মাংসজীব

  • লেখক: নাহার তৃণা
  • শিল্পী: চিত্রা মিত্র

     –ওরা মাংসের তৈরী।

     –মাংস? বলো কী?

     –হ্যাঁ মাংস। মাংস দিয়ে তৈরী করা হয়েছে ওদের।

     –আজব কাণ্ড! মাংস দিয়ে তৈরী হতে পারে এমন জিনিস?

     –তা আর বলছি কী! আমরা ওদের বেশ কয়েকটিকে ধরে নিয়ে এসেছি গ্রহের বিভিন্ন জায়গা থেকে। ল্যাবে নিয়ে তাদের আগাপাশতলা বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলাম তাদের সমস্তটাই মাংসের তৈরী।

     –অসম্ভব কথা। মাংস থেকে রেডিয়ো সিগন্যাল কীভাবে বের হবে? নক্ষত্রের দিকে বার্তা পাঠানোই বা কীভাবে সম্ভব?

     –অসম্ভবের কিছু নেই। তারা রেডিয়ো ওয়েব দিয়ে কথা বলে ঠিকই কিন্তু সিগন্যাল আসে মেশিন থেকে।

     –সেই মেশিন কে বানালো? আমরা তো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই।

     –তারাই মেশিন বানিয়েছে, মানে ওই মাংসজীবেরাই। আমি তোমাকে এতক্ষণ এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছি যে মাংসল জীবেরা বানিয়েছে মেশিনগুলো।

     –একটা ফালতু হাস্যকর কথা বললে। মাংস কিভাবে মেশিন বানাবে? তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলবে যে সংবেদনশীল মাংস বলে কোন বস্তু আছে জগতে?

     –তা আমি বলছি না। আমি বলছি, এই অদ্ভুত জীবগুলো হল জগতের একমাত্র সংবেদনশীল প্রজাতি যারা মাংস দিয়ে তৈরী।

     –তার মানে ওরা হল সেই ‘ওরফোলেই’ এর মতো। তুমি জানো ওরফোলেই হল কার্বন দিয়ে তৈরী এক জাতের বুদ্ধিমান প্রাণী যারা বিবর্তিত হয়ে মাংসের পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল।

     –নাহ এরা ঠিক সেরকম না। এরা মাংস হিসেবেই জন্ম নেয় এবং মাংস হিসেবে মৃত্যুবরণ করে। আমরা ওদের কয়েকটির আয়ুষ্কালের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে গবেষণা করেছি, যদিও খুব অল্প তাদের আয়ু। তুমি ভাবতেও পারবে না কত অল্প সময় বাঁচে ওরা!

     –বাদ দাও। ঠিকাছে ধরে নিলাম ওদের শরীর আংশিক মাংস দিয়ে তৈরী। সেই ওয়েডিলেইদের মতো। মাংসের মাথার ভেতরে যাদের ইলেকট্রন প্লাজমার মগজ ছিল।

     –নাহ। আমরা তাও ভেবেছিলাম পয়লা। ভেবেছিলাম যেহেতু ওদের মাথাও মাংসের তৈরী তারা নিশ্চয়ই ওয়েডিলেইদের মতো হবে। কিন্তু তা নয়। আমি তো বলেইছি তোমাকে, তাদের আগাগোড়া পরীক্ষা করেছি ল্যাবে। আগাগোড়াই মাংসের তৈরী ওরা।

     –তার মানে তাদের কোন মগজ বা বুদ্ধিসত্তাই নেই?

     –আহ, তা নয়, বলছি তো মগজ আছে। কিন্তু সেটা মাংসের তৈরী মগজ এই যা। আমি ওটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম তোমাকে।

     –তাহলে… ওদের চিন্তার কাজটা করে কে?

     –তুমি এখনো বুঝতে পারছো না ব্যাপারটা, পারছো? আমি যা বলছি তা তুমি বুঝতেই চেষ্টা করছো না। আরে আমি বলছি সেই মগজটাই ওদের চিন্তার কাজটা করে দেয়। ভেতরের সেই মাংসের পিণ্ডটা।

     –চিন্তাশীল মগজ! তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো যে চিন্তাশীল মাংস বলে কোন বস্তুর অস্তিত্ব আছে জগতে?

     –জী হ্যাঁ। চিন্তাশীল মাংস! সচেতন মাংস! প্রেমময় মাংস! স্বপ্নময় মাংস! আগাগোড়া মাংসের কারবার সব ওদের!!! তুমি কি এখন ব্যাপারটার পরিষ্কার চিত্র পেয়েছো নাকি আমাকে আবারো গোড়া থেকে বোঝাতে হবে?

     –হায় খোদা! তুমি তো সিরিয়াসলি বলছো তাহলে! তাদের সবকিছু মাংস দিয়েই তৈরী!

     –সাবাশ! অবশেষে বুঝতে পেরেছো। হ্যাঁ তাদের সবকিছুই মাংস দিয়ে তৈরী। এবং তারা গত একশো বছর ধরে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে।

     –ওহ খোদা! তাহলে এই মাংসজীবগুলার মনে কী আছে বলে মনে করো?

     –প্রথমত, এরা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। তারপর এরা মনে হয় বিশ্বজগত খুঁড়ে অন্য সংবেদনশীল জীবদের বের করতে চায়, তারপর তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময়, তথ্য আদানপ্রদান এসব করতে চায়। এটাই আর কী।

     –এখন ভাবো আমাদের এই অদ্ভুত মাংসজীবদের সঙ্গে কথা বলা উচিত কিনা!

     –সেটাই ভাবছি। তারা রেডিয়ো মারফত যে ধরণের বার্তা পাঠিয়েছে সেটা হল – ‘হ্যালো, কেউ আছো, ওদিকে কেউ আছো, কথা বলো’, ইত্যাদি।

     –তারা তাহলে বার্তা দিতে জানে। তারা কী শুধু বার্তা দেয় নাকি গল্পগুজব করা, মতামত দেয়া, ধারণা পোষণ করা ইত্যাদিও করে?

     –অবশ্যই। কিন্তু ওসব কাজ ওরা নিজেদের মধ্যে মাংসজীবদের সঙ্গেই করে।

     –আমি ভেবেছি তুমি বলেছো যে তারা রেডিয়ো ব্যবহার করে।

     –তা করে। কিন্তু রেডিয়োতে কী আছে বলে ভেবেছো? মাংসজীবের কথাবার্তা। তুমি জানো তুমি যদি মাংসজীবদের ধরে চড় চাপড় মারো, নাড়াচাড়া করো তাহলেও তাদের কাছ থেকে শব্দ বের হয়। কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের শরীর নাড়াচাড়া করেও পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে। এমনকি তারা গানও গাইতে পারে বাতাসে শব্দ নির্গমনের মাধ্যমে।

     –ওহ খোদা। গায়ক মাংসজীব! এটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে না? এখন এদের বিষয়ে তোমার পরামর্শ কী?

     –অফিশিয়ালি নাকি আনঅফিশিয়ালি বলবো?

     –দুটোই শুনি।

     –অফিশিয়ালি, ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দরকার আমাদের। ওদের স্বাগত জানিয়ে অন্যান্য সংবেদনশীল প্রাণীদের কাতারে ওদেরকে রাখা। তবে খুবই নৈর্ব্যক্তিকভাবে, কোনরকম ভীতি কিংবা প্রীতি থাকার দরকার নেই। আর… আনঅফিশিয়ালি বলতে গেলে, আমি বলবো ওদের সম্পর্কে সকল রেকর্ড মুছে ফেলে ব্যাপারটা ভুলে যাওয়া।

     –আমি জানতাম তুমি এরকম কিছু একটা বলবে।

     –শুনতে নিষ্ঠুর মনে হতে পারে, কিন্তু সবকিছুর একটা সীমা থাকা উচিত। আমরা কী আসলেই মাংসজীবদের সঙ্গে আদৌ কোন যোগাযোগ রাখতে চাই?

     –আমি তোমার সঙ্গে একশোভাগ একমত। কিন্তু কী করার আছে। আমরা কী ওদের বলবো- ‘শোনো হে মাংসজীবেরা, দিনকাল কেমন যাচ্ছে তোমাদের?’ এতে কোন ফল হবে? আচ্ছা, আমরা ওদের কটি গ্রহ নিয়ে কাজ করছি?

     –মাত্র একখানা। মাংসজীবরা তাদের মাংস কন্টেইনারে বোঝাই হয়ে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে ঘুরাঘুরি করে, কিন্তু তারা ওখানে বাস করতে পারে না। মাংস জীব হিসেবে তারা একমাত্র C মাত্রার মহাশূন্যে ভ্রমণ করতে সক্ষম। যেটা ওদেরকে আলোর গতির চেয়ে দ্রুত ছুটতে দেয় না। ফলে তাদের পক্ষে দূর কোন গ্যালাক্সির সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ

     –তাহলে কী আমরা ওদের বার্তার জবাব না দিয়ে ভান করবো যে এই মহাবিশ্বে আর কেউ নেই।

     –ঠিক তাই।

     –মর্মান্তিক! তুমি নিজেও তো বলেছো এক পাল মাংস জীবের সঙ্গে কে যোগাযোগ রাখতে চায়। কিন্তু যাদের আমরা পরীক্ষার জন্য ধরে এনেছি তাদের কী করবে? তুমি কি নিশ্চিত যে তারা আমাদের যা দেখেছে তা ভুলে যাবে?

     –ভুলতে না পারলে মাংসজীবদের সমাজে তাদের পাগল হিসেবে গন্য করা হবে। আমরা তাদের মগজ থেকে সবকিছু এমন নিখুঁতভাবে মুছে দিয়েছি যে আমরা ওদের কাছে একটি নিখাদ স্বপ্ন দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই নই।

     –মাংসজীবের স্বপ্ন। কী অদ্ভুত ব্যাপার যে আমরা মাংসের স্বপ্নে অবস্থান করবো!

     –এবং আমরা ওই অঞ্চলটাকেই খালি করে ফেলবো।

     –বেশ। আমি রাজী। অফিশিয়াল কিংবা আনঅফিশিয়া, ব্যাপারটা এখানেই শেষ। আর কেউ আছে ওদিকের গ্যালাক্সিতে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার উপযোগিতা আছে?

     –হ্যাঁ। অন্য একটি লাজুক মিষ্টি ধরণের হাইড্রোজেন ক্লাস্টারে তৈরী বুদ্ধিমান জীব আছে G445 এর নবম তারকাটিতে। দুই গ্যালাকটিক বর্ষ পূর্বে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। তারা আবারো যোগাযোগে আগ্রহ দেখিয়েছে।

     –তারা সবসময় ঘুরে ফিরে আসছে দেখি।

     –কেন আসবে না? ভেবে দেখো পুরো বিশ্বটা কেমন ভয়াবহরকমের নির্জন ও শীতল মনে হত যদি আমরা একেবারে নিঃসঙ্গ থাকতাম …..

সম্পাদকঃ গল্পটি টেরি বিসন (Terry Bisson) এর লেখা ‘দে আর মেড আউট অব মিট’ গল্পের বাংলা অনুবাদ। 

Tags: অনুবাদ গল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, চিত্রা মিত্র, নাহার তৃণা

One thought on “মাংসজীব

  • May 21, 2019 at 1:34 pm
    Permalink

    বেশ নতুন চিন্তা ভাবনা। শেষ লাইনটা দারুন

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!