মা

  • লেখক: রুশদী শামস
  • শিল্পী: জটায়ু

মিসেস ত্রিনিতা হাতের ভেজা প্লেটটা মুছতে মুছতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। রাস্তায় ইদানীং আর তেমন কেউ থাকে না। নিরাপত্তা রোবটগুলো শুধু নিয়ম করে চৌকি দেয়। গায়ে থাকে স্টাইরোফোমের তৈরি শিল্ড। দেখতে সার্কাসের সঙের মতো হাস্যকর লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই। ম্যাগনেটারের ভয়ংকর চৌম্বক তরঙ্গের হাত থেকে বাঁচতে হবে। সেজন্যই এই শিল্ড।

     রাস্তায় দুটো নিরাপত্তা রোবটকে হাঁটতে দেখতে পেলেন মিসেস ত্রিনিতা। রোবট দুটো একটা অন্ধকার গলির মুখে গিয়ে দাঁড়াল। গলির ভেতরটা অন্ধকার। অবলোহিত চোখগুলো দিয়ে গলির ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখছে ওরা। কাউকে কারণ ছাড়া ঘুরতে দেখলে সোজা থানায় তুলে নিয়ে যাবে। সরকারি নির্দেশ। নিয়ে গিয়ে জেরা করা হবে, জেল-জরিমানাও হতে পারে। নিরাপত্তা রোবটেরা কাউকে সেখানে দেখতে পেয়েছে বলে মনে হল না। পাথুরে রাস্তায় ধাতব শব্দ তুলে যেদিকে যাচ্ছিল, সেদিকে আবার হাঁটা শুরু করল ওরা।

     মিসেস ত্রিনিতা আবার তাঁর কাজে মন দিলেন। খুব সাবধানে এক ফোঁটা সাবান ফেললেন সিঙ্কের জলে। অকারণে হতে থাকা সব খরচ বন্ধ। গৃহস্থালির জিনিসপত্র শেষ হয়ে যাওয়া এখন একটা আতঙ্কের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরে যে অবস্থা, তাকে মোটামুটি কারফিউ-ই বলা চলে। একেবারে জরুরি কারণ ছাড়া কাউকে ঘরের বাইরে বের হতে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার নিষেধ করে দিয়েছে। গোটা পৃথিবীতেই এমন অস্বাভাবিক বন্দি অবস্থা। অস্বাভাবিকতাই যেন আজ স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটাকে আসলেও হালকাভাবে নেয়ার কোনও উপায় নেই। বহু আলোকবর্ষ দূরে থাকা বড়সড় একটা ম্যাগনেটার বিস্ফোরিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছে সেখান থেকে নাকি ক্ষতিকর চৌম্বক তরঙ্গ এসে ক্রমাগত আঘাত করছে পৃথিবীতে। অদৃশ্য, শক্তিশালী, ভয়ংকর, ক্ষতিকর, প্রাণঘাতী— চৌম্বক তরঙ্গগুলোকে কে কত আতঙ্কের বিশেষণ দেবে, তার জন্য সাংবাদিকেরা যেন উঠেপড়ে লেগেছে। ইদানীং অবশ্য ঘরের বিও-৩৯১ রোবটটা ঘণ্টায় ঘণ্টায় নতুন সব তথ্য দিচ্ছিল। তরঙ্গগুলো নাকি আসলে অন্য কোনও গ্রহের প্রাণীদের পাঠানোও হতে পারে। এসব নতুন কথা অবশ্য মিসেস ত্রিনিতার কাছে কেমন যেন আজগুবি বলে মনে হয়। বিও-৩৯১-কে অবশ্য দোষ দিয়ে কী লাভ? বেচারির কাজই তো এটা— বিভিন্ন পোর্টালের খবরের সারসংক্ষেপগুলো সব পড়ে শোনানো। বাড়তি হিসাবে থাকে ওটার নিজের যোগ করা একটু নাটকীয়তা।

     আজগুবি সব খবরে বিরক্ত হয়ে মিসেস ত্রিনিতা তাই কিছুদিনের জন্য রোবটটার অটোমেটন ব্যাটারিগুলোকে একেবারে খুলেই রেখে দিয়েছেন। এতে অন্তত ব্যাটারি চার্জ করার খরচটা বেঁচে যাবে। ট্রাইডা অবশ্য বিও-৩৯১-এর অনুপস্থিতিটা বেশ ভালোই টের পাবে। পাঁচ বছরের মেয়েটা আশপাশে থাকলেই রোবটটা ছোটদের উপযোগী মজার মজার সব খবর শোনাতে শুরু করত।

     তবে ম্যাগনেটার বা ভিনগ্রহের প্রাণী— তরঙ্গের উৎস যেটাই হোক না কেন, এখন বাইরে বের হওয়াটা আসলেও ভীষণ বিপজ্জনক। সরকারি খবরে এসেছে অনেককে নাকি রাস্তার পাশে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে! সরকারি নির্দেশ না-মেনে ঘরের বাইরে বেরিয়েছিল ওরা। অবশ্য সরকার বলে কথা! কোনটা যে সত্যি সত্যি বলছে আর কোনটা যে বানিয়ে, মিসেস ত্রিনিতা বুঝতে পারেন না।

     মিসেস ত্রিনিতা আবার তাঁর জগতে ফিরে এলেন। সাবান অত্যন্ত তুচ্ছ একটা জিনিস। এরকম একটা জিনিসের অভাবে এ-সময়টাতে বাইরে বের হওয়াটা হবে চরম বোকামি। আরবি-৪৫২ এখন থাকলে খুব ভালো হত, ভাবলেন তিনি। বেশ মেপে মেপে সাবান খরচ করত রোবটটা। চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় রোবটটা নিজে নিজে ভাঁড়ার ঘরের চার্জিং ডকটাতে হাইবারনেশন মোডে চলে গেছে। যেভাবেই হোক, খরচ বাঁচাতেই হচ্ছে সবাইকে। পাশের বাড়ির মিসেস ক্রিনা যেমন জলের খরচ বাঁচাতে টয়লেটের ফ্লাশের মধ্যে বিশাল এক থান ইট দিয়ে রেখেছেন। অতটা পাগলামি না করলেও যেখানেই সুযোগ পাচ্ছেন, খরচ কমিয়ে দিচ্ছেন মিসেস ত্রিনিতা। এমনকী দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা দ্বিতীয় চার্জিং ডকটাকেও এই মুহূর্তে সারাবেন না বলে ঠিক করেছেন।    

     চিৎকার করে মিসেস ত্রিনিতাকে ডাকল ট্রাইডা।

     বিরক্তি ফুটে উঠল মিসেস ত্রিনিতার চোখেমুখে। বিচ্ছু একটা মেয়ে হয়েছে। কিছুতেই কোনও কাজ নিজে নিজে করবে না। সবকিছুতেই মা-কে চাই তার। তার এত নেওটা হয়েছে মেয়েটা! শব্দ করে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললেন মিসেস ত্রিনিতা। আচ্ছা, তাকে ছাড়া আর কাকেই-বা চাইবে ট্রাইডা? মেয়েটার তো আর কেউ নেই! সেই কবে বাবাকে হারিয়েছে মেয়েটা। তখন থেকে বেচারা ট্রাইডার গোটা জগৎই তো আসলে তাকে ঘিরে।

     আবার ডেকে ওঠে ট্রাইডা। এবার সাড়া দিলেন মিসেস ত্রিনিতা। নাহলে ঘ্যানঘ্যানে কণ্ঠে মেয়েটা তাকে ডাকতেই থাকবে। হাতের উলটো পাশ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন তিনি। জল ঝরানোর র‍্যাকে প্লেটটাকে সাজিয়ে রাখলেন। আজকে কী রাঁধতে হবে সেটা ডিও-৯০১-কে ডেকে বুঝিয়ে দিলেন। আবার কী মনে করে রোবটটাকে পুরো সপ্তাহের জন্যই রান্না করে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এমনকী সপ্তাহের শেষের ছুটির দিনের খাবারটাও। এই দুর্যোগের আগে হলে অন্য কথা ছিল। ছুটির দিনটা তাঁর কাটত নিজের হাতে মজার মজার রান্না করে। ট্রাইডা গোটা দিনটা হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে রকেটে করে মঙ্গল ঘুরে আসত। ফিরে এসে তাঁর রেঁধে রাখা সব খাবার চেটেপুটে খেত। কিন্তু এখন সময় অন্যরকম। সব স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ট্রাইডার বন্ধু-বান্ধবরাও যে যার বাড়িতে বন্দি। ঘরে থেকে থেকে মেয়েটার বিরক্তি চরমে উঠেছে। মিসেস ত্রিনিতা তাই ঠিক করেছেন ছুটির দিনটার পুরো সময়টাই তিনি মেয়েটাকে দেবেন। অন্য দিনগুলোতে তো ইচ্ছা থাকলেও খুব একটা সময় দেয়া হচ্ছে না মেয়েটাকে। ঘরের কত কাজ থাকে। এই কারফিউ অবস্থায় দুজনেই ঘর-বন্দি  থাকার কারণে গৃহস্থালি কাজ যেন দ্বিগুণ বেড়েছে।

     এফপি-১০১-কে খুব ভালো করে সব বুঝিয়ে দিলেন মিসেস ত্রিনিতা। আপাতত সবার পুষ্টির দিকে খেয়াল না রাখলেও হবে। রোবটটার ভেতরের ঠাণ্ডায় রাখা খাবারগুলো দিয়ে যতটা সম্ভব বেশিদিন চালানো যায় আরকী। তাহলে আর জিএল-২২২-কে আর বাইরে বাজার করতে যাওয়া লাগে না। রান্নাবান্নার ব্যাপারে ডিও-৯০১-এর সঙ্গে সব কিছু সমন্বয় করে করতে এফপি-১০১-কে ভালো করে নির্দেশ দিলেন তিনি।

     বিরক্তি লাগছে মিসেস ত্রিনিতার। সেই কখন সকাল হয়েছে, এখন পর্যন্ত জিরানোর জন্য একটু বসতে পারলেন না। ঘর ভরতি এতগুলো সাহায্যকারী রোবট। একটার কোয়ান্ট্রনেও ঘিলু বলতে কিছু নেই! এদেরকে কাজ বোঝাতে বোঝাতেই সারাদিন শেষ। রোবটগুলোকে ঘরে এনে কাজ কমে যাবার বদলে যেন কাজ আরওই বেড়েছে সবার।

     অবশেষে মিনিট দশেক পরে কফি টেবিলটাতে এসে বসতে পারলেন মিসেস ত্রিনিতা। কিন্তু যেই-না বসেছেন, অমনি ট্রাইডা এসে হাজির। এতক্ষণ একা থেকে থেকে অস্থির হয়ে গেছে সে। কিছু একটা করতে চায়। মিসেস ত্রিনিতা জিজ্ঞেস করলেন বিটোভেনের সিম্ফনিগুলো চালু করবেন কি না। ক-দিন আগে ট্রাইডা শুনতে চেয়েছিল। ট্রাইডা চাইলে এখুনি শুনে সেগুলো সব মুখস্থ করে নিতে পারত। এরপর পিটি-৭৪৩-এর সঙ্গে বসে বসে সুরগুলো পিয়ানোতে তুলে ফেলার কাজ। কিন্তু পিটি-৭৪৩-এর কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চোখমুখ ওলটাল ট্রাইডা। এই রোবটের সুরজ্ঞানের সঙ্গে ট্রাইডার সুরজ্ঞানের আকাশপাতাল পার্থক্য। পান থেকে চুন খসলেই ট্রাইডার দিনটা শেষ, মিসেস ত্রিনিতার কাছে এসে নালিশ জানাতে থাকে রোবটটা। জোরে জোরে মাথা নেড়ে নিজের তীব্র অসম্মতির কথা জানিয়ে দেয় ট্রাইডা।

     কপাল কুঁচকে গেল মিসেস ত্রিনিতার। আচ্ছা, সবার বাচ্চাই কি এমন করে? আর কিছু না পেয়ে ট্রাইডাকে ছবি আঁকতে বললেন তিনি। ট্রাইডার মনে ধরল। কিন্তু কীসের যে ছবি আঁকবে? ভেবে না পেয়ে মিসেস ত্রিনিতাকে জিজ্ঞেস করল সে।

     কত কী-ই তো আঁকার আছে। ট্রাইডাকে একে একে সব বলতে থাকেন মিসেস ত্রিনিতা। ডাইনোসর, বানর, বাঘ, হাতি, ইউনিকর্ন আরও কত কী— প্রাণীজগৎ আর ছোট না! কিন্তু তাদের কেউই চিত্রশিল্পী ট্রাইডার মন ভরাতে পারল না। ট্রাইডাকে ডিএ-২৩৩ এদের সবার ছবিই দেখিয়েছে। কিন্তু একেকবার একেকরকম। কোনটা যে আসলে ডাইনোসর, বানর, বাঘ, হাতি কিংবা ইউনিকর্ন সেটা হয়তো ডিএ-২৩৩ নিজেই জানে না। রোবটটাকে অবশ্য দোষও দেয়া যাচ্ছে না। সে কত আগের কথা! ট্রাইডা তাই এদেরকে আঁকতে গেলেই একধরণের ধাঁধায় পড়ে যায়।

     ট্রাইডার চোখমুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে যায়। আবদার জানায় সে— মিসেস ত্রিনিতাকে আঁকতে চায়। মা-কে একটু পাশ ঘুরে তার দিকে ফিরে বসতে বলল ট্রাইডা। রাজি হয়ে যেতে এক সেকেন্ডও দেরি করলেন না মিসেস ত্রিনিতা। এতে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও ট্রাইডার হাত থেকে মুক্তি তার! নিজের ভারী শরীরটাকে ঘুরিয়ে ট্রাইডার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ।

     পাঁচ মিনিটেই ছবি আঁকা শেষ ট্রাইডার। দৌড়ে এসে মায়ের হাতে ছবিটাকে ধরিয়ে ধরিয়ে দিয়ে আবার নার্সারিতে খেলতে চলে গেল। ছবিটা হাতে নিয়েই মিসেস ত্রিনিতা হেসে ফেললেন। যে কারও পা দুটোকে বরাবরই সরু করে আঁকে ট্রাইডা। শরীরটাকে অবশ্য ঠিকঠাক এঁকেছে তার, মাথাটাকেও। 

     মিসেস ত্রিনিতার চিন্তায় ছেদ পড়ল। ঘোষক রোবটের গলার স্বরে চমকে উঠলেন তিনি। ঘরের দেয়ালের ভেতরে থাকা রোবটটার কথা ভুলতে বসেছিলেন তিনি। বছর দুশো আগে শেষবারের মতো মনে হয় কথা বলেছিল সে। সর্বোচ্চ মাত্রার জরুরি সরকারি একটা বার্তা পড়ে শোনাচ্ছে রোবটটা। পৃথিবীর দিকে নতুন ভয়ংকর এক বিপদ ধেয়ে আসছে। ক্যারিংটন শ্রেণির হাজার হাজার সৌর-ফুলকি আর কিছুক্ষণের ভেতরেই পৃথিবীতে আঘাত হানবে। মুহূর্তেই ফুলকিগুলো তাদের বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে রন্টেজন আর অতিবেগুনি রশ্মি ছড়িয়ে দেবে। পরিমাণটা হবে পৃথিবীর সব প্রাণ শেষ হয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট। ঘোষক রোবট এরপরে এই প্রলয় থেকে সবার বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়টি একঘেয়ে কণ্ঠে বর্ণনা করতে থাকে।

     তীব্র আতঙ্কে ট্রাইডার আঁকা ছবিটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে মিসেস ত্রিনিতা চেয়ার ঠেলে উঠে পড়েন। নার্সারি থেকে ট্রাইডাকে হ্যাঁচকা টানে কোলে নিয়ে ছুটলেন তিনি।

***

‘মা,’ ট্রাইডা ডাকল। তার কণ্ঠস্বরে এখন একটা আশ্চর্যজনক স্থিরতা। কোথায় উবে গেছে তার সারাদিনের ছোটাছুটি। মেয়েটার শরীর জুড়ে এখন যেন কেবলই ক্লান্তি। এখন তাকে দেখে কে বলবে মেয়েটা এমন ভয়ংকর চঞ্চল? প্রচণ্ড ঘুম পেয়ে গেছে তার।

     ‘বলো সোনা,’ মমতামাখা কণ্ঠে মিসেস ত্রিনিতা বললেন।

     ‘মা, তুমি এখন কী করবে, মা?’ আকুলতা নিয়ে জিজ্ঞেস করে ট্রাইডা। কণ্ঠ ঘুমে জড়িয়ে আসছে।

     মিসেস ত্রিনিতা স্মিত হেসে ট্রাইডার মাথায় কোমলভাবে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘ভয় নেই লক্ষ্মী সোনা আমার। আমি তোমার পাশেই থাকব। মা তোমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবে না।’

     একটা সময় ট্রাইডা ঘুমিয়ে পড়ে।

     মিসেস ত্রিনিতা তার বুকের বাঁ পাশটাতে একটা ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেছেন। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে তার। বুকের ভেতরটা আস্তে আস্তে কেমন যেন চেপে আসছে। বাতাসের অভাবে হাপরের মতো ওঠানামা করতে থাকে তার বুক। এর মাঝেও ট্রাইডার দিকে চট করে তাকিয়ে একবার দেখে নিতে ভুললেন না। নিশ্চিন্ত হলেন যে মেয়েটার এরকম কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।

     হাতে ধরে থাকা দুমড়ে যাওয়া ট্রাইডার আঁকা ছবিটাকে খুলে খুব ভালো করে তাকালেন মিসেস ত্রিনিতা। তার মাথার ওপরে ও দুটো কি শিং? মিসেস ত্রিনিতার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে দেখতে থাকেন তিনি। মেয়েটা তার মাথায় শিং কেন বসিয়েছে? একবার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন, আবার পরক্ষণেই সব ভুলে যাচ্ছেন।

     ট্রাইডার বয়স যখন ছয় মাস, তখন মিসেস ত্রিনিতাকে দেখে ট্রাইডা ভয় পেয়ে কাঁদত। সেই সময়টাতেই তিনি তার মাথা থেকে বিরক্তিকর এন্টেনা দুটো ফেলে দিয়েছিলেন। এই স্মৃতিটা অন্যান্য স্মৃতির মতোই মিসেস ত্রিনিতার কোয়ান্ট্রন থেকে এখন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় মিসেস ত্রিনিতা গভীর বিষাদের সঙ্গে খেয়াল করলেন তিনি ট্রাইডার ছেলেবেলার আদরে ভরা মুখটাকেও আর মনে করতে পারছেন না।

     ঘোষক রোবটটা চালু থাকা সমস্ত রোবটকে নিজ নিজ চার্জিং ডকে হাইবারনেশন মোডে চলে যেতে আরও কয়েকবার নির্দেশ দিল। এটাই এখন সবার বাঁচার একমাত্র উপায়—

     নাহলে একটা সময় সবার বুকের বাঁ পাশে বসানো ফ্লাক্স ক্যাপাসিটর নষ্ট হয়ে যাবে। ফটো-সেলের চোখের ফাইবার কোশগুলো আলো হারিয়ে সব অকেজো হয়ে যাবে। তৃতীয় ধাপে একে একে মুছে যাবে কোয়ান্ট্রনে রাখা সব স্মৃতি। আর সবশেষে পুড়ে যাবে মাথার কোয়ান্ট্রন সার্কিট। একটা সময় ঘোষক রোবটটা নিজেই চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে যায়।

     চার্জিং ডকে হাইবারনেশন মোডে বসে থাকা ট্রাইডার হাতটা মিসেস ত্রিনিতা আরও শক্ত করে ধরে থাকেন।

টীকা:

১। অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের এক ধরণের নিউট্রন তারা, যার ক্ষয়ের কারণে মহাবিশ্বে অকল্পনীয় তড়িৎচৌম্বক বিকিরণ ঘটে।

২। পারমাণবিক প্রজন্মের আয়নিক ব্যাটারি (কাল্পনিক)।

৩। শক্তিশালী শ্রেণির সৌরঝড় যা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রকে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। এই শ্রেণির সৌরঝড়ে বিভিন্ন যন্ত্র স্থবির বা সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যতে পারে।

৪। কোয়ান্টাম ক্ষমতাসম্পন্ন রোবট মস্তিষ্ক (কাল্পনিক)।

Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, জটায়ু, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, রুশদী শামস

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!