প্যারাডক্সের খোঁজে
লেখক: অলোক চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
উরগার চার মাথার মোড় থেকে অভ্যাসমতো গাড়িটা বাঁদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিল সুনন্দ। এটাই কোরবা থেকে রায়গড় ফেরার জন্যে ওর পছন্দের রাস্তা। সোজা গিয়ে চাঁপার থেকে হাইওয়ে ধরলে অবশ্য দূরত্বটা কিছুটা কম হয়, কিন্তু চাঁপার মোড়ে ভয়ানক জ্যামের মধ্যে পড়তে হয়। ভইস্মা থেকে তুমান লাবাড হয়ে রাস্তাটা যদিও সিঙ্গল রোড তাহলেও ট্রাফিক খুবই কম। রাস্তার অবস্থাও খুব খারাপ না। আর পাহাড়-জঙ্গলের পথ দিয়ে ড্রাইভ করতে ভালোই লাগে সুনন্দর।
কিন্তু ভইস্মা ঢোকার ঠিক আগেই কানহাইয়ার দোকানে চা খেতে খেতে জানা গেল দুটো ডাম্পারের মধ্যে মুখোমুখি ধাক্কা লেগে দুপুর থেকেই নাকি সে রাস্তা বন্ধ। মানে আবার সাত কিলোমিটার পিছিয়ে চাঁপার রাস্তা ধরতে হবে। তবে কানহাইয়া একটা নতুন রাস্তার খোঁজ দিল। সোজা এগিয়ে রামপুর থেকে একটা নতুন রাস্তা হয়েছে, মাণ্ড পাহাড়ের ঘাঁটি পেরিয়ে সেটা সোজা ভাটনগর গিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়েতে পড়ে শক্তি পার করে।
নতুন রাস্তা বলতে অবশ্য নতুন করে তৈরি রাস্তা। আগে ছিল এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি পথ, আর পুরোটাই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। সুনন্দ আগেও বার দুয়েক সেই রাস্তা দিয়ে গেছে। সেটাই পিচ করা হয়েছে। কানহাইয়া বলল, সরকার থেকে বন কেটে সেখানে নাকি কয়েকটা গ্রাম বসানো হবে। রায়গড়ের দিকে কোথাও নতুন কয়লার খনি আসছে। সেখানকার বিস্থাপিতদের নতুন বসতি হবে সেখানে। তবে সে এখনও দেড় দু-বছরের ব্যাপার। আগের রাস্তার নকশাও নাকি অনেকটা পালটে গেছে তার জন্য।
রামপুরের মোড় থেকে ডানদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে সুনন্দর মনে হল, সে যেন কোনো প্রাগৈতিহাসিক বনের ভেতর ঢুকে পড়েছে। পথের দু-দিকে বড়ো বড়ো শাল, সেগুন, তেন্দু গাছেরা যেন আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীচের ঝোপঝাড়গুলোও এত ঘন যে দশ ফুট দূরেও দৃষ্টি চলে না। এটাই সেই রাস্তা তো? সুনন্দর সন্দেহ হল। রামপুরের দশ কিলোমিটার বাদে বিজকোট নামে একটা ছোট্ট গ্রামে আবার একটা চায়ের দোকানে খোঁজ নিতে দাঁড়াল সে। জানা গেল, ঠিক পথেই এসেছে সে। এই রাস্তাটাই এঁকেবেঁকে পাহাড়ি ঘাঁটি পেরিয়ে ভাটনগর গেছে। মাঝে কয়েকটা মোরাম-বিছানো ফরেস্ট রোড ছাড়া আর কোনো বাঁক নেই। কয়েকটা জায়গা ছাড়া রাস্তাও একদম ঝকঝকে। সবে তৈরি হয়েছে। সুনন্দর মনে পড়ল, কয়েক বছর আগে যখন সে এ রাস্তায় গিয়েছিল, পথে একটা মন্দির পড়েছিল। সে কথা জিজ্ঞেস করতেই চায়ের দোকানের ছেলেটা বলল, হ্যাঁ, রাস্তা থেকে বাঁ হাতে। একটা পাহাড়ি জলপ্রপাতও আছে তার পাশে। আগে রাস্তার ওপরেই পড়ত বটে, তবে এখন নতুন করে বানানোর সময়ে কিছুটা এদিক-ওদিক হয়ে থাকতে পারে।
কথার মাঝেই এগিয়ে এল একজন বয়স্ক দেহাতি লোক। খুব সম্ভবত ওদের কথাবার্তা কানে গেছে। ঠেট ছত্তিশগড়িতে গড়গড় করে কী সব যেন বলতে লাগল। সুনন্দ যদিও চাকরিসূত্রে বছর তিনেক এখানে রয়েছে, তবুও এখানকার ভাষাটা ঠিকমতো রপ্ত করে উঠতে পারেনি। চায়ের দোকানের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করতে সে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ওর কথা বাদ দিন। এদিককার গ্রামের লোকজন এক-একটা কুসংস্কারের ডিপো। ও আপনাকে বলছিল যে এই রাস্তাটা ভালো নয়। ওদিক দিয়ে না-যাওয়াই ভালো। আর নিতান্ত যেতে হলে সন্ধের আগেই যেন ওই মন্দিরের জায়গাটা অন্তত পার হয়ে যায়।
শীতের শুরু। বেলা ইতিমধ্যেই পড়ে এসেছে। অন্ধকার নামার আগে ভাটনগরে পৌঁছোবার সম্ভাবনা কম। কৌতূহলী হয়ে সুনন্দ প্রশ্ন করল, কেন? কী আছে ওই রাস্তায়? ভালো নয় কেন? আবার ছত্তিশগড়িতে জবাব এল। দোকানের ছেলেটাই দোভাষীর কাজ করল। বলছে, ওটা জিনপরিদের জায়গা। পথে নাকি লোকজনদের আওয়াজ পাওয়া যায়। সন্ধের পর জঙ্গলের মধ্যে থেকে ঠিক যেন ঘরগেরস্থির আলো উঁকি মারে। মন্দিরের ঘণ্টার শব্দ আসে। এইসব আর কী। আপনি ও নিয়ে চিন্তা করবেন না। ওদিকে লোকবসতি নেই বটে, তবে জঙ্গলে গাছ কাটার ইজারা দেওয়া হয়। ঠিকাদারের লোকজন কাজ করে। তাদেরই কথাবার্তা শোনা যায় হয়তো।
—অন্ধকার হবার পর ওখানে থাকে না কেউ। বুড়ো এবার থেমে থেমে বলল। বোধগম্য হল সুনন্দর। একটু হেসে ওদের দুজনকেই ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা হল আবার। আঁকাবাঁকা পথ। যদিও গাড়ির ভিড় একেবারেই নেই, উলটোদিক থেকে ক্বচিৎ কখনও এক-আধটাই গাড়ি আসছে, তবু এ ধরনের রাস্তায় স্পিড তোলা খুব মুশকিল। দশ-বারো কিলোমিটার যেতে-না যেতেই হঠাৎই কেমন যেন অন্ধকার নেমে এল। ঠিক যেন অন্ধকার নয়। সুনন্দর মনে হল যেন একটা কুয়াশার আস্তরণ যেন নেমে এসেছে পথের ওপর। শেষ বিকেলের আলো তার মধ্যে এক অদ্ভুত অপার্থিব মায়া রচনা করেছে যেন।
প্রথম ফোন কলটা ঠিক সেই সময়েই এসেছিল।
পাশের সিটের ওপরে পড়ে ছিল ফোনটা। হঠাৎ স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠতে চোখের কোণ দিয়ে দেখেছিল কোনো নম্বর থেকে কল। নাম নেই। বাঁ হাত বাড়িয়ে কেটে দিয়ে আবার গাড়ি চালানোতে মনোনিবেশ করেছিল সে।
দু-মিনিটের মধ্যেই আবার রিং। নাঃ, জ্বালাল। কিছুটা বিরক্ত হয়েই ফোন অন করেছিল সে। হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই অপর প্রান্ত থেকে রিনরিন করে উঠেছিল কোনো মেয়ের উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর।
—বাপি, শুনতে পাচ্ছ? ভীষণ বিপদে পড়েছি। একটা পাথুরে ঢাল বেয়ে চড়তে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেছি। আমাকে ধরতে গিয়ে সোমাও পড়ে গিয়ে মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমার একটা পা দুটো বড়ো পাথরের খাঁজে আটকে গেছে। বার করতে পারছি না। খুব যন্ত্রণা, ভেঙে গেছে কি না জানি না। এখানে চিৎকার করলেও এই জঙ্গলে কেউ শুনতে পাবে না। বাপি, সাড়া দিচ্ছ না কেন? শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো—হ্যালো—
কলটা কেটে গেল। ব্রেক মেরে গাড়ি দাঁড় করাল সুনন্দ। কোনো মেয়ে কোথাও বিপদে পড়েছে। পাহাড়ি জায়গা। জঙ্গলও আছে। এই এলাকাতেই কি? ফোনটা তুলে নিল সে। কল ব্যাক করল সে। দুবার লাগল না। এসব জায়গায় সিগন্যালের অবস্থা খুবই খারাপ থাকে। তিনবারের বার রিং হতে-না হতেই অন্যদিক থেকে সেই আগের স্বর ভেসে এল। একটু কাঁপা-কাঁপা গলায় মেয়েটি হ্যালো বলল।
—শুনুন, এইমাত্র আপনার ফোন এসেছিল। যথাসম্ভব শান্ত গলায় সুনন্দ বলল। ভুল করেই লেগে গিয়েছিল হয়তো। তবে যেটুকু শুনলাম, তাতে বুঝেছি, আপনি খুব বিপদে পড়েছেন। আপনি ঠিক কোন জায়গায় আছেন, বলতে পারবেন?
কাঁপা গলায় উত্তর এল—এটা বাপির ফোন নয়? কী আশ্চর্য! এই নম্বরই তো—
—ওসব ছাড়ুন। সুনন্দ বলল। আপনি কোথা থেকে বলছেন, সেটা বলুন।
মেয়েটা একটু সময় নিল। একজন অচেনা মানুষকে ভরসা করা উচিত হবে কি না, সেটাই চিন্তা করল সম্ভবত। তবে যেটুকু এর আগে শোনা গেছে, তাতে বোঝা যায়, যথেষ্ট নিরুপায় অবস্থায় আছে সে। আশঙ্কা-জড়ানো গলায় উত্তর এল—আপনি কে, কোথা থেকে বলছেন, জানি না। আমরা দুই বন্ধু রায়গড়ে একটা পাহাড়ি জায়গায় ঘুরতে এসে একটা দুর্ঘটনায় পড়েছি।
—রায়গড়—মানে ছত্তিশগড়? জায়গাটা কোথায় বলুন। ঠান্ডা গলায় সুনন্দ বলল।
—এনএইচ সিক্সের ওপর শক্তির কাছে ভাটনগর। সেখান থেকে নর্থে রামপুরের রাস্তায় দশ কিলোমিটার মতো হবে। আ-আপনি কোথা থেকে বলছেন?
—এই রাস্তাতেই। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সুনন্দ।
—শুনুন, আমি বোধহয় আপনার কাছাকাছিই আছি। আশ্বস্ত করার সুরে বলল সে। ঘাবড়াবেন না। আমি চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জায়গাটা খুঁজে বার করার। তবে আধ ঘণ্টা অন্তত লাগবে। আপনি নার্ভাস হবেন না। ঠান্ডা মাথায় জায়গাটা সম্বন্ধে আর-একটু ডিটেলে বলুন।
টেলিফোনের অপর প্রান্তে একটা লম্বা শ্বাস নেবার শব্দ ভেসে এল। থেমে থেমে মেয়েটা বলতে লাগল, ভাটনগরের প্রায় দশ কিলোমিটার পরে বাঁদিকে একটা রাস্তা ঢুকে গেছে। কিছুটা গিয়ে একটা প্রাচীন শিব মন্দির আছে। সেটা দেখতেই আসা। পাশের গ্রামের কয়েকজন লোকও ছিল ওখানে। তারাই খবর দিল, ডানদিকের পাকদণ্ডি দিয়ে মিনিট দশেক গেলেই শিবধারা নামের একটা জলপ্রপাত আছে। হাতে সময় আছে দেখে আমরা মন্দিরের পাশে গাড়ি রেখে সেদিকে রওনা হই। গাড়িটা, লাল রঙের অল্টো এইট হান্ড্রেড, রাস্তার ধারেই রাখা আছে। স্পটটা খুঁজে নিতে অসুবিধে হবে না। জলপ্রপাতের দিকে যেতে গিয়ে পাথরে স্লিপ করে আমরা দুজনেই পড়ে গেছি। প্লিজ় আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। আমার ভীষণ ভয় করছে। আমার বন্ধুরও কতটা চোট লেগেছে, কে জানে! ও বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছে।
মেয়েটা একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিল। শুনতে শুনতেই সুনন্দ বুঝতে পারছিল, তার আওয়াজ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। এসব অঞ্চলে মোবাইল টাওয়ারের অবস্থা খুবই খারাপ। ওরই মধ্যে কথাগুলো সাধ্যমতো মাথার মধ্যে গেঁথে নিচ্ছিল সে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরটা যেন দূর থেকে আরও দূরে চলে যেতে যেতে একসময়ে হারিয়ে গিয়েছিল।
অনেকক্ষণ একটানা কথা বলার পর সুনন্দ একটু থামল। সকলে এতক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে তার কথা শুনছিল। এবার রামকিশোরবাবু বললেন, ভারী ইনটারেস্টিং তো। তারপর?
—তারপর আর কি! সুনন্দ একটা নিঃ:শ্বাস ফেলে বলল। ভাঙা শিবমন্দিরটা খুঁজে নিতে অসুবিধে হয়নি। গাছ কাটার ঠিকেদারের এক ট্র্যাক্টর ভরা লোকজন বাড়ি ফিরছিল। তাদের থামিয়ে ঘটনাটা সংক্ষেপে বলে পাকদণ্ডীর পথে ওপরে উঠে বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে কাউকেই দেখা গেল না। রাস্তার ধারে কোনো লাল রঙের অল্টোও ছিল না। ওই ফোন নম্বরে বারবার ফোন করে একই জবাব পাওয়া গেল—দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়াল্ড ডাস নট এক্সিস্ট। অগত্যা হাল ছেড়ে ফিরতে হল। পরিশ্রম, সময় নষ্ট তার ওপরে ঠিকেদারের লোকেদের চা খাবার জন্যে টাকাও গ্যাঁটগচ্চা গেল। ইতিমধ্যে বেশ অন্ধকারও নেমে এসেছিল। তাই রণে ভঙ্গ দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
—আমরা তখন কোথায় ছিলাম? রামকিশোরবাবু জিজ্ঞাসা করলেন। এরকম অদ্ভুত ঘটনা তখন তো কিছু শুনিনি।
—আপনারা তখন এখানে ছিলেন না। সুনন্দ জানাল। ব্যাঙ্গালোরে ছেলের কাছে গিয়ে কোভিডের ঝামেলায় আটকে পড়েছিলেন। পরে আপনাদের আর বলা হয়নি। আর তার পরে পরেই তো আমিও ট্রান্সফার হয়ে চলে গেলাম। তারপরে তো এই আসা। প্রায় দু-বছর পরে।
যা-ই হোক, ঘটনাটা বেশ অদ্ভুত। এবার মন্তব্য করলেন ডক্টর সেনগুপ্ত। উনি অবশ্য গোড়ার থেকে শোনেননি। তবে পরে এলেও কাহিনির গোড়ার দিকটা রামকিশোরবাবু তাঁকে সংক্ষেপে বলে দিয়েছিলেন।
ঘটনার সব থেকে অদ্ভুত অংশটা কিন্তু এখনও বলা হয়নি। কিছুটা নাটকীয়ভাবেই বলল সুনন্দ।
২
কথা হচ্ছিল রামকিশোর মুখার্জির বাড়িতে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে তার বৈঠকখানায় বসে গল্প চলছিল। রামকিশোরবাবু, তাঁর স্ত্রী, সুনন্দ ও তার কলকাতা থেকে সঙ্গে আসা এক বন্ধু বিভাস এবং তাদের গল্পের মধ্যেই হঠাৎ-এসে-পড়া প্রতিবেশী ডক্টর সেনগুপ্ত। বছর দুয়েক আগে রায়গড় থেকে বদলি হয়ে চলে যাবার আগের তিন বছর রামকিশোরবাবুর বাড়ির নীচের দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে থাকত সুনন্দ। থাকতে থাকতে কিছুদিনের মধ্যেই ওঁদের বাড়ির একজন হয়ে উঠেছিল সে। এতদিন বাদে সুনন্দর রায়গড় আসার খবরটা জানাতেই মুখার্জি দম্পতি ভারী খুশি হয়েছিলেন। সুনন্দকে বলেই দিয়েছিলেন ওদের বাড়িতেই থাকার জন্যে। কিন্তু সঙ্গে একজন বন্ধুও আসছে বলে কোনোমতে সেই উপরোধ পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল সুনন্দ। তবে খাওয়ার নেমন্তন্ন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
নানা বিষয় নিয়ে গল্প চলতে চলতে এল সুনন্দর এতদিন পর রায়গড়ে আসার প্রসঙ্গ। আর তাতেই এল সুনন্দর বছর দুয়েক আগের সেই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা।
—এ পর্যন্ত যা শুনলাম, সেটাই তো বেশ অদ্ভুত। সুনন্দর কথার খেই ধরে বললেন রামকিশোরবাবু। হঠাৎ জঙ্গলের পথে একটা মেয়ের ফোন। বিপদে পড়ার কথা বলা—তাও আবার নিজের বাবাকে ফোন করতে গিয়ে অন্য লোককে করে ফেলা। আবার সেই ভুল লোকটি ওই সময়ে ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকাটাও বেশ কাকতালীয়। তার ওপর খুঁজেপেতে সেই জায়গায় পৌঁছে দেখা গেল ওরকম কেউ সেখানে নেই। এর পরেও আরও অদ্ভুত কিছু আছে?
—সেটাই বলছি। সুনন্দ বলল। রায়গড়ে ফিরে মনে হল পুলিশের কাছে ব্যাপারটা জানানো উচিত। সেটা করার আগে একবার কল লিস্টটা দেখে নিতে গিয়ে দেখলাম—কী আশ্চর্য! কল লিস্টে প্রথম কলটার তারিখ আর সময় দেখাচ্ছে বিকেল পাঁচটা ছত্রিশ মিনিট, তেইশে নভেম্বর, দু-হাজার তেইশ। বাকিগুলোও তার পরে পরে। আরও আশ্চর্যের কথা, কী করব, ভাবতে ভাবতেই একটু বাদে দেখি, আমার মোবাইলের কল লিস্ট থেকে ওই কলগুলো আপনা-আপনিই মুছে গেছে। ফলে পুলিশের কাছে যাওয়ার কোনো মানেই ছিল না। তার চেয়েও বড়ো কথা, যদি কল লিস্টের একটা স্ক্রিন শটও নিয়ে রাখতাম তাহলেও অন্তত এই ঘটনার একটা প্রমাণ থাকত।
রামকিশোরবাবু সম্ভবত তারিখটার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু বুঝতে পারেননি। কিন্তু ডক্টর সেনগুপ্ত চমকে উঠলেন। বিস্মিত কণ্ঠে বললেন—কী বললেন? তেইশে নভেম্বর, দু-হাজার তেইশ? সে কী? সে তো আগামীকালের তারিখ!
—সেটাই তো অদ্ভুত ঘটনা। সুনন্দ বলল।
—মানে তুমি বলতে চাইছ দু-বছর আগে সেই সন্ধেতে তুমি দু-বছর পরের একটা দিন, মানে আজকের দিনটার থেকে ফোন কল পেয়েছিলে? অবিশ্বাসভরা গলায় বললেন রামকিশোরবাবু।
—ঠিক তা-ই। সুনন্দ বলল। আর সত্যি বলতে কী, ওইজন্যেই আমাদের এখানে আসা।
—মানে? রামকিশোরবাবুর গলায় বিস্ময়।
—আমরা দেখতে চাইছি, সত্যি সত্যি সেদিনের ওই ফোন কলটা দু-বছর পরের একটা সময় থেকে এসেছিল কি না। কথাটা বলল এতক্ষণ চুপ করে বসে-থাকা বিভাস। শুনলে খুবই অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু এরকম ঘটনা কল্পবিজ্ঞানের গল্পের বাইরেও মাঝে মাঝে ঘটে যায়। সময় কখনও, অল্পক্ষণের জন্যে হলেও, এগিয়ে আসে বা পিছিয়ে যায়, লোকে আটকে পড়ে টাইম লুপের মধ্যে, ডেজা ভ্যু জাতীয় ঘটনার কথা শোনা যায়। তবে এ পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
—অর্থাৎ তোমাদের উদ্দেশ্য হল অকুস্থলে গিয়ে দেখা যে সত্যিই কোনো মেয়ে আগামীকাল ওই সময়ে ওইখানে পৌঁছোয় কি না। রামকিশোরবাবুর স্বরে বিস্ময় এবং সংশয়ের মিশেল।
ডক্টর সেনগুপ্ত হঠাৎ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, আচ্ছা ধরুন, সেই মেয়েটাকে আপনারা খুঁজে পেয়ে গেলেন। তখন আপনারা কী করবেন? মানে নিশ্চয়ই তাকে পাথরের খাঁজে পড়ে যেতে দেবেন না? আর তা যদি হয়, মানে মেয়েটি যদি না-ই পড়ে যায়, সে তাহলে সাহায্য চেয়ে ফোন করবে কেন? অথচ মেয়েটি ইতিমধ্যেই ফোনটা করে ফেলেছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত এক প্যারাডক্সের মতো হয়ে যাচ্ছে না?
—আপনি একদম সঠিক শব্দটা বলেছেন। বিভাস বলল। এটাও হবে গ্র্যান্ডফাদার বা বুটস্ট্র্যাপ প্যারাডক্সের মতোই আরও একটা প্যারাডক্স। তফাত এই, ওগুলো এসেছে থট এক্সপেরিমেন্ট থেকে, আর আমরা সরাসরি ঘটনার মধ্যে দিয়ে এটা এক্সপেরিয়েন্স করতে যাচ্ছি।
একটু থেমে বিভাস আবার বলল, তবে এই সঙ্গে আরও একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখতে হবে, এই ঘটনাটা এত জটিল টাইম প্যারাডক্স না হয়ে স্রেফ মোবাইল নেটওয়ার্কের গোলমালের জন্যেও হতে পারে। সেজন্যে আমরা অত কিছু মাথায় না রেখে খোলা মনে একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে যাচ্ছি যে, সত্যি ওরকম কোনো টাইম লুপ বাস্তবে হয় কি না। মানে ওই ধরনের কোনো ঘটনা যদি কাল ওখানে ঘটে তাহলে টাইম লুপের একটা প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যাবে।
—এই প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা বলছি। সুনন্দ বলল। ঘটনাটা এতই অবাক-করা যে আমি ইনটারনেটে এই নিয়ে সার্চ করতে শুরু করি। তাতে অনেক বিস্ময়কর তথ্য সামনে আসে। জানতে পারি আমার এই অভিজ্ঞতা, মানে ভবিষ্যৎ সময়ের থেকে ফোন কল আসার ঘটনা আরও অনেকের সঙ্গেই হয়েছে। আমাদের দেশেই, ঝাড়খণ্ডের বিশেষ কয়েকটা জায়গায় লোকে এরকম কল পেয়েছে। শিলিগুড়ি, অরুণাচলের কয়েক জায়গায় এই ধরনের ঘটনার রিপোর্ট পাওয়া গেছে। তবে একটা ব্যাপার, খোঁজখবর করে যেটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়, আমার মতো এত পরিষ্কার কথাবার্তা কারও সঙ্গে হয়নি। বেশির ভাগই হয়েছে মিসড কল, কথা হলেও খুবই অস্পষ্ট। আর-একটা কথা, ফেসবুকে একটা বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রুপে এ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই কিন্তু বিভাসের সঙ্গে আমার পরিচয়। ও আগের থেকেই এই নিয়ে কাজ করছিল, আমার অভিজ্ঞতার খবর জেনে নিজের থেকেই ইনবক্সে যোগাযোগ করে।
ডক্টর সেনগুপ্ত এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। এবার বললেন, সত্যিই ভারী ইনটারেস্টিং। আচ্ছা, কাল তোমাদের প্রোগ্রামটা কী?
আমরা ঠিক করেছি, কাল সকাল সকাল খোঁজখবর করে ওই জায়গায় পৌঁছে যাব। সুনন্দ জানাল। জায়গাটা আগের থেকে ভালোভাবে দেখে নেব। আসলে মেয়ে দুটিকে চেনার বিশেষ কোনো উপায় নেই। নাম, চেহারা কিছুই জানা নেই, তবে যে ফোন করেছিল সে বাঙালি। আর-একটা ক্লু লাল রঙের অল্টো এইট হান্ড্রেড। দেখা যাবে, এটুকু দিয়ে আমরা মেয়ে দুজনকে খুঁজে পাই কি না।
—যে জায়গাটার কথা বলছ, সেটা সম্ভবত শিবধারা। ডক্টর সেনগুপ্ত বললেন। একটা ছোটো পাহাড়ি নদীর প্রপাত। জঙ্গল-পাহাড়ের মধ্যে শান্ত, নিরিবিলি জায়গা। আগে রাস্তাঘাট ভালো ছিল না। ইদানীং নতুন করে রাস্তা হবার পর পিকনিক স্পট হিসেবে বেশ পপুলার হয়েছে।
—ঠিক বলেছেন, জায়গাটার নাম শিবধারা। একটা নোটবুক দেখতে দেখতে বিভাস বলল। সুনন্দ জানাল, বিভাস আর সে মিলে যতটা সম্ভব স্মৃতি ঘেঁটে মেয়েটির সঙ্গে যা যা কথা হয়েছিল, সমস্তটা লিখে রেখেছে। মেয়েটির কথায় শিবধারা নামটার উল্লেখ ছিল।
—সেনগুপ্ত এমনিতে কলেজে কেমিস্ট্রি পড়ালে কী হবে, প্রায় সমস্ত উইকএন্ডে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এ অঞ্চলের সব পাহাড় আর জঙ্গল চষে বেড়ায়। বললেন রামকিশোরবাবু। কাওড়া পাহাড়, সিঙ্ঘন গুহা, টোপা রক শেলটার—যার সম্বন্ধে জানতে চাও, ওকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে।
—তাহলে যদি সম্ভব হয়, আপনিও চলুন-না আমাদের সঙ্গে—একটু ইতস্তত করে সুনন্দ বলল। সত্যি বলতে কী, আমি সেই অনেকদিন আগে ওখানে গেছি। এর মধ্যে রাস্তার নকশাও বোধহয় কিছুটা বদলে গেছে।
—আপনাদের বলতে হত না। ঈষৎ দুঃখিত স্বরে ডক্টর সেনগুপ্ত বললেন। আপনাদের এই অভিযানটা এত ইনটারেস্টিং যে আমি হয়তো নিজেই আপনাদের সঙ্গে যেতে চাইতাম। কিন্তু কালকেই সকালের ট্রেনে আমার মেয়ে বিলাসপুর থেকে আসছে। ও ওখানকার ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রিতে এমএসসি করছিল। হস্টেলে থাকত। ফাইনাল পরীক্ষার পর ঘর খালি করে ফিরছে। সঙ্গে মালপত্রও থাকবে। কাজেই ওকে আনতে গাড়ি নিয়ে স্টেশনে যেতে হবে। না হলে এরকম সুযোগ আমি ছাড়তাম না। তবে আপনাদের চিন্তার কিছু নেই। হাইওয়ে ধরে এখান থেকে শক্তির দিকে গেলে ভাটনগর থেকে ডানদিকে একটা রাস্তা ঢুকে গেছে। সেটা ধরে মোটামুটি দশ কিলোমিটার গেলে রাস্তার ওপর বাঁদিকে শিবধারা লেখা বোর্ড আছে। সেই রাস্তায় ঢুকে তিন-চারশো মিটার পরেই একটা শিব মন্দির। তার গা দিয়েই বাঁধানো সিঁড়ি উঠে গেছে। নীচে গাড়ি রাখার জায়গাও আছে। দু-একটা চা-জলখাবারের দোকানও হয়েছে বলে শুনেছি। জিজ্ঞেস করলে যে-কেউ দেখিয়ে দেবে।
সুনন্দ দু-বছর আগের স্মৃতিটা একবার ঝালিয়ে নিল। ভাঙা শিব মন্দির ছিল। পাশ দিয়ে পাকদণ্ডি। বড়ো বড়ো পাথরের বোল্ডার। একটু উঠে জঙ্গলের মধ্যে প্রায় শ-খানেক মিটার টানা পাথরের চাট্টান। তার ওপরেও অনেক জায়গায় পড়ে আছে বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই। সেখানেই মেয়ে দুটো পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে বলে তারা বেশ খোঁজাখুঁজি করেছিল। একদিক থেকে কুড়ি-পঁচিশ ফুট ওপর থেকে নেমে আসছে পাহাড়ি নদীর স্রোত। অন্যদিক দিয়ে নেমে যাচ্ছে পাহাড়ের আরও নীচের ধাপে। দু-বছরে সেখানে সিঁড়ি হয়েছে বটে, কিন্তু প্রাকৃতিক বিন্যাসের আর কোনো পরিবর্তন হওয়া উচিত নয়।
এখন দেখা যাক, সে আর বিভাস মেয়ে দুজনকে চিনে নিতে পারে কি না। আর সত্যিই যদি দুর্ঘটনার আগেই তাদের চিনে নিতে পারে? যদি মেয়েটির তাকে ফোন করার মতো পরিস্থিতিই না ঘটে? তাহলে? সুনন্দ আর ভাবতে পারে না।
আরও কিছুক্ষণ গল্পগাছার পর ডক্টর সেনগুপ্ত উঠলেন। তার আগে বলে গেলেন কোনো দরকার হলে তাকে বিনা দ্বিধায় ফোন করতে। ফোন নম্বরও বিনিময় করে নিলেন। একটু পরে সুনন্দরাও রওনা হল তাদের হোটেলের উদ্দেশে।
৩
তেইশে নভেম্বর, দু-হাজার তেইশ। বৃহস্পতিবার।
সকাল বারোটা চল্লিশে রায়গড় থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে শিবধারায় পৌঁছে গেল সুনন্দ আর বিভাস। দুজনেই উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। কিন্তু দুজনেই প্রাণপণে বাইরে থেকে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে।
জায়গাটায় পৌঁছোতে কোনো অসুবিধে হয়নি। ডক্টর সেনগুপ্তর বিবরণ একদম নিখুঁত। তার ওপর ছত্তিশগড় টুরিজ়্মের বোর্ডের নির্দেশ খুবই পরিষ্কার। শিব মন্দিরটাও রয়েছে, তবে দু-বছর আগের সেই ভাঙাচোরা অবস্থায় নয়। ভালোভাবেই তার সংস্কার হয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন একটা মন্দিরই বলা যায়। পাশ দিয়ে উঠে গেছে বাঁধানো সিঁড়ি। ওপরে উঠে জলপ্রপাতের জায়গাটা ভালোভাবে দেখে নিল ওরা। বাঁদিক দিয়ে পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে নেমে আসছে জলধারা। চারপাশে বেশ গভীর জঙ্গল, প্রধানত শাল, মহুয়া, তেন্দু আর সেগুন গাছে ভরা। নীচের ঝোপঝাড়ও বেশ ঘন। নেমে-আসা জলের ধারা বড়ো বড়ো পাথরের ফাঁক দিয়ে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ডানদিকের ঢালে। পাথরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে স্রোতের অন্য পাশে দিব্যি চলে যাওয়া যায়। সেদিকটাও পথ বড়ো বড়ো পাথরে ভরা। নেমে গেছে উলটোদিকের ঢালু উপত্যকায়। পাথুরে অংশটুকু বাদ দিলে বাকিটা বেশ ঘন জঙ্গল। সব মিলিয়ে এক অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ। তবে শান্ত স্থির মনে তা উপভোগ করা মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে প্রায় অসম্ভব।
ওরা যখন পৌঁছোল, তখন তিন-তিনটে পিকনিক পার্টির হুল্লোড়ে জায়গাটা জমজমাট। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে রান্নার আয়োজন চলেছে। ছোটো বাচ্চারা এদিক-সেদিক খেলে বেড়াচ্ছে। জলপ্রপাতের শব্দের ওপরে গলা তুলে চিৎকৃত কথাবার্তা চলেছে বড়োদের। পোর্টেবল মিউজ়িক সিস্টেমে গান বাজছে, যা এই সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে নিতান্তই বেমানান। আরও বেমানান দুজন দলছুট লোকের এই আবহে অনির্দিষ্টভাবে ঘুরে বেড়ানো। লোকজনেরা সুনন্দ আর বিভাসের দিকে বেশ সন্দেহের চোখেই দেখছে, মনে হয়। তার ওপরে তারা বেশ কৌতূহলী চোখে পিকনিকের লোকজনের দিকে দেখছে, বোঝার চেষ্টা করছে, এদের মধ্যে কেউ ওই দুজন মেয়ে হতে পারে কি না। ওরা অবশ্য মাঝে মাঝেই নীচে কার পার্কিং-এ নেমে যাচ্ছে। দেখে আসছে, কোনো লাল রঙের মারুতি অল্টো এল কি না। এর মধ্যে দু-দুবার চায়ের দোকানে বসে চা খেল ওরা। কথায় কথায় জানা গেল শিবধারার সামনের রাস্তাটা ঠিক রামপুরে যাবার পুরোনো পথটা নয়। অর্থাৎ দু-বছর আগে যে পথ ধরে সুনন্দ ওখানে পৌঁছেছিল, সেটা নয়। তবে এই পথটা ধরে আধ কিলোমিটার গেলে এই পাহাড়ি নদীর ওপরের ছোটো একটা পুল পেরিয়ে ওই পথটা পাওয়া যাবে। সেটা আবার বাঁদিকে আরও দু-কিলোমিটার গিয়ে এই নতুন রাস্তায় পড়েছে।
—এই হইচইয়ের ভেতর এখনই কিছু ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। বিভাস বলল। মেয়েটা বলেছিল, চিৎকার করলেও আশপাশে কেউ শুনতে পাবে না। মানে, জায়গাটা তখন খালি হয়ে গেছে, বা বলা উচিত—যাবে।
—আমার একটা ব্যাপারে বেশ খটকা লাগছে। সুনন্দ বলল। মেয়েটা বলেছিল, জলপ্রপাতে যাবার পথে তারা পাথরে পিছলে পড়ে যায়। কিন্তু বোল্ডারের জায়গাটা তো পাথর কেটে সিঁড়ি বানানো হয়ে গেছে, সেখানে পাথরের খাঁজে পড়ার সুযোগ নেই। আবার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলেই সামনে ফল্স। তখন শখ করে বোল্ডারে চড়ার চেষ্টা করাটা কিছুটা অস্বাভাবিক। তা ছাড়া মেয়েটা বলেছিল, ফল্সের দিকে যাবার পথেই তারা পড়ে গিয়েছিল—বা সঠিক বলতে হলে পড়ে যাবে।
বিভাস কথা বলতে বলতেই মাঝে মাঝে নোটবুক খুলে সুনন্দর স্মৃতি থেকে উদ্ধার-করা সেদিনের কথাবার্তাগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। এবার বলল—কিন্তু সব চেয়ে ভাবনার বিষয় লাল রঙের অল্টো না-আসা। তাহলে কিন্তু শেষ অবধি মেনে নিতে হবে, ওই পুরো ঘটনাটাই মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডারের ভুলের জন্যে ঘটেছে।
সুনন্দ চুপ করে রইল। আশঙ্কাটা তার মনে আগের থেকেই উঁকি দিচ্ছিল। সত্যি বলতে কী, এখানে আসার আগের থেকেই। এরকম আশ্চর্য ঘটনা কি সম্ভব হতে পারে কখনও?
এরই মধ্যে ভেতর দিক থেকে আসা এক বাইক যাত্রীর সঙ্গে গল্প করে জানা গেল, রামপুরের কাছে রাস্তায় কোথাও ধস নামার জন্যে ওদিকে যাওয়া-আসার পথ ক-দিন বন্ধ আছে। অর্থাৎ তারা যদি রামপুর হয়ে কোরবা বা বিলাসপুরের দিকে যেতে চায় তাহলে ওই ভেতরদিকের রাস্তা ধরে তাদের পুরোনো পথটা ধরতে হবে, এদিক দিয়ে সোজা রাস্তায় যাওয়া যাবে না।
চারটে বেজে গেল এইভাবেই। সুনন্দরা চায়ের দোকানি আর অন্য লোকেদের সঙ্গে গল্প করতে করতে আশপাশের পথঘাটের খবর জেনে নিয়ে বুঝেছিল যে তাদের উদ্দিষ্ট জায়গা এইটাই। ফলে মাঝে মাঝে ওপরে জলপ্রপাতের কাছে গিয়ে ঘুরে আসা ছাড়া ওদের করারও কিছু ছিল না।
এরই মধ্যে পিকনিক পার্টিদের ফেরা শুরু হল। চ্যাঁচামেচি-হইহট্টগোলে শান্ত প্রকৃতিকে সাধ্যমতো কলুষিত করে একে একে বিদায় নিলেন তাঁরা। শুধু ওদের ভাড়া-করা গাড়িটা ছাড়া আর কোনো গাড়ি স্ট্যান্ডে নেই। সুনন্দ আর বিভাস স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, এতক্ষণে তাদের কানে পাখির ডাক এসে পৌঁছোচ্ছিল। তা ছাড়াও ওপরের জলপ্রপাতের সামনেটা এখন জনশূন্য। কোনো কিছু ঘটার হলে তা এইবারে ঘটবে। স্নায়ু টানটান করে তারা অপেক্ষা করতে লাগল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য। কিন্তু লাল অল্টোর কোনো চিহ্ন কোথাও নেই। তবে কি মোবাইল ফোনের সার্ভিস প্রোভাইডারের কোনো অনিচ্ছাকৃত ভুলের মধ্যেই এই রহস্যের সমাধান আছে বলে ধরে নিতে হবে?
এই সময়ে ডক্টর সেনগুপ্তর ফোনটা এল। ঘড়িতে ঠিক সাড়ে পাঁচটা। ওদের খোঁজখবর নিলেন। গলার স্বরেই ওঁর কৌতূহলের ছাপ স্পষ্ট। কথার মধ্যেই হঠাৎ বললেন, আমার খুব আপশোশ হচ্ছে তোমাদের সঙ্গে যেতে না-পারার জন্যে—
—কিন্তু আপনি আর কী করবেন? আপনার মেয়ের আসার কথা সান্ত্বনার সুরেই বলল বিভাস। ডক্টর সেনগুপ্ত উত্তরে বললেন, আরে সেটাই তো কথা। আমার মেয়ে সকাল এগারোটায় ফোনে জানাল, ও ট্রেনে আসছে না। ওর বন্ধু সোমার সঙ্গে নিজেরা গাড়ি ড্রাইভ করে আসছে। ততক্ষণে আপনারা বেরিয়ে পড়েছেন। অবশ্য তখনও একবার ভেবেছিলাম—
ফোন স্পিকারে ছিল। হঠাৎই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল বিভাস। ডক্টর সেনগুপ্তর কথার মধ্যেই চেঁচিয়ে উঠল কী? কী নাম বললেন? সোমা? বলতে বলতেই দ্রুত হাতে ওলটাতে লাগল নোটবইয়ের পাতা। খুঁজতে লাগল সুনন্দর সঙ্গে মেয়েটির প্রথম ফোনের কথাবার্তার জায়গাটা।
—হ্যাঁ। জানালেন ডক্টর সেনগুপ্ত, ওর ব্যাচেরই, তবে আলাদা সাবজেক্ট। আর্কিয়োলজি।
—কী গাড়ি? লাল রঙের মারুতি অল্টো?
—তা তো জানি না। ওর বন্ধু সোমার গাড়ি।
—আপনার মেয়ের নাম?
—মহাশ্বেতা। ডাকনাম মধু। কিন্তু কেন বলুন তো?
সে কথার জবাব না দিয়ে বিভাস বলল, আচ্ছা বলুন তো, শিবধারায় পৌঁছোনোর আর কোনো পথ আছে?
—আমার জানা নেই। তবে পাহাড়ি এলাকায় আরও পায়ে-চলা পথ থাকতেও পারে। ডক্টর সেনগুপ্ত বললেন, পাহাড়ের উলটোদিক থেকে। কিন্তু এসব জানতে চাইছেন কেন?
উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিল বিভাস। একজন বাবাকে মেয়ের সম্ভাব্য দুর্ঘটনার খবর দিয়ে চিন্তায় ফেলার দরকার নেই।
সুনন্দ তখন একই প্রশ্ন করছে চায়ের দোকানে। একজন জানাল, পুরোনো রাস্তার দিক থেকে পাকদণ্ডি দিয়ে শিবধারায় আসা যায়। তবে এদিকে ভালো রাস্তা থাকতে ওদিক দিয়ে কেউ কেন যাবে? আর মূল সড়কের ধারে আছে বলেই-না সরকার থেকে এদিক দিয়েই টুরিস্ট স্পটের রাস্তা বানিয়েছে।
—আচ্ছা, উধার কোই পুরানা মন্দির হ্যায়? সুনন্দর গলা তখন উত্তেজনায় কাঁপছে।
—কভি মন্দির থা। একজন লোক নিস্পৃহ গলায় বলল, কম সে কম হাজার সাল পুরানা। হইহয় রাজাওঁ কে টাইম মে বনা হুয়া। অভি তো খণ্ডহর।
—উধার পঁহুচনে কা রাস্তা?
সুনন্দর প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল, শিবধারারই অন্যদিক দিয়ে যে বড়ো বড়ো বোল্ডার ভরতি ঢাল নেমে গেছে, সেই পথে শ-দুয়েক মিটার নামতে পারলেই পুরোনো সড়ক, আর তার ধারেই সেই প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ। তবে একটু ঘুরে হলেও, সামনের পথ দিয়ে সোজা গিয়ে পুল পার করে পুরোনো সড়ক দিয়ে সেখানে পৌঁছোনো অনেক সহজ।
পাঁচটা চল্লিশ। যা হবার ছিল, তা হয়ে গেছে। সুনন্দ আর বিভাস গাড়িতেই রওনা হল। সরু পুল পেরিয়ে বাঁদিকে ঘুরল গাড়ি। আর মাত্র শ-তিনেক মিটার দূরেই দাঁড়িয়ে-থাকা লাল রঙের মারুতি অল্টোটা চোখে পড়ল ওদের।
৪
মধু আর সোমা বিলাসপুর থেকে রওনা হবার সময়েই প্ল্যান করেছিল, উরগা থেকে চাঁপা রোড না ধরে আরও এগিয়ে এসে রামপুর থেকে ভাটনগরের রাস্তা ধরবে। উদ্দেশ্য—পুরোনো মন্দিরটা দেখা আর কিছু ছবি তোলা। সোমা আগে তার বাবাকে সে কথা জানায়নি, পাছে তিনি বারণ করেন। রওনা হবার পর ফোন করেছিল। মন্দির দেখার আগ্রহটা মূলত সোমার, সে পুরাতত্ত্ববিজ্ঞানের ছাত্রী। নতুন-বানানো রাস্তাটা বন্ধ থাকায় তাদের পুরোনো রাস্তাটাই ধরতে হয়। তাতে অবশ্য অসুবিধের কিছু ছিল না। কারণ তাদের লক্ষ্য যে প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, সেটা এই রাস্তার ওপরেই। তবে তার জন্যেই তাদের গাড়ি শিবধারার মুল টুরিস্ট স্পটের সামনে দিয়ে যায়নি। ফলে সুনন্দরাও দেখতে পায়নি তাদের লাল রঙের গাড়িটা।
মন্দির দেখা আর ছবি তোলার মধ্যেই স্থানীয় কিছু লোকের থেকে শিবধারার কথা জানতে পেরেছিল মধু ও সোমা। পাহাড় বেয়ে একটু ওপরে চড়লেই যে একটা জলপ্রপাত দেখা যেতে পারে—এটা জেনে দুজনের কেউই লোভ সামলাতে পারেনি। ওপরে উঠতে গিয়েই বিপর্যয়। বোল্ডারে চড়তে গিয়ে পিছলে যায় মধু, আর তাকে ধরতে গিয়ে একই সঙ্গে দুই পাথরের মাঝের খাঁজে পড়ে সোমাও। তার মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে যায়। মধুর একটা পা ফেঁসে যায় দুটো পাথরের খাঁজে। নিজের মোবাইল ছিটকে পড়েছিল একটু দূরে। নাগালের বাইরে। অগত্যা হাতের কাছে থাকা সোমার ব্যাগ থেকে মোবাইল বার করে নিজের বাবার নম্বরে ফোন করার চেষ্টা করে মধু। উত্তেজনা বা নার্ভাস শকের জন্য তার আঙুলগুলো তখন কম্পমান। ভুল ডায়াল হয়ে গিয়েছিল। ভুল লোকের কাছে পৌঁছে যায় সেই কল।
(শুধু কি ভুল ঠিকানায়? ভুল সময়েও তো। তার অজান্তেই।)
শেষ বিকেলের আলো তখন ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে পার্বত্য প্রান্তরে। জঙ্গলে-পাহাড়ে সন্ধ্যা নেমে আসে হঠাৎই। সেই অচেনা লোকটি বলেছিল, আধ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। মিনিট দশেক হয়েছে বড়োজোর। লোকটির আন্দাজ সঠিক হলেও কুড়ি-পঁচিশ মিনিট আরও লেগে যাবে তার। তার মধ্যে গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যাবে এই উপত্যকা। এই অঞ্চলে খুব ভালুকের উপদ্রব আছে। তাদের কেউ যদি হঠাৎ এসে পড়ে? মধু আর ভাবতে পারে না।
এমন সময়ে দূর থেকে কে যেন তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সোমার নাম ধরেও ডাকল কেউ। মধু কি স্বপ্ন দেখছে? তাদের নাম এখানে কে জানবে? আর কীভাবেই-বা জানবে? তবে যেমন করেই জানুক, কেউ যে তাদের উদ্ধার করতে এসেছে, অবিশ্বাস্য হলেও সেটা সত্যি। মধু প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল, এই যে, আমরা এখানে।
দুজন অচেনা লোক যখন পাকদণ্ডির পথে বোল্ডার টপকে তাদের উদ্ধার করতে পৌঁছোল, তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল দুশ্চিন্তায় বিপর্যস্ত মধু। সুনন্দ আর বিভাস তাদের সাবধানে বার করল পাথরের খাঁজ থেকে। মধুর বিশেষ কোনো আঘাত লাগেনি। সোমারও চোখে-মুখে জল ছেটাতে অল্পক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে এল। ভাগ্যক্রমে দুজনেরই বড়োসড়ো কোনো চোট লাগেনি।
গাড়ির সামনে আসার পর সুনন্দদের ধন্যবাদ দেবার পর মধু বলল, দুটো প্রশ্ন করব। এক, আপনারা এত তাড়াতাড়ি পৌঁছোলেন কীভাবে? আর আমাদের দুজনের নামই-বা কী করে জানলেন?
—সে অনেক লম্বা গল্প। সুনন্দ জানাল। আপনাদের বাড়িতে পৌঁছে দেবার পর সব বলব। আরও অনেকেই ব্যাপারটা বিস্তারিত জানার জন্যে অপেক্ষায় থাকবে।
ডক্টর সেনগুপ্তকে ফোন করে সব জানানোর পর রায়গড়ের দিকে রওনা হল তারা। সোমার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এল সুনন্দ।
বাকি পথটুকু নিরাপদে পার হয়ে রায়গড়ে পৌঁছে গেল তারা।
আর-একটা কথা না বলে এ কাহিনির উপসংহার টানা যাবে না। রায়গড়ে এসে নিজের মোবাইল ফোন খুলে সুনন্দ দেখেছিল, দু-বছর আগে হারিয়ে-যাওয়া কল লিস্টের সেই নম্বরগুলো আবার ফিরে এসেছে তার ফোনে। পাঁচটা ছত্রিশ থেকে শুরু করে পরপর। শুধু সাল আর তারিখটা সেদিনের। তেইশে নভেম্বর, দু-হাজার তেইশ। মধুর ফোনের সঙ্গেও মিলে গেল সময়গুলো।
হাতের নাগালে এসেও ধরা দিল না সময়ের এক অভিনব কূটাভাস।
Tags: অলোক চট্টোপাধ্যায়, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
