা বাড়িয়ে দেয় অদ্বিতীয়া। সেটা নিজের দু-হাতের মধ্যে নিয়েই চমকে ওঠে চিরন্তন, “এ কী! তোমার হাতে এগুলো…!” দু-চোখে একরাশ আতঙ্ক নিয়ে অদ্বিতীয়ার মুখের দিকে তাকায় চিরন্তন। সেখানে আস্তে আস্তে বলিরেখা ফুটে উঠতে শুরু করেছে। চামড়াগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। এতই দ্রুত যে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকলেই পরিবর্তন চোখে পড়ে।
“অদ্বিতীয়া… তুমি…”
স্বপ্নের মতো গলায় অদ্বিতীয়া বলতে থাকে, “বাবা মারা যাওয়ার পর জেঠুদের জ্বালায় আমাদের বাড়ি থাকা অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তার ওপর আমি এই যে এত ভালো একটা কেরিয়ার তৈরি করছিলাম—ওদের জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল একেবারে। যতভাবে পারত, আমাদের অসুখ এবং অস্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করত। তাই ডেসপারেট হয়ে আমি একটা প্রাইভেট প্রোজেক্টে কাজ করা শুরু করি। যযাতির অ্যান্টিডোট। হ্যাঁ… এমন একটা সিরাম, যেটা এজিংকে স্লো করার বদলে স্পিড আপ করবে। ইচ্ছে ছিল, ওটা কোনো না কোনোভাবে অ্যাপ্লাই করব ওই লোকটার ওপর। চোখের সামনে দগ্ধে দগ্ধে মরতে দেখতে ভালো লাগবে। অনেক দূর সফলও হয়েছিলাম। খুব বেসিক ইনগ্রেডিয়েন্টস এবং প্রোসেস। সেইজন্যই তো এত কম সময়ের মধ্যে কলেজের ল্যাবে আবার…। সব চেয়ে বেশি পয়সা খরচ করতে হয়েছে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টকে ঘুস দিতে গিয়ে, জানো!
“যা-ই হোক, যেটা বলছিলাম… আমি যদি খুব ভুল না হই, যারা আমাদের ওপর সেদিন আক্রমণ করেছিল, তাদের উদ্দেশ্য কেবল প্রোজেক্টটা থামানো ছিল না। ওরা আমাকে শেষ করতে চাইছিল। ওর মধ্যে একজন জেঠুর প্রাণের বন্ধুর ছেলে ছিল। সেই ছেলেটাই সম্ভবত ওদের আক্রমণের নেতা ছিল। আক্রোশটা ওদের কেবল আমার জিনিয়াসের ওপর ছিল না, ছিল আমার অস্তিত্বের ওপর। তাই আমি। শুধু আমি।…” বলে হাসতে হাসতে নিজের দু-হাতের দিকে তাকায় অদ্বিতীয়।
“তা-ই বলে তুমি…” অস্ফুটে কথাগুলো উচ্চারণ করে চিরন্তন।
“আর কিছু মাথায় আসছিল না আমার, চিরন্তন! আমি জানি, জীবনটা আমাকে তোমার সঙ্গেই কাটাতে হত। কিছু করার নেই। কিন্তু এত বয়সের ডিফারেন্স নিয়ে তো সেটা ঠিক… এথিক্যাল নয়, তা-ই না?”
“কিন্তু তোমার পড়াশোনা…? কেরিয়ার?”
হাসতে হাসতে দু-দিকে মাথা নাড়ে অদ্বিতীয়া, “আমার মায়ের কিছু জেনারেশনাল ওয়েল্থ আছে, জানো বোধহয়। তার ওপর… আমি অনন্যার মায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ভদ্রমহিলা এখনও বেঁচে আছেন। পাগল-পাগল হয়ে গিয়েছেন অবশ্য। আমায় দেখে যেন মনে হল আকাশের চাঁদ, সমুদ্রের নীচের আটলান্টিস, অ্যামাজ়নের এলডোরাডো—সব কিছু ওঁর হাতে এনে দিয়েছে কেউ।
“অনন্যার জেঠু মারা গেছে ক-দিন আগে। তার কোনো ছেলেপুলে ছিল না। জেঠিমাও মারা গেছেন বহুদিন। এই অবস্থায়, দুজনের কারোই আর কোনো জীবিত উত্তরসূরি না-থাকায়, জেঠু এবং বাবার সমস্ত সম্পত্তি অনন্যার। আর অনন্যার অনুপস্থিতিতে তার মায়ের। আর সেই সমস্তটা অদ্বিতীয়ার নামে লিখে দিতে চেয়েছেন অনন্যার মা। আর তার অঙ্কটা নেহাত কম নয়। আমাদের দুজনের বাকি জীবনটা মোটামুটি চলে যাবে।”
“আর… যযাতি?”
“এমনিতেই মানুষের চাপে পৃথিবীর প্রাণ ওষ্ঠাগত, চিরন্তন। এই অবস্থায় মানুষের আয়ু আরও টেনে লম্বা করে তাকে চিরায়ু না করলেই নয়? একটা-দুটো ব্যাপার প্রকৃতির হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে মনে হয় না? আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে আমি এই কথা বলতাম না। তখন পৃথিবীর অবস্থা অন্যরকম ছিল। জীবনে অনেক আশা ছিল। কিন্তু এখন সব কীরকম নষ্ট, দূষিত হয়ে গেছে, দেখতে পাও না? চারপাশে তাকিয়ে দ্যাখো… এই পৃথিবীতে কি বেশি দিন বাঁচা যায়? বাঁচা উচিত? এক-চতুর্থাংশ শতাব্দী পেরিয়ে গেছে, চিরন্তন… এটা তোমার একবারও মনে হয়নি? নাকি মনে হতে দাওনি নিজেকে?”
বলতে বলতে চিরন্তনের পাশে এসে বসে পড়ে ও। আঙুলের মধ্যে আঙুলগুলো জড়িয়ে নেয়। তারপর চাপা সুরে বলে, “তার থেকে এই ভালো… তুমি-আমি… আমরা কেউই বেশি দিন বাঁচব না। যতদিন আছি, এই শেষ ক-টা দিন… চিন্তাহীন, নিরুদ্বিগ্ন…।”
সেই নড়বড়ে খাটের উপর বসে আস্তে আস্তে মাথাটা চিরন্তনের কাঁধের ওপর হেলিয়ে দেয় অনন্যা।
চিরন্তন কোনো কথা বলে না। বাইরে আলো পড়ে আসছে। কোথা থেকে যেন স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবিরের ঘোষণার ফাঁকে দু-কলি গান বেজে ওঠে:
“মুহূর্ত যায় জন্মের মতো অন্ধ জাতিস্মর,
গত জন্মের ভুলে-যাওয়া স্মৃতি, বিস্মৃত অক্ষর।
ছেঁড়া তালপাতা পুথির পাতায় নিশ্বাস ফ্যালে হাওয়া…”
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, মোহনা দেবরায়
