বিধাতার বীজতলা
লেখক: অঙ্কিতা
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ওওঁওঁমমহ্মহ্মঅঁঅঁঅ…
বিকট ধ্বনিটা বদ্ধ করিডোরে তরঙ্গ তুলে পাক খাচ্ছিল। করিডোরের ধাতব মেঝেতে পড়ে থাকা অজস্র মৃতদেহের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা একটা দেহ একবার কেঁপে উঠল। দু-হাতে সে চেপে রেখেছে কান, যাতে শুনতে না হয়। তার বন্ধ চোখের পাতা কাঁপছিল তির তির করে, যাতে কিছু দেখতে না হয়। অসহ্য একটা শ্বাসরোধকারী গন্ধ ভাসছে বাতাসে। এক আঠালো গন্ধ! সে দম আটকে মৃতদেহগুলোর মাঝে শরীর চেপে শুয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরে বাতাস হালকা হয়ে এল। বিকট আওয়াজটাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। হাঁসফাঁস করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল সে। এই নিয়ে কতবার যে সে একই জায়গায় ফিরে এল, তার ইয়ত্তা নেই। এই করিডোরেই ওই ব্যাপারটা আছে। তাকে এখান থেকে সরে যেতে হবে। কিন্তু সরে যাবে কোথায়? প্রত্যেকটা করিডোর একইরকম দেখতে লাগে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না একই নম্বরের করিডোরে সে কেন বার বার ফিরে চলে আসছে। সে চেষ্টা করেছে প্রতিবারে ডান দিকে বাঁক নিতে, না কাজ হয়নি। প্রতিবার বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে, নাহ্। প্রতি তৃতীয়বার ডান দিকে, প্রতি দ্বিতীয় বার বাঁ দিকে… না … না… সে খালি একই জায়গায় চলে আসছে… কী যেন সমস্যা… কোথায় যেন সমস্যা…
ওওঁওঁমমহ্মহ্মঅঁঅঁঅ…
সে স্পষ্টত কেঁপে উঠল। চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল। এরকম অমানবিক বিকট আর্তনাদ সে জীবনে কখনও শোনেনি। খানিকদূর থেকেই ধ্বনিটা ভেসে এল। সেই ব্যাপারটা ফিরে আসছে ডান দিকের করিডোর ধরে। সে টের পাচ্ছে… সঙ্গে বিশ্রী একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। ধাতব মেঝের উপর দিয়ে চামড়া ঘষটানোর শব্দ! কী যেন একটা টেনে নিয়ে আসছে সেই ব্যাপারটা। সে জানে কী টেনে আনছে। তাকে পালাতে হবে। কোনোরকমে সে দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। সে আর সেই ব্যাপারটার মুখোমুখি হতে চায় না। সে জানে মুখোমুখি হলে কী হবে। এর আগে কতবার ঘটেছে ওই একই ঘটনা, সে গুণে উঠতে পারছে না আর…
ডান দিকের করিডোর থেকে আওয়াজটা এগিয়ে আসছে, বাঁ দিক ধরে পালাবে সে। কিছুতেই সে মুখোমুখি হবে না, হলেই আবার … আবার…
সে দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে বাঁ দিকের দ্বিতীয় করিডোরটা ধরল। করিডোরের মধ্যে নিজেকে পুরোপুরি ঢোকানোর আগেই দেখতে পেল সে। আতঙ্কে শরীরের প্রতিটা মাংসপেশি অসাড় হয়ে গেল তার। সেই ব্যাপারটা এই করিডোরেই অপেক্ষা করছিল তার জন্যে। তাহলে কীভাবে ওই অন্য করিডোরের মধ্যে থেকে আওয়াজটা এল?
আকার প্রকারহীন একটা ধোঁয়ার মেঘ করিডোর জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন তারই অপেক্ষায়। মেঘটার হাতে… নাকি শুঁড়… ওই শুঁড়ের মুঠোয় একটা ছেঁড়া পা। পা-টা আলাদা হয়ে গেছে শরীর থেকে। চামড়ার একাংশ এখনও ওই পায়ের সঙ্গে আটকে রেখেছে লালচে দেহটাকে। সে চেনে ওই পায়ের মালিককে। মেঘের মুঠোয় ধরে রাখা ওই ছেঁড়া পায়ের সঙ্গে আটকে থাকা দেহাংশ তার খুব চেনা। এখনও কি প্রাণ আছে মানুষটার শরীরে! ক্ষীণ গোঙানি ধাক্কা খাচ্ছে করিডোরের ধাতব দেওয়ালে।
মৃতপ্রায় দেহটাকে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে আসছে সেই ধোঁয়ার মেঘ। সে এক পা এক পা করে পিছোতে শুরু করেছে। সে দেখতে চায় না এরপরের ঘটনাটা, সে জানে কী ঘটতে চলছে। ছেঁড়া পা-টা টেনে তুলে ধরল মেঘের মতো অবয়বহীন ব্যাপারটা… যেন তাকে দেখাতে চাইছে জিতে নেওয়া ট্রফি… টানের চোটে বিশাল দেহটাও মেঝে ছেড়ে খানিক উঠে পড়ল বাতাসে। ছটফট করে উঠল। কেন ওই মেঘটা তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে এইসব করছে?
সে অনুভব করল তার পিছনের করিডোরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। তার পিঠ ঠেকে গেছে ধাতবদ্বারে। সে আটকা পড়ে গেছে করিডোরে। তাকে দেখতেই হবে, আবারও… আবারও… অবয়বহীন মেঘের গায়ে তৈরি হয়েছে অজস্র ফোঁড়ার মতো মেঘের বুদ্বুদ… জিনিসগুলো উল্লাসে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে… ছড়িয়ে পড়ছে মানুষটার দেহে… একটু একটু করে মানুষের দেহ থেকে চামড়া খুলে যাচ্ছে…
মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে… সে নাকি মানুষটা!!! কেন সে সব শুনতে পাচ্ছে? কেন সে সব দেখতে পাচ্ছে? কেন সে অনুভব করতে পারছে সামনের মানুষটার যন্ত্রণা… এ কি বিড়ম্বনা!
তার চোখের সামনেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মানুষটার চামড়াটা সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে নেওয়া হল। রক্তমাংসের দলাটা ধপ করে পড়ে গেল করিডোরে। তখনও মানুষটার পেশিগুলো কাঁপছে তির তির করে… এই নিয়ে কতবার দেখছে সে এই দৃশ্য! কতবার দেখল সে এই মানুষটার মৃত্যু!
বিশাল মেঘটা আরও বিশালকায় হয়ে করিডোরটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে… গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্ফোটকের মতো মেঘের দল… স্ফোটকগুলো আক্রমণ করেছে সেই চামড়া ছাড়ানো দেহটিকে… রক্তমাংস শুষে নিচ্ছে…
এইবার ঘটবে ব্যাপারটা, দু-হাতে কী যেন একটা চেপে ধরতে চাইল সে।
তীব্র ভয়ংকর একটা ধ্বনি উঠল করিডোর জুড়ে।
ওওঁওঁমমহ্মহ্মঅঁঅঁঅ…
***
আঁআঁআঁআঁ… চোখ খুলেও তাশা নিজের চিৎকারটা থামাতে পারছিল না। যেন সৃষ্টির প্রথম লগ্ন থেকে তার নাভিকেন্দ্র থেকে এইরকমই নাদব্রহ্ম তৈরি হয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ পরে প্রথম ধাক্কাটা সয়ে যেতে তাশা বুঝল সে মোটেও চিৎকার করছে না, কারণ তার মুখের মধ্যে দিয়ে শরীরে ঢোকানো একটা মোটা নল। সেই নলের চারপাশ দিয়ে চাপা একটা বুঁ বুঁ কান্নার মতো শব্দ বেরিয়ে আসছে। ইন্দ্রিয়গুলোর গ্রহণক্ষমতা আরেকটু পরিষ্কার হতেই সে বুঝল জলীয় এক তরলের মধ্যে সে ডুবে আছে, অথবা ভাসছে।
প্রতিক্রিয়াবশত ছটফটিয়ে উঠল সে। শোয়া অবস্থা থেকে প্রায় ছিটকে উঠে বসল তাশা। সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে টান পড়ল। অসংখ্য নল তাশার শরীরের বিভিন্ন অংশে ঢোকান ছিল। এখন সেগুলো একে একে খুলে যাচ্ছে নিজের থেকেই। বিহ্বল হয়ে সে নিজেকে ছাড়াতে চাইল নালিকাজাল থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে যেতেই তাশার মুখের ভিতরে ঢোকানো নলটায় টান পড়ল। বুকের ভিতরে একটা খিঁচ ধরল। তাশা ধীরে ধীরে নলটা দু-হাতে চেপে ধরে বার করতে শুরু করল। শরীরের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করতে করতে নলটা বেরিয়ে আসছিল ধীরে ধীরে। অস্বস্তির থেকেও আতংকটা যেন অনেক বেশি। এক সময় নলটাকে পুরো বার করে ফেলতে পারল তাশা।
এতক্ষণে তাশা বুঝল সে একটা হিমযন্ত্রের মধ্যে শুয়ে আছে। অদ্ভুত-দর্শন হিমযন্ত্র! হিমঘুমে ডুবে ছিল তাশা! ঘুম… আহ্, কী ছিল ওটা! কী ভয়ংকর। স্বপ্নটার কথা মনে পড়তেই তাশার মনে হল হৃৎপিণ্ডটা এখুনি যেন থেমে যাবে। কোনোমতে হিমযন্ত্রের একপাশ ধরে নিজেকে সামলাল সে। স্বপ্নের মধ্যেই তাশার শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছিল। এই যন্ত্রটা নিজেই অবস্থা বুঝে তাশাকে জাগিয়ে দিয়েছে। কি ভাগ্যিস! নয়তো তাশা ঘুমের মধ্যে ভয়েই হার্টফেল করত।
হিমযন্ত্রটা থেকে নামতে গিয়েই তাশা বুঝল পায়ে একটুও জোর নেই। অনেকটা বাথটাবের মতো জিনিসটা। বাইরে এক পা ঝুলিয়ে হিমযন্ত্রের সান্দ্র তরলের মাঝেই বসে রইল তাশা। সারা শরীর অলস, অবশ! এতটাই ভয় পেয়েছে সে! নাকি হিমঘুমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এটা! অথবা দুটোই… স্বপ্নটা অতীব বিশ্রী… এ কীরকম অদ্ভুত ধরনের স্বপ্ন! ওটা কী আদৌ স্বপ্ন নাকি ওটা তাশার স্মৃতি! স্বপ্নটার কথা মনে পড়তেই তাশার গা গুলিয়ে উঠল।খানিকটা জল উঠে এল খাদ্যনালী বেয়ে। সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। বাইরের মেঝেতে হড়হড় করে বমি করে দিল। পেট থেকে উঠে এল তরল জলীয় অংশ।
জলীয় অংশটা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত অনুভূতি জমাট বেঁধে গেল। তার পায়ের তলার মেঝেটা ঠিক যেন স্বাভাবিক ধাতব মেঝে নয়। কেমন যেন স্ফটিক স্বচ্ছ অথচ তার মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে শিরা-উপশিরার মতো অসংখ্য জালিকা। স্ফটিকের দেওয়াল ভেদ করে দৃষ্টি যায় না, অথচ মনে হয় স্ফটিকগুলো বুঝি স্বচ্ছ। ছোট্ট একটা ঘর। এটা যেন ঠিক তাশার হিমঘুমের জন্যেই তৈরি করা হয়েছে। এরকম ঘর তাশা আগে কখনও দেখেনি। না! ভুল, দেখেছে তাশা এরকম ঘর…
তার মনে পড়ল স্বপ্নটার কথা… অথবা স্মৃতি… প্রতিবার, প্রতিবার সে ছিটকে বেরোয় একই হিমযন্ত্র থেকে। প্রতিবারই একইভাবে তার গা গুলিয়ে ওঠে আর… আর… কিছুতেই তাশা মাথা তুলতে পারে না। আবারও সে স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, এখন মাথা তুললেই সে দেখবে এই স্ফটিকঘরের একটা দেওয়াল খুলে যাচ্ছে আর সেই মানুষটা এগিয়ে আসছে তার দিকে… মুখে হাসি, কিন্তু চোখে কোনো প্রাণ নেই… কী অদ্ভুত সেই মানুষ! … মানুষ নাকি অন্য কিছু! না-মানুষ! অতিমানুষ! পরামানুষ! শুধু তো সে নয়, বাকিরাও… অদ্ভুত… ভয়ংকর… ভয়াল সব মানুষের মতো জীব… তারপর, তারপর আসবে সেই ব্যাপারটা… মেঘের মতো স্ফোটক অথবা স্ফোটকের মতো মেঘ…সেটাকে দেখেই সবাই ছুটে পালাচ্ছে… না-মানুষটা তাশাকে নিয়ে পালাচ্ছে… সবাই পালাচ্ছে… আবারও সেই করিডোর ভর্তি মৃতদেহের ভিড়ে ইঁদুর বেড়ালের লুকোচুরি খেলা… আবারও… আবারও… মেঘটার হাতের মুঠোয় সেই না-মানুষটা আহত, মৃতপ্রায়… ধাতব মেঝে ধরে ছেঁচড়ে টেনে আনা হচ্ছে না-মানুষটাকে… তারপর…
একই ঘটনা… বারংবার… ঘুরে ঘুরে আসে… স্বপ্ন নাকি স্মৃতি… কিছুই বুঝতে পারে না তাশা…
ছোট্ট ঘরটার স্থির বাতাসে কম্পন উঠল। দেওয়ালের একটা অংশ ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। তাশা দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। সে জানে এই স্ফটিকের মেঝে আর শিরার জালিকা এইসব স্বাভাবিক নয়। আবার সে ঢুকে গেছে স্বপ্নের মাঝে। সেই না-মানুষটা…পরামানবটা আসবে এবার… তাশার সারা শরীর থর থর করে কেঁপে উঠল, আবার শুরু হয়ে গেছে স্বপ্নচক্রের ঘূর্ণন… আতঙ্কে এখুনি যেন সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু তাশা জানে তার জ্ঞান হারাবে না। এত সহজে তার মুক্তি নেই। যা ইচ্ছা হোক। সে আর পারছে না। একই স্বপ্ন, একই ভয়, একই আতঙ্ক আর যন্ত্রণার আবর্তে ঘুরে ঘুরে তাশা ক্লান্ত!
মুখে ঢোকান সেই নলটা এখনও একপাশে পড়ে আছে, নলটাও একই রকমের স্ফটিক দিয়ে তৈরি। সর্বশক্তি দিয়ে নলটাকে তাশা মুচড়ে ছিঁড়ল… একটা তীক্ষ্ণ অংশ তৈরি হয়েছে… হ্যাঁ, এই তো তার চামড়া ভেদ করে যাচ্ছে… এবারে সে নিজেই মরে যাবে… অন্তত… অন্তত এতে করে শেষের সেই ভয়ংকর দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে তাকে আবারও হেঁটে যেতে হবে না।
২
উড়াল যানের পেটের দিকের করিডোরগুলো যেখানে এসে মিশেছে সেই বিশাল ঘরটায়, সেখানে চুপচাপ ভাসছিল কৃণাত, একলা। এই দ্বাদশকোণাকৃতি ঘরটা থেকে লম্বা পাইপের মতো করিডোরের জটিল গোলকধাঁধা চলে গেছে বিভিন্ন দিকে। এই মহাকাশযানে এরকম ঘর আছে আরও অনেকগুলো। সেখানে কোথাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই অভিযানে কৃণাতের সঙ্গীরা—এগারোজন। ঘরটা জৈব-স্ফটিকে তৈরি। স্বচ্ছ! শিরা, উপশিরার জালিকা ভেদ করেও এখান থেকে অনন্ত মহাকাশের অনেকটা অংশ দেখা যাচ্ছে।
একদিকে ফেলে আসা প্রকাণ্ড এক মহাকায় বাষ্পগ্রহ আর ততোধিক প্রকাণ্ডতর বলয় এখনও দৃষ্টিসীমাকে আবদ্ধ করে রেখেছে। শনির বলয়। দুই সৌরপ্রহর আগে তারা যাত্রা শুরু করেছে ওইখান থেকেই। এখন তারা পার করছে ইউরেনাসের আবর্তন পথ। একদিকে প্রকাণ্ড শনিগ্রহ যতই ছোটো হয়ে আসছে, অন্যদিকে স্বচ্ছ স্ফটিকের মধ্য দিয়ে ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে দূরের নীল তুষার গ্রহ, নেপচুন।
না, কৃণাত কিছুই দেখছে না। দেখার মতো অবমানবীয় অনুভূতিকে সে ঘৃণা করে। অতিইন্দ্রিয়ের কাছে পঞ্চইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা আর কতটুকুই বা। সে অনুভব করছে। ঘরটার মাঝখানে আড়াআড়িভাবে ভাসতে ভাসতে সে খুব নিবিষ্ট মনে অনুভব করছে বিভিন্ন তরঙ্গ। কৃণাত অনুভব করছে একটু একটু করে দূরে সরে যাওয়া শনিগ্রহের ঝোড়ো তরঙ্গপ্রভা। অনুভব করছে মুহূর্তে মুহূর্তে এগিয়ে আসা হিমদানব নীলগ্রহটার শীতল তরঙ্গপ্রবাহ। তাদের তো আর অবমানবদের মতো সীমিত ইন্দ্রিয়ক্ষমতা নয়, তাদের আছে অতীন্দ্রিয়ের আশীর্বাদ। তাই সে দর্শনেন্দ্রিয় ব্যবহার না করেও, দেখতে পাচ্ছিল এগিয়ে আসা নীলাভ তুষারগ্রহটিকে। শ্রবণেন্দ্রিয় ছাড়াই শুনতে পাচ্ছিল মহাতরঙ্গের গুঞ্জন। দূর অন্ধকার মহাশূন্যের মাঝে বাকি গ্রহরা ঝলমলিয়ে উঠছে। কৃণাত তাও অতিদর্শন করছিল। বহু বহু দূরে উজ্জ্বল নক্ষত্রটা একটা প্রকাণ্ড উড়ালযানের মতোই ঝুলে আছে আকাশের গায়ে। অবিরাম ছুটে যাচ্ছে আকাশগঙ্গার পথ বেয়ে। প্রতিক্ষণে তরঙ্গমালা বিচ্ছুরিত হচ্ছে, ভাসিয়ে দিচ্ছে সৌরমণ্ডলের শেষ প্রান্তও। ক্ষীণ হলেও কৃণাত টের পাচ্ছিল সূর্যের সৌরভ। সৌরমণ্ডলীর শেষ প্রান্তে নক্ষত্রটির মহিমা বড়োই দূর্বল, তবু তা জ্বাজল্যমান। কৃণাত অনুভব করছে তারা ক্রমে সূর্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এগিয়ে চলেছে সৌরমণ্ডলীর শেষ গ্রহটির উদ্দেশে।
নীল দানবাকৃতি হিমগ্রহটা যতই কাছে সরে আসছে, ততই কেমন এক সমস্যার শেষ নেই। এতই শীতল, এতই কর্কশ… কুইপার বেল্টের হিম-শিলা-খণ্ডেরাও তো ছেড়ে কথা বলে না। কুইপার বেল্ট ঘেঁষে তাই পরামানবরা থাকতে চায় না। এই দুটো গ্রহকেই জাতীয় গ্রহসংঘ ব্যবহার করে বিভিন্ন গবেষণার জন্যে। বিশেষ করে ইউরেনাসকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক বিশাল বহিঃবিশ্ব গবেষণাকেন্দ্র। কিন্তু বিভিন্ন কারণে নেপচুন এখনও সে সবের বাইরে। নেপচুন লাগোয়া একটা ছোটো গবেষণাকেন্দ্র আছে বটে। তবে সেখানে যে ঠিক কীসের গবেষণা হয় তা কৃণাতও জানে না। গ্রহসংঘের দলিলে লেখা আছে আগে ওই গবেষণাকেন্দ্রটিতে বহিঃবিশ্বের গবেষণা হত, কিন্তু বিভিন্ন প্রাকৃতিক সমস্যার কারণে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার সৌরাবর্ত আগেই ওই কেন্দ্রটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া গবেষণাকেন্দ্রে নতুন করে কী এত সমস্যা তৈরি হল কে জানে!
তবে সৌরমণ্ডলের শেষ গ্রহে যাওয়ার থেকেও বড়ো কথা, কৃণাত আগে কখনও এরকম ধাতব-যানে চেপে মহাশূন্যে উড়াল দেয়নি। আন্তঃগ্রহ শূন্য-লঙ্ঘন সেতু, যাকে সংক্ষেপে অনেকে শূল-সেতুও বলে, আবিষ্কারের পর থেকে দূরযাত্রার উড়াল-যানের উপযোগিতা একদমই কমে গেছে। উড়াল-যান ব্যাপারটা জৈবদেহের পক্ষে কোনোদিনই খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না। শূন্যের মাঝে কখন কোন কলকবজা বিগড়ে যাবে, কখন কী ফুরিয়ে যাবে… এর থেকে শূল-সেতু অনেকগুণে ভালো। অনেক কম সময়েই পৌঁছান যায়। এই উড়াল-যানে করে শনিগ্রহ থেকে নেপচুন পৌঁছাতে তাদের অর্ধ সৌরাবর্ত অর্থাৎ চার সৌরপ্রহর সময় তো লাগবেই।
উড়ালযানটা এতক্ষণ মসৃণ গতিতে এগোচ্ছিল। ধাতব দেওয়ালে মৃদু ঝাঁকুনি লাগল। কৃণাত বুঝল এবার তারা ইউরেনাসের আবর্তন পথ ছেড়ে বেরিয়ে গেল, এবার তাদের উড়াল-যান কৌণিক গতিপথ বদলাচ্ছে। গতিপথ বদলে বদলে তারা একসময় ছুঁয়ে ফেলবে নেপচুনের আবর্তন তল।
স্বচ্ছ চামড়ার কোকুনের মধ্যে কৃণাত গুটিয়ে রেখেছিল নিজেকে। এরকমভাবে মহাকাশভ্রমণ করতে সে ভালোবাসে না। যে অভিযানে তারা চলেছে সেখানে তার কাজটা কী সেটাও সে সঠিক বুঝতে পারছে না। কৃণাত মূলত একজন গূঢ়-সংবাদবাহক, চলতি ভাষায় যাকে বলা হয় চর। তার কাজ থাকে সরকারের বাসার ভিতরে। ইউরেনাসের গবেষণাকেন্দ্রেও সে এসেছে বারকয়েক। এ জীবনে কতবার যে শূল-সেতু পার করে সে বিভিন্ন গ্রহে আর মহাকাশালয়ে গেছে তার হিসাব নেই। কিন্তু এই নেপচুন অভিযানে তার কাজটা কী এখনও পর্যন্ত সে মোটেও বুঝতে পারছে না। বিশেষ করে যখন, শূন্য-লঙ্ঘন সেতু বাদ দিয়ে কেন তাদের পাঠানো হল এরকম অদ্ভুত এক প্রাগৈতিহাসিক ধাতব-উড়ালযানে করে?
কৃণাত জানে নেপচুনের যে বন্ধ হয়ে যাওয়া গবেষণাকেন্দ্রটা আছে সেখানে সবকিছুর সঙ্গে একটা শূন্য-লঙ্ঘন সেতুও আছে। গবেষণাকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলেই তো আর পরিত্যক্ত হয়ে যায় না। কিছু পরামানব আজও সেখানে থাকে। তবে তারা শুধুমাত্র পরিত্যক্ত গবেষণাকেন্দ্রটিকে দেখে শুনে রাখার জন্যে থাকে, নাকি তাদের কোনো কাজ আছে সে কথা কৃণাত জানে না। তবে সে একথা জানে নেপচুনকে কেন্দ্র করে উপগ্রহের মতো পাক খেতে থাকা সেই মহাকাশ-আলয়টিকে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্যে একটি বায়ো-কোয়ান্টাম মস্তিষ্ক অর্থাৎ মেধষ আছে সেখানে। আর সেই মহাকাশ-আলয়ে একটি চলমান শূন্য-লঙ্ঘন সেতুও আছে।
সে নিজে কখনও আসেনি, তবে নিজে না গেলেও কী জানা যায় না। জানার কতই তো উপায় আছে। এই যে নেপচুন ছুঁয়ে যে শিলাখণ্ডের সারি তার ওধারে সে তো কখনও যায়নি। কিন্তু সে জানে। সে জানা শুধুমাত্র অবমানবদের মতো কিছু দৃশ্য বা শব্দতরঙ্গের রেকর্ড নয়। বায়ো-কোয়ান্টাম মস্তিষ্কের সাহায্যে তারা সশরীরে উপস্থিত না হয়েও অতীন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করতে পারে সকল কিছু। অনুভব করতে পারে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়া শিলাখণ্ডের ক্রোধান্বিত কম্পন, অনুভব করতে পারে ছুটে চলা ধূমকেতুর গুঞ্জন, অনুভব করে অনন্ত মহাশূন্যের মাঝের কত ধরনের তরঙ্গমালা!
কে জানে কত সৌরপ্রহর কৃণাত বুঁদ হয়ে ডুবে ছিল মহাজাগতিক তরঙ্গমালার মাঝে। আচমকা তার মাথার মধ্যে বার্তার সংকেত এল। পরামানবদের তরঙ্গ-বিচারের অতিইন্দ্রিয়টি খানিক অবমানবদের শ্রবণেন্দ্রিয়ের মতো। কানে আঙুল গুঁজে রাখলেও যেমন বোঝা যায় কেউ হাঁকডাক করছে কিনা। এটাও সেরকম, কোন তরঙ্গকে কে গ্রহণ করবে তা প্রত্যেকের একান্ত নিজস্ব বিচার। এখন যেমন কৃণাতের অতীন্দ্রিয়ের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে অভিযানের দলনায়ক হাঁকডাক করছে। কৃণাত অতীন্দ্রিয়ের দ্বার খুলতেই বার্তার পর বার্তা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার মস্তিষ্ক-অঞ্চলে।
‘আমরা নেপচুনের কক্ষতলে ঢুকে এসেছি। অর্ধ সৌরপ্রহরের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাব আমাদের গন্তব্যে। গন্তব্যের সঙ্গে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে আমাদের উড়াল-যানটি নেপচুনকে পাক খেতে শুরু করবে। আমাদের শূন্যচারণ করে যেতে হবে গন্তব্যে।’
‘আমাদের উড়ালযান গবেষণাকেন্দ্রের আকাশজেটিতে অবতরণ করবে না?’ একজন পরামানব প্রশ্নবার্তা পাঠাল।
‘না। এই উড়ালযানটিকে গবেষণাকেন্দ্রের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ এই উড়ালযানটিতে কোনো মেধষ নেই। তবে তার জন্যে আমাদের অবতরণে কোনো সমস্যা হবে না। আমরা শূন্যচারণ করে পৌঁছাব গবেষণাকেন্দ্রে।’
খর-তরঙ্গের প্রায় ঝড় উঠল। পরামানবদের কাছে শূন্যচারণ ব্যাপারটা খুবই কঠোর একটা কাজ। তার উপরে মেধষহীন একটি উড়ালযানে করে গ্রহসংঘ তাদের অভিযানে পাঠিয়েছে। এই কি রসিকতার সময়!
কৃণাত প্রশ্ন করল, ‘আমরা গবেষণাকেন্দ্রটি থেকে কত দূরে উড়ালযান রাখব?’
‘একশো কিলোমিটার দূরত্ব।’
সকলের মস্তিষ্ক থেকে একই সঙ্গে বিস্ময়সূচক অভিঘাত উঠল। একশো কিলোমিটার শূন্যচারণ! এ কি সম্ভব!
‘আপনারা বৃথা চিত্তক্ষয় করবেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাদের সবকিছু জানিয়ে দেওয়া হবে।’
‘কেন আমরা শূন্যলঙ্ঘন সেতু ব্যবহার করছি না? কেন আমাদের উড়ালযানকে গবেষণাকেন্দ্রের একশো কিলোমিটার আগে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে, সেইগুলোও কী আমাদের জানানো হবে?’ কৃণাত বলে উঠল।
কৃণাতের প্রশ্নে সকলের মনেই একই জিজ্ঞাস্য।
দলনায়কের বদলে এবার অন্য একজন বার্তা পাঠাল। ‘আমি কুসুদাম। এই অভিযানের সহনেতা। জাতীয় গ্রহসংঘ থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, দুই সৌরাবর্ত আগে ওই গবেষণাকেন্দ্রের শূন্যলঙ্ঘন সেতুটি নিজের থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। ওই কেন্দ্রে এখন প্রায় পঞ্চাশ জন পরামানব আটকা পড়ে গেছেন। আমাদের অভিযানের মূল উদ্দেশ্য তাদের সুস্থ অবস্থায় ওখান থেকে বের করে আনা।’
একটা গুঞ্জন তরঙ্গবার্তা প্রক্ষিপ্ত হচ্ছিল। নিশ্চয়ই কোনো বিজাতীয় ভাইরাসের আক্রমণ, নাকি বিদ্রোহ? পঞ্চাশজন পরামানব ওই পরিত্যক্ত গবেষণাকেন্দ্রে করছিলটা কী? ওরাই কী বিদ্রোহী?
কৃণাত ভাবছিল, একশো কিলোমিটার কেন? মেধষহীন উড়ালযান কেন?
প্রতিটি উড়ালযানে একটি করে ক্ষুদ্র ‘মেধষ’ থাকে; যেমন থাকে প্রতিটি মহাকাশআলয়ে একটি করে পূর্ণ মেধষ। এই বায়ো-কোয়ান্টাম মস্তিষ্কগুলিকে কোনোভাবেই হ্যাক করা সম্ভব নয়, এদের নতুন নির্দেশ দেওয়া সম্ভব নয়। এদের প্রথম যে কাজের জন্যে তৈরি করা হয় সেইটুকু কাজই এরা করে যায় অক্ষয়কাল ধরে। ‘পূর্ণ-মেধষ’ একটি শহর সমান মহাকাশআলয়ের সবটুকু খেয়াল রাখে। আবহাওয়া, পরিবেশ থেকে শুরু করে ছুটে আসা উড়ন্ত শিলাখণ্ডের থেকে সুরক্ষা সবকিছুই দেখেশুনে রাখে ‘মেধষ’। সঠিক তরঙ্গের প্রক্ষেপ ছাড়া কোনো মহাকাশআলয়ের কাছেই পৌঁছান যায় না। অচেনা বস্তুদের সাধারণত শত্রু হিসাবে দেখে মেধষ। মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো অসংখ্য শিলাখণ্ড এবং অন্যান্য গুপ্ত-আক্রমনের হাত থেকে বাঁচার জন্যেই এরকম সুরক্ষাব্যবস্থা।
কিন্তু তাদের উড়াল-যানে কোনো মেধষ নেই। এর অর্থ কী! এই যে একশো কিলোমিটার আগে তাদের উড়াল-যান থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অর্থ একটি পূর্ণ-মেধষের আওতার বাইরে। যাতে করে কোনো শিলাখণ্ড ভেবে তাদের উড়ালযানটিকে আক্রমণ না করে বসে মেধষ। নাকি অন্য কিছু… যাই হোক না, ওই পরিত্যক্ত গবেষণাগারটির মেধষকে কেন্দ্র করেই যে সমস্যাটি তৈরি হয়েছে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহই আর নেই।
কৃণাত এতক্ষণে চোখ খুলে তাকাল। তার পীতবর্ণের বিশাল চোখ দিয়ে দেখল, সামনের স্ফটিক-স্বচ্ছ অংশ দিয়ে সে দেখে অনন্ত কৃষ্ণ মহাশূন্য ধীরে ধীরে ঢেকে দিছে এক বিশাল নীল হিমগ্রহ। ওই নীলের মাঝেই লুকিয়ে আছে অপার রহস্য। কৃণাত বুঝতে পারছে এমন অভিযান পরামানবের ইতিহাসে এই প্রথম। কে জানে, হয়তো এমন বিপদও এই প্রথম…
৩
শনিগ্রহ থেকে যাত্রা শুরুর পরে কেটে গেছে চার সৌরপ্রহর। গন্তব্য আর মাত্র একশো কিলোমিটার দূরে। তাদের উড়ালযানটিকে গবেষণাকেন্দ্রের সঙ্গে নির্দিষ্ট দূরত্বে সম গতিবেগে বেঁধে ফেলা গেছে। কৃণাত একবার চোখ টান করে দেখল স্ফটিক দেওয়ালের ওপাশের দৃষ্টিসীমার সবটা জুড়ে থাকা বিশাল গ্রহটাকে। বিশ্রী ফ্যাকাশে নীল। আবর্ত উঠছে সেই নীল মেঘের মাঝে। তাদের মহাকাশযান থেকে কোনাকুনিভাবে দেখা যাচ্ছে পরিত্যক্ত গবেষণাকেন্দ্রটিকেও। বহুবর্ণের গোলক দিয়ে তৈরি একটা মালার মতন সেটা ভেসে বেড়াচ্ছে শূন্যের মাঝে। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ওর ভিতরে কী চলছে!
কী চলছে? এত বাধানিষেধের মোড়কে জাতীয় গ্রহসংঘ তাদের পাঠিয়েছে! কৃণাতের সন্দেহ, এবার তাদের পরামানব জীবনের সর্ববৃহৎ সমস্যাটির মুখোমুখি এসে বুঝি এবার তারা হাজির হয়েছে। এরকম সমস্যা যে হতে পারে সে কথা প্রজ্ঞানীরা মাঝেমাঝেই বলে থাকেন। সেসবের জন্যে বিভিন্ন সাবধানতাও অবলম্বন করা হয়ে চলেছে। এই অবতরণের সমস্যাটা উঠে আসার পর থেকেই কৃণাত স্থির বিশ্বাসে জানে ওই সর্বনাশটিই ঘটেছে। ‘মেধষ’রা বিদ্রোহ করেছে। সামনের ওই উজ্জ্বল মালার মতো সাজানো গোছানো মহাকাশআলয়টি এখন কোনো পরামানব নয়, বরং ‘মেধষ’-এর দখলে।
তারা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শূন্যচারণ শুরু করবে। সকলকে সুরক্ষা-বলয় দেওয়া হয়েছে। এই উড়াল-যানে ফিরে আসার আগে পর্যন্ত সুরক্ষা-বলয় বন্ধ করা যাবে না। ‘মেধষ’ আবিষ্কারের আগে এই ধরনের সুরক্ষা-বলয় ব্যবহার করত পরামানবেরা। অবশ্য তাদেরগুলো অনেক উন্নত। এগুলো তাদের চারধারের আবহাওয়া ইত্যাদি সবকিছু রক্ষা তো করবেই সঙ্গে বাইরের আঘাত, এবং অজানা তরঙ্গের থেকেও রক্ষা করবে। তবে সুরক্ষা-বলয় মহাশূন্যের মাঝে তাদের বাঁচিয়ে রাখবে ঠিকই, কিন্তু মহাশূন্যের মাঝে গতিশীল হওয়ার মতো কোনো জৈব-যন্ত্র তাদের কাছে নেই।
দলনায়ক কোসা তরঙ্গ বার্তা পাঠাতে সকলে এসে একটি কক্ষে জড়ো হল। এতক্ষণে সহনায়ক কুসুদামকে ভালো করে দেখার সময় পেল কৃণাত। আর তখনই একশো কিলোমিটার শূন্যচারণের সমস্যা নিয়ে কেন দলনেতার কোনো মাথাব্যথা নেই তা পরিষ্কার হয়ে গেল। কুসুদাম একজন শূন্যচারী পরামানব। কুসুদামের তরঙ্গ-প্রক্ষেপ থেকেই কৃণাত সেটা বুঝে নিয়েছে। শূন্যচারী পরামানবরা সংখ্যায় অত্যন্ত কম। তারা এই সৌরমণ্ডলীর সবচেয়ে ধনী পরামানবও বটে। সেরকম একজনকে অভিযানে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে জাতীয় গ্রহসংঘ! এর অর্থ পরিত্যক্ত গবেষণাকেন্দ্রের সমস্যাটি অতিশয় জটিল!
এই পুরো সৌরমণ্ডলীতে মাত্র পাঁচটি গোষ্ঠী আছে শূন্যচারী পরামানবদের। এরা কেউই গ্রহসংঘের সদস্য নয়, অথচ গ্রহসংঘকে এরাই চালনা করে থাকে। সামান্য প্রজ্ঞা-চালনা করে কৃণাত এইটুকু বুঝতে পেরেছে, পরামানব সমাজ থেকে এতদূরে এই নেপচুনের বুকে এই পরিত্যক্ত গবেষণাকেন্দ্রটা কোনো সাধারণ মহাকাশআলয় নয়। এই গবেষণাকেন্দ্রটি সম্পূর্ণভাবে কুসুদামদের গোষ্ঠীর আয়ত্ত্বাধীন। সেইজন্যেই এতগুলো পরামানব আটক হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো হেলদোল নেই কারোর। কোথাও কোনো খবর নেই। নিশ্চয়ই শূন্যচারী গোষ্ঠী নিজেরাই প্রথমে সমস্যাটা মেটাবার চেষ্টা করেছিল। এখন উপায় খুঁজে না পেয়ে গ্রহসংঘকেও টেনেছে।
এখানে শূন্যচারী গোষ্ঠী গোপনে কিছু একটা গবেষণা করে চলছে। সেই গুপ্ত-গবেষণার ফসল অথবা তথ্য ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই কি কুসুদামের আগমন? এইজন্যেই কি গ্রহসংঘ কৃণাতকেও পাঠিয়েছে, যাতে করে সেও গ্রহসংঘকে এনে দিতে পারে ওই গুপ্ত-গবেষণার ফসল অথবা তথ্য।
‘সবাই প্রস্তুত? দ্বার খোলা হবে এবার।’ কুসুদামের ঘোষণা কৃণাতের চিন্তাভাবনায় ছেদ ঘটাল।
কুসুদামের নির্দেশে সকলে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল। কৃণাতকে একদম শেষে রাখল কুসুদাম। রাখার সময় একটা মুচকি হাসির প্রক্ষেপ ভেসে এল কৃণাতের মাথার মধ্যে। কৃণাত একটু বিচলিত বোধ করল। কুসুদাম কি কিছু টের পেয়েছে, কৃণাতের আসল পরিচয়! একশো কিলোমিটার রাস্তা একেবারে কম নয়। কুসুদাম যতই শূন্যচারী হোক, সে কী একা এতটা টানতে পারবে?
কৃণাত এসব ভাবতে ভাবতেই একজন পরামানব দ্বার খুলে দিল। ওই পরামানব রয়ে যাবে এই উড়াল-যানে। কোনো ‘মেধষ’ নেই বলেই এই ব্যবস্থা। আরও একটু পিছিয়ে গিয়ে সৌরযান নিয়ে সে অপেক্ষা করবে।
সকলে বেরিয়ে গেল মহাশূন্যের মাঝে। কুসুদাম নিজের গুটিয়ে ছোট্ট করে রাখা শরীরটাকে খুলে ফেলছিল। বিশাল এক কেন্নোর মতো লম্বা শরীরটা পাকে পাকে খুলে যাচ্ছিল। বাকি নয়জন অভিযাত্রীকে সেই ধরে রেখেছিল ছোটো ছোটো আকর্ষ দিয়ে। তারপরেই কৃণাত সবিস্ময়ে লক্ষ করল তারা একটা বিশাল বৃত্ত স্থাপন করে ভেসে চলেছে মহাশূন্যের বুক দিয়ে। কুসুদামের মাথার দিকটা সূর্যের দিকে। সে সূর্যের তরঙ্গঢেউ ব্যবহার করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে মহাশূন্যের মাঝ দিয়ে।
এক অভিনব তীব্র অনুভুতি ছেয়ে ফেলছিল কৃণাতকে। তার ত্বকের তল দিয়ে কেমন শির শির করে বয়ে যাচ্ছে এক হিম জলধারা। আচমকা হৃৎপিণ্ডটা যেন ছটফটিয়ে উঠে ছিটকে যেতে চাইছে। খসে পড়তে চাইছে দেহ-অবয়ব। স্ফীত হয়ে উঠতে চাইছে স্নায়ুমণ্ডলী। কম্পন শুরু হয়েছে মস্তিষ্কের খাঁজে খাঁজে। ইন্দ্রিয় অসাড় হয়ে আসছে। কী যেন এক কৃণাতের শরীর ছিন্ন করে বেরিয়ে যেতে চাইছে… কৃণাতের সবকিছু যেন হারিয়ে যেতে বসেছে, সে যেন কোথায় পৌঁছাতে পারবে না!
এইরকম অনুভূতি এর আগে কৃণাতের হয়নি। এ কোনো বহিঃঅনুভূতি নয়, কৃণাতের দেহের স্নায়ুমণ্ডলীই এর উৎস। কৃণাত নিজের অনুভূতিতে এতটাই ডুবে ছিল যে আশপাশের পরামানবদের অনুভূতির দিকে তাকানোর সময়টুকুও পায়নি। আচমকাই দলনেতা কোসা-র প্রক্ষেপ পেল কৃণাত।
‘আপনার সুরক্ষা-বলয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিন, কৃণাত। আপনার তরঙ্গ গ্রহণ-ক্ষমতা কিছু প্রবল। প্রথমবার শূন্য-চারণ করলে এই ধরনের মৃদু স্বেদকম্প স্বাভাবিক। তবে আপনার ক্ষেত্রে কিছু বেশিই ঘটছে।’
স্বেদকম্প! স্বেদকম্প! হ্যাঁ, এই অনুভূতিটার কথা কৃণাত ভাসা ভাসা জানে। বির্বতনের প্রথম দিকে পরামানবরা নাকি অমর ছিল না। তারা মারা যেত অবমানবদের মতোই। মৃত্যুর সময় নাকি পরামানবদের প্রবল স্বেদকম্প অনুভূত হত। এখন সেই অনুভূতি লুপ্ত হয়ে গেছে। এখন প্রজ্ঞান এত বেশি উন্নত যে পরামানবদের মৃত্যু হয় না।
কয়েক সৌরক্ষণের যাত্রা মাত্র। কুসুদাম একসময় ছুঁয়ে ফেলল গবেষণাকেন্দ্রের আকাশজেটি। তাদের ছুড়ে দিল জৈব-স্ফটিকের উপরে। একজন পরামানব-সৈন্য পোশাকের মধ্যে থেকে চটজলদি বার করে আনল ছোটো একটা শূন্যচক্র। বসিয়ে দিল আকাশজেটি সংলগ্ন জৈব-স্ফটিক দেওয়ালের উপর। শূন্যচক্রটা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শিরা-উপশিরার জালিকা সরিয়ে একটা ছোটো ফোকর সৃষ্টি করল দেওয়ালের গায়ে। তারা এক এক করে নিজেদের গলিয়ে দিল দ্বারের মধ্যে দিয়ে। সবার শেষে কুসুদাম ঢুকে এল। অত লম্বা দেহটাকে গুটিয়ে ছোটো করে আনতে তার একটু সময় লাগল। অবশ্য কৃণাত মেঝে ছুঁতে না ছুঁতেই, কুসুদামও নেমে এল। শূন্যচক্রটা দ্বার বন্ধ করে ভিতরে এসে পড়ল। কুসুদাম লুফে নিল বস্তুটা। বার হবার সময় কাজে লাগবে।
মহাকাশ-আলয়ের ভিতরে ঢুকতে না ঢুকতেই কৃণাতের সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলী এক অদ্ভুত স্থিরতা অনুভব করল। হতচকিত কৃণাতের মস্তিষ্ক প্রথমে ধারণ করতে পারল না ব্যাপারটা। পরক্ষণেই সে বুঝতে পারল এখানে পরিবেশ স্পন্দনশূন্য। কোথাও কোনো জৈব-কম্পন অনুভূত হচ্ছে না। কোনো তরঙ্গও নেই। শুধু তারা দশজন। সুরক্ষা-বলয়ের জন্যে তাদের জৈব-কম্পনও অতিক্ষীণ। তারপর ছড়িয়ে রয়েছে অপার নিস্তব্ধতা… স্তব্ধতা তো ব্যবহার হয় শুধু শব্দের ক্ষেত্রে, এখানের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার মতো কোনো ভাষা কৃণাতের নেই। এ এক অন্তহীন নিরল অবস্থা… এখানে কিছু নেই… শুধুই শূন্য… এ কোনো নক্ষত্রমণ্ডলীর অংশ নয়… এ যেন কোনো গ্রহের সঙ্গযাপন করছে না… এমনকী জৈব-স্ফটিক নির্মিত মহাকাশ-আলয়ও যে অতি সামান্য কম্পন নির্গত করে তাও নেই… কিছু নেই… কিচ্ছুটি নেই… নিরল… নিথর… নিঃকম্প… নিস্তরঙ্গ…
৪
বিমূঢ় অবস্থাটা প্রথম কাটিয়ে উঠল ষৃণ নামের এক পরামানব-সৈন্য। তবে সে এই নিরালা নিষ্কম্প অবস্থা নিয়ে কোনো কথা তুলল না। সে বার্তা প্রক্ষেপ করল—‘কোনো অতিকর্ষ আক্রমণ এল না! মেধষ কী একেবারে বন্ধই হয়ে গেছে?’
কৃণাতেরও চমক লাগল। সত্যিই তো এটা কিরকম ঘটল! প্রতিটি মহাকাশ-আলয় রক্ষা করে ‘মেধষ’। কেউ সঠিক তরঙ্গের ব্যবহার না করে জোর করে ঢুকে এলে অতিকর্ষের আক্রমণ হয়। সে টান এড়াবার সাধ্য কারোর নেই, কিছুর নেই। খুবই সামান্য অথচ খুবই ফলদায়ক এই পদ্ধতি। যে অঞ্চলে অতিকর্ষের সৃষ্টি হয় সেখানে যা কিছু থাকুক সব গিয়ে আটকে যাবে দেওয়ালের গায়ে। নড়াচড়ার ক্ষমতা থাকবে না কারো। কিন্তু এক্ষেত্রে কই তেমন তো কিছু ঘটল না। ষৃণ হয়তো অতিকর্ষ এড়াবার জন্যে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে রেখেছিল। এইজন্যেই সেই প্রশ্নটা সর্বাগ্রে এসেছে তার মাথায়।
ষৃণের প্রশ্নের উত্তর কেউ দিল না। উত্তর দেওয়ার মতো কিছু নেইও। দলনেতা নির্দেশ দিল সকলকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। কুসুদাম আর কৃণাতকে মাঝখানের সারিতে রেখে সকলে সতর্ক হয়ে এগিয়ে চলল বিশাল অলিন্দ ধরে। কৃণাতের পরেন্দ্রিয়র উপর এক চাপ ফেলছে এই পরিবেশ। সে বিন্দুমাত্র কোনো তরঙ্গমাত্রা অনুভব করতে পারছে না। এটা একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। এটা ঘটতে পারে না। এই জগৎ সংসারে সকল বস্তু অতি বৃহৎ থেকে অতি সামান্য হলেও তরঙ্গ বিস্তার করে চলে। পরামানবরা সেই তরঙ্গ অনায়াসেই টের পায়। কৃণাত কিছু বেশিমাত্রায় পায়।
সম্পূর্ণ তরঙ্গহীন অবস্থা কেউ কখনও অনুভব করেনি। শূন্যলঙ্ঘন সেতুর মাঝেও তরঙ্গের ঢেউ খেলে। তবে তেমন তেমন অবস্থানে যেমন বুধগ্রহে যেকোনো তরঙ্গই অনুভব করতে বড়োই সমস্যা হয়। সূর্যের একদম কাছে অবস্থিত বলে এই সমস্যা। সূর্যের বিশাল তরঙ্গ প্রভায় আচ্ছন্ন থাকে সবকিছু। কিন্তু সেও তো এক ধরনের তরঙ্গময় অবস্থা। কিন্তু এই অবস্থাটা সম্পূর্ণ বিপরীত!
‘এখানে তরঙ্গহীন পর্যায়ের কোনো গবেষণা চলছিল নাকি?’ কৃণাত প্রশ্নটা শেষমেশ করেই ফেলল। অবশ্য সে শুধুই কুসুদামকে পাঠিয়েছে এই তরঙ্গবার্তা।
‘না।’ কুসুদামের বার্তায় বড়ো বেশি গাম্ভীর্য। সে নিজের বিশাল শরীরটাকে গুটিয়ে এক ফুটপাঁচেক ব্যাসবিশিষ্ট বলের মতো করে ফেলেছে। কুসুদামের শরীরে কোনো মুখমণ্ডল বা হাত পা নেই। অবশ্য বেশির ভাগ পরামানবের দেহই তাই। কুসুদামের দড়ি পাকানো বলের মতো দেহটা বেরিয়ে এসেছে অজস্র ছোটোবড়ো মাংসল আকর্ষ। কী এক সতর্কতায় আকর্ষগুলো তীক্ষ্ণ হয়ে আছে এই মুহূর্তে।
খানিকক্ষণ এইভাবে এগিয়ে চলার পর, তারা মূল গবেষণাকেন্দ্রের একটা অংশে এসে ঢুকল। সবার প্রথমে যে পরামানবটা এগোচ্ছিল সে মেঝে থেকে কিছু একটা তুলে নিয়ে দলনেতা কোসাকে দিল। কৃণাত জিনিসটা দেখে চিনল। এটা একটা অতি প্রাচীনকালের শব্দ-তরঙ্গ ধরে রাখার ধাতব যন্ত্র। ইঞ্চিখানেক ছোট্ট।
কৃণাতের মনে হল, দলনেতার উদ্দেশে কুসুদাম বুঝি কিছু একটা গোপন তরঙ্গবার্তা প্রেরণ করল।
দলনেতা বস্তুটাকে চালু করল। ষৃণ ছাড়া এখানে আর কারোর শরীরেই শ্রবণেন্দ্রিয় নেই। অবশ্য তাতে আটকাবে না, শব্দতরঙ্গটাকে সুরক্ষাবলয় পরাতরঙ্গে পরিণত করবে, কোনোরকম সমস্যাদায়ক তরঙ্গের অভিক্ষেপ থাকলে নষ্টও করে দেবে। কিন্তু কৃণাত শুনতে চাইছিল প্রকৃত শব্দতরঙ্গটাকে। সে সংগোপনে শরীরের একাংশ পরিবর্তন করে শ্রবণেন্দ্রীয় তৈরি করল।
এক সুরেলা ছন্দ সৃষ্টি করছিল শব্দযন্ত্রটা। কেমন এক আদিম মন্ত্রোচ্চারণের মতো। স্বরটা মধ্য থেকে অতি মন্দ্রে ফিরে ফিরে যাচ্ছিল… যেন এক গুহার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে কেউ কথা বলছে। শব্দগুলো বুঝতে পারছিল না কৃণাত। কোনো প্রাচীন অতিমানবীয় ভাষার মতো শব্দবন্ধ সব। কিন্তু এই শব্দতরঙ্গের প্রভাবে কৃণাতের সমস্ত শিরা-উপাশিরা পর্যন্ত ঝনঝন করে বেজে উঠছিল। যেন মনে হচ্ছিল আবারও স্বেদকম্প উপস্থিত হবে। পুরোটা না শুনেই কৃণাত শ্রবণেন্দ্রীয়টা বন্ধ করে নিল।
একবার চুপিচুপি বোঝার চেষ্টা করল, কেউ তাকে লক্ষ করছে কিনা। হ্যাঁ, কুসুদাম তীক্ষ্ণ অতিদর্শন করছে। কৃণাত চটজলদি সুরক্ষা-বলয়টাকে আরও এক মাত্রা বাড়িয়ে দিল। সুরক্ষা-বলয়ের মধ্যে ছাঁকনি হয়ে যে পরাতরঙ্গ এসে ঢুকছে তাতে একটু আগের ওই অতিমন্দ্র স্বর-ক্ষেপনের অনুভূতি কিছুই উপলব্ধ হচ্ছে না।
সকল পরামানবই কিঞ্চিৎ বিমূঢ় হয়ে গেছে। এমনকী কুসুদাম পর্যন্ত কোনো বার্তা প্রক্ষেপ করছে না। এই শব্দটা অবশ্যই কোনো পরামানবের স্বরযন্ত্র থেকেই প্রক্ষিপ্ত হচ্ছে কিন্তু এই ধরনের সুরেলা শব্দধারার অর্থ কী? আর যদি কোনো অর্থ না থাকে তাহলে সেরকম অর্থহীন শব্দধারা উৎসারিতই বা কেউ করবে কেন!
‘কেউ আদিম দেবতাদের আরাধনা করছে!’ ষৃণ নামের পরামানব সৈনিক বলে উঠল।
আদিম দেবতা! আরাধনা! এইসব শব্দ বন্ধ অদিকাংশ পরামানবের কাছেই কোনো অর্থ বহন করে না। আর যারা জানে যেমন কুসুদাম, দলনেতা এবং কৃণাত—সকলেই ঘৃণায় কুঞ্চিত হল। অশ্লীল সব অবমানবীয় ধারা! ছিঃ ছিঃ! যারা এই মহাবিশ্বকে জানত না সেইসব মুর্খদের তৈরি করা অপসংস্কার যত। কীভাবে একজন পরামানব এইধরনের অশ্লীল কাজ করতে পারে!
শব্দ-তরঙ্গ শেষ হয়ে গেলে দলনেতা একটা ছোটো জৈব-যন্ত্রের বার করে এই ধাতব-যন্ত্রটার অতীত বিচার করল। অতি সামান্য কিছু তথ্য উঠে এল।
দলনেতা জানাল, ‘এই শব্দ-তরঙ্গের অধিকারীরা খুব সম্ভবত বিয়াল্লিশ নম্বর কক্ষের কাছাকাছি কোথাও একটা জড়ো হয়েছিল। আমি ঠিক করেছি কুসুদামের নেতৃত্বে একটা দল ওইদিকে যাবে। আর আমরা যাব তেরো নম্বর কক্ষের দিকে, মেধষ অঞ্চলে। ওইখানেই শূন্য-লঙ্ঘন সেতুটাও আছে। আমাদের আগে পাঁচটা দলের মধ্যে দুটো দল শূন্য-লঙ্ঘন সেতুর মাধ্যমে ভিতরে এসেছিল। ওইখানে অতীত-বিচারের মাধ্যমে আমরা নিশ্চয়ই কিছু তথ্য পাব। এই সিদ্ধান্তে কারোর কোনো সমস্যা আছে?’
‘অন্য দুটো দল কীভাবে এসেছিল?’ কৃণাত প্রশ্ন করল।
দলনেতার বদলে কুসুদাম জবাব দিল। ‘চতুর্থ এবং পঞ্চম দলটি উড়ালযানে এসেছিল। দুটো উড়ালযানই ধ্বংস হয়ে গেছে মহাশূন্যের বুকেই।’
‘কীভাবে?’
‘মানে?’
‘কীভাবে ধ্বংস হয়েছে? এই গবেষণাকেন্দ্র থেকে রেখাপাত করা হয়েছিল? নাকি অন্য কোনো উপায়?’
কুসুদাম কেমন একটু বিচলিত হয়ে বার্তাক্ষেপণ বন্ধ করে দিল।
দলনেতা বলে উঠল, ‘সেই সৌরযানদুটোকে আমরা খুঁজে পাইনি। এমনকী এই গবেষণাকেন্দ্রের একশো কিলোমিটারের মধ্যে ঢোকার পর থেকে ওই গবেষণাযান দুটোর সঙ্গে আমরা কোনোরকম তরঙ্গ-সংযোগ করতে পারিনি। কৃণাত আপনি নিশ্চয়ই ধারণা করছেন আমরা কী সন্দেহে এখানে এসেছি।’
‘হ্যাঁ। আমি ধারণা করছি এই গবেষণাকেন্দ্রের ‘মেধষ’টি স্বয়ংজ্ঞানী হয়ে উঠেছে। সে একশো কিলোমিটারের মধ্যে ঢুকলেই অন্যান্য মেধষের সঙ্গেও সংযোগ করছে। কিন্তু আমরা শূন্যচক্রের ব্যবহার করে ভিতরে ঢুকে এলাম, কোনোরকম অতিকর্ষের আক্রমণ হল না। এতক্ষণে তো মেধষের বুঝে যাওয়া উচিত আমরা ভিতরে এসে ঢুকেছি। আপনাদের কি মনে হচ্ছে না এটা একটা ফাঁদ?’
‘এটা ফাঁদ হলেও আমাদের করণীয় কিছুই নেই। কারণ এইখান থেকে বার হবার কোনো রাস্তা নেই। ভিতর থেকে শূন্যচক্রের ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না।’ কুসুদামের গম্ভীর তরঙ্গ ঢেউ তুলল।
সব পরামানবদের মধ্যে বিচলনের একটা গুঞ্জন প্রক্ষিপ্ত হচ্ছিল। অবশ্য এ কথা কৃণাত অনেকক্ষণ থেকেই জানে। যেমন জানে, তারও আগে একশো কিলোমিটারের বলয়ে ঢোকামাত্রই সে আর কোনোরকম যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি তাদের উড়াল-যানে রেখে আসা প্রেরক যন্ত্রের সঙ্গেও।
দলনেতার বক্তব্য তাদের থামিয়ে দিল, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না মেধষটিকে আক্রান্ত করে, বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে; ততক্ষণ এখান থেকে বেরোবার রাস্তা নেই। অতএব বৃথা কালক্ষেপ না করে সেইদিকেই সকলের মন দেওয়া দরকার।’
কৃণাত লক্ষ করল এইসব ডামাডোলের মাঝে কখন যেন কুসুদামের সহচরটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেই শব্দ-যন্ত্রটা চালু করার সময় হট্টগোলের মাঝে সে কোথায় যেন চলে গেছে।
কৃণাতের আবারও মনে হল—ফাঁদ! পুরো গবেষণাকেন্দ্র জুড়েই যেন এক অদৃশ্য ফাঁদ পাতা হয়েছে। এক স্পন্দনশূন্য ফাঁদ। তারা বড্ড বেশি তরঙ্গের প্রক্ষেপ করছে। নিস্তরঙ্গের মাঝে বড়োই বেশি পরাতরঙ্গের ঢেউ তুলছে তারা… বড়ো বেশি জানান দিচ্ছে নিজেদেরকে…
৫
কুসুদামের সামনে সামনেই এগোচ্ছিল কৃণাত। কৃণাতের সামনে আরও একজন পরামানব। ওদের তিনজনকেই বিয়াল্লিশ নম্বর কক্ষের দিকে পাঠিয়েছে দলনেতা। কৃণাতের সন্দেহ কুসুদাম হয়তো গোপনে নির্দেশ দিয়েছে দলনেতাকে। এমনকী কুসুদামের যে সহচরটা অদৃশ্য হয়ে গেছে তার সম্পর্কে দলনেতা একটা বার্তাও প্রক্ষেপ করল না। জাতীয় গ্রহসংঘের একজন সেনানায়কও শেষমেশ শূন্যচারীদের লোক!
এখন প্রজ্ঞানীদের খোঁজার নাম করে কুসুদাম যে তাকে নিয়ে কোথায় চলেছে কে জানে। বিয়াল্লিশ নম্বর কক্ষে তারা থামেনি। অবশ্য সেখানে কেউ ছিলও না। কিন্তু ফিরে যাওয়ার বদলে কুসুদাম তাকে নিয়ে চলেছে গবেষণাকেন্দ্রের আরও গভীরে। আরও প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
‘এখানে কীসের গবেষণা হচ্ছিল?’ কৃণাত জানতে চাইল।
‘ইতিহাসের।’ সংক্ষেপে বলল কুসুদাম।
ইতিহাস! ইতিহাসের গবেষণা আবার কী! পরামানবদের ইতিহাস তো সকলেই জানে। সাড়ে ছয় হাজার সৌরাবর্ত ইতিহাসের প্রতিটি বিজয়, প্রতিটা বাঁক, প্রতিটি গলিপথ সকলেই জানে। বৃহস্পতির জাতীয় ইতিহাসঘরে সব রাখা আছে। অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই যে, ইতিহাসের গবেষণার জন্যে প্রকৃষ্ট স্থান এই নেপচুন।
এইখানে থেকেই সাড়ে ছয় হাজার সৌরাবর্ত আগে প্রথম শূন্য-লঙ্ঘন সেতু পার করে পৃথিবীতে গেছিল পাঁচ পরামানব। অবশ্য সেই সেতু ছিল প্রাকৃতিক। সেই সেতুর তরঙ্গ-তথ্য দিয়েই পরবর্তীকালে প্রজ্ঞানীরা বানিয়ে তোলেন কৃত্রিম শূন্য-লঙ্ঘন সেতু। পরামানবদের ইতিহাস তো সকলেই জানে। আর তার আগের ইতিহাস সবই অবমানবদের। সে ইতিহাস কে জানতে চায়? যতসব বিকৃত জান্তব অপবিজ্ঞানের ইতিহাস। ইতিহাস নিয়ে কিসের গবেষণা?
কৃণাতের চিন্তাতরঙ্গ ছিন্ন হল আরেকজনের আগমনে। কুসুদামের সেই সহচর যে এই মহাকাশ-আলয়টিতে ঢুকেই অদৃশ্য হয়ে গেছিল সে এসে দাঁড়িয়েছে।
কুসুদাম নিজের বার্তা প্রক্ষেপ গোপন করল না। সে প্রশ্ন করল, ‘কী অবস্থা প্রজেক্টের?’
‘নিজের থেকেই হিমযন্ত্রের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। হিমকক্ষের মাঝেই আছে তবে মস্তিষ্কের অবস্থা আশানুরূপ নয়।’
‘কতক্ষণ হিমঘুম ভেঙেছে?’
‘প্রায় এক সৌরপল আগে। মানে আমরা যখন উড়াল-যান থেকে যাত্রা শুরু করেছি প্রায় তখন।’
‘ঘুম ভাঙল কেন?’
‘ঘুমের মধ্যে শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। হিমযন্ত্র তাই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই…’
‘হিমযন্ত্রের রিপোর্টটা দাও।’
সহচর ছোটো একটা জৈব-যন্ত্র তুলে দিল কুসুদামের আকর্ষে। সকলে তখনও এগিয়ে চলেছিল। কৃণাত কিছুই বুঝতে পারছিল না। কে জেগে উঠেছে! কেন তার জেগে ওঠা এত গুরুত্বপূর্ণ!
‘কৃণাত! এবার তোমার কাজের সময় এসেছে।’ কুসুদাম বার্তা দিল।
একটা কক্ষের সামনে এসে তারা দাঁড়িয়েছে। ভিতরের অংশটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ছোটোখাটো একটা হিমকক্ষ। কক্ষের মাঝখানে একজন অবমানব নিজের হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। তাদের দিকে পিছন ফিরে। পাতলা চামড়ায় মেরুদণ্ডের কশেরুকাগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
‘ওই যে অবমানবটাকে দেখছ। ওর নাম ‘তাশা’। হিমঘুমে সে ঘুমিয়ে আছে আজ সাড়ে ছয় হাজার সৌরাবর্ত। যেভাবেই হোক এই অবমানবটিকে নিয়ে এই গবেষণাকেন্দ্র থেকে বার করে, আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে গোষ্ঠীর কাছে। অবমানবটি ঘুমন্ত থাকলে কোনো অসুবিধা ছিল না, কিন্তু এক্ষণে তুমি ছাড়া এ কাজ আর সম্ভব নয়। তুমি হিমঘরের ভিতরে ঢোকো। অবমানবটিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটি সুরক্ষা-বলয় পরিয়ে দিতে হবে।’
বুঝিয়ে সুঝিয়ে! কৃণাত জীবনে কোনো অবমানবের সঙ্গে কখনও কথা বলেনি। কথা বলা তো দূর, সে কোনো অবমানব দেখেওনি!
‘ওর মস্তিষ্কের উপরে তরঙ্গের প্রক্ষেপ করে এই কাজটা তো অতি সহজেই করা যায়।’
‘না। এই অবমানবটির মস্তিষ্কের কণামাত্র ক্ষতি যেন না হয়। প্রাচীন পরামানবদের নির্দেশ আছে। এমনকী এই অবমানবটিকে কোনোদিন জোর করে জাগাবার নির্দেশ ছিল না। যদি না একান্তই ও নিজের থেকে জেগে ওঠে। তাই আমরা শুধু ওর শরীরটাকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। এই হিমযন্ত্রটি বিশেষভাবে ওই অবমানবের জন্যেই প্রস্তুত করা হয়েছিল।’
‘প্রাচীন পরামানবদের নির্দেশ! এই অবমানবটি কী এমন বিশেষ?’
‘ওই জাগ্রত মস্তিষ্কটি খুব দামি। প্রাচীন পরামানবরা সন্দেহ করেছিলেন এই অবমানবটির স্মৃতিতে এমন কিছু আছে যা আমাদের পরামানবদের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ না নিজের থেকে সেই স্মৃতি জাগ্রত হয় ততক্ষণ ওই মস্তিষ্কটা উপরে জোর খাটানো সম্ভব নয়।’
‘আমার কাজটা কী?’ কৃণাত শান্তভাবে জানতে চাইল। সে বুঝতে পারছিল কুসুদামের বিরোধীতা করে কোনো লাভ নেই। এই মহাকাশ-আলয় থেকে বার হবার যদি কোনো রাস্তা থেকে থাকে তাহলে সে রাস্তা কুসুদামের জানা। এই অবমানবটা, হবে হয়তো কিছু একটা মূল্যবান জিনিস, এটাকে নিয়েই কুসুদাম ফিরে যেতে চাইছে।
‘তুমি ভিতরে গিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওটাকে এই সুরক্ষা-বলয়টা পরিয়ে দাও। সুরক্ষা-বলয়ের মাত্রাটা অবমানবদের হিসাবে একটু বাড়ানোই আছে।’
‘এই সামান্য কাজটার জন্যে আমি কেন? তোমার যে কোনো সহচরই তো…’
‘অবমানবের গ্রহণযোগ্যতায় আমরা অতি ভয়ঙ্কর দর্শন প্রাণী। অবমানবদের বুদ্ধিমত্তা যে পর্যায়ের তাতে তাদের গ্রহণ যোগ্যতার একটা নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের দেখলে যদি ওর মস্তিষ্কে কোনো ক্ষতি হয়! একমাত্র তুমিই পরিবর্তন করতে পার নিজের রূপ… হ্যাঁ হ্যাঁ কৃণাত অস্বীকার করো না। আমি জানি তুমি কে। আমার নির্দেশ হল, এখন তুমি নিজেকে অবমানবে রূপান্তরিত করবে।’
অবমানবের রূপ নিতে হবে! এত হেনস্থাও কৃণাতের জীবনে ছিল। বিষম-ঘৃণায় তার অন্তঃমস্তিষ্ক পর্যন্ত কাঁপছিল। এরকম অশ্লীল কাজের জন্যে জাতীয় গ্রহসংঘ যেমন অনায়াসে কুসুদামকে সৌরজগতের বাইরে নির্বাসনে পাঠাতে পারে; তেমনি কৃণাত নিজেও সারাজীবনের জন্য পরামানব-সমাজে অগ্রহণীয় হয়ে যাবে।
‘এখানে কেউ নেই কৃণাত। কেউ জানবে না।’ কুসুদাম প্রবোধ দেওয়ার মতো বলে উঠল।
কৃণাত স্পষ্ট বুঝতে পারছে কুসুদাম তাকে এখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না। খুব সম্ভবত ওই অবমানবটাকে ছাড়া কুসুদাম কাউকেই ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না। তার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
কুসুদামের কথামতো কৃণাত রূপ পরিবর্তন করতে শুরু করল। তার শরীরটা অনান্য পরামানবদের থেকে কিঞ্চিৎ আলাদা। প্রায় জেলির মতো থকথকে তার শরীর, প্রয়োজনমতো যে কোনো ধরনের পরামানবের রূপ সে ধারণ করতে পারে। অথবা গজিয়ে নিতে পারে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। এই যেমন এখন সে পঞ্চেন্দ্রিয় তৈরি করছে শরীর জুড়ে। এইজন্যেই তো গ্রহসংঘের কাছে গুপ্তচর হিসাবে কৃণাতের এত দাম।
প্রথম যুগের পরামানবরা একরকম দেখতে ছিল। কিন্তু পরবর্তী পরামানবরা ক্রমশ নিজেদের ধারা অনুযায়ী বদলে গেছে। এই যেমন, কুসুদাম এক বিশালাকায় কেন্নোর মতো, তেমনি ষৃণের শরীর পরিবর্তিত হয়েছে তার নিম্নাঙ্গে। দশখানা পা আছে ষৃণের। ওই পায়েই তার সমস্ত শক্তি। আর সেই পা দিয়ে সে যে কোনো তলে এক এক লাফে এক কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ফেলতে পারে। ক্ষমতা অনুযায়ী নিজেদের শরীর পরিবর্তন করে চলে পরামানবরা। তবে কৃণাতের মতো এরকম ক্ষমতা আর কারোর নেই।
‘ওই অবমানবটার সঙ্গে স্বর-ক্ষেপ করে কথা বলো। সাবধানে বোলো। ওটা অত্যন্ত ভয় পেয়ে আছে। একটু এদিক ওদিক হলে হৃদযন্ত্র স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে।’
একথা কৃণাতকে বলে দেবার প্রয়োজন নেই। কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়েও কৃণাত অবমানবটার ভয়ের প্রক্ষেপ অনুভব করছে।
কুসুদামের থেকে সুরক্ষা-বলয়টা নিয়ে কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করল কৃণাত। অতি-সাবধানে। ভুল করেও সে যেন মেরে না ফেলে ওই অবমানবটিকে। এখন কৃণাতের বেঁচে থাকার জন্যে ওই অবমানবটাকেও বাঁচিয়ে রাখা খুবই দরকার।
৬
ছয়জনের দলটা নিয়ে পরামানব কোসা এগোচ্ছিল সাবধানে। কৃণাতকে কুসুদামের সঙ্গে যেতে দিতেই হল। কুসুদাম তার কিছু গোপন অপরাধের খবর রাখে। ইতিমধ্যেই এই অভিযানের ব্যাপারে তাকে শাসিয়ে রেখেছে কুসুদাম। শূন্যচারীগুলো নিপাত যাক—কোসা নিজের মনেই বলে উঠল। এই সৌরমণ্ডলীর কণামাত্র তথ্যও বুঝি ওদের আয়ত্ত্বের বাইরে নয়।
কক্ষটা পার হতে হতে কোসা আরেকবার শূন্য-যন্ত্রটাকে স্ফটিকের গায়ে লাগিয়ে দেখল, নাহ কিছুই ঘটছে না। যেভাবেই হোক এই মহাকাশযানের মেধষটাকে বন্ধ করতে হবে। একজন সেনানায়ক হিসাবে সে বর্তমান অবস্থার উপরেই জোর দেয়।
ষৃণ সকলকে বার্তা দিল, ‘আমরা এখন তেরো নম্বর গোলকের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছি।’
কোসা জানাল, ‘সামনেই একটা শূন্যলঙ্ঘন সেতু আছে। সেখানে আমরা অতীত তরঙ্গ প্রক্ষেপের বিচার করব। তারপর এগিয়ে যাব মহাকাশ-আলয়ের মেধষ-অঞ্চলের দিকে…’
একদিকে সকলে যেমন চুপচাপ এগোচ্ছিল, অন্যদিকে ষৃণ প্রচুর কথা বলতে বলতে যাচ্ছিল। রীতিমতো স্বরক্ষেপণ করে করে অবমানবদের মতো ‘কথা’ বলছিল সে। ষৃণের শরীর প্রচলিত পরামানবদের মতো নয়। তার শরীরে মুখগহ্বর সমেত স্বরযন্ত্র আছে, অনেকটা অবমানবদের মতোই। তবে একের বদলে একাধিক। বোঝাই যায় ষৃণ স্বরক্ষেপ করতে ভালোবাসে। হয়তো অবমানবদের কাছে থেকেই এইরকম স্বরক্ষেপ শিখেছে সে। রীতিমতো একটা সুরের মতো বার্তা সে প্রক্ষেপ করছিল তার স্বরযন্ত্রের মাধ্যমে। অনেকটা ওই কুড়িয়ে পাওয়া শব্দ-যন্ত্রের বার্তাটার মতো। বিরক্তিতে কোসার গলকম্বলের ভাঁজে ভাঁজে কানকোসমূহ ফুলে ফুলে উঠছিল। একবার সাবধান করল সে, ষৃণের স্বরক্ষেপ সামান্য কমলেও সে একেবারে থামল না।
বারো নম্বর গোলকে একটি শূল সেতু। কোসা ভেবেছিল এইখানেই সজ্ঞান হোক, অজ্ঞান হোক কিছু পরামানব অন্তত থাকবে… কিন্তু কেউ নেই। ফাঁকা করিডোর। কোসা অতীত-পরাতরঙ্গ বিচারের জৈব-যন্ত্রটা চালু করল। যন্ত্রটা ধীরে ধীরে অতীত বিচার করছিল, তরঙ্গ পাঠাচ্ছিল কোসার মস্তিষ্কে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শূল সেতু অঞ্চলের মাঝে কোসা যেন পিছিয়ে যাচ্ছিল। এক প্রকার অতীত-গমন।
কিন্তু এত ফাঁকা কেন! কিছুই নেই… এমনকী… এমনকী… কী একটা দেখে কোসা যন্ত্রটাকে থামিয়ে একবার সময় বিচার করল। তৃতীয়বারের সেনাবাহিনীর দলটা তো এই শূল সেতু অতিক্রম করেই মহাকাশ-আলয়ে ঢুকে এসেছিল। জৈব-যন্ত্র তো অতীত-বিচারে সেই সময়টাকেও পেরিয়ে গেছে। তরঙ্গ বিচারে স্পষ্ট বোঝা গেল শূন্য-লঙ্ঘন সেতু চালু হল, কিন্তু যারা এসে ঢুকল তাদের তরঙ্গ আর খুঁজে পাচ্ছে না কোসা। দু-চারবার যন্ত্রটাকে কোসা চালু-বন্ধ করে দেখল, এই তো দিব্যি তাদের অতীত-তরঙ্গরেখা বিচার করছে যন্ত্রটা। এই তো তারা এসে ঢুকল এই অঞ্চলে। এসে দাঁড়াল শূল সেতুর সামনে… চালু করল যন্ত্র… তাহলে… তাহলে… তাহলে কী সেই তৃতীয় দলটা এসে ঢোকার পর, এখান দিয়ে এমন কোনো তরঙ্গ প্রবাহ খেলে গেছে যা পরামানবদের অতীত তরঙ্গরেখাকেও মুছে দিয়েছে একেবারে!
কোসার বর্তুলাকার অবয়বটি প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে উঠল। মেধষ মস্তিষ্কের এমন ক্ষমতা সম্ভব নয়! পরামানবদের তরঙ্গ প্রক্ষেপকে সম্পূর্ণভাবে মুছে দিতে পারে কোনো মহাকাশীয় তরঙ্গপ্রভাব। যেমন, তেমন তেমন সৌরঝড় উঠলে বুধ গ্রহ থেকে পরামানবদের তরঙ্গরেখা মুছে যায়। কিন্তু এখানে নেপচুনে! সূর্য থেকে এতদূরে! এ তো পরামানবের বোধ-জ্ঞানেরও বাইরে।
কোসা সকলকে সুরক্ষা-বলয়টিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাখার জন্যে বার্তা দিল। যদি কোনো আধিবৈশ্বিক প্রক্ষেপণে সত্যি সত্যিই মেধষটি অতিমাত্রায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে… না, কোসার যুক্তি কিছুতেই তাকে ওই চিন্তন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিচ্ছে না। ও তো চিন্তন নয়, ওটা কল্পনা। পরামানবরা কল্পনা করে না। কোসা ঠিক করল, এই গবেষণাকেন্দ্রের মেধষ-অঞ্চলটিকে সে একেবারে ধ্বংস করে দেবে। অবশ্য তার উপর নির্দেশ ছিল মেধষটিকে বন্ধ করে, শেষ মুহূর্তের তরঙ্গগুলো সংগ্রহ করার। কিন্তু এখন সে রীতিমতো বিচলিত বোধ করছে।
কোসার নির্দেশমতো সকলে এগিয়ে চলেছিল। সকলের সামনে নিশ্চিন্তে এগিয়ে চলেছে ষৃণ। সে রীতিমতো মধ্যসপ্তকে তান জুড়েছে। সুরেলাভাবে উচ্চারণ করে চলেছে শব্দের পর শব্দ…
তারা কখন যেন মেধষ অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে। ষৃণের মন্ত্রোচ্চারণের মতো কথাগুলো শুনতে শুনতে কোসা খেয়ালই করেনি! একটা অদ্ভুত তরঙ্গ খেলে বেড়াচ্ছে এখানে… বাতাসে বাতাসে… এ কি মেধষের প্রেক্ষণ! নাকি এটা অন্য কোনো ভাইরাসের আক্রমণ!
সে খেয়াল করল, অন্যান্য পরামানবরা বিচলিত হয়ে উঠছে… সামনের দৃশ্যটি দেখে কোসাসহ সকলেই হতবুদ্ধি হয়ে গেছে… এই মহাকাশ-আলয়ে কোনো মেধষ নেই… সামনের বিশাল কক্ষের ভিতরে প্রকাণ্ড জৈব মস্তিষ্কটি সম্পূর্ণরূপে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। প্রতিটি শিরাকে কে যেন চিবিয়ে ছিবড়ে করে দিয়েছে… শুষে খেয়েছে প্রতিটি স্নায়ু… প্রতিটি কোশ… প্রকাণ্ড মস্তিষ্কটি ছেত্রে ভেদ্রে পড়ে আছে… নীচের মেঝেতে বয়ে যাচ্ছে রস আর রক্তের মিশ্রণ…
দৃশ্যটা কোসার মতো পোড় খাওয়া পরামানবের স্নায়ুর পক্ষেও অত্যাধিক। বাকিরা আগেই শিউরে উঠে ছিটকে সরে গেছিল কক্ষের সামনে থেকে। কোসা ধীরে ধীরে নিজের স্নায়ুমণ্ডলীকে আয়ত্তে আনল। তারপরে কক্ষে ঢুকে অতীত-বিচারের যন্ত্রটা চালু করল। কীভাবে এরকম অস্বাভাবিক ব্যাপারটা ঘটল! এরকম ভয়ংকরভাবে একটা মেধষকে হত্যা করার কথা কোনো পরামানব চিন্তা করতে পারে না! না, শুধু চিন্তা নয়, এর প্রয়োজনীতা কী! এ সম্ভব নয়…
কোসা এই ঘরেও কোনো অতীত-তরঙ্গ পেল না। এখন মনে হচ্ছে যেন এই গবেষণাকেন্দ্রটির কোনো অতীত কখনও ছিল না… কোসার মস্তিষ্ক কেন বারংবার যুক্তি-চিন্তনের সীমারেখা পেরিয়ে যেতে চাইছে। এটা উচিত নয়। আচ্ছা এই যে অচেনা তরঙ্গ প্রবাহ খেলে বেড়াচ্ছে, কোসার মস্তিষ্ক অনুভব করতে পারছে; কিন্তু সুরক্ষা-বলয়… এটাও অস্বাভাবিক…
অনান্য পরামানবদের বারংবার বার্তাঘাতে, কোসা কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরে পরামানবরা রীতিমতো উত্তেজিত। ষৃণ কিছুতেই তার স্বরক্ষেপণ থামাচ্ছে না। কী এক অজানা ভাষায় বকে চলেছে সে—ষৃণ বলেই যাচ্ছিল, বলেই যাচ্ছিল, থামছিল না… সে যে কি বলতে চাইছে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না… একটানা একঘেয়ে সুরে সব ক-টা স্বরযন্ত্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করে সে বলে যাচ্ছিল।
আশপাশের বাতাস ক্রমে ভারী হয়ে উঠছে। ষৃণের এই শব্দ-উচ্চারণে… নাকি সেই অচেনা তরঙ্গটা! কোসার কেমন যেন মনে হল, ষৃণ যেন সেই অজানা তরঙ্গ উৎক্ষেপণকারীকে ডেকে আনছে। তার বার্তায় সকলে মিলে ষৃণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
কেউ ধরবার আগেই, ষৃণ লাফিয়ে উঠল… ছ-লাথিতে ছিটকে ফেলল সে সকলকে… কেউ নিজেকে সামলাবার আগেই একলাফে সে পুরো করিডোর পার করে চলে গেল অন্য একটা দিকে… আরেক বিশাল লাফে সে সকলের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল… কিন্তু তখনও দূর থেকে তার মন্ত্রোচ্চারণের মতো বিকট স্বরক্ষেপণ শোনা যাচ্ছিল…
আরাধনা কর… আরাধনা কর… হে মহাপ্রাচীন… হে প্রাকনক্ষত্রতর… হে বিধাতা আমাকে গ্রহণ কর… গ্রহণ কর… তোমরা আরাধনা কর তার… সে প্রথম… তারাই প্রথম… তারা চায়… সে চায়… আরাধনা কর আমাদের মহাবিধাতার… বিধাতা ক্ষুধার্ত… যুগ যুগন্তর তারা ক্ষুধার্ত… তারা তুলে নেবে খাদ্য… এই মহা মহা অনন্তের বুক থেকে তুলে নেবে খাদ্য… হে প্রাকসময়ের বিধাতা… আমরা তোমার আরাধনা করি… আরাধনা করি… আরাধনা করি সে মহা-বিধাতৃ-এর… সে মহাপ্রাচীনের… মহা-খাদকের…
৭
তাশা!
কে যেন ডাকল তাকে। তাশার মনে হল সে বুঝি জন্ম জন্মান্তর বাদে নিজের নামটা শুনল।
তাশা!
আবার কেউ তাকে ডাকল। তাশা বুঝল শব্দটা তার পিছন থেকেই এল। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণীটা তাকে নাম ধরে ডাকছে! কী ভয়ঙ্কর! কই এতক্ষণ তো ডাকেনি! তাশার সমস্ত শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল।
‘তাশা, তুমি ভয় পেও না।’
‘ভয়’ শব্দটা বড়ো অদ্ভুতভাবে উচ্চারণ করল প্রাণীটা, যেন সে শব্দের মানে বোঝেনি। কেউ কী তাশাকে সাহায্য করতে চাইছে? নাকি আরও বড়ো বিপদের সূচনা এটা? তাশা আরও কুঁকড়ে গিয়ে দেওয়ালের কোণে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল। শক্ত করে চেপে ধরল হাতের মুঠোতে রাখা নলটার সূচালো অংশ।
‘তাশা। তুমি বহুকাল বাদে হিমঘুম থেকে উঠেছ। এই মুহূর্তে যদি তুমি নিজেকে শান্ত না করো, তাহলে তুমি খুব শিগগিরি অসুস্থ হয়ে পড়বে।’
এই একই কথা এর আগে সে শত সহস্রবার শুনেছে, তাশা চোয়াল শক্ত করল। তাকে নিশ্চয়ই কোনো ভয়ংকর গবেষণার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। হয়তো এটা একটা পরীক্ষা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যেমন মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে গবেষণা হত। সেইরকমই হয়তো ভয়ংকর স্বপ্ন দেখিয়ে দেখিয়ে মেরে ফেলার কোনো একটা পরীক্ষা এটা।
তাশা শিউরে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পেটের মধ্যে পাক দিল। তাশা দু-হাতে মেঝেটাকেই খামচে ধরার নিষ্ফল চেষ্টা করতে করতে ওয়াক তুলল। এখন আর পেটের মধ্যে জলও নেই। সামান্য আঠাল লালা বেরিয়ে এল মুখ থেকে। তাশার সারা শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে সে এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে। সে জানে তার পিছনে কে দাঁড়িয়ে আছে… যে দাঁড়িয়ে আছে সে কোনো মানুষ নয়… সে এক না-মানুষ, শুধু মানুষের রূপ নিয়েছে ওটা… আবারও তার সেই ভয়ানক স্বপ্ন শুরু হবে।
‘এটা কোনো পরীক্ষা নয়, তাশা। এটা কোনো স্বপ্ন নয়। তুমি শান্ত হও। ভয় পেও না। তুমি কেন ‘স্বপ্ন’ দেখে ‘ভয়’ পেয়েছ আমরা জানি না। তোমার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। তুমি যদি আরও ভয় পাও তাহলে তোমার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে।’—পিছনের স্বরটি এক নাগাড়ে একইরকম অনুভূতিহীন ঠান্ডা বালক কণ্ঠে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল।
উফ্, ওই না-মানুষটা তার মনের কথাও পড়তে পারছে। আবারও সে আরেকটা স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। প্রতিবার এই এক বকবকানি। না-মানুষটা যত কথা বলছিল ততই তাশার মনে পড়ে যাচ্ছিল এর আগেও এই একই কথা সে বারংবার শুনেছে। এর আগেও সে কতবার কে জানে ওই প্রেতটাকে মারার চেষ্টা করেছে। তত বারই বিফল হয়েছে। কিন্তু এইবার তাশা আত্মহত্যা করবে। তাশা যদি মরে যায়… তাহলেই… তাহলেই এই স্বপ্ন থেকে তাশার মুক্তি। এতক্ষণ সে এই আশাতে বসেছিল স্বপ্নটা বুঝি এবারে শুরু হবে না। কিন্তু ওই যে প্রেতটা এসে ঢুকেছে। এবার আবারও সেই সারবদ্ধ দৃশ্যপট তাশাকে ঘিরে ফেলবে, যেখানে তাশা অসহায়। খেলার পুতুল।
তাশা ভাঙা নলের ছুঁচালো অংশটা নিজের গলায় বসিয়ে দেবার চেষ্টা করল।
তাশা কথাটা ভাবতেই, কৃণাত হকচকিয়ে গেছিল। তার মাথার মধ্যে কুসুদাম চেঁচিয়ে উঠল, ‘করছটা কী। চেপে ধর ওটাকে। ওটা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে।’
‘আত্মহত্যা! সে আবার কী? কেন?’ আত্মহত্যার মাঝে হত্যা অংশটা বুঝে নিল কৃণাত।
‘তোমায় বলেছিলাম না ‘ভয়’ অনুভূতিটা বিধ্বংসকারী অনুভূতি।’ কুসুদাম আবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘কৃণাত! নিজের তরঙ্গশক্তিকে বশে রাখো তুমি। অবমানবটার উপরে ব্যবহার করো না।’
কৃণাত এক হাতে তাশার হাত চেপে ধরেছে, অন্য হাতে আটকাতে গেছে নলটার মুখ। তার তালু ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে সুতীক্ষ্ণ শলাকা। রক্ত পড়ছে।
তাশা খানিক ভয়ে খানিক বিস্ময়ে মুখ ফেরাল কৃণাতের দিকে। পরক্ষণেই তার মনে হল, কই এর আগে তো অন্য কোনো স্বপ্নে এরকম রক্ত ঝরেনি। এর আগে কখনও তো না-মানুষটা স্পর্শ করেনি তাকে! স্বপ্নটা কি প্রতিবারে সামান্য হলেও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে?
অন্য সময় হলে কৃণাত হয় তো একজন অবমানবকে ছোঁয়ার কথা কল্পনাও করতে পারত না। তাশা মুখ ফেরাবার সঙ্গে সঙ্গে সে ভীষণরকম চমকে উঠল। না কোনো মস্তিষ্ক-তরঙ্গ নয়। কোনো অভিক্ষেপ নয়। শুধুমাত্র এই অবমানবটার ঝকঝকে চোখ দুটো দেখে তার মনে হল অবমানবটাকে সে চেনে। অবমানবটাও যেন তাকে চেনে। কিন্তু… কিন্তু… কৃণাত তো কোনো অবমানবকে চেনে না। এই সৌরজগতেই কোনো অবমানব তো আর নেই…
‘কালক্ষেপ করছ কেন? সুরক্ষা-বলয়টা পরিয়ে দাও।’ অন্যদিকে কুসুদাম তার মাথার মধ্যে ক্রমান্বয়ে বার্তা পাঠাচ্ছে।
এখন এই অবমানবটা আর আগের মতো কাঁপছে না। বরং কৃণাতের মনে হল এর স্নায়ুমণ্ডলী অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে। কে জানে হয়তো স্পর্শ অবমানবদের মানসিক ক্ষেত্রে অনেকখানি প্রভাব রাখে। অতিকষ্টে নিজের ঘৃণা-বিরক্তি লুকিয়ে কৃণাত বলে উঠল, ‘তাশা। তুমি শান্ত হও। এখানকার পরিবেশ তোমার পক্ষে ভালো নয়। তুমি এটা পরে নাও। এটা তোমায় সুরক্ষা দেবে।’
আচমকা কৃণাত শুনল অবমানবীটা বলছে—তুমি পালাতে চাও ওই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা না-মানুষটার হাত থেকে? শেষ হিমকক্ষে রাস্তা আছে…
কৃণাত স্নায়ুগুলো নিমেষে খর হয়ে উঠল। সে অনুভব করল, এই কথাটা উচ্চারণের আগের মুহূর্তেই অবমানবীটার মস্তিষ্কের মধ্যে একাধিক স্মৃতি গজিয়ে উঠল।
কৃণাত বুঝি আলোক-তরঙ্গের চেয়েও দ্রুত কাজ করল। সে অঙ্গের ব্যবহার করে একদিকে তাশাকে পরিয়ে দিল সুরক্ষা-বলয়। অন্যদিকে মস্তিষ্কের ব্যবহারে নিমেষে পড়ে ফেলল তাশার স্মৃতিগুলো। এই কক্ষের স্মৃতি। তার আর কুসুদামের যুদ্ধের স্মৃতি। কখনও সে হেরে গেছে… কখনও কুসুদাম হেরে গেছে… এছাড়া… এছাড়া… একটা পালানোর রাস্তা!
সম্পূর্ণ ঘটনাটা অতি দ্রুত ঘটল, তাশা কথাটা অর্ধেকও বলে ওঠার আগেই হিমঘরের বন্ধ দরজাটা একটা বিকট শব্দ করে খুলে গেল। তাশা এক ঝলক দেখল কুসুদামকে। পুরো সে দেখতেও পারেনি, কৃণাত তার সুরক্ষা-বলয় চালু করে দিয়েছে। তাশার চোখের সামনে একটা আধা স্বচ্ছ সবজেটে পর্দা নেমে এল। পরক্ষণেই তার মনে হল সে বুঝি আকাশে উড়ে গেল। আবার, আবার সে স্বপ্নে ঢুকে গেছে। আবার তাকে নিয়ে যুদ্ধ চলছে… তাশার আচমকা মনে পড়ল এর আগে পাঁচ বার ওই ভয়ংকর না-মানুষটা জিতেছে, আর তিনবার জিতেছে এই না-মানুষটা। এবার কে জিতবে? অবশ্য যেই জিতুক তাশার ভবিতব্য একই।
হিমকক্ষের বাইরে করিডোরের একপাশে ছিটকে পড়ল তাশা। অবশ্য সুরক্ষা-বলয় তাকে আঘাত থেকে রক্ষা করল। তখন তাশা ভাবছে—ওই বিশালকার বীভৎস কেন্নোর মতো না-মানুষটা জিতলে এখুনি তার এই অন্ধ অবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। সে তখন দেখতে পাবে সেই অতি ভয়ংকর দৃশ্য। আর যদি এই মানুষ রূপধারী না-মানুষটা জেতে তাহলে শুরু হবে ইঁদুর-বেড়াল খেলা…
তাশা যখন এইসব ভাবছে তখনই তরঙ্গটা অনুভব করল কৃণাত। এক অপরা অচেনা তরঙ্গের উদ্ভাস।
এ যেন এক তরঙ্গ নৃত্য… ছন্দহীন… তালহীন… যুক্তিহীন… কি এক আদিম জান্তব আকাঙ্ক্ষায় নেচে চলেছে তরঙ্গটা। নিরাকার রেখাহীন নৃত্য… ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে… ক্ষণে মিলিয়ে যাচ্ছে, ক্ষণে ফিরে আসছে দ্বিগুণ ঢেউ তুলে… এক অজানা তরঙ্গ প্রক্ষেপ! কি যেন এক ক্রূর বার্তা লুকিয়ে আছে… ঠিক ধরা যাচ্ছে না… ঠিক পড়া যাচ্ছে না… অথচ পাক খেয়ে খেয়ে বিভীষিকার মতো ছুটে আসছে তরঙ্গটা…
এক মুহূর্তের অন্যমনস্কতা, কুসুদামের দুই সহচর কৃণাতকে কাবু করে ফেলল। কৃণাতের হাতের ক্ষুদ্র অস্ত্রটা ছিটকে পড়ল ঘরের এক কোণে… কুসুদাম তার বিশাল শরীর নিয়ে ফুঁলে ফেঁপে উঠেছে। লম্বা ল্যাজের পিছনে এক ভয়ংকর হুল। ওই প্রাণঘাতী হুলের এক ছোবলেই যে কোনো পরামানব মৃত-চেতন হয়ে যাবে।
করিডোরের দেওয়ালের সঙ্গে কৃণাতকে চেপে ধরেছে কুসুদামের দুই সহচর। হুলটা উঠছে… এবার নেমে আসবে কৃণাতের শরীরে… আচমকা কুসুদাম থমকে গেল… থমকে গেল বাকিরাও… সুরক্ষা-বলয় ভেদ করেও তরঙ্গটা ক্রমে কৃণাতকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল… কৃণাতের মতো কুসুদামও কি টের পাচ্ছে ওই তরঙ্গ… এবার আর টের পাওয়া নয় সকলেই দেখতে পেল তরঙ্গ বিকিরণকারীকে।
কুসুদামের পিছনের করিডোর ধরে ছুটে আসছে এক ধোঁয়ার মেঘ… কুসুদাম যেন নড়তে পারছে না… ধোঁয়ার মেঘটা এক লহমায় কুসুদামকে ঘিরে ফেলল… কুসুদামের মস্তিষ্ক থেকে এক ভয়ংকর আর্তনাদের মতো তরঙ্গের বিক্ষেপ হল… সে আর্তনাদে এমন যন্ত্রণার বিকিরণ যে কৃণাত পর্যন্ত অসাড় হয়ে গেল…
কুসুদামের অন্তিম আর্তনাদকে ডুবিয়ে নীলচে-বেগুনী ধোঁয়ার মধ্যে থেকে উঠে এল এক অনন্ত নাদ।
ওওঁওঁমমহ্মহ্মঅঁঅঁঅ…
৮
তাশা বুঝি জ্ঞান হারিয়েছিল। যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন সে দেখল একটা অন্ধকার কক্ষ। অন্ধকার হলেও কোথা থেকে যেন সামান্য আলোর আভাস আসছে। কিছু একটা নরমসরম গদির মতো জিনিসের উপর সে শুয়ে আছে। তাশা মাথা ফেরাল একপাশে। তাকে ঘিরে একটা সবজেটে পর্দার মতন কী যেন ভাসছে। মনে হচ্ছে, একটা সবুজ স্যাঁতসেঁতে থলের মধ্যে তাশা শুয়ে আছে। থলের বাইরে দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট এক মানুষের মতো অবয়ব। তাশা উঠে বসল।
এতক্ষণে তার মনে হল এটা কোনো স্বপ্ন নয়, এটা বাস্তব ঘটনা। ওই না-মানুষটা তাকে বাঁচিয়েছে। সে অস্থির হয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইলে, সবসমেত হুমড়ি খেয়ে পড়ল। না-মানুষটা হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে ফেলল।
‘তুমি এখন বেশি নড়াচড়া কোরো না। এই সুরক্ষা-বলয় তোমাকে তোমার জৈবদেহের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োজনীয় বস্তু সরবরাহ করবে। তোমার জৈব-দেহ খুবই দুর্বল। বেশি নড়লে তোমার ক্ষতি হবে।’
কী বিশ্রী নিস্পৃহ জলজ স্বর… শব্দগুলো যেন থকথকে পাঁক মেখে উঠে আসছে— অন্য কেউ হলে ওই স্বর শুনেই হার্টফেল করত, তাশা ভাবল।
‘আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’
‘সুরক্ষা-বলয়ের দৃশ্যগ্রহণের ক্ষমতা খানিক কমিয়ে রাখা আছে। অবমানবদের মস্তিষ্কের গ্রহণ যোগ্যতার একটা নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা একটা বর্জ্য-কক্ষের মধ্যে আছি। এখানের অবস্থা ঠিক গ্রহণযোগ্যতার…’
এই না-মানুষটা তাশাকে অবমানব বলছে! তার থেকেও বড়ো কথা এ ব্যাটা তাশার মন পড়তে পারে। মানুষ কবে এত উন্নত হল! তাশা কি হিমঘুমের মাঝে অনেকটা সময় পার করে ফেলেছে। এটা কোন সাল? কত দিন ঘুমিয়েছে সে? কোথায় আছে সে? অজস্র প্রশ্ন তাশার মাথার মধ্যে ভিড় করছিল।
—মানুষ উন্নত হয়নি। আমরা পরামানব। তুমি আছ নেপচুন গ্রহের কক্ষপথে ঘুরন্ত এক মহাকাশ-আলয়ে। এটা ছ’হাজার চারশো পঞ্চাশ সৌরাবর্ত। পার্থিব বছরের হিসাব আমরা করি না। তবে বলতে পারি, এই হিমযন্ত্রের মধ্যে তুমি ঘুমিয়ে আছ সাড়ে পাঁচশো পার্থিব বছর।
মাত্র সাড়ে পাঁচশো বছর! এর মধ্যে মানুষ এত কিছু করে ফেলল! তাশা ভাবল।
—মানুষ নয়, আমরা পরামানব। আমরা মানুষ নই। তোমরা মানুষ, অবমানব। আমরা ভিন্ন। তোমাদের থেকে আমাদের জিনের গঠন ভিন্ন। আমাদের কোশের গঠন ভিন্ন। আমাদের খাদ্য তোমাদের সহ্য হয় না। আমাদের বায়ুমণ্ডল তোমাদের কাছে বিষাক্ত।
না-মানুষটার কণ্ঠস্বর একটু রাগী রাগী ঠেকছিল। বেশি ঘাঁটানো ভালো নয় বুঝল তাশা। কিন্তু, তাহলে মানুষ কোথায়? প্রশ্নটা করল তাশা।
‘অবমানবরা আর নেই।’
নেই!
‘এখন শুধু আমরা আছি। আমরা বিবর্তিত হয়েছি।’
গভীর শোকে তাশার দৃষ্টি শূন্য হয়ে গেল। তাশা প্রায় বোধহীনের মতো ঝাপসা সবজে পর্দা ভেদ করে তাকিয়ে থাকল না-মানুষটার অবয়বের দিকে।
কিছুক্ষণ পরে না-মানুষটা স্বরটাকে যথাসম্ভব কোমল করুণ করে বলল, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে তোমাদের অনুভূতি অত্যন্ত জোরালো হয়। আমার পরা-মস্তিষ্ক পর্যন্ত তাল সামলাতে পারেনি। আমরা জানি না দুঃখ কাকে বলে, কিন্তু তোমার জন্যে আমি দুঃখিত, তাশা।’
অন্যসময় এত করুণ, এত কোমল স্বরে হয়তো তাশার চোখে জল আসত; কিন্তু এখন আবেগটা অত্যন্ত বিকৃত লাগল তাশার।
কৃণাত তখন ভাবছিল—তাশা। তুমি কি জানো, তুমি এক অদ্ভুত অবমানব। এই অভিযানে এসে থেকে আমি ভাবছিলাম কেন কুসুদাম একটা অবমানবকে এত প্রাধান্য দিচ্ছে। এখন আমি খানিক বুঝতে পারছি কেন তুমি এত জরুরি। অবশ্য এই মহাকাশ-আলয়ের বায়ো-কোয়ান্টাম মস্তিষ্কটা বেঁচে থাকলে তোমার ব্যাপারে আরও অনেক কিছু আমি জানতে পারতাম। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। বেশির ভাগ তথ্যই মুছে গেছে। তোমাকে নিয়ে জাতীয় গ্রহসংঘে ফেরত না গেলে তোমার সম্পর্কে নতুন করে কিছু জানা সম্ভব নয় আমার। তোমার ওই মস্তিষ্ক স্মৃতি, তোমার স্বপ্ন আমাকে বাঁচিয়েছে শত্রুর হাত থেকে।
দুই সহচর নিয়ে কুসুদামকে গ্রাস করেছে ওটা। অবশ্য সেসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করার জন্যে কৃণাত বসে ছিল না। কুসুদামের মরণ আর্তনাদ তাকে স্থবির করে দিয়েছিল। তবে ঘোর কাটাতেও কৃণাতের বেশি সময় লাগেনি। ধোঁয়ার কুণ্ডলী যখন তাদের দিকে তেড়ে আসছিল, তখন সে অজ্ঞান তাশাকে নিয়ে শেষ হিমকক্ষের দিকে ছুটেছিল। ওটা একটা খারাপ হিমকক্ষ, কোনো কারণে ওটার জৈবিক অবস্থান নষ্ট হয়ে গেছে। ওই হিমকক্ষটায় ঢুকতেই খুলে গেছিল বর্জ্যগ্রহণের দ্বার। তাদের দুজনকে সোঁ করে টেনে নিয়ে, সোজা ছুড়ে দিয়েছে এই মহাকাশ-আলয়ের বর্জ্য-অঞ্চলে। এখন এখান থেকে বেরোতে পারলে হয়।
বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে সে দলনেতাকে বার্তা পাঠিয়েছে তাদেরকে এখান থেকে উদ্ধারের জন্যে। কিন্তু কেউ উত্তর দিচ্ছে না। বস্তুত তাশাকে সুরক্ষা-বলয় পরিয়ে দেওয়ার সময় ‘মেধষটা ধ্বংস হয়ে গেছে’ এই বার্তাটা এসেছিল দলনেতার থেকে। তারপর থেকে আর কোনো বার্তা সে পায়নি।
‘আমরা অপেক্ষা করছি কেন? কেউ আসবে না… শুধু ওই দানোটা আসবে…’ তাশা বিড়বিড় করে।
‘ভয় পেও না, তাশা। যে কোনো জীব, যে কোনো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবিলা করার মতো অস্ত্র আমাদের দলের সঙ্গে আছে। আমরা পরামানব। বিবর্তনের শ্রেষ্ঠ জীব আমরা।’
ছাই… মনে মনে ভাবল তাশা। বলল, ‘এখানের বাতাস অসহ্য… এখান থেকে বার না হলে আমি মরে যাব…’
কৃণাত চমৎকৃত হচ্ছিল অন্য একটা ব্যাপারে, এই অবমানবটার মস্তিষ্কের স্মৃতি-অঞ্চলটা বেশ অদ্ভুত। অবমানবটার জৈবদেহ যত স্বাভাবিক সুস্থির থাকে, ততই মস্তিষ্কের তরঙ্গগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একই স্মৃতি বহুরূপে ওখানে সংরক্ষিত। এটা কি ওই ‘স্বপ্ন’-নামক ক্রিয়াটার জন্যে ঘটেছে? পরামানবদের মস্তিষ্ক স্বপ্ন দেখে না। সব অবমানবরাই কি এক স্মৃতিকে বহুরূপে মস্তিষ্কের সংরক্ষিত রাখতে পারে? নিশ্চয়ই নয়, এই অবমানবটা বিশেষ কিছু। এইজন্যেই তো শূন্যচারী গোষ্ঠী এটাকে হাতছাড়া করতে চাইছিল না। বহুরূপ স্মৃতি ছাড়াও এই অবমানবটার মস্তিষ্কের কিছু অংশে অতি গভীরে কিছু অতীত আছে। সেগুলো স্পষ্ট নয়। মস্তিষ্ক-বিচার যন্ত্রে হয়তো বিশ্লেষণ করা যেত অতীত স্মৃতিগুলোকেও।
কিন্তু স্পষ্ট স্মৃতিগুলোকেই কৃণাত শুধুমাত্র পড়তে পারছে। যত সময় যাচ্ছে তত একই স্মৃতি বহুরূপে ভেসে উঠছে… প্রথমদিকের লড়াইগুলোতে কৃণাত হেরে গেছে… পরে কুসুদামের সঙ্গে লড়াইতে কৃণাত জিততে শুরু করেছে… তারও পরে ওই বিকট ধূম্র-স্ফোটকের মতো ব্যাপারটার হাত থেকে পালাতে পেরেছে… কিন্তু অনেক স্মৃতিই অস্পষ্ট… যেমন কুসুদামের সঙ্গে লড়াইতে হেরে গেলে অথবা ওই ধোঁয়াটার সঙ্গে লড়াইতে হেরে গেল… তারপরের স্মৃতিগুলো স্পষ্ট নয়… স্পষ্ট নয় প্রথম দিকের স্মৃতিগুলো… প্রথম দিকের স্মৃতিগুলো… প্রথম কোনটা…
আচমকা নিদারুণ যন্ত্রণার একটা তরঙ্গ এসে কৃণাতকে চাবুকের মতো আঘাত করল। কৃণাত পলকে নিজেকে সামলে নিল। তাশার সুরক্ষা-বলয় কালো হয়ে এসেছে!
৯
আহত তাশাকে নিয়ে বর্জ্য-কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এল কৃণাত। আরেকটু হলে সে ভুল করে অবমানবটাকে মেরেই ফেলছিল। যতটা পেরেছে শুশ্রূষা করেছে কৃণাত। এখনও অবশ্য তাশা আচ্ছন্নের মতো তার পিঠের উপরেই পড়ে আছে। তবে তার মস্তিষ্ক আবারও ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে। কৃণাত তাশাকে বুঝিয়ে বলেছে, তার অনিচ্ছাকৃত ভুলের কথা। এমনকী ক্ষমাও চেয়েছে। পরামানবের ইতিহাসে কৃণাত বুঝি একের পর এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। এর আগে অবমানবের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা কেউ কখনও ভেবেছে! এখন বুঝি অবমানবটা অনেকটা সুস্থির হয়েছে।
বর্জ্য-কক্ষ থেকে বাইরে যাবার পথটা একটু ঘুরপথ হলেও কৃণাত ওটাকে খুঁজে পেয়েছে। অবশেষে কোসার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে সে। যখন কুসুদামকে আক্রমণ করেছিল ওই ধোঁয়ার মেঘটা, প্রায় একই সময়ে ওটা কোসাদেরও আক্রমণ করেছিল। এখন শুধুমাত্র তিনজন বেঁচে আছে কোসাদের দলে। ষৃণসহ আরও দুজন পরামানবকে ‘খেয়ে’ ফেলেছে ওই ধোঁয়াটা।
কোসার মতে ওই দুটো ধূম্র-স্ফোটক আছে এই গবেষণাকেন্দ্রে। কিন্তু কৃণাতের মনে হচ্ছে ওটা একটাই জীব। অবশ্য কোসা এখন বাইরের দিকের সমস্ত গবেষণাকেন্দ্রটাকেই ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। কৃণাতকে সে নির্দেশ দিয়েছে গবেষণাকেন্দ্রের একদম অতলের দিকে চলে যেতে। যেখানে প্রথম যুগের স্থাপত্য আছে।
সেই সময়ই কৃণাত খুঁজে পেয়েছিল এই ধাতব পাইপের বর্জ্য-পথটা। সে আবিষ্কার করেছিল সে এই গবেষণাকেন্দ্রের একদম প্রথম যুগে তৈরি একটা অংশ দেখছে। খুবই সরু, ক্ষীণ ধাতব পাইপের মতো। কৃণাতের সুরক্ষা-বলয় জানাচ্ছে এই পথটা দিয়ে গেলে আবার তারা মহাকাশ-আলয়ের মধ্যে যেতে পারবে। কোসাকে খবরটা পাঠিয়ে সে তাশাকে নিয়ে ঢুকে পড়েছিল পাইপের মধ্যে।
চলতে চলতে তাশা হঠাৎই কৃণাতের দেহটাকে খামচে ধরল। অবমানবদের কীর্তিকলাপ সত্যিই জান্তব। কৃণাত যারপরনাই বিরক্তবোধ করল।
‘এই পরামানব, আমার সুরক্ষা-বলয়ের দৃষ্টি ফিরিয়ে দাও।’
‘আমি এখন অবমানবের রূপ ধারণ করতে পারব না।’ বিরক্তি আর রাগে কৃণাতের স্বরযন্ত্র গর গর করে উঠল।
‘প্রয়োজন নেই। ফিরিয়ে দাও। আমি তোমায় দেখতে চাই। পরামানবরা কেমন হয় আমি দেখতে চাই।’
‘হাঃ। শুধু দর্শণেন্দ্রিয় দিয়ে আমাদের বিচার করা সম্ভব নয়। তোমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় কম পড়বে।’
‘যেমন তোমাদের অতীন্দ্রিয় কম পড়ছে ওই মহা-প্রাণীটার জন্যে।’ তাশা ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠছে। আর সে কিছুকেই ভয় করে না। এই মহাবিশ্বে সে যদি শেষ মানুষ হয়, তাহলে আর ভয় পেয়ে কী হবে।
তাশা দেখল তার চারপাশ থেকে অস্বচ্ছ সবজে থলিটা মিলিয়ে গেল এক নিমিষে। আধা স্বচ্ছ লালচে ভেলভেটের মতো একটা বিশাল জৈবদেহ সংলগ্ন হয়ে সে ঝুলছে। শরীরটার তলায় শুঁয়োপোকার মতো অনেকগুলো পা—যা তাশা পিঠের উপরে বসেও দেখতে পাচ্ছে। এগিয়ে চলেছে জীবটা তাকে পিঠে নিয়ে! অতি দ্রুত!
এটা পরামানব! আর্তনাদ করতে গিয়েও তাশা নিজেকে সামলে নিল। কিন্তু ওই বিকট দর্শন জীবটাকে সে একটুও সহ্য করতে পারছিল না। মুখ ঘুরিয়ে উপর দিকে তাকাতেই ভয়ে তার দমবন্ধ হয়ে এল। আরে! এই তো সেই করিডোর। সেই ধাতব দেওয়াল… ঘুরতে ঘুরতে চরম নিয়তির মতো আবারও সে সেই একই জায়গায় এসে পড়েছে। এই… এই সামনের বাঁকটা ঘুরলেই…
কৃণাত ছুটে চলেছিল পাগলের মতো। সে অনুভব করছে দলনেতা কোসার তরঙ্গ, আরও দুজন পরামানবের তরঙ্গ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে পৌঁছে যাবে কোসার কাছে। সেখানে সে নিরাপদ। কোসার কাছে আছে সেই মারণ-অস্ত্র যা দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব একটা উপগ্রহ সমান শিলাখণ্ডকেও।
হঠাৎ দু-হাতে দানবাকৃতি পিণ্ডটার স্বচ্ছ চামড়াটাকে খামচে ধরলে তাশা। ‘না! থাম! আর এগিও না।’
অবমানবটার মনের মধ্যে এক নতুন স্মৃতির দল জেগে উঠেছে… কৃণাত সেটা পড়ে ফেলার আগেই অন্য একটা তরঙ্গ প্রভাব টের পেল সে। মুছে গেছে কোসাসহ বাকিদের তরঙ্গভঙ্গ। এখন দিকবিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে অন্য একটা তরঙ্গমালা
সেই তরঙ্গ… আরও মোহসৃষ্টিকারী… ছন্দহীন… তালহীন… যুক্তিহীন… আরও স্পষ্ট… এক মহাজাগতিক মহাজৈবিক তরঙ্গনৃত্য… পঞ্চতলের এক সুড়ঙ্গ বেয়ে উঠে আসছে তরঙ্গ-এর ঢেউ… পঞ্চমুখে খুলে খুলে যাচ্ছে সেই তরঙ্গ… পঞ্চবাহু মিলে মিশে যাচ্ছে একে অপরের সঙ্গে সৃষ্টি করছে এক বহুবাহু বহুতল বিশিষ্ট তরঙ্গ প্রভা…
আচমকা অন্য এক তীব্র ভয়ের আবেগ কৃণাত-এর মোহ ভঙ্গ করে দিল। তার পিঠের উপরে অবমানবটা তার দেহে আঘাত করছে আর চিৎকার করছে—পালাও, পালাও… ওটা আসছে… পালাও।
কৃণাত পালাল। এক অবমানবের সিদ্ধান্ত মানতে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হল না। পাশের একটা ধাতব সুড়ঙ্গ বেয়ে সে পালাল। সে বুঝতে পারছে কোসাসহ বাকিদেরও মেরে ফেলেছে ওই ভয়ংকর জীবটা। তাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বৃথা হয়ে গেছে। কেউ ওটাকে থামাতে পারবে না। ওটা একের পর এক শুষে খাবে পরামানবদের!
পালাতে পালাতে একসময় কৃণাতের জৈব দেহও হাঁপিয়ে উঠল। পিঠের উপর অবমানবটার ভারও কম নয়। কেন যে অবমানবটাকে নিয়ে পালাচ্ছে কৃণাত। ওটাকে ফেলে দিলেই তো হয়। কিন্তু কৃণাতের মন বলছে এই অবমানবটাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। এইরকম মনে হওয়ার কোনো যুক্তি নেই, তবু ‘মন’-এ হয়। এই মহাকাশ-আলয় থেকে যদি কেউ না বেরোতে পারে, কিছু না বার হতে পারে… তাহলে এই অবমানবটাও বার হতে পারবে না। তবু কেন যে যুক্তির সীমারেখা লঙ্ঘন করে এখনও অবমানবটাকে বয়ে নিয়ে চলেছে কৃণাত…
এখন আর সেই ধোঁয়ার তরঙ্গটা টের পাচ্ছে না কৃণাত। তারা পালাতে পালাতে ধাতব অঞ্চলের অনেকটা ভিতরে চলে এসেছে। এতক্ষণে কৃণাত টের পেল মারা যাবার আগে কোসা তাকে শেষ একটা তরঙ্গবার্তা পাঠিয়ে রেখেছে। কৃণাত তরঙ্গবার্তাটা পাঠ করে ভিতরে ভিতরে স্তব্ধ হয়ে গেল।
‘ৎশা।’ কৃণাত মস্তিষ্ক তরঙ্গ পাঠাল।
বিষাক্ত ছোবলের মতো তরঙ্গটা হুল ফোটাল তাশার মাথায়। তাশা দু-হাতে মাথা চেপে ধরল।
‘তাশা।’
আবার তবে এবার একটু কম। কিন্তু তাশার মন হল মাথার মধ্যে ঝনঝন করে খোল-করতাল বাজল বুঝি।
‘ত-আ-শ-আ’
এবারে তাশার মস্তিষ্ক গ্রহণ করতে সক্ষম হল, বার্তাটা। পরামানবটা তার নাম ধরে ডাকছে।
‘কী পরামানব?’ তাশা সাবধানে উচ্চারণ করল।
‘আমি আর তোমাকে বহন করতে পারছি না। এই অঞ্চলে তুমি গমন করতে পারবে তোমার অঙ্গের সাহায্যে।’ ধাতব করিডোরের মাঝে তাশাকে নামিয়ে দিল কৃণাত। ‘এখন আমাদের এইভাবেই বার্তালাপ করতে হবে। আমি এখন স্বরূপে থাকব। তোমার কিছু জৈব অসুবিধা হতে পারে।’
‘তোমার নাম কী পরামানব?’ বিশাল মাংসল পিন্ডটার সামনে সামনে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে তাশা প্রশ্ন করল। সামনেই হাঁটছিল তাশা অমন বীভৎস এক জীবকে সে ঠিক সহ্য করতে পারছিল না।
‘তোমাদের উচ্চারণে—কৃণাত।’
‘কৃ-ণা-ত’—তাশা উচ্চারণ করল আপনমনে। দর্শনের থেকে এই মুহূর্তে কৃণাতের চিন্তন-তরঙ্গ অনেক বেশি সুন্দর। এক মিষ্টি ঝরনার জলের মতো কৃণাতের চিন্তন-তরঙ্গ। তাশার উষ্ণমস্তিষ্ক ক্রমশ যেন ভিতরে ভিতরে শীতল হয়ে উঠছে। আরও একটু শীতল হওয়ার জন্যে কৃণাতের সঙ্গে কথা চালাতে থাকে তাশা।
‘পরামানবরা কোথা থেকে এসেছিল কৃণাত?’
‘এই নেপচুন সংলগ্ন অঞ্চল থেকেই। প্রথম পৃথিবীতে নেমে এসেছিল পাঁচজন পরামানব। তাদের আমরা প্রাচীন বলি। তারাই আমাদের বির্বতন করেছে।’
‘প্রাচীনরা আজও আছেন?’
‘না। নেই। তাঁরা প্রথম যুগের পরামানব। তাঁরা বহুযুগ বেঁচে থাকার পন্থা আবিষ্কার করতে পারেননি।’
‘তাঁরা কেমন ছিলেন আমার জানতে ইচ্ছা করে।’
‘আমি তোমার মস্তিষ্কের মাঝে তাদের ছায়াচিত্র তৈরি করতে পারি। হয়তো একটু যন্ত্রণা হবে। সহ্য কোরো।’
‘বেশ!’
তাশার মস্তিষ্কের মাঝে পাঁচজন পরামানবের ছায়াচিত্র তৈরি হল। সঙ্গে সঙ্গে তাশার মস্তিষ্কের আরেক স্মৃতির ফুল পাপড়ি মেলল।
কৃণাত স্তব্ধ-তরঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তাশার স্মৃতির ভাঁজে সে এটা কী দেখল! কী পড়ল! কী জানল! প্রথম শূন্যলঙ্ঘন সেতু তৈরি হয়েছিল আজ থেকে সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে। এক প্রাকৃতিক শূন্যলঙ্ঘন সেতু… অবমানবরা গবেষণা করছে… গাণিতিক গবেষণায় তারা বার করছে এই সেতু খুলছে নেপচুনের এই এলাকায়… অবমানবরা একটা উড়ালযানে করে সেতু পার করছে… অবমানবেরা নেপচুনে এসে পৌঁছেছিল… সাড়ে ছয় হাজার সৌরাবর্ত আগে… শূল সেতু পার করে প্রাগৈতিহাসিক উড়ালযানে চেপে অবমানবেরা এসেছিল এখানে! এখন কৃণাতরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেই অঞ্চলেই এসেছিল অবমানবরা! তাশা ছিল নয়জন অবমানব অভিযাত্রীর একজন… আর বাকিরা? আর ওই ধোঁয়ার মেঘ… কে আছে ওর অন্তরালে! কী তার উদ্দেশ্য!
কৃণাত তাকাল তাশা যেদিকে হেঁটে গেছে সেই দিকে… স্বেদকম্প হচ্ছে কৃণাতের… নাকি স্বেদকম্পের থেকেও বেশি কিছু? এক ভয়ংকর ইতিহাস জেনে গেছে কৃণাত… শূন্যচারীরা এই ইতিহাসকেই গোপন করে রেখেছিল এতদিন!
তাশা-রা কী দেখেছিল এখানে এসে? কী ঘটেছিল ওদের সঙ্গে? এখুনি কৃণাতকে সব জানতে হবে, এতে করে ওই অবমানবটার মস্তিষ্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেও জানতে হবে… কৃণাত এক ক্রুদ্ধ ধূমকেতুর মতো তেড়ে গেল তাশার দিকে… কোথায় গেল? কোন গলিতে গিয়ে ঢুকল? ওই তো… ওই তো দাঁড়িয়ে আছে অবমানবটা… কীসব বিড়বিড় করছে… ওর ওই অদ্ভুত মস্তিষ্কের খাঁজে ভাঁজে কত রহস্য লুকিয়ে রেখেছে!
কৃণাতের খর-তরঙ্গ তাশার মস্তিষ্কে প্রবেশ করার আগেই, তাশা সেই গন্ধটা পেল… একটা আঠালো গন্ধ… সে তার স্বপ্নের শেষ অংশে এসে দাঁড়িয়েছে… আসছে… সেই ভয়ংকর দানোটা আসছে… তাশা দেখল, পীতারুণ ধোঁয়ার মেঘ তৈরি হচ্ছে কৃণাতকে ঘিরে… তাশাকে আবারও দেখতে হবে তার স্বপ্নের শেষাংশটুকু… নিজের মস্তিষ্কে অনুভব করতে হবে ওই পরামানবের মৃত্যুযন্ত্রণা!
না! তাশা পালাতে চায়। সে দেখবে না, সে জানবে না… সে মুক্তি চায়। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে সবকিছু… তবু তাশা দেখছে… না, তাশা অনুভব করছে, ওই পরামানবের অতীন্দ্রিয় দিয়ে সে অনুভব করছে … এক আকারহীন অবয়ব, প্রকারহীন অবয়ব… সে এখানে আছে… আবার অন্য কোথাও আছে… জগতের পর জগৎ ভাঁজে ভাঁজে খুলে যাচ্ছে… অসীম… নিঃসীম… অনন্ত ভাঁজ… এঁরা এসেছিল আগেও… আসবে আবারও… প্রাণের খোঁজে এঁরা ঘুরে বেড়ায়… উপযুক্ত খাদ্যের খোঁজে… উপযুক্ত মাটির খোঁজে… মাটি পেলে বীজ বোনে… শষ্য গজায়… তাশার মস্তিষ্কের মধ্যে জেগে উঠল শেষ স্মৃতি অথবা প্রথম স্মৃতি…
০
একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় ছিল সেটা। এরকম অদ্ভুত কিছু মানুষ আগে কখনও দেখেনি। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ঠিক বাইরে চাঁদের মাঝ বরাবর একটা লম্বা ফাটল। ঠিক যেন চাঁদটাকে আধখানা করে ঝুলে আছে শূন্যের মাঝে। প্রথম দেখে তো মানুষের মধ্যে সে কী আতঙ্ক! সকলেই আতঙ্কে পাগল হয়ে উঠেছিল। চাঁদ বুঝি ভেঙে পড়ছে। প্রায় প্রত্যেক দেশই নিজস্ব স্যাটেলাইট পাঠাল। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন ওটা একটা প্রাকৃতিক ওয়ার্মহোল। ফাটল পার করে প্রথমে পাঠানো হল কিছু অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাওলা স্যাটেলাইট। কিন্তু তারা নেপচুনের ছবি ছাড়া কিছুই পাঠায় না। আরও গবেষণার পরে বোঝা গেল এই প্রাকৃতিক ফাটলটির অন্যপ্রান্তটা খুলেছে নেপচুনের কাছে। কোনো কারণে বিজ্ঞানীদের যন্ত্র সঠিক গণনার তথ্য দিচ্ছিল না।
তখন সব দেশ একত্রে হয়ে একটা অভিযান চালাবার কথা ভাবে। বিভিন্ন শাখার তরুণ তরুণীদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হয় শ্রেষ্ঠতমদের। একমাসের প্রশিক্ষণের পরে একটা মহাকাশযানে করে তাদের পাঠানো হয় ওই ওয়ার্মহোলের মধ্যে। তাশা একজন জীববিজ্ঞানী। অভিযানে সেই একমাত্র জীববিজ্ঞানী। পোর্টালের মধ্যে ঢোকার আগে সে কী উত্তেজনা! অথচ এক লহমায় তারা পার হয়ে গিয়েছিল ওই পোর্টাল। পৃথিবী থেকে নেপচুন এই সুবিশাল দূরত্ব তারা পার করে গেছিল সেকেন্ডের ভগ্নাংশে। চোখের সামনে দেখেছিল বিশাল নীল মহাকায় নেহচুন গ্রহটাকে। আর পরক্ষণেই এক অনন্ত লালচে হলদে ধোঁয়ার মেঘে হারিয়ে গেছিল তাদের মহাকাশযান। কোনো যন্ত্র কাজ করছিল না।
প্রতিটা করিডোরে প্রতিটা ঘরে ঢুকে এসেছিল সেই আঠালো ধোঁয়া, যেন পরীক্ষা করে নিচ্ছে তাদের মহাকাশযানটাকে… না ভুল করেছিল তারা। ওই আঠাল পীতারুণ মেঘ তাদের মহাকাশযানকে পরীক্ষা করছিল না। পরীক্ষা করছিল তাদের। জীবিত মানুষদের। আর তারপর সেই ধোঁয়াটা এক এক করে বদলে দিচ্ছিল তাদের… একদিন দু-দিন… সেই আঠালো ধোঁয়ার কোনো তাড়া ছিল না। সে নিশ্চিন্তে শিকার করে চলেছিল… তবে, সেই শিকারের ফলে কেউ মারা যায়নি। প্রথম সেই ধোঁয়ার মেঘ গ্রাস করেছিল এক তরুণ পদার্থবিদকে। নয়জন ছিল তারা। প্রথম যে তিনজনকে গ্রাস করছিল আঠাল ধোঁয়া তারা মারা গেছিল। কিন্তু ক্যাপ্টেন ফিরে এলেন। যে মানুষটা হারিয়ে গেল, সেই কী ফিরে এসেছিল? কে জানে? তাশা জানে। ফিরে আসেনি। যে গেছিল সে ফেরেনি। সে স্ক্যান করেছিল ক্যাপ্টেনের মস্তিষ্ক, সে মাইক্রোস্কোপের তলায় ফেলে দেখেছিল ক্যাপ্টেনের দেহকোশ, জিন…
ক্যাপ্টেনের মস্তিষ্কের মাঝে গজিয়েছিল এক নতুন ভাঁজ… দেহকোশ বদলে গেছিল… বদলে গেছিল জিনের পাক… আজ তাশা জানে ওরাই প্রথম পরামানব… ওই প্রাচীন ধোঁয়া, ওই মহাখাদক, ওই অনন্তের প্রাণ বীজ বুনে গেছে মানুষের শরীরে। উপযুক্ত ফসলের সন্ধানে সে খুঁজে বেড়ায় বীজতলা। সাড়ে পাঁচশো বছর পরে ফসল ফলবে। ফলন্ত শস্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে সৌরমণ্ডলী। তখন সে আবারও আসবে খাদ্যের সন্ধানে। এবার তার গোলাভরার পালা।
একে একে বদলে গেল সব ক-টা মানুষ। শুধু সে ছিল… আর তারপর ধোঁয়াটা তাকে গ্রাস করল… কী হল… ধোঁয়ার মাঝেই এক জটিল দৃশ্যপট… এক জগতের দৃশ্য তা নয়… ভাঁজের পর ভাঁজ সে দৃশ্যে… অথচ তা একই দৃশ্য… একই দৃশ্য বহুরূপ, নাকি বহুদৃশ্য একই রূপ… মানুষের মস্তিষ্ক ক্ষমতার বাইরে তা… মানুষের ইন্দ্রিয় ক্ষমতার বাইরে…
‘এখন আমি জেনেছি তুমি কে… আ-বা-র এসো… ৎ-আ-শ্-আ…’ কৃণাতের শেষ তরঙ্গপাতে তাশার ঘোর ভেঙে গেল।
কৃণাত তাকে জড়িয়ে ধরেছে। কৃণাত মারা যাচ্ছে! কৃণাতের মস্তিষ্ক ধূসর হতে হতে বর্ণহীন হয়ে গেল! আর, কোনো তরঙ্গের প্রক্ষেপ নেই তাশার মস্তিষ্কের মধ্যে। আর কোনো যন্ত্রণা নেই… সব ধূসর… সব বর্ণহীন…
কৃণাতের স্বচ্ছ শরীরের মধ্যে দিয়ে তাশা প্রত্যক্ষ করল সামনে দাঁড়িয়ে সেই মহাপ্রাণী… সেই অনন্ত খাদক। তাদের দুজনকেই ঘিরে ধরেছে ধোঁয়ার মেঘ। মৃত পরামানবের দেহটাকেও সে ছাড়ছে না। শুষে নিচ্ছে স্নায়ু… শুষে নিচ্ছে কোশ… কৃণাতের শরীরের মধ্যে দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে এক অপরা-জগৎ! সেই বিশাল মহাপ্রাণী… ভাঁজের পর ভাঁজ… দৃশ্যের পর দৃশ্য… অনেক দৃশ্যের ওপাশে ধোঁয়ার মাঝে আরেক তাশা…
কিন্তু এ কি! এক ভয়ংকর ধাক্কায় যেন দুলে উঠল সবকিছু। শূন্যে প্রক্ষিপ্ত হল তাশা। অনেক উঁচু থেকে ধাতব মেঝেতে আছড়ে পড়ার আগেই আবারও মহাবিস্ফোট! তাশা যেন কোথায় বিক্ষিপ্ত হল। তাকে ঘিরে বিক্ষিপ্ত হল ধোঁয়ার মেঘ। তাশা জানে না, পরামানব দলনেতা কোসা মারা যাওয়ার আগে নির্দেশ পাঠিয়েছিল কৃণাতকে। এই গবেষণাকেন্দ্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার নির্দেশ। এখন কৃণাত মারা যেতেই সেই বিস্ফোরণ শুরু হয়ে গেছে। এই মহাকাশ-আলয় মিশে যাবে অণু-পরমাণুতে। আগুনের ঝড় উঠেছে গবেষণাকেন্দ্র ঘিরে। নিমিষের মধ্যে করিডোরে করিডোরে ছুটে এল লেলিহান শিখা।
আবারও, এক মহাবিস্ফোট… মহাপ্রাণীর শরীরের পর শরীর ফুঁড়ে চলে গেছে সেই বিস্ফোটক… নিমেষে সব ওলটপালট… কৃণাতের দেহ কখন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, অথবা শুষে খেয়ে নিয়েছে সেই ধোঁয়া, অথবা বিলীন হয়ে গেছে পরা-অপরা জগতের মাঝে…তাশা প্রক্ষিপ্ত হচ্ছে সেই অনন্ত দৃশ্যপটের মাঝে… ভাঁজের সঙ্গে ভাঁজ মিশে যাচ্ছে… তাশার সঙ্গে তাশা…
এক অন্তহীন শূন্যতায় ডুবে যাচ্ছে তাশা। অতি প্রাচীন অতি মায়াবিনী সেই শূন্যতা ক্রমে জমাট বেঁধে পিষে দিচ্ছে তাশার চেতনা… নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাশার স্মৃতি… যেটুকু থাকছে সেইসব স্মৃতিরা গুটিয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্কের গহীন কন্দরে… এক অনন্ত ঘুমে ডুবে যাচ্ছে তাশা… সে পড়ে আছে ধাতব মেঝেতে, লীন হয়ে গেছে গভীর সুষুপ্তিতে। মিলিয়ে গেছে সেই আদিম ধোঁয়া। নেপচুন আর পৃথিবীর আকাশ থেকে মিলিয়ে গেছে সেই প্রাকৃতিক ফাটলটিও। বীজবপন করে চলে গেছে আদিম-প্রাণ। এখন উর্বর জমি তার কাজ করবে।
তাশার চেতনাহীন দেহটার চারপাশে ভিড় করে আসছে কয়েকজন সদ্য জন্ম নেওয়া পরামানব। নিজেদের মধ্যে কী যেন বার্তালাপ করছে তারা। তাশাকে তারা ঢুকিয়ে রাখছে একটা হিমযন্ত্রে। এবার তাদের অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে যেতে হবে পৃথিবীতে। সেখানে মানুষ বসে আছে নতুন জ্ঞানের আশায়।
পাঁচ বীজধান রওনা দিয়েছে পৃথিবীর উদ্দেশে, বীজতলা ভরে চাষ করবে তারা। ফসলে ফসলে ভরে উঠবে এই সৌরমণ্ডলের প্রতিটি গ্রহ। তাদের মহাবিধাতা যে ক্ষুধার্ত। তাঁর খিদে মেটানোর জন্যেই তো এত আয়োজন।
আর, তাশা?
তাশা ঘুমিয়ে থাকবে হিমঘুমে, আগামী সাড়ে পাঁচশো বছর। সেই মহাক্ষণে আরও একবার জেগে ওঠার জন্যে। যখন এক মহাখাদকের ব্রহ্মনাদে ঢেকে যাবে চরাচর…
ওওঁওঁমমহ্মহ্মঅঁঅঁঅ…
Tags: অঙ্কিতা, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
