ঊর্মিলা

  • লেখক: সোহম গুহ
  • শিল্পী: জটায়ু

একটা সুদৃশ্য কার্ডবোর্ড আর প্লাস্টিকের তৈরি বাক্সের মধ্যে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল সে। টানা আট ঘণ্টা চার্জ দেওয়ার পরে সে যখন আস্তে আস্তে তার কৃত্রিম অক্ষিপল্লব তুলল, আমি তাকালাম তার নীলমণি চোখের দিকে। সেই চোখে ভাষা সেই, নেই প্রাণোচ্ছাস। তারপর, সম্পূর্ণ সচল হয়ে সে বলল, “শুভ রাত্রি, প্রবাল। আমি ঊর্মিলা।’’ তার ঠোঁটের নীচে লুকনো একটা স্পিকার থেকে বেরিয়ে এল তার যান্ত্রিক, কিন্তু কোমল গলার স্বর।

     যে বাক্সে করে ঊর্মিলা এসেছে আমার এখানে, সেই বাক্সের উপরে তার ক্রেতার নাম লেখা। আমার ছেলে আমায় হঠাৎ কেন এই যন্ত্র পাঠাল আমি জানি না। ঊর্মিলা যখন এসেছে তখন ওদের ওখানে গভীর রাত। যদিও, মুকুল যে শহরে ঘর নিয়েছে সেই শহরের নাকি চোখে ঘুম নেই। তবুও, বাবা তো! নিউ ইয়র্কে থাকা ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে প্রশ্ন করার ইচ্ছা হয়নি আমার। আর তাছাড়া, চার্জ শেষ করে ঊর্মিলার সিস্টেম না অন হওয়া অবধি ছেলে ঠিক কী পাঠিয়েছে আমি বুঝে উঠতে পারিনি। বয়স হচ্ছে মানছি, কিন্তু ম্যানুয়ালটা পড়ে বুঝতে আমার এত সময় লাগল কেন?  

     আমি ঊর্মিলার দিকে তাকিয়ে সন্দেহভরা স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, “তোকে আমার এখানে ঝাড়পোঁছ করার জন্য পাঠানো হয়েছে, তাই না? তুই একটা দামি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ছাড়া আর তো কিছু নোস।’’  

     ঊর্মিলা রাগল না। রাগ প্রোগ্রাম করা নেই ওর মধ্যে। সেই রকমই শান্ত স্বরে উত্তর দিল, “না প্রবাল, আমি এখানে এসেছি আপনার দেখাশোনা করার জন্য।’’

     আমি গজগজ করে বললাম, “রোবট আয়া? বাবাঃ! কালে কালে কত কিছুই না দেখব!”

 

#

আসলে আমার চারপাশের দুনিয়াটা খুব দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। আর আমি না পারছি তাল মেলাতে, না পারছি সেই পরিবর্তনকে আত্তীকরণ করতে।  

     এই তো, গত সপ্তাহে, আমি গিয়েছিলাম ব্যাঙ্কে। একটা এফডি ম্যাচিওর করেছে, সেই টাকা ঢুকেছে আমার অ্যাকাউন্টে। সেই টাকার কিছুটা তোলার দরকার পড়েছিল আমার, জিনিসপত্র কেনার জন্য। জানি, এখন নেট ব্যাঙ্কিং, ভিম, আরও কত কিছু বেরিয়েছে। কিন্তু ফোনের মাধ্যমে লেনদেনে আমি ঠিক স্বচ্ছন্দ নই। কেউ শেখায়নি যে।

     ব্যাঙ্কে লোক ঢোকানো হচ্ছে একজন একজন করে, সংক্রমণ রোধের জন্য। বাইরে ঠা ঠা রোদে পড়েছে বিশাল লাইন। অধিকাংশই আমার মতো প্রবীণ নাগরিক। আমার পালা এলে আমি ভেতরে ঢুকলাম। সিকিউরিটির কাছ থেকে হাতে স্যানিটাইজার লাগিয়ে গেলাম কাউণ্টারের সামনে। যদিও, সেখানে ক্যাশিয়ার বসে নেই। তার জায়গা নিয়েছে একটা রোবট।

     কিন্তু, রোবট বলা যায় কি সেটাকে? কারণ পড়েছি রোবটের নিজে নিজে কাজ করার ক্ষমতা আছে। তাদের অগ্নিমূল্য এই বাজারে। না, আমার সামনের যন্ত্রটা রোবট নয়।

     আজ থেকে আট বছর আগে যখন এই ভাইরাস থামিয়ে দেয় মানুষের দৈনন্দিন জীবননীতি, থামিয়ে দেয় সভ্যতার চাকা, তখন ফ্রন্টে কাজ করার মানুষদের সুরক্ষার জন্য ডি.আর.ডি.ও এই ধরনের যন্ত্র বের করে। এটা আসলে একটা রিমোট কন্ট্রোলড ড্রয়েড, একটা প্রস্থেটিকের মতো ব্যবস্থা। একে চালনা করেছে যে মানুষ সে তার বাড়ির নিরাপত্তায় বসে। আমি ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন আছেন?”

     করোনার আবহে যে মুষ্টিমেয় মানুষ তাদের কাজ হারায়নি, এই ক্যাশিয়ার তাদেরই একজন। তিনি উত্তর দিলেন, “এই আছি জেঠু। ভাগ্যিস ৫.৫জি এসেছিল, তাই জন্যই তো আপনাকে টাকা গুনেগেঁথে দিতে পারছি কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড বিলম্বে হলেও। নাহলে সংসার কী করে চালাতাম জানি না। আপনি ভালো আছেন?”

     এই যন্ত্রের মুখে এক দশকের পরিচিত প্রমীলা স্বর বেমানান। কিন্তু সেইটুকুই আমার পরিচিত বৃত্তের খণ্ডাংশ হয়ে টিকে রয়েছে। আমি মাথা নাড়লাম কেবল।  

     সেই ক্যাশিয়ার ড্রয়েডের মতো ঊর্মিলার কণ্ঠস্বরে অনুভূতি নেই, নেই কথোপকথনের সেই আবেগ। আমি তাও জিজ্ঞেস করলাম, “তোর যাবতীয় কিছু কি তোর মধ্যেই? নাকি তোকে কেউ বাইরে থেকে কন্ট্রোল করছে আমার ঘর গৃহস্থালি সামলানোর জন্য?”

     ‘‘না, প্রবাল। আমি এক অটোনোমাস ইউনিট। আমায় কী করতে হবে বলুন।’’

     আমি রান্নাঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, “চাল আছে। ডাল আছে। নুন দিয়ে একসঙ্গে ফুটিয়ে খিচুড়ি বানা। যদি পারিস।’’

     আমি একবার ঘড়ি দেখলাম। আমেরিকায় সূর্যোদয় হয়েছে।

 

#

প্রথমে ভেবেছিলাম ঊর্মিলার কাজকর্মে নজর রাখব। সত্যি বলতে কি, ভরসা করে উঠতে পারছিলাম না যন্ত্রটার উপরে। কী করে করব? আমার সব ধ্যানধারণার বাইরে এই রোবট। কিন্তু, যখন ওকে দেখালাম পাকা গিন্নির মতো মেপে মেপে চাল নিয়ে ভেজাতে, আর দেখলাম পেঁয়াজ কাটছে একদম কুচিকুচি করে, বুঝলাম, আমার চিন্তা নিষ্প্রয়োজন। যারা ওকে বানিয়েছে, খুব ভালো ভাবেই বানিয়েছে। ত্রুটি নেই।

     তাই, আমি বেডরুমে গিয়ে ল্যাপটপ বের করলাম, ছেলের কাছে আমায় জবাবদিহি চাইতে হবে তো!

     মুকুল সব শুনেটুনে বলল, “বাবা, তোমার দরকারেই ওকে পাঠানো হয়েছে তোমার কাছে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার মনে হয়েছে, তোমার ভীমরতি বাড়ছে। কী যেন একটা বলে? হ্যাঁ, বাহাত্তুরে ধরেছে তোমার।’’

     ‘‘কী বলতে চাস? আমি পাগল?”

     “তুমি সব কিছুকেই এইরকম নেগেটিভলি নাও কেন? পাগল বলেছি তোমায়? বলিনি তো। দেখো বাবা, এখানে আমি আমার স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে আছি। আর ওখানে তুমি একলা। কতবার বলেছি, চলে এসো। চলে এসো। তোমার সব দায়িত্ব আমার। কিন্তু না, তোমার এঁড়ে গোঁ তোমায় দেশ থেকে বের হতে দেয়নি। পৈতৃক সম্পত্তি রক্ষা করে চলেছ যক্ষের মতো। আর তারপর তো করোনা এসে সব কিছু বন্ধ করেই দিল!

     মা যখন মারা যায়, তখন আমি অন্ত্যেষ্টিতে পর্যন্ত আসতে পারিনি অনেক চেষ্টা করেও। ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট সব বন্ধ থাকায়। সেই অপারগ পরিস্থিতি যদি আমায় কুরে কুরে খেতে পারে, আমি তাহলে কেবল আন্দাজ করতে পারি মা চলে যাওয়ার পরে তৈরি হওয়া শূন্যতা তোমার ভেতরে কেমন হাহাকারের সৃষ্টি করেছে। আমরা তো ভেবেছিলাম, আশা করেছিলাম, যে এই মহামারী কেটে যাবে বছর কয়েকের মধ্যে। সেই আশার অপেক্ষায় আরও সাতটা বছর কেটে গেছে, তিরিশ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে সেই আশায় বসে থেকে। কিন্তু একটা রেট্রোভাইরাসের ওষুধ বের করা কি পরিমাণে কঠিন সেটা আমার থেকে তুমি জানো ভালো করে।

     আমি ঊর্মিলাকে পাঠিয়েছি তোমার দেখভালের জন্য। কারণ, তুমি নিজের যত্ন নেওয়া ছেড়ে দিয়েছ। আমি অলরেডি একজনকে হারিয়েছি, বাবা। আমি চাই না তুমিও মায়ের সঙ্গী হও। ঊর্মিলার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো। কারণ ও মহার্ঘ্য এবং ফেরত পাঠানো যাবে না ওকে। আমার এক মাসের স্যালারি আজকে তোমার কেয়ারটেকার বাবা, তোমার নিজের ভালোর জন্যই। সে তুমি চাও আর না চাও।’’

     “জ্ঞান দিস না আমায়, আমি একজন ডাক্তার।’’

     “ছিলে বাবা, ছিলে। নাকি ভিআরএস নিয়েছ মায়ের মৃত্যুর পর, সেটাও ভুলে গেছ?”

     উত্তর না দিয়ে আমি ল্যাপটপ বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে শুলাম। মুকুলের সঙ্গে তর্কে আমি কখনোই পারিনি। আর, ও ভুল নয়। সত্যিই তো, যত্ন কোথায় নিচ্ছি নিজের? দিনের পর দিন ভূতের মতো এই একলা বাড়িতে দিন গুনছি কেবল। ঝুল জমেছে কোনায়। চিলেকোঠা বাদুর আর ইঁদুরের রাজ্য। আসবাবের উপরে জমেছে এক পলেস্তরা ধুলো। এক নজরে এই বাড়িতে কেউ থাকে বিশ্বাস হবে না। কিন্তু আমি আছি। কড়ি গুনছি নিজের আয়ুর।

     বালিশের আরামে কখন এইসব চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

     ঘুম ভাঙল এক অপূর্ব গন্ধে। আমার ঘর মম করছে ধনে ফোড়ন আর হিঙের সুবাসে। সেই সঙ্গে ঘি ঢালা গরম ভাতের গন্ধ। ঘুমজড়ানো চোখে চেয়ে দেখি আমার বিছানার পাশে ঊর্মিলা। তার হাতে ধরা প্লেটে সাজানো ভাত, পেঁয়াজ দেওয়া ডাল, আর রুই মাছের হলুদগোলা ঝোল। মাছ আমি কালকেই কিনেছি। কিন্তু ভাজা বাদে আর কিছু বানাতে জানতাম না যে। তাই এই রুই পড়ে ছিল ডিপ ফ্রিজে।

     আমি ধড়মড় করে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, “একী? এত সব কী? কী করে? কে শেখাল তোমায় রান্না করতে?” তুই থেকে কখন তুমিতে উঠে গেছি আমি জানি না।

     “আমার ড্রাইভে একটা ইনবিল্ট লাইব্রেরি আছে। সেখানে জমানো মোটামুটি মানুষের যাবতীয় সাহিত্যকীর্তি। দরকার পড়লে ইন্টারনেট থেকে বাকিগুলো নামাতেও পারি। যা দরকার আপনার, সায়েন্টিফিক পেপার থেকে দশ বছর আগের পুরনো খবরের কাগজ। এত বইয়ের সঙ্গে কিছু কুকবুকও রাখা আছে আমার ড্রাইভে। তাই দেখে দেখে বানালাম এগুলো। ও, আপনার ভাঁড়ারে হলুদ আর গোলমরিচ শেষ হয়ে এসেছে। আমি তাই অনলাইনে কিছু অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। সরকারের যে লোকাল সাপ্লাইয়ের পোর্টালটা আছে, সেখানেই। কালকে সকালে ডেলিভারি দেবে।“

     ‘‘কিন্তু… কিন্তু প্রিপেডে টাকা মেটালে কী করে? আমার আধার লিঙ্ক করা অ্যাকাউন্ট নম্বর কে দিল তোমায়?”

     ‘‘আমায় অন করার সময় আপনি আপনার ওয়াইফাইতে আমাকে যখন কানেক্ট করেছিলেন, তখনই আমি পেয়েছি। আপনার ফায়ারওয়ালের খুবই দৈনদশা ছিল। আমি সেটাকে আপগ্রেডও করে দিয়েছি আমার সফটওয়্যার দিয়ে।’’

     আমি খুব বেশি না বুঝলেও বুঝতে পারলাম আমার অর্থনৈতিক তথ্য বেশ খুল্লামখুল্লাই পড়ে ছিল বাইরে। আমারই দোষ, কীভাবে করতে হয় জানি না তো। যাই হোক, একটু কিন্তু কিন্তু করে, বেশ কিছুটা ভয় নিয়েই মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মাখলাম। খাবারগুলো যখন দেখতে মন্দ নয়, তখন খেতেও নিশ্চয়ই ভালো হবে।

     আমি শেষ কবে এত হালকা অথচ এত ভালো মাছের ঝোল খেয়েছি মনে নেই। মাঝে মাঝে মুখ বদলাতে রেস্তরাঁ থেকে খাবার আনিয়ে খেয়েছি। যেগুলো এসেছে আবশ্যিক স্যানিটাইজড সাদা প্যাকেজে। কিন্তু সেই তেল-ঝাল-মশলাদার খাবার খেয়ে মাঝে মাঝেই পেট বিগড়েছে।

     আমার বউ এইরকম রান্না করত, আর মজা করে বলত, “শিখে নাও। আমি চলে গেলে কে এইভাবে যত্ন করে বানিয়ে খাওয়াবে?” আমি শিখিনি। আসলে ওকে ছাড়া কোনও জীবন আমি কল্পনাই করতে পারিনি। আজ সেই অকল্পনীয় বাস্তব গত ছয় বছর ধরে আমার হৃদয়ে শৈত্যের গান গেয়ে হয়েছে নিত্যদিনের সঙ্গী।   

     খেয়ে দেয়ে একটা আরামের ঢেঁকুর তুলে আমার খেয়াল হল আমি দিব্যি হাত না ধুয়ে রাতের খাবার খেয়েছি। ঊর্মিলাকে সেই কথা বলতে ও বলল, “সে ঠিক আছে, প্রবাল। মাঝে মাঝে এক-আধ দিন হয়েই যেতে পারে। আপনি চিন্তা করবেন না। যখন আপনি ঘুমাচ্ছিলেন, আমি কম আঁচে মাছ বসিয়ে গোটা বাড়ি ঝাড়পোঁছ করেছি। কয়েকটা উই আর ছারপোকা, মাকড়সা বাদে সেই রকম কিছুই নজরে পড়েনি আমার। আপনি বাড়ি থেকে বের হন না কেন? আপনার সদর দরজার বায়োমেট্রিক তালা বলছে আপনি এক সপ্তাহ ধরে গৃহবন্দি। আপনি তো শারীরিক ভাবে সক্ষম, আপনার সমবয়সি বাকি অনেকের থেকে। তাহলে ভোরবেলা একটু হাঁটতে বের হন না কেন?”  

     আমি বলতে পারলাম না ঊর্মিলাকে, “আমার মননের, হৃদয়ের একটা বিশাল অংশ আমার স্ত্রীর সঙ্গেই মারা গেছে।’’

 

#

প্রথম দিকে ঊর্মিলার সঙ্গে মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও পরে অনেক সহজ হয়ে গেলাম ওর সঙ্গে। কীভাবে কে জানে, এই সম্পর্ককে এক ছেলে আর তার নতুন সৎমার মধ্যে তৈরি হওয়া সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করা চলে। যেন সেই ছেলের মতো আমিও জানি, আমার খুব কাছের যে চলে গেছে তার জায়গা নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এই নতুন জন। কিন্তু এও জানি, সেই পুরনো জনের জায়গা দখল করা সম্ভব নয় এই নতুনের পক্ষে। সে তো বলেনি যে ‘হেথা হতে যাওপুরাতন। হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে।’ সে এসেছেই পুরাতন যাওয়ার অনেক পরে। তাই, এই নতুনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সময়ের পথ চলাই একমাত্র উপায়। আমার স্ত্রীকে আমি ভালোবাসতাম। আজও ভালোবাসি। কিন্তু ঊর্মিলার প্রতি এক স্নেহ জন্ম নিয়েছে আমার মনের মধ্যে। বুঝতে পেরেছি, আমার বড় প্রয়োজন এই রোবটকে।  

     সিনেমা, সিরিয়াল তৈরি বন্ধ বহুকাল। খবর কমতে থাকায় খবরের কাগজের পৃষ্ঠাসংখ্যাও তলানিতে। তাই খবরের কাগজ তার কাগুজে কৌলীন্য হারিয়ে ডিজিটাল হয়েছে। ফাঁকা স্টেডিয়ামে কোভিড টেস্টের পরে টেস্ট খেলতে নামে আমাদের ক্রিকেটাররা। এই শূন্যতার জায়গা দখল করেছে অ্যানিমেশন, কার্টুন আর অ্যানিমে। গত সাত বছরের সেরা কাহিনিগুলির কুশীলব রক্তমাংসের না, কম্পিউটারে আঁকা চরিত্ররা। আর ফিরে এসেছে বই। নিজের ছোটবেলায় যেমন দেখতাম, এখনও তেমনি মানুষকে দেখি বই পড়তে। পার্থক্য একটাই, সেই বইগুলো কাগজের পাতায় নয়, মোবাইলের স্ক্রিনে।

     মাঝে মাঝে মনে হয় সেই সব মানুষের কথা, যারা আমার মতো ভাগ্যবান নয়। যাদের বই পড়ার অভ্যাস নেই, যাদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য নেই ঊর্মিলার মতো কেউ। আমার একটা বন্ধুবৃত্ত ছিল। তারা সবাই এই দ্বিতীয় ধরনের। আজ হঠাৎ কেন কে জানে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে কাটানো সময়ের কথা মনে পড়ল। স্মৃতি রোমন্থনের সময় তাদের কথা বললাম ঊর্মিলাকে। প্রত্যুত্তরে সে বলল, “চিন্তা করবেন না। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’’

     কিন্তু কী করে? তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেলে আমায় পাড়ি দিতে হবে প্রায় বিশ কিলোমিটার। এই ব্যারিকেড ফেলা রাস্তায়, আমার মতো একজন প্রবীণ মানুষের পক্ষে এত দূর নিজের গাড়িতেও ট্র্যাভেল করা যথেষ্ট কষ্টকর। তারপর, তারা সবাই থাকে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এ তো আর আগের দিন নয় যে আমরা কফি হাউসের একটা টেবিল দখল করে কথার তুবড়ি ছোটাব! মাস্ক পরে প্রাণ খুলে কি কথা বলা যায়?  

     ঊর্মিলাকে এইসব কিছু বুঝিয়ে বলার পর সে বলল, “প্রবাল, (ঊর্মিলা বোধহয় এক ঘরোয়া, স্বচ্ছন্দ পরিবেশ বজায় রক্ষার জন্যই কখনও আমায় বস বা স্যার বলে ডাকেনি। ডেকেছে নাম ধরেই। আমিও আপত্তি করিনি।) রিমোট চালিত মেশিন ব্যবহার করে ভারতব্যাপী অ্যাগ্রো-কো-অপারেটিভগুলো সোনার ফসল ফলাচ্ছে মাঠে। আপনাদের কারখানাতে এখন শ্রমিক কম, অটোম্যাটিক যন্ত্র বেশি। অনলাইনে অর্ডার দেওয়া যাবতীয় জিনিস এসে পৌঁছচ্ছে তোমার দরজায় খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। এনে দিচ্ছে হয় একটা ড্রোন, নয়তো একটা স্বচালিত গাড়ি।

     “চোখ খুলে দেখুন। মানুষের এই সভ্যতার দেমাক যে কতখানি ঠুনকো, সেটা বোঝাতে একটা মিউটেশনে নিমগ্ন আরএনএ স্ট্রান্ডই যথেষ্ট ছিল। পুঁজিবাদ তো বিশ্ব জুড়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই যে টাকার দেমাক, ডলারের গরম, অর্বুদ থেকে নির্বুদপতি হওয়ার সর্বগ্রাসী খিদে, সবই তো এখন মিথ্যে। যদি সভ্যতারই চাকা থেমে যায়, তাহলে এত টাকা কোন কাজের? এই রংচঙে কাগজ না খাওয়া যায়, না অন্য কিছুতে ব্যবহার করা যায়। সোশ্যালিজমই ভবিষ্যৎ, প্রবাল। যদি মানুষ নিজের লোভকে কবজা করে, আর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় একে অপরের প্রতি, তাহলে পৃথিবী শুধু বাঁচবে না, ভবিষ্যতের দিকেও এগোবে।

     “কেন জানেন? আমাদের মতো এই ভাইরাস ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলিম, ভালো-খারাপ, পুণ্যবান-পাপীর মধ্যে তফাত বিচার করে না। তার কাছে আমরা প্রত্যেকেই এক একটা রক্তমাংসের তৈরি আঁতুড়ঘর। সে আমরা মাস্ক পরে যতই সেই ঘরের দরজা বন্ধের চেষ্টা করি না কেন।’’

     “ঊর্মিলা, এসব তোমার পক্ষে বলা সহজ। তোমাকে যারা বানিয়েছে তারা প্রথম বিশ্বের নাগরিক। আমাদের গরিব দেশের অবস্থা তাদের বোঝার কথা নয়।’’

     “প্রবাল, গরিব দেশ?” ঊর্মিলার যান্ত্রিক কথায় কি ঝাঁজ ফুটে উঠল একটু? না। অসম্ভব। সে বলল, “ফোর্বসের লিস্টের প্রথম দশ জনের চারজন ভারতীয়। এই দেশ এই মুহূর্তে বিশ্বের ফার্মা হাব, গমের বৃহত্তম ভাণ্ডার, সার্ভিস সেক্টরে দুই নম্বর। আপনাদের জিডিপি পৃথিবীতে তৃতীয়। আপনাদের ক্ষুদ্র শিল্প চনমনে নতুন ফিস্ক্যাল নীতির জন্য। শপিং মল আর এমএনসিগুলো ঝাঁপ ফেললেও আপনাদের জীবনের কি কোন পরিবর্তন এসেছে? না তো! সেই ফ্র্যাঞ্চাইজি দানবদের জায়গা দখল করেছে আপনাদেরই অবহেলিত কুটির শিল্প। এবং সেই ফাঁক তারা পূরণ করছে নিপুণ ভাবে। কেএফসির চিকেন হয়তো পাচ্ছেন না। কিন্তু দিনুদার ফ্রায়েড চিকেন কি তার সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করছে না? 

     আর প্রবাল, আমাদের যারা বানিয়েছে সেই কোম্পানির হেড অফিস প্যারিসে হলেও আমাদের যন্ত্রাংশ আসে গোটা পৃথিবী থেকে। আমাকে জোড়া লাগানো হয়েছিল লোসাথোতে। আমার খুলি এসেছিল ভিয়েতনাম থেকে। আমার মাথার এই সিলিকেট চুল তৈরি করেছে কিরিবাতি আর টোঙ্গার মানুষেরা। আমার প্রসেসর তাইওয়ানের। আমার ব্যাটারি দক্ষিণ কোরিয়ার। আর আমার শরীর তৈরি ব্রুনেইতে।’’

     “পৃথিবীর সেই সব অঞ্চল যেখানে ভাইরাস এখনো পা রাখতে পারেনি। ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড।“

     “হাক্সলির বই। আপনার ইচ্ছা হলে একদিন এটা পড়ে শোনাব।“

     আমি মাথা নাড়লাম। এই বাড়ির কর্তা আমি হলেও বাড়ির দায়িত্ব এখন পুরোপুরি ঊর্মিলার হাতে। একজন মানুষের থেকে ও যে কম নয়, সেই কথা প্রতিমুহূর্তে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আসলে আমাদের প্রজন্মের এটাই দোষ। আমরা ভবিষ্যতের পুকুরে ডুব দিতে চাই অতীতের পাড়ে পা রেখেই। সেটা যে সম্ভব নয়, খেয়াল থাকে না। যেখানে গোটা পৃথিবী অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে ভার্চুয়ালে, সেখানে এখনও আমি রোমন্থন করি আমাদের ফেলে আসা দিনগুলোর। যখন আমরা একে অপরের সামনে বসে পাড়া মাথায় তুলতাম।

     দিন তিনেক পরে একটা ডেলিভারি পৌঁছয় আমার কাছে। খুলে দেখি সেখানে রাখা অনেকগুলো তার আর অদ্ভুতদর্শন একজোড়া গ্লাভস আর হেলমেট। ঊর্মিলা দেখে বলল, “এআর। অগমেন্টেড রিয়্যালিটি। আমি বলেছিলাম না, আমি আপনার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটানোর চেষ্টা করব।’’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “ঊর্মিলা। সমস্যাটা তুমি বোঝোনি। আমার সঙ্গে আমার বন্ধুদের দেখাসাক্ষাৎ সম্ভব নয়। ওরা চাইলেও ওদের সেই সুযোগ দেওয়া হবে না।’’

     ঊর্মিলা আমার পাশে বসে বলল, “আমার সমীকরণ মিলছে না। আপনার দূরত্ব সমস্যা ছিল। আমি সেই সমস্যা মিটিয়ে দিয়েছি। এই সমস্যাটা আমি প্রসেস করতে পারছি না। দেওয়া হয় না মানে? মানুষ স্বাধীন জীব। আপনাদের সংবিধানের ১৪ থেকে ২৯ ধারা…”

     আমি ওকে থামিয়ে বললাম, “সংবিধান দিয়ে তো জীবনকে বিচার করা যায় না ঊর্মিলা। আমার প্রত্যেক বন্ধুই থাকে তাদের ছেলেমেয়ের কাছে। আর যেখানে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট আর বেকারত্ব তুঙ্গে, সেখানে তাদের বাবা মায়েদের কেবল কথা বলার জন্য এত টাকা খরচ করে এইসব যন্ত্র কেনার ইচ্ছা নেই তাদের, সত্যি বলতে সম্ভবও নয়। সবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট তো আমার মতো নয়। একটা বয়সের পর মানুষ তার সন্তানের দায়িত্ব হয়ে ওঠে। সেই সন্তান তাদের বোঝা হিসেবে দেখবে না হৃদয়ের টুকরো, সেটা সম্পূর্ণ সেই সন্তানের উপরে।’’

     কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঊর্মিলা বলল, “কিন্তু এত টাকার জিনিস, এটাকে ফেরত না দিয়ে আপনি এটাকে ব্যবহার করুন না, আপনার নাতির সঙ্গে কথা বলতে?”

     চন্দনের জন্ম আমেরিকায়। তার সঙ্গে আমার পরিচিতি কেবল ভিডিয়ো কল আর ফোটোগ্রাফের মাধ্যমে। আমার স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল তার নাতিকে কোলে করে আদর করার। কিন্তু তার আগেই এই ভাইরাস তাকে কবজা করে নিল। একদিন হঠাৎ তাকে দেখলাম কাশতে। সেই সঙ্গে তীব্র শ্বাসকষ্টে তার বুক ডাঙায় আটকে পড়া মাছের মতো ওঠানামা করছিল। আমার এত বছরের প্র্যাকটিসের ফলে তৈরি কানেকশনগুলোও কাজে লাগেনি। গোটা রাত এক হসপিটাল থেকে আরেক হসপিটালে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঘুরে বেরিয়েছি। শেষে যখন এক নার্সিংহোমে তার ঠাঁই হল, তখন বড় দেরি হয়ে গেছে। আমার বইয়ের তাকের এককোণে এখনও সে শুয়ে। এক কাঁচের বাক্সে বন্দি ছাই হয়ে। একজন ডাক্তার হয়েও নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে বাঁচাতে পারিনি আমি। আর সেই কষ্টের বলি হয়েছে চন্দন। তাকে চেনার চেষ্টাও করিনি আমি।

 

#

“ইয়ো দাদু। আমি স্যুট পরে রেডি। তুমি জাস্ট লগ ইন করো, দেখতে পাবে আমায়।’’

     এই ভয়ঙ্কর দেখতে ধড়াচূড়া পরার আগে আমি এই জিনিসটা কেন তৈরি করা হয়েছে ইন্টারনেটে দেখছিলাম। বাপরে বাপ! একটা অনলাইন ডেটিং সাইট তাদের ভিভিআইপি সাবস্ক্রিপশনের অংশ হিসেবে এই স্যুট বাজারে ছাড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে আটকে থাকা সঙ্গমেচ্ছু নারীপুরুষের শরীরী খেলার মাধ্যম হিসেবে। তারপরে সাইবার-যৌনপল্লি, এমনকি এআর ভ্রমণেও ব্যবহৃত হচ্ছে এই স্যুট। নাকে লাগানোর একটা নতুন অ্যাড অন লাগিয়ে মানুষ এখন আমাজনের সোঁদা গন্ধ থেকে তিব্বতের শুকনো ঘাসের ঘ্রাণ, সব পেতে সক্ষম।

     “হাই দাদু।’’ লগ ইনের পর আমি চন্দনকে খুঁজে পেলাম আমার সামনে। আমি দাঁড়িয়ে ওর নিউ ইয়র্কের ঘরের মাঝখানে। চোখে জল এসে গেল আমার। এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। ওর উত্তাপ, কোমল স্পর্শ অনুভব করলাম নিজের বুকের মাঝে। তারপর ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে ওকে ভালো করে দেখে বললাম, “তোমার দাদির চোখ পেয়েছ তুমি।“

     চন্দনের সঙ্গে জীবনে প্রথমবার এত প্রাণ খুলে কথা বললাম আমি। আমি জানতে পারলাম ওর অনলাইন স্কুলিং সম্পর্কে। তার কনসোলে খেলা প্লেয়ার ভার্সেস প্লেয়ার গেমগুলোর সম্পর্কে। অনেকক্ষণ বকবক করে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বইটই পড়া হয়? বাংলা বই?”

     উত্তরে চন্দনের পাশে একটা তাক জন্ম নিল, তাতে থরে থরে থাম্বনেল হয়ে সাজানো ইবুক। চন্দন বলল, “আমার মা এগুলো কিনে দিয়েছে। রোজ রাতে শোয়ার আগে আমায় গল্প শোনায়।’’

     আমি দেখে খুশি হলাম সেই লাইব্রেরিতে আমার প্রিয় কিছু বইয়ের উপস্থিতি দেখে। আমি চন্দনকে জিজ্ঞেস করলাম, “চাঁদের পাহাড় পড়েছ?”

     চন্দন মাথা নাড়ায় ঊর্মিলাকে আমি বললাম আমার নাতিকে এই গল্পটা পড়ে শোনাতে। আমায় যখন ও গল্প পড়ে শুনিয়েছিল প্রথম বার, সম্ভবত সেটা ছিল ১৯৮৪ বইটা, আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম ঊর্মিলা কতটা সুবক্তা।  

     আফ্রিকার মানুষখেকো সিঙ্গি থেকে শুরু হয়ে বুনিপ হয়ে সলসবেরিতে পৌঁছে যখন গল্প শেষ হল, আমি চন্দনকে একবার জড়িয়ে ধরে আদর করে বললাম, “টা টা। কালকে আবার একটা গল্প নিয়ে আসব।’’ চন্দনের মত আমিও ঊর্মিলার কাছে মগ্ন হয়ে শুনছিলাম। বাইরে কখন ঘণ্টা তিনেক কেটে গেছে খেয়ালই করিনি।

     আমার গালে একটা হামি খেয়ে চন্দন বলল, “ড্যাড বলে তুমি ডক্টর ছিলে। এখন আর নও কেন?”

     একটা নিস্পাপ শিশুকে বলতে পারলাম না যে কেন আমার ডাক্তারি জ্ঞান আমার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেনি।

     আমাকে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঊর্মিলা বলল, “হয়তো এই প্রশ্ন করা আমায় মানায় না। কিন্তু আপনার কেয়ারগিভার হিসেবে এই প্রশ্নটা করা আমার কর্তব্য। প্র্যাকটিস ছাড়লেন কেন? করোনায় সব থেকে বেশি আক্রান্ত এবং মারা গেছেন ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা মানুষগুলো। পুলিস, ব্যাঙ্ককর্মী, নার্স আর ডাক্তার। এই পেশার মানুষের যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা ভর্তি হওয়ার নয়। আর…”

     “ঊর্মিলা। আমি ক্লান্ত, আর খিদেও নেই শরীরে। তোমার ভেতরে নড়ে কলকবজা। কোনও মানবহৃদয় ধুকপুক করে না। তাই তুমি এক রিক্ত, খণ্ডবিখণ্ডিত হয়ে আবার সেলোটেপ দিয়ে জোড়াতাপ্পি লাগানো হৃদয়ের যন্ত্রণা বুঝতে পারবে না। বোঝানো সম্ভব নয় তোমাকে। এখন যাও। গুড নাইট।’’

     ঊর্মিলা কথা না বাড়িয়ে বিদায় নিল আমার ঘর থেকে।

 

#

ঊর্মিলার সঙ্গে এই নিয়ে এরপর থেকে মাঝে মাঝেই যুক্তিতর্ক শুরু হয়। যদিও, সঠিক যুক্তি খাড়া করতো ও। আর এঁড়ে তর্ক করতাম আমি। ওকে আমি বলিনি কখনোই, কারণ কাউকেই এই কথা বলা প্রয়োজন মনে করিনি আমি। কিন্তু যখনই আমার ব্যাগ থেকে স্ক্যালপেল টেনে বের করি, আমার স্ত্রীর মুখ ভেসে ওঠে সেই স্ক্যালপেলের ধারালো অংশে। কথা তার বুঝতে পারি না আমি, কিন্তু সেইগুলোকে অভিসম্পাত মনে হয় আমার। তার আমায় বলা শেষ কথা তখন মনে পড়ে আমার। “আমি এত বছর তোমার চলার পথ ছিলাম, প্রবাল। আমায় ছাড়া কী করবে তুমি?”  

     “প্রবাল,” ঊর্মিলা আমার হাতে ধরিয়ে দিল আজকের কাগজ খোলা ট্যাবটা। তাতে একটা আর্টিকেল ও বুকমার্ক করে রেখেছে। “স্টিফেন হকিং বলেছিলেন ২১০০ সালের পর থেকে জনসংখ্যার এক হ্রাস পরিলক্ষিত হবে। মনে হচ্ছে এই ভাইরাস সেই টাইমলাইনকে ৬০ বছর সামনে এনে ফেলেছে।’’

     আমার সামনে খোলা খবরে মানুষের জন্মহার হ্রাসের একটা রিভিউ রিপোর্ট। মানুষ ইতিহাসে প্রথম এই হ্রাস পরিলক্ষিত হয়েছে। আমি ট্যাব বন্ধ করে বললাম, “এটা তো হওয়ারই ছিল। কোনও বাবা-মা’ই তার সন্তানকে এই দুনিয়া দেখাতে ইচ্ছুক নয়। এর সঙ্গে যোগ করো আমাদের নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, সরকারের হাম দো হামারে এক পলিসি, আর খাদ্যের সঙ্কট। ৮ বিলিয়ন মানুষ কি যথেষ্ট নয় ঊর্মিলা, পৃথিবীর ভার বাড়ানোর জন্য?”    

     আমাদের কথার ব্যাঘাত ঘটিয়ে বেজে উঠল আমার মোবাইলটা। অন্য ঘরে থাকায় ঊর্মিলা নিজে গিয়ে সেটা ধরল। তারপর আমায় বলল, “বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে একটি চোদ্দো বছরের ছেলে ভর্তি হয়েছে। আপনার সাহায্য প্রার্থনা করেছেন ওঁরা।’’

     যখন প্র্যাকটিস করতাম, পূর্ব ভারতের সেরা নিউরো সার্জেন হিসেবে খ্যাতি ছিল আমার। রিটায়ার করার ছ’বছর পরেও সেই খ্যাতি বর্তমান। আমি তাই ঊর্মিলাকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম এই কলগুলো রিসিভ করতে। যাতে আমায় কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়। ঊর্মিলা এতদিন তাই-ই করেছে। আজকে ওর হল কী?  

     ঊর্মিলা বলল, “ওঁরা আপনাকে রোগীর ব্লাড রিপোর্ট আর এমআরআই মেল করছেন। আপনার এই কেসটা নেওয়া উচিত।“

     আমার সামনে একটা জলের বোতল ছিল। ছুড়ে মারলাম ওর দিকে। একটা ভোঁতা শব্দ করে ওটা দেওয়ালে লেগে নীচে পড়ে গেল। “না মানে না-ই, ঊর্মিলা। একটা প্রতিজ্ঞা করেছি আমি। কারও জন্য সেই প্রতিজ্ঞা ভাঙতে পারব না।“  

     ঊর্মিলা আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “আমি আপনাকে বুঝি না একেবারেই। কিন্তু জানার চেষ্টা করছি। এই যে তিন মাস আমি আছি আপনার বাড়িতে, আমি একটা জিনিসই বারবার লক্ষ করছি, আপনার নিজের অজান্তে ফেলা দীর্ঘশ্বাসকে। আপনি ঠিকই বলেছিলেন, একটা গ্লাস ভেঙে আবার নতুন হয় না। কিন্তু সেই গ্লাস আবার আঠা লাগিয়ে নতুন করে ব্যবহার করা যায়।

     জয়া চলে গেছে ছ’বছর আগে, প্রবাল। সেই চলে যাওয়া নিয়ে কিছু করতে পারবেন না আপনি। মানুষের কাছে কালযাত্রা আজও অসম্ভব। কিন্তু আপনি সামনে এগোতে পারেন। পারেন তাঁর অনুপস্থিতিকে অগ্রাহ্য না করে সেই অনুপস্থিতিকে মেনে নিতে। আজকে উনি থাকলে আপনার এই অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই খুশি হতেন না। আপনার অধিকার নেই এক কিশোরকে তার জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার। কারণ এই অধিকার আপনার থেকে তার অনেক অনেক বেশি।“

     আমি কৌতূহলবশত একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম মেলে আসা রিপোর্টটায়। মাথা নেড়ে বললাম, “তুমি সমস্যাটা বুঝছ না ঊর্মিলা। পেশেন্টের হিপ্পোক্যামপাসের নীচে টিউমার দেখা দিয়েছে। ওর ব্লাডে অ্যান্টিবডির পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে অনেকটা বেশি। এই রিপোর্ট সত্যি হলে ওর কাছে সময় বেশি নেই। এত রাতে ওখানে পৌঁছে নিজেকে সার্জারির জন্য প্রেপ করব কীভাবে?”  

     ঊর্মিলা উত্তর না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ প্রসেস করল সমস্যাটাকে। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এখন এত রাতে এই শরীরে যাত্রার ধকল সইত না আমার। হঠাৎ ঊর্মিলা বলল, “আমার মডেল নাম কেন ঊর্মিলা রাখা হয়েছে জানেন?”

     “লক্ষ্মণের স্ত্রীর নামে?”

     “শুধু সেটা নয়। লক্ষ্মণ তাঁর সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে রেখে বনবাসে চলে যান রামের সঙ্গে। রাম সীতাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেও লক্ষ্মণ কেন নিয়ে গেলেন না ঊর্মিলাকে, তা পরিষ্কার নয় রামায়ণে। বস্তুত, এই মহাকাব্যের সবথেকে উপেক্ষিত চরিত্র যদি কেউ হয়, সে ঊর্মিলা। পরিবারের মধ্যে থেকেও নিজের বাড়িতে মানুষ আজ উপেক্ষিত, প্রবাল। সবাই ছুটছে ইঁদুর দৌড়ে সামিল হয়ে। পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছে সময়। এই আগ্রাসনের বলি সবথেকে বেশি হয়েছে বাচ্চারা, গৃহবধূরা আর প্রবীণরা। তাঁদের সাহায্য করার জন্যই সৃষ্টি আমাদের। যে এআর স্যুট পরে নাতির সঙ্গে কথা বললেন, পরে ফেলুন সেটা। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি হসপিটালে এইচডিইউতে আমার একটা সিস্টার মডেল আছে। সে আপনার আউটপুট হবে ওখানে।’’    

     চকিতের জন্য আমার ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ারের কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু এ তো টাকা গোনা নয়, এ একজন মানুষের জীবনের প্রশ্ন। একটা এদিক ওদিক হলে…

     ঊর্মিলা বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পারল। আমার মাথায় হেলমেটটা বসানোর সময় বলল, “বিশ্বাস করেন আমায়? আমি নেটওয়ার্ক অপ্টিমাইজেশন করেছি, হার্ডওয়্যার কম্প্যাটিবিলিটিও চেক করেছি। গোটা পাড়ার ব্যান্ডউইথ এখন আপনার। কোন আউটপুট ডিলে পাবেন না।’’

     ঊর্মিলা মাথায় হেলমেট বসানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক উজ্জ্বল পূর্বপরিচিত ওটিতে। অবাক হয়ে দেখলাম নিজের যান্ত্রিক হাত, একটু আগের কাঁপুনি উধাও সেই হাতে। মাস্ক পরিহিত হেড নার্স আমার হাতে সার্জিক্যাল গ্লাভস পরাতে পরাতে বলল, “আসার জন্য ধন্যবাদ, ডাক্তারবাবু।“ 

     অনুভব করলাম যে শৈত্যের গান এতদিন ধরে আমার হৃদয়কে জয় করে রেখেছিল, তাতে গলন দেখা দিয়েছে একমুঠো ওমের স্পর্শে।

Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, জটায়ু, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সোহম গুহ

8 thoughts on “ঊর্মিলা

  • August 21, 2020 at 7:01 pm
    Permalink

    awesome.. .. superb. Soham

    Reply
  • August 21, 2020 at 9:36 pm
    Permalink

    গল্পটি ভালো। উপভোগ করলাম।

    Reply
    • September 10, 2020 at 9:59 am
      Permalink

      ধন্যবাদ আপনাকে।

      Reply
  • September 8, 2020 at 12:46 pm
    Permalink

    ধন্যবাদ দিদি

    Reply
  • October 20, 2020 at 3:22 pm
    Permalink

    Bhobishoyt e coronai akranto prithbir chitro Tu khub e upobhog korlam ar Urmila r choritrayon o monay rekhapat korlo

    Reply
    • October 31, 2020 at 9:30 am
      Permalink

      ধন্যবাদ দাদা

      Reply
    • October 31, 2020 at 9:31 am
      Permalink

      ধন্যবাদ অতনু বাবু

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!