দি কোরিয়ার
লেখক: পথিক মিত্র
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“সারা আমাকে বাঁচাও সারা…ঘুম থেকে ওঠো” অসহায় কণ্ঠে চিৎকার করছিল ছেলেটা আর ক্রমে একটা ডিজিটাল চোরাবালির মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। ছেলেটার মুখটা দেখে কয়েকবার মনে হচ্ছে ভীষণ চেনা, কিন্তু স্মৃতির অতল হাতড়েও কোনো নাম উঠে আসছে না। এদিকে ছেলেটা ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছে। এবার দেখা গেল আর একটি মুখ ,মাথায় টুপি, মূখে চাপ দাড়ি, ছেলেটা ডুবে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সেই লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর হাতটা চেপে ধরল। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করল সেই ডিজিটাল চোরাবালির বুক থেকে টেনে তুলতে ছেলেটাকে। আর ঠিক সেই সময় একটি লেজার বিন্দু খেলে গেল লোকটার পিঠে। বোঝা গেল সেটা একটি লেজার স্নাইপার। আর আলো-আঁধারির মধ্যে থেকে একটি নারীমূর্তি এগিয়ে এল হাতে দুটো বন্দুক উঁচিয়ে। আর ঠিক তখন একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজের তাড়নায় যেন কান চাপা দিতে বাধ্য হল রিন!!
“এই রিন ঘুম থেকে ওঠে পড়ো। তুমি আবার স্বপ্ন দেখছ! তোমার হার্ট বিট, ব্লাড প্রেসার, সমস্ত ভাইট্যালস ভয়ানক শুট করছে..” যান্ত্রিক সুরে বলে উঠল বস্কো! নিজের স্লিপিং পডের মধ্যে উঠে বসল রিন। একটা লম্বা হাই তুলে, একবার হাত-পা ছড়িয়ে একবার আড়মোড়া ভাঙল রিন। “যদিও এখন পৃথিবীর সময় বিকেল তিনটে, তবু যেহেতু তুমি ঘুম থেকে উঠলে—সুপ্রভাত রিন” আবার বস্কো! বস্কো একটি স্পেস রোবট! মহাকাশযাত্রার আদর্শ সঙ্গী। একটি উলটো বালতির যদি নীচে চারটে চাকা লাগানো থাকত আর দুটো চোখ থাকত দু-দিকে, তাহলে যেমন দেখতে হত, এই বস্কোকেও ঠিক তেমন দেখতে।
রিন এবার উঠে তার মহাকাশযান অর্থাৎ নিও স্পেসক্রাফটের কনট্রোল প্যানেলটা চেক করে নিল। না সব ঠিকঠাক আছে। যাত্রাপথে কোনো বেয়ারিশ উল্কা বা কসমিক ঝড়ের আশঙ্কা নেই। নির্ধারিত সময়ের থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা এগিয়ে তারা। আর ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যেই তাদের গন্তব্য কাইরোস-৪ এ নির্বিঘ্নে ল্যান্ড করার কথা তাদের। কাইরোস আসলে শনির একটা চাঁদ। এখানে কিছু উৎকৃষ্ট জ্বালানির খবর পাওয়া যায় আজ থেকে বছর পঞ্চাশ আগে। আর তার পরেই এখানে সিন্ডিকেট একটি মাইনিং কলোনি স্থাপনা করে। আর এই কলোনিতেই ডাক্তার হুনের অত্যাধুনিক প্রয়োগশালা আর সেখানেই আজ যেতে হবে রিনকে, একটি অত্যন্ত জরুরি প্যাকেজ ডেলিভার করতে।
সময়টা ২৩৪৫ সাল। বিগত দুশো বছর ধরে পৃথিবী স্পেস রিসার্চে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। আসলে এটা করতে আমরা বাধ্য হয়েছি। তিলতিল করে আমরা নিজের সুন্দর প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি। এখন পৃথিবীর ৬০ শতাংশ আর বাসযোগ্য নয়। বাকি চল্লিশ শতাংশে একটি কৃত্রিম পৃথিবী এমন নিপুণ হাতে গঠন করা হয়েছে, যে অবশিষ্ট জনগণ যেন ভুলেই গেছে তাদের বাকি পৃথিবীর কী হাল। আসলে এক্ষেত্রে তাদের বৈজ্ঞানিক কায়দায় ভুলিয়ে রাখা হয়েছে। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে অতি সহজেই নানাবিধ বিভ্রান্তি বা ভ্রম সৃষ্টি করা সম্ভব। আর মানুষ এতটাই আসক্ত এই মায়াজালে যে সে বাস্তব আর কৃত্রিম বাস্তবের ফারাকটুকু ভুলতে বসেছে। গরীব মানুষের মৃত্যু, অবিশ্বাস্য দরিদ্র, দিনে দিনে প্রকৃতির তাণ্ডব, মহামারীর প্রকোপ, পরিকল্পিত শোষণ, পারমাণবিক দূষণ সব কিছু মিলেমিশে যেন অর্ধেকের বেশি পৃথিবী আর বাসযোগ্য রাখেনি। অথচ কৃত্রিম বাস্তবের মায়াতে মজে আছে জনতা।
পৃথিবীর এই বিরূপ দশার ফলে এখন আর তেমন দেশে বিভক্ত নয় গোটা বিশ্ব। এখন পৃথিবীর শাসন করে তিনটে শক্তিশালী কর্পোরেট। রেড, গ্রিন আর ব্লু সিন্ডিকেট। এদের মধ্যে পারস্পরিক আকচাআকচি লেগেই আছে। এখন প্রতিটি সিন্ডিকেটের একটাই লক্ষ্য—মহাকাশ দখল। বিভিন্ন গ্রহে নিজের বেস আর বাসস্থান তৈরি করা। আর পৃথিবীর অর্থবান বড়োলোকদের এখন একটাই লক্ষ্য পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশের অন্য কোনো প্রান্তে গিয়ে সেটেল করা। যেমন কাইরোস-১,২,৪ আর ৫ হল রেড সিন্ডিকেটের অংশ। আর আজ মঙ্গলগ্রহের আলফা বেস থেকে রিন রওনা হয়েছে এই বিশেষ প্যাকেজটি নিয়ে।
“এই বস্কো কে বলত ওই ছেলেটা? খুব চেনা লাগল আর ভীষণ হ্যান্ডসাম! কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না ও কে?” রিন অন্যমনস্ক স্বরে জিজ্ঞাসা করল।
“ওটা স্বপ্ন রিন! স্বপ্নের ব্যাখ্যা হয় না!” রোবটের সহসা উত্তর।
“এটা ঠিক নয় বুঝলি তো! নিশ্চয়ই কোনো মানে আছে, নাহলে এই অচেনা ছেলেটাকে বারবার দেখব কেন বল!” অধৈর্য কণ্ঠে বলল রিন।
“খুব সহজ কারণ রিন! তোমার চল্লিশ ছাড়িয়েছে। মেনোপজ আসন্ন। তার উপর জীবনে প্রেম, যৌনতা কিছুই নেই। তাই হ্যান্ডসাম ছেলে দেখেই ব্রেন প্রসেস করতে পারছে না।” আবার রোবটের সপাটে জবাব। এবার যেন বেশ বিরক্ত হল রিন। বড়ো মুখে মুখে কথা বলে এই যন্ত্র! তারপর নিজেই ভাবতে থাকে রিন, নিজের ফেলে আসা দিনগুলির কথা। হারিয়ে যেতে থাকে স্মৃতির গোলকধাঁধায়। অনাথ আশ্রমে বড়ো হওয়া, তারপর স্কুল থেকেই রেড সিন্ডিকেটের স্পেস ফোর্সে তার নির্বাচন। দুরন্ত মহাকাশযোদ্ধা, একের পর এক দুর্ধর্ষ মিশন। স্পেস দস্যু থেকে ভিনগ্রহীদের সঙ্গে ভয়ানক সব যুদ্ধ। নিদারুণ সাফল্য। যোদ্ধা হিসেবে চূড়ান্ত খ্যাতি। একাধিক মেডেল জেতা। তারপর সেই দুর্ঘটনা ঘটলো। জীবনটাই পাল্টে গেল রিনের!
কাইরোস-২ এর সেই পরিত্যক্ত কলোনি তখন কিছু মহাকাশজঙ্গির কবজায়। তাদের নেত্রী এক দুর্ধর্ষ স্পেস ক্রিমিনাল। কুইন শিবা। তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা, স্পেস ব্লাস্ট, স্পেস ডাকাতির অভিযোগ। রেড সিন্ডিকেটের হিটলিস্টের একেবারে শীর্ষে ছিল এই ভয়ানক মহিলা। তবে শোনা যায় একসময় এই মহিলা রেড সিন্ডিকেটের স্পেস প্রোগ্রামের হেড ছিলেন। তার প্রচুর দারুণ দারুণ আবিষ্কারও ছিল। এই শিবার বা জঙ্গিদের ডাকে কুইন শিবার মূলত রিসার্চ ছিল মেমোরি ম্যাপিং নিয়ে। মানুষের স্মৃতিশক্তি কী করে একজনের থেকে আর একজনের মধ্যে ট্রান্সফার করা যায় যাতে একজন মানুষের মৃত্যু বা অক্ষমতার দরুন তার স্মৃতি বা মস্তিষ্ক ওপর একজন ব্যবহার করতে পারে। তবে এই বিজ্ঞানের একটা ভয়ানক দিকও আছে। এর ফলে মেমোরি অল্টার করা সম্ভব। অর্থাৎ মানুষের সবথেকে বড়ো শক্তি, যে কোনো বিপ্লবের বা প্রতিবাদের গোড়ার কথা, স্বাধীন চিন্তাশক্তি চিরতরে পরিবর্তিত করে দেওয়া সম্ভব। এই প্রযুক্তিকে রেড সিন্ডিকেট ব্যান করতেই শিবা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং নিজের একটা দল তৈরি করে। সম্ভবত সেখানে সবার ডিজিটাল ব্রেন ওয়াশ করা হয়, তাই তারা হয়ে পরে ভয়ানক সিন্ডিকেট বিরোধী। এমন ভয়ানক, নির্দয়, নির্মম জঙ্গিদের শায়েস্তা করতে নিজের টিম নিয়ে হাজির হয় স্পেস কমান্ডার রিন।
আবার মাথাটা ভয়ানক টনটন করে ওঠে রিনের। কৌটো খুলে লাল ট্যাবলেটটা মুখে গুঁজে দিয়ে ঢকঢক করে জল খেল। মাথার ভিতরে চলতে থাকা একাধিক চিৎকার যেন ওষুধটা খাবার সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল। এটাই বিপদ, এই অংশের পর থেকে স্মৃতিটা বড়ো নড়বড়ে, ঠিক করে কিছুই মনে পড়ে না। আর মনে করার চেষ্টা করতেই মাথা টনটন করে ওঠে। সিন্ডিকেট আহত রিনকে মহাকাশে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে। জানা যায় নাকি এক দুর্ধর্ষ যুদ্ধ হয়েছিল সেদিন। তবে রিনের সমস্ত সঙ্গীরা মারা যায়। কুইন শিবার দলেরও প্রচুর লোক মারা যায় কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে রিনকে ধরে ফেলে। তারপর রিনের মেমোরি অল্টার করতে শুরু করে। তার পরিকল্পনা ছিল রিনকে একটি ডবল এজেন্ট বানিয়ে সিন্ডিকেটের কাছে ফেরত পাঠানো। যাতে এবার সে সিন্ডিকেটের যাবতীয় ক্ষতি সাধন করতে পারে। এবার এই প্রক্রিয়া মানুষের স্বাভাবিক স্মৃতির উপর কিছু এমন প্রভাব সৃষ্টি করে যে তাদের নিজেদের স্মৃতির বেশ কিছু অংশ একেবারে পালটে যায়। তবে রিন হার মানেনি। প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই একটি কসমিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সে কুইন শিবাকে হত্যা করে। এই বীরত্বের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হয় পরবর্তী সময়, কিন্তু রিনের নিউরাল সার্কিট সেই মেমোরি অল্টারেশন দরুন নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাকে উদ্ধার করার পর প্রায় তিন মাস ব্যাপি তার নিউরাল ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি হয়। সুস্থ হতে প্রায় এক বছর সময় লাগে। তবে সুস্থ হওয়ার পর সে কমব্যাট ফোর্স থেকে অবসর নিতে বাধ্য হয়। এখন তার নিস্তরঙ্গ, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। স্পর্শকাতর সমস্ত প্যাকেজ ডেলিভার করার কাজে সে নিযুক্ত। এমনিতেই ইনট্রোভার্ট প্রকৃতির মানুষ রিন। লোকের সঙ্গে কথা বলতে তার বিশেষ ভালো লাগে না আজকাল। তবে এই মহাকাশ কোরিয়ার এর কাজ তাকে ঠিক শান্ত রাখতে পারে না। বড়ো উচাটন হয় মনে। আর একটা উপরি সমস্যা—মাঝে মাঝে প্রচণ্ড মাথা ধরে আর প্রায় নিয়মিত ওই বিচ্ছিন্ন স্বপ্নগুলো ফিরে ফিরে আসে। যেন তার স্মৃতিশক্তির সঙ্গে একটা ভয়ানক এক্সপেরিমেন্ট করার দরুন সেটা চিরকালীন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সত্যি কি শুধু এই যুদ্ধের স্মৃতিটাই হারিয়ে গেছে নাকি আরও কিছু স্মৃতি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে?
ডক্টর হুন বর্তমানের সবথেকে বিখ্যাত মেমোরি ট্রান্সপ্লান্ট সার্জেন। তার জাদুতেই অনেকটা আবার কর্মজীবনে ফিরতে পেরেছে রিন। তিনি একটা কথা বলেন যে কোনো স্মৃতি নাকি মানুষের মস্তিষ্ক থেকে চিরতরে মুছে ফেলা যায় না। নিউরাল সার্কিট থেকে একটা অংশ কেউ ইচ্ছাকৃত বাদ দিলেও তার কিছু ইমপ্ল্যান্ট বা ছাপ থেকেই যায়। আর কোনো বিশেষ ঘটনার প্রভাবে সেই অংশটা অটোজেনারেট হয়ে ফিরে আসতেই পারে। তবে এই কাজটা কৃত্রিমভাবে করার প্রযুক্তি এখনও আবিষ্কার হয়নি। এবার ডক্টর হুনের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলবে ঠিক করল রিন। এমনিতেও দীর্ঘ মহাকাশ যাত্রার পর, রিনকে একটি নিউরাল স্লিপে ঘুম পাড়িয়ে দেন ডাক্তার হুন। তখন তার নিউরাল সার্কিটের অবস্থানটিও চেক করে নেন।
“বিপ বিপ বিপ বিপ”
ইন্টার স্পেস কমিউনিকেটর কল আসছে। রেড সিন্ডিকেট বেস থেকে। কল তোলার আগেই বস্কো বলল, “আজকের দিনটা বড়ো শুভ রিন! মহামহিম হুতুম পেঁচা স্বয়ং তোমার সঙ্গে কথা বলবেন!”
কথাটা শুনেই কিছুটা তটস্থ হয়ে গেল রিন। একবার নিজের পোশাক চেক করে, অবিন্যস্ত চুলটা ঠিক করে নিল। প্রথমে ভেবেছিল এটা রুটিন কল। স্পেস কমান্ডার মার্সেলো হয়তো আপডেট চাইছেন। কিন্তু হঠাৎ রেড সিন্ডিকেটের সর্বেসর্বা মহামহিম হুতুম পেঁচা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন কেন। মনে এক রাশ প্রশ্ন আর সংশয় এবং কপালে ভ্রুকুটি নিয়ে কলটা অন করল রিন। লাইভ স্ক্রিনে স্বয়ং মহামহিম হুতুম পেঁচা । ভেসে উঠল সেই বড়ো চেয়ারে বসা, পেঁচার মুখোশ পরা মুখটা।
“স্পেস কমান্ডার রিন, শুভ সন্ধ্যা। রেড সিন্ডিকেটের পক্ষ থেকে আমরা আবারও আপনার বীরত্ব ও নির্ভীক মানসিকতাকে স্যালুট জানাই। আপনাদের মতো বীরাঙ্গনারা আমাদের রেড সিন্ডিকেটের সম্পদ! আপনাদের এই বীরত্বের জন্যেই আমাদের স্পেস কলোনিতে হাজার হাজার মানুষ শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারছেন।”
“মহামহিমের জয় হোক। রেড সিন্ডিকেট দীর্ঘজীবী হোক। নিজের জন্মভূমির জন্য এইটুকু করতে পারা আমার কাছে সৌভাগ্যের ব্যাপার।” হাত তুলে উত্তর দিল রিন!
অন্য স্ক্রিনে ভেসে উঠল কমান্ডার মার্সেলোর মুখ।
“আশা করি আপনার যাত্রাপথে কোনো বিঘ্ন ঘটেনি? কোনোরকম উল্কাপাত বা কসমিক ঝড়ের পূর্বাভাস নেই। কাজেই আশা করি আপনার কোনোরকম অসুবিধে হচ্ছে না রিন?”
“সব ঠিক আছে কমান্ডার!”
এবার কথা বললেন মহামহিম, “এই অস্থিরতার যুগে একটা কথা প্রচলিত রিন। যখন দেখবে সবকিছু একদম ঠিক আছে, নির্বিঘ্নে কেটে যাচ্ছে তখন বুঝবে বড়ো কিছু গলত অপেক্ষা করছে। এ যেন ঠিক ঝড়ের আগের নীরবতা। আর সেই কারণেই আমরা তোমাকে কল করেছি”
“আপনারা কি কোনো কসমিক ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়েছেন মহামহিম যা আমার স্পেসক্রাফটের রাডার ধরতে পারছে না?” একটু সোজা হয়ে সতর্ক কণ্ঠে প্রশ্ন করল রিন।
“রিন আপনি আমাদের অ্যাসেট! কুইন শিবার মতো ডেঞ্জারাস জঙ্গিকে আপনি এলিমিনেট করতে সক্ষম হন। আপনার কাছে আমরা চিরঋণী থাকব। তবে দুঃখের খবর হচ্ছে সেদিন আপনি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সকল স্পেস রেবেলকে ধ্বংস করতে পারেননি। শিবার সবথেকে কাছের বন্ধু বা প্রেমিক বলতে পারেন—আলম মুসাফির সেদিন বেঁচে যায়। এবার এই লোকগুলো কিটের মতো। একটা থাকলেই আর কয়েকটা বংশ বৃদ্ধি করবে। তাই এদের সমূলে বিনাশ চাই। এবার এই মুসাফির একটা দল গঠন করেছে। নিজেদের এরা অল্টারনেট ফোর্স বা বিকল্প শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। কিন্তু শিবার প্রযুক্তি না থাকায় এরা আদতে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এবার এরা চাইছে কিছু একটা ঘটিয়ে খবরে ফিরে আসতে। চাইছে কুইন শিবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। আর তাই তাদের হিটলিস্টে এখন আপনি!”
কথাটা শুনেই একটা বাঁকা হাসি খেলে গেল রিনের ঠোঁটে। এই একঘেয়ে কোরিয়ারের কাজ আর ভালো লাগছে না। এদিকে কমব্যাট ফোর্সে ফেরার ক্লিয়ারেন্স তার নেই। তবে তার ভিতরে দুরন্ত যোদ্ধাটি তো আর মরে যায়নি। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় শীতঘুমে শায়িত। এবার তার জাগার পালা।
“আমি প্রস্তুত মহামহিম। আমি চাই ওরা আসুক। আমি ওই মুসাফিরকেও চিরনিদ্রায় শায়িত করতে চাই। রেড সিন্ডিকেটের জয়।” আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল রিন।
“আপনার মতো একজন বীরাঙ্গনার কাছ থেকে আমি এটাই আশা করেছিলাম রিন। তবে এটা কমব্যাট করার সময় নয়। আপনি অবিলম্বে আপনার যানের গতিবেগ বাড়িয়ে দিন। ছায়াপথে আত্মগোপন করে ম্যানুয়াল মোডে নেভিগেট করে অতি সত্তর ডাক্তার হুনের কাছে পৌঁছান। সেখানে মানে কাইরোস-৪ এ আপনি নিশ্চিন্তে কিছুদিন বিশ্রাম করুন আর ততদিনে আমরা এদিকটা সামলে নিচ্ছি।” ভারী গলায় আদেশের সুরে জানালেন মহামহিম।
“কিন্তু মহামহিম আমি পারব মুসাফিরকে নিউট্রালাইজ করতে—”
“কমান্ডার রিন, ইটস অ্যান অর্ডার! কপি দ্যাট! ডু নট এঙ্গেজ ইন কমব্যাট!” এবার যেন আরও বেশি আদেশের সুরে বললেন মহামহিম।
***
কলটা শেষ হওয়ায় পর থেকেই নিদারুণ বিরক্তি লাগছিল রিনের। এই প্রথম তার কর্মক্ষমতা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে কেউ প্রশ্ন করছে, সন্দেহ জানিয়েছে। যে একহাতে ধরা পড়ার পরেও কুইন শিবার মতো দুর্ধর্ষ শয়তানকে শায়েস্তা করেছে আজ তার উপর সন্দেহ। একজন অনফিল্ড কমব্যাট এজেন্টকে এরা একজন কোরিয়ার বানিয়ে দিচ্ছে। রাগে যেন মাথাটা টিপটিপ করতে লেগেছে রিনের। আর একটা ট্যাবলেট দরকার তার।
নতুন গতিবেগে এবার গন্তব্যে পৌঁছাতে লাগবে আর মাত্র দশ ঘণ্টা। এদিকে ম্যানুয়াল রাইডে টানা কনসোলে বসে থাকতে হচ্ছে রিনকে। ভিতরে ভিতরে সে একরকম ফুঁসছে। একবার নিজের মেমোরি আর্কাইভ থেকে নির্দিষ্ট কিছু মেমোরি বের করে দেখল। মূলত যুদ্ধের মুহূর্ত। রিন নির্মমভাবে শত্রুপক্ষকে শায়েস্তা করছে। হত্যা করছে, নিস্পলক হয়ে অব্যর্থ নিশানায় উড়িয়ে দিচ্ছে শত্রুদের মাথা। যেন একটা কিলিং মেশিন! কিন্তু কেন যেন সেই উত্তেজনা তার শরীরে সঞ্চারিত হচ্ছে না। কোথায় যেন মনে হচ্ছে কেন এই হত্যালীলা? কেন এত মানুষকে মেরেছে সে? এটা নিশ্চয়ই সেই মেমোরি অল্টারেশন এর কুপ্রভাব! তার মতো একজন যোদ্ধাকে দুর্বল, আবেগপ্রবণ করে দিতে চেয়েছিল কুইন শিবা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। সে পরাস্ত করেছে কুইন শিবার জঙ্গিদলকে। আজকে সে একজন জনপ্রিয় মহাকাশ যোদ্ধা। তাকে দেখে উল্লসিত হয়ে চিৎকার করে রেড সিন্ডিকেটের তামাম জনতা। এই প্যাকেজ তো সংরক্ষিত সে রাখবেই। কারণ আসলে প্যাকেজটি কোনো ডিস্কে নেই। আছে স্বয়ং রিনের মাথায়। এটাই অত্যাধুনিক কোরিয়ার প্রযুক্তি যা ডক্টর হুন আবিষ্কার করেছেন। এই জন্যেই কোরিয়ার নির্বাচন করা হয় অনেক কিছু দেখে। শত্রুপক্ষ জানল একটা নির্দিষ্ট প্যাকেজ নিয়ে যাচ্ছে কোরিয়ার কিন্তু আসল তথ্য সংরক্ষিত রইল সেই বাহকের মাথায়। অর্থাৎ কোরিয়ার নিজেই আসলে সেই প্যাকেজ! কিন্তু তার মাথায় রাখা সেই প্যাকেজের কিছু ড্যাটা লিকের জন্যেই কি এইসব উদ্ভট স্বপ্ন দেখছ রিন?? সেই জন্যেই কি এই বাড়তি উত্তেজনা? এত রাগ হচ্ছে তার। নিজের মেমোরি নেটওয়ার্ক একবার চেক করে নিল রিন। না কোনো ড্যাটা লিকের লক্ষণ নেই তো। সব ঠিকঠাক! কোনো আলার্ম নেই। সেই প্যাকেজের ড্যাটা সযত্নে এনকোড করে রাখা আছে। সেটার খোলার চাবি শুধু ডক্টর হুনের কাছেই আছে। তবু কেন মাথায় এই অসহ্য ব্যথা? ক্রমে যেন বাড়ছে না ব্যথাটা?
এবার আবার অটোমোড অ্যাক্টিভেট করে দিল রিন। একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। আর পারছে না সে। এবার ডাক্তার হুনকে বলতেই হবে এই সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান করতে। তারপর আবার ফিল্ডে ফিরতে পারবে রিন! কিছুটা তন্দ্রা মতো আসছিল সহসা ডেকে উঠল বস্কো। “রিন একটি প্যারাসাইট পড আমাদের স্পেসক্রাফট এর উপর ল্যান্ড করেছে! সাবধান!” এক লাফে উঠে দাঁড়াল রিন। উঠে গিয়ে কনসোল স্ক্রিনে চোখ রাখল।
“ক-জন আছে? সঙ্গে কি এক্সপ্লোসিভ আছে?”
“দুজন! না কোনো এক্সপ্লোসিভ নেই! সাধারণ দুটি স্পেস গান! নির্বিবাদে এলিমিনেট করে দাও!” বস্কো উত্তর দিল।
রিনের চোখে একটা হিংস্র হাসি। লেজার গানের বোতামের উপর আঙুল। কিন্তু টিপতে গিয়েও সুইচটা টিপল না সে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “মিস্টার মুসাফির আপনি ভেবেছিলেন এটা একটা সাধারণ কোরিয়ার ক্রাফট! আপনি আসবেন, বন্দুক দেখিয়ে, প্যাকেজ লুট করে চম্পট দেবেন! এত সোজা নয়! আপনি জানেন না রিনকে দি কিলিং মেশিন বলে ডাকা হত ওই দুর্ঘটনার আগে। আপনাকে আপনার প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।” বলেই স্পেস ক্রাফটের সিকিউরিটি শিল্ডটা অফ করে দিল রিন।
“এটা কী করছ রিন? এটা তো প্রোটোকল বহির্ভূত! তুমি এটা করতে পারো না! এর ফলে তো শত্রু অনায়াসে ভিতরে ঢুকে আসবে—” বস্কো প্রতিবাদ করে উঠল।
“শাট আপ বস্কো! তুমি এবার বেসের সঙ্গে এই মিনিট কুড়ির মতো যোগাযোগ ছিন্ন করে দাও। প্যারাসাইট পড ভাববে তাদের ম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রভাবে আমাদের শিল্ড ফেল করেছে আর তারা ভিতরে ঢুকবে। ব্যাস ওদের ধরে নিতেই তুমি সিস্টেম অন করে দেবে। কাইরোস-৪ এ আমার সঙ্গে যাবেন এই মুসাফির আর তার সাগরেদ! ওদের উচিত শিক্ষা দেব আমি। দরকারে হত্যা করব। মহামহিম বুঝতে পারবেন আমি এখনঅ যুদ্ধক্ষেত্রে ঠিক কতটা কার্যকরী।” বলেই নিজের স্পেসক্রাফটকে এনার্জি সেভার মোডে চালিত করল রিন। ভিতরে সমস্ত আলো নিভে গিয়ে একটা হলদেটে নরম আলো ছড়িয়ে পড়ল। যখন মহাকাশচারী ঘুমোয় তখন এমন আলো জ্বলে!
নিজের পডে শরীর এলিয়ে দিয়ে হাতের ঘড়িতে ফিড দেখতে লাগল রিন। একটা হিংস্র শ্বাপদের মতো অপেক্ষায় রইল শিকারের। প্যারাসাইট পড থেকে দুজন নেমে ইনফ্রারেড রিডিং নিয়ে সেই ভুলটাই করল যেটার পরিকল্পনা করেছিল রিন। তারা নিশ্চিন্ত হল এই ভেবে যে কোরিয়ার নিদ্রামগ্ন! এবার তারা তাদের অটো কোড ব্রেকার মেশিন দিয়ে স্পেসক্রাফট এর দরজা খুলতে শুরু করল। অন্য সময় এই স্পেসক্রাফট অনায়াসে তাদের উড়িয়ে দিতে পারত। কিন্তু আজ রিনের চোখে অন্য প্ল্যান। তার টার্গেট এখন একজন মহাকাশ জঙ্গি, রেড সিন্ডিকেটের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টের শীর্ষে থাকা ওই আলম মুসাফির! জীবিত বা মৃত!!
অতি সন্তর্পণে ভ্যাকিউম ল্যান্ডিং এর ভিতরে ঢুকল মুসাফির এবং তার সঙ্গী। হাতে উদ্ধত স্পেস শাটল গান! সতর্ক ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল দুজনে ঝুঁকে পড়ে। “মার্কো আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে, নাহলে এত সহজে আমাদের এন্ট্রি কিছুতেও দিত না। আমি আশা করেছিলাম ঢুকতেই কেউ আক্রমণ করবে, কিন্তু সেটা যখন করেনি তার মানে আমি নিশ্চিত এটা ট্র্যাপ।” ভারী গলায় বললেন আলম মুসাফির। “তাহলে মুসাফির এবার? আপনি ঢুকলেন কেন?” উদ্বিগ্ন গলায় মার্কো বলে ছেলেটা।
“আমাদের চেষ্টা করতেই হত মার্কো। কেন সেটা তুমি খুব ভালো করে জানো। একবার যদি ওই প্যাকেজটা পৌঁছে যায় কাইরোস-৪ এর প্রয়োগশালায় তাহলে সব শেষ। আমাদের এই লড়াই চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে। তাই এটাই করতেই হত। আমরা ফিরে যাই বা না যাই ওই প্যাকেজটা আমাদের চাই।” কথা শেষ করতে পারল না মুসাফির। তার আগেই জোরালো আলোতে আলোকিত হয়ে উঠল পুরো স্পেসক্রাফট!
কিছু বোঝার বা করার আগেই মুসাফির আর মার্কোর হাত থেকে ছুটে গেল তাদের অস্ত্র! চোখের নিমেষে দুটি শিকলে আবদ্ধ হয়ে পড়ল দুজনে।
***
“আলম মুসাফির! রেড সিন্ডিকেটের মোস্ট ওয়ান্টেড টেররিস্ট! আপনি এমন একটা ছেলেমানুষের মতো কাজ করবেন আমি ভাবতেও পারিনি। আমি ভাবছিলাম আপনারা লড়াই করবেন আর তখন আমি আপনাদের হত্যা করব কিন্তু আপনারা তো নেংটি ইদুরের মতো ধরা পড়ে গেলেন? কী ভেবেছিলেন একজন মামুলি কোরিয়ার? তারপর আবার নারী? বকে ধমকে প্যাকেজ হাতিয়ে নেবেন?” হিংস্র হাসি মিশিয়ে বলল রিন।
এদিকে রিনকে দেখার পর আতঙ্কের থেকে যেন মার্কো আর মুসাফিরের চোখমুখে খেলে গিয়েছে একরাশ বিস্ময়। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল মার্কো কিন্তু তাকে চোখের ইশারায় থামতে বলল মুসাফির। নিজের ভুল বুঝতে পেরে যেন নিজেই চুপ করে গেল মার্কো। সেটা বেশ নজর করেছিল রিন। রাগত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, “তোদের প্রত্যেকটাকে খুঁজে এনে আমি খুন করব! তিল তিল করে মারব! তোরা এক একটা শয়তান। লোকের স্মৃতির সঙ্গে খেলা করিস! তোদের আসল লক্ষ্য যেন আমি বুঝি না। বিপ্লবের নামে আসলে তোরা ভাড়াটে খুনির দল। অন্যান্য সিন্ডিকেটগুলি তোদের গোপনে নিয়োগ করেছে এই বিপ্লবের নামে রেড সিন্ডিকেটে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য। জনতাকে ক্ষেপিয়ে তুলে গোলমাল সৃষ্টি করার জন্য। মহামহিম হুতুম পেঁচাকে বিপাকে ফেলাই একমাত্র লক্ষ্য। আসলে তোদের গা জ্বলছে এটা দেখে যে কি নিপুণ হাতে মহামহিম হুতুম পেঁচা জনপ্রিয়তা শিখরে পৌঁছে গেছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম মানুষ স্বাধীনতার মানে বুঝেছে, সুখ সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গেছে।
আর তোরা কিনা সেই নির্ঝঞ্চাট মানুষের মাথায় যত রাজ্যের কুবুদ্ধি প্রতিস্থাপিত করে তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছিস। মানুষের স্মৃতি নিয়ে খেলা করা একটা চরম অপরাধ আর সেটাই করত তোদের কুইন শিবা। তাকে আমি যেমন শেষ করেছি তোদের কেও করব!! চিরতরে!” উত্তেজনায় প্রায় কাপতে কাপতে বলে উঠল রিন।
“আজ থেকে প্রায় চারশো বিশ বছর আগে ভারতবর্ষে একজন বিপ্লবী ছিলেন নাম ভগৎ সিং। ইংরেজের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছিলেন। তার একটি উক্তি আমার খুব প্রিয়, ‘you can kill me, but you can’t kill my idea!’ কুইন শিবাকে হত্যা করতেই পারেন আপনারা কিন্তু তার চিন্তাগুলো? নাহ আপনি মারতে পারবেন না! আইডিয়া বা আদর্শ অবিনশ্বর! তার মৃত্যু নেই। তাই কুইন শিবার ও মৃত্যু নেই।” গম্ভীর কণ্ঠে উওর দিলেন মুসাফির।
“বড়ো বড়ো আদর্শের বাণী ঝেড়ে লোককে বোকা বানাতে পারদর্শী হয়তো তুমি, কিন্তু এসব আমার উপর একদম কার্যকরী নয়। আর কী বললে? চিন্তাধারা অবিনশ্বর!! তার মৃত্যু নেই?? হা হা হা হা!! একটু পরেই বুঝবে যে তোমার এই উক্তি কতটা ঝুটো! একবার পৌঁছাতে দাও কাইরোস-৪ এ। তারপর দেখবে তোমাদের এই অমর আদর্শকে কী অনায়াসে কবরে শুয়ে দেবেন ডক্টর হুন!!” রাগত কণ্ঠে হিসহিস করে বলল রিন।
“সেকি তুমি না বললে কুইন শিবা মানুষের মেমোরি অল্টার করে ভয়ানক অপরাধ করছিলেন, তো তোমাদের এই ডক্টর হুন কী করছেন? তার বেলা সাথ খুন মাফ তাই তো? কারণ উনি রেড সিন্ডিকেটের পোষ্য?”
এবার যেন নিজেকে আর রুখতে পারল না রিন। সজোরে ছুটে গিয়ে একটা লাথি কষিয়ে দিল আলম মুসাফিরের তলপেটে। ব্যথায় ককিয়ে উঠল মুসাফির।
“বেশ করেছেন ডক্টর হুন! উনি যা করেন অপরাধীদের মস্তিষ্কের সঙ্গে করেন, যাতে তাদের জীবনের মূল স্রোতে ফেরানো যায়। আর তোমরা যেটা করো সেটার একমাত্র উদ্দেশ্য হল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, লোক কে তাতিয়ে তোলা!!” চিৎকার করে উঠল রিন।
স্মিত হাসল মুসাফির। তারপর বলল, “আচ্ছা তাই বুঝি? তাহলে হঠাৎ তোমাকে কেন উনি চিকিৎসা করলেন? তুমি তো আর অপরাধী নও?”
“কারণ আমি একজন কর্তব্যরত সাহসী সৈনিক। মাতৃভূমির জন্য নিজের সবটুকু দিতে প্রস্তুত। আমি একজন দামী অ্যাসেট! দি কিলিং মেশিন! আমি নিজে হাতে শেষ করেছিলাম কুইন শিবাকে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই ডাইনি আমার স্মৃতিশক্তি ঘেঁটে দিয়েছিল। দীর্ঘসময় অসুস্থ ছিলাম আমি। ডক্টর হুন আমাকে প্রাণে বাঁচায়। তবে আমি পুরো কমব্যাট ফিট হতে পারেনি, তাই আজ আমার মতো একজন গ্রেড ওয়ান সোলজার একজন নিছক কোরিয়ার! এর দায় তোমাদের! আর তাই আমি তোমাদের ঘৃণা করি। সিন্ডিকেট ক্লিয়ারেন্স পাই বা না পাই আমি তোমাদের খুঁজে খুঁজে টিপে টিপে মারব। নিজে মরে গেলেও মারব। তাতে যদি সিন্ডিকেট আমার বিচার করে করুক!!” জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল রিন।
“আচ্ছা রিন আমার এই সহকারীকে আপনি চেনেন?” আচমকা হঠাৎ একটা বেলাইন প্রশ্ন করে বসল মুসাফির।
“কেন চিনতে যাব? রাস্তার সব কুকুর বা দুনিয়ার সব কিটকে চেনার দায় আমার নেই—” কথাটা বলে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিল রিন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে যেন তার চোঁখ আটকে গেল মার্কোর মুখে। নাহ্ এই মুখটা সে চেনে না, তার স্মৃতি স্পষ্টই জানিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মাথার ব্যথাটা যেন হঠাৎ চাগাড় দিয়ে উঠল। ভেসে উঠল সেই স্বপ্নের দৃশ্যটা। একটা ছেলে একটা কৃত্রিম ডিজিটাল চোরাবালির বুকে ডুবে যাচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, “সারা আমাকে বাঁচাও সারা… ঘুম থেকে ওঠো।” এক মুহূর্তে ছিটকে গেল রিন। সে নিশ্চিত এই ছেলেটাকে আগে সে কখনও দেখেনি, এমনকী সিন্ডিকেট ক্রিমিনাল ডেটাবেসেও দেখেনি, তবু এটা সে নিশ্চিৎ যে তার স্বপ্নে চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া ছেলেটা আর কেউ নয় নিশ্চিত মার্কো!
“কে সারা? তোমরা আমার সঙ্গে কী করতে চেষ্টা করছ? তোমরা ইচ্ছে করেই ধরা দিয়েছ না?” মাথা চেপে বসে পড়ে প্রশ্ন করে রিন।
“এদের কে বেশি কথা বলতে দিও না রিন! এরা তোমাকে বিপথে চালিত করছে। তোমার আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আগেই তোমার নিউরাল সার্কিট ক্ষতিগ্রস্ত করে এদের কুইন শিবা। এবার সেটার সুযোগ নিয়ে এরা তোমাকে কুপথে নিয়ে যাচ্ছে। বেসের সঙ্গে সংযোগ ফিরিয়ে আনতে হবে রিন। এই মুসাফির লোকটাকে বাঁচিয়ে রাখা প্রোটোকল বহির্ভূত। ওকে শেষ করে দিলে তুমি নিশ্চিৎ কমব্যাট ফোর্সে ফিরে আসতে পারবে রিন। এদের শেষ করে দাও।” সহসা বলে উঠল বস্কো।
লাল চোখে মুখ তুলল রিন। এক ঝটকায় বের করে নিল তার স্পেস বন্দুক। অত্যাধুনিক বন্দুকের একটা গুলিতেই খেলা শেষ। কোনো রক্তপাত ছাড়াই ব্রেনে খেলে যাবে একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গ। ব্যাস সব শেষ।
“আমাদের তুমি মারতেই পারো রিন। আচ্ছা তোমার মনে কখনও প্রশ্ন জাগে না এখন একজন এক্স-কমব্যাট স্পেশালিস্টকে একজন নিছক কোরিয়ার বানিয়ে মহাকাশে ঘুরে বেড়াতে বলছে এরা? কেন? তবে আমাদের মারলে কিন্তু সেইদিন ঠিক কী হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে, কীভাবে তুমি কুইন শিবাকে মেরেছিলে সেই সব রহস্য চিরতরে হারিয়ে যাবে। তোমার মেমোরির ওই মিসিং এপিসোড চিরতরে হারিয়ে যাবে। আচ্ছা তোমার একবারও মনে হল না যে তোমার সমস্ত স্মৃতি ফিরে এল অথচ ওই নির্দিষ্ট যুদ্ধের অংশটাই কেন হারিয়ে গেল?” মুসাফির আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
“বাজে কথা বন্ধ কর মর্কট!” বলে মুসাফিরকে দেয়ালের সঙ্গে সেটে ধরল রিন। একেবারে মুখের কাছে গিয়ে মুসাফিরের মাথায় বন্দুক ঠেকাল রিন। সহসা একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবেই রিনের ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিল জঙ্গি কমান্ডার আলম মুসাফির।
কাইরোস-৪
ঘণ্টাদুয়েক আগে ল্যান্ড করেছে রিনের স্পেসক্রাফট! ডক্টর হুন বেশ কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন যখন প্রায় আধ ঘণ্টার উপর সময় ধরে স্পেসক্রাফটের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। অনেক সময় কসমিক গোলযোগের জন্য এমন হয় বটে, তবে এই প্যাকেজটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই কোনোরকম রিস্ক নেওয়া যেত না। তাই যখন আবার সংযোগস্থাপন হল, তখন কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন হুন।
কিন্তু এর পরের খবরটা একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। করেছে কী মেয়েটা? আলম মুসাফির আর তার মূল সহযোগী মার্কোকে গ্রেফতার করেছে রিন! এই খবরটা রেড সিন্ডিকেটের মাথাদের কাছে পৌঁছলে তারা নিশ্চিত পুরস্কৃত করবে তাকে এটা বেশ জানে হুন। তবে তার আগে এই প্যাকেজের ব্যবস্থা করতে হবে। ভালোই হয়েছে রিন ইচ্ছে করেই প্রোটোকলের ভয়ে বেসে রিপোর্ট করেনি। মেয়েটির কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। তার মনে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। এই মুসাফিরকে সে চরম শাস্তি দিতে চায়। আসলে মেয়েটা এখনও মনে করে তার কমব্যাট লাইসেন্স চলে যাওয়ার মূল কারণ ছিল কুইন শিবার মেমোরি আলটারেশন! মনে মনে হাসলেন ডক্টর হুন।
“রিন তুমি কি দারুণ দুরন্ত একটা কাণ্ড ঘটিয়েছ তুমি নিজেও বুঝতে পারছ না। এই দুটোর মেমোরি ম্যাপ থেকে এদের সমস্ত গুপ্ত আস্থানা আর জঙ্গিদের ডিটেইলস এক্সট্র্যাক্ট করে নেব আমি। বিরোধী সিন্ডিকেটদের সঙ্গে এদের সমস্ত যোগসাজস এবার জনসমক্ষে নিয়ে আসবেন মহামহিম হুতুম পেঁচা। যে বিপ্লবের বিষাক্ত চারা আমাদের শান্তি বিঘ্নিত করতে উদ্ধত হচ্ছিল, আজকে তোমার জন্য আমরা তাদের সমূলে বিনাশ করব। এবার তুমি পডে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি আগে প্যাকেজটা এক্সট্র্যাক্ট করে নিই!” ডক্টর হুন বললেন।
“না ডক! আমি ক্লান্ত বটে ,তবে আমি আরও কিছুটা সময় জেগে থাকত পারব। আমি এই লোকটাকে নিজের হাতে খুন করব। ও জানে না আমি কে! আজকে ওকে বুঝিয়ে দেব কেন আমাকে কিলার মেশিন বলে ডাকা হয়! আর একজন মহিলার সঙ্গে অসভ্যতা করার শাস্তি আমি নিজে হাতে দেব ওকে।” রাগত কণ্ঠে বলল রিন।
“সে কি? তোমার সঙ্গে আবার কী করল মুসাফির?”
“আমাকে চুমু খেয়েছে! একটা কামুক শয়তান। এই অবস্থায়ও এদের মাথায় শুধু কাম। আজকে ওর চুমু খাওয়া ঘুচিয়ে দেব আমি!” চেঁচিয়ে উঠল রিন।
কথাটা শুনেই যেন কিছুটা তটস্থ হয়ে রিনের দিকে ঘুরে তাকালেন হুন। “তোমার শরীর ঠিক আছে তো রিন! এই লোকটা সেয়ানা ঘুঘু। নিছক কামের তাড়নায় এমন একটা কিছু করবে বলে মনে হয় না। তোমার মুখে কোনো নিউরাল টক্সিন ঠুসে দেয়নি তো?” সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল হুন।
“না ডক!! ওসব কিছু না! লোকটা আসলে মহিলা দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। আমি যে ঠিক আছি সেটা তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমার দেহে কোনো টক্সিন এর উৎপত্তি থাকলে আপনার জার্ম স্কানেই ধরা পড়ত। আপনি এদের তাড়াতাড়ি ম্যাপ করুন, তারপর আমার হাতে ছেড়ে দিন।” বলেই সশব্দে হেঁটে পাশের ঘরে চলে গেল রিন।
এইবার ডক্টর হুনের ঠোঁটে খেলে গেল একটা বাঁকা হাসি। তার সামনের চেয়ারে বসে তখন মুসাফির আর মার্কো। তাদের হাত পা মুখ বাঁধা। এবার গিয়ে মুখের লকটা খুলে দিল হুন। তারপর দুজনের মাথায় পরিয়ে দিল দুটি অত্যাধুনিক নিউরাল হেলমেট!!
“কি অদ্ভুত না মুসাফির? কার আবিষ্কার, কে কীসের জন্য ব্যবহার করছে। তোমার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আহা রে! তবে এবার তুমি মুক্তি পাবে। যে সমস্ত স্মৃতি তোমাকে বিরক্ত করে মারে, রাতে ঘুমাতে দেয় না, এবার সেগুলো চিরতরে হারিয়ে যাবে। এর সঙ্গেই হারিয়ে যাবে সেই সব সুখস্মৃতি। সব মুখগুলো যাদের তুমি খুব ভালোবাসতে! সব মুছে যাবে! চিরতরে। আর যখন তখন চুমু খেতে ইচ্ছে করবে না! কারণ সমস্ত আবেগ মুছে যাবে। এবার তোমাদের পুনর্জন্ম হবে। তারপর তোমরাই হবে কোনো স্পেস কমব্যাট এক্সপার্ট বা কিলার মেশিন। কিছু বলতে চাও নাকি? শেষবারের মতো?”
“বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!” দৃঢ় কণ্ঠে বলল আলম মুসাফির!
সশব্দে হেসে নিজের কনসোলে ফিরলেন হুন। এক এক করে অন করতে লাগলেন সুইচগুলো। আর ঠিক তখনই গোটা পডটা গহীন অন্ধকারে ডুবে গেল।
***
এমার্জেন্সি ব্যাক আপ আসতে সময় লাগল মিনিট তিনেক। আসলে কাইরোস-৪ এ এমন পাওয়ার ফেলিওর এই প্রথম। এর আগে কখনও হয়নি এমন। তাই প্রথমটা বেশ কিছুটা থতমত খেয়ে গেছিলেন ডক্টর হুন। এমার্জেন্সি জেনারেটরগুলো চালু হতে সময় লাগার কথা দশ সেকেন্ড কিন্তু সেখানেও আজ গোলযোগ! এখানেই কু ডেকেছিল হুনের মনে। কিন্তু সেই সময় তার করণীয় বিশেষ কিছুই ছিল না। গার্ডগুলোকে ডেকেও সাড়া পাওয়া গেল না। তার মানে কি কেউ আক্রমণ করল? সেটা হলে তো পাওয়ার ফেল হওয়ার আগেই সংকেত পাওয়া যেত। তাই নিজেই এমার্জেন্সি রুমে গিয়ে পাওয়ার ব্যাক আপ চালু করে ঘরে ফিরলেন হুন।
দুটো চেয়ার ফাঁকা। এটা তো অসম্ভব। কেউ যদি ম্যানুয়ালি খুলে না দেয় এদের বাঁধন, তাহলে এদের মুক্তি অসম্ভব। এবার আতঙ্কের একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল হুনের শিরদাঁড়া বেয়ে। লালচে এমার্জেন্সি আলোতে দেখতে পেলেন হুন, তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে দুটো ছায়ামূর্তি। দুজনের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র। মার্কো আর আলম মুসাফির!
“ডাক্টার তোমার খেলা শেষ! তোমার এই পুরো ফেসিলিটি কম্প্রোমাইজ হয়ে গেছে। এবার আমাদের হাতে প্যাকেজটা তুলে দাও ভালোয় ভালোয়, না হলে প্রাণে বাঁচবে না তুমি।” আদেশের সুরে বলল মুসাফির।
“আমাকে মারতেই পারো তুমি। কিন্তু তার আগে আমাদের কিলার মেশিনকে সামলাও তো। রিন এদের শেষ করে দাও।” চিৎকার করে উঠলেন ডাক্তার। তার কথা শেষ করার আগেই পিছন থেকে বন্দুক উঁচিয়ে ছুটে এল রিন। তার হাতে উদ্ধত বন্দুক। মুসাফিরের দিকে তাক করা।
“কী করে হল ডক?”
“বুঝতে পারছি না এরা কোনোভাবে সিকিউরিটি সিস্টেম ব্রিচ করেছে। এদের দলবল ঘিরে ধরেছে ল্যাবটা। বেসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে ফেলেছে। এখন এদের চাই প্যাকেজটা! তুমি সেল্ফ ডেসট্রাক্ট কর সেটাকে।” উত্তেজিত কণ্ঠে বলল হুন।
“কী বলছেন ডক! আমার নিউরাল নেটওয়ার্ক এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত! এখন আমার মাথার ভিতরে যদি প্যাকেজ সেল্ফ ডেসট্রাক্ট করি তাহলে তো আমি মরে যেতে পারি, পাগল হয়ে যেতে পারি। আর কোনোদিন কমব্যাট ফোর্সে কিছুতেই ফিরতে পারব না!”
“স্বার্থপরের মতো কথা বোলো না রিন। এক্ষেত্রে তোমার আমার থেকে অনেক বেশি দরকার সিন্ডিকেটের সুস্থ ভবিষ্যৎ। তোমার একটা বলিদান তোমাকে অমর বানিয়ে দেবে। তোমার নামে রাস্তার নামকরণ হবে, তোমার জীবনী নিয়ে ওয়েব সিরিজ হবে। তোমাকে পুজো করবে জনগণ! কিন্তু এই প্যাকেজ এদের হাতে পড়লে সর্বনাশ! তাই যা বলছি সেটা করো।” উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল ডক্টর হুন।
“না রিন! একদম নয়।” বন্দুক উঁচিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল মুসাফির আর মার্কো। দু-পা পিছিয়ে গেল রিন। “কী আছে এমন ওই প্যাকেজে আমাকে বলো ডক! আমাকে জানতে হবে!” রিন বলল।
“কখনও নয়! কোনো কোরিয়ারকে প্যাকেজে কী আছে সেটা জানানো সিন্ডিকেট প্রোটোকলবিরোধী।” প্রতিবাদ করে উঠল হুন।
“সেই যুক্তিতে কেন একজন ওয়ার ভেটেরান কমব্যাট স্পেশালিস্টকে একটা কোরিয়ার এর কাজ দিয়ে বারবার কাইরোস-৪ এ পাঠানো উচিত নয় ডক! আমার উত্তর চাই কিন্তু। কী আছে এই প্যাকেজে?” সহসা এবার রিন ঘুরে বন্দুকটা ঠেকাল ডক্টর হুনের মাথায়।
“কুইন শিবার মেমোরি ম্যাপ!” কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল ডক্টর হুন।
“মানে? এটা কী করে সম্ভব! কুইন শিবাকে সেইদিন আমি হত্যা করেছিলাম! তার মৃতদেহ অবধি উদ্ধার করা যায়নি। তাহলে কী করে আপনারা কুইন শিবার মেমোরি ম্যাপ এক্সট্র্যাক্ট করলেন?” সচকিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল রিন। এবার এক নিমেষে নিজের সুট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে রিনকে আক্রমণ করল ডক্টর হুন। কিন্তু এইসব আক্রমণ বিচলিত করতে পারবে কি একটি কিলার মেশিনকে। সঠিক সময় নিজেকে সরিয়ে নিল দুরন্ত কায়দায় রিন। আর পরমুহূর্তেই ডক্টর হুনের চোয়ালে আছড়ে পড়ল একটা ঘুসি। পিছমোড়া করে হুনকে ধরে একটা চাড় দিতেই, নেতিয়ে পড়ল হুনের দেহটা।
রেড সিন্ডিকেট বেস ক্যাম্প
“হচ্ছেটা কী? কমান্ডার মার্সেলো? প্রায় তিন ঘণ্টা হয়ে গেল এখনও তোমরা কাইরোস-৪ এর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারলে না?” রাগত কণ্ঠে চিৎকার করে বললেন মহামহিম হুতুম পেঁচা।
মিনমিনে স্বরে উত্তর এল মার্সেলোর তরফ থেকে, “লেভেল থ্রি সিকিউরিটি ব্রিচ হয়েছে মহামহিম! যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমার মনে হয় আমরা কাইরোস-৪ কম্প্রোমাইজ করেছি। ডক্টর হুন নিহত। এই ডেটা তার বায়োমেট্রিক রেকর্ড বলছে।”
রাগে, বিরক্তিতে বিকট চিৎকার করে উঠলেন মহামহিম হুতুম পেঁচা। আর ঠিক তখন তাদের সামনের স্ক্রিনটাতে কাইরোস-৪ এর দৃশ্যপট ভেসে উঠল। লাইভ কল চলছে। সামনে সশস্ত্র দাঁড়িয়ে আলম মুসাফির আর মার্সেলো।
“মহামহিম হুতুম পেঁচা! এবার আপনাদের কাউন্ট ডাউন শুরু। এবার আপনারা দেখবেন জনরোষের কী ক্ষমতা! বিপ্লবের ছোট্ট স্ফুলিং এবার দাবানল হয়ে আপনাদের এই মিথ্যের সাম্রাজ্য পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। আমরা অল্টারনেট ফোর্স এখন কাইরোস-৪ অধিগ্রহণ করেছি। আমাদের আগামী আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হন।” কড়া গলায় বলল মুসাফির!
“আমি আপনাদের নেতার সঙ্গে কথা বলব।” কাটা কাটা কথায় বললেন মহামহিম।
এবার মার্কো আর মুসাফিরকে ঠেলে পিছন থেকে এগিয়ে এল একটি ছায়ামূর্তি। লালচে আলোর ছটায় চিনতে পারলেন মহামহিম রিনকে। “কমান্ডার রিন, এরা নিশ্চয়ই আপনার ব্রেন অল্টার করে দিয়েছে। আপনি কিন্তু…” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কমান্ডার মার্সেলো, কিন্তু হাতের ইশারায় তাকে থামতে বললেন মহামহিম। স্ক্রিনে অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল একটা বজ্র কঠিন নারীকণ্ঠ, “রিন নয়, সারা হিলার বা কুইন শিবা বলুন কমান্ডার! আপনাদের ত্রাস, আপনাদের গহীন কালো রাতের দুঃস্বপ্ন! কী ভেবেছিলেন আপনারা! সেইদিন আপনাদের অতর্কিত আক্রমণে, আপনাদের মার্সেনারি কমান্ডার রিন মারা যান। কিন্তু আপনারা প্রোটোকল বহির্ভূতভাবে একটি কৃত্রিম ডিজিটাল চোরাবালি সৃষ্টি করে মার্কোকে ফাঁসিয়ে দেন। আমি বুঝতে পারি সবাই ধরা পড়লে সর্বনাশ। তাই মার্কোকে রক্ষা করে পালিয়ে যায় মুসাফির। ওকে আমি একটাই কথা বলেছিলাম, আমাকে খুঁজে একটা চুমু খেয়ো! আসলে আমি জানতাম আপনারা আমার মেমোরি অল্টার করে বিপ্লবের আইডিয়াটিকে সমূলে বিনাশ করতে চাইবেন। তাই আমি একটি অত্যাধুনিক নিউরাল লক ইনস্টল করি আমার মেমোরিতে। ডক্টর হুন আমার মেমোরি প্রতিস্থাপিত না করতে পেরে সেটাকে ইনঅ্যাকটিভ করে দেন এবং আপনাদের ড্যাটাবেস থেকে নিয়ে রিনের চেতনা গুঁজে দেন আমার মগজে। তারপর সিন্ডিকেট বেসে নিয়ে আপনাদের পুরো টিম অনেক চেষ্টা করেও আমার নিউরাল লক ভাঙতে পারে না। আপনারা ঠিক করেন আমাকে আর একবার ডক্টর হুনের কাছে পাঠাবেন। তার দেওয়া ওষুধ যেন নিউরাল লক নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। একবার আমার মেমোরি পেয়ে গেলেই যেন আমাকে খুন করা হবে—এমন আদেশ দিয়েছিলেন আপনারা। এদিকে কী অদ্ভুত আমি নিজেই কোরিয়ার হয়ে প্যাকেজ নিয়ে গেলাম, এটা না জেনে যে আসলে আমি নিজেই প্যাকেজ। ভাগ্যিস সঠিক সময় মুসাফির চলে আসে! আমার নিউরাল ম্যাপ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়নি, তাই থেকে থেকে সে ড্রিম সিগন্যাল পাঠাতে থাকে আমাকে। তবু রিনের চেতনা বারবার সেই সিগন্যাল প্রতিহত করতে থাকে। একটা যুদ্ধ আমার মাথার ভিতরেও চলছিল। আমাকে জাগানোর জন্য প্রয়োজন ছিল একটা ফিসিকাল স্টিমুলাস! প্রেমের বা ভালোবাসার স্পর্শের থেকে উৎকৃষ্ট কোনো স্টিমুলাস আজ অবধি বিশ্বে আবিষ্কার হয়নি। তার সামনে সমস্ত কৃত্রিম নিউরাল স্টিমুলাস নগন্য। আর তাই আমার ভাই মার্সেলোকে দেখে আর মুসাফিরের চুম্বনে আমার নিউরাল লক খুলে যায়! কিন্তু এখন আমার মাথায় রিন এবং আমি দুজনেই বাস করি। সহাবস্থান, যুদ্ধ নয়! অর্থাৎ আপনাদের একাধিক সিক্রেট এখন আমার মাথায় মুক্ত। আর এখন চালকের আসনে আমি কুইন শিবা!” রাগত কণ্ঠে বলে দিল রিন ওরফে কুইন শিবা।
নিজের রাগ সংযত করে হিমশীতল কণ্ঠে এবার বললেন মহামহিম হুতুম পেঁচা, “একটা রাউন্ডে জিতে নিজেকে বিজয়ী ভাবার ভুল কোরো না কুইন শিবা। একবার ধরেছিলাম, এবার সোজা মেরে ফেলব। প্রস্তুত হয়ে থেকো কুইন শিবা, একটা ঝড় আসছে, ধ্বংসের প্রহর গোনা শুরু করে দাও!!”
“আমরা অপেক্ষায় থাকব! তবে কাইরোস-৪ এর সমস্ত স্বাধীন মানুষ ও আমাদের সঙ্গে তৈরি থাকছে।”
এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই লাইভ স্ক্রিনে কাইরোস-৪ আর রেড সিন্ডিকেট বেস ক্যাম্পের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল।
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, পথিক মিত্র
