শর্তহীন
লেখক: মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
কী উলটো-পালটা হাওয়ার একটা দিন। মুখের, ঠোঁটের চারপাশে বিঁধছে, ঠোঁট দুটো একবার চেটে নিলেন তিনি। শীতাতপনিয়ন্ত্রক জামাকাপড় পরে বেরোলে ঠান্ডা-গরম কিছুই তেমন গায়ে লাগে না—কিন্তু মুখটাকে বাঁচানো যায় না। বড়ো কঠিন নির্দয়ী আবহাওয়া। কাঁচাপাকা চুলগুলো বিশ্রস্ত। সেই পুরোনো দিনের অধ্যাপকদের মতোই লাগে প্রফেসার আবিদকে। হেঁটে চলেছেন সুদীর্ঘ কংক্রিটের এক রাস্তা। কিছু দূর অন্তর অন্তর সিঁড়ি নেমে বা উঠে গিয়ে সংযুক্ত করেছে কখনও বিল্ডিং অথবা অন্য কোনো রাস্তার সঙ্গে। এই প্রধান পথটি মাটির ওপরে তিনতলা উচ্চতায়। রাস্তার মাঝখানে, পাশে সযত্নে লাগানো গাছ। এখন ঠান্ডায় পাতাহীন। বিশ্ববিদ্যালয় বিশাল বড়ো। ছড়ানো।
সমস্যাটা হল, মানুষ এখন বড়ো বেশি দিন বাঁচে। সমস্যা ভাবলে সমস্যা, তথ্য বললে তথ্য। তাই প্রকৃতির নিয়মে হাঁটু ক্ষয় যায়, বদলাতে হয়, কিন্তু প্রায় বার্ধক্য পৌঁছেও আবিদ বদলাবেন না… এই ছড়ানো ক্যাম্পাসে তাকে হাঁটতে হয় অনেকটা, কিন্তু ওই কষ্টটুকু তিনি করেন। এখন চলেছেন ক্যাম্পাসের উত্তর প্রান্তে। পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে—বিশাল। পরিবেশ ভূতত্ত্ব, ভূবিজ্ঞান, প্রাণীবিজ্ঞান, প্রাণী মনোবিজ্ঞান—তবে পরিবেশগত আইন বিভাগ? না, এখনও বানানো হয়নি। আইন আর কেউ বিশেষ ভাঙে না। আইন ভাঙতে ভাঙতে, অপচয় করতে করতে, ধ্বংস করতে করতে নিজেরাও শেষ হতে হতে এখন বেশি মানুষ আর বাকি নেই। তাই বাধ্যবাধকতার মধ্যেই থাকে। তা ছাড়া না থাকলেও বিপদ। এখন প্রকৃতি করুণাহীন। সেই একটা গান ছিল না, বিরাট শিশু না কী যেন? এই শান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে, এই হাসছে, এই হাত থেকে খেলনা ছুড়ে কান্না জুড়ছে বিকট চিৎকার করে। আর সেটা হলে কখনও আসে বিধ্বংসী বৃষ্টি, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নদীতে বন্যা, মারাত্মক তুষারপাত, কোথাও অন্ধকার করে বালির ঝড় হাজার হাজার মাইল জুড়ে। শিশু যেমনভাবে পুতুল খ্যালে, মানুষ তেমনি থাকে। প্রকৃতির ইচ্ছেয়। কোনোরকমে।
যে ক-টি ভূখণ্ড অবশিষ্ট আছে, তাতে পূর্বতন ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের একটি জায়গায় এই বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সময়ে এখানে হরিয়ানা বলে একটি প্রদেশ ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের চেহারা ছিল অন্যরকম। পুরোনো ভারতবর্ষের একটি ভিডিয়ো ক্লিপিং-এ দেখেছিলেন—এই সমস্ত জায়গায় ছিল আদিগন্ত সরষে ফুলে ঢাকা খেত, সোনালি-নীল আকাশে খুব উঁচুতে সাদা সাদা মেঘখণ্ড, তিনি কল্পনা করেন, হলুদ ফুলখেতের মাঝখান দিয়ে যাওয়া কাঁচা রাস্তায় শনশন করে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে একটি মেয়ে, তার সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলানো খাবারের টিফিন ক্যারিয়ার। তার বাবার জন্য। এরকম মন-ভালো-করে-দেওয়া দৃশ্য হুট করে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। খুব উঁচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখি, উড়ছে না ভেসে আছে? ইশ্, একবার যদি দেখা যেত। নেই—পাখি নেই, পশু নেই, শস্য নেই, অরণ্য নেই, খাঁ খাঁ-করা ঊষর জমি শুধু। সেই একের পর এক আসা মহা সাইক্লোনে ধ্বংস হয়ে গেছে—দেশের উপকূল ভেসে গেছে। খণ্ড খণ্ড ক-টা দ্বীপে অবশিষ্ট আছে ভারতীয় উপমহাদেশ। পশুপাখিরা নিজেদেরকে বাঁচাতে পারেনি, বুদ্ধিমান কিছু হাতে গোনা মানুষ পেরেছিল। তাদের উত্তরসূরিরাই আবার গড়ে তুলেছে সভ্যতা। তাই এই গোটা পৃথিবীতে এখন বিশ্ববিদ্যালয় আছে হাতে গোনা। এখন পৃথিবীতে মানুষ কম, তাই শিক্ষক কম, ছাত্রছাত্রী কম, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খুব ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। এখন পড়ার বিষয়গুলোর মধ্যে বিভেদরেখা নেই, একের অন্যের মধ্যে অনায়াস যাতায়াত, ঢিলেঢালা জানতে চাওয়া, শিখতে চাওয়া… কোথাও পৌঁছোনোর তাড়া নেই, যা শেখা, গভীরভাবে যত্ন করে শেখা—তাদের জন্য, যারা শিখতে চায়।
কিছুদিন বাদে বাদে সব অধ্যাপকের মিটিং হয়, কারণে তো বটেই, কখনও তেমন কোনো কারণ ছাড়াই। শুধু কথা বলার আর শোনার জন্য। সহকর্মীরা মুখোমুখি দেখা হওয়া। ছুঁয়ে থাকা। এত সংখ্যায় কম, তাই বেঁধে বেঁধে থাকা। আবিদ বড়ো চুপচাপ মানুষ। কথা বলেন না বিশেষ। একাচোরা। তবে আসেন মিটিংগুলোতে। সবার কথা শোনেন। আজকের মিটিং-এর কারণ তিনি আবছা জানেন। খোলা স্বচ্ছ দেওয়াল, অনেক আলো দিয়ে শেষ দুপুরের রোদ লুটোপাটি খাচ্ছে। এদিক-ওদিক জটলা করে গল্প করছে তাঁর সহকর্মীরা। এরাই তাঁর বন্ধুও। তাঁকে দেখে হইহই গলায় বলে উঠলেন প্রফেসার ইরম, ‘আরে আসুন আসুন আবিদ… দেখেছেন, পাখিরা কী কাণ্ড করেছে?’
সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখ গেল ঘরে আর-একদিকে আরামচেয়ারে বসা প্রফেসার উইংসের দিকে… বয়সের অনেকখানি আঁচড় মুখে, কাজ করেন প্রাণী মনোবিজ্ঞান নিয়ে, আর সময়ে পেলেই পেনসিল স্কেচ। ওঁর আঁকার প্রিয় বিষয়—ডানা… ছোট্ট উড়তে-পারা পোকা থেকে পাখি, মোট কথা, ডানা যাদের আছে…। তাই ওঁর এই নামকরণ। এখন বেশ কিছু মানুষের মধ্যে দেখা যায় ছবি তুলে রাখা বা এঁকে রাখা—চারপাশের ছোট্ট ছোট্ট জিনিসের। ঝরে-যাওয়া ফুল, মুকুল, পাতা সংরক্ষণ করা। খুব যত্নে রেখে দেওয়া—
প্রফেসার আবিদ তাকিয়ে আছেন ইরমের দিকে—
‘দক্ষিণের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খবর এসেছে। এ বছরও পাখিরা ওখানে পৌঁছেছে।’
আবার? এই নিয়ে দ্বিতীয় বছর… পরিযায়ীরা আবার এখানকার গরম জায়গায় ফিরছে… আবার শুরু হয়েছে… পৃথিবীর একটা আবর্তনে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরা।
চারদিকে কথা, উল্লাসের টুকরো। আবিদের নিবে-যাওয়া মনটাতে, সারাদিনে প্রথম একটা খোলা ছটফটে হাওয়া খেলে গেল। একচিলতে হাসি এল মুখে। তারপর হইহই করে এসে গেল কেক। আজ তার জন্মদিন। সারা ঘর ভরে গেল জন্মদিনের শুভেচ্ছা গানে। পৃথিবী গেছে অনেক ধ্বংস, পুনর্নির্মাণের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু কিছু কিছু জিনিস একদম আগের মতো আছে। যেমন জন্মদিনের শুভেচ্ছা গান। জন্মদিনের কেক। তারপর গল্প। ছাত্রছাত্রীদের প্রোজেক্ট, মজার গল্প, দুষ্টুমি—এসবের গল্পে সরগরম হয়ে উঠল চারদিক। এই গল্পগুলোই মিটিংগুলোর প্রাণশক্তি। এর মুখ থেকে বার হয়ে, অন্যের হৃদয়ে পৌঁছিয়ে তৈরি করে একটা শক্তিক্ষেত্র, একটা চুম্বকক্ষেত্রের মতো, সবাইকে টেনে রাখে, বেঁধে ফ্যালে। একটু একটু করে তৈরি হচ্ছে একটা প্রজন্ম—তাদের হাতে। তাঁরাও আবার বাঁচছেন।
আর ঠিক এই জায়গাতেই প্রফেসার আবিদ বসে থাকেন একা। একটি নিঃসঙ্গ ভূতের মতো। তাঁর ভাগ করার মতো কিছু নেই। তিনি ইতিহাসের অধ্যাপক। যখন পড়ান ছাত্রছাত্রীদের, যখন আলোচনা হয়, তিনি ওদের চোখে শুধু ঘৃণা দেখেন, বিশ্বাসঘাতকতার ওপর ঘৃণা। পৃথিবীকে একটু একটু করে ধ্বংস করে ফেলেছে যে মানুষরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, যাদের জন্য ধ্বংসস্তূপের ওপর বাস করে আজকের প্রজন্ম, তাদের প্রতিনিধি যেন তিনি; তার কাছেই শুনতে পায় তারা, কত সুন্দর ছিল পৃথিবী—তার ঋতু, গভীর অরণ্য, সময়ের বৃষ্টি, ঠিক সময়ে বওয়া সমুদ্রস্রোত, সময়ের ফসল, দেশে দেশে জন্মানো ভিন্ন ফসল, কত ধরনের প্রাণী। সব সব। আরে, তিনিও দেখেননি বহু কিছুই! তিনিও প্রত্যেকদিন শুধু ওদের মতোই হাওয়ায় উড়তে-থাকা রোবো মাইক্রো-মৌমাছি দেখতে অভ্যস্ত। যারা আগত আবহাওয়া বিপর্যয় বুঝতে পারলে তাদের আওয়াজ বাড়তে থাকে, মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় নেবার প্রস্তুতি নিতে হয়। কিন্তু ছাত্ররা বোঝে না। ওরা বৃদ্ধ ইতিহাসের অধ্যাপককেই দেখতে পায়—বিশ্বাসঘাতক পূর্বপ্রজন্মের প্রতিনিধি। তাঁর মুখেই বিশ্বাসঘাতকতা কেন লেখা? আর কেন তিনি ওই আগের পৃথিবীটা থেকে আনন্দ শুষে নেওয়াটা শেখাতে পারেননি? শুধু ওরা দেখতে পায়… ওরা কী পেল না।
অথচ ইতিহাস না পড়লে অতীতের ভুল-ঠিকগুলো জানবে কী করে? জানবে কী করে, কোন ভুল কোনো কিছুর বিনিময়ে আর করবে না? আর কোন জিনিসগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে? রক্ষা করতে হবে—
আর আজ তো…
ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
‘থ্যাংক ইউ তোমাদের সকলকে—এবার আমি বাড়ি যাব। ক্লান্ত লাগছে।’
সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে।
প্রফেসার থাপা বলে উঠলেন, ‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না তো… এমনি।’
‘ক্লাসে বুঝি?’
‘ওই আর কী।’
‘কী?’
একটা ক্লিষ্ট হাসি ফুটে উঠল তার মুখে।
থাপা এগিয়ে এসে তার কাঁধে একটা হাত রাখলেন, ‘ওহ্ তোমার রিসার্চ পেপারের কাজ শুরু হয়েছে।’
থাপা জানেন। অনেকেই জানে। এই বড়ো রিসার্চ পেপারের যখন সময় আসে, ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীরা একটা বিষয়েই লেখে। অনেক ভাবে। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কিন্তু মূল বিষয়টা একই।
‘যেমনভাবে এই পৃথিবীকে পেয়েছি আমরা।’ এই বহুভাবে ধ্বংস-হয়ে-যাওয়া পৃথিবীতে, প্রকৃতির নির্মমতা সহ্য করে বাঁচা এই প্রজন্মের গবেষণার বিষয় মূলত কারা এর জন্য দায়ী, কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেত, কী কী করা হয়নি, কীভাবে তাদের কথা পূর্বপ্রজন্ম বিন্দুমাত্র ভাবেনি। বহু-পূর্ব প্রজন্ম। এই প্রেজ়েন্টেশনগুলোর মাঝখানে বৃদ্ধ প্রফেসার আবিদ যেন দাঁড়িয়ে থাকেন পূর্বমানুষদের দায়ভার কাঁধে নিয়ে।
আর বারবার এই কথাগুলো বলতে ভালো লাগে না।
চিন্তাসূত্রটা ভেঙে গেল।
‘আপনার গিফটটা নেবেন না?’ প্রফেসার ফার্নান্দো বলে উঠলেন।
‘গিফট?’
‘এই তো।’ ঘরের কোণেই রাখা ছিল, তিনি তেমনভাবে খেয়াল করেননি। একটা স্কুটার। নীচে একটা পাটাতন, তার নীচে দু-জোড়া চাকা, লম্বা হ্যান্ডেল আর ওপরে ছোটো একটি হ্যান্ডেল। পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে ছোটো হ্যান্ডেল ধরে এগিয়ে যেতে হয়। লম্বা হ্যান্ডেলে ছোটো ছোটো সোলার প্যানেল, ধরার হ্যান্ডেল কয়েকটা সুইচ। ই-স্কুটার। ছিমছাম।
‘আমার হাঁটতে কষ্ট হয় বলে? খুব থটফুল। থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।’
মনের মধ্যে এল, কিন্তু আমি তো হাঁটবই, তখন এটাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে?
প্রফেসার ফার্নান্দো যেন তার মনের কথা পড়ে নিলেন।
‘আমরা জানি, আপনি হাঁটতে ভালোবাসেন, হাঁটবেন। যখন আপনি হাঁটবেন, তখন ও আপনাকে অনুসরণ করবে। আবিদ, আগে আপনি ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে এটা চালু করুন।’
আধ ঘণ্টা বাদে তিনি যখন বাড়ির রাস্তায়, ওঁর পাশে পাশে হাঁটছে স্কুটারটা। শেষ খানিকটা রাস্তা তিনি চাপলেন স্কুটারটাতে, প্রথমদিকে একটু অসুবিধে হলেও, পথের শেষটা একটু সহজ হয়ে গেল। তবে গতি বেশ কম।
যাক, এবার এর রাখার জায়গা কোথায় হবে, বাড়িতে ঢুকেই বিক্রয় সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।
‘একে কোথায় রাখতে পারি?’
ওপার থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত সহকারী বলে উঠল, ‘একে আপনার বাড়ির যে-কোনো জায়গায় রাখতে পারেন। কোনো অসুবিধা নেই।’
‘বাড়ির মধ্যে? আমি তো ভাবছিলাম, নীচে একটা কমন বাইক রাখার জায়গা আছে…’
‘বাইক স্ট্যান্ডে রাখতে পারবেন না। ফিট করবে না।’
‘করবে না? কিন্তু দেখেছি তো, এরকম স্কুটার আছে?’
‘না, এই মডেল একটু ছোটো, ফিট করবে না।’
একটু ভাবলেন আবিদ।
‘আচ্ছা, ভাঁজ করে কোথাও রাখতে পারব?’
‘না। এত ভাবছেন কেন? যেখানে হোক রেখে দিন। বেশি জায়গা নেবে না। এইচবিএফ-এর এই মডেলগুলো খুব লো মেইনটেনেন্স।’
এবার একটু বিরক্তি আসছে। ক্লান্তিও বোধ হচ্ছে। স্কুটারটা একটু বেশি বৈশিষ্ট্যহীন না?
তাঁর ফ্ল্যাটের ঢোকার দরজার পাশে রেখে দিলেন—রাখার আগে চোখে পড়ল, হ্যান্ডেলের কাছে খুব ছোটো ছোটো করে লেখা আছে ‘এইচবিএফ’।
প্রথম দিন রাত কেটে গেল একদম ঘটনাবিহীন। স্কুটারটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন কলেজে, অনেকটা রাস্তা চেপে দেখলেন। লক্ষ করলেন রাস্তায় চলা অন্য স্কুটারের তুলনায় একটু ধীর। আজ তিনি একটু খেয়াল করছিলেন, মাথার ওপর উড়তে-থাকা কয়েকটি যাত্রীবাহী ড্রোন, রাস্তায় কয়েকটি সাইকেল, বিভিন্ন ধরনের স্কুটার। অন্যদিনে এগুলোকে পরিবেশেরই অংশ মনে হয়, আজ একটু খেয়াল করে দেখছেন। আজ আবহাওয়া স্তিমিত। সুন্দরই বলা যায়। তাই বেশ ঠান্ডা থাকলেও মানুষ বাইরে। কলেজের মধ্যে প্রশস্ত করিডরে স্কুটারটি তাকে ধীরেসুস্থে অনুসরণ করল। ক্লাসের বাইরে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা ছিল। বিকেলের আগে খেয়ালই করেননি। বাড়ি ফিরে রাত্রে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মাঝরাতে একটা অস্বস্তিতে ঘুম সম্পূর্ণ ভেঙে গেল। দরজার বাইরে কে দাঁড়িয়ে? আধো অন্ধকারের মধ্যে চট করে সরে গেল। এক মুহূর্ত সময় লাগল বুঝতে। তার স্কুটারের মাথাটা, মনে হল যেন ঘাড় বেঁকিয়ে তাকেই দেখছিল। তিনি নিঃশব্দে শুয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ বাদে নিঃশব্দে ভেতরে এল স্কুটারটা। উলটোদিকের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল।
পরদিন রাত্রে প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি হল। গল্ফ বলের মাপের শক্ত বরফ। কানফাটানো আওয়াজ। এখন যে-কোনো সময় হয়।
তিনি বিছানায় উঠে বসলেন, একটু জল খাবেন। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে চোখে পড়ল, ওঁর খাটের পাশে সাইড টেবিলের সামনে পড়ে আছে। জল খেয়ে এসে একবার তাকালেন ওটার দিকে, একঝলক মনে হল, কেমন যেন একদিকে ফিরে ঘুমোচ্ছে।
পরের ছুটির দিনটা। তিনি উঠে দেখলেন স্কুটারটা বিছানার নীচে, মাটিতে। কিন্তু সেদিন সকালে দুজন বন্ধুর সঙ্গে বেরোবার প্ল্যান ছিল। উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে যখন বেরোলেন, স্কুটারের কথা তাঁর মনে ছিল না। বাইরে ঝিরঝির করে বরফ পড়ছে, একবার মনে হল… তারপর ভাবলেন, ভালোই হয়েছে, আনেননি। ফিরতে বেশ দেরি হল। সময়টা বড়ো ভালো কেটেছে। মনটা বেশ হালকা। দরজা একটু অন্যমনস্ক হয়ে খুলতে গিয়ে ধাক্কা খেল, স্কুটারটা একদম সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এর পরদিন থেকে এই দরজায় প্রায় ধাক্কা খাবার ব্যাপারটা বেশ চালু হয়ে গেল। স্নান করতে বা বাথরুমে গেছেন, দরজা খুলে অন্যমনস্কভাবে প্রায় ধাক্কা খেলেন। ও কি এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল? আশ্চর্য তো? আরও মজা হল পরের ছুটির দিন। তিনি একটু আগে উঠে পড়েছেন, হাঁটতে যাবেন, নিঃশব্দে তৈরি হয়ে দরজার কাছে এসে দেখেন স্কুটারটা ওখানেই দাঁড়িয়ে। হ্যান্ডেলটা একটু বেঁকানো, যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি দরজা খুলতেই, ও সাঁ করে আগে বেরিয়ে গেল।
রোববার। আজ পায়ে বেশ ব্যথা। তিনি এক কাপ কফি নিয়ে আর্মচেয়ারে বসলেন। মন দিয়ে গান শুনবেন অনেকক্ষণ। স্কুটার একটু আস্তে আস্তে এসে প্রথমে দরজার দিকে গেল। তারপর ফিরে এল আর দাঁড়িয়ে রইল। তাঁর চেয়ারের কাছ ঘেঁষে।
কী মনে হতে তিনি ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গুড মর্নিং, মর্নিং।’ কেন বললেন, নিজেও জানেন না। নিজের মনেই হেসে ফেললেন।
ওর হ্যান্ডেলটা একদিকে বেঁকে গেল, যেন শুনল।
স্কুটারের মনে হয়, মর্নিং নামটা পছন্দ হয়েছে।
নিজের অজান্তে আবার হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে। স্কুটারকে নাম দিলেন?
তারপর অভ্যেস হয়ে গেল খুব দ্রুত।
‘মর্নিং, চলো।’
‘মর্নিং, সামনে একটু উঁচু আছে।’
‘মর্নিং, দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
‘মর্নিং, একটু তাড়াতাড়ি।’
‘উফফ কী ঠান্ডা রে, তোকে আনলাম কেন।’
তারপর ঘটল আশ্চর্য ঘটনা।
বহুদিন বাদে একটি তাইচির ক্লাস করতে গিয়েছিলেন, উনি এই ক্লাস খুব উপভোগ করেন। ক্লাসটি একটি খুব সুন্দর গ্লাস ডোমের মধ্যে হয়… ভেতরে অনেক গাছ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের গাছ আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছে। অনেক মানুষ আসে এই ক্লাসে। শরীর-মন দুইয়েরই আরাম। তিনি মর্নিংকে বাইরে বাইক স্ট্যান্ডে রেখে চলে গেলেন, ক্লাস শুরু হল, মগ্ন হয়ে সবাই তাইচি করছে, হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল। শুধু তাঁর নয়, ক্লাসে সবাইকার। বাইরে মর্নিং ভীষণ দ্রুত বেগে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াত করছে, দৌড়োচ্ছে বলা যায়। আশ্চর্যজনকভাবে মাঝে মাঝে লাফিয়ে উঠছে। মুখটা ডোমের দরজার দিকে। খানিকটা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন।
‘মর্নিং?’ তিনি যেতেই স্থির হল সে।
তিনি জানেন না কেন, খুব বিরক্ত হলেন, লজ্জাও পেলেন।
এ কী ধরনের স্কুটার?
বাড়িতে এসেই এইচবিএফ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ঘটনাটা বললেন। বলতে বলতেই একটা সম্ভাবনা তাঁর মনে এল।
কোম্পানি থেকে তাঁকে বলল, ‘স্কুটারটা কি আপনি দেখতে পাচ্ছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘ও দেখতে পাচ্ছিল?’
‘তার মানে?’
‘মানে ওই আর কী, দৃষ্টিসীমার মধ্যে ছিল?’
কথাটা তিনি খেয়াল করলেন না। বলে উঠলেন, ‘আচ্ছা, রোদে ওর সোলার প্যানেলগুলো বেশি অ্যাকটিভ হয়ে যেতে পারে? ওভার স্টিমুলেটেড?’
‘সোলার প্যানেল? নট শিয়োর। কিন্তু আপনাকে বলেছিলাম, ওকে বাইরে রাখবেন না প্লিজ়? রাখবেন না। আর কিছু সমস্যা?’
‘না, তেমন কিছু নেই।’
‘বাই। আপনার দিন ভালো কাটুক।’
আবার একটা মিটিং-এর দিন, যার জন্য সবাই অপেক্ষা করে বসে থাকে। কিন্তু আজ মিটিং তেমন জমল না। বেশ একটু তাড়াহুড়ো। নিজেদের কাছে নোটিফিকেশন আসছে। তা ছাড়া বাইরে আবহাওয়া মাইক্রো-মৌমাছিদের থেকে সম্মিলিত আওয়াজ আসছে, ভারী তুষারপাত আসছে। মাঝে মাঝে আলোচনা করেন তাঁরা, পুরোনো ভারতীয় উপদ্বীপে তুষারপাতের কথা নাকি কল্পনা করা যেত না। তাঁরা পড়েছেন, উষ্ণতায়, প্রবল বৃষ্টিতে কী সবুজ ছিল এই ভূমি। সেই সবুজ প্রাণেরা নিজেদের প্রবল বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় মানুষের হাজার নির্দয়তার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ছিল। বাঁচিয়ে রেখেছিল এই ভূমিকে। ইতিহাসের অধ্যাপক হিসাবে তিনি পড়ান, কীভাবে তাঁদের এই জায়গার কৃষিজমি অধিগ্রহণ হয়ে যায়। গরিব চাষিদের একরকম ঠকিয়ে বের করে দেওয়া হয়। ঠান্ডা পানীয়ের কারখানা। প্রথম আন্তর্জাতিক লোভের আগ্রাসী থাবা। সেই থাবা শিকড় দিয়ে শুষে নিল জমির নীচের জল। বাকি চাষের জমিও শুকিয়ে গেল। হুহু করে বিক্রি হয়ে যায় চাষের জমি। শহর এল এগিয়ে। আকাশচুম্বী বাড়িঘর, শপিং মল। সবুজ হারাতে হারাতে ঠাঁই নিল মানুষের ম্যানিকিওর্ড লনে। আর আজ? সেই সবুজ, সেই ধ্বংস-করে-ফেলা সবুজকে কত যত্নে কত পরিশ্রমে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে আজকের পৃথিবীর মানুষ। দীর্ঘশ্বাস পড়ল।… রাগ করবে না তাঁর ছাত্ররা? তাদের নিজেদের রাগ হয় না? ভাবনায় ছেদ পড়ল। হঠাৎ করে মাইক্রো-মৌমাছিদের আওয়াজ এক পর্দা বেড়ে গেল। না, আর বসে থাকা ঠিক হবে না। তিনিও বেরিয়ে পড়লেন। আজ হাঁটতে হবে বেশি, মর্নিংকে ব্যবহার করা যাবে না, ব্যালান্স থাকবে না। কারণ বেশ বরফ পড়ছে আর জমাও হয়ে যাচ্ছে। উদ্বিগ্ন হলেন না, ভয়ংকর তুষারঝড় না হলে এখন তিনি বরফের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। তবে একটা সময়ের পর দেখলেন, হাঁটা বেশ কষ্ট মনে হচ্ছে, বিশেষ উপাদানের বানানো রাস্তা গলিয়ে ফেলতে পারছে না বরফকে, হাওয়ার গতি বাড়ছে, চোখে-মুখে এসে পড়ছে বরফ। দৃষ্টিসীমা কমে গেছে অনেকটাই। তবে পাশে বা পিছনে তাঁকে অনুসরণ করে আসছে মর্নিং, মাঝে একবার পড়ে গিয়েছিল, তিনি তুলেছেন, এখন এক হাত দিয়ে ওর একটা হ্যান্ডেল ধরে আছেন, হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়েছেন অনেকটাই। এইবার আর তাল সামলাতে পারলেন না। পা সম্পূর্ণ পিছলে গেল আর তিনি পড়ে গেলেন পিছনদিকে। আর তার সঙ্গে ব্যাগটাও কোথায় যেন ছিটকে গেল। একটু ধাতস্থ হয়ে চোখ খুললেন, তুষার নেমে আসছে সোজা তাঁর দিকে। অবিরাম। ঘাড় এপাশ-ওপাশ ঘোরালেন, না, ঠিক আছে। তেমন লাগেনি কোথাও। কোনো বিশেষ ব্যথা বোধ করছেন না। তারপর দৃষ্টি একটু ধাতস্থ হতে দেখলেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে মর্নিং।
তাঁর মুখে ফুটে উঠল একটু হাসি।
‘কী রে, একটু কাজ কর? ব্যাগটা কোথায় গেল? খুঁজে আনতে পারবি না?’
মর্নিং কী বুঝল, কে জানে, খুব আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে তেমন ধীরেই তাঁর বুকের ওপর পড়ে গেল।
‘তুই কী রে? কোনো কাজ পারিস?’
তাঁর একটা হাত উঠে এল ওর ছোটো হ্যান্ডেলটাতে, হাত বোলাতে থাকলেন তিনি।
কিছুক্ষণ বাদে এই দৃশ্যটুকুর ছোট্ট ভিডিয়ো ক্লিপিংসহ মেসেজ পৌঁছোবে তাঁর কয়েকজন বন্ধুর কাছে।
‘দেখুন তো, এটাই তো আপনারা চেয়েছিলেন প্রফেসার আবিদের জন্য? এই শান্তি… এই সঙ্গটুকু? আজকের এই পৃথিবীতে ওরা আর নেই, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ওরা মানুষের সঙ্গে থাকত, মানুষদের পরিবার ওদের পরিবার, মানুষের গড়ে-দেওয়া পৃথিবীটুকুই ছিল ওদের পৃথিবী। মানুষরাই ধ্বংস হয়ে গেল, ওরা তো ছিল নির্ভরশীল, নিজেদের কীভাবে বাঁচাবে? কিন্তু মানুষের প্রতি ওদের যে ভালোবাসা, নিঃশর্ত ভালোবাসা—সেটা অন্তত আমরা অনুকরণ করতে পারি। ফিরিয়ে আনতে পারার চেষ্টাটুকু করতে পারি। যেভাবে, যে রূপে আপনারা চাইবেন। নিঃসঙ্গ মানুষের সঙ্গী হয়ে থাকুক ওই ভালোবাসা। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ আমাদের এই সার্ভিস গ্রহণ করার জন্য।’
মেসেজটি পাঠিয়েছে ‘হিউম্যান’স বেস্ট ফ্রেন্ড’—নেক্সট জেনারেশন আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স কোম্পানি।
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
