মনের খোঁজ
লেখক: ডা. রুদ্রজিৎ পাল
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
বর্ণিল ট্রাম থেকে নেমে সামনে তাকিয়েই বেশ খুশি হল। সেই পুরোনো কাফেটা একই জায়গাতেই আছে। একদিকে বিশাল অফিসবাড়ি আর অন্যদিকে ঝাঁ-চকচকে রেস্তোরাঁর মাঝখানে কোনোরকমে পিঠ গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। নামটাও এক আছে—‘জলখাবার’। এমনকি সামনের কাচের দেওয়ালে যে রংচটা পোস্টারগুলো ছিল, সেগুলোও একই আছে। কী আশ্চর্য! এ তো বহু পুরোনো পোস্টার। ওই তো একটা অর্ধেক ছেঁড়া ‘লগান’-এর ছবি। তার পাশে ‘ফসিলস ২’ অ্যালবামের একটা বিজ্ঞাপন। এত পুরোনো সব পোস্টার এখনও লাগানো? নতুন কোনো পোস্টার কি এরা পায় না? বর্ণিল দরজা ঠেলে ঢুকল।
সেই কালো কালো টেবিল আর চেয়ার। একদিকে একটা দপদপ-করা টিউবলাইট। দেওয়ালে রামকৃষ্ণদেবের ছবি। এককোণে সেই খোঁচা খোঁচা দাঁড়িওয়ালা লোকটা বসে সিগারেট খাচ্ছে আর একটা লিট্ল ম্যাগাজ়িন পড়ছে। সামনে প্লেটে আধখাওয়া চাউমিন। বর্ণিল যখন আগে আসত, তখন এই লোকটাকে দেখতে পেত। এই সময়ে, মানে বেলা তিনটের সময়ে, এই কাফেতে এলে এই লোকটা ওই বিশেষ টেবিলে থাকবেই। বর্ণিল আর ওর বন্ধুরা মজা করত যে, এই লোকটা হয় দোকানের মালিক, ছদ্মবেশে সবার দিকে নজর রাখে, আর নইলে এই কাফের আঁতেল ভূত। লোকটা সেই আগের মতোই একা বসে আছে। বয়সও বেড়েছে বলে তো মনে হয় না!
বর্ণিল সামনের দিকে একটা থ্রি-সিটার টেবিলে বসতেই দেবু হাসিমুখে এসে দাঁড়াল। দেবু হল এই কাফের অল পারপাস কর্মচারী। ওয়েটার, রাঁধুনি, এমনকি সময়ে সময়ে ম্যানেজারও। বর্ণিল টেবিলের ওপর থেকে একটা মাছি তাড়িয়ে বলল, “কী রে, কেমন আছিস?”
“তুমি যেমন রেখেছ।”
দেবুর বয়স তখন ছিল চোদ্দো-পনেরো। এখন হয়তো একটু বেড়েছে। কিন্তু দেখতে একই রকম আছে। ওর কথা চিরকালই এরকম পাকা-পাকা। “তোমার অর্ডার নিয়ে আসি?”
বর্ণিল অবাক হয়ে বলল, “তোর মনে আছে এতদিন পর?”
“এতদিন আর কোথায়? এই তো সেদিন এলে। ভালো ওয়েটার কাস্টমারের সব কিছু মনে রাখে।”
বর্ণিল হেসে ফেলল। ব্যাটার কথা সেই একই রকম আছে। “বেশি পাকামি করিস না। নিয়ে আয়।” দেবু যখন রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে, তখন বর্ণিল একবার ডাকল, “এই, আরেকবার শুনে যা।”
দেবু চেঁচিয়ে বলল, “তোমার বাটার টোস্টে চিনি বেশি হবে আর ডিমটা হাফ বয়েল। জানি।” বলেই সুড়ুত করে ঘরে ঢুকে গেল। বর্ণিল একবার সেদিকে দেখে আবার দরজার দিকে তাকাল। এই কাফেতে ঢুকলেই পেঁয়াজ, পোড়া মাংস, রুহ্ আফজা আর কফি-মেশানো একটা গন্ধ নাকে আসে। এই সময়ে এখানটা খালি থাকে। কলেজ ছুটি হয়নি। আবার দুপুরের লাঞ্চের ভিড়টাও শেষ। কাফের ম্যানেজার খালি গায়ে একটা গামছা জড়িয়ে বসে আছে।
বর্ণিল এখানে আগে প্রায়ই আসত। যখন পাশের ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে রিসার্চের জন্য আসতে হত। ঘণ্টা তিনেক কাজের পর এক কাপ কফি না খেলে ও আর বাসে চড়ে বাড়ি ফেরার এনার্জি পেত না। সে-ও তো কম দিন হল না। কতদিন হবে? বর্ণিল মনে মনে বছর গুনছে, এই সময়ে দরজা দিয়ে একজনকে ঢুকতে দেখে সব ভুলে গেল।
“আরে প্রিয়মদা। কতদিন পর! আসুন আসুন।”
প্রিয়ম দত্তর সঙ্গে ওর আলাপ সেই কলেজ থেকে। কলেজের ইমিডিয়েট সিনিয়র নয়। বয়েসে অনেক বেশি। প্রিয়মদা কলেজ ছাড়ার পরেও ইউনিয়ন রুমে এসে বসে থাকত। নানা লোককে নানা সাহায্য করত। এটাই ওঁর জীবনের কাজ। বোধহয় পারিবারিক একটা রফতানির ব্যাবসা আছে। ফলে খেটে খাওয়ার দরকার নেই। জয়েন্ট ফ্যামিলি; ব্যাবসা ভাইরা দ্যাখে। প্রিয়মদা এইসব করে বেড়ান। বিয়ে করেননি। পরোপকার ছাড়া একমাত্র নেশা বেড়ানো। অনেকটা বর্ণিলের বাবার মতো। বর্ণিলের বাবা অবশ্য শেষ জীবনে—থাক সে কথা।
উনি টেবিলে বসতেই বর্ণিল জিজ্ঞাসা করল, “হাতে ওইসব কাগজ কীসের?”
“আরে, ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়ের অপারেশন। ব্লাড লাগবে। সেইজন্য ব্লাড ব্যাংকে এসেছিলাম। ওরা সব কাগজ নিয়ে দু-ঘণ্টা ওয়েট করতে বলেছে। তাই এখানে এলাম।”
বর্ণিল হালকা হাসল। টিপিক্যাল প্রিয়মদা। বর্ণিলদের ইয়ারেও একজনের কী একটা অসুখে প্রিয়মদা একাই সব দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছিল, ওর মনে পড়ল। কিন্তু উনি এত কাজ করলেও রাজনীতি একদম করেন না। এমনকি রাজনীতি নিয়ে কথাও বলেন না।
ইতিমধ্যে সেই দেবু খাবার নিয়ে চলে এসেছে। বর্ণিল প্রিয়মদার জন্য কিছু অর্ডার দিতে যাবে, তার আগেই দেবু ওঁর সামনে একটা প্লেটে মুড়ি আর চানাচুর নামিয়ে রাখল। ব্যাটা দূর থেকে দেখেছে যে, প্রিয়মদা এসেছেন। তাই ওঁর পেটেন্ট খাবার নিয়ে চলে এসেছে। প্রিয়মদা দেবুর দিকে একবার দেখে বললেন, “কী রে? এবার প্রাইভেটে মাধ্যমিক দিবি তো?”
দেবু হেসে ঘাড় হেলাল।
বর্ণিল বলল, “সে তো তুমি কতদিন ধরে বলে আসছ। কী রে দেবু? বয়স কত? আর কবে মাধ্যমিক দিবি?”
দেবু বলল, “আমার জন্মের সময়ে সুন্দরবনে আমাদের গ্রামে একটা নারকেল গাছ লাগানো হয়েছিল। সেটা এখন ছয়তলা বাড়ির সমান হয়ে গেছে। বয়স তো আর জানি না।” বলে চলে গেল।
প্রিয়মদা বললেন, “কাজ কি একটা? এই তো, তোদের কলেজে একটা ক্লাসরুমে দরজা ভেঙে গিয়েছিল। স্টুডেন্টরা অনেক অ্যাপ্লিকেশন করেও কিছু করতে পারেনি। শেষে আমি রাইটারসে গিয়ে কথা বলে করালাম।”
‘রাইটারস’ শুনে বর্ণিলের কী যেন একটা মনে এল। কিন্তু পুরো কথাটা এল না। প্রিয়মদা ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই এদিকে কী করতে?”
“এই একটু ঘুরতে।”
“তুই দেশে কবে এলি? লাস্ট তো শুনেছিলাম তুই জার্মানিতে।”
“দেশে? এই তো কয়েকদিন।”
“এমনি ঘুরতে? নাকি কোনো কাজ? কোথায় উঠেছিস? তোদের সেই বাড়িতেই?”
বর্ণিল একটু হাসল। সত্যি বলতে, দেশে যে কেন এসেছে, সেটা ওর মনেও নেই। দেশে এখন সেরকম কেউ চেনা আর নেই। মা-বাবা তো সেই কবেই গত। বোনও বিয়ে করে আমেরিকা। বর্ণিলের দেশে আসার সেরকম কোনো দরকার নেই। তাও এসেছে। আর এসেই কলকাতা ঘুরতে বেরিয়েছে।
প্রিয়মদা বললেন, “আমি উঠি রে। একটা ওষুধ কিনতে হবে। তুই একদিন আমার বাড়ি আয়-না। কোথায় আমার বাড়ি, মনে আছে?”
বর্ণিল কিছুক্ষণ ভেবে তারপর উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে বলল, “জগুবাজার। ইয়েস। মনে আছে। একটা পার্ক ছিল। তার সামনে। ওখানেই থাকো?”
“আর কোথায়? শরিকের বাড়ি। ভাঙা তো যাবে না। আমি একা। একতলায় একটা দিক নিয়ে থাকি। আসিস একদিন। কর্নেল তোকে দেখলে খুশি হবে। আমারও আজকাল একটু হাঁটাহাঁটি করলেই মাথাব্যথা শুরু হয়। তুই বাড়ি আয়। গল্প করব।”
কর্নেল হল প্রিয়মদার পোষা হাস্কি সারমেয়। “কর্নেল?” বর্ণিল অবাক হল। এতদিন বেঁচে আছে? “কুকুরের আয়ু কতদিন হয়, দাদা?” প্রিয়মদা অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, “সে কী রে? কত আর বয়স হবে ওর? তুই কি পাগল হয়েছিস নাকি?” বলে বেরিয়ে গেলেন।
বর্ণিল উঠে পড়ল। আরেকটা জায়গায় যেতে হবে। রাস্তাটা ঠিক মনে নেই। তবে সেই মন্দিরটা চোখে পড়লে রাস্তা চিনতে পারবে। খুব বেশি দূরে নয়। দেবুর জন্য একটা একশো টাকার নোট প্লেটের তলায় রেখে বর্ণিল বেরিয়ে পড়ল। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়েই মনে পড়ল, প্রিয়মদা ‘রাইটারস’ বলল কেন? সে তো এখন ফাঁকা। ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্টের সব কিছু তো এখন নবান্নে। প্রিয়মদা ওদের কলেজ লাইফে অবশ্য রাইটারসে অনেকবার নানা কাজে যেত। প্রিয়মদার এই মাথাব্যথার কথা শুনে আরেকটা কথা কী যেন মনে পড়তে পড়তে পড়ছে না।
ওই তো সেই শিব মন্দিরটা!
বর্ণিল দাঁড়িয়ে পড়ল। রাস্তার একদম শেষে। সামনে একটা আখের শরবতের ঠেলা। এখন প্রায় বিকাল। কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আখের শরবত খাচ্ছে।
এই মন্দিরের পাশ দিয়েই একটা গলি। সেখানে ঢুকে পড়ল বর্ণিল। সরু হলেও পরিষ্কার। অবশ্য একবার বৃষ্টির সময় এসে বর্ণিল পুরো কোমর-জলে আটকে গিয়েছিল। বর্ণিল কয়েক পা হেঁটেই বাড়িটা দেখতে পেল। অরুণ স্যারের বাড়ি। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের কেমিস্ট্রির প্রফেসার। বর্ণিলের পিএইচডি গাইড। দেশে এসে একবার স্যারের সঙ্গে দেখা করতে আসতেই হত। স্যার অনেক হেল্প করেছেন একটা সময়ে। এমনকি পিএইচডি-র পর এখানে চাকরির চেষ্টা না করে সরাসরি পোস্ট ডক করতে আমেরিকা যাওয়ার বুদ্ধি স্যারেরই দেওয়া। তারপর তো সেখানে কাজ করতে করতেই বিশাল চাকরি এবং সারা পৃথিবী ঘোরা। স্যারের বাড়ির নম্বরটা দেখে বর্ণিল বেল টিপল।
একজন মহিলা বেল শুনে দরজা খুললেন। “কাকে চাই?”
“অরুণ বিশ্বাস স্যার আছেন?”
“উনি তো নেই। এখানে আর থাকেন না।”
“ও আচ্ছা। এখন তাহলে কোথায়?”
“জানি না। আমরা এখানে আছি প্রায় সাত বছর। উনি বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছেন।”
বর্ণিল হতাশ হয়ে বেরিয়ে এল। উলটোদিকেই সেই মিষ্টির দোকান। অনেকদিন এরকম হয়েছে যে, ও এসে দেখেছে, স্যার বাড়ি ফেরেনি। তখন এই মিষ্টির দোকানে বসে শিঙাড়া বা অন্য কিছু নিয়ে খেতে খেতে স্যারের দরজার দিকে চোখ রাখত। সেই মিষ্টির দোকানে ঢুকল বর্ণিল।
দোকানের কাউন্টারে যে আছে, তাকে একটু চেনা-চেনা মনে হল। কিন্তু অনেকদিন আগেকার কথা। এই লোকের মুখ মনে থাকবে না। আর সেই সময়ে এই দোকানে বসতে হত দায়ে পড়ে। চোখ থাকত স্যারের দরজার দিকে। ফলে দোকানের লোকের মুখ খুব একটা মনে নেই। বর্ণিল একটা শিঙাড়া আর একটা ক্ষীরকদম্ব নিল। খেতে খেতে দু-একবার স্যারের বাড়িটার দিকে তাকাল। একদম বিদেশ যাওয়ার সময়ে স্যারের সঙ্গে কী একটা নিয়ে যেন রাগারাগি হয়েছিল। পিএইচডি-র পর ও তখন বিদেশে অ্যাপ্লাই করছে। স্যার চাইছেন, ও মলিকিউলার কেমিস্ট্রি নিয়ে কাজ করুক। কিন্তু বর্ণিল চাইছে ড্রাগ ডেভেলপমেন্ট কেমিস্ট্রি। এতে চাকরির সুযোগ অনেক বেশি। সেই নিয়ে মনে হয়, স্যারের সঙ্গে রাগারাগি হয়েছিল।
এখন আর ঠিক মনে পড়ছে না। যা-ই হোক। খাওয়া শেষ করে বর্ণিল ফেরার পথে পা বাড়াল। শেষবার একবার পিছন ফিরে বাড়িটা দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল সেই দোতলার বারান্দাটা। আশ্চর্য! সেই পাতাবাহার গাছগুলো এখনও আছে! এগুলো স্যারের নিজের হাতে লাগানো। বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছেন, কিন্তু নিজের প্রিয় গাছ ফেলে গেছেন? নাকি বাড়িতেই আছেন এখনও? সেই রাগ রয়ে গেছে বলে আর দেখা করলেন না?
বর্ণিল এবার ফিরে চলল নিজের বাড়ির দিকে। ট্যাক্সি ধরে নিল। বেশি দূরের রাস্তা নয়। কিন্তু আর হাঁটতে ভালো লাগছিল না। যেতে যেতে ল্যান্সডাউন মার্কেটের কাছে চোখে পড়ল সেই লাল বাড়িটা। কে থাকতেন এখানে?
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। অলীক মুখার্জি। কবি। স্কুল-কলেজে এঁর কবিতা খুব পড়ত ওরা। প্রায় সেলেব্রিটি কবি ছিলেন। প্রায়ই কলেজের প্রোগ্রামে আসতেন। নিজের কবিতা নিজেই পড়তেন। এ ছাড়া গান লিখতেন। ওঁর একটা কথা শোনার জন্য তখন অনেকেই ভিড় করে থাকত।
এখন অবশ্য বাড়ির সামনে কোনো ভিড় নেই। বর্ণিল অনেকদিন বাংলা বই পড়েনি। আর সময় হয় না। আর এইসব কবিতার বই বিদেশে পাওয়াও যায় না। বার্লিনে অবশ্য এখন একটা ছোটো বঙ্গ উৎসব হয়। সেখানে নাকি কলকাতার কিছু প্রকাশক বইয়ের দোকান দিচ্ছেন। এবার একটু খোঁজ করে দেখতে হবে যে, এইসব কবিতার বই পাওয়া যায় কি না। অবশ্য এখন কি আর ভালো লাগবে?
এইসব ভাবতে ভাবতেই গড়িয়াহাটে বর্ণিলের বাড়ি এসে গেল। দেশে ফিরলে এখানেই ওঠে ও। কেউ আর নেই। সেই শীতলদা বাড়িটাকে সামলে রাখেন। অনেকবার লোকাল নেতা এসে বাড়িটা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বর্ণিলের বাবা ছিলেন নামকরা সরকারি কর্মচারী। ফলে সরকারি ওপরমহলে কিছুটা চেনাজানা আছে। সেইজন্য বাড়িটা এখনও দখল হয়নি। কলকাতায় অন্য কারও বাড়ি হলে এতদিনে হাপিস হয়ে যেত।
বর্ণিল বেল বাজাতে শীতলদা দরজা খুলে হাসল।
“কী? কলকাতা বেড়ানো হল?”
বর্ণিল মাথা নাড়ল।
শীতলদা আজ প্রায় চল্লিশ বছর এই বাড়িতে। প্রথমে এসেছিলেন বাবার সেবা করতে। বর্ণিলের বাবা খুব কম বয়সে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। পক্ষাঘাত। বেঁচে ছিলেন তার পরেও অনেকদিন। কিন্তু কারও সাহায্য ছাড়া কোনো কাজ করতে পারতেন না। শীতলদা সেইজন্য এই বাড়িতে থাকত। ওর আদি বাড়ি বোধহয় কোচবিহার। যা-ই হোক, তারপর থেকে এই বাড়িতেই থেকে গেছে। পুরো ফ্যামিলি নিয়ে চলে এসেছেন। ফ্যামিলি থাকে পাশেই একটা ফ্ল্যাটবাড়ির একতলায়। শীতলদা সেখানে পাম্প চালান। আর এই বাড়িটা বুক দিয়ে আগলে রাখেন।
পরপর মা আর বাবা চলে গেলেন। বর্ণিল অবশ্য আগেই বিদেশে। বোন তখনও বিয়ের পর পাশের পাড়ায় থাকত। কিন্তু তারপর জামাইবাবু আমেরিকায় দারুণ একটা অফার পেয়ে গেলেন। তারপর আর পরিবারের কেউ দেশে নেই।
অবশ্য শীতলদা যেভাবে বাড়িটা রেখেছেন, তাতে মনে হয়, বাড়ির লোক এইমাত্র বেড়াতে গিয়েছে। আবার ফিরে আসবে।
বর্ণিল ঘরে এসে এসি চালিয়ে বসতেই শীতলদা একটা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকে বলল, “তোমার প্রিয় জিনিস এনেছি আজকে!”
বর্ণিল হেসে বলল, “কোনটা?”
“এই যে, ড্রিমল্যান্ডের চিকেন রোল।”
ড্রিমল্যান্ড? সেই রোলের দোকানটা? বর্ণিলের ছোটোবেলায় এই দোকানটা ছিল বাড়ির পাশের গলিতে। অপূর্ব চিকেন রোল বানাত। যেমন বেশি মাংস থাকত, সেরকম ঝাল সস। এরকম টেস্ট বর্ণিল আর কোনো দোকানের রোলে পায়নি। তারপর দোকানটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
“শীতলদা, দোকানটা তো অনেকদিন বন্ধ হয়ে গেছে!”
“না গো। অন্যদিকে উঠে গিয়েছিল। আমি কিছুদিন হল, খোঁজ পেয়েছি। আজকে তুমি বেরোতেই আমি গিয়ে নিয়ে এলাম।”
রোলে কামড় দিয়ে বর্ণিল চোখ বুজে ফেলল। সেই স্বাদ! মনে হল মায়ের গলা যেন শোনা যাচ্ছে—“বাবাই, পুরো রোল একা খাবি না। বোনকে ভাগ দিবি।”
রোল খেতে খেতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল বর্ণিলের। “শীতলদা, আর রাতে কিছু খাব না।” বলেই ছুটে দোতলায় উঠে নিজের সেই ঘরে ঢুকে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। বিছানার নীচে কিছু একটা ছিল। কিন্তু সেটা তাকিয়ে দেখার মতো আর শক্তি ছিল না। ঘুমের জগতে তলিয়ে গেল বর্ণিল।
আইসিইউ-এর বাইরে দাঁড়িয়ে ডা. মিলার চার্ট দেখছিলেন। ভেতরে পেশেন্ট ভেন্টিলেটরে। শুধু বুকটা ওঠানামা করছে। কোনো নড়াচড়া নেই। চার্টের রিপোর্টগুলোও ভালো নয়। ডা. মিলার একটা নিশ্বাস ফেললেন। দেখা যাক! কতদিন চলে।
উনি বাইরে এসে পেশেন্টের বাড়ির লোকের দিকে তাকালেন। অলিভিয়া, তার স্বামী আর ছেলে মুখে উদ্বেগ নিয়ে বাইরে বসে আছে। ডা. মিলার বেরোতেই ওরা উঠে এল।
ডা. মিলার মাথা নাড়লেন, “সেরকম উন্নতি কিছু নেই। মে বি আর একদিন।”
অলিভিয়া মুখ নামিয়ে কাঁদতে শুরু করল। ওর স্বামী অরণ্য জিজ্ঞাসা করল, “ডা. মিলার। যে যন্ত্রটা আপনারা লাগিয়েছেন, সেটাতে কি লাভ হচ্ছে? মানে সেই নে নিউরো এনহ্যান্সার?”
ডা. মিলার অরণ্যকে ডেকে নিলেন ভেতরে। পেশেন্টের গায়ের নানা জায়গায় অজস্র পাইপ, টিউব, লাইন। একটা উজ্জ্বল লাল তার এসে লেগেছে মাথার ঠিক পাশে লাগানো একটা ডিস্কে। আর তারের অন্য প্রান্ত রয়েছে একটা বড়ো সার্কিট বোর্ডে। সেখানে স্ক্রিনে নানা গ্রাফ, সংখ্যা এবং কোড ভেসে উঠছে, পালটে যাচ্ছে।
ডা. মেলার সেই স্ক্রিনের দিকে দেখিয়ে বললেন, “ব্রেইনওয়েভ যা দেখছি, তাতে ফ্রন্টাল লোবে অ্যাকটিভিটি ভালোই। লিম্বিক লোবেও বারবার স্পাইক আসছে। পেশেন্ট মনে হয়, পারছে।”
ইতিমধ্যে অলিভিয়া এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পাশে। “দাদা কী ভাবছে, সেটা কি জানা যায়?”
ডা. মিলার মাথা নাড়লেন, “নো! আমরা শুধু এই সার্কিট ইউজ় করে ওঁর ব্রেইনের অ্যাকটিভিটি বাড়িয়ে মেমোরি এরিয়া অ্যাকটিভ করে রেখেছি। কিন্তু উনি কি কাজে লাগাচ্ছেন সেই মেমোরি, সেটা আমাদের জানার বাইরে।”
অলিভিয়া কাচের দেওয়ালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। দাদা শুয়ে আছে চুপ করে। কিন্তু ওই স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে যে দাদার মস্তিষ্ক প্রচণ্ডভাবেই অ্যাকটিভ। কী ভাবছে দাদা?
ও ডা. মিলারকে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, এই যে দাদা এভাবে শুয়ে আছে, ওর মেমোরি কোনোভাবে স্টিমুলেট করা যায়? মানে ছবি বা গান দিয়ে?”
“দেখুন, চোখ উনি খুলছেন না। ফলে ছবি দিয়ে লাভ নেই। তবে স্মৃতির সব থেকে ভালো বাহন কী জানেন? গন্ধ। আপনি যদি ওর চেনা কোনো গন্ধ এনে দিতে পারেন, তাহলে লাভ হতেও পারে।”
ডা. মিলার আইসিইউ থেকে বেরিয়ে অন্যদিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলেন, কী দুর্ভাগ্য এই লোকটির। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স। জার্মানির একটা নামকরা ড্রাগ কোম্পানির রিসার্চ প্রধান। সামনেই কোম্পানির নতুন ড্রাগ লঞ্চ। উনি ছিলেন তার প্রধান গবেষক। হঠাৎ জীবন কোথায় চলে গেল!!
বার্লিনে এক মিউজ়িক ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিলেন বর্ণিল সেনগুপ্ত। জমজমাট ফেস্টিভ্যাল। গুজব ছিল, পল ম্যাকার্টনি নাকি একবার আসবেন। ফলে লোক উপচে পড়েছিল। চারদিকে ফেসবুক লাইভ আর ইনস্টা রিলের বন্যা বইছে। বর্ণিল নিজেও ফেসবুক লাইভ করে বোনকে দেখাচ্ছিল। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ। আর তারপরেই ফোনের ভিডিয়োটা ঝিরঝির করে, তারপর একটা বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল।
অলিভিয়া ভেবেছিল, কারও হাতের ধাক্কায় ফোনটা পড়ে গেছে আর নষ্ট হয়ে গেছে। ও তারপর ফোন করেছিল দাদাকে। ফোন লাগেনি। শেষে হোয়াট্সঅ্যাপ মেসেজ করে ও কাজে চলে গিয়েছিল। পরে দেখা যাবে। এইসব ভিড়ের জায়গায় এরকম অনেক হয়।
কিন্তু তারপরেই এল সেই ফোন।
বার্লিনের সেই মিউজ়িক ফেস্টিভ্যালে যখন সবাই আনন্দ করছে, এই সময়ে একজন লোক একটা বড়ো পিক আপ ট্রাক নিয়ে সেই ভিড়ের মধ্যে সজোরে চালিয়ে দিল। এরকম ‘লোন উল্ফ’ আক্রমণ ইউরোপে এখন প্রায়ই হয়। একত্রিশজন সঙ্গে সঙ্গে মৃত। একশো আঠারোজন আহত। আর এর মধ্যেই ছিল বর্ণিল সেনগুপ্ত। ট্রাকের সামনের লোহার বাম্পার এসে মেরেছিল তার বুকে। তিনটে রিব ভেঙে ঢুকে গিয়েছিল এবং তার মধ্যে একটা রিব সরাসরি হার্টের ভেন্ট্রিক্ল ফুটো করে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। যা-ই হোক, সিপিআর দিয়ে ওকে নিয়ে আসা হয়েছিল পাশের হাসপাতালে।
কিন্তু জ্ঞান আর ফেরেনি।
অলিভিয়া স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, ওই যে ব্রেইনওয়েভগুলো, ওগুলো কি দাদার চিন্তা? দাদা কী ভাবছে এখন? আর গন্ধ? দাদার কোন গন্ধ ভালো লাগবে? আর এই বিদেশে সেই কলকাতার চেনা গন্ধ আসবে কথা থেকে?
এই সময়ে লিম্বিক লোবের লিডগুলোতে কয়েকটা স্পাইক হল। অলিভিয়া অরণ্যকে ডেকে বলল, “দ্যাখো দ্যাখো, দাদা কী যেন ভাবছে!”
অরণ্য ওকে ধরে বাইরে নিয়ে এল।
বর্ণিল ঘুম ভাঙতেই সরাসরি উঠে বসল। মাথাটা বেশ ফ্রেশ লাগছে।
আর উঠেই ওর মনে পড়ে গেল একটা কথা। প্রিয়মদার যেন কী একটা হয়েছিল? ফেসবুকে ওদের কলেজের গ্রুপেই তো খবরটা দেখেছিল? ক্যানসার না কী একটা? কোথায় যেন পড়েছিল অপারেশনের জন্য ভেলোর গেছে। কিন্তু আজকে দেখে তো সেরকম কিছুই মনে হল না! নিজে তো কিছু বললও না। তাহলে সেরে গেছে মনে হয়। যাক! আচ্ছা যদি আবার দেখা হয়, তাহলে জিজ্ঞাসা করবে।
বিছানা থেকে নামতেই একটা কাগজ পায়ে লাগল। এটা কী?
টেনে বিছানার নীচ থেকে বার করে দেখল, ও মা! এটা সেই বিয়ন্সের পোস্টার। মনে আছে, একবার বোনের সঙ্গে ঝগড়া হল। বোন দেওয়াল থেকে এটা টেনে ছিঁড়ে লুকিয়ে রেখেছিল। বর্ণিল অনেক খুঁজেও পায়নি। তার মানে এই বিছানার নীচে ছিল? বেশ বেশ! এবার বোনের সঙ্গে ভিডিয়ো কল হলেই এটার কথা বলবে। বর্ণিল একবার দেওয়ালের ঘড়িটা দেখল। এখন আমেরিকায় রাত। আর ঘণ্টা তিনেক পরে ফোন করবে। ও পোস্টারটা বার করে বিছানার ওপরে রাখল। বোনের সঙ্গে শেষ কথা কবে হল?
ও হ্যাঁ। সেই মিউজ়িক ফেস্টিভ্যালে। লাইভ ভিডিয়ো করে দেখাচ্ছিল। তারপর কী হল? ভিডিয়ো কেটে গেল? একটা বুকে ব্যথা?
নাহ্। বর্ণিল বুকে হাত দিয়ে দেখল। কোথাও ব্যথা তো নেই! তাহলে কী হল তারপর? কিছুতেই মনে পড়ছে না। মনে হয় জেট ল্যাগ। ঠিক আছে। আবার একটু ঘুমালেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
এই সময়ে বর্ণিল বাইরের ঘরে এসে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে হাঁক দিল, “শীতলদা! আমাকে চা দিয়ো। আর সঙ্গে কেক।” ক-টা বাজে এখন? অন্ধকার হয়ে গেছে?
বর্ণিল বাইরের ঘরের সোফায় এসে বসল। সামনে সেই বইয়ের আলমারি। ওর চোখে পড়ল সেইসব বই, দেশে থাকতে, সেই স্কুল লাইফ থেকে, ওর সঙ্গী। বুদ্ধদেব গুহর ‘মাধুকরী’, ‘জিম করবেট অমনিবাস’, শঙ্করের ‘চরণ ছুঁয়ে যাই’, নারায়ণ সান্যালের ‘বিশ্বাসঘাতক’। শীতলদা বেশ যত্ন করে রেখেছে তো। একটা গান বাজছে কোথাও। কারও বাড়ির টিভি? নাকি মোবাইল? চেনা সুর। অনেক আগে শুনেছে। সিনেমার গান? নাকি ব্যান্ডের?
বসে থাকতে থাকতেই আবার ঘুমে চোখ ঢুলে এল।
সিস্টার বেরিয়ে আসতেই অলিভিয়া জিজ্ঞাসা করল, “কিছু ইনজেকশন দিলেন?”
সিস্টার মাথা নাড়লেন, “পেশেন্টকে সিডেট করতেই হয়। নইলে কষ্ট পাবে। অলিভিয়া স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল, ব্রেইনওয়েভ এখন অনেক কম। দাদা তার মানে এখন ঘুমাচ্ছে। অলিভিয়া একটা আইপডে গান চালিয়ে বিছানার পাশে রেখে এসেছে। দাদার ছোটোবেলার গান। বন্ধুদের সঙ্গে শুনত স্কুলের পর, কারণ ওদের বাড়িতে হেমন্ত, মান্না বা লতা ছাড়া কোনো গান শোনা যেত না। বাড়িতে শোনা বারণ ছিল, তাই দাদা শুনত বন্ধুর বাড়িতে বা পুজোর প্যান্ডেলে। অঞ্জন দত্তর গান, পরে আলিশা চিনয়ের গান। যদি সেই গান কানে ঢোকে, তাহলে দাদার হয়তো সেই দিনের কথা মনে পড়বে।
অ্যাক্সিডেন্টের পর আমেরিকা থেকে জার্মানি এসে অলিভিয়া দেখল, আর কিছুই করার নেই। এতদিন টিভি-তে এরকম ডোমেস্টিক টেররিজ়্মের ঘটনা দেখেছে। এবার দেখতে হল নিজের লোকের সঙ্গে। দাদা পুরো কোমায়। সেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর ব্রেইনে যে অক্সিজেনের অভাব হয়েছিল, সেটাই সর্বনাশ করে দিয়েছে। এই সময়ে ডা. মিলার এই নতুন প্রযুক্তির কথা বললেন। এটা এখন ট্রায়াল চলছে। তার মানে, এটার জন্য এখন কোনো খরচা নেই।
নিউরো এনহ্যান্সার নামে একটা মেশিন কানেক্ট করে দেওয়া হবে রোগীর ব্রেইনের সঙ্গে। কোনো বড়ো অপারেশন নয়। জাস্ট একটা ড্রিল করে একটা ইলেকট্রোড বসিয়ে দেওয়া হবে টেম্পোরাল লোবে। এই মেশিনের কাজ হল, রোগীর মেমোরি এরিয়াকে স্টিমুলেট করা। যেসব রোগীর আর কোনোদিন ঘুম ভাঙবে না, তাদের জন্য এই মেশিন। এই মেশিন রোগীর ব্রেইনে চিন্তাভাবনা, স্মৃতি ইত্যাদি অংশকে উত্তেজিত করবে। ফলে, রোগী নিজের স্মৃতির জগতে ফিরে যেতে পারবে এবং এই শেষ কয়েকদিনে নিজের স্মৃতির মধ্যে থাকতে পারবে। বাইরের জগতের কোনো স্টিমুলাসে রোগী সাড়া দেবে না। কিন্তু নিজের মস্তিষ্কের অবচেতনের জগতে ঘুরে বেড়াবে। অবশ্য বাইরে থেকে গান শুনলে বা গন্ধ নাকে এলে কোনো প্রতিক্রিয়া হবে কি না, সেটা জানা নেই।
সব শুনে অলিভিয়া রাজি হয়েছিল। দাদার এই কোমা আর তো ভাঙবে না। যদি এই শেষ কিছু সময়ে সে নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে শান্তিতে থাকে তো থাকুক। এত প্রমিসিং একটা জীবন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল! অলিভিয়া এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। সিএনএন বা এমএসএনবিসি-তে এই দুর্ঘটনার খবর দেখাচ্ছে। সেইসব খবর দেখেও অলিভিয়ার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, ওই ভিকটিমের তালিকায় ওর দাদা আছে।
ডাক্তাররা বর্ণিলের ব্রেইনওয়েভ স্ক্রিনে দেখছেন। রোগী যদি অবচেতনে খুব উত্তেজিত হয়ে যায়, তখন তাকে শান্ত করা হয়। ডা. মিলার বলেছিলেন, “আমাদের স্বপ্ন মানে তো অবচেতন। তাহলে ধরে নিন, এই শেষ কয়েকদিন আপনার দাদাকে আমরা স্বপ্নের জগতে রাখছি। আমরা নতুন করে কোনো চিন্তা ওঁর মাথায় দেব না। যেসব চিন্তা, সেটা রিসেন্ট হোক বা বহুদিন আগেকার, ওঁর মস্তিষ্কের কোনো না কোনো কোণে আগে থেকেই আছে, সেগুলো শুধু ফিরে আসবে। সেটা ভালো হোক বা খারাপ।” বেশ কয়েকবার বর্ণিল এভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। পাল্স বেড়ে গেছে। তখন ঘুমের ওষুধ দিয়ে ওকে শান্ত করতে হয়েছে। কী ভাবছে ও? এই উত্তেজনা কি আনন্দের না দুঃখের?
কিন্তু সেটাও আর ক-দিন? ডা. মিলার আজকে যা বললেন, তাতে আর তো মনে হয় সময় বেশি নেই। ইউরিন কমে গেছে। সমস্ত অঙ্গ আস্তে আস্তে শাট ডাউন করছে।
এখন স্ক্রিনে কোনো ব্রেইনওয়েভ নেই। অলিভিয়া বেরিয়ে চলে গেল।
ওদের ফ্যামিলি হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে আপডেট দিতে হবে। অবশ্য ফ্যামিলি বলতে আর কে-ই-বা আছে? দূর সম্পর্কের কিছু কাজ়িন। কলকাতার বাড়িটা বিক্রির পর আর দেশে যেতেও হয় না। যতদিন বাবার আমলের শীতলদা ছিল, বাড়িটা ছিল। গত বছর শীতলদা মারা যাওয়ার পর দাদা নিজেই বাড়িটা বিক্রি করে দিল।
ঘুম আবার ভেঙে গেল বর্ণিলের। জেগে উঠে ও দেখল পাশের টেবিলে চা রাখা। তার মানে শীতলদা এসে চুপচাপ রেখে গেছে। ভাবতে ভাবতেই শীতলদা পাশের শোয়ার ঘর থেকে মাথা বাড়াল। “বিছানা গুছিয়ে দিলাম। আর বিছানার ওপর এই যে পোস্টার না কী রেখেছ, সেটা কী হবে?”
“ওটা থাক, রাতে ভিডিয়ো কল করে দেখাব অলিকে।”
শীতলদা বলল, “এটা তো অলিদিদি সেই তোমার থেকে লুকিয়ে রেখেছিল। তা-ই না?”
“তোমার মনে আছে?”
শীতলদা মুচকি হেসে বললেন, “মনে থাকবে না কেন? আমাকেই তো দিয়ে বলেছিল আমার কাছে লুকিয়ে রাখতে!”
বর্ণিল হেসে ফেলল, “সেইজন্য ওর ঘর, মা-বাবার ঘর সব খুঁজেও আমি তখন পাইনি। তুমি এতদিন যত্ন করে রেখেছ?”
এই সময়ে হঠাৎ বর্ণিল বলল, “শীতলদা, একটা হাসপাতাল-হাসপাতাল গন্ধ পাচ্ছ?”
শীতলদা বলল, “তোমার মাথাটা খারাপ হয়েছে। কোথায় আর ওই গন্ধ? যখন বাবু ছিলেন, তখন তো বাড়িটা একটা হাসপাতাল ছিল। এখন আর কী?”
বর্ণিলের বাবার জন্য বাড়িতে ডাক্তার, নার্স আসা-যাওয়া লেগেই থাকত। আজ ইনজেকশন, কাল ড্রেসিং। এই পাশের ঘরটাতেই ছিলেন বাবা। বর্ণিলের এইসব একদম সহ্য হত না। ইনজেকশন, ছুরি, তুলো দেখলেই ওর বমি আসত। ও বেশি বাবার ঘরে আসত না।
তারপর বর্ণিল বলল, “তুমি যতদিন আছ, এই বাড়ি থাকবে। তারপর আমি বাড়ি বিক্রি করে দেব। আর তো ফিরব না। এই বাড়ি কে দেখবে?”
শীতলদা কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল কাশতে কাশতে। বর্ণিল বলল, “তোমার আবার কাশি হয়েছে নাকি?”
“সে তো আমার সারাবছরই থাকে, দাদা।”
“কতবার বলেছি, বিড়ি এবার ছাড়ো। সে তো শুনবে না।”
বর্ণিল উঠে বুকশেল্ফের দিকে গেল। সেইসব পুরোনো বই। টিনটিন, ফেলুদা, রাস্কিন বন্ড। মনে আছে, একবার স্কুলে রাস্কিন বন্ড নিয়ে গিয়েছিল ও। বন্ধুরা কাড়াকাড়ি করে পড়েছিল। তখন বাবা সারা ভারত ঘুরে বেড়াত। আর ছেলেমেয়ের জন্য এইসব বই, খেলনা নিয়ে আসত। বর্ণিলের হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাবার এরকম কম বয়সে স্ট্রোক হল! অত প্রাণচঞ্চল মানুষটা পুরো অথর্ব হয়ে গেলেন। শীতলদা ছিল, তাই অনেকদিন বেঁচে ছিলেন। কিন্তু যিনি সাত দিনের নোটিশে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে ট্রেক করতে যেতেন, তাঁর কাছে এরকম বেঁচে থাকা খুব, খুব কষ্টের।
একটা বই বার করে বর্ণিল বিছানায় এসে শুল। সেই ছোটোবেলার মতো। বইয়ের পাতা খুলেই মনে হচ্ছিল, মা বোধহয় নীচ থেকে ডাক দেবে, “বাবাই, পড়তে বোস।”
বইটা খুলেই কয়েক পাতা পড়ার পর বর্ণিল দেখল, ও ঠিক কনসেনট্রেট করতে পারছে না। বই পড়তে গিয়ে বারবার অন্যদিকে মন চলে যাচ্ছে। একবার মনে পড়ল শীতলদার কাশিটার কথা। কে যেন কী একটা বলেছিল। ডাক্তার কি? একবার যেন হাসপাতালে নিয়ে দেখানো হয়েছিল। কিছু কি ধরা পড়েছিল?
বইয়ের পাতার দিকে চোখ দিতেই বর্ণিল দেখল, লেখাগুলো কেমন যেন হয়ে গেছে। মানে, ইংরেজিতে লেখা। কিন্তু ও কিছুই বুঝতে পারছে না। কী হচ্ছে? ও চোখ কচলে আবার তাকাল।
অলিভিয়া আর অরণ্য বাইরে থেকে উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে ছিল। ভেতরে দুজন ডাক্তার আর দুজন নার্স ছোটাছুটি করছেন। দু-তিনটে মনিটর থেকে ক্রমাগত ইলেকট্রনিক বিপ শোনা যাচ্ছে। একটা মনিটর ফ্ল্যাশ করছে। কিছু একটা প্রবলেম হয়েছে। ওরা শুনেছে যে, হঠাৎ করেই নাকি সোডিয়াম ফল করে গেছে। ব্যাস। ব্লাড প্রেশার ফল করেছে। নিউরো এনহ্যান্সার স্ক্রিনে ব্রেইনওয়েভ উলটো-পালটা ওঠানামা করছে। বর্ণিলের হাত-পা নাড়ার ক্ষমতা নেই। কিন্তু চোখের পাতা কাঁপছে।
বর্ণিল বইয়ের পাতা উলটে অবাক হল। প্রথম পাতায় রাস্কিন বন্ডের গল্প। পরের পাতায় টিনটিনের বইয়ের ছবি। তার পরের পাতায় ব্যাটম্যান। আবার বইয়ের মাঝখানে লালমোহনবাবুর ছবি আঁকা। উনি জপযন্ত্র ঘোরাচ্ছেন। বর্ণিল ভাবল, সেই কাঠমান্ডুর লালমোহনবাবুর মতো ওকেই কেউ এলএসডি খাইয়ে দিয়েছে নাকি? একটা বইতে এরকম এত ছবি কেন? নাকি কেউ মজা করার জন্য সব বই থেকে একটা করে পাতা ছিঁড়ে একসঙ্গে লাগিয়ে দিয়েছে?
নাহ্। এবার উঠে পড়া যাক। আমেরিকায় ফোন করতে হবে। মেঝেতে ওটা কী পড়ে আছে? বর্ণিল উঠে জিনিসটা হাতে তুলে দেখল। একটা নীল মাছ। ঠান্ডা।
ওর মনে পড়ে গেল, ছোটোবেলায় একবার ও বাড়িতে অ্যাকোয়ারিয়ামে এরকম একটা নীল মাছ রেখেছিল। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখেছিল, সেই নীল মাছটা জল থেকে লাফিয়ে বাইরে মেঝের ওপর পড়েছে। মাছটা ততক্ষণে মরেই গেছে। খুব দুঃখ হয়েছিল সেদিন। কিন্তু সেই মাছ এখানে এল কী করে? শীতলদা কি সেই মাছ আবার পুষেছে? কই? বলল না তো! আর বাড়িতে সেভাবে অ্যাকোয়ারিয়াম তো চোখে পড়েনি।
এই মাছটাও মরে গেছে। বর্ণিল জানলা খুলে মাছটা ছুড়ে ফেলে দিল। জানলার বাইরে সেই কদম ফুলের গাছটা। একবার একটা টুনটুনি এই গাছে বাসা বেঁধেছিল। ছোটোবেলায় ওর ধারণা ছিল, এই গাছে একটা ভূত থাকে। রোজ রাতে সেটা মুখ দিয়ে নানারকম শব্দ করে।
আবার মাথাটা কেমন করছে। বর্ণিল এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
ডা. মিলার বিমর্ষ মুখে বাইরে এসে বললেন, “সরি। আর কিছু করার নেই।”
অলিভিয়া কাচের ভেতর দিয়ে দেখল, সব ক-টা স্ক্রিনের ওয়েভগুলো আস্তে আস্তে সোজা লাইন হয়ে যাচ্ছে।
ও ডা. মিলারকে জিজ্ঞাসা করল, “ওই নিউরোএনহ্যান্সার?”
“ব্রেইন ডেড হয়ে গেলে তো ওটার আর কোনো ফাংশন নেই। সেটা হলে আমরা খুলে নেব।”
সেই মেশিনের স্ক্রিনে তখনও একটু একটু ওয়েভ আসছে। কখনও পরপর দু-চারটে ওয়েভ। আবার কিছুক্ষণ খালি। তারপর আবার দুটো স্পাইক।
একটা অদ্ভুত ভালো-লাগা ঘিরে ধরেছে বর্ণিলকে। কে যেন ওই বইয়ের তাক থেকে অনেকগুলো বই এনে খাটে সাজিয়ে দিয়েছে। বর্ণিল বসে আছে তার মাঝখানে। অন্যদিকে রাখা ওর ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট, বাস্কেটবল। আরও অন্যদিকে ওই সেই প্রিয় ক্যামেরা, যেটা দিয়ে ও এই জানালা থেকে টুনটুনির বাসার ছবি তুলত। একবার টিনটিনের বই খুলে দেখল। মনে হল যেন বইয়ের পাতা থেকে টিনটিন বেরিয়ে এসে হাসছে। আবার অন্য একটা বই খুলে দেখল। প্রফেসার শঙ্কু মিশরে হিরে তৈরি করছেন। আশ্চর্য, এরকম বই হয় নাকি? বইয়ের পাতা খুললেই যেন অ্যানিমেশন চালু হয়ে যাচ্ছে। বর্ণিল দু-পা ছড়িয়ে বিছানায় বসে আরামে বালিশে হেলান দিল। আহ্! কতদিন পর। কোনো চিন্তা নেই, ভাবনা নেই। নীচ থেকে শীতলদার রান্নার দারুণ সুগন্ধ আসছে। জানলাটা খোলা ছিল। মনে হচ্ছে, বৃষ্টি শুরু হল। একটা বই তুলে নিয়ে বর্ণিল গন্ধটা শুঁকল। অপূর্ব গন্ধ। কোথায় ছিল এইসব গন্ধ?
চোখ বন্ধ করে, মুখের ওপর বইটা রেখে, গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বর্ণিল বালিশে মাথা এলিয়ে দিল। একটা শব্দ আসছে। সেই ছোটোবেলায় এই ঘরে শুয়ে রাতে যেরকম শব্দ শুনলে ও ভয় পেত, সেরকম। কদম গাছে সেই ভূতটা এসেছে নাকি? একবার উঠে দেখবে?
পিঁক পিঁক করে কয়েকবার শব্দ করে শেষ স্ক্রিনটাও থেমে গেল। এখন শুধু সোজা লাইন আসছে। ওপর-নীচে নড়ছে না লাইন।
অলিভিয়া স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, শেষদিকে কী ভাবল দাদা? ওর কথা কি মনে পড়েছিল? মা-বাবার কথা? বর্ণিলের দেহ এখন নিথর হয়ে বিছানায়। মুখে এত কষ্টের সব রেশ মুছে গিয়ে একটা স্মিত হাসি।
Tags: ডা. রুদ্রজিৎ পাল, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
