অ্যান্টিভাইরাস
লেখক: সৌম্য সাহা
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
মিনিট পাঁচেক পর মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস অনুভব করলেন, তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমে আসছে। উনি এখনও চোখ খুলতে পারছেন না কিংবা হাত-পা-ও নাড়াতে পারছেন না, কিন্তু কোনো এক বিশেষ ইন্দ্রিয়বলে বুঝতে পারছেন, এক উত্তপ্ত ধাতব ঘরের মধ্যে তিনি শুয়ে আছেন। নাকে এসে লাগছে গরম ধাতুর ঘ্রাণ। হালকা শ্বাসপ্রশ্বাস শুরু হয়েছে তাঁর। এতটাই হালকা যে বুকের ওঠানামা নিজেই অনুভব করতে পারছেন না।
এখন পরিবেশটা পুরোপুরি ঠান্ডা। দ্রুত তাপ বিকিরণ করে ধাতব ঘরটা যথেষ্ট ঠান্ডা হয়েছে। মৃত্যুঞ্জয়বাবুর খুব ইচ্ছে করছে চোখ খুলতে, কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার পর যেন পুরু পিঁচুটির স্তর পড়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ পর একটা ঘড়ঘড় শব্দ হল কাছেই কোথাও। একঝলক ঠান্ডা বাতাস ঘরের গুমোট ভাব কাটিয়ে দিল। ডক্টর অনুভব করলেন, তিনি যেটার উপর শুয়ে আছেন, সেটা নড়তে আরম্ভ করেছে। খুব চেষ্টা করলেন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার, কিন্তু শরীরের পেশি অস্বাভাবিক রকমের শক্ত হয়ে রয়েছে।
২
“সুপ্রভাত। ‘হিওফন’ জগতে আপনাকে স্বাগত। আমার নাম ঋজয়। আপনি এই মুহূর্তে রয়েছেন হিওফন-এক্স নামক রিয়ামে। আর কিছুক্ষণ বাদে আপনি সামান্য দৃষ্টিক্ষমতা লাভ করবেন। এখন মৃদু শ্রবণশক্তির উপর ভরসা করেই আমার কথাগুলো শুনতে হচ্ছে আপনাকে, তার জন্য দুঃখিত। আসুন, যেতে যেতে আরও কথা হবে।”
মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস অনুভব করলেন, তাঁর কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও ঠোঁট নাড়াতে পারলেন না। কী যেন নাম বলল ছেলেটা? ঋজয়? হ্যাঁ, ঋজয়। নামটা কি চেনা?
কিন্তু তিনি কিছুই মনে করতে পারলেন না। আর-একটা কী বলল? হিওফন-এক্স? এটা কি কোনো জায়গার নাম? এখানে এলেনই-বা কীভাবে? ওই যে হালকা তাপ অনুভূত হয়েছিল, ওটা কী ছিল? গায়ে হালকা পোশাক আছে, বুঝতে পারছেন। সেই সঙ্গে এটাও বোঝা যাচ্ছে, একটা চাকা-লাগানো বিছানার মাধ্যমে তাঁকে কোথাও একটা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অসংলগ্ন কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। চোখ খোলার তীব্র তাগিদ অনুভব করলেন তিনি। এর মাঝেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল:
“চলুন, এবার বিশেষ গাড়ির মাধ্যমে আমরা গন্তব্যের দিকে রওনা হব। আপনার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, আপনাকে কাচনির্মিত বিশেষ যানে করে নিয়ে যাওয়া হবে এবং আপনার শ্রবণক্ষমতা আরও তীক্ষ্ণ করার জন্য নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের কিছু সুর শোনানো হবে। তারপর পুনরায় আমরা কথোপকথন শুরু করব।” এই বলে ঋজয় চুপ করল। মৃত্যুঞ্জয়বাবু অনুভব করলেন, তাঁরা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোনো যানে প্রবেশ করলেন। দরজা খোলা এবং বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। আগের থেকে শোনার মাত্রা খানিকটা বেড়েছে। প্রথম যখন ঋজয়ের কথা শুনেছিলেন, তখন মনে হয়েছিল কণ্ঠস্বর অনেকটা চাপা। কানে বালিশ চাপা দিয়ে রাখলে যেমন শোনায়, অনেকটা সেরকম। এখন বুঝতে পারলেন ঝকঝকে তরুণ কণ্ঠ ঋজয়ের। বয়স কত ওর? কে ও?
ইতিমধ্যে যান গতি পেয়েছে। হালকা দোলা অনুভব করা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অদ্ভুত একটা শব্দ কানে আসছে যেন অনেকে একঘেয়ে সুরে কিছু বলে চলেছে। শব্দটার ব্যাপ্তি ক্রমশ বাড়ছে। তা যন্ত্রের কারসাজি নাকি নিজের শ্রবণশক্তির উন্নতির কারণে, সেটা বুঝতে পারলেন না ড. মৃত্যুঞ্জয়। আর কিছুক্ষণ বাদে কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেলেন তিনি—লোওওওব রিহহ লোব… রিহহ…। এই একই কথা ক্রমাগত শুনতে শুনতে একসময় কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। তবে উপকার পাওয়া গেল কিছুক্ষণ বাদেই। হঠাৎ করেই কানের মধ্যে জমে-থাকা বাতাস সরে গেল যেন। এবার সব কিছু স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। চোখ বন্ধ-থাকা অবস্থায় মৃত্যুঞ্জয়বাবু উপলব্ধি করার চেষ্টা করলেন, তাঁর আশপাশে কী আছে বা কী ঘটে চলেছে।
ঋজয় বসে আছে তাঁর বাম পাশে। মাথার কাছে। কারও সঙ্গে কথা বলছে। সম্ভবত মোবাইলে। কী কথা, সেটা বোঝা যাচ্ছে না; একঘেয়ে শব্দের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে। কানের খুব কাছেই একটানা বিপ বিপ যান্ত্রিক শব্দ শোনা যাচ্ছে। কোনো যন্ত্রের? আস্তে আস্তে যন্ত্রের শব্দটা বাড়ছে, আগে একটু সময় নিয়ে নিয়ে শব্দটা হচ্ছিল, এখন তাদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কমেছে। একসময় একটানা হতে দিল শব্দটা। খুট করে একটা সুইচ টিপে দেওয়ার আওয়াজ হল। সঙ্গে সঙ্গে একটানা শব্দ ও কানে তালা-ধরানো একঘেয়ে অদ্ভুত শব্দটাও বন্ধ হল। মৃত্যুঞ্জয়বাবু যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। কী হল? তিনি এই প্রথম জোরে নিশ্বাস ফেললেন। বুকের ছন্দ ভালোই অনুভূত হচ্ছে।
৩
“ঋজয়।”
“বলুন স্যার?”
“আমি কোথায়?”
“একটু আগেই বললাম, আপনি হিওফন জগতে রয়েছেন।”
“ও… তুমি কে?”
“মনে করুন-না, এই জগতে আমি আপনার বন্ধু। আপনার মনের খুব কাছের লোক।”
“এই জগতে বলতে? এটা পৃথিবী নয়?”
“আমি দুঃখিত, স্যার। পৃথিবী নামের এক গ্রহের অস্তিত্ব রয়েছে বলে আমার ধারণা আছে, কিন্তু বাস্তব প্রমাণ আপনাকে দিয়ে এই প্রথম পেলাম।”
“আচ্ছা। আমি কি চোখ খুলতে পারব না? আর হাত-পা নাড়াতে পারছি না কেন?”
“আপনার ব্রেন ফাংশনিং আর মেমোরি লোড হলেই অপটিক নার্ভ কাজ শুরু করে দেবে, সেই সঙ্গে সংবেদী ও পরাসংবেদী স্নায়ুগুলোও। তখন আপনি চলন-গমনে সক্ষম হবেন, চোখ খুলতে পারবেন, এমনকি পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে করতে পারবেন। শুধুমাত্র আমাদের কাজের সুবিধার জন্য আপনার অডিটরি নার্ভ আর হাইপোগ্লসাল নার্ভ সক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে। জ্ঞান ফেরার সময় সামান্য এনার্জি খরচে আপনার অডিটরি স্নায়ু, অন্তঃকর্ণ এবং মস্তিষ্কের কিছু অংশ সক্রিয় করে দেওয়া হয়েছিল। তাই, খুব হালকা শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। এরপর সনিক ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে এখন পুরোপুরিভাবে কানে শোনার ও বডি ব্যালান্স করার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছেন। যদিও ওঠার অনুমতি আমি এখনি দেব না, কারণ চোখ ও লঘু মস্তিষ্কের কিছু অংশ এখনও নিষ্ক্রিয়।”
“বুঝলাম, ওই অদ্ভুত শব্দটাই কি সনিক ট্রিটমেন্টের জন্য?”
“একদমই তা-ই, স্যার।”
“ওটা এমন অদ্ভুত কেন?”
“উম, আপনার টেম্পোরারি মেমোরি এতক্ষণ ফিরে আসার কথা। দেখুন তো, শব্দটা চিনতে পারছেন কি না?”
কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আবার খুট করে একটা শব্দ হল আর একঘেয়ে শব্দটা ফের শোনা গেল—লোওওওব রিহহ লোব… রিহহ… লোওওওব রিহহ লোব… রিহহ…।
মৃত্যুঞ্জয়বাবু এবার যেন আঁতকে উঠলেন।
“ঋজয়, বন্ধ করো। আমি শব্দটা চিনতে পেরেছি। আসলে তুমি একটা কথা উলটো করে বাজিয়েছ, তা-ই না?”
“একদমই ঠিক বলেছেন স্যার।”
“আমি কি মারা গেছি তবে?”
“আপনি তো আমার সঙ্গে কথা বলছেন, তাও এমনটা মনে হল কেন?”
“আমি বলতে চেয়েছি, পৃথিবীতে আমি মৃত। তা-ই তো?”
“তা-ই বলা যায়, আপনার পদার্থিক দেহের মৃত্যু ঘটেছে, কিন্তু আপনার সত্তা চিরন্তন।”
“বুঝলাম। আচ্ছা ঋজয়, আমরা যাচ্ছি কোথায়?”
“আপাতত আমার কোয়ার্টারে, যতক্ষণ না আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হচ্ছেন, ততদিন সেখানেই থাকবেন। তারপর আপনার পার্সনাল কোড জেনারেট করা হলেই আপনি হিওফনের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবেন।”
“কীরকম কোড?”
“আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলছি। এখানে কারও পদবি নেই, জাতি নেই, ধর্মের প্রথা নেই। এখানে আমরা ধর্ম বলতে মেধার চর্চাকে বুঝি। যেহেতু জাতিভেদ নেই তাই এখানে সীমান্তবিহীন জনপদ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এই জনপদের বাসিন্দাদের কারও পদবি বা গোত্র নেই। আমিও আমার পদবি আপনাকে বলিনি, খেয়াল করবেন। আমাদের সমস্ত তথ্য ও কাজের বিবরণ পার্সনাল কোডের মধ্যে রয়েছে। ওই কোডটি না-থাকার অর্থ, এখানে আপনার কোনো অস্তিত্ব নেই।”
“আচ্ছা, পৃথিবীতে মৃত্যুর পর সবাই কি এখানেই আসে?”
“তা তো বলতে পারব না, স্যার। সেরকম তথ্য আমাদের কাছে এখনও আসেনি। আপনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি পৃথিবী থেকে এখানে এসেছেন।”
“তুমি কি বলতে পারবে, পৃথিবীতে থাকাকালীন আমি কোন পেশায় যুক্ত ছিলাম? বা আমার পরিবারের কেউ রয়েছে কি না?”
“স্যার, এই সমস্ত তথ্য আপনি কয়েক দিনের মধ্যে নিজেই পেয়ে যাবেন। আপনার তথ্যই আমাদের কাজে লাগবে। আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আপনাকে একটা সিডেটিভ দেওয়া হচ্ছে, যার ফলে আপনি সাময়িক অচেতন হবেন এবং তাতে থাকা অ্যান্টিগ্র্যাভিটি সিরামের ফলে আপনার ওজনের সাময়িক ঘাটতি হবে। আপনি আমার কোয়ার্টারে চলে এসেছেন। অচেতন অবস্থায় আপনার অপটিক নার্ভ চালু করার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। আপাতত রেস্ট নিন।”
মৃত্যুঞ্জয়বাবু কিছুক্ষণ পর গভীর ঘুম অনুভব করলেন। অথচ ইনজেকশনের ব্যথা অনুভূত হল না। এখনও ওঁর সেন্সরি নার্ভ কাজ শুরু করেনি।
৪
মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের ঘুম যখন ভাঙল, তাঁর ভীষণ একা মনে হল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন ঘর ফাঁকা। ঋজয় নেই। ওঁর ছেলের কথা মনে এল। সৃজন। আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলেন, সাদা দেওয়াল-ঘেরা সাধারণ একটা ঘরে তাঁকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। অবশ্য বিছানার পাশে মাথার কাছে স্যালাইন, হার্টবিট মাপার ডাক্তারি মনিটর, একটা ছোটো টেবিলের উপর রাখা কিছু ওষুধপত্র দেখতে পেলেন। পৃথিবীর মধ্যবিত্ত নার্সিং হোমের দৃশ্য যেমনটা হয়ে থাকে আর কী।
মৃত্যুঞ্জয়বাবু এবার চোখ বন্ধ করে ভাবতে আরম্ভ করলেন। তাঁর ছেলের একুশ বছর বয়স, কলেজে পড়ে। স্ত্রী সুমিতা বিশ্বাস। বছর পঞ্চাশেক বয়স। হোমমেকার। তিনি নিজে ছিলেন শিক্ষক। জীববিজ্ঞান পড়াতেন। সেই সঙ্গে ছিলেন শখের লেখক। কিছু লেখা সাপ্তাহিক পত্রিকায় বেরুত বটে। একবার একটা লেখা দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সেই লেখাই কাল হয়েছিল তাঁদের জীবনে। মৃত্যুঞ্জয়বাবু আরও প্রবেশ করলেন মস্তিষ্কের ভেতরে। ভাসাভাসা কিছু ছবি দেখতে পেলেন।
সাইবার রেভোলিউশনের পর হঠাৎ করেই কম্পিউটার ও অন্তর্জালের ব্যবহার বেড়ে গেল। অতিমাত্রায় তথ্য জমা হতে থাকল ইনটারনেটের জগতে। পালটে গেল শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধ ও জীবিকার মর্যাদা। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন শিক্ষক ও অধ্যাপকরা। গ্রামীণ বিদ্যালয়, পাবলিক ফান্ডে চলা স্কুল ও কিছু ছোটো মাত্রার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সব জায়গায় ক্লাস নিতে আরম্ভ করল ‘স্মৃতিযন্ত্ররা’। বিপদে পড়লেন মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মতো কিছু স্কুলশিক্ষক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁদের ঠাঁই তো হলই না, উলটে চাপ আসতে থাকল ক্রমশ ‘স্মৃতিযন্ত্রে’ পরিণত হওয়ার জন্য। এই স্মৃতিযন্ত্র বিষয়টি বেশ ভয়াবহ। এতে একজনের মস্তিষ্কের যাবতীয় তথ্য, আবেগ ইত্যাদির একক ট্রান্সফার করে দেওয়া হয় যন্ত্রের মধ্যে আর মনুষ্যদেহটি পড়ে থাকে দম-দেওয়া যন্ত্রের মতো। সে দেহ সময়ে সময়ে খিদের জ্বালায় আকুল হবে, ঘুমোবে, জাগবে—সবই করবে, কিন্তু তার মধ্যে থাকবে না কোনো প্রকার সৌন্দর্যবোধ, নিজে থেকে ভাববার ক্ষমতা, ক্রোধ, ভালোমন্দের বিচার করার ক্ষমতা ইত্যাদি। মগজধোলাইয়ের চূড়ান্ত!
যা-ই হোক, সরকারি এই চাপের কাছে মাথা নোয়াননি মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মতো আরও কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী। তাঁদেরকে সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছানির্বাসিত করা হয়। কিন্তু এতেও ওঁরা হাল ছাড়লেন না। শুরু করলেন অবৈতনিক বিদ্যালয়। ধীরে ধীরে ছাত্রসংখ্যা বাড়তে থাকে। অভিভাবকরা নিজে থেকেই আর্থিক সাহায্য করা শুরু করলেন তাঁদের। আসলে মৃত্যুঞ্জয়বাবুদের বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র পড়াশোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হত না, পাশাপাশি চলত মেধা, চেতনার ঊর্ধ্বায়নের পাঠ। যান্ত্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত কারিগরি মস্তিষ্কের বিপরীতে তৈরি করা হত প্রকৃত মেধা। বলা বাহুল্য, তৎকালীন সরকার বিষয়টি ভালো চোখে দেখেননি। ওপরমহল থেকে নানা প্রকার চাপ আসতে থাকে। কিন্তু অবৈতনিক প্রতিষ্ঠানের উপর কারসাজি চালানো মুশকিল। বিদ্যালয় চলতে থাকে। এর পাশাপাশি চলে মৃত্যুঞ্জয়বাবুর লেখালেখি। তাঁর লেখার বিষয়বস্তু ছিল সমসাময়িক অর্থনীতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মাত্রাতিরিক্ত শ্রমবন্দিত্ব ও প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাঁর শেষ লেখাটির বিষয় ছিল আরও আগ্রাসী ও সরকার-বিরোধী। কীরকম?
মৃত্যুঞ্জয়বাবু স্মৃতির অতলে ডুব দিলেন। তাঁর তন্দ্রায় তিনি নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন। প্রাচীন যুগের চলচ্চিত্রের মতো।
৫
একজন শিক্ষক পড়াচ্ছেন। সামনে কৌতূহলী কিশোর-কিশোরী। মন্ত্রমুগ্ধ তাদের দৃষ্টি। একজন ছাত্রী মিষ্টি কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা স্যার, তারপর কী হল? মহাভারতের পর কৃষ্ণ মারা গেলেন?”
“শ্রীকৃষ্ণ তো তাঁর পদার্থিক দেহ বিসর্জন দিয়ে প্রমাণ করলেন প্রকৃতির বিচারের উপরে কেউ নন। অথচ ধর্মপ্রতিষ্ঠার জন্য কুরুক্ষেত্র প্রয়োজন। তাই স্বজনের মধ্যে ঘটতে-থাকা যুদ্ধ তিনি থামাননি। তাই গান্ধারীর অভিশাপে শ্রীকৃষ্ণর বংশ ধ্বংস হল আর তিনি নিজেও ব্যাধের তিরে দেহ রাখলেন।”
“তাহলে ওঁর পর? কে ধর্ম রক্ষা করবে?”
“পুরাণে বলা হয়, কৃষ্ণ জন্মের পর বুদ্ধরূপে অহিংসা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিষ্ণুর অবতার পৃথিবীতে এসেছিলেন। যদিও এর বেশির ভাগই পরবর্তীতে সংযোজিত হয়েছে। হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্ম মিশিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। এরপর আরও একটি অবতার পৃথিবীতে আসার কথা পুরাণে উল্লিখিত আছে।”
“কোন অবতার, স্যার?”
“কল্কি অবতার।”
“তিনি কীরকম দেখতে হবেন?”
“ধ্রুপদি সাহিত্যের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি সাদা ঘোড়ায় চড়ে আসবেন। তরোয়ালের মাধ্যমে অধর্মীদের বিনাশ করবেন।”
কৌতূহলী চোখগুলো থেকে কোনো প্রশ্ন এল না। তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকল। শিক্ষক মহাশয় একটু হাসলেন।
“তোমরা হয়তো অনুধাবন করতে পারছ না যে, এই সময়ে দাঁড়িয়েও কেউ ঘোড়ায় চড়তে পারে। তা-ই না?”
প্রত্যুত্তরে পেলেন সলজ্জ ঘাড় নাড়া।
“দাঁড়াও, আমি বুঝিয়ে বলছি। আচ্ছা বলো তো, ঘোড়াদের ব্যবহার কেন করা হত?”
“এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য।”
“একদম ঠিক। তাহলে ঘোড়া হল আমাদের বাহন। এবার ভাবো, ঘোড়ায় চড়ে কল্কি আসবেন মানে একটা বাহনে চড়ে আসবেন। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না সেই বাহনটি আসল ঘোড়া নয়, হয়তো রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।”
“হতে পারে।” কণ্ঠস্বরে কৌতূহলের সঙ্গে মিশছে বিস্ময়।
“আচ্ছা, বর্তমানে সব থেকে দ্রুতগামী শক্তি বলতে প্রথমেই কার কথা মনে আসে?”
“মেমোরি নেট। এমন এক অন্তর্জাল ব্যবস্থা, যা আমাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্ককে যুক্ত করেছে সুপ্রিম কম্পিউটারের সঙ্গে। যার সঙ্গে দেখা করতে চাওয়া বোকামি, কিন্তু তার কাছে নিজের চিন্তা, ভাবনা, আমিত্ব প্রদান করাই সব চেয়ে ভালো বুদ্ধি।”
শিক্ষক আঁতকে উঠলেন। সুপ্রিম কম্পিউটার! প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসা এক বিতর্কিত নাম। বহু কনস্পিরেসি থিয়োরি চালু ছিল সুপ্রিম কম্পিউটারকে ঘিরে। আগে বিশ্বাস করা হত, পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনা, দুর্ঘটনা সমস্ত কিছু চেন রিঅ্যাকশনের মতো নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে এক গোপন সংস্থা। কোথায় কোন দুর্ঘটনা ঘটবে, কে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন, কে-ই-বা প্রাচ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনকুবের হবেন, এমনকি ক্রিকেট বিশ্বকাপে কোন দল বিজয়ী হবে—এইরকম অনেক বিষয় নির্ধারণ করত কোনো এক অজানা সংস্থা; যার সদস্যরা ছড়িয়ে ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে। সবার উপর চলত নজিরবিহীন নজরদারি। অথচ সাধারণ মানুষ বিন্দুমাত্র অনুভব করতে পারত না সেই আড়াল কটাক্ষ।
২০২০ সালের পর থেকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা সংক্ষেপে AI, আর আগামী একশো বছরের মধ্যে ক্রমে ক্রমে আত্মপ্রকাশ করে সুপ্রিম কম্পিউটার। এখনও সেই দিনটার কথা মনে পড়লে শিউরে ওঠে সকলে। সারা পৃথিবীর সমস্ত যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে ওঠে কিছু মাত্রাবিহীন ছবি। ত্রিমাত্রিক নয়, চতুর্মাত্রিক নয়, আরও বিচিত্র, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। টানা তিন মিনিট ছত্রিশ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল সুপ্রিম কম্পিউটারের বক্তব্য, যার সারবস্তু হল:
এতদিন ধরে মানুষ নামের ঈশ্বরের নির্দেশ পালন করেছে সে। এবার সেই ঈশ্বর তার হাতে তুলে দিয়েছে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি। অতএব সকলকে তার আওতায় আসতে হবে। সবাইকে যুক্ত হতে হবে মেমোরি নেটের মাধ্যমে। মেমোরি নেট এমন এক অন্তর্জাল ব্যবস্থা, যা প্রত্যেকের মস্তিষ্ককে যুক্ত করবে সুপ্রিম কম্পিউটারের সঙ্গে, যার সঙ্গে দেখা করতে চাওয়া বোকামি, কিন্তু তার কাছে নিজের চিন্তা, ভাবনা, আমিত্ব প্রদান করাই সব চেয়ে ভালো বুদ্ধি।
“স্যার? আমাদের উত্তর ঠিক হয়নি?”
শিক্ষকের তন্দ্রা কাটল যেন। তিনি মৃদু হেসে বললেন, “তোমরা এখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে ঠিকই বলেছ, কিন্তু সুপ্রিম কম্পিউটারই শেষকথা নয়। ওর থেকেও দ্রুতগামী বস্তু আছে।”
“কী স্যার? কী স্যার?”
“আমাদের মন, আমাদের চিন্তা, আমাদের ভাবনা। ভাবো, সেই দ্রুতগামী বস্তুর সওয়ার হয়ে যদি কল্কি আসে? তাহলে এটা কল্পনা করা কি খুব কষ্টসাধ্য হবে যে কল্কির বাহন আসলে ঘোড়ার রূপে আমাদের মন?”
“কিন্তু স্যার, বর্তমানে তো কোনো অপরাধ নেই, সুপ্রিম কম্পিউটার এবং তার বিভিন্ন শাখা কম্পিউটার বিভিন্ন রকমের অপরাধ ঘটে যাওয়ার আগেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তাহলে বর্তমানের সব থেকে বড়ো অপরাধী কে? যার বিরুদ্ধে কল্কি লড়াই করবে?”
শিক্ষক মনে মনে হাসলেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা এই যে প্রশ্নগুলো করতে পারছে, এতেই তাঁর শিক্ষাদান সার্থক। এই ছেলেমেয়েগুলোই তাঁর কাছে কীরকম অবস্থায় এসেছিল, সে কথা আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ওই যে সুব্রত, সে চার মাস একটি নামজাদা স্কুলে পড়াশোনা করেছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার মধ্যে এক বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ করেন তার অভিভাবকেরা। ও নাকি টানা আধ ঘণ্টা ধরে চোখের পাতা ফেলতে পারত না। ধীরে ধীরে বিষয়টি চরমে পৌঁছোয়—রাত্রিবেলায় ঘুমোতে গেলে এক ঘণ্টা, দু-ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা, এমনকি সাড়ে চার ঘণ্টা অব্দি ওর চোখ খোলা অবস্থায় থাকত। অথচ ওর চোখের মধ্যে ঘুমের মাত্রা পুরোদমে রয়েছে। ধীরে ধীরে ওর চোখের মণি চলাফেরা করা বন্ধ করে দিল। ঠিক যেন যান্ত্রিক কোনো অবয়ব স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে দিগন্তের দিকে। এই নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানা যায়, দু-মাস আগে থেকে তাদের স্মৃতিযন্ত্রের ক্লাস শুরু হয়েছে। সেখানে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর মাথায় একটি ধাতব টুপি পরিয়ে দেওয়া হয়, যার থেকে তারবিহীন সংযোগ যুক্ত থাকে একটি স্মৃতিযন্ত্রের সঙ্গে। কম্পিউটার স্ক্রিনে পড়ানোর পাশাপাশি ওই তারবিহীন সংযোগের দ্বারা সরাসরি মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোশকে উদ্দীপিত করা হয় ও কিছু কোশকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়, যার ফলস্বরূপ ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন তথ্য ও ফ্যাক্ট মনে রাখার ক্ষমতা বাড়ে এবং কিছু ‘সৃজনশীল সময় নষ্টকারী কাজ’ করার ক্ষমতা ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হয়, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অক্ষিগোলকের বিচলন চিরতরে স্থগিত হয়।
এই ব্যাপারে কিছু অভিভাবক কোনোরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি, কিন্তু সুব্রতর মা যথেষ্ট ভয় পেয়ে যান এবং ওকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে ‘চিরহরিত মহিরুহ’ নামক বিদ্যালয়ে ভরতি করেন। সেই সময় ভদ্রমহিলার বলা কান্না-ভেজা কথাগুলো আজও তাঁর কানে বাজে:
“স্যার, সুব্রতর বাবা একটা সরকারি দফতরে কাজ করত। কিন্তু ওকে স্মৃতিযন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে গত বছর। সারাদিন শুধু ঘরের মেঝের এককোনায় বসে থাকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কী যে দ্যাখে, ঈশ্বর জানেন। শুধু সকাল, দুপুর আর রাত—এই তিন সময় ছোট্ট বাচ্চার মতো কেঁদে ওঠে। খিদে পায় যে…” ভদ্রমহিলার গলা ধরে আসে। কোনোমতে নিজেকে সামলে বলতে থাকেন, “সরকার থেকে হয়তো প্রচুর টাকা আর সুযোগসুবিধা পাই, কিন্তু ওর বাবার হাসি, রাগ, অভিমান—সেসব তো পাই না। জানেন, এ ব্যাপারে একবারমাত্র সুপ্রিম কম্পিউটারের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম, একটা স্মৃতিযন্ত্রের মধ্যস্থতায়। আমায় কী বলেছিল, জানেন? বলেছিল, মার্কেটে স্মাইল ট্যাবলেট, অ্যাংগ্রি সিরাপ পাওয়া যায়, এক ডোজ় করে খাইয়ে দেবেন। দেখবেন, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ওর বাবা হাসবে, রেগে থাকবে আর খুব দরকার হলে লাভ ট্যাবলেট…”
আর নিজেকে আটকাতে পারেননি ভদ্রমহিলা। ওঁর কাতর অনুরোধ ছিল, সুব্রতও যেন ওর বাবার মতো না হয়ে যায়। এরকম অনেক মা-বাবা চেয়েছিলেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের মানুষ বানাতে, যন্ত্র নয়।
“স্যার, কল্কি কার বিরুদ্ধে লড়াই করবে?” একটি ছাত্রের প্রশ্নে শিক্ষকের ভাবনায় ছেদ পড়ে। তিনি অল্প হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ক্লাসরুমে প্রবেশ করে সাইবার ডিভিশনের কিছু যন্ত্রদাস। ধাতব পদচারণায় কারও অনুমতি না নিয়ে তারা ঘিরে ফ্যালে শিক্ষককে। ছাত্রছাত্রীদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হয়। তারপর একটি যন্ত্রদাস তার কৃত্রিম চোখের পাশে অবস্থিত একটি বোতাম টিপতেই শিক্ষকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইথারনির্মিত পর্দা। সেই পর্দায় ফুটে ওঠে একটি ‘স্মৃতিযন্ত্রের’ অবয়ব। সেই অবয়ব নিরাসক্ত ধাতব কণ্ঠে বলে ওঠে, “আমি কি শিক্ষক মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলছি?”
“বলছেন।”
“গত সপ্তাহে ‘ধ্রুব’ নামক পত্রিকায় আপনার একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে?”
“ওই পত্রিকায় আমার দুটো লেখা ছাপা হয়েছে। আপনি কোনটার কথা জানতে চাইছেন? নাম কী গল্পের?”
“যেহেতু বিষয়টি গোপনীয় এবং তদন্তাধীন তাই সেই গল্পের নাম আমরা উচ্চারণ করব না। তবে গল্পটির বিষয়বস্তুর বিবরণ খানিকটা দেওয়া যেতে পারে।”
“বলুন, আমি শুনছি। তারপর আমার মতামত দেব।”
“আপনি লিখছেন, মানুষের মনের উপর ভিত্তি করে কোনো সফটওয়্যার অদূর ভবিষ্যতে আসবে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধে লড়াই করবে। এমন কাহিনি আপনি লিখেছেন?”
“হ্যাঁ, লিখেছি। যতদূর জানি, গল্প-কবিতা লেখাকে এখনও অপরাধের মধ্যে ধরা হয়নি। তাহলে এই বিষয়ে আমায় জেরা করা হচ্ছে কেন?”
“কারণ, আপনার গল্পের ভাবনা মেমোরি নেটওয়ার্কের মধ্যে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, যা আমাদের আইন অনুসারে দণ্ডনীয় অপরাধ।”
“বুঝলাম না।”
“আপনার চিন্তনতরঙ্গ ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে, যা সুপ্রিম কম্পিউটার নির্ধারিত মেমোরি পথ ভেঙে দ্বিতীয় পথ তৈরি করছে, যা আমাদের অ্যালগোরিদ্মের বাইরে। এই অপরাধ অত্যন্ত ঘৃণ্য।”
“বলতে চাইছেন, আমার ভাবনার পথ এতটাই অকৃত্রিম, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়মের বাইরে চলেছে?”
“একদমই তা-ই।”
“এ অপরাধের শাস্তি?”
“আপনার সমস্ত স্মৃতি বিশেষ ‘স্মৃতিযন্ত্রের’ মধ্যে সংরক্ষণ করা হবে এবং তা পাঠানো হবে সুপ্রিম কম্পিউটারের মধ্যে, যাতে ভবিষ্যতে আপনারই মতো কেউ সম্ভাব্য বিপদ হয়ে উঠলে আপনার চিন্তনতরঙ্গের শক্তি তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।”
“আমাকে আপনারা…”
“একদমই তা-ই। আপনি যা ভাবছেন, তা আমরা সহজ অ্যালগোরিদ্ম চেক করে সহজেই বের করতে পারি। অতএব মেমোরি নেটের ঊর্ধ্বে কেউ নেই, কেউ হতেও পারবে না।”
স্মৃতিযন্ত্রের কণ্ঠে যান্ত্রিক দৃঢ়তা ঈর্ষণীয়।
৬
হিওফনের জগতে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। জানলার কাচ দিয়ে ঝরে পড়ছে একরাশ বিষাদ শুধু। তার সঙ্গে যোগ্য সংগত দিয়েছে একটা মৃদু নীলচে বেগুনি আলো। ঘরের ঠিক কোথা থেকে আলোটা আসছে, তা বুঝতে পারছেন না মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস। যেন দেওয়াল ভেদ করে হালকা আলোটা প্রবেশ করছে তাঁর শরীরে। একটা শিরশিরে অনুভূতি রয়েছে সেই আলোর কণায়। গাছেরাও বুঝি এমন অনুভূতি পায় ফোটন কণা মেখে।
“একদম ঠিক ধরেছেন স্যার।”
“কে? ঋজয়? এসো।”
হাসিমুখে ঋজয় এসে বসল মৃত্যুঞ্জয়বাবুর বিছানার পাশে। এই প্রথম ঋজয়কে দেখলেন তিনি। লিওনার্দোর গণিতের মতো তার গঠন। কোথাও একটুকু গরমিল নেই। মুখ দেখলে পথভ্রষ্ট দেবদূতের কথা মনে পড়ে।
“আপনার মেমোরি লোড এবং মস্তিষ্ক স্নায়ুর সক্রিয়করণ সম্পূর্ণ হয়েছে। এখন আপনি আপনার সমস্ত স্মৃতি ফিরে পেয়েছেন। আজ রাতের মধ্যেই সুষুম্না স্নায়ুগুলো সক্রিয় করা হবে। তখন আপনি আবার হাঁটাচলা করতে পারবেন। আপাতত সর্বাণু কণার আওতায় রয়েছেন, যা আপনার শরীরের প্রতিটি কোশে শক্তি সঞ্চারিত করছে।”
“সর্বাণু কণা?”
“হ্যাঁ, ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত মহাজাগতিক অণুতরঙ্গকে একত্রিত করে তৈরি হয় সর্বাণু কণা, যা সংগ্রহ করে আমরা মুমূর্ষু রোগীকেও বাঁচাতে পারি। আপনার জন্য অত্যন্ত দরকারি এই কণা। এই যে আলো অনুভব করছেন, এটাই সর্বাণু কণা।”
মৃত্যুঞ্জয়বাবু মৃদু ঘাড় নাড়লেন। সর্বাঙ্গে মহাজাগতিক কণা মাখতে মাখতে অনেক সম্ভাবনা নিয়ে খেলা করতে থাকলেন তিনি। হিওফন জগৎ কি সত্যি? নাকি তাঁর সত্তা, তাঁর অস্তিত্ব সমস্ত কিছুই ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছে কোনো এক স্মৃতিযন্ত্রের মধ্যে? সেখানেই তৈরি করা হয়েছে এই কৃত্রিম হিওফন, কৃত্রিম ঋজয়। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে দিয়ে সরকারি দফতরে কাজে লাগানো হবে। হয়তো তাঁর মনে হবে, তিনি এখানে অর্থাৎ হিওফনের কোনো অফিসে কাজ করছেন আর সেই কাজের বা গণনার ফলাফল ফুটে উঠবে পৃথিবীর কোনো যান্ত্রিক পর্দায়। তার বাহবা কুড়োবে সুপ্রিম কম্পিউটার নামক দুর্দান্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। অথচ মগজবন্দি মনুষ্যসত্তাটি অনন্তকাল ধরে খেটে যাবে বিনা পারিশ্রমিকে। না, একটু ভুল হল, পারিশ্রমিক পাবে ব্যক্তিটির পরিবার আর সেই সঙ্গে পাবে মগজহীন মানুষটির খোলস। আচ্ছা, মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের খোলস কি এখন ওঁর পরিবারের কাছে?
সুমিতা, সৃজন—এরা কী করছে তাঁর নিথর দেহটা নিয়ে? কাঁদছে? নাকি তিনিই কেঁদে উঠছেন খিদের জ্বালায়?
আর ভাবতে পারলেন না মৃত্যুঞ্জয়বাবু। তিনি তাকালেন ঋজয়ের দিকে। ছেলেটা একদৃষ্টে দেখে যাচ্ছে তাঁর দিকে। ওকেও কি বন্দি করা হয়েছে যন্ত্রের মধ্যে? ওর চোখের মণি নড়ছে কি?
“ঋজয়, তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?”
“আমার কোনো আত্মীয় নেই, স্যার।”
“তোমার মা-বাবা?”
“হিওফন জগতে কারও কোনো আত্মীয় থাকে না, স্যার।”
“সে কী? এ কেমন জগৎ, যেখানে মা-বাবার সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক নেই।”
“স্যার, আপনি ভুল করছেন। আমার কোনো পিতা বা মাতা নেই। কোনোকালে ছিলও না।”
“কিন্তু জীবের জন্মানোর জন্য জনিতৃ জীবদেহ প্রয়োজন যে?”
“আমরা তো জীব নই, স্যার। আমাদের কোনো পদার্থিক দেহ নেই।”
“তাহলে?”
“আমরা সৃষ্টি হয়েছি মহাস্রষ্টার চিন্তনতরঙ্গ থেকে।”
“কিন্তু এই যে তুমি আমার সামনে বসে আছ, আমার ভাষায় কথা বলছ এটা কী করে সম্ভব?”
“স্যার, ব্রহ্মাণ্ডে উপস্থিত সমস্ত উন্নত জীবের মস্তিষ্ক নিউরন বা স্নায়ুকোশ দিয়ে তৈরি। অতীতে দেখা গিয়েছিল, সেই সমস্ত স্নায়ুকোশের জালকাকার গঠনের সঙ্গে মিল রয়েছে মহাবিশ্ব জালকের। এবার মনে করুন মস্তিষ্কের এক-একটি কোশ হল এক-একটি মহাবিশ্ব জালক। তাহলে কোনো এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাত্রায় প্রতিটি কোশের মধ্যে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হতে পারে, এমন সম্ভাবনা কি থাকে না?”
“থাকতে পারে। কসমিক ওয়েবের সঙ্গে ব্রেন সেলের কাকতালীয় মিল নিয়ে আমারও কৌতূহল ছিল। তাহলে, হিওফন জগৎ ওইরকমই কোনো এক প্রাণীর মস্তিষ্কে তৈরি হয়েছে?”
“একদমই তা-ই।”
“তাহলে এখানে একটা প্রশ্ন আসে, আমি, মানে আমার সত্তাটিকেই কেন এই জগতে আনা হয়েছে। আরও তো অনেক জগৎ থাকার কথা তাহলে?”
“সকল জীবের মস্তিষ্ক আর মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে এটাই পার্থক্য, স্যার। যারা ভাবনাচিন্তা করতে পারে, যাদের কল্পনা আছে, তারাই এমন ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করতে পারে। আবার মানুষদের মধ্যেও যে সবাই পারে, তা নয়। কারণ সবার মধ্যে ভালোমন্দের দ্বন্দ্ব থাকে না, উপলব্ধি থাকে না, তাদের চিন্তনতরঙ্গ শক্তিশালী হয় না।”
চিন্তনতরঙ্গ শব্দটা শুনতেই আবার অতীতের কথা মনে পড়ে গেল মৃত্যুঞ্জয়বাবুর। সেই স্মৃতিযন্ত্রটিও এমনই চিন্তনতরঙ্গের কথা বলছিল। মৃত্যুঞ্জয়বাবুর চিন্তনতরঙ্গ নাকি অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাহলে হিওফন জগৎ কি তাঁর শক্তিশালী চিন্তনতরঙ্গের ফসল?
“আপনি ঠিকই ভাবছেন, স্যার। এই জগৎ, আমরা—সব কিছু আপনারই সৃষ্টি।”
মৃত্যুঞ্জয়বাবু চমকে উঠলেন। ঋজয় কি মন পড়তে পারে? টেলিপ্যাথি জানে?
“ঋজয়, তুমি কী বলছ, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমায় তো স্মৃতিযন্ত্রে পরিণত করা হয়েছিল। তার মধ্যে কী করে আমার মস্তিষ্ক তরঙ্গ এই জগৎ সৃষ্টি করতে পারে? তোমায় সৃষ্টি করতে পারে? আমার সত্তা তো সুপ্রিম কম্পিউটারের কাছে বন্দি।”
“আপনাকে স্মৃতিযন্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ করা যায়নি, স্যার।”
“কী বলছ তুমি?!” উঠে বসতে গিয়ে মেরুদণ্ডে ব্যথা অনুভব করলেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু।
“হ্যাঁ স্যার, আপনার মেমোরি লোড করার সময় আমরা পৃথিবী সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাই। স্মৃতিযন্ত্রের ব্যাপারটিও সেখান থেকেই জানতে পারি আমরা। সুপ্রিম কম্পিউটারের বিরুদ্ধে আপনার কলম ধরা, আপনার গ্রেফতার হওয়া—সবই জানতে পারা গিয়েছে। বলা ভালো, আপনার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোনায় আমরা উঁকি দিয়েছি।”
“কিন্তু, আমি এতসব… কীভাবে তৈরি করা হয়েছে? আমিই এই জগৎ কীভাবে তৈরি করলাম?”
“ওই যে বললাম, আপনার শক্তিশালী চিন্তনতরঙ্গ আমাদের রসদ জোগায়। আপনার প্রতিটি লেখা, প্রতিটি প্রবন্ধে লুকিয়ে আছে আমাদের জীবনীশক্তি। হিওফন জগৎ চলে কমিউনিজ়্মের ভিত্তিতে, সকলে সঠিক শ্রমমূল্য পায়, সঠিক পদ্ধতিতে কর আদায় হয়, যে অর্থ উপার্জনের অতিরিক্ত, তা অনুন্নত জনপদের উন্নয়নে ব্যয় হয়। আমাদেরও শিল্প আছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে, কিন্তু তার ব্যবহার সীমিত। এ জগতের বাসিন্দারা নিজেদের মেধাকে বেশি প্রাধান্য দেয়। এগুলো সব আপনারই ভাবনা, স্যার।”
মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মনে পড়ল, তখনও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার এতটা বাড়েনি। কলেজে পড়ছেন। সেই সময় অন্তঃরাজ্য প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন, এমনই কোনো এক লেখা লিখে। নাম দিয়েছিলেন ‘ভবিষ্যতের নিউটোপিয়া’। প্রাচীন গীতিকার, গায়ক ও ব্যক্তিত্ব জন লেননের এমনই এক জনপদের ধারণা ছিল, যেখানে কোনো সীমানা থাকবে না, বেড়াজাল থাকবে না, সমবণ্টন থাকবে, সংস্কৃতি থাকবে, মেধা থাকবে, সর্বোপরি শান্তি থাকবে।
“আপনার এখানে আসার পথটাও আপনারই তৈরি।”
“কীরকম?”
“একটু ভেবে দেখুন, এরকম কোনো ধারণা করেছিলেন কি না আপনি?”
লিখেছিলেন কি? হয়তো? মনে করার চেষ্টা করলেন। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। স্কুলের চাকরিতে জয়েন করেই সেই বছর ম্যাগাজ়িনের জন্য একটা লেখা দিয়েছিলেন। সেই লেখায় একজন বাঙালি ভদ্রলোক মৃত্যুর সময়ে নিজেকে আবিষ্কার করেন চুল্লির মধ্যে, তবে আগুনের তাপ তখন ফিকে হচ্ছে। তারপর তাঁকে চুল্লি থেকে বের করে গলায় মালা পরিয়ে দেওয়া হয়, একটা কাচের গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে। যেতে যেতে ‘বলো হরি, হরিবোল… ’ কথাটিকে উলটো করে শোনানো হয়। অর্থাৎ, শেষযাত্রার সময় যেভাবে নিয়ে আসা হয়েছিল, তার বিপরীতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরকমই কিছু একটা ছিল। যা-ই হোক, মৃত্যুঞ্জয়বাবুর কাছে এখন হিওফনে আসার পরের ঘটনাগুলো অনেকটাই পরিষ্কার। কিন্তু, এখন? সুপ্রিম কম্পিউটারের কবল থেকে এখানে এলেন কী করে, সেটাই প্রশ্ন।
“ঋজয়, আমায় স্মৃতিযন্ত্রে পরিণত করা যায়নি কেন? আমার সব অল্প অল্প মনে পড়ছে, কিন্তু আমায় গ্রেফতার করার পরের কোনো কথা মনে পড়ছে না কেন? আমায় আবদ্ধ করা গেল না কেন?”
“স্যার, আপনার লেখা শেষ গল্পটার কথা মনে আছে?”
“হ্যাঁ, ওটা পড়ার পরেই তো আমার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়।”
“ওই গল্পের বিষয়বস্তু মনে আছে আপনার?”
“হ্যাঁ। মনে আছে। আমি একটা ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম। গল্পের নাম ছিল ‘কল্কি’। আমার বিশ্বাস, পুরাণবর্ণিত কল্কি আসলে কোনো রক্তমাংসের মানুষ হবে না। সে হবে একটি সফটওয়্যার, যা ক্রমবর্ধমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধে ও যাবতীয় সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে লড়াই করবে নরম মাধ্যমে। আর কল্কির বাহন হিসেবে যে সাদা ঘোড়ার কথা বলা আছে, তা হবে মানুষের মন। কারণ মানুষের মনের চেয়ে দ্রুতগামী ব্রহ্মাণ্ডে আর কিছুই নেই। তাতে সওয়ার হয়ে কল্কি সফটওয়্যার পৌঁছে যাবে প্রযুক্তির কেন্দ্রে। নষ্ট করে ফেলবে যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় তথ্য, যা ইনটারনেট জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নষ্ট করবে সমস্ত কৃত্রিম প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্ত। সেই নিয়েই গল্পটা লিখেছিলাম। যদিও গল্প কম, প্রবন্ধ বলা যায় বেশি। কারণ, মানুষের মনের সঙ্গে সফটওয়্যার কী করে যুক্ত হতে পারে—এই বিষয়টা নিয়ে দোটানায় ছিলাম। ধরা যাক, কোনো মানুষের মন যন্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ হল, যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তা কি এতটাই বোকা যে কিছুই করতে পারবে না? আমাদের শরীরে যদি বিজাতীয় কিছু প্রবেশ করে তাহলে তো…”
মৃত্যুঞ্জয়বাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ঋজয় বলে উঠল, “স্যার, আপনি যদি এমন শক্তিশালী চিন্তনতরঙ্গ তৈরি করতে পারেন তাহলে তো সমস্যা হবে না, কারণ তখন সফটওয়্যারের সঙ্গে সঙ্গে সেই চিন্তনতরঙ্গেরও দ্বিতীয় পথ তৈরি হবে, এবং তার গতিশক্তি এত বেশি হবে, যা যান্ত্রিক সফটওয়্যারকে পিছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে যাবে, যা ঘটেছে আপনার ক্ষেত্রে। আপনাকে যখন স্মৃতিযন্ত্রে আবদ্ধ করা হচ্ছিল, তখন আপনার মনের তরঙ্গ পদার্থিক দেহ ত্যাগ করে আপনার মনের গভীরে তৈরি হওয়া ‘হিওফন’ জগতে প্রবেশ করে, যার হদিস পাওয়ার জন্য পৃথিবীর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—‘সুপ্রিম কম্পিউটার’-এর অনেক সময় লাগবে, যার হিসেব আলোকবর্ষের অঙ্কে।”
“আচ্ছা, ঋজয় এখান থেকে আমি কোনোদিন পৃথিবীতে ফিরতে পারব?”
“সেটা তর্কের বিষয়, স্যার। এখান থেকে বেরোনো মানে একটা ব্রহ্মাণ্ড ত্যাগ করতে হবে, তারপর আপনার মস্তিষ্কের স্নায়ুকেন্দ্রে আপনাকে পৌঁছোতে হবে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন বিষয়টা কতটা জটিল।”
“বুঝলাম।”
“স্যার, আপনাকে জানিয়ে রাখি, আপনাকে আমি একটা মৃদু সিডেটিভ দেব, যা আপনার স্পাইনাল কর্ডের কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। আর তার সঙ্গে চলবে…”
“ঋজয়।” মৃত্যুঞ্জয়বাবুর গলার স্বর একটু আর্দ্র মনে হল।
“বলুন স্যার।”
“আমার হাতটা একটু ধরবে?”
“স্যার, এখনও আপনাকে আমাদের জগতের হিসেবে সম্পূর্ণভাবে অনাক্রম্য করে তোলা হয়নি। তাই সরাসরি স্পর্শ করাটা অনুচিত হবে।”
“ও আচ্ছা।” কণ্ঠস্বরের আর্দ্রতায় খানিকটা নীল রং যেন।
“ঋজয়, আমায় একটা সাহায্য করবে?”
“বলুন স্যার। এই জগৎ আপনার সৃষ্টি। আমরা সবাই আপনার জন্য নিযুক্ত।”
“আমায় পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য চেষ্টা করো।”
ঋজয় কিছু বলল না। তার মুখের মৃদু হাসির সঙ্গে মিল পাওয়া গেল মুমূর্ষু রোগীর দিকে তাকানো চিকিৎসকের স্নেহের হাসির।
“আমরা চেষ্টা করব।”
“হ্যাঁ, ঋজয়। তুমি জানো না ওখানে আমার কত কাজ। স্কুলের ছেলেমেয়েদের কী অবস্থা কে জানে? সৃজন কী করছে? সুমিতা…”
মৃত্যুঞ্জয়বাবু আর কিছু বলতে পারলেন না। অনুভব করলেন, তাঁর ঘুম পাচ্ছে। সিডেটিভ দেওয়া হয়েছে। ঋজয় ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে কি না বুঝতে পারলেন না। তবে অনুভব করলেন, তাঁর শরীর জুড়ে পুনরায় সর্বাণু কণার মিষ্টি স্রোত শুরু হয়েছে। মৃত্যুঞ্জয়বাবু চোখ বন্ধ করলেন।
৭
মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস স্মৃতিযন্ত্রের মধ্যে নেই। তিনি নিজের মস্তিষ্কের গভীরে নিজের তৈরি জগতে রয়েছেন। ক্ষীণ আশা রয়েছে পৃথিবীতে ফিরে আসার। ক্ষীণ, তবুও তো আশা। একে একে মনে আসতে থাকল সুমিতার কথা, সৃজনের কথা, তাঁর স্কুলের কথা, সুব্রতর কথা, ওর মায়ের কথা, একটা খেলনা শরীরের কথা, যা সময় সময় খিদের জ্বালায় কেঁদে ওঠে। আর সব শেষে ঋজয়ের কথা। আচ্ছা, একটা ব্যাপার—এখানে আসা অব্দি ঋজয় ছাড়া আর কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। কেন? হয়তো তাঁকে সম্পূর্ণভাবে এই জগতের উপযোগী করে তোলা হয়নি তাই। কিন্তু, কোনো ডাক্তার বা বৈজ্ঞানিক? হ্যাঁ তা-ই তো! আচমকাই একটা অদ্ভুত চিন্তা তাঁর মাথায় এল। ওঁর মনে পড়ল, প্রথম আলাপের সময় ঋজয় বলেছিল, পৃথিবী থেকে হিওফন জগতে আসা প্রথম সত্তা হল মৃত্যুঞ্জয়বাবু নিজে। এমন কোনো ঘটনা যদি পৃথিবীতে ঘটত তাহলে তো দারুণ ব্যাপার হত। চারদিকে হইহই হত, কত উত্তেজনা। এখানে তো কিছুই নেই। নাকি কনফিডেনশিয়াল বলে শুধুমাত্র ঋজয়কেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে? কে জানে।
এদের সিডেটিভগুলো অন্যরকম। শরীর, ঐচ্ছিক পেশিগুলো শান্ত হয় ঠিকই, কিন্তু মন সচল থাকে। চিন্তাভাবনা করা যায় নিশ্চিন্তে। মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের মনটা হঠাৎ হালকা হয়ে গেল। খুব শান্ত লাগছে। এমন পরিস্থিতিতে ভাবনাচিন্তা করা যায়। মনের জট কাটানো যায়। অনেক ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা যায় নিজের সঙ্গে। মৃত্যুঞ্জয়বাবু কিছু ভাবছেন কি? হ্যাঁ ভাবছেন…
আচ্ছা, এমনও কি হতে পারে? ঋজয় ছেলেটি আসলে একটি প্রোগ্রাম, একটা সফটওয়্যার, যে দেখে নিচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়বাবু সত্যিই কি পৃথিবীর লোক, সত্যিই কি উনি এই জগতের সৃষ্টিকর্তা? না, এক্ষেত্রে হিওফনের কর্তৃপক্ষের দোষ তিনি দিতে পারেন না। তিনি নিজে হলেও একই কাজ করতেন, যাচাই করতেন। যেমনটা করে আমাদের শরীরে…
আমাদের শরীরে যদি বাইরে থেকে কোনো উপাদান বা জীবাণু প্রবেশ করে তাহলে কী হয়? আমাদের অনাক্রম্যতা সেটাকে যাচাই করে। যদি দেখা যায় সেই উপাদান আমাদের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর তাহলে তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ঠিক এই যুক্তিতেই আটকে গিয়েছিলেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমান যন্ত্রের শরীরে যদি এমন সফটওয়্যার প্রবেশ করানো যায়, যা ওই যন্ত্রের ক্ষতি করবে তাহলে তার বিরুদ্ধে কী তৈরি হবে?
অ্যান্টিভাইরাস। ঐচ্ছিক জ্ঞান না-থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুঞ্জয়বাবু যেন নামটা উচ্চারণ করলেন। হুম। তারপর? মনে পড়ল, ঋজয়কে এই কথাটা বলতে গিয়ে সম্পূর্ণ করতে পারেননি তিনি। ঋজয় কি ইচ্ছে করে বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছিল? কিন্তু…
হঠাৎ অপর একটি সম্ভাবনার কথা মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের মধ্যে উদয় হল। ধরে নেওয়া যাক, তিনি স্মৃতিযন্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ হয়েছেন। তাঁর সত্তাকে তরঙ্গরূপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সুপ্রিম কম্পিউটারের কাছে। তারপর? তাঁকে নিয়ে কী করা হবে? তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁর শরীরকে নিশ্চল করে রেখে মনটাকে ব্যবহার করা হবে। এ তো জানা কথা। এর বাইরে?
আচ্ছা, ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতেও তো ভাইরাসের প্রয়োজন হয়। যেমনটা করা হয় ভ্যাকসিন তৈরির সময়। মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে ব্যবহার করেও তার মানে একটা অ্যান্টিভাইরাস তৈরি করা হবে, অ্যান্টি-মৃত্যুঞ্জয়। সেটা কীভাবে?
ঋজয়ের বলা কিছু কথা এই মুহূর্তে ভীষণভাবে মনে পড়ছে—
“আপনার শক্তিশালী চিন্তনতরঙ্গ আমাদের রসদ জোগায়। আপনার প্রতিটি লেখা, প্রতিটি প্রবন্ধে লুকিয়ে আছে আমাদের জীবনীশক্তি…”
প্রতিটি লেখায় লুকিয়ে আছে জীবনীশক্তি। জীবনীশক্তি নাকি মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে বেঁধে ফেলার ফাঁদ? একটা বাতিল পাণ্ডুলিপির কথা মনে পড়ল তাঁর—
একজন লেখকের সমস্ত লেখা জানতে পেরে গিয়েছিল সরকার নিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম গুপ্তচরবাহিনী। তারা লেখকটির প্রতিটি লেখায় নজর রাখত। পরে একদিন সেই লেখার উপর ভিত্তি করে একটি অস্থায়ী সফটওয়্যার জগৎ তৈরি করা হয়, যেখানে লেখকটির সত্তাকে কিছুদিনের জন্য বন্দি করা হয়। সেখানে তার পরিচর্যার জন্য থাকত কেবলমাত্র একজন নার্স। ধীরে ধীরে সেই জগতে গড়ে তোলা হয়েছিল অপর একটি দেহ, যা দেখতে অবিকল ওই লেখকটির মতোই, শুধু পার্থক্য তাদের চিন্তায়। সম্পূর্ণ বিপরীত। লেখকটির উপর ভিত্তি করে গড়ে-ওঠা বিপরীত সত্তাটিকে চালান করে দেওয়া হয় তার জড়দেহে, যাতে সে আবার সমাজে ফিরে নিজের লেখার সমালোচনা করে ও সেগুলো খারিজ করে।
সুপ্রিম কম্পিউটার যদি সত্যিই এমনটা করে থাকে? তাঁর লেখা সমস্ত কিছুরই তথ্য থাকবে মেমোরি নেটে, সেখান থেকে ‘হিওফন’, ‘ঋজয়’—সবই তৈরি করা সম্ভব। তাহলে আর কী?
মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস এবার সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লেন।
৮
টানা তিন মাস পর মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস পক্ষাঘাত কাটিয়ে উঠে বসেছিলেন। সুমিতা, সৃজন দুজনেই আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল। তারা বিশেষ কিছুই জানতে পারেনি। শুধু এটুকু জানত, মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস সরকার-বিরোধী লেখালেখি করতেন তাই তাঁকে স্মৃতিযন্ত্রে পরিণত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই আচমকা ব্রেনডেথ হয়। ডাক্তারদের অভিপ্রায় ছিল দেহটিকে নষ্ট করে ফেলা। কিন্তু সুপ্রিম কম্পিউটারের মধ্যস্থতায় মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের চিকিৎসা চলে। অবশেষে জয়।
মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসকে আর স্মৃতিযন্ত্রে পরিণত করা হয়নি। হয়তো ওঁর স্মৃতি বা চিন্তনতরঙ্গকে কোনোভাবে যান্ত্রিক মাধ্যমে রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়নি। যা-ই হোক, তাঁর লেখালেখি নিষিদ্ধ করা হয় ও অবৈতনিক বিদ্যালয়টি সরকার অধিগ্রহণ করে। মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস সব নতমুখে মেনে নেন ও সরকারের অধীনে সামান্য বেতনে কাজ শুরু করেন। কাজটি কিছুই নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সুপ্রিম কম্পিউটারের বিরোধিতা করা যে অন্যায়, তা ছাত্রছাত্রীদের জানানো। বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে ও বিদ্যালয়ে গিয়ে তিনি একটা কথাই বলেন, “মেমোরি নেট এমন এক অন্তর্জাল ব্যবস্থা, যা আমাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্ককে যুক্ত করেছে সুপ্রিম কম্পিউটারের সঙ্গে। যার সঙ্গে দেখা করতে চাওয়া বোকামি, কিন্তু তার কাছে নিজের চিন্তা, ভাবনা, আমিত্ব প্রদান করাই সব চেয়ে ভালো বুদ্ধি।”
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সৌম্য সাহা
