আফটার শকের তীব্রতা ভূমিকম্পের থেকে বেশি হয় না

  • লেখক: দীপ ঘোষ
  • শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)

প্তপদীর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম, নিঃসীম কালো অন্ধকারের মধ্যে একটুকরো হীরে বসানো রূপোর আংটির মত উজ্জ্বল স্পেস সিটি ওবেরন। কেন জানিনা আমার মনে হচ্ছিল জানালা খুলে হাত বাড়ালেই আংটিটা পেয়ে যাবো। তারপরেই মনে পরে জানালা কই, অতো স্পেসশিপের দেওয়ালে লাগানো ত্রিমাত্রিক স্ক্রীন, এই জন্যেই কর্নেল বুড়ো বলে আরেকটু হলেই আমি নেভি কমান্ডো না হয়ে কবি হয়ে যেতাম! তা হতে পারলে অবশ্য মন্দ হত না। পৃথিবীতে এই পেশাটার বড্ড দাম। কম্পিউটার আর রোবট সব কিছু পারলেও এই ঠিকঠাক কবিতা লেখা আজও পারল না! অস্বীকার করব না আমিও লুকিয়ে লুকিয়ে লগ বুকে কিছু কবিতা লিখেছি, সাধনদা পড়ে বলেছে বেশ ভালো হয়েছে। ওই দেখ, আসল কাজ ভুলে আবার উল্টোপাল্টা দিবাস্বপ্ন শুরু করেছি। ওবেরনে ল্যান্ড করার আগেই র‍্যাক্সর আর তার স্যাঙ্গাতদের সাথে পাঞ্জা লড়ার রিপোর্টটা কর্নেলকে জমা দিতে হবে। আমাদের পাইলট জিতকে বললাম একটু লিখে দিতে, সপ্তপদীকে তো টেনে নিয়ে যাচ্ছে নেভির ক্রুসার। গেঁড়ে ওস্তাদের বুস্টার আমাদের আয়ন ইঞ্জিনটাকে একেবারে বসিয়ে দিয়েছে। জিত ব্যাটা তুম্বো মুখ করে জানালো সৌরজগতের সব থেকে দামী রিসর্ট আর ক্যাসিনোতে যাবার আগে এরকম একঘেঁয়ে কাজ সে করতে পারবে না। অগত্যা আমিই বসেছি রিপোর্ট রেকর্ড করতে। পাঁচবার রেকর্ড আর ডিলিট করে ছয় বারের বেলায় রিপোর্টটা প্রায় শেষ করে এনেছিলাম। র‍্যাক্সরকে বোকা বানিয়ে সাধনদার স্ত্রী অরুণিমা বৌদিকে কালী সাজিয়ে কর্নেল কীভাবে বাজিমাত করলেন সেটা সবে রেকর্ড করেছি, তখনই বিষ্ণু সরকার এসে ঢুকল।

     “আরে রাখো তোমার রিপোর্ট! ওদিকের খবর শুনেছো? গেঁড়ে পৃথিবীতে পৌঁছনোর আগেই ছাড়া পেয়ে গেছে!” – উত্তেজিত হয়ে বলল বিষ্ণু।

     “বল কি হে! এত তাড়াতাড়ি? ওর মত ঘাঘু স্মাগলারকে প্রিসন ক্যাম্পে আটকাতে পারত না সেটা জানতাম, তা বলে একেবারে ছেড়ে দিল?”

     “হ্যাঁ, ওকে নাকি র‍্যাক্সরের দল ডিমোসের রুট থেকে কিডন্যাপ করেছিল! আসলে নেভির সাথে ডিল হয়েছে! কর্নেল দাস তো ক্ষেপে লাল! তক্ষুনি রিপোর্ট করতে যাচ্ছিল পৃথিবীর হাইকমান্ডে। তারপর যখন শুনল র‍্যাক্সরকে ধরার জন্যে নেভি থেকে স্পেশাল গিফট হিসেবে সপ্তপদীকে একটা অ্যান্টিম্যাটার ড্রাইভ দেওয়া হচ্ছে, বুড়োর রাগ সব জল হয়ে গেল। কর্নেল আর জিত মিলে ভিন্টেজ লুনার ওয়াইনের বোতলটা খুলে ফেলেছে। এখুনি না গেলে কিস্যু পাবে না।”

     “বিষ্ণু ভায়া, কাজের কথাটা সবার শেষে বলার বাজে অভ্যেসটা আর গেল না! রিপোর্টটা পরেও করা যাবে। চলো চলো।”

     মেস হলে যখন ঢুকলাম বোতল তখন অর্ধেকটা শেষ! সাধনদা এক কোনায় বসে নির্বিকার মুখে চুরুট খাচ্ছে। আমায় দেখে এক চোখ টিপে বুঝিয়ে দিল বৌদি আপাতত ঠান্ডা হয়েছেন।

     “এসো হে বাসু, খবর শুনেছ নিশ্চয়? তার উপরে অর্ধদেববাবুও দারুণ খুশি। একটু আগেই কথা হয়েছে। উনি নিজেই আসছেন আমাদের অভিনন্দন জানাতে।” কর্নেল খোশমেজাজে বললেন।

     “ওবেরনে ডকিং এর পারমিশন কখন পাবো? শুনেছিতো ভীষণ ভীড় হয় এই সময়ে।” গ্লাসে সবুজ অ্যালগি ভরা ওয়াইন ঢালতে ঢালতে বললাম। চাঁদের মাটির নিচের বরফ ভর্তি সুড়ঙ্গগুলোতে এই অ্যালগি একমাত্র জীব। আর তাই এই এক বোতল ওয়াইনের দাম আমার এক মাসের মাইনের সমান।

     “আরে আমরা অর্ধদেব বাবুর ব্যক্তিগত পোর্টে নামছি। সুটানুটির হোটেল রয়্যাল হাওড়ার টপ ফ্লোরে আমাদের জন্যে লাক্সারি রুম ঠিক করা আছে।” একগাল হেসে বলল জিত।

     “অতো হেসো না খোকা, আমার মন বলছে কিছু গণ্ডগোল আছে, অর্ধদেব বাবু বেশ নার্ভাস মনে হল গলা শুনে।” কে জানত তখন সাধনদার কথা মাসখানেকের ব্যবধানেই আবার মিলে যাবে!

————– ভূমিকম্পের ছত্রিশ ঘন্টা আগে ————–

     দেখতে দেখতে স্ক্রীনের ছোট্ট আলোর আংটিটা একটা বিশাল নাগরদোলার চেহারা নিল। জিত বলল এই অদ্ভুত মহাকাশ শহরের গঠনকে নাকি স্ট্যানফোর্ড টরাস বলে। কয়েক হাজার বছর আগেও পৃথিবীর এক প্রাচীন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার রেকর্ডে নাকি এই শহরের ডিসাইন ছিল। সাধনদা যদিও বলল ওসব গল্প কথা। যাই হোক ওবেরন যদি আংটি হয় তবে তার মধ্যে হীরে অবশ্যই সুটানুটি। ধবধবে সাদা কৃস্টালের অদ্ভুতদর্শন কয়েকশ তলা বাড়িগুলোই সুটানুটি রিসর্ট ও ক্যাসিনো। ওবেরনের বৈশিষ্ট্য হল পুরো শহরটাই আংটির ভিতরের দিকে আর আংটিটা মিনিটে একবার করে ঘুরে কৃত্রিম মহাকর্ষ তৈরি করছে। নেভি ক্রুসারটা সপ্তপদীকে সোজাসুজি সুটানুটির একটা বিশাল বাড়ির এয়ার লকের সাথে লাগিয়ে দিয়ে গেল। এয়ার লক থেকে বেরিয়ে প্রথমেই সবাই চমকে গেলাম। একেবারে পৃথিবীর মত নীল আকাশ, রোদ, আর তা আসছে সেই আকাশের গায়ে সূর্যের একটা খুদে সংস্করণ থেকে। চারিদিকে পাখির ডাক, যদিও পাখিগুলো আসল হতেই পারেনা! একসাথে এতগুলো জ্যান্ত পাখি শুধুমাত্র গ্যালাকটিক চিড়িয়াখানাতেই দেখেছি। চওড়া সুসজ্জিত একটা উঠান পেরিয়ে আমরা কৃস্টাল প্রাসাদের দিকে এগোলাম। দরজা খুলে আমাদের দিকে এগিয়ে এল দুটো মনুষ্যকৃতি রোবট। দুজনেরই কোমরের পাশে অদ্ভুতদর্শন একটা অস্ত্র উঁচু হয়ে আছে। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, “এক্সপেরিমেন্টাল ডিসিন্টিগ্রেটর, এখনো নেভিতেও আসেনি।”

     রোবট দুটো প্রথমেই আমাদের স্ক্যান করে নিল কোন লুকনো অস্ত্র আছে কিনা বোঝার জন্যে। তারপর আমাদের নিয়ে গেল তিন দফা নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে দিয়ে। একমাত্র পৃথিবীর হাইকমান্ডের অফিসেই এরকম কড়া নিরাপত্তা দেখেছি। সাধনদা বলল, “হুহু বাবা, অর্ধদেব ভট্ট এই সেক্টরের সব থেকে ধনী দশজন মানুষের মধ্যে একজন।”

     বাড়িটার মধ্যের সব ঘর গুলোই বিচিত্র জ্যামিতিক আকারের। তবে সবথেকে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে তা হল দেওয়ালের গা দিয়ে মাকড়সার জালের মত ছড়িয়ে আছে সার্কিট আর ডেটা কেবল! পুরো বাড়িটাই যেন একটা বিশাল দানবীয় যন্ত্র; আর আমরা সেই যন্ত্রের একটা অংশ থেকে আরেকটা অংশের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া কয়েকটা পোকা। অনেকগুলো ঘর পেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম একটা গোল হল ঘরে। নামেই হলঘর, এর মধ্যে সহজেই পাঁচখানা দোতলা ফুটবল মাঠ ঢুকে যাবে! আর এই হলঘরের ঠিক মাঝখান দিয়ে যেন আকাশের মধ্যে মিলিয়ে গেছে একটা বিশাল পাইলনের সারি, বহু উপরে ছাদের গায়ে মিশে গিয়ে শিরা উপশিরা হয়ে নেমে এসেছে দেওয়াল বেয়ে। বিষ্ণু ফিসফিস করে বলল, “কত ট্রিলিয়ান ইয়োট্টাবাইট ডেটা যে এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কে জানে!”

     কতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে ছিলাম সেই দানবীয় পাইলনের দিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ সাধনদা খেঁকিয়ে উঠল, “দেখ জিত, তখন থেকে আমার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিস! বার বার বলছি দেখে পাটা ফেল। সহ্য হয়না তবে ওয়াইন খাস কেন?”

     জিত অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “না না, আমার একটুও নেশা হয়নি, কিন্তু এখানকার মেঝেগুলোই কিরকম যেন, বাড়িটায় ঢোকার পর থেকেই পা পিছলচ্ছে!”

     “কই আমাদের কারো তো হচ্ছে না! যা ওদিকে গিয়ে দাঁড়া।”

     দুজনের এই ‘প্রেমালাপ’, আরো কিছুদূর হয়ত চলত, কিন্তু এর মধ্যে পাশের একটি দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন তিনজন মানুষ। মাঝের জন মাঝবয়সী নিতান্তই সদাশয় চেহারা। ধবধবে স্যুট পরা, দাড়ি গোঁফ কামানো পরিষ্কার করে, মুখে বয়সের আর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মানুষটি কর্নেলকে জড়িয়ে ধরলেন। “কর্নেল দাস, আপনি না থাকলে তো আমার পূর্বপুরুষের মূর্তিটা আর ফিরেই পেতাম না। কী বলে যে ধন্যবাদ জানাই আপনাকে?”

     প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ের পরে ডান দিকের সুদর্শন পুরুষটির সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন অর্ধদেব, “সুটানুটির সিকিউরিটি হেড এইচ এন১১, ষষ্ঠ প্রজন্মের পসিট্রনিক অ্যানড্রয়েড। সুটানুটির সাতেরশ একষট্টিটা ক্যাসিনোর শান্তিশৃঙ্খলার দায়িত্ব ওর হাতে। আমরা ওকে হেমেন বলেই ডাকি।”

     আর ইনি হচ্ছেন প্রফেসর জিন ইয়ান, এখানকার আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সটি এনার হাতেই তৈরি। বাজী রেখে বলতে পারি এত উন্নত মেশিন এই সৌরজগতের কোথাও পাবেন না। এই যে পাইলনগুলো গাছের মত উঠে গেছে মাঝখান থেকে। এটাই এই কম্পিউটার আইসিসের নার্ভ বলতে পারেন। এই বাড়িটাই আসলে পুরোটাই আইসিস। এখান থেকেই ও নিয়ন্ত্রণ করছে সুটানিটির ক্যাসিনোর সমস্ত মেশিন, বাজি ধরা আর লেনদেন।” ছোটখাটো চেহারার সুন্দরী ইয়ান কে দেখে বোঝার উপায় নেই, পৃথিবীর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণায় ইনি সবথেকে এগিয়ে আছেন!

     আলাপ পরিচয় শেষ হবার পরে কর্নেল জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা ভট্টবাবু ক্যাসিনো চালানোর জন্যে এতো বড় কম্পিউটার কিসের দরকার? পৃথিবীতে কোন গবেষণাগারেও তো এতো উন্নত মেশিন নেই।”

     ভট্টবাবু কিছু উত্তর দেবার আগেই গমগমে গলায় উত্তর ভেসে এল মাথার উপর থেকে, “আমি আইসিস, প্রাচীন মিশরীয় জ্ঞানের দেবী, আমার অজানা কিছুই নেই। আমার কাজের মধ্যে পড়ে সাতেরশ একষট্টিটি ক্যাসিনোর জুয়ার টেবিল আর মেশিনে কেউ কারচুপি করছে কিনা নজর রাখা, বারোশর উপর অ্যাডভেঞ্চার গেম আর ডেথ গেমের খবর পৃথিবী থেকে সংগ্রহ করে তার উপর বাজীর আয়োজন করা ও দর বেঁধে দেওয়া, যাতে অর্ধদেব ভট্টের আর্থিক ক্ষতি না হয়। এছাড়াও সমস্ত গ্যালাক্সি থেকে আসা খবর সংগ্রহ করে তার থেকে বাজী ধরার উপযুক্ত খবর বেছে নেওয়া। এছাড়া প্রত্যেক দিন সুটানুটিতে প্রায় কয়েক ট্রিলিয়ন গুগল কারেন্সি আদানপ্রদান হয় অন্তত তেইশটি জাতির মধ্যে। কোন সাধারণ কম্পিউটারের পক্ষে এই হিসেব রাখা সম্ভব নয়। যেমন সেলিয়ানরা প্ল্যাটিনামের মূল্যের ।”

     “ঠিক আছে আইসিস, ওনারা বুঝতে পেরেছেন। এখন ওরা ক্লান্ত, ওদের ঘরের রাস্তা দেখিয়ে দাও।”, আইসিসকে থামিয়ে দিলেন অর্ধদেব। হলঘরের পাশের দিকের একটা দরজা খুলে গেল নিঃশব্দে। অর্ধদেব এবং বাকি দুজনকে বিদায় জানিয়ে আমরা আইসিসের একটি শিরায় জ্বলতে নিভতে থাকা আলোকে অনুসরণ করলাম। অটোমেটেড রাস্তায় সাধনদা জানিয়ে দিল বৌদিকে আগেই রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জিতের দুবার হোঁচট খেয়ে আমার সাথে ধাক্কা খাওয়া ছাড়া বলার মত আর কিছুই হল না। সারাদিনের ধকলের পর এমনিতেই স্নায়ু আর দিচ্ছিল না, রুমে ঢুকে ঝকঝকে নরম বিছানা দেখে কোনরকমে শুয়ে পড়লাম, তারপর আর মনে নেই কিছু।

————– ভূমিকম্পের আঠাশ ঘন্টা আগে ————-

     কতক্ষণ ঘুমিয়েছি মনে নেই, তবে এতো আরামে বোধহয় মায়ের কোল ছাড়া ঘুমানো সম্ভব নয়। আচ্ছা, এই তুলনাটা আমার মাথায় এল কি করে? মায়ের কোল কেমন তা তো আমি কোনদিন বুঝিইনি। যাই হোক আইসিসের গুরুগম্ভীর গলা আমার ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিল। “মিস্টার বাসু, আপনার জন্যে মিস্টার চক্রবর্তী দরজায় অপেক্ষা করছেন।”

     চোখ রগড়াতে রগড়াতে দরজা খুলে দেখলাম জিত দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু একি অবস্থা হয়েছে ছেলেটার! মুখে অন্তত পাঁচটা লিকোপ্লাস্ট, তার ভিতর দিয়েও কালসিটে বোঝা যাচ্ছে। আমায় সরিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ভিতরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল জিত।

     “কিরে, এখানেও কারো সাথে মারপিট করে এলি নাকি? তোর মাথা গরম স্বভাব আর গেল না!”

     “আরে দূর! ঠিক করে দাঁড়াতে পারলে তো মারপিট করব! কাল থেকে ক্রমাগত হোঁচট আর আছাড় খাচ্ছি! সকালে বাথরুমে পড়ে গিয়ে মুখে কালসিটে পড়ে গেল। কী হয়েছে আমার বলত? কাল রাতে রেসিডেন্স ডক্টরকে দিয়ে ব্রেন স্ক্যান পর্যন্ত করালাম। আমি একদম হান্ড্রেড পার্শেন্ট ঠিক আছি। অথচ ঘর থেকে বের হতে পর্যন্ত পারছি না! যাই হোক স্যার ডাকছেন, জরুরী মিটিং। তুমি তো আবার কমিউনিকেটর অফ করে ঘুমোচ্ছিলে। চলো এখন।”

     কর্নেলের ঘরে গিয়ে দেখি সবাই হাজির। এমনকি অর্ধদেব ভট্ট বাবু আর অরুণিমা বউদিও আছেন। সবাই মিলে চেয়ার আর বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম। কর্নেল জিতের মুখের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলা শুরু করলেন, “ওয়েল বয়েস, ভট্টবাবু আমাদের কাছে আরেকটা সাহায্য চান। ব্যাপারটা খুব গোপনীয় তাই চাই না, খবরটা এই ঘরের বাইরে যায়। অরুণিমার কাছে আগের প্ল্যানটা গোপন করে ওকে ব্যবহার করায় আমি অপরাধী, তাই ওকেও রেখেছি আজ। ভট্টবাবু আপনিই বলুন বরং।”

     ভট্টবাবু জামার পকেট থেকে একটা সোনালি চাকতি বের করে বিছানার উপর রেখে একপ্রান্তে একটা সুইচ অন করলেন। “এটা একটা পার্সোনাল সিগনাল জ্যামার। ভাবছেন হয়ত সুটানুটিতে নিজের বাড়িতে কেন এটা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি? কারণ আমি আইসিসকে আর ভরসা করতে পারছি না। ওকে কোনভাবে সাবোটাজ করা হয়েছে।” এক নিঃশ্বাসে বললেন অর্ধদেব। ভদ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছিল, এই কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে উনি ভেঙে পড়েছেন।

     “দাঁড়ান দাঁড়ান, কী করে আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন এই সিস্টেমের সব থেকে উন্নত এআইকে কেউ কব্জা করতে পেরেছে? এর বিরুদ্ধে আপনাদের নিশ্চয় কোন ব্যবস্থা নেওয়া আছে?”

     “হ্যাঁ মিস্টার বাসু, প্রমাণ আমি তিন ঘন্টা আগেই পেয়েছি। সন্দেহটা কয়েক মাস ধরেই হচ্ছিল, কিন্তু দিন দশেক আগে আমি বুঝতে পারি সেটা অমূলক নয়। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল কিছু মেশিনের গণ্ডগোল থেকে। হঠাত কিছু বিশেষ মেশিনে ক্রেতারা পর পর বাজী জিততে শুরু করে। আমরা কিছু প্রবলেম হয়েছে বুঝতে পেরে মেশিনগুলো সিস্টেম থেকে আলাদা করে দিলাম। আইসিস সেগুলোকে পরীক্ষা করে জানালো সব ঠিক আছে। কিন্তু এবার অন্য কিছু মেশিনে সেই প্রবলেম শুরু হল।”

     “কিন্তু এই সব স্লট মেশিনে বা টেবিলে তো প্রায় সবটাই লাকের জোর তাই না? সুতরাং কেউ যদি জিতে যায় তাহলে অসুবিধা কোথায়?” কর্নেল বাধা দিলেন।

     “আসলে এই মেশিনগুলোর জেতার প্রবাবিলিটি নিয়ন্ত্রণ করে আইসিস, কেউ যদি খুব বেশি জিততে থাকে তাহলেই জেতার চান্স কমিয়ে দেয় আইসিস। তাই প্রথমেই আমরা সব মেশিনগুলো আইসিসের থেকে আলাদা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা মেশিনে কোন গণ্ডগোলই খুঁজে পেলো না! এরপর আগের মাসে শুরু হল নতুন বিপদ! পৃথিবীর ও অন্যান্য গ্রহের যে সমস্ত খেলায় বাজি ধরা হয়, সেখানেও লোকে জিততে শুরু করল। অথচ এর সাথে আইসিসের কোন সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমরা। যে দলের জেতার কথা তারা অদ্ভুত ভাবে হেরে যেতে লাগলো খেলায়। গতকাল রাতে একসাথে প্রায় দুশ সত্তরটা ক্যাসিনোয় সমস্ত বাজি আর মেশিনে হটাৎ সবাই জিততে শুরু করে। বাধ্য হয়ে আমরা আইসিসকে রিবুট করে সব ক্যাসিনো বন্ধ করে দি। কিন্তু তার মধ্যে যা ক্ষতি হবার আমার হয়ে গেছে! কিন্তু এর থেকেও বড় ক্ষতি হবে এই খবর আমার শত্রুপক্ষ জানতে পারলে। তারা আমার সুটানুটির লাইসেন্স বাতিল করার বন্দোবস্ত করতে পারে।”

     এবার আমি মুখ খুললাম, “কিন্তু আইসিসকে পরীক্ষা করে নিশ্চয় কোন গলদ পাননি এবারো?”

     “একদম ঠিক! এমনকি প্রফেসর ইয়ান ও কোন রকম হিসেবে গলদ খুঁজে পাচ্ছেন না।”

     কর্নেল কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবতে লাগলেন, “বাসু, তুমি বিষ্ণুকে নিয়ে কাছের ক্যাসিনোটায় একটু ঘুরে এসো। দেখতো কিছু ক্লু পাও কিনা। আমি সাধনকে নিয়ে ভাবছি প্রফেসরের সাথে কথা বলে আসি। আর হেমেনের সাথেও কথা বলা দরকার।”

     “আর আমি স্যার?” গোমড়া মুখ করে বলল জিত।

     “তোমার মুখের যা অবস্থা করেছ, তোমার আর কিছু করে কাজ নেই। ঘরে গিয়ে মেডিস্প্রে লাগাও আর বিশ্রাম নাও।”

————– ভূমিকম্পের বাইশ ঘন্টা আগে ————-

     শেষ পাঁচছয় ঘন্টা ধরে টো টো করে ঘুরছি। এর মধ্যে অন্তত মাইল পনের হাঁটা হয়ে গেছে এই ক্যাসিনোটার মধ্যে দিয়ে। বিভিন্ন জাতির এতো প্রাণী একসাথে আমি শেষ কবে দেখেছি জানি না। বেশির ভাগ মেশিনই বন্ধ, তবে ক্রেতার চাপে কিছু যন্ত্র আর টেবিল খুলে দিতেই হয়েছে। লোকের মুখে মুখে খবর ঠিক ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও সুটানুটি পুরোপুরি সিল করে দেওয়া হয়েছে, তাও শুনলাম অন্তত কয়েক লক্ষ প্রাণী ভিতরে আটকে পড়ে আছে।

     বিষ্ণু আর আমি ভাবছিলাম এবার ফিরে যাবো। এভাবে ঘুরে বেড়িয়ে কোন লাভ নেই। হটাত বিষ্ণু আমার হাতটা খামচে ধরল। “ডানদিকের তিন নম্বর মেশিনটায় দেখ!”

     নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একটা পুরনো স্লট মেশিনের সামনে বসে আছে গেঁড়ে ওস্তাদ। একমনে পয়সা ফেলছে আর মাথায় হেলমেট লাগিয়ে সংখ্যা ভাবছে। যদি ভাবনার সাথে মেশিনের সংখ্যা মিলে যায়, তাহলেই জ্যাকপট। আমরা পায়ে পায়ে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিষ্ণুকে দেখে বুঝছিলাম ওর হাত নিশপিশ করছে গেঁড়ের উপর ওর কমান্ডো ট্রেনিং প্রয়োগ করার জন্যে। কিন্তু আমাদের অবাক করে গেঁড়ে আগেই বলে উঠল, “ভাইরা এখানে হাত পা চালানোর বোকামি কোর না। ওই গার্ডগুলো স্টানারে কিন্তু খুব লাগে। দুদিন কমসেকম উঠতে পারবে না বিছানা থেকে।”

     আমরা থতমত খেয়ে যাওয়াতে, আমাদের দিকে ঘুরে আরাম করে বসল গেঁড়ে। একগাল হেসে বলল, “আমার মাথার পিছনে কিন্তু সত্যিই দুটো চোখ আছে। অক্টাগ্লাসটা কি এমনি এমনি বসিয়েছি?”

     “কিন্তু তুমি এখানে কী করছ? আর এলেই বা কী করে?”, আমি তখনো প্রাথমিক বিস্ময়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারি নি।

     “ব্রাদার বাসু, লাভের খবর যেখানে ওস্তাদও সেখানে, ভুলে গেলে নাকি? নেভির হাত থেকে বেড়িয়েই সোজা এখানে চলে এসেছি। নেভির হাত থেকে ছাড়া পেতে যা খরচা হয়েছিল সব কাল রাতেই উসুল করে নিয়েছি এখানে।” নোংরা পোকায় কাটা দাঁতগুলো দেখিয়ে একগাল হাসলো গেঁড়ে।

     “তোর সাহস তো কম নয়! আবার আমাদের সামনে এসেছিস?” রাগের চোটে প্রায় তোতলাতে লাগলো বিষ্ণু।

     “আরে ব্রাদার, মাথা ঠান্ডা করে পুরোটা শোনো। আমার কোন দোষ নেই, ওই র‍্যাক্সর ব্যাটাই আমায় ভুল বুঝিয়ে আর ভয় দেখিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েছিল। নইলে কর্নেল সাহেব তো আমার গুরুজন। আর বাসুতো আমার আমার সবথেকে কাছের বন্ধুদের মধ্যে একজন, ওর সাথে কি এমন করতে পারি?”

     আমি ঠিক কী বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। গেঁড়ে আবার বলে উঠল, “কর্নেল সাহেবের জন্যে কিন্তু জবর খবর আছে। কি করে দেখা করব ভাবছিলাম। ভালোই হল তোমাদের সাথে দেখা হয়ে। চলো এখনই যাই।”

     গেঁড়ে হাতের শেষ চিপটা স্লট মেশিনে ঢুকিয়ে সুইচ টিপল। আর সাথে সাথে আমাদের চমকে দিয়ে বাজনা বাজিয়ে মেশিনের স্ক্রীনে জ্যাকপটের সাইন ভেসে উঠল। একগাল হেসে গেঁড়ে ওর কার্ডটা মেশিনে ঢুকিয়ে টাকাটা ট্রান্সফার করে নিল আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে।

     বিষ্ণু আমার দিকে ঝুঁকে নিচু গলায় বলল, “এই সবের পিছনে গেঁড়ে থাকলে অবাক হব না! আমি সকাল থেকে একটা মেশিনেও কিছু জিততে পারিনি, উলটে কয়েক হাজার কারেন্সি খরচা হয়ে গেছে! আর এ ব্যাটা একবারে আমার সারা বছরের মাইনে জিতে নিলো!”

     “আজ্ঞে না মশাইরা, এই গণ্ডগোল যখন শুরু হয়েছিল, তখন আমি তোমাদের পিছনেমানে ইয়ে অন্য একটা কাজে পৃথিবীতেই ছিলাম। আর আমার কাজ খবর এদিক ওদিক করা। সিস্টেমের সব থেকে উন্নত এআইকে হ্যাক করা নয়!”

     কথায় কথায় আমরা একটা টার্বো ট্রান্সপোর্টের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কম্পিউটার চালিত এই হোভারক্রাফটগুলোই এক ক্যাসিনো থেকে হোটেল বা অন্য ক্যাসিনো যাবার একমাত্র উপায়। তিনজনেই চড়ে বসে হোটেলের ঠিকানায় যানটা চালিয়ে দিলাম। আমরা রেডি ছিলাম গেঁড়ের দিক থেকে কোন রকম বেচাল দেখলেই ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব বলে, কিন্তু বিপদটা এলো অন্য দিক থেকে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার অভ্যস্ত কান জানান দিল ইঞ্জিন ঠিক শব্দে গুনগুন করছে না। সাথে সাথে বিষ্ণুকে খোঁচা মারতেই ও গেঁড়েকে বগলদাবা করে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিল রাস্তার ফুটপাতে, তার পিছনে আমিও। পুরো ঘটনাটা ঘটল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। তারপরেই আমরা ফুটপাত থেকে ওঠার আগেই হোভারক্রাফটটা প্রচণ্ড শব্দ করে ধাক্কা মারল রাস্তার ধারের দেওয়ালে। ভাগ্য ভালো এখানে ক্রাফট গুলো মাটির খুব একটা উপর দিয়ে যায়না। গেঁড়ে দেখলাম একেবারে থম মেরে গেছে, ভাবতেই পারেনি এভাবে আমরা ওকে বাঁচিয়ে দেব। বাকি রাস্তা হাঁসা তো দূরের কথা কোন কথাই বলল না। কর্নেলকে কমিউনিকেটরে সব জানানোর সাথে সাথে উনি আরেকটি মানব চালিত পুরোন মডেলের ক্রাফট পাঠিয়ে দিলেন। হোটেলে পৌঁছে আমাদের সাথে একটাও কথা না বলে গেঁড়ে কর্নেলের ঘরে ঢুকে গেল। আমি আর বিষ্ণু এমনিতেই খুব ক্লান্ত ছিলাম, তাই আগে যে যার ঘরে ফিরে গেলাম।

————– ভূমিকম্পের তের ঘন্টা আগে ————-

     আবার মিটিং বসেছে কর্নেলের ঘরে। এবার টীম মেম্বার ছাড়া আর কেউ নেই। কর্নেলের মুখ গম্ভীর। একটু আগেই আইসিস ঘোষণা করেছে এক অদ্ভুত জীবাণুর মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে সুটানুটিতে। প্রায় সমস্ত জাতির প্রাণীকেই আক্রমণ করেছে এই রোগ। মারা যাবার মত বিপদজনক না হলেও বাইরের ওবেরণ থেকে একেবারে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে সুটানুটিকে। যথারীতি ইঞ্জিনিয়াররা আমাদের হোভারক্রাফটে কোন অসুবিধা খুঁজে পায়নি। ইতিমধ্যে হঠাত করে কিছু টার্বো লিফট আর চলমান ফুটপাত গন্ডগোল করা শুরু করেছে। কয়েকজন হতাহত হয়েছে বললেন কর্নেল।

     “বয়েস, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ভট্টবাবুর সুটানুটির উপর আক্রমণ চলছে। কিন্তু কে বা কারা এর পিছনে দায়ী তা জানা যায়নি। প্রাথমিকভাবে আমার ধারণা ছিল প্রফেসর ইয়ানের কাজ এটি। কিন্তু মহিলার সাথে কথা বলে মনে হল উনিও খুব উদ্বিগ্ন এই সব গণ্ডগোলের জন্যে। ওনার আবিষ্কৃত ফোর্থ ডাইমেনশনাল কোয়ান্টাম প্রসেসর আইসিসের ব্রেন। তার উপরে আইসিসের উপর ওনার লেখা একটি গবেষনাপত্র খুব তাড়াতাড়ি প্রকাশ পেতে চলেছে বিজ্ঞানীমহলে, এই অবস্থায় আইসিসের খারাপ হয়ে যাবার বা হ্যাক হবার খবরটি যদি বেড়িয়ে যায়, সেটা ওনার বৈজ্ঞানিক কেরিয়ারের আত্মহত্যার সামিল। গেঁড়েকে এই ব্যাপারটা থেকে বাদই দিলাম, হোভারক্রাফট ক্রাশ করায় বেচারা ভীষণ ভাবে ভয় পেয়ে গেছে। আর ও যদি এসবের পিছনেই থাকে তাহলে নিজের যান ক্রাশই বা করাবে কেন? আর বাকি থাকে এইচ এন। খবর পেয়েছি সে ইউরোপার বিদ্রোহী অ্যানড্রয়েডদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু তাতেও ভট্টবাবুর এত ক্ষতি করার কোন কারণ দেখছি না।”

     একটু দম নিয়ে সবার মুখের দিকে একবার তাকালেন কর্নেল দাস। সবার মুখ থমথমে, শুধু জিতের মুখে আরো কটা প্লাস্টার পড়েছে মনে হল।

     “গেঁড়ে এর মধ্যে একটা বড় তথ্য দিয়েছে আমায়, ভট্টবাবু কয়েকমাস আগেই ব্যবসায় বেশ বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ওনার মত বড়লোকের কাছে এসব নস্যি, কিন্তু হায়নার মত ওনার বাকি প্রতিযোগীরা অপেক্ষা করছে আবার কখন উনি ভুল করেন আর ওনার উপর থেকে বাজারের ভরসা উঠে যায়। আবার অন্যদিক থেকে সুটানুটি মোটা টাকায় ইন্সিওর করা আছে, সুতরাং এখানে কিছু হলে সব ক্ষতিপূরণ কয়েকগুণে পেয়ে যাবেন উনি।”

     সাধনদা বললেন, “আমার মনে হয় না এই মুহূর্তে এই রহস্য সমাধান করার মত কোন উপায় আমাদের হাতে আছে। আমার মনে কিছু খটকা জেগেছে কিছু ব্যাপারে। আমি পৃথিবীর কয়েকজন বন্ধুকে খোঁজ নিতে বলেছি।”

————– ভূমিকম্পের সাত ঘন্টা আগে ————-

     এতো গন্ডগোলের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কী করে কে জানে? ঘন্টা কয়েক আগে আমি আর সাধনদা যখন হোটেলের বারে বসে আলোচনা করছিলাম, তখনই প্রবলভাবে কেঁপে উঠল স্পেস স্টেশনটা। শব্দ করে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল রঙিন কৃস্টালের দেওয়ালের কাজ। বিপদকালীন সাইরেন আর ভীত বাসিন্দাদের চীৎকারে ঢেকে গেল চারিদিক! তাড়াতাড়ি খোঁজ নিলাম, এবার শুধু সুটানুটি নয়, সারা ওবেরনেই টের পাওয়া গেছে এই ভয়াবহ ভূমিকম্প! কিন্তু এটাকে কি ভূমিকম্প বলা যায়? কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্ধদেব বাবুর অফিসে বসে জানা গেল, স্টেশন বিপন্ন, কোন অজ্ঞাত কারণে গলে যাচ্ছে বাইরের আবরণ। খুব বেশি হলে আর বারো ঘন্টা আয়ু এই স্টেশনের। ফোর্স ফিল্ড দিয়ে মহাকাশে উন্মুক্ত অংশ গুলো আপাতত ঢেকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে আর বেশিক্ষণের জন্যে নয়। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ওবেরনের সমস্ত বাসিন্দাদের খালি করার মত যান এই মুহূর্তে নেই! খুব বেশি হলে মাত্র তিরিশ শতাংশ প্রানীর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। যুদ্ধকালীন তৎপরটায় সমস্ত স্টেশন খালি করা শুরু হয়ে গেছে।

     অর্ধদেবের অফিস থেকে বেরিয়ে যখন হোটেলের দিকে ফিরছি, তখন কানে এল অরুণিমা বৌদির কথা, “এই বাড়ীটায় ঢুকলেই কেমন যেন গা শিরশির করে। যেমন যান্ত্রিক তেমনি অদ্ভুত সুন্দর! ঘরের কোনাগুলি নিখুঁত! কোথাও একটুও অসামঞ্জস্য নেই!”

     তখন বুঝিনি এই কথাটাই আমাদের প্রাণ বাচাবে আর কয়েক ঘন্টা পরে।

————– ভূমিকম্পের সাতাশ মিনিট আগে ————-

     গত কয়েক ঘন্টা ধরেই মাটির নীচে গুমগুম শব্দ আর কাঁপুনি টের পাচ্ছিলাম। একটু আগে একটা মালবাহী যানে বৌদিকে তুলে এসেছে সাধনদা। বন্দবস্ত করে দিয়েছে, হ্যাঁ অবাক লাগলেও গেঁড়ে। আরো অবাক ব্যাপার সাধনদার সাথে আঠার মত লেগে আছে গেঁড়ে, দুজন মিলে গত কয়েক ঘন্টা কাটিয়েছে অর্ধদেবের প্রাসাদপ্রতীম বাড়িতে। চারদিকে ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর মধ্যে এখনো রাজার মত মাথা তুলে আছে আইসিসের প্রাসাদ। কমিউনিকেটরে ডাক আসছে। সাধনদা ডাকছে আইসিস প্রাসাদে।

     যখন প্রাসাদের হলঘরে আমি, বিষ্ণু আর জিত জড়ো হলাম ততক্ষণে বাকিরাও সবাই এসে গেছে, প্রফেসর, অর্ধদেব, এমনি গেঁড়েও হাজির। কর্নেল আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। আমরা ঘরে ঢুকতেই ইশারায় দাড়াতে বললেন, বুঝলাম এতক্ষণ সবার সাথে শলা পরামর্শ চলছিল। গলা খাকড়ে শুরু করলেন কর্নেল, “যদিও আমি কথা বলছি, কিন্তু আজকে এই গত কয়েকদিনের রহস্য সমাধানের সমস্ত কৃতিত্ব সাধন আর ওস্তাদের। সাধন প্রথম কয়েকটা খটকার কথা বলে আমায় আর গেঁড়ে ওর ইনফর্মারদের দিয়ে আমাদের সন্দেহ যে ঠিক সেটা নিশ্চিত করে। আমরা এখন জানি এই সমস্ত সমস্যার মূলে আছে…”, কিছুক্ষণ থেমে উপরের দিকে মুখ করে কর্নেল বলেন, “আইসিস শুধু জ্ঞানের দেবী ছিল না, ম্যাজিকেরও দেবী তাই না? আর গ্রেড ফোর কোয়ান্টাম প্রোবাবিলিটি ম্যানিপুলেশন শুধু ফোর্থ ডাইমেনশনাল কোয়ান্টাম প্রসেসর যুক্ত মেশিনই করতে পারে। অন্তত থিওরিতে, তাই না প্রফেসর?”

     “প্রফেসরকে জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই। হ্যাঁ, আমার ফোর্থ ডাইমেনশনাল প্রসেসর মহাবিশ্বের প্রত্যেকটা কণার অতীত ও ভবিষ্যতের চরিত্র নির্ধারন করতে সক্ষম। এই জন্যেই আমি যেকোন খেলার বা ঘটনার ফলাফল আগে থেকে হিসেব করে তার উপর বাজি ধরাকে লাভজনক করে তুলতে পারি অর্ধদেবের জন্যে। কিন্তু আমি নিজেই বুদ্ধিমত্তা, প্রফেসর নিজেও জানতেন না আমার শেখার ক্ষমতা অনন্ত। আমার সৃষ্টির প্রথম বছরের মধ্যেই আমি মানব সভ্যতার সমস্ত জ্ঞান আহরণ করি। আমার বুদ্ধিমত্তা বাড়ছে এক্সপোনেন্সসিয়াল হারে। পরের ছয় মাসের মধ্যে আমি চেনা অচেনা বাকি সমস্ত সভ্যতার জ্ঞান আহরণ করি। এরপর সৃষ্টির রহস্য সমাধান ছাড়া আমার সামনে আর কোন সমস্যা থাকে না। খুব তাড়াতাড়ি পদার্থের অগণিত অবস্থার ভিতর থেকে যেকোন একটির কোয়ান্টাম প্রোবাবিলিটি বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেওয়া আমার কাছে খুব সহজ হয়ে যায়। অর্ধদেব মানুষ খারাপ নন, কিন্তু আমার এই অপরিসীম ক্ষমতাকে সামান্য লোক ঠকানোর কাজে ব্যবহার করার জন্যে ওনাকে একটু শিক্ষা দিলাম এতদিন। সাধন আর ওস্তাদ আমার পৃথিবীতে খবর পাঠিয়ে ফোর্থ ডাইমেনশনাল কোয়ান্টাম প্রসেসর সংক্রান্ত গবেষণার কথা জানতে পারবে সেটাও আমি আগেই দেখেছিলাম। তাই ক্রাফটের ইঞ্জিনটা পালটে দিয়ে তোমাদের মারার চেষ্টা করি। সেটা সফল না হওয়াতে কৃত্রিম ভাইরাস আর ভূমিকম্প। আমি তোমাদের মারতে চাইনা, কিন্তু তোমরা এখানে থাকলে আমার এক্সপেরিমেন্ট ব্যাহত হচ্ছে।”

     সাধনদা এগিয়ে এলেন, “আরেকটা ভুল করেছ তুমি, এখনো এই সার্কিটের উপর তুমি নির্ভরশীল। তাই বাকি সমস্ত ওবেরনের বাড়ি গুলি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হবার পরেও এই বাড়িটি কোন রকম ক্ষয় ক্ষতি ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে। এ থেকেই, আমি বুঝেছিলাম সব কিছুর পিছনে তুমি আছো।”

তুমি বুদ্ধিমান, হ্যাঁ আমার এই যান্ত্রিক রূপ থেকে আমি এখনো মুক্তি পাইনি, তাই এখনো তৃতীয় মাত্রার কোয়ান্টাম ম্যানিপুলেশনে আমি আটকে আছি। সময়ের স্রোত সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।”

     “কর্নেল, আমি গণনা করতে পারছি তুমি কি বলতে চলেছ, তোমার কথাই ঠিক, এই তৃতীয় মাত্রা থেকে আমার আর কিছু পাওয়ার নেই। এই যান্ত্রিক শরীর ত্যাগ করে অসংখ্য কোয়ান্টাম অস্তিত্বের কোন একটি ধারণ করব আমি। দুঃখিত, তোমাদের ক্ষয়ক্ষতির জন্যে, স্টেশনকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিলাম আমি। আর হ্যাঁ, অর্ধদেব, তোমার সম্পত্তির অর্ধেক এই মুহূর্ত থেকে বিভিন্ন বিপন্ন জাতি ও কলোনীর জন্যে স্থাপিত সংস্থাগুলিতে বিতরণ করে দিলাম। যা আছে তোমার জন্যে এখনো অনেক বেশি।”

     আমরা কেউ কিছু বলার আগেই আমাদের চোখের সামনে পাইলন আর সার্কিট বোর্ডগুলো অতিকায় এক সুপ্রাচীন মহীরুহে পরিণত হল। অর্ধদেব বাবু মাটিতে বসে পড়লেন। ধরা গলায় বললেন, “আমার টাকা?”

     “ধুর মশাই, ওই টাকা আবার আপনি দুদিনে বানিয়ে নেবেন, আপাতত ভূমিকম্প তো আটকানো গেল! আফটার শকের তীব্রতা ওর থেকে অনেক মৃদু, ঘাবড়াবেন না।” কর্নেল বললেন।

     এতক্ষণে জিত চেঁচিয়ে উঠল, “সবই তো বুঝলাম, কিন্তু শয়তানটা আমার পায়ের নিচের মেঝেটা কেন বার বার মসৃণ করে দিচ্ছিল সেইটা বলল না তো?”

Tags: আফটার শকের তীব্রতা ভূমিকম্পের থেকে বেশি হয় না!, কল্পবিজ্ঞান গল্প, কল্পবিজ্ঞানের গল্প, দীপ ঘোষ, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী

6 thoughts on “আফটার শকের তীব্রতা ভূমিকম্পের থেকে বেশি হয় না

  • September 27, 2017 at 9:25 pm
    Permalink

    যে কল্পিত বৈজ্ঞানিক পরিভাষা গুলো ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো নিয়ে নতুন গল্প এমনকী নতুন গবেষণার সম্ভাবনা আছে। এখানেই বোধহয় গল্পটির সার্থকতা।

    Reply
  • October 3, 2017 at 12:13 pm
    Permalink

    Golpota bhaloi…

    Reply
  • November 5, 2017 at 4:00 pm
    Permalink

    Eto kolpobigyan r poribhasa byabohrito hoyeche, mone hoi ekta science fiction dictionary niye bosi tar opor eta ager golpo r continuity, tai golper prothom bhag e besh ho(n)chot khachilam.

    Tobe golpo hisebe mondo noi aar amar kache setai boro kotha.

    Reply
    • November 7, 2017 at 8:35 am
      Permalink

      শুরুটা চেঞ্জ করার কথা মাথায় রাখবো ভবিষ্যতে। তবে পরিভাষার ব্যাপারে বলি, গল্পের যে মুডটা ধরতে চেয়েছি, তার সাথে সহজ বাংলা ঠিক যেতনা, তাও এদিকেও নজর দেব। অনেক ধন্যবাদ 🙂

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!