রোঁয়া

  • লেখক: শাম্ব চ্যাটার্জী
  • শিল্পী: সুমন দাস 

রোঁয়া

লেখক – শাম্ব চ্যাটার্জী

অলংকরণ – সুমন দাস 

 

॥১॥

ক্রিং…ক্রিং…। রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে থানার ফোনটা পরিত্রাহি চিৎকার আরম্ভ করলো। হেডকনস্টেবল রামহরি সেই শব্দে টুল থেকে টাল খেয়ে পড়ার মুখে কোনওমতে সামলে নিয়ে, তড়িঘড়ি ফোনের কাছে গিয়ে রিসিভার তুলতে ওপাশ থেকে ত্রস্তস্বরে এক পুরুষকণ্ঠ ভেসে এলো, “হ্যালো, এটা কি শিলিগুড়ি থানা? আপনাদের এক্ষুনি একবার হোটেল ব্লু-মুনে আসতে হবে। এখানে কিছুক্ষণ এক গেস্টের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।” রিসিভারটা রেখে রামহরি দ্রুতপায়ে থানার ওসি অদ্বয় ভরদ্বাজের চেম্বারে ঢুকতেই উনি বললেন, “আবার একই কেস মনে হচ্ছে।” থতমত খেয়ে রামহরি অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই মিঃ ভরদ্বাজ বলে উঠলেন, “শিরস্ত্রাণ ছাড়া  আবির্ভাবেই বুঝেছি। তা অকুস্থলটি কোথায়?” রামহরি উত্তর দিতে মিঃ ভরদ্বাজ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তি করলেন, “এই নিয়ে তিন নম্বর। নাহ, প্রফেসরকে এবার জানাবার সময় আসন্ন। আর দেরী করলে মুশকিল।” 

 

॥২॥

     হোটেল ব্লু-মুন এই শহরের অন্যতম খ্যাতনামা হোটেল। পাঁচতারা এই হোটেলে সবসময়ই দেশী-বিদেশী পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। এখানেই এক বিলাসবহুল স্যুইটে এই অঞ্চলের নামকরা বিজনেসম্যান রাশি গুরুং-এর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। হোটেলের বেয়ারা রাতের খাবার পৌঁছাতে গিয়ে রুম নাম্বার ২০২-এর দরজা নক করতে সাড়া না পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আবার নক করে। এই হোটেলে শাঁসালো কাস্টমারদের নিয়ে এই অভিজ্ঞতা নতুন নয়। তাছাড়া ফুর্তির সময়ে তাদের অযথা বিরক্ত করলে সেটার ফল কর্মচারীর পক্ষে খুব একটা সুখপ্রদ হয়না। গোল বাঁধল বেশ খানিকটা অপেক্ষার পর মিঃ গুরুং-এর কোনও সাড়াশব্দ না মেলায়। ডুপ্লিকেট কার্ড সোয়াইপ করে দরজা খুলতে নজরে এলো তিনি বিস্রস্ত অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছেন। খবর পেয়ে ম্যানেজার তড়িঘড়ি ছুটে এসে পরিস্থিতি বুঝে প্রথমে ডাক্তার ডাকেন। ডঃ বীরেন ভৌমিক এই অঞ্চলের খ্যাতনামা ডাক্তার। উনি এসে মিঃ গুরুংকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। আপাতদৃষ্টিতে উনি কোনও অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাননি। সম্ভবত মৃত্যুর কারণ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে সেখানে ওসি মিঃ ভরদ্বাজ উপস্থিত হলেন। সঙ্গে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞের দল। প্রারম্ভিক পরীক্ষানিরীক্ষার পর ফরেন্সিক অফিসার পাভেল বোস একান্তে মিঃ ভরদ্বাজকে বললেন, “একইভাবে মারা গেছেন ভদ্রলোক। নখের উপর ছোট্ট ক্ষতচিহ্নের দাগ। আর চোখসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে বিক্ষিপ্ত রোঁয়ায় ভরা!” কথার মাঝে অদ্বয় মিঃ বোসকে জিজ্ঞাসা করলো, “থার্মাল সেন্সরে কিছু পেলেন আপনি?” উত্তরে মিঃ বোস হতাশ মুখে মাথা নাড়ালেন। “স্ট্রেঞ্জ, আপনাদের দেওয়া তথ্য যদি ঠিক হয়, তাহলে সেটা এত তাড়াতাড়ি কোথায় অদৃশ্য হল!” বডিটাকে পোস্টমর্টেমে পাঠাতে বলে রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেলো অদ্বয়। পুলিশ অ্যাকাডেমির সার্থক ফসল অদ্বয় ভরদ্বাজ। যেমনি ডাকাবুকো, তেমনি ক্ষুরধার বুদ্ধি ধরে। তাছাড়া সে নিজেও ফরেনসিক সায়েন্সের ছাত্র। কিন্তু এবারে বেশ প্যাঁচে পড়েছে অদ্বয়। এই কেসটা সত্যিই অদ্ভুত! রিসেপশনের দিকে এগোলেও সে জানে, সেখানে তাকে একই কথা শুনতে হবে। একটা ছোট্ট বাক্স, এক ক্যুরিয়ার বয় এবং উপহারের বাক্স পৌঁছে দিয়ে তার অন্তর্ধান! এই ত্রিভুজের গভীরে লুকিয়ে সব রহস্য। আগের দুটো কেসেও ঠিক একইরকম প্রেক্ষাপট। হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজে এ’ব্যাপারটা স্পষ্ট। ফুটেজগুলো যদিও ভিডিও অ্যানালিস্টের কাছে পাঠানো হয়েছিলো, কিন্তু ভস্মে ঘি ঢালা এক প্রকার! কারণ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রেরকের দেওয়া ঠিকানা ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়েছে। আর প্রত্যেকবারেই দেশের বিভিন্ন শহর থেকে ক্যুরিয়ার করা হয়েছে।

   

॥৩॥

     রোববারের অলস সকাল। কোলকাতার বালিগঞ্জ প্লেসের এক দোতলা বাড়ীর সামনে লনে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক। কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায় এক অদ্ভুত প্রাখর্যের প্রকাশ তাঁর চোখমুখে। মুখে নানারকম অভিব্যক্তির খেলা চলছে। হঠাৎ একটা খবরে চোখ আটকে গেলো ভদ্রলোকের। নিজের মনে বললেন, “এই নিয়ে তিন নম্বর। হুম, ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো হয়ে উঠেছে। খটকাটা শুধু এক জায়গায়…।” এমনসময় পিছনে পায়ের আওয়াজের শব্দে বলে উঠলেন, “এসো অদ্বয়। তোমার অপেক্ষাই করছিলাম।” বক্তা হলেন প্রফেসর ধীমান বাগচী। কোলকাতার স্বনামধন্য ইন্সিটিউট অফ ফরেন্সিক সায়েন্সের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট এবং ডিরেক্টর। অদ্বয় ওঁর সামনের চেয়ারে বসে বলল, “স্যার, আপনার এই অনুমান ক্ষমতাটা জাস্ট ফাটাফাটি! কি করে যে ধরে ফ্যালেন!” প্রফেসর মৃদু হেসে বললেন, “পুলিসের জুতোর সোলের আওয়াজ চেনা বোধহয় সব থেকে সহজ। আর আজকের কাগজ দেখেই বুঝেছিলাম যে তোমার আগমন আসন্ন। দুয়ে দুয়ে চার বলতে পারো।”

     “এবারের ঘটনাটা নিয়ে সত্যিই খুব বিপাকে পড়েছি স্যার। আসলে পরপর তিন বিজনেস টাইকুনের অস্বাভাবিক মৃত্যু, আর প্রতিক্ষেত্রেই একই পদ্ধতি। পোস্টমর্টেমে প্রত্যেকের দেহেই একই ধরণের টক্সিন পাওয়া গিয়েছে। ব্যবসায়ীমহল তো রীতিমতো ভীত। সকলেই আশঙ্কায় প্রহর গুনছে এরপর কার পালা?”

     “সেটাই স্বাভাবিক। তোমাদের প্রাথমিক তদন্ত কি বলেছে?” – মিটিমিটি হেসে বললেন প্রফেসর।

     “সামগ্রিকভাবে মনে হচ্ছে নিছক মার্ডার কেস। পেশাগত শত্রুর কাজ হওয়াটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অথচ প্রত্যেকেই যথেষ্ট প্রভাবশালী, রাজনৈতিক মহলেও বেশ হাত আছে। ভিকটিমরা হোটেল ব্যাবসা এবং এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের ব্যাবসায় যুক্ত। এদের নিজস্ব সিকিউরিটি সিস্টেমও রয়েছে, যা পার করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার! শেষ মার্ডার হওয়ার আগে পর্যন্ত মৃত ছাড়া বাকিরা এব্যাপারে সন্দেহভাজন তালিকায় ছিল, কিন্তু তারপর আমাদের আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হচ্ছে। আসলে এমুহূর্তে উদ্দেশ্যটাই ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না!”

     পোস্টমর্টেম রিপোর্টে যা দেখলাম, মৃত্যুর কারণ নিউরোটক্সিন। ভিকটিমদের প্রত্যেকেরই পেশীতে খিঁচুনি ধরেছিল, টক্সিনের প্রভাবে তাঁরা শেষমুহূর্তে বমিও করে ফ্যালে। এছাড়া ফুসফুসে জল জমার প্রমাণও মিলেছে। গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসাবে মারাত্মক অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ারও শিকার তাঁরা সকলেই। নখের ক্ষতচিহ্নের বহর দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ শক্তপোক্ত বিষদাঁতের কীর্তিকলাপ! অথচ এটি সাপের কম্ম নয়, কেননা তেনাদের বিষদাঁতের ক্ষতচিহ্নের নিদর্শনের সাথে এর যথেষ্ট অমিল রয়েছে। আমি তোমার পাঠানো রিপোর্ট এক দক্ষ ওফিওলজিস্টকে দিয়ে যাচাই করিয়ে দেখেছি যে আমার ধারণাই সঠিক। তোমার অর্ককে মনে পড়ে অদ্বয়?”

     “কেন মনে থাকবেনা স্যার! ওর মতো মাল্টি-ডাইমেনসনাল ছেলে খুব কম পাওয়া যায়। খুব সম্ভবত ও তো এখন অস্ট্রেলিয়ায়। তাই না স্যার?”

     “হুম, ঠিক ধরেছ। অর্ক এখন মেলবোর্নে। অ্যারাকনোলজি নিয়ে কমনওয়েলথ সিরাম ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করছে। ওকে কেস ডিটেলসগুলো পাঠিয়েছিলাম। ও আমার সাথে সহমত। এধরণের ক্ষত একমাত্র বিশেষ প্রজাতির মাকড়সা দ্বারাই সম্ভব। কিন্তু…”

     “বলেন কি স্যার! আপনার খটকাটা কোন ব্যাপারে যদি বিশদে একটু বলেন?”

     “অস্ট্রেলিয়ায় এক বিশেষ প্রজাতির নিশাচর শ্রেণীর মাকড়সার এব্যাপারে বিশেষ সুখ্যাতি আছে। নাম ফানেল ওয়েব স্পাইডার। অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূল বরাবর উত্তরে নিউক্যাসল আর দক্ষিণে ইল্লাওয়ারা বেষ্টিত অঞ্চলে এর দেখা মেলে। কালো রঙের পুরুষ প্রজাতি বিগবয় নামে বিখ্যাত। পিছনের দিকে বাঁকানো বিষদাঁত মানুষের আঙুলের নখ এবং জুতোর চামড়া ভেদ করতেও সক্ষম! এদের বিষে উপস্থিত ডেল্টা অ্যাট্র্যাকোটক্সিন প্রোটিন আমাদের নার্ভ সিস্টেমের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে যা মূলতঃ সোডিয়াম আয়ন চ্যানেলকে নিষ্ক্রিয় করে অটোনমিক ও মোটর নিউরনকে প্রভাবিত করে। ফলস্বরূপ দেখা দেয় অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন, বর্ধিত রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, মুখের চারপাশ অসাড় হয়ে যাওয়া। মিনিট পনেরর মধ্যেই সব শেষ। কিন্তু খটকাটা অন্য জায়গায়! তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যদি ধরেওনি ওদেশ থেকে চোরাপথে আনিয়ে ক্যুরিয়ারের মাধ্যমে ভিকটিমের কাছে ভুয়ো ঠিকানা থেকে পাঠিয়ে মার্ডারগুলো করা হয়েছে, তবুও কিছু হিসেব এক্কেবারে মিলছে না। বিশেষত ওই রোঁয়ার ব্যাপারটা! কেননা ফানেল ওয়েব স্পাইডার শিকারের উপর রোঁয়া ছড়িয়ে দেয় না। এমনকি তাদের শরীরে ট্যারান্টুলাদের মতো ওই বস্তুটির অস্তিত্বই নেই! তাছাড়া শেষের ঘটনায় ভিকটিমের রুম খুব অল্পসময়ের মধ্যেই সিল করে দেওয়া হয়, অথচ ইনভেস্টিগেশন টীম পৌঁছে থার্মাল সেন্সরেও কোনও প্রাণীর অস্তিত্ব টের পায়নি! বন্ধঘরের কোনও ফাঁকফোকরে আশ্রয় নিলেও সেন্সরে তা ধরা পড়া উচিত ছিল।”

     ব্র্যাভো! এই কারণেই আপনার শরণাপন্ন হয়েছি স্যার। শেষের খটকাটা অবশ্য আমারও আছে! তবে স্যার, কিছুতেই মার্ডারের মোটিভটা স্পষ্ট হচ্ছেনা।”

     ধন্দ আমারও যে কিছু নেই তা নয়। যাইহোক, সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েছে নাকি কেসেই হাবুডুবু খাচ্ছ। একটা বহুলপ্রচলিত কথা মনে রেখো, ‘পেটে খেলে, পিঠে সয়’। বুদ্ধির গোড়ায় খাদ্যদ্রব্য না পড়লে বুদ্ধি খুলবে কি করে?”

     স্যার আপনি সেই একইরকম খাদ্যরসিক রয়ে গেলেন। অগত্যা…।

     এসবের মাঝেই প্রফেসরের মাথায় প্রশ্নেরা একইরকম আলোড়ন তুলে চলছিলো। খবরের অন্য একটা হেডলাইনও তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল – “প্রখ্যাত আমেরিকান সাংবাদিক এলেনা স্টোন নিখোঁজ।” তাঁর যদি ভুল না হয় এই ভদ্রমহিলা বেশ কিছুদিন ধরে দেশের পূর্ব সীমান্তে চোরাচালান ও অনুপ্রবেশ নিয়ে ডকুমেন্টারি রিপোর্ট তৈরি করছিলেন।

 

॥৪॥

     চিনের দক্ষিণ প্রান্তের গুয়াংডং প্রদেশের গুয়াংঝাউ শহর। পার্ল নদীর অববাহিকায় অবস্থিত দেশের তিনটি বড় শহরের অন্যতম। ফোর্বসের তালিকা অনুযায়ী চিনের সেরা বাণিজ্যিক শহর। এই আলফা-গ্লোবাল শহরে সাম্প্রতিককালে বিদেশী অভিবাসীদের সংখ্যাবৃদ্ধি নজরে পড়ার মতো। শহরের অন্যতম ব্যস্ত এয়ারপোর্টে কিছুক্ষণ হল নেপাল থেকে একটি অন্তর্দেশীয় ফ্লাইট অবতরণ করেছে। বাইয়ুন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে প্রত্যেকদিনই অসংখ্য বিমান যাতায়াত করে। এই ফ্লাইট থেকে নেমে এক চিনা ভদ্রলোক নির্দিষ্ট কারাউসেল থেকে ছোট্ট সুটকেসটি সংগ্রহ করে ধীর পায়ে গুয়াং ঝাউ মেট্রোর লাইন ৩-এর আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের দিকে এগিয়ে চললেন।  লাইন ৩ মেট্রো এখানকার এয়ারপোর্ট সাউথ আর তিয়ানহে কোচ টার্মিনালকে ইংরাজি ‘Y’ অক্ষরের মতো প্যান ইয়ু স্কোয়্যারের সাথে জুড়েছে। মেট্রোয় উঠে ধীরেসুস্থে একটা সিটে বসে পড়লেন তিনি। বেশ কিছু সময় পরে স্বয়ংক্রিয় স্পীকারে ‘ইয়ান তাং’ নাম ঘোষণা হতে মেট্রো থেকে নেমে গেলেন ভদ্রলোক। এটা লাইন ৬-এর সংযোগ স্টেশন। সেখান থেকে ‘কালচারাল পার্ক’ মেট্রো হয়ে বাইয়ুন লেক পৌছতে হবে তাঁকে। গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছে বাইরের কার পার্কিং-এর জায়গায় এসে দাঁড়াতে একটা কালো মার্সিডিজ গাড়ি সামনে এসে দাঁড়াল। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে বৌদ্ধমতে অভিবাদন করতে প্রতিঅভিবাদন করলেন ভদ্রলোক। নিচু স্বরে ক্যান্টনিজ ভাষায় ড্রাইভারকে কিছু বলতে সে মাথা নাড়ল। এরপর তিনি গাড়িতে উঠে সিটে গা এলিয়ে দিলেন। দীর্ঘ পথযাত্রার ক্লান্তি তাঁর চোখে মুখে স্পষ্ট। গ্রীষ্মকালের এই সময়টা আর্দ্র সাবট্রপিক্যাল জলবায়ুর প্রভাবে উচ্চতাপমাত্রা, উচ্চআর্দ্রতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। পড়ন্ত বিকেলের মনোরম বাতাসে সেই অস্বস্তি অনেকটাই কম। ধীরে ধীরে গাড়িটা ছিমছাম রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছিল। সন্ধ্যের কমে আসা আলোয় দুধারের ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দৃশ্য জায়গাটার পর্যটকমহলে জনপ্রিয়তার কারণ দর্শাচ্ছিল। অবশেষে লেক ভিউ হোটেলে প্রবেশের পর ড্রাইভার আরোহীকে জানাল যে তারা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে হোটেল লাউঞ্জে ঢুকে রিসেপশনের সামনে দাঁড়াতে কাউন্টারের কর্মচারী রুমের স্মার্ট-কি ভদ্রলোকের হাতে তুলে দিলো। ঘরে পৌঁছে নিজের স্মার্টফোনে চেনা নম্বর ডায়াল করতে উত্তর এলো, “শুভসন্ধ্যা প্রফেসর ঝাং ইয়ং, প্রথমেই আপনার সাফল্যে অভিনন্দন জানাই। সরকার আপনার কাজে গর্বিত। তাঁরা আপনার গবেষণার অনুদানের পরিমাণ বাড়ানোর ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করেছেন।”

     ধন্যবাদ মিঃ লি ওয়েই। এই খবর আমার জন্যও খুবই আনন্দের। দেশের কাজে আসতে পেরে আমি গর্বিত।

     আপনি আমাদের গর্ব প্রফেসর। দেশের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণাকে উন্নতির শিখরে তুলে ধরেছেন আপনি। শীঘ্রই মহামান্য প্রেসিডেন্ট আপনাকে জাতীয় সম্মাননা স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভাবছে। আজকের দিনটা আপনি পূর্ণ বিশ্রাম নিন, কাল সাক্ষাতে কথা হবে।

     ঠিক আছে। আমার শুভেচ্ছা নেবেন।

     কথাবার্তা শেষ হতে একটি তৃপ্তিসূচক শব্দ বেরোল প্রফেসর ইয়ং-এর মুখ থেকে। মিঃ ওয়েই হলেন মহামান্য প্রেসিডেন্টের মুখ্যসচিব। সোফায় বসে স্মৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে একের পর এক ছবির মতো ভেসে উঠলো অতীতের ঘটনাগুলো। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই গবেষকমহলে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত কাজে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। কাইমেরিক প্রজাতি বিষয়ক গবেষণার জন্য পিএইচ.ডি-তে তাঁকে বেস্ট থিসিস অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হয়। চিনের প্রেসিডেন্টের হাভার্ড সফরকালে একটা ছোট্ট মিটিং তাঁর জীবনের মোড়টাই অন্য খাতে বইয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট তাঁকে দেশে ফিরে এসে বিশেষ দায়িত্বভার নিতে বলেন। সেই দায়িত্ব নেওয়ার পর আস্তে আস্তে সরকারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয় তাঁর কাছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত তখন দ্রুত বিশ্ববাণিজ্যিকমহলে জনপ্রিয়তা অর্জন করে চলেছে। এর সঙ্গে কূটনৈতিক বা সামরিক ক্ষেত্রেও তাঁরা ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, যা তাদের প্রেসিডেন্ট তথা কূটনৈতিকমহলের কাছে অস্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বের অন্যান্য শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির সাথে ভারতের সুসম্পর্ক এবং পরমাণুশক্তিধর রাষ্ট্রমণ্ডলীতে সাম্প্রতিক স্বীকৃতি সেই কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেয়। ভবিষ্যতে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসাবে নিজের প্রতিপত্তি কায়েম রাখতে চটজলদি পথ হিসাবে ছকে ফ্যালে মারাত্মক এক রূপরেখা! যে কোনও দেশের মূল শক্তিই হল তাদের কর্মোদ্যমী যুবসমাজ। সেই যুবসমাজকে বেপথু করতে নেওয়া হল ড্রাগসের প্রলোভনের পথ! ড্রাগসের সাম্রাজ্য হিসাবে পরিচিত গুয়াংঝাউ-এর বণিকমহলকে বেআইনি উৎসাহ দিয়ে লাগানো হল এই কাজে। নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ আর মায়ানমারকে কেন্দ্র করে বোনা হল প্রাচীন সিল্ক রুটের মতো আন্তর্জাতিক ড্রাগ রুট। সুপরিকল্পিত এই ছকে সমস্যা বাঁধল অন্যভাবে! সেখানেই সরকার চটজলদি তাঁর শরণাপন্ন হয়। আজ পর্যটকদের প্রিয় বাইয়ুন লেক হয়ে উঠলো তার কর্মকেন্দ্র। এখানেই পাহাড়ের কোলে লোকচক্ষুর অন্তরালে আস্তে আস্তে জন্ম নিলো চীন সরকারের অত্যাধুনিক জৈব-অস্ত্র গবেষণাগার। যার প্রধান হিসাবে নিযুক্ত হলেন তিনি। শুরু হল পড়শি দেশের স্যাটেলাইট সিস্টেমকে ফাঁকি দেওয়া ভূগর্ভস্থ গবেষণাগারের মানবতাবিরোধী কর্মসূচী।

 

॥৫॥

     নেপালের কাঠমান্ডু শহর। এখানে সারাবছরই পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। বাগমতি নদীর তীরে শহরের পশুপতিনাথ মন্দির এলাকা পর্যটকদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। অদূরেই আলোহা ইন হোটেল। বিলাসবহুল এই হোটেলের এক স্যুইটে নিভৃত আলাপচারিতায় ব্যস্ত দুই মাঝবয়েসী ভদ্রলোক। একজনের চেহারা দেখে আন্দাজ করা যায় মানুষটা খুবই সৌখীন। পোশাকপরিচ্ছদে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। অন্যজন রীতিমতো স্যুটেড-বুটেড হলেও চেহারায় একটা রুক্ষতার ছাপ রয়েছে। দেখলে বোঝা যায় যে কোনও অবস্থার মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। অন্তত শরীরের পেশীবাহুল্য তাই বলে। প্রথমজন হলেন এই অঞ্চলের নামকরা বিজনেস টাইকুন সুরজ শ্রেষ্ঠ। ইম্পোর্ট-এক্সপোর্টের বিশাল ব্যবসার মালিক। দ্বিতীয়জন ওঁর সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী স্ট্যালিন থাপা। ব্যবসা সামলানো থেকে বেয়াড়া বিরোধীদের সামলানো যার বাঁ হাতের কাজ। আলোচনার সুর শুনে বোঝা যাচ্ছে একটা অত্যন্ত জটিল ব্যাপারে আলাপচারিতা চলছে দুজনের মধ্যে।

     “এই কনসাইনমেন্টটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্ট্যালিন। সামান্য ভুলচুক হলে পুরো প্ল্যানটা ভেস্তে যাবে। তাহলে দেশের সরকার তো মাথার উপর থেকে হাত তুলে নেবেই, উপরন্তু বিদেশেও ঠাই মিলবে না।”

     “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার, এ ব্যাপারে কোনও কাকপক্ষীও কিছু টের পাবেনা। আর তাছাড়া বাগড়া দেওয়ার জন্য লোক থাকলে তো! আমাদের ক্যারিয়াররা এতক্ষণে রওনা হয়ে গেছে। ইদানীং কাস্টমসের ঝামেলা খুব বেড়েছে, তাই এবারে আকাশপথের বদলে সড়কপথে ওদের পাঠানো হয়েছে। ওই পথে এক্স-রে স্ক্রিনিং-এর চান্সও কম। মালদা বর্ডারে আমাদের লোক অলরেডি ফিট। ওরা ক্যারিয়ারদের যথাস্থানে পৌঁছে দেবে। প্রায় কয়েক কেজি ‘র’ অ্যামফেটামাইন, মেথামফেটামাইন এবং কোকেন   ক্যাপসুলের মাধ্যমে ওদের খাদ্যনালীতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় কনসাইনমেন্টটা মণিপুরে ভারত-মায়ানমার সীমান্ত হয়ে ঢুকবে। সকলের অগোচরে থাকা সেপথ বেশ দুর্গম।”

     “তোমার শেষমুহুর্তের এই আইডিয়াটা বেশ কাজে এসেছে বুঝলে। কাস্টমসের নজর ঘোরানোর জন্য একইসময়ে কলকাতা বিমানবন্দরে কিছু মালসহ আমাদের নাইজেরিয়ান ক্যারিয়ারকে ইচ্ছা করে ধরা পড়ানো, আর সেই একই সময়ে দেশের অন্য দুপ্রান্ত দিয়ে বিপুল মাল ঢোকানো। এই কাজটা সাকসেসফুলি করতে গেলে এটুকু ক্ষতি তো মানতে হতই।”

     “ধন্যবাদ স্যার, আমার উপর আস্থা রাখার জন্য।”

     “ওদিককার কোনও খবর পেলে? ‘র’ ড্রাগ থেকে ওরাল কম্বি-ক্যাপসুল বানানোর আস্তানার ব্যবস্থা কদ্দুর?”

     “এ ব্যাপারে আমরা অনেকটাই এগিয়ে গেছি। মালদা শহরের বাইরে একটু ভিতরের দিকে পশুবর্জ্য থেকে সার তৈরির একটা কারখানা রয়েছে। আমাদের এজেন্ট অলরেডি সেটার মালিকের সাথে কথা বলে হাতবদলের ব্যবস্থা সেরে ফেলেছে। ওই চৌহদ্দির ভেতরেই সেটআপ বিলকুল রেডি। কারখানার গন্ধে এমনিতেই কেউ বড় একটা ওদিকে পা মাড়ায় না। স্থানীয় পঞ্চায়েত মেম্বারদের সাপোর্ট আমরা পেয়ে যাব। টাকা ছড়ানোর ব্যবস্থাও হয়ে গেছে।”

     “আর কারিগরের আসার কথা কবে? ময়রা ছাড়া মিষ্টি বানানো তো অসম্ভব!”

     “ওঁরা শিগগিরি চলে আসছেন। সরকারের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য চামড়ার ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে। সেজন্য কিছু নকল ব্যবসায়িক কাগজপত্রও তৈরি করে ফেলেছি। কিছু কাস্টমস অফিসারও অলরেডি ম্যানেজড।  ফুলপ্রুফ প্ল্যান স্যার, ফেল হবার চান্সই নেই।”

“তুমি আমায় নিশ্চিন্ত করলে স্ট্যালিন। এবার আমি একটু বিশ্রাম নেবো।”

“থ্যাঙ্ক য়ু স্যার। আমি তবে আসি।”

মিঃ থাপা বিদায় নিতে সুরজ শ্রেষ্ঠ স্যুইটের ওয়াশরুমে ঢুকে জাকুজির উষ্ণতায় নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন। ধীরে ধীরে তার ক্লান্ত শরীর সেই উষ্ণতার সংস্পর্শে তাজা হয়ে উঠলো। নিশ্চিন্ত অবসর যাকে বলে।

 

॥৬॥

     ইন্সিটিউট অফ ফরেন্সিক সায়েন্সের ফরেনসিক এন্টোমোলজি বিভাগ। কম্পিউটার স্ক্রীনের সামনে নিমগ্ন হয়ে বসে রয়েছেন বিভাগীয় প্রধান সমিধ সেন। মেডিকো-লিগ্যাল ফরেনসিক এন্টোমোলজিতে দেশের হাতে গোনা কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মধ্যে অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব। যে কোনও অপরাধ তদন্তে পচনশীল মৃতদেহে আর্থ্রোপোড, অর্থাৎ সন্ধিপদ প্রজাতির বেড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্যায় বিশ্লেষণ করে মৃত্যুর সময়কাল নির্ধারণ করতে ওঁর জুড়ি মেলা ভার। এ ছাড়া অ্যারাকনোলজি আর এন্টোমোটক্সিকোলজিতেও মিঃ সেনের ব্যুৎপত্তি যথেষ্ট ঈর্ষণীয়। প্রফেসর বাগচীরও তার উপর ভীষণ আস্থা। বাইরে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নেমেছে সেদিকে তার কোনও হুঁশ নেই! একমনে নিজের বিষয়ে ডুবে রয়েছেন তিনি। অকৃতদার তাই পিছুটানও কম। চোখের সামনে একরাশ কোডিং সিকোয়েন্স অনর্গল তাদের রূপরেখার ম্যাচিং সংক্রান্ত তথ্য জানিয়ে চলেছে। এই মুহূর্তে একেবারে দম ফেলার ফুরসত নেই। একের পর এক তথ্যের জাল উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে সামনের স্ক্রীনে। যা দেখছেন, সেটা যদি সত্যি হয় তবে প্রকৃতির নিয়মের বড় রকম ওলটপালট ঘটতে চলেছে! প্রফেসর বাগচী তাকে যে রোঁয়ার নমুনা পাঠিয়েছিলেন, সেগুলো থেকে ডিএনএ বার করে বিশ্লেষণ করছিলেন তিনি। থার্মোসাইক্লার যন্ত্রে নমুনা থেকে নিষ্কাশিত ডিএনএ-র অসংখ্য প্রতিলিপি বানিয়ে, তা থেকে ডিএনএ লাইব্রেরী তৈরির পর সেই ডিএনএ ক্রম থেকে প্রাপ্ত তথ্য রীতিমতো চমকপ্রদ! কোনও নির্দিষ্ট প্রজাতির সাথে একক মিল মেলেনি! একাধারে তার মধ্যে পাওয়া গেছে শীতল রক্তের রেপ্টাইল প্রজাতির ডিএনএ, ক্যামোফ্লেজিং ক্যামেলিওন প্রজাতির ডিএনএ এবং সেই সঙ্গে মিশেছে দুই বিশেষ প্রজাতির মাকড়সার ডিএনএ! জন্ম নিয়েছে নতুন এক প্রজাতি, যার চালচলন সাধারণভাবে মাকড়সার মত। আশ্চর্যের ব্যাপারখানা হল একই শরীরে ফানেল ওয়েব স্পাইডারের ডেল্টা অ্যাট্র্যাকোটক্সিন প্রোটিন তৈরির ক্ষমতা আর গোলিয়াথ বার্ডইটারের মত ট্যারান্টুলা প্রজাতির অ্যালার্জেনিক বিষাক্ত রোঁয়া পাওয়া গেছে! জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে এই দুই-এর মারণক্ষমতার মাত্রা এতটাই বাড়ানো হয়েছে, যে কোনও মানুষের পক্ষেই হামলার পর দু-তিন মিনিটের বেশী টেঁকা মুশকিল। কিন্তু এমন মারাত্মক প্রজাতির মাকড়সা বানালই বা কে, আর উদ্দেশ্যটাই বা কি? এদেশে আধুনিক বিজ্ঞানের পদধূলি পড়লেও, খোদার উপরে খোদকারির এহেন অনুমতি মেলার কোনও সম্ভাবনাই নেই! তাছাড়া বিদেশেও কাইমেরিক অ্যারাকনোলজি নিয়ে কোনও সাম্প্রতিক গবেষণার খবর তার গোচরে নেই! ঘটনাটা প্রফেসর বাগচীকে জানাতে হচ্ছে। স্মার্টফোনে নাম্বারটা ডায়াল করতে ওপ্রান্তে রিং-এর আওয়াজ শোনা গেলো।

     “হ্যালো প্রফেসর, সমিধ বলছি। আপনি এখন ব্যস্ত নয়তো?”

     “তোমার ফোনেরই অপেক্ষা করছিলাম। আমার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছিল আজ তোমার কাছ থেকে একটা জম্পেশ খবর পাওয়া যাবে। আমি জানি, আমি নিরাশ হবোনা।”

     “আপনার পাঠানো নমুনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রীতিমতো তাজ্জব বনে গেছি প্রফেসর! যা ঘটেছে তা একেবারেই প্রকৃতির নিয়মের বাইরে! বাস্তবে এই প্রজাতির অস্তিত্ব অসম্ভব, যদিনা…।”

     “বুঝেছি, তোমার বিশ্লেষণ অনুযায়ী আমাদের পাওয়া নমুনা প্রকৃতির বাইরে অর্থাৎ মানুষের গবেষণাগারে জন্ম নিয়েছে। আমিও এটাই আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের দেশে তো ব্যাপারটা বেআইনি! বিদেশেও…।”

     ঠিক বলেছেন প্রফেসর। খটকাটা আমার সেখানেই!

     তোমার জানাশোনা কেউ কি সম্প্রতি এ ধরণের কোনও গবেষণায় রত? আসলে তুমি তো হাভার্ডে থাকাকালীন বহুদিন অ্যারাকনোলজি নিয়ে গবেষণায় যুক্ত ছিলে, সেসময় যদি এব্যাপারে কিছু শুনে থাকো।”

     কথাটা শুনে সমিধের মাথার এতক্ষন ধরে পাকানো জটটা আচমকাই বিদ্যুৎচমকের মতো ছেড়ে গেল। একজন আছেন বটে, যার দ্বারা এই অসাধ্যসাধন সম্ভব। কিন্তু হার্ভার্ড ছাড়ার পর তার কর্মকাণ্ডের এযাবৎ আর কোনও হদিশ মেলেনি। শেষ জানা খবর অনুযায়ী তিনি দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁর সরকার তাঁকে যথোপযুক্ত সম্মানজনক পদেই বসিয়েছিলেন এমনটাই সবাই জানে। এর বেশী কিছুই কারও জানা নেই। আসলে ভদ্রলোকের দেশটাও তো চিরকালই বিশ্বের কাছে রহস্যের ঘেরাটোপে ঘেরা! বর্তমান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তিধর দেশ চিন।

     “সমিধ তোমার নীরবতা দেখে মনে হচ্ছে, আমার প্রশ্নের একটা যুতসই জবাব এই মুহূর্তে তোমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তোমার আশঙ্কার কথাটা নিঃসংকোচে আমাকে খুলে বলতে পারো। এব্যাপারে তোমার থেকে ভাল সাহায্য আর কেউ এখন করতে পারবে বলে আমার মনে হয়না।”

     “আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমার হার্ভার্ডে থাকাকালীন প্রাক্তন এক গবেষকের অ্যারাকনোলজির উপর জমা করা গবেষণাপত্র আর্কাইভ থেকে আমাদের রেফার করা হয়েছিলো। মিশ্র গুণসম্পন্ন প্রজাতি নিয়ে পরে হার্ভার্ডে তাঁর আমন্ত্রণমূলক লেকচার শুনে বিজ্ঞানীমহলে সেসময় সাড়া পড়ে যায়। স্বদেশীয় প্রেসিডেন্টের ডাকে তিনি আগেই হার্ভার্ড ছেড়ে দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। এরপর তাঁর গবেষণার অগ্রগতির আর কোনও হদিশ মেলেনি। শুনেছি তিনি স্বদেশে উচ্চপদে আসীন।”

     “হুম, ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো বলে মনে হচ্ছে। তবে তোমার দেওয়া এই সূত্রটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। লাটাইয়ের সুতো গোটানোর সময় আসন্ন। আয়্যাম প্রাউড অফ য়ু, মাই বয়। বেস্ট অফ লাক ফর ইওর ব্রাইট ফিউচার।”

     “ধন্যবাদ প্রফেসর, আপনার কাজে আসতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। ভাল থাকবেন।”

     ফোনটা রেখে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন প্রফেসর বাগচী। ত্রয়ীমার্ডার, সাংবাদিকের অন্তর্ধান এবং আজকের সদ্য পাওয়া তথ্যগুলো মেলানোর চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। ঠিক এই সময়ই হাতের মুঠোফোনটা সশব্দে আর্তনাদ করে উঠলো। অদ্বয়ের কলটা রিসিভ করতে ওপাশ থেকে সে বলল, “প্রফেসর, এই মুহূর্তে খবর পেলাম সেই আমেরিকান সাংবাদিকের খোঁজ পাওয়া গেছে। ভদ্রমহিলার খোঁজে উত্তরপূর্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্পাই ড্রোন নিয়ে চিরুনিতল্লাশি চলছিলো। সেই সূত্রেই মালদার শহরতলী অঞ্চলে একটা পশুবর্জ্য সার তৈরির কারখানায় সন্দেহজনক কিছু কাজকর্ম লক্ষ্য করে স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চের অফিসাররা। আসলে ওই সাংবাদিক নিজের ডকুমেন্টারির বিষয়ে আগেই কলকাতায় সিআইডি-র দপ্তরে জানিয়ে বিশেষ অনুমতি নিয়ে রেখেছিলেন। সেখানেই নিরাপত্তাজনিত কারণে ওঁর দাঁতে একটা মাইক্রোচিপ সেন্সর ফিট করে দেওয়া হয়। ওঁর অপহরণের পর ড্রোন তল্লাশিতে সেই সিগন্যাল আর জিপিএস ট্র্যাকারের মদতে জায়গাটার হদিশ মেলে। উন্নতপ্রযুক্তির ড্রোনটি   অটোমেটিক টেক-অফ এবং ল্যান্ডিংও করতে পারে। বিশেষ সেন্সরের দৌলতে ক্যামোফ্লেজিং ক্ষমতার দরুণ আশেপাশে মানুষের নজর এড়িয়ে কারখানার পিছনের দিকের একটা বিল্ডিঙের দোতলায় মিস স্টোনকে খুঁজে নিতে তাই সেটার বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। তারপর নিজস্ব বায়োমেট্রিক ফেস রেকগনাইজারে ভদ্রমহিলার ডেটা ম্যাচ করতে, সেটি তৎক্ষণাৎ রেকর্ডেড ভিডিও ডেটা সদরদপ্তরে পাঠিয়ে দেয়। এরপরই সিআইডি এবং নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো কারখানায় রেড করে। অপহৃত সাংবাদিককে উদ্ধার করে গ্রেপ্তার করা হয় একদল চিনা নাগরিককে। ডেরা থেকে পাওয়া যায় কয়েকশো কেজি মাদকদ্রব্য ও র’ড্রাগ থেকে মাদক তৈরির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। প্রাথমিক জেরায় চিনা লোকগুলোর কাছ থেকে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে।” এরপর অদ্বয়ের বলা কথাগুলো শুনে আস্তে আস্তে প্রফেসর বাগচীর মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠলো। ফোনকলটা কাটার পর মনে মনে বললেন, “মানবতা শব্দটা সত্যি আজ ধীরে ধীরে বিপন্ন প্রজাতির মতো অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি।”

 

॥৭॥

     কলকাতায় সিআইডির সদরদপ্তর প্রেসের লোকজনের ভিড়ে জমজমাট। গোটা দেশ রীতিমতো উত্তেজনায় ফুটছে। সবার উৎসুক চোখ টিভির পর্দায় আটকে। দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিকর্তা আজ সকলের সামনে বিশেষ বিবৃতি দেবেন। মালদার ঘটনাটার পর আরও কয়েকজন চিনা নাগরিক কোলকাতার চায়নাটাউন থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে। এরা প্রত্যেকেই হংকং-এর বাসিন্দা। এব্যাপারে সিআইডির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তথ্যানুসন্ধান করেছে মার্কিন ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নয়াদিল্লি শাখা আর নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো। ধৃতদের জেরায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য! চিন, মায়ানমার আর নেপালকে নিয়ে তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক ত্রিভুজ ড্রাগ বলয়! রাজ্যকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিলো নতুন ড্রাগ ট্রানজিট পয়েন্ট! শুধু অ্যামফেটামাইন বা মেথামফেটামাইনের মতো পার্টি ড্রাগই নয়, এর সাথে কোকেন মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছিলো নতুন কম্বি পার্টি ড্রাগ! কাস্টমসের কিছু অফিসারকে অর্থপ্রলোভন দেখিয়ে হাতের মুঠোয় এনে, ওই চিনা নাগরিকদের ব্যবসায়ীর ভুয়ো পরিচয়ে এরাজ্যে ঘাঁটি গাড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলো আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিদের মূল মাথারা। নেপালের কিছু অসাধু শিল্পপতিও এই চক্রে জড়িত। ইতিমধ্যেই নেপাল সরকারের সাহায্যে সেখানকার সুপরিচিত বিজনেস টাইকুন সুরজ শ্রেষ্ঠ ও তার ডান হাত স্ট্যালিনকে আন্তর্জাতিক আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইন্টারপোলের জেরায় তারা কবুল করেছে, শিলিগুড়ির তিন অভিজাত ব্যবসায়ীকে মারার পিছনে তারাই লোক লাগিয়েছিল। তবে মাস্টারপ্ল্যান ছিল চিনের ড্রাগ বিজনেস হাবের কেউকেটাদের। আন্তর্জাতিক মাদক কারবারের স্বর্গরাজ্য গুয়াংঝাউ শহর থেকে সব নিয়ন্ত্রিত হত। ইন্টারপোল যখন নেপালে সুরজ শ্রেষ্ঠর অফিসে হানা দেয়, সেখানকার বেসমেন্টে তারা মাল্টিস্ক্রীন স্যাটেলাইট সুপার কম্পিউটার খুঁজে পায়। উন্নতমানের সার্ভারের সাথে যুক্ত সেই যোগাযোগ ব্যবস্থার সাহায্যেই ডার্কওয়েবের মাধ্যমে চলত সব কথাবার্তা। উদ্ধার করা ডেটা রেকর্ডারে মাদকচক্রের কথোপকথন জন্ম দিয়েছে নতুন চমকের! ধরা পড়েছে চিন সরকারের ন্যক্কারজনক মতলবের কথা! বিশ্ববাজারের অর্থনীতিতে অগ্রগণ্য ভারতের যুবসমাজকে ধ্বংস করে সমগ্র এশিয়ায় আধিপত্য কায়েম করার জটিল কূটনীতি! এবিষয়ে তারা কাজে লাগিয়েছে জৈব-অস্ত্রকেও! শিকার হয় শিলিগুড়ির তিন বিজনেস টাইকুন। প্রতিবেশী দেশের এই জঘন্য ষড়যন্ত্রে সামিল না হওয়ার শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। হত্যাকারী ছিল গবেষণাগারে তৈরি মারাত্মক কাইমেরিক মাকড়সা! স্রষ্টা প্রফেসর ঝাং ইয়ং, অ্যারাকনোলজি গবেষণার গডফাদার। প্রতিটি হত্যার পরেই সেই কুশলী হত্যাকারী নিজের ক্যামোফ্লেজিং ক্ষমতার দরুন সবার চোখকে এড়িয়ে যায়। অফিসার অদ্বয় ভরদ্বাজের টীমও ঠিক এই কারণেই থার্মাল সেন্সরে শীতল রক্তের এই মিশ্র প্রজাতিকে খুঁজে পাননি। হতভম্ব হয়ে তাই প্রফেসর ধীমান বাগচীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন। ক্ষুরধার বুদ্ধির ঝানু প্রফেসর তারপর অনুজপ্রতিম বৈজ্ঞানিক সমিধ সেনের সাহায্যে সেই কালান্তক হত্যাকারীর রহস্য উন্মোচন করেন। খুলে যায় রোমহর্ষক রোঁয়ার নেপথ্য কাহিনি।     

 

॥৮॥

     প্রফেসর বাগচীর বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়ীর একতলার বসার ঘরে সান্ধ্যকালীন আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। সদ্য তদন্তের সাফল্যে অদ্বয়ের মেজাজ খুশিতে ভরপুর। এরমধ্যেই প্রফেসর বাগচী সমিধের দিকে চোখ টিপে বলে উঠলেন, “যাই বলো, অদ্বয় তদন্তের খুঁটিনাটি আমাদের হাতে নিপুণভাবে তুলে না দিলে, এই কেসটা আমরা এতো সহজে সলভ্ করতে পারতাম না। সো হ্যাটস অফ টু য়ু, মাই বয়।” প্রফেসরের ইঙ্গিত বুঝে সমিধ মৃদু হেসে সম্মতিসূচক মাথা দোলাল। অদ্বয় এসবে মন না দিয়ে সামনে টী-টেবিলে রাখা জলখাবারের দিকে মনোনিবেশ করলো। স্যারের পেয়ারের খানসামা আবদুলের হাতের ফাউল কাটলেটের চমৎকার সুবাস ইতিমধ্যেই পাকস্থলীর আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য এক্কেবারে রেডি। সাগ্রহে হাত বাড়াল অদ্বয়। আপাতত কোনও কথাই যে তার কানে ঢুকবেনা সেটা বলাই বাহুল্য।

     নর্থ কোরিয়ার পিয়ংইয়াং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এইমাত্র এয়ার চায়নার গভীররাতের ফ্লাইট সেখানে অবতরণ করেছে। ফ্লাইট থেকে নেমে এক সুপুরুষ চিনা ভদ্রলোক ধীরপায়ে টার্মিনাল-২ ধরে এয়ারপোর্টের বাইরে যাওয়ার পথের দিকে এগোলেন। বেরোবার গেটের মুখের নিউজস্ট্যান্ড থেকে খ্যাতনামা দৈনিক ‘রোদং সিনমুন’ সংগ্রহ করে চোখ বোলাতে প্রথম পাতার একটা খবরে নজর আটকাল তার – “চিনের বাইয়ুন লেক সংলগ্ন অঞ্চলে আকস্মিক ভূকম্প!” নিজের অজান্তেই চোখের কোনাটা ভিজে গেলো আগুন্তুক ভদ্রলোকের। এক্ষেত্রে প্রকৃতি যে ভিলেন নয়, তাঁর থেকে ভাল আর কেইবা জানে। ইন্টারপোলকে ফাঁকি দেওয়ার চমৎকার বুদ্ধি যাকে বলে। বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করলেন, “আহাম্মকগুলোর জন্য আজ আমার অপত্যদের অকালমৃত্যুও আমাকে সইতে হল। এমনকি নিজের দেশেও…।” হঠাৎ নিজের অজান্তেই তার চোখ পড়লো সামনের কাচের দরজায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে। আবেগের তাড়নায় ভুলেই গিয়েছিলেন পৃথিবী থেকে চিরদিনের মতো তার পরিচয়টাই মুছে দিয়েছে হতচ্ছাড়াগুলো।  নিজের চেহারাটাই আজ প্লাস্টিক সার্জারির আঁচড়ে বড্ড অচেনা! নতুন পাসপোর্টটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে টার্মিনালের বাইরে নতুন শহরের আকাশের নীচে এসে দাঁড়ালেন। শহর বদলেছে, চেহারা বদলেছে, কিন্তু আবিষ্কারের নেশাটা একই রয়ে গেছে। হাত নাড়িয়ে অপেক্ষারত ক্যাব-ড্রাইভারকে ডেকে নিলেন তিনি। শহরতলীর গন্তব্যের দিকে রওনা দিল তার গাড়ি, সেখানে অপেক্ষায় নতুন ভবিষ্যৎ।

***

(সব চরিত্র ও ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক)

Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, রোঁয়া, শাম্ব চ্যাটার্জী, সুমন দাস

One thought on “রোঁয়া

  • November 17, 2018 at 1:22 pm
    Permalink

    Porlam. Kharap na…ektu ghosa Maja korte hoto…onek ta thesis er first draft er Moto laglo. Revision jato besi hbe quality tato valo hobe. Shambo Babu likhte thakun…prothom golpei bajimat hoi na sobar kintu lege thakle obossoi hoi ekdin. All the best.

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!