জোঁক

  • লেখক: অদ্রীশ বর্ধন
  • শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ

নন্ত মহাশূন্যের ভিতর দিয়ে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ভেসে চলছিল অচেতন বুভুক্ষু জোঁকটা। অগণিত শতাব্দী কেটে গেছে এক নক্ষত্র থেকে আর এক নক্ষত্রের মধ্যবর্তী মহাকাশ অতিক্রম করতে। তারপর এলো সূৰ্য। ধীরে ধীরে সঞ্জীবনী বিকিরণে স্নান করে উঠলো শুকনো আর কঠিন বীজগুটিগুলো। শুরু হলো অভিকর্ষের আকর্ষণ।

     অসংখ্য ধূলিকণার সাথে মিশোনো সামান্য এককণা ধুলো বইতো কিছুই নয়। পৃথিবীর দুরন্ত হাওয়ায় কতদিন নেচে নেচে বেড়ালো সেই কণিকাটি। তারপর নেমে এলো ধরিত্রীর বুকে।

     মাটি স্পর্শ করেই নড়ে উঠল সে। বীজগুটির আবরণের মধ্যে দিয়ে শুষে নিলে পুষ্টি। পুষ্টিকর খাবার। তারপর, একটু একটু করে বৃদ্ধি পেতে লাগল তার কলেবর!

     লনের প্রান্তে পরিখার মধ্যে পড়েছিল ধুসরাভ কালো জিনিসটা। মোটর ট্রাকের টায়ারের মত একটা গোলাকার বস্তু। ইঞ্চিখানেক পুরু।

     কোনার্সের হাত থেকে কোদালটা ছিনিয়ে নিয়ে সজোরে খোঁচা দিলেন মাইকেল—কিন্তু এক চুলও নড়াতে পারলেন না। আর, তার পরেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন দুজনেই।

     কোদালটার ডগার দিক থেকে ইঞ্চি দুয়েক ধাতু ভোজবাজির মতই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে!

     এক মুঠো ধুলো দিয়ে জিনিসটার ওপর ছড়িয়ে দিলেন মাইকেল। দেখতে দেখতে তা মিলিয়ে গেল। ইঞ্চিকয়েক দূরে হাত নিয়ে গেলেন মাইকেল। না, কোনো উত্তাপ নেই। অথচ এর পরেই দুহাতে কোদালিটাকে বাগিয়ে ধরে প্রচণ্ড আঘাত হেনেই হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলেন উনি।

     হাতের মধ্যে রইলো শুধু কাঠের হাতলটা আর অল্প একটু ধাতু। প্ৰায় পুরো কোদালটা ধীরে ধীরে উধাও হয়ে গেল গোলাকার বস্তুটার জঠরে!

     কুল কুল করে ঘামছিলেন প্রফেসর মাইকেল। স্খলিতস্বরে বললেন—“এটা পাথর নয়। জোঁক রক্ত পান করে। কিন্তু এ জিনিসটা দেখছি ধুলো আর কোদাল দিয়েই তৃষ্ণা মিটোচ্ছে। আমি কলেজে চললাম। বায়োলজিষ্ট বা ফিজিসিষ্ট আনা দরকার।”

     কিছুই বাদ গেল না জোঁকের বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধার কাছে। হাওয়া, বৃষ্টি, সূৰ্যকিরণ—সবকিছুই অল্প অল্প করে বাড়িয়ে চলল তার কাইনেটিক বা গতীয় এনার্জির ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে। মাটি, পাথর, বৃক্ষ-শাখা তার বিচিত্র জটিল কোষের মধ্য গিয়ে ভেঙেচুরে রূপান্তরিত হলো এনার্জিতে এবং এনার্জি থেকে বস্তুতে। বৃদ্ধি পেতে লাগল তার দেহ।

     এইবার চেতনার স্ফুলিঙ্গ দেখা যায় জোঁকের কোষে কোষে। নিজের অবিশ্বাস্য ক্ষুদ্রতা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত হয়ে ওঠে তার কলেবর বৃদ্ধির বেগ।

     কলেজে না গিয়ে বাড়ীর ল্যাবরেটরিতেই এমন একটা অ্যাসিড তৈরীর চেষ্টা করেছিলেন মাইকেল, যা দিয়ে অনায়াসেই গলিয়ে ফেলা যায় ঐ আশ্চর্য পাথরটাকে। পরের দিন এসে উনি দেখলেন আট ফুট লম্বা হয়ে গিয়েছে জোঁকটা। পরিখা পেরিয়ে রাস্তায় উঠে এসেছে তার বর্ধিত দেহ। তার পরের দিন দেহের বিস্তার দাঁড়ালো আঠারো ফুট। রাস্তাও প্ৰায় বন্ধ।

     সেইদিনই শহর থেকে গাড়ী হাঁকিয়ে এলেন শেরিফ। সঙ্গে আনলেন। ব্লো-টর্চ আর একটা পেল্লায় হাতুড়ি।

     সব শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন শেরিফ। মুখে কিছু বললেন না। ব্লো-টর্চ জ্বালিয়ে নিয়ে শিখাটা ধরলেন পাথরটার একটা কিনারায়। অনেকক্ষণ এক নাগাড়ে ধরে রইলেন উনি। কিন্তু এতটুকু পরিবর্তনের ছোঁয়া দেখা গেল না জোঁকের দেহ-উত্তাপে অথবা বর্ণে। ব্রো-টর্চ নামিয়ে সঙ্গীকে নির্দেশ দিলেন শেরিফ। পোল্লায় হাতুড়িটা মাথার ওপর তুলে প্ৰচণ্ডবেগে সে আঘাত হানলে সেই বিশেষ জায়গাটির ওপর এবং সঙ্গে সঙ্গে চীৎকার করে উঠল বিকট শব্দে।

     হাত ঝনঝন করে উঠেছিল তার। কিন্তু পাথরটার একটা কোষও স্থানচ্যুত করতে পারেনি সে।

     ঠিক এমনি সময়ে দূরে শোনা গেল মিলিটারী কনভয় এখানে আসার নির্ঘোষ।

     দেখতে দেখতে সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল পুরোভাগের জীপটি। ভেতর থেকে যে সৈনিক পুরুষটি নামলেন, তার কাঁধের তারার বাহার দেখেই মাইকেল বুঝলেন তিনিই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।

     কপাল কুঁচকে ভারিক্কি চালে এগিয়ে এসে শুধোলেন—“রাস্তা বন্ধ করেছেন কেন?”

     মাইকেল বললেন-“কিছুতেই পাথরটাকে সরাতে পারছি না আমরা।”

     “এত শাবল কোদাল ব্লো-টর্চ হাতুড়ি দিয়েও সরাতে পারেন নি?” অফিসারের চোখে বিদ্রুপ আর অবিশ্বাস।

     নিরুত্তর রইলেন মাইকেল।

     ফিরে দাঁড়ালেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। কড়াগলায় হুকুম দিলেন—“ড্রাইভার, ওপর দিয়ে চালাও।”

     গোঁ করে গর্জে উঠে চার ইঞ্চি পুরু পাথরটার উপর লাফিয়ে উঠল পুরো ভর্ত্তী জীপটি। কিন্তু ঠিক মাঝানে এসেই নিশ্চল হয়ে গেল চাকাগুলো।

     হুংকার দিয়ে উঠলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল—আমি তোমায় থামতে বলিনি।

     অসহায় স্বরে জবাব দিলে ড্রাইভার—আমি থামাইনি, স্যার।

     বার বার গর্জে উঠল জীপের ইঞ্জিন। কিন্তু আর একচুলও নাড়ানো গেল না।

     অদ্ভুত গলায় ফিসফিস করে উঠলেন মাইকেল—দয়া করে চাকার দিকে দেখুন।

     দেখলেন অফিসার। তারপরেই যেন ভূত দেখছেন এমনি স্বরে চেচিয়ে উঠলেন, ড্রাইভার! ড্রাইভার! লাফিয়ে নেমে এসো। পাথরে পা দিও না!

     সৈন্যবাহিনীর চোখের সামনেই ঘটল সেই আশ্চৰ্য কাণ্ড ! প্ৰথমে চাকা চারটি গলতে শুরু হয়েছিল। তারপর ক্ৰমে ক্ৰমে গোটা জীপটাই গলে মিলিয়ে গেল জোঁকের দেহমধ্যে। সবশেষে গেল এরিয়ালটা।

     ফিরে দাঁড়ালেন অফিসার, বাজখাঁই গলায় হুকুম দিলেন—হাতবোমা আর ডিনামাইট নিয়ে এসো।

     চেতনার স্ফুরণ প্ৰায় সম্পূর্ণ হয়েছিল। নিঃসীম ক্ষুধায় লোলুপ হয়ে উঠেছিল তার প্রতিটি কোষ। খাবার চাই, আরও খাবার। মিলিয়ে যেতে লাগল তলাকার মাটি। ব্লটিংয়ের ওপর কালীর ফোঁটার মতই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগিল জোঁকটার দেহ।

     আচম্বিতে একটা বিরাট বস্তু এসে পড়লো দেহের ওপর। রূপান্তরিত হলো তা খাদ্যে। আর তারপরেই……

     একেবারে গায়ের ওপরেই ফেটে পড়লো এনার্জির বিপুল উৎসধারা…নিমেষে শোষণ করে নিলে জোঁকটা…তারপরেই আবার বিস্ফোরণ…আবার…আবার…মহাভোজের উল্লাসে মেতে উঠল সে…তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পেতে লাগল তার দেহ!……

     পাহাড়ের ওপর স্তব্ধ দেহে দাড়িয়ে ছিলেন মাইকেল!

     অনিমেষ চোখে দেখছিলেন। কিভাবে কয়েক শ গজ ব্যাসের বিশাল লাভার আকারে ছড়িয়ে পড়া জোঁকটা গ্ৰাস করছে তার দীর্ঘকালের আবাসস্থানটিকে। চোখের সামনেই ভেঙে পড়লো গাড়ী বারান্দা…মিলিয়ে যেতে লাগল ধীরে ধীরে……

     নীচে নেমে এলেন মাইকেল। কাঁটাতার দিয়ে সমস্ত অঞ্চলটা ঘিরে ফেলেছিল সৈন্যবাহিনী। নিষিদ্ধ এলাকা। রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার—কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। একজন রক্ষীর পিছুপিছু মাইকেল এসে দাঁড়ালেন জেনারেল ওডোনেলের তাঁবুতে।

     টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন জেনারেল। সাগ্রহে কর মর্দন করে বললেন—“প্রফেসর, এইবার আপনার চিন্তার অবসান ঘটবে। আমাদের রেডিওঅ্যাকটিভ অস্ত্রসস্ত্রের সমারোহটা লক্ষ্য করছেন তো?”

     নিস্প্রাণ স্বরে মাইকেল বললেন—কিন্তু আপনারা একটা বড় ভুল করছেন। জোঁকটার জটিল কোষ সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না ঠিকই, কিন্তু এটুকু জানি যে বস্তুকে এনার্জিতে এবং এনার্জিকে সরাসরি দেহগত বস্তুতে রূপান্তরিত করার আশ্চর্য ক্ষমতা তাৱ আছে। এককথায় এনার্জিই তার খাদ্য। সেক্ষেত্রে রেডিও অ্যাকটিভ বিস্ফোরণ মানেই তাকে খাবারের মধ্যে আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিয়ে আরও শক্তিশালী করে তোলা!

     হাসলেন জেনারেন। সে হাসি শক্তিমানের। বললে—আমি একটি মাত্র তত্ত্বেই বিশ্বাস করি। তা হলো, শক্তি দিয়ে শত্রু নিপাত। আসুন আপনার চোখের সামনেই দুটুকরো করে ফেলছি জোঁকটাকে!

     দীর্ঘ প্ৰতীক্ষার পর আবার শুরু হলো খাদ্য সরবরাহ। প্ৰথমে অল্প, ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পেল পরিমাণ। বিকিরণ, কম্পন, বিস্ফোরণ, কঠিন পদাৰ্থ, তরল পদার্থ—খাদ্যসামগ্রীর বিস্ময়কর সমারোহ। কিন্তু সর্বগ্ৰাসী ক্ষুধা তো কই মিটছে না! খাবার চাই, আরও খাবার! নিরত সৃষ্ট নতুন নতুন কোষের ক্ষুধার সঙ্গে মিলিত হয়ে জোরদার হয়ে উঠল। উপোসী জোঁকের খাদ্যের দাবী!

     আকারে আর ছোটটি নয় সে। চেতনার বিকাশও হয়েছে সম্পূর্ণ। অপরিমেয় খাদ্যবন্যায় প্রথমটা বিহ্বল হয়ে পড়লেও পরক্ষণেই চনমনে হয়ে উঠল উৎসের সন্ধানে। অবহেলে ভেসে উঠল সে শুন্যে। মন্থর গতিতে এগিয়ে গেল বায়ুপথে। টুপ করে নেমে পড়ল খাবারের স্তুপের উপর! পুষ্টিকর রেডিও-অ্যাকটিভ উপাদানগুলোকে চটপট জঠরস্থ করে নিলে তার অতি-সক্রিয় কোষগুলো। ধাতু আর কার্বোহাইড্রেটের পিণ্ডও বাদ গেল না। উড়ন্ত জোঁকের দেহ যখন নৰ্থ হিল পেরিয়ে এল, তখন সুৰ্য ঢেকে গিয়েছিল। প্ৰাণ হারালো সাতষট্টিজন সেনানী। জেনারেল ওডোলেন পরমাণু বোমা চেয়ে পাঠালেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ পাঠিয়ে দিলেন কয়েকজন বিজ্ঞানীকে। তাঁবুর বাইরে অশান্ত চরণে পায়চারী করতে লাগলেন মাইকেল আর জেনারেল।

     জোঁকের দেহের ব্যাস তখন দুই মাইল। দু’দুটো খামার বাড়ী অদৃশ্য হয়ে গেছে তার কোষের মধ্যে।

     ক্ষণপরেই তাঁবু থেকে থমথম মুখে বেরিয়ে এলেন বিজ্ঞানীরা।

     মাইকেল শুধোলেন—জোঁকটার নেচার কি বুঝতে পারলেন?

     আপনার সিদ্ধান্ত মোটামুটি সঠিক। সম্ভবত পৃথিবীর বাইরে থেকে এসেছে জিনিসটা। পৃথিবীর মাটিতে নামার আগে পর্যন্ত খুব সম্ভব বীজগুটিরূপেই ছিল সে। আমাদের কপাল ভাল, সমুদ্রে নামেনি। নামলে সমুদ্র তো হারাতামই, তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই পায়ের নীচের মাটিও, চলে যেত ওর পেটে।

     তাহলে এখন উপায়? ব্যাগ্রস্বর জেনারেলের।

     অ্যাটমবোমা। যে এনার্জি ওর খাদ্য, সেই এনার্জির বন্যাতেই ডুবিয়ে মারা। গম্ভীর মুখে বললেন অ্যালেনসন।

     অন্যান্য গভর্ণমেণ্টের বিজ্ঞানীরা যাচাই করে দেখলেন এই সিদ্ধান্ত। তারপর ওয়াশিংটন বেঁকে বসলো। নিউইয়র্ক ষ্টেটের মাঝখানে অ্যাটম বোমা ফেলা ছাড়া আর কি কোনো উপায় নেই? পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে গেল আরও কয়েকটি দিন। পরিশেষে এল অনুমতি। পার পর পাঁচটা বোমা ফেলা হবে জোঁকটার অপার্থিব শরীরের ওপর।

     লোকজন সরিয়ে ফেলার পর নিউইয়র্ক থেকে আকাশে উড়ল একটা রকেট। আকাশ থেকে দেখা গেল দগদগে ক্ষতের মত ধূসরাভ কালো একটা দাগ ছড়িয়ে রয়েছে লেক প্ল্যাসিড থেকে এলিজাবেথ টাউন পর্যন্ত।

     নেমে এল প্ৰথম বোমাটি।

     প্ৰথম পুষ্টিকর খাবারের পর অনেকদিন আর তেমনটি পাওয়া যায় নি। তারপরেই একদিন ঘটলো—

     এনার্জির এক বিস্ময়কর বিস্ফোরণ! জোঁকের কাছে সবকিছুই খাবার। কিন্তু তবুও যেন দম বন্ধ হয়ে এল তার। আহার্যের সে কি বিপুল বন্যা? শক্তির স্রোতে ভেসে গেল সে, ডুবে গেল, থেঁতলে গেল—আর তারই মধ্যে এই অকল্পনীয় মাত্রার বিপুল খাদ্যকে ধরে রাখার আপ্ৰাণ প্ৰচেষ্টায় ক্ষিপ্তের মত বাড়িয়ে চলল নিজের দেহকে। অচিরেই প্রবল চাপে শ্বাসরুদ্ধ কোষগুলো পরিতৃপ্তির অনাবিল আনন্দে স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। খাবার চাই, আরও খাবার! বিদ্যুৎগতিতে জন্ম নিতে লাগল নতুন নতুন কোষ।

     শুরু হলো এনার্জির নিয়ন্ত্রণ। অবিশ্বাস্যবেগে বৃদ্ধি পেল দেহ। ফলে, আশ্চর্য রকমের উপাদেয় মনে হলো পরবর্তী ডোজগুলো।

     সুস্বাদু আহার্যের এই মহাভোজের অন্তে যেন পাগল হয়ে উঠল সে। লক্ষ গুণ বৃদ্ধি পেল তার উপোসী কোষগুলোর অন্তহীন খাদ্যস্পৃহা।

     শেষ নেই এই ক্ষুধার! আতংকবিহ্বল অবশিষ্ট সৈন্যসামন্ত নিয়ে মাইল দশেক পিছু হটে এসে ঘাঁটি গাড়লেন জেনারেল ওডোলেন। গভর্ণমেণ্ট অনুমতি দিলেন, বিজ্ঞানীদের সাথে পরামর্শ করে হাইড্রোজেন বোমা ব্যবহার করতে পারেন তিনি। বৈঠক বসলো বিজ্ঞানীদের? ভয় পেলেন তাঁরা চেইন রিঅ্যাকসনের ভয়।

     ইতিমধ্যে জোঁকের দেহের ব্যাস দাঁড়িয়েছে দুশো মাইলেরও বেশী। সারানাক লেক থেকে পোর্ট হেনরী পর্যন্ত আডিরোনডাক পর্বতমালার ওপর দিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে তার প্রকাণ্ড দেহ। প্ৰতি ঘণ্টায় বিশ ফুট হিসেবে বর্ধিত হয়ে চলেছে এই বিশাল কলেবর।

     আশপাশের দুশো মাইল পৰ্যন্ত সমস্ত অঞ্চল থেকে লোকজন পালিয়েছে সরকারের ইস্তাহার পেয়ে।

     বিতর্কে যোগ দেন নি মাইকেল। ইজিচেয়ারে আড় হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে চেয়ে উনি ভাবছিলেন, বারবার একই ভুল করে চলেছে সবাই। শক্তিই জোঁকের খাদ্য। সুতরাং তা প্রয়োগ করে তাকে নিপাত করা যাবে না। অথচ……

     আচম্বিতে ছিলা ছেঁড়া ধনুকের মত লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন মাইকেল।

     রুদ্ধকণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন—জেণ্টেলমেন, আমি পেয়েছি। বিকল্প হাতিয়ারের সন্ধান আমি পেয়েছি। সম্ভাবনাটা যদিও খুবই ক্ষীণ তবুও…একটু থেমে সারি সারি উৎকণ্ঠিত চোখের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললেন—অ্যানটেয়াসের নাম শুনেছেন?

     খাবারের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃহৎ থেকে বৃহৎতম হয়ে উঠতে লাগল জোঁকের দেহবৃদ্ধির বেগ আর ততই সর্বনাশা হয়ে উঠতে লাগল তার ক্ষুধা। মনে নেই কবে কিভাবে তার জন্ম হয়েছিল। তবে সুদূর অতীতের কথা মনে পড়ে এখনও। পুরাকালের কথা। একটা গোটা গ্রহকে খেয়ে ফেলেছিল সে। ক্ষুধায় জর জর বিপুল দেহ নিয়ে রওনা হয়েছিল নিকটবর্তী নক্ষত্রের দিকে। যাত্রাপথে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করেছিল কোষগুলো এনার্জিতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়ে। আস্ত নক্ষত্রটাকে দিয়ে ক্ষুধার জ্বালা আংশিকভাবে মিটিয়েছিল সে। তার পরেই খাবার ফুরিয়ে গেল। সবচেয়ে কাছের তারাটি তখন অপরিমেয় দূরত্বে ভাসমান।

     আবার শুরু হলো যাত্রা। কিন্তু নতুন খাবারের কাছে পৌঁছোবার অনেক আগেই নিঃশেষিত হলো তার এনার্জি। দেহগত বস্তুকে এনার্জিতে রূপান্তরিত করতে করতে তাড়াতাড়ি সঙ্কুচিত হয়ে এল সে।

     তারপর এনার্জির শেষ বিন্দুটুকুও যখন ফুরিয়ে গেল, বীজ-গুটির আকারে লক্ষ্যহীনভাবে মহা আকাশে ভেসে যেতে লাগল তার মুমূর্ষু দেহ।

     সেই কি প্রথম? উঁহু, কুয়াশা ছাওয়া আরও দূর অতীতের কথাও যেন তার মনে পড়েছে? সে সময়ে সমদূরত্বে বিক্ষিপ্ত নক্ষত্র জগৎ দিয়ে সাজানো ছিল বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড। উদর পূরণ করতে করতে তাদের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল সে। কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গিয়েছিল ছবির মত সাজানো এই ব্ৰহ্মাণ্ড ৷ আতংকে অভিভূত হয়ে তারকার সৃষ্টি করেছিল নক্ষত্রপুঞ্জ—আর ছায়াপথের পর ছায়াপথ।

     কিন্তু তা কি স্বপ্ন?

     অভ্যেসমত ধরিত্রীকে উদরস্থ করে চলল সে। নতুন নতুন পুষ্টিকর খাবারের সন্ধানে লোলুপ হয়ে উঠল তার কোষগুলো। আর তারপর খাবার নিজেই এসে পৌঁছোলো। এবার আকাশে—ঠিক ওপরে।

     প্ৰতীক্ষায় রইল সে। তবুও নাগালের বাইরে ঝুলতে লাগল খাবারটা। পুষ্টিকর, বিশুদ্ধ খাবারের এত সন্নিধ্যে থেকে উদগ্র হয়ে উঠল তার খাদ্য কামনা।

     কিন্তু খাবারটা নেমে আসছে না কেন?

     বহুক্ষণ অপেক্ষা করল সে। শেষে অসহিষ্ণু হয়ে আকাশে ভেসে উঠে ধেয়ে গেল খাবারের দিকে।

     পিছিয়ে গেল খাবারটা। উঠে গেল পৃথিবীর জমি থেকে অনেক ওপরে।

     যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধাওয়া করে চলল সে। দেখতে দেখতে পৃথিবীর অভিকর্ষ পেরিয়ে পড়লো মহাকাশে। সমান ব্যবধান বজায় রেখে তখনও ছুটে চলেছে সামনের খাবারটা!

     হঠাৎ চনমনে হয়ে উঠল তার প্রতিটি কোষ নতুন অনুভূতি বন্যায়। আরও পুষ্টিকর খাদ্যের ইশারা পেয়েছে সে ছুটন্ত খাবার যে দিকে ধেয়ে চলেছে, সেইদিকে।

     গনগনে সুৰ্যই সেই পরম স্বাদু খাবার!

     পানাহারের আনন্দে মেতেছিলেন ওডোনেল, মাইকেল আর বিজ্ঞানীরা। পৃথিবী থেকে উধাও হয়েছে জোঁক। ছুটে চলেছে সুর্যের দিকে—নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে।

     কিন্তু গুম হয়ে বসেছিলেন মরিয়ার্টি। মাঝে মাঝে পেন্সিল দিয়ে অঙ্ক কষছিলেন এক তা কাগজের ওপর।

     মাইকেল বললেন—জানেন তো, ধরিত্রী জি আর সমুদ্র পসিডনের সন্তান অজেয় মল্লবীর অ্যানটেয়াসকে যতবার মাটিতে আছড়ে ফেলেছিলেন হারকিউলিস, ততবারই নতুন শক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল সে। শেষকালে তাকে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন তিনি। জোঁককেও নিশ্বেস করতে হলে এই পথই নিতে হবে আমাদের।

     মহাকাশের মাঝে তখনও ছুটে চলেছিল স্পেশশিপটা। বিশুদ্ধ রেডিও-অ্যাকটিভ উপাদানে ভরা মহাকাশযানটিকে পৃথিবী থেকেই নিয়ন্ত্রণ করছিল অপারেটর। জননী ধরিত্রীর কোল ছেড়ে আকাশে উঠে নিবীৰ্য হয়ে গিয়েছিল অ্যানটেয়াস। স্পেশশিপের প্রলোভন দেখিয়ে জোঁকটাকেও সুকৌশলে আকাশের মধ্য দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছিল স্পেশশিপটা।

     দৌড় প্ৰতিযোগিতার অন্তে রয়েছে একটা প্ৰলয়ংকর সংঘর্ষ—সূর্যের সাথে।

     আচমকা নিরক্ত মুখে চেঁচিয়ে উঠলেন মরিয়ার্টি—স্পেশশিপ ফেরান!

     বলেই, অঙ্ক কষা কাগজটা ফেলে দিলেন সবার সামনে।

     অতি সহজ অঙ্কে উনি দেখিয়েছেন কি হারে বেড়ে চলেছে জোঁকের দেহ। মহাকাশের মাঝে তার গতি ধ্রুব। কিন্তু শক্তি শোষণের অথবা দেহ বৃদ্ধির রেখচিত্র উর্ধ্বগামী।

     পরিণামে—

     সূৰ্যকেও খেয়ে ফেলবে ও। শান্ত কণ্ঠে বললেন মরিয়ারটি। পরক্ষণেই তুমুল হট্টগোল শুরু হয়ে গেল কনট্রোলরুমের মধ্যে।

     অ্যালেনসন বললেন—বন্ধুগণ, গতিবেগ খুবই কম হওয়ার ফলে জোঁকটার শক্তি ব্যয় হচ্ছে নামমাত্র। সে অনুপাতে এনার্জি শোষণ এবং দেহের বৃদ্ধি অনেক বেশী। কাজেই সূর্যের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছোলে সূৰ্যকে গ্ৰাস করার মত বিপুল আকার সে পাবে।

     রেডার-স্ক্রিনের ওপর ঝুঁকে পড়ে হুমকি দিলেন ওডোনেল—স্পেশশিপ ফেরাও!

     পথ থেকে সরে গেল খাবারটা। সামনেই রয়েছে বিপুল উৎস—কিন্তু এখনও অনেক দূরে। দ্বিধায় পড়ে জোঁকটা। ঝটিতি সিদ্ধান্তের জন্যে ছটফটিয়ে ওঠে কোষগুলো। বেপরোয়াভাবে এনার্জি খরচ করলে কি চলে? আর, অত্যন্ত কাছেই দুলতে লাগল সেই লোভনীয় খাবারটা।

     কাছেরটা আগে, না, দূরেরটা আগে?

     আর দেরী করা যায় না। খাবার চাই, এখুনি চাই।

     সূর্যের দিক থেকে ফিরে ছুটন্ত খাবারের দিকে ধেয়ে গেল সে। সুর্যের পালা পরে আসবে।……

     রেডার-স্ক্রিনের ওপর দেখা গেল সমকোণে বেঁকে গিয়ে বড় বিন্দুটা ছুটে চলল ছোটো বিন্দুর পিছু পিছু।

     ওডোনেল শুধোলেন—আকাশের কোনদিকে রয়েছে ওরা?

     আসুন, দেখাচ্ছি, বললেন একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। দরজা খুলে আঙুল তুলে দেখালেন আকাশের একটা বিশেষ দিক।

     দোরগোড়া থেকে হুকুম দিলেন। ওডোনেল—অপারেটর, এইবার……।

     স্ক্রিনের ওপর দেখা গেল ছোটো বিন্দুটার গতিবেগ কমে যাচ্ছে। বড় বিন্দুটা কাছে এগিয়ে আসছে…আরও কাছে…তারপর মিশে গেল একসাথে।

     হুংকার দিয়ে উঠলেন ওডোনেল—পুশ দি বাটন্‌।

     একটা বোতাম টিপে দিলে অপারেটর। আকাশের পানে চোখ তুললেন ওডোনেল। প্রথমে কিছুই দেখা গেল না। তারপরেই রাত্রির নিঃসীম অন্ধকারকে চমকিত করে জ্বলে উঠল একটা নতুন নক্ষত্র। আলোয় আলো হয়ে গেল সারা আকাশ। তারপরেই ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল ঔজ্জ্বল্য।

     নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসে বললেন মাইকেল—ও কি?

     বিজয় গৌরবে ফিরে দাড়ালেন ওডোনেল—শক্তি দিয়ে শক্রকে নিপাত করেছি আমি। একটা হাইড্রোজেন বোমার চারদিকে তৈরী হয়েছিল ঐ স্পেশশিপটা—আমারই নির্দেশে। এইখান থেকেই দেখলেন তার বিস্ফোরণ!

     অকস্মাৎ কেন জানি নামহীন আতংকে শিউরে উঠলেন প্রফেসর মাইকেল।

     শক্তিব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কুচিত হয়ে আসছিল সে। ঠিক এমনি সময়ে ঘটলো সেই প্ৰলয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। প্রতিটি কোষের ধারণক্ষমতা সীমার অতীত সেই প্ৰচণ্ড শক্তিপুঞ্জ।

     টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে থেতলে ধ্বংস হয়ে গেল জোঁকটা। হাজার টুকরোয় রেণু রেণু হয়ে গেল তার দেহ এবং প্রতিটা টুকরোই আরও লক্ষ লক্ষ টুকরোয় গুঁড়িয়ে গেল।

     বিস্ফোরণের তরঙ্গ-ব্যুহে ছিটকে পড়লো টুকরেগুলো। এবং পরমুহূর্তেই তা ভেঙে গেল আরও কোটি কোটি কণিকায়।

     প্রতিটি কণিকাই এক-একটি বীজগুটি।

     নিস্প্রাণ ধূলিকণার মতই কোটি কোটি শুকনো কঠিন বীজগুটি তাল তাল হয়ে ভেসে গেল মহাকাশের দিকে দিকে। সীমাহীন মহাকাশে শুরু হলো তাদের অচেতন অভিযান।

     কোটি কোটি বীজগুটির খাদ্য অভিযান !……

Tags: অদ্রীশ বর্ধন, জোঁক, দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, পুনঃপ্রকাশিত গল্প, মূল প্রচ্ছদ

One thought on “জোঁক

  • July 29, 2017 at 6:40 pm
    Permalink

    Osomvob sundor golpo ar tar totodhik sundor anubad. Adrish babur kolomei somvob…

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!