আলোকজাল
লেখক: অরিত চক্রবর্তী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
অধ্যায় ১: অব্যাখ্যাত সংকেত
অক্টোবরের সন্ধ্যার হালকা শীতল হাওয়া কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো ইটের দেয়াল ছুঁয়ে বইছিল। দোতলার জানালা দিয়ে কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানের ফ্লুরোসেন্ট আলো ভেসে আসছিল, যেন শত বছরের জ্ঞানের আলো। কিন্তু আজ সেই আলোও ড. অভিজিৎ রায়চৌধুরীর মানসিক অশান্তি দূর করতে পারছিল না।
অভিজিতের হাত কাঁপছিল—এমন নয় যে ঠান্ডায়, বরং যা দেখছিল তার আতঙ্কে। তার চুল এলোমেলো, চশমা নাকের ডগায় নেমে এসেছে। সাদা ল্যাব কোটের পকেট থেকে একটা পেন খসে পড়েছে মেজেতে, কিন্তু তাঁর সেদিকে খেয়াল নেই। তার সামনের ২৭ ইঞ্চি স্যামসাং মনিটরে ভেসে উঠেছিল এমন এক ব্রেইন স্ক্যানের ছবি যা তার গত পনেরো বছরের নিউরোসায়েন্স ক্যারিয়ারের সমস্ত ধারণাকে ধুলিসাৎ করে দিচ্ছিল।
তিনি আস্তে আস্তে চেয়ারে হেলান দিলেন। চেয়ারের চাকা মেজের নীচের তারের ওপর দিয়ে গড়িয়ে একটা ক্রিক ক্রিক আওয়াজ তুলল। তার কানে সেই শব্দও যেন দূরের কোথাও থেকে ইকো হয়ে আসছে বলে মনে হল।
নিউরোসায়েন্স বিভাগের তৃতীয় তলার এই ছোট্ট গবেষণাগারটি অভিজিতের দ্বিতীয় ঘর। দেয়ালে ঝুলানো তার পিএইচডির সার্টিফিকেট, প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে হানিমুনের ছবি, আর বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালের প্রচ্ছদ। টেবিলের কোণে একটা মগে ঠান্ডা চা, যেটা তিনি সকাল থেকে স্পর্শ করেননি।
বাইরে কলকাতার সন্ধ্যার কোলাহল—ট্রামের ঘণ্টা যেন আজও ১৯ শতকের সেই পুরোনো ধুন বাজাচ্ছে, বাসের হর্ন, হকারদের ডাকাডাকি, পার্ক স্ট্রিটের ট্যাক্সির আওয়াজ। সাধারণত এই শব্দগুলো তাকে মানসিক প্রশান্তি দেয়, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এক অন্য জগতের আওয়াজ। তার পুরো মনোযোগ কেবল সেই অসাধারণ নিউরাল প্যাটার্নে যা কম্পিউটার স্ক্রিনে একটা জটিল নৃত্য পরিবেশনা করছিল।
ল্যাবের LED ডেস্ক ল্যাম্পের সাদা আলো তার চশমার কাচে প্রতিফলিত হচ্ছিল, তৈরি করছে ছোট্ট রংধনু। তিনি চশমাটা খুলে পরিষ্কার করলেন—প্রথমে একবার, তারপর দুবার, তিনবার। তারপর আবার পরে স্ক্রিনের দিকে তাকালেন। না, তার চোখের ভুল নয়। মস্তিষ্কের স্ক্যানে যে অদ্ভুত তরঙ্গ প্যাটার্ন দেখাচ্ছে, সেটা ঠিক তেমনই আছে। লাল, নীল, সবুজ রঙের কোডিংয়ে দেখানো নিউরাল অ্যাক্টিভিটি যেন কোনো অজানা ভাষায় লেখা চিঠি।
“এটা অসম্ভব,” তিনি একা একা বিড়বিড় করলেন। তার গলার স্বর ভেঙে যাচ্ছিল। শুষ্ক গলা, যেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেননি। “একেবারে অসম্ভব। এমন কোনো কেস স্টাডি নেই, কোনো রেফারেন্স নেই…”
তিনি মাউসটা নাড়িয়ে স্ক্রিনের ব্রাইটনেস বাড়ালেন। তারপর আবার কমালেন। কনট্রাস্ট চেঞ্জ করলেন। কিন্তু যা দেখছিলেন তাতে কোনো ভুল নেই।
দরজায় হালকা টোকার আওয়াজ। তিনবার—টক টক টক। এটা প্রিয়াঙ্কার সিগনেচার নক। “অভিজিৎদা?”
অভিজিৎ মাথা তুলে দেখলেন তার গবেষণা সহকারী এবং স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা সেন দরজার ফ্রেমে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। তার গলায় একটা হালকা নীল স্কার্ফ, যেটা তিনি সর্বদা পরেন এই অক্টোবরের শীতে। তার চুল একটা ঝুঁটিতে বাঁধা, কয়েকটা খোঁপা খুলে গিয়ে কপালে পড়েছে। তার চোখে সেই পরিচিত চিন্তার ছায়া—যেটা অভিজিৎ গত সাত বছরের বিবাহিত জীবনে অনেকবার দেখেছেন।
প্রিয়াঙ্কা আইআইটি দিল্লি থেকে কোয়ান্টাম ফিজিক্সে পিএইচডি করেছেন। তার বিশেষত্ব কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট এবং কোহেরেন্স। গত তিন বছর ধরে তিনি অভিজিতের সঙ্গে মস্তিষ্ক ও চেতনা নিয়ে ইন্টারডিসিপ্লিনারি গবেষণা করছেন—একদিকে নিউরোসায়েন্স, অন্যদিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
“এখনও অফিসে? রাত তো প্রায় আটটা বেজে গেছে।” প্রিয়াঙ্কা দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে স্বামীর চেহারা দেখে থমকে গেলেন। অভিজিতের মুখ ফ্যাকাশে, চোখে একটা অদ্ভুত উজ্জ্বলতা—যেটা সাধারণত আবিষ্কারের মুহূর্তে আসে। “কী হয়েছে? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো অভূতপূর্ব কিছু দেখেছ।”
অভিজিৎ গভীর নিশ্বাস নিলেন। “প্রিয়াঙ্কা, এদিকে এসো। এটা দেখো।” তার গলায় উত্তেজনা এবং আতঙ্ক মিশে ছিল।
প্রিয়াঙ্কা কাছে এসে অভিজিতের চেয়ারের পাশে দাঁড়ালেন। তার পরনে নীল রঙের কার্ডিগান, যার হাতা গুটিয়ে রাখা। এই অক্টোবরের হালকা ঠান্ডায় ল্যাবটা একটু শীতল হয়ে উঠেছে। বেঞ্চের ওপর ছড়িয়ে থাকা কাগজপত্র, ফাইল, আর বিভিন্ন যন্ত্রাংশের মাঝে কম্পিউটারটা জ্বলজ্বল করছে।
“এই স্ক্যানটা…” প্রিয়াঙ্কা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকালেন। “এটা কার?”
“আজ সকালে যে রোগীটি এসেছিল। নাম অর্জুন মিশ্র। বয়স পঁয়ত্রিশ। পেশা… মধু সংগ্রাহক।” অভিজিৎ ফাইলটা নেড়েচেড়ে দেখলেন। ফাইলের কাগজগুলো একটু কুঁচকানো—তিনি সারাদিন ধরে বারবার পড়েছেন। “সে বলেছিল যে গত ছয় মাস ধরে তার মাথায় অদ্ভুত জিনিস ঘটছে। প্রথমে ভেবেছিল চাপের কারণে। কিন্তু ব্যাপারটা ক্রমশ বাড়ছে।”
অভিজিৎ থামলেন, তারপর ফাইল থেকে চোখ তুলে প্রিয়াঙ্কার দিকে তাকালেন। “অর্জুন বলেছে যে মাঝে মাঝে তার মনে হয় অন্য কারো চিন্তাভাবনা তার মাথায় ভেসে উঠছে। শুধু তাই নয়, সে বলতে পারে পাশের রুমে কে কী ভাবছে। এমনকী একবার সে তার স্ত্রীর স্বপ্নের কথা বলে দিয়েছিল—এমন একটা স্বপ্ন যেটা তার স্ত্রী কাউকে বলেনি।”
প্রিয়াঙ্কা তাড়াতাড়ি চেয়ারটা টেনে কাছে এনে বসলেন। “সাইকিক অ্যাবিলিটি? টেলিপ্যাথি?”
“আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু তার রক্ত পরীক্ষা, ইইজি, সব স্বাভাবিক। মানসিক স্বাস্থ্যেরও কোনো সমস্যা নেই।” অভিজিৎ স্ক্রিনের দিকে ইশারা করলেন। “কিন্তু এই MRI স্ক্যানটা…”
প্রিয়াঙ্কা ব্রেইন স্ক্যানের ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন। তিনি মাউস নিয়ে ইমেজ জুম করলেন, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখলেন। নিউরাল নেটওয়ার্কের জটিল গ্রাফে কিছু অদ্ভুত তরঙ্গ দেখা যাচ্ছিল। এগুলো একেবারে নিয়মিত, প্রায় যেন কৃত্রিমভাবে তৈরি। সাধারণত মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গ এত নিয়মিত হয় না—সেখানে র্যান্ডমনেস থাকে, ক্যাওস থাকে।
“এই ফ্রিকোয়েন্সি…” প্রিয়াঙ্কা একটা পেনসিল নিয়ে দ্রুত কিছু ক্যালকুলেশন করলেন। “অভিজিৎদা, এটা দেখতে ঠিক কোয়ান্টাম অসিলেশনের মতো। ১৪.৭ হার্জের মাল্টিপল ফ্রিকোয়েন্সি।”
“এবং সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হল,” অভিজিৎ ল্যাপটপে আরেকটা ফাইল খুললেন, “আমাদের ব্রেইন স্ক্যানিং মেশিনের রিডিং বলছে এই তরঙ্গগুলো মস্তিষ্কের অভ্যন্তর থেকে আসছে না। এগুলো কোনো বাহ্যিক উৎস থেকে আসছে, কিন্তু রোগীর নিউরনের সঙ্গে পারফেক্ট সিঙ্ক্রোনাইজেশনে চলছে।”
প্রিয়াঙ্কা কলম ফেলে দিয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন। তার চোখ বড়ো হয়ে গেছে। “তুমি কী বলতে চাইছ সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা…”
“এটা যে কী তাই আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু যদি আমাদের ডেটা সঠিক হয়, তাহলে এই মানুষটির মস্তিষ্ক কোনো অজানা বাহ্যিক উৎসের সঙ্গে কোয়ান্টাম লেভেলে এনট্যাঙ্গল হয়ে গেছে।” অভিজিৎ নিজের কথাগুলো বলতে বলতেই গলার স্বর ভারী হয়ে এল।
দুজনেই কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। ল্যাবের ভেতর শুধু কম্পিউটারের ফ্যানের মৃদু গুঞ্জন আর বাইরে থেকে আসা কলকাতার রাতের আওয়াজ।
প্রিয়াঙ্কা চেয়ারটা টেনে অভিজিতের আরও কাছে এনে বসলেন। তিনি তার হাতব্যাগ থেকে একটা নোটবুক বের করলেন—সর্বদা সঙ্গে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু লিখে রাখার জন্য। “রোগীটি কোথাকার?”
“উত্তর পশ্চিমবঙ্গের একটা জায়গা। নাম নীরক্ষেত্র।” অভিজিৎ ফাইল ঘেঁটে রোগীর ঠিকানা দেখলেন। “দার্জিলিং জেলার খুবই গভীর পাহাড়ি এলাকা। অর্জুন বলেছে ওখানে পৌঁছতে শিলিগুড়ি থেকে আরও চার ঘণ্টার পাহাড়ি রাস্তা। তারপর পায়ে হেঁটে আরও দেড় ঘণ্টা।”
অভিজিৎ থামলেন, অর্জুনের দেওয়া বর্ণনাটা মনে করার চেষ্টা করলেন। “অর্জুন বলেছে যে ওই অঞ্চলটা তিন দিক দিয়ে উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে একটা উপত্যকা, আর সেখানেই তাদের ছোট্ট গ্রাম। মাত্র ষাট-সত্তর ঘর। আর গ্রামের চারদিকে ঘন জঙ্গল।”
“নীরক্ষেত্র?” প্রিয়াঙ্কা নামটা নোটবুকে লিখে নিলেন। “অদ্ভুত নাম। মানে কী?”
“অর্জুনের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলেছে তার ঠাকুর্দার কাছে শুনেছে যে এই নামের অর্থ ‘শূন্য ক্ষেত্র’ বা ‘নীরব স্থান’। কিন্তু আসলে ওখানে কোনো নীরবতা নেই। রাতে জঙ্গল জীবন্ত হয়ে ওঠে।”
অভিজিৎ আবার ফাইলটা পড়তে লাগলেন। তার হাতের লেখায় অর্জুনের সাক্ষাৎকারের নোট। “অর্জুন বলেছে যে তার গ্রামের আরও কয়েকজনের এই একই ধরনের সমস্যা আছে। বিশেষ করে যারা জঙ্গলের গভীরে মধু সংগ্রহের কাজ করে। তারা নাকি বলে যে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় গেলে তাদের মনে অন্যদের চিন্তা ভেসে ওঠে।”
প্রিয়াঙ্কা পেনসিল দিয়ে নোটবুকে টোকা দিতে লাগলেন—তার চিন্তা করার অভ্যাস। “কয়জন?”
“অর্জুনের হিসেবে অন্তত সাত-আটজন। সবাই মধু সংগ্রাহক। সবারই একই ধরনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু মজার বিষয় হল, এই সমস্যা শুধু তাদেরই যারা জঙ্গলের একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে কাজ করে।”
“কেমন অঞ্চল?”
অভিজিৎ নোটের পাতা উলটালেন। “অর্জুনের ভাষায়, ‘যেখানে রাতে গাছেরা জ্বলে’। প্রথমে ভেবেছিলাম রূপক কথা। কিন্তু পরে সে বিস্তারিত বর্ণনা দিল। বলল যে জঙ্গলের কিছু অংশে রাতে নীলাভ আলো জ্বলে। মাটি থেকে, গাছের গুড়ি থেকে, এমনকি পাতা থেকেও।”
প্রিয়াঙ্কা ভ্রু কুঁচকালেন। “বায়োলুমিনেসেন্স? জোনাকির মতো?”
“হতে পারে। কিন্তু অর্জুন বলেছে এটা জোনাকি নয়। এটা যেন গাছের অংশই।” অভিজিৎ থামলেন। “এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, যারা এই আলোকিত অঞ্চলে বেশি সময় কাটায়, তাদের এই মানসিক ক্ষমতা বেশি।”
প্রিয়াঙ্কা ভ্রু কুঁচকালেন। “এটা হ্যালুসিনেশন হতে পারে।”
“আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু এই স্ক্যান তো হ্যালুসিনেশন নয়। এটা সত্যিকারের কোয়ান্টাম অ্যাক্টিভিটি।”
হঠাৎ অভিজিতের মনে পড়ে গেল। গত মাসে Nature Neuroscience জার্নালে একটা আর্টিকেল পড়েছিলেন। পূর্ব হিমালয়ের কিছু অঞ্চলে নাকি অদ্ভুত ধরনের বায়োলুমিনেসেন্ট ছত্রাক পাওয়া যায়। স্থানীয়রা বলে যে এই ছত্রাকগুলো রাতে আলো দেয় এবং কোনোভাবে মানুষের মনের সঙ্গে যুক্ত। তখন তিনি ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবেননি। কিন্তু এখন…
“প্রিয়াঙ্কা, আমার মনে হচ্ছে আমাদের ওখানে যেতে হবে।”
“কোথায়? নীরক্ষেত্রে?” প্রিয়াঙ্কা একটু অবাক হলেন।
“হ্যাঁ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এই ঘটনার সঙ্গে ওই পাহাড়ি জঙ্গলের কোনো গভীর সম্পর্ক আছে। হয়তো কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা, যা আমাদের আধুনিক বিজ্ঞান এখনও সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারেনি। হয়তো কোয়ান্টাম বায়োলজির কোনো নতুন দিক।”
প্রিয়াঙ্কা স্বামীর চোখে সেই চেনা ঝিলিক দেখলেন—যা তখনই আসে যখন তিনি কোনো বিরাট আবিষ্কারের গন্ধ পান। অভিজিৎ যখন এভাবে উত্তেজিত হন, তখন তার মানসিক শক্তি যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়। প্রিয়াঙ্কা জানেন যে এই অবস্থায় তাকে থামানো প্রায় অসম্ভব।
“ঠিক আছে। কিন্তু এত তাড়াহুড়ো না করে প্রথমে আরও কিছু ডেটা কালেক্ট করা দরকার। অর্জুনের সঙ্গে আরও বিস্তারিত কথা বলতে হবে। এবং নীরক্ষেত্র সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।” প্রিয়াঙ্কা ব্যবহারিক দিকটা ভাবলেন। তিনি জানেন যে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অতিরিক্ত উৎসাহ কখনও কখনও ভুল সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়।
অভিজিৎ সম্মতিতে মাথা নাড়লেন। তিনি আবার অর্জুনের ফাইলটা খুললেন। রোগীর বর্ণনা অনুযায়ী, নীরক্ষেত্রের জঙ্গলে কিছু জায়গা আছে যেখানে রাতে গাছের গুড়িতে এবং মাটিতে নীল আলো জ্বলে। স্থানীয়রা এই জায়গাগুলোকে “চৈতন্যক্ষেত্র” বলে ডাকে। তাদের বিশ্বাস যে যারা এই অঞ্চলে বেশি সময় কাটায়, তাদের মানসিক ক্ষমতা বেড়ে যায়।
“প্রিয়াঙ্কা, তুমি কী মনে কর? এটা কি সম্ভব যে কোনো জৈবিক উৎস থেকে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট হতে পারে?”
প্রিয়াঙ্কা কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। তিনি তার নোটবুকে কিছু সূত্র লিখলেন, তারপর কাটলেন। “তাত্ত্বিকভাবে অসম্ভব নয়। কোয়ান্টাম বায়োলজি এখন প্রমাণিত বিষয়। পাখিদের চৌম্বকীয় নেভিগেশন সিস্টেম, উদ্ভিদের ফোটোসিনথেসিস প্রক্রিয়া—সবকিছুতেই কোয়ান্টাম মেকানিক্স কাজ করে। এমনকি মানুষের ঘ্রাণের ক্ষেত্রেও কোয়ান্টাম এফেক্টের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু চেতনার ক্ষেত্রে? দূরত্ব নির্বিশেষে?”
তিনি থামলেন, তারপর আবার বললেন, “এটা হলে নিউরোসায়েন্সের সমস্ত মৌলিক ধারণা বদলে যাবে।”
“আর যদি শুধু মানুষের চেতনা না হয়? যদি কোনো বৃহত্তর নেটওয়ার্ক হয়? যদি প্রকৃতিই এমন একটা সিস্টেম তৈরি করে ফেলেছে যা আমরা এখনও বুঝতে পারিনি?”
“কী ধরনের নেটওয়ার্ক?” প্রিয়াঙ্কা তার পেনসিলটা মুখে দিয়ে চিবোতে লাগলেন—চিন্তা করার সময়ের আরেকটা অভ্যাস।
“ছত্রাকের মাইসেলিয়াল নেটওয়ার্কের কথা ভাবো। একটি ছত্রাক নেটওয়ার্ক কয়েক বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে এই নেটওয়ার্ক বিভিন্ন গাছের মধ্যে পুষ্টি এবং তথ্য আদান-প্রদান করে। যদি এই ধরনের কোনো নেটওয়ার্ক কোয়ান্টাম লেভেলে কাজ করতে পারে…”
অভিজিৎ আর কথা শেষ করতে পারলেন না। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা ব্যাপারটা বুঝে ফেললেন।
দুজনেই একযোগে নীরব হয়ে গেলেন। বাইরে কলকাতার রাতের আওয়াজ আসতে আসতে কমে যাচ্ছিল। ট্রামের শেষ ট্রিপ শেষ হয়ে গেছে। পার্ক স্ট্রিটের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে এখনও মাঝে মাঝে হর্নের আওয়াজ ভেসে আসছে। কিন্তু কলেজ স্ট্রিট এখন শান্ত। বইয়ের দোকানগুলোর বন্ধ শাটারের ওপর রাস্তার আলো পড়ে অদ্ভুত ছায়া তৈরি করছে।
ল্যাবের জানালা দিয়ে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির পুরোনো বিল্ডিংটার দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে রাতের আলোয় সেটা কেমন রহস্যময় লাগছে। যেন এই পুরোনো দেয়ালগুলো অনেক অজানা রহস্যের সাক্ষী।
“অভিজিৎদা,” প্রিয়াঙ্কা মৃদু গলায় বললেন, “যদি তোমার অনুমান ঠিক হয়, তাহলে এটা শুধু নিউরোসায়েন্সে নয়, পুরো বিজ্ঞানের ইতিহাসেই এক নতুন অধ্যায় হতে পারে। চেতনা, তথ্য বিনিময়, এমনকি জীবনের সংজ্ঞাই পালটে যেতে পারে।”
অভিজিৎ ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। তার মন ইতিমধ্যে চলে গিয়েছিল সেই রহস্যময় পাহাড়ি জঙ্গলে, যেখানে হয়তো লুকিয়ে আছে চেতনার এক অকল্পনীয় রহস্য। যেখানে হয়তো প্রকৃতি নিজেই তৈরি করেছে এক জৈবিক ইন্টারনেট।
কম্পিউটার স্ক্রিনে এখনও জ্বলজ্বল করছিল সেই অব্যাখ্যাত কোয়ান্টাম সংকেত। সেই নিয়মিত, প্রায় মিউজিক্যাল প্যাটার্ন যা বলছে যে অর্জুন মিশ্রের মস্তিষ্ক কোনো অজানা উৎসের সঙ্গে যুক্ত।
আর অভিজিতের মনে বারবার ভেসে উঠছিল অর্জুনের সেই শেষ কথাগুলো, যা তিনি বলেছিলেন ক্লিনিক ছেড়ে যাওয়ার সময়: “ডাক্তারবাবু, ওই জঙ্গলে কিছু একটা আছে। আমি জানি আপনি বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু ওটা আমাদের সবাইকে এক সূত্রে বেঁধে দিচ্ছে। যেন আমরা সবাই একটা বড়ো মনের অংশ হয়ে গেছি।”
অধ্যায় ২: গবেষণার গভীরে
পরের দিন সকাল সাতটার সময় প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে একটা নীরব যুদ্ধ চলছিল। কলকাতার নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের হালকা ঠান্ডা হাওয়া জানালা দিয়ে ভেতরে আসছিল, কিন্তু অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কার মাথায় ঘাম। গত রাতে তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে ভোরে উঠে তারা লাইব্রেরিতে এসেছেন—একটা বৈজ্ঞানিক রহস্যের সমাধান খুঁজতে।
লাইব্রেরির দোতলার পূর্ব কোণের একটা বড়ো টেবিলে তারা নিজেদের ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে নিউরোসায়েন্স, কোয়ান্টাম ফিজিক্স, মাইকোলজি (ছত্রাক বিজ্ঞান), এবং বায়োলজিক্যাল কম্পিউটিং নিয়ে অসংখ্য জার্নাল। অভিজিতের ল্যাপটপে এখনও খোলা আছে গতকালের সেই রহস্যময় ব্রেইন স্ক্যান—যে ছবিটি তাদের পুরো জীবন বদলে দিতে চলেছে।
প্রিয়াঙ্কা তার নোটবুকের একটা পাতা ভরে ফেলেছেন জটিল গাণিতিক সূত্রে। তার সামনে একটা ছোটো ক্যালকুলেটর, যেটা দিয়ে তিনি বারবার কোয়ান্টাম ফ্রিকোয়েন্সির হিসাব করছেন। তার চুল এলোমেলো হয়ে গেছে, কপালে একটা গভীর ভাঁজ—যেটা তখনই আসে যখন তিনি কোনো জটিল সমস্যায় সম্পূর্ণ মনোযোগ দেন।
“এটা দেখো,” প্রিয়াঙ্কা হঠাৎ একটা পেপার অভিজিতের দিকে এগিয়ে দিলেন। তার গলায় উত্তেজনা এবং আবিষ্কারের আনন্দ মিশে ছিল। “২০২৩ সালের Nature Physics জার্নালের একটা আর্টিকেল। শিরোনাম: ‘Quantum Coherence in Biological Networks: Evidence from Mycorrhizal Systems’।”
অভিজিৎ পেপারটা নিয়ে দ্রুত পড়তে শুরু করলেন। তার চোখ ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠছিল। “অবিশ্বাস্য! গবেষকরা প্রমাণ করেছেন যে কিছু ছত্রাকের মাইসেলিয়াল নেটওয়ার্ক কোয়ান্টাম কোহেরেন্স বজায় রাখতে পারে,” তিনি জোরে পড়লেন। “এবং এই কোহেরেন্স সাধারণ তাপমাত্রা এবং পরিবেশগত নয়েজের উপস্থিতিতেও স্থিতিশীল থাকে।”
কোয়ান্টাম কোহেরেন্স হচ্ছে একটি অবস্থা যেখানে কোয়ান্টাম সিস্টেমের বিভিন্ন অংশ একসঙ্গে সুসংগতভাবে কাজ করে—ঠিক যেন একটা অর্কেস্ট্রার সব বাদ্যযন্ত্র একসঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজছে। সাধারণত মনে করা হত যে জৈবিক সিস্টেমে এই অবস্থা টিকে থাকতে পারে না কারণ জীবন্ত কোশে অনেক বেশি তাপমাত্রা, গোলমাল এবং অস্থিরতা থাকে। কিন্তু এই গবেষণা সেই ধারণাকে উলটে দিয়েছে।
“আর এখানে আরও ইন্টারেস্টিং জিনিস আছে,” প্রিয়াঙ্কা তার নোটবুক দেখিয়ে বললেন। তিনি সারারাত জেগে এই পেপারের ডেটা বিশ্লেষণ করেছেন। “তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে এই নেটওয়ার্কগুলো শুধু পুষ্টি আর রাসায়নিক সংকেত নয়, তথ্যও আদান-প্রদান করে। এবং সেই তথ্য আদান-প্রদানের গতি আলোর গতির প্রায় সমান!”
অভিজিৎ চোখ বড়ো করে তাকালেন। “কী বলছ তুমি?”
“আমি বলছি যে এই নেটওয়ার্কে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট কাজ করছে।” প্রিয়াঙ্কা তার পেনসিল দিয়ে নোটবুকে একটা জটিল ডায়াগ্রাম আঁকতে শুরু করলেন। “দুটো এনট্যাঙ্গল্ড কণার মধ্যে তাৎক্ষণিক তথ্য আদান-প্রদান হয়, দূরত্ব যতই হোক না কেন।”
কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট হচ্ছে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের সবচেয়ে রহস্যময় এবং বিস্ময়কর ঘটনা। আইনস্টাইন একে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন “spooky action at a distance”—দূরত্বে ভূতুড়ে কার্যকলাপ। যখন দুটো কণা এনট্যাঙ্গল্ড হয়, তখন একটির অবস্থা পরিবর্তন করলে অন্যটির অবস্থাও তাৎক্ষণিকভাবে পরিবর্তিত হয়, তারা মহাবিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন। এটা আপেক্ষিকতার নিয়মকে ভাঙে না, কারণ এখানে কোনো তথ্য বা শক্তি স্থানান্তর হয় না—শুধু কোরিলেশন থাকে।
“কিন্তু এখানে আসল বিষয়টা আছে,” অভিজিৎ আরেকটা পেপার খুলে দেখালেন। তার হাত একটু কাঁপছিল উত্তেজনায়। “এই গবেষণাটি উত্তরপূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে করা হয়েছে। আর দেখো এই ছত্রাকের প্রজাতির নাম—Luminomyces Conscientiae।”
“Luminomyces Conscientiae?” প্রিয়াঙ্কা ল্যাটিন নামটা উচ্চারণ করলেন। “মানে ‘চেতনার আলোকিত ছত্রাক’?”
“ঠিক তাই। এবং এই প্রজাতিটি শুধুমাত্র পাওয়া যায় পূর্ব হিমালয়ের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে—যেখানে উচ্চতা ১৮০০ থেকে ২৮০০ মিটার, আর্দ্রতা ৮৫% এর বেশি, এবং মাটিতে নির্দিষ্ট খনিজ পদার্থ আছে।” অভিজিৎ তার নোট পড়তে লাগলেন। “বৈশিষ্ট্য: রাতে তীব্র নীল-সবুজ বায়োলুমিনেসেন্স, অর্থাৎ নিজস্ব আলো উৎপাদন। আর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয়—এরা বিস্তৃত কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক তৈরি করে।”
বায়োলুমিনেসেন্স হচ্ছে জীবের নিজস্ব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আলো উৎপাদনের ক্ষমতা। জোনাকি, গভীর সমুদ্রের মাছ, কিছু ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকে এই ক্ষমতা দেখা যায়। কিন্তু Luminomyces Conscientiae-র আলো অন্যদের চেয়ে আলাদা—এটা শুধু আলো নয়, যেন তথ্যবাহক।
প্রিয়াঙ্কা তার চেয়ারে এগিয়ে এসে বসলেন। “অভিজিৎদা, তুমি কি বলতে চাইছ যে এই ছত্রাকগুলো কোনোভাবে মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট তৈরি করতে পারে?”
“থিয়োরিটিক্যালি এটা সম্পূর্ণ সম্ভব,” অভিজিৎ আরেকটা পেপার খুলে দেখালেন। “মানুষের নিউরনেও কোয়ান্টাম প্রসেস চলে। বিশেষ করে মাইক্রোটিউবিউল স্ট্রাকচারে। রজার পেনরোজ এবং স্টুয়ার্ট হেমেরফের ‘অর্কেস্ট্রেটেড অবজেক্টিভ রিডাকশন’ থিয়োরি অনুযায়ী, চেতনা নিজেই একটা কোয়ান্টাম ঘটনা হতে পারে।”
মাইক্রোটিউবিউল হচ্ছে কোশের অভ্যন্তরের ছোট্ট নলাকার প্রোটিন স্ট্রাকচার যা কোশের কাঠামো বজায় রাখে এবং কোশের ভেতরে পরিবহনের কাজ করে। পেনরোজ-হেমেরফ থিয়োরি অনুযায়ী, নিউরনের এই মাইক্রোটিউবিউলে কোয়ান্টাম কম্পিউটেশন চলে যা চেতনা সৃষ্টি করে। এই থিয়োরি এখনও বিতর্কিত, কিন্তু ক্রমশ আরও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
হঠাৎ অভিজিতের মোবাইল বেজে উঠল। রিংটোন লাইব্রেরির নিস্তব্ধতা ভেঙে দিল। ফোনে অর্জুন মিশ্রের নাম ভেসে উঠল। “হ্যালো, অর্জুনবাবু?”
“ডাক্তারবাবু, আমি কলকাতায় আছি। আজ সকালে এসেছি শিয়ালদহের ট্রেনে।” অর্জুনের গলায় উদ্বেগ এবং তাড়াহুড়ো। “আপনার সঙ্গে জরুরি দেখা করতে হবে। আমার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।”
“কী হয়েছে? আপনি এখন কোথায় আছেন?”
“হাওড়া স্টেশনের কাছে আমার এক দূর সম্পর্কের দাদার বাড়িতে আছি। কিন্তু ডাক্তারবাবু, গতকাল রাত থেকে আমার মাথায় যা হচ্ছে সেটা…”
“আপনি এখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসুন। আমরা লাইব্রেরিতে আছি। দেখা হলে বিস্তারিত বলবেন।”
ফোন রেখে অভিজিৎ প্রিয়াঙ্কার দিকে তাকালেন। “অর্জুন আসছে। তার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে মনে হচ্ছে।”
প্রিয়াঙ্কা ভ্রু কুঁচকালেন। “যদি আমাদের অনুমান ঠিক হয়, তাহলে এটা স্বাভাবিক। সে যত বেশি সেই নেটওয়ার্ক থেকে দূরে থাকবে, তত বেশি অস্বস্তি অনুভব করবে। ঠিক যেমন একটা রেডিয়ো রিসিভার সংকেত এলাকার বাইরে গেলে স্ট্যাটিক নয়েজ পায়।”
দুপুর দুটোর সময় অর্জুন মিশ্র নিউরোসায়েন্স বিভাগে পৌঁছালেন। তার চেহারা দেখে অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা দুজনেই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অর্জুনের চোখে গভীর কালো দাগ, মুখ ফ্যাকাশে, হাত সামান্য কাঁপছে। মনে হচ্ছে গত রাতে একটুও ঘুম হয়নি।
“অর্জুনবাবু, বসুন,” অভিজিৎ তাকে তার অফিসের চেয়ারে বসালেন। “আগে একটু জল খান। তারপর বলুন কী হয়েছে।”
অর্জুন জল খেয়ে কিছুটা স্থির হলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, “ডাক্তারবাবু, গতকাল আপনার কাছে আসার পর থেকে আমার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। রাতে ঘুমাতে পারিনি। মনে হচ্ছিল যেন আমার মাথায় অনেকের চিন্তাভাবনা একসঙ্গে ঝড়ের মতো আসছে।”
“কেমন ধরনের চিন্তাভাবনা?” প্রিয়াঙ্কা একটা নোটপ্যাড নিয়ে বসলেন।
“আমার গ্রামের অন্য মধু সংগ্রাহকদের। বিশেষ করে যারা এখন জঙ্গলে কাজ করছে।” অর্জুন কপালে হাত দিয়ে বললেন। “আমি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছিলাম কে কোথায় আছে, কী করছে, এমনকি কী ভাবছে। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল, মনোজদার হাত কেটে গেছে—সেই ব্যথাটাও আমি অনুভব করতে পারছিলাম।”
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা একে অপরের দিকে তাকালেন। এটা নিছক হ্যালুসিনেশন বা মানসিক রোগের লক্ষণ নয়। এটা কোনো ভিন্ন ধরনের ঘটনা।
“অর্জুনবাবু, আপনি কি মনোজদার সঙ্গে যোগাযোগ করে এই বিষয়টা যাচাই করেছেন?” প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞেস করলেন।
“আজ সকালে ফোন করেছিলাম। সত্যিই তার হাত কেটে গেছে। গতকাল বিকেল চারটার সময় মধু সংগ্রহের সময় একটা ধারালো ডাল দিয়ে।” অর্জুনের গলায় আশ্চর্য এবং সামান্য ভয় মিশে ছিল। “আর আমি সেই ব্যথা অনুভব করেছি ঠিক সেই সময়েই, কলকাতায় বসে।”
প্রিয়াঙ্কা দ্রুত নোট নিলেন। “আর কোনো ঘটনা?”
“হ্যাঁ। রমেশ কাকা গতকাল রাতে একটা বড়ো মৌচাক পেয়েছেন। আমি এখানে বসে বুঝতে পারছিলাম তিনি কতটা খুশি। এবং আজ সকালে ফোন করে জানলাম যে সত্যিই তিনি রাত দশটার সময় একটা বিরাট মৌচাক আবিষ্কার করেছেন।”
অভিজিৎ গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। “অর্জুনবাবু, আপনার গ্রামে এই ধরনের অভিজ্ঞতা আর কারো হয়?”
“আমাদের গ্রামের যারা ‘চৈতন্যক্ষেত্রে’ নিয়মিত কাজ করে, তাদের সবারই কম-বেশি এই অভিজ্ঞতা হয়। কিন্তু আমার মতো এত তীব্র কারো হয় না।”
“চৈতন্যক্ষেত্র?” প্রিয়াঙ্কা এই শব্দটা লিখে নিলেন।
“হ্যাঁ, আমাদের জঙ্গলে যে জায়গাগুলোয় রাতে নীল আলো জ্বলে। আমাদের পূর্বপুরুষরা এই নাম দিয়েছেন। তাদের বিশ্বাস ছিল যে এই জায়গায় গেলে মানুষের মন খুলে যায়, চেতনা প্রসারিত হয়।”
অভিজিৎ এগিয়ে এলেন। “এই নীল আলো সম্পর্কে বিস্তারিত বলুন।”
অর্জুন চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলেন। “রাত নামার পর থেকে ভোর পর্যন্ত পুরো জঙ্গলের কিছু অংশ যেন জ্বলে ওঠে। মাটি থেকে, গাছের গুড়ি থেকে, পাতা থেকে, এমনকি বাতাস থেকেও নীল-সবুজ আলো বের হয়। প্রথম দেখলে মনে হবে স্বর্গ নেমে এসেছে পৃথিবীতে।”
“আর সেই আলোর কাছে গেলে আপনার কেমন লাগে?” প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞেস করলেন।
“প্রথম প্রথম ভয় লাগত। কিন্তু পরে মনে হয় যেন মনটা হালকা হয়ে যায়। চিন্তাভাবনা পরিষ্কার হয়ে যায়। আর সবচেয়ে অদ্ভুত হল, অন্যদের চিন্তা বুঝতে পারি। প্রথমে নিজের গ্রামের মানুষ, তারপর ধীরে ধীরে আরও দূরের মানুষদের।”
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা একে অপরের দিকে তাকালেন। তাদের অনুমান সঠিক প্রমাণিত হচ্ছে।
“অর্জুনবাবু, আমার একটা প্রশ্ন,” অভিজিৎ বললেন। “আপনার গ্রামে কতজন এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন?”
“আমাদের গ্রামে মোট আটজন নিয়মিত মধু সংগ্রাহক আছি। আমরা সবাই কম-বেশি এই নেটওয়ার্ক সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু কেউ কেউ বেশি, কেউ কম।”
“নেটওয়ার্ক?” প্রিয়াঙ্কা শব্দটা ধরলেন।
“হ্যাঁ। আমাদের মনে হয় যেন আমরা সবাই একটা বড়ো মনের অংশ। যখন একজন কিছু ভাবে, অন্যরাও সেটা অনুভব করতে পারে। যখন একজনের ব্যথা হয়, অন্যরাও সেটা বুঝতে পারে।”
অভিজিৎ ইতিমধ্যে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। “অর্জুনবাবু, আমাদের নীরক্ষেত্রে যেতে হবে। আপনি কি আমাদের গাইড করতে পারবেন?”
অর্জুন কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তার মুখে দ্বিধার ছাপ। “পারব। কিন্তু একটা কথা বলে রাখি। আপনারা যদি চৈতন্যক্ষেত্রে যান, তাহলে আপনাদের মনেও এই পরিবর্তন আসতে পারে।”
“আপনি কি মনে করেন এটা বিপজ্জনক?” প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞেস করলেন।
“বিপজ্জনক বলা যায় না। কিন্তু একবার এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হলে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া কঠিন।” অর্জুন গভীর নিশ্বাস নিলেন। “আমাদের গ্রামের যারা এখানে কাজ করেছে, তারা বলে যে শহরে গেলে মনে হয় যেন অর্ধেক মানুষ হয়ে গেছি। যেন আমাদের মনের একটা অংশ সব সময় ওই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চায়।”
এই কথাটা অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা দুজনকেই গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলল। কিন্তু একইসঙ্গে এটা তাদের আরও আগ্রহী করে তুলল। এটা হতে পারে মানব চেতনার ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো আবিষ্কার।
“আমরা রিস্ক নিতে প্রস্তুত,” অভিজিৎ দৃঢ়ভাবে বললেন। “এটা বিজ্ঞানের জন্য, মানবজাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।”
বিকেলের দিকে তারা তিনজনে নীরক্ষেত্রে যাওয়ার বিস্তারিত পরিকল্পনা করলেন। পরের দিন ভোর পাঁচটায় হাওড়া থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি, সেখান থেকে গাড়িতে শিলিগুড়ি, তারপর আরও চার ঘণ্টার পাহাড়ি রাস্তা। অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সঙ্গে নেওয়ার পরিকল্পনা করলেন।
“আমাদের কী কী লাগবে?” প্রিয়াঙ্কা একটা তালিকা তৈরি করতে শুরু করলেন।
“পোর্টেবল EEG মেশিন, কোয়ান্টাম ফিল্ড ডিটেক্টর, বায়োলুমিনেসেন্স স্পেকট্রোমিটার, আর EMF মিটার,” অভিজিৎ গুনে গুনে বললেন।
EEG (Electroencephalography) মেশিন মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ রেকর্ড করে। কোয়ান্টাম ফিল্ড ডিটেক্টর অতি সূক্ষ্ম কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এবং এনট্যাঙ্গলমেন্ট শনাক্ত করতে পারে। বায়োলুমিনেসেন্স স্পেকট্রোমিটার জৈবিক আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য, তীব্রতা এবং ফ্রিকোয়েন্সি মাপে। আর EMF (Electromagnetic Field) মিটার বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের পরিমাপ করে।
“আর আমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য কিছু প্রটেকশন ডিভাইস নিতে হবে,” প্রিয়াঙ্কা যোগ করলেন। “যদি সত্যিই কোয়ান্টাম রেডিয়েশন থাকে।”
“অর্জুনবাবু, আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে,” অভিজিৎ বললেন। “এই ঘটনা কি শুধু আপনাদের গ্রামেই, নাকি অন্য জায়গাতেও?”
অর্জুন কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। “আমার জানা মতে আরও তিন-চারটা গ্রামে এই ধরনের চৈতন্যক্ষেত্র আছে। সবই এই পাহাড়ি অঞ্চলে, একে অপরের থেকে ২০-৩০ কিলোমিটার দূরে। আর সবখানেই একই ধরনের নীল আলো আর একই ধরনের অভিজ্ঞতা।”
“মানে এটা একটা বিস্তৃত নেটওয়ার্ক?” প্রিয়াঙ্কা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
“হ্যাঁ। আমার বিশ্বাস যে পুরো এই পাহাড়ি অঞ্চল জুড়ে একটা বিরাট কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। আর যারা এর সঙ্গে যুক্ত হয়, তারা সবাই এক অদ্ভুত সমষ্টিগত চেতনার অংশ হয়ে যায়।”
এই কথা শুনে অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে গেলেন। তারা যা আবিষ্কার করতে চলেছেন তা হয়তো শুধু বিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করবে না, বরং মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনা বদলে দিতে পারে।
সন্ধ্যার পর অর্জুন তার দাদার বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা আবার লাইব্রেরিতে ফিরে গেলেন। তারা আরও কিছু গবেষণাপত্র পড়লেন। বিশেষ করে কোয়ান্টাম বায়োলজি, কালেক্টিভ কনশাসনেস, এবং নেটওয়ার্ক সায়েন্স নিয়ে।
“অভিজিৎদা, তুমি কি মনে কর আমরা এমন কিছুর সন্ধান পেয়েছি যা মানুষের চেতনার সংজ্ঞাই বদলে দিতে পারে?” প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞেস করলেন।
“হতে পারে। যদি সত্যিই একটা বায়োলজিক্যাল কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক থেকে থাকে যা মানুষের চেতনাকে যুক্ত করতে পারে, তাহলে এটা শুধু নিউরোসায়েন্স নয়, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, এমনকি রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও বিপ্লব আনতে পারে।” অভিজিৎ গভীর চিন্তায় বললেন। “কল্পনা করো, যদি মানুষ সত্যিকারের টেলিপ্যাথিক নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে পারে, তাহলে ভুল বোঝাবুঝি, মিথ্যা, প্রতারণা—সব শেষ হয়ে যেতে পারে।”
রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরি ধীরে ধীরে খালি হয়ে গেল। কিন্তু তারা দুজনে আরও কিছুক্ষণ বসে রইলেন, পরের দিনের যাত্রার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে।
“একটা কথা বলি?” প্রিয়াঙ্কা হঠাৎ বললেন। “আমার মনে হচ্ছে আমরা এমন কিছুর দোরগোড়ায় পৌঁছেছি যা শুধু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নয়, মানব সভ্যতার পরবর্তী বিবর্তনীয় ধাপ হতে পারে।”
অভিজিৎ মাথা নাড়লেন। তার মনেও একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। “হয়তো ব্যক্তিগত চেতনা থেকে সমষ্টিগত চেতনায় উত্তরণের সময় এসে গেছে। আগামীকাল যে যাত্রা শুরু করতে চলেছি, সেটা হয়তো শুধু আমাদের জীবনই বদলে দেবে না, পুরো মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।”
বাইরে কলকাতার রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছিল। কিন্তু দুজন বিজ্ঞানীর মনে জেগে উঠেছিল এক অদম্য কৌতূহল—নীরক্ষেত্রের সেই রহস্যময় নীল আলোর রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য।
অধ্যায় ৩: নীরক্ষেত্রের পথে
ভোর পাঁচটার সময় হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নম্বর ১৬-তে একটা অদ্ভুত দৃশ্য। অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা দাঁড়িয়ে আছেন দুটো বড়ো ব্যাকপ্যাক এবং একটা মেটালিক সুটকেসের সঙ্গে—যেটার ভেতরে রয়েছে তাদের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। নভেম্বরের সকালের কুয়াশা স্টেশনের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে, আর প্রত্যেকটা ট্রেনের হর্ন যেন এক রহস্যময় সুরে বাজছে।
অভিজিতের চোখে গত রাতের অনিদ্রার চিহ্ন। তিনি সারারাত চিন্তা করেছেন যে তারা যে যাত্রা শুরু করতে চলেছেন সেটা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। প্রিয়াঙ্কা তার থার্মস ফ্লাস্ক থেকে গরম চা ঢালছেন প্লাস্টিকের কাপে। তার হাত সামান্য কাঁপছে—উত্তেজনা নাকি ভয়, সেটা স্পষ্ট নয়।
“নিউ জলপাইগুড়ি এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্ম নম্বর ১৬-এ প্রবেশ করছে,” স্টেশনের ঘোষণা ভেসে এল। ট্রেনের আলো দূর থেকে দৃশ্যমান হল, ধীরে ধীরে কাছে আসছে।
অর্জুন তাদের কাছে এসে পৌঁছালেন। তার পরনে খাকি রঙের শার্ট আর প্যান্ট, কাঁধে একটা পুরোনো চামড়ার ব্যাগ। তার চেহারায় আজ একটা ভিন্ন ভাব—যেন তিনি তার নিজের এলাকায় ফিরে যাওয়ার জন্য উৎসুক।
“ডাক্তারবাবু, ম্যাডাম, ট্রেন এসে গেছে। আমাদের B3 কামরায় সিট।” অর্জুন তাদের ভারী ব্যাগ নিয়ে নিলেন।
ট্রেন ছাড়ার পর অভিজিৎ জানালার ধারে বসে কলকাতার উপকণ্ঠ দেখতে লাগলেন। ধীরে ধীরে শহরের ভিড় কমে গিয়ে গ্রামের সবুজ প্রান্তর দেখা যেতে শুরু করল। প্রিয়াঙ্কা তার নোটবুক খুলে গতকালের সব তথ্য আবার পড়ছেন।
“অর্জুনবাবু,” প্রিয়াঙ্কা বললেন, “আপনার গ্রামে আমরা পৌঁছানোর পর কী হবে? মানে, অন্য মানুষজন আমাদের দেখে কী ভাববে?”
অর্জুন মুচকি হাসলেন। “আমাদের গ্রামের মানুষ বাইরের লোকজনকে সন্দেহের চোখে দেখে। বিশেষ করে যখন শুনবে যে আপনারা চৈতন্যক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করতে এসেছেন। কিন্তু আমি তাদের বুঝিয়ে বলব।”
“তারা কেন সন্দেহ করবে?” অভিজিৎ জিজ্ঞেস করলেন।
“আমাদের এই চৈতন্যক্ষেত্রের বিষয়টা আমরা বাইরের কারো কাছে বলি না। এটা আমাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য, আমাদের গোপন সম্পদ।” অর্জুন জানালার বাইরে তাকিয়ে বললেন। “কিন্তু আমার মনে হয় এটা লুকিয়ে রাখার সময় শেষ হয়ে গেছে। বিজ্ঞান যদি এর ব্যাখ্যা দিতে পারে, তাহলে পুরো বিশ্ব উপকৃত হতে পারে।”
ট্রেন জলপাইগুড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে। বাইরে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ দৃশ্য—ধানখেত, পুকুর, কাশফুলের মাঠ। কিন্তু অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কার মন অন্যত্র—সেই রহস্যময় নীল আলোর জগতে।
দুপুর দুটোর সময় তারা নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছালেন। স্টেশন থেকে বেরিয়ে তারা একটা অটো ভাড়া করে শিলিগুড়ি শহরে গেলেন। সেখান থেকে অর্জুনের একজন পরিচিত ড্রাইভারের গাড়িতে উঠলেন—একটা পুরোনো টাটা সুমো।
শিলিগুড়ি থেকে নীরক্ষেত্রের পথ শুরু হল। প্রথমে সমতল রাস্তা, তারপর ধীরে ধীরে পাহাড়ে ওঠা। গাড়ি চলতে চলতে চারদিকের দৃশ্য পালটাতে লাগল—চা বাগান, ছোটো ছোটো পাহাড়ি গ্রাম, ঘন জঙ্গল।
“এই রাস্তায় আর কোনো বড়ো গাড়ি যায় না,” ড্রাইভার রমেশ বললেন। “বছরে দুই-তিনবার সরকারি অফিসারদের জিপ যায়। বাকি সময় শুধু মোটরসাইকেল আর পায়ে হাঁটা।”
প্রিয়াঙ্কা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন যে তারা ক্রমশ সভ্যতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। মোবাইল নেটওয়ার্কের সিগন্যাল কমে গেছে। রাস্তার ধারে বিদ্যুতের খুঁটি নেই। চারদিকে শুধু পাহাড় আর জঙ্গল।
“অর্জুনবাবু, এই জঙ্গলেই কি সেই বিশেষ ছত্রাক পাওয়া যায়?” অভিজিৎ জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ। কিন্তু সব জায়গায় না। শুধু নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়। যেখানে মাটিতে বিশেষ ধরনের খনিজ আছে, জলের স্রোত আছে, আর পাহাড়ের উচ্চতা ঠিক আছে।” অর্জুন ব্যাখ্যা করলেন।
“কী ধরনের খনিজ?” প্রিয়াঙ্কা তার নোটবুকে লিখতে শুরু করলেন।
“আমাদের গ্রামের পুরোনো মানুষরা বলেন যে এই মাটিতে ‘জ্যোতির্ময় পাথর’ আছে। রাতে অন্ধকারে এই পাথরগুলো সামান্য জ্বলে।”
“জ্যোতির্ময় পাথর?” অভিজিৎ আগ্রহী হয়ে উঠলেন। “সম্ভবত কোয়ার্টজ বা অন্য কোনো পাইজোইলেকট্রিক মিনারেল।”
পাইজোইলেকট্রিক পদার্থ হচ্ছে এমন পদার্থ যা চাপ প্রয়োগে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। কোয়ার্টজ এর একটা উদাহরণ। যদি ভূমিকম্প বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক চাপের কারণে এই পাথরগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তাহলে সেটা ছত্রাকের বায়োলুমিনেসেন্সকে প্রভাবিত করতে পারে।
বিকেল পাঁচটার সময় তারা একটা পাহাড়ি রাস্তায় উঠতে শুরু করলেন যেটা এত সরু যে দুটো গাড়ি একসঙ্গে যেতে পারে না। দুপাশে উঁচু উঁচু গাছ, নীচে গভীর খাদ। প্রিয়াঙ্কার হার্ট রেট বেড়ে গেল।
“আর কতদূর?” অভিজিৎ জিজ্ঞেস করলেন।
“আরও এক ঘণ্টা গাড়িতে। তারপর গাড়ি আর যেতে পারবে না। সেখান থেকে দেড় ঘণ্টা পায়ে হাঁটতে হবে।” অর্জুন জবাব দিলেন।
সন্ধ্যার আগে তারা পৌঁছালেন সেই জায়গায় যেখানে গাড়ি আর যেতে পারে না। সামনে একটা সরু পথ জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেছে। রমেশ তাদের নামিয়ে দিয়ে বললেন যে তিনি এখানেই তাদের জন্য অপেক্ষা করবেন।
অর্জুন তাদের ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চললেন। অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা তার পিছু পিছু চলতে লাগলেন। জঙ্গলের ভেতরের পথটা কাদামাটি, পিছল, আর জায়গায় জায়গায় পাথর।
“সাবধানে চলুন,” অর্জুন বললেন। “এখানে সাপ আছে। তবে এই সময় খুব একটা বিপদ নেই।”
পথ চলতে চলতে প্রিয়াঙ্কা লক্ষ করলেন যে জঙ্গলের গাছপালা ক্রমশ ভিন্ন রকম হয়ে যাচ্ছে। পাতাগুলো বড়ো, গাছের কাণ্ড মোটা, আর একটা অদ্ভুত ধরনের নীরবতা। পাখির ডাক কম, পোকামাকড়ের আওয়াজও কম।
“অর্জুনবাবু, এই জঙ্গল কেমন যেন ভিন্ন লাগছে,” প্রিয়াঙ্কা বললেন।
“আমরা চৈতন্যক্ষেত্রের কাছে আসছি। এখানকার প্রকৃতি একটু ভিন্ন। গাছপালা বেশি বড়ো হয়, রং বেশি গাঢ়, আর একটা অদ্ভুত শান্তি আছে।”
একটু পরে তারা একটা ছোটো ঝরনার কাছে পৌঁছালেন। জল পাহাড় থেকে নেমে এসে একটা ছোটো পুকুর তৈরি করেছে। অর্জুন সেখানে থামলেন।
“এখানে একটু বিশ্রাম নিন। আর জল খান। এখান থেকে গ্রাম আর আধ ঘণ্টার পথ।”
অভিজিৎ জলের কাছে গিয়ে হাত ধুলেন। জল ঠান্ডা, স্বচ্ছ। কিন্তু তার মনে হল যেন জলে একটা সামান্য নীলাভ আভা আছে।
“এই জলে কিছু একটা ভিন্ন আছে,” অভিজিৎ অর্জুনকে বললেন।
“হ্যাঁ। এই জলে সেই খনিজ মিশে আছে। আমরা এই জল খাই, এই জল দিয়ে রান্না করি। হয়তো এটাও আমাদের মানসিক পরিবর্তনের একটা কারণ।”
প্রিয়াঙ্কা একটা ছোটো বোতলে সেই জল সংগ্রহ করে নিলেন পরে বিশ্লেষণের জন্য।
সূর্য অস্ত যাওয়ার ঠিক আগে তারা নীরক্ষেত্র গ্রামে পৌঁছালেন। ছোট্ট একটা গ্রাম—মাত্র ৬০-৭০টি ঘর। ঘরগুলো বাঁশ, কাঠ আর টিনের তৈরি। গ্রামের মাঝখানে একটা ছোটো মাঠ, যেখানে কিছু ছাগল চরছে।
গ্রামের মানুষজন তাদের দেখে আগ্রহী হয়ে উঠল। কিন্তু কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিও। অর্জুন তাদের কয়েকজনের সঙ্গে স্থানীয় ভাষায় কথা বললেন। তারপর অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কার দিকে ফিরে বললেন।
“আমি তাদের বলেছি যে আপনারা বিজ্ঞানী। আমাদের চৈতন্যক্ষেত্রের বিজ্ঞান বুঝতে এসেছেন। তারা রাজি হয়েছে। কিন্তু বলেছে যে আপনারা যেন ওই অঞ্চলের কোনো ক্ষতি না করেন।”
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা আশ্বাস দিলেন যে তারা শুধু পর্যবেক্ষণ করবেন, কোনো কিছু নষ্ট করবেন না।
গ্রামের মোড়ল, একজন বয়স্ক ব্যক্তি যার নাম বিরেন, তাদের সঙ্গে কথা বললেন। “আমার নাম বিরেন মিশ্র। অর্জুনের কাকা। আপনারা আমার ঘরে থাকতে পারেন।”
বিরেনের ঘরটি গ্রামের সবচেয়ে বড়ো ঘরগুলোর একটি। দুটো ঘর, একটা ছোটো রান্নাঘর। বিদ্যুৎ নেই, কিন্তু কেরোসিনের লন্ঠন আছে। অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা তাদের যন্ত্রপাতি রেখে সেটআপ করতে শুরু করলেন।
“বিরেনকাকা,” অভিজিৎ বললেন, “আমরা শুনেছি যে এখানে রাতে বিশেষ ধরনের আলো দেখা যায়। আমরা সেটা পর্যবেক্ষণ করতে চাই।”
বিরেন গম্ভীর হয়ে গেলেন। “বাবু, সেটা আমাদের পবিত্র জায়গা। আমাদের পূর্বপুরুষরা বলে গেছেন যে ওখানে দেবতারা বাস করেন।”
“আমরা কোনো অসম্মান করব না। শুধু বুঝতে চাই এটা কীভাবে সম্ভব।”
“আচ্ছা। কিন্তু একটা শর্ত। আপনারা যখন চৈতন্যক্ষেত্রে যাবেন, আমার ছেলে গোপাল আপনাদের সঙ্গে যাবে। সে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। যদি কোনো বিপদ হয়, সে আপনাদের সাহায্য করতে পারবে।”
সন্ধ্যার খাবারের পর অর্জুন তাদের বললেন, “আজ রাতে আমরা চৈতন্যক্ষেত্রে যেতে পারি। রাত নয়টার পর সেখানে আলো শুরু হয়।”
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা তাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রস্তুত হলেন। EEG মেশিনের ছোটো সেন্সর নিজেদের মাথায় লাগালেন। কোয়ান্টাম ফিল্ড ডিটেক্টর এবং বায়োলুমিনেসেন্স স্পেকট্রোমিটার ব্যাকপ্যাকে রাখলেন।
রাত আটটার সময় তারা চৈতন্যক্ষেত্রের দিকে রওনা দিলেন। অর্জুন এবং গোপাল তাদের গাইড হয়েছেন। গোপাল একজন ২৫ বছর বয়সি যুবক, যে ছোটোবেলা থেকেই চৈতন্যক্ষেত্রে যায়।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়াঙ্কা লক্ষ করলেন যে তার মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। যেন কেউ তার মনের দিকে তাকিয়ে আছে।
“অভিজিৎদা, তোমার কেমন লাগছে?” প্রিয়াঙ্কা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন।
“আমারও একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার চিন্তাভাবনা যেন কেউ পড়তে পারছে।”
অর্জুন তাদের কথা শুনে পিছন ফিরে তাকালেন। “এটাই শুরু। আমরা নেটওয়ার্কের এলাকায় ঢুকে যাচ্ছি।”
আরও পনেরো মিনিট হাঁটার পর তারা একটা পাহাড়ের ঢালে পৌঁছালেন। সামনে একটা প্রশস্ত উপত্যকা, যেটা চারদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা।
“এটাই চৈতন্যক্ষেত্র,” গোপাল বললেন।
প্রথমে কিছুই বিশেষ মনে হল না। অন্ধকার জঙ্গল, গাছের আওয়াজ। কিন্তু ঠিক রাত নয়টার সময়…
হঠাৎ করে পুরো উপত্যকাটা যেন জেগে উঠল। গাছের গুড়ি থেকে, পাতা থেকে, মাটি থেকে একটা নীল-সবুজ আলো বের হতে শুরু করল। প্রথমে মৃদু, তারপর ক্রমশ উজ্জ্বল।
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এমন সুন্দর দৃশ্য তারা জীবনে দেখেননি। পুরো জঙ্গল যেন একটা জ্যোতির্ময় রাজ্যে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু আরও অবাক করা বিষয় ছিল তাদের মানসিক অনুভূতি। অভিজিৎ অনুভব করলেন যে তার মন যেন প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন প্রিয়াঙ্কা কী ভাবছে, অর্জুন কী অনুভব করছে।
প্রিয়াঙ্কা তার EEG মেশিনের দিকে তাকাল। স্ক্রিনে অস্বাভাবিক তরঙ্গ প্যাটার্ন। তার নিজের মস্তিষ্কের তরঙ্গ অভিজিতের সঙ্গে সিঙ্ক্রোনাইজ হয়ে যাচ্ছে।
“অভিজিৎদা,” প্রিয়াঙ্কা বলল, কিন্তু তার মনে হল যে তিনি কথা বলার আগেই অভিজিৎ জানেন তিনি কী বলতে চান।
“আমিও অনুভব করছি,” অভিজিৎ জবাব দিল। “আমাদের চেতনা যেন একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে।”
কোয়ান্টাম ফিল্ড ডিটেক্টর পাগলের মতো বিপ বিপ শব্দ করতে লাগল। প্রিয়াঙ্কা দেখল যে সেটার রিডিং অস্বাভাবিক। এমন উচ্চ মাত্রার কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন তিনি কখনও দেখেননি।
আর তখনই, নীল আলোর মাঝে, তারা অনুভব করলেন যে তারা একা নেই। তাদের মনে অন্য অনেক মানুষের উপস্থিতি অনুভূত হল—গোপাল, অর্জুন, এমনকি গ্রামের অন্য মানুষ যারা ঘরে ঘুমিয়ে আছে।
এটা ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। বিজ্ঞান এবং রহস্যের এক অকল্পনীয় মিলন।
অধ্যায় ৪: নেটওয়ার্কের গভীরে
চৈতন্যক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অভিজিৎ অনুভব করল যে তার চেতনা যেন একটা বিশাল সমুদ্রে মিশে যাচ্ছে। নীল আলোর ঢেউয়ের মতো ছন্দে তার মস্তিষ্কের নিউরনগুলো কাজ করছে। চারদিকের গাছপালা থেকে আসা বায়োলুমিনেসেন্স যেন একটা জটিল সঙ্গীতের তাল বাজাচ্ছে—এমন সুন্দর যে তিনি প্রথমে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
তার মাথার EEG সেন্সরগুলো থেকে ডেটা আসছে রিয়েল টাইমে। নিউরাল অ্যাক্টিভিটির প্যাটার্ন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আলফা, বিটা, গামা—সব ধরনের ব্রেইন ওয়েভ একটা অভূতপূর্ব সিঙ্ক্রোনিতে কাজ করছে।
তিনি প্রিয়াঙ্কার দিকে তাকালেন এবং অবাক হয়ে দেখলেন যে তিনি প্রিয়াঙ্কার চিন্তা পড়তে পারছে—শব্দ ছাড়াই। প্রিয়াঙ্কার মুখে একই ধরনের বিস্ময়ের ভাব।
“এটা অবিশ্বাস্য,” প্রিয়াঙ্কা মনে মনে ভাবল, এবং অভিজিৎ সেই কথা পরিষ্কার শুনতে পেল। যেন তাদের দুজনের মস্তিষ্ক একটা রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সিতে টিউন হয়ে গেছে।
“আমিও তোমার চিন্তা বুজতে পাচ্ছি,” অভিজিৎ মনে মনেই জবাব দিল। দুজনেই বুঝতে পারল যে তারা টেলিপ্যাথিক কমিউনিকেশনে রত। এটা শুধু কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়, সত্যিকারের ঘটনা।
প্রিয়াঙ্কা কাঁপা হাতে তার পোর্টেবল EEG মেশিনের স্ক্রিনের দিকে তাকাল। ছোট্ট LCD ডিসপ্লেতে দুটো ভিন্ন রঙের গ্রাফ লাইন—একটা তার নিজের ব্রেইন ওয়েভ, অন্যটা অভিজিতের। কিন্তু যা দেখছেন তা অভূতপূর্ব। দুটো লাইন সম্পূর্ণভাবে সিঙ্ক্রোনাইজ হয়ে গেছে। যেন তারা দুজন এক মস্তিষ্কের দুটো গোলার্ধ।
“কোহেরেন্স লেভেল ৯৮.৫%,” প্রিয়াঙ্কা ফিসফিস করে বলল। “এটা কীভাবে সম্ভব? ল্যাবরেটরিতে সর্বোচ্চ আমরা ৩০% কোহেরেন্স পেয়েছি।”
ব্রেইন কোহেরেন্স হচ্ছে বিভিন্ন মস্তিষ্কের অঞ্চল কতটা সুসংগতভাবে কাজ করছে তার পরিমাপ। ৯৮.৫% মানে তাদের মস্তিষ্কের প্রায় সব অংশ একসঙ্গে কাজ করছে—এমন অবস্থা যা সাধারণত গভীর ধ্যানের সময়ও হয় না।
গোপাল তাদের কাছে এসে বলল, “এখন আপনারা নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে গেছেন। প্রথমবার এমন লাগে। ভয় পাবেন না, এটা স্বাভাবিক।”
“তুমি আমাদের চিন্তা পড়তে পারছ?” অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল। তার গলার স্বরে বিস্ময় এবং সামান্য আতঙ্ক মিশে ছিল।
“হ্যাঁ। আর আপনারাও আমার চিন্তা পড়তে পারছেন।” গোপাল মুচকি হেসে বলল। “এখন আপনারা আমাদের মানসিক পরিবারের সদস্য। এখন অর্জুনদার সঙ্গেও যোগাযোগ করে দেখুন। তিনি গ্রামে গেছেন, কিন্তু নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এখানেই উপস্থিত।”
প্রিয়াঙ্কা চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিল। প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না। তারপর ধীরে ধীরে তার মনে একটা অস্পষ্ট উপস্থিতি অনুভূত হল। যেন কেউ দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনোযোগ আরও বাড়াল। হঠাৎ করে অর্জুনের উপস্থিতি স্পষ্ট হয়ে উঠল। অর্জুন তার ঘরে বসে তাদের কথা ভাবছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য চিন্তা করছে।
“অর্জুনবাবু, আপনি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছেন?” প্রিয়াঙ্কা মানসিকভাবে প্রশ্ন করলেন। শব্দ নয়, চিন্তার তরঙ্গে।
“হ্যাঁ, ম্যাডাম । স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আপনারা এখন নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। আমি বুঝতে পারছি আপনারা কেমন অনুভব করছেন। প্রথমে একটু ভয়ই লাগে।” অর্জুনের উত্তর তাদের মনে ভেসে উঠল, একেবারে পরিষ্কার।
এই অভিজ্ঞতা এতটাই অভূতপূর্ব যে অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা দুজনেই প্রথমে ভয় পেয়ে গেল। তাদের বৈজ্ঞানিক মন এই ঘটনার কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিল না। কিন্তু ভয়ের পাশাপাশি একটা অদ্ভুত শান্তি এবং পূর্ণতার অনুভূতিও হচ্ছিল। যেন তারা সারা জীবন অসম্পূর্ণ ছিলেন, আর এখন সেই অভাব পূরণ হয়েছে।
“কোয়ান্টাম ফিল্ড ডিটেক্টর কী বলছে?” অভিজিৎ প্রিয়াঙ্কাকে জিজ্ঞেস করল। তার হাত কাঁপছিল উত্তেজনায়।
প্রিয়াঙ্কা তার ব্যাকপ্যাক থেকে ছোট্ট একটা ইলেকট্রনিক ডিভাইস বের করল। এটা দেখতে একটা ছোটো ট্যাবলেটের মতো, কিন্তু এর কাজ অসাধারণ—এটা অতি সূক্ষ্ম কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন মাপতে পারে। যন্ত্রটার স্ক্রিনে অসাধারণ রিডিং দেখা যাচ্ছিল।
“কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্টের মাত্রা ০.৯৭। এটা প্রায় পূর্ণ এনট্যাঙ্গলমেন্ট!” প্রিয়াঙ্কার গলায় বিস্ময়। “ল্যাবরেটরিতে আমরা সর্বোচ্চ ০.৫ পেয়েছি অসাধারণ কনট্রোল্ড কন্ডিশনে।”
কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্টের মাত্রা ০ থেকে ১ এর মধ্যে থাকে। ০ মানে কোনো এনট্যাঙ্গলমেন্ট নেই, ১ মানে পূর্ণ এনট্যাঙ্গলমেন্ট—যেখানে দুটি সিস্টেম সম্পূর্ণভাবে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। ০.৯৭ মানে তাদের চেতনা প্রায় সম্পূর্ণভাবে একসঙ্গে কাজ করছে। এটা কোয়ান্টাম ফিজিক্সের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড।
“বায়োলুমিনেসেন্স স্পেকট্রোমিটার কী দেখাচ্ছে?” অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল। তিনি তার নোটপ্যাডে দ্রুত লিখে চলেছেন।
প্রিয়াঙ্কা দ্রুত আরেকটা যন্ত্র চালু করল। এটা একটা ছোটো টেলিস্কোপের মতো দেখতে, কিন্তু এর কাজ আলোর বিশ্লেষণ। “আশ্চর্য! এই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪৮০ থেকে ৫২০ নানোমিটার—নীল থেকে সবুজ রেঞ্জ। কিন্তু এটা সাধারণ বায়োলুমিনেসেন্স নয়। এর মধ্যে একটা অত্যন্ত জটিল প্যাটার্ন আছে। আলোর তীব্রতা প্রতি মাইক্রোসেকেন্ডে পরিবর্তিত হচ্ছে। যেন এটা মোর্স কোডের মতো কোনো তথ্য ট্রান্সমিট করছে।”
বায়োলুমিনেসেন্ট আলো সাধারণত ৪০০-৭০০ নানোমিটার রেঞ্জে হয়। কিন্তু এই আলোর প্যাটার্ন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন—এটা শুধু আলো নয়, একটা অত্যাধুনিক কমিউনিকেশন সিস্টেম। প্রকৃতি নিজেই তৈরি করেছে একটা ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক।
গোপাল তাদের জঙ্গলের আরও গভীরে নিয়ে গেল। পথে হাঁটতে হাঁটতে তারা দেখল যে মাটির নীচ থেকেও সূক্ষ্ম নীল আলো বের হচ্ছে। যেন পুরো জঙ্গলের মাটির নীচে একটা আলোকিত নেটওয়ার্ক রয়েছে।
“এই আলো মাটির নীচ থেকে আসছে কেন?” প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞেস করল।
“এখানে শিকড়ি আছে,” গোপাল ব্যাখ্যা করল। “মাইসেলিয়াম। এগুলো পুরো জঙ্গলের নীচে ছড়িয়ে আছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা বলতেন এটা ‘ভূগর্ভস্থ মস্তিষ্ক’।”
“আসুন, আমি আপনাদের নেটওয়ার্কের হৃদয় দেখাই।”
আরও পনেরো মিনিট হাঁটার পর তারা একটা প্রাচীন গাছের কাছে পৌঁছাল। এই গাছটা দেখে অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা দুজনেই স্তব্ধ হয়ে গেল। গাছটা এত বিশাল যে পনেরোজন মানুষ হাত ধরে দাঁড়ালেও এর পরিধি ঘেরা যাবে না। উচ্চতা অন্তত ৮০ ফুট। গাছটার বয়স হাজার বছরের বেশি হবে নিশ্চয়। আর এই গাছ থেকেই সবচেয়ে উজ্জ্বল নীল আলো বের হচ্ছে। গাছের প্রতিটি পাতা, প্রতিটি ডাল থেকে যেন তরল নীলাভ আলো গড়িয়ে পড়ছে।
“এটা আমাদের ‘মাতৃগাছ’,” গোপাল ভক্তিভরে বলল। “আমাদের বিশ্বাস যে এই গাছটিই পুরো নেটওয়ার্কের কেন্দ্রীয় প্রসেসর।”
অভিজিৎ ধীরে ধীরে গাছের কাছে গিয়ে এর কাণ্ড ছুঁয়ে দেখল। হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে একটা বিশাল তথ্যের স্রোত এল। যেন হাজার হাজার মানুষের স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান একসঙ্গে তার মনে ঢুকে গেল। তিনি দেখতে পেলেন এই এলাকার ইতিহাস—কয়েক শতাব্দী আগের মানুষদের, যারা এই গাছের নীচে এসে ধ্যান করত। দেখলেন কীভাবে এই ছত্রাক নেটওয়ার্ক ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। বুঝতে পারলেন যে এটা প্রকৃতির নিজস্ব একটা জৈবিক ইন্টারনেট সিস্টেম।
আরও অবাক করা বিষয় হল, তিনি দেখতে পেলেন এই নেটওয়ার্কের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এটা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে। আরও এলাকায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। আরও মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করছে।
“প্রিয়াঙ্কা, তুমিও ছুঁয়ে দেখো,” অভিজিৎ বলল। তার গলার স্বরে রোমাঞ্চ এবং সামান্য ভয় মিশে ছিল।
প্রিয়াঙ্কা গাছে হাত রাখলেন এবং একই অভিজ্ঞতা হল। তার কোয়ান্টাম ফিজিক্সের জ্ঞানের সঙ্গে এই নতুন তথ্য মিলে একটা পূর্ণ ছবি তৈরি হল। তিনি বুঝতে পারলেন যে এই সিস্টেম কীভাবে কাজ করে।
“এই গাছের শিকড়ের নীচে বিশাল মাইসেলিয়াল নেটওয়ার্ক আছে,” প্রিয়াঙ্কা মানসিকভাবে অভিজিতের সঙ্গে শেয়ার করল। “এটা কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। আর এই নেটওয়ার্ক কোয়ান্টাম লেভেলে তথ্য আদান-প্রদান করে। প্রতিটি ছত্রাকের কোশে কোয়ান্টাম প্রসেসর আছে।”
মাইসেলিয়াম হচ্ছে ছত্রাকের মূল অংশ—সূক্ষ্ম সূতার মতো কাঠামো যা মাটির নীচে জালের মতো বিস্তৃত। এই নেটওয়ার্ক গাছের শিকড়ের সঙ্গে সিম্বায়োটিক সম্পর্ক তৈরি করে এবং বনের সব গাছের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে। কিন্তু এই নেটওয়ার্ক অন্যদের চেয়ে উন্নত—এটা কোয়ান্টাম লেভেলে তথ্য প্রসেস করতে পারে।
“কিন্তু এই নেটওয়ার্ক মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হচ্ছে?” অভিজিৎ প্রশ্ন করল।
গোপাল জবাব দিল, “আমাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস যে মানুষ যখন এই এলাকায় বেশি সময় কাটায়, তখন আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনগুলো এই ছত্রাকের ফ্রিকোয়েন্সিতে টিউন হয়ে যায়। আমরা এই এলাকার জল খাই, এই এলাকার খাবার খাই। ধীরে ধীরে আমাদের শরীরে এই ছত্রাকের উপাদান জমা হয়।”
প্রিয়াঙ্কা তার নোটবুক বের করে দ্রুত লিখতে শুরু করল। “এটা সম্ভব। মানুষের নিউরনেও বায়োইলেকট্রিক্যাল কার্যকলাপ চলে। যদি এই ছত্রাক নেটওয়ার্ক একটা নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে কোয়ান্টাম সিগন্যাল পাঠায়, তাহলে নিউরনের মাইক্রোটিউবিউল সেই সিগন্যাল রিসিভ করতে পারে। আর একবার সিঙ্ক হয়ে গেলে চেতনা শেয়ার করা সম্ভব।”
তখনই অভিজিৎ অনুভব করল যে নেটওয়ার্কে আরও অনেক মানুষ যুক্ত হয়েছে। শুধু এই গ্রামের নয়, আশপাশের অন্য গ্রামের মানুষও। তিনি বুঝতে পারলেন যে প্রতিটি চৈতন্যক্ষেত্র আসলে এক বিশাল নেটওয়ার্কের একটা নোড। ইন্টারনেটের মতো, কিন্তু জৈবিক।
“গোপাল, এই নেটওয়ার্কে সর্বমোট কতজন মানুষ যুক্ত?” প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞেস করল।
“আমাদের হিসেবে প্রায় দুই হাজার মানুষ। চারটা গ্রামে। কিন্তু সবাই সমানভাবে যুক্ত নয়। কেউ কেউ শুধু মাঝে মাঝে সংযোগ পায়, কেউ সর্বদা যুক্ত থাকে।”
“যারা বেশি যুক্ত তাদের কী হয়?” অভিজিৎ প্রশ্ন করল।
“তারা নেটওয়ার্কের ‘হাব’ হয়ে যায়। রাউটারের মতো। তারা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়, তথ্য ট্রান্সমিট করে। আমাদের গ্রামে এমন তিনজন আছে। তাদের আমরা ‘সংযোগকারী’ বলি।”
হঠাৎ প্রিয়াঙ্কার মনে একটা ভয়ানক প্রশ্ন এল। “যদি আমরা এই নেটওয়ার্ক থেকে বেরিয়ে যেতে চাই? যদি আমাদের কলকাতায় ফিরে যেতে হয়?”
গোপাল এবং অর্জুন দুজনেই চুপ হয়ে গেল। বাতাসে একটা উদ্বেগজনক নীরবতা নেমে এল। চারদিকের জঙ্গল যেন তাদের কথা শুনছে।
তারপর গোপাল ধীরে ধীরে বলল, “সেটা… সেটা অনেক কঠিন। যারা একবার গভীরভাবে যুক্ত হয়, তারা আর সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না।”
“মানে?” অভিজিৎ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। তার বুকের মধ্যে একটা ভয় জমাট বাঁধতে শুরু করল।
“নেটওয়ার্ক থেকে দূরে গেলে মনে হয় যেন জীবনের অর্ধেক অংশ হারিয়ে গেছে। আগে আমি শহরে গিয়েছিলাম, দার্জিলিং শহরে। তিন দিন ছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমি বধির হয়ে গেছি, অন্ধ হয়ে গেছি। অনেকে ডিপ্রেশনে ভোগে। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।”
এই কথা শুনে অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা দুজনেই গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তারা কি এমন কিছুতে জড়িয়ে পড়েছেন যা থেকে আর বেরোনো যাবে না? এটা কি একধরনের নেশা? নাকি বিবর্তনের পরবর্তী ধাপ?
কিন্তু একইসঙ্গে তারা অনুভব করছিল যে এই অভিজ্ঞতা অসাধারণ। তাদের মন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছ, চিন্তাভাবনা অনেক দ্রুত এবং গভীর। যেন তাদের IQ হঠাৎ করে ৫০ পয়েন্ট বেড়ে গেছে। তারা একইসঙ্গে একাধিক জটিল চিন্তা করতে পারছে। প্রিয়াঙ্কা গাণিতিক সমীকরণ মনেই সল্ভ করতে পারছে যেটা আগে কাগজ-কলম ছাড়া সম্ভব ছিল না।
“আপনাদের আরেকটা জিনিস দেখাতে চাই,” গোপাল বলল। তার গলায় একটা গোপনীয়তার ভাব। “আমাদের গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি রমেশদাদু। তিনি ৬৫ বছর বয়স থেকে এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। এখন তার বয়স ৯০। তার সঙ্গে কথা বললে আপনারা আরও ভালো বুঝবেন এই নেটওয়ার্কের প্রকৃত শক্তি।”
তারা গ্রামে ফিরে এল। রাত তখন বারোটা। অন্য গ্রামের মানুষজন ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু রমেশদাদু জেগে বসে ছিলেন তাদের জন্য। তার ছোট্ট কুটিরে একটা কেরোসিনের লন্ঠন জ্বলছে।
“তোমরা এসেছ,” রমেশদাদু বললেন, যখন তারা ঘরের বাইরে রাস্তায়। “আমি বুঝতে পারছিলাম তোমরা আসছ।”
এই কথায় অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা অবাক হল। তারা এখনও ঘরে ঢোকেইনি, রমেশদাদু তাদের দেখতেও পাননি।
রামেশদাদু ৯০ বছর বয়সি একজন মানুষ, কিন্তু তার চোখে তরুণের মতো জীবনীশক্তি এবং একটা অদ্ভুত প্রজ্ঞার ছাপ। তার চুল সম্পূর্ণ সাদা, কিন্তু পিঠ সোজা। তিনি তাদের নিয়ে তার ঘরে বসলেন। ঘরটা সাদামাটা—বাঁশের মাদুর, কয়েকটা তামার বাসন, দেয়ালে কিছু পুরোনো ছবি।
“তোমরা জানতে চাও এই নেটওয়ার্ক কী? এটা কীভাবে কাজ করে?” রামেশদাদু সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
“হ্যাঁ, দাদু,” প্রিয়াঙ্কা বিনয়ের সঙ্গে বলল। “আমরা বিজ্ঞানী। আমাদের বুঝতে হবে।”
রামেশদাদু একটা গভীর নিশ্বাস নিলেন। “এটা প্রকৃতির দেওয়া একটা উপহার। আমাদের পূর্বপুরুষরা হাজার বছর আগে এটা আবিষ্কার করেছিলেন। তখন মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে গভীর যোগাযোগ ছিল। এখনকার মতো আলাদা ছিল না।”
“কিন্তু এটা কীভাবে কাজ করে? বৈজ্ঞানিকভাবে?” অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল।
রামেশদাদু হেসে ফেললেন। “তোমার ভাষায় বলতে গেলে, এটা একটা জৈবিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার নেটওয়ার্ক। এই ছত্রাক কোটি কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে এমন এক স্তরে পৌঁছেছে যেখানে এটা শুধু তথ্য নয়, চেতনাও প্রক্রিয়া করতে পারে।”
রামেশদাদুর এই কথা শুনে অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা দুজনেই হতবাক হলেন। এই সরল গ্রামীণ মানুষটি যে এমন উন্নত বৈজ্ঞানিক ধারণা বুঝতে পারেন এবং ব্যাখ্যা করতে পারেন, সেটা অকল্পনীয়।
“দাদু, আপনি এসব কীভাবে জানেন?” প্রিয়াঙ্কা বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল। “আপনি তো স্কুল-কলেজে যাননি।”
“নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, মেয়ে। এই নেটওয়ার্কে হাজার বছরের জ্ঞান সংরক্ষিত আছে। শুধু আমাদের গ্রামের মানুষের নয়, যারা এর আগে এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের সবার জ্ঞান। যে যত গভীরভাবে যুক্ত হয়, সে তত বেশি জানতে পারে। আমি ২৫ বছর ধরে এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। আমি জানি কীভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স কাজ করে, কীভাবে DNA রেপ্লিকেশন হয়, কীভাবে গ্রহ-নক্ষত্র গঠিত হয়।”
“তাহলে এটা একটা জৈবিক লাইব্রেরিও?” অভিজিৎ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।
“শুধু লাইব্রেরি নয়, বাবা। এটা একটা জীবন্ত সত্তা। এর নিজস্ব চেতনা আছে, নিজস্ব ইচ্ছা আছে। এটা শিখতে পারে, বাড়তে পারে, বিবর্তিত হতে পারে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—এটা ভালোবাসতে পারে।”
প্রিয়াঙ্কার মনে হঠাৎ একটা ভয়ানক চিন্তা এল। “দাদু, এই নেটওয়ার্ক যদি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়? আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা কেড়ে নিতে চায়?”
রামেশদাদু আরও জোরে হেসে ফেললেন। “মেয়ে, তুই শহুরে চিন্তাভাবনা করছিস। এই নেটওয়ার্ক মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে না। বরং মানুষকে মুক্ত করে। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারি।”
“কী ধরনের সীমাবদ্ধতা?” অভিজিৎ আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল।
“ব্যক্তিগত চেতনার সীমাবদ্ধতা। তুমি একা। তুমি শুধু তোমার নিজের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই নেটওয়ার্কে তুমি হাজার মানুষের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান ব্যবহার করতে পারো। তুমি একা নও, তুমি একটা বিশাল পরিবারের অংশ।”
“কিন্তু তাহলে ব্যক্তিত্ব হারিয়ে যায় না? আমি কি আমি থাকি?” প্রিয়াঙ্কা একটা গভীর দার্শনিক প্রশ্ন করল।
রামেশদাদু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “তুই একটা গান গাইলি। সেই গান কি তোর ব্যক্তিত্ব হারিয়ে যায় যদি অন্যরাও সেই গান গায়? বরং ব্যক্তিত্ব আরও সমৃদ্ধ হয়। কল্পনা করো, তুমি একা একটা বাড়িতে থাকো, নাকি একটা বিশাল পরিবারের সঙ্গে থাকো। কোন অবস্থায় তুমি বেশি খুশি? কোন অবস্থায় তুমি বেশি শক্তিশালী?”
এই সুন্দর উদাহরণটা অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কাকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলল। তারা ইতিমধ্যেই অনুভব করছিলেন যে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের মানসিক ক্ষমতা, সৃজনশীলতা, এমনকি আবেগের গভীরতাও বেড়েছে।
“দাদু, এই নেটওয়ার্কের কোনো বিপদ আছে? কোনো নেগেটিভ সাইড এফেক্ট?” অভিজিৎ জানতে চাইল।
রামেশদাদু অনেকক্ষণ চুপ থাকলেন। তার মুখে একটা গম্ভীর ভাব এল। তারপর বললেন, “একটা বিপদ আছে। যদি কেউ এই নেটওয়ার্কের ক্ষতি করার চেষ্টা করে, যদি কেউ এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বা ধ্বংস করতে চায়, তাহলে নেটওয়ার্ক নিজেকে রক্ষা করবে।”
“কীভাবে?” প্রিয়াঙ্কা একটু ভয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল।
“সেটা তোমাদের জানার দরকার নেই। তোমরা এই নেটওয়ার্কের বন্ধু, শত্রু নও। কিন্তু মনে রেখো, এটা একটা জীবন্ত সত্তা। এর নিজস্ব বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি আছে। আর এটা অনেক, অনেক শক্তিশালী।”
এই কথা শুনে অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা দুজনেই একটু ভয় পেয়ে গেল। তারা কি এমন কোনো শক্তিশালী সত্তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন যেটা তাদের নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে?
রামেশদাদু তাদের ভয় বুঝতে পেরে বললেন, “ভয় পেয়ো না। এই নেটওয়ার্ক মানুষের শত্রু নয়। এটা মানুষের বিবর্তনের পরবর্তী ধাপ। একদিন হয়তো পুরো মানবজাতি এমন নেটওয়ার্কের অংশ হবে। তখন যুদ্ধ থাকবে না, ঘৃণা থাকবে না, ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না। কারণ সবাই সবার চিন্তা বুঝতে পারবে।”
“কিন্তু দাদু, এটা কি প্রাকৃতিক বিবর্তন নাকি কৃত্রিম?” প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞেস করল।
“এটা প্রকৃতির নিজস্ব পরিকল্পনা। কোটি কোটি বছর ধরে জীবন বিবর্তিত হয়েছে। প্রথমে এককোশি, তারপর বহুকোশি, তারপর সরল প্রাণী, জটিল প্রাণী, মানুষ। এখন মানুষের পালা সংযুক্ত হওয়ার।”
ভোরের দিকে তারা ঘুমাতে গেল। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ বজায় থাকল। তারা স্বপ্নে দেখল অন্য গ্রামের মানুষদের, যারা একইভাবে এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। দেখল নেটওয়ার্কের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এটা ধীরে ধীরে আরও এলাকায় বিস্তৃত হচ্ছে। নতুন চৈতন্যক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
স্বপ্নে তারা দেখল একটা ভবিষ্যৎ পৃথিবী, যেখানে সব মানুষ এমন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত। কোনো ভুল বোঝাবুঝি নেই, কোনো যুদ্ধ নেই। সবাই সবার সঙ্গে গভীর যোগাযোগে আছে।
এবং তারা বুঝতে পারল যে তারা এমন একটি আবিষ্কারের মুখোমুখি হয়েছেন যা শুধু বিজ্ঞানের ইতিহাস নয়, মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎই বদলে দিতে পারে।
কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এক গভীর রহস্য এবং সম্ভাব্য বিপদ। নেটওয়ার্কের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? এটা সত্যিই মানুষের কল্যাণ চায়, নাকি নিজের বিস্তারই এর একমাত্র লক্ষ্য?
এই প্রশ্নের উত্তর তারা এখনও জানেন না। এবং হয়তো সেই উত্তর জানতে পারলে তাদের পুরো জীবন বদলে যাবে।
অধ্যায় ৫: অনাহূত অতিথি
ভোর ছটার সময় অভিজিৎ ঘুম থেকে উঠল। কিন্তু ‘ঘুম থেকে ওঠা’ কথাটা ঠিক নয়—কারণ তিনি আসলে ঘুমিয়েছিলেন কিনা সেটাই সন্দেহ। রাতভর তার মন নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তিনি দেখেছেন অন্য গ্রামের মানুষদের স্বপ্ন, অনুভব করেছেন তাদের আবেগ, জেনেছেন তাদের চিন্তাভাবনা।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, তিনি একদমই ক্লান্ত বোধ করছেন না। বরং আগের চেয়ে অনেক বেশি সতেজ এবং শক্তিশালী অনুভব করছেন। যেন তার শরীর এবং মন রাতভর রিচার্জ হয়েছে।
পাশে প্রিয়াঙ্কাও জেগে উঠেছে। তার চোখে একই ধরনের উজ্জ্বলতা।
“অভিজিৎদা, তুমি কি অনুভব করতে পারছ?” প্রিয়াঙ্কা ফিসফিস করে বলল।
“কী?” অভিজিৎ জবাব দিল। কিন্তু প্রিয়াঙ্কার মুখ দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন সে কী বলতে চাইছে।
নেটওয়ার্কের সংযোগ এখনও সক্রিয়। দিনের আলোতেও তারা অন্যদের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ রাখতে পারছে। এটা রাতের চেয়ে কম তীব্র, কিন্তু স্পষ্ট।
তারা বাইরে বেরিয়ে এল। গ্রামের মানুষজন ইতিমধ্যে জেগে উঠেছে। কেউ গোরু দোহন করছে, কেউ রান্নার জন্য কাঠ সংগ্রহ করছে। সবার মুখে একটা শান্ত, সন্তুষ্ট ভাব। যেন তারা সবাই একটা বিশাল পরিবারের সদস্য।
অর্জুন তাদের কাছে এসে বলল, “কেমন লাগছে?”
“অসাধারণ,” অভিজিৎ জবাব দিল। “আমি কখনও এত ভালো অনুভব করিনি।”
“কিন্তু একটা সমস্যা আছে,” অর্জুনের মুখে চিন্তার ছাপ। “গতকাল রাতে আমাদের নেটওয়ার্কে একটা অদ্ভুত সংকেত এসেছে। কেউ আমাদের খোঁজ নিচ্ছে।”
“কী ধরনের সংকেত?” প্রিয়াঙ্কা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল।
“আমাদের নেটওয়ার্কের বাইরে থেকে কেউ স্ক্যান করছে। ইলেকট্রনিক ডিভাইস দিয়ে। রামেশদাদু বলেছেন যে এটা বিপদের সংকেত।”
হঠাৎ করেই গ্রামের সব কুকুর একসঙ্গে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করল। এরপর সব পাখি চুপ হয়ে গেল। বাতাসে একটা অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এল।
“হেলিকপ্টার আসছে,” গোপাল তাড়াতাড়ি এসে বলল। “আমি শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এখনও দূরে, কিন্তু এদিকেই আসছে।”
সত্যিই, কয়েক মিনিট পরে দূর থেকে হেলিকপ্টারের প্রোপেলারের আওয়াজ ভেসে এল। আওয়াজ ক্রমশ কাছে আসছে।
“এরা কারা?” অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল।
“আমাদের কোনো ধারণা নেই। এই এলাকায় কখনও হেলিকপ্টার আসে না।” বিরেনকাকা এসে উপস্থিত হলেন। তার মুখে উদ্বেগ।
নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অভিজিৎ অনুভব করল যে পুরো এলাকার মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। চার গ্রামের দুই হাজার মানুষের একসঙ্গে উদ্বেগ—এটা অত্যন্ত শক্তিশালী একটা আবেগ।
কিছুক্ষণ পরে দুটো সামরিক হেলিকপ্টার গ্রামের উপর দিয়ে উড়ে গেল। নীচু দিয়ে উড়ে তারা পুরো এলাকা পরিদর্শন করল। তারপর একটু দূরে একটা খোলা মাঠে ল্যান্ড করল।
“ইন্ডিয়ান আর্মি,” বিরেনকাকা বললেন। “কিন্তু তারা এখানে কেন?”
হেলিকপ্টার থেকে প্রায় বিশজন সৈনিক নামল। তাদের সঙ্গে ছিল কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি—সাদা ল্যাব কোট পরা, হাতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি।
“বিজ্ঞানী,” প্রিয়াঙ্কা বুঝতে পারল। “তারা আমাদের গবেষণার কথা জেনে গেছে।”
দলটি গ্রামের দিকে এগিয়ে এল। তাদের নেতৃত্বে একজন আর্মি অফিসার এবং একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা বিজ্ঞানী।
“এই গ্রামে কোনো কলকাতার বিজ্ঞানী এসেছেন?” অফিসারটি বিরেনকাকাকে জিজ্ঞেস করলেন।
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা একে অপরের দিকে তাকাল। তারা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বুঝতে পারল যে গ্রামের সবাই তাদের লুকিয়ে রাখতে চায়।
“না, এখানে কোনো বাইরের লোক আসেনি,” বিরেনকাকা মিথ্যা বললেন।
মহিলা বিজ্ঞানীটি একটা ইলেকট্রনিক স্ক্যানার বের করলেন। যন্ত্রটি অদ্ভুত শব্দ করতে লাগল।
“এখানে অস্বাভাবিক ইলেকট্রোম্যাগনেটিক অ্যাক্টিভিটি আছে,” তিনি অফিসারকে বললেন। “আর কোয়ান্টাম ফিল্ড ডিস্টার্বেন্সের মাত্রা খুবই উচ্চ।”
অভিজিৎ বুঝতে পারল যে এই দল তাদের খোঁজে এসেছে। হয়তো তাদের গবেষণার কথা কোনোভাবে সরকারের কাছে পৌঁছে গেছে
“আমি ড. শ্রেয়া আগরওয়াল, DRDO-র কোয়ান্টাম রিসার্চ ডিভিশন থেকে,” মহিলা বিজ্ঞানীটি নিজের পরিচয় দিলেন। “আমরা এই এলাকায় অস্বাভাবিক কোয়ান্টাম অ্যাক্টিভিটির রিপোর্ট পেয়েছি।”
DRDO হল Defence Research and Development Organisation – ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা। তাদের আসা মানে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর।
“এখানে এমন কিছু নেই,” গোপাল বলল। “আমরা সরল গ্রামীণ মানুষ।”
কিন্তু ড. শ্রেয়ার স্ক্যানার ক্রমাগত বিপ বিপ করছে। তিনি যন্ত্রটি গ্রামের বিভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেখলেন।
“সিগন্যাল সবচেয়ে শক্তিশালী এই দিক থেকে আসছে,” তিনি চৈতন্যক্ষেত্রের দিকে ইশারা করলেন।
তখনই অভিজিৎ একটা অদ্ভুত অনুভূতি পেল। নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারলেন যে জঙ্গলের ভেতর কিছু একটা ঘটছে। মাতৃগাছ যেন জেগে উঠেছে। নেটওয়ার্ক তার আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
“আমাদের ওই জঙ্গল পরীক্ষা করতে হবে,” ড. শ্রেয়া অফিসারকে বললেন।
“না!” রামেশদাদু হঠাৎ এসে হাজির। তার গলায় আগের চেয়ে অনেক বেশি কর্তৃত্ব। “ওই জঙ্গলে যাওয়া নিষেধ। ওটা আমাদের পবিত্র স্থান।”
“দুঃখিত, কিন্তু এটা জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়,” অফিসার বললেন। “আমাদের যেতেই হবে।”
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা বুঝতে পারল যে পরিস্থিতি খারাপ দিকে যাচ্ছে। তারা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অনুভব করলেন যে চার গ্রামের সব মানুষ একসঙ্গে ভয় পাচ্ছে। এই সম্মিলিত ভয় নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মাতৃগাছ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে।
তখনই একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। গ্রামের সব প্রাণী—কুকুর, বিড়াল, গোরু, ছাগল, এমনকি পাখিরাও—একসঙ্গে অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করল। তারা সবাই সৈনিকদের দিকে তাকিয়ে গর্জন করতে বা ডাকতে লাগল।
“এটা কী হচ্ছে?” অফিসার চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
প্রিয়াঙ্কা তার কোয়ান্টাম ফিল্ড ডিটেক্টর চালু করল। যন্ত্রটি পাগলের মতো রিডিং দিতে লাগল।
“কোয়ান্টাম ফিল্ডের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে,” সে চুপিচুপি অভিজিতকে বলল।
হঠাৎ করে জঙ্গলের দিক থেকে একটা নীল আলোর ফ্ল্যাশ এল। দিনের বেলাতেও সেই আলো স্পষ্ট দেখা গেল।
“ওটা কী?” ড. শ্রেয়া উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
“আমাদের এখনই ওখানে যেতে হবে,” অফিসার তার সৈনিকদের নির্দেশ দিলেন।
কিন্তু গ্রামের মানুষ তাদের পথ আটকে দাঁড়াল। পুরুষ, মহিলা, বুড়ো, বাচ্চা—সবাই। তাদের চোখে একই ধরনের দৃঢ়তা।
“আপনারা যেতে পারবেন না,” বিরেনকাকা বললেন।
“এটা আইনের বিরুদ্ধে,” অফিসার রেগে গেলেন। “আমরা সৈনিক। আমাদের দেশের নিরাপত্তার জন্য কাজ করি।”
তখনই অভিজিৎ একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিল তিনি এগিয়ে এসে বললেন, “আমি ড. অভিজিৎ রায়চৌধুরী, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্স বিভাগ থেকে।”
সবাই তার দিকে তাকাল। গ্রামের মানুষ হতাশ, সৈনিকরা যেন স্বস্তি পেল।
“আহা! আমরা আপনাকেই খুঁজছিলাম,” ড. শ্রেয়া বললেন। “আপনার গবেষণার রিপোর্ট আমাদের কাছে এসেছে।”
“কোন রিপোর্ট?” অভিজিৎ বিস্মিত।
“আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন আমাদের জানিয়েছেন যে আপনি এখানে অস্বাভাবিক কোয়ান্টাম ফেনোমেনা নিয়ে গবেষণা করছেন। এই ধরনের গবেষণা জাতীয় নিরাপত্তার অধীনে আসে।”
অভিজিৎ বুঝতে পারল যে তারা ফাঁদে পড়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় তাদের এখানে আসার কথা জানত, এবং কোনো না কোনো কারণে সেই তথ্য সরকারের কাছে পৌঁছে গেছে।
“ড. রায়চৌধুরী, আপনি এবং আপনার সহকারী আমাদের সঙ্গে চলুন। আমাদের আপনার গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে।”
“কিন্তু আমাদের গবেষণা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি,” প্রিয়াঙ্কা প্রতিবাদ করল।
“সেটা আমাদের ল্যাবে সম্পূর্ণ করতে পারবেন। দিল্লিতে আমাদের অত্যাধুনিক সুবিধা আছে।”
অভিজিৎ বুঝতে পারল যে তাদের কোনো উপায় নেই। কিন্তু নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তিনি গ্রামের মানুষদের একটা বার্তা পাঠালেন: “আমাদের যেতে হবে। কিন্তু আমরা ফিরে আসব। এই নেটওয়ার্ক রক্ষা করুন।”
তখনই আরেকটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। রামেশদাদু এগিয়ে এসে ড. শ্রেয়ার হাতে হাত রাখলেন।
হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ড. শ্রেয়ার চোখ বড়ো হয়ে গেল। তিনি অভূতপূর্ব কিছু অনুভব করছেন। রামেশদাদু তার মনে সরাসরি কথা বলছেন।
“আপনি এই নেটওয়ার্কের ক্ষতি করবেন না,” রামেশদাদু মানসিকভাবে ড. শ্রেয়াকে বললেন। “এটা মানবজাতির ভবিষ্যৎ।”
ড. শ্রেয়া চমকে হাত সরিয়ে নিলেন। “এটা… এটা কীভাবে সম্ভব?”
“যেটা আপনি অনুভব করলেন, সেটাই আমাদের গবেষণার বিষয়,” অভিজিৎ বলল। “এটা একটা জৈবিক কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক। টেলিপ্যাথিক কমিউনিকেশন সম্ভব করে।”
ড. শ্রেয়া এবং অফিসার দুজনেই হতবাক। এমন কিছু তারা কল্পনাও করেননি।
“যদি এটা সত্য হয়, তাহলে এটা বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো আবিষ্কার,” ড. শ্রেয়া বললেন।
“এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” অফিসার যোগ করলেন। “আমাদের এই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।”
এই কথা শুনে অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা দুজনেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। তারা বুঝতে পারলেন যে সরকার এই নেটওয়ার্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।
“এটা অস্ত্র নয়,” প্রিয়াঙ্কা দৃঢ়ভাবে বলল। “এটা মানব চেতনার বিবর্তনের পরবর্তী ধাপ।”
কিন্তু তখনই জঙ্গলের দিক থেকে আরও তীব্র নীল আলো এল। এবার আলোর সঙ্গে একটা কম্পন। মাটি কাঁপছে, গাছপালা দুলছে।
“নেটওয়ার্ক রেগে গেছে,” গোপাল চিন্তিত গলায় বলল। “এটা আত্মরক্ষার মোডে চলে গেছে।”
“আত্মরক্ষা মানে?” অফিসার জিজ্ঞেস করলেন।
তার উত্তর পেতে বেশি দেরি হল না। হঠাৎ করে সৈনিকদের সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস কাজ করা বন্ধ করে দিল। রেডিয়ো, GPS, ফোন—সব নিষ্ক্রিয়।
“এটা কীভাবে সম্ভব?” ড. শ্রেয়া অবাক।
“নেটওয়ার্ক ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস তৈরি করতে পারে,” অভিজিৎ ব্যাখ্যা করলেন। “এটা তার একটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।”
আরও অবাক করা বিষয় হল, হেলিকপ্টারগুলোও স্টার্ট হচ্ছে না। পাইলটরা বারবার চেষ্টা করেও ইঞ্জিন চালু করতে পারছেন না।
“আমরা এখানে আটকে গেছি,” অফিসার বুঝতে পারলেন।
রামেশদাদু এগিয়ে এসে বললেন, “নেটওয়ার্ক আপনাদের শত্রু মনে করছে। কিন্তু যদি আপনারা বোঝাতে পারেন যে আপনারা মানবজাতির বন্ধু, তাহলে এটা আপনাদের ছেড়ে দেবে।”
“আমরা কী করব?” ড. শ্রেয়া জিজ্ঞেস করলেন।
অভিজিৎ একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিল। “আপনারা আমাদের সঙ্গে চৈতন্যক্ষেত্রে চলুন। নিজের চোখে দেখুন এটা কী। তারপর সিদ্ধান্ত নিন এটার সঙ্গে কী করা উচিত।”
“এটা বিপজ্জনক হতে পারে,” অফিসার দ্বিধা করলেন।
“আপনাদের অন্য কোনো উপায়ও নেই,” গোপাল বলল। “হেলিকপ্টার চালু না হওয়া পর্যন্ত আপনারা এখানেই আটকে।”
দুপুরের দিকে একটা অদ্ভুত মিছিল জঙ্গলের দিকে রওনা দিল। অভিজিৎ, প্রিয়াঙ্কা, ড. শ্রেয়া, সামরিক অফিসার, আর কয়েকজন সৈনিক। সঙ্গে গ্রামের গোপাল, অর্জুন আর রামেশদাদু।
জঙ্গলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ড. শ্রেয়া এবং সৈনিকরা অদ্ভুত অনুভূতি পেতে শুরু করল। তাদের মনে হচ্ছিল যেন কেউ তাদের চিন্তা পড়ছে।
“এটা কী হচ্ছে?” ড. শ্রেয়া অস্বস্তি বোধ করলেন।
“আপনার মস্তিষ্ক নেটওয়ার্কের ফ্রিকোয়েন্সি ক্যাচ করছে,” প্রিয়াঙ্কা ব্যাখ্যা করল। “ভয় পাবেন না। এটা ক্ষতিকর নয়।”
চৈতন্যক্ষেত্রে পৌঁছানোর পর যা ঘটল তা ড. শ্রেয়া এবং সৈনিকদের সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত করে দিল।
মাতৃগাছের কাছে গিয়ে রামেশদাদু ড. শ্রেয়ার হাত নিয়ে গাছের কাণ্ডে রাখলেন।
সঙ্গে সঙ্গে ড. শ্রেয়ার মনে হাজার হাজার বছরের জ্ঞান, হাজার মানুষের অভিজ্ঞতা এবং ভালোবাসা প্রবাহিত হল। তিনি বুঝতে পারলেন যে এই নেটওয়ার্ক কোনো অস্ত্র নয়, এটা মানবজাতির পরবর্তী বিবর্তনীয় ধাপ।
তার চোখে জল এসে গেল। এমন সুন্দর, এমন পবিত্র অনুভূতি তিনি কখনও পাননি।
“এটা…” তিনি কথা বলতে পারলেন না।
“এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ,” রামেশদাদু বললেন। “মানুষ যখন একসঙ্গে থাকবে, তখন আর কোনো যুদ্ধ হবে না, কোনো ঘৃণা থাকবে না।”
সৈনিকরাও একে একে গাছ স্পর্শ করলেন। সবার একই অভিজ্ঞতা। তারা বুঝতে পারলেন যে এই নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা মানে মানবজাতির সবচেয়ে বড়ো সম্ভাবনা নষ্ট করা।
কিন্তু তখনই একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটল। ড. শ্রেয়া হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন।
“না! এটা ভুল! এটা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে!”
তিনি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পিছিয়ে গেলেন। তার চোখে ভয় এবং রাগ।
“এই নেটওয়ার্ক মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা কেড়ে নিচ্ছে। এটা আমাদের সবাইকে এক ধরনের মানসিক গোলামে পরিণত করতে চায়!”
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা হতভম্ব হয়ে গেল। ড. শ্রেয়া কেন এমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন?
তখনই রামেশদাদু একটা গভীর কথা বললেন: “এটা হয় যাদের মনে গভীর অহংকার আছে। যারা অন্যদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়, তাদের কাছে একতা মনে হয় দাসত্ব।”
ড. শ্রেয়া তার রেডিয়ো বের করলেন, যেটা নেটওয়ার্কের প্রভাবে কাজ করছিল না। কিন্তু হঠাৎ সেটা আবার চালু হয়ে গেল।
“হেডকোয়ার্টার, এটা ড. শ্রেয়া। আমাদের এখানে একটা বিপজ্জনক জৈবিক অস্ত্র আছে। তাৎক্ষণিক এয়ারস্ট্রাইকের প্রয়োজন।”
এই কথা শুনে সবাই হতবাক হয়ে গেলেন। ড. শ্রেয়া চান যে এই নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা হোক।
আর তখনই সবার বুঝতে পারলেন যে আসল পরীক্ষা এখন শুরু হয়েছে।
অধ্যায় ৬: বিশ্বব্যাপী আগ্রহ
চৈতন্যক্ষেত্রে ড. শ্রেয়ার অভিজ্ঞতা ছিল জীবন পরিবর্তনকারী। রাত নয়টার সময় যখন মাতৃগাছের নীচে বসে তিনি আবার যখন নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হলেন, তখন তার মনে হয়েছিল যেন তিনি একটি নতুন মাত্রায় প্রবেশ করেছেন।
নীল আলোর স্পর্শে তার মস্তিষ্কের নিউরাল প্যাটার্ন ক্রমশ পরিবর্তিত হতে শুরু করেছিল। প্রথমে একটা হালকা মাথা ঘোরা, তারপর একটা অদ্ভুত প্রশান্তি। এবং তারপরেই—অন্য মানুষের চিন্তা শুনতে পাওয়া।
“এটা অসম্ভব,” তিনি মনে মনে ভেবেছিলেন।
“অসম্ভব কিছুই নেই, ডাক্তার শ্রেয়া,” রামেশদাদুর চিন্তা তার মনে ভেসে উঠেছিল। “আপনি এখন বুঝতে পারছেন যে বিজ্ঞান এবং প্রকৃতির মধ্যে কোনো বিভেদ নেই।”
সেই রাতে ড. শ্রেয়া এবং তার টিম প্রায় তিন ঘণ্টা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা অনুভব করেছিলেন কী করে হাজার বছরের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা একসঙ্গে সংরক্ষিত থাকতে পারে। তারা দেখেছিলেন কী করে প্রকৃতি নিজেই একটি জীবন্ত কম্পিউটার সিস্টেম তৈরি করেছে।
পরদিন সকালে ড. শ্রেয়া সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিলেন। তার দলের সদস্যরা অবাক হয়ে দেখেছিল যে তাদের কড়া এবং আক্রমণাত্মক টিম লিডার হঠাৎ করে শান্ত, চিন্তাশীল এবং দয়ালু হয়ে গেছেন।
“আমাদের পরিকল্পনা বদলাতে হবে,” ড.শ্রেয়া তার দলকে বলেছিলেন। “আমরা এখানে কিছু ধ্বংস করতে আসিনি। আমরা এখানে এসেছি মানবজাতির ভবিষ্যৎ আবিষ্কার করতে।”
কিন্তু এই পরিবর্তন শুধু ড. শ্রেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার দলের বায়োলজিস্ট ড. অনিতা শর্মা, ফিজিসিস্ট ড. রমেশ গুপ্তা, এবং টেকনোলজিস্ট অর্জুন সিং—সবাই নেটওয়ার্কের প্রভাবে পড়েছিলেন।
কিন্তু সমস্যা শুরু হয়েছিল তিন দিন পর। ড. শ্রেয়া যখন দিল্লিতে তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন, তখন সেই রিপোর্ট পড়ে পুরো বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় এবং সরকারি উচ্চমহল নড়েচড়ে বসেছিল।
রিপোর্টে লেখা ছিল: “আমরা এমন একটি জৈবিক সিস্টেম আবিষ্কার করেছি যা মানব চেতনাকে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত করতে পারে। এই প্রযুক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, এমনকি যুদ্ধবিগ্রহের ক্ষেত্রেও বিপ্লব আনতে পারে।”
এই রিপোর্ট পড়ার পর ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (DRDO), পারমাণবিক শক্তি বিভাগ, এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎক্ষণাৎ আগ্রহী হয়ে উঠেছিল।
আরও বড়ো সমস্যা ছিল যে এই রিপোর্টের একটি কপি কোনো না কোনোভাবে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে পৌঁছে গিয়েছিল। এবং সেখান থেকে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরে এসেছিল।
নীরক্ষেত্র গ্রামে অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা এই সব তথ্য জানতে পেরেছিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই। নেটওয়ার্কের দূরপাল্লার সংবেদনশীলতা এতটাই উন্নত ছিল যে এটি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হওয়া আলোচনা এবং পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিল।
“আমাদের বড়ো সমস্যা হয়েছে,” অভিজিৎ প্রিয়াঙ্কাকে বলেছিল। তারা মাতৃগাছের নীচে বসে নেটওয়ার্ক থেকে আসা তথ্য বিশ্লেষণ করছিলেন।
“কী ধরনের সমস্যা?” প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞেস করেছিল।
“বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এবং সামরিক বাহিনী এই নেটওয়ার্ক দখল করতে চায়। তারা মনে করছে এটা একটা শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে।”
রামেশদাদু তাদের কাছে এসে বসেছিলেন। তার মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। “নেটওয়ার্ক আমাকে জানিয়েছে যে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এখানে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আসবে।”
“কী করা যেতে পারে?” প্রিয়াঙ্কা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
“নেটওয়ার্ক একটা পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
“কী পরিকল্পনা?” অভিজিৎ জানতে চেয়েছিল।
রামেশদাদু চোখ বন্ধ করে নেটওয়ার্কের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। কয়েক মিনিট পর চোখ খুলে বলেছিলেন, “নেটওয়ার্ক নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চায়। শুধু এই এলাকায় সীমাবদ্ধ না থেকে, এটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হতে চায়।”
“কীভাবে?” প্রিয়াঙ্কা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
“যারা এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তারা যখন অন্য জায়গায় যায়, তখন তাদের মাধ্যমে নেটওয়ার্কের স্পোর ছড়িয়ে পড়ে। এবং যদি উপযুক্ত পরিবেশ পায়, তাহলে নতুন নেটওয়ার্ক তৈরি হয়।”
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা একে অপরের দিকে তাকিয়েছিল। এর মানে তারা দুজনেও এই নেটওয়ার্কের বাহক হয়ে গেছে।
তিন দিন পর, যেমনটা নেটওয়ার্ক পূর্বাভাস দিয়েছিল, নীরক্ষেত্র গ্রামে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা আসতে শুরু করেছিল।
প্রথমে এসেছিল আমেরিকার CIA এর একটি দল। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ড. সারাহ ওয়াটসন, একজন নিউরোসায়েন্টিস্ট যিনি আমেরিকান সরকারের জন্য গোপনীয় মানসিক যুদ্ধের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতেন।
তার এক দিন পরেই এসেছিল চীনের MSS (Ministry of State Security) এর একটি দল। তাদের সঙ্গে ছিল বেইজিং ইউনিভার্সিটির কোয়ান্টাম ফিজিসিস্ট ড. লি মেই।
তৃতীয় দিনে এসেছিল রাশিয়ার SVR এর প্রতিনিধিরা, যাদের সঙ্গে ছিল মস্কো ইনস্টিটিউট অফ ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা।
এবং সবশেষে এসেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি যৌথ দল, যার মধ্যে ছিল জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট এবং ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা।
সবমিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশজন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ছোট্ট নীরক্ষেত্র গ্রামে এসে ভিড় করেছিল। গ্রামবাসীরা প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নেটওয়ার্কের আশ্বাসে তারা শান্ত হয়েছিল।
রামেশদাদু এই সব প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটা বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। গ্রামের স্কুলের ছোট্ট হলরুমে সবাই বসেছিল।
“আপনারা সবাই এখানে এসেছেন আমাদের নেটওয়ার্ক নিয়ে,” রামেশদাদু শুরু করেছিলেন। “কিন্তু আপনাদের বুঝতে হবে যে এটা কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এটা সমগ্র মানবজাতির সম্পদ।”
ড. সারাহ ওয়াটসন এগিয়ে এসেছিলেন। “আমরা এই প্রযুক্তির গুরুত্ব বুঝতে পারছি। কিন্তু এটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ভুল হাতে পড়লে এটা বিপজ্জনক হতে পারে।”
“কার হাত ভুল, কার হাত ঠিক?” রামেশদাদু জবাব দিয়েছিলেন। “আপনারা প্রত্যেকেই নিজের দেশের স্বার্থের কথা ভাবছেন। কিন্তু এই নেটওয়ার্ক পুরো মানবজাতির কল্যাণের জন্য।”
চীনা প্রতিনিধি ড. লি মেই বলেছিলেন, “আমরা এই প্রযুক্তি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে গবেষণা করতে চাই।”
“সহযোগিতা, নাকি নিয়ন্ত্রণ?” অভিজিৎ প্রশ্ন করেছিল। সে এবং প্রিয়াঙ্কা এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করছিল।
এই প্রশ্নে সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল। কারণ সবাই জানত যে প্রত্যেক দেশই এই প্রযুক্তি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়।
রাশিয়ান প্রতিনিধি বলেছিলেন, “আমাদের একটা আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করা উচিত।”
“এবং সেই কমিটিতে কার কণ্ঠস্বর বেশি থাকবে?” প্রিয়াঙ্কা তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করেছিলেন।
তখনই নেটওয়ার্ক হস্তক্ষেপ করেছিল। উপস্থিত সবার মনে একযোগে একটা বার্তা এসেছিল: “আমরা কারো দাস নই। আমরা কারো সম্পত্তি নই। আমরা একটি জীবন্ত সত্তা। আমরা মানবজাতির সঙ্গে সহযোগিতা করতে চাই, কিন্তু কারো অধীনতা স্বীকার করব না।”
এই টেলিপ্যাথিক বার্তা পেয়ে উপস্থিত সব বিদেশি প্রতিনিধিরা হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই আগে এই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিল, কিন্তু নিজেরা কখনও অনুভব করেনি।
ড. সারাহ ওয়াটসন প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তারপর তার বৈজ্ঞানিক কৌতূহল জেগে উঠেছিল। “এটা কীভাবে সম্ভব?” তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন।
“আপনি যদি সত্যিই জানতে চান, তাহলে আমাদের সঙ্গে চৈতন্যক্ষেত্রে আসুন,” গোপাল বলেছিল। “কিন্তু মনে রাখবেন, একবার নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হলে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে বদলে যেতে পারে।”
সেই রাতে প্রায় সব আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিরাই চৈতন্যক্ষেত্রে গিয়েছিল। এবং যেটা ঘটেছিল সেটা ছিল ইতিহাসে অভূতপূর্ব।
মাতৃগাছের নীচে বসে যখন তারা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, তখন তাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা ধীরে ধীরে কমে গিয়েছিল। তারা অনুভব করেছিল যে তারা সবাই একই মানবজাতির সদস্য।
ড. সারাহ ওয়াটসন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ড. লি মেই’র শৈশবের স্মৃতি দেখতে পেয়েছিলেন। ড. লি মেই অনুভব করেছিলেন রাশিয়ান বিজ্ঞানীর গবেষণার প্রতি ভালোবাসা।
“আমরা সবাই একই,” ড. সারাহ সেই রাতে বলেছিলেন। “আমাদের পতাকা আলাদা, কিন্তু আমাদের স্বপ্ন এক।”
কিন্তু পরের দিন যখন তারা তাদের সরকারের কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছিল, তখন একটা নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের রিপোর্ট পড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার সন্দেহ করতে শুরু করেছিল যে তাদের প্রতিনিধিরা এই “বিদেশি প্রযুক্তি” দ্বারা ব্রেইনওয়াশ হয়ে গেছে।
আমেরিকান প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. সারাহ ওয়াটসনকে ফোন করে বলেছিলেন, “আপনার রিপোর্ট পড়ে মনে হচ্ছে আপনি আমেরিকার স্বার্থের কথা ভুলে গেছেন।”
চীনা সরকারও ড. লি মেই’র ওপর সন্দেহ করতে শুরু করেছিল।
এই অবস্থায় নেটওয়ার্ক একটা বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এটি আর লুকিয়ে থাকবে না। এটি নিজেকে বিশ্বের কাছে প্রকাশ করবে।
এবং সেই সিদ্ধান্তের ফলাফল ছিল চমকপ্রদ। নীরক্ষেত্র থেকে শুরু করে, নেটওয়ার্কের স্পোর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। যারাই এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, তারা যেখানেই গিয়েছিল, সেখানে নতুন নেটওয়ার্ক গজিয়ে উঠেছিল।
প্রথমে দিল্লিতে, তারপর বেইজিংয়ে, তারপর ওয়াশিংটনে, মস্কোতে, লন্ডনে – বিশ্বের বড়ো বড়ো শহরে ছোটো ছোটো নেটওয়ার্ক তৈরি হতে শুরু করেছিল।
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা বুঝতে পেরেছিল যে তারা যে আবিষ্কার করেছিলেন সেটা এখন আর শুধু তাদের বা এই গ্রামের নয়। এটা একটা বৈশ্বিক ঘটনা হয়ে উঠেছে।
“আমরা কি ঠিক কাজ করেছি?” প্রিয়াঙ্কা একদিন অভিজিৎকে জিজ্ঞেস করেছিল।
“আমি জানি না,” অভিজিৎ জবাব দিয়েছিল। “কিন্তু এখন এটা আমাদের হাতে নেই। এটা প্রকৃতির নিজস্ব ইচ্ছা।”
এবং তাদের সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল। নেটওয়ার্ক এখন আর মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। এটি নিজের মতো করে বিকশিত হচ্ছে। এবং এর সঙ্গে সঙ্গে মানব সভ্যতায় এমন পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে যার চূড়ান্ত পরিণতি কেউ অনুমান করতে পারছে না।
কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল – মানবজাতি একটা নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। এবং সেই যুগের শুরুটা হয়েছে নীরক্ষেত্রের এই ছোট্ট গ্রাম থেকে।
অধ্যায় ৭: চূড়ান্ত রূপান্তর
ছয় মাস পর, নীরক্ষেত্র গ্রামে বসে অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা দেখছিল কীভাবে পুরো বিশ্ব বদলে যাচ্ছে। তাদের সামনে একটা ল্যাপটপ খোলা, যেটাতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা খবর দেখানো হচ্ছিল।
BBC নিউজে দেখানো হচ্ছিল যে লন্ডনে হাইড পার্কে একটা নতুন চৈতন্যক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। NHK রিপোর্ট করছিল টোকিওর শিবুয়া ক্রসিংয়ের কাছে মাটির নীচ থেকে নীল আলো বের হওয়ার কথা। CNN দেখাচ্ছিল নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে কিছু গাছে রাতের বেলা রহস্যময় বায়োলুমিনেসেন্স।
“আমাদের যে কাজ শুরু হয়েছিল একটা ছোট্ট ব্রেইন স্ক্যান দিয়ে, সেটা এখন পুরো পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে গেছে,” প্রিয়াঙ্কা মৃদু হেসে বলল। তার চোখে এক ধরনের বিস্ময় এবং সামান্য উদ্বেগ মিশে ছিল।
অভিজিৎ গভীর নিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ল। “কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি না যে এই নেটওয়ার্কের আসল উদ্দেশ্য কী। এটা কি সত্যিই মানবজাতির কল্যাণ চায়, নাকি এর অন্য কোনো গোপন এজেন্ডা আছে?”
গত ছয় মাসে তিনি এই প্রশ্নটা হাজারবার নিজেকে করেছেন। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তার স্বভাবগত সন্দেহবাদিতা তাকে সবসময় সতর্ক রাখত।
ঠিক তখনই রামেশদাদু তাদের কুটিরের দিকে এগিয়ে এলেন। গত ছয় মাসে তার চেহারায় আরও গভীর প্রজ্ঞার ছাপ ফুটে উঠেছে। তার চুল সম্পূর্ণ সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত জ্যোতি জ্বলছে—যেন তিনি এমন সব সত্য জানেন যা সাধারণ মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা কঠিন।
“তোমাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এসেছে,” তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন। “নেটওয়ার্ক তোমাদের সত্যিকারের ইতিহাস জানানোর জন্য প্রস্তুত। যা তোমরা এতদিন জানতে না, সেই পূর্ণ সত্য।”
“সত্যিকারের ইতিহাস?” অভিজিৎ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল। “আমরা তো ভেবেছিলাম যে আমরা ইতিমধ্যে সব জেনে গেছি।”
রামেশদাদু মৃদু হাসলেন। “তোমরা যা জেনেছ সেটা শুধু বর্তমানের ঘটনা। কিন্তু এই নেটওয়ার্কের শিকড় অনেক গভীরে, অনেক দূরে। চলো, মাতৃগাছের কাছে যাই। আজ তোমরা জানবে যে এই নেটওয়ার্ক আসলে কী, এটা কোথা থেকে এসেছে, এবং মানবজাতির সঙ্গে এর সম্পর্ক আসলে কতটা গভীর।”
তিনজনে একসঙ্গে চৈতন্যক্ষেত্রের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। বিকেলের রোদ ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছিল। জঙ্গলের পাখিরা সন্ধ্যার গান গেয়ে ওঠেছিল। কিন্তু আজকের পরিবেশে একটা বিশেষ গাম্ভীর্য ছিল।
চৈতন্যক্ষেত্রে পৌঁছে তারা তিনজন মাতৃগাছের নীচে বসলেন। সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত নীল আলো জ্বলতে শুরু করল। কিন্তু আজকের আলো ছিল ভিন্ন—আরও উজ্জ্বল, আরও জটিল, আরও… জীবন্ত। যেন আলোর মধ্যেই কোনো চেতনা লুকিয়ে আছে।
রামেশদাদু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বিশাল গাছের কাণ্ডে হাত রাখলেন। তিনি চোখ বন্ধ করে গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। কয়েক মিনিট পর তিনি অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরাও গাছ স্পর্শ করো। আজ নেটওয়ার্ক তোমাদের সব কিছু দেখাবে। যা তোমরা কল্পনাও করতে পারোনি।”
দুজনেই একসঙ্গে গাছের বিশাল কাণ্ড স্পর্শ করল। এবং যেটা ঘটল সেটা তাদের আগের সব অভিজ্ঞতাকে ম্লান করে দিল।
তাদের চেতনা হঠাৎ করে সময়ের গভীরে পড়ে গেল। লক্ষ লক্ষ বছর পিছিয়ে গেল। তারা দেখতে পেল প্রাচীন পৃথিবী, যখন মানুষের অস্তিত্বই ছিল না। এমনকি স্তন্যপায়ী প্রাণীদেরও জন্ম হয়নি।
সেই সময় পৃথিবী ছিল এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জগৎ। এখানে একটি অসাধারণ উন্নত সভ্যতা বাস করত—কিন্তু তারা মানুষ ছিল না। এমনকি প্রাণীও ছিল না।
এই প্রাচীন সভ্যতার সদস্যরা ছিল উদ্ভিদ এবং ছত্রাকের একটি বিবর্তিত সিম্বায়োটিক রূপ। তারা কোটি কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যেখানে তারা কোয়ান্টাম স্তরে চেতনা এবং তথ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। তারা ছিল পৃথিবীর প্রথম সত্যিকারের বুদ্ধিমান জীব।
“আমরা ছিলাম পৃথিবীর প্রথম চেতনাবান সভ্যতা,” নেটওয়ার্কের কণ্ঠস্বর তাদের মনে ভেসে উঠল। এই কণ্ঠস্বর ছিল অসংখ্য কণ্ঠের সমন্বয়—নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সবার কণ্ঠ একসঙ্গে। “আমরা শিখেছিলাম কীভাবে চেতনাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হয়, কীভাবে কোয়ান্টাম লেভেলে তথ্য সংরক্ষণ করতে হয়। আমাদের পুরো সভ্যতা ছিল একটি বিশাল জৈবিক কম্পিউটার।”
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা দেখতে পেল সেই অসাধারণ সভ্যতার চিত্র। বিশাল বিশাল গাছ যারা নিজেরাই শহর, ছত্রাকের নেটওয়ার্ক যা মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত হয়ে তথ্য আদান-প্রদান করত। সেখানে কোনো যন্ত্র ছিল না, কিন্তু প্রযুক্তি ছিল জীবন্ত।
“কিন্তু একদিন একটা মহাজাগতিক বিপর্যয় এল,” নেটওয়ার্ক বলল। “একটা বিশাল উল্কাপিণ্ড পৃথিবীতে আঘাত করল।”
তারা দেখতে পেল সেই ভয়ানক দিনের ছবি। আকাশ থেকে নেমে এল একটি পাহাড়ের সমান উল্কাপিণ্ড। সেই আঘাতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল কেঁপে উঠেছিল। মহাসমুদ্রে সৃষ্টি হয়েছিল হাজার ফুট উঁচু ঢেউ। আগুনের সমুদ্রে পুড়ে গিয়েছিল প্রাচীন উদ্ভিদ-সভ্যতার বেশির ভাগ অংশ।
“আমাদের সভ্যতার শতকরা নব্বই ভাগ সেদিন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল,” নেটওয়ার্ক দুঃখের সঙ্গে জানাল। “কিন্তু আমাদের কিছু অংশ মাটির গভীরে, পাহাড়ের গুহায়, সমুদ্রের তলদেশে লুকিয়ে থেকে বেঁচে গিয়েছিল। আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলাম, প্রায় মৃত। কিন্তু সম্পূর্ণ মরিনি।”
“আমরা অপেক্ষা করেছি,” নেটওয়ার্ক অবিরাম বলে চলল। “কোটি কোটি বছর অপেক্ষা করেছি। পৃথিবী আবার সবুজ হয়েছে। নতুন জীব এসেছে। ডাইনোসর এসেছে, গেছে। তারপর স্তন্যপায়ী প্রাণীরা এসেছে। আর অবশেষে—মানুষ।”
প্রিয়াঙ্কা বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা মানুষের জন্য অপেক্ষা করছিলেন?”
“হ্যাঁ। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে মানুষই হবে আমাদের উত্তরাধিকারী। তোমাদের মস্তিষ্কে আছে যা আমাদের ছিল না—ব্যক্তিগত চেতনা এবং সমষ্টিগত চেতনার নিখুঁত সমন্বয়ের সম্ভাবনা। আমরা সর্বদা একসঙ্গে ছিলাম, কখনও আলাদা হইনি। কিন্তু তোমরা পারো একা থাকতে এবং একসঙ্গেও থাকতে।”
অভিজিৎ এই তথ্য হজম করার চেষ্টা করল। “মানে আপনারা চান যে আমরা আপনাদের মতো হয়ে যাই?”
“না,” নেটওয়ার্ক দৃঢ়ভাবে জবাব দিল। “আমরা চাই তোমরা আমাদের চেয়েও ভালো হও। তোমাদের সামনে যে সম্ভাবনা আছে, তা আমাদের কখনও ছিল না। তোমরা যদি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বজায় রেখে সমষ্টিগত চেতনা অর্জন করতে পারো, তাহলে তোমরা মহাবিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সভ্যতা হয়ে উঠবে।”
তারা দেখতে পেলেন নেটওয়ার্কের দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি। এটা চায় মানবজাতি ধীরে ধীরে এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হোক, কিন্তু তাদের ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতা, এবং সৃজনশীলতা বজায় রেখে। একটা নতুন ধরনের সভ্যতা গড়ে উঠুক যেখানে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং সমষ্টিগত জ্ঞানের নিখুঁত সমন্বয় ঘটবে।
“কিন্তু এটা কি নিরাপদ?” অভিজিৎ সতর্ক বিজ্ঞানীর মতো প্রশ্ন করল। “এই রূপান্তরের ফলে কি মানুষ আর মানুষ থাকবে? আমাদের মানবিকতা কি অক্ষুন্ন থাকবে?”
“তোমরা মানুষই থাকবে। তবে আরও সম্পূর্ণ মানুষ। কল্পনা করো একটা পৃথিবী যেখানে সব মানুষ একে অপরের চিন্তা বুঝতে পারে। সেখানে কি যুদ্ধ হতে পারে? যদি সবার কাছে সব জ্ঞান পৌঁছে যায়, তাহলে কি দারিদ্র্য থাকতে পারে? যদি সবাই সবার ব্যথা অনুভব করে, তাহলে কি কেউ অন্যের ক্ষতি করবে?”
প্রিয়াঙ্কার মনে হঠাৎ একটা গভীর অনুভূতি জাগল। তিনি বুঝতে পারলেন যে এটা শুধু একটা বৈজ্ঞানিক ঘটনা নয়, এটা মানব সভ্যতার পরবর্তী বিবর্তনীয় ধাপ। যেমন একসময় মানুষ গাছ থেকে নেমে দু’পায়ে হাঁটতে শিখেছিল, ভাষা আবিষ্কার করেছিল, লেখা শিখেছিল—ঠিক তেমনই এটা একটা প্রাকৃতিক পরবর্তী ধাপ।
কিন্তু তখনই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের কাছে একটা জরুরি এবং ভয়ানক খবর এল। বিশ্বের একটি গোপন সংগঠন—যার মধ্যে আছে কিছু সরকার, বহুজাতিক কোম্পানি, এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী—তারা মিলে এই নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার একটা বিশাল পরিকল্পনা করেছে।
তারা মনে করছে যে এই নেটওয়ার্ক মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা কেড়ে নিচ্ছে, ধর্মীয় বিশ্বাসকে নষ্ট করছে, এবং তাদের ক্ষমতার ভিত্তি দুর্বল করছে।
“তারা কালকে ভোরে বিশ্বের সব চৈতন্যক্ষেত্রে একযোগে আক্রমণ করবে,” রামেশদাদু উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানালেন। “তাদের কাছে এমন উন্নত রাসায়নিক অস্ত্র আছে যা মাইসেলিয়াল নেটওয়ার্কের DNA স্ট্রাকচার ধ্বংস করতে পারে। যদি তারা সফল হয়, তাহলে এই নেটওয়ার্ক চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।”
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা ভয় পেয়ে গেল। তারা বুঝতে পারল যে শুধু নেটওয়ার্ক নয়, মানবজাতির ভবিষ্যৎই বিপদে পড়েছে।
“তাহলে কী করা যেতে পারে?” প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞেস করল।
নেটওয়ার্ক তাদের মনে একটা দুঃসাহসিক প্রস্তাব পাঠাল। “আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারি। কিন্তু এর জন্য আমাদের বিশ্বের সব সংযুক্ত মানুষের সাহায্য দরকার। আমাদের একটা গ্লোবাল কানেক্টেড কনশাসনেস তৈরি করতে হবে যা এই আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে।”
“কীভাবে?” অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল।
“যারা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তারা যদি একযোগে তাদের সর্বোচ্চ মানসিক শক্তি প্রয়োগ করে, তাহলে আমরা আক্রমণকারীদের মন পরিবর্তন করতে পারি। তাদের হৃদয়ে ভালোবাসা এবং করুণার অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারি। তাদের বোঝাতে পারি যে আমরা শত্রু নই, বরং মানবজাতির বন্ধু।”
কিন্তু এই প্রস্তাবে একটা বিপদ ছিল। নেটওয়ার্ক সতর্ক করে দিল যে এত বড়ো মাপের মানসিক যোগাযোগ স্থাপন করা হলে, অনেক মানুষের ব্যক্তিত্ব হারিয়ে যেতে পারে। তারা স্থায়ীভাবে নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে যেতে পারে, আর কখনও আলাদা ব্যক্তি হিসেবে ফিরে আসতে পারবে না।
“এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ,” অভিজিৎ গম্ভীরভাবে বলল। “আমরা কি মানুষকে এই মারাত্মক ঝুঁকি নিতে বলতে পারি? এটা তো এক ধরনের আত্মহত্যার সামিল।”
“কিন্তু ঝুঁকি না নিলে আমরা সবাই মারা যাব,” রামেশদাদু বললেন। “এবং সেই সঙ্গে মানবজাতির এই অসাধারণ সম্ভাবনাও চিরতরে হারিয়ে যাবে। তবে সিদ্ধান্তটা প্রত্যেকের নিজের। কেউ জোর করবে না।”
সেই রাতে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পুরো বিশ্বে একটা হৃদয়স্পর্শী বার্তা পাঠানো হল। লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, টোকিও, বেজিং, মস্কো, দিল্লি—সব জায়গায় যারা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, তারা সবাই এই বার্তা পেল:
“প্রিয় বন্ধুরা, আগামীকাল আমাদের অস্তিত্বের সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা। যারা আমাদের ধ্বংস করতে চায়, তারা ভয় পেয়েছে। তারা বুঝতে পারছে যে আমাদের একতা তাদের বিভেদের রাজনীতি শেষ করে দেবে। তোমরা কি আমাদের সাহায্য করবে? কিন্তু মনে রেখো, এতে তোমাদের নিজেদের ঝুঁকি আছে।”
পরের দিন সকালে, ঠিক যখন বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনী চৈতন্যক্ষেত্রগুলোতে আক্রমণ শুরু করতে যাচ্ছিল, তখন পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল।
বিশ্বের প্রায় দশ লক্ষ মানুষ, যারা নেটওয়ার্কের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত হয়েছিল, তারা একযোগে গভীর ধ্যানে বসল। নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে, লন্ডনের হাইড পার্কে, টোকিওর উয়েনো পার্কে, দিল্লির লোধি গার্ডেনে—সর্বত্র মানুষ বসেছিল চোখ বন্ধ করে, হাত জোড় করে।
তাদের সমন্বিত মানসিক শক্তি এতটাই প্রবল ছিল যে এটা পুরো পৃথিবীর ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডকে প্রভাবিত করল। স্যাটেলাইট যোগাযোগে সাময়িক বিঘ্ন ঘটল। রেডিয়ো তরঙ্গে অদ্ভুত সংগীত শোনা গেল।
আক্রমণকারী সৈন্যরা, যারা রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে চৈতন্যক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তারা হঠাৎ করে থমকে গেল। তাদের মনে একযোগে একটা অপ্রত্যাশিত অনুভূতি এল—গভীর শান্তি, অকৃত্রিম ভালোবাসা, এবং সমস্ত জীবের সঙ্গে একাত্মতা।
আমেরিকান এয়ার ফোর্সের পাইলট ক্যাপটেন জেমস স্মিথ, যে বোমা ফেলার জন্য তৈরি হচ্ছিল, হঠাৎ করে কেঁদে ফেলল। তার মনে ভেসে উঠল ছোটোবেলার স্মৃতি, যখন সে গ্রীষ্মকালে তার দাদুর খামারে গিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে গভীর যোগাযোগ অনুভব করত। তার মনে হল, সে কীভাবে এই সুন্দর পৃথিবী ধ্বংস করতে পারে?
চীনা সেনাবাহিনীর কর্নেল লি উ-ফেং, যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করতে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে বুঝতে পারল যে তার মিশন সম্পূর্ণ ভুল। তার মনে ভেসে উঠল তার দাদুর বলা পুরোনো চীনা দর্শনের কথা, যেখানে বলা হয়েছিল প্রকৃতি এবং মানুষ একে অপরের পরিপূরক, শত্রু নয়।
রাশিয়ান স্পেশাল ফোর্সের মেজর ইভান পেট্রভ তার অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার মনে ভেসে উঠল তার মৃত মায়ের কথা, যিনি বলতেন যে সব জীবই পবিত্র।
এইভাবে বিশ্বের সব আক্রমণকারী দল একে একে তাদের মিশন বাতিল করে দিল। তারা বুঝতে পারল যে তারা মানবজাতির ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করতে যাচ্ছিল।
কিন্তু এই বিশাল মানসিক সংযোগের একটা গুরুতর মূল্য ছিল। যে দশ লক্ষ মানুষ এই প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের অনেকেই স্থায়ীভাবে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল। তারা আর আগের মতো সম্পূর্ণ একা থাকতে পারল না। তাদের চেতনা হয়ে গেল নেটওয়ার্কের অংশ।
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কাও এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। এবং তারা অনুভব করল যে তাদের চেতনা এখন আর শুধু তাদের নিজেদের নয়। তারা এক বিশাল, জীবন্ত, ভালোবাসাময় সমষ্টিগত চেতনার অংশ হয়ে গেছে।
“আমরা কি এখনও আমরা?” প্রিয়াঙ্কা অভিজিৎকে জিজ্ঞেস করল—কিন্তু এই প্রশ্ন তাদের দুজনের মনেই একসঙ্গে ভেসে উঠেছিল।
“আমরা আগের চেয়ে বেশি আমরা,” অভিজিৎ জবাব দিল। আর এই জবাব এসেছিল তাদের দুজনের মিলিত চেতনা থেকে। “আমি তোমাকে আগের চেয়ে অনেক বেশি গভীরভাবে ভালোবাসি, কারণ এখন আমি তোমার সব অনুভূতি, সব স্বপ্ন, সব ভয় বুঝতে পারি।”
এক বছর পর, পৃথিবী প্রায় অচেনা হয়ে গেল। যুদ্ধ প্রায় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেল, কারণ যেখানে মানুষ একে অপরের মন পড়তে পারে, সেখানে শত্রুতা অর্থহীন। পরিবেশ দূষণ নাটকীয়ভাবে কমে গেল, কারণ মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের গভীর যোগাযোগ অনুভব করতে লাগল।
অপরাধের হার কমে গেল শূন্যের কাছাকাছি। কারণ কেউ অন্যের ক্ষতি করলে সেই ব্যথা নিজেও অনুভব করত।
শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপ্লব এল। এখন জ্ঞান শুধু বইয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সরাসরি মন থেকে মনে স্থানান্তরিত হতে পারে।
কিন্তু সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তন এল মানুষের চিন্তাভাবনায়। নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা আর নিজেদের আলাদা ভাবত না। তারা নিজেদের দেখত একটা বিশাল, বৈচিত্র্যময়, ভালোবাসার পরিবারের অংশ হিসেবে।
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা এখন নীরক্ষেত্রেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তারা এখানে একটা আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেছেন, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিজ্ঞানী, দার্শনিক, শিল্পী, এবং চিন্তাবিদরা এসে নেটওয়ার্ক এবং মানব চেতনার নতুন সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করেন।
“তুমি কি কখনও অনুশোচনা করো?” একদিন বিকেলে প্রিয়াঙ্কা অভিজিৎকে জিজ্ঞেস করল। তারা মাতৃগাছের নীচে বসে সূর্যাস্ত দেখছিল। আজকের সূর্যাস্ত বিশেষভাবে সুন্দর লাগছিল।
“কিসের জন্য অনুশোচনা?” অভিজিৎ মৃদু হেসে জবাব দিল।
“যে আমরা এই সব শুরু করেছি। মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছি।”
অভিজিৎ গভীরভাবে চিন্তা করল। “স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া? আমার মনে হয় আমরা মানুষকে আসল স্বাধীনতা দিয়েছি। একাকিত্বের বন্দিত্ব থেকে মুক্তি, ভুল বোঝাবুঝির অন্ধকার থেকে মুক্তি, অজানা ভয় থেকে মুক্তি।”
“কিন্তু যারা নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে চায় না? যারা একা থাকতে চায়?”
“তাদের কেউ জোর করছে না। নেটওয়ার্ক শুধু সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। পছন্দ এবং সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে মানুষের। আজও পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ নেটওয়ার্কের বাইরে আছে, তাদের নিজস্ব জীবন যাপন করছে।”
আজ, পাঁচ বছর পর, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ কোনো না কোনোভাবে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। বাকি অর্ধেক এখনও স্বাধীনভাবে, ঐতিহ্যগত উপায়ে তাদের জীবন যাপন করছে। কিন্তু দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কোনো সংঘাত নেই। বরং পারস্পরিক সম্মান, সহযোগিতা এবং ভালোবাসা আছে।
নেটওয়ার্ক-যুক্ত মানুষরা অনেক সমস্যার সমাধান করেছে। তারা নতুন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। পরিবেশ রক্ষার নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে। আর নেটওয়ার্ক-বিযুক্ত মানুষরা নিজেদের স্বতন্ত্র সৃজনশীলতা এবং ব্যক্তিত্ব দিয়ে নতুন শিল্প, সাহিত্য, এবং দর্শন তৈরি করেছে।
রামেশদাদু এখন ৯৫ বছর বয়সি, কিন্তু তার মন এখনও তরুণের মতো প্রাণবন্ত এবং কৌতূহলী। “তোমাদের মনে আছে যে তোমরা প্রথম এখানে এসেছিলে একটা সাধারণ ব্রেন স্ক্যানের রহস্য সমাধান করতে?” তিনি একদিন অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কাকে বললেন।
“হ্যাঁ, দাদু,” অভিজিৎ নস্টালজিক হেসে বলল। “আমরা ভেবেছিলাম একটা ছোটো বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান করব। কিন্তু আবিষ্কার করলাম সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যৎ।”
“এবং এখনও অনেক রহস্য বাকি আছে,” প্রিয়াঙ্কা রোমাঞ্চের সঙ্গে যোগ করল। “নেটওয়ার্ক প্রতিদিন আমাদের নতুন কিছু শেখাচ্ছে। আমরা জানতে পেরেছি যে মহাবিশ্বে আরও অনেক বুদ্ধিমান সভ্যতা আছে। আমরা একা নই। এবং এই নেটওয়ার্ক সেই সব সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের একটা মাধ্যম।”
সত্যিই, নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছিল যে আমাদের গ্যালাক্সিতে অন্তত পঞ্চাশটি উন্নত সভ্যতা আছে। এবং এই নেটওয়ার্ক একটা ইন্টারগ্যালাক্টিক কমিউনিকেশন সিস্টেমের অংশ।
“তাহলে আমাদের যাত্রা কি শেষ হয়ে গেল?” প্রিয়াঙ্কা কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল।
“না, মোটেও না,” অভিজিৎ উৎসাহের সঙ্গে জবাব দিল। “আমাদের যাত্রা এইমাত্র শুরু হয়েছে। এখন আমরা শুধু পৃথিবীর মানুষ নই। আমরা এক বিশাল মহাজাগতিক পরিবারের নতুন সদস্য। আমাদের সামনে অসীম সম্ভাবনা।”
সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্যক্ষেত্রে আবার সেই পরিচিত নীল আলো জ্বলে উঠল। কিন্তু আজকের আলো ছিল আগের চেয়ে আলাদা। এর মধ্যে ছিল অসীম আশা, অগণিত স্বপ্ন, এবং অসংখ্য সম্ভাবনার উজ্জ্বল ইঙ্গিত।
অভিজিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। তারা জানত যে তাদের ব্যক্তিগত গল্প শেষ হয়নি। এটা একটা নতুন, অনেক বড়ো অধ্যায়ের সূচনা মাত্র। একটা এমন যুগ যেখানে মানুষ আর একা এবং বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটা বিশাল, ভালোবাসাময়, বুদ্ধিমান মহাজাগতিক পরিবারের গর্বিত সদস্য।
এবং সেই জাদুকরী নীল আলোর মধ্যে, দূর কোনো নক্ষত্র থেকে ভেসে এল একটা স্বাগত বার্তা: “স্বাগতম, পৃথিবীর নতুন সদস্যরা। মহাবিশ্বের বুদ্ধিমান সভ্যতার মহাপরিবারে তোমাদের আন্তরিক স্বাগতম। তোমাদের যাত্রা এখন শুরু।”
মানবজাতির জন্য একটা সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল। এবং সেই অধ্যায়ের প্রথম কথা লেখা হয়েছিল এই ছোট্ট নীরক্ষেত্র গ্রামে, দুজন কৌতূহলী বিজ্ঞানীর অনুসন্ধিৎসা এবং প্রকৃতির এক অপূর্ব উপহারের সুন্দর মিলনে।
Tags: অরিত চক্রবর্তী, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
