আল-বিরুনির চিরুনি
লেখক: স্বর্ণদীপ রায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
জেসন ধীর পদক্ষেপে গহ্বরটার পরিধি বরাবর হেঁটে চলেছিল। ওর দৃষ্টি গহ্বরের ভিতরের অন্ধকার অংশটার ওপর নিবদ্ধ। প্রায় মিনিট পনেরো হল, আইশা গহ্বরটার ভিতরে নেমেছে। জেসন ওকে নিষেধ করেছিল, কিন্তু ও শোনেনি। আইশার ধমনিতে প্রবাহিত হচ্ছে আরব বেদুইন আর মেক্সিকান যুদ্ধবাজ জনজাতির মিশ্র রক্ত। সেই কারণেই বোধহয় মেয়েটা মারাত্মক রকমের জেদি। আইশা যদি আর মিনিট দশেকের মধ্যে উঠে না আসে তাহলে জেসনকে বিষয়টা মিশন কমান্ডারকে রিপোর্ট করতে হবে। আর কমান্ডার যে এই বিষয়টা খুব একটা ভালো চোখে দেখবেন না, সেটা বলাই বাহুল্য। ওঁর অনুমতি ছাড়া ওই গহ্বরে অনুপ্রবেশের জন্য জেসন আর আইশার বিরুদ্ধে উনি কোনো ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনও নিতে পারেন। তবে আপাতত জেসন সেসব নিয়ে চিন্তিত নয়। এই মুহূর্তে তার মাথায় কেবল ঘুরছে আইশার সেফটির ব্যাপারটা। আইশা গহ্বরে প্রবেশ করার পর থেকেই ওর সঙ্গে জেসনের টেলি যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। খুব সম্ভবত জেসন তাকে তাড়াতাড়ি উঠে আসার জন্য তাগাদা দেবে ভেবে, আইশা নিজেই হয়তো নিজের কমিউনিকেশন ডিভাইসটা অফ করে দিয়েছে।
কিন্তু যদি তা না হয়ে থাকে!
যদি সত্যিই আইশা কোনো বিপদে পড়ে থাকে!
একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে জেসন অন্ধকার গহ্বরটার দিকে চেয়ে রইল।
চাঁদের মাটিতে এরকম অসংখ্য গহ্বর বা ক্রেটার রয়েছে। তবে তার মধ্যে এই ক্রেটারটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত জেসন আর আইশার কাছে তো বটেই।
কারণ, আনা সোয়ার্জকফকে শেষবারের জন্য এই ক্রেটারটার কাছেই দেখা গিয়েছিল!
আনা ছিলেন মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA-র একজন ভেটেরান অ্যাস্ট্রোনট। আইশা আর জেসনের মেন্টরও ছিলেন তিনিই। গত বছর NASA-র লুনার মিশন চলাকালীন আনা চাঁদের মাটি থেকে রহস্যজনকভাবে অন্তর্হিত হন। ঘটনাটা নিয়ে সেই সময় ব্যাপক তোলপাড় হয়েছিল। মার্কিন তদন্তকারী সংস্থাগুলির পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক তদন্তকারী সংস্থা, SRI-কেও মাঠে নামানো হয়েছিল। কিন্তু অনেক অনুসন্ধানের পরেও আনার অন্তর্ধানের পিছনে কোনোরকম অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে জানা যায় যে, আনার ফ্যামিলিতে কার্ডিয়াক ডিসঅর্ডার-এর একটা হিস্ট্রি ছিল। যদিও আনা নিজে ছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, বংশে হৃৎপিণ্ডজনিত সমস্যার ইতিহাস থেকে থাকলে অনেক সময়ে আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ ব্যক্তির মধ্যেও অকস্মাৎ এই মারণ ব্যাধির প্রকোপ ঘটে। কাজেই তদন্তকারীদের অনুমান, আনা হয়তো অকস্মাৎ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর তারপরে গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিলেন ওই ক্রেটারের ভিতরে। সেক্ষেত্রে ওই ক্রেটারের ভিতরে তল্লাশি চালালেই আনার মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়া উচিত।
আর সেই উদ্দেশ্যেই চাঁদের মাটিতে অনুসন্ধানের জন্য NASA এবং তদন্তকারী সংস্থাগুলির একটা যৌথ টিম পাঠানো হয়েছে।
ওই টিমে NASA-র মনোনীত সদস্য হিসেবে স্থান পেয়েছেন আনার দুই স্টুডেন্ট—আইশা রেয়েস আর জেসন কোহেন। টিমে ওদের ভূমিকা মিশন স্পেশালিস্ট-এর। যেহেতু ওরা দুজনেই আগের বেশ কয়েকটি লুনার মিশনের সদস্য ছিল, তাই চাঁদের মাটিতে অনুসন্ধানের কাজে ওরা তদন্তকারীদের অনেকটাই সাহায্য করতে পারবে বলে কর্তৃপক্ষ মনে করেছেন। তা ছাড়া আনার সঙ্গে ওদের ইমোশনাল কানেকশনটাও ওদের এই টিমে স্থান পাওয়ার পিছনে একটা বড়ো কারণ।
আইশা ও জেসন সমেত আটজনের টিম নিয়ে মহাকাশযান আর্টেমিস ১৯ চাঁদের মাটিতে নেমেছে, পৃথিবীর হিসেবে প্রায় বারো ঘণ্টা আগে। মিশনটার নেতৃত্বে আছেন NASA-র অভিজ্ঞ নভশ্চর, কমান্ডার ডিন ক্যালওয়ে। আইশা ও জেসন ছাড়া দলটাতে রয়েছেন একজন পাইলট এবং একজন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। কমান্ডার গ্যালওয়ে, আইশা আর জেসনের মতো এই দুজনও হলেন NASA-র কর্মী।
কিন্তু দলের অন্য তিনজন সদস্যের ক্ষেত্রে ওই কথাটা প্রযোজ্য নয়। ওঁদের সঙ্গে NASA-র কোনো সম্পর্ক নেই। যে তিনটি সংস্থা আনার অন্তর্ধান রহস্যের তদন্ত করছিল, ওঁরা হলেন সেই সংস্থাগুলির প্রতিনিধি। চাঁদের মাটিতে আনার অন্তর্ধানের সূত্র খুঁজে বের করার কাজটা আসলে এঁরাই করবেন। ক্রু-এর অন্য মেম্বারদের কাজ হল কেবল এঁদের সাহায্য করা। এই তিনজন ইনভেস্টিগেটর হলেন ফিল্ড ইনটেলিজেন্স অফিসার রোনান ভস, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়েনা ওয়ার্ড এবং এজেন্ট Vaan।
রোনান ভস হলেন NRO নামক সংস্থার প্রতিনিধি। NRO অর্থাৎ National Reconnaissance Office হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ-সংক্রান্ত প্রধান ইনটেলিজেন্স এজেন্সি। আমেরিকার গুপ্তচর উপগ্রহগুলি এই সংস্থাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ওইসব উপগ্রহ অর্থাৎ স্যাটেলাইটগুলির সাহায্যে এরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ওপর নজরদারি করে থাকে। এরা CIA, NSA প্রভৃতি অন্য সরকারি সংস্থাগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করে। আর ওরকমই আরেকটি সংস্থা হল USSF বা United States Space Force। বাস্তবে এটা কোনো পৃথক সংস্থা নয়, আসলে এটা মার্কিন সেনাবাহিনীরই একটি বিভাগ। এদের প্রধান কাজ হল মহাকাশে সক্রিয় মার্কিন অ্যাসেটগুলিকে রক্ষা করা। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়েনা ওয়ার্ড হলেন এই বাহিনীরই একজন সিনিয়র অফিসার।
তবে এই তদন্তকারী দলের সব চেয়ে ইনটারেস্টিং সদস্য হল এজেন্ট Vaan নামের লোকটি। রোনান ও সিয়েনা দুজনেই শুনেছেন যে ওই ব্যক্তি নাকি SRI-এর দক্ষতম ফিল্ড অপারেটিভদের অন্যতম। তবে এই মিশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত ওঁদের দুজনের কেউই, এজেন্ট Vaan তো দূরের কথা, এমনকি তার সংস্থাটির নামও জানতেন না।
আর সেটা খুবই স্বাভাবিক।
কারণ, সাধারণ মানুষের কাছে ওই সংস্থাটির কোনো অস্তিত্বই নেই। আসলে SRI বা Scientific Research Intelligence হল একটি ultra classified autonomous body। ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রসংঘের একটি গোপন রেজ়োলিউশনের মাধ্যমে এই আন্তর্জাতিক গুপ্তচর সংস্থাটির সৃষ্টি হয়। ওই বছর সাইবেরিয়াতে একটি গোপন জেনেটিক অস্ত্রনির্মাণ প্রকল্পের কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরেই, রাষ্ট্রসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলের বিশেষ রুদ্ধদ্বার বৈঠক বসে। তখনই পরিকল্পনা নেওয়া হয় এমন একটি সংস্থা সৃষ্টির, যারা নিরপেক্ষভাবে বিশ্বের সকল দেশের রিসার্চ ফেসিলিটিগুলির ওপর নজরদারি করতে পারবে, যাতে কোনো দেশ বা সংস্থা গোপনে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় লিপ্ত হতে না পারে, যা মানবজাতির পক্ষে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিকারক।
ওই বৈঠকের পরেই, এই মর্মে রাষ্ট্রসংঘে ওমেগা-৯১ নামক একটি গোপন রেজ়োলিউশন পাস করা হয়।
আর তার ফলশ্রুতিতেই সৃষ্টি হয় SRI!
বিশ্বের প্রধান প্রধান রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের এবং গ্লোবাল ইনটেলিজেন্স কমিউনিটির মাথাদের বাদ দিয়ে, আর প্রায় কেউই এই সংস্থাটির অস্তিত্বের কথা জানে না।
কাজেই রোনান আর সিয়েনা যখন স্বয়ং ডিফেন্স সেক্রেটারির মুখ থেকে SRI এবং এজেন্ট Vaan-এর বিষয়ে জেনেছিলেন, তখন খুবই অবাক হয়েছিলেন।
ওঁদের দুজনকে ব্রিফ করার পরে ডিফেন্স সেক্রেটারি বলেছিলেন, “মনে রাখবেন, আপনাদেরকে যা বললাম, সেটা হাইলি ক্লাসিফায়েড ইনফর্মেশন। এটা যেন কোনোভাবেই পাবলিক ডোমেইনে না আসে।”
ওঁরা দুজনেই সেক্রেটারিকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, অন্তত ওদের তরফ থেকে কোনো তথ্য ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা নেই।
তবে সেক্রেটারির কথা থেকে ওঁরা বুঝেছিলেন যে, একই বিষয়ের ওপর তদন্ত করলেও এজেন্ট Vaan-এর লক্ষ্য ওঁদের থেকে আলাদা, যেখানে ওঁদের দুজনের প্রধান কাজ হবে আনার মৃতদেহ সন্ধান করে ফিরিয়ে আনা, সেখানে SRI-এর ইনভেস্টিগেটরটির প্রধান লক্ষ্য হবে আনার অন্তর্ধানের যথার্থ কারণটা খুঁজে বের করা। খুব সম্ভবত SRI ‘আনার হার্ট অ্যাটাক’ তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়। বোধহয় তারা সন্দেহ করছে যে, চাঁদের মাটিতে আমেরিকা কোনো গোপন বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাচ্ছে। আর তাতে কোনোরকম ভুলত্রুটির কারণেই আনার এই অকস্মাৎ অন্তর্ধান!
তবে NASA আর আমেরিকান গভর্নমেন্ট, দু-তরফ থেকেই চাঁদের মাটিতে কোনো গোপন রিসার্চ প্রোগ্রাম চালানোর কথা অস্বীকার করা হয়েছে।
কিন্তু তাহলেও রাষ্ট্রসংঘের ওমেগা-৯১ রেজ়োলিউশনের অন্যতম সিগনেটরি হওয়ার কারণে, আমেরিকা SRI-এর সঙ্গে সহযোগিতা করতে বাধ্য। আর সেই কারণেই তারা নিজেদের লুনার রিকভারি মিশনে SRI-এর একজন এজেন্টকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে। তবে আমেরিকার তরফ থেকে SRI-কে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আনার মৃতদেহ রিকভার করামাত্রই এই মিশন টারমিনেট করা হবে। অর্থাৎ সকল যাত্রী সমেত মহাকাশযানকে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। সুতরাং এই সময়ের মধ্যেই এজেন্ট Vaan-কে নিজের তদন্তের কাজ শেষ করতে হবে।
আর সেই কারণেই আর্টেমিস ১৯ চাঁদের মাটি ছোঁয়ার ঠিক পরেই এজেন্ট Vaan ওই ক্রেটারটার কাছে যেতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু মিশন কমান্ডার ডিন ক্যালওয়ে ওঁকে সেই অনুমতি দেননি।
“মাফ করবেন এজেন্ট Vaan,” উনি বলেছিলেন, “প্রোটোকল অনুসারে আগে আমাদের দুজন লুনার মিশন স্পেশালিস্ট জায়গাটা পরিদর্শন করে আসবেন। কারণ, অনেক সময় এইসব এক্সট্রা টেরিস্ট্রিয়াল সাইটের তাপমাত্রা এবং অন্য এনভায়রনমেন্টাল প্যারামিটারগুলো ঠিক অনুকূল থাকে না। তাই আমার স্পেশালিস্ট দুজন ক্লিয়ারেন্স না-দেওয়া পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতেই হবে।”
আর সেই দুজন স্পেশালিস্টই ছিল জেসন ও আইশা।
কমান্ডার গ্যালওয়ে ওদের পইপই করে বলে দিয়েছিলেন যে, ওরা যেন রুটিন পরীক্ষাগুলো সেরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মহাকাশযানে ফিরে আসে। কিন্তু আইশা সেই নির্দেশ মানতে পারেনি। কমান্ডারের অনুমতি না নিয়েই, জেসনের আপত্তি সত্ত্বেও সে নেমে পড়েছে ওই রহস্যময় ক্রেটারটির অন্দরে।
অবশ্য রহস্যময় হলেও, ক্রেটারটি ওদের কাছে একেবারেই অপরিচিত নয়। আর শুধু ওরাই নয়, বরং সব লুনার এক্সপার্টই ওই ক্রেটারটিকে এক ডাকে চেনে।
চাঁদের ‘ফার সাইড’ অর্থাৎ যেদিকটি পৃথিবী থেকে দেখা যায় না, সেইদিকে অবস্থিত এই ক্রেটার দীর্ঘকাল ধরেই বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে আসছে। ১৯৭০ সালে ইনটারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন, পারস্যের বিখ্যাত প্রাচীন পণ্ডিত ও বিজ্ঞানী আবু রায়হান আল-বিরুনির নামে এই চান্দ্রগহ্বরটির নামকরণ করেন ‘আল-বিরুনি ক্রেটার’।
আর এই মুহূর্তে, জেসন এরই কিনারায় দাঁড়িয়ে, একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে ক্রেটারের ভিতরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে রয়েছে।
“নাঃ, আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।”
ও মনে মনে ভাবল, ‘কমান্ডারকে এখনই ইনফর্ম করতে হবে। আইশা মে বি ইন ট্রাব্ল ডাউন দেয়ার।’
জেসন নিজের কমিউনিকেশন ডিভাইসে কমান্ডার গ্যালওয়ের চ্যানেলটা ট্যাপ করতেই যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক তখনই ও টের পেল যে, ওর ডিভাইসের অ্যানোনিমাস চ্যানেলটা ব্লিংক করছে। অর্থাৎ কোনো অজ্ঞাত ব্যক্তি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।
তবে কি আইশা?
হতেই পারে। হয়তো ওর ডিভাইসে ওর নিজস্ব চ্যানেলটা কাজ করছে না। আর তাই অ্যানোনিমাস চ্যানেলের মাধ্যমেই জেসনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে।
জেসন চ্যানেলটা ট্যাপ করল।
২
“হ্যালো জেসন।”
জেসন চমকে উঠল। এ তো আইশার স্বর নয়।
তবে কণ্ঠস্বরটা ওর চেনা।
“এজেন্ট Vaan!”
জেসন বিস্মিত স্বরে বলল, “ইয়েস ক্যাপটেন জেসন কোহেন, ইট’স মি। বুঝতে পারছি যে, আপনি খুবই অবাক হয়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। আসলে আমি আপনার সঙ্গে কিছু কথা শেয়ার করতে চাই।”
“আই অ্যাম সরি, এজেন্ট Vaan।”
জেসন বলল, “কিন্তু আপনি আমার অথবা ক্রু-এর অন্য কোনো মেম্বারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন না। দ্যাট’স এগেইনস্ট প্রোটোকল। আপনার যা বলার, সেটা কমান্ডার গ্যালওয়েকে বলুন।”
“আমার কথাগুলো কিন্তু আপনার সহকর্মী ডক্টর আইশা রেয়েস সম্পর্কে। আমি জানি যে, উনি আপনাদের কমান্ডারের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ক্রেটারের ভিতরে নেমেছেন।”
কথাটা শুনে জেসন চমকে উঠল।
আশ্চর্য! লোকটা এটা জানল কীভাবে!
“প্লিজ় কোঅপারেট উইথ মি, ক্যাপটেন কোহেন।”
কমিউনিকেশন ডিভাইসের মধ্য দিয়ে এজেন্ট Vaan-এর আকুতিপূর্ণ স্বরে ভেসে এল, “মানবজাতি এই মুহূর্তে এক বিরাট সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। আর কেবল আপনিই পারেন সকলকে বাঁচাতে।”
কথাটা শুনে জেসন হতভম্ব হয়ে পড়ল।
লোকটা বলে কী! ওর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছে?
অন্ধকার ক্রেটারের মধ্যে নেমে আইশা হয়তো নিজেকে বিপন্ন করেছে। কিন্তু এর মধ্যে মানবজাতির সংকটের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?
“গিভ মি আ চান্স টু এক্সপ্লেইন, ক্যাপটেন জেসন।”
লোকটা আবার বলল, “আমার কথা শুনলেই আপনি সবটা বুঝতে পারবেন।”
তারপর একটু থেমে আবার বলল, “আমাদের হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই।”
কয়েক মুহূর্ত দোনোমনো করে জেসন অবশেষে বলল, “ওকে… গো অ্যাহেড… আই অ্যাম লিস্নিং।”
এজেন্ট Vaan জেসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের বক্তব্য শুরু করল। আর তার কথাতে প্রকাশ পেল আশ্চর্য এক কাহিনি।
…দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে, পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হিসেবে আমেরিকা নিজেকে বিশ্বের সব চেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু তার কয়েক বছরের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নও পরমাণুশক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে ওঠে। আর তারপরেই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের জন্য আরম্ভ হয় এক চোরা প্রতিযোগিতা, যা ইতিহাসে ‘ঠান্ডা লড়াই’ বা cold war নামে খ্যাত।
এই পর্যায়ে, দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রই প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে, নতুন নতুন অস্ত্র আবিষ্কারের জন্য চেষ্টা করতে থাকে। এগুলির মধ্যে সব চেয়ে আশ্চর্যজনক ছিল সাইকিক অর্থাৎ মনোবৈজ্ঞানিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্প। ১৯৭০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকা এই মর্মে যে গোপন প্রকল্পটি চালিয়েছিল, তার নাম Project Stargate। প্রকল্পটি চলাকালীন এর কথা সাধারণ মানুষ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তীতে এই প্রকল্পের অনেক তথ্যই ডিক্লাসিফাই করা হয়। সেইসব তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকা এই প্রকল্পটি লঞ্চ করেছিল একটি সাইকিক এসপায়োনেজ সিস্টেম তৈরির উদ্দেশ্যে। এর আওতায়, সাইকিক অর্থাৎ বিশেষ মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকজন মানুষকে বাছাই করে নিয়ে তাদের বিশেষভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয়। এদের কাজ ছিল আমেরিকাতে বসেই, স্রেফ মানসিক ক্ষমতা ব্যবহার করে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন ডিফেন্স ইনস্টলেশনের ওপর নজরদারি করা। প্রকল্পটি সম্পূর্ণভাবে সফল না হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়। CIA এবং DIA-র মতো মার্কিন ইনটেলিজেন্স সংস্থাগুলি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে এই প্রোজেক্ট পরিচালনা করত। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই এই প্রকল্পের গুরুত্ব কমতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৫ সালে এই প্রোজেক্ট অফিশিয়ালি টারমিনেট করা হয়।
কিন্তু প্রকল্পটি বন্ধ করা হলেও এর সমস্ত টেকনিক্যাল নো-হাউ কিন্তু ধ্বংস করা হয়নি। বরং CIA-র মাধ্যমে সেগুলি পৌঁছে যায় অন্য একটি প্রভাবশালী মার্কিন সংস্থার হাতে।
আর এই সংস্থাটিই হল DARPA অর্থাৎ Defence Advanced Research Projects Agency।
এই সংস্থার প্রধান দায়িত্ব হল নিত্যনতুন সামরিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন, যা মার্কিন সেনাবাহিনীকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে সব সময়ই বেশ কয়েক কদম এগিয়ে রাখবে। DARPA ইতিমধ্যেই CIA-র বন্ধ-হয়ে-যাওয়া MKULTRA প্রোজেক্টের গবেষণালব্ধ তথ্যগুলিও হাতে পেয়েছিল। ১৯৫০-এর দশক থেকে সাতের দশক পর্যন্ত চলা এই প্রোজেক্টটিও ছিল অত্যন্ত গোপনীয়। এই প্রোজেক্টের লক্ষ্য ছিল mind control। অর্থাৎ মানুষের মন ও তার চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী মার্কিন সমাজে এই প্রকল্পের কথা জানাজানি হতেই বিতর্ক শুরু হয়।
প্রশ্ন ওঠে এই প্রকল্পের লক্ষ্য কারা?
স্রেফ শত্রুরা? নাকি মার্কিন নাগরিকেরাও?
বিতর্কের মুখে পড়ে সরকারকে এই প্রকল্প বন্ধ করে দিতে হয়।
কিন্তু এখন, MKULTRA-র পাশাপাশি Stargate প্রকল্পেরও সমস্ত রিসার্চ আউটপুট হাতে পাওয়ার পরে, DARPA-র ডিরেক্টর ইভলিন ক্রাউজের মাথায় একটা ভয়ংকর আইডিয়া জন্ম নেয়।
MKULTRA এবং Stargate, এই দুই প্রোজেক্টেই দেখা গিয়েছে যে, মানুষের মনের মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে অমিত সাইকিক শক্তির ভাণ্ডার। কোনোভাবে বাইরে থেকে মস্তিষ্কে স্টিমুলেশন দিয়ে এই শক্তিকে জাগানো যায় কি?
ইভলিনের এই ভাবনাটা মনে ধরে মার্কিন গভর্নমেন্টের। আর তাই এই বিষয়ে গবেষণার জন্য লঞ্চ করা হয় একটি নতুন প্রকল্প।
প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস!
আর এই প্রকল্পের ফলস্বরূপই উদ্ভাবিত হয় একটি ভয়ংকর বস্তু, যার সাংকেতিক নাম… দ্য সাই কম।
জিনিসটা দেখতে একটা মাঝারি সাইজ়়ের ধাতব চিরুনির মতো। আর ওটা চিরুনির মতো করেই ব্যবহার করতে হয়। চুল আঁচড়ানোর সময় চিরুনির দাঁড়াগুলো মাথা স্পর্শ করলেই যন্ত্রটা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন ওই দাঁড়াগুলো থেকে নির্গত হতে থাকে এক বিশেষ ধরনের তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। এই তরঙ্গগুলি খুলির কঠিন আবরণ ভেদ করে মস্তিষ্ককে স্পর্শ করে। এর ফলে মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু কেন্দ্র উদ্দীপ্ত হয়, যা মনের গভীরে লুকিয়ে-থাকা সাইকিক শক্তির উৎসমুখ খুলে দেয়।
সাই কম উদ্ভাবনের পরেই আরম্ভ হয় প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর সেকেন্ড ফেজ় অর্থাৎ দ্বিতীয় ধাপ। এই যন্ত্রটি বিভিন্ন সাবজেক্টের ওপর পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করে দেখা হতে থাকে। এই সাবজেক্টরা ছিলেন সেনাবাহিনীসহ মার্কিন গভর্নমেন্টের বিভিন্ন বিভাগের কর্মী, যাঁরা নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
কোনো বিষয়ে দক্ষতা আসলে ব্যক্তির মানসিক ক্ষমতারই পরিচায়ক। আর এটাই ছিল ওইসব মানুষকে সাবজেক্ট হিসেবে নির্বাচনের কারণ।
আর এইসব সাবজেক্টের মধ্যে এমন একজন ছিলেন, যাঁর ওপর সাই কম প্রয়োগ করে অকল্পনীয় মাত্রায় সাইকিক শক্তির স্রোত আবিষ্কার করা গিয়েছিল। আর ওই মানুষটিই ছিলেন NASA-র ভেটেরান অ্যাস্ট্রোনট, আনা সোয়ার্জকফ। আনাই ছিলেন প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর সব চেয়ে মূল্যবান আবিষ্কার। ওঁর মধ্যে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বিপুল সাইকিক শক্তির ভাণ্ডার। ইভলিনের ভাষায় আনা ছিল একজন ‘সাইকিক বম’। অর্থাৎ এমন একজন, যার সাহায্যে অন্য মানুষদের মনের মধ্যে চিন্তার বিস্ফোরণ ঘটানো যায়। এই ‘বোমা’র প্রয়োগ করে, মার্কিন গভর্নমেন্ট তার শত্রুদের, এমনকি নিজের নাগরিকদেরও, নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং মানসিক অবস্থান সম্পূর্ণ ধ্বংস করে, তাদেরকে মার্কিন গভর্নমেন্টের অন্ধ সমর্থকে পরিণত করতে পারে।
এ এমন এক অস্ত্র, যা কোনো যুদ্ধ অথবা রক্তপাত ছাড়াই সারা পৃথিবীতে আমেরিকার আধিপত্য সুনিশ্চিত করতে সক্ষম। আর সেটাও করা যাবে চুপচাপ, সকলের অজ্ঞাতসারেই। হিরোশিমা-নাগাসাকির পরমাণু বিস্ফোরণও যা করতে পারেনি, এই ‘সাইকিক বম’ আমেরিকার সেই অভীষ্ট লক্ষ্যই পূরণ করার ক্ষমতা রাখে। আর তা হল সমগ্র বিশ্বের ওপর বৌদ্ধিক আধিপত্য। Complete moral and intellectual dominance on the entire world!
“তার মানে আপনি বলছেন, আনাই হল সেই ‘সাইকিক বম’ আর ওই চিরুনিটাই হল এই বোমার ডিটোনেটর?” জেসন প্রশ্ন করল।
“এগজ়্যাক্টলি।”
“কিন্তু ওরকম একটামাত্র বোমা দিয়ে কী হবে? ওটা তো শারীরিক অসুস্থতা অথবা অন্য কোনো কারণে যে-কোনো সময়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে।”
“ওয়েল, এখন প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর একটা প্রধান কাজই হল আনার সাহায্য নিয়ে, ওর মতো অন্য পোটেনশিয়াল সাইকিক বমদের খুঁজে বের করা।”
“কিন্তু আনা নিজেই তো নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন!”
“না ক্যাপটেন কোহেন, আনা আসলে নিরুদ্দেশ হননি। ওঁর নিরুদ্দেশ হওয়ার পুরো ব্যাপারটাই আসলে সাজানো।”
“হোয়াট!”
এজেন্ট Vaan-এর কথায় জেসন প্রচণ্ড অবাক হয়।
“তাহলে আনা এখন কোথায় আছেন?”
“মাপ করবেন। সেই তথ্যটা আমি এই মুহূর্তে আপনাকে জানাতে পারছি না।”
এজেন্ট Vaan বলল, “তবে এটুকু বলতে পারি যে, উনি সুরক্ষিত আছেন এবং মার্কিন সরকারের নজরদারিতেই আছেন।”
“কিন্তু… কিন্তু… আনার এই সাজানো অন্তর্ধানের প্রয়োজন হল কেন?”
“বলছি। আসলে রাশিয়া আর চায়নার ইনটেলিজেন্স সংস্থাগুলো আঁচ পেয়ে গিয়েছিল যে, আমেরিকা গোপনে, কোনো নতুন ধরনের অস্ত্র তৈরি করার চেষ্টা করছে। তাই তাদের নজর এড়াতেই ঠিক করা হয় যে, বোমা অর্থাৎ আনা এবং তার ডিটোনেটর অর্থাৎ ওই চিরুনি, দুটোকেই গায়েব করা হবে। আসলে রাষ্ট্রসংঘের ওমেগা-৯১ নামক গোপন রেজ়োলিউশনের সিগনেটরি হিসেবে, আমেরিকা সিকিউরিটি কাউন্সিলকে অন্ধকারে রেখে এরকম কোনো গবেষণা করতেই পারে না, তাদের সেই এক্তিয়ার নেই। তাই রাশিয়া বা চায়না আবেদন করলেই আমেরিকাকে নিজের গবেষণাকেন্দ্রগুলিকে SRI-এর কাছে তদন্তের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হত। আর তাহলেই ওই গোপন প্রোজেক্টের কথা জানাজানি হয়ে যেত। কিন্তু সেটা যাতে না হয়, সেজন্য ইভলিন দারুণ একটা পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আনা, লুনার মিশনে গিয়ে চাঁদের মাটি থেকে নিরুদ্দেশ হবে। আর তার অনুসন্ধানে চাঁদে ইনভেস্টিগেটরদের একটা টিম পাঠানো হবে। এরা আনাকে খুঁজে পাবে না। কিন্তু তার বদলে চাঁদের আল-বিরুনি ক্রেটার থেকে খুঁজে পাবে একটা রহস্যময় জিনিস, যার নামকরণ করা হবে ‘আল-বিরুনি আর্টিফ্যাক্ট’। ওই জিনিসটাকে প্রোজেক্ট করা হবে কোনো ভিনগ্রহী অর্থাৎ এলিয়েন সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে। জিনিসটা যে কী, সেটা অনুমান করতে পারছেন নিশ্চয়ই।”
“দ্য সাই কম!”
জেসন অস্ফুটস্বরে বলল, “ঠিক তা-ই।”
এজেন্ট Vaan বলল, “ওটাকে ডাকা হবে ‘আল-বিরুনির চিরুনি’ নামে। ‘এলিয়েন সভ্যতার নিদর্শন’ হওয়ার কারণে ওটার ‘অলৌকিক শক্তি’র জন্য আমেরিকাকে কোনোভাবে দায়ী করা যাবে না। রাশিয়া আর চায়না যখন সেই রহস্যময় এলিয়েন সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকবে, সেই অবসরে আমেরিকা প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর চূড়ান্ত পর্বের কাজ শেষ করে ফেলবে। আর আমেরিকান গভর্নমেন্টের এই পরিকল্পনা যদি সত্যিই সফল হয়, তাহলে সেটা কিন্তু, মার্কিন জাতিসহ সারা পৃথিবীর মানবজাতিকেই একটা গভীর সংকটের মধ্যে ঠেলে দেবে। সো উই নিড ইয়োর হেল্প। এই মুহূর্তে একমাত্র আপনি পারেন এই সংকটের হাত থেকে সকলকে বাঁচাতে।”
“কিন্তু কীভাবে?”
জেসন কিছুটা অসহায়ভাবে বলল, “বলছি। আপনার সহকর্মী ডক্টর আইশা রেয়েস আর কিছুক্ষণ পরেই আল-বিরুনি ক্রেটার থেকে উঠে আসবেন। ওঁর হাতে থাকবে সেই চিরুনিটা। উনি আপনাকে বলবেন যে, ওটা উনি ওই ক্রেটারের মধ্যে পেয়েছেন।”
“মাই গড! আইশা! তার মানে, ও কি…”
“ইয়েস, শি ইজ় অ্যান এন্ড অ্যাকটিভ মেম্বার অব প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস।”
“কান্ট বিলিভ দিস!”
“ওয়েল, ট্রুথ ইজ় স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন, ইউ সি।”
এজেন্ট Vaan বললেন, “যা-ই হোক, আপনাকে কী করতে হবে, সেটা শুনুন। আইশা আপনাকে জিনিসটা দেখালে আপনি বিস্ময় প্রকাশ করবেন। খেয়াল রাখবেন, আপনার অভিনয়টা যেন নিখুঁত হয়। আপনি আইশাকে বলবেন যে আপনার ধারণা জিনিসটা হয়তো কোনোভাবে আনার সঙ্গে লিংকড। তাই ওটা অবিলম্বে স্পেসশিপে নিয়ে গিয়ে কমান্ডার গ্যালওয়ে আর অন্য ইনভেস্টিগেটরদের দেখানো উচিত। আইশা আপনার কথা মেনে নেবেন আর আপনাকেই অনুরোধ করবেন জিনিসটা ক্যারি করার জন্য।”
“কিন্তু…”
জেসন সন্দিগ্ধ স্বরে বলল, “আইশা যদি সত্যিই গভর্নমেন্টের স্পাই হয়ে থাকে তাহলে সে ওই জিনিসটা নিজের কাছে না রেখে আমার হাতে তুলে দেবে কেন?”
“টু মেক থিংস লুক অথেন্টিক।”
এজেন্ট Vaan বলল, “আপনার সঙ্গে প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর কোনো ডাইরেক্ট কানেকশন নেই। কাজেই আপনার মতো একজনের হাত দিয়ে জিনিসটা প্রকাশ্যে এলে, ওটার সঙ্গে প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর যে কোনো লিংক থাকতে পারে, সেটা কেউ সন্দেহ করবে না।”
“বুঝলাম। বাট নাউ হোয়াট অ্যাম আই সাপোজ়ড টু ডু?”
“দ্যাট’স ইজ়ি। আপনি আইশার প্রস্তাবে রাজি হবেন। অর্থাৎ ওঁর থেকে চিরুনিটা নেবেন। কিন্তু স্পেসশিপে পৌঁছোনোর আগেই ওটা পালটে ফেলবেন। তবে খেয়াল রাখবেন, আইশা যেন ঘুণাক্ষরেও ব্যাপারটা টের না পায়।”
“পালটে ফেলব মানে?”
জেসন আকাশ থেকে পড়ল, “কীসের সঙ্গে পালটাব?”
“আপনার স্পেসসুটের কোমরের কাছে যে পকেটের মতো চেম্বারটা রয়েছে, তার মধ্যেই ওই চিরুনিটার একটা ডুপ্লিকেট রাখা আছে।”
এজেন্ট Vaan-এর নির্দেশমতো চেম্বারটা হাতড়াতেই জেসন জিনিসটা পেয়ে গেল।
“মাই গুডনেস! এটা এখানে কীভাবে এল!”
“আমি রেখেছি।”
এজেন্ট Vaan বলল, “সামান্য একটু হাতের কাজ আর কী।”
“কিন্তু… কিন্তু…”
জেসন হতভম্ব হয়ে বলল, “আপনি এই রেপ্লিকাটা বানালেন কীভাবে? আপনি কি আসল চিরুনিটা দেখেছেন?”
“দুঃখিত, ক্যাপটেন কোহেন।”
এজেন্ট Vaan বলল, “আপনার এই প্রশ্নের উত্তরটা এই মুহূর্তে দিতে পারছি না।”
তারপর একটু থেমে, আবার বলল, “এবার প্রস্তুত হোন। আইশা ইজ় অ্যাসেন্ডিং।”
জেসন অবাক হয়।
আশ্চর্য! যেখানে ও নিজে আইশার কাছাকাছি থেকেও ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না, সেখানে এই লোকটা স্পেসশিপে বসেই আইশার মুভমেন্টের ওপর নজর রাখছে কীভাবে?
সবটাই ওর চালাকি নয় তো?
না, তা নয়।
কারণ জেসনকে চমৎকৃত করে, সত্যিই ক্রেটারের মধ্যে থেকে উঠে এল আইশা।
“বেস্ট অব লাক।”
জেসনের কমিউনিকেশন ডিভাইসের মধ্যে থেকে ভেসে এল এজেন্ট Vaan-এর স্বর। আর তারপরেই লাইনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল।
আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওর ডিভাইসে আইশার চ্যানেলটা আবার সক্রিয় হয়ে উঠল।
জেসন দেখল, আইশা ধীর পদক্ষেপে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
“বুঝতে পারছি যে, আমার ওপর খুব রেগে গিয়েছিস।”
চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে ভেসে এল আইশার মোলায়েম স্বর।
“সেটাই স্বাভাবিক নয় কি?”
“তা বটে। তবে আমি ক্রেটারের নীচে যেটা খুঁজে পেয়েছি, সেটা দেখলে তুই অবাক হয়ে যাবি। আমার মনে হয় এটা আনার অন্তর্ধান রহস্যের একটা বড়ো ক্লু।”
জেসন এজেন্ট Vaan-এর কথাগুলো মনে করল। ওকে এবার অভিনয় শুরু করতে হবে।
“রিয়েলি?”
জেসন অবাক স্বরে বলল, “তা জিনিসটা কী?”
আইশা মুখে কিছু না বলে নিজের ডান হাতটা তুলে ধরল।
জেসন দেখল, আইশার হাতে ধরা রয়েছে একটা মাঝারি আকারের সোনালি রঙের ধাতব চিরুনি!
৩
লেকসাইড টাওয়ারস,
সেক্টর ফাইভ, সল্ট লেক
কলকাতার তথ্যপ্রযুক্তি তালুকের একপ্রান্তে, একটা বিশাল লেকের ধারে এই কর্পোরেট বিল্ডিংটা অবস্থিত। পনেরোতলা এই বাড়িটার বিভিন্ন ফ্লোরে রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির অফিস। তবে এগুলোর সব ক-টাই যে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা, তা কিন্তু নয়। যেমন এই বিল্ডিং-এর নাইন্থ ফ্লোরের অফিসটা হল কায়া ফার্মাসিউটিক্যালসের। এটি হল পূর্ব ভারতের অন্যতম নামি ফার্মা কোম্পানি।
ডক্টর অনির্বাণ চক্রবর্তী এই সংস্থারই একজন সিনিয়র সায়েন্টিস্ট। সে নিজের ওয়ার্ক স্টেশনে কাজ করছিল। এমন সময় অফিসের বেয়ারা জামাল এসে বলল, “স্যার, আপনি কি কিছু অর্ডার করেছিলেন? আপনার নামে রিসেপশনে একটা প্যাকেজ এসেছে।”
অনির্বাণ ভুরু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছু অর্ডার করেছে বলে মনে করতে পারল না। ও জামালের দিকে চেয়ে বলল, “ঠিক আছে। তুমি যাও, আমি ওটা দেখে নিচ্ছি।”
জামাল চলে গেলে পরে অনির্বাণ ধীরেসুস্থে নিজের হাতের কাজ সেরে নিয়ে, রিসেপশনে গেল। সেখানে গিয়ে দেখল যে, ওর নামে একটা ব্রাউন পেপারে মোড়া প্যাকেট এসেছে। ওপরে নামি ই-কমার্স সংস্থার লোগো। রিসেপশনিস্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনির্বাণ প্যাকেটটা নিয়ে নিজের ওয়ার্কস্টেশনে ফিরে এল। এখানকার ওয়ার্কস্টেশনগুলো আসলে একেকটি প্রাইভেট কেবিনের মতো। প্রত্যেক সিনিয়র সায়েন্টিস্টের জন্যই ওরকম একটি করে কেবিন অ্যালটেড রয়েছে। আগে অবশ্য সকলকে একটা জেনারেল ওয়ার্কস্টেশনই শেয়ার করতে হত। তবে ইদানীং সিনিয়র সায়েন্টিস্টদের জন্য কোম্পানি এই প্রাইভেট ওয়ার্কস্টেশনগুলো বরাদ্দ করেছে।
কেবিনের একদিকে রয়েছে চেয়ার, টেবিল, বই ও ফাইলপত্র রাখার ক্যাবিনেট ইত্যাদি। আর অন্যদিকে রয়েছে ল্যাব টেবিল, তার ওপর সাজানো বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সরঞ্জাম ও আধুনিক যন্ত্রপাতি। টেবিলের একপাশে রয়েছে কেমিক্যাল রিএজেন্ট এবং টেস্টটিউব, বিকার প্রভৃতি সরঞ্জাম রাখার দুটি আলাদা ক্যাবিনেট। দেয়ালে টাঙানো আছে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক চার্ট ইত্যাদি।
অনির্বাণ চেয়ারে বসল। তারপর টেবিলের ওপর খোলা ল্যাপটপটা একপাশে সরিয়ে রেখে, হাতের প্যাকেজটা টেবিলের ওপর রাখল।
প্যাকেজের ওপর অনির্বাণের নাম ও তার অফিসের ঠিকানা লেখা।
আশ্চর্য! এই প্যাকেজটা ওকে কে পাঠাল?
ও তো ইদানীং অনলাইন কিছু অর্ডার করেনি।
“তবে কি… হতেও পারে…”
অনির্বাণ মনে মনে ভাবল, ‘সতর্ক থাকা ভালো।’
ও এবার টেবিল সংলগ্ন ড্রয়ারগুলির মধ্যে সব চেয়ে ওপরের ড্রয়ারটা টেনে খুলে ফেলল। তারপর তার ভিতর থেকে বের করে আনল একটা যন্ত্র। ধাতব যন্ত্রটা দেখতে অনেকটা কাঠির মাথায় আলুর দমের মতো। ওটার ‘আলু’ অর্থাৎ মাথাটাতে ছোটো ছোটো আলো বসানো রয়েছে। অনির্বাণ ওটার ‘কাঠি’ অর্থাৎ হাতলের গোড়ায় একটা ছোট্ট সুইচ টিপে যন্ত্রটাকে সক্রিয় করতেই, ‘আলু’র গায়ের সব ক-টা আলো জ্বলে উঠল। অনির্বাণ এবার যন্ত্রটা প্যাকেজের গায়ে ঠেকাল। সবুজ আলোগুলো একবার ব্লিংক করে উঠল, কিন্তু আর কিছু ঘটল না।
অনির্বাণ একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল।
যাক, প্যাকেজটায় কোনো বিষাক্ত পদার্থ অথবা বিস্ফোরক নেই।
আর সেটা না-থাকার সম্ভাবনাই ছিল ৯৯.৯৯%।
কারণ অনির্বাণের অনেক শত্রু থাকলেও তারা কেউই তার এই পরিচয় কিংবা কর্মক্ষেত্রের কথা জানে না।
তারা যাকে চেনে, সে হল SRI-এর এজেন্ট Vaan! কিন্তু সেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিক্রেট এজেন্টটিই যে কলকাতার একটি ফার্মা কোম্পানিতে গবেষক হিসেবে চাকরি করে—এটা বোধহয় তাদের কল্পনারও অতীত। আসলে কায়া ফার্মার এই চাকরিটা এজেন্ট Vaan-এর ‘কভার’। বা বলা ভালো যে এটাই ওর বাস্তবিক পরিচয়। যার কথা জানে, কেবল SRI-এর হাইকমান্ড এবং কায়া ফার্মার টপ ম্যানেজমেন্টের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। একজন বিজ্ঞানী থেকে অনির্বাণ কীভাবে একটি আন্তর্জাতিক গুপ্তচর সংস্থার সিক্রেট এজেন্ট হয়ে উঠল, সেটা অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কাহিনি। কখনও সুযোগ হলে সেই কাহিনিও শোনানো যাবে। তবে আপাতত বর্তমান কাহিনিতেই মনোনিবেশ করা যাক।
প্যাকেজটা যে ওকে হত্যার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়নি, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হতেই অনির্বাণ কাঁচি দিয়ে প্যাকেজের মুখটা কেটে ফেলল। তারপর খুব সাবধানে ওটার ভিতরের জিনিসগুলো বাইরে বের করে আনল।
একটা নীল রঙের বাক্সো আর একটা চিঠি।
বাক্সোটা কিন্তু কোনো সাধারণ বাক্সো নয়। অনির্বাণ জানে যে, এই ধরনের বাক্সোগুলো সাধারণত সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত হয়। এগুলো বায়ুশূন্য তো বটেই, এ ছাড়া যে-কোনো ধরনের ম্যাগনেটিক কিংবা ইলেকট্রিক ফিল্ড-এর প্রভাব থেকেও মুক্ত। এমনকি এগুলো তেজস্ক্রিয়তা প্রতিরোধেও সক্ষম। সাধারণত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেন্সিটিভ কোনো জিনিস পাঠানোর জন্য এই ধরনের বাক্সো ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু তাকে, অর্থাৎ কায়া ফার্মার নিরীহ বিজ্ঞানী ডক্টর অনির্বাণ চক্রবর্তীকে এরকম জিনিসকে পাঠাতে পারে?
তবে কি এই প্যাকেজ ডক্টর অনির্বাণকে নয়, বরং এজেন্ট Vaan-কে উদ্দেশ করেই পাঠানো?
কী আছে এই বাক্সে?
বাক্সের সঙ্গে থাকা চিঠিটা পড়লে হয়তো সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। এই মনে করে অনির্বাণ চিঠিটা পড়তে আরম্ভ করল।
বাংলায় লেখা চিঠিটার বয়ান অনেকটা এইরকম—
প্রিয় এজেন্ট Vaan,
আমার মধ্যে সাইকিক ক্ষমতার উন্মেষের ফলে আমি এখন মানুষের বলা যে-কোনো ভাষাতেই কথা বলতে অথবা লিখতে পারি। তাই আপনাকে এই চিঠি আপনার মাতৃভাষা বাংলাতেই লিখলাম। আপনি আমার অনুরোধে সাড়া দিয়ে যে অসাধ্যসাধন করেছেন, বলতে পারেন তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যই এই চিঠি।
আপনি যা করেছেন, তার জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। সঠিক সময়ে ক্যাপটেন জেসন কোহেনকে কনভিন্স করে ওকে দিয়ে চিরুনিটা বদলে না ফেললে ওটা হয়তো এতক্ষণে আমেরিকান গভর্নমেন্টের হেপাজতে থাকত। আর তার পরিণামে হয়তো হিরোশিমা ও নাগাসাকির চেয়েও ভয়ংকর কিছু হতে পারত। আনা সেটা চায়নি। আর তাই ও চিরুনিটা সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করে। আনা সোয়ার্জকফই মার্কিন কর্তৃপক্ষকে বোঝায় যে ‘সাই কম’-এর কথাটা জানাজানি হয়ে গেলে আমেরিকার বিপদ। চায়না ও রাশিয়া তখন চাপ দেবে প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। ওমেগা-৯১-এর সিগনেটরি হিসেবে আমেরিকা বাধ্য হবে সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে। কিন্তু ‘সাই কম’-কে যদি একটা এলিয়েন আর্টিফ্যাক্ট হিসেবে প্রেজ়েন্ট করা যায়, তাহলে আমেরিকা এইসব জটিলতার হাত থেকে রক্ষা পাবে। আর প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুসও চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। মার্কিন কর্তারা আনার কথা মেনে নেয়। ওরাই তখন চাঁদের মাটি থেকে আনার অন্তর্ধান আর ‘সাই কম’-এর ‘আল-বিরুনির চিরুনি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্ল্যান বানায়। কিন্তু তারা জানতে পারেনি যে, আনা নিজেও গোপনে একটা প্ল্যান বানিয়েছিল। আর তার সেই প্ল্যানের লক্ষ্য ছিল ‘সাই কম’-কে চিরতরের জন্য আমেরিকান গভর্নমেন্টের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া। আনার ওই গোপন পরিকল্পনার একমাত্র সঙ্গী ছিলাম আমি। প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর সব সদস্যের মধ্যে একমাত্র আমিই ছিলাম আনার স্টুডেন্ট। ও জানত যে, মরে গেলেও আমি কখনও ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না। আর তাই ও আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে নিজের গোপন পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ওর পরিকল্পনা সফল করার দায়িত্বও ও আমাকে দিয়েছিল। আর আমি যে ওকে নিরাশ করিনি, সেটা আপনার চেয়ে ভালো আর কে জানে! অবশ্য এটাও ঠিক যে আপনার সাহায্য না পেলে হয়তো আনার দেওয়া দায়িত্বটা আমি পালন করতে পারতাম না। আপনার কথায় কনভিন্সড হয়েই জেসন আসল চিরুনিটাকে নকল চিরুনির সঙ্গে বদলে ফেলেছিল। কিন্তু সেই আপনিই যে ও স্পেসশিপে পৌঁছোনোর পরে ওর স্পেসসুটের পকেট থেকে আসল চিরুনিটা নিয়ে নকল চিরুনি রেখে দিয়েছেন, সেটা বেচারা জেসন স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। জেসনের কাছ থেকে জিনিসটা সরিয়ে আপনি আমার হাতে তুলে দেওয়ার পরে, আমি একরকম বাধ্য হয়েই ওটা নিজের ওপর প্রয়োগ করি। আসলে আনার নির্দেশ ছিল যে, জিনিসটা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি যেন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু আমাকে কি এর মধ্যেই এমন কোনো গোপন জায়গায় সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, যেখানে আমার মানসিক তরঙ্গ পৌঁছোতে সক্ষম ছিল না? তাই আমি নিজের সাইকিক ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটানোর জন্য চিরুনিটা নিজের ওপর প্রয়োগ করি। এর ফল যে আমার আশানুরূপ হয়েছিল, তা-ই নয়, বরং আমার প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। চিরুনির প্রভাবে আমার মানসিক ক্ষমতার মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে, আমি এখন যে-কোনো মানুষের চিন্তা ও ভাষা পড়তে এবং বুঝতে পারি। এমনকি সেই ভাষায় কথাও বলতে পারি। তা সেই মানুষটি আমার থেকে যত দূরেই থাকুন-না কেন। এই সুপিরিয়র সাইকিক এবিলিটির সাহায্যে আমি আনাকে সহজেই ট্র্যাক করতে পেরে যাই। ওকে রাখা হয়েছে আমেরিকার মূল ভূখণ্ডের বাইরে, আটলান্টিক মহাসাগরের এক নির্জন দ্বীপে। নিউম্যান’স আইল্যান্ড নামে ওই দ্বীপের মাটির নীচে রয়েছে মার্কিন সেনার একটি গোপন রিসার্চ ফেসিলিটি। বর্তমানে ওটি প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ওখানকার ডিটেনশন সেন্টারেই আনাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আপনার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে যে, আনার মতো অ্যাসেটকে এভাবে আটকে রাখা হয়েছে কেন।
উত্তরটা জানলে চমকে উঠবেন।
আসলে চাঁদের আল-বিরুনি ক্রেটার থেকে উদ্ধার-হওয়া ‘সাই কম’টা যখন নকল বলে বোঝা যায়, তখন প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর ডিরেক্টর ইভলিন ক্রাউজ জেসনের গ্রেফতারির ব্যবস্থা করেন। কারণ জেসনই তো জিনিসটা মিশন কমান্ডারের হাতে তুলে দিয়েছিল। তাই ইভলিন নিশ্চিত ছিলেন যে, জেসনই ওঁকে নকল চিরুনিটা গছিয়েছে। আসল চিরুনিটা নিশ্চয়ই জেসনের কাছেই আছে। এরকমটা যে ঘটতে পারে, সেটা আনা আগে বুঝতে পারেনি। জেসনের মতো ক্লিন রেকর্ডসম্পন্ন একজন NASA নভশ্চরের বিরুদ্ধেও যে কেউ অন্তর্ঘাতের অভিযোগ আনতে পারে, সেটা আনার কল্পনার অতীত ছিল। এরকম হবে, অনুমান করতে পারলে আনা হয়তো জেসনকে ইনভল্ভই করত না। ওর সব স্টুডেন্টের মধ্যে জেসন কোহেন নামের এই ইহুদি তরুণ ছিল আনার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তাই জেসনের বিপদ দেখে ও আর চুপ করে থাকতে পারেনি। ‘সাই কম’ নিখোঁজ হওয়ার সব দায় ও নিজের কাঁধে তুলে নেয়। যদিও জিনিসটা কোথায় আছে, সেই ব্যাপারে ও মার্কিন কর্তাদের কাছে মুখ খোলেনি। আনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তো তাকে টর্চার করে মুখ খোলানোর চেষ্টা করা হত। কিন্তু আনা সোয়ার্জকফ তো প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর প্রাইজ়ড ক্যাসেট। তার সঙ্গে তো ওরকম করা চলে না। তাই ইভলিন সিদ্ধান্ত নেয় অন্যভাবে ওর থেকে কথা বের করার। উনি আনাকে নিউম্যান’স আইল্যান্ড-এর ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তারপর আনাকে বাদ দিয়ে বাদ দিয়ে প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর অন্য যে ছয়জন প্রথম শ্রেণির সাইকিক রয়েছেন, তাঁদেরকেও নিউম্যান’স আইল্যান্ডে পাঠান। এদের কাজ হল আনার মানসিক প্রতিরক্ষা প্রাচীর ভেদ করে তার মনের গভীর থেকে ‘সাই কম’ এবং সেই বিষয়ে আনার গোপন পরিকল্পনা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য বের করে আনা। তবে আনার সাইকিক ক্ষমতা ওই ছয়জনের তুলনায় এতটাই বেশি যে ওরা সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করেও এ পর্যন্ত ওর ওর মেন্টাল ডিফেন্স ভাঙতে পারেনি। কিন্তু আনা ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। সে আর খুব বেশি দিন এদের আটকে রাখতে পারবে না। যে মানসিক তরঙ্গের মাধ্যমে সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, সেটা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। আনা নিজেও তা বুঝতে পারছে। তাই ও আমাকে বলেছে যে, ওই চিরুনিটা নিয়ে আমি যেন আমেরিকা ছেড়ে পালিয়ে যাই। কারণ সাইকিকদের ওই টিম একবার আনার মনের মধ্যে ঢুকতে পারলেই ওর সব পরিকল্পনার কথা জেনে যাবে। ওরা জেনে যাবে যে প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর সব চেয়ে মূল্যবান অ্যাসেট হয়েও আনা আসলে ওই প্রকল্পের ঘোর বিরোধী। সে আসলে মনে করে যে, এই প্রোজেক্ট মার্কিন সরকারের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য কায়েমের স্বপ্নকে সফল করলেও সংকটে ফেলে দেবে সমগ্র মানবজাতিকে। বাদ যাবে না মার্কিন নাগরিকেরা। আর তাই এই প্রকল্প ব্যর্থ করার জন্য আনা আমার ও আপনার সাহায্য নিয়ে ওই মারাত্মক চিরুনিটা সরিয়ে ফেলেছে। সেই তথ্যটাও সাইকিকদের টিম মারফত ইভলিনের কাছে পৌঁছে যাবে। আপনি তো SRI-এর মতো আন্তর্জাতিক তদন্তকারী সংস্থার এজেন্ট। ফলে আপনি ওর নাগালের বাইরে। তা ছাড়া আপনার হোয়্যারঅ্যাবাউটও ওর অজানা। ফলে চাইলেও আপনার কাছে পৌঁছোতে পারবে না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা সেরকম নয়। আমি মার্কিন নাগরিক, মার্কিন সরকারি সংস্থার কর্মী। ফলে আমার নাড়িনক্ষত্র সব ওর জানা। তাই ইচ্ছা করলেই ও আমাকে গ্রেফতার করাতে পারে। আর আমার কাছ থেকে চিরুনিটাও কেড়ে নিতে পারে। আমি তাই আনার পরামর্শমতো আমেরিকা থেকে পালিয়ে এসেছি। আর এখন আক্ষরিক অর্থেই দেশে দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু মার্কিন গুপ্তচর সংস্থাগুলোর লম্বা হাত, যে-কোনোদিনই আমায় পাকড়াও করতে পারে। তাই আমি ধরা পড়লেও চিরুনিটা যাতে ওদের হাতে না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। আর তাই, এই পৃথিবীতে আনার ও আমার যে একমাত্র বন্ধুটিকে আমরা এই বিষয়ে বিশ্বাস করতে পারি, তারই হাতে ওই চিরুনিটা তুলে দিলাম। পারলে সে-ই পারবে জিনিসটা মার্কিন গুপ্তচরদের হাত থেকে রক্ষা করতে।
আমাদের এই বন্ধুটি যে কে, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আপনার সঙ্গে কথা না বলেই আপনার কাঁধে এত বড়ো দায়িত্বটা চাপিয়ে দিলাম। আসলে এ ছাড়া আমার হাতে আর কোনো উপায় ছিল না। সম্ভব হলে ক্ষমা করে দেবেন।
শুভেচ্ছাসহ
ডক্টর আইশা রেয়েস
দীর্ঘ চিঠিটা পড়া শেষ করে অনির্বাণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর সেটা ভাঁজ করে পেপারওয়েটের নীচে চাপা দিয়ে রেখে, নীল বাক্সোটার প্রতি মনোনিবেশ করল। বাক্সোটায় বিশেষ ধরনের সেফটি লক লাগানো। এই লক খোলার উপায় সাধারণ মানুষের অজানা। তবে অনির্বাণের মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিক্রেট এজেন্টের পক্ষে ওটা খোলা কঠিন নয়।
অনির্বাণ অন্যমনস্কভাবেই লকটা খুলে ফেলল। তারপর বাক্সের ডালাটা সরাতেই বাক্সের ভেতরে ভেলভেটে মোড়া খোপের মধ্যে রাখা একটা সোনালি রঙের ধাতব বস্তু ঝলমল করে উঠল।
দ্য সাই কম… আল-বিরুনির চিরুনি।
৪
“দিস ইজ় টু মাচ, মাই বয়!” SRI সর্বাধিনায়ক প্রফেসার জিওফ্রে পামার বললেন, “উই কান্ট টেক অন দি ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা!”
“বাট স্যার… দিস ইজ় নট দ্য ফার্স্ট টাইম!”
এনক্রিপ্টেড আর সিকিয়োরড টেলিফোন লাইনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল একটি দৃঢ় কণ্ঠস্বর।
প্রফেসার পামার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
এই ছেলেটাই কোনদিন ওঁকে ঠিক বিপদে ফেলবে। SRI ফিল্ড অপারেটিভদের মধ্যে সকলেই কমবেশি দুঃসাহসী। কিন্তু সিংহের সঙ্গে টক্কর নেওয়ার মতো কলিজা, যা এই ছেলেটার মধ্যে আছে, তা আর কারও মধ্যে নেই। ওকে এবার কঠিন হাতে শাসন করা দরকার। নয়তো নিজের সঙ্গে সঙ্গে পুরো অর্গানাইজ়েশনকেই বিপদের মধ্যে ফেলে দেবে।
“নাউ লুক হিয়ার এজেন্ট Vaan।”
প্রফেসার পামার কঠিনস্বরে বললেন, “এর আগেও আমরা আমেরিকার বিভিন্ন রিসার্চ ফেসিলিটিতে হানা দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের কাছে প্রপার অথরাইজ়েশন ছিল। ওইসব কেসে সিকিউরিটি কাউন্সিলের কোনো না কোনো মেম্বার স্টেট ওই গবেষণাকেন্দ্রগুলি সম্পর্কে আমাদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল। উই হ্যাভ ওনলি রেসপন্ডেড টু দ্যাট। ওটা আমাদের করতেই হত। রাষ্ট্রসংঘের সিক্রেট ওমেগা ৯১ রেজ়োলিউশন অনুসারে সেটা আমাদের দায়িত্ব এবং অধিকার দুটোর মধ্যেই পড়ে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে, যেখানে সিকিউরিটি কাউন্সিলের কোনো মেম্বার স্টেট কোনোরকম অভিযোগ জানায়নি, সেখানে আগ বাড়িয়ে, নিউম্যান’স আইল্যান্ড-এর মতো একটি রেস্ট্রিক্টেড রিসার্চ ফেসিলিটিতে, আমরা অপারেশন চালাতে পারি না। সেই এক্তিয়ার SRI-এর নেই। সিকিউরিটি কাউন্সিল কখনোই এই ধরনের অপারেশন অনুমোদন করবে না।
“কিন্তু স্যার, SRI-এর তো কাজই হল মানবজাতিকে সংকটাপন্ন করতে পারে এমন সমস্ত রিসার্চ অ্যাকটিভিটিকে নিউট্রালাইজ় করা। তাহলে প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর বিরুদ্ধে আমরা অ্যাকশন নিচ্ছি না কেন?”
“তার কারণ, আমেরিকা এই প্রকল্পটা এখনও পর্যন্ত সবার থেকে গোপন রাখতে সফল হয়েছে। কোনো দেশের ইনটেলিজেন্স বিভাগই এ পর্যন্ত ওই প্রোজেক্টের বিষয় কিছু জানতে পারেনি। এমনকি আমরাও কিছু জানতে পারতাম না, যদি না আনা সোয়ার্জকফ আর আইলা রেয়েস তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।”
“কিন্তু এখন যখন SRI বিষয়টা জেনেই গিয়েছে তাহলে এখনও কোনো অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছে না কেন?”
অনির্বাণ কিছুটা অধৈর্যভাবে বলল, “তার কারণ…”
প্রফেসার পামার শান্তস্বরে বললেন, “কোনো রিসার্চ প্রোজেক্টকে ‘threat to humanity’ দাগিয়ে না-দেওয়া পর্যন্ত আমরা তার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারি না। আর এই ‘দাগিয়ে দেওয়া’র অধিকার রয়েছে কেবলমাত্র সিকিউরিটি কাউন্সিলের পাঁচটি পারমানেন্ট মেম্বার স্টেট-এর কাছে। তাই তাদের দিক থেকে যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনো ইনিশিয়েটিভ নেওয়া হচ্ছে…”
“অর্থাৎ আমাদের হাত-পা বাঁধা।”
অনির্বাণ বলল, “অথচ আমাদের যেটা করার কথা, সেটা করতে গিয়েই আনা আর আইশা বিপদে পড়েছেন। আর আমরা ওদের কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারছি না।”
প্রফেসার আমার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “দুর্ভাগ্যজনক হলেও, এটাই সত্যি!”
“ভেরি ওয়েল, স্যার। দেন আই উইল টেক ইয়োর লিভ। আমি এক মাসের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড হওয়ার অনুমতি চাইছি।”
অনির্বাণের কথা শুনে প্রফেসার পামার চমকে উঠলেন। ছেলেটা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ অর্থাৎ অজ্ঞাতবাসে যাওয়ার অনুমতি চাইছে। এর অর্থ এই সময়টুকুর জন্য ও সম্পূর্ণ বেপাত্তা হয়ে যাবে। ওকে কোনো অফিশিয়াল মিশনে ইনভল্ভ করা যাবে না। এমনকি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করাও যাবে না। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে, ফিল্ড অপারেটিভদের পার্সনাল ইশ্যু সেট্ল করার জন্য এই ধরনের ‘ছুটি’ মঞ্জুর করা হয়। যেমন গত বছরেই পেট্রোভা নামের একজন রাশিয়ান এজেন্টকে এরকম ‘ছুটি’ দিতে হয়েছিল। পেট্রোভার বয়ফ্রেন্ড আলি হাসানও ছিল SRI-এর ফিল্ড এজেন্ট। মিড্ল ইস্টের একটা অপারেশন চালানোর সময় একজন আরব শিল্পপতির ষড়যন্ত্রে হাসানের মৃত্যু হয়। কিন্তু লোকটার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ না-থাকায় তাকে শাস্তি দেওয়া যায়নি। তখন পেট্রোভা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে নিজে লোকটার ডেরায় ঢুকে তাকে মেরে আসবে। এইসব ক্ষেত্রে SRI নিজের এজেন্টদের সরাসরি সমর্থন করতে পারে না। আর তাই তখন তাদের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। পেট্রোভা আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে নিজের বয়ফ্রেন্ডের হত্যাকারীকে সাজা দিয়ে ফিরে এসেছিল।
কিন্তু প্রফেসার পামার বুঝতে পারছেন যে, অনির্বাণ ওরকম কোনো পার্সনাল ইশ্যু সেট্ল করার জন্য ছুটি চাইছে না। তার উদ্দেশ্য অতি ভয়ংকর। সে চাইছে নিউম্যান’স আইল্যান্ডে গিয়ে আনা সোয়ার্জকফকে উদ্ধার করে আনতে। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ হয়ে এ ধরনের রেসকিউ অপারেশন সে আগেও চালিয়েছে। তবে এবারের ব্যাপারটা অনেক বেশি বিপজ্জনক। নিউম্যান’স আইল্যান্ডে অভিযান চালানো আর সিংহের গুহায় মাথা গলানো আসলে একই ব্যাপার। ওখানে একবার ঢুকলে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। প্রফেসার পামার ঠিক করলেন, যেভাবে হোক, অনির্বাণকে আটকাতেই হবে।
৫
কলকাতার শহরতলির একটি অঞ্চল।
মূল শহরের মতো এখানেও গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য ছোটোবড়ো ফ্ল্যাটবাড়ি। ‘আকাশগঙ্গা’ হল ওরকমই একটি আবাসন। পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়িটা খুবই সাদামাটা। ছোটো ছোটো খুপরির মতো ফ্ল্যাটগুলোতে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের বাস। বাড়িটা খুব বেশি দিন আগে তৈরি হয়নি। বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাট এখনও ফাঁকা রয়েছে। এই তো গত সপ্তাহেই থার্ড ফ্লোরের একমাত্র খালি ফ্ল্যাটটাতেও বাসিন্দা চলে এল। ফার্স্ট ফ্লোরের অবনী চাটুজ্জে ওঁর শ্যালিকার জন্য ফ্ল্যাটটা কিনতে চেয়েছিলেন। প্রোমোটারের সঙ্গে দরদাম ঠিক করে কথাবার্তাও প্রায় একরকম পাকা করেই ফেলেছিলেন।
হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত!
কোথাকার কে এক ভদ্রমহিলা নাকি তিনগুণ দাম দিয়ে ফ্ল্যাটটা কিনে ফেলেন। অবনীবাবু মহিলাকে দূর থেকে দেখেছেন। ফরসা, লম্বা, সুশ্রী চেহারা। কথাবার্তা বাংলায় বললেও উচ্চারণে একটা সাহেবি ছাপ রয়েছে। যে কারণে অবনীবাবু আড়ালে মহিলাকে ‘মেমসাহেব’ বলে উল্লেখ করেন।
প্রোমোটার নান্টু দত্তকে অবনীবাবু বলেছিলেন, “বলি, এভাবে হুট করে একজন একলা মেমসাহেবকে ফ্ল্যাটটা বেচে দিলেন! সব দিক ভাবনাচিন্তা করে নিয়েছেন তো?”
“মানে?”
নান্টু দত্ত ভুরু কুঁচকে জানতে চেয়েছিল।
“না মানে বলছিলাম, আজকাল যেভাবে টেররিস্টরা ভদ্রলোক সেজে এখানে-ওখানে ঢুকে পড়ছে… নিউজ়ে তো মাঝেমধ্যেই দেখা যায়!”
“নান্টু দত্ত অত কাঁচা কাজ করে না।”
দামি বিদেশি সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে নান্টু দত্ত বলেছিল, “ওই ম্যাডামের ফুল ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে তবেই ডিল করেছি। নয়তো একজন একলা মেয়েছেলেকে কোনো খোঁজখবর না করে আপনাদের মাঝখানে বসিয়ে দেব কী করে?”
এরপর নান্টু দত্তর কাছ থেকেই অবনীবাবু জেনেছিলেন যে ওই মহিলা একজন গোয়ানিজ় খ্রিস্টান। নাম সামারা জোসেফ। একটি ই-কমার্স কোম্পানিতে চাকরি করেন। অবশ্য অবনীবাবু এরপরেও আশা ছাড়েননি। উনি মহিলার ওপর কড়া দৃষ্টি রেখে চলেছেন। যদি ওই মেমসাহেবের কোনো গণ্ডগোল বের করতে পারেন, তাহলে ফ্ল্যাটটা হয়তো এখনও বাগানো যেতে পারে। মহিলা যে এই ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দা হিসেবে একটু বেমানান, সেটা নান্টু দত্তও স্বীকার করেছে। এরকম একজন ‘মেমসাহেব’-এর স্থান হওয়া উচিত ছিল কলকাতার কোনো অভিজাত আবাসনে। শহরতলির এই ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়িতে ওঁকে একেবারেই মানায় না।
মহিলা সকাল ন-টা নাগাদ একটা লাল স্কুটিতে চেপে কাজে বেরিয়ে যান। আর ফেরেন রাত আটটা নাগাদ। আজও সেই সময়ই ফিরেছিলেন। অবনীবাবু সেটা নিজের ফ্ল্যাটের জানালা থেকে দেখেওছিলেন।
আর তখনই হঠাৎ লোডশেডিং!
অবনীবাবু জানালা থেকে সরে যেতে যেতে শব্দ শুনে বুঝলেন যে, ভদ্রমহিলা সিঁড়ির নীচে নির্ধারিত স্থানে নিজের বাহনটি রাখলেন। তারপর সিঁড়িতে হাই হিল জুতোর খটখট শব্দ তুলে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে চলে গেলেন। লোডশেডিং না হলেও মহিলাকে নিজের চারতলার ফ্ল্যাটে ওভাবে সিঁড়ি বেয়েই উঠতে হত, কারণ এই বাড়িতে লিফটের কোনো ব্যবস্থা নেই।
৬
অনির্বাণকে কিছুতেই আটকানো গেল না। প্রফেসার পামার প্রায় একরকম বাধ্য হয়ে তার ‘ছুটি’ অনুমোদন করলেন।
“স্যার, আমাকে কাইন্ডলি ব্যাপারটা ইনডিপেন্ডেন্টলি হ্যান্ডল করতে দিন।”
ও প্রথমে অনুনয়ের সুরেই প্রফেসার পামারকে বলেছিল, “আমি কথা দিচ্ছি, কোনো পরিস্থিতিতেই এর মধ্যে SRI-কে জড়াব না।”
“বেশ, কিন্তু তাহলেও SRI-এর ক্ষতি তুমি আটকাতে পারবে না।”
“ঠিক বুঝলাম না, স্যার।”
“Vaan, মাই বয়, তুমি ভুলে যাচ্ছ যে, SRI-এর ফিল্ড এজেন্টদের সকলেই হল এই অর্গানাইজ়েশনের ভ্যালুয়েব্ল অ্যাসেট। আর তোমার মতো একজন টপ অপারেটিভকে হারালে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।”
“আমাকে হারানোর প্রশ্ন উঠছে কেন, স্যার?”
“উঠছে, কারণ আমি বেশ বুঝতে পারছি যে, আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে তুমি আসলে কোথায় যেতে চাইছ।” প্রফেসার পামার উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠেন।
তারপর কিছুটা নরমভাবে বলেন, “আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াই সব সময়েই কঠিন। আর নিউম্যান’স আইল্যান্ডের মাটিতে সেই লড়াই জেতা কার্যত অসম্ভব। আমি জানি না, তুমি ওই অভিশপ্ত দ্বীপের বিষয়ে কতটা কী জানো, কিন্তু…”
“আমি সবটাই জানি, স্যার।”
অনির্বাণ বলেছিল, “দ্বীপটা আমেরিকার পূর্ব উপকূল থেকে সাড়ে চারশো কিলোমিটার দূরে, আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে অবস্থিত। জায়গাটা কোনো সাধারণ মানচিত্রে চিহ্নিত করা থাকে না। মার্কিন সরকার ওটাকে ‘মেরিটাইম এক্সক্লুশন জ়োন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ এখানে বহিরাগতদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দ্বীপটার আয়তন ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর চারপাশে রয়েছে খাড়া পাহাড় ও পাথুরে উপকূল। দ্বীপের উত্তর অংশে রয়েছে ঘন পাইন অরণ্য। আর তার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সুবিশাল সিক্রেট রিসার্চ ফেসিলিটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অপারেশন ব্ল্যাক ভল্ট নামে একটি টপ সিক্রেট প্রোজেক্টের অংশ হিসেবে মার্কিন সেনা ও নৌবাহিনী এই দ্বীপ অধিগ্রহণ করে। পরবর্তীকালে এটা DARPA-র অধীনে চলে যায়। DARPA-র ডিরেক্টর ইভলিন ক্রাউজ প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর দায়িত্ব নেওয়ার পরে, এই দ্বীপের রিসার্চ ফেসিলিটিকে সাইকিক রিসার্চের কাজে ব্যবহার করতে থাকেন। আর গবেষণাকেন্দ্রের পাশাপাশি ওখানে গড়ে তোলেন একটি ডিটেনশন সেন্টারও, যাতে প্রয়োজন হলে সেখানে সাইকিক শক্তিসম্পন্ন মানুষদের বন্দি করে রাখা যায়। যেমন রাখা হয়েছে আনা সোয়ার্জকফকে।”
“বাঃ! এত ইনফর্মেশন তো আমার কাছেও ছিল না। কিন্তু এই দ্বীপের আরও একটা নাম আছে, সেটা জানো কি? গ্লোবাল ইনটেলিজেন্স কমিউনিটির লোকেরা ওই জায়গাটার নাম দিয়েছে…”
“দ্য ব্ল্যাক হোল!”
প্রফেসার পামারের কথা শেষ হওয়ার আগেই অনির্বাণ বলে ওঠে, “গত ২৫ বছরে সাতটি দেশের সাতজন সিক্রেট এজেন্ট বিভিন্ন সময় এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ওই দ্বীপে হানা দিয়েছিল। তাদের আর কখনও দেখতে পাওয়া যায়নি। ওই দ্বীপ যেন ব্ল্যাক হোলের মতোই তাদের গ্রাস করে নিয়েছিল।”
“আর এটা জানার পরেও তুমি…”
“ইয়েস, স্যার। মরতে তো একদিন সবাইকেই হবে। তবে কোনো মহান উদ্দেশ্যপূরণের জন্য যদি প্রাণ যায়, তবে তো জীবন সার্থক। আনা সোয়ার্জকফ একজন মার্কিন নাগরিক হয়েও সমগ্র মানবজাতিকে সংকটমুক্ত করতে মার্কিন বিরোধিতা করে বিপদে পড়েছেন। মানবজাতির একজন সদস্য হিসেবেই আমি ওঁর পাশে থাকতে চাই। এতে যদি জীবন চলেও যায় তাহলে সেই জীবন সার্থক।”
এরপর প্রফেসার অনির্বাণকে আর বাধা দেননি। ওকে নিঃশর্তভাবে এক মাসের জন্য ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ হওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।
৭
অন্ধকারের মধ্যে সিঁড়ি ভেঙে তিনতলার ফ্ল্যাটে পৌঁছোতে সামারা বিশেষ অসুবিধা বোধ করল না। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল।
বিশ্রী গরম আর আর্দ্রতা। তার ওপর পাওয়ার কাটের জন্য পাখাও চলছে না। সামারা চোখ বুজে গভীরভাবে শ্বাস নিতে ও ছাড়তে লাগল। কিছুক্ষণ এভাবে কাটাতে পারলেই মন শান্ত হবে। আর মন শান্ত হলেই শরীরও শান্ত হবে। হাঁসফাঁস গরম আর আর্দ্রতা কোনোটাই তখন আর তাকে বিচলিত করতে পারবে না। মিনিট দশেক এভাবেই কেটে গেল। সামারা অনুভব করল যে, তার ভিতরটা শান্ত হয়ে এসেছে। ও ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। ঘর এখনও অন্ধকার। কিন্তু ওর চোখ অনেকটা সয়ে গেছে। আর তাই বিপরীত দিকের সোফায় বসে-থাকা ছায়ামূর্তিটাকে ও সহজেই দেখতে পেয়ে গেল।
ফ্ল্যাটের দরজা লক করা ছিল। তা সত্ত্বেও লোকটা ভিতরে ঢুকে এসেছে।
তার মানে…
অন্য কোনো মহিলা এই পরিস্থিতিতে হয়তো আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়তেন।
কিন্তু সামারার মধ্যে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। সে বরং আবার চোখ বুজে ধ্যানস্থ হল।
মিনিটখানেক পরে তার ঠোঁটের কোণে হালকা একটা হাসির আভাস দেখা গেল।
সে এবার ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল।
ছায়ামূর্তিটা এখনও একইভাবে একই জায়গায় বসে রয়েছে।
সামারা এবার মূর্তিটাকে লক্ষ করে বলল, “ওয়েলকাম, এজেন্ট Vaan, আমার সন্ধান পেয়ে গিয়েছেন, দেখছি।”
“থ্যাংক ইউ, ডক্টর রেয়েস।”
ছায়ামূর্তি অর্থাৎ অনির্বাণ বলল, “আপনার অ্যাপার্টমেন্টে অনুপ্রবেশ করার জন্য ক্ষমা চাইছি। কিন্তু এ ছাড়া উপায় ছিল না। আমার প্রকাশ্যে এখানে আসাটা, আমার এবং আপনার, দুজনের পক্ষেই ঝুঁকি হয়ে যেত।”
“ইট’স অল রাইট।”
সামারারূপী আইশা বলল, “কিন্তু আমার সন্ধান পেলেন কীভাবে?”
“ওয়েল, ইউ সি, আমার মধ্যেও এখন একটু একটু সাইকিক পাওয়ার ডেভেলপ করছে।” অনির্বাণ মুচকি হেসে বলল।
“তার মানে… আপনি… ওই চিরুনিটা…”
“ব্যবহার করেছি। এ ছাড়া উপায় ছিল না। না হলে আপনার কাছে পৌঁছোতে পারতাম না। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াটা খুবই জরুরি ছিল।”
“বাট দিস ইজ় ম্যাডনেস!”
আইশা বিচলিত স্বরে বলল, “প্রপার গাইডেন্স ছাড়া ওই জিনিসটা ব্যবহার করে আপনি মস্ত ঝুঁকি নিয়েছেন! আপনার বড়োসড়ো বিপদ হতে পারত। আর তা ছাড়া আমার সঙ্গে দেখা করারও কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি এ দেশে এসেছি কেবলমাত্র চিরুনিটা গোপনে ও নিরাপদে আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। সেই কাজ তো মিটে গিয়েছে। এবার দ্রুত এ দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। এক জায়গায় বেশি দিন থাকলেই মার্কিন ইনটেলিজেন্স-এর নজরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।”
অনির্বাণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আইশার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল। অন্ধকারে মেয়েটার মুখের ভাব বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ওর মস্তিষ্ক থেকে নির্গত মানসিক তরঙ্গের প্রবাহ অনির্বাণ অনুভব করতে পারছে। মেয়েটা যে কিছু একটা গোপন রাখতে চাইছে, সেটা বুঝতে অনির্বাণের অসুবিধে হচ্ছে না।
“ওয়েল, ডক্টর রেয়েস…”
“ইউ মে কল মি, আইশা।”
“ফাইন… ওয়েল আইশা, আপনি যেভাবে ফেক আইডেন্টিটি ক্রিয়েট করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে মুভ করছেন, নিজের জন্য কভার তৈরি করছেন, এগুলো কোনো সাধারণ নাগরিকের পক্ষে সম্ভব নয়। এসবের জন্য ফান্ডস অ্যান্ড আন্ডারওয়ার্ল্ড কনট্যাক্টস-এর প্রয়োজন হয়। আপনার মতো NASA-র একজন জুনিয়র অ্যাস্ট্রোনটের পক্ষে এগুলোর অ্যাকসেস পাওয়া তো সহজ নয়!”
“তার মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি?”
“আই অ্যাম কোয়ায়েট শিয়োর যে আপনার একজন প্রভাবশালী সাহায্যকারী রয়েছেন। আর আপনার মনের ভিতরে ঢুকে আমি যাতে তার পরিচয় জানতে না পারি, আপনি সেই বিষয়ে সতর্ক রয়েছেন।”
অনির্বাণের কথা শুনে আইশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “আসলে ও বলেছিল যে, ওর ব্যাপারে এখনই আপনাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই। সময়মতো ও নিজেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবে। কিন্তু এখন আর আপনার কাছে লুকোনোর মানে হয় না।”
অনির্বাণ অনুভব করল যে, আইশার মস্তিষ্ক থেকে নির্গত মানসিক তরঙ্গের প্রবাহ সংযত হয়ে উঠছে। ও এবার নিজের সদ্যলব্ধ সাইকিক ক্ষমতা ব্যবহার করে তরঙ্গগুলো বিশ্লেষণ করতে আরম্ভ করল। আর-একটু চেষ্টা করতেই ও যে তথ্যটা জানতে চাইছিল, সেটা পেয়ে গেল।
আইশার রহস্যময় সহযোগীর পরিচয়!
“মাই গুডনেস!”
অনির্বাণ বিস্মিত স্বরে বলল, “ডক্টর সোয়ার্জকফ কি এর এই পরিচয় জানেন?”
“নট ইয়েট। ও বলেছে, নিউম্যান’স আইল্যান্ড-এর বন্দিশালা থেকে আনাকে উদ্ধার না-করা পর্যন্ত ওর এই পরিচয়টা আনাকে না-জানাতে।”
“হোয়াট!”
অনির্বাণ চমকে উঠে বলল, “আপনারা ডক্টর সোয়ার্জকফকে রেসকিউ করার পরিকল্পনা করছেন!”
“হ্যাঁ, আর আপনিও ঠিক সেটাই করছেন, নয় কি?”
অনির্বাণ বুঝল যে, সে যেমন আইশার মনের কথা বুঝতে পারছে, সেরকম আইশাও ওর মনের মধ্যে ঢুকে ওর গোপন পরিকল্পনার কথা জেনে ফেলেছে।
“আমাদের উদ্দেশ্য যখন এক, তখন একসঙ্গে কাজ করলে ভালো হয় না কি?” আইশা বলল।
“আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আপনার বন্ধুটি রাজি হবেন কি?”
“ডেফিনিটলি। আনাকে উদ্ধার করার জন্য ও সব কিছু করতে পারে। আমি ওকে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখছি। আর বলছি আজ রাতেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।”
“আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার দরকার নেই।”
“তার মানে?”
“আমি আজ রাতেই আমেরিকা যাচ্ছি। ওখানেই ওর সঙ্গে সামনাসামনি কথা হবে।”
“দ্যাট’স গ্রেট! তাহলে আমারও আর এখানে পড়ে থাকার মানে হয় না। আমিও যাব।”
“বেশ, তবে তা-ই হোক।” অনির্বাণ বলল।
৮
কেপ এলিজাবেথ,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
“জায়গাটা তো বেশ নিরিবিলি।” অনির্বাণ বলল।
“ইয়েস, বাবাই এই জায়গাটা সাজেস্ট করলেন। পোর্টল্যান্ড বন্দরও এখান থেকে কাছেই। ওখান থেকে একটা ফিশিং বোট ভাড়া নিয়ে সহজেই নিউম্যান’স আইল্যান্ড অবধি চলে যাওয়া যেতে পারে।” জেসন বলল।
হ্যাঁ, জেসন, অর্থাৎ জেসন কোহেনই হল আইশার সেই রহস্যময় বন্ধু তথা সাহায্যকারী।
“আপনার বাবা তো আসলে একজন ‘মোসাদ’ এজেন্ট, তা-ই না?” অনির্বাণ প্রশ্ন করল।
“নট অ্যাট অল!”
জেসন আঁতকে উঠে বলল, “হি ইজ় আ ফেইথফুল সিটিজ়েন অব দি ইউনাইটেড স্টেটস। তবে…”
“তবে?”
“আসলে কী জানেন, ইহুদিরা পৃথিবীর যে প্রান্তে এবং যে দেশেই বসবাস করুক-না কেন, দ্য স্টেট অব ইজ়রায়েল অলওয়েজ় কিপ ইন টাচ উইথ দেম।”
“কথাটা আমেরিকান ইহুদিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য?”
“অব কোর্স।”
জেসন বলল, “যদিও এ দেশে আমাদের ওপর কোনো অত্যাচার হয় না। আমেরিকা আর ইজ়রায়েল তো পরস্পরের মিত্র। কিন্তু কী জানেন, ভবিষ্যতের কথা তো কেউ বলতে পারে না। তাই ইজ়রায়েল মনে করে, শত্রুদের পাশাপাশি বন্ধুদের ওপরেও নজর রাখাটা জরুরি।”
“তার মানে এ দেশেও ইজ়রায়েল ইনটেলিজেন্স, আই মিন ‘মোসাদ’-এর নেটওয়ার্ক আছে?” অনির্বাণ প্রশ্ন করল।
“আমি যতদূর জানি, এ দেশে ওদের কোনো অপারেটিভ নেই। তবে ইনফর্মেশন গ্যাদারারদের একটা টিম আছে। এরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের ইহুদিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলে। এদের উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন ধরনের ইনফর্মেশন জোগাড় করা, যেগুলো মার্কিন সমাজে ইহুদিদের অবস্থান বুঝতে সাহায্য করে। আর তাদের সম্পর্কে মার্কিন স্টেটের মনোভাব বুঝতেও সহায়তা করে।”
“বুঝলাম, তার মানে আপনার বাবা এই টিমটার ঘনিষ্ঠ, তা-ই তো?”
“সেটা বলতে পারেন। বাবা এই অঞ্চলের একজন বড়ো ব্যবসায়ী। মোটামুটি প্রভাবশালী ব্যক্তি। এরকম ইহুদিদের সঙ্গে ওরা ভালো সম্পর্ক রাখতে চায়।”
“তার মানে আপনার বাবার ওই ‘মোসাদ’ বন্ধুদের রিসোর্স কাজে লাগিয়েই আপনি আইশাকে সাহায্য করছেন?”
“ঠিক তা-ই। ইন ফ্যাক্ট, এই বাড়িটাও ওদেরই ঘাঁটি ছিল। তবে আপাতত পরিত্যক্ত।”
“ওরা কি প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর বিষয়ে জানে?”
“এখনও না। কিন্তু আনাকে উদ্ধার করতে হলে তো…”
“না।”
অনির্বাণ বলল, “এই ব্যাপারে ‘মোসাদ’-কে সরাসরি ইনভল্ভ করা ঠিক হবে না। রাষ্ট্র হিসেবে ইজ়রায়েলের দৃষ্টিভঙ্গি আমেরিকার থেকে খুব একটা আলাদা নয়। ‘সাইকিক ওয়েপ্ন’-এর গন্ধ পেলে ভবিষ্যতে ওরা নিজেরাও ওরকম অস্ত্রনির্মাণের চেষ্টা করতে পারে। সেটা মানবজাতির পক্ষে শুভ হবে না।”
“কিন্তু আমরা একা কতটা কী করতে পারব?” আইশা প্রশ্ন করল।
“ওয়েল, আই হ্যাভ আ প্ল্যান।”
অনির্বাণ বলল, “খালি প্রয়োজন একটা ফিশিং বোট আর একটা ছোটো জাহাজের।”
“হয়ে যাবে।” জেসন বলল।
“গুড, তাহলে আমার প্ল্যানটা শোনো…”
৯
“দিস ইজ় ইনসেন।” আইশা হতাশভাবে বলল, “চার-চারটে যুদ্ধজাহাজ দ্বীপটাকে ঘিরে টহল দিচ্ছে। ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে ওখানে পৌঁছোনো অসম্ভব। অন্তত এই দিনের আলোয় তো নয়ই।”
অনির্বাণ ওর কথার কোনো উত্তর দিল না। কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল, তারপর বোটের খোলের মধ্যে নেমে গেল।
এই বোটটা আদতে একটি ফিশিং বোট। আটলান্টিক মহাসাগরের এই অঞ্চলে এর মাছ ধরার পারমিট রয়েছে। এটা জেনেই অনির্বাণ বন্দর থেকে বোটটা ভাড়া করেছিল। আর এই বোটের সাহায্যেই মার্কিন নৌবাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে এই পর্যন্ত চলে আসা গিয়েছে। কিন্তু এখানে থেকেই নিউম্যান’স আইল্যান্ডের মেরিটাইম এক্সক্লিউশন জ়োন আরম্ভ হচ্ছে। নিষিদ্ধ এই অঞ্চলের সীমানা পাহারা দিচ্ছে চার-চারটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ। কাজেই এই ফিশিং বোট নিয়ে আর এগোনো সম্ভব নয়।
তাহলে উপায়?
অনির্বাণের কাছে কি কোনো ব্যাকআপ প্ল্যান আছে?
কোথায় গেল ও?
আইশা অধীর আগ্রহে ওর পথ চেয়ে বসে রইল।
খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না।
মিনিট দশেকের মধ্যেই অনির্বাণ আবার বোটের খোল থেকে ওপরে উঠে এল। আইশা অবাক হয়ে দেখল যে ওর গায়ে ডুবুরির পোশাক।
“আপনি… আপনি তার মানে…” আইশার কথা আটকে গেল।
“হ্যাঁ।”
অনির্বাণ মাথা নেড়ে বলল, “বোট নিয়ে যে ওই দ্বীপের ধারেকাছেও যাওয়া যাবে না, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। এখন একমাত্র পথ হচ্ছে জলের নীচে দিয়ে যাওয়া।”
“কিন্তু… আমি…”
“না না, আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। আপনি বোটেই থাকবেন। আমার এই ডুবুরির পোশাকে একটা ক্যামেরা লুকোনো আছে। আপনি নিজের ট্যাবে সেটার ফিড রিসিভ করতে পারবেন। কাজেই আমি কোথায় যাচ্ছি, কী করছি, সেসব আপনি এই বোটে বসেই দেখতে পারবেন।”
আইশা কিছু একটা বলতে চাইল।
কিন্তু অনির্বাণ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “হাতে সময় খুব বেশি নেই। তাই আগে আমার পুরো কথাটা শুনে নিন।”
“বেশ, বলুন।”
“যদি সব কিছু আমাদের প্ল্যানমাফিক চলে, দেন ইট’স ওকে। কিন্তু যদি তা না হয়, যদি আমি ধরা পড়ে যাই, তাহলে আমার কথা ভুলে গিয়ে, এই বোটটা নিয়ে সরে পড়বেন।”
“সরে পড়ব মানে? কোথায় সরে পড়ব?”
“এই জায়গাটা থেকে আর এক নটিক্যাল মাইল গেলেই আমেরিকার জলসীমায় পৌঁছে যাবেন। তার ওদিকটা হল এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জ়োন। ওখানে মার্কিন ফিশিং বোট বা মার্চেন্ট শিপগুলো যেতে পারলেও, জায়গাটা আমেরিকার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ওইখানে একটা ছোটো মালবাহী জাহাজে জেসন অপেক্ষা করে থাকবে। ওর কাছে একবার পৌঁছে যেতে পারলেই আপনি নিরাপদ।”
অনির্বাণের কথা শেষ হতে আইশা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “আমার মন বলছে, এসবের প্রয়োজন হবে না। আপনি আপনার মিশনে সফল হবেন। আর আনাকে নিয়ে ওই দ্বীপ থেকে নিরাপদে ফিরতে পারবেন।”
অনির্বাণ মাথা নেড়ে বলল, “দেয়ার ইজ় ফিফটি ফিফটি চান্স। দেখা যাক, কী হয়।”
তারপর আইশাকে আরও কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়ে অনির্বাণ অবশেষে জলে নেমে পড়ল। দেখতে দেখতে ওর ডুবুরির পোশাক-পরা শরীরটা আটলান্টিকের জলের নীচে তলিয়ে গেল।
১০
ঘরের মধ্যে জ্বলছে হালকা, স্নিগ্ধ ফ্লুরোসেন্ট আলো।
সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে যে, ঘরের দেয়াল, মেঝে, ছাদ—সব কিছুই সাদা রঙের।
খুব বেশিক্ষণ এই ঘরে থাকলে সব কিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি সব বিকল হয়ে পড়ে।
এই ঘরেরই ঠিক মাঝখানে একটা স্টিলের চেয়ারে বসে রয়েছেন আনা… আনা সোয়ার্জকফ। ওঁর শরীরেও আঁটোসাঁটো সাদা রঙের পোশাক। ওঁর হাত ও পা চেয়ারের সঙ্গে ধাতব ক্ল্যাম্প দিয়ে আটকানো।
আনার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওঁর চোখ দুটোতে অদ্ভুত এক দীপ্তি। আর ভাবভঙ্গিতে একটা দৃঢ়, অনমনীয় ভাব।
আনার মুখোমুখি অন্য একটা চেয়ারে বসে ছিলেন একজন প্রৌঢ়া। মহিলার চেহারায় প্রবল ব্যক্তিত্বের ছাপ। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে উনি চেয়ে ছিলেন আনার মুখের দিকে। আনাও ওঁর চোখে চোখ রেখে চেয়ে ছিল। দুজনের মধ্যে যেন একটা মানসিক দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলছিল।
কিছুক্ষণ এভাবে চলার পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনা অবশেষে চোখ বন্ধ করল।
সেটা দেখে প্রৌঢ়ার চেহারায় একটা প্রসন্ন ভাব ফুটে উঠল। মোলায়েম স্বরে উনি বললেন, “বৃথা প্রতিরোধ করছ আনা। তুমি নিজেও বুঝতে পারছ যে, আর কিছুক্ষণ পরেই তোমার মানসিক প্রাচীর ভেঙে পড়বে। তখন তোমার মনের গভীরে লুকোনো সব তথ্যই আমরা জেনে যাব। তাহলে শুধুশুধু এত কষ্ট সহ্য করা কেন?”
আনা এবার চোখ মেলে মহিলার দিকে চাইলেন, তারপর বললেন, “ওয়েল, ডক্টর ক্রাউজ, ধরে নিন এটা আমার প্রায়শ্চিত্ত।”
আনার কথায় প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর ডিরেক্টর ডক্টর ইভলিন ক্রাউজের ভুরু দুটো ঈষৎ কুঁচকে গেল।
“প্রায়শ্চিত্ত! মানে? কীসের প্রায়শ্চিত্ত?” বিরক্ত স্বরে ইভলিন প্রশ্ন করলেন।
“ম্যানহাটন প্রোজেক্ট-এর বিজ্ঞানীরাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওঁরা আমেরিকান গভর্নমেন্টের হাতে একটি ভয়ংকর অস্ত্র তুলে দিতে চলেছেন।”
আনা গম্ভীরস্বরে বললেন, “এমন এক অস্ত্র, যা মানবজাতির জন্য সংকট হয়ে উঠবে। বাট দে ডিড নাথিং অ্যাবাউট ইট। আমার মতে, ওঁদের ওই উদাসীনতাই ছিল মানবতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীদের করা এক ভয়ংকর অপরাধ। আজ এতকাল পরে আবার বিজ্ঞানীদের দিয়ে ওরকম একটা অপরাধ করানোর চেষ্টা হচ্ছে। তাই একজন বিজ্ঞানী হিসেবে, আমি সেটার প্রতিরোধ করছি। আর এটাই হল সেকালের বিজ্ঞানীদের করা অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত।”
“তোমার কথাগুলো বড্ড নাটকীয় শোনাচ্ছে, আনা।”
ইভলিন বললেন, “মনে রেখো, আমেরিকাকে সে যুগেও কেউ আটকাতে পারেনি আর এ যুগেও পারবে না। তুমি আমাদের একজন অ্যাসেট। তাই তোমার অবাধ্যতা সত্ত্বেও আমরা তোমার বিষয়ে যথেষ্ট ধৈর্য দেখিয়েছি।”
“সত্যিই কি তা-ই?”
আনা শ্লেষের সঙ্গে বললেন, “আমার তো মনে হয়, আল-বিরুনির চিরুনিটা এখনও পাননি বলেই আমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন। ওটা পেয়ে গেলেই আমায় এলিমিনেট করবেন।”
“ওয়েল।”
ইভলিন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “তোমার ধারণা যে পুরোপুরি ভুল, সেটা বলতে পারছি না। বেঁচে থাকতে চাইলে এখনও সময় আছে। কোঅপারেট উইথ আস। সাই কম নিয়ে তোমার ওই ছাত্রী আইশা কোথায় লুকিয়েছে, সেটা বলে দাও। আজ নয় কাল আমার সাইকিক টিম এমনিতেই তোমার মাইন্ড থেকে ওই তথ্যটা বের করে নেবে। কিন্তু তারপর তোমাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। ইউ উইল বি ডিক্লেয়ারড আ ‘হোস্টাইল অ্যাসেট’ অ্যান্ড দেন ডিসপোজ়ড অফ।”
আনা চেয়ারের ব্যাকরেস্টের ওপর মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল। তারপরে ক্লান্তস্বরে বলল, “উইশ ইউ অল দ্য লাক। নাউ প্লিজ় লিভ অ্যান্ড লেট মি স্লিপ।”
ইভলিন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।
সোজা আঙুলে যে ঘি উঠবে না, সেই বিষয়ে ওঁর আর কোনো সন্দেহ নেই। ইভলিন ঘরের দরজার দিকে এগোলেন। হঠাৎ ওঁর হাতে ধরা সেল ফোনটা বেজে উঠল। ইভলিন কলারের নামটা চেক করলেন।
কর্নেল মেলভিন, নিউম্যান’স আইল্যান্ড-এর সিকিউরিটি ইনচার্জ।
ইভলিন কলটা রিসিভ করলেন।
“ইয়েস কর্নেল?”
“সরি টু বদার ইউ, ম্যাম।”
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল কর্নেল মেলভিনের স্বর: “বাট উই হ্যাভ আ সিচুয়েশন হিয়ার। সামওয়ান হ্যাজ় ইনফিলট্রেটেড দি আইল্যান্ড।”
“হোয়াট!” ইভলিন চমকে উঠলেন।
“ইয়েস, ম্যাম। লোকটা আমাদের ফার্স্ট অ্যান্ড সেকেন্ড জ়োনের সিকিউরিটি ব্রিচ করে থার্ড জ়োনের দিকে এগোচ্ছে। মাই বয়েজ় আর আফটার হিম। শিগগিরই ওকে ধরে ফেলবে। কিন্তু তাও বিষয়টা আপনাকে জানিয়ে রাখলাম।”
“থ্যাংকস কর্নেল, আই অ্যাপ্রিশিয়েট দ্যাট।”
ইভলিন বললেন, “কিপ মি আপডেটেড।”
“শিয়োর, ম্যাম।”
লাইনটা কেটে গেল।
ইভলিন অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ওঁর ভুরু দুটো কুঁচকে রইল। ওই অনুপ্রবেশকারীর খবরটা ওঁকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।
লোকটা কে? এখানে কোন উদ্দেশ্যে ঢুকেছে?
আনার সঙ্গে ওর কোনোরকম যোগ নেই তো?
ইভলিনের মনে হল আনার এই কক্ষের সিকিউরিটি আরও জোরদার করা দরকার। এমনিতে অবশ্য এই দ্বীপের ডিটেনশন সেন্টার (যার মধ্যে এই কক্ষটি অবস্থিত) হল জ়োন ফাইভ অর্থাৎ সর্বাধিক সুরক্ষিত অংশ। এর আগেও কয়েকজন বিদেশি সিক্রেট এজেন্ট এই দ্বীপে পা রেখেছিল। কিন্তু তারা কেউই জ়োন ফাইভ পর্যন্ত পৌঁছোতে পারেনি। এই লোকটাও পারবে না। ধরা ও পড়বেই। আর তারপরেই জানা যাবে, ও কে এবং কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে।
কেবল একটা ব্যাপার ইভলিনকে অবাক করেছে। এর আগে যারাই এখানে এসেছে, তারা সবাই এসেছে রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে। কিন্তু এই লোকটা একেবারে দিনেদুপুরে সিংহের গুহায় এসে মাথা গলিয়েছে।
কিন্তু… ও রাতের জন্য অপেক্ষা করল না কেন?
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস? নাকি কোনো গভীর ষড়যন্ত্র?
ইভলিন জানেন যে, এই প্রশ্নের উত্তর পেতে ওঁকে আর মাত্র কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
১১
একটা স্বল্প আলোকিত সুড়ঙ্গের পথ ধরে অনির্বাণ গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলেছিল। এই পথ যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখান থেকেই জ়োন থ্রি শুরু। ওটাই হল নিউম্যান’স আইল্যান্ড-এর রিসার্চ ফেসিলিটির প্রথম অংশ। তার পরের এলাকা অর্থাৎ জ়োন ফোর হল এই গবেষণাকেন্দ্রের মূল অংশ, যেখানে গবেষণাগারগুলি অবস্থিত। আর এই অংশের ঠিক মাঝখানটাই হল জ়োন ফাইভ, এই দ্বীপ তথা গবেষণাকেন্দ্রের সব চেয়ে সুরক্ষিত এলাকা। এখানকার চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের অফিস আর ডিটেনশন সেন্টার, দুটোরই ঠিকানা হল জ়োন ফাইভ। অর্থাৎ আনা আর ইভলিন দুজনকেই ওখানে পাওয়া যাবে।
হঠাৎ পিছন থেকে অনেকগুলো ভারী মিলিটারি বুটের শব্দ ভেসে এল।
অনির্বাণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই দ্বীপের জ়োন ওয়ান অর্থাৎ সমুদ্রতট অঞ্চলটা ও খুব সহজেই পেরিয়ে এসেছে। ওখানে গার্ডরা ঘুরে ঘুরে টহল দিচ্ছিল। তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে ও খুব সহজেই পৌঁছে গিয়েছিল জ়োন টু-তে অর্থাৎ দ্বীপের জঙ্গল এলাকায়। ওখানে একটা পাথর দিয়ে এই সুড়ঙ্গের মুখটা চাপা দেওয়া ছিল। পাথরটা সরাতে ওকে একটু কসরত করতে হয়। সেই সময়টুকুর মধ্যেই জঙ্গলের গাছের উপর লাগানো ক্যামেরাতে ওর অস্তিত্ব ধরা পড়ে যায়। সিকিউরিটি গার্ডরা ওকে তাড়া করে। অনির্বাণ ওদের চোখ এড়িয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পড়ে। লোকগুলো জঙ্গলের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করে ওকে না পেয়ে বুঝতে পেরেছে যে, ও নিশ্চয়ই টানেলের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। আর তাই এখন ওকে ধরার জন্য সবাই মিলে দল বেঁধে সুড়ঙ্গের মধ্যে নেমে এসেছে।
অনির্বাণ আর দেরি করল না। টানেলের শেষ প্রান্ত লক্ষ করে দৌড় দিল। ওখানেই আছে জ়োন থ্রি-র প্রবেশদ্বার। ওর পায়ে রয়েছে SRI-এর আর অ্যান্ড ডি ডিপার্টমেন্টের বিজ্ঞানীদের তৈরি করা বিশেষ ধরনের শব্দহীন জুতো। তাই ওর পায়ের শব্দ লোকগুলোর কানে যাবে না। ‘ওমনিপড’ নামের এই জুতো জলে-স্থলে সর্বত্র ব্যবহার করা যায়। দৌড়োতে দৌড়োতেই অনির্বাণ ওর বাঁ হাতের কবজিতে বাঁধা রিস্টওয়াচের মতো যন্ত্রটাতে জোরে একটা টোকা দিল। যন্ত্রটায় ‘বিপ’ শব্দ হতেই অনির্বাণ দৌড়োনো বন্ধ করল। তারপর একপাশে সরে এসে সুড়ঙ্গের দেওয়ালের সঙ্গে প্রায় সেঁটে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ভারী বুটগুলোর শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছিল।
মিনিটখানেকের মধ্যেই একদল সশস্ত্র মার্কিন সৈনিক অনির্বাণ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই জায়গাটায় পৌঁছে গেল।
কিন্তু আশ্চর্য! ওরা যেন অনির্বাণকে দেখতেই পেল না। ওর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সৈনিকের দলটা সুড়ঙ্গপথ ধরে সামনে এগিয়ে গেল। ওরা দৃষ্টির বাইরে যেতেই অনির্বাণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
যাক, ‘ওমনিসুট’ তাহলে কাজ করেছে!
এই পোশাকও SRI-এর R&D বিভাগের বিজ্ঞানীদেরই সৃষ্টি। ফিল্ড এজেন্টদের ব্যবহারের জন্য এই পোশাক সম্প্রতি বিশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি করা হয়েছে। মূলত আন্ডারওয়াটার অপারেশনের জন্য ডিজ়াইন করা হলেও এই পোশাক মাটির ওপরেও সমান কার্যকর। ওমনিসুটের সঙ্গেই থাকে একটা রিস্টওয়াচের মতো যন্ত্র। যন্ত্রটা সুইচ অন করলেই ওটার থেকে একটি বিশেষ ধরনের তরঙ্গ নির্গত হয়ে ওমনিসুটের ফেব্রিকের ফাইবারগুলির মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। ফলে ওই পোশাক এবং যে ওই পোশাক পরে থাকে, সে-ও মানুষের চোখে অদৃশ্য হয়ে যায়। তবে এই পোশাকের চূড়ান্ত পরীক্ষা বা ফাইনাল ট্রায়াল এখনও বাকি। তাই এখনও এই পোশাক অফিশিয়ালি SRI অপারেটিভদের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। অনির্বাণ R&D-এর হেড, প্রফেসার বার্গারকে ম্যানেজ করে ওমনিসুটের কয়েকটা স্যাম্পল জোগাড় করতে পেরেছিল। অবশ্য ল্যাব কন্ডিশনে এই পোশাক ভালোভাবে কাজ করলেও অপারেশনাল কন্ডিশনে এটা একই রকম কার্যকর হবে কি না, সে বিষয়ে প্রফেসার বার্গার নিশ্চিত ছিলেন না।
কাজেই এ ব্যাপারে একটা ঝুঁকি তো ছিলই।
কিন্তু অনির্বাণ ঝুঁকিটা নিয়েছিল। আর ওর ওই সিদ্ধান্তই আজ ওকে বাঁচিয়ে দিল।
মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পরে অনির্বাণ দেখল, সৈনিকের দলটা ফিরে আসছে। লোকগুলোর মুখে-চোখে বিস্ময়ের ভাব স্পষ্ট। ওর সামনে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় ওদের কথাবার্তা অনির্বাণের কানে এল।
“মনে হয়, আমাদের দেখতে ভুল হয়েছে। লোকটা সত্যিই এই টানেলে ঢুকে থাকলে আমরা ওকে ঠিকই ধরে ফেলতাম। এখান থেকে পালাবার তো কোনো পথ নেই।”
“তার মানে তো ও এখন জঙ্গলেই আছে।”
“ইয়েস, নিশ্চয়ই তা-ই। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লোকটাকে ধরে ফেলতে হবে।”
দলটা কথা বলতে বলতে অনির্বাণের দৃষ্টিপথের বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই সেদিক থেকে একটা ভারী শব্দ শোনা গেল। অর্থাৎ লোকগুলো সুড়ঙ্গের বাইরে বেরিয়ে প্রবেশদ্বারটা বন্ধ করে দিল।
তার মানে এখন পথ পরিষ্কার।
অনির্বাণ এবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চারপাশ দেখতে দেখতে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে চলল। প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পরে ও একটা রুপালি ধাতব দরজার সামনে এসে পৌঁছোল।
এটাই জ়োন থ্রি-র প্রবেশপথ। সুড়ঙ্গের পথটা এখানে এসেই শেষ হয়েছে। দরজাটার ঠিক পাশেই দেওয়ালের গায়ে লাগানো রয়েছে একটা ‘আই-স্ক্যানার’ যন্ত্র। অর্থাৎ যাদের জ়োন থ্রি-তে প্রবেশের অথরাইজ়েশন আছে, তেমন কেউ ওই স্ক্যানারে নিজের চোখ স্ক্যান করলে তবেই দরজা খুলবে।
কিন্তু তেমন কারও সাহায্য যে অনির্বাণ এই মুহূর্তে পাবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। যা করার, ওকে নিজেকেই করতে হবে। অনির্বাণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর নিজের কবজিতে বাঁধা রিস্টওয়াচের মতো যন্ত্রটা আবার স্পর্শ করল।
অদৃশ্য হওয়া ছাড়াও ওমনিসুটের আরও অনেকরকম ক্ষমতা আছে। এবার তেমনই একটা ক্ষমতা অনির্বাণ কাজে লাগাতে চলেছে। আর তা হল যে-কোনো সলিড স্ট্রাকচার ভেদ করে চলে যাওয়ার ক্ষমতা। প্রফেসার বার্গারের মুখে যখন ও প্রথম ওমনিসুটের এই বৈশিষ্ট্যের কথা শুনেছিল, তখন পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি। প্রফেসার তখন ব্যাপারটা ওকে ডেমনস্ট্রেট করে দেখিয়েছিলেন।
সুটের ক্ষমতা দেখে অনির্বাণের তাক লেগে গিয়েছিল।
তবে ল্যাব ডেমনস্ট্রেশনে যেটা সম্ভব হয়েছিল, ফিল্ড অপারেশনের ক্ষেত্রেও কি সেটা সম্ভব হবে?
দেখাই যাক-না, কী হয়।
অনির্বাণ একটা গভীর শ্বাস নিল। তারপর ওর কবজিতে বাঁধা যন্ত্রটার একটি বিশেষ অংশে সন্তর্পণে তিনবার টোকা দিল।
এবার ওমনিসুটের চরম পরীক্ষা।
১২
“আনা… আনা… আনা।”
আনা চেয়ারে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ছিলেন।
হঠাৎ নিজের নামটা শুনে উনি সচেতন হয়ে উঠলেন।
কেউ যেন ওঁকে ডাকছে।
কিন্তু কোথায়? ঘরের ভেতরে তো কেউ নেই।
একটু ঠাহর করতেই আনা বুঝলেন যে, আওয়াজটা আসছে ওঁর মাথার ভেতর থেকে। তার মানে কেউ মানসিক তরঙ্গের মাধ্যমে ওঁর সঙ্গে সংযোগস্থাপনের চেষ্টা করছে।
আনা গভীর শ্বাস নিয়ে মনঃসংযোগ করতে সচেষ্ট হলেন। খানিকক্ষণ চেষ্টা করতেই উনি মানসিক তরঙ্গের মাধ্যমে পাঠানো বার্তাগুলো স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারলেন। আর বার্তাপ্রেরকের পরিচয় পেতেই উনি প্রচণ্ড বিস্মিত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন।
“এ কী! এজেন্ট Vaan! আপনি… আপনি… কীভাবে…”
“হ্যাঁ, আমি।”
আনা নিজের মাথার ভেতর আবার অনির্বাণের স্বর শুনতে পেল।
“আল-বিরুনির চিরুনি আমার মধ্যেও সাইকিক শক্তির জাগরণ ঘটিয়েছে। সেই শক্তির জোরেই আমি আপনার সঙ্গে মানসিক সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছি।”
“ওই চিরুনি আপনার ব্যবহার করা উচিত হয়নি, এজেন্ট Vaan। বিপদে পড়তে পারতেন।”
“আমার কাছে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।”
অনির্বাণ বলল, “ওটা ব্যবহার না করলে, প্রথমে আইশার এবং তারপরে আইশার মাধ্যমে আপনার খোঁজ কীভাবে পেতাম?”
“আপনি মস্ত বড়ো ভুল করেছেন, Vaan। আমাদের খোঁজ করা বা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা আপনার উচিত হয়নি।”
আনা হতাশস্বরে বলল, “আমি তো ইতিমধ্যেই মার্কিন গভর্নমেন্টের হাতে বন্দি। আইশাও হয়তো আজ নয় কাল ধরা পড়েই যাবে। এই কারণেই আমি ওই চিরুনিটা আমাদের কাছে না রেখে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলাম। আপনার সঙ্গে আমাদের বা ওই চিরুনির কী সম্পর্ক, সেটা তো মার্কিন ইনটেলিজেন্স এখনও পর্যন্ত জানতে পারেনি। কিন্তু এবার আমেরিকার সাইকিক টিম আমার মাইন্ড হ্যাক করলেই আপনার খোঁজ পেয়ে যাবে। আর এই কাজটা করতে ওদের খুব বেশি সময় লাগবে না। আমি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছি। আর বড়োজোর দিন দুয়েক ওদের আটকে রাখতে পারব। তারপরেই ওরা আমার মনের মধ্যে ঢুকে সব তথ্য বের করে নেবে।”
“ডোন্ট ওয়ারি আনা, সেই সুযোগ ওরা পাবে না।”
“মানে?”
“তার আগেই আপনাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাব।”
“হোয়াট! তার মানে… আপনি…”
“ইয়েস, আনা, আমি এখন নিউম্যান’স আইল্যান্ডে। আপনার খুব কাছাকাছি আছি।”
“ওঃ গড! আপনি কি উন্মাদ, এজেন্ট Vaan? এটা আপনি কী করলেন? আপনি কি জানেন না যে, এই দ্বীপ থেকে আজ পর্যন্ত কেউ কখনও পালাতে পারেনি!”
“আমি সবই জানি, আনা। আর এটাও জানি যে, এর আগে যেসব বিদেশি এজেন্ট এখানে হানা দিতে এসেছিল, তাদের কারোই সাইকিক পাওয়ার ছিল না। তা ছাড়া…”
“তা ছাড়া কী?”
“এই দ্বীপের ভেতরে ওদের সাহায্য করার মতোও কেউ ছিল না।”
এই শেষ কথাটা শুনে আনা চমকে উঠল, “তার মানে? এই দ্বীপের ভেতরে আপনাকে সাহায্য করার মতো কেউ আছে?”
“অবশ্যই।”
“কে সে?”
“যার সঙ্গে আমি এখন কথা বলছি।”
“মানে আমি?”
“ইয়েস।”
“কিন্তু আমি তো বন্দি!”
“ডাজ়্ন্ট ম্যাটার। আমার কেবল একটা ইনফর্মেশন প্রয়োজন। আর আমার বিশ্বাস, আপনি সেটা আমায় দিতে পারবেন।”
“কী ইনফর্মেশন?”
“ওয়েল, আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, এই ধরনের রিসার্চ ফেসিলিটিগুলো থেকে বের হওয়ার একটা করে গোপন পথ থাকে, যার সন্ধান কেবলমাত্র ফেসিলিটির চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরেরই জানা থাকে। ফেসিলিটির ওপর সামরিক অথবা সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ ঘটলে, সমস্ত ইম্পরট্যান্ট ব্যক্তিদের ওই সিক্রেট এগজ়িট পাথ দিয়ে শত্রুর চোখ এড়িয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমি চাই, আপনি ওই পথের সন্ধানটা আমাকে জোগাড় করে দিন।”
“কীভাবে? আমি তো চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নই।”
“না, তা নন। কিন্তু আপনি তো অবশ্যই চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরকে চেনেন। আপনি ওঁর সঙ্গে মানসিক স্তরে সংযোগ স্থাপন করুন। মানসিক তরঙ্গের মাধ্যমে আপনার বার্তা পেলে উনি নিশ্চয়ই সেটা রিসিভ করবেন। সেই সুযোগেই আপনি ওঁর মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে, সিক্রেট এগজ়িট পাথ সংক্রান্ত ইনফর্মেশনটা বের করে নেবেন।”
“চমৎকার প্ল্যান।”
আনা শ্লেষের সঙ্গে বলল, “কেবল দুটো ছোট্ট সমস্যা রয়েছে।”
“কী সমস্যা?”
“প্রথমত, এই রিসার্চ ফেসিলিটির চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হলেন প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর ডিরেক্টর ইভলিন ক্রাউজ স্বয়ং। ওঁর মতো চালাক মানুষ দুটো হয় না। আমি ওঁকে মানসিক তরঙ্গের মাধ্যমে বার্তা পাঠালেই সেটা ওঁকে সন্দিগ্ধ করে তুলবে। কাজেই সেই বার্তা রিসিভ করার জন্য উনি ওঁর মনের দরজা না-ও খুলতে পারেন।”
“অবশ্যই খুলবেন।”
অনির্বাণ জোরের সঙ্গে বলল, “কারণ উনি এতক্ষণে নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছেন যে, ফেসিলিটিতে একজন বহিরাগতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আর সেই ব্যক্তি যে আপনাকেই রেসকিউ করতেই এসেছে, সেটা অনুমান করাও ওঁর পক্ষে কঠিন নয়। এই পরিস্থিতিতে আপনার দিক থেকে সাইকিক লেভেলে কোনো মেসেজ পাঠানো হলে সেটা ওঁকে যথেষ্টই উদ্বিগ্ন করবে। কাজেই উনি ওই মেসেজ রিসিভ না করে পারবেন না।”
“বেশ।”
আনা বললেন, “তর্কের খাতিরে না হয় আপনার কথা মেনেই নিলাম। কিন্তু তাহলেও একটা দ্বিতীয় সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। আর সেটা হল এই যে, মানুষের মনের মধ্যে কোটি কোটি তথ্য সঞ্চিত থাকে। তার মধ্যে থেকে একটা বিশেষ তথ্য খুঁজে বের করা তো খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার চাইতেও কঠিন কাজ।”
“ঠিকই বলেছেন। তবে যে মানুষটির মনের ভেতর তথ্যটি রয়েছে, সে যদি নিজেই সেই মুহূর্তে তথ্যটির বিষয়ে চিন্তা করে, তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই তথ্যটি খুঁজে পাওয়া যাবে।”
“দ্যাট’স পসিব্ল।”
আনা কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, “কিন্তু ইভলিন হঠাৎ ওই গোপন পথটার কথা ভাবতেই-বা যাবেন কেন?”
“এমনিতে হয়তো ভাববেন না। তবে ওঁকে ভাবাতে হবে। কীভাবে? সেটা…”
“আর বলতে হবে না।”
আনা বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, “গট ইয়োর পয়েন্ট। আপনার কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু তারপর? পথের সন্ধান পেলেই তো শুধু হবে না। তার আগে আপনাকে তো আমার কাছে পৌঁছোতে হবে। না হলে আমাকে আর ওই পথ দিয়ে নিয়ে যাবেন কীভাবে?”
“সে তো আমি অনেকক্ষণ আগেই পৌঁছে গিয়েছি, ডক্টর আনা সোয়ার্জকফ।”
আনা চমকে উঠলেন।
কারণ, ওই শেষ কথাটা মানসিক তরঙ্গের মাধ্যমে বলা হয়নি। বলা হয়েছে শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে।
আনা চোখ মেলে তাকালেন।
আর সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন যে, একটু আগে যে চেয়ারটায় ইভলিন বসে ছিলেন, এখন সেটাতেই বসে রয়েছে অনির্বাণ।
১৩
“কর্নেল,” ইভলিন ঠান্ডাস্বরে বললেন, “আপনি বলেছিলেন, লোকটাকে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে পারবেন। অথচ তিন ঘণ্টা হতে চলল, এখনও লোকটাকে ধরতে পারলেন না।”
“আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি, ম্যাম।”
নিউম্যান’স আইল্যান্ড-এর সিকিউরিটি ইনচার্জ কর্নেল মেলভিন প্যাশ কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “আসলে লোকটা ঠিক যেন কোনো অশরীরীর মতো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। এই দ্বীপ এবং গবেষণাকেন্দ্রের বিভিন্ন অংশে যে দুশোটা সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরা ফিট করা আছে, তার কোনোটাতেই ওকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয়, ও কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে। অন্ধকার নামলে তারপরে বেরোবে।”
“সো হোয়াট’স দ্য সলিউশন অব দিস প্রবলেম?”
“ম্যাম, আপনি তো জানেন যে, আমাদের ক্যামেরাগুলো অন্ধকারেও অ্যাকটিভ থাকে। কাজেই লোকটা যদি রাত্রিতেও বেরোয়, তাহলেও আমাদের নজর এড়াতে পারবে না। আমাদের সার্ভেইল্যান্স স্টেশনে কুড়িজন লোক সর্বক্ষণ সব ক-টা ক্যামেরার ফিড-এর ওপর নজর রেখে চলেছে। তা ছাড়া এই দ্বীপে মোতায়েন আমাদের সম্পূর্ণ বাহিনী এখানকার প্রত্যেকটি কোনা তন্নতন্ন করে তল্লাশি করছে। কাজেই ধরা সে পড়বেই।”
“আর যদি ইতিমধ্যেই সে আপনাদের নজর এড়িয়ে দ্বীপের বাইরে চলে গিয়ে থাকে?”
“দ্যাট’স ইম্পসিব্ল, ম্যাম। কারণ ওর অস্তিত্ব টের পাওয়ামাত্রই আমরা নিউম্যান’স আইল্যান্ড থেকে বেরোনোর সব রাস্তা ব্লক করে দিয়েছি।”
“অলরাইট কর্নেল, আপনি এখন আসতে পারেন। মনে রাখবেন, লোকটা যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে, আপনার পক্ষে ততই মঙ্গল।”
ইভলিনের কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হুমকিটা বুঝতে কর্নেল প্যাশের কোনো অসুবিধা হল না।
উনি তটস্থভাবে ইভলিনকে আরেকপ্রস্থ আশ্বাস দিয়ে এবং অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিলেন।
কর্নেল চলে যাওয়ার পরে ইভলিন চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। ওঁর এই অফিসকক্ষটি রিসার্চ ফেসিলিটির এমন জায়গায় অবস্থিত, যেখান থেকে দ্বীপের সব ক-টা দিকেরই চমৎকার ভিউ পাওয়া যায়। ইভলিন এখন দাঁড়িয়ে আছেন দক্ষিণদিকের জানালায়। এখান থেকে সমুদ্রতট বরাবর সৈনিকদের তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ইভলিন অন্যমনস্কভাবে সেদিকে চেয়ে রইলেন। ওই রহস্যময় অনুপ্রবেশকারীর উপস্থিতি ওঁকে ভাবিয়ে তুলেছে।
কে হতে পারে লোকটা!
কোনো বিদেশি সিক্রেট এজেন্ট? কোন দেশের?
ইভলিন জানেন, এর আগেও এই দ্বীপে সাতবার বিদেশি এজেন্টদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অবশ্য তারা কেউই এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারেনি। সেই সময় এই দ্বীপ ও গবেষণাকেন্দ্র প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এটি ছিল ইউএস আর্মির একটি সিক্রেট রিসার্চ ফেসিলিটি। অনুপ্রবেশকারীদের জন্য তাদের একটিই নীতি ছিল।
কঠিন মৃত্যু।
ইভলিন শুনেছেন যে, ধরা-পড়া ওইসব এজেন্টের কাছ থেকে অত্যাচার করে প্রথমে প্রয়োজনীয় ইনফর্মেশন বের করে নেওয়া হয়েছিল। তারপর তাদের দেহগুলি টুকরো টুকরো করে কেটে, আটলান্টিক মহাসাগরের হাঙরদের খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু এবার আর সেরকম হবে না। লোকটা ধরা পড়লে তাকে নিয়ে কী করবেন, সেটা ইভলিন ইতিমধ্যেই ভেবে রেখেছেন। প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর কতকগুলো বিপজ্জনক এক্সপেরিমেন্টের জন্য কয়েকজন হিউম্যান সাবজেক্ট প্রয়োজন। এই লোকটাকে ওই কাজেই ব্যবহার করা যাবে।
তবে তার আগে ও এই দ্বীপে ও কেন এসেছে, সেটা ওর থেকে জেনে নিতে হবে। সেটা অবশ্য কর্নেল প্যাশ আর ওঁর লোকজন ভালোই পারবেন। কথা বের করার অনেক উপায় ওদের জানা আছে।
ইভলিন এইসব সাত-পাঁচ ভাবছিলেন। হঠাৎ ওঁর মনে হল, কেউ যেন ওঁর নাম ধরে ডাকল।
ইভলিন চমকে উঠলেন।
কে ডাকছে?
একটু ঠাহর করতেই উনি বুঝতে পারলেন যে, ডাকটা আসছে ওঁর মাথার ভিতর থেকে। আর স্বরটা হল আনা সোয়ার্জকফের।
কী ব্যাপার! আনা হঠাৎ ওঁর সঙ্গে সাইকিক মোডে কমিউনিকেট করছে কেন?
ইভলিন চেয়ারে এসে বসলেন।
তারপর কয়েকবার গভীর শ্বাস নিয়ে, চোখ বুজে মনঃসংযোগ করতে সচেষ্ট হলেন।
১৪
“কী ব্যাপার, আনা! তুমি হঠাৎ এইভাবে?”
“ইভলিন, আপনি আর কত চালাকি করবেন? তবে যতই চেষ্টা করুন, স্বেচ্ছায় আমি কোনো তথ্যই ফাঁস করব না।”
“চালাকি! মানে?”
“এইমাত্র কেউ একজন আমার সঙ্গে সাইকিক মোডে কমিউনিকেট করেছিল। তার বক্তব্য, সে নাকি একজন সিক্রেট এজেন্ট। আমাকে উদ্ধার করতে এই দ্বীপে এসেছে।”
“হোয়াট!”
“ইয়েস। এটা যে আপনার সাইকিক টিমেরই কারও কারসাজি, সেটা বুঝতে অবশ্য আমার অসুবিধা হয়নি। আমার বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য সে এটাও বলেছে যে, এই দ্বীপ থেকে বেরোনোর নাকি একটা গোপন পথ আছে। সেই পথেই সে আমাকে বের করে নিয়ে যেতে চায়।”
আনা কথাটা বলামাত্রই ইভলিনের মনের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া হল। ফলে ওঁর মনের গভীর তল থেকে কিছু কথা ও দৃশ্য মনের ওপরের স্তরে ভেসে উঠল।
অবশ্য মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য।
পরক্ষণেই ইভলিন নিজেকে সামলে নিলেন। ফলে ওই ভেসে-ওঠা তথ্যগুলি আবার ওঁর মনের গভীরে তলিয়ে গেল।
“দ্যাখো আনা,” ইভলিন নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রেখে বললেন, “মনে হচ্ছে, সাইকিক টিমের কোনো মেম্বার তোমার সঙ্গে রসিকতা করেছে। আমি এসবের বিন্দুবিসর্গও জানি না। তবে যে-ই এটা করে থাক, সে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধ করেছে। তার শাস্তি হবে। তবে তার জন্য আগে তাকে শনাক্ত করা প্রয়োজন। সে যখন তোমার সঙ্গে কমিউনিকেট করেছে, তখন নিশ্চয়ই তোমার মনের মধ্যে তার trail ছেড়ে গেছে। আমি অনুরোধ করছি, তুমি প্লিজ় তোমার মাইন্ডের গেটগুলো একটু খুলে দাও। তাহলে আমি ওই trail-টা অ্যাকসেস করে, অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারব।”
কিন্তু অপরদিক থেকে আনার কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
“আনা।” ইভলিন আবার ডাকলেন, কিন্তু কোনো সাড়া এল না।
অমনি বিদ্যুতের ঝলকের মতো ইভলিনের মনে একটা উপলব্ধি জেগে উঠল।
“আই হ্যাভ বিন ট্রিকড!”
“নো নো নো নো…” বলতে বলতে উনি কর্নেল প্যাশকে ফোন করলেন।
“কর্নেল, সেন্ড ইয়োর বয়েজ় টু আনা’জ় সেল, রাইট নাউ।”
“কিন্তু ম্যাম…”
“কোনো কিন্তু নয়। দিস ইজ় অ্যান এমার্জেন্সি। আমার বিশ্বাস, ওই অনুপ্রবেশকারী লোকটা আনাকে অপহরণের চেষ্টা করছে।”
“ইম্পসিব্ল ম্যাম! দ্যাট’স জ়োন ফাইভ, দ্য মোস্ট সিকিয়োরড জ়োন অব দিস আইল্যান্ড। ক্যামেরা আর প্রহরীদের নজর এড়িয়ে ওখানে পৌঁছোনো অসম্ভব।”
“কর্নেল!” ইভলিন এবার প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, “ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু আর্গিউ। ফলো মাই অর্ডার নাউ।”
কর্নেল প্যাশ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “ওকে ম্যাম, আই অ্যাম সেন্ডিং মাই বয়েজ় দেয়ার, রাইট অ্যাওয়ে।”
“এক মিনিট কর্নেল, আমি চাই, আপনি নিজেও ওখানে যান। ওখানে পৌঁছে আনাকে পেলেই আমায় ইমিডিয়েটলি ইনফর্ম করবেন।”
“শিয়োর, ম্যাম।”
ফোনটা রেখে ইভলিন ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। একবার জানালার কাছে এসে আকাশের দিকে তাকালেন। সূর্যাস্তের আর বেশি দেরি নেই।
হঠাৎ টেবিলের ওপর ওঁর ফোনটা বেজে উঠল।
ইভলিন দ্রুতপদে গিয়ে কলটা রিসিভ করলেন।
“ইয়েস, কর্নেল?”
“ম্যাম… ম্যাম… আই ডোন্ট নো হাউ ইট হ্যাপেনড… কিন্তু… আনা… আনা সোয়ার্জকফ… এই ঘরে নেই।”
কথাটা শুনে ইভলিন যেন পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পরে উনি অবশেষে খুব শীতলস্বরে বললেন, “থ্যাংক ইউ, কর্নেল। আপনার সাহায্যের আর প্রয়োজন নেই। আই উইল টেক ইট ফ্রম হিয়ার।”
ইভলিন ফোন রেখে দিলেন।
তারপর টেবিলের দেরাজ খুলে দুটো জিনিস বের করলেন। একটা চশমা আর একটি পিস্তল। চশমাটি বিশেষ ধরনের, যাতে অন্ধকারেও দেখা যায়। পিস্তলটা হলে একটা উন্নত ধরনের লেজ়ার পিস্তল। এতে লেজ়ার রশ্মির তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করারও ব্যবস্থা রয়েছে। সব চেয়ে কম তীব্রতার রশ্মিও একজন মানুষকে ভালোরকম জখম করতে পারে। আর সব চেয়ে বেশি তীব্রতার রশ্মি মানুষটাকে মুহূর্তের মধ্যে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে।
ইভলিন নিজের সেক্রেটারিকে ফোন করলেন, “অ্যালেন, আমি এখন একটু বিশেষ কাজে ব্যস্ত আছি। আমি না-বলা পর্যন্ত কেউ যেন আমার ঘরে না আসে।”
“শিয়োর ম্যাম, আই উইল এনশিয়োর দ্যাট।”
ইভলিন ফোনটা রেখে দিলেন।
তারপর চশমাটা পরলেন আর পিস্তলটা হাতে নিলেন।
এরপর ওঁর কক্ষ সংলগ্ন পার্সনাল ওয়াশরুমে প্রবেশ করে দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিলেন।
ওয়াশরুমটা বেশ বড়ো। একপাশে একটা বড়ো বাথটাব বসানো রয়েছে।
ইভলিন বাথটাবটার কাছে এলেন।
তারপর ওটার গায়ে একটা বিশেষ অংশে চাপ দিলেন। অমনি বাথটাবটা সরে গিয়ে তার নীচে একটা বড়োসড়ো অন্ধকার গহ্বর বেরিয়ে পড়ল। গহ্বরটার মধ্যে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নীচের দিকে নেমে গিয়েছে।
১৫
“আপনার অভিনয় ক্ষমতার তুলনা নেই।” অনির্বাণ তারিফের সুরে বলল, “NASA-র নভশ্চর না হলে হলিউডে আপনার স্থান পাকা ছিল।”
“ভেরি ব্যাড জোক।” আনা মন্তব্য করলেন।
“না না। জোক নয়। আমি কিন্তু কথাটা সিরিয়াসলি বললাম। ইভলিন ক্রাউজের মতো একজন পাকা মাথাকেও আপনি যেভাবে বোকা বানালেন…”
“সত্যিই কি বোকা বানিয়েছি? নাকি এটাও ওর একটা চাল?”
“মানে?”
“আমাকে যে ঘরে আটকে রেখেছিল, সেই ঘরেই সিক্রেট এগজ়িট পাথ… এটা কেমন যেন লাগছে! এটা ইভলিনের পাতা কোনো ফাঁদ নয় তো?”
অনির্বাণ একটু চিন্তা করে বলল, “মনে তো হয় না। আসলে এই ধরনের গোপন বহির্গমনপথের অনেকগুলো মুখ থাকে। আপনার ঘরের দেওয়ালে, গোপন দরজার পিছনে ওরকমই একটা মুখ ছিল। শত্রুপক্ষ গবেষণাকেন্দ্র আক্রমণ করলে আপনার মতো একজন প্রাইজ়ড অ্যাসেটকে যাতে দ্রুত বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়, সম্ভবত তার জন্যই ওই ব্যবস্থা। আপনি গোপন পথের কথা পাড়তেই ইভলিনের মনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই তাই এই দরজাটার কথাই ভেসে উঠেছিল।”
“তার মানে আপনার মতে এই পথের একাধিক প্রবেশদ্বার আছে?”
“থাকাটাই স্বাভাবিক।”
“সর্বনাশ, তবে তো ওইসব দ্বার দিয়ে সৈনিকেরা এখানে চলে আসতে পারে!”
“তার সম্ভাবনা কম। কারণ প্রোটোকল অনুযায়ী, যুদ্ধ কিংবা সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ ছাড়া ফেসিলিটির চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কখনোই এই পথের কথা অন্য কাউকে জানাতে পারেন না। তা ছাড়া…”
“তা ছাড়া, যদি তেমন কিছু ঘটেও তাহলেই-বা আপনার চিন্তা কী? এই সুটের ক্ষমতা তো দেখলেন। এটা যতক্ষণ পরে আছেন, ততক্ষণ বিপদের সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।”
অনির্বাণ নিজের সঙ্গে একটা বাড়তি ওমনিসুট নিয়ে এসেছিল। আনা এই মুহূর্তে সেটাই পরে রয়েছে।
অনির্বাণের হাতে একটা জোরালো ফ্ল্যাশলাইট। তার আলোতেই ওরা এই অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ ধরে এগিয়ে চলেছে। অনির্বাণের অনুমান, ভূগর্ভস্থ এই পথটা সমুদ্রের নীচে কোথাও শেষ হয়েছে। সেখানে পৌঁছোতে পারলেই জলের নীচ দিয়ে নিরাপদে বোটে পৌঁছে যাওয়া যাবে। সেখানে আইশা ওদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে নিশ্চয়ই অনির্বাণের পোশাকের মধ্যে লুকোনো ক্যামেরার দৌলতে আনার উদ্ধার পাওয়ার বিষয়টা এতক্ষণে জেনে গিয়েছে। অনির্বাণ ওকে বলেছিল খুব প্রয়োজন না হলে যোগাযোগ না করতে। তাই হয়তো ও এখনও নীরব রয়েছে।
আরও মিনিট দশেকমতো চলার পরে ওরা সমুদ্রের গর্জন শুনতে পেল। সেই সঙ্গে নাকে এসে লাগল নোনা জলের গন্ধ। এখান থেকে পথটা ঢালু হয়ে নীচের দিকে নেমে গিয়েছে। অর্থাৎ সমুদ্রের গভীরে গিয়ে শেষ হয়েছে।
“ব্যাস, আর-একটু এগোলেই সমুদ্র।”
অনির্বাণ বলল, “একবার ওখানে পৌঁছোতে পারলেই ইভলিন আর আমাদের নাগাল পাবেন না।”
আনা উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই…
“নট সো ফাস্ট, ম্যান।”
কে বলল কথাটা!
অনির্বাণ চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল। আর তখনই ওর হাতের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় দেখা গেল তাকে।
ইভলিন ক্রাউজ!
চশমার কাচের পিছন থেকে মহিলার চোখ দুটি প্রতিহিংসায় জ্বলজ্বল করছে।
আর ডান হাতে ধরা পিস্তলটা সোজা ওদের দিকেই তাগ করা রয়েছে।
“আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরেই তোমাদের অনুসরণ করছিলাম।”
ইভলিন বললেন, “তোমাদের কথাবার্তা সবই শুনেছি। না না, কোনো চালাকির চেষ্টা নয়। যদি ভুল করে ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেলি, তাহলে কী হবে, জানো তো? এই দ্যাখো।”
আনার পায়ের কাছে একটা বড়োসড়ো পাথরের টুকরো পড়ে ছিল। ইভলিন সেটাকে লক্ষ করে পিস্তলের ট্রিগার টানলেন। অমনি পিস্তলের নল থেকে একটা তীব্র আলোর রশ্মি বেরিয়ে এসে পাথরটাকে স্পর্শ করল। পরমুহূর্তেই দেখা গেল পাথরটা আর সেখানে নেই। তার জায়গায় পড়ে রয়েছে একদলা ছাই।
দৃশ্যটা দেখে আনার মুখ আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
কিন্তু অনির্বাণের মধ্যে বিশেষ ভাবান্তর দেখা গেল না। সে যেন কতকটা আপন মনেই বলল, “হুম, সুপার অ্যামপ্লিফায়েড লেজ়ার!”
তারপর ইভলিনের দিকে চেয়ে বলল, “কিন্তু ম্যাম, আমি ছাইয়ের দলা হয়ে গেলে আল-বিরুনির চিরুনিটাও যে আর কখনও পাবেন না।”
ইভলিন অগ্নিবর্ষী দৃষ্টিতে ওর দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন। তারপর ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, “জিনিসটা তার মানে এখন SRI-এর হেপাজতে আছে?”
“নো ম্যাম, SRI এর মধ্যে ইনভল্ভড নয়। এটা আমার পার্সনাল মিশন।”
“প্রমাণ?”
“ওয়েল, আপনি যদি মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকেন তাহলে আমি জিনিসটা আপনার হাতে তুলে দিতে পারি।”
ওর কথা শুনে আনা চমকে উঠল, “এ আপনি কী বলছেন?”
সে আহতস্বরে বলল, “আমি আপনাকে বিশ্বাস করে…”
“সরি, আনা। আমি ভেবে দেখেছি যে, আমেরিকান ইনটেলিজেন্স-এর থেকে কোনো জিনিসই বেশি দিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আজ নয় কাল ওরা সেটা ফেরত নিয়েই ছাড়বে। তাই সময় থাকতে থাকতে ওদের সঙ্গে জিনিসটা ট্রেড-অফ করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।”
আনা কিছু বলতে পারল না। কেবল অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে রইল।
“ওয়েল ওয়েল, এজেন্ট Vaan,” ইভলিনের স্বরে শ্লেষের সুর, “লেজ়ার গানের সামনে পড়ে আপনার সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে দেখে ভালো লাগছে। কিন্তু একটা কথা বলুন তো, আমাদের সঙ্গে ট্রেড-অফ করাই যদি আপনার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে আনাকে নিয়ে পালাচ্ছিলেন কেন?”
অনির্বাণ মাথা নেড়ে বলল, “আসলে আমি চেয়েছিলাম আপনাদের সঙ্গে আড়ালে থেকে ডিলটা করতে। কিন্তু আমার অনুমান ছিল যে, আপনারা আজ নয় কাল আনার কাছ থেকে আমার বিষয়ে জানতে পেরেই যাবেন। তাই, তার আগেই ওকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আর তা ছাড়া আমার মনে হয়েছিল যে, ওকে ফেরত পাওয়ার জন্যও আপনারা ভালো মূল্য দিতে রাজি হবেন।”
“অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবাউট আইশা?”
“শি ইজ় অলসো উইথ মি। ভালো মূল্য পেলে ওকেও আমি আপনাদের হাতে…”
অনির্বাণ কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই আনা এগিয়ে এসে ওর গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিল।
ইভলিন এবার খলখল করে হেসে উঠলেন। তারপর আনার দিকে চেয়ে বললেন, “ইউ সি, হানি। দিস ইজ় রিয়ালিটি। অর্থ আর ক্ষমতাই হল আসল। আর তুমি বোকার মতো একটা আদর্শের পিছনে ছুটতে গিয়ে, নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছিলে। এখনও সময় আছে, ফিরে এসো।”
“নেভার!” আনা চিৎকার করে বলল, “আমার কাছে মানবতাই সব চেয়ে বড়ো ছিল, আর তা-ই থাকবে। তোমাদের অশুভ কর্মকাণ্ডে শামিল হওয়ার চাইতে মৃত্যুবরণ করাই আমার কাছে শ্রেয়। চালাও তোমার লেজ়ার গান।”
ইভলিনের মুখে একটা ক্রূর হাসির রেখা ফুটে উঠল, “রিল্যাক্স হানি। এত তাড়া কীসের? মরতে চাইলে মরবে। তবে তার আগে প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস তোমার ওপর যে ইনভেস্টমেন্টটা করেছে, তার রিটার্ন তো দিয়ে যেতে হবে, সোনামণি!”
আনার মুখটা রাগে ঝলসে উঠল। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ও ইভলিনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল। কিন্তু তার আগেই অনির্বাণ ওকে ধরে ফেলল। তারপর অদ্ভুত কায়দায় অত্যন্ত দ্রুত ওর হাত-পাগুলো দড়িজাতীয় কিছু দিয়ে বেঁধে ফেলল।
আনা নিষ্ফল আক্রোশে ছটফট করতে লাগল।
“বাঃ! আপনি তো খুব কাজের লোক দেখছি।” ইভলিন অনির্বাণের দিকে প্রসন্নদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন।
“ওঃ, ইট’স নাথিং।” অনির্বাণ অল্প হেসে বলল, “এবার কাজের কথা হোক।”
ইভলিন ওর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, “চিরুনিটা কোথায়?”
“ইন সেফ হ্যান্ডস।”
“হুম, ওটার বিনিময়ে কত টাকা চান?”
“বেশি নয়, ওয়ান মিলিয়ন ইউএস ডলারস।”
“আই সি।”
ইভলিন কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, “দেখুন এজেন্ট Vaan, লেট মি বি ফ্র্যাংক উইথ ইউ। আমি চিন্তা করে দেখলাম যে, আপনি যা চাইছেন, চিরুনিটার মূল্য আসলে তার চেয়ে অনেক বেশি। আমি আপনাকে ঠকাব না। আপনি চিরুনিটা আমায় দিয়ে দিন, আমি তার বদলে আপনাকে একটা অতি মূল্যবান জিনিস দেব।”
“তা সেই অতি মূল্যবান বস্তুটা কী, সেটা জানতে পারি?”
“শিয়োর! আপনার প্রাণ! মানুষের কাছে নিজের প্রাণের চেয়ে মূল্যবান আর কী হতে পারে!”
“তার মানে?”
ইভলিনের মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসির রেখা ফুটে উঠল, “দেখুন, আই অ্যাম শিয়োর যে জিনিসটা এখন আপনার সঙ্গেই আছে। ওটা আমায় দিয়ে দিন, আমি কথা দিচ্ছি যে, আপনাকে এখান থেকে নিরাপদে চলে যেতে দেব। না হলে কিন্তু…”
অনির্বাণ একটু উশখুশ করে বলল, “আপনাকে বিশ্বাস করব কীভাবে?”
“ইউ ডোন্ট হ্যাভ অ্যান অপশন, ডিয়ার।”
ইভলিন মোলায়েম স্বরে বললেন।
কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে অনির্বাণ অবশেষে বলল, “অলরাইট।”
তারপর নিজের পোশাকের মধ্যে একটা লুকোনো পকেট থেকে কিছু একটা বের করল। তারপর জিনিসটা ডান হাতে নিয়ে ওপরে তুলে ধরল।
“নো-ও-ও-ও…”
জিনিসটা অনির্বাণের হাতে দেখেই আনা চিৎকার করে উঠল, “এজেন্ট Vaan, প্লিজ় ডোন্ট ডু দিস।”
“আই অ্যাম সরি, আনা।”
অনির্বাণ বলল, “আই ডোন্ট হ্যাভ আ চয়েস হিয়ার!”
তারপর জিনিসটা নিয়ে ইভলিনের দিকে এগোতেই উনি ওকে বাধা দিয়ে বললেন, “স্টপ! আমার কাছে আসার প্রয়োজন নেই। ওটা আমার দিকে ছুড়ে দিন।”
অনির্বাণ আদেশ পালন করল।
ইভলিন বাঁ হাতে জিনিসটা লুফে নিলেন। তারপর চোখের কাছে এনে ভালোভাবে পরীক্ষা করতে থাকলেন। মুহূর্তের জন্য ওঁর দৃষ্টি অনির্বাণের ওপর থেকে সরে গেল।
আর ঠিক তখনই অনির্বাণের একটা হাত ওর বেল্টের দিকে চলে গেল।
পরক্ষণেই ইভলিনের শরীরটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। ওঁর হাত থেকে চিরুনি আর পিস্তল দুটোই পড়ে গেল। আর তারপরেই ওঁর সংজ্ঞাহীন দেহটা সুড়ঙ্গের মেঝেতে এলিয়ে পড়ল।
১৬
জাহাজটা আটলান্টিক মহাসাগরের মহাসাগরের অসীম জলরাশির ওপর দিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলেছিল।
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ মাথার ওপর নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশের দিকে চেয়ে ছিল।
হঠাৎ কাঁধের ওপর একটা নরম স্পর্শ পেয়ে ও সচকিত হয়ে উঠল।
আনা!
অনির্বাণের গালে হাত রেখে উনি বললেন, “ব্যথা আছে?”
“তা একটু আছে।”
“আই অ্যাম সো সরি। আসলে এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি যে, আপনি অভিনয় করছেন।”
“ভাগ্যিস মনে হয়নি। ভাগ্যিস আপনি আমায় চড়টা মেরেছিলেন। নয়তো ইভলিনের কাছে আমার কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য হত না।”
“আর তাহলে উনি আপনার পাতা ফাঁদে পা দিতেন না, তা-ই তো?”
“ঠিক তা-ই।”
এই ফাঁদের ব্যাপারটা ফিশিং বোটে চেপে নিউম্যান’স আইল্যান্ড এলাকা ছেড়ে এই জাহাজে পৌঁছে অনির্বাণ ব্যাখ্যা করেছিল। পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে জেসন এই জাহাজটা নিয়ে ওদের জন্য আমেরিকার জলসীমার ঠিক বাইরে অপেক্ষা করছিল। অনির্বাণ আনা আর আইশার সঙ্গে জাহাজে পৌঁছোনোর পরে ওই ফিশিং বোটটা ডুবিয়ে দেওয়া হয়। তারপর জাহাজ আটলান্টিক মহাসাগরের পথ ধরে ইউরোপের অভিমুখে চলতে থাকে।
“ইভলিনকে যে চিরুনিটা দিয়েছিলাম,” জাহাজের ডাইনিং হলে বসে ডিনার সারতে সারতে অনির্বাণ বলেছিল, “সেটা ছিল আসল চিরুনিটার একটা নিখুঁত রেপ্লিকা। ওটার মধ্যে একটা বিশেষ বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্র লুকোনো ছিল। আমার বেল্টের সঙ্গে লাগানো একটা রিমোট ডিভাইসের সাহায্যে যন্ত্রটা সুইচ অন করা যেত। ইভলিন চিরুনিটা হাতে পেতেই আমার দিক থেকে ওর মনোযোগ সরে যায়। আর সেই সুযোগেই আমি রিমোট ডিভাইসের সাহায্যে যন্ত্রটা সুইচ অন করে দিই। আর অমনি বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্রটা থেকে উচ্চশক্তির বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহিত হতে থাকে। তার ধাক্কাতেই ইভলিন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ফলে উনি আর নিজের লোকজনকে অ্যালার্ট করার সুযোগ পাননি। আর তাই আমি আনাকে নিয়ে সমুদ্রের নীচ দিয়ে সহজেই আমাদের ফিশিং বোটে ফিরে আসতে পারি।”
ডিনারের পরে সবাই নিজের নিজের কেবিনে বিশ্রাম করতে চলে গিয়েছিল। কেবল অনির্বাণ জাহাজের ডেকে উঠে এসেছিল।
আর এখন আনাও ওর খোঁজ করতে করতে এখানে এসে পৌঁছেছে।
ওরা দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
অবশেষে আনা মৌন ভঙ্গ করলেন, “ইভলিন তো আপনার পরিচয় জেনে গিয়েছেন, এজেন্ট Vaan। এবার তো তাহলে উনি SRI-এর বিরুদ্ধে নিউম্যান’স আইল্যান্ডে আন-অথরাইজ়ড অপারেশন চালানোর অভিযোগে আনতে পারেন।”
“নাঃ, সেটা করলে তো প্রোজেক্ট অর্ফিয়ুস-এর কথা জানাজানি হয়ে যাবে। আমেরিকার গভর্নমেন্ট নিশ্চয়ই সেটা চাইবে না।”
“বুঝলাম, কিন্তু আমার আর আইশার কী হবে, এজেন্ট Vaan? আমাদের মাথার ওপর তো SRI-এর মতো কোনো আন্তর্জাতিক সংগঠনের ছত্রছায়া নেই।”
“আমি যতক্ষণ আপনাদের সঙ্গে আছি, আপনাদের কোনো চিন্তা নেই। আপনারা মানবজাতির জন্য যা করেছেন, তার গুরুত্ব আমি বুঝি। আপনাদের এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখব, যেখানে আপনারা আপনাদের সাইকিক শক্তি আর ওই অলৌকিক চিরুনিটা নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারেন। আর মানবতার জন্য কাজ করে যেতে পারেন। কেউ কখনও আপনাদের বিরক্ত করতে আসবে না।”
আনা একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল।
তারপর অনির্বাণের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, “থ্যাংক ইউ এজেন্ট Vaan, থ্যাংক ইউ সো মাচ!”
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, স্বর্ণদীপ রায়
