মঙ্গল গ্রহে জীবনের সন্ধান

  • লেখক: ডক্টর দিলীপ রায়চৌধুরী
  • শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য

লেখক – ডক্টর দিলীপ রায়চৌধুরী

অলংকরণ – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য

 

“মঙ্গল গ্রহের ওপর মহাকাশযান নামানো সহজ নয়”

দীর্ঘ দিন ধরে আকাশের একটি গ্রহ সম্পর্কে জ্যোতির্বিদরা অত্যন্ত কৌতূহলী। রক্তবর্ণ এই প্রতিবেশী গ্রহটির নাম রোমানরা দিয়েছিল মার্স, যার অর্থ ‘যুদ্ধদেবতা।’ আমরা বলি মঙ্গল। এটি ছোট একটি গ্রহ, ব্যাস মাত্র ৬,৮০০ কিলোমিটার। সূর্য থেকে বাইশ কোটি আশী লক্ষ কিলোমিটার দূরের এই গ্রহটির চেহারা পৃথিবীর চেয়ে খুব আলাদা হওয়ার কথা নয়। কারণ এই দূরত্ব সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্বের মাত্র দেড় গুণ।

     নানা কারণে বৈজ্ঞানিকদের মনে বহুদিন থেকে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে মঙ্গল গ্রহে জীবনের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্কিয়াপারেল্লি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে অনেক বছর ধরে খুঁটিয়ে গ্রহটিকে পর্যবেক্ষণ করেন। মঙ্গলকে পৃথিবী থেকে দেখার সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থা হচ্ছে যখন দুটি গ্রহ এই দিকে খুব কাছাকাছি থাকে। এই অবস্থাটিকে বলা হয় ‘মহাবিরোধী’ অবস্থা। ১৮৭৭ সালে এইরকম ‘মহাবিরোধী’ থাকাকালীন মঙ্গলকে পর্যবেক্ষণ করে স্কিয়াপারেল্লি একটি মানচিত্র প্রকাশ করেন। তাতে তিনি দেখিয়েছিলেন মঙ্গলের ওপর সমুদ্র ও অসংখ্য সরু সরু খাল আছে। সেদিন সমস্ত পৃথিবী স্কিয়াপারেল্লির মানচিত্রকে অবিশ্বাসের চোখে দেখেছিল বটে কিন্তু ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে আরেক ‘মহাবিরোধী’ অবস্থায় মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী লাওয়েল আরিজোনা মরুভূমি থেকে মঙ্গলকে টেলিস্কোপে ভালো করে লক্ষ করে দুনিয়াকে জানালেন : মঙ্গল গ্রহে খাল আছে। ওগুলো সব সময় দেখা যায় না কারণ শীতে বরফে ঢাকা থাকে। বসন্তে বরফ গলে যখন জলে ভরে যায় তখন দেখা যায় উত্তর থেকে দক্ষিণে জল যাচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, হেমন্তে দক্ষিণ থেকে উত্তরে জল যায়। এ থেকে লাওয়েল-পন্থীরা সিদ্ধান্ত করলেন যে, মঙ্গল গ্রহে নিশ্চয়ই অত্যন্ত বুদ্ধিমান ইঞ্জিনীয়ারদের বাস। কারণ জল আপনা-আপনি গড়িয়ে যেতে পারে না। জল পরিচালনের জন্য পাম্প দরকার এবং সে পাম্প নিশ্চয়ই মঙ্গলবাসীরা নির্মাণ করতে জানে।

     লাওয়েলের কথা ঠিক কি ভুল সে সম্পর্কে নানা তর্কবিতর্ক বহুদিন যাবৎ চলে আসছে। পরিশেষে মঙ্গলগ্রহে জীবন আছে কি নেই, এই প্রশ্নের সমাধান এক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি কারণে মঙ্গলগ্রহে জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকদের সন্দেহ জেগেছে। আমেরিকার মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরী থেকে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে গ্রহটির পরিবেশে অক্সিজেনের নিতান্ত অভাব। মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রধানতঃ নাইট্রোজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইড ছাড়া খুব অল্প পরিমাণ জলীয় বাষ্প ও আর্গন আছে। হয়তো এই অবস্থায় কয়েকটি আদিম জাতের শ্যাওলা অথবা ব্যাকটেরিয়া টিকে থাকতে পারে, কিন্তু কোনও উচ্চতর প্রাণীর সন্ধান পাওয়ার আশা নিতান্তই দুরাশা। যেহেতু তুন্দ্রা অঞ্চলে অথবা ভূপৃষ্ঠের ওপরে ৫৬,০০০ ফুট উঁচুতেও জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়, সেই কারণে অত্যন্ত বিরূপ অবস্থার মধ্যে কি জাতের প্রাণী বাঁচবে, সে খবর অত্যন্ত মূল্যবান। এ নিয়ে আমেরিকায় নানা নিরীক্ষাও চলেছে।

     মঙ্গলগ্রহে জীবনের অস্তিত্ব আছে কি নেই এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ও পরোক্ষ প্রমাণের দিন আজ ফুরিয়েছে। মহাকাশ অভিযানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ চায় সরাসরি মহাকাশযান মারফৎ প্রত্যক্ষ সংবাদ। একজন মার্কিনী বৈজ্ঞানিকের কথায় : যদি মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলের সন্‌ সন্‌ শব্দও মহাকাশযানের মাইক্রোফোন মারফৎ পৃথিবীতে পৌঁছয়, তা হলেও বেশ খানিকটা আশ্বস্ত হই।

     দুঃখের কথা, আমেরিকায় বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠীর মধ্যে তর্কবিতর্ক এবং সেই সঙ্গে মহাকাশ অভিযানের বড় কর্তাদের দীর্ঘসূত্রতার জন্য মঙ্গলের জীবনানুসন্ধানের কাজ ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। স্মরণ রাখতে হবে এই বছর, এর পরে ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালে পৃথিবী ও মঙ্গল খুব কাছাকাছি অর্থাৎ সাত থেকে দশ কোটি কিলোমিটারের মধ্যে থাকবে। এই সময়ে যদি প্রাথমিক অনুসন্ধান পর্ব শেষ করা যায় তবে ১৯৭১ সালে যখন মঙ্গল ও পৃথিবী ‘মহাবিরোধী’ অবস্থায় আসবে তখন আরও জরুরী জটিল পরীক্ষা গুলি শেষ করা যাবে। প্রথম স্তরে গ্রহ পৃষ্ঠের সর্ব রকমের ছবি টেলিভিসন মারফৎ দেখে এবং জীবনের অস্তিত্ব জানবার প্রাথমিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত মহাকাশ যান গ্রহে নামানো যেতে পারে। তবে এই সময়ে যে সব মহাকাশ যান পাঠানো হবে তা থেকে কোনও রকম জীবাণু গিয়ে যদি মঙ্গলগ্রহ দূষিত করে তবে ভবিষ্যতের পরীক্ষাগুলি জটিল হয়ে পড়বে। এই জন্যই মরুভূমি অঞ্চল থেকে অর্থাৎ যেখানে বায়ু বীজাণুমুক্ত সেখান থেকে শোধিত বীজানুহীন মহাকাশযান পাঠাতে হবে। আমেরিকানরা অবশ্য ভাবছেন ইতিমধ্যে রাশিয়ানরা সেখানে মহাকাশযান পাঠিয়ে যদি গ্রহটির পরিবেশ পাল্টিয়ে দিয়ে থাকেন তাহলে সব শ্রম ও অর্থব্যয় একেবারে বৃথা হয়ে যাবে। কিন্তু এই বিতর্কে সময় কেটে গেলে সঠিক সংবাদ মানুষ পাবে কবে?

     মঙ্গলগ্রহের উপরে মহাকাশযান অবতরণের কাজটি খুব সহজ হবে না। কিছুদিন আগে অঙ্ক কষে দেখা গেছে যে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের মোট চাপ পৃথিবীর বায়ুচাপের শতকরা মাত্র ৩৩ ভাগ হবে। এত নিম্নচাপে প্যারাচুটের সাহায্যে কোনও বস্তুকে মঙ্গল পৃষ্ঠে নামানো সম্ভব নয়। বিপরীতমুখী রকেট জ্বালিয়ে অবতরণকারী যানটিকে ধীরে ধীরে মন্থর করতে হবে। এ ছাড়া যদি যানটির চারিদিকে সংঘর্ষের প্রথম ধকল সামলানোর জন্য একটি বিশেষ খোলস দেওয়া থাকে তাহলে যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়বে না। মনে রাখতে হবে যে, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল যদি আরও ক্ষীণ হয় তবে এত সব প্রতিষেধক ব্যবস্থা সত্ত্বেও সন্ধানী মহাকাশযানটি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে।

     আরেকটি বিষয় এখনও পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না। যদি মঙ্গলের জীব জগৎ পৃথিবীর জীবদের অনুরূপ রাসায়নিক মেটাবলিজম অবলম্বনেই প্রাণ ধারণ করে তবেই এখান থেকে পাঠানো সন্ধানী যন্ত্রপাতি মঙ্গল থেকে সঠিক সংবাদ আহরণ করতে পারবে। এমনও হতে পারে যে, অবতরণের পর যন্ত্রপাতি থেকে কোনও সংবাদ পাওয়া গেল না। সেটা যন্ত্রপাতি বিকল হওয়ার দরুণ, না, পৃথিবীর রাসায়নিক প্রক্রিয়া মঙ্গলে অচল বলে–এ কথার জবাব দেবে কে? আমেরিকান জৈব রাসায়নিকরা আশাবাদী। তাঁরা মনে করছেন এত সব সন্দেহবাদ নিয়ে আঁকুপাঁকু করে লাভ নেই। পৃথিবীর বাইরে জীবনের অস্তিত্বের প্রশ্নটিকে সায়েন্স-ফিকশনের পাতা থেকে বিজ্ঞানের চৌহদ্দীতে নিয়ে আসার এই অমূল্য সুযোগ কেউ ছাড়তে রাজী নয়।

 

কঃ সঃ  বাংলা কল্পবিজ্ঞানে ডক্টর দিলীপ রায়চৌধুরী একটি উল্লেখযোগ্য নাম। কল্পবিশ্ব ওঁর গল্প এবং জীবনী আগেও পুনঃপ্রকাশ করেছে। তবে এই রচনাটি একটু ব্যতিক্রম। গত বছরই ওঁর সমস্ত রচনা একত্রিত করে একটি সমগ্র প্রকাশিত হয়েছিল সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে। এই রচনাটির কথা ওঁর কন্যা যশোধরাদির কাছেও জানা ছিল না। কল্পবিশ্ব টিমের সন্তু বাগ পুরানো আশ্চর্য!র বিভিন্ন সংখ্যা ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ এটির সন্ধান পায়। তারপরেই আমরা যশোধরাদির সঙ্গে যোগাযোগ করি এটি কল্পবিশ্বে পুনঃপ্রকাশের অনুমতি চেয়ে। উনিও সাদরে অনুমতি দিয়ে দেন। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল আশ্চর্য! ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে। প্রায় ৫৩ বছর আগের লেখাটির পুনঃপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আজকের যুগে দাঁড়িয়ে একই বিষয়ে মহাকাশবিজ্ঞান কতটা এগিয়েছে সেটাও তুলে ধরার কথা ভাবি। সেই কাজটি অতি অল্প সময়ের মধ্যে সুন্দরভাবে করেছেন সুমন দাস। নিচে তাঁর লেখাটিরও লিঙ্ক দিলাম। অনুসন্ধিৎসু পাঠক আশা করি সেটিও মিস করবেন না।  লেখাটি টাইপ করে আমাদের সাহায্য করেছেন দেবস্মিতা মিত্র এবং সন্তু বাগ। 

লাল মাটির জগৎ – সুমন দাস

 

Tags: ডক্টর দিলীপ রায়চৌধুরী, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, পূজাবার্ষিকী, প্রবন্ধ, মঙ্গল গ্রহে জীবনের সন্ধান

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!