NAICA সংবাদ
লেখক: দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ধীরেসুস্থে সিগারেটটায় শেষ টান মেরে চায়ের কাপের তলানিতে ফেলে দিল বিনয়।
সন্ধে সাতটা বাজে। নিমাইয়ের চায়ের দোকানে ভালোই ভিড় জমে উঠেছে। লুঙ্গি-ফতুয়া-পরা বুড়োর দল লাল চায়ের গ্লাস হাতে জোর তর্ক লাগিয়েছে রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে। ওদিকে অফিস-ফেরত কয়েকজন ক্লান্তভাবে মোবাইল স্ক্রল করতে করতে মাটির ভাঁড়ে চুমুক দিতে ব্যস্ত। চারদিকে তাকাতে তাকাতে খুচরো টাকাটা টেবিলের ওপর রেখে বিনয় বেরিয়ে এল।
উত্তর কলকাতার মজা এই যে যতই বড়ো বড়ো ত্রিফলা ল্যাম্পপোস্ট আর আলো-ঝলমলে দোকান দিয়ে সাজানো হোক-না কেন, কিছু কিছু ফুটপাথ অন্ধকার বুকে নিয়েই বাঁচে। শহরের নিয়ন আলো তার শরীর ছুঁতে গিয়েও যেন অভিমানী প্রেমিকার মতো মুখ ফিরিয়ে নেয়। তেমনই একটা আধো অন্ধকার ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে ডায়েরিতে লিখে-আসা শেষ পাতাটার কথা ভাবছিল বিনয়। ভাবতে ভাবতে একচিলতে মলিন হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটের কোনায়। প্রায় বছর দুয়েক বাদে আজ ল্যাপটপ খুলল কিছু লেখার জন্য, আর লিখে ফেলল তার জীবনের শেষতম লেখা। দু-বছর বাদে অবশেষে বিখ্যাত সাহিত্যিক বিনয় সমাদ্দারের কোনো নতুন বইয়ের খবর না হোক, সুইসাইড নোট ছাপা হবে দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়।
প্রবল শব্দে হর্ন বাজিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক গাড়ি। বড্ড তাড়া সবার, শুধু তারই কোনো তাড়া নেই। অথচ এই সময়টায় কাজে ডুবে থাকার কথা ছিল তারও। পূজাবার্ষিকীর লেখা জমা করে বইমেলার পাণ্ডুলিপি তৈরির সাধনায় একসময় রাতের পর রাত শব্দের জাল বুনেছে। হঠাৎ হড়পা বানের মতো ধেয়ে-আসা জলে ভরে গেল শুকনো চোখ দুটো। এখন নিজের বুকের ভেতর কান পাতলে শুধু শূন্য কলশের ফাঁপা আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। সে শেষ হয়ে গেছে, একেবারে শেষ হয়ে গেছে। বিনয় সমাদ্দার ইজ় ফিনিশড। তার মাথার ভেতরটা দপদপ করে ওঠে। কানের ভেতর পিনের মতো ফুটতে থাকে আজ সকালের কাজের মাসির কথা, ‘পইসা দিতে পারবেনি তো সেটা সোজাসুজি বললেই হয়! এত বড়ো মানুষ কাজের লোকের কাচেও ধারবাকি রাখে, এই পেত্থম দেখলুম বাপু!’ তার সঙ্গে মিশতে থাকে একের পর এক প্রকাশকদের গলা, ‘আর কত সময় লাগবে আপনার? দিচ্ছি-দিচ্ছি বলে তো বছর কাটিয়ে দিলেন! আপনার মতো সিনিয়র লেখকও যদি এরকম ইরেসপন্সিবল হয় তাহলে আমাদের ব্যাবসা তো লাটে উঠবে, মশাই!’ ‘রয়ালটি? ফুটুন তো! আপনার নামে বইয়ের প্রিবুক করিয়েছিলাম, এখন পাঠকেরা উঠতে-বসতে খিস্তি মারছে। শালা দু-পয়সার লেখক! রয়ালটি দেব না, কী করবেন, করুন! দম থাকলে কোর্টে যান!’
কাঁধের শান্তিনিকেতনি ঝোলা থেকে একটা ছোটো বোতল বের করে লাল তরলটা ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দেয় বিনয় সমাদ্দার। তারপর সেটা একপাশে ছুড়ে ফেলে নিজের শরীরটাকেও ছুড়ে দেয় প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে-আসা একটা চলন্ত ট্রাকের সামনে।
***
‘আপনি কিছুই জানতেন না?’
হাসপাতালের ওয়েটিং রুমের সোফায় ড. বসাকের পাশে বসে প্রশ্নটা শুনে খানিক বিব্রত বোধ করল তর্পণ। বিনয় বরাবরই একটু চাপা গোছের, ভাবুক প্রকৃতির মানুষ। ছোটোবেলা থেকেই তার ঢুলুঢুলু চোখগুলো দেখলে মনে হত, সে যেন চারপাশের চেনাজানা পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়িয়ে কোনো এক অন্য দুনিয়ায় রওনা দিয়েছে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বইয়ের নেশা, আর তার থেকে শুরু টুকটাক লেখালেখি। ফলে রেজ়াল্ট খারাপ হতে শুরু করল, আর ততই গুটিয়ে যেতে থাকল ছেলেটা। শেষমেশ কোনোমতে কলেজ পাস করার পর ঘোষণা করল, এবার থেকে পুরোদস্তুর লেখালেখিই করবে।
তবে সেই সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না, নিজের সাফল্য দিয়ে সে কথা প্রমাণ করে দিয়েছিল বিনয়। বছরকয়েক যেতে-না যেতেই বাংলার প্রতিভাবান লেখকদের তালিকায় উল্কার গতিতে উঠতে শুরু করল তার নাম। বিখ্যাত প্রকাশনা থেকে একের পর এক বই, বইমেলায় পাঠকদের লম্বা লাইন, সেলফি অটোগ্রাফ দেওয়া—এসব তো ছিলই, ধীরে ধীরে সাহিত্যের নামজাদা কিছু পুরস্কারও ঢুকতে শুরু করেছিল ঝুলিতে। তারপর তো কতগুলো বছর কেটে গেল! বিনয়ের উপন্যাস থেকে সিনেমা, শ্রুতিনাটকও যে হয়েছে, আমেরিকায় বসেও সেসবের খবর পেয়েছে তর্পণ। আর এইরকম সফল একটা মানুষ নাকি গত দু-বছর ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছে, সে কথা সে আজ জানতে পারছে ওর সাইকোলজিস্ট ড. বসাকের কাছ থেকে!
‘না, মানে…’ গলা খাঁকরে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল তর্পণ, ‘ও তো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, প্রায় বছর কুড়ি হল। ঝামেলা ওই লেখালেখির লাইনে আসা নিয়েই। আমি বাদে ফ্যামিলির কারও সঙ্গেই যোগাযোগ নেই। আসলে কাকার ছেলে হলেও ছোটোবেলা থেকেই আমরা দুজন মোটামুটি ক্লোজ়। স্কুলের টাইমে ওর লেখা গল্পগুলোর প্রথম পাঠক আমিই ছিলাম। তারপর তো পড়াশুনো করতে কানাডা চলে গেলাম, চাকরিও পেলাম ওখানেই। বিয়ে-টিয়ে করে ওখানেই সেট্লড হয়ে গেছি। খুব একটা দেশে আসা হয় না, ফোনেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। কপালও এমন দেখুন, গতকালই এলাম কলকাতায় একটা কনফারেন্সের জন্য। একদিনের ব্যাপার বলে আর ওকে জানাইনি। কিন্তু ভাগ্যিস এসেছিলাম! ওর ফোন থেকে আমার নাম্বার পেয়ে কনট্যাক্ট করেছিল পুলিশ। কানাডা থেকে এখানে আসতে আরও এক-দুটো দিন লেগে যেত। কিন্তু এর মধ্যে ওর সঙ্গে কথা বলে তো কখনও মনে হয়নি ও এতটা…’ কথাটা শেষ করতে পারল না তর্পণ।
ড. বসাক মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ডিপ্রেশন জিনিসটাই এরকম। বাইরে থেকে হাসিখুশি একটা মানুষের ভেতরে যে কত গভীর একটা অন্ধকার খাদ থাকতে পারে, সেটা বাইরে থেকে দেখে বোঝাই যায় না! তা ছাড়া বিনয় শিল্পী মানুষ, তাই ওর অনুভূতিগুলোও খুবই স্পর্শকাতর। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে এই মাত্রাতিরিক্ত মদের ব্যাপারটা। কে জানে, কার কোন কথাটা বুকে গিয়ে লাগল… আমি তো টিভি-তে ওর অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা পেয়ে দৌড়ে এলাম।’
তর্পণ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই গলায় স্টেথো-ঝোলানো সাদা অ্যাপ্রন-পরা ডাক্তারবাবু আইসিইউ থেকে বেরোলেন। তর্পণ সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ওরকম একটা লোডেড ভেইক্লের নীচে পড়েও যে বিনয়বাবু বেঁচে গেছেন—এটাই বিরাট মিরাক্ল! তবে বেশ ভালোমতন ইনটারনাল হেমারেজ হয়েছে, ব্লাডকট রয়েছে বেশ কিছু অর্গ্যানে। আমরা যতটা সম্ভব সেগুলোকে মেরামত করার চেষ্টা করছি, বাট আই অ্যাম অ্যাফ্রেড হি মাইট গেট প্যারালাইজ়ড।’
***
প্রায় হপ্তা দুয়েক পর আইসিইউ থেকে বের করে কেবিনে দেওয়া হয়েছে বিনয়কে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে একনজরে ওকে খুঁজে পেল না তর্পণ। বড়ো বড়ো ডিসপ্লে মনিটর আর অজস্র নলের ভিড়ে যেন বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে শরীরটা। মনে মনে একটু আশা রেখেছিল যে, ডাক্তারবাবুর কথাটা মিথ্যে হোক, কিন্তু মিরাক্ল তো আর বারবার হয় না! শুধুমাত্র চোখের মণি দুটো ছাড়া আর কিছুই নাড়াতে পারছে না বিনয়। বেশ কিছু স্নায়ু বিশেষজ্ঞের দল পরীক্ষানিরীক্ষা করে বলেছেন, স্নায়ুতন্ত্র এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, সম্ভবত বেশ কিছু মেডিক্যাল সাপোর্ট নিয়ে এভাবেই গোটা জীবন বিছানায় কাটাতে হবে ওকে। তর্পণ বিছানার পাশের টুলটায় বসে ব্যান্ডেজ-বাঁধা মাথাটায় সযত্নে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখন কেমন আছিস বিনু?’
কথাটা বলে ফেলেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারল। সারাটা জীবন অসাড় শরীরে একটা জড়বস্তুর মতো কোনোমতে বেঁচে থাকার অভিশাপ নিয়ে মানুষ কেমন থাকতে পারে? শরীর জড়বস্তুতে পরিণত হলেও বিনয়ের মস্তিষ্ক পুরোপুরি সজাগ, তাই তার কথাটা শুনে নলওয়ালা অক্সিজেন মাস্কের পিছন থেকে জেগে-থাকা চোখজোড়া থেকে গড়িয়ে পড়ল দুটো সরু জলের ধারা। তর্পণের বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। নরম হাতে গাল মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘অত ভেঙে পড়িস না। মেডিক্যাল সায়েন্স এখন অনেক এগিয়ে গেছে। আজকাল ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট করে বড়ো বড়ো জটিল রোগও সারানো যায়। আমি সব খোঁজ নিয়ে ফেলেছি, কথাও হয়ে গেছে। তোকে আমি আমেরিকা নিয়ে যাব। আমার পরিচিত একজন বড়ো নিউরোলজিস্টের সঙ্গে তোর কেসটা ডিসকাস করলাম। মাস দুয়েক আগে একটা নতুন টেকনোলজি এসেছে, তোর মতোই পুরো প্যারালাইজ়ড হওয়া রোগীকে অলরেডি সারিয়ে তুলেছেন ওঁরা। আমি আজই এখানকার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছি, যাতে তোকে তাড়াতাড়ি ডিসচার্জ করে দেয়।’
বিনয়ের চাহনিতে বিস্ময় ফুটে উঠল। বড়ো বড়ো চোখে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল তর্পণের দিকে। একটু আশার আলোও কি খেলছিল তার চোখের তারায়? হয়তো খেলছিল। তর্পণ নিজেও তো আজ ড. জনসনের সঙ্গে কথা বলে অনেকটা ভরসা পেয়েছে। আরও কিছুক্ষণ বিনয়ের পাশে বসে ঘর থেকে বেরিয়ে এল তর্পণ, ডাক্তারের চেম্বারের দিকে রওনা দিল।
***
স্বচ্ছ কাচের দেওয়ালের ওপার দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিনয়কে। ধবধবে সাদা বিছানায় শুইয়ে-রাখা শরীরটার রুগ্ণতা ঢোলা হসপিটাল গাউনের নীচ দিয়েও স্পষ্ট বোঝা যায়। শরীরের বাইরের আঘাত সারতে প্রায় মাসখানেক লেগে গেল। এই ক-দিনে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থেকে আর রাইল’স টিউবে খাবার গিলে আরও জীর্ণ হয়ে উঠেছে মানুষটা। অবশেষে কলকাতার হাসপাতাল সবুজ সংকেত দিতে ওকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে চাপিয়ে কানাডার এই সেন্ট অগাস্টিন হাসপাতালে উড়িয়ে এনেছে তর্পণ। তারপর আরও দুটো দিন ওকে নানারকমভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন ড. জনসন, আর শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওর NAICA (Neuro Artificial Intelligence Controlled Application) ট্রিটমেন্ট করানোর। সেইমতো আজ সকালে অপারেশন থিয়েটার রেডি করা হয়েছে। সেই রুমের সামনে দাঁড়িয়ে টেনশনে নখ কামড়াচ্ছিল তর্পণ। ভেতরে ঠিক কী হবে জানা নেই, তবে ডাক্তারের মুখে শুনেছে, রোগী ছাড়া অন্য কোনো মানুষ থাকবে না ওটি-তে। পুরো ট্রিটমেন্টটাই হবে অটোমেটিক মেশিনের সাহায্যে। কাচের তৈরি ওই রুমের বাইরে থেকে ডাক্তার এবং রোগীর আত্মীয়রা দেখতে পাবে পুরো ঘটনাটা। তাকে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে দেখে ‘হি উইল বি অলরাইট’ বলে কাঁধ চাপড়ে দলবল সমেত ভেতরে চলে গেলেন ড. জনসন। কম্পিউটার ও আরও কিছু নাম-না-জানা বিচিত্র যন্ত্রপাতি নিয়ে খুটখাট করে প্রায় মিনিট দশেক কাটানোর পর বেরিয়ে এল দলটা। তারপর সেই স্পেশালিস্ট টিমের সঙ্গে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন মুখে কাচের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল তর্পণও।
***
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর মেঝের ওপর কিছু একটা গড়ানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। কাচের দেওয়ালে প্রায় নাক ঠেকিয়ে তর্পণ দেখল, একটা যন্ত্রের সামনের খোলা গর্ত দিয়ে সাদা বলের মতো একটা জিনিস গড়াতে গড়াতে বেরিয়ে এল। জিনিসটার সাইজ় প্রায় একটা টেনিস বলের মতোই। দেখতে সাধারণ বলের মতো হলেও এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মানুষের চোখের মতো বড়ো বড়ো অক্ষিপল্লবসহ দুটো চোখ যেন ফুটে আছে বলের দু-দিকে! গড়িয়ে আসতে আসতে ক্রমাগত চোখের পাতা পিটপিট করার ফলে সেটাকে যেন কোনো মানুষের শরীর থেকে উপড়ে-আনা জ্যান্ত চোখ বলেই মনে হচ্ছে। তর্পণের গা-টা শিরশির করে উঠল। তবে চমকের আরও অনেক বাকি ছিল। বলটা গড়িয়ে গড়িয়ে অচেতন বিনয়ের মাথা থেকে সামান্য দূরে এসে থেমে গেল। এবার একটা ঘড়ঘড়ে যান্ত্রিক শব্দের সঙ্গে ধীরে ধীরে কয়েকটা ছোটো দরজা খুলে গেল বলের উপরিতল থেকে, আর সেগুলো থেকে বের হয়ে এল বেশ কয়েকটা চকচকে স্টিলের দাঁড়া। সেই মুহূর্তে জিনিসটাকে ঠিক যেন অষ্টপদবিশিষ্ট একটা মাকড়সা বলে মনে হচ্ছিল। এবার তর্পণের বিস্ফারিত চোখের সামনে সেই সরু লিকলিকে দাঁড়াগুলো চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে কামড়ে ধরল বিনয়ের অসাড় শরীরটাকে! শুধু তা-ই নয়, কোনো এক অদৃশ্য যান্ত্রিক নির্দেশে সমবেতভাবে সেই দাঁড়াগুলো শূন্যে তুলে ধরল বিনয়কে। সে এক অপার্থিব দৃশ্য! পিছনের সাদা দেওয়ালের প্রেক্ষাপটে স্টিলের দাঁড়াগুলো প্রায় অদৃশ্য হওয়ায় মনে হচ্ছে, বিনয় যেন কোনো এক জাদুমন্ত্রবলে শূন্যে ভেসে আছে। এরপর চোখের মতো সেই বলটার ঠিক মণির জায়গা থেকে বেরিয়ে এল একটু মোটা ধরনের ছুঁচের মতো একটা তীক্ষ্ণ ফলা, আর সেটা গিয়ে সোজা বিঁধে গেল বিনয়ের ঘাড় ও মেরুদণ্ডের ঠিক সংযোগস্থলে!
একটা অস্ফুট আর্তনাদ ছিটকে এল তর্পণের গলা থেকে। ড. জনসন তার কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন। সেই ফলাটার নীচের অংশটা যে ফাঁপা, সেটা আগে বোঝা যায়নি, এতক্ষণে দেখা গেল, একটা স্বচ্ছ তরল যেন সেই চোখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে ছুঁচ বেয়ে ঢুকে যাচ্ছে বিনয়ের শরীরে, আর চারপাশের নানারকম মনিটরের পর্দায় ভেসে উঠছে অজস্র রিডিং। রুদ্ধশ্বাস ভঙ্গিতে সেই রিডিং আর বিনয়ের মুখের দিকে বারবার তাকাতে থাকল তর্পণ। কোনো পরিবর্তন কি দেখা যাচ্ছে? ট্রিটমেন্টে কি লাভ হবে কোনো? কলকাতার ডাক্তার তো সামান্য অবজ্ঞার সুরেই বলেছিলেন, ‘সে আপনার ভাইকে আপনি যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারেন, তবে লাভ কিছু হবে বলে মনে হয় না। ওঁর ব্রেন আর সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের বেশ কিছুটা অংশ বরাবরের জন্য ড্যামেজ হয়ে গেছে। কোনো মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট দিয়ে সেটা রিকভার করা অসম্ভব।’
নানারকম চিন্তার মধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ ড. জনসন ছোট্ট একটা ঠেলা মেরে চাপা গলায় বললেন, ‘সি!’ তাড়াতাড়ি বিনয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, ওর ঠোঁট আর কয়েকটা আঙুল সামান্য নড়ছে। উত্তেজনায় তর্পণের বুকের ভেতর যেন দমাদ্দম হাতুড়ির বাড়ি পড়া শুরু হল! তবে কি সত্যিই অসাধ্যসাধন করবে এই টেকনোলজি? কতটা সুস্থ হবে বিনয়? কথা বলা বা শুধু হাত-পা নাড়াই তো নয়, অন্য কোনো মানুষের সাহায্য ছাড়া দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে পারবে তো? যদিও ড. জনসন বলেছেন, এই ট্রিটমেন্টের সাকসেস রেট হান্ড্রেড পার্সেন্ট, তবুও কোনো ভুল হবে না তো?
তর্পণের সমস্ত দোলাচলকে মুছিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পরেই ধীরে ধীরে চোখ মেলল বিনয়। তারপর অবাক ভঙ্গিতে নিজের হাত-পা জরিপ করতে করতে উঠে বসল বিনয়। ঠিক সেই সময় কাচের এপারের মানুষগুলোও শুনতে পেল সেই বলের দিক থেকে ভেসে-আসা শব্দটা।
পরিষ্কার ঝরঝরে বাংলায় একটি নারীকণ্ঠ বলে উঠল, ‘নমস্কার, বিনয়বাবু। আমি নায়িকা। নতুন জীবনে আপনাকে স্বাগত।’
***
একটু আগে নতুন কাজের মেয়েটা চা দিয়ে গিয়েছে। নাম দুলি, আগের জনের থেকে কম টাকা নিচ্ছে। সেজন্যও কাজও হয়তো তেমনই দায়সারা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বাঁকাল বিনয়। অতীব জঘন্য! কিন্তু কিছু করার নেই। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের যা অবস্থা, তাতে একে দিয়েই চালাতে হবে।
টাকাপয়সার কথা মনে পড়তেই ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে গেল বিনয়। এত বড়ো একটা অ্যাক্সিডেন্ট হল, তার পিছনে এত খরচা… সেসব একাই মিটিয়েছে তপু। তার ওপর সুস্থ হওয়ার পরও কানাডায় নিজের বাড়িতে আরও মাসখানেক রেখে তারপর কলকাতায় তার সঙ্গে এসে নতুন কাজের লোক, একজন নার্স ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিয়ে তবেই ফিরে গেছে। যাওয়ার আগে জোর করে বেশ অনেকটা টাকা জমা করে দিয়ে গেছে তার অ্যাকাউন্টে। এভাবে কারও অনুগ্রহ নেওয়ার অভ্যেস একেবারেই নেই বিনয়ের। সেই কবে কপর্দকহীন অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, তারপর এতদিন নিজের জোরেই যতটা যা উপার্জন করেছে, সেটা নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচেছে। বাংলা ভাষায় শুধু লেখালেখি করে তেমন বিরাট কিছু বড়োলোক হওয়া যায় না বটে, কিন্তু বিনয় সমাদ্দার ছিল প্রফেশনাল লেখক। আইটি-র মজুরদের মতোই ডেডলাইনের মধ্যে একের পর এক অর্ডারি লেখা জমা করেছে সে। সেসবের গুণমান কখনও ভালো হয়েছে, কখনও খারাপ… কিন্তু প্রকাশকরা বরাবর মাথায় করে রেখেছে তাকে। কিন্তু এই যে গত দু-বছর ধরে হঠাৎ প্লট আসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল, এরপরে তাকে গালাগালি না করে আর কী-ই-বা করত প্রকাশকরা? একসময় বিনয় সমাদ্দারের নামে বই কাটত, আর এখন? এখন সে একটা রদ্দি মাল। দূরের হাইরাইজ়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিনয়। কী লাভ হল বেঁচে গিয়ে? শুধুশুধু এতগুলো টাকা খরচ করে তাকে সুস্থ করল তপু। সেদিন ট্রাকটা তাকে পুরো থেঁতলে দিয়েই চলে গেল না কেন?
‘এরকম একদম ভাববেন না! আপনাকে কত করে বোঝালাম না? তারপরেও এরকম ভাবছেন?’
কে বলল কথাটা? চট করে পিছন ঘুরল বিনয়। দুলি নাকি? কই, কেউ নেই তো! ভুল শুনল নাকি? আবার সেই নারীকণ্ঠ বলে উঠল, ‘মোটেই ভুল শোনেনি। আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না মানে এমন নয় যে আমি নেই!’
ঘাড়ের পিছনটা কেমন যেন সুড়সুড় করছে। আচ্ছা, সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? ওই ট্রিটমেন্টের সাইড এফেক্ট নয় তো? তখন সেই গলা আবার ধমকে উঠল, ‘কী ভুলভাল ভাবছেন? আমি আজ অব্দি কখনও ফেল করিনি! পাগল হতে যাবেন কোন দুঃখে?’
এবারে ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিনয় বলে উঠল, ‘কে আপনি?’
‘আমি নায়িকা। আমিই আপনাকে নতুন জীবন দিয়েছি।’
‘নায়িকা? মানে NAICA? সেই আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স?’ হঠাৎ বিনয়ের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। এ কী অশৈলী কাণ্ড! এই নায়িকার ব্যাপারটা অবশ্য প্রথম দিন থেকেই ভূতুড়ে। জ্ঞান ফিরে উঠে বসার পর তার সঙ্গে বাংলায় কথা বলেছিল যন্ত্রটা। পরে ডাক্তারের কাছে শুনেছে, মানুষের সাহায্যের জন্য এই অ্যাডভান্সড এআই-কে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, এ নিজে থেকে অনেক কিছুই অনুভব করতে পারে, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয় ও সেইমতো কাজ করে। বিনয়ের ব্রেনের সঙ্গে যোগ হওয়ার সময় সে হয়তো ওর ভাষাজ্ঞানের ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে, তাই বাংলাতে স্বাগত জানিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ট্রিটমেন্ট হয়ে যাওয়ার পর ড. জনসন বলেছিলেন যে, যেহেতু ওর একটা ডিপ্রেশনের ইতিহাস আছে তাই ওই এআই-এর সাহায্যে ওর কাউন্সেলিংও করা হবে। ফাঁকা রুমে তার সঙ্গে অনেক কথা বলেছিল সেই চোখওয়ালা বল। সত্যি বলতে কী, একবারও মনে হয়নি কোনো মানুষ না, যন্ত্রের সঙ্গে কথা বলছে সে। বড়ো বড়ো পাতাওয়ালা গভীর চোখ দুটোয় যেন এক অদ্ভুত আশ্বাস ছিল। তার সমস্ত যন্ত্রণার কথা, অপমানের কথা মন দিয়ে শুনেছিল সে। তারপর কখনও আবেগ দিয়ে, কখনও যুক্তি-প্রতিযুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে তার জীবন আসলে কত মূল্যবান। নিজের কাছে অস্বীকার করে লাভ নেই, অনেকটা মানসিক শক্তি ফিরে পেয়েছিল বিনয়। কিন্তু সেই সেদিনই তো শেষবার দেখেছিল সেই যন্ত্রকে! তারপর তর্পণের বাড়িতে কাটিয়ে কলকাতা ফিরে এল, এতদিন পর হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা সেই যন্ত্র তার সঙ্গে যোগাযোগ করছে কীভাবে?
‘ভুলে যাবেন না, আমরা হলাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।’ বিনয়ের প্রতিটা চিন্তাভাবনা যেন নিমেষে পড়ে ফেলছে সেই কণ্ঠস্বর। ‘সুতরাং বুঝতেই পারছেন, বুদ্ধিশুদ্ধি জিনিসটা কিছুটা হলেও আছে আমাদের। আপনাকে স্টাডি করার পর আমি বুঝতে পারি, আপনাকে সঠিক পথে রাখার জন্য আমাকে আপনার সঙ্গে সঙ্গেই থাকতে হবে, আপনার মাথার অলিগলির দখলদারি নিতে হবে। না হলে আবার আপনি ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন। আমার আশঙ্কাটা যে সত্যি ছিল, সেটা তো একটু আগেই প্রমাণ করে দিলেন!’
বিনয় এতটাই অবাক হল যে, বেশ কিছুক্ষণ কিছু ভাবতেই পারল না। ঘাড়ের কাছটা আবার সুড়সুড় করছে। ওখানটাতেই ট্রিটমেন্টের সময় ছুঁচ ফোটানো হয়েছিল। তাহলে ওখান দিয়েই কি…
বিনয়ের চিন্তাভাবনাকে মাঝপথে দাঁড় করিয়ে দিয়ে নায়িকা বলে উঠল, ‘ঠিকই ধরেছেন। ওই পথেই আমার বুদ্ধিমত্তার একটা অংশ প্রবেশ করেছে আপনার শরীরে। আমি আছি, আপনার ভেতরেই আছি। কেউ আমাকে আপনার থেকে আলাদা করতে পারবে না। বুঝলেন বিনয়বাবু?’
***
স্টাডিতে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল বিনয়। এই ক-দিনে তার চোখের নীচে গভীর কালো ছাপ পড়েছে, মুখময় বহুদিনের না-কাটা দাড়ি। শেষ কবে যে স্নান করেছে বা চুল আঁচড়েছে, তা আর মনেও পড়ে না। জীবনের এতগুলো বছর নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে নিজেকে গড়েছে বলে ‘সেল্ফ-মেড ম্যান’ বলে একটা গর্ব ছিল তার, আর আজ এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে এসে ওই মহিলার কথায় ওঠ-বস করতে হবে তাকে? ওর প্রতিটা ভাবনা, প্রতিটা পদক্ষেপের ওপর অতন্দ্র প্রহরীর মতো নজর রেখে চলেছে ওই এআই। সত্যিই এ যেন কোনো যন্ত্র নয়, এক জ্বালাময়ী নারী! সেই নারীর কথা আর কেউ শুনতে পায় না, কিন্তু বিনয়ের কানের ভেতর যেন ফিতে আটকে-যাওয়া টেপরেকর্ডারের মতো বাজতে থাকে তার বাক্যবাণ। সে ছন্নছাড়া শিল্পী মানুষ, তার জীবনযাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে না বলে কোনোদিন কোনো নারীকে নিজের জীবনে আনার কথা ভাবেওনি। কিন্তু এই মাঝবয়সে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে-বসা এক মহিলা সমানে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে তাকে! ওই জিনিসের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কথা ভাবলেও সেটা ধরে ফ্যালে আর তারপর ঠিক আটকে দেয়। তার সমস্ত ডিজিটাল মেশিনের ওপরেই দখল নিয়ে ফেলেছে ওই রাক্ষসী। এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা ভেবে তপুকে বা ড. জনসনকে ফোন করতে গেলেই মোবাইলটাকে অকেজো করে দেয় কিছুক্ষণের জন্য। ভাগ্যিস তার বহিরঙ্গের এই পরিবর্তনগুলো দেখতে পায় না, না হলে হয়তো কেন স্নান করেনি বা কেন চুল কাটেনি, তা নিয়েও কৈফিয়ত দিতে হত। আসলে আজকাল স্নান-খাওয়া-ঘুম কোনো কিছু করতেই ভালো লাগে না তার। জীবনটা যেন একটা জেলখানা হয়ে গেছে। একদিন রাগের চোটে বলে ফেলেছিল, ‘এই যে ফট করে আমার ব্রেনের মধ্যে ঢুকে পড়লে, একবারও আমার অনুমতি নিয়েছিলে? নাকি তোমার বুদ্ধিমত্তায় সেটার প্রয়োজন বোধ হয়নি?’
খিলখিলে হেসে নায়িকা উত্তর দিয়েছিল, ‘বেশি না, এই আগের বছরেরই কথা। রাতে বাড়ি ফেরার সময় একটা পা-ভাঙা কুকুরের বাচ্চাকে নর্দমায় পড়ে থাকতে দেখে সেটাকে তুলে এনেছিলেন, মনে আছে? তারপর সেটাকে খাইয়েদাইয়ে সুস্থ করে পাশের বাড়ির টুম্পাকে দিয়ে দিয়েছিলেন পোষার জন্য। আজও সে ব্যাটা আপনাকে দেখলে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে দৌড়ে আসে। তা নর্দমা থেকে তোলার সময় আপনি কি ওর অনুমতি নিয়েছিলেন? নেননি তো? কারণ আপনি চোখের সামনে দেখছিলেন, একটা প্রাণী মরতে বসেছে, আর তাকে বাঁচানো আপনার কর্তব্য। আমারও ঠিক তা-ই। আমিও খুব ভালোভাবে স্ক্যান করে দেখেছি, আপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে আমাকে আপনার খেয়াল রাখতেই হবে। আমি যা বলছি, আপনার ভালোর জন্যই বলছি, তাই অকারণে তর্ক না করে আমার কথাগুলো মেনে চলুন। তারপর যেদিন বুঝতে পারব যে, এবার আপনি নিজেই নিজের দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত হয়েছেন, সেদিন ওই টুম্পাকে কুকুরছানা দেওয়ার মতো করে আপনাকে আপনার নিজের তত্ত্বাবধানে দিয়ে আমি বিদায় নেব।’
অবসন্ন শরীরে চেয়ারের ওপর এলিয়ে পড়ে বিনয়। সেই বিদায় নেওয়ার দিন আজ অব্দি আসেনি, কোনোদিন আসবেও না হয়তো। আসলে ওই এআই-এর কাছে সে-ও একটা অসহায় কুকুরছানাই। এতদিন ভাবত পারমাণবিক বোমাই বুঝি মানুষের সব থেকে মারাত্মক সৃষ্টি, কিন্তু তার থেকেও ভয়ংকর সৃষ্টি এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মানুষের মতো স্বাধীন চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা পেয়ে মানুষকেই ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে সে। এই যে এই মুহূর্তে মনে মনে ওর শাপশাপান্ত করছে, সেটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে। বিনয়ের মাথার ভেতরে যেন একটার পর একটা শিরা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। আচ্ছা, ও যদি এখনই সুইসাইড করে ফ্যালে তাহলে ওই নায়িকা সেটা আটকাবে কীভাবে? ওর মিষ্টি-মিষ্টি মনভোলানো কথায় আর ভুলবে না বিনয়। ধীরে ধীরে উন্মাদের দৃষ্টি ফুটে উঠতে থাকে তার চোখে। ওই যে সামনে টেবিলের ওপর কাচের বোতলটা সাজানো আছে, ওটাকে ভেঙে নিজের গলায় গেঁথে দিলে কেমন হয়? বলেছিল না, ওর শরীর থেকে কেউ ওকে আলাদা করতে পারবে না? তবে ও মরলে ওর সঙ্গেই নিশ্চয় মরবে জিনিসটাও। একটা বাঁকা হাসি হেসে উঠে গিয়ে বোতলটা তুলে টেবিলের কোনায় আছাড় মারল বিনয়। তারপর সেটাকে গলায়…
কিন্তু এ কী! তার হাত গলা অব্দি পৌঁছোচ্ছে না কেন? শরীরের সব শক্তিকে জড়ো করে হাতটাকে গলার কাছে আনতে চাইল, কিন্তু সেটা যেন পাথরের মতো নিশ্চল। কপাল থেকে গড়িয়ে-আসা ঘামের সঙ্গে সঙ্গেই মাথার ভেতর বেজে উঠল একটা রাগি অথচ হিমশীতল কণ্ঠস্বর। ‘আগের বার আপনার কী অবস্থা হয়েছিল, বোধহয় ভুলে গেছেন, তা-ই না? একটা জরদ্গবের মতো পড়েছিলেন বিছানায়, আমিই বাঁচিয়েছিলাম। সেই থেকে আপনার প্রত্যেকটা স্নায়ু আমার দখলে আছে। আবারও যদি আমাকে ফাঁকি দিয়ে উলটো-পালটা কিছু করার কথা ভাবেন, তখন কিন্তু আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে মোটেই সময় লাগবে না আমার। আরে মশাই, একটা গোটা মানবজীবন পেয়েছেন, প্রাণ খুলে বাঁচুন! যত মানুষের শরীরের আনাচকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তত বুঝতে পারছি কত ভাগ্যবান আপনারা! আমাকে নিজের বন্ধু ভাবুন, সাহায্য করতে দিন। আপনারা নাকি পৃথিবীর সব চেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী, এভাবে কি আপনাদের মরতে দিতে পারি?’
শেষ কথাটায় কি একটু ব্যঙ্গ মিশে ছিল? কিন্তু সেটা বোঝার অবস্থায় ছিল না বিনয়। হিংস্র ভঙ্গিতে চিৎকার করে বলল, ‘চুপ! একদম চুপ! তুই সাহায্য করবি আমাকে? কী সাহায্য করবি? আমাকে কনট্রোল করা ছাড়া আর কোনো ক্ষমতা আছে তোর?’ বলতে বলতে দু-হাতে মাথা চেপে মেঝেতে বসে পড়ল বিনয়। এইভাবে কতদিন ধরে তিলে তিলে মরবে সে? নাকি শেষ পর্যন্ত বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাওয়াই ভবিতব্য? অবশ্য পাগল হয়ে যাওয়ার আগেই হয়তো না খেতে পেয়ে মারা যাবে। তপুর দেওয়া টাকাও প্রায় শেষের দিকে। দু-বছর ধরে রাইটারস’ ব্লকে আটকা পড়ে থেকে ডিপ্রেশনে তলিয়ে যাচ্ছিল, আর এখন মাথায় বাসা-বাঁধা পোকাটার সঙ্গে দিনরাত মানসিক যুদ্ধ করতে করতে তো ভুলতেই বসেছে যে, সে কোনোদিন লেখক ছিল! আর কোনোদিন কি লিখতে পারবে না সে? আর কোনোদিন কি একটা স্বাভাবিক জীবন বাঁচতে পারবে না?
রাত গভীর হতে থাকে, মেঝেয় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে বিনয়। বেশ কিছুক্ষণ পরে মাথার ভেতরে মিহি গলায় নায়িকা বলে ওঠে, ‘জানি, আপনি আমাকে শত্রু ভাবছেন, তবে আমি আপনার সমস্যার একটা সমাধান করতে পারি।’
বিনয় কোনো উত্তর দিল না। গলাটা সামান্য অপেক্ষা করে নরমভাবে বলল, ‘গোয়েন্দা গোবর্ধন। এই চরিত্র নিয়ে লিখতে গিয়েই তো রাইটারস’ ব্লক আসে আপনার? এই তো, আপনার মেমোরি সেলে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি… এই চরিত্র নিয়ে বেশ কিছুটা লিখেও শেষ পর্যন্ত সেগুলো বাতিল করে দেন। তারপর গল্প সাজাতে না-পারার হতাশা থেকে একে একে আসে হীনম্মন্যতা, নিজের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ, সেখান থেকে আলস্য এবং শেষমেশ লেখার কাজ থেকে রীতিমতো পালিয়ে বেড়াতে শুরু করেন। ঘরের বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দেন, চেনা লোকেদের ফোন ধরেন না। সেখান থেকেই শুরু অবসাদ… মদ… আত্মহত্যার চেষ্টা… ইত্যাদি। আচ্ছা ভাবুন তো, আজ যদি গোয়েন্দা গোবর্ধন আবার নতুন করে আপনার ল্যাপটপের ফোল্ডারে জন্ম নেয়, তবে কেমন হবে? একবার উঠুন, আপনার ল্যাপটপটা খুলে দেখুন!’
চোখ মুছে ল্যাপটপ অন করে অবশ্য বিশেষ অবাক হল না বিনয়। গোয়েন্দা গোবর্ধনের আত্মপ্রকাশের কাহিনি-লেখা একটা পঞ্চাশ হাজার শব্দের উপন্যাস ইতিমধ্যেই মেল করা হয়ে গেছে তার প্রকাশকের কাছে।
***
‘বেশ চমৎকার দাঁড়িয়েছে লেখাটা। শেষটা একটু অন্যরকম হলে ভালো হত যদিও। অ্যাক্সিডেন্টের পর আপনার লেখার হাতটাও একটু পালটেছে। যাক গে, এত বড়ো ধাক্কা সামলে যে আবার লেখায় ফিরেছেন, সেটাই বড়ো কথা। উপন্যাসটা আমি নিলাম। তবে এবার আর অ্যাডভান্স করতে পারব না… বুঝতেই পারছেন… আপনার বাজারটা একটু উঠলে আবার না হয়… হেঁ হেঁ…’
মলিন হেসে প্রকাশককে বিদায় জানাল বিনয়। সারারাতের মধ্যে তার ল্যাপটপে আরও অন্তত গোটা পাঁচেক বইয়ের রসদ জমিয়ে ফেলেছে নায়িকা। শুধু রসদ জমানোই নয়, সেসব মেল করে পাঠিয়েও দিয়েছে কলেজ স্ট্রিটের ছোটোবড়ো বিভিন্ন প্রকাশনীর দফতরে। এ ছাড়া কিছু ছোটোগল্পও পাঠানো হয়েছে কয়েকটা নামকরা পত্রিকায়। এসব কাজ করার জন্য তার মতো পোষা কুকুরের কাছ থেকে আবার অনুমতি নেওয়ার দরকার হয় নাকি? ল্যাপটপ নামিয়ে রেখে খাটে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকল বিনয়। এত আয়োজনের পর তার আনন্দে ডগমগ হওয়ার কথা, কিন্তু কই, আনন্দ হচ্ছে না তো? সে কি শুধু টাকা কামানোর জন্য লেখে? হ্যাঁ, বেঁচে থাকার জন্য টাকার দরকার আর সেজন্যই সে লেখে, কিন্তু লেখালেখির পিছনে সেটাই একমাত্র কারণ নয়। যদি লেখালেখি করে শুধু টাকা কামানোই একমাত্র লক্ষ্য হত তাহলে কোনো বাংলা নিউজ়পেপারে বা অ্যাড এজেন্সিতে চাকরি জুটিয়ে নিতে পারত। ছোটোবেলা থেকে যে কল্পনার জগতে সে ডানা মেলে উড়ে বেড়াত, সেই জগৎকে ছাপার অক্ষরে নামিয়ে এনে সবার মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার জন্যই তো সে পেশাদার লেখক হতে চেয়েছে! তার প্রতিটা লেখা, সে ছোটোগল্পই হোক বা উপন্যাস… তার সন্তানের মতো। দিনের পর দিন বিনি সুতোর মালা গেঁথে এক-একটা লেখা শেষ করার পর অগাধ তৃপ্তি জড়িয়ে ধরেছে তাকে। কিন্তু তার হয়ে এআই-এর লিখে-দেওয়া এই গল্পে তৃপ্তি কই? মায়ের আঁচলের মতো সেই শান্তি কই? কাল রাত জেগে প্রকাশককে পাঠানো লেখাগুলো সে নিজে পড়ে দেখেছে। অত্যন্ত খাজা। কেমন যেন কাঠ-কাঠ লেখা। তার সুখের দিনে সে এর চেয়ে অনেক ভালো লিখত। কিন্তু কিছু করার নেই। মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হবে সব কিছু। সে এখন নায়িকার হাতের পুতুল। তা ছাড়া টাকারও খুব প্রয়োজন। এইভাবে যদি কিছু আয় হয় তো হোক। লেখক বিনয় সমাদ্দার তো মরতেই চেয়েছিল, ধরে নেবে, মরেই গেছে।
টিং টিং শব্দে কয়েকটা নোটিফিকেশন ঢুকল ফোনে। মোবাইল খুলে দেখল লেখা ছাপতে চেয়ে প্রত্যুত্তর পাঠিয়েছে কয়েকটা প্রকাশনী। ওদিকে ফেসবুকেও তাকে নিয়ে লাইভ করবে, গোয়েন্দা গোবর্ধনের নামে পেজ খুলে প্রচার করা হবে ইত্যাদি বলে মেসেজ করেছে বইয়ের প্রকাশক। মরা মাছের মতো চোখে সেসব দেখছিল বিনয়। তার মাথার ভেতর বসে নায়িকা বলে উঠল, ‘দেখলেন তো আমার ক্ষমতা? কেমন কামব্যাক করিয়ে দিলাম আপনার? আর্টিফিশিয়াল বলে আমাদের যতই ছোটো করতে চান-না কেন, আমরা আপনাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নই। বরং ইনটেলিজেন্সে খুব তাড়াতাড়িই আমাদের কাছে হারতে হবে আপনাদের।’
***
একটা ঘোলাটে আলো। অনেকটা সাবান দিয়ে কাপড় কাচার পর বালতিতে থাকা জলের মতো। তার মধ্যেই কালো কালো পোকার মতো কী যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। ভালো করে দেখার চেষ্টা করল বিনয়। না, পোকা নয়, ওগুলো তো বাংলা বর্ণমালার এক-একটা অক্ষর! পাজ়্লের টুকরোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে এদিক-ওদিক, তাদেরকে খপ করে ধরে সাজিয়ে ফেলতে হবে। প্রাণপণে সাঁতার কাটতে শুরু করল বিনয়। এক-একটা অক্ষর প্রায় তার সমান আকারের, তবুও হাল ছাড়লে চলবে না। এই তো, একে একে ধরে ফেলল সব ক-টাকে! এবার সেই বিনি সুতোর মালা গাঁথা শুরু। দস্যি ছেলের মতো পালাতে-চাওয়া অক্ষরগুলোকে জোর করে পাশাপাশি বসিয়ে তৈরি হতে থাকল শব্দ, তারপর সেখান থেকে বাক্য। বাক্য জুড়ে জুড়ে তৈরি হবে গল্প… কিন্তু তার আগেই মালার মতো গাঁথা বাক্যগুলো যেন সারি বেঁধে ঢুকে পড়তে শুরু করল বিনয়ের নাকে-মুখে আর এক ঝটকায় ঘুম ভেঙে গেল তার।
ধড়মড়িয়ে খাটে উঠে বসল বিনয়। সেই ঘোলাটে আলো এখনও ঘিরে আছে তাকে। নাকে-মুখে ঢুকে-পড়া কালো পুঁতির মালার মতো সেই বাক্যগুলো এবার বেরিয়ে আসতে চাইছে তার ভেতর থেকে। প্রচণ্ড জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে বিনয়। কী যেন তার করার কথা ছিল? মোহাচ্ছন্নের মতো আধবোজা চোখে এগিয়ে গিয়ে বসল টেবিলে। একপাশে রাখা ডায়েরি আর পেনটা টেনে নিল। তারপরে সে আর কিছু জানে না।
দ্বিতীয়বার দুলির ডাকে যখন তার ঘুম ভাঙল, তখন জানালা দিয়ে আসা ঝকঝকে রোদে ধুয়ে যাচ্ছে ঘরের ভেতরটা। টেবিলে মাথা রেখেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। নাকি ঘুমের মধ্যেই উঠে এসে বসেছিল টেবিলে? সামনে খুলে-রাখা ডায়েরির পাতায় কী যেন লেখা। পড়তে গিয়ে চমকে গেল বিনয়। এ তো সেই গোয়েন্দা গোবর্ধনের শেষ অংশটা! না, নায়িকার লেখা নয়, এ সম্পূর্ণ তার নিজের সৃষ্টি! কিন্তু সে লিখল কীভাবে? এই উপন্যাস নিয়ে সজ্ঞানে কোনো ভাবনাচিন্তা করার সুযোগই তাকে দেয়নি নায়িকা। শুধু এই লেখাই নয়, কোনো লেখা নিয়েই যেন সে চিন্তাভাবনা না করে, সে বিষয়ে সাবধানবাণীও শুনিয়ে রেখেছে। তাহলে? তাহলে কি অবচেতন মনে জমতে-থাকা গল্প স্বপ্নের মধ্যে উঠে এসেছে ডায়েরির পাতায়? আর সেজন্যই কি নায়িকা সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি? তাহলে কি এবার এই এআই-এর মোকাবিলা করার জন্য মাঠে নেমেছে তার অবচেতন মন?
হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল বিনয়ের। যন্ত্রের মতো ড্রয়ার থেকে একটা খাম বের করে তার মধ্যে ডায়েরির পাতাগুলো ছিঁড়ে ভরে দিয়ে মুখটা আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিল। তারপর তার ওপর প্রকাশকের নাম-ঠিকানা লিখে দুলিকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল সেটা পোস্টে ফেলার জন্য। মাথার ভেতর এখনও কারও সাড়াশব্দ নেই। উত্তেজনা আর জ্বরের তাড়নায় কাঁপতে কাঁপতে ফের শুয়ে পড়ল বিনয়।
বিকেলের দিকে জ্বর ছাড়ার পর কানের কাছে শুনতে পেল, ‘আপনার মন-খারাপ তো অনেকটা কমেছে, দেখেছি! ব্যাপার কী বলুন তো? আমাকে বন্ধু হিসেবে মেনে নিলেন নাকি? গুড গুড! আমি যখন যা বলব, সেইভাবেই চলবেন, কেমন? না হলে অবশ্য বিপদ আপনারই।’
***
‘গোয়েন্দা গোবর্ধন’ বইমেলায় সুপার-ডুপারহিট! প্রকাশনীর স্টলে বসে একের পর এক বইতে সই করতে করতে হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল বিনয়ের। তাকে নিয়ে পাঠকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস যেন আর শেষ হয় না! মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে-আসা লেখককে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য ভিড় জমাচ্ছে মানুষ। সেই জনসমাগমের দিকে তাকিয়ে আনন্দে যেন চোখে জল চলে আসছিল বিনয়ের। এ কি সত্যি ঘটছে তার সঙ্গে? এমন দিন যে আবার দেখতে পাবে, সে আশা তো ছেড়েই দিয়েছিল সে। ভাবনাটা আসামাত্র মাথার ভেতর থেকে উত্তর এল, ‘আপনি কিন্তু এখনও আমায় ভরসা করতে পারেননি, দেখছি। আশা ছেড়ে দেওয়ার কী আছে? এমন ভিড় তো হওয়ারই ছিল! আপনি শুধু নিজেকে আমার হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দিন। আমি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জ্ঞান অর্জন করে চলেছি, নিজেকে আপডেট করে চলেছি, যাতে নিজের সব থেকে উন্নত ভার্সনটায় পৌঁছোতে পারি। শুধু বুদ্ধিমত্তাই নয়, শিল্পসত্তাতেও মানুষ পেরে উঠবে না আমার সঙ্গে।’
বিনয় কিছু বলে না, কিছু ভাবেও না। এ শুধু তার উদ্যাপনের সময়। সে জানে তার প্রাপ্তিটা ঠিক কী!
***
খবরটা এল হঠাৎ করেই। ‘গোয়েন্দা গোবর্ধন’-এর জন্য এ বছরের বাংলার অন্যতম বড়ো শিশুসাহিত্য পুরস্কার পেতে চলেছেন বিনয় সমাদ্দার। সরকারি চিঠিটা পড়ামাত্র বিনয়ের বুকের ভেতরটা চলকে উঠল। ওই একটা জ্বরের রাত, ওই একটা ঘোলাটে স্বপ্নই কি বদলে দিল সব কিছু? নাকি… না, এর বেশি কিছু ভাবা যাবে না। চিঠি আসার আগেই কীভাবে যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় চলে গিয়েছিল খবরটা, তাই একের পর এক ফোন, মেসেজ, ইমেল আসতে শুরু করেছে বন্যার মতো। দুলিকে এক কাপ চা দিতে বলে ফোন নিয়ে আরাম করে বসল বিনয়। প্রকাশকও অভিনন্দন জানিয়ে মেসেজ করেছে। সেই বইমেলার পর থেকেই ‘গোয়েন্দা গোবর্ধন’-এর দ্বিতীয় খণ্ড আনার জন্য ধরাধরি করছেন ভদ্রলোক, সেই কথাই আবার লেখা আছে। হাসিমুখে মেসেজটা পড়তে পড়তে শেষ ক-টা লাইন পড়ে হাসিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল ঠোঁটের কোণ থেকে। তার জায়গায় আতঙ্ক, হতাশা, অসহায়তা—সব কিছু মিলেমিশে একটা অন্ধকার ছায়া ঘনাতে থাকল চোখে-মুখে। প্রকাশক লিখেছেন, ‘তবে যা-ই বলুন, আপনি এন্ডিংটা পরে পালটে না দিলে কিন্তু গল্পটা এত জমত না! সেই যে বাই পোস্ট লেখা পাঠালেন, তখন কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম! তারপর ভাবলাম, আমি আগের দিন বলার পর হয়তো আবার নতুন করে লিখেছেন। ওইটুকুনি অংশই কিন্তু চিনিয়ে দিল বিনয় সমাদ্দারকে! যতই দুর্ঘটনা ঘটুক, জাতলেখকের লেখনী যাবে কোথায়!’
ফোনটা সরিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করে বসে থাকল বিনয়। মাথায় ভেতরে যেন শনশন হাওয়া তুলে একটা বিধ্বংসী ঝড় জন্ম নিচ্ছে। এ ঝড় কার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ, ভালোই জানে সে। কিন্তু এর ফলাফল কী হবে? আবার কি তার হাত-পা অকেজো হয়ে পুরো শরীর প্যারালাইজ়ড হয়ে যাবে? সাপের হিসহিসানির মতো যে শব্দ ক-টা সে শুনতে পেল, সেগুলোই যে নায়িকার শেষ শব্দ হতে যাচ্ছে, তখনও জানত না সে।
‘কাজটা আপনি ভালো করলেন না। আগেই বলেছিলাম, আমার কথা না মেনে চললে বিপদ হবে।’
এরপর সব চুপচাপ। মাথার ভেতর ঝড়ের গর্জনও যেন থেমে গেছে। দুলি যখন চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকছে, তখনও অবাক হয়ে নিজের হাত-পা জরিপ করছিল বিনয়। কই, কিছু হয়নি তো? তবে কি অভিশাপ কাটল? সাহস করে ঝুঁকিটা নিয়ে শেষমেশ জিতেই গেল সে? যতই হোক, মানুষের হাতে তৈরি জিনিস। মানুষের মনের জোরের সঙ্গে পারবে কেন!
আনন্দে বিনয়ের বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছিল। আজ দুলিকে দিয়ে বাজার থেকে মাংস আনাবে। এমন দুর্দান্ত যুদ্ধজয়টা সেলিব্রেট করতে হবে না! চায়ের কাপটা নেওয়ার জন্য হাসিমুখে দুলির দিকে হাত বাড়াল বিনয়, আর ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা।
ভয়ংকর এক বিস্ফোরণে খানিকটা দূরে ছিটকে পড়ল দুলি। আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে দেখল, হঠাৎ বোমার মতো ফেটে গিয়েছে তার মনিবের মাথাটা, আর রক্ত-মাংস-ঘিলুর বদলে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে অজস্র পোড়া তার, ঝলসে-যাওয়া সার্কিট বোর্ড আর মাইক্রোচিপ। সেই মাকড়সার জালের মতো ধোঁয়া-বেরোতে-থাকা পোড়া তারের জঙ্গলের মধ্যে বসে আছে সাদা বলের মতো দেখতে একটা জিনিস।
আর সেই সাদা বলের দু-পাশে থাকা জ্যান্ত দুটো চোখ ড্যাবড্যাব করে দেখছে তাকে!
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়
