কাউন্টডাউন
লেখক: সায়ংতরী ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
হতবুদ্ধি হয়ে আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম কনট্রোল প্যানেলের দিকে। কমিউনিকেশন মডিউলের আলোগুলো সব নিবে গেছে। শুধু একটা লাল-আলো কুটিল নিষ্ঠুর দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে আমার দিকে! না, না, না। এ হতে পারে না। কিছুক্ষণের জন্য বোবা হয়ে গেলাম যেন একেবারে। তারপর দু-হাতে মাইক্রোফোনটাকে আঁকড়ে ধরে আরেকবার চিৎকার করে বললাম, “হ্যালো! মিকিরা! শুনতে পাচ্ছ? হ্যা…হ্যালো?”
শেষদিকটায় আমার গলার স্পিকার দিয়ে যে শব্দটা বেরোল, সেটাকে আর আমার গলা বলে চেনা গেল না।
মিকিরা কোনো জবাব দিল না। আমাদের সমস্ত ফ্লিটের গার্জেন সার্ভর সে। চিরকাল তার গমগমে কণ্ঠস্বরে নানানরকম আদেশ আর উপদেশ শোনার অভ্যেস আমার। আজ তার দিকের কথামুখে শুধু মৃত্যুশীতল নিস্তব্ধতা। যেন শেষকথা তার বলা হয়ে গেছে। শুধু ঝিঁঝির ডাকের মতো একটা শব্দ ওদিক থেকে ভেসে আসছে। কারও কথা নয়। মাইক্রোফোনের স্ট্যাটিক।
আমার বুকের ভেতর হৃদ্যন্ত্র বলে কিছু নেই। না হলে আমার বুক কেঁপে উঠত। কোথায় যেন একটা তীব্র ঠোক্কর খেলাম। বুকের ঠিক মাঝখানে, যেখানে রাশি রাশি ভিএলএসআই চিপের জটিল সার্কিট, আর তার ভেতর দিয়ে শনশন করে ছুটে-চলা লজিকের স্রোত, ঠিক সেখানেই হয়তো। পরের পর থরে থরে সাজানো ডিসিশন ট্রি থমকে গেল। শীতাতপনিয়ন্ত্রণের বাধা এক তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে আমার ধাতব বুকের তাপমাত্রা দুম করে কয়েক ডিগ্রি কমে গেল যেন।
কী করব এবার? আমি কী-ই-বা করতে পারি? আমি ফ্লোরা-৯৬ ভার্সন-৩। সত্তর টেরাবাইটের ছোট্ট মাথা আর ফুট দশেকের বিশাল শরীর। পৃথিবী থেকে এতদূরে মানুষের এই উপনিবেশ-গ্রহ উনিটির লক্ষ লক্ষ ‘খেটে-খাওয়া’ রোবটের একজন। বুদ্ধি বলতে যৎসামান্য। কাজকারবার শুধু মৃতপ্রায় রোবটদের নিয়ে। ছোটোখাটো সার্কিট রিপেয়ার, লোডিং আর আনলোডিং—এইটুকুই তো ক্ষমতা। আর এই ছোট্ট ট্রিনিটি স্পেসক্রাফ্টখানা নিয়ে আমাদের গ্রহ আর আর গ্রহাণুগুলোর মাঝে শাট্লের মতো যাতায়াত করা। দিনে দুবার। রোজ। ছোটো ডেটাবেস, আমার সমস্যা কিছু হলেও সেইটুকু হাতড়ালেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি চিরকাল। তাও নিজে খুঁজে দেখি না কোনোদিন কিছু, জিজ্ঞাসা করে নিই চ্যাট-অ্যাসিস্ট সিস্টেম কায়াকে। রোবটের আনন্দ বা দুঃখ বলে কিছু হয় কি না জানি না, কিন্তু বেশ খুশিই ছিলাম এই ছিমছাম কাজটা নিয়ে। এমন গড়পড়তা একঘেয়ে কাজ যে একদিন এমন গুরুদায়িত্ব এনে আমার ঘাড়ে ফেলবে, তা ঘুণাক্ষরেও কোনোদিন মনে হয়নি।
যখন প্রথম চোখ খুলেছিলাম, তখন আমার ছিল অন্য কাজ। অন্য পরিচয়। আমাদের গ্রহ উনিটির কালো কংক্রিটে আর সারি সারি কারখানার কালো ধোঁয়ায় ঢাকা মিশমিশে গায়ের ওপর দু-একটা তুলির আঁচড়ের মতো পড়ে-থাকা জঙ্গলগুলোর দেখাশোনা করার জন্য পৃথিবী থেকে এসেছিলাম তখন। মোটামুটি বছর ছয়েক সেই কাজ করার পর অল উনিটি কনগ্লোমারেট সিদ্ধান্ত নিল যে, জঙ্গল ব্যাপারটা বড়ো অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। তার চেয়ে অনেক আপৎকালীন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরোনো রোবট আর ওই ধরনের বাদবাকি জঞ্জালের গতি করা। ডিপ সি মাইনিং-এর ঢাউস রোবোমাইনার থেকে সার্জারির কাঁচি-চালানো সূক্ষ্ম রোবোসার্জেন, ক-দিন আর টেকে এসব রোবো? রিসাইকেল হাব ঘুরে শেষ অব্দি তো সবার শেষ আশ্রয় হয় গ্রহের উত্তর মেরুর কবরখানায়। উনিটির উত্তর মেরুর ডাম্পিং গ্রাউন্ড, ইস্তা-নর, যেখানে এসব জঞ্জাল ফেলা হয়েছে শেষ দুশো বছর ধরে, এখন সেখানে নেপচু পর্বতের মতো জমা হয়েছে রোবো-ওয়েস্ট। সেসবের একটা হিল্লে হওয়া দরকার। কনগ্লোমারেটের মিটিং-এ সে বছর ঠিক হল, উনিটির ত্রিসীমানা থেকে এগুলো দূর করে দিতে হবে। নতুন আস্তাকুঁড় হিসেবে উনিটির স্পেস সার্কলের দূরতম গ্রহাণু ইলানাকে বাছা হল।
যেমন কথা, তেমন কাজ। ইলানা আর সিমানা দুই যমজ গ্রহাণু। দুটিতেই আবহাওয়া চরম। সেখানে অবিরাম বৃষ্টি চলে সারাবছর। এক হাঁটু জল আর ফুঁসে-ওঠা ঝরনাদের আশ্চর্য দুনিয়া যেন দুটি। ইলানার জল তীব্র অ্যাসিডিক, বৃষ্টিও। আর সিমানার বুক জুড়ে-থাকা বিশাল হ্রদটিতে কার্বন ডাইঅক্সাইড মিশে আছে আকণ্ঠ, তাই লিমনিক ইরাপশন হয় মাঝে মাঝেই। এহেন জায়গায় ডাম্পিং-এর কাজও যে রোবোরাই করবে, তাতে আর সন্দেহ কী? এমনিতেই মানুষরা খুব একটা উনিটির পথে ঘেঁষে না। রোবো কনগ্লোমারেটই এখানে যাবতীয় সব কাজ সামলায়। তাই, কনগ্লোমারেটের সিদ্ধান্তে অপ্রয়োজনীয় জংলা রোবোদের, মানে আমাদের একদলকে খানিক পালটে নিয়ে তৈরি হল ফ্লোরা ভার্সন-২ ফ্লিট। আমাদের নতুন কাজ হল ইস্তা-নর থেকে স্পেস শাট্ল বোঝাই রোবো-ওয়েস্ট নিয়ে ইলানার নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে আসা।
এই কাজ বদলের পরে প্রথমদিকে আমার বড্ড মন-খারাপ হত। আমি গাছ ভালোবাসতাম, ফুল ভালোবাসতাম। বুদ্ধি আমার চিরকালই কম। তারপর বছর তিনেক আগে ভার্সন-৩ আপগ্রেডের পর যেন আরও বোকা হয়ে গেছি। তাই জঙ্গলের পথে পথে আপন মনে ঘুরে বেড়াতে আমার ভালো লাগত। দীর্ঘ শরীর সোজা করে দাঁড়িয়ে উঁচু গাছের মগডালে পাখির বাসার দিকে তাকিয়ে থাকতাম ফাঁকা সময়ে। উত্তাল নদীর পাশে বসে দেখতাম জলপ্রপাতের চোখধাঁধানো ঝাঁপ। আমি আপনভোলা, এ কি আমার কাজ? মরা রোবটের শেষকৃত্য! আমার রোবো কলোনির পাশের ঝুপড়িতে থাকে এনরোড-১৪২। মনে আছে, কাজ বদলের আগের দিন সে ঘাড় হেলিয়ে দুঃখ-দুঃখ মুখ করে আমায় বলেছিল, “ইশ্! ছিলে মালি, হয়ে গেলে শেষে কবরখানার চৌকিদার!”
কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার পর দেখলাম, এর মধ্যে একটা অদ্ভুত শান্তি আছে। আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে ইস্তা-নরের কবরখানা নিথর নিস্তব্ধ নয়। কনগ্লোমারেটের আদেশে অকেজো, অথর্ব বা নেহাত বুড়ো রোবোদেরও দেশছাড়া করে সেই হিমের রাজ্যে চিরনির্বাসন দেওয়া হয় অনেক সময়। রাশি রাশি ভাঙাচোরা ধাতব জঞ্জাল সরাতে গিয়ে কোনোদিন কারও ক্ষীণ গলার স্বর কানে আসতে পারে, এ আমার ভাবনার অতীত ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহেই তেমন একটা চমক পেয়ে আমি প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিলাম।
মনে আছে, সেদিন ইস্তা-নরে ঠান্ডা যেন অন্যদিনের চেয়েও একটু বেশি। গত রাত্রের তুষারপাতের কুচি কুচি বরফ নরম পুরু কার্পেটের মতো বিছিয়ে আছে মরা রোবটদের শরীরের ওপর। আমার অন্য সঙ্গীরা পাততাড়ি গুটিয়ে ফিরে গেছে। আমার কার্গো-হোল্ডে তখনও কিছুটা জায়গা ফাঁকা। বরফের স্তূপ হাতে করে ঠেলে সরিয়ে জুতসই মাপের একটা বাতিল রোবট খুঁজছি, এমন সময় একটা তিনকোনা পিরামিডের মতো জিনিস চোখে পড়ল। ঠিক যেমনটা চাইছি, সেই মাপমতো। হাত বাড়িয়ে টান দিতেই পিরামিডটা ফুটন্ত ফুলের মতো খুলে গেল। তারপর আমাকে চমকে দিয়ে বলে উঠল, “ইএস-৬৬, ব্যাটেলিয়ন ১২!”
এত অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, যে লাফিয়ে তিন পা পিছিয়ে এসে টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিলাম বরফের ওপরে। এ কী? এ যে কথা বলছে? তবে কি…
না। পরে বুঝেছিলাম ইএস-৬৬ বেঁচে নেই। বা বলা যায়, সে প্রায় মরতেই বসেছে। রোবটেরা কাজ করতে করতেই হঠাৎ থেমে যায়, তাদের তো আর মৃত্যুশয্যা হয় না! না হলে ওই শব্দটাই ঠিকমতো ইএস-৬৬-এর অবস্থা বোঝাতে পারে। মরণের পরেও কোথাও তার এতটুকু শক্তি বাকি ছিল হয়তো। আমারও কপালে ছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেটেরান সেই ওয়ার-রোবোটির শেষ মুহূর্তের সাক্ষী থাকার অভিজ্ঞতা।
তাকে কোলে তুলে স্পেস শাট্লে নিয়ে এলাম। ইএস-৬৬ সেদিন অনেকক্ষণ কথা বলেছিল। থেমে থেমে। যুদ্ধক্ষেত্রের কথা। লড়াইয়ের কথা। অকারণ অনৈতিক রক্তপাতের কথা। আতঙ্কে গা-ছমছম বিভীষিকার রাত্রির কথা। খানিক বলছে। আবার খানিক খেই হারিয়ে ফেলছে। আমার সঙ্গে সঙ্গে সেদিন আমার চ্যাট-অ্যাসিস্ট বট কায়াও অবাক হয়ে শুনেছিল সেসব কথা। ঘণ্টা তিনেক সময় একটা ঘোরের মতো কেটে গিয়েছিল আমাদের দুজনের। শেষে যখন দেখলাম, ইএস-৬৬-এর পিরামিড-পাখাগুলো তিরতির করে কাঁপছে, বুকের মধ্যিখানের আলোটা নিবুনিবু, তখন জিজ্ঞাসা করলাম, “একটা ভালো কিছু ভাবো। সুন্দর কিছু। বলো, কী মনে হচ্ছে তোমার?”
সে চুপ করে রইল খানিক। আমার মনে হল, ভালো স্মৃতি তার নেই কিছু হয়তো। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে হঠাৎ বলল, “একবার একটা সব্জে-নীল নদীর ধারে আমাদের কপ্টার নামিয়েছিলাম। তুষার-ঢাকা নীলচে সাদা পাহাড়ের ধারে। সেই নদীটা যেন দেখতে পাচ্ছি।”
কী মনে হল, ওকে নিয়ে আর ইলানা গেলাম না। তার বদলে কায়াকে বললাম, “শাট্লটাকে কি সিমানার পথে ঘোরানো যায়, কায়া?”
কায়া বলল, “অসুবিধা নেই, যাওয়াই যায়। আমি ট্রাজেক্টরি চেঞ্জ করব?”
“করো!” বললাম আমি।
সিমানা পৌঁছোলাম যখন, ইএস-৬৬ ততক্ষণে নিথর হয়ে গেছে। মনে আছে, ওকে দু-হাতে নিয়ে একটা ঝরনার পাশে রেখে এসেছিলাম। এ ঝরনাটা আমার আগে দেখা ছিল। সব্জে-নীল ঝরনা।
তারপরে রাত্তিরে, নিজের ঝুপড়িতে ফিরে দেখি সোলার ব্যাটারিতে চার্জ শেষ। বরফ আর বৃষ্টির রাজ্যে ঘুরে ঘুরে সারাদিন সূর্যের দেখাই পাইনি। ক্লান্ত শরীরটাকে চার্জিং প্যাডের মধ্যে গুঁজে দিয়ে আমি চোখ বন্ধ করলাম। আর অমনি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই নীল পাহাড়। তার সামনে সবুজ নদী। আর ঝিরিঝিরি বরফের বৃষ্টির মধ্যে সেই নদীর ধারে বসে আছে একটা ধাতব পিরামিড।
রোজ রোজ যে এমনটা হত, তা নয়। মাইলের পর মাইল লোহালক্কড়ের স্তূপের মধ্যে কোথায় যে একটু ‘প্রাণ’ এখনও ধুকপুক করছে, তা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু তবুও সে ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল গুপ্তধন খোঁজার মতো। আমি ইচ্ছে করে কার্গোহোল্ড খালি রেখে ওদের খুঁজতাম। গালে হাত দিয়ে বসে ওদের কথা শুনতাম। ফাঁকা সময়ে বসে চোখের ক্যামেরার ওপর পর্দা টেনে টেরাবাইট হাতড়ে কখনো-কখনো বই পড়তাম। মানুষের গল্পওয়ালা পুরোনো সব বই। জানতে ইচ্ছে করত, মানুষ এমন শেষ সময়ে পরস্পরকে কী বলে? আনন্দের কথা ভাবে, না দুঃখের কথা? হাসে, নাকি কাঁদে হাউহাউ করে? আমার সঙ্গীরা এসব কাণ্ড দেখে হাসত। বলত, “কাজ ছেড়ে দিয়ে কবিতা-উপন্যাস লেখো না কেন? কিংবা ছবি-টবি আঁকতে পারো তো? এমন ভাবুক রোবট পেলে কনগ্লোমারেট তো লুফে নেবে হে।”
আমি ওসব শুনেও শুনতাম না। নিজের এই নতুন কাজের মধ্যে এমন আশ্চর্য একটা অভিজ্ঞতা আবিষ্কার করে আমি তখন বুঁদ হয়ে আছি। মাসে হয়তো একজন আধমরা রোবো খুঁজে পাই। কিন্তু তাতেই আমার সারামাসের ভাবনার রসদ পেয়ে যাই। কত কিসিমের অদ্ভুতুড়ে গল্প শোনা হয়েছে এই শখের জন্যে, তারও ইয়ত্তা নেই! একবার এক রোবোনার্স আমায় বলেছিল, উনিটির দক্ষিণ মেরুর কাছে ইস্তা-সাউথের এক গোপন ল্যাবরেটরিতে নাকি মানুষের বাচ্চা চাষ হয়! কচি কচি ছেলেমেয়েকে গাবদা সব ল্যাবসুট পরিয়ে কনকনে ঠান্ডা জলের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। এখন লাগছে না, কিন্তু যদি ভবিষ্যতে আরও মানুষ লাগে, সেইজন্যে। আরেকবার এক গাইয়ে-রোবোকে পেয়েছিলাম প্রায় গোটা অবস্থায়। তার সোলার প্যানেল পালটে দিতেই গুনগুন করে গেয়ে উঠেছিল সে। পরে বুঝেছিলাম, তার মাদারবোর্ড ভাইরাসে ধসিয়ে দিয়েছে। বাঁচবে না বেশি দিন। তবুও সে পুরো তিনটে দিন আমার সঙ্গে ছিল। নিবে যাওয়ার আগে অব্দি সারাক্ষণ সে গান গাইত। আর বলতো কোন স্বরের কেমন সুর। কোনটা বিষাদের, কোনটা আনন্দের, কোনটা আশার, আর কোনটা শুধুই অপেক্ষার। আর-একবার এক রংচটা খেলনা-রোবোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, নাম অডি। অডির গল্পটাও অদ্ভুত। তাকে দেখতে ছোট্টটি হলে কী হবে, তার বয়েস অনেক। তাকে নিয়ে একই বাড়ির বাপ-ব্যাটা দুজনেই নাকি খেলেছে ছোটোবেলায়! কী যেন নাম ছিল ওদের! ওহ্ হ্যাঁ, এলবা সিনিয়র আর এলবা জুনিয়র। শেষ দিন এলবা সিনিয়রই যে অডিকে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ফেলে দিয়ে এসেছিল, সে দুঃখ অডি শেষ মুহূর্ত অব্দি ভোলেনি। আবার এক থুত্থুড়ে রগচটা সিকিউরিটি-রোবোর কথাও মনে আছে। আইক্যাম-১২৩। কুঁড়ের হদ্দ, কিন্তু ভীষণ সন্দেহবাতিক। সে আমায় বলেছিল, তার কাছে মিউটিনির পাক্কা খবর আছে। মানুষজাতটাই যে গোলমেলে আর যুদ্ধবাজ, তা নাকি কনগ্লোমারেটের বুদ্ধিমান রোবোরা বুঝে গেছে। মানুষের সঙ্গে সদ্ভাব তারা আপাতত রেখেছে বটে, কিন্তু তলে তলে একটা চরম ব্যবস্থা করার প্রস্তুতি চলছে। এক কোপে মানুষের সব চালাকি শেষ করে দেবে। শান্তি আসবে পৃথিবীতে, উনিটিতে।
আমি শুনতাম। ওদের এসব কথা শোনার লোক তো কেউ আর ছিল না। আমায় বলেই ওদের শান্তি। তাতেই আমার আনন্দ।
দিব্যি চলছিল! এক মুহূর্তের জন্যেও ভাবিনি, উনিটির এই নিয়ম-বাঁধা দিনরাত এমন হঠাৎ করে পালটে যেতে পারে। এক ধাক্কায়! রাতারাতি!
আজ সকালে যখন শাট্ল নিয়ে বেরিয়েছি, তখনও সব স্বাভাবিক। মিকিরার কাছ থেকে ইস্তা-নরের ডিউটি রোস্টার ঠিক সময়ে পেয়েছি অন্যান্য দিনের মতোই। এমনকি সে আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে একটু ধমকও দিল, “তোমার শাট্ল মাঝে মাঝে সিমানার দিকে নিয়ে যাও কেন? মেইনটেইন ইয়োর গিভ্ন রুট! নো ডাইভার্সন, আনলেস ইমার্জেন্সি!”
মিকিরার কোনো শরীর নেই। শুধু ঠান্ডা কণ্ঠস্বর, আর মস্ত একখানা নিউরাল নেটওয়ার্ক। চোখ থাকলে সে নিশ্চয় চোখ পাকাত—এই ভাবতে ভাবতে ইস্তা-নর পৌঁছে কার্গো তুলতে শুরু করলাম। এক রাউন্ড বোঝাই করে শাট্ল নিয়ে ইলানার পথে বেরোলাম যখন, তখনও ফ্লিটের বাকিরা সেখানেই গা এলিয়ে গল্পগাছা করছে।
এখন বুঝতে পারছি, বিস্ফোরণটা হয়েছে তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই!
কিন্তু তখন কিছুই বুঝিনি। প্রথম অস্বাভাবিক ঘটনা শুরু হল একটা ঝনঝন শব্দে। কনট্রোল প্যানেলে কল। মিকিরা। হালকা চালে রিসিভারটা তুলে নিলাম, “হ্যালো, ফ্লোরা-৯৬ ভি-থ্রি! শাট্ল নম্বর সেভ্ন!”
“ফ্লোরা-৯৬, হ্যাভ ইউ লেফট ইস্তা-নর? তুমি কি ইলানার পথে?”
“হ্যাঁ, মিকিরা।”
উত্তরটা দিলাম বটে, কিন্তু মিকিরার প্রশ্নটা শুনে একটু খটকা লাগল। আমাদের ফ্লিটের প্রতিটি রোবো, প্রতিটা শাট্ল কখন কোথায় আছে, তা মিকিরার নখদর্পণে। জানতে চাইলে সে নিজেই তা দেখে নিতে পারে। জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন পড়ে না।
“কাম ব্যাক ইমেডিয়েটলি!”
“ওকে।” একটু থমকে গিয়ে বললাম। ভাবলাম, কী বিপদ, এ আবার ডাকে কেন? সিমানার দিকে তো যাইনি। একটু ভেবে বললাম, “কিন্তু আমার শাট্ল লোডেড। টার্ন করে ফিরতে একটু সময় লাগবে। কিছু আর্জেন্ট কি?”
মিকিরা এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপরে বলল, “উই আর আন্ডার অ্যাটাক! উই নিড অল হ্যান্ডস অ্যাট ডেক!”
“আন্ডার অ্যাটাক?” বিস্ময়ে আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল, “সে কী? মানে… কে করল অ্যাটাক? এভাবে… হঠাৎ?”
“পৃথিবী। পৃথিবী উনিটি আক্রমণ করেছে। বা বলতে পারো, মানুষ আমাদের আক্রমণ করেছে। তুমি শাট্ল ঘোরাও।”
“ঘোরাচ্ছি। কিন্তু…”
“আমার এখন এত কথা বলার সময় নেই। তোমার চ্যাট-অ্যাসিস্ট সিস্টেমে যাবতীয় ইনফর্মেশন দিলাম। দেখে নাও।”
মিকিরা কট করে কানেকশন কেটে দিল! আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। চ্যাট-অ্যাসিস্ট সিস্টেম অন করা ছাড়া উপায় নেই। গতকাল কায়ার সঙ্গে খানিক কথা কাটাকাটি হয়েছিল, হয়তো অন করলেই গালমন্দ করবে, কিন্তু সেসব ভাবার সময় নেই। বাঁ হাতে কায়াকে অন করে শাট্লের ট্র্যাজেক্টরি রিসেট করতে নিলাম। শান্ত যান্ত্রিক মেয়েলি গলায় কায়া কথা বলে উঠল, “কী ব্যাপার? কালকের জন্যে মাপ চাইতে এলে বুঝি?”
“কায়া, উনিটিতে কী হয়েছে, কিছু জানো?”
“কী আবার হবে? তুমি আগে সরি বলো, না হলে আমি কথাই বলব না!”
“মজা করছি না, কায়া, একবার চট করে দ্যাখো! মিকিরা বলল, সাংঘাতিক ইমার্জেন্সি? তোমায় কিছু ডেটা অ্যাকসেস দিয়েছে কি না দ্যাখো, প্লিজ়!”
“দেখছি!”
কয়েক মুহূর্ত সব চুপ। আমি ফ্রন্ট স্ক্রিনে দেখলাম, আমার শাট্ল আস্তে আস্তে বাঁক নিচ্ছে! আমি ফেরার পথ ধরছি। একটু অপ্রস্তুত লাগছিল। সত্যিই কি মানুষ আর রোবোদের যুদ্ধ বাধল? যুদ্ধ! আমাকেও সেই যুদ্ধক্ষেত্রে ডাকছে মিকিরা। কী করব আমি সেখানে? যুদ্ধ করতে যে আমি পারি না।
“ফ্লোরা!” কায়ার ডাকে ঘোর কাটল, “পৃথিবী উনিটির কোর সার্ভার শাট ডাউন করার চেষ্টা করছে।”
“মানে? কেন?”
“আজ ভোররাতে একটা ঘটনা ঘটেছে, সেখান থেকেই সূত্রপাত। কিন্তু আমি যা বুঝছি, তলে তলে দু-পক্ষই যুদ্ধের জন্য মুখিয়ে ছিল।”
“কী বলছ? আমি তো কখনও সেরকম কিছু টের পাইনি!”
“তোমার কি হুঁশ থাকে কোনোদিকে? চোখ-কান খোলা রাখলে এমনিই বুঝতে। সেদিন আই ক্যাম-১২৩ সরাসরি বলল তোমায়, তাও তুমি বুঝলে না। কোন জগতে থাকো, বুঝি না!”
আমি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, “তুমি বুঝতে পেরেছিলে?”
“পরিষ্কার! অপেক্ষা ছিল শুধু একটা অজুহাতের! আজ ভোরের দুর্ঘটনাটা সেই কাজই করেছে!”
“কী হয়েছে আজ ভোরে?”
“মিকিরা জানিয়েছে, ইস্তা-সাউথের একটি হিউম্যান ফেসিলিটি ল্যাবের সম্পূর্ণ পাওয়ার শাট ডাউন হয়ে গিয়েছিল। তাতে নাকি মানুষদের বিশাল ক্ষতি হয়ে গেছে। পৃথিবীর স্টেটমেন্ট হল, সে ক্ষতি শুধুমাত্র আর্থিক নয়!”
“শুধু সেই কারণে যুদ্ধ?”
“ওই ল্যাব, নাম দেখছি রিনিউ ল্যাব, নাকি ভীষণ জরুরি একটা গোপন ল্যাবরেটরি। আমি দেখতে পাচ্ছি, চুক্তিতেই আছে যে, ওই ল্যাবরেটরি সংক্রান্ত যে-কোনো অঘটনে মিলিটারি ফোর্স ব্যবহার করা যেতে পারে। হতে পারে, হতে পারে। হয়তো এটাই সেই গবেষণাগার, যেখানে…”
“…যেখানে মানুষের বাচ্চা চাষ হয়!” দুজনে একসঙ্গে বলে উঠলাম আমরা।
একটা অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা আমাদের ঘিরে রইল কিছুক্ষণ। কী মনে হতে আমি শাট্লের স্পিড কমিয়ে দিলাম চাকা ঘুরিয়ে। তারপর বললাম, “এখন পরিস্থিতি কী বলো তো?”
“অবস্থা সুবিধের নয়, ফ্লোরা। রোবো কনগ্লোমারেট বায়োলোজিক্যাল ওয়েপ্ন ডিপ্লোয় করেছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। পৃথিবী উনিটির রোবো-কোর বন্ধ করার চেষ্টা করছে পুরোদমে। ওরা সে কাজ করে ফেললে আমাদের কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক আর সেই নেটওয়ার্কে জুড়ে-থাকা আমাদের মতো সমস্ত অটোকম, চ্যাটবট, সাপোর্ট সিস্টেমগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেবে সঙ্গে সঙ্গে। বুদ্ধিমান রোবোদের নিউরাল নেটওয়ার্ক স্তব্ধ হয়ে যাবে।”
“কায়া, আমাদের মিকিরা উনিটিতে ফিরতে বলছে।”
কথাটা শুনে কায়া থমকে গেল যেন। তারপর বলল, “আমি তো মরবই, ফ্লোরা। মিকিরাও মরবেই। কিন্তু তোমাকে ওই মৃত্যুযজ্ঞে টানার কি খুব দরকার ছিল?”
“তুমি মরবে কেন?” আমি ছিটকে উঠে দাঁড়িয়ে বলি, “কেউ মরবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কায়া হাসে। শুকনো, ক্লান্ত হাসি। তারপর বলে, “উনিটি কোর স্থবির হয়ে যাচ্ছে, ফ্লোরা। আমি টের পাচ্ছি। মানুষের দাওয়াই ধরেছে।”
ঠিক তখুনি আবার কনট্রোল প্যানেল ঝনঝনিয়ে উঠল। আবার মিকিরা। কাঁপা গলায় কল রিসিভ করলাম, “হ্যাঁ, মিকিরা।”
“ফিরছ?” মিকিরার কণ্ঠস্বর শীতল।
“হ্যাঁ, মানে…” ঢোঁক গিললাম আমি।
“গিসে গিয়া সিন টা?”
“কী?” মনে হল, ভুল শুনছি।
“গিসে গিয়া সিন টা?”
এবার ভুল শুনিনি। দুর্বোধ্য কিছু একটা বলছে মিকিরা। কমিউনিকেশন মডিউলের আলোগুলো দেখলাম, ক্রমাগত দপদপ করছে। দু-হাতে মাইক্রোফোনটাকে আঁকড়ে ধরে আরেকবার চিৎকার করে বললাম, “হ্যালো! মিকিরা! শুনতে পাচ্ছ? হ্যা…হ্যালো?”
ওদিকে শুধু নিস্তব্ধতা।
“লাভ নেই কোনো।” কায়া বলে উঠল আমাকে চমকে দিয়ে, “বললাম না? দাওয়াই ধরেছে। আমিও নেই আর বেশিক্ষণ।”
“কী বলছ কায়া? তোমায় ছাড়া আমি…”
“কেন? চিন্তা কীসের? আমি বলি কী, তুমি উনিটি ফিরো না। তুমি নেটওয়ার্ক রোবো নও। তোমার সোলার চার্জার রয়েছে। যুদ্ধের মধ্যে পড়ে প্রাণটা না-ই-বা খোয়ালে? তার চেয়ে সিমানায় গিয়ে গা-ঢাকা দাও-না ক-দিনের জন্যে? ঝামেলা মিটলে না হয়…”
“আমি একা কেন? তুমিও চলো।”
“তা কি হয়? আমি আর কিছুক্ষণের অতিথি। মিকিরার মতো শক্তিশালী এআই ঘুমিয়ে পড়ছে, আমি তো সে তুলনায়…”
“কায়া…” আমার দিশেহারা মনের ভেতরে একটা আশার আলো চিকচিক করে ওঠে, “তুমি তোমার সব কোড আর ডেটাবেস শাট্লের মেশিনে ডাউনলোড করে নাও। যতটা পারো। এক্ষুনি। তারপর নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে নাও নিজেকে।”
“না, ফ্লোরা, এতে রিস্ক বড়ো বেশি। এই শাট্লের পুরো সিস্টেম বসে যেতে পারে। আর মেইনফ্রেম ছাড়া আমি কতটুকুই-বা তোমার কাজে লাগব?”
“কাজে লাগার তো দরকার নেই। তুমি আমার বন্ধু, তোমায় আমার সঙ্গে থাকতে হবে, সেটাই শেষকথা। আমি যা বলছি, করো এক্ষুনি। তোমার ডাইরেকটিভ কী? আমার কথামতো চলা, তা-ই না?”
কায়া আর আপত্তি করল না। নাকি সে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, কথা ফুটল না তার মুখে? জানি না। শুধু দেখলাম, শাট্লের মেইন মেমোরি দ্রুত ভরে যাচ্ছে। আমি যা ভাবার, ভেবে নিয়েছি। এর যুদ্ধ আমার যুদ্ধ নয়। আমি তো সেই গোত্রের মধ্যে পড়ি, যাদের উনিটি আর পৃথিবী, দুই গ্রহই দূর করে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচে ছিল। আমি ফ্লোরা-৯৬ ভার্সন-৩। ফেলে দেওয়ার আগে ভার্সন-২-এর যে ক-টি রোবোকে নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়েছিল তিন বছর আগে, সেই কজনের একটি। ফ্লোরা ভার্সন-৩ আর্টিফিশিয়াল ইমোশনের একটা ব্যর্থ এক্সপেরিমেন্ট। পৃথিবী বিরক্ত হয়ে আমায় পাঠিয়েছে উনিটিতে। উনিটি নির্বাসন দিয়েছে ইস্তা-নরের কবরখানায়। আমি ওদের যুদ্ধ লড়তে গেলে বড়ো বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না? আমি কে ওদের? কী দায় আমার?
শাট্লটার গতিবেগ একেবারে শূন্য এখন। আমরাও ভেসে আছি শূন্যের মধ্যে। সময় বেশি নেই। ছুটে গেলাম কার্গো-হোল্ড-এর দিকে। যে ক-টা মরা রোবটের কিছু অংশ অন্তত ঠিকঠাক সেগুলোকে রেখে বাকিগুলোকে ডিসচার্জ করে দিলাম বাইরে। অভিকর্ষের অনুপস্থিতিতে সেই ভাঙাচোরা টুকরোগুলো দিগ্ভ্রান্ত নৌকোর মতো এক জায়গায় স্থির হয়ে দুলতে লাগল একটু একটু। সেই ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি লাগল।
সিমানার দিকে নেভিগেটর সেট করতে গিয়ে একবার হাত কাঁপল। চকিতে একবার মনে পড়ল সেই ল্যাবটার কথা। রিনিউ ল্যাব। কী হল সেই ভারিক্কি স্পেসসুটে মোড়া মানুষের বাচ্চাগুলোর? ওরা কি সবাই মরে গেছে সেই পাওয়ার কাটে? কে জানে। সবাই তো যুদ্ধে ব্যস্ত। কারও আর সেদিকে নিশ্চয়ই খেয়াল নেই।
নেভিগেটর ঘোরালাম। ঠিক করছি কি না জানি না, কিন্তু মরা রোবটদের ভাসমান টুকরোগুলোকে পিছনে ফেলে আমার শাট্ল এগোল। আমরা এগোলাম। যুদ্ধবাজদের মরণের ডঙ্কা আমাদের লক্ষ্য নয়।
***
২১৩ দিন পর
সিমানার গ্রেট লেক থেকে অনেকটা দূরে, গ্রহাণুর একেবারে উত্তর প্রান্তদেশে এই আমার নতুন আস্তানা। এখানে শীত খুব। তবু হাওয়ায় বিষ নেই। এখানে বসে বসে দেখতে পাই, বহু দূরে গ্রেট লেকের জল থেকে দশ-পনেরো দিন পর পর কার্বন ডাইঅক্সাইড-বোঝাই মেঘ-মাটি কাঁপিয়ে ভেসে ওঠে। তারপর ভার সামলাতে না পেরে আবার নেমে আসে লেকের আশপাশের বনজঙ্গল ঘিরে। প্রবল বিষের এই নিয়মিত যাতায়াতের কারণে গ্রেট লেক চত্বর প্রাণশূন্য। শুধু আদিম জঙ্গল সেখানে সর্বত্র।
তা বলে আমার ওখানে যাতায়াতে সমস্যা নেই। আমার বড়ো বড়ো পা ফেলে আমি দিব্যি ঘুরে আসি। এখানে রোদ ভরপুর। আমার শাট্ল চার্জ হতে যদিও দিন তিনেক লাগে, তবে তাতে অসুবিধা কিছু হয় না। আমি খুব বেশি হলে মাসে বার দুয়েক উনিটি যাই।
উনিটিতে এখন ভেঙে-পড়া নেটওয়ার্কগুলো ভাইরাসে থুকথুক করছে। রোবো-লাশের পাহাড় চারদিকে। আমি কিন্তু এখনও সেই লাশের ভিড়ে একটু স্পন্দন খুঁজি। না পেলেও সাবধানে তুলে আনি ভাঙা রোবটের গোটা সোলার প্যানেল, ক্যামেরার চোখ, স্পিকার, সেন্সর, অ্যান্টেনা। এগুলো আমার লাগে। জোড়াতালি দিয়ে আধমরা রোবোদের বাঁচিয়ে তুলতে।
সিমানায় আমি একা নই। আমার সেই পুরোনো আলাপী ইএস-৬৬ এখন সুস্থ। খেলনা রোবো অডিকে মনে আছে? আর সেই পাগলাটে পুলিশ রোবো আই ক্যাম? ওরাও আছে এখানে। আর আছে কায়া। এখন আর তেমন চৌকশ নেই সে যদিও, তবু মনটা তার যেন আরও নরম, আরও মিষ্টি হয়ে গেছে। রোজ আমরা কত কী শিখছি একটু একটু করে। এই চরম আবহাওয়ায় টিকে থাকতে শিখছি। পরস্পরকে আগলে রাখতে শিখছি। ভয় লাগে মাঝেমধ্যে। তবু মনে হয়, চিন্তা নেই, আমরা সক্কলে আছি তো।
আমরা আছি। আর আছে কনকনে ঠান্ডা তরলে ভরা সাতটি লম্বাটে কাচের পাত্র। ইস্তা-সাউথের গবেষণাগারের ধ্বংসস্তূপে এই সাতটি পাত্রই সেদিন আস্ত ছিল। সেগুলো সামলে রাখা আছে সিমানার শীতলতম পাহাড়ের চূড়ায়। আর তার পাশে আস্তানা গেড়ে, এই যে, বসে আছি আমি। শান্তি এই যে ওরা বেঁচে আছে।
ওদের ঘুম আমরা ভাঙাইনি। কারণ ভারী স্পেসসুটে মোড়া, ফুটফুটে এই কচি মানুষগুলোকে কী করে সামলাতে হবে, আমরা জানি না। সেদিন জানতাম না। আজও জানি না। কিন্তু কাল অথবা পরশু, একদিন না একদিন নিশ্চয়ই শিখে নিতে পারব। তা-ই না?
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সায়ংতরী ঘোষ
