কৌস্তূভ

  • লেখক: সুমিত বর্ধন
  • শিল্পী: সুমিত বর্ধন

কৌস্তূভ

লেখক – সুমিত বর্ধন

অলংকরণ – সুমিত বর্ধন 

 

(১)

ক্ষিণের আকাশের দিকে একবার তাকালো শতদল।

     গাঢ় নীল আকাশের বুকে দিগন্তব্যাপি এক সাদা খিলানের মতো দাঁড়িয়ে কৌস্তূভের বলয়। দিনের আলোয় চোখে না পড়লেও শতদল জানে ওই খিলানের আশে পাশেই কোথাও অভিকর্ষের জটিল পথ বুনে চলেছে কৌস্তুভের দুটি চাঁদ, সুহাস আর উল্লাস। কৌস্তূভ আবিষ্কর্তা বিজ্ঞানী সুহাস ভদ্রের নামে নামে সুহাস। সুহাস পুত্র উল্লাসের নামে উল্লাস। কৌস্তূভ অবধি পৌঁছতে পারেননি দুজনেই। যাত্রাপথের মাঝামাঝি উল্কাপিণ্ডের আঘাতে মহকাশ যানের যে অংশ বিকল হয়ে পড়ে, দুজনের হিমায়ন প্রকোষ্ঠ ছিল সে অংশেই। এই দুর্গম যাত্রায় মৃতের চাইতে জীবিতের দাম বেশি, তাই কৌস্তূভ অবধি না এনে মৃতদেহগুলো বিসর্জন দেওয়া হয়েছে মহাকাশেই। আরও পনেরজন অভিযাত্রীর সঙ্গে পিতাপুত্রও অনন্ত নিদ্রায় শুয়ে আছেন মহাকাশের নিঃসঙ্গ বিশালতার কোথাও।

     কয়েক বছরের মাধ্যাকর্ষণ বিহীন হিমনিদ্রার ফলে শরীরটা দুর্বল লাগে শতদলের, একটা বড় পাথরের ওপর বসে পড়ে সে।

     —আমাদের কি এরা কিছু খেতে দেবে?

     নারীকণ্ঠের আওয়াজে মাথা তুলে তাকায় শতদল। মেয়েটির পরণে হিমশয্যার অপরিচ্ছন্ন গাউন, পায়ে প্লাস্টিকের জুতো। কামানো মাথায় আর হাড় সর্বস্ব কব্জীতে ধমনীসূচের শুকিয়ে আসা লালচে দাগ – হিমায়ন আর পুষ্টি নালিকার সদ্য স্মৃতি।

     সামনে আয়না না থাকলেও শতদল জানে তার চেহারাটাও মেয়েটির চোখে একই রকম লাগছে – অপরিচ্ছন্ন পোষাক, প্লাস্টিকের জুতো, আর হাতে মাথায় ছুঁচের শুকিয়ে আসা লালচে দাগ। দীর্ঘ হিমনিদ্রার পর ম.যা. দুলারীর বেশির ভাগ যাত্রীর চেহারা ওইরকমই।

     অন্যমনস্ক ভাবে নিজের কব্জীতে হাত বোলাল শতদল,

     —নামার আগে বিস্কুট পাননি?

     গতরাত থেকে আরম্ভ হয়ে আজ সকাল পর্যন্ত যাত্রীদের হিমনিদ্রা থেকে জাগানোর কাজ শেষ হয়েছে। ঘুম থেকে তুলে সবাইকে একটা করে বিস্কুট আর একটা পরিচয় পত্র দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

     একটু অপ্রস্তুত দেখালো মেয়েটিকে,

     —পেয়েছিলাম, কিন্তু—

     পকেট থেকে বের করে একটা বিস্কুট বাড়িয়ে ধরল শতদল,

     —এটা নিতে পারেন। পরে খাব বলে রেখে দিয়েছিলাম, কিন্তু খিদে নেই, বড্ড গা গুলোচ্ছে।

     খানিক্ষণ ইতস্ততঃ করল মেয়েটি, কিন্তু দীর্ঘ অনশনের সঙ্গে লড়াইয়ে হার হল কুণ্ঠার। প্রায় একরকম ছোঁ মেরেই শতদলের হাত থেকে বিস্কুটটা টেনে নিয়ে গোগ্রাসে পুরে দিল মুখে।

     পেছনের দিকে একবার তাকালো শতদল। ছোট টিলাটার নিচে কোনও এক বিশালাকার প্রাগৈতিহাসিক জীবের মতন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পড়ে আছে ম.যা. দুলারী। আর সে উড়বে না। আলোকবর্ষের পর আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দিয়ে তার জীবনী শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। এখন তার বিশাল শরীরের ওপর পিঁপড়ের মতো ইতস্ততঃ মানুষ আর নানা যন্ত্রপাতির ব্যস্ততা। তাকে টুকরো টুকরো করার কাজ চলছে। তার কলকব্জা আর ধাতব শরীরের অংশ এখন উপনিবেশ তৈরির কাজে লাগবে।

     শতদল খেয়াল করে মেয়েটি তখনও তার পাশে দাঁড়িয়ে।

     —বসবেন?

     পাথরের একপাশে সরে গিয়ে বসার জায়গা করে দেয় সে।

     বসে না মেয়েটি, সঙ্কুচিত ভাবে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অচেনা লোকের কাছ থেকে যে খাবার নেওয়াটা যে ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যে পড়ে তা হয়তো সে বুঝে থাকবে।

     —আমার নাম শতদল। আপনি?

     —আমার নাম সুচেতা।

     সৌজন্যের ম্লান হাসি হাসে সুচেতা। কিন্তু সে হাসি ছড়ায় না তার চোখ অবধি। শতদল লক্ষ করে সেখানে জমে রয়েছে গভীর ক্লান্তি আর হতাশা।

     —আপনার জিনিসপত্র?

     ফের শুকনো হাসি হাসে সুচেতা,

     —না জিনিসপত্র বেশী নেই, খালি কয়েকটা জামাকাপড়। নিজের টাকাই জোগাড় করতে পারছিলাম না, তা আবার জিনিসপত্র। আপনার?

     দুলারীতে ভাড়া দিতে হয়েছে ওজনমাফিক। আলোকবর্ষ পাড়ি দেওয়া যানে একটা ছূঁচ বইবারও মূল্য অনেক, তাই এই সুচেতার মতন অনেকেই হয়তো নতুন জীবনের সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছে রিক্ত হস্তে। শতদলের তেমন অর্থাভাব না থাকলেও সে পুরানো জীবনের কিছুই বয়ে আনতে চায়নি সঙ্গে—দুঃখের চাইতে সুখের স্মৃতি আরও বেদনার।

     —আমারও প্রায় ওইরকম। জামাকাপড় আর কিছু যন্ত্রপাতি। আপনি কি একলা, না কোনও দলের সঙ্গে?

     দুলারীতে অনেকে দল বেঁধে এসেছে, একসঙ্গে মিলে কৌস্তূভে কলোনি বসাবে। শতদল অবশ্য একাই, নিঃসঙ্গতার সন্ধানেই তার পৃথিবী থেকে চলে আসা।

     —না, আমিও একা।

     প্রসঙ্গ বাড়ালো না শতদল। অন্যের জীবন বৃত্তান্তে তার কোনও প্রয়োজন নেই।

     আঙুল তুলে সামনের দিকে দেখালো সুচেতা,

     —ওটাই তো সন্তোষগঞ্জ?

     ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে জমিটা, সেখানে একটা বসতি। প্লাস্টিকের চাদর, কাঠ আর মিশ্র ধাতুর টুকরো দিয়ে তৈরি সারি সারি ঘর। মাঝখানে তোবাড়ানো, টোল খাওয়া একটা ধাতব অর্ধগোলক।

     সায় দিল শতদল,

     —হ্যাঁ, ওটা সন্তোষগঞ্জ। আদরিণীর ক্যাম্প।

     অল্প কিছু অভিযাত্রী আর অনেক যন্ত্রপাতি নিয়ে আদরিণী, দুলালীর একবছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল। উদ্দেশ্য দুলারী এসে পৌঁছনোর আগে জমি আবাদ করে কৌস্তূভকে দুলারীর যাত্রীদের জন্যে খানিকটা বাসযোগ্য করে রাখা।

     কচ্ছপের পিঠের মতন বাড়িটার দিখে আঙুল তুলে দেখালো সুচেতা,

     —অদ্ভূত দেখতে!

     হাসল শতদল,

     —দেখে বুঝতে পারছেন না? ওটা মহাকাশ যানেরই অংশ। সম্ভবত আদরিণীর কন্ট্রোল রুম ছিল। ওটাই বোধহয় হেডঅফিস।

     পাশ দিয়ে হইহই করতে করতে স্ত্রী পুরুষের একটা বড় দল সন্তোষগঞ্জের দিকে নেমে গেল। দুলারীতে এরকম বেশ কয়েকটা গ্রুপ এসেছে, সঙ্গে এনেছে নানা যন্ত্রপাতি আর রসদ। সবাই মিলে একসঙ্গে কলোনি বসাবে। দল বাঁধলে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করা সহজ।

     শতদল এসেছে একাই। কারণ লড়াই করে বেঁচে থাকা নয়। লড়াই করে ভুলে থাকাই তার উদ্দেশ্য।

     —আপনারা বুঝি আমার মতো একাই?

     দলের পেছন থেকে একজন এগিয়ে এসেছে শতদলের দিকে। খর্বকায় চেহারা, মুখে প্রৌঢ়ত্বের ছাপ থাকালেও পিঠ সোজা, চওড়া কাঁধ টানটান।

     চোখ তুলে দলটার দিকে ইশারা করল শতদল,

     —আপনি ওদের সঙ্গে নেই?

     —আরে না না, ওঁরা সব নিজেদের টিম নিয়ে এসেছেন। আমার সঙ্গে কি আর ওঁদের মেলে? আমি একে সেপাই, তায় আবার নুলো।

     শতদল খেয়াল করল লোকটির বাঁ-হাতের কনুই থেকে বাকিটা ধাতুর নানা যান্ত্রিক কারিকুরিতে তৈরি।

     —আমার নাম নিত্যানন্দ দাস, লোকে বলে নুলো নিতাই। আপনারা আমাকে নিতাইদা বলতে পারেন।

     বায়োনিক হাতটা শতদলের সামানে তুলে বারদুয়েক মুঠো বন্ধ আর খুলে দেখালো নিতাই।

     —তবে নুলো বলে অচ্ছেদ্দা করবেন না। এটা একেবারে খাঁটি মিলিটারি জিনিস, বাইরে পাবেন না। মুঠোয় পাথর গুঁড়িয়ে দেব।

     নিতাইয়ের ব্যবহারে হেসে ফেলল শতদল।

     —তা নিতাইদা, আপনি এমন আদত জিনিসটা পেলেন কোথায়? ওপরমহলে অনেক জানাশোনা আছে নাকি?

     —আরে দুর দুর, আমার আবার জানাশোনা। লড়াইয়ে গেল হাতখানা খোয়া। সে সময়ে ইউনিটের অর্ধেকের ওপর লোক মারা গেছে, লড়াইও তুঙ্গে। কত্তারা ভাবলেন নুলো ল্যাংড়াগুলোকে যদি হাতপা লাগিয়ে দেওয়া যায় তবে আরও দিনকতক লড়া যাবে। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল, আমিও হাতখানা পেলাম।

     —বাঃ নিতাইদার কপাল তো দেখছি বেশ! তা চলুন, সন্তোষগঞ্জের দিকে যাওয়া যাক, আমাদের মালপত্র ওখানেই ফেরত দেবে বলেছিল। তা ছাড়া ওখানে একটা ক্যান্টিন আছে শুনেছি, খাওয়ার বন্দোবস্তটা যদি করা যায়।

     —তা চলুন। কিন্তু দাদা-দিদির নামগুলো যে জানা হল না!

     —যেতে যেতে বলছি, চলুন।

     কাঠের ডেরাগুলোর ঠিক আগে খুঁটিতে লটকানো তক্তায় অপটু হস্তাক্ষরে বড় বড় করে লেখা ‘সন্তোষগঞ্জ’, তার নিচে দু-তিনজন মানুষের জটলা। তাদেরই দু-একজন এগিয়ে আসে,

     —এই জামাকাপড়গুলো নিন, জিনিসপত্র না পাওয়া পর্যন্ত আপাতত এই দিয়েই চালান। ক্যান্টিন বাঁদিকে, তার একটু আগেই কাপড় পাল্টানোর ঘর।

     ঘর কথাটা কিছুটা অত্যুক্তি। সামনে পর্দা খাটানো খাড়া করে রাখা কয়েকটা বাক্স কেবল। তার স্বল্প পরিসরে কোনও রকমে কাপড় পালটে বেরিয়ে আসে শতদল।

     নতুন পোষাক গায়ে অপেক্ষা করে নিতাই। ঘোলাটে সাদা রঙের রুক্ষ মোটা কাপড়ের শার্ট আর পাজামা, কিন্তু তাতেই চওড়া হাসি তার মুখে।

     —নতুন দেশের নতুন জামা! কি বলেন?

     পর্দা ঠেলে বাইরে আসে সুচেতা। শার্টটা মাপে বড়, লম্বা হাতাটা গুটোতে থাকে।

     —নতুন কি? কাপড়ের রঙটা যেন কেমন!

     হেসে ফেলে শতদল।

     —আনকোরা নতুন আর কোথা থেকে পাবে! খুব সম্ভব আদরিণীর ভেতরে যেখানে সব ফেব্রিক লাইনিং ছিল সেগুলোকেই রিসাইকেল করেছে। চলুন খেয়ে আসি।

     ক্যান্টিন মানে কাঠের খুঁটির ওপর কাঠের তক্তা মারা একটা লম্বাটে শেড, মাথার ওপরে জোড়াতালি দেওয়া ধাতুর চাদরের ছাউনি। মটিতে বেছানো কাঠের তক্তার ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা মানুষের কথার গুঞ্জন ছাপিয়ে কানে আসে বাসনের টুংটাং। বাতাসে ভাসে রান্নার সুঘ্রাণ আর পোড়া কাঠের গন্ধ। শেডের অন্য প্রান্তে ধোঁয়া ওঠে বড় বড় ডেকচি থেকে। তাদের নিচে মাটির উনুনে উত্তাপ জোগায় জলন্ত কাঠ।

     সামনে কাঠের টেবিলে ডেকচি থেকে খাবার পরিবেশন করে একজন। টেবিলে জড় করা বড় বড় নীলচে রঙের পাতা। আকারে অবিকল থালার মতো। গোল, মাঝখানটা কানার থেকে নিচু। তারই একটা দুহাতে তুলে নেয় শতদল, দাঁড়ায় গিয়ে পরিবেশনকারীর সামনে।

     —নমস্কার। কৌস্তূভে স্বাগত। আমি সুজয় বোস, আজকে আপনাদের শেফ। ল্যাবের টেস্ট টিউব ছেড়ে আজ খুন্তি ধরেছি, সুতরাং কোনও গ্যারান্টি দিতে পারব না।

     লম্বা শীর্ণ চেহারা সুজয় বোসের। দুহাতে উল্কির আঁকিবুঁকি, টানটান করে আঁচড়ানো চুল মাথার পেছনে পনিটেল করে বাঁধা।

     ডেকচি থেকে হাতায় তুলে শতদলের পাতায় খাবার ঢালেন সুজয় বোস। একটা সাদা রঙের মণ্ড আর শাকসব্জীর ঘ্যাঁট একটা।

     —আমি আদরিণীর বায়োলজিস্ট, সুতরাং এগুলো সব আক্ষরিক অর্থেই আমার গবেষণার ফসল। সাদাটা আলুসেদ্ধ। আলুটা পৃথিবীর বটে, তবে কৌস্তূভের জলমাটির জন্যে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড। শাকপাতাগুলো সব কৌস্তূভের। মশলাগুলো সিন্থেটিক, এই গ্রহের নানান রকম ভেষজ থেকে এক্সট্রাক্ট করা। তবে ভাববেন না, সব সেফ, ল্যাবে টেস্ট করে নিয়েছি।

     —মানুষের ওপর টেস্ট?

     অনিশ্চিত কণ্ঠে প্রশ্ন সুচেতার।

     —আরে না না, ইঁদুরের ওপর। মানুষেরটা আপনাদের ওপর দিয়ে হচ্ছে। হাঃ হাঃ হাঃ।

     বায়োলজিস্ট সুজয় বোসের অট্টহাসিতে গমগম করতে থাকে সন্তোষগঞ্জের ক্যান্টিন।

     ক্যান্টিনের এক কোনে খাবারের পাতা হাতে করে মাটিতে বসে পড়ে তিনজনে। দেখতে যতটা খারাপ, খেতে ততটা মন্দ নয়। অথবা দীর্ঘ অনাহারের পর এই শাকাপাতাই হয়তো তাদের মুখে অমৃত ঠেকে। সুতরাং খাবার শেষ হতে বেশি দেরি হয় না।

     খাওয়ার পর খানিকটা উদ্দেশ্যহীন ভাবেই এদিক সেদিক একটু হাঁটে তিনজন।

     খানিকটা হেঁটেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে সুচেতা। বসে পড়ে মাটিতে পড়ে থাকা একটা বাক্সর ওপর।

     —খাবারটা ঠিক ছিল কি? কেমন শরীরটা ভারী লাগছে।

     ঘাড় নাড়ে নিতাই,

     —হ্যাঁ, আমারও শরীরটা কেমন ভার ভার লাগছে।

     মুচকি হাসে শতদল,

     —খাবারের জন্যে নয়। আপনাদের শরীরটাই ভারী হয়ে গেছে—কৌস্তূভের অভিকর্ষ পৃথিবীর চাইতে প্রায় সোয়াগুণ বেশী। মানিয়ে নিতে খানিক সময় লাগবে।

     আকশের দিকে আঙুল তোলে নিতাই,

     —আকাশটা দেখেছেন? সূর্যটা কেমন ছোট!

     মাথা ঝাঁকায় শতদল।

     —পৃথিবী যে নক্ষত্রের চারপাশে ঘোরে তার নাম সূর্য। আকাশে যেটাকে দেখছেন তার নাম মিহির। সূর্য জি-টু শ্রেণীর নক্ষত্র। মিহির এফ-এইট গোত্রের।

     ভুরু কোঁচকায় নিতাই।

     —বুঝলাম না।

     —তারাদের ও, বি, এ, এফ, জি, কে, এম – এই সাতটা শ্রেণী আছে। জি শ্রেণীর নক্ষত্রের থেকে এফ শ্রেনীর নক্ষত্রদের উত্তাপ বেশী। প্রত্যেকটা শ্রেনীকে আবার শূন্য থেকে নয়, এই দশভাগে ভাগ করা আছে। শূন্য বিভাগের নক্ষত্রের থেকে এক বিভাগের নক্ষত্রের উত্তাপ কম, আবার একের থেকে দুই বিভাগের নক্ষত্রের, এইরকম আর কি।

     —অঃ বুঝলাম। তা সূয্যি, না কি ওই মিহির, অতটা ছোট দেখাচ্ছে কেন?

     —সূর্য্যের থেকে মিহিরের উত্তাপ অনেক বেশী। সূর্য্য থেকে পৃথিবীর যতটা দূরত্ব, কৌস্তূভ মিহিরের ততটা কাছাকাছি থাকলে বাসযোগ্য হত না। পৃথিবী সূর্য্যের যতটা ফারাকে থাকে, আমরা মিহিরের থেকে তার চাইতে বেশী দূরে আছি। সেইজন্যে আকাশে মিহিরকে সূর্য্যের তুলনায় খানিকটা ছোট লাগছে।

     কোথাও একটা লাউডস্পীকারের আওয়াজ গমগম করে ওঠে—“দুলারীর যাত্রীদের অফিস ঘরের সামনে আসতে অনুরোধ করা হচ্ছে। দুলারীর যাত্রীদের—”

     অফিসের সামনে মানুষের জটলার মাঝে এসে দাঁড়ায় শতদল। অচেনা মুখে কোথাও আড়ষ্ট হাসি, কোথাও উদাস দিশাহীনতা, আবার কোথাও যাত্রা আরম্ভের অধীর আগ্রহ। কথা বলার অস্পষ্ট গুঞ্জন ছাপিয়ে মাঝে মধ্যে বাতাসে ভেসে জলের শব্দ আর কোনও অজানা প্রাণীর তীক্ষ্ণ চিৎকার।

     —নমস্কার! কৌস্তূভে আপনাদের স্বাগত।

     থেমে গেল ভিড়ের গুঞ্জন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আওয়াজ উঠল হাততালির। ঘাড় উঁচু করল শতদল। সামনে একটা বড় বাক্সের উপর উঠে দাঁড়িয়েছে একজন।

     —আমি নীলেশ পাঠক। আপনাদের প্রাক্তন পাইলট। আপনাদের কৌস্তূভ পৌঁছে দিয়ে আমার ড্রাইভারির ক্যারিয়ার পাকাপাকি ভাবে শেষ। এবার আপনাদের দায়িত্ব নেবেন শিপ্রা ম্যাডাম। ডক্টর শিপ্রা দত্ত।

     পনিটেল করে বাঁধা চুলে সাদা টানগুলো বয়সের সাক্ষ্য দিলেও, শরীরের ভাষায় তার কোনও ছাপ নেই। নীলেশের বাড়ানো হাতটা না ধরে নিজেই বাক্সের ওপর লাফিয়ে উঠলেন ডক্টর শিপ্রা।

     —নমস্কার। ভণিতা না করেই বলি, কৌস্তূভে আমাদের যাত্রা শেষ হয়নি, সবে শুরু হয়েছে কেবল। মানুষের সভ্যতা থেকে আমরা অনেক অনেক দূরে। এখানে দোকান বাজার আইন আদালত স্কুল হাসপাতাল কিচ্ছু নেই। যা আমাদের দরকার আমাদের নিজের হাতে গড়ে নিতে হবে।

     —এবার আমাদের কি করতে হবে।

     ভিড়ের মধ্যে থেকে ভেসে এল প্রশ্ন।

     —কি করতে হবে সে উত্তর ঠিক আমারও জানা নেই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কোনও মতে পৃথিবীর শেকল কেটে বেরিয়ে আসা। আদরিণী আর দুলারীকে যাত্রা করানোটাই এত দুরূহ কাজ ছিল যে তার বাইরে অন্য কিছু আর আমরা ভেবে ওঠার অবকাশ পাইনি। সুহাস ভদ্রের মাথায় হয়তো কিছু আইডিয়া ছিল, কিন্তু তিনি আর নেই।

     থেমে যাওয়া গুঞ্জনটা শুরু হল আবার দ্বিগুন জোরে। কানে ভেসে এল টুকরো টুকরো শব্দ ‘কিন্তু-’, ‘তাহলে-‘, ‘কি করে-’।

     দু-দুবার জোরে তালি দিলেন ডক্টর শিপ্রা।

     —এদিকে শুনবেন। আমরা যা করব আপনাদের সবার সঙ্গে আলোচনা করেই করব। কিন্তু সে পরে। এখন কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস জেনে নিন। মনে রাখবেন কৌস্তূভ পৃথিবীর মতন পোষ মানা গ্রহ নয়, এখানে হিংস্র জন্তু, বিষাক্ত পোকামাকড় কোনও কিচ্ছুর অভাব নেই।

     —ডাক্তার ম্যাডামের সোজা-সাপটা কথা বলার অভ্যেসটা যায়নি দেখছি!

     পেছন থেকে ভেসে এল নিতাইয়ের গলা।

     ঘাড় ঘোরাল শতদল।

     —আপনি চেনেন নাকি?

     উত্তর না দিয়ে কেবল মুচকি হাসে নিতাই।

     ফের শুরু হওয়া গুঞ্জনটা থামাতে আর একবার তালি দিলেন ডক্টর শিপ্রা।

     —কৌস্তূভে অক্সিজেনের পরিমাণ পৃথিবীর চাইতে বেশি। অক্সিজেন টক্সিসিটি এড়ানোর জন্যে নিয়মিত ওষুধ খাবেন, না হলে শরীর খারাপ হতে পারে। ওষুধ ক্যান্টিনের পেছনের ডিস্পেন্সারিতে পাবেন, মনে করে নিয়ে নেবেন।

     —যাঃ বাব্বা!! অ্যাদ্দিন জানতাম অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচে না। এখন শুনছি বেশি অক্সিজেনের জন্যে শরীর খারাপ হবে!!

     ভিড়ের মধ্যে থেকে উড়ে আসে একটা আলগা মন্তব্য। সঙ্গে যোগ হয়ে কয়েকটা কণ্ঠের সন্ত্রস্ত হাসির চাপা শব্দ।

     হালকা হাসি ফোটে ডক্টর শিপ্রার ঠোঁটের কোনে,

     —অতি প্রয়োজনীয় বস্তুও মাত্রা ছাড়া হলে শরীরের ক্ষতি করে। কৌস্তূভে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ তিরিশ শতাংশ। পৃথিবীর চাইতে পাক্কা ন-শতাংশ বেশি। পৃথিবীর হাওয়া খাওয়া শরীরে কৌস্তূভের বাতাস বেশিক্ষণ সইবে না।

     —কি হবে?

     ভিড়ের মধ্যে থেকেই কেউ প্রশ্ন করে।

     —কানে ঝিঁ ঝিঁ ধরবে, চোখে ভালো দেখতে পাবেন না, বুকে ব্যাথা হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা না নিলে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন।

     —আমাদের কি একটানা ওষুধ খেয়েই বাঁচতে হবে এ গ্রহে?

     সুচেতা প্রশ্নটা নিচু গলায় অনেকটা নিজের মনে করলেও শুনতে পান ডক্টর শিপ্রা। মাথাটা হালকা নাড়ান দুপাশে।

     বায়োলজিস্ট সুজয় বোস জিন থেরাপি নিয়ে কাজ আরম্ভ করে দিয়েছেন। সামনের দিনে আমাদের শারীরিক ক্ষমতাকে কৌস্তূভের জন্যে পাকাপাকি ভাবে বদলে নিতে পারব। কিন্তু যতদিন না তাঁর কাজ সম্পূর্ণ হচ্ছে, ততদিন আমাদের ওষুধ দিয়েই কাজ চালাতে হবে।

     কোমরে দুহাত রেখে মাথা ঘুরিয়ে ভিড়ের সবটা একবার দেখেন ডক্টর শিপ্রা।

     —কৌস্তূভ মানুষের বাসযোগ্য বটে, কিন্তু পৃথিবী নয়। এখানে পদে পদে বিপদ লুকিয়ে আছে। সাবধানে থাকার জন্যে আর কি কি প্রয়োজন সুরিন্দারের থেকে শুনে নিন।

     ডক্টর শিপ্রার জায়গায় বাক্সর ওপরে লাফিয়ে ওঠে যে, তার বয়স তিরিশের মাঝামাঝি। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা, ইস্পাত কঠিন চাহনি।

     —আমি সুরিন্দার চাওলা। এই ক্যাম্পের সিকিউরিটি ইনচার্জ।

     সুরিন্দারের রংচটা জ্যাকেটের নীচ থেকে উঁকি মারা হোলস্টারটা নজরে পড়ে শতদলের।

     —ক্যাম্পের ছেড়ে রাতের বেলা বাইরে যাবেন না। এখানে হিংস্র জীব জন্তুর কোনও অভাব নেই। ক্যাম্পের ভেতরেও রাতের বেলা পুরো নিরাপদ নয়। কোথাও যেতে হলে দু-চারজন একসঙ্গে যাবেন। রাতে খোলা জায়গায় শোবেন না, টেন্ট এনে থাকলে ভালো, না হলে পরে এসে কথা বলুন, আপনাদের অন্য কোথাও শোবার বন্দোবস্ত করব।

     আর এক বার বাক্সের ওপর ওঠেন ডক্টর শিপ্রা।

     —একটা কথা মনে রাখবেন। পৃথিবীর টাকা পয়সা এখানে অচল। এখানে দোকানপাট নেই, কিছু চাইলেই কিনে আনা যাবে না। যা যা প্রয়োজন সব আমাদের নিজের হাতে গড়ে নিতে হবে। কাল সকালে সবাই একে একে অফিসে আসুন, যে যেরকম কাজ পারেন তাকে সেই অনুযায়ী দায়িত্ব দেওয়া হবে। তবে—

     পশ্চিমের আকাশে দিকে একবার তাকালেন ডক্টর শিপ্রা।

     —তবে সে করার জন্য অনেক সময় আছে। বেলা গড়িয়ে এল, সবাই একবার নদীর পাড়ে আসুন। কৌস্তূভের অস্তকালের আকাশ দেখলে আপনাদের দুশ্চিন্তা আর ক্লান্তি অনেকটাই দূর হয়ে যাবে।

     নদীর দিকে হেঁটে যাওয়া ভিড়টার পিছু নেয় তিনজন।

     ক্যাম্পের কাঠের বাড়িগুলো পার হয়ে ঘাসে ছাওয়া লম্বা মাঠ। মাঠের ওপর দিয়ে ভিড়ের সঙ্গে হাঁটে শতদল, ক্রমে কানে আসতে থাকে জলের শব্দ। আরও একটু এগিয়ে পাতলা হয়ে ছড়িয়ে যায় ভিড়টা, নজরে আসে ছোট বড় পাথরের ওপর দিয়ে গর্জন করে ছুটে যাওয়া নদীটা।

     নদীর প্রায় কিনারায় এসে দাঁড়ায় তিনজনে। আকাশের দিকে চোখে তোলে সুচেতা,

     —এখানে আকাশটা পৃথিবীর থেকে বেশী নীল, না?

     ঘাড় নাড়ে শতদল,

     —হ্যাঁ। নীল আলোর পরিমাণ অনেক বেশী।

     আকাশের দিকে চোখ তোলে নিতাইও।

     —কেন বলুন তো?

     নীলেশ পাঠক কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি শতদল। উত্তর আসে তাঁর কাছ থেকে।

     —নক্ষত্রের তারতম্যের জন্যে। সূর্যের মতো জি গোত্রের নক্ষত্রের আলোয় নীলের পরিমাণ একষট্টি শতাংশ। এফ শ্রেণীর নক্ষত্র মিহিরের আলোর সাতাত্তর শতাংশই নীল রঙের।

     নীল আকাশের পশ্চিম দিকে তখন মিহিরের আলো লালের নানা বর্ণে রাঙিয়ে তুলছে।

     বেশী দেরী হল না, মিহিরের পড়ন্ত আলোয় ছটায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল দক্ষিণ দিগন্ত জুড়ে খিলানের মতো দাঁড়িয়ে থাকা কৌস্তূভের বলয়। তার পাণ্ডুর চেহারায় ফুটে উঠল নানা বর্ণের অসংখ্য বৃত্ত রেখা। একের মধ্য আর এক, তার মধ্যে আর এক, তারপরে আর এক, স্তরে স্তরে ক্রমশঃ সাজানো। যেন জ্যামিতিক নকশায় ফোটানো আকাশ জোড়া এক রত্ন রঙীন মহাধনু।

     আকাশের নীল তখন আরও গাড় হয়ে এসেছে। এবার বলয়ের কাছাকাছি তার বুকে ফুটে উঠল মুক্তোর আকারের দুটো চাঁদ।

     পশ্চিম দিকে আরও খানিকটা হেলে পড়ল মিহির। বলয়ের পূর্বদিক বেয়ে উঠে এল অন্ধকার। মিহিরের দিগন্তের দিকে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই অন্ধকার বলয় বরাবর ক্রমশঃ এগোতে আরম্ভ করল পশ্চিম দিকে। তার যাত্রা পথের পেছনে নীল থেকে কালো হতে থাকা আকাশে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকল নানা রঙে রঙীন দিনান্তের মহাধনু।

     ক্রমে দিগন্তের পেছনে ঢলে পড়ে মিহির। অন্ধকার আকাশ জুড়ে একে উঁকি মারতে শুরু করে তারারা। কেবল আকাশের যেখানটা দিনের বেলায় বলয়ের খিলেন দখল করে রেখেছিল, সেইখানে একটা চওড়া মেখলার মতন রয়ে গেল নক্ষত্রবিহীন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।

     আকাশের শোভা দেখতে মুগ্ধ হয়ে ছিল শতদল, সম্বিৎ ফিরল হুইশেলের তীক্ষ্ণ শব্দে। আলো সামান্যই, কিন্তু তবু চোখে পড়ল দু-চারটে ছায়ামূর্তি হাত নেড়ে তাদের ক্যাম্পের দিকে ফিরে যেতে বলছে।

     ভিড়টা ক্যাম্পের ভেতর চলে আসতেই তীব্র আওয়াজে বেজে দু-তিনবার উঠল সাইরেন।

     —হুঁ। চলুন ক্যান্টিন থেকে খেয়ে আসি। আর সুচেতা, দেখে তো মনে হল আপনার কাছে টেন্ট নেই।

     —না, নেই!

     ছোট্ট জবাব সুচেতার।

     —তাহলে চলুন, আপনার জন্যে রাত্রে থাকারও একটা বন্দোবস্ত করতে হবে।

     এইভাবে দুলারীর যাত্রীদের শেষ হল কৌস্তূভে প্রথম দিনটি।

 

(২)

     যন্ত্র করাতটা দিয়ে এক এক করে পড়ে থাকা গাছটার ডালপালা ছাড়ায় শতদল। সঙ্গে হাত লাগায় নিতাই। খানিক দূরে একটা লম্বা গাছের গোড়ায় করাত চালায় আরও তিন চারজন।

     সন্তোষগঞ্জের অবস্থানটাও এ কয়েক দিনে বুঝে নিয়েছে শতদল। উত্তর পূর্বে বিস্তৃত হয়ে রয়েছে উঁচু উঁচু পাহাড়, রামগিরি পর্বতমালা। পাহাড়ের নিচ থেকে শুরু হয়ে জঙ্গল এগিয়ে এসেছে সামনের দিকে। জঙ্গলের পর থেকে শুরু হয়েছে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি।

     শতদলের প্রথম দিনের দেখা নদীটার নাম আনন্দী। রামগিরি থেকে বেরিয়ে বয়ে গেছে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, তারপরে খানিকটা এগনোর পর হঠাৎ করে বাঁক নিয়েছে পূর্বদিকে। এইই বাঁকটার মধ্যেই সন্তোষগঞ্জ, নদী তাকে দু-দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। সন্তোষগঞ্জ আর জঙ্গলের মধ্যে, কয়েকটা ছোট ছোট ঢেউ খেলানো টিলা, এদের একসঙ্গে অযোধ্যা পাহাড় বলে ডাকা হয়। এর থেকেই খানিকটা দূরে মাঠের মধ্যে কৌস্তূভে নেমেছিল দুলারী।

     এ কয়েকদিনের মধ্যে ঘোরলাগা ভাবটাও কেটে গেছে। সহজ হয়ে এসেছে সম্পর্কগুলো, পালটে গেছে, সম্বোধনগুলো। একটা রুটিনে বাঁধা পড়ে গেছে দিনগুলো। বেঁচে থাকার তাগিদে সবাই নিজের মতো করে তুলে নিয়েছে এক একটা কাজের দায়িত্ব। উদ্দেশ্যহীনতার ভাবটা কেটে গিয়ে যে যার মতন করে ডুব দিয়েছে নতুন জীবন গড়ার উদ্দেশ্যে।

     শতদল আর নিতাই জড়িয়ে পড়ে গাছকাটা দলের সঙ্গে। সন্তোষগঞ্জ থেকে জঙ্গলের সীমানা সাত আট কিলোমিটার। সকাল হলেই একটা দল রওনা দেয় জঙ্গলের দিকে। গাছ কেটে ডালাপালা ছেঁটে গুঁড়িগুলো ভাসিয়ে দেয় নদীর জলে। এগুলো সন্তোষগঞ্জে জল থেকে তুলে নেবে আর একটা দল।

     গাছকাটা দলকে ঘিরে পাহারা দেয় সুরিন্দার আর আরও তিন চারজন। তাদের হাতে রাইফেল, নজর ইতস্ততঃ ঘোরে আসেপাশে।

     সুরিন্দারের দলটা ছাড়াও আর একটা দু-তিনজনের দল কাজ করে বায়োলজিস্ট সুজয় বোসের সঙ্গে। ফুল, পাতা, পোকা, নানা রকম জৈব বস্তুর স্যাম্পেল জড়ো করে বোতল বন্দী করে তাঁর নির্দেশ মতো। সুচেতা আছে এ দলের সঙ্গে।

     করাত নামিয়ে ডালপালা ছাঁটা গাছের গুঁড়িটাকে নদীর দিকে ঠেলতে আরম্ভ করে শতদল। সঙ্গে হাত লাগায় নিতাই আর আরও দু-চারজন।

     নদীর ধারে বেছানো নুড়ি আর পাথরের টুকরোর ওপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে গুঁড়িটাকে নদীর জলে এনে ফেলে সবাই মিলে। তারপর হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে একটা একসঙ্গে একটা জোর ধাক্কা দিতেই গুঁড়ি পৌঁছে যায় মাঝনদীতে।

     স্রোতে ভেসে চলে যেতে থাকা গুঁড়িটা ছাড়িয়ে শতদলের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে নদীর অপর পারে। দক্ষিণ পশ্চিমে নীল বেগুনী জঙ্গল শেষ হয়ে শুরু হয়েছে নীলচে ঘাসে ছাওয়া মাঠ। সেখানে চরে নানান তৃণভোজী পশুর দল। মাটিতে মুখ রেখে মন্থর গতিতে হাঁটে শামুক সম্বরের পাল। তাদের পিঠে বসানো প্যাঁচানো শঙ্কুর মতো খোলস ঝকঝক করে আলোয়। অগুন্তি পায়ে মাটির ওপর দিয়ে পিছলে যায় সাত-আট ফুট লম্বা তেঁতুলে গণ্ডার, তাদের গাঁটে গাঁটে বাঁধা শরীরটা মোড়া পুরু চামড়ায়। তাদের মাঝে পিঠে ছড়ানো রামধনু রঙের ঝিল্লী নিয়ে ইতস্ততঃ দৌড়ে বেড়ায় ছাতাহরিণের দল।

     —চলো। অনেক কাজ বাকি আছে।

     —হ্যাঁ। চলো।

     বাকিরা এগিয়ে গেছে। নিতাইয়ের ডাকে কৌস্তূভের অচেনা জন্তুগুলোর দিকে আর একবার তাকিয়ে নদী পেছনে ফেলে দিকে পা বাড়ায় শতদল।

     নদীর পাড় ঘেঁষে একটা ঝোপ, তার নীলচে রঙের পাতাগুলো চেহারা ঠিক বড় থালার মতন। নিচু হয়ে ঝোপটার পাতা কেটে একপাশে জড়ো করে সুচেতা। ট্যাটু করা দুহাত কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে দেখেন বায়োলজিস্ট সুজয় বোস।

     থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নিতাই।

     —আরে! এই পাতাগুলোয় করে আমাদের ক্যান্টিনে খেতে দেয় না?

     মুচকি হাসেন সুজয় বোস,

     —ঠিক ধরেছ। এ হল গাছ। কৌস্তূভে থালা গাছে হয়। এক্কেবারে রেডিমেড! পেড়ে নিলেই হয়।

     ভুরু কোঁচকায় নিতাই।

     —তা নয় বুঝলাম। কিন্তু একটা কথা বলুন দিকি, এখানে গাছপাতা সব নীল রঙের কেন? পৃথিবীতে গাছপালা তো সবুজ রঙেরই দেখে এসেছি।

     মাথা তুলে আকাশের দিকে ইঙ্গিত করেন সুজয় বোস।

     —মিহিরের জন্যে। মিহিরের আলোয় নীল আলোর পরিমাণ এত বেশী যে গাছের পাতা তার বেশিরভাগটাই সংশ্লেষের জন্যে ব্যবহার না করে প্রতিফলিত করে ফেরৎ দিয়ে দেয়।

     ঝুঁকে গাছটা খুঁটিয়ে দেখে কৌতূহলী শতদল।

     —পাতার রঙের কারণ তো বুঝলাম। কিন্তু আকার এইরকম গোল থালার মতন কেন?

     ফের মুচকি হাসেন সুজয় বোস।

     —পৃথিবী আর কৌস্তূভের মধ্যে একটা মূল পার্থক্য কি জানো? এখানে কোথাও কোথাও বিবর্তনের পাশা পড়েছে গন্ধের বদলে শব্দের পক্ষে।

     মাথা ঝাঁকায় শতদল।

     —ঠিক বুঝলাম না।

     থালা গাছের দিকে ইঙ্গিত করেন সুজয় বোস।

     —এখানে জীবজগৎ একটা বড় অংশ গন্ধের বদলে কাজে লাগিয়েছে শব্দকে। এই বড় পাতাগুলো সাউণ্ড রিফ্লেক্টরের কাজ করে। শব্দ এতে প্রতিফলিত হয়ে ফেরত যায়।

     মাথা চুলকোয় নিতাই।

     —কিন্তু কি হয় তাতে?

     —পৃথিবীতে যেমন পতঙ্গ বা অন্য জীব ফুল ফলের গন্ধে গাছের দিকে ছুটে আসে, কৌস্তূভে তেমনি তারা আসে শব্দ সন্ধান করে।

     —অনেকটা বাদুড়ের মতন।

     ঘাড় নাড়েন সুজয় বোস।

     —ঠিক। অনেকটা বাদুড়ের মতন। তবে কৌস্তূভে শব্দ সন্ধানী প্রাণীর সংখ্যা পৃথিবীর চাইতে বেশি। ওই দেখো—

     নদীর অন্য পারে চরতে থাকা প্রাণীগুলোর দিকে চোখ তুলে নির্দেশ করেন সুজয় বোস।

     —শামুক সম্বরগুলো দেখো। এককালে হয়তো কোনও শামুক জাতীয় প্রাণী থেকে এদের বিবর্তন হয়েছিল। খোলসটা এদের আর প্রয়োজন নেই, তাই বিবর্তনের ঠেলায় সে-টা পরিণত হয়েছে রেজোন্যান্স চেম্বারে।

     ভালো করে দেখার জন্যে উঠে দাঁড়ায় সুচেতা।

     —কি হয় তাতে?

     —খোলসের ওপরের দিকে ছোট ছোট ছিদ্র আছে। খুব হালকা শব্দও তাদের মধ্যে দিয়ে ঢুকলে খোলসের মধ্যে শব্দের অনুরণন হতে থাকে।

     মাথা নাড়ে সুচেতা

     —মানে সোজা কথায় শামুক সম্বর হালকা শব্দও জোরে শুনতে পারবে।

     —এক্স্যাক্টলি!! লক্ষ করে দেখ মাঝে মধ্যেই পিঠের খোলসটাকে ওরা এদিক সেদিকে ব্যাঁকাচ্ছে। শব্দ ধরার চেষ্টা করছে। কোনও শিকারী পশুর আসার শব্দ ওরা দূর থেকেই শুনতে পাবে।

     আঙুল তুলে ছাতা হরিণের পালের দিকে দেখায় নিতাই।

     —আর ওইগুলো? ওই যে পিঠ বরাবর ছাতার মতন বসানো?

     —যাকে ছাতা বলছ তার উদ্দেশ্য একই। পিঠে বসানো লম্বা লম্বা কাঁটার মতন ফাঁপা হাড়ের মাঝে টানটান করে ঝিল্লীর পর্দা বসানো। ওই পর্দা ঠিক আমাদের কানের পর্দার মতন কাজ করে। ওই ছাতাটা আসলে একটা বৃহৎ কানের মতন।

     ছাতাহরিণের মাঝে চরতে থাকা একটা তেঁতুলে গণ্ডারে দিকে আঙুল তুলে ফের কি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল নিতাই, কিন্তু তার আর সুযোগ হল না। জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে এল কারোর আর্তনাদ আর প্লাজমা রাইফেলের বাজ পড়ার মতন আওয়াজ।

     বিদ্যুৎ বেগে নদীর পার ছেড়ে জঙ্গলের দিকে দৌড়লেন সুজয় বোস। পেছনে নিতাই, শতদল আর সুচেতা।

     জঙ্গলের ভেতর খানিকটা ফাঁকা জায়গা। দু-একটা কাটা গাছ পড়ে আছে মাটিতে। তারই একটাতে ঠেস দিয়ে কাতরায় একজন, তার কাঁধ থেকে অঝোরে ঝরে পড়ে রক্ত। তার আসেপাশে মাটিতে বসে রক্তমাখা শরীরে আর্তনাদ করে আরও কয়েকজন।

     আর এদের মাথার ওপরে ক্রুদ্ধ গুঞ্জন তুলে পাক খায়ে একটা বিশাল আকারের পতঙ্গ। আকৃতিতে সেটা অনেকটা ফড়িঙের মতন হলেও তার গাঁট পাকানো কালো শরীরটা লম্বায় কম করে ফুটখানেক হবে। শরীরের দুপাশে দুটো শিরা-উপাশিরা আঁকা ঘোলাটে ডানা ছড়িয়েছে রয়েছে অন্তত চারফুট জুড়ে। আখরোটের আকারের লোমশ মাথাটায় ইতস্তত বসানো লাল ফুটকির মতন অজস্র চোখ। মাথার দুপাশে দপদপ করে রামধনু রঙা ঝিল্লী, মাথার তলা থেকে উঁচিয়ে থাকে হুকের মতন বাঁকানো একজোড়া দাঁত।

     একটা অস্ফূট ভয়ের শব্দ বেরিয়ে আসে সুজয় বোসের গলা থেকে।

     —সর্বনাশ। এটা কোথা থেকে এলো?

     উড়তে থাকা পতঙ্গের ওপর সাবধানী দৃষ্টি রাখে শতদল।

     —কি এটা?

     —চিল-ফড়িং। ঝাঁকে থাকে। মাথার দুপাশে ঝিল্লী দুটো দপদপ করছে দেখেছ? হাই-ফ্রিকোয়েন্সীতে আওয়াজ করছে। আমরা শুনতে পাচ্ছি না বটে, কিন্তু আওয়াজটা ঝাঁক অবধি গেলে, পুরো ঝাঁকটাই এখানে ছুটে আসবে। সুরিন্দার, এটাকে পেড়ে ফেল। শিগ্‌গির।

     ফের বাজ পড়ার মতন দু-দুটো আওয়াজ হয়। উড়তে থাকা বিশালদেহী পতঙ্গকে লক্ষ্য করে ছুটে আসে লালচে আগুনের দু-দুটো রেখা। কিন্তু লাভ হয় না। কালো হিলহিলে শরীরটাকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে অনায়াসে চিল-ফড়িং পাশ কাটিয়ে যায় দুটো মারণ রেখাকেই।

     —সুরিন্দার, সুরিন্দার -!

     চিৎকার করতে থাকেন সুজয় বোস। গুঞ্জন তুলে বাতাসে ভাসতে থাকে চিল-ফড়িং।

     আর একবার বাজ পড়ার আওয়াজে ছুটে আসে রাইফেলের প্লাজমা। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হয়। একপাশে ছিটকে গিয়ে লালচে রেখাটাকে এড়ায় চিল-ফড়িং, তারপর বিদ্যুৎ বেগে ঝাঁপ দেয় সুজয় বোসের মাথা লক্ষ্য করে।

     কাঁধের ধাক্কায় সুজয় বোসকে দূরে ঠেলে দেয় শতদল।

     লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় চিল-ফড়িং। একটু আগেই যেখানে সুজয় বোসের শরীরটা ছিল ডানার গুঞ্জন তুলে পেরিয়ে যায় সেই জায়গার বাতাস। কিন্তু সুজয় বোসকে সরিয়ে দিয়ে নিজেও টাল সামলাতে পারে না শতদল। পড়ে থাকা একটা গাছের ডালে পা জড়িয়ে সেও হমড়ি খেয়ে পড়ে মাটিতে। হাওয়ায় একটা পাক খায় চিল-ফড়িং, তারপর ঝাঁপ দেয় শতদলের পড়ে থাকা শরীরের দিকে।

     বহুকালের অভ্যাসের বশে নিজের কোমরটা হাতড়ায় শতদল, কিন্তু প্যান্টের রিসাইকেল করা কাপড়ের রুক্ষতা ছাড়া তার হাতে ঠেকে না অন্য কিছু।

     শতদলের কানে আসে সুচেতার অসহায় চিৎকার, দেখতে পায় রাইফেল ছুঁড়ে ফেলে মাটি থেকে একটা যন্ত্র করাত তুলে তার দিকে দৌড়ে আসছে সুরিন্দার, চিল-ফড়িঙের মাথার বিন্দু বিন্দু লাল চোখ আর হুকের মতন দাঁত আরও প্রকট হয়ে আসে তার দৃষ্টিতে, বুঝতে পারে সুরিন্দার পৌঁছনোর আগেই তার শরীরে বসে যাবে ওই দাঁত।

     আড়াআড়ি দুহাতে মাথা ঢেকে শতদল প্রতীক্ষা করে চিল-ফড়িঙের।

     হঠাৎই আর একটা শরীর আছড়ে পড়ে তার দেহের ওপর।

     মুখ দেখা না গেলেও তার বায়োনিক হাতের ধাতব ঝলকানিতে শতদলের বুঝতে অসুবিধে হয় না মানুষটা কে।

     নিতাই।

     নিতাইয়ের উঁচু করে তুলে ধরা বায়োনিক হাতে সজোরে ধাক্কা খায় চিল-ফড়িং। কড় কড় আওয়াজ ওঠে ধাতুতে দাঁত বসানোর ব্যর্থ চেষ্টার। গাঁট বাঁধা লম্বা শরীরটা আছাড়ি-পিছাড়ি করে নিতাইয়ের হাত পেরিয়ে শরীরে ফুটিয়ে দিতে চেষ্টা করে শেষাংশের হুল।

     করাত হাতে সুরিন্দার তখন এগিয়ে এসেছে অনেকটাই। হাতে তার গর্জন করে যন্ত্র করাত।

     —সুরিন্দার!

     একটা চিৎকার করে নিতাই বায়োনিক হাতখানা টেনে আনে বুকের দিকে। তারপর সজোরে এক ঝটকায় ছুঁড়ে দেয় সামনের দিকে।

     পেছনে ছিটকে যায় চিল-ফড়িং।

     দুহাতে ধরা যন্ত্র করাত কাঁধের ওপর থেকে এক ঝটকায় নামিয়ে আনে সুরিন্দার।

     পিচকিরির মতন খানিকটা কীটরস ছড়িয়ে দু-টুকরো হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ে চিল-ফড়িং।

     করাত নামিয়ে হাঁপায় সুরিন্দার। শতদলকে মাটি থেকে টেনে তোলে নিতাই।

     চিল-ফড়িঙের শরীরের পড়ে থাকা টুকরোদুটো ঝুঁকে পরীক্ষা করেন সুজয় বোস।

     —সুচেতা, এটাকে স্যাম্পেলের ব্যাগে ঢোকাও। আর সুরিন্দার, এখানে কাজ বন্ধ করে দাও। কাছাকাছি চিল-ফড়িঙের বাসা আছে কিনা না জেনে আমাদের এখানে কাজ করাটা উচিৎ হবে না। করাতের শব্দে চিল ফড়িঙের ঝাঁক এসে পড়লে কেউ রেহাই পাবো না।

     গাছের ডালের তৈরি স্ট্রেচার আহতদের শুইয়ে সবাই রওনা দেয় সন্তোষগঞ্জের দিকে। কেউ কথা বলে না, যেন এই অতর্কিত আক্রমণে বোবা হয়ে গেছে সবাই।

     কেবল শতদলের দিকে আড়চোখে তাকায় নিতাই। খুব নিচু গলায় বলে,

     —কোমরে যে-টা রাখা অভ্যেস সেটা রাখলেই তো পারো। এখানে চারধারে যা বিপদ।

     সামনের দিক থেকে দৃষ্টি সরায় না শতদল। হালকা মাথা নাড়ে কেবল।

     না! ও জীবন পেছনে ফেলে এসেছি।

 

(৩)

     —বসিয়েছি, বসিয়েছি। নাও, নাও পেরেক মারো।

     লম্বা তক্তাটা খুঁটির গায়ে ঠেসে ধরে শতদলকে নির্দেশ দেয় নিতাই।

     পেরেকের মাথায় দুমদুম আওয়াজে হাতুড়ি মারে শতদল। নীল আকাশ থেকে মাথার ওপরে তাপ ঢালে নীল মিহির।

     চিল-ফড়িঙের ভয়ে জঙ্গলে কাঠ কাটতে যাওয়া আপাতত স্থগিত। সুতরাং অন্য কাজে হাত লাগিয়েছে শতদল। কৌস্তূভে এসে থেকে সুচেতার রাতের আস্তানা বলতে ছিল ক্যান্টিনের মেঝে। নিতাইকে সঙ্গে নিয়ে তাই শতদল লেগে পড়েছে তার জন্যে সন্তোষগঞ্জের এক পাশে একটা ঘর বানাতে।

     ঘর বলতে অবশ্য পাকাপাকি কিছু নয়। জঙ্গলের গাছ থেকে কাটা তক্তা জুড়ে বানানো একটা কাঠের কেবিন মাত্র। কিন্তু তবু কৌস্তূভের ভয়ানক জীবজন্তুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে মাথা গোঁজার এ আচ্ছাদানটুকুর দাম কম নয়।

     পেরেকটাকে শেষবারের মতো ঠুকে তক্তাটাকে বসিয়ে দেয় শতদল। এক পা পেছিয়ে এসে কোমরে হাতে রেখে অর্ধেক তৈরি কুটিরটাকে নজর করে ঘাড় উঁচু করে নিতাই।

     —বেশ দাঁড়িয়েছে কিন্তু!

     গর্বের ছোঁয়া নিতাইয়ের গলায়।

     হাসি চাপে শতদল।

     —আরও অনেক কাজ বাকি কাছে নিতাইদা।

     —আরে কোথায় অনেক কাজ! কেবল বাকি দুটো দেওয়াল আর ছাদটা হলেই তো বাইরেটা হয়ে গেল। তারপরের তো বাকি খালি ভেতরের কাজ।

     এবারে হেসে ফেলে শতদল।

     তা যা বলেছে। সুচেতার বাড়ি তৈরি হয়ে এলই বলে।

     —একদম! কিন্তু সুচেতা দিদি এখনও আমাদের খাবারটা নিয়ে এলো না কেন বলতো?

     তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করবে বলে নিতাই আর শতদল আর ক্যান্টিনে খেতে যায় না। তাদের দুপুরের খাবারটা সুচেতাই নিয়ে আসে।

     —ওই তো আসছে!

     সন্তোষগঞ্জের মেঠো রাস্তায় নজরে পড়ে সুচেতার খাটো, পাতলা চেহারাটা। প্রথমদিনের দেখা সেই অবসাদের ভাবটা তার মুখ থেকে মুছে গেছে অনেকটাই। কামানো মাথা ঢাকা পড়েছে ছোট ছোট চুলে।

     কাছে এসে দাঁড়ায় সুচেতা। মাথা তুলে দেখে বাড়ির কাঠামো।

     —বেশ হচ্ছে কিন্তু!

     বায়োনিক হাতে মুঠো পাকায় নিতাই।

     —তা হবে না? নিতাই দাসের এই হাতে যাদু আছে! তা আমাদের খাবারটা কোথায়? ক্ষিধের চোটে তো গেলাম।

     শতদল খেয়াল করে সুচেতার দু-হাত খালি। অন্যদিন তার হাতে একটা খাবারের চুবড়ি আর জলের বোতল থাকে।

     মাথা নাড়ে সুচেতা।

     —খাবার আনিনি।

     —সে কি? কেন?

     —সুজয়দা গাছকাটা দলের সবাইকে ক্যান্টিনে ডেকে পাঠিয়েছে। খাবার ওখানেই খেয়ে নেবে চলো।

     সুচেতার দিকে তাকায় শতদল।

     —হঠাৎ ডাক পড়ল কেন আমাদের?

     নীলবনে চিল ফড়িঙের বাসার খোঁজ পাওয়া গেছে।

     ক্যান্টিনের চেহারাটা সেই প্রথমদিনের মতনই আছে। এই কয়দিনে কেবল যোগ হয়েছে কয়েকটা কাঠের লম্বা বেঞ্চ আর চেয়ার। একটা টেবিলে রাখা ফুলদানীর আকারের প্রোজেক্টর। তার সামনে দাঁড়িয়ে সুরিন্দার। টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসে ডক্টর শিপ্রা, তাঁর পাশে ট্যাটু করা হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে সুজয় বোস। এদিক ওদিকে টেবিলে বেঞ্চে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আরও কয়েকজন।

     পাতায় খাবার তুলে নিয়ে এসে একটা বেঞ্চে বসে পড়ে নিতাই আর শতদল।

     প্রজেক্টরে হাত রাখে সুরিন্দার। একটা ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে ওঠে প্রজেক্টরের ওপরের বাতাসে। আকাশ থেকে তোলা জঙ্গলের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা একটা টিলার ছবি।

     —এটা আমাদের স্যাটেলাইট থেকে তোলা।

     একটা টিলাতে আঙুল ছোঁয়ায় সুরিন্দার। সরে যায় ছবির বাকি অংশ। কেবল বড় হয়ে ফুটে থাকে সুরিন্দারের ছোঁয়া টিলাটা।

     ভালো করে দেখার জন্যে সামনের দিকে ঝোঁকে শতদল।

     —টিলার গায়ে ওগুলো কি? ছোট ছোট ফোকর মনে হচ্ছে না?

     প্রজেক্টরের ওপর পাক খায় টিলার ত্রিমাত্রিক ছবি। তার সারা গায়ে এবার নজরে আসে অজস্র কালো ফুটকি।

     প্রজেক্টরের দিকে এগিয়ে যান সুজয় বোস।

     —হ্যাঁ। ওই ফোকর দেখে আমাদের সন্দেহ হয়েছিল যে ওটা চিল-ফড়িঙের বাসা। কাল সুরিন্দার তাই একবার নিজে গিয়ে দেখে আসে। এইটা ওর টেলিলেন্সে তোলা ছবি।

     হাত নাড়ায় সুরিন্দার। পাল্টে যায় ছবিটা। ভেসে ওঠে টিলার গায়ের ছবি। যেন খুব কাছে থেকে তোলা। স্পষ্ট দেখা যায় টিলার ফোকর দিয়ে ঢুকছে বেরোচ্ছে চিল-ফড়িং। টিলার চারপাশেও ইতস্তত উড়ে বেড়াচ্ছে তারা।

     প্রজেক্টরটা বন্ধ করে দেন সুজয় বোস।

     —আমরা যেখান থেকে কাঠ জোগাড় করি এই বাসাটা সেখান থেকে খুব দূরে নয়। এখানে কাজ করা অত্যন্ত ঝুঁকির। আমাদের আপাতত এখানে কাজ করা বন্ধ রাখতে হবে।

     একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলেন ডক্টর শিপ্রা।

     —সুজয়, তুমি জানো কাঠ ছাড়া আমাদের চলবে না। যতক্ষণ না আমরা খনিজ ধাতুর খোঁজ পাচ্ছি, কারখানা দাঁড় করাতে পারছি, ততদিন কাঠের ওপর ভরসা করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।

     কাঁধ ঝাঁকান সুজয় বোস।

     —আরও খানিকটা দুরের জঙ্গলে থেকে যোগাড় করা যেতে পারে। আরও পূর্বদিক থেকে। যেখানে অযোধ্যা পাহাড় শেষ হয়েছে।

     কিন্তু অতদূর থেকে আমরা কাঠ বয়ে আনব কি ভাবে? এখন আমরা কাঠ নদীতে ভাসিয়ে নিয়ে আসি।

     উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন সুজয় বোস, কিন্তু তার আর সুযোগ হল না। হঠাৎই নাকে এল ধোঁয়ার কটু গন্ধ, আর অনেকগুলো কণ্ঠে ‘আগুন’, ‘আগুন’ চিৎকার।

     হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে সকলে, ছুট লাগায় চিৎকার যেদিক থেকে আসছে সেদিকে।

     আগুন লেগেছে ক্যান্টিনের পেছনের ডিস্পেন্সারীতে। দাউদাউ করে জ্বলছে কাঠের ছোট বাড়িটা। অনেকজনে মিলে আগুনের ওপর মাটি, জল যা পারছে তাই ছুঁড়ছে বটে, কিন্তু আগুন যেভাবে ধরে গেছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে পুরো বাড়িটা পুড়ে ছাই না হয়ে যাওয়া অবধি আগুন আর নিভবে না।

     মাথায় হাত দিয়ে জ্বলন্ত বাড়ির সামনে পাথরের মতন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন সুজয় বোস। পাংশু মুখে তাকান ডক্টর শিপ্রার দিকে।

     অক্সিজেন টক্সিসিটির ওষুধ সবটাই ডিস্পেনসারিতে রাখা ছিল।

 

(৪)

     রাতে চোখটা সবে বুজে এসেছে শতদলের, টেন্টের গায়ে মৃদু চাপড় পড়ে।

     বাইরে বেরিয়ে আসে শতদল। টেন্টের বাইরে দাঁড়ানো ছায়ামূর্তিকে চিনতে অসুবিধে হয় না। নিতাই।

     —কি ব্যাপার নিতাইদা?

     —চলো! ডাক্তার ম্যাডাম ডেকে পাঠিয়েছেন।

     ঘুমিয়ে পড়েছে সন্তোষগঞ্জ। মাথার ওপর তারা জ্বলা আকাশ, চারপাশে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। ভেসে আসে কেবল নদীর জলের শব্দ আর অজানা পশুর বন্য আওয়াজ। আর তার মাঝে পাণ্ডুর আলো ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অর্ধগোলাকার কন্ট্রোল রুম। যেন আদিম গ্রহের বুকে মানব সভ্যতার একমাত্র আলোকস্তম্ভ।

     কন্ট্রোল রুমে ছড়ানো স্ক্রিন, সুইচ প্যানেল আর যন্ত্রপাতির টেবিলের মাঝে গম্ভীর মুখে বসে থাকেন ডক্টর শিপ্রা। তাঁর একপাশে কপালে চিন্তার রেখা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সুজয় বোস আর নীলেশ পাঠক। অন্যপাশে একটা চেয়ারে বসে নির্লিপ্ত মুখে একটা রাইফেল পরিষ্কার করে সুরিন্দার।

     হাতটা চারদিকে একবার ছড়িয়ে দেন ডক্টর শিপ্রা।

     —শতদল, নিতাই। এ ঘরে যারা রয়েছে, তারা বাদে এই মূহূর্তে তোমাদের ছাড়া আর কারও ওপর ভরসা করতে পারছি না। তাই এত রাতে তোমাদের ডেকে পাঠানো। নিতাইকে আমি আমার ইউনিট থেকেই চিনি, আর শতদল, ডক্টর সুহাসের কাছে তোমার কথা শুনেছি। তুমি উল্লাসের ছোটবেলাকার বন্ধু, তাই না?

     নীরবে মাথা নাড়ে শতদল। উল্লাসের বন্ধু হওয়া ছাড়াও তার আরও একটা অতীত আছে। কিন্তু সেকথা এখন নিষ্প্রয়োজন।

     ভুরু কুঁচকোয় নিতাই।

     —কিছু হয়েছে ম্যাডাম?

     একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলেন ডক্টর শিপ্রা।

     —নিতাই, আমাদের এই পুরো কলোনিটাই মনে হচ্ছে বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর কর্পোরেটতন্ত্রের মুঠোর বাইরে নতুন বসতি শুরু করার আমাদের এই চেষ্টা না শুরুতেই নষ্ট হয়ে যায়।

     —কিসের বিপদ ম্যাডাম? জন্তু-জানোয়ারের? ওই চিল-ফড়িঙের মতন?

     —না নিতাই। ভয় কৌস্তূভের হিংস্র পশুকে নয়, ভয় পৃথিবীর মানুষকে।

     বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকায় নিতাই,

     —ঠিক বুঝলাম না ম্যাডাম।

     পকেট থেকে কি একটা বের করে উঁচু করে তুলে ধরেন সুজয় বোস।

     —এটা কি জানো তো নিতাই?

     —হ্যাঁ। অক্সিজেন টক্সিসিটি ক্যাপ্সুল। সকালেই তো একটা খেয়েছি।

     —হ্যাঁ। যতদিন না আমার জিন থেরাপির কাজ শেষ হচ্ছে ততদিন আমাদের এটা ছাড়া চলবে না। সেইজন্য দুলারী পৌঁছনোর আগে আমি প্রচুর ক্যাপসুল তৈরি করে ডিস্পেন্সারীতে স্টক করে রেখেছিলাম। আজ তার পুরোটাই পুড়ে গেছে। কেউ চায় না যে আমরা কৌস্তূভে টিকে থাকি।

     বাধা দেয় শতদল।

     —কিছু মনে করবেন না সুজয়দা। একটা অজানা গ্রহে আমরা কলোনি বসানোর চেষ্টা করছি। এ ধরণের দুর্ঘটনা ঘটাটা খুব একটা স্বাভাবিক। তার জন্যে আমরা আমাদেরই কলোনীরই লোকেদের অযথা সন্দেহ করছি কেন?

     টেবিল থেকে একটা আধপোড়া ন্যাকড়া তুলে নিতাইয়ের দিকে ছুঁড়ে দেয় সুরিন্দার।

     —দুর্ঘটনা নয়। সাবোটাজ। এটা ডিস্পেন্সারীর পোড়া কাঠের নিচে ছিল।

     হাওয়ায় লুফে নেয় নিতাই কাপড়টা। চোখ তুলে ইঙ্গিত করেন ডক্টর শিপ্রা।

     —শুঁকে দেখো।

     কাপড়টা নাকে ঠেকায় নিতাই। বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে তার দুই চোখ।

     —জেট ফুয়েল!

     মাথা নাড়েন ডক্টর শিপ্রা।

     —হ্যাঁ। ডিস্পেন্সারীতে আগুন ইচ্ছে করেই লাগানো হয়েছে।

     নিতাইয়ের হাত থেকে কাপড়টা নিয়ে পরখ করে শতদল।

     —জেট ফুয়েল এলো কোথা থেকে?

     —খুব সম্ভব দুলারী থেকে। দুলারীর ইঞ্জিন ফিউসন রিঅ্যাক্টরে চলতো বটে, কিন্তু ল্যান্ডিং এর জন্যে ব্যাকআপ হিসেবে কিছুটা জেট ফুয়েলও আমরা নিয়ে এসেছিলাম। সেটা প্রায় পুরোটাই দুলারীতে রয়ে গেছে।

     নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেন নীলেশ পাঠক।

     শতদলের দিকে তাকান সুজয় বোস।

     —আর সেই ফুয়েলও বেশি লাগেনি। অল্প একটু এনে ছিটিয়ে দিতেই কাজ হয়ে গেছে।

     —কেন?

     প্রশ্ন আসে নিতাইয়ের কাছে থেকে।

     বুকের ওপর দুহাত আড়াআড়ি রেখে একটা টেবিলে ঠেস দেন সুজয় বোস।

     —কৌস্তূভের বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি। এখান আগুন পৃথিবীর চাইতে বেশি তাড়াতাড়ি ধরে যায়।

     —কিন্তু এসব ক্ষতি করে কার কি লাভ?

     বিস্মিত কন্ঠে ফের প্রশ্ন করে নিতাই।

     নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেন ডক্টর শিপ্রা।

     —পৃথিবীর অবস্থা তো তুমি জানো নিতাই। সবই বড় কর্পোরেটেদের হাতের মুঠোয় বন্ধ। আইনত কোনও বাধা নেই বটে কিন্তু নতুন কিছু শুরু করতে হলে পদে পদে বাধা আসে।

     ঘাড় নেড়ে সায় দেয় নিতাই।

     —হ্যাঁ বিশেষতঃ মহাকাশ ভ্রমণটা তো কর্পোরেটদের একচেটিয়া অধিকারে।

     —ঠিক বলেছ। পৃথিবীতে আরও অনেকে যদি ডক্টর সুহাসের দেখাদেখি নিজেদের প্রচেষ্টায় মহাকাশে পাড়ি দিতে শুরু করে কি হবে ভেবে দেখেছ।

     ডক্টর শিপ্রার দিকে তাকায় শতদল।

     —মানুষের ওপর বিশাল কর্পোরেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ অনেকটা কমে যাবে।

     —একদম! ডক্টর সুহাসের এই এক্সপেরিমেন্টটা তাই অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়াটা এদের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী।

     —কিন্তু সে তো আমাদের ওরা পৃথিবীতে আটকে দিতে পারতো?

     চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান ডক্টর শিপ্রা।

     —বাধা অনেক দিলেও, প্রথম দিকে আমাদের ওরা বোধহয় আমল দেয়নি। ভেবেছিল আমাদের প্রচেষ্টা মাঝপথেই ব্যর্থ হবে। যখন বুঝতে পারলো আমরা সত্যিই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি, তখন আমাদের সোজাপথে আটকানো আর সহজ কাজ ছিল না।

     ডক্টর শিপ্রার কথায় সায় দেন নীলেশ পাঠক।

     —হ্যাঁ। আমাদের যাত্রা নিয়ে মানুষের মধ্যে এমন উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল যে সরাসরি আমাদের আটকাতে গেলে জনমত কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে চলে যেত।

     হাত মুঠো করেন ডক্টর শিপ্রা।

     —তার চাইতে ভালো যাত্রীদলে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দেওয়া। কৌস্তূভের বুকে কলোনি ধ্বংস হয়ে গেলে পৃথিবীর মানুষ হয় কৌস্তূভের প্রকৃতিকে দোষ দেবে, কিংবা অভিযাত্রীদের অদূরদর্শিতাকে।

     সুজয় বোসের দিকে তাকায় শতদল,

     —সুজয়দা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। অক্সিজেন টক্সিসিটি ওষুধের স্টক তো সব পুড়ে গেল। কাল থেকে চলবে কি করে?

     টেবিলে একটা চাপড় মারেন সুজয় বোস।

     —সেটাই তো চিন্তা। আমাদের ড্রাগ প্রিন্টারের ক্ষমতা বেশি নয়। আদরিণীতে যাত্রী বেশি ছিল না। বাড়তি ওষুধ আমি জমিয়ে স্টক করে রেখেছিলাম। কিন্তু দুলারীতে যত লোক এসেছে, তাতে একদিনে যা ওষুধ তৈরি হবে তা সেইদিনই খরচ হয়ে যাবে।

     —আর ড্রাগ প্রিন্টারটা যদি কোনও ভাবে কেউ নষ্ট করে দেয়, আমরা কৌস্তূভে দিন দুয়েকের বেশি টিকব না।

     ডক্টর শিপ্রার কণ্ঠস্বরে আশঙ্কার ছোঁয়াটা বুঝতে অসুবিধে হয় শতদলের।

     —কাউকে সন্দেহ হয় ম্যাডাম? যে আগুন লাগিয়েছে।

     ডক্টর শিপ্রার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে নিতাই।

     —কয়েক মুহূর্তের জন্যে দৃষ্টি বিনিময় হয় ডক্টর শিপ্রা আর নীলেশ পাঠকের মধ্যে। মাথাটা সামান্য নাড়েন ডক্টর শিপ্রা। নিতাইয়ের দিকে নজর ফেরান নীলেশ পাঠক।

     —দুলারী যাত্রা করার কয়েকদিন আগে একটা যন্ত্রাংশে কিছুটা গলদ ধরা পড়ে। সেজন্যে আমি হন্যে হয়ে তার একটা বদলি যন্ত্র খুঁজতে থাকি। কিন্তু কর্পোরেট কর্তাদের ভয়ে সেটা আমাদের কেউ আর বেচতে চায় না। অবশেষে একজন রাজি হয়, কিন্তু সে শর্ত চাপায় যে যন্ত্রের বদলে তার এক আত্মীয়কে আমাদের সঙ্গে নিতে হবে।

     টেবিল থেকে একট ছবি তুলে নিয়ে নিতাইয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরেন নীলেশ পাঠক।

     —এই সেই লোক। এর নাম বিজন। যন্ত্র পাবার বিনিময়ে আমাদের যাকে সঙ্গে নিতে হয়েছে।

     হাত বাড়িয়ে ছবিটা নেয় নিতাই। ঝুঁকে পড়ে বিজনের চেহারাটা দেখে শতদলও। অল্প বয়েস, গোঁফ দাড়ি কামানো, চেহারায় তেমন কোনও বিশেষত্ব নেই।

     —প্রথমে ভেবেছিলাম ব্যাপারটা একরকমের ঘুষ। আমাদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে জোর করে কৌস্তূভ পাড়ি দেওয়ার সুযোগ আদায় করে নেওয়া। উপায় ছিল না বলে তখন রাজীও হয়েছিলাম। কিন্তু আজকের ঘটনার পর সন্দেহ হচ্ছে, এ আসলে কর্পোরেটের চর নয়তো।

     —আমাদের কি করতে হবে ম্যাডাম?

     এগিয়ে এসে নিতাইয়ের কাঁধে হাত রাখেন ডক্টর শিপ্রা।

     —কাল তুমি, আমি আর শতদল মিলে এই বিজনকে খুঁজে বের করবো। এ সত্যি কর্পোরেটের চর কিনা, ওর দলে ও ছাড়া আর কেউ আছে কি না, থাকলে তাদের মতলব কি আমাদের জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।

     সুরিন্দারের দিকে চোখ তুলে ইঙ্গিত করে শতদল।

     —কিছু মনে করবেন না ডক্টর। সুরিন্দার ক্যাম্পের সিকিউরিটি ইনচার্জ। এ কাজের জন্যে আপনি আমাদের ডেকেছেন কেন।

     —সুরিন্দারকে ক্যাম্পের সবাই চেনে শতদল। কর্পোরেট চর যদি কেউ থাকে ওকে দেখলেই সাবধান হয়ে যাবে। আর তা ছাড়া—

     হাতের রাইফেলে খটাস শব্দ তুলে পাওয়ার ক্লীপ পরায় সুরিন্দার। কৌস্তূভের রাত্রির নির্জনতায় আওয়াজটা কানে বাজে বিস্ফোরণের মতন।

     আর তা ছাড়া কাল থেকে সুরিন্দারের প্রধান কাজ ড্রাগ প্রিন্টারটা পাহারা দেওয়া। কোনওভাবে ওটা নষ্ট হয়ে গেলে কৌস্তূভে আমাদের আয়ু বড়জোর চব্বিশ ঘন্টা।

 

(৫)

     —এটা এখানেই থাক। এটাকে হঠাৎ বয়ে বেড়ালে লোকে সন্দেহ করবে।

     সুরিন্দারের দেওয়া রাইফেলটাকে দেওয়ালের গায়ে হেলিয়ে রেখে কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে আসে শতদল। সঙ্গে ডক্টর শিপ্রা আর নিতাই।

     বাইরে বেরিয়ে এসে ভুরু কুঁচকোয় নিতাই। ডক্টর শিপ্রা দু-কদম এগিয়ে যেতে নিম্নকণ্ঠে বলে,

     —এত অনীহা কেন? মনে তো হয় না যে চালাতে জানো না।

     একটা করুণ হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায় শতদলের ঠোঁটের কোনে।

     —বললাম না! ও জীবন পেছনে ফেলে এসেছি।

     কিছুক্ষণ সন্তোষেগঞ্জের রাস্তায় এদিক সেদিক হাঁটে তিনজনে কিন্তু বিজনের দেখা মেলে না। দুলারী থেকে নামার পর যাত্রীরা ক্যাম্পের চারপাশে যে যার মতন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আস্তানা করে নিয়েছে। কেউ টেন্টে, কেউ নিজেদের বানানো কাঠের কেবিনে, কেউ মহাকাশযানের নানা টুকরো-টাকরা জোড়া কুটিরে। আগে থেকে না জানলে কাউকে খুঁজে পাওয়া সেখানে সোজা নয়।

     থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন শিপ্রা।

     —নাঃ! এইভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

     —একে তাকে জিজ্ঞেস করবো ম্যডাম?

     প্রশ্ন করে নিতাই।

     —না। লোকে সন্দেহ করবে। লোকে প্রশ্ন করতে আরম্ভ করলে আমরা সামলাতে পারবো না।

     হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যায় শতদলের।

     —থাকুক যেখানেই, খাবার খেতে যদি ক্যান্টিনে যায় তাহলে সুচেতা নিশ্চয়ই চিনবে।

     হেসে শতদলের পিঠ চাপড়ে দেয় নিতাই।

     —একদম ঠিক বলেছ। একথাটা আমার মাথায় এতক্ষণ আসেনি কেন কে জানে! চলো ক্যান্টিনের দিকে যাওয়া যাক।

     শতদলের দেখানো ছবিটা একনজর দেখেই চিনতে পারে সুচেতা।

     —হ্যাঁ, একে তো দেখেছি। ক্যান্টিনে খেতে আসে।

     —কোথায় থাকে জানো?

     দক্ষিণের দিকের একটা ঘর থেকে একবার বেরোতে দেখেছিলাম। চলো দেখিয়ে দিচ্ছি।

     শতদলের মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও সুচেতা পা বাড়ায় তাদের সঙ্গে।

     কিন্তু বিজনের ঘর অবধি যাওয়া হয় না শতদলের। ক্যান্টিন ছাড়িয়ে খানিকটা যেতেই হঠাৎ কানে আসে মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার আর কোনও অচেনা পশুর জান্তব আওয়াজ।

     —আবার কি ফ্যাসাদ হল!

     আওয়াজ লক্ষ্য করে দৌড়ন ডক্টর শিপ্রা। পিছু নেয় বাকিরা।

     কয়েকটা কাঠের বাড়ি আর কেবিনের এদিক সেদিক দৌড়ে আচমকাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েন ডক্টর শিপ্রা।

     সন্তোষগঞ্জের এই জায়গয়াটায় কোনও ঘর নেই। কেবল দুলারী থেকে নামানো বড় বড় বাক্সের মতন সব কন্টেনার থাকে থাকে সাজানো রয়েছে গোল করে।

     শতদলের নজরে পড়ে কন্টেনারের গায়ে লেপ্টে দাঁড়িয়ে কিছু নারী পুরুষ, চোখ তাদের আতঙ্কে বিষ্ফারিত। আর তাদের সামনের ফাঁকা জমিতে সদর্পে চলে বেড়াচ্ছে একটা অদ্ভুতদর্শন জীব। দুটো খাটো থামের মতন পায়ের ওপর বসানো একটা ইঁদুরের মতন লম্বাটে চেহারা। লম্বায় তা কম করে ফুট দেড়েক হবে। সামনের দুটো খাটো পা শেষ হয়েছে দু-দুটো ইঞ্চি খানেক লম্বা নখে। মুখের গোল ফুটোর চারপাশ ঘিরে সারি দিয়ে বসানো হুকের মতন দাঁত। মাথায় বসানো ঝিনুকের মতন খোলস। ল্যাজটা ধনুকের মতো গোল হয়ে ঝুলে রয়েছে পিঠের ওপর। তার শেষপ্রান্তে চকচক করে একটা বাঁকানো হুল।

     একটা অস্ফূট গালাগাল বেরিয়ে আসে ডক্টর শিপ্রার মুখ দিয়ে।

     —বিছে-ইঁদুর!

     পশুটার বীভৎস মুখের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে কর্কশ চিৎকার। ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে কন্টেনারের গায়ে লেপ্টে থাকা দু-একজন।

     মাথা নিচু করে বিছে-ইঁদুর মাথায় বসানো ঝিনুকের মতন খোলসটাকে ঘোরায় এদিক সেদিক। তারপর দুই পায়ে তেড়ে যায় যেদিক থেকে আওয়াজ এসেছিল সেদিকে। চিৎকার করে তার পথ থেকে ছিটকে যায় মানুষ।

     জন্তুর মাথার ওপরের ঝিনুকের মতন আচ্ছাদনটাকে লক্ষ করে শতদল। চকিতে তার মনে পড়ে যায় আগের দিনে সুজয় বোসের কাছে শোনা কথাগুলো।

     —চেঁচাবেন না, চেঁচাবেন না। ওটা আওয়াজ লক্ষ করে আক্রমণ করছে, যতটা পারেন নিঃশব্দে সরে যান।

     থেমে যায় ভয়ার্ত চিৎকার। পা টিপে টিপে ফাঁকা জায়গাটা ছেড়ে সরে যেতে থাকে লোকজন।

     বুটের ভেতর থেকে একটা ছোরা টেনে বের করেন ডক্টর শিপ্রা।

     —ল্যাজের হুলটা থেকে সাবধান শতদল। ওর বিষের কোনও অ্যান্টিডোট আমাদের কাছে নেই। লাগলে মৃত্যু অবধারিত।

     ডক্টর শিপ্রার গলার আওয়াজে এবার তাঁর দিকে ক্ষিপ্র গতিতে তেড়ে যায় বিছে-ইঁদুর। ওপরের পায়ের লম্বা নখ চালিয়ে দেয় তাঁর শরীর লক্ষ করে।

     একটা পায়ের নখ ছোরা দিয়ে আটকান বটে ডক্টর শিপ্রা, কিন্তু অন্য পায়ের নখ দিয়ে বিছে ইঁদুর একটানে ফেড়ে দেয় তাঁর বাঁ হাতের বাহুমূল থেকে কনুই অবধি।

     যন্ত্রনায় চিৎকার করে ওঠেন শিপ্রা, চেষ্টা করেন পেছনে হটে যেতে, কিন্তু টাল সামলে পড়ে যান চিৎ হয়ে।

     আরও কাছে লাফিয়ে চলে যায় বিছে ইঁদুর, ল্যাজটাকে বেঁকিয়ে চেষ্টা করে তাঁর পড়ে যাওয়া শরীরের হুল বিঁধিয়ে দিতে।

     লাফ দেয় নিতাই। বায়নিক হাতটা বাড়িয়ে দেয় বিছে-ইঁদুরের হুলের সামনে। একটা ধাতব আওয়াজ করে হাতে লেগে ছিটকে যায় ব্যর্থ হুল, কর্কশ শব্দ করে বিছে ইঁদুর সামনের নখ চালায় নিতাইয়ের গলার দিকে।

     ছুটে যায় শতদল, সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারে জন্তুটার পাঁজরে।

     দুটো পাক খেয়ে খানিকটা দূরে ছিটকে পড়ে বটে বিছে ইঁদুর, কিন্তু সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। সামনের পা দুটো শরীরের দুপাশে ছড়িয়ে দিকে ভয়ানক চিৎকার করে ওঠে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে।

     ক্ষতস্থান চেপে ধরে হাঁপান ডক্টর শিপ্রা।

     খালি হাতে এর সঙ্গে পারা যাবে না। সুচেতা! কন্ট্রোল রুম থেকে রাইফেল নিয়ে এসো! জলদি!

 

(৬)

     উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে এসে কন্ট্রোলরুমের দরজায় প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে সুচেতা।

     —রাইফেল! রাইফেলটা চাই!

     কেউ উত্তর দেয় না বটে কিন্তু কন্ট্রোলরুমের দেওয়ালে হেলান দেওয়া রাইফেলটা নজর এড়ায় না তার।

     শরীরের ধাক্কায় দু-একটা চেয়ার এদিক ওদিক ছিটকে দিয়ে রাইফেলের দিকে হাত বাড়ায় সুচেতা। কিন্তু রাইফেলটা ছোঁওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই তার মাথায় শক্ত কিছুর আঘাত পড়ে। আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সুচেতা, তার চোখের সামনে একটা কালো পর্দা নেমে আসে যেন।

     চোখ খোলে যখন সুচেতা তখন তার শরীরে কেমন একটা আচ্ছন্ন ভাব, দৃষ্টি ঝাপসা।

     ধীরে ধীরে কেটে যায় ঘোর লাগা ভাবটা, দৃষ্টিও পরিষ্কার হয়ে আসে। সুচেতা বুঝতে পারে সে পড়ে রয়েছে মাটিতে। তার হাত বাঁধা পিছমোড়া করে, বাঁধা পা দুটোও।

     মাথা ঘুরিয়ে কন্ট্রোলরুমের চারপাশটা দেখার চেষ্টা করে সুচেতা। এতক্ষণে তার নজরে পড়ে একটা টেবিলের পেছনে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছেন নীলেশ পাঠক। তাঁর রক্তে ভেজা চুলগুলো লেপ্টে রয়েছে মাথার সঙ্গে।

     মাথাটা আর এক দিকে ঘোরায় সুচেতা। একটা টেবিলের ওপর ভাসে আলোয় গড়া কম্পিউটারের ভার্চুয়াল স্ক্রীন। টেবিলের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো একটা ধাতুর ডাণ্ডা, তার এক প্রান্তে লেগে রয়েছে রক্তের ছোপ।

     আর টেবিলের সামনে একটা চেয়ারে বসে কম্পিউটারে মনোযোগ দিয়ে কাজ করে চলে যে লোকটা, একটু আগে তাকেই খুঁজছিল শতদল, নিতাই আর ডক্টর শিপ্রা।

     বিজন।

     চিৎকার করতে গিয়ে সুচেতা বুঝতে পারে তার মুখ বাঁধা। কোথা থেকে একটা কান্না উঠে এসে আটকে যায় তার গলার কাছে। মনে পড়ে যায় অনেকদিন আগে এইভাবেই অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকার কথা। আচ্ছন্ন ভাবটা যেন আবার ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিতে চায় তাকে।

     মাথা ঝাঁকায় সুচেতা। অবসাদে ডুবে যাবার সময় এটা নয়। কৌস্তূভে এসেছিল সে নতুন করে সব শুরু করার জন্যে। পুরানো ভয়কে আঁকড়ে থাকার জন্যে নয়। এই মূহূর্তে প্রাণ হাতে নিয়ে লড়াই করছে যে তিনটে মানুষ সময় মতো রাইফেল না নিয়ে পৌঁছতে পারলে তারা কেউ বাঁচবে না।

     আর একবার চারপাশ খুঁটিয়ে দেখে সুচেতা। নজরে পড়ে একটা উলটে পড়ে থাকা চেয়ারের পায়া থেকে বেরিয়ে আছে একটা ধাতুর পাত।

     ধীরে ধীরে চেয়ারটার দিকে সরে সুচেতা, উঁচিয়ে থাকা পাতে ঘষতে থাকে হাতের বাঁধন।

     বিজন কম্পিউটারে ব্যস্ত নিজের কাজ নিয়ে। সুচেতার নড়াচড়া টের পায় না।

     হাতটা বিজন খুব সম্ভব বেঁধেছিল কাপড় বা ন্যাকড়া দিয়ে। ধাতুর পাতে কিছুক্ষণ ঘষতেই ফেঁসে যায় তার খানিকটা।

     অল্প হাত নাড়িয়ে চাড়িয়ে বাকি বাঁধনটাও খুলে ফেলে সুচেতা। শরীরটাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা রাইফেলটার কাছে।

     কম্পিউটের ভার্চুয়াল স্ক্রিন বন্ধ করে দেয় বিজন। উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে।

     রাইফেলের দিকে হাত বাড়ায় সুচেতা।

     আর সেই মূহূর্তেই তার পা আটকে যায় একটা টেবিলে।

     শব্দ করে নড়ে ওঠে টেবিল। চমকে পেছন ফেরে বিজন, তার দৃষ্টি পড়ে সুচেতার বাঁধন খোলা হাতের ওপর।

     লাফিয়ে আসে বিজন আসে সুচেতার দিকে, তার বেঁধে রাখা পা দুটো ধরে হিড়হিড় করে সরিয়ে আনে রাইফেলের কাছ থেকে, তারপর টেবিলের পাশে রাখা ডাণ্ডাটা তুলে নিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে তার থাকে শরীরে।

     হাত দিয়ে কয়েকটা আঘাত কোনওরকমে বাঁচায় সুচেতা। তারপর বাঁধা পা দুটো উঁচুতে তুলে সজোরে লাথি মারে বিজনের বুকে।

     পেছনে ছিটকে যায় বিজন, হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড।

     তারপর একটা ক্রুদ্ধ চিৎকার করে লাফিয়ে পড়ে সুচেতার ওপর। বুকের ওপর বসে ডাণ্ডাটা দুহাতে ধরে তাই দিয়ে চেপে ধরে তার গলা।

     নিঃশ্বাস আটকে আসে সুচেতার, চোখের সামনে নেমে আসতে থাকে অন্ধকার, সে বুঝতে পারে একটু একটু করে লোপ পাচ্ছে তার চেতনা।

 

(৭)

     —এটা ধরো!

     শতদলের দিকে হাতের ছুরিটা ছুঁড়ে দেন ডক্টর শিপ্রা। হাতের ক্ষতস্থান চেপে ধরে সরে যান একপাশে।

     ইচ্ছে না থাকলেও ছুরিটা হাওয়ায় লুফে নেয় শতদল। মুঠোয় বাঁটটা চেপে ধরতেই কেমন একটা শিরশিরানি ছড়িয়ে যায় তার শরীরে। বহুকালের প্রয়াসে গড়া প্রবৃত্তিগুলো যেন ছটফটিয়ে জেগে উঠতে চায়। এক অদ্ভুত শিহরণ নেমে যায় শিরদাঁড়া দিয়ে।

     হাঁটু সামান্য ভাঁজ করে, পিঠ ঝুঁকিয়ে দাঁড়ায় শতদল। ছুরি ধরা হাতটা বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে।

     সামনের পায়ের লম্বা নখগুলো উঁচিয়ে তেড়ে আসে বিছে ইঁদুর। তার লম্বা হুল সমেত লেজটা চাবুকের মতন দোলে ডাইনে বাঁয়ে।

     পা দুটো মাটিতে গেঁথে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শতদল।

     জন্তুটা যখন একেবারে তার ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে, হঠাৎই পা দুটো সামনে করে শরীরটাকে চিৎ করে মাটিতে ফেলে দেয় শতদল। বিছে ইঁদুরের বাড়ানো থাবা হাওয়া কাটে কেবল, তার দেহটা দৌড়ে যায় শতদলের শুয়ে থাকা শরীরের পাশ দিয়ে।

     ছুরিধরা হাতটা বিছে ইঁদুরের দৌড়ে যাওয়া শরীরের দিকে তুলে ধরে শতদল। ছুরির ধারে তার লম্বাটে দেহ বরাবর চড়চড় করে কেটে যায় চামড়া, ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে নীল রঙের রক্ত।

     মাটি থেকে স্প্রিঙের মতন লাফিয়ে ওঠে শতদল। ছিটকে সরে যায় একদিকে।

     কর্কশ স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে বিছে ইঁদুর। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চেষ্টা করে শরীরের আঘাতটাকে।

     জন্তুটার দৃষ্টি এড়িয়ে এবার উল্টোদিক থেকে দৌড়ে আসে নিতাই, বায়োনিক হাতের অমানুষিক শক্তিতে ঘুষি মারে তার দেহে। সে ভয়ানক আঘাতে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ে বিছে ইঁদুর।

     ফাঁকা জায়গাটার দুদিকে দাঁড়িয়ে হাঁপায় নিতাই আর শতদল। নজর তাদের বিছু ইঁদুরের ওপর।

     গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় বিছে ইঁদুর, মাথা তুলে আকাশের দিকে ছড়িয়ে দেয় কর্কশ চিৎকার।

     ছুরি সমেত হাত এগিয়ে ধরে শতদল। বায়োনিক হাত মুঠো করে নিতাই। দুজনেই প্রস্তুত হয় বিছে-ইঁদুরের পরবর্তী আক্রমণের জন্য।

     হঠাৎই দু-দুটো আওয়াজ হয় বাজ পড়ার মতন। দুটো আগুনের রেখা এসে ধাক্কা খায় বিছে ইঁদুরের মাথায়। একটা পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে যায় বাতাসে।

     মাটিতে আছড়ে পড়ে বিছে-ইঁদুর। আর ওঠে না।

     ঘুরে তাকায় নিতাই আর শতদল।

     সুরিন্দার! কাঁধে রাইফেলের স্টক, চোখ স্কোপে, তর্জনী ট্রিগারে।

     উঠে দাঁড়ান ডক্টর শিপ্রা।

     —তুমি এখানে কি করে সুরিন্দার? তুমি ড্রাগ প্রিন্টারের পাহারায় ছিলে না? সুচেতা কোথায়?

     কাঁধ থেকে রাইফেল নামায় সুরিন্দার।

     —সুচেতা কোথায় জানি না। লোকের মুখে খবর পেয়ে ছুটে এসেছি।

     —এই জন্তুটা ক্যাম্পের মধ্যে এল কি করে? এটা তো জঙ্গলের ভেতরে থাকে।

     মৃত বিছে ইঁদুরের দেহটাকে ঝুঁকে দেখেন ডক্টর শিপ্রা।

     নিচু হয়ে বায়োনিক হাত দিয়ে বিছে ইঁদুরের দেহটাকে নেড়ে চেড়ে দেখে নিতাই। হঠাৎ কিছুতে চোখ আটকে যায় তার। পশুটার গলার লোমের মধ্যে আঙুল চালিয়ে তুলে আনে ছোট একটা কিছু।

     —এটা দেখুন ডক্টর ম্যাডাম!

     —ট্র্যাঙ্কুলাইজার ডার্ট!

     নিতাইয়ের হাতের জিনিসটা দেখে বিস্ময় চাপতে পারেন না ডক্টর শিপ্রা।

     —এটাকে তাহলে কেউ জঙ্গল থেকে অজ্ঞান করে ধরে এনে ক্যাম্পে ছেড়ে দিয়ে গেছে! কিন্তু কেন?

     বিস্ময় নিতাইয়ের গলাতেও।

     কারনটা চকিতে বুঝতে পারে শতদল।

     —ডাইভার্সন। আমাদের অন্য দিকে আটকে রাখার কায়দা। যাতে অনায়াসে অন্য কোথাও একটা সাবোটাজ করা যায়।

     বিস্ফারিত চোখে সুরিন্দারের মুখের দিকে তাকান ডক্টর শিপ্রা।

     —ড্রাগ প্রিন্টার! তুমি ড্রাগ প্রিন্টারের পাহারা ছেড়ে চলে এসেছ।

     সবাই মিলে দৌড় লাগায় ওষুধ তৈরীর কেবিনের দিকে।

     ওষুধ তৈরির কেবিনে রাইফেল হাতে পাহারায় তিন-চারজন। ভেতরে একমনে কাজ করেন সুজয় বোস। সবাই একসঙ্গে দৌড়ে আসায় খানিকটা অবাকই হন তিনি।

     না, এখানে তো কোনও ঝামেলা হয়নি!

     কপাল কুঁচকোয় নিতাই।

     আর সুচেতাই বা কোথায় গেল। রাইফেল আনতে গিয়ে এখনও ফিরলো না কেন?

     না ফেরার কারণটা হঠাৎ দিনের আলোর মতন স্পষ্ট হয়ে যায় শতদলের কাছে।

     সুচেতা! সুচেতা কন্ট্রোল রুম থেকে ফেরেনি। ওই কন্ট্রোল রুমেই কেউ কিছু স্যাবোটেজ করছে।

     সবাই মিলে ফের দৌড়য়। এবারে কন্ট্রোল রুমের দিকে।

 

(৮)

     মেঝেতে অসম যুদ্ধ প্রায় হেরে এসেছে সুচেতা। ডাণ্ডা দিয়ে তার শ্বাস রোধ করে রেখেছে বিজন, মুখ তার ক্রোধে বিকৃত। প্রাণপণ শক্তিতে ঠেলেও গলা থেকে ডাণ্ডার চাপ সরাতে পারছে সুচেতা।

     হঠাৎ খুলে যায় কন্ট্রোল রুমের দরজা। হুড়মুড় করে ঢুকে আসে শতদল, নিতাই, সুরিন্দার আর ডক্টর শিপ্রা।

     কিছুক্ষণের যেন থেমে যায় সময়। স্ট্যাচুর মতন দাঁড়িয়ে পড়ে চারজনেই। যেন সুচেতার আর বিজনের দ্বৈরথের দৃশ্য কেড়ে নিয়েছে তাদের নড়ার ক্ষমতা।

     কিন্তু সে কেবল কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে। একটা হুঙ্কার ছেড়ে সামনে দৌড়ে যায় নিতাই, বিজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বায়োনিক হাতে তার গলা ধরে তুলে ধরে শূন্যে, তারপর ছুঁড়ে ফেলে দূরে।

     —নিতাই! নিতাই! ওকে আমাদের দরকার! নিতাই! নিতাই! ছেড়ে দাও!

     পেছন থেকে চিৎকার করতে থাকেন ডক্টর শিপ্রা।

     কিন্তু নিতাই যেন শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেছে তখন। ডক্টর শিপ্রার নিষেধকে আমলে না এনে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজনের ওপর। বুকে হাঁটু দিয়ে তাকে মেঝের ওপর চেপে ধরে, বায়নিক হাতে ঘুষির পর ঘুষি মারতে থাকে তার মাথায়।

     কয়েক মিনিটে বাদে শতদল আর সুরিন্দার মিলে যখন নিতাইকে বিজনের ওপর থেকে হিঁচড়ে টেনে এনে ডক্টর শিপ্রার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় তখন বিজনের মাথাটা আর চেনার উপায় নেই। শুধু রক্ত আর ব্রেন ম্যাটারে মাখামাখি একটা মাংসপিন্ড ছড়িয়ে রয়েছে মেঝের ওপর।

     চোখে আগুন জ্বলে ডক্টর শিপ্রার। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপায় নিতাই।

     বিজনকে আমাদের দরকার ছিল নিতাই। এই ষড়যন্ত্রে আর কেউ সামিল আছে কি না, তারা কে, এসব খবর আমরা বিজনের কাছে থেকে বের করতে পারতাম। কিন্তু আফশোষ, তুমি তার উপায় রাখলে না।

     উত্তর দেয় না নিতাই। কেবল একবার তাকায় মাটিতে বসে থাকা সুচেতার ওপর। হাতের ছোরাটা দিয়ে শতদল তখন তার পায়ের বাঁধন কাটছে।

     নিতাইয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সুচেতার দিকে তাকান ডক্টর শিপ্রা, চোখের চাহনি কিছুটা নরম হয়ে আসে তাঁর।

     —নিতাই, জানি তোমার মেয়ে থাকলে আজ সুচেতার বয়সী হত। তোমার রাগের কারণটা তাই বুঝতে পারি। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতে নিজেদের যদি সামলে না রাখতে পারি তাহলে আমরা কৌস্তূভে টিকতে পারবো না। আমাদের সামনে এখনও অনেক লড়াই বাকি আছে।

     অবাক চোখে সুচেতা তাকায় নিতাইয়ের দিকে।

     —নিতাইদার মেয়ে! আমার মতো! কি হয়েছিল নিতাইদা তোমার মেয়ের?

     একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নিতাই।

     —যেবারে খাবারের আকাল দেখা দিল, সে সময়ে আমি ফ্রন্টে। মেয়েটা বাড়িতে একাই ছিল। সরকারী দোকান থেকে চাল আনতে গিয়ে আর ফেরেনি। খুব সম্ভব রেশন মাফিয়াদের হাতে—

     জল চিকচিক করে নিতাইয়ের চোখের কোনায়। অস্বস্তি এড়াতে অন্যদিকে তাকায় সে।

     কে জানে কেন, মাথা ঘুরিয়ে নেয় শতদলও। তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হয়ে পড়ে নীলেশ পাঠকের বাঁধন কাটতে।

     উঠে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় সুচেতা।

     —ম্যাডাম, আমি যখন কন্ট্রোল রুমে এসে পৌঁছই তখন বিজন এই টেবিলে বসে কম্পিউটারে কিছু করছিল।

     দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ে ডক্টর শিপ্রার মুখে।

     —নীলেশ, একবার দেখো এদিকে!

     মাথার গড়িয়ে পড়া রক্ত জামার হাতায় মোছেন নীলেশ পাঠক। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়েন ভার্চুয়াল স্ক্রিনের সামনে।

     স্ক্রীনে ফুটে ওঠে নানা সংখ্যা আর লিপির আঁকিবুঁকি। ঝুঁকে পড়ে তার কয়েকটা দেখেই চমকে ওঠেন নীলেশ পাঠক।

     —ভাইরাস! আমাদের সিস্টেমে বিজন ভাইরাস ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।

     —কি ভাইরাস? কি করছে সেটা?

     স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বোঝার চেষ্টা করেন ডক্টর শিপ্রা।

     পাংশু মুখে থরথর করে কাঁপেন নীলেশ পাঠক।

     —ভাইরাস সরাসরি আমাদের ক্যাম্পের ফিউশন রিঅ্যাক্টরকে আক্রমণ করছে। একে না আটকাতে পারলে বিস্ফোরণে উড়ে যাবে রিঅ্যাক্টর। ক্যাম্পশুদ্ধু উড়ে যাবো আমরাও।

 

(৯)

     —অসম্ভব! ক্যাম্প সন্তোষগঞ্জ থেকে অন্য কোথাও উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

     টেবিলে সজোরে চাপড় মারেন ডক্টর শিপ্রা।

     —একবার ভেবে দেখ শিপ্রা। রিঅ্যাক্টর যদি উড়ে যায় সন্তোষগঞ্জ একটা বিশাল ক্রেটারে পরিণত হবে। আমরা কেউই বাঁচবো না।

     অনুনয় ঝরে পড়ে নীলেশ পাঠকের কণ্ঠে।

     সজোরে মাথা ঝাঁকান শিপ্রা।

     —বরং তুমিই একবার ভাবো নীলেশ। মানুষগুলোকে না হয় আমরা দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এত সরঞ্জাম সরাবে কী করে? যন্ত্রপাতি ছাড়া আমরা কৌস্তূভে চব্বিশ ঘন্টাও টিকতে পারবো না।

     —এক সেকেণ্ড নীলেশ।

     ট্যাটু করা হাত নীলেশ পাঠকের কাঁধে রাখেন সুজয় বোস। একটু আগেই সুরিন্দার ডেকে এনেছে তাঁকে।

     —ঠিক কি হয়েছে, বা হতে কি চলেছে আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে?

     ভার্চুয়াল স্ক্রীনের দিকে তাকান নীলেশ পাঠক। নীল আলো পড়ে তাঁর ফাকাশে মুখে।

     —তুমি জানো সন্তোষগঞ্জের বিদ্যুৎ আসে ফিউসন রিঅ্যাক্টর থেকে।

     —হ্যাঁ জানি। আদরিণীতে আমরা একটা ছোট রিঅ্যাক্টর নিয়ে এসেছিলাম। সেটাকে আদরিণীর পুরানো কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে জুড়ে চালানো হচ্ছে।

     —এই রিঅ্যাক্টরের মর্মকেন্দ্রের তাপমাত্রা ঠিকঠাক রাখতে হয়। উত্তাপ পড়ে গেলে রিঅ্যাক্টর বন্ধ হয় যাবে, আর বেশী গরম হয়ে গেলে উড়ে যাবে পরমাণু বিস্ফোরণে। সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখে রিঅ্যাক্টরের ভেতরে একসারি ফ্যান। সেগুলোকে আবার নিয়ন্ত্রণ করে এই কন্ট্রোল রুমের সিস্টেম। দরকার মতো ফ্যানকে কখনও আস্তে আবার কখনও বা জোরে করে।

     কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে পড়েন সুজয় বোস।

     —এসব আমরা জানি নীলেশ। কিন্তু এর সঙ্গে ভাইরাসের কি সম্পর্ক?

     —ভাইরাসটা বসে আছে কন্ট্রোল সিস্টেম আর রিঅ্যাক্টরের মাঝখানে। সেটা কন্ট্রোল সিস্টেমকে সঠিক তাপমান না জানতে দিয়ে ভুল বুঝিয়ে চলেছে যে রিঅ্যাক্টরের উত্তাপ ঠিকঠাকই আছে। তার ভিত্তিতে কন্ট্রোল সিস্টেম কমিয়ে রেখেছে ফ্যানের স্পিড। এদিকে ফ্যানগুলো আস্তে চলাতে তেতে উঠছে রিঅ্যাক্টর, আস্তে আস্তে তার তাপ পৌঁছে যাচ্ছে বিপদসীমার কাছে।

     —রিঅ্যাক্টর বন্ধ করে দিলে হয় না? তাহলেই তো ঝামেলা চুকে যায়।

     নীলেশ পাঠকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে শতদল।

     ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন নীলেশ পাঠক।

     —নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন ওইভাবে একটা সুইচ টিপে বন্ধ করা যায় না। রিঅ্যাক্টর বন্ধ করতে গেলে আগে ওর তাপমাত্রা নামিয়ে আনতে হবে। আর সেটা করতে গেলে সিস্টেমকে ভাইরাস মুক্ত করাটা জরুরী।

     —আমি চেষ্টা করে দেখবো?

     কন্ট্রোল রুমের এক কোন থেকে ভেসে আসে প্রশ্নটা।

     অবাক দৃষ্টিতে একই সঙ্গে তাকায় সবাই।

     —প্রশ্নটা এসেছে সুচেতার কাছে থেকে।

     —তুমি! তুমি রিঅ্যাক্টরের সিস্টেম জানো?

     বিস্ময় চেপে রাখতে পারেন না ডক্টর শিপ্রা।

     কেমন জড়সড় হয়ে পড়ে সুচেতা।

     —না রিঅ্যাক্টরের ব্যাপারে কিছু জানি না। কিন্তু ভাইরাস সাফ করা যায় কিনা চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমি, আমি—

     কোনও এক অজানা কুণ্ঠায় যেন বাকরোধ হয়ে আসে সুচেতার।

     —আমি পৃথিবীতে থাকতে কম্পিউটার নিয়ে কাজ করতাম।

     বাকি কথাটুকু তাড়াহুড়ো করে শেষ করে সে।

     নীলেশ পাঠকের দিকে তাকান ডক্টর শিপ্রা।

     —সুচেতাকে একবার চেষ্টা করে দেখতে দেবে নাকি?

     —আমার কোনও আপত্তি নেই। সুজয়?

     কাঁধ ঝাঁকান সুজয় বোস

     —চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি! এমন তো নয় যে আমাদের হাতে আরও অনেক সমাধান আছে।

     ঘাড় নেড়ে ইঙ্গিত করেন ডক্টর শিপ্রা, কম্পিউটার টেবিলে হাত রাখে সুচেতা।

     —এক মিনিট।

     সামনে এগিয়ে আসে সুরিন্দার। সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ইস্পাত কঠিন দৃষ্টিতে দেখে সুচেতাকে।

     —ব্যাপারটা একটু সরল হয়ে যাচ্ছে না? ভাইরাস যে বিজন আপলোড করেছে সে তো কেবল এর মুখে শোনা। কাজটা যে এ নিজে করেনি তার প্রমাণ কোথায়। স্রেফ এর কথায় বিশ্বাস করে একে আমরা কন্ট্রোল সিস্টেমে হাত দিতে দিচ্ছি। এবার এ যদি আরও বাড়তি সাবোটাজ করে?

     অভিযোগের আকস্মিকতায় কেমন হকচকিয়ে যায় সুচেতা। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে সুরিন্দারের দিকে।

     একটা ক্রুদ্ধ আওয়াজ করে এগিয়ে যায় নিতাই। বায়োনিক হাত তার মুঠো করা।

     —এই! মুখ সামলে—

     —দাঁড়াও নিতাইদা!

     মাঝপথেই থেমে যায় নিতাই। সুচেতার কন্ঠস্বরের চেনা দীনতা উধাও। যেন গলন্ত লাভা ঝরে পড়ছে তার গলা থেকে।

     আপনাদের মনে হচ্ছে আমি কর্পোরেটের চর? কৌস্তূভের কলোনি ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে আমিও সামিল? কর্পোরেটের সঙ্গে আমার সম্পর্কের প্রমাণ চান? এই দেখুন!

     পেছনে ফিরে একটানে পিঠের জামাটা উঠিয়ে দেয় সুচেতা। বিস্ময়ের অস্ফূট আর্তনাদ বেরিয়ে আসে একসঙ্গে প্রায় সবারই গলা দিয়ে। চমকে কয়েক পা পিছিয়ে যায় সুরিন্দারও।

     সুচেতার পিঠ জোড়া অজস্র লম্বা লম্বা ক্ষতচিহ্নের দাগ। যেন সাম্প্রতিক অতীতে কোনও কিছুর আঘাতে ফালাফালা হয়ে গিয়েছিল তার শরীর।

     পিঠের জামা নামিয়ে সবার মুখের দিকে পালা করে চায় সুচেতা। চোখ দিয়ে যেন তার আগুন ঝরে পড়ে।

     ফিলামেন্ট চাবুকের দাগ। মারের পর মার। একবারের মারের ক্ষত সেরে গেলে আবার মার। দিনের পর দিন ধরে। কর্পোরেট কার্টেলদের ভাড়াটে জল্লাদের হাতে। তাদের বাড়তি উপহারগুলোর কথা আর নাই বা বললাম।

     শতদলের লম্বা টানা নিঃশ্বাসটা শোনায় শিসের মতন।

     —কিন্তু কেন। কর্পোরেটেদের বিষনজরে পড়লে কি করে তুমি?

     একটা লম্বা নিঃশ্বাস নেয় সুচেতাও। এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার চোখের কোনও দিয়ে।

     —আমার অনলাইন নাম ছিল ব্লু-ম্যাজিসিয়ান।

     অবাক চোখে নীলেশ পাঠক তাকান সুচেতার দিকে।

     —ব্লু-ম্যাজিশিয়ান! তুমি?

     নীরবে ঘাড় নাড়ে সুচেতা।

     হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে নিতাই।

     —ব্লু-ম্যাজিশিয়ান কে? সুচেতার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক।

     —ব্লু-ম্যাজিশিয়ান একজন হ্যাকার। ফ্রীডম ইনিসিয়েটিভ নামে হ্যাকার গ্রুপের নামকরা সদস্য।

     উত্তর আসে শতদলের কাছে থেকে।

     —ফ্রীডম ইনিশিয়েটিভ! হ্যাকার! কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

     হতভম্ব ভাবটা কাটে না নিতাইয়ের।

     —ফ্রীডম ইনিশিয়েটিভের কাজ ছিল কর্পোরেটদের নানা কেলেঙ্কারী ফাঁস করে দেওয়া। বেআইনী কাজকর্ম, সরকারী আমলাদের সঙ্গে লুকানো আঁতাত, দূষণজনিত মৃত্যু, এসব নানান গোপন কথা কথা মানুষ ফ্রীডম ইনিশিয়েটিভের দৌলতেই জানতে পারতো। এ দলের সদস্যদের আসল পরিচয় কেউ জানত না। নানান ছদ্মনামেই তারা পরিচিত ছিল।

     কপালে ভ্রু তোলেন সুজয় বোস।

     —তুমি তো সাঙ্ঘাতিক মেয়ে দেখছি! এতদিন আমার অ্যাসিস্টান্ট হয়ে কাজ করে গেছ, অথচ কিচ্ছুটি টের পেতে দাও নি!

     হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে ম্লান হাসে সুচেতা।

     —লুকিয়ে থাকতে থাকতে পরিচয় গোপন রাখাটা অভ্যেসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে সুজয়দা।

     মুচকি হাসেন সুজয় বোস।

     —তা যাকগে! তোমাদের গ্রুপে রেড-ম্যাজিশিয়ান বলে আর একজন নামকরা হ্যাকার ছিল না? তার কি হল? আর তোমাদের ফ্রীডম ইনিশিয়েটিভের কাজকর্মই বা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কেন?

     আর একবার চোখের জল মোছে সুচেতা।

     —রেড-ম্যাজিশিয়ান আমার জমজ ভাই। সুচেত। ফ্রীডম ইনিশিয়েটিভের কাজকর্ম বিনা কারণে বন্ধ হয়নি। আরও দু-চারজনের সঙ্গে আমি আর সুচেত ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। যেভাবেই হোক কর্পোরেট কার্টেল আমাদের লোকেশন ট্র্যাক করে ফেলে। তারপর একদল ভাড়াটে খুনী পাঠিয়ে দেয় আমাদের তুলে নিয়ে যেতে। তারা অকথ্য অত্যাচার করার পর এক এক করে সবাইকে খুন করে। সুচেতকেও। কেবল—

     —কেবল অত্যাচারের পর তোমাকে ছেড়ে দেয়। যাতে তুমি তাদের ভয়ানক পরিণতির কথাগুলো অন্যদেরকে বলতে পারো। যাতে সে সব শোনার পর কর্পোরেট কার্টেলদের দিকে কেউ চোখ তুলেও তাকাতে সাহস না করে।

     সুচেতার কথার বাকিটুকু সম্পূর্ণ করে দেয় শতদল। নীরবে মাথা নাড়ে সুচেতা।

     সুচেতার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দেয় সুরিন্দার।

     —সরি সুচেতা। গো অ্যাহেড।

 

(১০)

     —বিজন কন্ট্রোল সিস্টেমে ভাইরাস আপলোড করলো কী ভাবে?

     ডক্টর শিপ্রা যে ধৈর্য্য হারাচ্ছেন তাঁর কন্ঠস্বরেই তা বোঝা যায়।

     একটা ধাতুর পাতলা ফালি বাড়িয়ে ধরে সুরিন্দার।

     —এই কম্যুনিকেটর থেকে। এটা বিজনের জামার ভাঁজে লোকানো ছিল।

     হাত বাড়িয়ে কম্যুনিকেটরটা নেন ডক্টর শিপ্রা।

     —এটাতে কি আছে দেখলে হয় না সুচেতা?

     জামার হাতায় কপালের ঘাম মোছে সুচেতা। ঘন্টা খানেক হয়ে গেল সে কন্ট্রোল সিস্টেম থেকে ভাইরাস পরিষ্কার করার চেষ্টা করে চলেছে। তার কোনও কায়দাই এ পর্যন্ত কাজে আসেনি।

     —ওটা এনক্রিপ্ট করা আছে ম্যাডাম। ওর বেড়া ভাঙতে অনেক সময় লেগে যাবে। আর ওর ভেতরে ঢুকেও কিছু হবে না। যা করার এই কন্ট্রোল সিস্টেমেই করতে হবে।

     সুচেতার কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে স্ক্রিনে চোখ রাখেন সু্জয় বোস।

     —আদৌ কিছু করা যাবে কি সুচেতা? আমাদের হাতে আর বড়জোর মিনিট চল্লিশ সময় আছে।

     —চেষ্টা তো করছি সুজয়দা। এই ভাইরাস যারাই বানিয়ে থাকুক বহু মাথা ঘামিয়ে বানিয়েছে। প্রতি মূহূর্তে মিউটেট করে রূপ বদল করছে, এক জায়গা থেকে সরালে আর এক জায়গায় ফের মাথা চাড়া দিচ্ছে।

     মাথা ঝাঁকান নীলেশ পাঠক।

     —হচ্ছে না শিপ্রা। কোনও লাভ নেই। ক্যাম্পের লোকজনকে জানিয়ে দাও। যে যেখানে পারে অন্তত দৌড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা তো করুক।

     একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলেন ডক্টর শিপ্রা।

     —ছেলেমানুষী করো না নীলেশ। এইটুকু সময়ের মধ্যে ব্লাস্ট রেডিয়াসের বাইরে দৌড়ে পালানো সম্ভাব নয়। লোককে জানলে আতঙ্কই ছড়াবে শুধু, প্রাণ বাঁচবে না।

     —তবুও—

     বাকি কথাগুলো কানে যায় না সুচেতার। তার সমস্ত মন নিয়ে সে তখন ফের ডুব দিয়েছে প্রোগ্রামিং-এর জগতে।

     ফের আর একবার শুরু থেকে কন্ট্রোল সিস্টেমের প্রতিটি রুটিন আর সাবরুটিন চেক করে সুচেতা। খুঁটিয়ে দেখে প্রত্যেকটা স্ক্রিপ্ট আর এক্সিকিউটেবল। এক এক করে আলাদা করে দেখে প্রত্যেকটা প্রসেস আর থ্রেড।

     প্রত্যেকবারই ফলাফল হয় এক। ভাইরাসকে এক জায়গা থেকে সরালে ফের জেগে ওঠে আর এক জায়গায়।

     বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পর সুচেতা বুঝতে পারে কন্ট্রোল সিস্টেমের থেকে ভাইরাসকে এভাবে পরিষ্কার করা কার্যত অসম্ভব। এক চিমটে নুন যেমন এক গ্লাস জলে মিশে যায়, ভারাইসের কোডও তেমন টুকরো টুকরো হয়ে মিশে গেছে কন্ট্রোল সিস্টেমের কোডের সঙ্গে। প্রতিটি টুকরো আবার রক্তবীজের মতন ক্রমাগত তৈরি করছে তাদের নিজেদের নকল, ছড়িয়ে দিচ্ছে আরও নানান জায়গায়।

     সুচেতার মাথার মধ্যে কোথাও একটা টাইমারে কমতে থাকে মিনিট আর সেকেণ্ড, তার শরীর ভিজতে থাকে ঘামে।

     কন্ট্রোল সিস্টেম পরিষ্কার করার একমাত্র রাস্তা সমস্ত প্রোগ্রামিং পুরোপুরি মুছে দিয়ে ফের সিস্টেম চালু করা। চালু হওয়ার সময় প্রোগ্রামিং খুঁজে না পেলে কন্ট্রোল সিস্টেম তার ব্যাকআপ থেকে পুরানো একটা পরিষ্কার ভাইরাস মুক্ত কপি ফের লোড করে নেবে।

     কিন্তু সেটা করার আগে রিঅ্যাক্টর বন্ধ করা দরকার।

     আর রিঅ্যাক্টর বন্ধ করতে হলে কন্ট্রোল সিস্টেমের দখল পেতে হবে।

     বিজনের ভাইরাস যেন এক প্রযুক্তির চক্রব্যুহ। তার মধ্যে ঢোকা যায়, কিন্তু বেরনো যায় না।

     সুচেতার মাথার ভেতরে টাইমারে মিনিট সেকেণ্ডের সংখ্যাগুলো কমে আসে আরও। কেমন একটা অসহয়াতার অবসাদ যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে তাকে।

     সজোরে মাথা ঝাঁকায় সুচেতা। হেরে যাবার আগে হেরে যাওয়ার সময় এটা নয়। অনেকগুলো মানুষের বাঁচা-মরা নির্ভর করছে তার ওপর। তার হেরে যাওয়ার অর্থ কৌস্তূভে বয়ে আনা স্বাধীনতার বীজটুকু অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাওয়া।

     হঠাৎই তার মাথার মধ্য আর চাড়া দিয়ে ওঠে আর একটা চিন্তা। ভাইরাসকে সরানো সম্ভব নয়। কিন্তু না সরিয়েও তাকে আটকানো যায় কি?

     আর একটা সম্ভাব্য পন্থার ধূসর রেখা ধীরে ধীরে পরিষ্ফূট হয়ে ওঠে তার মনে।

     কয়েক সেকেণ্ড ভেবে নেয় সুচেতা কি কি করবে। তারপর নতুন একটা প্রোগ্রাম লিখতে শুরু করে।

     স্ক্রীনের মিটারে বাড়তে থাকে রিঅ্যাক্টরের তাপমাত্রা, কমতে থাকে সুচেতার মনের টাইমারে মিনিট আর সেকেণ্ডের সংখ্যা।

     কীবোর্ডে ঝড়ের বেগে চলতে থাকে সুচেতার আঙুল।

     যখন মনের কোনের টাইমারে আর মাত্র মিনিটপাঁচেক বাকি আছে, তখন চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায় সুচেতা। মাথার চুলগুলো তার ঘামে লেপ্টে আছে। ঠোঁটের কোনও হালকা হাসি।

     —ভাইরাস সরাতে পারলে?

     উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করেন ডক্টর শিপ্রা।

     নীরবে আঙুল তুলে স্ক্রীনের কোনের দিকে চলতে থাকা তাপমানের মিটারের দিকে দেখায় সুচেতা।

     ধীরে ধীরে লাল থেকে সবুজের দিকে নেমে আসছে তাপমানের দাগ। কমে আসছে রিঅ্যাক্টরের উত্তাপ।

     —ভাইরাস পরিষ্কার করতে পারছিলাম না। সুতরাং ভাইরাসের মতোই কন্ট্রোল সিস্টেমকে বোকা বানানোর একটা প্রোগ্রাম যোগ করে দিয়েছি?

     ঝুঁকে পড়ে বোঝার চেষ্টা করেন নীলেশ পাঠক।

     —ঠিক কি করেছ বলতো?

     —ভাইরাসটা রিঅ্যাক্টরের সঠিক তাপমান কন্ট্রোল সিস্টেমকে জানতে দেয় না। কন্ট্রোল সিস্টেম তাই রিঅ্যাক্টরকে ফ্যানের স্পীড কমিয়ে রাখতে নির্দেশ দেয়। রিঅ্যাক্টর আর সিস্টেমের মাঝখানে বসে থেকে আমার প্রোগ্রাম ঠিক উলটো কাজটা করে। কন্ট্রোল সিস্টেম ফ্যানের স্পীড কমাতে বললে তার বদলে উলটে বাড়িয়ে দেয়।

     —মানে ভাইরাস সিস্টেমকে বলছে তাপ ঠিক আছে। সিস্টেম রিঅ্যাক্টরকে বলছে ফ্যানের গতি কমাতে। তোমার প্রোগ্রাম সেই ‘কমিয়ে দাও’ নির্দেশকে পালটে দিচ্ছে ‘বাড়িয়ে দাও’ আদেশে। এই তো?

     —হ্যাঁ। একদম তাই।

     —ব্রিলিয়ান্ট!

     প্রশংসা ঝরে পড়ে নীলেশ পাঠকের গলায়।

     —বিপদ কাটলো তাহলে?

     উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করে নিতাই।

     সুচেতার কাঁধ চাপড়ে দেন ডক্টর শিপ্রা!

     —তাই তো মনে হচ্ছে।

     —না! আমাদের বিপদ কাটেনি শিপ্রা। কিছু সময়ের জন্যে তাকে ঠেকিয়ে রাখা গেছে কেবল!

     সুজয় বোসের জোরালো কন্ঠস্বরে চমকে ফিরে তাকায় সবাই।

     চোখ তুলে স্ক্রীনের দিকে নির্দেশ করেন সুজয় বোস।

     —আর কিছুক্ষণের মধ্যে রিঅ্যাক্টর বন্ধ হয়ে যাবে। তার সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে আমাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ।

     কন্ট্রোল রুমের ছাদের আলোর পট্টিগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখেন নীলেশ পাঠক।

     —হ্যাঁ তা হবে। দিন কতক অসুবিধে হবে আমাদের হয়তো। তবে কাজ চালিয়ে নিতে পারবো। ততদিনে বিদ্যুতের আর একটা বিকল্প ব্যবস্থা—

     হাত তুলে বাধা দেন সুজয় বোস।

     —একটা কথা ভুলে যাচ্ছ নীলেশ। আমাদের অক্সিজেন টক্সিসিটি ওষুধের স্টক নেই। ওষুধ রোজেরটা রোজ বানাতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ ছাড়া ড্রাগ প্রিণ্টার চলবে না। আজকের ওষুধ বিলি হয়ে গেছে বটে, কিন্তু কাল থেকে আমরা আর ওষুধ পাবো না।

     সবার মুখের দিকে একবার তাকান সুজয় বোস।

     আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে বিদ্যুৎ চালু করে ড্রাগ প্রিন্টার চালু না করা গেলে কৌস্তূভে আমরা টিকে থাকতে পারবো না।

 

(১১)

     —তাহলে বিদ্যুৎ জোগানের একমাত্র রাস্তা নেট টার্বাইন?

     কম্পিউটার টেবিলের ওপর ভাসতে থাকা। একটা ত্রিমাত্রিক ছবির দিকে দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে শতদল।

     রিঅ্যাক্টর বন্ধ হবার পর দু-একবার দপদপ করে নিভে গেছে ছাদের রোশনি স্ট্রিপগুলো। দরজা দিয়ে আসা এক চিলতে দিনের আলো আর ব্যাটারীর শেষ চার্জটুকু শুষে নিয়ে জেগে থাকা কম্পিউটার টেবিলের নীলচে দ্যুতিতে ঘরখানা দেখায় গুহার মতন।

     টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন ডক্টর শিপ্রা। অল্প আলোয় আবছায়া সিল্যুটের মতন দেখায় তাঁর চেহারাটা।

     —হ্যাঁ। এখন নেট টার্বাইনই ভরসা আমাদের। আদরিণীতে আমরা ফিউশন রিঅ্যাক্টর ছাড়াও সোলার প্যানেল আর উইন্ড টার্বাইন দুই-ই এনেছিলাম। কিন্তু আদরিণী কৌস্তূভে নামার সময়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। আগুন লেগে অনেক জিনিসপত্রের সঙ্গে সেসবও নষ্ট হয়ে যায়।

     টেবিলের ওপর পাক খেতে থাকা ত্রিমাত্রিক ছবিটা দেখতে থাকে শতদল। একটা জলপ্রপাতের গায়ে ঝোলানো একটা বিশাল নেট।

     —এটাকে জলপ্রপাতের গায়ে ঝুলিয়ে দিতে হবে?

     সামনে এগিয়ে আসেন নীলেশ পাঠক।

     —ওই নেটের টানা আর পোড়েনের মাঝের প্রতিটি গিঁট আসলে এক-একটা ন্যানো টার্বাইন।

     —এটাকে লাগানো হবে কি করে?

     টেবিলে হাত রাখেন নীলেশ পাঠক। সরে যায় নেটের ছবি। হাওয়া ভেসে পাক খায় একটা লম্বাটে বাক্সের চেহারা।

     —নেট টার্বাইন নিজে নিজেকে বসিয়ে নেবে। এই বাক্সর মধ্যে নেট টার্বাইন লাটিমে জড়িয়ে রাখা আছে। আমাদের কাজ এটাকে জলপ্রপাত অবধি নিয়ে যাওয়া?

     —কত বড় এটা?

     কন্ট্রোল রুমের অন্ধকার থেকে ভেসে আসে নিতাইয়ের গলা।

     আবার টেবিলের ওপর হাত রাখেন নীলেশ পাঠক। বাক্সটা ঘুরে যায় লম্বালম্বি ভাবে। পাশে ভেসে ওঠে একটা মানুষের প্রতিকৃতি। এবার দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে বাক্সটা কম করে দুমানুষ লম্বা হবে।

     একটা শিসের মতন শব্দ করে নিতাই।

     —এতো বিশাল বড়। এটাকে নিয়ে যাবো কি করে?

     হাসির রেখা ফোটে নীলেশ পাঠকের মুখে,

     —ওটা নিজেই তোমাদের সঙ্গে যাবে।

     মিলিয়ে যায় টেবিলের ওপর ভাসতে থাক মানুষের প্রতিকৃতি। নেট টার্বাইনের বাক্সটা একপাক ঘুরে এবার সমান্তরাল হয়ে যায় মাটির সঙ্গে। বাক্সের দুপাশ থেকে এইবার বেরিয়ে আসে দুজোড়া পা।

     —এই বাক্সের মধ্যে অটো-নেভিগেশন সিস্টেম আছে। তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক চলে যাবে। তোমাদের কাউকে কেবল এইটা কব্জীতে পড়ে থাকতে হবে।

     টেবিলের ওপর এবার ভেসে ওঠে একটা রিস্ট-ব্যাণ্ডের ত্রিমাত্রিক ছবি।

     বিদ্যুৎ চলে গিয়ে কন্ট্রোল রুমের হাওয়া কেমন বদ্ধ আর গুমোট হয়ে উঠেছে। মাথার ঘাম মোছে শতদল।

     —নেট টার্বাইন না হয় বসিয়ে দেব। কিন্তু সন্তোষগঞ্জের সঙ্গে বিদ্যুৎ যোগাযোগ হবে কি করে?

     নীলেশ পাঠকের হাতের ছোঁয়ায় ভেসে ওঠে আর একটা ত্রিমাত্রিক ছবি। শতদলের চিনতে অসুবিধে হয় না জিনিসটাকে।

     —জল ড্রোন!

     —হ্যাঁ। আকাশে ওড়ার বদলে এই ড্রোন চলে জলপথ ধরে। এর ভেতরে একটা লাটিমে জড়ানো আছে প্রায় চুলের মতন সরু সুপারকণ্ডাটিং তার। ড্রোনের একপ্রান্ত নেট টার্বাইনের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ড্রোন ভাসিয়ে দিতে হবে জলে। নদী বেয়ে ড্রোন সন্তোষগঞ্জ অবধি চলে এলে ড্রোনের টেনে আনা তার আমরা আমাদের বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে জুড়ে দেব।

     অন্ধকার থেকে ফের ভেসে আসে নিতাইয়ের কন্ঠস্বর।

     —ড্রোন তো কাউকে চালাতে হয়। চালাবে কে?

     ড্রোনের ছবি সরিয়ে দেন, তার জায়গা নেয় একটা কৃত্রিম উপগ্রহের চেহারা।

     —আদরিণী নামার আগে কক্ষপথে এই স্যাটেলাইটটাকে ছেড়ে আসে। এতে একটা ‘এ আই’ বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম আছে। এই ‘এআই’ ড্রোনকে চালিয়ে আনবে। তবে তার আগে আর একটা কাজ করতে হবে—

     ড্রোনের ছবি সরে যায়। ভেসে ওঠে একটা লম্বা ট্রান্সমিশন টাওয়ারের ছবি।

     —একটা উঁচু পাহাড়ের মাথায় এটাকে বসাতে হবে। কৌস্তূভের চৌম্বকক্ষেত্রটা কিছুটা গোলমেলে। সিগন্যাল খুব জোরালো না হলে এখানে কাজ করে না। ড্রোনের নিজস্ব সিগন্যালে যা জোর, সেটা স্যাটেলাইট অবধি পৌঁছবে না। ড্রোন আর স্যাটেলাইটের মধ্যে যোগাযোগ রাখবে এইটা।

     —কি কি করতে হবে তা তো বুঝলাম। কিন্তু যেতে কোথায় হবে?

     টেবিলের কাছে এগিয়ে আসে নিতাই। সামনে এগিয়ে আসে ডক্টর শিপ্রাও।

     —বলছি নিতাই। নীলেশ ম্যাপটা দেখাও—

     এবার ভেসে ওঠে একট ত্রিমাত্রিক ম্যাপ। ম্যাপে আঙুল রাখেন ডক্টর শিপ্রা।

     —এই দেখ। এইটা আনন্দী নদী। এই নদীর বাঁকে সন্তোষগঞ্জ। আনন্দী বেরিয়ে এসেছে রামগিরি পর্বতমালা থেকে। এই আনন্দী ধরে যদি উত্তরপূর্ব দিকে যেতে থাকো, তাহলে শ্যামলাঝোরা জলপ্রপাতে পৌঁছে যাবে। এই শ্যামলাঝোরার ওপরে বসাতে হবে নেট টার্বাইন।

     —তাহলে আমরা ওই আনন্দী বরাবর যাত্রা করবো তো?

     —না! তোমাদের একটু ঘুর পথে যেতে হবে।

     আঙুলের ছোঁয়ায় ম্যাপটাকে একটু বড় করেন ডক্টর শিপ্রা।

     —এইখানটা লক্ষ করো। রামগিরি থেকে বেরোনোর পরপরেই পূর্বদিক থেকে আনন্দীতে এসে পড়ছে সরযূ। তোমাদের যেতে হবে সরযূ নদী বরাবর।

     ম্যাপটা ঝুঁকে দেখে শতদল।

     —সরযূ তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের এতটা ঘুরে যেতে হবে কেন? আনন্দী বরাবর গেলে তাড়াতাড়ি হত না?

     —তা হয়তো হত কিন্তু ওভাবে তোমরা যেতে পারবে না। ভালো করে ম্যাপটা দেখ। আনন্দী আর সরযূ যেখানে পাশাপাশি রামগিরি থেকে বেরিয়ে এসেছে সে জায়গাটার নাম ত্রিশূল রেঞ্জ। আনন্দী বেরিয়ছে আনন্দী পাস থেকে আর সরযূ নেমে এসেছে সরযূ পাস থেকে। আনন্দী পাস আর সরযূ পাসের তফাৎটা বুঝতে পারছো?

     আঙুল দিয়ে ম্যাপটাকে আরও বড় করে শতদল।

     —আনন্দী পাস দেখে মনে হচ্ছে সরু, দুর্গম। সরযূ পাস তুলনামূলক ভাবে চওড়া, অতটা খাড়াই নয়। মালপত্র সঙ্গে থাকলে সরযূ পাস ধরে যাওয়াটা সুবিধের।

     —শুধু তাই নয়—

     ম্যাপে আনন্দী পাসে আঙুল ছোঁয়ান ডক্টরর শিপ্রা।

     —আনন্দী পাস ধরে গেলে শ্যামলাঝোরার মাথায় পৌঁছনো অসম্ভব। খাড়া পাহাড়ের মাথা থেকে জলপ্রপাত সোজা নিচে এসে পড়েছে। শ্যামলাঝোরার ওপরে পৌঁছতে গেলে তোমাকে সরযূ পাস হয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে পশ্চিমে আসতে হবে।

     —কখন যাত্রা করতে হবে?

     ম্যাপটা সরিয়ে দেন ডক্টর শিপ্রা। কন্ট্রোলরুমের অন্ধকার আরও যেন গাড় হয়ে আসে।

     —যত তাড়াতারি পারো। রাতটা কোথাও ক্যাম্প করে ভোরে ফের যাত্রা শুরু করলে কাল দুপুর নাগাদ হয়তো শামলাঝোরা পৌঁছে যাবে।

     দরজার দিকে পা বাড়ায় নিতাই।

     —তাহলে আর দেরি করে লাভ কি? কই গো নীলেশ স্যার, মালপত্র কি নিয়ে যেতে হবে সে সব দিন।

     একে একে দরজার দিকে পা বাড়ায় সবাই।

     দরজার বাইরে পা রাখতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় শতদল।

     —ম্যাডাম, আপনার ছুরিটা। ফেরৎ দেওয়া হয় নি।

     শতদলের ছুরি সমেত বাড়ানো হাতটা সরিয়ে দেন ডক্টর শিপ্রা।

     —ওটা তুমিই রাখো শতদল। আজ যা দেখেছি আমার চাইতে ওটার ব্যবহার তুমিই ভালো জানো।

(১২)

     পিঠে ভারী ব্যাগ বেঁধে দুটো মানুষ হাঁটে সরযূ নদীর উপত্যকা ধরে। তাদের পেছনে কব্জা বসানো চারটে সরু পায়ে হেঁটে চলে একটা লম্বাটে বাক্স, তার সমনের দিকে টিপটপ করে জ্বলে ক্ষুদে ক্ষুদে লাল সবুজ আলো।

     দুপাশে প্রাচীরের মতন উঠে গেছে পাহাড়। তার মাঝখানে পাথরে নুড়িতে ধাক্কা খেয়ে সরযূর স্বচ্ছ জল বয়ে যায় কলকল শব্দে। নদীর আর পাহাড়ের মাখখানে গালিচার মতো ছড়িয়ে থাকে নীলচে ঘাসে ঢাকা মাঠ, তার এখানে ওখানে দুরন্ত গতিতে ছুটে বেড়ায় রঙবেরঙের পঞ্চপাশ। মাথার ওপর গাঢ় হয়ে আসে কৌস্তূভের নীল আকাশ, রামধনুর রঙ ধরে খিলেনের মতো বলয়ে।

     ছুটতে গিয়ে নিতাইয়ের জুতোয় ধাক্কা খেয়ে হঠাৎ ছিটকে যায় একটা পঞ্চপাশ। সামনের দুটো শুঁড় তুলে কির্‌র্‌ কির্‌র শব্দে প্রতিবাদ জানায় সেটা, তারপর ফের ছুট লাগায় অন্যদিকে।

     মুচকি হাসে নিতাই।

     —চেহারাটা দেখেছ? সাইজে মোটে এক বিঘৎ হলে কি হবে, দেখতে অবিকল আমাদের পৃথিবীর অক্টোপাসের মতন।

     ঘাসের ওপর ছোটাছুটি করতে থাকা ক্ষুদে প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয় শতদল।

     —নিতাইদা, অক্টোপাসের আটটা শুঁড় থাকে, এগুলোর মোটে পাঁচটা। আর—

     —আর জলের বদলে এগুলো থাকে ডাঙায়। এখানকার সবই দেখি অদ্ভূত।

     এবার হাসির রেখা ফোটে শতদলের মুখেও।

     —তা যা বলেছ। তবে থাকতে থাকতে হয়তো এসবই আমাদের কিছুদিন বাদে স্বাভাবিক মনে হবে।

     —কিছুদিনে হবে কি? রোজই তো নতুন নতুন কিছু দেখি—

     নিতাইয়ের কথা শেষ হবার আগেই নদী থেকে লাফ দিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে হাতখানেক লম্বা একটা প্রাণী। গায়ে চিংড়ির মতন কঠিন বর্ম, সামনের দিক লম্বা শুঁড়। একটা অসতর্ক পঞ্চপাশকে শুঁড়ে জড়িয়েই কাঠির মতন সরু সরু পায়ে ভর দিয়ে ফের লাফ দেয় জলে। নদীর শব্দে বিলীন হয়ে যায় পঞ্চপাশের কির্‌র্‌ কির্‌র্‌ প্রতিবাদের আওয়াজ। হাওয়ায় ছিটকে ওঠা জলকণা মিহিরের নীল রঙ মেখে নিয়েই আবার উধাও হয়ে যায় নদীর বুকে।

     —ওই দেখ! কি বলছিলাম! এখান যা যা আছে সব এক জীবনেও দেখে কুলোবে না।

     —তা তো বুঝলাম। কিন্তু এবার তো একটা আস্তানা খোঁজার চেষ্টা করতে হয়। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, যে-টা এখুনি লাফ দিল তার কোনও বড়ভাই আমাদের নতুন খাবার ভেবে অন্ধকারে উঠে এলে মুস্কিল।

     সামনের দিকে আঙুল তুলে দেখায় নিতাই।

     —ওই দেখ। পাহাড়ের গায়ে যেখানটা কেমন টোল খেয়ে গেছে না, ক্যাম্প করার জন্যে ওটা বেশ ভালো জায়গা।

     ঠিক গুহা না হলেও নিতাইয়ের দেখানো জায়গাটাতে পাহাড়ের গায়ে একটা গর্ত মতন হয়ে গেছে, কষ্টেসৃষ্টে সেখানে দুজন বসা যায়। গর্তের একপাশে পিঠের জিনিসপত্র নামিয়ে রাখে নিতাই আর শতদল, নেট টার্বাইনের বাক্সটা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে একপাশে।

     কোমরে হাত রেখে চারপাশটা একবার মাথা ঘুরিয়ে পরীক্ষা করে নিতাই।

     —বাঃ। ফাস্টক্লাস জায়গা, এবার এর সামনেটা একটু আগুন জ্বেলে নিতে পারলেই আর কোনও জন্তু জানোয়ার ধারে কাছে ঘেঁসবে না।

     সামনে একটা ছোট গাছের দিকে দেখায় শতদল।

     —এটার ডালগুলো দিয়ে আগুন জ্বালানো যেতে পারে। কিন্তু কাটবে কী করে?

     —হুঁ! তার আবার চিন্তা? আমার এই হাতখানা রয়েছে কি করতে?

     গাছের কাছে গিয়ে বায়োনিক হাতের চাপে ডালপালা মুচড়ে ভাঙতে আরম্ভ করে নিতাই।

     সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকে শতদল।

     —নিতাইদার হাতের কেরামতি যতই দেখি ততই আশ্চর্য হই। তা নিতাইদা, হাতখানা পেলে কি ভাবে?

     ভাঙা ডালপালা পাহাড়ের গায়ে স্তূপ করে নিতাই। মাথার ওপর নীল থেকে ধীরে ধীরে কালো হয়ে ওঠে কৌস্তূভের আকাশ।

     —ফৌজে আমার কোম্পানী কমান্ডার ছিল মেজর পরেশ। গোঁয়ার আর বদরাগী। ইউনিটে কারও সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। একবার লড়াইয়ের সময় আমরা আক্রমণের মুখে পড়েছি, সামনের একটা টিলার ওপর থেকে বৃষ্টির মতন নেমে আসছে গুলির ধারা, পরেশ আমাদের অর্ডার দিল চার্জ করার। ইউনিটের হেভি মেশিনগানটা পরেশের জিম্মায় রেখে আমরা আস্তে আস্তে পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলাম। পরেশের কাজ ছিল পেছন থকে আমাদের কভারিং ফায়ার দেওয়া।

     মড়মড় আওয়াজে গাছের একটা ডাল ভেঙে ফেলে নিতাই। অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। রঙীন পঞ্চপাশগুলো লুকিয়ে পড়েছে কোথাও।

     —কিন্তু অর্ধেক পথ যেতেই অন্য আর এক জায়গা থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ শুরু হল। আমাদের কভার করা দূরে থাক, আক্রমণের মুখে পরেশ পজিশন ছেড়ে পালাল। দুদিকের আক্রমণে আমরা যেন জাঁতাকলে আটকে পড়লাম। ইউনিটের অনেকে মারা পড়ল। বাকিদের আমি কভারিং ফায়ার দিয়ে পিছু হটার সুযোগ করে দিলাম বটে, কিন্তু নিজে হাতে গুলি লেগে রক্তক্ষরণে অচৈতন্য হইয়ে পড়লাম। শিপ্রা ম্যাডাম আমাদের ইউনিটের ডাক্তার ছিলেন, বুক ঘষটে আমাকে আড়ালে টেনে না আনলে আমিও মারা পড়তাম।

     অন্ধকারে নদীটাকে আর দেখা যায় না, কেবল কানে আসে তার জলের শব্দ। সেই আওয়াজের দিকে তাকিয়ে বায়োনিক হাতের মুঠোটা বার দুয়েকে খোলে বন্ধ করে নিতাই।

     —ডাক্তার ম্যাডামের সুপারিশেই এই হাতখানা পাওয়া। বলতে পারো কিছু লোকের জীবন বাঁচানোর পুরষ্কার।

     নিতাইয়ের ভাঙা ডালগুলো পাঁজা করে সাজায় শতদল।

     —আর পরেশ?

     —ডাক্তার ম্যাডাম পরেশের নামে কমপ্লেন করেছিলেন। কোর্ট মার্শাল হয়ে সে ফৌজ থেকে বরখাস্ত হয়।

     তারায় ঢেকে গেছে কৌস্তূভের আকাশ। জোড়া মুক্তোর মতন ঝকঝক করে সুহাস আর উল্লাস। সেদিকে তাকিয়ে একবার একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নিতাই, তারপরে তাকায় কাঠের পাঁজার দিকে।

     —গালগল্প তো অনেক হল। এবার আগুনটা জ্বালিয়ে ফেলো। অন্ধকার হয়ে গেছে।

     কাটা ডালাপালায় শতদল লাইটারে আগুন ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গে হুহু করে আগুন ধরে ওঠে।

     হালকা কুয়াশায় ঢেকেছে নদীর পাড়। সেখানে এবার ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে একঝাঁক প্রাণী। উল্টোনো বাটির মতো তাদের চেহারায় সোনালী আলোর দীপ্তি, সোনালী আলোয় জ্বলা তন্তু হাওয়ায় আন্দোলিত হয় তাদের শরীরের নিচে। হাওয়ায় ভেসে তারা ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলে সরযূর উপত্যকা।

     আগুনের পেছনে পাহাড়ের কন্দরে পিঠ রেখে নিতাই আর শতদল দেখতে থাকে সে অদ্ভূত দৃশ্য।

     হঠাৎ কি মনে পড়ে যায় শতদলের। চমকে ওঠে সে।

     —নিতাইদা, ভাইরাস ঢুকিয়ে রিঅ্যাক্টর উড়িয়ে দিলে আমরা হয়তো বাঁচতাম না, কিন্তু বিজনও তো এ গ্রহে টিকতে পারতো না।

     —ঠিক বলেছ। হয় কর্পোরেট কার্টেলরা বিজনকে আত্মঘাতী মিশনে রাজী করিয়ে কৌস্তূভে পাঠিয়েছিল। আর না হলে—

     —আর না হলে বিজন জানতো যে আমাদের খতম করার পর তাকে উদ্ধার করতে আর একটা টিম কৌস্তূভ পৌঁছবে খুব শিগ্‌গিরই।

     পাহাড়ের নির্জনতা যেন হঠাৎ আরও গাড় হয়ে ওঠে। উদ্বিগ্ন চাহনিতে নিতাই আর শতদল তাকিয়ে থাকে পরস্পরের দিকে। পাহাড়ের অন্ধকারে কোথাও কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে কোনও নাম না জানা প্রাণী।

 

(১৩)

     পুড়ে যাওয়া ডিস্পেন্সারির সামনে কোমরের হোলস্টারে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকেন ডক্টর শিপ্রা, পশ্চিমে হেলে যাওয়া মিহিরের আলো পড়ে তাঁর মুখে। পোড়া মালপত্র সরাচ্ছে কয়েকজন, রাইফেল নামিয়ে রেখে তাদের সঙ্গে হাত লাগায় সুরিন্দার। পোড়া কাঠের কটু গন্ধে ভারী হয়ে থাকে কৌস্তূভের ঘন বাতাস।

     —ডক্টর ম্যাডাম! ডক্টর ম্যাডাম!

     হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে সুচেতা, চোখেমুখে তার উদ্বেগের ছাপ স্পস্ট।

     —ম্যাডাম, এটার এনক্রিপ্‌শন ভাঙার চেষ্টা করছিলাম, হঠাৎ খেয়াল করলাম এটা সিগন্যাল রিসিভ করছে।

     হাত বাড়িয়ে ধরে সুচেতা। মিহিরের নীলচে আলোয় তার হাতের চেটোয় চকচক করে বিজনের কমিউনিকেটর।

     সুচেতার হাত থেকে কমিউনিকেটরটা একরকম ছিনিয়ে তুলে নেন ডক্টর শিপ্রা। কমিউনিকেটরের একপ্রান্তে টিপটিপ করে জ্বলা লাল আলোর বিন্দুটা নজর এড়ায় না তাঁর।

     —সুরিন্দার! বিজনের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে!

     ডক্টর শিপ্রার হাত থেকে নিয়ে কমিউনিকেটরটা খুঁটিয়ে দেখে সুরিন্দার।

     —ম্যাডাম, এটা অল্প পাল্লার কমিউনিকেটর। যে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে সে ক্যাম্পের আসেপাশেই কোথাও আছে।

     মাথা নাড়েন ডক্টর শিপ্রা।

     —হ্যাঁ। হয়তো রিঅ্যাক্টরের বিস্ফোরণে সন্তোষগঞ্জ উড়ে যাবে আশা করে দূরে কোথাও লুকিয়ে ছিল, কিছু হয়নি দেখে এখন খোঁজ নিতে এসেছে।

দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে সুচেতার।

     —ম্যাডাম কেবল খোঁজা নয়। বিজনের সঙ্গীর মাথাতেও কোনও স্যাবোটেজের প্ল্যান থাকতে পারে।

     —অবশ্যই থাকবে। এদেরকে যারা পাঠিয়েছে তারা বিজন অসফল হলে আমাদের ধ্বংস করার জন্যে দ্বিতীয় আর একটা প্ল্যান তাকে অবশ্যই দিয়ে থাকবে। সুরিন্দার, একে এখুনি খুঁজে বের করা দরকার।

     ঢলে আসছে মিহির, রামধনুর রঙ ধরছে কৌস্তূভের বলয়ে। সে দিকে একবার তাকায় সুরিন্দার।

     —ম্যাডাম এ লোকটাকে তাই তো আমরা জানি না। তাকে খুঁজে পাবো কি করে?

     হয়তো বা সুরিন্দারের প্রশ্নের উত্তরেই একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ আসে সন্তোষগঞ্জের এক প্রান্ত থেকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শব্দ ওঠে ভারী কিছু একটা আছড়ে পড়ার।

     চমকে উঠে আওয়াজ যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে তাকায় সুরিন্দার। কৈস্তূভের নীল আকাশে সেখানে নজর পড়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী

     —ম্যাডাম ট্রান্সমিটার! আমাদের রেডিও ট্র্যান্সমিটার—

     রাইফেল তুলে নিয়ে দৌড়য় সুরিন্দার। ডক্টর শিপ্রার সঙ্গে সুচেতাও দৌড়তে থাকে তার পেছনে।

     সন্তোষগঞ্জের কাঠের বাড়িগুলো যেখানে শেষ হয়ে মাঠ আরম্ভ হয়েছে সে জায়গাটা পৌঁছতেই সুচেতা দেখতে পায় মাঠের মধ্যে কাত পড়ে রয়েছে রেডিও ট্রান্সমিটারের লম্বা টাওয়ারটা। তার মাথায় লাগানো ডিশ অ্যান্টেনাগুলো ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আসেপাশে।

     টাওয়ারের পায়ার খুঁটিগুলো থেকে ওঠা ধোঁয়ার দিকে আঙুল তুলে দেখায় সুরিন্দার।

     —এক্সপ্লোসিভ! এক্সপ্লোসিভ চার্জ বসিয়ে ট্রান্সমিশন টাওয়ার উড়িয়ে দিয়েছে।

     মাঠের মধ্যে দিয়ে পড়ে থাকা টাওয়ারের দিকে দৌড়য় সুরিন্দার।

     কিন্তু টাওয়ার অবধি পৌঁছনো হয় না সুরিন্দারের। প্লাজমা রাইফেলের বাজপড়া আওয়াজ করে একটা বাড়ির আড়াল থেকে ছুটে আসে আলোর লালচে রেখা, স্পর্শ করে সুরিন্দারের শরীর।

     মাটির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে সুরিন্দার। তার হাত থেকে রাইফেল ছিটকে যায় দূরে।

     থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সুচেতা। মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করে আক্রমণ কোথা থেকে আসছে।

     কিন্তু কিছু বুঝতে পারার আগেই তাকে সজোরে ধাক্কা মারেন ডক্টর শিপ্রা।, মাটিতে হুমড়ি খেয় পড়ে সুচেতা, আর একটা লালচে রেখা বেরিয়ে যায় তার শরীরের ওপর দিয়ে।

     ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে পড়েন ডক্টর শিপ্রা। দুবার পাক খেয়ে মাটিতে পিঠ রেখেই হোলস্টার থেকে টেনে বের করেন স্প্রিং পিস্তল।

     সুচেতা দেখতে পায় বাড়ির আড়াল থেকে ক্ষিপ্র পায়ে দৌড়ে আসছে কেউ, তার দুহাতে ধরা রাইফেলের নল ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে তার দিকে।

     শরীরের সামনে দুহাত উঁচু করে স্প্রিং পিস্তল তুলে ধরেন ডক্টর শিপ্রা। হালকা শব্দ ওঠে ট্রিগার টেপার, উচ্চ চাপে ভরা হিলিয়ামে ভর করে পিস্তলের নল থেকে শূন্যে ছিটকে যায় অতিকঠিন কার্বনের গোল প্যাঁচানো স্প্রিং।

     সুচেতার দিকে রাইফেল তুলে ধরে আততায়ী, তার আঙুল চেপে বসে ট্রিগারে।

     আততায়ীর শরীরের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ টুকরো টুকরো হয়ে যায় কার্বনের স্প্রিং। তার অংশগুলো একই গতিতে সামনের দিকে ছুটে যায় সজারুর কাঁটার মতন।

     আততায়ীর শরীরে একসঙ্গে আছড়ে পড়ে অতিকঠিন কার্বনের অসংখ্য কাঁটা। তার সারা দেহে নিমেষের মতন ফুটে ওঠে অজস্র রক্তবিন্দু।

     দু-একবার টলমল করে মাটিতে বসে পড়ে আততায়ী, তার হাত থেকে খসে পড়ে রাইফেল।

     পিস্তল ফেলে দৌড়ন ডক্টর শিপ্রা। হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন সুরিন্দারের শরীরের পাশে।

 

(১৪)

     কন্ট্রোল রুমের টেবিলে একটা ছোট ল্যাম্প আলো ফেলে বৃত্তাকারে। তাকে ঘিরে গম্ভীর মুখে বসে থাকে চারটে মানুষ।

     সুরিন্দারের খুব কপাল ভালো প্লাজমার রেখা পেটের একপাশ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে, শরীরের কোনও মেজর অর্গ্যানের তেমন ক্ষতি করেনি। কিন্তু তাও তোমার এখন রেস্টে থাকা দরকার।

     নীরবে মাথা নাড়ে সুরিন্দার। তার জামার বোতাম খোলা, পেট জড়ানো ব্যাণ্ডেজে।

     ডক্টর শিপ্রার দিকে চোখ রাখেন সুজয় বোস।

     —সুরিন্দার আহত, নীলেশের মাথায় চোট, তোমার হাতের বিছে-ইঁদুরের আঘাত এখনও সারেনি। সুস্থ বলতে কেবল আমি আর সুচেতা।

     —হ্যাঁ। আর তোমাকেও থাকতে হবে ড্রাগ প্রিন্টারের কাছে, যাতে বিদ্যুৎ এলেই ফের প্রিন্টার চালু করা যায়। নীলেশ, একটু আগে আমাকে যা যা বললে আর একবার সবাইকে বলবে?

     আলোর নিচে একগোছা ছবি নামিয়ে রাখেন নীলেশ পাঠক।

     কন্ট্রোল রুমে কাজ করতে করতে হঠাৎ খেয়াল করলাম আমাদের ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে কে একটা সিগন্যাল পাঠাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে সিগন্যাল সে-টা ট্র্যাক করে স্যাটেলাইটের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে এইগুলো পেলাম।

     টেবিলের ওপর ছবিগুলো ছড়িয়ে দেন নীলেশ পাঠক। প্রথমটাতে দেখা যায় কৌস্তূভের আকাশ থেকে নেমে আসছে একটা ল্যান্ডার। পরেরগুলোতে দেখা যাচ্ছে ল্যান্ডারের অবতরণের সময় ল্যান্ডার থেকে লাফ দিয়ে পড়ছে পিঠে গ্লাইডার বাঁধা চার-পাঁচজনের এক একটা দল।

     টেবিলে সজোরে চাপড় মারে একটা সুরিন্দার। টেবিল থেকে লাফিয়ে ওঠে ছবিগুলো।

     —ভাড়াটে সৈন্য! কর্পোরেট কার্টেলের পাঠানো!

     ছবিগুলো সরিয়ে সরিয়ে দেখেন সুজয় বোস।

     —আর ছবি নেই?

     মাথা নাড়েন নীলেশ পাঠক।

     —না এগুলো পাঠানোর পরেই বিজনের সাগরেদ ট্র্যান্সমিশন টাওয়ার উড়িয়ে দেয়। বন্ধ হয়ে যায় স্যাটেলাইটের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ।

     একটা ছবি তুলে নেয় সুরিন্দার।

     —একটু বড় করা যাবে কি?

     —নাঃ তারও উপায় নেই। ব্যাটারী শেষ, বন্ধ হয়ে গেছে আমাদের কম্পিউটার। তোমাদের দেখানোর জন্য আমি এই কয়েকটা ছবি প্রিন্ট নিয়ে রেখেছি কেবল।

     —আর একবার ছবিগুলোকে খুঁটিয়ে দেখে সুরিন্দার।

     —এরা ল্যান্ডার থেকে আমাদের ক্যাম্পের দুদিকে লোক নামিয়ে দিয়েছে, আর ল্যান্ডারটাকে খুব সম্ভব নামিয়েছে রামগিরির একদম ভেতরে কোনও উপত্যকায়।

     একটা ছবিতে আঙুল রাখেন সুজয় বোস।

     —কেবলমাত্র সন্তোষগঞ্জের চারপাশে নয়, দু-একজনকে মনে হচ্ছে ত্রিশূল রেঞ্জেও নামিয়েছে।

     সুজয় বোসের দেখানো ছবিটা ঝুঁকে পড়ে আর একবার দেখে সুরিন্দার।

     —হুঁ। খুব সম্ভব বিজনের সঙ্গী শতদলের আর নিতাইয়ের খবর ওদের জানিয়ে দিয়ে থাকবে।

     সবার মুখের দিকে একবার তাকান ডক্টর শিপ্রা।

     রাতটুকু কাটার অপেক্ষা কেবল। কৌস্তূভের ভয়ানক জন্তুজানোয়ারের কথা এদের অজানা নয়, সুতরাং রাতের বেলা এরা কোনও ঝুঁকি নেবে না। কিন্তু সকাল হলেই শুরু হয়ে যাবে এদের আক্রমণ।

     ট্যাটু করা দু-হাত বুকের ওপর ভাঁজ করেন সুজয় বোস।

     —ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ না হয় আমরা কোনও ভাবে ঠেকাবো। কিন্তু শতদল আর নিতাইকে সাবধান করা যাবে কি করে? ট্র্যান্সমিটার তো নষ্ট হয়ে গেছে, রেডিও সিগন্যাল পাহাড়ের পেছনে যাবে না। আর একটা ট্র্যান্সমিটার বানানোর মতন পার্টসও এই মূহূর্তে আমাদের কাছে নেই।

     সুচেতার দিকে তাকান ডক্টর শিপ্রা।

     —ও কাজটা সুচেতাকেই করতে হবে। সুচেতা, আলো ফোটার আগেই তোমাকে ক্যাম্প ছেড়ে পালাতে হবে। না হলে সাঁড়াশি আক্রমণের ফাঁদে এখানেই আটকে যাবে। যে করেই হোক তোমাকে নিতাই আর শতদলকে সাবধান করে দিতে হবে। না হলে কিছু বোঝার আগেই ওরা আচমকা আক্রমণের মুখে পড়ে যাবে।

     বুকের ভেতরের জমতে থাকা ভয়টাকে জোর করে সরিয়ে দেয় সুচেতা।

     —আমার যেতে আপত্তি নেই ম্যাডাম। কিন্তু নিতাইদা আর শতদল তো এতক্ষণে এগিয়ে গেছে অনেকটাই। তাদের ধরবো কি করে?

     একটা ম্যাপ নামিয়ে রাখেন নীলেশ পাঠক টেবিলের ওপর।

     —শতদল আর নিতাই গেছে ঘুরপথে, সরযূ পাস ধরে। তা ছাড়া কাল সকালে পাহাড়ের মাথায় ট্রান্সমিশন টাওয়ার বসাতেও ওদের খানিক্ষণ সময় যাবে। তুমি যাবে আনন্দী পাস ধরে। দুর্গম পথ বটে, কিন্তু দূরত্ব অপেক্ষাকৃত কম। ম্যাপের এখানটা দেখো, সরযূ আর আনন্দী পাসের মাঝের পাহাড়টা এখানে খানিকটা নিচু। এখান দিয়ে তুমি আনন্দী পাস থেকে সরযূ পাস পৌঁছে যেতে পারবে। যদি তাড়াতাড়ি করো, তাহলে শ্যামলাঝোরার আগেই হয়তো ধরতে পারবে ওদের।

     একটা রাইফেল বাড়িয়ে ধরে সুরিন্দার।

     —সঙ্গে এটা নিও, রাস্তায় তোমার ওপরেও আক্রমণ হতে পারে।

     হাত নেড়ে নিষেধ করে সুচেতা।

     —রাইফেল আমি ভালো করে চালাতে জানি না। তা ছাড়া ওই পাহাড়ি রাস্তায় এত ভারী রাইফেল নিয়ে আমি তাড়াতাড়ি হাঁটতেও পারবো না।

     হোলস্টার থেকে স্প্রিং পিস্তলটা সুচেতার দিকে বাড়িয়ে ধরেন ডক্টর শিপ্রা।

     —এটার পাল্লা রাইফেলের মতন নয়। শত্রু খুব কাছে না থাকলে এটা ব্যবহার করা যায় না। আদৌ কোনও কাজে লাগবে কি না জানি না, তাও এটা রাখো।

     রাইফেল রেখে দিয়ে একটা ছোট রেডিও সুচেতার দিকে এগিয়ে দেয় সুরিন্দার।

     —এটা সাবধানে রেখো। রেডিও যোগাযোগ না করতে পারলে পাহাড়ে নিতাই আর শতদলকে খুঁজে পাবে না।

     চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান নীলেশ পাঠক।

     —শিপ্রা, আর একটা ব্যাপার তোমার হয়তো জানা দরকার, কারণ তোমার একটা পুরানো ইতিহাস আছে। ব্যাটারী ফুরিয়ে গিয়ে কম্পিউটার বন্ধ হয়ে যাওয়াতে বিজনের সঙ্গীর পাঠানো সিগন্যাল আমি পুরোটা পড়তে পারিনি—

     ব্যাণ্ডেজ বাঁধা কপালে দু-আঙুলে চেপে ধরেন নীলেশ পাঠক।

     —তবে শুরুটা দেখে মনে হয়েছে এই ভাড়াটে পল্টনের কমাণ্ডারের নাম মেজর পরেশ।

     একটা অস্ফূট আর্তনাদের শব্দে সবাই একসঙ্গে অবাক চোখে তাকায় সুচেতার দিকে।

     থরথর করে কাঁপে সুচেতা, তার হঠাৎ পাংশু হয়ে যাওয়া মুখে আতঙ্কেরর ছাপ সুস্পষ্ট।

     —আমাকে আর ফ্রিডম ইনিশিয়েটিভের অন্যদের যে ভাড়াটে খুনিরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাদেরও মাথায় ছিল মেজর পরেশ।

 

(১৫)

     বিদ্যুৎ নেই, মশালের লালচে আলো ছড়িয়ে থাকে ক্যান্টিন রুমের টেবিলে। টেবিলে ছড়ানো ম্যাপ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকেন নীলেশ পাঠক, সুজয় বসু আর ডক্টর শিপ্রা। একটু দূরে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে সুরিন্দার।

     এখানে মিলিটারি অভিজ্ঞতা আছে একমাত্র ডক্টর শিপ্রার, তাই নির্দেশ দেন তিনিই।

     —ওরা আমাদের দু-দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ করবে। উত্তর পশ্চিমের পাহাড় থেকে একটা দল আমাদের দূর পাল্লার বন্দুক দিয়ে সন্তোষগঞ্জের ভেতরে আটকে রাখার চেষ্টা করবে। আর একটা দল ঠিক তার কোনাকুনি দক্ষিণপূর্ব থেকে সন্তোষগঞ্জে ঢোকার চেষ্টা করবে।

     ম্যাপে উত্তরপশ্চিমের অযোধ্যা পাহাড়ের একটা অংশে আঙুল রাখেন ডক্টর শিপ্রা।

     —প্রথম দলটা এইখানে পজিশন নেবে। এদের কাছে ফোটন কামান থাকবে, মিসাইল থাকাও অসম্ভব নয়।

     টেবিলে ভর দিয়ে ম্যাপের ওপর ঝোঁকেন নীলেশ পাঠক।

     —আদরিনীতে একটা টর্পেডো সিস্টেম ছিল। মহাকাশে সামনে উল্কাপিণ্ড পড়লে বা দরকার পড়লে কৌস্তূভে পাহাড় ফাটিয়ে ল্যাণ্ডিং সাইট বানানোর জন্যে এটাকে আদরিণীতে বসানো হয়েছিল। কিন্তু আমাদের এটা প্রয়োজন হয়নি। সবকটা টর্পেডোই রয়ে গেছে। একটু রদবদল করে দিলে এই টর্পেডো সিস্টেম দিয়ে হয়তো এদের মিসাইল খানিকটা আটকানো যাবে। কিন্তু দক্ষিণ দিকটা?

     ম্যাপে সন্তোষগঞ্জের দক্ষিণ দিকটা ঝুঁকে দেখেন ডক্টর শিপ্রা।

     —এরা খুব সম্ভব দুলারীর ল্যাণ্ডিং সাইটের কাছাকাছি নেমেছে। ওইখান থেকে ওরা সন্তোষগঞ্জে ঢোকার চেষ্টা করবে। একবার ভেতরে ঢুকতে পারলে আমাদের রিঅ্যাক্টরটাকে কোনওভাবে ওড়ানোর ব্যবস্থা করে ওরা সন্তোষগঞ্জ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয় নেবে।

     নিচু হয়ে ম্যাপটা দেখেন সুজয় বোস।

     —রিঅ্যাক্টর ওড়ানোর কি দরকার আছে ওদের? অযোধ্যা পাহাড়ের ওপর থেকে ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়েই তো আমাদের খতম করে দিতে পারে ওরা।

     ঘাড় নাড়েন ডক্টর শিপ্রা।

     —না। ওরা ওদের স্ক্রিপ্ট পালটাবে না। অ্যাক্সিডেন্টে রিঅ্যাক্টর উড়ে গিয়ে আমাদের কলোনি নষ্ট হয়ে গেছে, এই গল্পটা পৃথিবীর মানুষের কাছে বেচতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কর্পোরেটের শেকল কেটে অন্য কোথাও দূরে কেউ বসতি করার ঝুঁকি না নেয়।

     ক্যান্টিনের খোলা দরজা দিয়ে এক ঝলক হাওয়া বয়ে আনে কৌস্তূভের বুনো গন্ধ। দপদপ করে মশালের আলো, লম্বা ছায়াগুলো প্রেতের মতন সরে যায় একপাশ থেকে আর এক পাশে।

     —তা ছাড়া এরা ময়দানে নেমেছে বিজনের অন্তর্ঘাত সফল হয়নি বলে। নাহলে এরা কেবল হয়তো রিঅ্যাক্টর বিস্ফোরণে কেউ বেঁচে গিয়ে থাকলে তাদেরকে খতম করে দুলারীতে পাঠানো নিজেদের লোকেদের নিয়ে ফেরৎ চলে যেত।

     মাথার পনিটেলটা মাথার ঝটকায় পিঠের দিকে পাঠিয়ে দেন ডক্টর শিপ্রা।

     —আমাদের সঙ্গে লম্বা লড়াই করার এদের মানসিকতাও নেই, রসদও নেই।

     ডক্টর শিপ্রার দিকে তাকায় সুরিন্দার।

     —আমাদের তাহলে দুদিক থেকে এদের ঠেকাতে হবে?

     —দু-দিকে আমাদের স্ট্রাটেজি দুরকম হবে। উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়ে এদের পজিসন দুর্ভেদ্য। এখান থেকে লড়াই করে আমরা ওদের হঠাতে পারবো না। আমাদের কাজ হবে বাড়ির আড়াল থেকে এদের আক্রমণের উত্তর দেওয়া।

     —আর দক্ষিণে?

     —আসল লড়াইটা দক্ষিণে হবে। দক্ষিণে যারা নেমেছে তাদের অনেকটা ফাঁকা মাঠে পেরিয়ে সন্তোষগঞ্জ পৌঁছতে হবে।

     ম্যাপটা ঝুঁকে দেখে সুরিন্দার।

     —হ্যাঁ আমরা যদি এইদিকটা একটা ব্যারিকেড তৈরি করি তাহলে এদের অনেক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পারবো।

     মাথা নাড়েন ক্যাপ্টেন শিপ্রা।

     —না! আমরা ব্যারিকেড বানাবো। কিছুক্ষণ ওদের আটকেও রাখবো। কিন্তু তারপর পিছু হটে ওদের সন্তোষগঞ্জে ঢোকার সুযোগ করে দেব।

     —সেকি! পিছু হটবো কেন?

     বিস্ময় কণ্ঠে প্রশ্ন করেন সুজয় বোস।

     আলোছায়া পড়া সবকটা মুখের দিকে পালা করে তাকান ডক্টর শিপ্রা।

     —বেশিক্ষণ লড়ার আমাদের ক্ষমতা নেই সুজয়। একটা কথা ভুলে যাচ্ছ—আমাদের অক্সিজেন টক্সিসিটির ওষুধ ফুরিয়ে গেছে। ওষুধ ছাড়া আমরা কেউ বিকেল অবধি টিকতে পারবো না।

     দূর থেকে ভেসে আসে কৌস্তূভের কোনও অজানা জন্তুর চিৎকার। নীরবে সবাই তাকিয়ে থাকে ডক্টর শিপ্রা মুখের দিকে।

     —নিতাই আর শতদল যদি শ্যামলাঝোরা থেকে ড্রোন পাঠিয়েও দেয়, তাহলেও আমরা ড্রোন থেকে সন্তোষগঞ্জে বিদ্যুৎ টেনে আনতে পারবো না। পশ্চিম দিকের আনন্দীর পাড়টা অযোধ্যা পাহাড়ের ওপরের হানাদারদের রাইফেল আর মিসাইলের পাল্লায় থাকবে।

     একটা লম্বা নিঃশ্বাস টানেন নীলেশ পাঠক।

     —তাহলে উপায় কী?

     —দক্ষিণের হানাদারদের সন্তোষগঞ্জের ভেতর টেনে এনে খতম করে দিতে হবে। তাহলে উত্তরের পাহাড়ের হানাদাররা বাধ্য হবে নিচে নেমে সন্তোষগঞ্জের ভেতরে রিঅ্যাক্টর আক্রমণ করতে। তাদেরকে যদি এক জায়গায় আটকে রাখা যায়, তাহলে সেই সুযোগে কেউ নদী থেকে বিদ্যুতের তারটা সন্তোষগঞ্জ অবধি টেনে আনতে পারবে। এই প্ল্যানে রাজী সবাই?

     সবার মুখের দিকে পালা করে একবার তাকান ডক্টর শিপ্রা। সম্মতিতে মাথা নাড়ে সকলেই।

     ম্যাপটা গুটিয়ে ফেলেন ডক্টর শিপ্রা, হুকুম দিতে থাকেন মিলিটারি কায়দায়

     —বেশ। উত্তরের ডিফেন্সের দায়িত্ব আমার। সুরিন্দার তুমি দক্ষিণের দিকটা তোমার টিম নিয়ে সামলাবে। তোমায় ঠিক কি করতে হবে আমি এই মিটিং-এর পর তোমায় আলাদা করে বুঝিয়ে দেব। নীলেশ, তুমি টর্পেডো সিস্টেমের দায়িত্বে।

     ডক্টর শিপ্রার দিকে তাকান সুজয় বোস। চিন্তার ভাঁজ পড়ে তাঁ কপালে।

     —শিপ্রা, ক্যাম্পের লোকজনদের নিরাপত্তার কি হবে? বিশেষত যারা লড়াই করবে না?

     —সন্তোষগঞ্জের বাইরের দিকে আস্তানাগুলো খালি করে দাও, লোকজনকে সরিয়ে আনো ক্যান্টিনের আশেপাসে।

     —শুধু কি তাতে এনার্জী অস্ত্রের থেকে বাঁচা যাবে। আমাদের সমস্ত বাড়ি তো কাঠের তৈরি, কতক্ষণ আটকে রাখেবে আক্রমণ?

     ডক্টর শিপ্রা কিছু বলার আগে উত্তর দেন নীলেশ পাঠক।

     —উত্তাপ আর উল্কাপিণ্ডের ধাক্কা থেকে বাঁচতে দুলারীর গায়ে যে সেরামিকের বর্ম লাগানো ছিল, সেগুলো পাটা করে কেটে করে কন্ট্রোল রুমের পেছনে জড় করা আছে। যে সব বাড়িতে লোকেরা আশ্রয় নেবে, সেগুলোর গায়ে পাটাগুলো লাগিয়ে দাও। এনার্জী অস্ত্রের হাত থেকে অনেকটা বাঁচাবে।

     একে একে বেরিয়ে যায় সবাই। দাঁড়িয়ে থাকে কেবল সুরিন্দার।

     ম্যাপটা আর একবার খোলেন ডক্টর শিপ্রা।

     —দক্ষিণের দিকটা একবার ভালো করে দেখো সুরিন্দার। এইখানে ব্যারিকেড বসবে। ঘন্টাখানেক লড়াইয়ের পর তুমি তোমার টিম নিয়ে সরে আসবে এই জায়গাটা। তারপর—

 

(১৬)

     উপত্যকা কথাটা বোধহয় খানিকটা বাড়িয়ে বলা। দুপাশের পাহাড় চিরে নেমে এসেছে আনন্দী নদী, তার দুপাশে শুকনো জমি অল্পই। পাহাড় আর নদীর মাঝখানের জায়গটা ঢাকা অজস্র ছোট বড় পাথরে, তাদের এখানে সেখানে নীলচে শাওলার ছোপ।

     একটা বড় পাথরে বসে হাঁপায় সুচেতা। তার মাথার চুল ঘামে ভিজে লেপ্টে থাকে কপালে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে বুক পিঠ ওঠা পড়া করে হাপরের মতন।

     পেছনে ফেলে আসা খাড়াইটার দিকে তাকায় সুচেতা। একটু আগেই ওইখান দিয়ে ওঠার সময় পা হড়কেছিল তার, প্রায় গড়িয়ে পড়েই যাচ্ছিল সে নিচে, একটা ঝোপকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে কোনও রকমে রক্ষা পেয়েছে।

     হাঁটু আর কনুইয়ের ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলো নদীর জলে ধোয় সুচেতা, আঁজলা করে জল ছেটায় চোখে মুখে, তারপর ফের চড়তে শুরু করে ওপরের দিকে।

     খানিকটা উঠে থামতে হয় সুচেতাকে। পথ আটকে রেখেছে একটা মানুষপ্রমাণ উঁচু পাথরের চাঁই, গায়ে তার নীল শ্যাওলার পুরু কার্পেট।

     একপা পিছিয়ে গিয়ে পাথরটাকে ভালো করে দেখে সুচেতা। পাথরের একদিক ডুবে রয়েছে নদীতে, সেখানে শব্দ করে আছড়ে পড়ছে নদীর জল। অন্যদিকটা প্রায় ঠেকে রয়েছে পাহাড়ের গায়ে। পাহাড় আর পাথরের মাঝখানের জায়গাটাতে মাথা তুলেছে ঝোপঝাড়ের দুর্ভেদ্য জঙ্গল।

     সামনের দুটো বিকল্প পথই খুঁটিয়ে দেখে সুচেতা। পাহাড়ের দিকের ঘন ঝোপঝাড় ঠেলে সামনে এগনো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু নদীর দিকটাও কম বিপজ্জনক নয়। আনন্দীর জল সেখানে পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে ফুঁসছে, পাথরগুলোও জলে আর শ্যাওলায় পেছল হয়ে রয়েছে। কোনওমতে পা ফস্কালে জলের স্রোত টেনে নিয়ে যাবে পাহাড়ের নিচে।

     দুটো পথই ভালো করে দেখে, নদীর দিকটা দিয়ে যাওয়াই মনস্থ করে সুচেতা। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়াটাই কেবল অসুবিধের নয়, ওর মধ্যে কৌস্তূভের কোনও হিংস্র প্রাণী লুকিয়ে থাকাটাও অসম্ভব নয়।

     কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা দড়ির গোছা আর একটা পাহাড় চড়া গজাল বের করে সুচেতা। গজালটা পাথরের গায়ে বসিয়ে টিপে দেয় তার ওপরের বোতামটা। একটা ছোট্ট বিস্ফোরণের আওয়াজ করে গজালের মুখ গেঁথে যায় পাথরের ভেতর, তার মাথা থেকে তিনটে আংটা নেমে এসে বাঁকানো আঙুলের মতন আঁকড়ে ধরে পাথরকে।

     দড়ির একপ্রান্ত নিজের কোমরে জড়ায় সুচেতা, অন্য প্রান্ত বাঁধে গজালে। তারপর দড়িটা টানটান করে ধরে রেখে পা রাখে আনন্দীর জলে।

     খরস্রোতা নদী তাকে প্রতি মুহূর্তে টেনে ফেলে দিতে চায় জলে, সন্তর্পণে ধীরে ধীরে পাথরে পা ফেলে একটু একটু করে এগোতে থাকে সুচেতা। এখানে পায়ের নিচের জমি একবার হারালে উঠে দাঁড়ানো অসম্ভব হবে।

     নদীতে বেরিয়ে থাকা বড় পাথরটার যখন প্রায় অর্ধেকটা বেড় দিয়ে পাড়ের অন্য দিকটার কাছে এগিয়ে এসেছে সুচেতা, তখন হঠাৎ শব্দ করে লাফিয়ে ওঠে মাঝ নদীর জল।

     চমকে ওঠে সুচেতা। হৃৎপিণ্ডটা তার যেন লাফিয়ে ওঠে গলার কাছে। জলটা কৌস্তূভের কোনও অজানা জীব ছিটিয়িছে মনে করে আতঙ্কে সিঁটিয়ে যায় সে।

     কিন্তু পরক্ষণেই ফের দু-দুবার শব্দ করে ছিটকে ওঠে জল, আর সেই সঙ্গে ভুলে ভাঙে সুচেতার। কোনও জলজন্তু নয়, জল ছিটকেছে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া পাথরে। পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে ছোটবড় কয়েকটা পাথর ছিটকে পড়েছে নদীর জলে।

     একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফের সামনের দিকে এগোতে যাচ্ছে সুচেতা, এমন সময়ে কি মনে করে পাহাড়ের ওপরে দিকে তাকায় সে।

     মিহির উঠে এসেছে আকাশের অনেকখানি ওপরে, তার তেজে পূর্বদিকে তাকানো দায়, তবু তার মধ্যেই সুচেতার মনে হল পাহাড়ের মাথায় আলো পড়ে ঝলসে উঠলো কিছু একটা।

     দড়ি থেকে একহাত সরিয়ে নেয় সুচেতা, পা শক্ত করে চেপে রাখে ভিজে পাথরে। পাশের ব্যাগ থেকে একটা মনোকিউলার বের করে চোখে লাগিয়ে তাকায় ওপর দিকে।

     আকাশের উজ্জ্বল প্রেক্ষাপটের জন্যে প্রথমটা চোখ ধাঁধিয়ে গেলেও কয়েক সেকণ্ডের মধ্যেই নিজে থেকেই আলোর ফিল্টার পালটে ফেলে মনোকিউলার। পাহাড়ের মাথায় বসে থাকা মানুষটাকে খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় না সুচেতার। তার রাইফেলের নল তাক করা নিচে নদীর দিকে, আলো পড়ে মাঝ মধ্য চমকায় স্কোপের লেন্স।

     লোকটা যে পৃথিবী থেকে পাঠানো হানাদার সুচেতার তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তার নাড়াচাড়াতে পাথর গড়িয়ে পড়ে সুচেতা সাবধান না হয়ে গেলে এতক্ষণে সে গিয়ে পড়ত রাইফেলের পাল্লার মধ্যে।

     খরস্রোতা আনন্দীর হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে মনোকিউলার চোখে অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করে সুচেতা। লোকটাকে এড়িয়ে তার সামনে যাওয়ার কোনও রাস্তা নেই। পাথরের আড়ালে লোকটা তাকে দেখতে পাচ্ছে না বটে, কিন্তু পাথরে পেরিয়ে গেলেই তার নজরে পড়ে যাবে সুচেতা। আর তার ওই দুরপাল্লার রাইফেলের মোকাবিলা করার জন্যে সুচেতার কাছে কোনও অস্ত্রও নেই। তার কাছে হাতিয়ার বলতে কেবল ডক্টর শিপ্রার দেওয়া স্প্রিং পিস্তল, আর পাহাড়ের মাথায় বসা হানাদার তার পাল্লার বাইরে।

     কি করবে স্থির করতে না পেরে হাঁটু জলেই নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সুচেতা। নদীর পাড় ধরে যাওয়া অসম্ভব, ওই দূর পাল্লার রাইফেলের সামনে সে কয়েক মিনিটও টিকবে না। তবে কি সে ফেরৎ যাবে? আন্ন্দী পাস ছেড়ে সরযূ পাস ধরে সামনে যাবার চেষ্টা করবে?

     নিজের মনেই মাথা নাড়ে সুচেতা, না, তা সম্ভব নয়। অনেক দেরি হয়ে যাবে। ততক্ষণে শতদল আর নিতাই হয়তো পড়ে যাবে চোরাগোপ্তা আক্রমণের মুখে। তা ছাড়া পরেশ যে সরযূ পাসেও পাহারা বসায়নি, তারই বা কি নিশ্চয়তা আছে?

     চোখে মনোকিউলার লাগিয়ে আনন্দী আর সরযূ পাসের মাঝের পাহাড়ের মাথাগুলো ভালো করে দেখে সুচেতা, যদি হানাদারের নজর এড়িয়ে সেখান দিয়ে টপকে সরযূ পাসে যাওয়া যায়। কিন্তু ফের নিরাশ হতে হয় তাকে। ওই দেওয়ালের মতন খাড়া পাহাড়ে দক্ষ পর্বতারোহী ছাড়া কারোর পক্ষে সম্ভব নয়।

     মনোকিউলারের একটা বোতামে হালকা হাত ছোঁয়ায় সুচেতা। মনোকিউলার হানাদারকে ছাড়িয়ে ফোকাস করে পাহাড়ের আর এক অংশে। একটা ছোট লাল বিন্দু দপদপ করতে থাকে মনোকিউলারে দেখতে পাওয়া অংশের একটা জায়গার ওপর।

     অর্থাৎ আনন্দী পাস থেকে সরযূ পাসে যাবার পথ ওই একটিমাত্রই। পরেশের অনুচরকে টপকে সেখানে না পোঁছতে পারলে সরযূ পাসে যাওয়া সম্ভব নয়।

     হতাশ মনে মনোকিউলার নামাতে গিয়ে হঠাৎ সুচেতার মনে হয় পাহাড়ের গায়ে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। ফের চোখে মনোকিউলার লাগায় সে, ভালো করে খুঁটিয়ে নজর করে জায়গাটা।

     মনোকিউলারের বৃত্তের মতো দৃশ্যপটের মধ্যে সুচেতা দেখতে পায় হানাদারের থেকে খানিকটা দূরে, পাহাড়ের গায়ে একটা গাছের নিচে চলেফিরে বেড়াচ্ছে গোটা তিনেক বিছে ইঁদুর।

     চকিতের মধ্যে একটা চিন্তা খেলে যায় সুচেতার মাথায়। পাহাড়ের ওপর থেকে পরেশের সৈন্যকে তাড়ানোর একটা মরিয়া চেষ্টা করে দেখবে সে। অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ, তার নিজের প্রাণ হারানোর ঝুঁকি যথেষ্ট। কিন্তু বন্ধুদের সময় থাকতে সাবধান করতে গেলে এ ছাড়া তার কাছে আর কোনও রাস্তা নেই।

     অতি সাবধানে বড় পাথরটা বেড় দিয়ে আরও সামনের দিকে এগিয়ে আসে সুচেতা। পাথরের আড়াল থেকে বের করে আনে কাঁধ আর মাথা।

     —ওই!! ওই!!

     পাহাড়ে বসা পাহারাদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সুচেতা চিৎকার করে তারস্বরে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই ফের শরীর গুটিয়ে আনে পাহাড়ের আড়ালে।

     তার চেষ্টা ব্যর্থ হয় না। একটা কড়াৎ শব্দ করে পাথর লক্ষ করে উড়ে আসে প্লাজমার লালচে রেখা। ছিটকে যায় ধূলো আর পাথরের টুকরো।

     পাথরের আড়াল থেকে মনোকিউলারে চোখ রাখে সুচেতা। সচকিত হয়ে উঠেছে পাহাড়ের ওপরের বিছে-ইঁদুরগুলো, ঝিনুকের মতন শ্রবণ ইন্দ্রিয় বসানো মাথাটা এদিক সেদিক ঘুরিয়ে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে বাজ পড়া আওয়াজের উৎস।

     আর একবার পাথরের আড়াল থেকে মাথা বের করে সুচেতা। এবার আর চেঁচানোর প্রয়োজন হয় না। বাজ পড়া শব্দে ছুটে আসা প্লাজমা সুচেতার মাথার ওপর দিয়ে তির্যক রেখায় আঘাত করে পাথরে।

     ফোয়ারার মতন ছিটকে ওঠে পাথরকুঁচি, সুচেতা মাথা সরানোরর আগেই তার একটার আঘাতে গাল দিয়ে নেমে আসে রক্তের ধারা।

     উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপে সুচেতা, শক্ত হাতে দড়ি টেনে রেখে কোনওমতে সামলে রাখে নিজেকে।

     কাঁপাকাঁপা হাতে আবার চোখে মনোকিউলার রাখে সুচেতা। আওয়াজের অবস্থান বুঝতে পেরেছে বিছে-ইঁদুরেরা। স্প্রিঙের মতন লাফিয়ে লাফিয়ে ছূটে আসছে রাইফেলধারীর দিকে। আর একবার—আর কিছুক্ষণের জন্যে পরেশের সৈন্যের নজর আটকে রাখতে হবে তার নিজের ওপর। যাতে সে বিছে-ইঁদুরদের উপস্থিতি টেরই না পায়।

     জামার হাতায় গালের রক্ত মুছে মাথাটা ফের সামনে বাড়ায় সুচেতা। ফের বাজপড়া শব্দে গর্জে ওঠে রাইফেল। এবার অল্পের জন্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় প্লাজমা, সুচেতার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় তার লালচে রেখা।

     পাথরের আড়ালে সরে এসে মনোকিউলারে চোখে রাখে সুচেতা। স্কোপে চোখ লাগিয়ে রাইফেলধারী নজর রেখেছে নদীর পাথরটার দিকে। তার অজান্তে বিছে-ইঁদুর তিনটে প্রায় পৌঁছে গেছে তার খুব কাছে।

     প্রায় শেষ মুহূর্তে পরেশের সৈন্য টের পায় বিছে-ইঁদুরের উপস্থিতি। রাইফেল ঘুরিয়ে সে মোকাবিলা করার চেষ্টা করে নতুন শত্রুর, কিন্তু ততক্ষণে খুব দেরি হয়ে গেছে।

     পাহাড়ে উপত্যকায় ছড়িয়ে যাওয়া একটা আর্ত চিৎকার সত্ত্বেও কি ঘটছে আর দেখার চেষ্টা করে না সুচেতা। বড় পাথরটাকে পুরোটা বেড়া দিয়ে সে এসে পড়ে নদী পাড়ের অন্য দিকটায়। তারপর ছড়ানো ছেটানো ছোটবড় পাথরের ওপর দিয়ে ছুটতে আরম্ভ করে পাহাড়ের সে দিকটায়, যেখানটায় খানিক আগেই মনোকিউলার সরযূ পাস যাওয়ার পথের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

 

(১৭)

     পাহাড়ের ওপরে এখানে উঁচু গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে পরস্পরের সঙ্গে বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে। তাদের মাঝের জমিতে বেছানো শুকনো পাতার গালিচায় মস্‌মস্‌ আওয়াজ তুলে হেঁটে চলে নিতাই আর শতদল। তাদের পেছনে হ্যাঁচকা টানে পা তুলে তুলে হেঁটে চলে নেট টার্বাইনের লম্বা বাক্সটা।

     ওপরের দিকে একবার তাকায় শতদল। শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে এ ডাল থেকে ও ডালে দুলে দুলে লাফিয়ে যায় সপ্তপাশের দল, তাদের পিচ্ছিল শরীরে মিহিরের আলো পড়ে চকচক করে।

     ওপর দিকে তাকায় নিতাইও,

     —দেখেছ? গাছের অক্টোপাশ!

     হাসে শতদল।

     —নিতাইদা। অক্টোপাসের আটটা শুঁড় থাকে, আর এদের—

     —সাতটা। এদের সাতটা শুঁড় থাকে। আর জলের বদলে এরা থাকে গাছে। বললাম না, এখানকার সবই অদ্ভূত, একজন্মে দেখে শেষ হবে না।

     দূরে কোথাও পটকা ফাটার মতন ফট্‌ফট্‌ আওয়াজ ওঠে। গাছের আড়াল থেকে আকাশে লাফিয়ে ওঠে জবা পাখির দল, তাদের চোঙের মতন ঠোঁট থেকে বেরনো সুরেলা শিসের শব্দ ভরিয়ে ফেলে বাতাস। উত্তরে অবিকল বাঁদরের মতন কিচকিচ আওয়াজ তোলে সপ্তপাশের দল, তারপর ডালে ডালে দুলে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে যায় যেদিকে থেকে আওয়াজ এসেছিল সেদিকে।

     কলালে ভ্রু তোলে নিতাই।

     —কে পটকা ফাটালো বল তো?

     —পটকা নয় নিতাইদা। মনে নেই সুজয়দা বলছিলেন, এ গ্রহের প্রাণীরা গন্ধের বদলে শব্দের ওপর বেশি নির্ভরশীল? খুব সম্ভব কোনও গাছের ফল ফেটে গিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। এবার এইসব পাখি আর সপ্তপাশ সেগুলো খাবে, তার বীজ ছড়িয়ে দেবে এপাশে ওপাশে।

     একটা ঝোপের দিকে আঙুল তুলে দেখায় নিতাই। সেখানে আঙুরের মতন থোকাথোকা ফল ধরে রয়েছে।

     —এইগুলো হয়তো। না?

     —হতে পারে।

     কপালে ফের ভ্রু তোলে নিতাই।

     —বাঁদুরে অক্টোপাস, গেছো পটকা। আর কত কি যে দেখবো!

     —অনেক কিছু দেখবো আমরা নিতাইদা, কিন্তু আপাতত চলো ট্রান্সমিটার লাগিয়ে ফেলি। এইখানটা খালি জায়গা রয়েছে।

     শতদল যে দিকে ইঙ্গিত করে সেখানে গাছগুলোর মাঝে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। মিহিরের আলো উজ্জ্বল চাদরের মতন লুটিয়ে রয়েছে সেখানে।

     পিঠ থেকে ব্যাগ নামায় নিতাই আর শতদল, মালপত্র ছড়িয়ে বেছায় মাটির ওপর। একটা গাঁইতি দিয়ে মাটিতে গর্ত করে নিতাই, ট্রান্সমিশন টাওয়ারের লম্বা টুকরোগুলো পরের পর জুড়তে থাকে শতদল।

     উঁচু টাওয়ারটা যখন দুজনের বিরামহীন পরিশ্রমে উঠে দাঁড়ায়, ততক্ষণে মিহির উঠে এসেছে আকাশের অনেকখানি ওপরে।

     মাথার ঘাম মুছে ওপর দিকে তাকায় নিতাই। প্লাস্টো-স্টিলের একপায়া টাওয়ারটা গাছের মাথা ছাড়িয়েছ। তার ওপরের দিকে দুপাশে ডানা মেলেছে রোদ-প্যানেল, তাদের মাঝে মন্থর গতিতে পাক খায় গোল থালার মতন অ্যান্টেনা।

     —যাক! লাগানো হয়ে গেল! এবার ঠিকঠাক কাজ করছে কি না দেখে নাও।

     ব্যাগ থেকে একটা রেডিও বের করে চালু করে শতদল।

     —হ্যালো সন্তোষগঞ্জ! হ্যালো সন্তোষগঞ্জ!

     —কোনও সাড়া আসে না।

     কপাল কোঁচকায় নিতাই।

     —টাওয়ারটা ঠিকঠাক কাজ করছে তো?

     টাওয়ারের মাথায় দপদপ করে জ্বলতে থাকা লাল আলোটার দিকে নির্দেশ করে শতদল।

     —ঠিক আছে বলেই তো মনে হচ্ছে!

     —আর একবার চেষ্টা করে দেখো তাহলে।

     আরও একবার কেন, প্রায় চার পাঁচ-বার চেষ্টা করে শতদল। কিন্তু কোনও সাড়া মেলে না।

     আশঙ্কার ছায়া পড়ে নিতাইয়ের চোখে।

     —ক্যাম্পের ওপর ফের কোনও আক্রমণ হল না তো?

     চিন্তিত দেখায় শতদলকেও।

     —আক্রমণ হয়ে থাকতে পারে। কিংবা কেবল ওদের ট্র্যান্সমিটারটা বিগড়ে গিয়ে থাকতে পারে। এখান থেকে আন্দাজ করা মুস্কিল।

     —কি করবে? ফেরৎ যাবে?

     মাথা নাড়ে শতদল।

     —না, কাজ পুরো না করে ফেরা যাবে না। বিদ্যুৎ না থাকলে সন্তোষগঞ্জের বাঁচা মুস্কিল হবে। আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

     —কিন্তু—

     মৃদু আপত্তি জানানোর চেষ্টা করে নিতাই, কিন্তু তার আগেই যান্ত্রিক ঘূর্ণনের শব্দ তুলে গাছের আড়াল থেকে তাদের দিকে উড়ে আসে গোলাকার কিছু, দিনের আলো ছিটকে যায় তার বলের মতন আকার থেকে।

     —নিতাইদা—

     একটা তীব্র চিৎকার তুলে মাটিতে ঝাঁপ দেয় শতদল।

     বিপদটা কি বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না লড়াইয়ে পোড় খাওয়া নিতাইয়েরও। একদিকে সরে গিয়ে মাটিতে ঝাঁপ দেয় সেও।

     মাটিতে পড়ে দু-পাক গড়িয়ে যায় শতদল। তারপর চিৎ একটা পাথর তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারে উড়ন্ত বলের দিকে।

     নিশানা ফস্কায় না শতদলের। পাথর গিয়ে লাগে উড়ে আসা গোলকের গায়ে।

     একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে উড়ে যায় গোলক, তার আগুনের হলকা ছিটকে যায় আকাশের দিকে, উত্তাপে দু-একটা গাছ জ্বলে ওঠে দাউদাউ করে। গাছের ডালে দোল খেয়ে পালাতে থাকে আতঙ্কিত সপ্তপাশের দল, ঝটপট করে আকাশে পাখা মেলে জবা পাখি।

     মাটিতে বসে হাঁপায় নিতাই।

     —হাওয়া গ্রেনেড!! তুমি আর একটু দেরিতে দেখলেই আমাদের—

     লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় শতদল।

     —রাইফেল, নিতাইদা! রাইফেল! গ্রেনেডটা যারা ছেড়েছে তারা আসেপাশেই কোথাও আছে। রাইফেল ওঠাও, শিগ্‌গির।

     খানিক দূরে শুকনো পাতার ওপর পড়ে থাকা রাইফেলটা লক্ষ করে বসা অবস্থাতেই ঝাঁপ দেয় নিতাই।

     কিন্তু রাইফেল অবধি পৌঁছতে পারে না নিতাই। তার আগেই গাছের আড়াল থেকে উড়ে আসে একটা বিদ্যুৎ চাবুকের শেষ প্রান্ত, সপাং সপাং আওয়াজে জড়িয়ে যায় নিতাইয়ের গলায়। গলার বাঁধন ছাড়াতে চেষ্টা করে নিতাই, কিন্তু চাবুক বেয়ে ছুটে আসে বিদ্যুতের নীল দ্যুতি, চড়চড় আওয়াজে ঘিরে ধরে নিতাইয়ের গলা।

     দুহাতে গলা চেপে ধরে মাটিতে হাঁটু রেখে যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে নিতাই। তার আর্তনাদ ছড়িয়ে যায় বাতাসে।

     গাছের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে কেউ। মাথায় টুপি, পরণে পলিমারের কালো বর্ম। এক হাতের মুঠোয় ধরা বিদ্যুৎ চাবুকের প্রান্ত, অন্য হাতে দোলে খাটো নলের সাব-রাইফেল।

     নিতাইয়ের দিকে তাকায় বটে শতদল, কিন্তু তাকে সাহায্য করা সুযোগ পায় না। তার আগেই তার শরীর লক্ষ করে ছুটে আসে প্লাজমার লাল রেখা, নিতাইয়ের আর্তনাদ মুহূর্তের জন্যে ঢাকা পড়ে যায় রাইফেলের বাজ পড়া শব্দে।

     শরীরটা অদ্ভূত কায়দায় বেঁকিয়ে প্লাজমার শিখাটা এড়ায় শতদল, তারপর মাতা নিচু করে দৌড়য় রাইফেলের আওয়াজের উৎসের দিকে।

     গাছের আড়াল থেকে তখন দৌড়ে বেরিয়ে আসছে আরও একজন। কাঁধে রাইফেল, ট্রিগারে আঙুল।

     কিন্তু ট্রিগার চাপার আগেই শতদলের শরীরটা আছড়ে পড়ে তার ওপর।

     সে ধাক্কায় মাটিতে ছিটকে পড়ে বটে আততায়ী, কিন্তু হাতের রাইফেলের ছাড়ে না।

     শতদল ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। শুরু হয় রাইফেলের দখল নিয়ে দুজনের প্রাণপণ লড়াই।

     দুহাতে গলার ফাঁস ছাড়াতে চেষ্টা করে নিতাই। মুঠোর বিদ্যুৎ চাবুক পেছনের দিকে হ্যাঁচকা টান মারে প্রথম আক্রমণকারী। নিতাইয়ের মাথাটা বেঁকে যায় পেছনে, তার যন্ত্রণার চিৎকার ফের ছড়িয়ে যায় বাতাসে।

     গাছের পেছন থেকে লাফিয়ে বেরোয় তৃতীয় আক্রমণকারী। হিসহিস আওয়াজ তুলে তার হাতের বিদ্যুৎ চাবুক ছিটকে যায় শতদলের মাথা লক্ষ করে।

     শেষ মুহূর্তে শতদল মাথাটা সরিয়ে নেয় বটে, কিন্তু বিদ্যুৎ চাবুকের প্রান্ত জড়িয়ে যায় তার হাতে। যন্ত্রনায় চিৎকার করে ওঠে শতদল। রাইফেলের দখল খসে যায় তার হাত থেকে।

     শতদলের হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে তাকে পায়ের ধাক্কায় দূরে ঠেলে দেয় প্রথম আক্রমণকারী। তারপর কাঁধে স্টক রেখে রাইফেলের নল ঘোরায় তার দিকে।

     ততক্ষণে প্রথম আক্রমণকারী আরও শক্ত মুঠোয় টেনে ধরেছে নিতাইয়ের গলায় জড়ানো বিদ্যুৎ চাবুকের প্রান্ত। তার অন্য হাতে ধরা সাব-রাইফেলের খাটো নলের নিশানা ধীরে ধীরে সরিয়ে আনছে শতদলের দিকে।

 

(১৮)

     সরযূ পাসের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে রেডিওটা আর একবার দেখে সুচেতা। টপ টপ করে জল ঝরতে থাকা রেডিওটা দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে ওটা আর কোনও কাজে লাগবে না। আনন্দীর জলে দাঁড়িয়ে সে যখন রাইফেলের প্লাজমা থেকে মাথা বাঁচাতে চেষ্টা করছিল, তখন কখন ব্যাগে জল ঢুকে রেডিওটা ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।

     চারপাশে একবার তাকায় সুচেতা। মিহির উঠে এসেছে অনেকটা ওপরে, তার প্রখর আলোয় কৌস্তূভের খিলেনের মতো বলয় আর প্রায় চোখেই দেখা যায় না। একটু দূরে শুরু হয়েছে হালকা জঙ্গলের গাছের সারি, আড়াল করে রেখেছে নিচের নদী আর উপত্যকাকে।

     গাছের সারির সামনে দাঁড়িয়ে কি করবে ঠিক করার চেষ্টা করে সুচেতা। শতদল আর নিতাইকে এখানেই খোঁজার চেষ্টা করবে, না কি শ্যামলাঝোরার দিকে এগিয়ে যাবে। রেডিও যোগাযোগ ছাড়া সামনের এই ছড়ানো জঙ্গল আর উপত্যকার নিতাই আর শতদলকে খুঁজে পাওয়া সোজা নয়। তার চাইতে শ্যামলাঝোরায় গেলে দুজনকে হয়তো সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু নিতাই আর শতদলকে আগে থেকে যদি সুচেতা সাবধান করতে না পারে, এই জঙ্গলেই হয়তো তারা পরেশের লোকেদের মুখে আক্রমণে পড়ে যেতে পারে।

     কি করবে মনস্থির করতে না পেরে রাগের মাথায় হাতের ভিজে রেডিওটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছে সুচেতা, হঠাৎ গাছের সারির পেছন থেকে তার কানে ভেসে আসে দু-একটা কথার টুকরো।

     সুচেতার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে ওঠে। নিতাই আর শতদল! পাওয়া গেছে দুজনকে।

     কিন্তু নিজের উপস্থিতি জানান দিতে গিয়েও গলা থেকে উঠে আসা ডাকটা গলাতেই আটকে যায় সুচেতার। যদি নিতাই আর শতদল না হয়ে পরেশের লোক হয়? আনন্দী পাসের মতন এখানেও পরেশে লোকজন থাকার সম্ভাবনা ষোলআনা।

     মাথা নিচু করে গাছের সারির দিকে এগিয়ে যায় সুচেতা। একবার পরখ করে দেখে নেয় কোমরে গোঁজা পিস্তলটাকে। তারপর গাছের আড়ালে আড়ালে সাবধানে হাঁটতে থাকে একটু আগে শোনা কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে।

     কিছুটা এগোতেই সুচেতা বুঝতে তার আশঙ্কা অমূলক নয়। গলার স্বরেই বোঝা যায়, যারা কথা বলছে, তারা কেউই শতদল বা নিতাই নয়।

     সন্তর্পণে আরও কিছুটা কাছে এগিয়ে যায় সুচেতা। গাছের আড়াল থেকে সে এবার দেখতে পায় জঙ্গলের আলো ছায়ার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে তিনজন লোক। গায়ে তাদের পলিমারের কালো বর্ম। বুঝতে অসুবিধে হয় না তারা পৃথিবী থেকে আসা হানাদার।

     বুকের মধ্য মাথাচাড়া দেওয়া ভয়টাকে দাবিয়ে রেখে গাছের আড়াল রেখে সাবধানে তাদের পিছু নেয় সুচেতা।

     কিছুক্ষণ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটার পর হঠাৎ উত্তেজিত ভাবে নিজেদের মধ্য কথা বলতে আরম্ভ করে তিনজনই। তাদের টুকরো টুকরো কথা থেকে সুচেতার বুঝতে অসুবিধে হয় না তারা কিছু একটা দেখতে পেয়েছে।

     পরেশের অনুচরদের কথা ভালো করে শোনার জন্যে ধীরে ধীরে গাছের আড়ালে লুকিয়ে তাদের দিকে এগোতে থাকে সুচেতা। কিন্তু কয়েক পা যেতে না যেতেই চুপ করে যায় তারা, তারপর দৌড়তে শুরু করে জঙ্গলের এক দিকে।

     তারা যেদিকে গেছে সেদিকে তাকিয়ে তাদের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করছে সুচেতা, হঠাৎই গাছের ডালাপালার ফাঁক দিয়ে তার নজর আটকে যায় একটু দুরের আকাশে।

     সেখানে গাছের মাথা ছাড়িয়ে আকাশে রোদপ্যানেল আর ডিশ অ্যান্টেনা তুলে ধরেছে একটা ট্রান্সমিশন টাওয়ার।

     চকিতের মধ্যে সুচেতা বুঝতে পারে কি ঘটতে চলেছে। সদ্য বসানো টাওয়ারের কাছে নিতাই আর শতদলকে আক্রমণ করতে চলেছে পরেশের ভাড়াটে সৈন্যরা।

     পরেশের অনুচরদের তোয়াক্কা না রেখে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে টাওয়ারের দিকে ছুটতে আরম্ভ করে সুচেতা। পায়ের নিচে মসমস আওয়াজ তোলে শুকনো পাতা, গায়ের ওপর আছড়ে পড়ে নিচু ডাল, হাতে বেঁধে ঝোপঝাড়ের কাঁটা, কিন্তু কোনও দিকে দৃকপাত না করে দৌড়তে থাকে সুচেতা।

     কিছু দূর যেতে না যেতেই, হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের শব্দ আসে টাওয়ারের কাছ থেকে। আকাশের দিকে ছিটকে যায় আগুনের হলকা, একটা গাছ জ্বলে ওঠে দাউদাউ করে, গাছের ওপর দিয়ে ভয়ার্ত আওয়াজ করে ছুটে পালায় সপ্তপাশের দল।

     এক মুহূর্ত থেমে কোমর থেকে স্প্রিং পিস্তলটা টেনে বের করে সুচেতা।

     তারপর বাড়িয়ে দেয় ছোটার গতি।

 

(১৯)

     কৌস্তূভের আদিম প্রকৃতি এই প্রথমবার প্রত্যক্ষ করে মানব সভ্যতার হিংস্রতা। সকাল হতে না হতেই হতেই শুরু হয়ে যায় আক্রমণ।

     ডক্টর শিপ্রার অনুমান বৃথা যায় না। উত্তর পশ্চিম দিকের অযোধ্যা পাহাড়ের আড়াল থেকে ফোটন কামানের বিন্দু বিন্দু শক্তিপুঞ্জ উজ্জ্বল বৃষ্টির মতন আছড়ে পড়ে উত্তরে আর পশ্চিমে। মানুষের সামান্য নড়াচড়া দেখলেই তার শরীর লক্ষ্য ছুটে আসে স্নাইপার রাইফেলের লালচে প্লাজমার রেখা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সন্তোষগঞ্জের উত্তর দিকের বাড়িগুলো জ্বলে ওঠে দাউদাউ করে, কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতে থাকে আকাশে।

     দুলারীর বাইরের ধাতব আচ্ছাদন দিয়ে তৈরি একটা ব্যারিকেডের পেছনে নিজের টিমের লোকেদের নিয়ে গুঁড়ি মেরে বসে থাকেন ডক্টর শিপ্রা।

     —কেউ নড়বে না। ফোটন কামান একটানা চলে না, তেতে যায়। খানিক বাদে ওটাকে ঠাণ্ডা করার জন্যে ওরা বন্ধ করবে, তখন রাইফেল চালাবে। কিন্তু মাথা তুলবে না – কেবল হাত উঁচু করে চালাবে। মাথা তুললেই টার্গেট হয়ে যাবে।

     ডক্টর শিপ্রার কথায় সায় দিয়ে হঠাৎ থেমে যায় ফোটন কামানের দ্রুত বিপবিপ শব্দ। থেমে যায় ধেয়ে আসা শক্তিপুঞ্জের ধারা।

     —এবার! ফায়ার! ফায়ার!

     মাথা নিচু রেখে কেবল ব্যারিকেডের ওপরেই হাত তুলে অযোধ্যা পাহাড় লক্ষ করে রাইফেল চালান ডক্টর শিপ্রা।

     তাঁর দেখাদেখি একই ভাবে রাইফেল চালায় তাঁর সঙ্গীরাও। সন্তোষগঞ্জ থেকে অযোধ্যা পাহাড়ের হানাদারদের পজিশনের দিকে বাজ পড়া শব্দে ছিটকে যায় প্লাজমার রেখা।

     —মাথা নিচে! মাথা নিচে!

     উচ্চকন্ঠে সাথীদের বারংবার সাবধান করতে থাকেন ডক্টর শিপ্রা।

     তাও তাঁর কথা অগ্রাহ্য করে একজন, উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠে রাইফেল থেকে প্লাজমা বর্ষণ করতে থাকে। উলটোদিকের জবাবী ফায়ারিঙের প্লাজমার রেখা এসে আঘাত করে তার মাথায়, রক্ত ছড়িয়ে প্রাণহীন দেহটা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।

     —মাথা নিচে, বেওকুফ! মাথা নিচে!

     গর্জন করতে থাকেন ডক্টর শিপ্রা।

     —ম্যাডাম, মিসাইল! মিসাইল!

     অযোধ্যা পাহাড় থেকে আসা আকাশের গায়ে একটা হালকা ধোঁয়ার রেখার দিকে আঙুল তুলে দেখায় কেউ। রেখাটা সন্তোষগঞ্জের কাছাকাছি আসার আগেই সন্তোষগঞ্জের ভেতর থেকে আকাশে লাফিয়ে ওঠে ওইরকমই একটা ধোঁয়ার রেখা।

     —কানে আঙুল! কানে আঙুল দাও।

     চিৎকার করে সাবধান করতে থাকেন ম্যাডাম শিপ্রা।

     দু-দিকের দুটো রেখা পরস্পরকে স্পর্শ করে মাঝ আকাশে।

     একটা প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হয় আকাশের বুকে। কেঁপে ওঠে মাটি, কয়েক মূহূর্তের জন্যে মনে হয় আকাশে আবির্ভাব হয়েছে আর এক মিহিরের, একটা গরম হাওয়া ঝড়ের মতন নাড়িয়ে দেয় সন্তোষগঞ্জের বাড়িগুলোকে।

     আবার শুরু হয়ে যায় দ্রুত বিপবিপ আওয়াজ। ফোটন কামানের এনার্জির বিন্দু এসে পড়তে থাকে ধারাপাতের মতন।

     রাইফেলটা চেপে ধরে একটা লম্বা শ্বাস টানেন ডক্টর শিপ্রা।

     সবে শুরু। এখনও আরও লড়াই বাকি আছে।

 

(২০)

     গাছের পেছন থেকে খালি জায়গাটায় প্রায় হুমড়ি খেয়ে এসে পড়ে সুচেতা। কয়েক মুহূর্তের জন্যে যেন সময় দাঁড়িয়ে পড়ে, সুচেতার মনে হয় সে যেন সময়ের স্রোতে আটকে যাওয়া এক খণ্ডচিত্রের মধ্যে এসে পড়েছে। সে নিশ্চল ছবির একদিকে যন্ত্রণাকাতর মুখে হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে নিতাই, তার গলায় জড়ানো বৈদ্যুতিক চাবুক। চাবুকের রাশ একহাতে শক্ত মুঠোয় ধরে রেখে সাব রাইফেলের খাটো নলে শতদলকে নিশানা করছে এক হানাদার। শতদল আধশোয়া অবস্থায় পড়ে মাটিতে, মাটিতে বসেই তার দিকে রাইফেল তুলেছে আর এক হানাদার। তৃতীয় হানাদার দাঁড়িয়ে সুচেতার দিকে পিঠ রেখে, তার হাতের বৈদ্যুতিক চাবুকের প্রান্ত পেঁচিয়ে রয়েছে শতদলের হাতে।

     প্রায় পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয় সুচেতা, তার পায়ের ধাক্কায় বাতাসে ছিটকে ওঠে মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতা। রুদ্ধ গতি সময় যেন ফের ছুটতে শুরু করে তার আপন বেগে।

     চমকে উঠে পেছনে ফেরে তৃতীয় হানাদার, মুখে তার বিস্ময়ের চিহ্ণ। পেছন থেকে কেউ এসে পড়বে সে বোধহয় আশা করতে পারেনি। তার বাঁ হাতখানা নেমে আসে তার ঊরুতে বাঁধা হোলস্টারের দিকে।

     কিন্তু তাকে কিছু করা অবকাশ দেয় না সুচেতা। নিজের অজান্তেই উঠে আসে তার স্প্রিং পিস্তল ধরা হাত, তৃতীয় হানাদারের মুখের মাত্র কয়েক হাত দূর থেকেই স্প্রিং পিস্তলের ট্রিগার টিপে দেয় সে।

     সজারুর কাঁটার মতন অতি কঠিন কার্বনের অসংখ্য শলাকার একটা ছোট ঝড় আছড়ে পড়ে হানাদারের মুখে। মূহূর্তের মধ্যে মানবিক ইন্দ্রিয়ের সবরকম পরিচয় হারিয়ে তার মাথাটা পরিণত হয় একটা রক্তাত্ত মাংসপিণ্ডে, প্রাণহীন দেহটা আছড়ে পড়ে মাটিতে।

     সুচেতার আচমকা আক্রমণে চমকে ওঠে প্রথম হানাদার, এক লহমার জন্যে তার নজর সরে যায় শতদলের ওপর থেকে। তার অন্যমস্কতার সুযোগ নেয় শতদল, ঝাঁপ দিয়ে ছিটকে যায় একদিক। সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল চালায় হানাদার, কিন্তু যেখানে তার প্লাজমার রেখা আঘাত করে সেখানে শতদল তখন আর নেই। কেবল মাটি থেকে খানিকটা ধুলো ওড়ে বাতাসে।

     রাইফেলের নল সরিয়ে ফের শতদলকে নিশানায় আনার চেষ্টা করে বটে হানাদার, কিন্তু ততক্ষণে শতদলের হাতে উঠে এসেছে তার কোমরে গোঁজা ছোরা। ফের একটা ঝাঁপ দিয়ে আর এক পাশে ছিটকে যায় শতদল, একই সঙ্গে তার হাতের ছোরা বিদ্যুতবেগে ছুঁড়ে দেয় রাইফেলধারী হানাদারের দিকে। রাইফেলের ট্রিগার টেপার আগেই শতদলের ছোঁড়া ছোরা আমূল গেঁথে যায় হানাদারের কপালে, তার দেহটা ঢলে পড়ে একপাশে।

     সর্ব শেষ হানাদার তখন তার সাব-রাইফেলের খাটো নলটা সরিয়ে আনছে সুচেতার দিকে, তার হাতের বিদ্যুৎ চাবুকের অন্যপ্রান্তে নিতাইয়ের নজরও সুচেতার ওপর, চোখ তার বিস্ময়ে বিষ্ফারিত।

     সুচেতার দর্শনে যেন হঠাৎ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে নিতাইয়ের শক্তি। ডান হাত গলা থেকে সরিয়ে বাড়িয়ে ধরে মাথার পেছনে, মুঠোয় চেপে ধরে বৈদ্যুতিক চাবুকের মধ্যভাগ।

     চড়চড় করে আওয়াজ হয়, নিতাইয়ের চাবুক ধরা মুঠো থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওঠে, তার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে গগনবিদারী আর্তচিৎকার।

     কিন্তু তবু চাবুক ছাড়ে না নিতাই। তার এক হ্যাঁচকা টানে নিতাইয়ের ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে হানাদার, তার সাব রাইফেলের প্লাজমার রেখাটা বেরিয়ে যায় সুচেতার অনেক দূর দিয়ে।

     হানাদার তার পিঠের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়তেই চাবুক ছেড়ে দেয় নিতাই, সেই হাতে হানাদারের ঘাড় ধরে তাকে আছড়ে ফেলে মাটিতে। তার বাঁদিকের বায়োনিক হাত এবার কামারের হাতুড়ির মতন আছড়ে পড়ে হানাদারের শরীরের ওপর।

     ডিমের খোলার মতন তুবড়ে যায় হানাদারের বুকের অস্থি পিঞ্জর, মুখ দিয়ে এক ঝলক রক্ত তুলে নিশ্চল হয়ে যায় তার দেহটা।

     শুয়ে, বসে দাঁড়িয়ে হাঁপায় তিনটে মানুষ। রক্তে মাটি ভেজায় তিনটে মৃতদেহ।

     নিভে আসে জ্বলন্ত গাছের আগুন। থেমে আসে সপ্তপাশের চিৎকার। বাতাসে মিলিয়ে যায় বিস্ফোরণের গন্ধ।

     ধীরে ধীরে নিজের ছন্দে ফিরে আসে কৌস্তূভ।

কৌস্তূভ উপন্যাসের শেষ অংশ পড়তে নিচে ক্লিক করুন 

কৌস্তূভ – শেষ অংশ

Tags: উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, কৌস্তূভ, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সুমিত বর্ধন

17 thoughts on “কৌস্তূভ

  • October 16, 2018 at 2:19 am
    Permalink

    জাস্ট অসাধারণ…শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনে হলো ঠিক যেন কোনো হলিউড সাইফাই সিনেমা দেখছি!!! বাংলাতেও এমন লেখা সম্ভব!!! বিশেষত action scene গুলোর বর্ণনা ভীষণ সাবলীল যা আদতে একটা ভীষণ কঠিন কাজ আমার মতে।লেখক আর কল্পবিশ্ব দুজনকেই কুর্নিশ!!!
    *পুনশ্চ এর সিকুয়েলের অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু😋😋😋

    Reply
  • October 17, 2018 at 2:10 am
    Permalink

    অসাধারণ! রুদ্ধশ্বাস পাঠের পরে এখন আমি বাকরুদ্ধ! অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকব এর পরবর্তী অংশের, যার হিন্টস দেওয়া আছে শেষের কয়েকটি প্যারাগ্রাফে। সুমিতদা, কুর্ণিশ!

    Reply
  • October 20, 2018 at 9:30 am
    Permalink

    “ফুল ফোটে? তাই বলো, আমি ভাবি পটকা…”

    আজ্ঞে না, পটকা নয়, কল্পবিশ্বের পাতায় স্রেফ একখানা ভূমিকম্প বোমার মতই ফেটে পড়েছেন সুমিত বর্ধন মহাশয়। একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে বর্ধনদের শিরস্ত্রাণে একটা নতুন উজ্জ্বল পালক যোগ হল। ওঁর লেখা পড়ে আমি অভিভূত, আপ্লুত। আমার পড়াশোনার পরিধি খুবই কম, তাই কেউ দোষ ধরবেন না, তবু বলি প্রেমেন্দ্র মিত্রের “পাতালে পাঁচ বছর”-এর পর এত ভালো, জমজমাট কল্প-উপন্যাস যে কেউ লিখবেন, আর আমার জীবনকালে সে লেখা আমি পড়ে যেতে পারব, এ আমার প্রত্যাশার বাইরে ছিল। সেজন্যই আমার আনন্দের আতিশয্য বোধহয় কিছুটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলাতে পারছি না। আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করছে। কোন দিক দিয়ে ওঁর লেখার প্রশংসা করব? হীরের টুকরোর দিকে যেমন যেদিক দিয়েই তাকানো যায় সেদিকেই ঝলকানি দেখা যায় এ লেখাও তেমনি।
    এ লেখার বাঙালিয়ানা মনে পড়িয়েছে হেমেন্দ্রকুমারকে, যদিও তাঁর অধিকাংশ গল্পগুলি ছিল বিদেশী গল্পের অনুবাদ, বিদেশী চরিত্রদের তিনি পরিয়েছিলেন বাঙালির পোষাক, আর এ গল্প একেবারেই মৌলিক।
    এ লেখার সাথে এঁকে দেওয়া দেওয়া সংক্ষিপ্ত ম্যাপ মনে পড়িয়েছে ব্যোমকেশের চিড়িয়াখানাকে, এছাড়া আর কোথাও এমন দৃষ্টান্ত বিশেষ চোখে পড়েনি, এমনকি সত্যজিৎ রায়ের গল্পেও না। এ ধরণের গল্পের সঙ্গে ম্যাপ একটা অপরিহার্য অঙ্গ। তাই বলে একথা ভাবলে ভুল হবে যে তাঁর বর্ণনা অপরিচ্ছন্ন। বস্তুত এত ভালো, প্রাঞ্জল বর্ণনাও আমি বেশি পড়িনি। নদীর জলে ন্যানোটারবাইনের জাল বিছোনোর বর্ণনা পড়ে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়না যে যন্ত্রটা কিভাবে কাজ করে।
    জীবজন্তুদের বর্ণনাও বেশ বিজ্ঞানসম্মত লেগেছে। মনে পড়িয়েছে Into the universe with stephen hawking ডকুমেন্টারিটাকে। মনে পড়েছে এমন অনেক কিছুই, কিন্তু এগুলোর কোনোটা থেকে তিনি টুকেছেন একথা কিছুতেই বলতে পারলাম না।
    সত্যি বলতে কি, গোড়ার দিকে হিমায়ন কক্ষের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা পড়ে প্যাসেঞ্জার সিনেমাটার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় একটু নাক সিঁটকোনো ভাব ছিল আমার, কিন্তু তারপর কখন যে সিঁটকোনো ভাব চলে গিয়ে প্যালারাম বিশ্বাসের মত মুখখানা হাঁ হয়ে গেছে আর ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে আরম্ভ করেছি নিজেই জানতে পারিনি। ভাগ্যিস, বিছানায় শুয়ে শুয়ে এ গল্পখানা পড়েছি, নইলে চাঁদনি মার্কেটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে নির্ঘাত গাড়িচাপা পড়ে যেতাম।
    শুরুতেই যাঁর এমন আত্মপ্রকাশ তিনি যে আরও অনেক পথ পাড়ি দেবেন এই আশাতেই বুক বেঁধেছি। তবে দিনকাল পাল্টেছে। হেমেন রায়, প্রেমেন মিত্তিরের যুগ গিয়েছে। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে পেটের ভাত জোগাতেই আজকাল মানুষকে নিজের সবটুকু নিংড়ে দিতে হয়। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যুগের এই নিষ্পেষণ এই নব্য প্রতিভাকে যেন থামিয়ে দিতে না পারে।

    সবশেষে বলি এর দ্বিতীয় অংশের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। যতদিন না পাচ্ছি ততদিন কল্পবিশ্বের লোকজনদের জ্বালিয়ে মারব কিন্তু। আপনার বাড়ির সামনে অনশনেও বসে যেতে পারি। খুব সাবধান।

    Reply
    • October 20, 2018 at 11:36 am
      Permalink

      কল্পবিশ্ব ম্যানেজমেন্ট টিমের উদ্দেশ্যেঃ কমেন্ট করতে গিয়ে কয়েকটা অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছি। প্রথমত এতে কমেন্ট লেখার সময় নিজের লেখা কাট-পেস্ট করা যায় না, দ্বিতীয়ত, কমেন্ট করার পর নিজের কমেন্ট আর সেটা এডিট করা যায় না। ফলে ভুল করে কোথাও কোনও বানান ভুল করলে সেটা আর শুধরোনো যায় না।
      যেমন উপরোক্ত কমেন্টে লিখেছি ‘কোনটা থেকে টুকেছেন বলতে পারলাম না।’ ওটা আসলে হবে ‘কোনোটা থেকে টুকেছেন বলতে পারলাম না।’ দুটো বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা। পাবলিকের ভুল বোঝার সম্ভাবনা খুব বেশি।

      Reply
      • October 20, 2018 at 12:57 pm
        Permalink

        নির্জন বাবু, কাট-কপি পেস্ট, সচেতন ভাবে সমস্ত সাইটে বন্ধ করা আছে। নইলে বিভিন্ন সময় গল্প গুলি সাইট থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছিল। আর কমেন্ট এডিটের জন্যে আপনার কমেন্টের উপরে একটা ‘এডিট দিস’ বলে লিংক আসার কথা, সেখানে ক্লিক করলেই এডিট হবে আশা করি। আমি উপরের কমেন্টটা আপনার হয়ে এডিট করে দিচ্ছি।

        Reply
        • October 20, 2018 at 2:32 pm
          Permalink

          শ্রদ্ধেয় দীপ ঘোষ মহাশয়,
          আমি html কোডিং-এর কিছুই জানি না। কপি-পেস্ট শুধু কমেন্ট বক্সে active করা সম্ভব নয় বোধহয়, তাই না? অথবা এমনটা কি করা সম্ভব যে কমেন্ট বক্সে শুধু পেস্ট করা যাবে, কপি বন্ধই থাকবে? তাহলে প্রথমে অন্যত্র লিখে নিয়ে এখানে পেস্ট করে দেওয়া যায়।
          অথবা এরকম হয় কি যে শুধু নিজের কমেন্টটুকু কমেন্টবক্সে এডিট করা যাবে, অন্য আর কিছু কপি-পেস্ট বা এডিট কিছু করা যাবে না? বা শুধু অ্যাডমিনরাই করতে পারবেন? সেক্ষেত্রে যিনি কমেন্ট করতে চান তিনি প্রথমে registration করবেন, তারপর log in করে কমেন্ট করবেন? যেমনটা কোনো ফোরামে(যেমন বেঙ্গলি ডাউনলোডে) হয় আর কি।

          আপনারা প্রত্যেকেই ব্যস্ত মানুষ। তাই এইসব আবদার বিরক্তিকর মনে হতে পারে। দয়া করে রাগ করবেন না। আবদার করছি না, কিছু সম্ভাবনার কথা মাথায় এল সেগুলোই লিখলাম মাত্র। আগেই বলেছি আমি আনাড়ি লোক। তাই যতটুকু সম্ভব হয় ততটুকুই করবেন। এমনিতেই আপনারা যা করেছেন এবং করে চলেছেন তা আক্ষরিক অর্থেই তুলনাহীন।

          আমার কমেন্টের উপর ‘এডিট দিস’ বলে কোনো লিংক আসছে না। উপরোক্ত কোনো কিছুই যদি সম্ভব না হয় তবে আপাতত এইটুকু ঠিক করা সম্ভব হলেই অনেক কৃতজ্ঞ থাকব। এতে পেস্ট হচ্ছে না নইলে স্ক্রিনশটের লিঙ্ক পাঠাতুম।

          বিজয়ার শুভকামনা রইল, ভালো থাকুন আর কল্পবিশ্বের আরও আরও শ্রীবৃদ্ধি হোক।

          Reply
          • October 20, 2018 at 2:46 pm
            Permalink

            পুনশ্চঃ আমার কমেন্ট করার সময়টাও ভুলভাল দেখাচ্ছে।

    • October 20, 2018 at 12:03 pm
      Permalink

      পরবর্তী অংশে গাছপালার বৈচিত্র্য আরেকটু বেশী আশা করব। এটাতে শুধু থালা গাছ ছাড়া আর তেমন কিছু জানতে পারিনি। আর পতঙ্গগুলোর সাইজও একটু বাড়াবাড়িরকমের ঠেকেছে। যে গ্রহে মাধ্যাকর্ষণ বেশী সে গ্রহে পতঙ্গের আকার আরও ছোট হওয়া উচিত।

      Reply
      • October 20, 2018 at 3:14 pm
        Permalink

        আপনার প্রথম অনুযোগটা অস্বীকার করতে পারি না । শব্দ সংখ্যার ওপর রাশ ধরে রাখতে গিয়ে ওয়ার্ল্ড বিল্ডিঙের সময় জীবজগৎ যে ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সে তুলনায় উদ্ভিদজগতের দিকে নজর দেওয়া হয় নি । দ্বিতীয়টার উত্তরে বলি পতঙ্গের আকার বাতাসে অক্সিজেনের পার্সেন্টেজ বৃদ্ধির সাথে বৃদ্ধি পায় – উদাহরণ পৃথিবীর কেম্ব্রিয়ান যুগ । অভিকর্ষ বেশি হলে ওড়ার সময়ে ডানার নিচে লিফট বা উচ্চচাপ বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হবে, অতএব ডানার সাইজ এবং সেই অনুপাতে পতঙ্গের শরীরের সাইজ বৃদ্ধি পাবে । তবে কৌস্তুভের অভিকর্ষ পৃথিবীর চাইতে ভয়ানক রকমের বেশি নয় । সুতরাং এখানে পতঙ্গের আকারের ব্যাপারে অক্সিজেনের অনুপাত প্রধান নির্ণায়ক হওয়াটা স্বাভাবিক !

        Reply
        • October 20, 2018 at 4:51 pm
          Permalink

          আর্থার সি.ক্লার্কের কোন একটা বইতে যেন এই নিয়মকানুন গুলো পড়েছিলাম। এখন আর নাম ধাম কিছুই মনে পড়ছে না। খুঁজে পেলে আপনাকে জানাবো। অবিশ্যি উনি লিখেছেন বলেই ঠিক আর আপনি লিখেছেন বলেই ভুল এমন গোঁড়ামিতে আমিও বিশ্বাস করি না।

          Reply
          • November 12, 2018 at 1:16 pm
            Permalink

            Childhood’s End?

  • October 20, 2018 at 9:41 am
    Permalink

    দারুন উপন্যাস।রুদ্ধশ্বাসে শেষ করলাম। এটা একটা সিরিজ হবে বলে মনে হয়।পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

    Reply
  • October 20, 2018 at 12:02 pm
    Permalink

    দেড় দিনে শেষ করলাম কৌস্তুভ। এ গল্প বাংলা কল্পবিজ্ঞানে একটা মাইলস্টোন হয়ে রইল। এত অনায়াসে এই নতুন জগতটা তৈরি হয়েছে, এত অদ্ভুত জীবজন্তু তৈরি হয়েছে যে এর পেছনের কঠিন পরিশ্রমটা বোঝাই যাচ্ছে না। নতুন পৃথিবীর নতুন খেলার নিয়মগুলিকে খুব নিখুঁতভাবে মানা হয়েছে। একটাও লুজ এন্ড পেলাম না।

    প্রশংসা করার বিশেষণ কম পড়ে যাচ্ছে। এরকম লেখা আরো চাই।

    Reply
  • October 22, 2018 at 6:47 am
    Permalink

    দুর্দান্ত লেখা..

    Reply
    • October 23, 2018 at 11:40 am
      Permalink

      Ses na aro ache?

      Reply
  • November 8, 2018 at 12:35 pm
    Permalink

    Second part joldi chai Mr. Bardhan. Osadharon lekhar hat aapnar. Onek onek likhun.

    Reply
  • November 20, 2018 at 3:36 pm
    Permalink

    সিম্পলি কাঁপিয়ে দিয়েছেন গুরু!

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!