ভূষণ্ডী কাগের নক্‌শা

  • লেখক: সুমিত বর্ধন
  • শিল্পী: অদ্রীজা বর্ধন

এই নক্‌শাখানি কি অভিপ্রায়ে ইহা লিখিত হলো পাঠ করামাত্র পাঠক তা আপনা আপনি অনুভব কর্ত্তে সমর্থ হবেন। তবুও গোড়ায় খানিক গৌরচন্দ্রিকা কোরে লওয়া আবশ্যক। বাঙ্গালাদেশে এক সময়ে হরিচরণের বিষয় লয়ে যে ধন্ধের কুজ্ঝটিকা তৈয়ের হয়েছিলো আমি তাহা পরিহার করার চেষ্টাতে প্রবৃত্ত হই এবং ভূষণ্ডী কাগ নামের আড়ালে তাহার বিবরণ লিপিবদ্ধ কোর্ত্তে সচেষ্ট হই। কারণ সেই সময় দেকতে পাই সমাচার দর্পণ, সোমপ্রকাশ ও অমৃতবাজারের ইত্যাদি দিসি সম্বাদপত্রের দুর্জন দমন সম্পাদকগণ জেল বাঁচ্‌য়ে লেখার দায়ে কলমে কুলুপ এঁটেচেন এবং ইংলিস্‌ম্যান, ডেলিনুস ও হরকরার ন্যায় ইংরিজী কাগজও সেই রহস্য তরঙ্গের তিমির দূরীকরণের প্রচেষ্টা না কোরে মৌনব্রত অবলম্বন কোরেচে ও কেবল আলত-পালত সম্বাদে পাতা ভর্ত্তি কচ্চে। ইহার মদ্যে কেবল বঙ্গদর্শন কমলাকান্তের দুট -একটা কতা প্রকাশ করে বটে, কিন্তু সম্পাদকের উপর পুলিসের রক্তচক্ষু পড়াতে তাও বন্ধ হয়ে যায়। লোকমুকে শোনা যায়, খোদ মহামহিম গবরনর জেনারেল বাহাদুর আপিস থেকেই সরক্যুলর জারি হয় যেন হরিচরণকে লয়ে কোন সম্বাদপত্র খপর না করে।

     নেটিফ্‌রা ইংরাজের কাছে খাতির নদারৎ, এবং তাদের ‘ড্যাম নিগার’, ‘ইস্টুপিড’, ‘রাসকেল’ ইত্যাদি সুমিষ্ট বিভূষণে ভূষিত করতে তাঁহাদের বাধে না। তবে এ কতাও সত্য যে মিউটিনির পর হতে তাঁহারাও তটস্থ থাকেন পাছে ইয়ংবেঙ্গলিদের “ন্যাসানাল” প্রবৃত্তিটি ফের কোনো প্রকারে জেগে ওঠে। বিশেষ যখন এই নকশা লিখিবার কালে সরকার বাহাদুর মঙ্গলের বাসিন্দাদের লয়ে অম্নিই বিষম বিভ্রাটে ছিলেন। কিন্তু তা হলেও এসময়ে তাঁহাদের অ্যাত বাড়াবাড়িতেই মনে সন্ধ জাগায়ে তোলে। হরিচরণ দলবল লয়ে চানকের ফৌজী বারুদখানায় কেবল অ্যাকবার ডাকাতি করে বৈ তো নয়। এর আগেও সহরে নানা প্রকারের লুটদরাজ মায় দু চার নিমগোচের দাঙ্গা পর্জ্জন্ত হয়ে গ্যাচে কিন্তু এরূপ আদালতের শমন সফিনের ভয় দেখ্‌য়ে সম্বাদপত্রকে শিক্‌লী পরানোটা সেই নীলের হ্যাঙ্গামের পর থেকে আর নজর হয়নে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া, এসময়ে এও কানাঘুষ শুন্তে পাই যে লেপটেনান্ট গবরনর ও কমাণ্ডারনচিপ দুজনেই ঘনঘন গবরনর জেনারেলের মিটিঙ এটেণ্ড কর্চ্ছেন এবং তাঁদের হুকুমে সহর হতে রেজিমেন্টকে রেজিমেন্ট গোরা, গান আর বোট নানা দিকে যাত্রা কচ্চে। তাহার ওপোরে হরিচরণের দলে কারা ছিল সেই লয়েও নানা গুজোব রটে। কেউ বলে তারা সব মিউটিনির ডিজার্মড্‌ সেপাই, বদলা লতে হরিচরণের সাতে ভিড়েচে, কেউ বলে তারা ফেমিনে ঘড়ছাড়া বেহার প্রদেসের রাইয়ত, পেটের দায়ে ডাকাতের দলে নাম লিখয়্‌চে। অ্যামন কতাও শোনা গ্যালো হরিচরণ নাকি দানো জাগানো বিদ্যে রপ্ত করেচে, তার দলে যারা ছিল তারা কেউ মানুষ নয়, তারা কতা কয় না, ক্যামন দুলকি চালে হ্যাচকা মেরে হাঁটে। চানকের সেপাইদের তলোয়ারের মারে তাদের রক্তও ঝরেনি, তারা কেউ টুঁ শব্দটি পর্জ্জন্ত করেনি।

     যাহোক যথামত গৌরচন্দ্রিকা গাওয়া হয়েচে, এখন কাযের কতাগুলো পাড়া যাক। ইস্কুলবয় থেকে বুড়ো মিনসে অবদি যখন এই প্রলয় হুজুকে নিজেদের মতামত জাহির কচ্চে, তখন আমার মনে হলো প্রকৃত সত্যটা একবার অনুসন্ধান করে এবার রিপোর্টারের কর্তব্যটা নির্বাহ করি। এ বিষয়ে কমলাকান্তই যা দু-এক কতা লিকেছিল, তাই স্থির কল্লুম প্রথমে তার কাচেই তত্ত্ব লওয়া যাক। কিন্তু বঙ্গদর্শনের দপ্তরে গিয়ে তার দ্যাকা পেলুম না। একজন বুড়ো কম্পোজিটর চস্‌মা চোকে হরপ বসাচ্ছিল, তার কাচে জানতে পাল্লুম কমলাকান্ত তার পোষা ভালুকের জ্বরের ওজর দিয়ে দিনকতোক আগে আপিস হতে নিরুদ্দেশ হয়ে গ্যাচে।

     ভালুকের জ্বরজারি আসাটা মোটে আশ্চয্যির নয়, কিন্তু কমলাকান্তের ন্যায় বেওয়ারেষ লোক এই বয়সে একটা ভালুককে পুষ্যি লয়চে সেটিও বিশ্বাস কোর্ত্তে মন চাইল না। বোধ হল কমলাকান্ত পুলিসের হ্যাঙ্গামের ভয়ে গা-ঢাকা দিয়েচে। মনে কল্লুম তার বাসায় গে একবার দেকা করি, কিন্তু আমার অনেক অনুনয়ে বিনয়ে কম্পোজিটরের মন বিগলিত হলো না, কমলাকান্তের বাড়ির ঠিকনাটি তার মুক দে বের কোর্ত্তে পাল্লুম না।

     কমলাকান্তের আফিনের নেসাটির কতা অন্যান্যদের ন্যায় আমারও জানা ছিল, সুতরাং সিদ্ধান্ত কল্লেম বাগবাজারের গুলিখোর গাঁজাখোরদের আড্ডায় গে তার সন্ধান কোর্ব্ব। পরের দিন গুপুস করে দশটার তোপ পড়তে না পড়তে বাগবাজার হাজির হয়ে আফিনের দোকানে২ আর গুলির আড্‌ডায়২ কমলাকান্তের সন্ধান কল্লুম, কিন্তু কোতাও তাকে পাওয়া গ্যালো না। লাভের মদ্যে কেবল কোতাও গেঁজেলদের তামাসা, কোতাও ঠোনাটা ঠানাটা জুট্‌লো। ক্রমে বেলা বেড়ে উঠ্‌লো, সূর্য্যের উত্তাপে মাতা পুড়ে যাচ্চে মনে হলো, অলিগলিতে টহল দে নিতান্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে ভাবচি এবার বাগবাজারের ঘাটে গে মাতা ভিজিয়ে আসবো কিনা, খাদিশুরে ‘ও মোসাই শুনচেন?’ বলে কেউ ডাক পাড়লো। তাকিয়ে দেকি একজন ইয়ার গোচের বামুন, গলায় পইতের গোচ্ছা, দাঁতে মিশি, পরণে চেটালো কালা পেড়ে ধুতি। চোক দুট লাল টক্‌ টক্‌ করচে, যেন এই সবে কোনো গুলির আড্ডা হতে নিষ্ক্রান্ত হয়েচে।

     মনে মনে ভাবচি এ আবার কোন আফতের আমদানী হলো, বামুন ফিক্‌ করে হেসে “কমলাকান্তকে চাই? তো চিৎপুর গ্যালেই তো হয়!” বলে একটা গলি দে কোতায় সট্‌কে পড়লো।

     সাতপাঁচ ভেবে রপ্টে রপ্টে চিৎপুর রোড এসে উপস্থিত হলেম। ব্যস্ত রাস্তা কেরাঞ্চি, ব্রাউহ্যাম, বগী ইত্যাদি রকমওয়ারি গাড়িতে জোতা ঘোড়ার পায়ের টাপেতে কেপে কেপে উঠচে। পথ লোকে লোকারণ্য, তর বেতর পোষাকে নানান লোক আপন খেয়ালে ছুটচে। পাগড়ি মাতায় শিপ সরকার, হাতে সোণার তাগা আর সোণার হার গলায় মালের আড়দ্দার, ধূপছায়া চেলীর যোড় পরণে ব্রাহ্মণ অধ্যাপক, কপালে পেল্লায় রক্তচন্দনের টিপ আর সাদা ফিনফিনে ধুতি পরিহিত উকীল সাহেবের হেডকেরাণী, সালের সামলা ও চাপকান পরা হাইকোর্টের প্লীডার, এলবার্ট ফেসানে চুলে ফেরানো কালেজের ছোকরা, তকমাওয়ালা দরোয়ান, হরকরা, কেও বাকি নেই। কিন্তু এদের মধ্যে কমলাকান্তকে দেক্‌তে পেলুম না। ক্রমে ক্রমে চিৎপুরের এমুড় ওমুড় চসে ফেল্লুম, যোড়াসাঁক, নতুন বাজার, আহিরিটোলা, বটতলা ও সণাগাছির গলিও বাকি রাখ্‌লুম না। হাঁটাহাঁটাই সার হলো, কমলাকান্ত কোতাও নজরে পড়লো না।

     দেখ্‌তে দেখতে সন্ধে ঘনিয়ে এলো। কাঁশোর ঘন্টার শব্দ কানে এলো, পথের আলো জ্বালা হলো, দোকানীরাও একে একে ঝাপ্তাড়া ফেলতে লাগ্‌লো। পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে একটা দেওয়ালগিরি জ্বলা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবচি আজকের মত রিপোর্টারি কর্ম সস্পেণ্ড কোরে বাড়ি ফিরে চাট্টি চিঁড়ে-মুড়ির যোগান্‌ দেকব কিনা, এই প্রলয় গর্ম্মিতেও গায়ে চাদর জড়ানো অ্যাক ফিলজফার গোচের ছোকরা দোকানের খদ্দেরের ভিড় হতে বার হয়ে আমার দিকে মুচকে হাসি হেসে খানিক চোক নাড়ানাড়ি কল্লে। ছোকরার মতলবটা কি আমি তা ঠাউর কোর্ত্তে চেস্‌টা কচ্চি, অ্যামোন সময় সে আমার কাচ বাগে সরে এসে বল্ল, “কমলাকান্তকে তল্লাস কচ্চ? তার খপর হেতায় পাবে ভেবেচ?”

     আমি— তবে আর কোতায় পাওয়া যাবে? আর তুমিই বা কে হে, গায়ে পড়ে ফপর দালালি কচ্চ?

     ছোকরা— আমি কে সে কতা যাক। তবে কমলাকান্তের সন্ধান এই স্থানে পাবে।

     এই বোলে আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দে ছোকরা ধাঁ কোরে ভিড়ের মদ্যে মিসে গ্যাল। রাস্তার আলোয় চিরকুটটা ধরে নে দেখলুম তাতে একটা ঠিকানা লেকা আচে।

     ছোকরার দেওয়া ঠিকানা খুঁজতে২ ক্রমে শভাবাজারে একটা গলির মুকে একটা বাড়ির সামনে এসে সামনে এসে পল্লুম। দেখলেম ফটকের সাম্নে দাঁড়িয়ে হামদো চেহারার অ্যাকজন সেপাই নিজামের নাতির মত গোঁফে চাড়া দে হেঁটে বেড়াচ্চে। তাকে দেখে কিঞ্চিৎ মুস্‌ড়ে পল্লুম। বুজলুম এ কোন বড়মান্‌ষের বাড়ি, শেসে কমলাকান্তের সন্ধান লতে গে কপালে গালিগুফ্‌তা না জোটে। কিন্তু ভয়ে ভয়ে তার কাচে কমলাকান্তের নাম কোর্ত্তেই তার তোয়াজ দ্যাকে কে, বলে “আইয়ে মহারাজ হুজুর বোলায়া। রাস্তা এধার হে মহারাজ।”

     সেপাইয়ের পেচন২ একটি কক্ষে উপস্থিত হলুম। ঘরে চার ডেলে দেওয়ালগিরি জ্বলচে, মেঝেয় ফরাসের ওপর মির্জাপুরি গালচে পাতা। ঘরের মদ্যে অ্যাক কালোয়াত লক্ষ্ণৌ ঢঙে চুড়িদার পাজামা, জরির কারচোপের কর্ম্ম করা কাবা আর মাতায় টুপি পরে ঠুংরী গাচ্চেন। তার পাসে বসে অ্যাকটি তবলজী এবং অ্যাকটি বাজন্দার যথাক্রমে তবলা ও সারেঙ্গা লয়ে গানের সহিত তাল-দোরস্ত সংগত কচ্চে। ঠুংরীর বোলওয়াট, সারেঙ্গার কোঁয়া কোঁয়া আর তবলার তেটে নাগে সব্দে ঘরখানা পরিপূর্ণ হয়ে রয়েচে। তবে চাদ্দিকে নজর করেও কমলাকান্তকে কোতাও দেখতে পেলুম না। সুদুমুদু সময় নষ্ট না কোরে এখান হতে বিদায় লব কিনা ভাবচি, কালোয়াতটি আমাকে ইশেরা কোরে বোসতে বল্লেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলুম ঘরের একমাত্র প্রবেশদ্বারটি আগলে ফটকের সেপাইটি জোমদূতের মত দাঁড়িয়ে আচে। কি করি, পড়েচি মগলের হাতে খানা খেতে হবে সাতে এবম্বিধ ভাবতে২ ফরাসের ওপর বোসে পল্লুম।

     খানিক বাদে গানের পালা সাঙ্গ হলো। তবলজী আর বাজন্দার তাদের তোবড়া-তুবড়ি লয়ে বাড়ির ভিতড় কোতাও অন্তর্ধান কল্ল। সেপাইটিও বাইরে থেকে দ্বার বন্ধ কোরে দে সরে পড়লো।

     সেলামালকী সেরে কালোয়াত বল্লেন “আমি লক্ষ্ণৌ’র ওস্তাদ এহ্‌সান বক্স। আপনি কমলাকান্তের সন্ধান কচ্চেন?”

     ভূ— হ্যাঁ। কিন্তু মহাশয় কি মর্ম্মে তাহার সহিত পরিচিত আচেন?

     ওস্তাদ— কমলাকান্ত আমার গাণ্ডা বান্‌ধ সাগির্দ। আমি সহরে এলে আমাকে সে সেলাম পেস করে যায়।

     গাঁজা, গুলি, আফিন, কমলকান্তের ইত্যাদি বাচা বাচা সদ্‌গুণের সাতে আমার বিলক্ষণ পরিচিতি ছিলো। কিন্তু তার মত নেসার টেক্কা যে সে সব বাদে লক্ষ্ণৌর কালোয়াতের কাচে নাড়া বেঁদে সংগীত সিক্ষাও কোরেচে, এ কতাটি মনে ধল্ল না। তার উপর ওস্তাদের চেহারাটিও ক্যামন পূর্বপরিচিত ঠেকল, বোধ হলো আগে কোতাও দেকেচি।

     ভূ— কমলাকান্ত কি এই বাটিতে উপস্থিত আচে?

     ওস্তাদ— না সে হেথায় নাই। কিন্তু তার সংগে আপনার কি প্রয়োজন?

     ভূ— হরিচরণকে লয়ে সম্বাদ প্রকাসের কড়াকড়িতে আমার কৌতূহল উজ্জীবিত হয়েচে। সেই বিষয়ে কমলান্তকে দুট একটা কতা জিজ্ঞাসা কোর্ত্তাম।

     ওস্তাদ— কমলাকান্ত রাজরোষ এড়াতে গা ঢাকা দিয়েচে। তবে হরিচরণকে লয়ে সরকার বাহাদুরের এই কড়াকড়ির পশ্চাতে আচে দেসের বর্তমান পলেটিকশ।

     ভূ— কি রকম মহাশয়?

     ওস্তাদ— আপনি নিশ্চয় মঙ্গলের বাসিন্দেদের সম্বাদ অবগত আচেন?

     মিউটিনির কয়েক বৎসর পরেই মঙ্গলম্যানরা ভূতলে এসে উপস্থিত হয়। বস্তুতঃ আগে লোকের মঙ্গলের দসা হলে স্বস্তয়নে তাবিজে মাদুলিতে কাজ লত। কিন্তু মঙ্গলের পেয়াদারা যে বর্গীর ন্যায় আসমান হতে মর্তে নাজিল হয়ে জ্যোতিষার্ণবদের অন্ন মারবে আর যুদ্ধে ইংরাজদের ওটসার কিস্তি দেবে এ কতা আগে কেও ভাবেনি।

     ভূ— অল্প-সল্প জানি। শুনতে পাই তাদের সঙ্গে ইংরাজদের এক নিমগোচের সন্ধি হয়। মিটমাটের পশ্চাতে ইংরাজ বেহারের এক অংশ তাদের ছেড়ে দ্যায়।

     ওস্তাদ— ইহা সত্য বটে, তবে ইহার অগ্রে ও পশ্চাতের ঘটনা আপনি কি জানেন?

     ভূ— না ইহা ব্যতীত আমি আর কিছু জানি না।

     ওস্তাদ— ওসকল ঘটনা না জান্‌লে হরিচরণের ব্যাপার-স্যাপার বোজা মুস্‌কিল।

     ভূ— তাহা হইলে মহাশয় আপনি যাহা জানেন শীঘ্র বলিতে আজ্ঞা হউক।

     ওস্তাদ— মিউটিনির কিছুকাল পশ্চাৎ মঙ্গল গ্রহ হইতে নিক্ষেপ করা একটি বৃহদাকার গোলা বিলাতে বকিং সহরের নিকটস্থ পল্লীতে এসে পড়ে। গোলার ভিতর দু চার মঙ্গলম্যান ঘাপটি মেরে ছিল, গোলা থেকে বের হয়ে ইংরাজ ফৌজকে কচুকাটা করে ফ্যালে।

     ভূ— ইহা কি প্রকারে সম্ভব? প্রবলপ্রতাপাণ্বিত ইংরাজের ফৌজকে খাস বিলাতে দু চার মঙ্গলের বাসিন্দে মিলে গোবেড়েন দিল এ কতায় ভরোসা কোর্ত্তে পারচি না।

     ওস্তাদ (মুচকি হাসিয়া)— ইংরাজের সহিত আসান্টাদিগের লড়াইটে যেমন বন্দুক বনাম ক্যাঁচার দ্বন্দ্ব ছিল, ইহাও সেই প্রকার।

     ভূ— মহাশয় বুজতে পাল্লুম না।

     ওস্তাদ— মঙ্গলম্যানরা একপ্রকার তোপ ব্যবহার করে। তাহা হতে গোলা বার হয় না, কেবল একপ্রকারের সবুজ বর্ণ অগ্নিশিখা নিষ্ক্রান্ত হয়। সেই আগুনের হল্কা কিছুর ওপর পড়লেই তাকে তৎক্ষণাৎ ভস্ম কোরে দ্যায়। এর বিপরীতে ইংরাজদের বন্দুক আর তোপ কাবু হয়ে পড়ে।

     ভূ— ইংরাজরা তাহা হলে যুদ্ধে ফতেহ্‌ পেলো কি প্রকারে?

     ওস্তাদ— দৈবযোগে। লড়াইয়ের মাজে মঙ্গলম্যানরা যে গোলাটিতে চড়ে এসেছিল সেটি হটাৎ গুড়ুম কোরে উড়ে গে সবকটি মঙ্গলম্যান আর অনেক ইংরাজ সেপাই একযোগে অক্কা পায়।

     ভূ— একটি গোলাতেই এই বিপদ। পরের পর মঙ্গলম্যান পোরা গোলা এসে পড়লে আর দেকতে হতো না।

     ওস্তাদ— সেটি ইংরাজরাও বুজেছিল। বিলাতের পণ্ডিতরা দূরবীনে চোক রেকে মঙ্গলের গায়ে কিছু দাগ দেখে অনুমান করেন সেথায় পৃথিবীর উদ্দেশ্যে ছোঁড়ার উপযুক্ত বৃহৎ তোপ প্রস্তূত হচ্চে। এইটি দ্যাখার পর ইংরাজরা মারকিন দেসে সম্বাদ পাঠান।

     ভূ— মারকিন দেস ক্যানো?

     ওস্তাদ— মারকিন দেসের বল্টিমর প্রদেসে ইম্পি বর্বিকেন নামে এক মারকিনি চাঁদে মানুষ পাঠাবে বোলে একটা বৃহদাকার তোপ তৈয়ার কচ্চিলো। তার গোলায় মানুসের বদলে বারুদ পোরে মঙ্গলের উদ্দেস্যে দাগা হয়।

     ভূ— তাহা মঙ্গলের তোপসকল নষ্ট করতে সফল হয় কি?

     ওস্তাদ— হ্যাঁ। মঙ্গলের প্রায় সকল তোপই ইম্পি বর্বিকেনের তোপের গোলার আঘাতে বিনষ্ট হয়। কেবল একটি বেঁচে যায়। সেটির গোলা বিলাতের পরিবর্তে ভারতবর্ষে এসে পড়ে।

     ভূ— মহাশয়, ভারতবর্ষে মঙ্গলম্যানের আবির্ভাবের ইতিহাস জান্তে পাল্লুম। কিন্তু এ সকলের সহিত হরিচরণের কি সম্পর্ক?

     ওস্তাদ— হরিচরণের বিষয় বুজতে গেলে আপনাকে মূল কাটামোটা আগে ধত্তে হবে। ক্যানো আজকাল ফৌজদারী আইনের জোরে ম্যাজিস্ট্রেটরা হাতে মাতা কাটা হুকুম জারী কচ্চেন, ক্যানো লঘু দোষে মানুসের গুরু দণ্ড হোচ্চে, দায়মালী জেল ক্যানো আসামীতে উপচে পড়চে, এইটি জান্তে হবে।

     ভূ— আচ্ছা মহাশয়। বলতে আজ্ঞা হউক।

     ওস্তাদ— মঙ্গলম্যানদের চেহারা কিরূপ তাহা আপনি অবগত আচেন কি?

     আমি— অনেককাল পূর্ব্বে একটি বহিতে অ্যাকখানি চিত্র দেকেছিলুম বটে। একটা তেপায়ার ওপর য্যানো অ্যাকটা ওলটানো হাঁড়ি বসানো।

     ওস্তাদ— ওটি মঙ্গলম্যানদের স্বরূপ নহে। ওটি অ্যাক প্রকারের যান। মানুস যেরূপ রেলওয়ের বাষ্পপোতে চড়ে দেশান্তরে ভ্রমণ করে, মঙ্গলম্যানেরাও তাহাদের যানে কোরে গতায়াত করে। ওলটানো হাঁড়িটাতে মঙ্গলম্যানরা বোসে থাকে। তেপায়ার অ্যাক-অ্যাকটা পা কম করে দুট তালগাচ প্রমাণ লম্বা। রণ-পা’র মত নদী-নালা-পগার-জাঙাল বেতখলিপে টপকে যায়। এ সওয়ায় যানটিতে দুখান কলের হাত আচে, মঙ্গলম্যানরা তা দে তাদের আগুনে তোপ ধোরে লড়াই করে।

     ভূ— তবে মঙ্গলম্যানদের চেহারা কিরূপ।

     ওস্তাদ এহ্‌সান বক্স তাঁর কাবার ভিতর হতে এক্‌খান ছবি বার করে আমার হাতে দে বল্লেন “ইংরাজ রাজত্বে মঙ্গলম্যানদের তসবির্‌ ছাপা নিষিদ্ধ। এইটি আমি বহুকস্‌টে যোগাড় করেচি। এইটি একটুকু মন দে নজর করুন।”

     ছবিটি দেকে গাটা ক্যামন গুল্‌য়ে উঠলো। মঙ্গলম্যানের দেহটি একটি মাল ঠাসা পোঁটলা গোচের। পোঁটলার সাম্নে দুটি ভাঁটার ন্যায় চক্ষু আর একটি তোপের ছ্যাঁদার ন্যায় মুক বসানো। শরীরে হাত-পা নাই, কেবল মুকের চারপাসে কেঁচোর ন্যায় সাত-আট কিলবিলে শুঁড় রয়েচে।

     ভূ— মহাশয় ইহাদের হস্ত পদ নাই ক্যানো? ইহার কর্ম্ম কি প্রকারে করে?

     ওস্তাদ— মঙ্গলম্যানরা সকলেই যন্ত্রবিদ। ইহারা সকল কর্ম্মই কলের দ্বারা কোরে থাকে। বিনা ব্যবহারে ব্যাঙাচির যেরূপ ন্যাজ খসে যায়, ইহাদেরও সেরূপ হাত-পা খসে গ্যাচে। কেবল মাতাটি অবশিষ্ট আচে। মাতাটি মানুষের মাতা অপেক্ষা আকারে বড় বোলে মঙ্গলম্যানরা মাতার কাজে অধিক দড়। মানুষের চে তাদের বুদ্ধিসুদ্দি অনেক বেসি।

     ছবির দিকে হাঁ কোরে তাকিয়ে ভাবচি পরমেশ্বর কি বিচিত্র জীব না সৃষ্টি কোরেচেন, এম্নি সময়ে “মহারাজ, জরা পান ফর্‌মাইয়ে” বোলে ফটকের সেপাইটি এসে অ্যাকটা পানের খিলি বাড়িয়ে ধল্লে। পান মুকে দিতেই ক্যামন বুদ্ধিটে চাগিয়ে উঠল। আমি এহসান বক্সকে প্রশ্ন কল্লুম “কিন্তু উদর? মহাশয় ইহাদের উদর নাই ক্যানো? উদর ব্যতীত ইহারা খাদ্য হজম করে কি প্রকারে? আর খাদ্য হজম না কোর্ত্তে পাল্লে, ইহারা শরীর ধারণই বা করে কি প্রকারে?”

     ওস্তাদ (মুচকি হাসিয়া)— আপনি এক্ষণে সঠিক প্রশ্ন কোরেচেন। কিন্তু ইহার উত্তর দিবার পূর্ব্বে আমি আপনাকে একটা কতা জিজ্ঞাসা কোর্ত্তে চাই। প্রাণীসকলের উদর শরীরধারণে কি প্রকারে সহায়তা করিয়া থাকে?

     আমার হটাৎ ক্যামন ঘুম পেয়ে গ্যালো, চোক দুট ভারী হয়ে এল, বেস কস্‌টো করে বল্লুম “খাদ্যের সারভাব হতে উদর রক্ত প্রস্তূত করে। রক্তে প্রানীগণ জীবনধারণ করে”

     ওস্তাদ— যথার্থ বোলেচেন। এর পেচনেই রহস্য লুকিয়ে আচে। মঙ্গলম্যানদের উদর নাই। তারা অন্যের রক্তে জীবিত থাকে।

     ঘুমে আর চোক খুলে রাক্তে পাল্লুন না। মাতাটা বুকের উপর ঝুঁকে পল্ল। তার মদ্যেই শুন্তে পেলুম এহ্‌সান বক্স বোলচেন “এই যে বাৎসাই আমোলের ন্যায় কতায় কতায় লোক্‌কে সাজা দে জেলে পোরা হোচ্চে এর পেচনে ভয়ানক একটা অবিচার চলচে। হরিচরণ তার প্রতিকার কোর্ত্তেই কাযে নেমেচে। কেবল লুটদরাজ কিম্বা হঙ্গাম হুজ্জৎ করাটা তার উদ্দেস্য নয়। ”

     আর জেগে থাক্তে পাল্লুম না, ফরাসের ওপোর ইষ্টিকবৎ লম্বমান হয়ে ঘুমিয়ে পল্লুম।

     চোক খুলতে দেখলেম ঘরের দোর খোলা, সকালের আলো ফুটে গ্যাচে। কাগগুলো সব কটুস্বরে কা কা কচ্চে। আমি খালি ভূঁয়ের ওপর শুয়ে আচি, ফরাস গালচে সব বেপাত্তা। উঠে কাপড়খানা ঝেড়েঝুড়ে বাটির এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে দুট আর্সুলা মাকুসা ব্যতীত কিছু দেকতে পেলুম না। বুজলুম এটি এমটি হাউস। হেতায় সেলরদের দালালরা বিশেষ প্রয়োজনে লয়ে আসে। অন্য সময় বাড়ি ফাঁকা থাকে।

     বাইরে ফটকে আগের রাতের সেপাইটিও নজোরে পড়লো না। কেবল ফটকের গোড়ায় পাতর চাপা দেওয়া একটা কাগজের ফালি বাতাসে ফরফর কচ্চে। কাগজখানা তুলে নে দেখলেম লাল কালিতে লেকা আচে “আজ দুকুরে আর্ম্মানী ঘাট।”

     ক্যামন ভোঁ লেগে গ্যালো। আগের দিন থেকে কি ঘটচে তার মাথামুণ্ডু বোজতে না পেরে আকাসের দিকে হাঁ কোরে তাকিয়ে রইলুম। অ্যাকবার ভাবলেম অনেক রিপোর্টারি হলো, এবার বাড়ি গে নেয়ে খেয়ে ঘুমোইগে। শেসে প্রাণ লয়ে না টানাটানি হয়। আবার রহস্যের নিষ্পত্তি করতে চেয়ে মনটাও ক্যামন কোর্ত্তে লাগ্‌লো। শেসে নিষ্পত্তি কল্লুম জা হয় হোক আর্ম্মানী ঘাটে অ্যাকবার গে দেকব।

     কিন্তু দুকুর হতে তখনো বেস দেরি। ঠিক কল্লুম আর্ম্মানী ঘাটের যাওয়ার পুর্ব্বে অ্যাকবার গরাণহাটায় বসন্তকের সাতে দ্যাকা করে আসবো, যদি তার কাচে হরিচরণের বিষয়ে আরো কিচু খপর থাকে।

     সম্বাদপত্রের ওপোর কড়াকড়ি হওয়া ইস্তক বসন্তকের হাতে সেরূপ কর্ম্ম নাই। সে বাটির দোরগোড়ায় বস্যে মুসারির ছারপোকা মাত্তে ব্যস্ত ছিল, আমার চেহারাখানা নজরে পোড়তে প্রফুল্ল বদনে আমাকে অভ্যর্থনা কল্ল।

     বস— এস এস ভূষণ্ডী। সব কুশল তো? হেতায় কি মনে কোরে?

     ভূ— হরিচরণের বিষয়ে তোমার কাছ হতে দুট একটা কতা জানতে চাই।

     বস (এদিক সেদিক তাকাইয়া)— তোমার কি ভয়ডর নাই? এই বিষয়ে খচাখুচি না কল্লেই মঙ্গল। এর মদ্যে সেঁদোতে গে কি শেসে কোমরে বেড়ি পরবে?

     ভূ— তোমার ভয় নাই। আমি ইদানীং যা২ হচ্চে সে বিষয়ে কিচু জান্তে চাহি না। হরিচরণের পূর্বজীবনের কতক ইনফারমেসন চাই কেবল।

     বস (দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করিয়া )— বলো কি জান্তে চাও।

     ভূ— শুনেচি হরিচরণ যেতা কর্ম্ম কোর্ত্তো সেতা চুরি করে ফেরার হয়। কিন্তু তার পূর্ব্বাপর ইতিহাস কিচু জানা নেই।

     বস— হরিচরণের পিতার নাম কালীচরণ। কালীচরণ শৈশবে অনাথ হয়। পল্লীস্থ সহৃদয় ব্যক্তিগণ তাহাকে ডেবিড হেয়র সায়েবের ইস্কুলে দাখিল করে দ্যায়। কিন্তু কালীচরণের লেকাপড়ায় বিশেস মতি ছিল না। বইয়ের পড়া তার কাছে ড্রজরী লাগতো। অনাথ বালক কি কোরে আপনার অন্নসংস্থান করবে এই চিন্তা কোরে তাকে হেয়র সায়েব ঘড়ির কাযে শিক্ষা দ্যান। সাবালক হলে কালীচরণ একটি ঘড়ির দোকান দ্যায়।

     ভূ (আশ্চর্য্য হইয়া)— কালীচরণের ঘড়ির দোকানের কতা জানি। ঘড়ি রিপেয়র কোর্ত্তে তার সহরে জুড়ি ছিল না। কিন্তু সে হরিচরণের পিতা তাহা জান্তুম না। তবে বহুকাল আগে দেনার দায়ে গেরেপ্তার হয়ে সে দায়মালী জেল চালান যায় এটুক সুনেচি।

     বস— সেটিও একটি রহস্য। কালীচরণের দোকানের পসার যখন বেস জমে উঠেচে সহরের একজন নামকরা বড়মানুসের দালাল এসে তার কাচে দোকানের আট আনার অংশীদারি কিনতে চায়। কালীচরণ তাকে গলাধাক্কা দে বিদেয় দ্যায়।

     ভূ— সেটি মোটে বুদ্ধিমানের কায হয় নে।

     বস— সত্য বলেচ। ইহার কয়েক দিবস পরেই কালীচরণের দোকানে রেতের ব্যালা চোর পড়ে, রিপেয়র হতে আসা সোনার গার্ড চেন সুদ্দু মেকাবী হন্টিং এবং আরো কতকগুলান ঘড়ি চোরে লয়ে যায়। খরিদ্দারের ঘড়ি কিম্বা ঘড়ির মূল্য দিতে অপারগ হলে কালীচরণের বিচার হয়। আদালাত তাকে দায়মালী জেল চালান দ্যায়।

     ভূ— আর হরিচরণ?

     বস— হরিচরণের মাতা তাহার শৈশবেই পরলোক গমন করে। কালীচরণ দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করে নাই। সে অ্যাকাই সস্নেহে পুত্রটিকে প্রতিপালন করে। দুই বাপ-ব্যাটায় যেরূপ ভালবাসা ছিল সেরূপ এযুগে বিরল।

     ভূ— তাহা হলে কালীচরণের জেল হতে হরিচরণ মনে বড় দাগা পেয়ে থাকবে অবস্যই?

     বস— বিলক্ষণ। সে আর বোলতে। পুয়র বেচারা সবে ঘড়ি রিপেয়রিঙে হাত মক্‌সো কচ্ছিল, এম্নি সময়ে এই বিপত্তি। বাপকে পুলিস জেলে ধরে নে গেলে হরিচরণ দিনকতোক নাওয়া খাওয়া ভুলে পাগোলের মত এদি সেদিক ঘুরে ব্যাড়ালো। তারপর বসত-বাটি দোকান ইত্যাদি বেচে দে কোতায় চলে গ্যালো।

     ভূ— কোতায় গেসল সে ব্যাপারে কিছু জানা আচে?

     বস— না সে কতা হরিচরন কারোর কাছে প্রকাস করে নাই। তবে ফিরে এসে সে আর ঘড়ির ব্যবসায় শুরু করার কোনরূপ প্রয়াস না করে এক বড়মানুষের নিকট চাকুরি লয়।

     ভূ— এ কতা শুনেচি। বাদুড়বাগানের যজ্ঞেশ্বর মিত্তির, পিস গুট্টের দালাল। বিস্তর রোজগার।

     বস— পিস গুট্টের দালালী, নিমকির দেওয়ানী, তেজারতি, দু চার বড় বড় হৌসের মুৎসুদ্ধীর কর্ম ইত্যাদি থেকে যজ্ঞেশ্বর মিত্তিরের আগেও বিলক্ষণ দশটাকা রোজগার ছিল। কিন্তু বৎসর কয়েক হলো অন্য কোন একটি ব্যবসায়ে তাহার আঙুল ফুলে কলাগাচ হয়ে গ্যাচে।

     ভূ— কিসের ব্যবসা?

     বস (মুচকি হাসিয়া)— সেটাই তো রহস্য। সে কতা কারোর জানা নেই।

     ভূ— যাহা হউক। ইহা ব্যতীত কি জানো বলে ফ্যালো।

     বস— যজ্ঞেশ্বর মিত্তিরের চাকরি লয়ে হরিচরণ অল্পদিনের মদ্যেই নিজ হেকমৎ আর হুনুরীতে তার দক্ষিণ হস্তস্বরূপ হয়ে উঠল। এইরূপে কিছুকাল অতিবাহিত হবার পর হটাৎ অ্যাকদিন শোনা গ্যালো হরিচরণ নাকি তার সিন্দুক ভেঙে গহনা আর নকদ হাতিয়ে সরে পড়েচে।

     ভূ— ইহার পর হরিচরণের কোন সম্বাদ পাওয়া যায় নাই?

     বস— না। ইহার পর যা কিচু হোয়েচে তাহা তুমি অবগত আচো। কিন্তু তাহা লয়ে আমি কিচু বলতে চাই নে।

     ইহার পর অনেক সেদেও বসন্তকের মুকের কুলুপ খোলাতে পাল্লুম না। এদিকে দুকুরও হয়ে আসচে দেখে তার সাতে আর কতা না বাড়িয়ে আর্ম্মানী ঘাটের পথ ধল্লুম।

     পাঠক, আর্ম্মানী ঘাটের বিষয়ে আপনি সবিশেস অবগত আছেন। ইদানীং এই ঘাটের যেরূপ জলজলাট অবস্থা পূর্ব্বে তদ্রূপ ছিল না। কিন্তু গঙ্গার অপর পাড়ে ইআর রেলওয়ের এস্টেসন হওয়া অবদি এই ঘাটে সর্বদাই লোক গিসগিস করে। বিশেস রেলওয়ের ফেরি ঘাটে লাগিবার কালে লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে।

     দুকুরবেলা আর্ম্মানী ঘাটে হাজির হয়ে দেখলেম খাতায় খাতায় লোক দাঁড়িয়ে আচে, মাজ গঙ্গায় রেলওয়ে ইস্টীম ফেরী দ্যাকা যাচ্চে। চারপাসে তাকালুম কিন্তু সন্ধজনক ত্যামন কিছু দেকতে পেলুম না। ঘাটের একপাসে অ্যাকজন পশ্চিমি খোট্টা গায়ে রামজামা আর মাতায় সাপুড়ের পেটারির ন্যায় হেঁড়ে পাগড়ি মাতায় দাঁড়িয়ে। মানুস প্রমাণ বিলিতী পোসাক পরা চার পাঁচ কাটের পুতুল তার পাসে দাঁড় করানো। হয়ত রেলে কোরে কোতাও লয়ে যাবে বলে নে এসেচে। ঘাটে বাঁধা একটা গহনার নৌকার মাজিরা যাত্রীদের ডাকাডাকি কচ্চে। তার কাচে কন্ঠী আর চৈতন চুটকি সুশোভিত দুই বোস্‌টম নিজেদের মদ্যে ঝকড়া কচ্চে। ঘাটের হেতায় সেতায় রেলওয়ের চাপরাশীরা বেত হাতে নিরীহ ভদ্রসন্তানদের ওপোর ক্যার্দ্দানি দেকাচ্চে।

     টুনুন্টাং টুনুন্টাং আওয়াজে ঘন্টা বেজে উঠলো। হুইলের ঝপ ঝপ শব্দ করে ইস্টীমার ঘাটে এসে থামলো। রল্লা কোরে লোকে স্টীমারে চড়তে লাগ্‌লো। তারই মদ্যে একখানা বজরা এসে ঘাটে লাগ্‌লো। বজরা থেকে লেঠিয়াল সেপাই পরিবৃত হয়ে গুলদার উড়ুনি আর শান্তিপুরি ধুতি পরণে অ্যাকজন নেমে এল। তাদের পেচনে আরো দুজন একটা কাটের সিন্দুক ধরাধরি করে বজরা হতে নামালো। বুজলুম কোন জমিদারের খাজনা এসেচে। ঘাট হতে সোজা তেরজুরি নে যাবে।

     ফের টুনুন্টাং টুনুন্টাং কোরে ঘন্টা বেজে উঠল। ইস্টীমার ঘাট ছাড়ার তোড়জোড় কোর্ত্তে লাগ্‌লো। খাজনার পেয়াদারা সিন্দুক লয়ে ‘খবর্দার খবর্দার’ হাঁকতে হাঁকতে সিঁড়ি দে উঠচে এম্নি সময় ক্যামোন ধুন্দুমার বেঁধে গ্যালো। বোস্‌টম দুট নিজেদের তকরার ভুলে গে জে দুট লোক সিন্দুক বইছিল তাদের নিকট হতে সিন্দুকটা কেড়ে লয়ে গহনার নৌকটার দিকে দৌড়ুতে লাগ্‌লো। এদিকে পাগড়ি মাতায় খোট্টা ছুটে এসে উড়ুনি গায়ে লোকটাকে অ্যামন ধাক্কা দিলো যে সে তফরা খেয়ে জলের ভিতরে গে পোড়লো।

     দেপাইরা হো হো করে কেউ খাপ থেকে তলোয়ার খালাস কচ্চে, কেউ লাটি তুলে ধরেচে, হটাৎ দেকি ঘাটে দাঁড়ান পুতুল কটার চোক ক্যামন সবুজ হয়ে জ্বলে উঠেচে। দেকতে দেকতে পুতুলগুলান টলে টলে সিঁড়ি দে নেমে এসে সেপাইদের ঘাড় ধোরে অ্যাক২ করে ছুঁড়ে ফেলতে লাগ্‌লো। সেপাইদের লাটির মার কি তলোয়ারের কোপে তাদের মোটেও চোট লাগ্‌লো মনে হলো না।

     লোকের হুটোপাটি, ‘ডাকাত ডাকাত’ আর ‘ধল্লেরে মেলেরে’ ইত্যাদি সোর সরাবতের মদ্যেই পাগড়ি মাতায় খোট্টা, দুই বোস্‌টম আর পুতুলগুলান বোটে উঠে পড়লো। বোটের দাঁড়িরা ঝপাঝপ দাঁড় টেনে বোট লয়ে চোকের বাইরে সরে পড়লো।

     আমি ঘাটের মাতায় হাঁ করে দাঁড়্‌য়ে ফ্যাসাদ দেকচি, হটাৎ আমার কানের গোড়ায় কে মুক নে এসে ফিসফিস করে বল্ল “আরে হেতায় আর থাকতে আচে? পুলিস এসে পল্লে সব্বাইকে ধরে নে যাবে জে।”

     তাকিয়ে দেকি আগের দিন দ্যাকা চিৎপুরের সেই ফিলজফার গোচের ছোকরা। আমি কিচু বলার পূর্ব্বেই সে আমায় টানতে২ নে এসে রাস্তায় দাঁড়ানো একখানা নিমখাসা রকমের ছক্কড়ে একপ্রকার ঠেলেঠুলে উঠ্‌য়ে দিলো। ঘরঘরিয়ে গাড়ি ছুট দিলো।

     গাড়ির মদ্যে বোসে বুকটা ঢিবঢিব কোর্ত্তে লাগ্‌লো। রিপোর্টারি কোর্ত্তে গে শেসে হরিণবাড়ী না যেতে হয়। গাড়ির খড়খড়েগুলো টানা, কোতায় যাচ্চি সে বোজার উপায় নাই। গাড়ি থামায়ে নেমে পোড়ব সে সাহসও হচ্চে না পাছে পুলিসে পাকড়াও করে। অগত্যা গাড়ির বাতের বেদনা নিবারণ ঝাঁকুনি সজ্জ কোরে মুক বুজে বোসে রইলুম।

     অনেকটা পথ দৌড়ে তবে গে গাড়ি থামলো। বুকের ধুকধুকনি সামলে নেমে দেখলেম আইরীটলা ঘাটের কাচে এসে পড়েচি। মনে মনে ভাবচি রিপোর্টারি কর্ম্মে জলাঞ্জলি দে এবার যঃ পলয়ায়তি স জীবতি অবলম্বন পূর্ব্বক ফোরফাদর গিপ্টেড প্রাণটা প্রিজর্ভ করার চেস্‌টা কোরবো কিনা, এম্নি সময় দেকি ঘাটে লাগানো অ্যাকটা পিনেসের মাজি ‘কত্তা কত্তা’ বোলে আমায় হাত নেড়্যে ডাকচে

     রিপোর্টারি কৌতূহল সামলাতে পাল্লুম না। পায়ে পায়ে পিনেসের কাচে গে জিজ্ঞাসা কল্লুম “কি হে ডাকাডাকি কোচ্চ ক্যানো?”

     মাজি— উটে পড়েন কত্তা। বাবু আপনারে নে যেতে বোলেচেন

     ভূ— কোন বাবুর কতা বোলচ?

     মাজি— কমলাকান্ত বাবু। যারে আপনি খোঁজচেন।

     রিপোর্টারি পোস্টপন কোরে সরে পড়ার চিন্তা মুলতবী রেখে কপাল ঠুকে নৌকয় উঠে পল্লুম। মাজিরা নৌকো ছেড়ে দিলো।

     উজানে চলে নৌকো ক্রমে বাগবাজারের পোল, কাসীপুরের ঘাট পার হয়ে রাশমনীর নবরত্ন মন্দিরের কাচে এসে পড়লো। তার উলট দিকে নদীর অপর পাড়ে এক আঘাটায় মাজিরা পিনেস ভেড়াল।

     নৌক থেকে নেমে দেখলেম একটা নাবাল ন্যাড়া জমি। জোয়ারে ডুবে ছিল বোলে কাদা প্যাচ প্যাচ কচ্চে। তার এক কোনে একটা বটগাচ বেরোনো পোড়ো বাড়ি দাঁড়িয়ে আচে।

     কাদা মাট টপকে বাড়িটাতে গে দেকতে পেলুম বাড়ীখানির অবস্থা ভাল নয়। বালিকাম খসে পড়েছে, দু-একটা কড়ি আড়িয়েল ঘোড়ার ন্যায় ঝুঁকে রয়েছে। কিন্তু ভিতরের একটা ঘরে দিব্য ধবো ফরাস পাতা। আর তার ওপোর গড়গড়ার নল হাতে নে তাকিয়া হেলান দে কমলাকান্ত বর্দ্ধমানের মহারাজার ন্যায় বোসে আচে। তার চেহারা দেকে বোধ হল তামাক ছাড়াও তার আরো কিচু স্টিমুলন্টের সেবা নসীব হয়েচে , মেজাজ অ্যাকেবারে আলী হোয়ে আচে।

     আমায় দেকে কমলকান্ত বল্ল, “এস এস ভূষণ্ডী। শুনতে পাই তুমি সহর চসে আমায় তলাস কচ্চ?”

     ভূ— হ্যাঁ। তবে তোমায় খুঁজতে গে জে হয়রানিটে হলো তার কতা সুনেচ কি? এখানে ঘাপ্টি মেরে কি কচ্চ বলোতো?

     কম— কি করি পুলিসের গেরেপ্তারী এড়াতে গা ঢাকা দিতে হলো। তবে হেতায় ব্যাবস্থা মন্দ নয়। আফিনের অভাব নাই, মাজে মদ্যে শেরিটে শাম্পিনটেও পাওয়া যায়। তা আমায় কি প্রয়োজনে তলাস কচ্চিলে বলো।

     ভূ— আর ক্যানো। হরিচরণকে লয়ে সরকার বাহাদুরের অ্যাত কড়াকড়ি ক্যানো সেটি বুজতে চাইছিলুম। এই রিপোর্টারি কর্ম্ম নির্ব্বাহ কোর্ত্তে গে কি ফেসাদে পল্লুম দ্যাকো। শেসে পুলিস হতে আমার নামেও না ওয়ারিন জারী হয়।

     কম— আরে ভয় পাও ক্যানো? তোমার বিষয়ে কেউ জানে না। হরিচরণের কতা কি জান্তে চাও বোলে ফ্যালো।

     ভূ— হরিচরণ কি তন্ত্রে সিদ্দি লাভ কোরেচে? না হোলে পুতুলকে জেন্ত কোরে মারপিট করায় কি প্রকারে? আর এবম্প্রকার হাঙ্গামা-হুজ্জৎ সে করাচ্চে ক্যানো?

     জবাব না দে চোক মুদে কমলাকান্ত তামাক টানতে লাগ্‌লো। আলবোলার খুড়খুড় শব্দ আর অম্বুরি তামাকের খোসবে ঘরটা পরিপূর্ণ হোয়ে উঠল। এই প্রকারে কিয়ৎক্ষণ অতিক্রান্ত হোলে আমি বিরক্ত উঠে বল্লুম “ঘুময়ে পড়লে নাকি?”

     মুক হতে নলটা সর্‌য়ে কমলাকান্ত বল্ল “কোতা হতে শুরু করি তাই ভাবছিলুম। যাক হরিচরণের পূর্ব্ববৃত্তান্ত তুমি হয়ত অবগত আচো। তার পিতার একটি ক্লাক রিপেয়রিং সপ ছিলো। ”

     ভূ— হ্যা বসন্তকের নিকট তাহা শুনেচি। যজ্ঞেশ্বর মিত্তিরের ঘরে চুরি করে সে গাঢাকা দ্যায় সে কতাও জানি। কিন্তু তাহার পরের বৃত্তান্তসকল অবগত নই।

     কম— বেস। যজ্ঞেশ্বর মিত্তির যে বর্তমানে প্রভূত ধনার্জ্জন করচে তার পেচনে একটা ভয়ানক সত্য আচে। মঙ্গলম্যানদের উদরের রহস্য তুমি শুনে লয়েচ।

     ভূ (আশ্চর্য হইয়া)— সে কতা তুমি জানলে কি প্রকারে?

     কম (মুচকি হাসিয়া)— আমার কাচে সে খপর আচে। যাহা হউক বাকিটুক শুন।

     ভূ— হ্যাঁ শীঘ্র বলো।

     কম— মঙ্গলম্যানরা আহার করে না। তারা অন্য প্রাণীর রক্ত শোষণ করে জীবন ধারণ করে। মনুষ্যেতর জীবের রক্তে তাদের চলে যায় বটে তবে মনুষ্যশোণিত তাদের অধিক প্রিয়।

     ভূ (আতঙ্কিত হইয়া)— বলো কি! মঙ্গলম্যানরা তো দেকচি সাক্ষাৎ রাক্ষসের ন্যায়।

     কম— হ্যাঁ একপ্রকার সেইরূপই বোলতে পারো। ইংরেজরা আর তাহাদের মদ্যে তলে তলে একটি গোপন অণ্ডরস্টণ্ডিং হয়।

     ভূ— সেটি কি?

     কম— তাহারা ইংরাজদের কোনপ্রকার আক্রমণ কোরবে না। ইহার পরিবর্তে ইংরাজরা তাদের আহারের জন্য মানুস যোগান দিবে।

     ভূ— কি ভয়ানক! এ তো মহাভারতের বকরাক্ষসের মতো শনাচ্চে।

     কম— তা বটে। তবে বকরাক্ষসের গল্পের পেচনেও যে কোন মঙ্গলম্যানের সত্য লুকিয়ে নেই কে বোলতে পারে।

     ভূ— কিন্তু ইংরাজরা মঙ্গলম্যানদের মানুস যোগান দিবে কি প্রকারে? পথ হোতে কাওকে পাকড়াও করে নে গে তো আর মঙ্গলম্যানদের হাতে তোলে দেওয়া জায় না!

     কম— ইংরাজদের সেটিই সমস্যা হোয়ে দাঁড়ালো। কোম্পানীর আমোলে বিস্তর সুবিদে ছিলো। শ্যামচাঁদে কিম্বা গুমি গেরেপ্তারিতে দিব্য কায হয়ে যেত। কিন্তু প্রোক্লেমেসনের পর হতে দেসে মহরানীর শাসন কায়েম হয়েচে। বর্তমানে কাযে না হোলেও অন্তত কতাতে আইনের মান রাকতে হয়। এই উভয়সঙ্কট হতে পরিত্রাণ পেতে ইংরাজরা তাই বুদ্ধি খাটিয়ে যজ্ঞেশ্বর মিত্তিরকে নিযুক্ত কল্ল।

     ভূ— কোন কর্ম্মে নিযুক্ত কল্ল? মানুস ধোরে আনার?

     কম— না দায়মালী জেলের ফাটকদারের কর্ম্মে।

     ভূ— ফাটকদার। তাহা কি রূপ কর্ম্ম?

     কম— দায়মালী জেল চালানোর দায় যজ্ঞেশ্বর মিত্তিরের। ইংরাজরা খোরচ দ্যায় কেবল।

     ভূ— ক্যানো?

     কম— যজ্ঞেশ্বর মিত্তির জেলের ফাটকদার। জেল হতে মাজেমদ্যে যদি দুট একটা কয়েদী উধাও হোয়ে যায় তাহলে দায় বর্তায় যজ্ঞেশ্বর মিত্তিরের ওপোর। ইংরাজরা তাকে ধমক ধামক দে শাসন কোরে দায় সার্ত্তে পারেন। তেনাদের হাত পরিষ্কার ধোবোধোবো থাকে। পরিবর্তে যজ্ঞেশ্বর মিত্তির সরকারে খোরচের দুনো হিসাব দাখিল করে।

     ভূ— তাহা হলে ইংরাজরা চক্ষু মুদে থাকে?

     কম— যজ্ঞেশ্বর মিত্তির মঙ্গলম্যানদের আহারের সপ্লইটি যথাযথ বজায় রাকলে ইংরাজরা আর চক্ষু খোলার প্রয়োজন দ্যাকে না।

     ভূ— আর হরিচরণ? হরিচরণের সাতে এ সকল বিষয়ের সম্পর্ক কি?

     কম— কালীচরণকে জেলে নে যাওয়ার পর হরিচরণ দোকান বেচে টাকাপয়সা লয়ে দায়মালী জেলের কাচে গে উপস্থিত হয়। তার আশা জেলের পেয়াদাদের ঘুসঘাস দে বাপকে ছাড়ায়ে লয়। কিন্তু সেতায় গে হরিচরণ জান্তে পাল্লো কালীচরণ মঙ্গলম্যানদের খানা হয়ে চালান গ্যাচে। সে আর ফিরবে না।

     ভূ— বুজলুম। বদলা লতে এরপর হরিচরণ যজ্ঞেশ্বর মিত্তিরের নিকট চাকুরি লয় এবং সুজোগ বুজে তার সিন্দুক ভেঙে টাকাকড়ি লয়ে সরে পড়ে।

     কম (মুচকি হাসিয়া)— বিষয়টি অ্যাতটা সহজ নয়। ইংরাজ আর মঙ্গলম্যানের পলেটিকশে যজ্ঞেশ্বর মিত্তির শতরঞ্চের বোড়ে মাত্তর। তার টাকা মাল্লে গায়ের জ্বালা মিটতে পারে বটে কিন্তু দেসের মানুস যে ঘোর সমস্যায় পোড়েচে তার সমাধান হবে না।

     ভূ— তাহলে যজ্ঞেশ্বর মিত্তিরের বাড়িতে চুরির অর্থ কি?

     কম— সেটা তোমাকে হরিচরণের কাচ হতে জান্তে হবে। জে পিনেসে এলে সেটিতে ফের উঠে পড়ো। তোমাকে হরিচরণের নিকট নে যাবে।

     কমলাকান্ত চোক মুদে পুনরায় গড়গড়ার নলে মুক দিলো। বুজুলুম তার কাচ দে আর কোন কতা আদায় করা যাবে না। অতএব মাটের কাদা ভেঙে ফের গঙ্গাপাড়ের পিনেসে যে উটলাম।

     পিনেসে চড়ে ফের বুকটা ঢিবঢিব কোরে উঠল। দেকলুম দুকুরে আর্ম্মানী ঘাটে দ্যাকা বোস্‌টম দুট পিনেসের এক পাসে বোসে রয়েচে। কিন্তু তাদের হাঁটুর ওপোর তোড়াদার বন্দুক রাকা আর গলায় জপমালার থোলের বদলে তোষদান বাঁধা। কতা না কোয়ে ভালমানষের মতো গুড়িশুড়ি মের‍্যে বোটের একদিকে বোসে পল্লুম।

     সন্ধ্যে হোয়ে এসেচে। গঙ্গার অপর পার হোতে রাশমণির মন্দিরের শাঁক ঘন্টার শব্দ ভেসে আসচে। তার মদ্যে ঝপঝপ দাঁড় ফেলে মাজিরা উজানে নৌকো ছুটিয়ে নে চল্ল।

     ক্রমে রাত বেড়ে এলো। আকাস মেঘে ঢাকা। অন্ধকারে কোতায় চলেছি ঠাওর হয় না। কেবল একবার চন্দ্রমা সদয় হয়ে উঁকি দিলেন। তার পাণ্ডুর আলোয় মনে হোল ফরাসডাঙার কাচে কোতাও এসে পোড়েচি।

     ধীরে ধীরে মাজিরা গঙ্গার পশ্চিম কূলে পিনেস লাগালো। কোতাও আলো নাই, পাড়ের কাচে বড় গাচের জঙ্গলের ন্যায় হয়ে আচে। মানুসের সাড়া নাই, মিস কালো অন্ধকারে কেবল উচিঙ্গার ঝিরঝির ও শৃগালের হুয়া হুয়া রব শোনা যাচ্চে। তারই মদ্যে বোস্‌টম দুট বন্দুক ঘাড়ে টপ কোরে নেমে পোড়লো। উপায়ন্তর না দেকে আমিও তাদের পেচন পেচন চল্লুম।

     জঙ্গলের ভিতর অন্ধকার গাঢ়ো হয়ে আচে, চোকে কিচু দেকতে পাওয়া দায়। তবু কোন প্রকারে হাতড়ে হাতড়ে কিচুটা এগতে গাচপালার ফাঁকে সামান্য আলোককিরণ দেকতে পেলুম। আলো লক্ষ্য করে আরো কিছুটা গে খানিকটা খালি জমি দেকতে পেলুম, তার মধ্যস্থলে একটি দ্বিতল গৃহ দাঁড়িয়ে আচে। গৃহদ্বার হতে নিষ্ক্রান্ত আলোয় চতুর্পার্শ্ব আলোকিত হয়ে আচে।

     বোস্‌টমদ্বয়ের পশ্চাৎ গৃহে পদার্পন কল্লুম। ভিতরে একটি বৃহৎ কক্ষ, চার ডেলে দেওয়ালগিরিতে আলোকিত হোয়ে আচে। ঘরের একপাশের দ্যালে ঠেস দে ঢাল বল্লম টাংগি তলোয়ার মাস্কট এবম্বিধ নানা প্রকার হাতিয়ার জড়ো করা। আর তার পাসে আর্ম্মানী ঘাটে দ্যাকা পুতুলের মত আট-দস পুতুল সারগেতে দাঁড় করানো আচে। গলাটা ক্যামোন শুখিয়ে গ্যালো, বুকের কোলজেটাও ধুকপুক কোর্ত্তে লাগ্‌লো। বুজলুম অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না কোরে অ্যাকেবারে লয়ন্স ডেনে মাথা দে ফেলেচি।

     তবে ঘরের অন্যদিকে চেয়ে অ্যাকেবারে আশ্চর্য্য হয়ে গেলুম। সেতায় ফরাসের ওপোরে আর্ম্মানী ঘাটে দ্যাকা সেই হেঁড়ে পাগড়ি মাতায় খোট্টা আর ওস্তাদ এহসান বক্স তাকিয়ায় ঠ্যাস দে বসে।

     অবাক হোয়ে বল্লুম “ওস্তাদ এহসান বক্স। আপনি হেতায় কি করে?”

     “এহ্‌সান বক্স বলতে পারেন আবার হরিচরণও বলতে পারেন।” বলে এহ্‌সান বক্স পাসে রাখা একটা চাদর আর চসমা পোরে ফেলে, টুপি নামিয়ে চুলটা হাত দে ফিরয়ে দিলেন। আমি হতভোম্বা হয়ে দেকতে পেলুম এহ্‌সান বক্স কোতায়, ফরাসের ওপর চিৎপুরের সেই ফিলজফার ছোকরা বোসে আচে।

     হাঁ কোরে হরিচরণের দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে থেকে বল্লুম “তুমিই কালেজের ছোকরা আর লক্ষ্ণৌয়ের ওস্তাদের পোসাকে আমাকে বেওকুফ বানিয়ে রাখছেলে?”

     হরিচরণ (মুচকি হাসিয়া)— হ্যাঁ । আর বাগবাজের জে গেঁজেল বামুন আপনাকে চিৎপুর যেতে বলে সেও আমি। আপনি পুলিসের চর কিনা তা বাজিয়ে লয়ে তবে শভাবাজারের এমটি হাউসে আপনাকে পাঠাই।

     ভূ— ইংরাজের পুলিস আদাড়েবাদাড়ে তোমার তল্লাস কচ্চে আর তুমি তাদের চোকে ধূলো দে তাদের নাকের ডগায় বারংবার বেস পাল্টে ঘুরে বেড়াচ্চ এ বড়ো অদ্ভূত কতা। কিন্তু যাহা হউক তোমার উদ্দেস্যটি কি তাহা আমায় খোলসা কোরে বোলবে কি?

     হরি— উদ্দেস্য আর কি! দেসের মানুসকে জালিম জুলুমের হাত হতে রক্ষা করা।

     ভূ— বুজলুম। মহৎ উদ্দেস্য সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহা কি প্রকারে সাধিত হবে তাহা জান্তে পারি কি?

     হরি— আমার পূর্বকথা আপনি এতক্ষণে অবগত আচেন।

     ভূ— হ্যাঁ কিছু কতা শুনেচি বটে। কিন্তু তুমি যজ্ঞেশ্বরের সিন্দুক ভাংলে ক্যানো আর এইসব পুতুল ক্যামোন করে চলেফিরে ব্যাড়ায় সে বিষয়ে অ্যাখোনো কিচু বুজে উঠতে পারি নি।

     হরি— আমি দায়মালী জেলে গে জান্তে পাল্লুম আমার বাবাকে কালীঘাটের পাঁটার ন্যায় মঙ্গলম্যানদের কাচে ভেট দেওয়া হোয়েচে। এই সম্বাদ পেয়ে অ্যাকেবারে মুসড়ে পল্লুম। দিন কতক বাদে মাতাটা কিচুটা ঠাণ্ডা হতে খুব রাগ হলো। মনে কল্লুম এর বদলা লতে হবে।

     ভূ— শোকে তুমি মেন্টলি ডিস্টর্বড হোয়ে পোড়েছিলে সন্ধ নাই। না হলে যেথায় সেপাইরা তোপ বন্দুক লয়ে ইংরাজের সাথে এঁটে উঠতে পাল্লে না সেথায় তুমি একা তাদের সাথে টক্কর দেবে এটি মাতায় আসার কতা নয়।

     হরি— যথার্থ বোলেচেন। একদিন এই কতাই ভাবতে২ একটা গাঁয়ের মদ্যে দে যাচ্চি দেকতে পেলুম এক বাজিকর একটা গাচতলায় পুতুল নাচ দ্যাকাচ্ছে। পুতুলের হাতে পায়ে সুতো বাঁদা। সুতো টানলে পুতুল হাত পা নাড়চে। এইটি দ্যাকার পর ঝাঁ কোরে একটা কতা স্মরণ হলো।

     ভূ— কি কতা?

     হরি— আমার পিতা কালীচরণের ঘড়ি বিষয়ক নানা প্রকার জিনিস সংগ্রহ করা অব্যেস ছিলো। জাহাজী সেলররা মাজে মদ্যে তাঁর কাচে এসে ঘড়ির যন্ত্র, বহি, পুস্তকাদি বিক্রয় কোরে জেত। আমার মনে পোড়ে গ্যালো বেস কয়েক বৎসর আগে এক আদবুড় ফরাশিস সেলর তাঁকে পীর জাক্যিদো’র স্বহস্তে লিখিত একখানি নোট বহি বিক্রয় করে। পিতার বহি দস্তাবেজ সমস্ত বাটিতে রক্ষিত ছিলো। দোকান বিক্রয় কল্লেও তাহা হাতাছাড়া করি নাই। সত্বর গৃহে ফিরে গে তার মদ্যে থেকে পীর জাক্যিদো’র নোটবহিখানা উদ্ধার কল্লুম।

     ভূ— আরে রোসো রোসো। মাতামুণ্ডু কিচ্ছু বুজতে পাল্লুম না। পীর জাক্যিদো কে? ইনি কোতাকার পীর? তাহার নোট বহি লয়েই বা তোমার কি উবগার হলো?

     হরি— পীর জাক্যিদো ইয়োরোপের এক অদ্ভূতকর্ম্মা ক্লাক মেকর। শত বৎসর পূর্ব্বে তিনি ইয়োরোপের রাজন্যবর্গের জন্য ঘড়িকলে চলা পুতুল তৈয়ার কোর্ত্তেন। তাঁর তৌরি পুতুল নানা প্রকারের ক্যারামতি দ্যাকাতে পার্ত্তো। কোনটি গাইত, কোনটি বাজাত আবার কোনটি বা কলম দে কাগোজে লিক্‌তো।

     ভূ— এরূপ পুতুলের কতা কস্মিনকালেও শুনি নাই। কিন্তু এই পীরের নোট বহি এক নগণ্য সেলরের হাতে গে পড়লো কি প্রকারে?

     হরি— সেলর বোলেছিল তার এক পূর্বপুরুষ পীর জাক্যিদোর গৃহে ভৃত্যের কর্ম্ম কোর্ত্ত। পীর জাক্যিদোর নিকট হতে সে নোট বহিটি পুরস্কার রূপে প্রাপ্ত হয়। তবে ইহা বিশ্বাস কোর্ত্তে মন সায় দ্যায় না। হতে পারে ভৃত্যটি এটি চুরি কোরেছিলো।

     ভূ— যাহা হউক। ইহার পর কি হলো কি তাহা বলো।

     হরি— আমি মনে২ একটি ধারণা কোরেছিলুম। পুতুলকে দে যদি গান বাজনা করানো জায় তাহা হোলে তাদের দে লড়াই করাতে বাধা কোতায়? এইরূপ ভেবে ইংরাজের নজর হতে দূর ফরাসডাঙায় একটা বাসা লয়ে এই পুতুল তৈয়ার কোর্ত্তে লাগলুম।

     ভূ— তৈয়ার কোর্ত্তে পাল্লে?

     হরি— হ্যাঁ। পুতুল তৈয়ার হলো বটে তবে একটা মুস্কিল দ্যাকা দিলো। দম দিলে পুতুল কাজ করে বটে তবে দম ফুরিয়ে গ্যালে আর নোড়তে পারে না। বুজলুম পুতুলকে দে লড়াই করাতে গ্যালে দমের ভরসা কল্লে চলবে না।

     ভূ— হ্যাঁ বাস্তবিক ইহা সমস্যার কতা বটে। কিন্তু তুমি ইহার সমাধান কল্লে কি প্রকারে?

হরিচরণ পাসে বসা পাগড়ি মাতায় পশ্চিমার দিকে চেয়ে বল্ল “ভাগ্যক্রমে এই সঙ্গীটি জুটে গ্যালো। এর সাহাজ্যে সমস্যার হাল কোর্ত্তে পাল্লুম।”

     ভূ— ইনি কে?

     হরি— এর নাম গণপত রাও। মিউটিনির সময়ে গণপত ঢুণ্ঢুপান্তি নানার ফৌজে তোপদারের কার্যে বহাল ছিল। কানপুর পতনের পর নানার সহিত সেও নেপালে গা ঢাকা দ্যায়।

     ভূ— শুনেচি নানা নেপালেই দেহ রাকেন।

     হরি— হ্যাঁ। নানার মৃত্যুর পর গণপত বেস কিছুকাল নেপালেই অতিবাহিত করে। তারপর মিউটিনির হ্যাঙ্গাম জুড়োতে আরো দু চার সাথী লয়ে দেসে ফিরে এসে ফরাসডাঙায় আশ্রয় লয়। এ সকল কতা আগে জান্তুম না, সখ্যতা হলে গণপত ধীরে ধীরে এ সমস্ত আমার কাচে প্রকাশ করে।

     ভূ— গণপত রাও হতে তোমার কি উপকার হলো শীঘ্র বলো।

     হরি— গণপত নেপাল হতে দেসে আসবার কালে বেহার প্রদেসে মঙ্গলম্যানদের প্রায় মুকে গে পড়ে। অনেক কস্‌টে গাচপালার পেচনে লুকোয়ে সে আর তার সাথীরা প্রাণ রক্ষা করে। এই সময়ে সে মঙ্গলম্যানদের কাচ থেকে দ্যাখার সুজগ পায়। গণপতের কাচ হতে একটি আশ্চর্য্য কতা জান্তে পারি। এইটি শোনার পর বুজতে পারি ইহা হতেই আমার পুতুলকে সচল রাকার মুস্কিল আসান হ’তে পারে।

     ভূ— তাহা কি? মঙ্গলম্যানদের ব্যবহৃত কোন যন্ত্র?

     হরি— আপনার অনুমান মিছা নহে। ইংরাজরা যেরূপ উত্তাপের সাহায্যে বাষ্প তৈয়ার কোরে তাহার শক্তিতে নানা কর্ম্ম নির্বাহ করে, মঙ্গলম্যানরাও সেরূপ হরিৎ আলোককে বলে পরিণত কোরে তাকে তাহাদের যন্ত্র, যান, তোপ ইত্যাদিতে নিযুক্ত কোরে থাকে। স্থির কল্লুম এই আলোকশক্তির সাইন্সের রহস্যটি মঙ্গলম্যানদের কাচ হতে কেড়ে লতে হবে।

     ভূ— এইবার বুজলুম। মঙ্গলম্যানদের সন্নিকটে পঁহুছিবার জন্য তুমি যজ্ঞেশ্বর মিত্তিরের চাকুরীটি স্বীকার কোরেছিলে।

     হরি (হাসিয়া)— হ্যাঁ যথার্থ বোলেছেন। যজ্ঞশ্বরকে মঙ্গলম্যানদের ইলাকায় কার্য্যোপলক্ষে জেতে হয়। এই প্রয়োজনে মঙ্গলম্যানরা তাহাকে একটা সংকেত মুদ্রা দে রেকেচে। এইটি দ্যাকালে তাহারা নিরাপদে তাহাদের নিকট জেতে দ্যায় কোনরূপ অনিস্টো করে না। যজ্ঞশ্বরের সিন্দুক ভেঙে প্রথম এইটি জোগাড় কল্লুম। তাহার পশ্চাৎ মঙ্গলম্যানদের ইলাকায় গে তাদের যন্ত্রের সাইন্সের গুপ্তরহস্য আয়ত্ত কল্লুম।

     ভূ— বুজলুম। তাহার পর মঙ্গলের সাইন্স প্রয়োগ কোরে তুমি তোমার পুতুলদের সচল কল্লে। আর আমি ভাবছিলুম তুমি মন্ত্র-তন্ত্রে সিদ্ধি লাভ কোরে কিম্বা স্পৃচুলিয়াস্টদের বিদ্যে হাসিল কোরে এই খেল দ্যাকাচ্চো। তবে অ্যাকটা বিষয় ভেবে ভেবে বুজতে পাচ্চি না। এই সব গোপন কতা আমার কাচে ফাঁস কল্লে ক্যানো?

     হরি— কারণ শুধুমাত্র তলোয়ার দ্বারা ফতেহ্‌ পাওয়া জায় না। লড়াই কোর্ত্তে গ্যালে কলমেরও প্রয়োজন হয়।

     ভূ— বুজতে পাল্লুম না।

     হরি— ইংরাজ মিউটিনির লড়াই কেবল তোপের বলে জেতে নাই। সম্বাদপত্র ও গ্রন্থপ্রণেতাগণও তাদের সংগে ছিলো। ইংরাজদের সাতে লড়ায়ে লিপ্ত হলে ইহারা পূর্ব্বের ন্যায় আমারদেরকে চোর বদমাইস বলে বিষোদ্গার কোরে দেসের লোককে আমাদের প্রতিপক্ষ কোরে তুলবে। আমি চাই আপনি আমাদের হয়ে কলম ধরুন।

     ভূ— খেপে উঠেচো? আমার কি মাতার ওপোর মাতা আচে? গবর্মেন্টের সমালোচনা কোর্ত্তে গে এম্নিতেই এর আগে দু চার মোছলেকা হোয়ে গ্যাচে। তোমাদের হয়ে কলম ধল্লে বেড়ি পড়া কেহ ঠ্যাকাতে পার্ব্বে না।

     হরি— এ কাযে বিপদের কতা অস্বীকার কোর্ব্ব না। বেড়ি পড়তে হোতে পারে, হয়ত ফাঁশীও জেতে হোতে পারে। কিন্তু তাহা হলেও দেসের মানুসের এনসাফের স্বার্থে আপনাকে এই কর্ম্মটি স্বীকার কোর্ত্তে হবে। মানুসকে ফ্রেটরনিটি, ইকোয়ালিটি ও ফ্রিডমের কতা শোনাতে হবে।

পাঠক। আপনি আমার সহিত অনেকদুর এসেচেন। এইবার আপনার কাচ হতে বিদায় লব। তবে তাহার পূর্ব্বে আরো কয়েকটি কতা বলার আচে। হরিচরণের অনুরোধ আমি উপেক্ষা কোর্ত্তে পারি নাই। আমি এবং কমলাকান্ত মিলিয়া একটি গুপ্ত সম্বাদপত্র সম্পাদনা কোরে দেসের মানুসকে সত্য জানানোর দায়িত্বটি স্কন্ধে তুলিয়া লই।

     পাঠক। আপনার কাচে এই নকশাখানি আসিবার দুটি অর্থ হতে পারে। হয়ত দেস হতে ইংরাজগণ বিতাড়িত ও মঙ্গলম্যানেরা পরাস্ত হয়েচে এবং এই নকশাটি ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসাবে মুদ্রিত হয়েচে। অথবা লড়ায়ে হেরে গে আমাদের প্রাণ গ্যাচে এবং কোনপ্রকারে নকশাটি আপনার হস্তগত হোয়েচে।

     তবে ফল যাহাই হোয়ে থাকুক, হার বা জিত যাহাই ঘটিয়া থাকুক, আমি, কমলাকান্ত, হরিচরণ, গণপত রাও এবং অন্য যাহারা একদা এক মহা অন্যায় দূরীকরণের প্রচেষ্টায় ঘোর বিপদ মাতায় লতে দ্বিধা করি নাই তাহাদের মঙ্গলকামনায় আপনি জগদীশ্বরের কাচে কিয়ৎকাল প্রার্থনা কোর্ব্বেন আপনার কাচে করপুটে এই অনুরোধ রহিল।

     কিমধিকমতি।

==========================================================

সংযোজন

১। শমন – summons

২। সফিনে – subpoena

৩। পীর জাক্যিদো – Pierre Jaquet-Droz (1721-1790)

৪। ঢুণ্ঢুপান্তি নানা – নানা সাহেব। অপর নাম ঢোন্ডু পন্থ।

৫। বসন্তক – উনবিংশ শতাব্দীতে প্রকাশিত ব্যঙ্গাত্মক পত্রিকা।

৬। এমটি হাউস – খালি বাড়ি।

৭। ইম্পি বর্বিকেন – জুল ভের্ন রচিত ‘ফ্রম আর্থ টু দ্য মুন’ দ্রষ্টব্য।

৮। ইংরাজের সহিত আসান্টাদিগের লড়াই – Anglo-Ashanti war।

৯। ‘মঙ্গল গ্রহ হইতে ….. বিলাতে বকিং সহরের নিকটস্থ পল্লীতে’ – এইচ.জি. ওয়েলস রচিত ‘ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস’ দ্রষ্টব্য

১০। তেরজুরী – ট্রেজারী

১১। হেকমৎ – কর্মকুশলতা

১২। হুনুর – কর্মদক্ষতা

১৩। এন্সাফ – ইন্সাফ, ন্যায়বিচার

১৪। ফরাশিস – ফরাসী

১৫। দায়মালী জেল – যাবজ্জীবন দণ্ডিত বন্দীদের কারাগার

১৬। আর্ম্মানী ঘাট – আর্মেনিয়ান ঘাট

১৭। শ্যামচাঁদ – চাবুক

১৮। সেলামালকী – সেলাম আলেয়কুমের অপভ্রংশ ; কুশলাদি বিনিময়

১৯। মেকাবী হন্টিং – McCabe hunting watch

২০। তফরা খেয়ে – ছিটকে গিয়ে

২১। ক্যাঁচা – বল্লম

২২। ডেবিড হেয়র – David Hare (1775- 1842)

২৩। নাজিল হয়ে – অবতরণ করে

২৪। তসবির – প্রতিকৃতি

২৫। মোছলেকা – মুচলেকা

Tags: অদ্রীজা বর্ধন, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সুমিত বর্ধন

18 thoughts on “ভূষণ্ডী কাগের নক্‌শা

  • October 3, 2019 at 1:23 pm
    Permalink

    গুরুদেব _/|\_ এবার একটা ফুলটুস স্ক্রিপ্ট হয়ে যাক – মুভির জন্যে|

    Reply
  • October 3, 2019 at 10:49 pm
    Permalink

    কী লিখেছেন সুমিতদা! আমি তো পড়তে-পড়তে হুতোমের কালেই চলে গেছিলাম।
    আপনি অতুলনীয়, এবং সর্বার্থে প্রণম্য। আর কিছু বলার নেই।

    Reply
    • October 4, 2019 at 1:27 am
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ ঋজু ! এই উনবিংশ শতাব্দীর সময়কালটা আমার কিছুটা fascinating লাগে , তাই তার পটভূমিকায় একটা গল্প লেখার
      চেষ্টা করে দেখলাম । ভাল লেগেছে জেনে এ ধরণের লেখার আগ্রহ বেড়ে গেল ।

      Reply
  • October 4, 2019 at 2:36 am
    Permalink

    মোস্ট ফ্যাসিনেটিং গদ্য ইদানীঙ কালে পড়া। হ্যাঁ হুতোমি বাংলা আমার খুব প্রিয় কিন্তু একটা গল্পের মধ্যে তাকে বুনতে পারার দক্ষতা, আর পদে পদে পাঠককে জড়িয়ে নেওয়া , উফ। জাস্ট হ্যাটস অফ।

    পেজে শেয়ার করেছি। জনে জনে শেয়ার করব।

    Reply
    • October 4, 2019 at 6:51 am
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ দিদি ! গল্পটা লেখা অবধি ভয়ে ভয়ে ছিলাম কেমন ভাবে সবাই এটাকে নেয় । আপনাদের উৎসাহ পেয়ে কি আনন্দ হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না , মনে হচ্ছে আমার পরিশ্রমটা সত্যিই সার্থক হয়েছে ।

      Reply
  • October 4, 2019 at 3:38 am
    Permalink

    এই ভাষায় এইরকম আঙ্গিকে কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখা যায়!!! এ কী পড়লাম! আমি বাকরুদ্ধ। লেখক আমার কুর্ণিশ জানবেন।

    Reply
  • October 4, 2019 at 7:52 am
    Permalink

    হুতোমি ভাষায় সেকালের কথা একালে লেখা, তাও আবার কল্পবিজ্ঞান ~ এ বোধহয় শুধু আপনার পক্ষেই সম্ভব সুমিতবাবু। ভূষণ্ডি কাগের নকশায় যেভাবে তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ ভারতের কাল্পনিক ইতিহাস, তা সত্যি ভেবে নিতেই মন চাইছে। জুলে ভের্ন এবং এইচ জি ওয়েলসের প্রতি যেভাবে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছেন তার জন্য আলাদা করে কুর্নিশ। ক্লকওয়ার্কের সাথে রে পাংকের মিশেলে এক অন্যরকম কলগোলামের সৃষ্টিও যুগান্তকারী। বাংলা রেট্রো কল্পবিজ্ঞানের আপনিই গুরুদেব।

    Reply
  • October 4, 2019 at 2:34 pm
    Permalink

    হুতোম এর ভাষায় যে কল্পবিজ্ঞান সম্ভব,এই লেখা পড়ার আগে তা অকল্পনীয় ছিল। অনবদ্য বললেও কম বলা হয়।

    Reply
  • October 5, 2019 at 3:37 am
    Permalink

    যে ভাষায় ও যে প্রেক্ষাপটে এই রুদ্ধশ্বাস কাহিনীটি আপনি বুনেছেন, সে জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। একটিই দুঃখ, বড় দ্রুত শেষ হয়ে গেল।

    আপনার কলমকে কুর্ণিশ, স্যার।

    Reply
  • October 5, 2019 at 6:38 am
    Permalink

    এ একটা নতুন সৃষ্টি, একেবারেই ইউনিক। বাংলা সাহিত্যে এ একটা মাইলস্টোন হয়ে রইল। কল্প-ইতিহাস বলে হয়ত একটা নতুন সাহিত্যের গোত্র তৈরি হল।

    Reply
  • October 5, 2019 at 8:21 am
    Permalink

    অসম্ভব সুন্দর। লেখাটা নিজেই একটা টাইম মেশিন

    Reply
  • October 5, 2019 at 1:00 pm
    Permalink

    এই রাত দুকুরে পোড়তে বসে ভাবনাখান এলো যে দেসের বর্ত্তমান পলেটিকশ যখন জেলেপাড়ার সং এর মতো আমোদ দিচ্ছে আর আমরাও চুল বা মনের ফেসানে এলবার্ট বা ওয়েলসি টেরি কেটে আপন খেয়ালে আপনিই মত্তো তখন গপ্পের এমন ব্রাউহামে সওয়ার করিয়ে আমাদের চালান কোর্ল্লেন সেই হুতোমকালে। এখন এই গেসবাতির মায়াঘোরের পর নিজের সোময়ের ডিহি কলকেতার আলো বরো ফেকাসে লেগে যায় কর্ত্তা। সেলাম নেবেন।।

    Reply
  • October 6, 2019 at 8:57 am
    Permalink

    ওঃ, দাদা একদম দুর্দান্ত। হার্ডকপি মুদ্রিত হলে জানাবেন সংগ্রহে রাখার ইচ্ছে আছে।

    Reply
  • October 6, 2019 at 9:04 am
    Permalink

    বেশ লাগলো। চালিয়ে যান স্যর। আশা করি এরকম আরো পড়তে পাবো

    Reply
  • October 7, 2019 at 3:11 am
    Permalink

    লেখাটি নিজেই একটা কালযাত্রীর ডাইরি। মঙ্গলম্যানের কথা না দেখতে পেলে এটাকে দিব্বি হুতুমের দ্বিতীয় অপ্রকাশিত নকশা বলে ছাপা যেত। বর্ধনবাবু যেভাবে প্রত্যাশার পারদ চড়িয়ে যাচ্ছেন ওনার প্রতি সৃষ্টিতে….

    Reply
  • October 8, 2019 at 12:02 am
    Permalink

    মুগ্ধ, বিস্মিত, অভিভূত! ভাবাই যায়না হুতুমের এই অপূর্ব ভাষায় এইরকম একটা দুর্ধর্ষ টানটান গল্প, তাও আবার কল্পবিজ্ঞানের, কেউ লিখতে পারে! সেই যুগের কলকাতা যেন সাদা-কালো-খয়েরী ভিন্টেজ ছবির মত চোখের সামনে ভেসে উঠল। মঙ্গলম্যানদের তো পরিস্কার ভিস্যুয়ালাইজ করতে পারলাম। এত ভালো লেখা, এত ভালো লেখা আরো একাধিকবার পড়তে ইচ্ছা করছে। প্রথমে অর্থতৃষ্ণা, তারপর এই ভূষুন্ডী কাগ – লেখকের কাছে প্রত্যাশা তো ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

    Reply
  • October 11, 2019 at 5:23 am
    Permalink

    কিছু লিখবো না।
    লেখার কিছুই নেই।
    আভূমি কুর্ণিশ জানবেন!

    Reply
  • January 4, 2022 at 6:45 pm
    Permalink

    হঠাৎই চোখে পড়ল লেখাটি, অতি চমৎকার।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!