পুনরাগমনায় চ

  • লেখক: গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
  • শিল্পী: সৌরভ দে

সকালবেলা। এভার ঘুম ভেঙে গেল। গুহার ঠিক বাইরে জ্বালা আগুনটা ভোরের দিকে নিভে গিয়েছে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। ভাল্লুকের মোটা চামড়াটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল এভা। তার বেশ মনে পড়ে ছোটবেলায় বেশ কয়েক চাঁদ ধরে এত গরম পড়ত যে ওই দূরের পাহাড়টাও গায়ের বরফের সাদা চাদর খুলে ফেলত। সে সময় এভারও খালি গায়ে ঘুরতেও কোনও কষ্টই হত না। কিন্তু এখন সারাক্ষণই কনকনে ঠান্ডা। মাঝে মাঝে আকাশ থেকেও বরফ পড়ে।

     সকালটা ঝকঝকে পরিষ্কার। গুহার বাইরে এসে দাঁড়াতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সূর্য ওর পিছনে, তার আলো ওই সাদা চাদরটার উপর পড়েছে। প্রতিদিন যেন বরফের চাদরটা একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। শিকারের সময় এভারা যেমন গুঁড়ি মেরে আস্তে আস্তে এগোয়, হরিণ যেন বুঝতে না পারে। খুব কাছে না যেতে পারলে পাথরের কুঠার দিয়ে হরিণ মারা যায় না। এখন হরিণও কমে গেছে। বাইসনের দল আগে দুই পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে এভাদের কাছের জঙ্গলে আসত। কিন্তু অনেকদিন তারাও আসেনি।

     এভার দু’হাতে যতগুলো আঙুল আছে তত চাঁদ আগে বরফের চাদরটা ছিল ঝর্নার ওপারে। গতকাল বিকেলে এভা ঝর্নার দিকে গিয়েছিল। কেন ও নিজেও জানে না। ঝর্নাটা কবে শুকিয়ে গেছে! জল খেতে এখন যেতে হয় পাহাড়ের আরও নীচের দিকে। সেখানে একটা পুকুর আছে। সাবধানে যেতে হয়। দাঁতালও ওখানে জল খেতে আসে। তার সঙ্গে দেখা হলেই বিপদ। ক’দিন ধরে এভার মনে হচ্ছে চাদরের দিক থেকে আরও বড় বিপদ আসছে। ঠিক যেমন হিকের সঙ্গে যখন সেদিন পুকুরে জল খেতে যাচ্ছিল, সামনে বিপদ মনে করে এভা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। হিক দাঁড়ায়নি। তারপরেই দাঁতালটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে হিকের উপর লাফিয়ে পড়েছিল। এক ঝটকাতেই ঘাড় মটকে দিয়েছিল।

     সাদা চাদরটা থেকে বিপদ কেমন করে আসতে পারে এভা জানে না। একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখছিল এভা। ও জানে বরফের টুকরো হাতে নিলে কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা জল হয়ে যায়। ভালো করে দেখতে গিয়ে এভা ওই সাদা চাদরের মধ্যে একটা আঙুল ঢুকিয়ে দেয়। আঙুলটা একটু বেশিক্ষণ রেখেছিল, নীল হয়ে গিয়েছিল। চাদরেরও দাঁত আছে! কিন্তু সে দাঁত যতই ধারালো হোক, সে তো দাঁতালের মতো দৌড়োতে পারে না। তাকে ভয় পাওয়ার কী আছে? কিন্তু গতকাল এভা দেখেছে যে চাদরটা ঝর্না পেরিয়ে এসেছে। রাতে ও স্বপ্ন দেখেছে বরফের চাদরটা ওকে তাড়া করেছে, ও পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনদিকে যাবে? দলের বাকিরা কি ওর সঙ্গে যাবে?

 

*       *       *

সকালবেলা। ইভের ঘুম ভেঙে গেল। অবশ্য এত গরম যে সারা রাতে অনেকবারই ঘুম ভেঙেছে। ইলেকট্রিসিটি নেই আজ তিন বছর হয়ে গেল। সোলার প্যানেল কিছু আছে, কিন্তু দিনের অধিকাংশ সময় মেঘে ঢাকা বলে তারা ব্যাটারিকে চার্জ করতে অনেক সময় নেয়। তাই প্রয়োজন ছাড়া ব্যাটারি ব্যবহারের নিয়ম নেই। প্রয়োজন বলতে শুধু রেডিওটা চালানো। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলা রেডিও চালিয়ে কোনও জায়গা থেকে যদি কিছু খবর পাওয়া যায়, সেই চেষ্টা করা হয় ইভদের কমিউনে। ইভ জানে সে চেষ্টা বৃথা। কোনও রেডিও কি টিভি স্টেশন আর সম্প্রচার করছে না। ইন্টারনেট তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই ধ্বংস হয়ে গেছে। সব দেশই শত্রুপক্ষের উপগ্রহগুলোকে এবং কেবল ল্যান্ডিং স্টেশনগুলোকে প্রথমেই টার্গেট করেছিল। কিন্তু সে সব কথা লোকে ভুলে যেতে চায়। এখনো তারা আশা করে কেউ এসে ওদের এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করবে!

     বাকিরা কী ভাবছে তাতে অবশ্য ইভের কিছু আসে যায় না। ও অনেকদিন ধরেই জানে যে এই কমিউনের আয়ু বেশি দিন নয়, তার আগেই ও এই শহর ছেড়ে যাবে। ইলেকট্রিসিটির মতো আরামে ইভ আর অভ্যস্ত হতে চায় না। বাকিরা চোখ বুজে থাকলেও ও খুলে রেখেছে, তাই দেখতে পাচ্ছে সমুদ্র প্রত্যেকদিন আরও উঠে আসছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে মাত্র একশো বছর আগেও লোকজন তর্ক করত। দক্ষিণ মেরুর বরফ গলতে শুরু করার পরেও মানুষ ভেবেছিল ব্যাপারটা নিতান্ত সাময়িক। কিছু না করলেও জীবনটা আগের মতো থেকে যাবে! কিন্তু ইভের তার চেয়েও বেশি অবাক লাগে এই ভেবে যে কমিউনের লোকজন এখনও একই কথা মনে করে। চোখ থাকতেও অন্ধ লোককে কে শেখাবে?

     জানলা থেকে বাঁধা দড়িটা বেয়ে নৌকাতে নামল ইভ। দাঁড়দুটো হাতে নিল। এই স্কাইস্ক্র্যাপারটাই সবচেয়ে উঁচু বলে শহরে যে ক’জন লোক টিকে আছে তারা সবাই এটাতে এসে জুটেছে। কিন্তু আরও কতকগুলো বাড়ি এখনও জলের উপর মাথা উঁচু করে আছে। প্রত্যেকদিন ইভ নৌকা নিয়ে একটা না একটা বাড়িতে যায়, আর খুঁজে দেখে যদি কিছু দরকারি জিনিস পাওয়া যায়। ওর আগে অবশ্য অন্যরাও সেই বাড়িগুলোতে ঢুকেছে, কিন্তু ইভের কাছে যেগুলো প্রয়োজনীয়, অন্য লোকরা অনেক সময় সেগুলোকে পাত্তা দেয় না। ইভ শিগগিরি কমিউন ছাড়বে, তার জন্য এক মাস ধরেই অল্প অল্প করে জোগাড়যন্ত্র করছে। তার মধ্যে দু’একবার কপাল খুলে যায়। গত সপ্তাহে ইভ একটা পেন্টহাউস অ্যাপার্টমেণ্টের কার্পেটের তলায় চোরকুঠুরি থেকে থেকে একটা রাইফেল আর এক বাক্স বুলেট পেয়েছিল। সেটা দেখে কমিউনের অনেকেরই চোখ লোভে চকচক করে উঠেছিল। ইভ একদিনও সেগুলো নিজের কাছে রাখেনি। একটা বর্শা, একটা হাতে ধরা হার্পুন, একটা ক্রসবো আর কুড়িটা স্টিলের তিরের বদলে দিয়ে দিয়েছিল। গুলি শেষ হবে একদিন,‌ তারপর রাইফেলটা দিয়ে মুগুর ছাড়া আর কী কাজ হবে?

     বাড়িগুলোতে খাবারদাবার পাওয়া যায় না, সে তো অনেকদিন আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। মাছ, ঝিনুক, হাঙর, অক্টোপাস— এসবই এখন সকলেরই প্রধান খাবার। প্রোটিন নিয়ে চিন্তা নেই, কিন্তু কার্বোহাইড্রেটের আকাল আছে। কয়েকটা বাড়ির ছাদে ধান-গম-ভুট্টা লাগানো হয়েছে। ফলনের পরিমাণ খুব কম। জল চারদিকেই, কিন্তু সে তো নোনা। তাই ফসলের জন্য বৃষ্টিই ভরসা। বৃষ্টির অবশ্য ঘাটতি নেই, দিনের অর্ধেক সময়টাই আকাশ থেকে মুষলধারে জল ঝরছে। কিন্তু সে জলে এত অ্যাসিড যে ফসল বাঁচানোই শক্ত।

     আজও ইভের কপাল ভালো। একটা সেলাইয়ের বাক্স পেয়ে গেল, তার একটা ছুঁচেও মরচে ধরেনি। শহর ছেড়ে যাওয়ার জন্য সব গোছানো হয়ে গেছে। কিন্তু যাবে কোনদিকে ইভ? সঙ্গে কি কাউকে নেবে?

       

*       *       *

একজনও এল না এভার সঙ্গে ।

     এভা সবাইকে বলেছে যে সামনে বিপদ। জঙ্গলে হরিণ নেই, বাইসনরা আসছে না। সাদা চাদরটা শিকার ধরার জন্য এগিয়ে আসছে। কিন্তু বিপদ কী এভা নিজেও জানে না। জানলেও কথায় প্রকাশ করতে পারত না, তাদের ভাষাতে সেইরকম শব্দ নেই।

     ঠিক আছে, এভা একাই যাবে। ও কখনও কাউকে দল ছেড়ে যেতে দেখেনি। দাঁতাল আছে, ভাল্লুক আছে, লম্বানাকী আছে, জঙ্গলে বিপদ অনেক। তার ওপর আছে দানব পিশাচ। ওঝা না থাকলে ওদের সবাইকে কবেই তারা মেরে ফেলত। কিন্তু ওই সাদা চাদরটাকে কিছুতেই ভুলতে পারছে না এভা। ওদের জঙ্গলটা চারদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। পাহাড়ের একদম উপরে যাওয়া যায় না, সেখানে শীতদানব বাস করে। এভার মনে হচ্ছে যে ওই দানবটাই সাদা চাদর সেজে এসেছে। সেটাকে আগে তো পাহাড়ের উপরেই দেখা যেত।  দুই পাহাড়ের মধ্যের একটা ফাঁক দিয়ে বাইসনরা আসত। এভারা যেখানে থাকে তার থেকে সেটা খুব উঁচুতে নয়। হয়তো শীতদানব এখনও ওইদিকে হাত বাড়ায়নি। ওদের দলের কেউ কখনও ওই ফাঁকের ওদিকে যায়নি। খুব শীত পড়লে বাইসনরা ওখান দিয়েই জঙ্গল ছেড়ে যায়। এভা তাদের রাস্তাই ধরবে।

     সকাল হতে হতে না হতেই বেরিয়ে পড়ল এভা। এক সপ্তাহ আগে শেষ হরিণটা মেরেছিল, এখন তার প্রায় কিছুই নেই। শুধু চামড়াটা আর নাড়িভুঁড়ি— কী ভেবে কে জানে, এভা সেগুলো তুলে নিল। চামড়াটা দিয়ে একটা ঝোলা মতো হল। পাথরের কুঠার তিনটে আর চকমকি পাথর ওর সব সময়ের সঙ্গী, সেগুলো গেল ঝোলাতে। গুহা থেকে বেরিয়ে পড়ল। কেউ ওকে ডাকল না, কোথায় যাচ্ছিস জিজ্ঞাসা করল না।  শীতে কেউ গুহা থেকে এত সকালে বেরোয়নি।

     দুই পাহাড়ের ফাঁকটা যতটা কাছে মনে হচ্ছিল, তার থেকে অনেক বেশি দূরে। এভা ভেবেছিল সূর্য মাথার উপরে আসার আগেই পৌঁছে যাবে। কিন্তু সূর্য যখন পাহাড়ের পিছনদিকে হেলে পড়ছে, তখনও অনেক রাস্তা বাকি। তার চেয়েও বড় সমস্যা হল যে সামনে অনেকটা ওই চাদরের মতোই সাদা বরফ জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে আছে।

     এভা এতক্ষণ ধরে পাহাড়ে উঠছে, গা দিয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। কিন্তু এইবার দাঁড়াতেই ঠান্ডাটা ওকে খুঁজে পেল। রাস্তায় একবার ভেবেছিল ভাল্লুকের চামড়াটা ফেলে দেবে। ভাগ্যিস দেয়নি, এবার সেটা কাজে লেগে গেল। গায়ে জড়িয়ে নিল। তাতেও শীত বাগ মানছে না। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে এদিক ওদিক তাকাল এভা। জঙ্গলের গাছের তলায় অনেক শুকনো কাঠকুটো আর পাতা ছড়িয়ে আছে। সেগুলো টেনে এনে জড়ো করল। তারপর চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালল। রাস্তায় পাথর ছুঁড়ে দুটো খরগোস মেরেছিল, তার একটার চামড়াটা ছাড়িয়ে পিছনের একটা পায়ে দাঁত বসাল। অনেকক্ষণ আগে মেরেছে, মাংসটা বেশ শক্ত হয়ে গেছে।

       

*      *       *

খাবার খেয়ে ইভ নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল একেবারে ভোরবেলা। সরাসরি কাউকে জিজ্ঞাসা করেনি ইভ, কিন্তু আভাসে ইঙ্গিতে এই ডুবে যাওয়া শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলেছিল অনেকের সঙ্গে। একজনকেও পেল না যে সে ব্যাপারে আগ্রহী। সকলেরই বিশ্বাস, এবার জল নামতে শুরু করবে। তারপরেই আবার ফিরে যাওয়া যাবে আগের জীবনে। এত উথালপাতালের পরেও তাদের বিশ্বাস টলেনি!

     বৃষ্টি হয়েই চলেছে। সঙ্গের জিনিসগুলোকে খুব ভাল করে মুড়েছে ইভ যাতে জল না ঢোকে। বেরোনোর আগে ম্যাপটাতে একবার চোখ বুলিয়েছিল, উত্তর দিকে একটা মালভূমি আছে। অনেকটা রাস্তা, তবু ইভকে সেদিকেই যেতে হবে। তবে উঁচু জমি পাওয়া যাবে, মাটির উপরে দাঁড়াতে পারা যাবে। কম্পাসটাতে জল ঢোকার ভয় নেই, পকেট থেকে বার করে সেটাকে সামনে রাখল ইভ। একবার চোখ বুলিয়ে নিলো নৌকার খোলে। না, কিছু ভুলে যায়নি। নৌকা ছেড়ে দিল। আরও অনেকগুলো নৌকা বাঁধা আছে, সাবধানে সেগুলো এড়িয়ে শহর থেকে বেরিয়ে এল।

     কয়েক ঘণ্টা পরে দাঁড় টানা থামিয়ে নোঙর নামাল ইভ। একটু বিশ্রাম নিতে হবে। এতক্ষণ একটানা নৌকা চালানোর অভ্যাস নেই। একটুও হাওয়া নেই, তাই পাল গুটিয়ে রেখেছে। যতদূর চোখ যায় শুধু জল। বৃষ্টির জল ধরার পাত্রটা ভরে গেছে। সেটা থেকে ঢাকনাওলা বড় ড্রামটায় ঢেলে রাখল। বৃষ্টিটা একটু থেমেছে। ওয়াটারপ্রুফের টুপিটা মাথা থেকে নামাল ইভ। নৌকাতে রোদজল থেকে বাঁচতে একটা ছাউনি করা আছে বটে, কিন্তু খুব জোর বৃষ্টিতে সেটা পুরোপুরি জল আটকাতে পারে না। তাই ওয়াটারপ্রুফটা সারাক্ষণই গায়ে থাকে।

     দূরে দূরে আরও দু’একটা নৌকা। ইভ তাদের এড়িয়েই যাচ্ছে। পুলিস নেই, আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। জোর যার মুলুক তার— এটাই এখন নিয়ম। বিশেষ করে মেয়েদের সমস্যা স্বাভাবিকভাবেই আরও বেশি। তাই অপরিচিত লোকের কাছে না যাওয়াই ভালো। ক্রসবো হাতের কাছেই রেখেছে। শুকনো খাবার সঙ্গে কিছু আছে বটে, কিন্তু ইভের হিসেব মতো অনেকদিনই ওকে নৌকোতে কাটাতে হবে। তাই যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে খরচ করতে হবে। ছিপটা বার করল ইভ। মাছ ধরা যাক। রান্নার জন্য কাঠ পেলে ভালো হত, কিন্তু উপায় নেই। কাঠ অনেক ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু না শুকোলে তো আর তা দিয়ে আগুন জ্বালা যাবে না। নিজের বানানো সোলার কুকারটাতে জল গরম করতে দিল। রোদ কম, আকাশ অনেকটা সময়ই মেঘে ঢাকা, রান্না হতে সময় লাগে। তবু এটা না থাকলে ওকে কাঁচা মাছ খেতে শুরু করতে হত।

     সূর্য ডোবার সময় হলে দাঁড় টানা বন্ধ করে দিল ইভ। ভীষণ ক্লান্ত, এবার ঘুমোতে হবে।

 

*       *       *

আর কত দূর? ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে এভা। দুটো পাহাড়ের ফাঁক পর্যন্ত পৌঁছোতেই দু’দিন লেগেছিল। অনেকটা জায়গা বরফের উপর দিয়ে হাঁটতে হয়েছিল। এভার পায়ের তলার চামড়া মোটা হলে কী হবে, পা কামড়ে ধরছিল বরফ। শেষকালে হরিণের চামড়াটার থেকে দুটো টুকরো পাথর দিয়ে কেটে দু’পায়ে বেঁধে নিয়েছে। তাতে কষ্টটা একটু কমেছে।

     দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সুঁড়িপথ। একটাও পাখি ডাকছে না। একটাও পোকার আওয়াজ নেই। এত নিস্তব্ধতা এভা কোনওদিন পায়নি। পায়ের তলা সাদা হয়ে আছে। উপর দিকে তাকিয়ে দেখল, পাহাড়ের উপরদিকে বরফ স্তূপ হয়ে জমে আছে, মাঝে মাঝে ঝুপ ঝুপ করে নীচে পড়ছে। দেয়ালেও সাদা বরফে ঢাকা।  শনশন করে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। কখনও কখনও আকাশ থেকেও বরফ পড়ছে।

     সন্ধে হয়ে এসেছে। অন্ধকার নামার আগে আশ্রয় খুঁজে পেতেই হবে। সে জন্য অনেকক্ষণ ধরে চারদিকে চোখ রেখে হাঁটছিল এভা, এতক্ষণে দেওয়ালে একটা গর্ত দেখতে পেল। অন্তত হাওয়ার কামড় থেকে তো বাঁচা যাবে। পিঠের থেকে বোঝাটা গুহার মধ্যে নামিয়ে সাবধানী চোখে এদিক ওদিক তাকাল এভা। অনেক সময় এইরকম গুহার মধ্যে হিংস্র জন্তু থাকে। তবে এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় কোন জন্তু এখানে আসবে? তাছাড়া এটাকে গুহা বললে বাড়িয়ে বলা হয়। পাহাড়ের গায়ে নিতান্তই ছোটো একটা গর্ত।

     চকমকিটা ঝোলা থেকে বার করল। বেশ কিছু কাঠকুটো ঝোলাতে ভরেছিল। তার থেকে কয়েকটা নিয়ে মাটিতে রাখল। কয়েকবারের চেষ্টায় আগুন ধরল। শরীরটা একটু হলেও গরম হল। ঝোলা থেকে অন্য খরগোসের মাংসটা বার করল। বেশি পড়ে নেই, তার থেকেই একটা বড় টুকরো নিল। কিন্তু মাংসে দাঁত বসাতে পারল না এভা। শক্ত হয়ে কাঠের মতো হয়ে গেছে। কী হবে তাহলে? এভা জানে না— তবে তা নিয়ে মাথাও ঘামাল না। দলের অন্যদের মতো ওরও শিকার না জুটলে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে।

     মাংসটা যখন কাঠই হয়ে গেছে, সেটা দিয়ে আগুনই জ্বালানোই যাক। একটু কাঠ বেঁচে যাবে, রাস্তায় আবার কোথায় কাঠ পাওয়া যাবে এভা জানে না। কিন্তু খরগোসের মাংসটা আগুনে দিতেই একটু পরে কেমন একটা গন্ধ বেরোল।  টুকরোটার যে অংশটা আগুনের বাইরে, সেটা ধরে টেনে বার করল এভা। ফেলেই দিতে যাবে, কিন্তু হঠাৎ মনে হল টুকরোটা তো আর শক্ত ঠেকছে না। ধোঁয়া ওঠা টুকরোতেই কামড় বসাল। প্রথমবারের জন্য জিভ পুড়ে গেল। কিন্তু একটু হাতে রাখতেই ঠান্ডা হয়ে গেল। দিব্যি খাওয়া গেল টুকরোটা। কোনওদিন এভা ভাবেনি মাংস এরকম করে পুড়িয়ে খাওয়া যায়।

     সারাদিনের পরিশ্রম, পেটে খাবার পড়া মাত্র চোখ বুজে আসছে। আগুনের জন্য বেশ আরাম লাগছে, কিন্তু গুহার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে ঘুমলে রাত্রিবেলা অনেক সময় পিশাচ এসে প্রাণটা চুরি করে নিয়ে যায়। এভা নিজেই দেখেছে। ওদের দলের কন একবার আগুন ঠিক করে নেভায়নি, ঘুমের মধ্যে জোয়ান মরদটার প্রাণ পিশাচ নিয়ে গিয়েছিল। আগুনটা নিভিয়ে দিল এভা, তারপর ঝুলিটা বিছিয়েই শুয়ে পড়ল।  

     অনেকক্ষণ পরে  ঘুম ভাঙল। গুহার ভিতরটা বেশ গরম, কিন্তু নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে। চোখ খুলে দেখল একেবারে অন্ধকার, হাওয়াটাও থেমে গেছে। গুহার মুখটা কোনদিকে বুঝতে পারছে না। কোথাও কোনও ফাঁক নেই। নিশ্চয়ই রাত্রে শীতদানব এসে গুহার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে! কী করবে এখন এভা?

     নিজেকে সামলে নিল এভা। তারপর গুহার দেয়ালের গায়ে হাত দিল— আস্তে আস্তে হাতড়ে হাতড়ে গুহার দেওয়াল ধরে যেতে লাগল। কিছুটা গিয়েই হাতে ঠেকল ঠান্ডা আর নরম কিছু। বুঝতে পারল এখানেই মুখটা আছে, রাত্রিবেলা বরফ পড়ে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করে খুঁড়তে লাগল। কিন্তু একটু পরেই আঙুলগুলো জমে যাচ্ছে। হাতড়ে হাতড়ে ঝোলা থেকে পাথরের কুড়ুলটা বার করল। এবারে বরফ খোঁড়ার কাজটা অনেক সোজা হয়ে গেল। একটু পরেই একটা গর্ত দিয়ে এক ঝলক ঠান্ডা কিন্তু তাজা হাওয়া এসে ঢুকল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল এভা। আলো দেখে বুঝল সকাল হয়ে গেছে।

     একটা মানুষ বেরোনোর মতো গর্ত খুঁড়ল এভা। ঝুলিটা বাইরে ফেলে দিল, তারপর কোনওরকমে বেরিয়ে এল। বাইরেটা ভিতরের থেকে অনেক বেশি ঠান্ডা। সারা রাত ধরে বরফ পড়ে দুই পাহাড়ের মাঝের রাস্তাটাও জায়গায় জায়গায় প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবু এভা ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারছে না। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ঝুলিটা কাঁধে তুলবে, এমন সময়ে হঠাৎ কানে এলো একটা নতুন শব্দ। এভা যেদিকে যাবে সেদিকে থেকেই হাওয়া আসছে। মনে হল মানুষের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে সেই হাওয়াতে। কারা যেন কথা বলছে। এভা একটু দাঁড়ালো, আওয়াজ ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে।

     তাহলে কি ওর দলের লোকরা ওকে খুঁজতে আসছে? নাকি তারাও এভার কথায় বিশ্বাস করে বরফের চাদরের থেকে পালিয়ে যাচ্ছে? কিন্তু আওয়াজটা তো এভা যেদিক থেকে এল, সেদিক থেকে আসছে না! এভা জানে পাহাড়ের উল্টোদিকে ওদের মতোই আর একটা দল থাকে। ও নিজে দেখেনি, কিন্তু শুনেছে তার জন্মের আগে তারা নাকি একবার এসে আক্রমণ করেছিল। অনেক লড়াই করে তাদের তাড়াতে হয়েছিল। এভাদের দলের বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছিল। তাহলে কি তারা আবার এভাদের মারতে আসছে? ওকে সামনে পেলে কি আর ছাড়বে? কিন্তু এভা লুকোবে কোথায়?

     এদিক ওদিক তাকিয়ে ও বুঝল কালকের আশ্রয়টাই একমাত্র লুকোনোর জায়গা। তাড়াতাড়ি করে আবার গর্ত দিয়ে গুহার ভিতরে ঢুকল, তারপর যতটা সম্ভব ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে রইল।

     আস্তে আস্তে মানুষগুলো কাছে এল। এভা যে ওদের কথা প্রায় সবই বুঝতে পারছে, তাতে অবাক হল না। কারণ ও যত মানুষকে চেনে, সবাই একই রকম ভাষায় কথা বলে। ভাষা যে আলাদা হতে পারে তা ওর অভিজ্ঞতার বাইরে। ভবিষ্যতের কোনও ভাষাবিদ বা নৃতত্ত্ববিদ যদি সে সময় সেখানে থাকতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন যে এভাদের দল আর পাহাড় পেরিয়ে আসা এই মানুষরা কয়েক পুরুষ আগেও একই সঙ্গে ছিল। এভার জানার কোনও উপায় নেই, বলে দিলেও বুঝতে পারত কিনা সন্দেহ— কিন্তু ওর পূর্বপুরুষরা বাইসনের দলের পিছনে পিছনে এই পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় এসেছিল, আর ফিরে যায়নি।

     কিন্তু এভা অবাক হল অন্য কারণে। এ তো শিকার ধরার বা আক্রমণ করার দল নয়। বুড়ো থেকে বাচ্চা— সবাই আছে দলে। ওদের কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারছে যে ওরা পাহাড় পেরিয়ে চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। এভারই মতো। কিন্তু ওরা যেখানে যাচ্ছে, সে জায়গাও তো নিরাপদ নয়। এভা সেখান থেকেই পালিয়ে আসছে।

     কী করবে এভা এখন? ওদের যেতে দেবে? নাকি সাবধান করবে? বলবে ওদিকে কোনও আশ্রয় নেই? ওরা কি এভাকে কিছু বলার সময় দেবে? বিশ্বাস করবে ওকে? এভা ইতস্তত করছে। ষোল বছরের জীবনে এভা কখনও এই রকম দ্বিধার মুখে পড়ে নি।

     এভার জানার কোনও উপায় নেই, কিন্তু মানুষের আগামী দু’লক্ষ বছরের ভবিষ্যৎ তার উপর নির্ভর করছে। মিশর-ব্যাবিলন-মহেঞ্জোদড়ো-গ্রিসের সভ্যতা ওর মুখ চেয়ে আছে। তুতানখামেন-বুদ্ধ-আর্কিমিডিস-অশোক-ক্লিওপেট্রা-হারুন আল রশিদ-গ্যালিলিও-মিকেলাঞ্জেলো-মেরি কুরি-হিটলারেরা অপেক্ষা করছে। চিনের প্রাচীর তৈরি, হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা ফেলা থেকে চাঁদের বুকে নিল আর্মস্ট্রঙের পদক্ষেপ— সবই এভার পরের কয়েক মুহূর্তের সিদ্ধান্তের উপর দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে এভা?

 

*       *       *

ইভ ইতস্তত করতে থাকল। ওরা ওকে খেয়াল করেনি। নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে কি বিপদ ডেকে আনবে? তার চেয়ে ওরা যখন অন্য দিকে ব্যস্ত থাকবে, তখন পালিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু ইভ কিছু না করলে ওরা হয়তো লোকটাকে মেরেই ফেলবে! জীবনে চোখের সামনে অনেক মৃত্যু দেখেছে ইভ। বাবা-মা-ভাই, বন্ধু-পরিচিত-অপরিচিত— কত মৃত্যু! ইভ জানে মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণের ফলে সভ্যতা ধ্বংসের শিকার হয়েছে কয়েকশো কোটি মানুষ, বেঁচে আছে তার থেকে অনেক অনেক কম। কিন্তু তা বলে কোনওদিনই মৃত্যুতে অভ্যস্ত হতে পারেনি ইভ।

     নৌকাদুটোর কাছাকাছি গেল ইভ। দাঁড় টানা বন্ধ করে ক্রসবোতে তির লাগিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর গলা তুলে বলল, ‘ওকে ছেড়ে দে।’

     লোকগুলো ফিরে তাকাল। সবগুলোকে দেখেই মনে হয় বদমাইশ। দু’জনে মিলে তরোয়াল নিয়ে একটা লোককে মারতে চেষ্টা করছিল। অন্য একটা লোক নিজেদের নৌকা থেকে একটা হুক দিয়ে অন্য নৌকাটাকে ধরে রেখেছে যাতে ভেসে ভেসে না সরে যায়। আক্রান্ত লোকটার হাতে কোনও অস্ত্র নেই, একটা নৌকার দাঁড় দিয়ে আনাড়ির মতো আটকাচ্ছিল। এভার মনে হল সে নেহাতই নিরীহ গোবেচারা। এর মধ্যেই গায়ের দু এক জায়গা দিয়ে রক্ত ঝরছে। সে একটু পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।

     ‘ওরে, একটা মেয়ে এসেছে রে। আমাদের বলছে ছেড়ে দিতে। আমরা ভীষণ ভয় পাচ্ছি,’ সর্দার মতো লোকটা তার সঙ্গীকে বলল। কথা বললেও নজর রেখেছে শিকারের দিকে।

     সঙ্গী লোকটা অত সাহসী নয়, ক্রসবো দেখে ভয় পেলেও লুকোনোর চেষ্টা করছে। বলল, ‘দেখ, তোকে ছেড়ে দিচ্ছি। ভালোয় ভালোয় এখান থেকে চলে যা। একটা ক্রসবো দিয়ে তুই একটার বেশি লোক মারতে পারবি? পরের তীরটা লাগানোর আগেই তোকে শেষ করে দেব।’

     ইভ জানে এই কথাগুলো হচ্ছে ওর নজরটাকে অন্যদিকে ফেরানোর জন্য। ও চোখ রেখেছে তৃতীয় লোকটার দিকে। সে হুকটা ছেড়ে দিয়ে আস্তে আস্তে ওদের নৌকার খোলের দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, হাতে একটা হার্পুন। বর্শার মতো করে সেটা ছুঁড়তে যাবে, ইভ তাকে সেই সময় দিল না। বিদ্যুৎগতিতে ইভের তির গিয়ে ওর থাইতে বিঁধল। হার্পুন হাত থেকে পড়ে গেল। একটা আর্ত চিৎকার করে লোকটা নৌকার মধ্যে উল্টে পড়ে গেল।

     দুটো বদমাইশেরই চোখ তাদের সঙ্গীর দিকে, সেই সময় আক্রান্ত লোকটা সাহস করে এসে দাঁড় দিয়ে সর্দারটাকে এক ঘা দিতে গেল। নৌকাটা টলে গিয়েছিল না হয় সর্দার শেষ মুহূর্তে বুঝতে পেরে সরে গিয়েছিল, আঘাতটা একেবারে জোরদার হয়নি। সে লোকটার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ক্রসবোতে তির লাগানোর সময় নেই, ইভ ধনুক ফেলে হাতে বর্শাটা তুলে নিল। বলল, ‘তোরা তো সমানে সমানে কখনও লড়িস না। এবার দুয়ের সঙ্গে দুই। দেখ কী করবি। আর দেরি হলে তোদের সঙ্গী কিন্তু রক্তক্ষরণেই মরে যাবে।’

     একটু ইতস্তত করে লোক দুটো পিছিয়ে গেল। তারপর লাফ দিয়ে নিজেদের নৌকাতে গেল। ওদের সঙ্গী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি করে তার পায়ে একটা ব্যান্ডেজ মতো বাঁধতে লাগল। সর্দার ইভের দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না।

     ইভ ওদের উপর নজর রেখে গলা তুলে বলল, ‘ওদের নৌকাটাকে দাঁড় দিয়ে জোরে ঠেলে দাও।’ আক্রান্ত লোকটা তাই করল। আস্তে আস্তে বদমাইশদের নৌকাটা দূরে চলে গেল।

     এতক্ষণে ইভ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। অন্য লোকটা বলল, ‘ধন্যবাদ। আমি মাছ ধরতে বেরিয়েছিলাম। ভেসে ভেসে অনেকটা দূর চলে এসেছি। ক্লান্ত হয়ে একটু ঝিমোচ্ছিলাম, চটকা ভাঙতে দেখি ডাকাতগুলো আমার নৌকাতে। আপনি না এসে পড়লে আমার আজকেই শেষদিন হত। আইনশৃঙ্খলা বলে তো আর কিছু নেই। তাই এদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। আর কিছুটা দূর কি আমরা একসঙ্গে যেতে পারি? তাহলে ওরা আবার ফিরে আসার সাহস পাবে না।’

     লোকটার কথা শুনে বোঝা যায় শিক্ষিত। কথাতে যুক্তিও আছে। ইভ বলল, ‘আপনার কাটা জায়গাগুলোতে আগে ব্যান্ডেজ বেঁধে নিন।’

     ‘এই জায়গা থেকে আর একটু দূরে চলে যাই। একটু পরে করলেও হবে, ক্ষতগুলো একেবারেই গভীর নয়।’

     দু’জনে পাশাপাশি নৌকা বাইছিল। অনেকক্ষণ পরে যখন ডাকাতদের নৌকা আর দেখা যাচ্ছে না, তখন ওরা নোঙর ফেলল। ইভ বলল, ‘আমি বরঞ্চ আপনাকে ব্যান্ডেজ বাঁধতে সাহায্য করি।’ লোকটা একটু ইতস্তত করে রাজি হল। ইভ যখন নৌকা দুটো এক সঙ্গে বাঁধছে, ও তখন একটা বাক্স থেকে ব্যান্ডেজের কাপড় আর একটা কৌটো বার করে বাক্সটা বন্ধ করে দিল।

     কৌটোটা হাতে নিয়ে ইভ চমকে উঠল। গায়ে একটা কাগজের লেবেলে ভিতরে মলমটার নাম হাতে করে লেখা আছে। গত পাঁচ বছরে এই জিনিস সে চোখে দেখেনি। লোকটারও চোখ এড়ায়নি ইভের প্রতিক্রিয়া। বলল, ‘হ্যাঁ। অ্যান্টিবায়োটিক।’

     ‘কোথায় পেলেন? এই ছোট্ট চোটগুলোর জন্য এটা খরচ করব!’

     ‘স্বচ্ছন্দে। ওটার সময় শেষ হয়ে এসেছে। তাছাড়া দরকার হলে আরও পাওয়া যাবে।’

     ইভের চোখ কপালে উঠে গেল। যে শহরটা ও ছেড়ে এসেছে, সেখানে এই একটা মলমের কৌটোর বদলে একটা ছোটো নৌকা পাওয়া যাবে। কোনও কথা না বাড়িয়ে ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধতে লাগল।

     শেষ হলে লোকটা ইভকে বলল, ‘আপনার জন্য একটা প্রস্তাব আছে। আপনি আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন?’

     ‘আপনারা কারা?’

     ‘আমরা কিছু লোক যারা অনেকদিন আগেই বিশ্ব উষ্ণায়নের ফল কী হতে যাচ্ছে তার কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম। তাই ভবিষ্যতের জন্য কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। এখান থেকে বেশি দূরে নয়, একটা বড়ো দ্বীপ আছে। আমরা জানতাম যে জল যতই বাড়ুক, ওই জায়গাটা ডুববে না। তাই সেখানে আমরা একটা আশ্রয় বানিয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে অনেকেই বিজ্ঞানী। আধুনিক বিজ্ঞান দিয়ে যতটা করা সম্ভব, ততটা আমরা করেছি। যেমন ধরুন, সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক আমরা বানাতে পারি।’

     ‘এতই যদি আপনার ক্ষমতা, তাহলে এই ছিঁচকে ডাকাতগুলোর পাল্লায় পড়েছিলেন কেন?’ ইভ জিজ্ঞাসা করে।

     লোকটা কিছুটা লজ্জা পেয়েই বলে, ‘বন্দুকও আমাদের আছে, তার গুলিও আমরা বানাতে পারি। কিন্তু আমি সেটা নিয়ে বেরোতে ভুলে গেছি। আসলে এদিকটায় আগে কখনও এরকম গুন্ডামির খবর ছিল না।’

     ‘আমাকে বলছেন কেন? আমি তো বিজ্ঞানী নই,’ ইভ বলে।

     ‘শুধু বিজ্ঞানী দরকার তা নয়, আমাদের আরও নানা ধরনের লোক প্রয়োজন। আমরা যতজনকে আমাদের ঘাঁটিতে রাখতে চেয়েছিলাম, অনেক চেষ্টা করেও তার থেকে অনেক কম সংখ্যায় লোক পেয়েছি। একদল মানুষ, তাদের সংখ্যা কম, একেবারেই এই বদমাইশগুলোর মতো খুনোখুনি ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে, তাদের থেকে আমরা দূরে থাকি। অধিকাংশ মানুষই এখনো ভালো, কিন্তু তারা আগের জীবনেই ফিরে যেতে চায়। সেটা যে হওয়ার নয়, তা তাদের বোঝার বাইরে। আপনার বুদ্ধি আছে, অ্যান্টিবায়োটিক দেখে চিনতে পেরেছেন। সাহস আছে, উপকার করার ইচ্ছা আছে, শক্তি আছে— আপনার মতো লোককে আমাদের দরকার। আপনিও একা একা বেরিয়েছেন, নিশ্চয়ই বেঁচে থাকার একটা উদ্দেশ্য খুঁজছেন। আমাদের সঙ্গে যোগ দিন।’

     ‘কী হবে এত ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করে? মানুষের তো আর কোনও আশা নেই!’

     ‘হয়তো নেই। কিন্তু আগে থেকে হাল ছেড়ে দেব কেন? আমরা এমন ব্যবস্থা করতে চাই যে অন্য সব জায়গা থেকেও মানুষ যদি লুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই আশ্রয় থেকেই সভ্যতা আবার জন্ম নেওয়ার সুযোগ থাকবে।’

     ইভ অবিশ্বাসের হাসি হেসে বলল, ‘কজন আছেন আপনারা? সাতশো কোটি লোক শেষ হয়ে গেল, আর আপনারা কজন মানুষের সভ্যতা বাঁচিয়ে থাকার স্বপ্ন দেখছেন!’

     ‘স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কী? তাছাড়া এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছিল। দু’লক্ষ বছর আগে তুষারযুগের সময়টাকে বলে মেরিন আইসোটোপ স্টেজ সিক্স। সেই সময় এমনি ঠান্ডা পড়েছিল যে অধিকাংশ মহাদেশই হিমবাহে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। আমি জেনেটিসিস্ট। তাই আমি জানি যে জেনেটিক্সের সাক্ষ্য বলছে সে সময় পৃথিবীতে আমাদের পূর্বপুরুষের সংখ্যা হয়তো একশোরও নীচে চলে গিয়েছিল। সম্ভবত আফ্রিকার দক্ষিণে সমুদ্রের ধারে একটা মাত্র জায়গায় মানুষ টিকে ছিল। সেখানকার কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, চিংড়ি, মাছ – এ সমস্ত খেয়ে তারা বেঁচেছিল। তাদের থেকেই আমাদের সবার জন্ম। এই ঘটনাকে পপুলেশন জেনেটিক্সে বলে বটলনেক। আবার একবার একই ভাবে অল্প মানুষ নিয়েই শুরু করার চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? আমাদের হারানোর তো কিছু নেই। কয়েকটা দিন কাটান আমাদের সঙ্গে, ভালো না লাগলে চলে যাবেন।’

     ইভ কথাগুলো নিয়ে ভাবল। লোকটা হয়তো বেশি আশাবাদী। কিন্তু একটা কথা ঠিক, এতদিন পর্যন্ত যত লোকের সঙ্গে ইভের পরিচয় হয়েছে, তারা সবাই হয় বিশ্বাস করে যে কিছু না করলেই জীবন আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে। নয়তো তারা ভবিষ্যতের কথা ভাবা ছেড়ে দিয়েছে। এই দুই ধরনের লোকদেরই ইভ সহ্য করতে পারে না। কিছুদিন এদের সঙ্গে কাটিয়ে দেখা যেতে পারে।

     ‘ঠিক আছে। চলুন কোথায় নিয়ে যাবেন। আপনার নামটা বলুন।’

     ‘ধন্যবাদ। আমার মনে হয় না আমাদের ডেরা আপনার খারাপ লাগবে। আমার নাম অ্যাডাম লকিয়ার। আপনার নাম কী?’

 

*       *       *

ভবিষ্যতের কোনও সমাজতাত্ত্বিক সেখানে থাকলে বলতেন শেষ পর্যন্ত এভা যে সিদ্ধান্ত নিলো, তার পিছনে রয়েছে অন্য মানুষের সঙ্গ লাভের ইচ্ছা। মানুষ সামাজিক প্রাণী। কদিন এভা কারওর সঙ্গে কথা বলেনি, প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছিল। আগে কখনও দলের বাইরে একদিনও কাটায়নি। তাই বেরিয়ে এল গুহা থেকে।

     পাহাড়ের অন্য দিকের লোকেরা এভাকে দেখে চমকে উঠেছিল, ভয়ও পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যখন দেখল যে ও একা, তখন তারা একটু শান্ত হল। এভা অনেক কষ্টে  বোঝাতে পারল ওরা যে পথে যাচ্ছে, সে পথে বিপদ। শীতদানব সাদা চাদর সেজে ক্রমশই এগিয়ে আসছে।

     অনেকে ওর কথা বিশ্বাস করেনি, ভেবেছে এভা হয়তো ওদেরকে নিজেদের জঙ্গলে যেতে দিতে চায় না। কিন্তু এভার কথার সমর্থকও অনেক ছিল। তারা প্রথম থেকেই এদিকে আসতে চায়নি। তাদের চাপাচাপিতেই শেষ পর্যন্ত গোটা দলটা আবার পিছন দিকে ফিরল।

     সকাল থেকে বরফ পড়েই চলেছে। জায়গায় জায়গায় এমন বরফ জমা হয়েছে যে আর একদিন দেরি হলেই পেরোনো যেত না। এভা বুঝতে পারছে যে ওর নিজের দলের কাউকে ও আর কোনওদিন দেখতে পাবে না। একবার যদি এই দলটা এভাদের উপত্যকায় পৌঁছে যেত, তাদেরও আর ফেরার কোনও পথ থাকত না।

     অদম বলে একটা ছেলে এভার সঙ্গে কথা বলছিল। অদমরা যেখানে শিকার করে, সেখানটাও বরফে ঢেকে যাচ্ছে। হরিণ, বাইসন, শুয়োর, খরগোশ— কিছুই প্রায় নেই। সবাইকে আধপেটা খেয়ে থাকতে হচ্ছে। তাই ওরা ঠিক করে অন্য কোথাও চলে যাবে। কিন্তু কোনদিকে যাবে বুঝতে পারেনি। শেষপর্যন্ত দুটো বুড়ো বলল যে অনেক অনেক চাঁদ আগে জোয়ান বয়সে তারা বাইসনদের পিছনে পিছনে পাহাড় পেরিয়েছিল। দেখেছিল যে পাহাড়ের ওপারের জঙ্গলে শিকার অনেক সহজে মেলে। অন্যদিকে গেলে শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের ধারে পৌঁছে যাবে। সেখানে হরিণ, বাইসন কিছুই নেই। তাদের কথায় বাকিরাও পাহাড় পেরিয়ে জঙ্গলে যাচ্ছিল। এখন এভার কথায় ওরা মত পাল্টেছে। সবাই সমুদ্রের দিকেই চলেছে।

     সমুদ্র কী এভা জানে না। সে অদমকে জিজ্ঞাসা করল, ‘সমুদ্রে হরিণ পাওয়া যায় না?’                                                                          

Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সৌরভ দে

2 thoughts on “পুনরাগমনায় চ

  • October 11, 2019 at 3:28 am
    Permalink

    খুব সুন্দর লাগলো!!

    Reply
    • October 13, 2019 at 9:37 am
      Permalink

      ধন্যবাদ

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!