অভাগার স্বর্গ
লেখক: সোহম গুহ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“ড্যাড, তুমি যখন নীচে থাকতে, হাউ ওয়াজ় ইট?” সৌগত প্রশ্ন করল।
বরুণ তার ছেলের সঙ্গে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিল। দিনের শেষে এই আধ ঘণ্টা সময়ই তারা রাখতে পেরেছে নিজেদের জন্য। আবার তো খেয়ে শুয়ে পড়ো, তারপর পরদিন সকালে উঠে ফুড স্ল্যাবের একটা প্যাকেট ছিঁড়ে মুখে পুরে ছোটো অফিস এবং স্কুলের শাট্ল ধরতে। এই আধ ঘণ্টা একসঙ্গে কাটানোর জন্যই বরুণ ফুড প্রিন্টার কিনেছে, সাধ্যের বাইরে খরচা করে। সে নিজে যে খাবারের স্বাদ পেয়ে বড়ো হয়েছে, তার ভগ্নাংশও যদি সৌগতকে দেওয়া যায়, তার জন্য। না, তাদের শহরে বাঁচার যাবতীয় উপকরণ উপস্থিত, কিন্তু তার একটিও আসল নয়। অথবা আসল, যে আসলের সংজ্ঞা বরুণের সংজ্ঞার সঙ্গে খাপ খায় না। যে ডিমের ঝোল তারা রুটি দিয়ে মেখে খাচ্ছে, সেই ডিম পাড়েনি কোনো মুরগি। এই রুটির গম আসেনি কোনো খেত থেকে। আর পাঁচটা জিনিসের মতো এরও কার্ট্রিজ উপলব্ধ বাজারে। এখানে বাতাস দূষণহীন, জল পরিষ্কার। কিন্তু কোনোটাই আসল নয়। পৃথিবীর হলেও পৃথ্বীর নয়। কারণ তাদের ভূমিকে আর ধরিত্রী বলে ডাকা হয় না, ডাকা হয় নীচ বলে। জীবনধারণের যে উপকরণগুলি তারা পরিবেশের অঙ্গ বলে ভাবত, তার প্রত্যেকটি আজ সাবস্ক্রিপশন দিয়ে কিনতে হয়। তাই, যখন সৌগত প্রশ্ন করল, বরুণের হাতের চামচ হাতেই রয়ে গেল। বলা অনেক কিছু যায়, ‘আমাদের যা ছিল, তার কিছুই তোকে দিতে পারলাম না। দেখাতে পারলাম না।’ কিন্তু এক দশ বছরের ছেলের সামনে অতীতের স্মৃতি রোমন্থনের না হলে এই না-দেওয়ার অসহায়তা তুলে ধরা বাতুলতা। তাই, বরুণ উত্তর দিল, “আমার নাম রেখেছিল তোমার দাদু। যখন আমি জন্মেছি, সেই কলকাতা এক ফেলে-দেওয়া একাকী কংক্রিটের মরুভূমি ছিল না। তুমি যাকে নীচ বলে চেনো, আমার কাছে সেই নীচ ছিল আমার সমগ্র পৃথিবী। কিন্তু আজকে হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? তোমায় যখন আমি আমার ছোটোবেলার কথা বলতে যাই, তুমি তখন হয় খাবার নিয়ে খুঁটতে থাকো, নয়তো ঘুম পেয়েছে বলে উঠে যাও।”
সৌগত মুখ নামিয়ে নিল। হাতের চামচটা কিছুক্ষণ মন দিয়ে দেখার ভান করে বলল, “না, আসলে… আজকে টিচার একটা ডকুমেন্টারি দেখিয়েছে, ইউ নো, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড উই হ্যাড’ নামে।”
সৌগতর বলার ভঙ্গি, শব্দচয়নের মধ্যে কোথাও বাঙালির বাঙালিত্ব হারানোর সুর খুঁজে পায় বরুণ। কিন্তু সে কিছু বলে না। বলতে পারে না। বলতে গেলেই সুমিত্রার কথাগুলো মনে পড়ে তার। বিচ্ছেদের সময় জোর গলায় বলেছিল, “আমার ছেলে। সে কী করবে, কী খাবে, সব আমি ঠিক করব। যখন বাবা হওয়ার কোনো দায়িত্ব পালন করোনি এই দুই বছর, তখন এখন আর সন্তান-পিরিত দেখাতে হবে না কোর্টরুমে সবার সামনে।” তাই সৌগতর স্কুল আর পালটায়নি বরুণ। সেখানেই আছে। কী শিখছে, কেন শিখছে খোঁজখবর নেয়, কিন্তু খবরদারি ফলায় না। সুমিত্রা বলে দিয়েছিল, ‘আমার ছেলে’। সেই কথা সুমিত্রা মুখার্জি চলে যাওয়ার তিন বছর পরেও এখনও মেনে চলছে বরুণ বসু। তাই সে শুধু বলল, “তোমায় কতবার বলেছি, বাবা বলে ডাকবে। ড্যাড নয়। আর কথায় কথায় এত ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ করবে না।”
“বাট ড্যা… বাবা, আমি যদি তোমার মতো কথা বলি স্কুলে, টিচার স্কোল্ড করবে, ফ্রেন্ডসরা হাসবে। তোমার কথার স্টাইল খুব ওল্ড ওল্ড, ওই ফিল্মের লোকগুলো ঠিক এভাবে কথা বলছিল।”
“কী দেখাচ্ছিল ওই তথ্যচিত্রে?”
“পিপ্ল ফ্রম ইয়োর চাইল্ডহুড।” একবার বরুণের দিকে তাকাল সৌগত। ভুল হয়েছে, বুঝতে পেরে জিব কাটল। তারপর বলল, “তোমার শৈশবের শহরকে দেখলাম। দেখলাম ওই বড়োবাজারের ন্যারো পথঘাট, ভিড়, জ্যাম, হট্টগোল। কিন্তু বাবা, তোমরা তো তখন ভালো ছিলে বেশ। অন্তত আমাদের মতো এই মেটাল কেজের মধ্যে আটকে ছিলে না। তাহলে নিজেদের এন্ড এভাবে ডেকে আনলে কেন?”
“কারণ, আমরা সীমাহীন লোভের শিকার হয়েছিলাম। ডি-এক্সটিঙ্কশনের নামে ঈশ্বর হওয়ার সাধনায় আমরা অনেক কিছু করেছি। সেই সময় সাইবেরিয়ায় পার্মাফ্রস্ট থেকে একটা সবুজ বরফের চাঁই তুলে আনে একটা শেল কোম্পানি। শেষ গ্লেসিয়াল ম্যাক্সিমামের সময়ে…”
“এবার তুমি আমার মতো করে কথা বলছ।”
সৌগতর কথায় বরুণ হাসল। ক্লিষ্ট হাসি। “যে ওমেগা ভাইরাস বরফচাপা ছিল সেই প্লিয়োসিন যুগ থেকে, তাকে আমরা বরফের পিঞ্জর থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম পৃথিবীর খোলা বাতাসে।”
ওমেগা। মানবসভ্যতার ভূমিহীন হওয়ার ঠিক আগে একটা জুতসই নাম দিয়েছিল বটে সংবাদপত্রগুলো। যখন ইরস্কুটস্ক শহরের জনজীবন চিরকালের জন্য থেমে গেল এক সকালে, তখন পৃথিবী জুড়ে লকডাউন ঘোষণা করল প্রতিটি সরকার। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সেই গ্লোবালাইজ়েশনের দুনিয়ায় পেশেন্ট জ়িরো থেকে আট বিলিয়ন মানুষকে আক্রান্ত করতে ওমেগাকে সাহায্য করেছিল রাশিয়া থেকে বের-হওয়া প্রতিটি ফ্লাইট, বিআরআই সিস্টেমের প্রত্যেকটি রেলপথ এবং রাস্তা। কলকাতার রাস্তায় যেদিন একটা লোক মেট্রোর মধ্যে ধড়ফড় করে পড়ে আর উঠল না, এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের ক্যামেরায় ধরা দিল তার শরীরের প্রত্যেকটি ফুটো থেকে বেরিয়ে-আসা নীলচে তরল, সেই দিন বরুণ ভয় পেয়েছিল। যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের কোনো প্রতিরোধ নেই, যে আণুবীক্ষণিক শত্রু তাদের মস্তিষ্কে ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে থাকে এক পক্ষকাল, এবং তারপর আড়মোড়া ভেঙে মস্তিষ্ককে গলিয়ে তৈরি করে তার জননধাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, তার বিরুদ্ধে মানুষ লড়বে কী করে? তাই তারা পালিয়েছিল, যারা পেরেছিল।
সর্বস্ব বেচে তার ছেলে এবং অন্তঃসত্ত্বা বউকে ডিকন শহরে পাঠিয়েছিল বরুণের বাবা। তাঁর শেষ পরিণতি কী হয়েছিল, বরুণ জানে না। কিন্তু সেপারেশন গিয়ার বাদে একটা মানুষ সেই স্পোর ভরতি বাতাসে শ্বাস নিলে কী হবে, তা বরুণ জানে। তাই ডিকনে এসে নিজের বাবার নাম বরুণ নথিভুক্ত করেছিল মেমোরিয়াল দফতরে। সেখানে আজ যে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে অতি খুদে অক্ষরে নামগুলো ভাসে সতর্কতার বাণীগুলোর পাশে, বরুণ জানে তার একটি নাম তার অতিপরিচিত।
সুমিত্রা সেই কথাগুলো ভুলে গেল কী করে? তাদের উভয়ের যে ঋণ আছে বরুণের বাবার কাছে, সেই ঋণ শোধ করা কি আদৌ যায়? আসলে তখন বরুণ বোঝেনি, কিন্তু এখন অনুধাবন করতে পারে। সুমিত্রা ভুলে যায়নি। ভুলতে বাধ্য করেছিল নিজেকে। এখনও চোখ বন্ধ করলে সেই ভয়ংকর দৃশ্যের কথা ভাসে। দমদম থেকে টেক অফ করা শেষ প্লেনের যাত্রী ছিল তারা। ডিকন শহরে ঢোকার পাশ পায়নি তারা, কালোবাজার থেকে সর্বস্ব বেচে কিনতে হয়েছিল সেই পাশ। না হলে তার মতো সিকল সেল এনিমিয়ার ক্যারিয়ারের জায়গা হয় নাকি ডিকনের মতো ভাসমান স্বর্গোদ্যানে? সেই প্লেনে করে যাওয়ার সময় তারা দেখতে পেয়েছিল, আগুন জ্বলছে কলকাতার বুকে। সেই আগুন ওমেগার ইনফেকশনের মতোই ছড়িয়ে পড়েছিল কলকাতা থেকে শহরতলির দিকে। আসলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে সাধারণ মানুষের বুদ্ধিবিবেচনা লোপ পেয়েছিল। মস্তিষ্ক গলে তরলে পরিণত হওয়ার আগে তারা কিছু প্রমাণ করতে চেয়েছিল, যে প্রমাণ করতে চাওয়ার স্পৃহা টেনে নিয়ে গেছে আলেকজান্ডার বা চেঙ্গিসের মতো মানুষদের পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। স্বল্প সময়ের মধ্যে নিজেদেরকে কীর্তির মাধ্যমে অমরত্ব প্রদান করতে মানুষের ধ্বংস করা বাদে আর কিছু জানা নেই।
সেইজন্যই পরপর মিসাইলের আঘাতে গঙ্গার বুকে মিশে গেল হাওড়া সেতু, সুমিত্রার মতো বরুণও শিউরে উঠেছিল। কিন্তু অবাক হয়নি। তারপর প্লেন যত এগিয়েছে দক্ষিণের দিকে, হাওড়া, উলুবেড়িয়া, হলদিয়ার ধূলিসাৎ রূপ দেখেছে সে অপলকে। অনুধাবন করেছিল, গোটা উপমহাদেশ পর্যবসিত হয়েছে অঙ্গারে। সেই অঙ্গার এবং এক মাটিচাপা কষ্টের সমুদ্র বুকে নিয়ে ডিকনে পা রেখেছিল এই নবদম্পতি। যে সময়ে তাদের সুখের সংসার বাঁধার কথা, সেই সময়ে তারা পৃথিবীর আবহমণ্ডল ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিল জিও-সিঙ্ক্রনাস কক্ষপথে আবদ্ধ এক অতিকায় ধাতব পদ্মের দিকে। ডিকন শহর তাদের স্বাগত জানিয়েছিল প্লাস্টিকের পাসের উপরে থাকা বারকোডে স্ক্যান করে।
তার পরের বছরগুলি ধরে এই দুই সর্বহারা মানুষ তিলে তিলে গড়েছে তাদের সব কিছু। বড়ো করেছে তাদের সদ্যোজাতকে। ডিকনের রিসাইক্ল সেন্টারের কাছে একটা ছোট্ট জায়গা তখনও ফাঁকা ছিল। পৌরসভার থেকে অনুমতি নিয়ে প্রিন্ট করেছিল তাদের আবাস। কিন্তু গড়ে-তোলা সংসার যে মিথ্যে হয়ে যায়, যদি সমাজ না থাকে। আর সমাজের যে মৃত্যু ঘটেছে নীচের পৃথিবীর সঙ্গে।
বরুণ এখনও বুঝতে পারেনি, সুমিত্রা তাকে কেন ছেড়ে গিয়েছিল। সে কি বুঝতে পেরেছিল, মৃত্যু তাকে অলক্ষে টানছে?
বরুণের চোখ ছলছল করে উঠল পুরোনো কথা মনে পড়ে। কয়েক মিনিটের জন্য তার সামনে থেকে মুছে গিয়েছিল বর্তমানের চিত্র। ডিকন, অথবা ডিকন্টামিশনেশন জ়োন—১ এখন তাদের আবাস। পৃথিবীর উপরে মানুষের একমাত্র আবাস। আর বাকি ডিকন্টামিশনেশন জোনগুলি অর্ধসমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে পাপুয়া নিউগিনির বিভিন্ন স্থানে।
“বাবা, তুমি ওকে?” সৌগত জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ। হ্যাঁ।”
সৌগত আরও কিছুক্ষণ খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করল অন্যমনস্কভাবে। তারপর বলল, “অ্যাকচুয়ালি, আজকে একটা মেল এসেছে ফর ইউ। সিটি কাউন্সিলের স্ট্যাম্প মারা। আমি খুলে দেখছি। সরি। কিন্তু মেলটার তুমি রিপ্লাই করবে না।”
“কীসের লেফাফা?”
“বাবা, প্রমিস করো যে, রিঅ্যাক্ট করবে না।” বলে পকেট থেকে একটা দুমড়ে-যাওয়া কাগজ বের করল সৌগত। তার থেকে ছোঁ মেরে কাগজটা টেনে নিয়ে বরুণ বুঝতে পারল, কেন তার ছেলে আজকে নীচের পৃথিবী নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। হতে পারে, তার স্কুলে আজ কোনো তথ্যচিত্র দেখিয়েছে। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়।
পৌরসভার চেয়ারম্যানের লেটারহেডের নীচে গোটা গোটা করে লেখা—‘এতদ্দ্বারা নাগরিক নম্বর ১২৪৫/১-কে জানানো হচ্ছে, তিনি যেন সত্বর স্ক্যাভেঞ্জ ম্যানেজার প্রকিত পুরকাইতের সঙ্গে দেখা করেন। স্ক্যাভেঞ্জ এক্সপিডিশন ৩২-এ আপনাকে স্বাগত।’
বিড়বিড় করে আরেকবার পড়ল সৌগত। আরেকবার। তার বিশ্বাস হচ্ছে না শব্দগুলোকে। স্ক্যাভেঞ্জ এক্সপিডিশন সম্পর্কে সে খুব ভালো করে অবগত। সুমিত্রার দৌলতে অবগত তার ছেলেও। ডিকন শহর সম্পূর্ণরূপে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। মাঝে মাঝেই রিসাইক্ল সিস্টেম থাকা সত্ত্বেও এখানে কাঁচামালে টান পড়ে। তখন কিছু অনিচ্ছুক মানুষকে ফেরত পাঠানো হয় পৃথিবীর বুকে। পৌরসভার লিফলেটে এই কাজকে শহর মহত্তম কাজ, এমনকি তীর্থযাত্রার সঙ্গে তুলনা করা হলেও বরুণ জানে এই কাজের পরিণতি। যারা যায় নীচে, তাদের অনেকেই ফেরে ক্রেটের পর ক্রেট ভরতি করে। কিন্তু অনেকেই চলে যায় না-ফেরার দেশে। একজন মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে তার বায়োহ্যাজ়ার্ড সুটে একটা সূচিমুখের থেকেও ছোটো ফুটোই যথেষ্ট। সুমিত্রা নীচে নেমেছিল, এক্সপিডিশন ২৬-এর অংশ হয়ে। সে আর ফেরেনি।
বরুণ বুঝতে পারল, একটা বৃত্ত খুব শীঘ্রই সম্পূর্ণ হওয়ার মুখে। সে ছেলেকে বলল, ভেতরের শঙ্কা এবং বিষণ্ণতা যতটা সম্ভব লুকিয়ে, “তোমার জন্য নীচ থেকে কী আনব?”
সৌগত উত্তর দিল না। ঠিক এই প্রশ্নটা তাকে তার মা-ও করেছিল। তার মনে হচ্ছে… না, সে জানে, মায়ের মতো বাবাও কথা রাখবে না।
***
প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে জ্ঞান ফিরল বরুণের। সে এখনও জটায়ু-৪-এর পেটে। চারপাশের আর ছয়জনের মতো সে-ও এখনও সিটবেল্ট পড়ে আছে। কিন্তু জটায়ু আর নীচে নামছে না, সে এক জায়গায় স্থির। তাহলে কি তারা অবতরণ করেছে? বরুণের ভেতরটা একটু তেতো হয়ে গেল। বাইরে ভোর হচ্ছে, তার ইচ্ছা ছিল এত বছর পর পৃথিবীকে আরেকবার উপর থেকে দেখার। লো আর্থ অরবিট থেকে পৃথিবীকে দেখতে গ্রহের মতো লাগে, ঘরের মতো নয়। জটায়ু হয়তো সবে অবতরণ করেছে। এখনও তার প্রপালশন নোডগুলো অল্প অল্প কাঁপছে। বাইরের জগতের সঙ্গে বরুণের সম্পর্ক কেবল একটা গোল জানলা। সে তাকাল বাইরের দিকে। এবং তাকিয়েই থাকল। বাইরে আকাশ দেখা যাচ্ছে, দিগন্ত দেখা যাচ্ছে না। জটায়ুর দুজন ক্রু-এর একজন যখন তাকে সিটবেল্ট খোলার সময়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এল, সে জিজ্ঞেস করল, “আমরা নামিনি?”
ক্রু-এর মেয়েটির কত বয়স? বাইশ বা তেইশ? কিন্তু এর মধ্যেই অনেকগুলো গ্রাভ-ডাইভ যে সে করেছে গরুড়ের পেটে বসে, বোঝা গেল। স্মিত হেসে মেয়েটি উত্তর দিল, “আমরা নেমেছি। কিন্তু আপনাদের নামা এখনও বাকি। স্ট্র্যাটোপজ় স্টেশন ’৮২-তে আপনাকে স্বাগত।” চোখে কৌতুক ফুটে উঠল তার, “বাইরে কী আছে, দেখতে চান?”
বরুণ ঘাড় নাড়ল। “ডানদিকে একটা দরজা আছে, সেটার পর যে সিঁড়ি আছে, সেটা ধরে নেমে চার নম্বর দরজাটা খুলবেন। অনেকগুলো সুট আছে, আপনার সাইজ় বুঝে পড়বেন। ও, আর অক্সিজেন সাপ্লাইটা খুলে নেবেন সুটটা সিল করার পর।” বলে মেয়েটা আর দাঁড়াল না। অনেক কাজ বাকি তার। বরুণ ছাড়া তার বাকি সহযাত্রীদের ঘুম ভাঙেনি। ওইদিকে প্রবাল বলে একজন তো বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছে গোটা মেঝে।
ঘরে ফিরতে সবাই চায়। কিন্তু ঘর নরক হয়ে গেলে সেখানে কে আর ফিরতে চায়? তাদেরকে ডাকা হয়েছিল পৌরসভার অফিসে। পৌরপিতার সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকের মনে ছিল একটাই প্রশ্ন—এত লোক থাকতে আমিই কেন। কিন্তু সেই দীর্ঘদেহী লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করার সাহস কেউ করেনি। পৌরপিতাকে বরুণ বাকিদের মতো শুধু ভয় পায় না, ঘৃণাও করে। এত কিছুর পরেও সে সুমিত্রাকে ভালোবাসত। সৌগতর কাছ থেকে তার মা-কে কেড়ে নেওয়ার অধিকার পায়নি ডিকন। জীবন পণ করে তারা এসেছিল এই শহরে বাঁচতে। জীবন পণ রেখে সংসার বাঁধার জন্য নয়।
কিন্তু কী লাভ হল এই পরিভ্রমণের? যে পৃথিবী ছেড়ে তাদেরকে আসতে হয়েছে, পরিবেশ বাধ্য করেছে, সেখানে আবার ফেরত যাওয়ার অর্থ কী? যা খুঁজতে তাদেরকে নীচে পাঠানো হচ্ছে, সেই রেয়ার আর্থ মিনারেল কি চাঁদনি চকের বিবর্জিত ইলেকট্রনিক্সের দোকানেই পাওয়া যাবে? ডিকনের চারপাশে এত পরিত্যক্ত উপগ্রহ, তাদেরকে কেন ব্যবহার করা যাবে না? আসলে বরুণ অর্থনীতি কম বোঝে। নীচে পৃথিবীতে পাঠানো, টাকার অঙ্কে অনেক সহজ, স্পেসওয়াক করে উপগ্রহ থেকে তা নিয়ে আসার থেকে। এর জন্য না লাগে ট্রেনিং, না লাগে দামি নভশ্চারণ উপযোগী পোশাক। লাগে কেবল কিছু মানুষ, যারা চলে গেলেও তাদের অভাব অনুভূত হবে না। আর মানুষ? সে যে বড়ো সস্তা।
স্ট্র্যাটোপজ় স্টেশন ’৮২-এর বিশাল ডেকে নেমে দাঁড়াল বরুণ। স্পেস এলিভেটরটা এখান থেকে টানা নামবে একদম নীচে। সেখানে গরুড়ের মতো বিশাল যানের প্রবেশাধিকার নেই। প্রায় উড়িয়ে-নিয়ে-যাওয়া হাওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে তেনজিং-এর মতো লাগল তার। যতদূর দেখা যায় মেঘমুক্ত আকাশ। সেই আকাশের ঠিক নীচে এক ধূসর চাদর বিস্তৃত। একটু আগে সুটটা পরতে তার বিশেষ অসুবিধা হয়নি। কিন্তু লক্ষ করেছে, এস সাইজ়ের একটা সুট ছিল না ঠিক জায়গায়। কিন্তু সেই নিয়ে বিশেষ ভাবেনি সে। সামনে যে মেঘের চাদর চিরে সূর্য উঠছে, তার সামনে গিয়ে সে দাঁড়াল। চোখ বন্ধ করল। উত্তাপ অনুভূত হচ্ছে তার গোটা শরীরে। এই ওমের পরশের কথা সে ভুলে গিয়েছিল যে। কী মনে হতে বরুণ পায়ে পায়ে একেবারে ধারে গিয়ে দাঁড়াল। নীচে দেখা যাচ্ছে হালকা হালকা মেঘ, যেন পাতলা মসলিনের পর্দার ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে ভূপৃষ্ঠ। বর্শার ফলার মতো জেগে আছে বহুতলের কঙ্কালগুলো, সিমেন্টের ত্বক ক্ষইয়ে সবুজের চাদর গায়ে দিয়ে।
যেন বলছে, মানুষকে পৃথিবীর দরকার নেই। কিন্তু পৃথিবী ছাড়া মানুষের চলবে না। বরুণ অপলকে তাকিয়ে রইল সেইদিকে। তাদের মতো ডিকন শহরের অধিবাসীরা বাদে মানুষের গোটা সভ্যতা, যত সাম্রাজ্য, যত কীর্তি, যত ইমারত, যত সাজানো প্রাঙ্গণ, যত গান, সাহিত্য, যুদ্ধ, গরিমা, আস্ফালন, সব কিছু আজ সে দেখতে পাচ্ছে তার পায়ের তলায়। সভ্যতার নিদর্শন বলতে কেবল অবিকৃত যে জিনিস, তা পৃথিবীর মাটিতে নেই, আছে অনেক উপরে, চাঁদের গায়ে রেখে-যাওয়া কয়েকটা বুটজুতোর ছাপ।
পিছনে কেউ ধপ করে একটা ভারী জিনিস রাখল। সচমকে ঘুরল বরুণ, এখান থেকে কাউকে নীচে ফেলে দেওয়া ভীষণ সোজা। যে লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে সুটের হেলমেটের মধ্যে দিয়ে, তার বমির গন্ধে একটু আগেও নাকে চাপা দিয়েছে বরুণ। সে জিজ্ঞেস করল, “প্রবালবাবু যে, জ্ঞান কখন ফিরল আপনার?”
“আর বলবেন না দাদা, গ্র্যাভ-জাম্প এরকম হবে জানলে কয়েকটা পুরিয়া গিলে আসতাম। একদম সেন্সলেস এরা, কীভাবে জটায়ু চালাতে হয়, জানে না।” বচন শুনে বরুণ হাসি চাপল। পৃথিবীর আবহমণ্ডলে রিএন্ট্রি কতখানি বিপজ্জনক জানলে এই কথা ভদ্রলোক বলতেন না। একটু অঙ্কের গণ্ডগোল, আর তাদের ছাই ভেসে থাকত এই স্তরে। পরিবর্তে, সে জিজ্ঞেস করল, “আপনি একেবারে বাঁধাছাঁদা করে নেমে এলেন যে?”
“আরে ওইজন্যই তো বলছি। বদ্দাদের সিস্টেমে ক্যাচাল ধরা পড়েছে। কী করে যে হল, ব্যাটারা গোটা সিস্টেম চেক করেও ধরতে পারছে না। তাই আমাদেরকে বের করে ফিরে যাবে উপরে।”
“ফি…ফিরে যাবে মানে? আর্টিক্ল ৯ অনুসারে…”
“আর কেন দাদা বিধিনিষেধ মাড়াচ্ছেন? আপনিও জানেন, আমিও জানি, ওগুলো শুধু আমাদের মতো অভাগাদের উপরেই প্রযোজ্য।”
“তা ক্যা… ইয়ে, গণ্ডগোলটা কী?” বরুণ একটু সমঝে নিল নিজেকে। প্রবালের মুখের ভাষা ঠিক ভদ্রলোকোচিত নয়। এবং এই শব্দচয়ন কী রকমের সংক্রামক, সে জানে। সৌগত প্রথমবার স্কুল থেকে কিছু চার এবং পাঁচ অক্ষরের ‘বাণী’ শিখে আসার পরে বরুণের বেশ সময় লেগেছিল ছেলেকে সেই শব্দগুলো ভোলাতে।
“৩৪ কেজি ওজনের হিসেব পাচ্ছে না। এসকেপ… এসকেপ ভেলোসিটি পেতে ওদের যে পরিমাণ ফুয়েল লাগবে, তা নাকি নেই। মানে কী বা…”
প্রবালকে থামাল বরুণ। “৩৪ কেজি কী করে বেশি হল?”
“আরে, ওরা সেইটাই ধরতে পারছে না।”
প্রবালকে পিছনে রেখে বরুণ এগিয়ে গেল জটায়ুর দিকে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একে একে সরঞ্জামগুলো নামাচ্ছিল মেয়েটি। তাকেই প্রশ্নটা করল সে। উত্তরে কাঁধ ঝাঁকাল মেয়েটি। বলল, “যা প্রশ্ন, উপরে পৌঁছে করবেন। আমায় কাজ করতে দিন।” একটু আগের সৌহার্দ্য উধাও হয়েছে তার কণ্ঠ থেকে।
একে একে স্টেশনের নীচে লাগানো পডে করে নামল সবাই। বরুণ রইল পিছনে। সে নিজেকে এই সময়টুকু দিল। আবহমণ্ডলের এই সীমাহীন শান্তি, সুটের উপরে কেটে-বেরোনো বাতাস, এবং চোখের সামনের অবারিত দৃশ্যের প্রত্যেকটা ফ্রেম সে বন্দি করছিল মনের ক্যামেরায়। শেষে সে-ও নামল নিজের পডে। প্যাকেট খুলে বের করল তার ব্রিফিং। বুঝতেও পারলো না, কখন নিঃশব্দে নীচে নামতে শুরু করেছে ফাঁপা অ্যালুমিনিয়ামের যানটি।
বাকিদের মতো তাকে কাঁচামাল জোগাড় করতে হবে না। তার গন্তব্য যোগমায়া আর্ট গ্যালারি। যামিনী রায় এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটি আঁকা ফ্রেম সমেত ডিকনে ফেরত নিয়ে আসার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়েছে। সেটিকে পুনরুদ্ধার করে রাখা হবে পৌরপিতার নিজস্ব আর্ট গ্যালারিতে, যেখানে বার্থ অব ভেনাসের পাশে শোভা পাচ্ছে মোনালিসা। চারটে কার্গো প্লেন ভরতি করে পৃথিবীর বিভিন্ন শিল্পকে উড়িয়ে আনা হয়েছে ডিকনের আর্থরাইজ় ক্যাম্পে। মানুষের জন্য সেই প্লেনগুলি বরাদ্দ করার প্রয়োজন বোধ করেননি পৌরপিতা। এককালে তিনি ছিলেন, এবং এখনও আছেন, পৃথিবীর সব থেকে ধনবান ব্যক্তি।
“সত্যিই মানুষ বড়ো সস্তা।” দীর্ঘশ্বাস ফেলল বরুণ।
“আমাদের আর কতক্ষণ লাগবে, ড্যাড?”
সিটবেল্ট না-লাগানো থাকলে হয়তো পডের মধ্যে লাফিয়ে উঠে মাথা ঠুকে বসত বরুণ। ওইদিকে একটা ব্যাগ, তার পিছনে এতক্ষণ গুটিশুটি মেরে বসে ছিল সৌগত। “তুই… তুমি এখানে কেন? তুমি এখানে কী করছ?”
“নীচ দেখতে এসেছি। সিম্পল।”
একে বরুণ কী করে বোঝাবে নীচ দেখা এত ‘সিম্পল’ নয়। মাউথপিস খামচে সে গরুড়ে বার্তা পাঠাল, “আমার এক্ষুনি উপরে ফেরত আসা দরকার।”
“যেটা করতে নীচে পাঠানো হয়েছে, সেটা সম্পন্ন করুন। তারপর এসব কথা বলবেন।” উত্তর এল। তারপর ভেসে এল একটা স্বগতোক্তি, “মামার বাড়ির আবদার পেয়েছে। বলে, উপরে আসবে।”
তাও আরেকবার চেষ্টা করল বরুণ। কেন চৌত্রিশ কেজির গোলমাল হয়েছে, কেনই-বা একটা সুট কম ছিল, সব পরিষ্কার তার কাছে। “আপনারা বুঝছেন না। আমার সঙ্গে…”
“আমাদের বুঝে লাভ নেই। ময়দানে চব্বিশ ঘণ্টা পর এক্সট্রাকশন পয়েন্টে আসবেন, তুলে নেব আপনাকে। ফর্মে সই করার আগে এগুলো ভাবা উচিত ছিল আপনার।”
ভাবা উচিত ছিল মানে? আমি কি ইচ্ছা করে করেছি? বরুণের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, সিট থেকে উঠে সৌগতকে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় মারে। নিজেকে সে থামাল। কারণ এই রাগ সৌগতর উপরে নয়। রাগ এই সমস্ত ব্যাপারটার উপরে, যার গালভরা নাম সিস্টেম। সিস্টেমকে যারা চালায়, তারা সব সময় চায়, সিস্টেম যাদেরকে চালায়, তারা যেন কখনও মুখ তুলতে না পারে। তারা যেন প্রশ্ন করতে না পারে। কারণ প্রশ্ন করলে রাজার কেন কাপড় নেই, তা জানতে চাওয়া হবে যে। বেআবরু হবে ডিকন শহরের আইন নামক ভেকের মধ্যে লুকিয়ে-থাকা গরলের রূপ।
তাই, বরুণ কিছুই করল না। এমনকি বললও না, ‘বাড়ি চল, তোর ব্যবস্থা করছি।’ পরিবর্তে বলল, “তোমার সুটটা নামার আগে আমায় চেক করতে হবে।”
“অলরেডি চেকড, সব সিল করে নিয়েছি।” কথাটা বলে একটু থেমে গেল সৌগত, “তোমার ওয়ার্নিংগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি আমি।”
“তুমি এখানে এলে কেন? আর এলেই-বা কী করে?” বরুণ জিজ্ঞেস করল। যদিও সে জানে, উপর থেকে নীচে নামার জন্য বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় না। সমস্যা তো নীচ থেকে উপরে ফেরত আসার সময়। তাদেরকে ছয় দিন রাখা হয় একটা পৃথক ঘরে, যে ঘর বাকি ডিকন শহর থেকে সব দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন। তারপর তাদের এবং তাদের সঙ্গে আসা মালপত্রের উপর নানাবিধ পরীক্ষা হয়। কাপড়ের মতো বারবার অতিবেগুনি রশ্মির তলায় দাঁড়িয়ে চান করতে হয় তাদেরকে। তারপর, সব কিছু ঠিক থাকলে তবেই আবার পা রাখা যায় ডিকন শহরের রাস্তায়।
“তোমার পিছন পিছন ঢুকে এদিক-ওদিক করে এসে গেছি। কয়েকটা এয়ার ভেন্টের সাহায্য নিয়েছি। এই নিয়ে আবার চিৎকার শুরু কোরো না।” খুব মেপে মেপে উত্তর দিল সৌগত, হেলমেটের মধ্যে দিয়ে বরুণের মুখের ভাব পরীক্ষা করে। “আমি দেখতে চাই, তোমাদের পৃথিবীকে, ড্যা… বাবা। আমার পৃথিবী বড্ড এম্পটি… নিঃস্ব।”
মানুষ যেখানে সংখ্যামাত্র, তার পরিমাপ হয় সোশ্যাল ক্রেডিট স্কোর দিয়ে, যেখানে দিগন্ত দেখার জন্য সামনে নয়, নীচে তাকাতে হয়, সেই শহরকে এক শিশুর নিঃস্ব মনে হবে না? বরুণ বড়ো হয়েছে নীল আকাশ দেখে। পকেটে টাকা থাকলে তাকে কখনও ভাবতে হয়নি, ছুটি পেলেই উত্তরবঙ্গের কোথায় যেতে হবে। পরের দিকে তাও সুমিত্রা সংগত দিয়েছিল, কিন্তু প্রথমদিকে সে তো একাই গুনেছে পায়ের তলায় আটকে-যাওয়া সরষের বীজগুলিকে। লোকাল ট্রেনের ভিড় যে কী, কিংবা বাগবাজারের লালুদার দোকানের পাঁঠার কিমা দিয়ে বানানো ঘুগনি কেমন খেতে, এসব তো সৌগতকে বলে বোঝাতে পারবে না সে। তার ছেলের কাছে সূর্যাস্ত মানে মেঘের রাঙা হয়ে ওঠা নয়, ছায়াবৃত্তের সামনের দিকে এগিয়ে আসা। বরুণ মাঝে মাঝে ভাবে, প্রায় একশো বছর আগে চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিল মানুষ। সেখান থেকে আজও পৃথিবীর সন্তান বাদে কেন আর কিছু হতে পারল না মানুষ? সম্ভাবনা তো তাদের মধ্যে অনেক ছিল। এর জন্য কি দায়ী শুধু ওমেগা ভাইরাস, নাকি তাদের সংকীর্ণ স্বার্থপরতা?
বরুণের চিন্তার মাঝেই পড প্রায় নিঃশব্দে ভূমি স্পর্শ করল। তাকে সতর্ক করে ধীরে ধীরে খুলে গেল হ্যাচটা। তাকে চমকিয়ে ভেতরটা হঠাৎ ধুয়ে গেল এক ক্ষণিকের আলোর বন্যায়। সেই সঙ্গে কানে এল এক অতিপরিচিত প্রাণ-ঠান্ডা-করে-দেওয়া শব্দ। বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি পড়ছে। সেই সঙ্গে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বরুণ সন্তর্পণে বাইরে মুখ বাড়াল। তাদেরকে পড এনে ফেলেছে হাওড়া স্টেশনের বাস স্ট্যান্ডে। চেনা লাল ঔপনিবেশিক আকারটির ওপারে ধূসর আকাশের শামিয়ানায় ধরা দিচ্ছে এক ধাতব দৈত্যের কঙ্কাল, মরচে-ধরা হাওড়া ব্রিজ। তার ওপারে সবুজের চাদরে প্রায় ঢাকা পড়েছে এক ভূতপূর্ব ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গল। কলকাতাকে নিজের করে নিতে প্রকৃতির বিশেষ কষ্ট হয়নি।
বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছা ছিল বরুণের। তার সুটের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল, যেন মনে হচ্ছে সে একটা ত্রিপলের নীচে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টির শব্দ না থাকলে এই দৃশ্য তার হজম করা কঠিন হত। বাসের কয়েকটা ধ্বংসাবশেষ, এবং ইতস্তত কয়েকটি প্রায় কাদাচাপা-পড়া হাড়গোড় বাদ দিলে চারপাশ ভীষণ রকমের নির্জন। এই নির্জনতার পটচিত্র মৃত্যুর তুলি দিয়ে আঁকা। বরুণ ঘাড় ঘুরিয়ে একবার সৌগত, তারপর ওপারের দিকে তাকাল। তার তিলোত্তমা আজ শ্মশান।
ব্রিজ পার হওয়ার সময়ে সে একবার নীচের দিকে তাকাল। গঙ্গার জল আশ্চর্য রকমের পরিষ্কার। নদী বেয়ে উত্তরের দিকে এগোচ্ছে এক রুপোলি ঢেউ। বরুণ আগে কখনও একসঙ্গে এত ইলিশ দেখেনি। সে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, “আমরা ভাবতাম আমরা পৃথিবীর অধীশ্বর, কিন্তু পৃথিবীর কাছে আমরা একদল অসভ্য ভাড়াটে বাদে আর কিছু ছিলাম না। আর আজ ঘরগুলোকে ফেরত পেয়ে প্রকৃতি সেই ঘরের দেওয়ালে সবুজ দিয়ে চুনকাম করেছে। আমাদের সভ্যতা নামক পিকের দাগের একটা চিহ্নও লেগে নেই সেই দেওয়ালে।”
হেলমেটের ইয়ারপিসে সেই কথা শুনতে পেল সৌগত। এমজি রোডে নামার পর থেকে সে নিজে হতবাক এই দৃশ্য দেখে। সব কিছু তার কাছে নতুন, ভীষণ রকমের নতুন। সে দু-হাত জড়ো করে এক আঁজলা বৃষ্টির জল সংগ্রহ করল। ফিলট্রেশন সিস্টেম বাদে কাকচক্ষু জল যে এভাবে আকাশ থেকে পড়তে পারে, জানা ছিল না তার। আর চারপাশে এত এত প্রাকার, এত ইমারত, এত গাড়ি, যতদূর চোখ যায়, ততদূর দেখতে পাওয়া এই বিশাল শহর যে থাকতে পারে, সে ভাবতে পারেনি। স্কুলে তাকে অনেক ছবি দেখানো হয়েছে। কিন্তু সে তো কেবল ছবি। এই বিশালত্বের কাছে সে যে কতখানি ক্ষুদ্র! বরুণকে সে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা এগুলো সব বানিয়েছিলে?”
“কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস তোমার চারপাশে মূক দর্শক হিসেবে বসে। এককালে এখানে ছিল তিন বর্ধিষ্ণু গ্রাম। তারপর সেখানে আর্মেনিয়ানরা এল, এল পালতোলা জাহাজে করে ব্রিটিশরা। ধীরে ধীরে ডালপালা মেলল বেনিয়ার দাপট। ক্যাশ মেমো পরিণত হল রাজদণ্ডে। তারপর আমরা, প্রায় দুশো বছর পর তাদেরকে তাড়ালাম এখান থেকে। এখান থেকেই জাতীয়তাবাদের শুরু, এখানেই শুরু জাতিভেদের। এখানেই শুরু প্রগতির, এখানেই শেষ হয়েছিল অচলায়তনের। এই শহরকে আমি নিজের চোখে ডুবতে দেখেছি ধীরে ধীরে, অপদার্থ সরকারের হাতে। এই শহরকে আমি প্রতিবাদ করতে দেখেছি, জোর গলায় এই শহর প্রশ্ন তুলেছিল, রাত জেগেছিল, ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল ব্যারিকেড। এই শহর আমায় ভালোবাসতে শিখিয়েছিল। এই শহরই হিংস্র হয়ে উঠেছিল, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-র দিন বা ওমেগা আউটব্রেকের শেষ সপ্তাহে।” বরুণের গলা ধরে এল, “এই শহর কেবল আমার শহর নয়, সৌগত। এই শহর আমাদের শহর, যে আমায় প্রতিনিয়ত মনে করায় আমার মাতৃভাষার মর্ম, স্বকীয়তা এবং স্বাধীনতার অর্থ। আমি জানি না, এই কথাগুলো তুমি বুঝবে কি না, কিন্তু এই শহরই একমাত্র কারণ… যখন তুমি জগাখিচুড়ি বাংলায় কথা বলো, আমি রেগে যাই সেই কারণেই।”
“আমি তোমাকে বুঝতে চাই, মা-কে বুঝতে চাই বলেই এসেছি এখানে।” সৌগত এগিয়ে এসে বরুণকে জড়িয়ে ধরল। সুটের ব্যবধান থাকলেও ছেলের উষ্ণতা স্পর্শ করল তাকে। সে গলার কাছে জমা কষ্টকে গিলে বলল, “চলো, দেখাই তাহলে তোমাকে।”
কলেজ স্ট্রিটে, পুঁটিরামের পাশে এক বাড়ির চারতলায় যোগমায়া আর্ট গ্যালারির স্টোরেজ। সেখানে পৌঁছোনোর আগে পায়ে হেঁটে ছেলেকে কলকাতা যতটা পারল, দেখাল বরুণ। দেখাল পোস্তার ভেঙে-পড়া ব্রিজের অংশ, মেছুয়ার নিকটবর্তী গুরুদ্বার, এবং সব শেষে কফি হাউস। বৃষ্টি থেমেছে ততক্ষণে। চারপাশ যে কত নিস্তব্ধ হতে পারে, এতক্ষণে বুঝল বরুণ। ভাঙা ড্রেন বেয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। গাছের ডালে বসে ডাকছে পাখি। ওমেগার বিস্তারের জন্য কোশের মধ্যে সক্স-৯ জিন থাকা জরুরি। আর সেই জিন মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর এত পরিমাণে আছে? কে জানে, হয়তো মানুষের বিবর্তনের জন্যই এতদিন সাইবেরিয়ায় শীতঘুমে ছিল ওমেগা। আজ তাই পৃথিবী ডিকন শহরের ভাসমান কারাগারে বন্দি-থাকা মানুষদের প্রতিপদে মনে করায়, মানুষকে তার আর প্রয়োজন নেই। মানুষের পৃথিবীকে দরকার প্রতিমুহূর্তে। আর সেই দরকারের তাগিদেই আজ তারা এখানে, জীবনকে প্রতিকূলতার মুখে ঠেলে দিয়ে, পায়ের ভৃত্য করে নয়।
তাও, ছেলেকে প্রথমবার নিজের শহরে এনে আনন্দ পাচ্ছিল না বরুণ। বাবা হিসেবে সে কি দিতে পেরেছে ছেলেকে? বরং কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই। মায়ের স্পর্শ পায়নি সৌগত বহুকাল। সেই অনুপস্থিতি কি বরুণ পেরেছে মুছে দিতে? না তো।
শৈশবে মাতৃহারা হয়েছিল বরুণ। যদিও তার বাবা তাকে সেই অনুপস্থিতি না-বুঝতে-দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে, তবুও না-পাওয়ার বেদনা যে সব পাইয়ে দিয়েও ঘোচানো যায় না। বরুণ যখন বুঝত না, অনেক কিছু বলেছে বাবাকে। আর যখন বুঝতে পারল, পাশে থাকার চেষ্টা করল, দেখল, ওমেগা কড়া নাড়ছে সভ্যতার দোরগোড়ায়।
এই চাওয়া না-চাওয়া, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব করতে করতেই যে বছরগুলো জমে পরিণত হয় দশকে।
পুঁটিরামের ঠিক পাশে দেওয়াল ফাটিয়ে উঠেছে এক বিশাল বট গাছ, মানুষের অনুপস্থিতিতে তার বৃদ্ধি দেখার মতো। ঝুড়ির পিছনে মনে করে করে গ্যালারির প্রবেশপথটা খুঁজে পেতে একটু সময় লাগল বরুণের। রিসেপশনের ডানদিকে ডিএনএ হেলিক্সের মতো পাকিয়ে উপরের দিকে উঠেছে লোহার সিঁড়ি। কাল তার গায়ে বসিয়েছে জঙের প্রলেপ। উপরে বোধহয় ছাদ ভেঙেছে, চুইয়ে চুইয়ে জল নামছে সিঁড়ি এবং দু-ধারের দেওয়াল বেয়ে। বরুণ হাত দেখিয়ে সৌগতকে তার পিছন পিছন দেওয়াল ধরে উঠতে নির্দেশ করল। সিঁড়ি মাঝে মাঝে বিরক্তি প্রকাশ করল তাদের পদক্ষেপে, রিভেটগুলো একটু একটু গুঙিয়ে উঠছে। ঝুরঝুর করে পাশের দেওয়াল থেকে খসে পড়ছে শ্যাওলা-ভেজা পলেস্তারা।
কিন্তু যখন সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠল তারা, বরুণের মনে হল, এত কষ্ট তাদের সার্থক হয়েছে। হ্যাঁ, আর কয়েক ঘণ্টা পরে এইগুলোর হয়তো স্থান হবে ডিকন শহরের পৌরপিতা বা তাঁর নিকটস্থানীয় মানুষগুলোর ঘরে, হয়তো এই ছবিগুলোর নীচে আর চারটে শনিবারের মতোই বসবে মজলিশ, যেখানে নিজেদের শরীর বিক্রি করে শহরে থাকার অধিকার কিনবে কিছু দুর্ভাগা অষ্টাদশী। কিন্তু তার আগে, পডে ঢোকার আগে অবধি এই যামিনী রায়, যোগেশ চৌধুরী, নন্দলাল, পরিতোষ সেন, বা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলির কাজগুলোর উপরে বরুণের ক্ষণিকের কিন্তু একচ্ছত্র অধিকার।
“আমার… আমার… আমার…” চিৎকার করে উঠল বরুণ। বাবার হঠাৎ এই মুষ্টিবদ্ধ আস্ফালনে ভয় পেয়ে পিছু হটতে গিয়ে একটা চাঙড়ে হোঁচট খেল সৌগত। দড়াম করে সে পড়ে গেল মাটিতে। সংবিৎ ফিরে সঙ্গে সঙ্গে তাকে তুলে ধরল বরুণ। সৌগতর হেলমেটের একটা অংশের কাচ ভেঙে পড়ল নীচে।
“দ…দম চেপে থাক। শ্বাস নিবি না একদম।” যত তাড়াতাড়ি পারে, নিজের হেলমেট খুলে ছেলেকে পরানোর চেষ্টা করল বরুণ। কিন্তু অত জবরজং জিনিস মুহূর্তের মধ্যে খোলা কি যায়? সৌগতর মুখে আতঙ্কের সাদা ক্রমশ পরিণত হচ্ছে শ্বাসকষ্টের নীলে। না, আর সে পারছে না। বাবা কী করছে? কী হবে শ্বাস নিলে একটু? আর যে… আর যে সে পারছে না। দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে। না। এবার সে দম নেবে।
বরুণ নিজের হেলমেট খুলে সেটা সজোরে চেপে ধরল সৌগতর মুখে। কিন্তু ততক্ষণে সৌগতর ফুসফুসে জায়গা করে নিয়েছে একঝলক ফুরফুরে টাটকা, বিষাক্ত পার্থিব বাতাস।
***
থম মেরে বসে ছিলেন ডিকন সাহেবের পৌরপিতা। একটু আগে সেক্টর আট থেকে পড ফেরত এসেছে। ভেতরে কেবল একটা বাচ্চা ছেলের মৃতদেহ। যাকে পাঠানো হয়েছিল, তার ছেলে। আর সেই সঙ্গে অনেকগুলো ছিঁড়ে ফালাফালা-করে-দেওয়া ক্যানভাস। বরুণ ফেরত আসেনি শহরে। কিন্তু কেন সৌগত সেই পডে ছিল, কেনই-বা অমূল্য শিল্পকীর্তিগুলোকে সে নষ্ট করেছে, উত্তর নেই পৌরপিতার কাছে। কিন্তু রাগটা গিলে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাঁর। বরুণের সুটে বাতাস বেশি অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। আর মৃতেরা বিদ্রোহ করে না। বরুণের প্রাক্তন স্ত্রী-ও করেনি।
***
আকাশের পুব কোণে একটা তারা নিজের জায়গা ছেড়ে নড়ে না। ওমেগা তার কিচ্ছু করতে পারেনি। কিন্তু তার মাতৃমুখী ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে চিরকালের জন্য। ধীর গলায় সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি জানতে, বাবা?”
বরুণের বাবা হাসলেন না। দীর্ঘ এক দশক তিনি দিন গুনেছেন। মৃত্যু যেভাবে আসার কথা ছিল, আসেনি। বরং বার্ধক্য জাঁকিয়ে বসেছে শরীরে। ওমেগা তাঁদেরকে আক্রমণ করতে গিয়েও পারেনি। সেই জেনেটিক কোডটি নিজের ছেলেকে দিয়ে যেতে পারেনি বরুণ। সে তো এই পৃথিবীতে নতুন। যারা মানবসভ্যতার মহাভিনিষ্ক্রমণ দেখেছে, দেখেছে তাদের সূর্যাস্ত, তারা তো বাঁচতে ভুলে গিয়েছিল। কারণ, তাদের সন্তানেরা ফেলে চলে গিয়েছিল তাদেরকে, বোঝা ভেবে। তাও, এই বৃদ্ধাশ্রমের যারা বেঁচে গিয়েছিল মহামারির প্রকোপ থেকে, তারা দাঁতে দাঁত পিষে টিকে থাকার লড়াই করেছিল। আর এখন, বরুণের থেকে শুনে তারা বুঝতে পেরেছে, গরল মানুষ পৃথিবীতে ফেলে যায়নি, নিজেদের সঙ্গে করে নিয়ে গেছে লো আর্থ অরবিটে। তাদের সঙ্গে দলে দলে যোগ দিয়েছে সেইসব অর্থনীতির চাকায় পিষ্ট হওয়া মানুষ, যাদেরকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি ডিকন শহরে। জলে পিঁপড়েদের মতো তারা মৃত্যুবরণ করেছে ভাইরাসের প্রকোপে। কিন্তু যারা টিকে গিয়েছিল, প্রতিজ্ঞা করেছিল একত্রিত হওয়ার, সভ্যতার যে প্রদীপ পিছনে ফেলে যাওয়া হয়েছিল, সেই প্রদীপের আগুনকে বাঁচিয়ে রাখার।
দুই প্রজন্মের দুই ভগ্নমনোরথ মানুষ পরস্পরের দিকে চাইল। উত্তরের জন্য নয়, প্রশ্ন করার জন্য। মানবসভ্যতার এই অভাগাদের স্বর্গ দখলের প্রয়োজন এবার।
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সোহম গুহ
