জ়াম্বোলার নরখাদক
লেখক: রবার্ট ই হাওয়ার্ড অনুবাদ: সায়ক দত্ত চৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
রাতের মাদল
“আরাম বক্সের সরাইয়ে মৃত্যু ওঁত পেতে আছে।”
লোকটা ভয়ার্ত কণ্ঠে কুঁইকুঁই করে উঠল। তার কাঁপা-কাঁপা হাতের কালো নখওয়ালা সরু সরু আঙুল কোনানের বাহুর শক্তিশালী পেশিকে খামচে ধরেছিল। কোনানের এই ছিপছিপে, শক্তপোক্ত, তামাটে বর্ণের সঙ্গীটির মুখে লম্বা কালো দাড়ি, পরনে মলিন বসন। দৃশ্যতই সে একজন মরুর যাযাবর। তাকে শালপ্রাংশু, কবাটবক্ষ, বৃষস্কন্ধ, পেশিবহুল কোনানের পাশে অবশ্য ছোটোখাটো লাগছিল। তারা তলোয়ার নির্মাতাদের বাজারের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের দু-পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল বহু বর্ণের, বহুভাষাভাষী মানুষের স্রোত। জ়াম্বোলার এই রাস্তা সত্যিই আড়ম্বরপূর্ণ, বিচিত্র, বর্ণিল, মুখর এবং ক্ষেত্রবিশেষে সংগীতময়।
কোনান একটি আয়তচক্ষু, লাল পুরু ঠোঁটের ঘানারা বারবনিতার হেঁটে যাওয়া লক্ষ করছিল। মেয়েটির টকটকে লাল রঙের ছোটো স্কার্ট তার সবল তামাটে পায়ের জানু অবধিও নামেনি। সঙ্গীর কথায় বিরক্ত হয়ে সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “মৃত্যু বলতে কী বোঝাতে চাইছ?”
লোকটা জবাব দেওয়ার আগে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকটা সাবধানে দেখে নিল। তারপর চাপা গলায় বলল, “সেটা পরিষ্কার করে ঠিক জানি না। কিন্তু যেসব মরুমানুষ একবার আরাম বক্সের বাড়িতে ঘুমিয়েছে, তাদের আর দেখাও যায়নি, শোনাও যায়নি। কী হল তাদের? ও দিব্যি গেলে বলেছে, তারা সকলেই নাকি ঘুম থেকে উঠে জিনিসপত্র সমেত তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। এটা অবশ্য ঠিক যে শহরের কোনো মানুষ কখনও ওর ঘর থেকে হারিয়ে যায়নি। কিন্তু বিদেশি যাযাবর যারা ছিল, তাদের ক্ষেত্রে গল্পটা আলাদা। লোকে বলে, তাদের জিনিসপত্রের কিছু কিছু নাকি এই বাজারেই পরে দেখা গেছে। যদি আরামই বিক্রি না করে, তবে ওগুলো বাজারে এল কোথা থেকে?”
“আমার সঙ্গে কোনো মালপত্র নেই।” কোনান নিজের চওড়া তরবারির হাতলটা স্পর্শ করে বলল, “আমি ঘোড়াটাকেও বেচে দিয়েছি।”
“কেবল যে পয়সাওয়ালা বিদেশিরাই রাতের বেলা আরাম বক্সের বাড়ি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে, এমন নয়।” জুয়াগিরটি ফিশফিশ করে বলল, “ওর সরাইখানার ভাড়া কম বলে অনেক গরিব পথিকও সেখানে শুতে যায়। তাদের অনেকেই আর দিনের আলো দ্যাখে না। একবার এক জুয়াগির সর্দারের ছেলে ওভাবেই হারিয়ে যায়। সে সত্রাপ জাহাঙ্গির খানের কাছে গিয়ে নালিশ করে। তখন ওর সরাইখানায় সৈন্যরা তল্লাশি চালায়।”
“আর সেখান থেকে গাদা গাদা মৃতদেহ পাওয়া যায়।” কোনান মজার সুরে বলল।
“নাহ্, কিছুই পাওয়া যায়নি। ওরা সর্দারটাকে গালাগাল দিয়ে শহর থেকে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু…” কোনানের কাছে ঘনিয়ে এল যাযাবরটি। কম্পিত কণ্ঠে বলল, “অন্য একটা বিষয়ে জানা যায়। ওর সরাইখানার দিকে, মরুভূমির সীমান্তে ঘরবাড়িগুলো যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে বালিয়াড়ির মধ্যে বেশ কয়েকটা পাম, খেজুর—এইসব গাছের জটলা আছে। সেগুলোর আড়ালে একটা গভীর গর্ত পাওয়া যায়। সেখানে মাঝে মাঝেই নাকি মানুষের হাড়গোড় মেলে। কালো, পোড়া হাড়ের টুকরো। একবার না, বেশ কয়েকবার।”
“তাতে কী প্রমাণিত হল?” কোনান গরগর করে জিজ্ঞেস করল।
“আরাম বক্স একটা রাক্ষস। যা-ই বলো, স্টাইজীয়রা এই বদ শহরটা বানিয়েছিল। তারপর এখানে এসে জুটেছিল কারা? হাইরকানীয়রা। চারদিকে তাকাও, কালো, সাদা, বাদামি মানুষের ঢল নেমেছে একেবারে। এদের মেলামেশায় কোনোদিনই কোনো বাধা ছিল না। ফলে অপবিত্র, পাপী দোআঁশলাতে ছেয়ে গিয়েছে চারদিক। কে বলতে পারে এদের মধ্যে কোনটা মানুষ আর কোনটা ছদ্মবেশী রাক্ষস? ওই আরাম বক্সও একটা রাক্ষস। রাতের আঁধারে ও নিজের আসল রূপ ধরে সরাইখানা থেকে মানুষ তুলে নিয়ে যায় গর্তটার কাছে। নানা জায়গা থেকে আসা ওর রাক্ষস-বন্ধুদের সঙ্গে নরমাংস খাবে বলে।”
“ও শুধু বিদেশিদের খায় কেন?” কোনানের কণ্ঠে সংশয়ের সুর।
“শহরের লোকেদের খেলে ওরা ওকে ছেড়ে দেবে নাকি? বিদেশিদের নিয়ে শহুরেদের কোনো মাথাব্যথা নেই। শোনো কোনান, তুমি পশ্চিম থেকে এসেছ, পুবের এইসব প্রাচীন শহরের রহস্য সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। শোনা যায়, সৃষ্টির আদি থেকে এখানে রাক্ষসেরা আগুনের কুণ্ড বানিয়ে মহাশূন্যের দেবতা যোগের আরাধনা করে। তাতে মানুষের আহুতি দেওয়া হয়।
“তুমি আমাদের সঙ্গে মরুভূমির শিবিরে অনেক চাঁদের রাত কাটিয়েছ। তুমি আমাদের ভাই। তাই সাবধান করছি, আরাম বক্সের সরাইয়ে যেয়ো না।”
“আচ্ছা, সে দেখা যাবে। আপাতত তুমি গা-ঢাকা দাও। আমি নগররক্ষীদের একটা দলকে দেখতে পাচ্ছি। ওরা টহল দিতে দিতে এদিকেই আসছে। ওরা যদি তোমায় দেখতে পায়, আর সত্রাপের ঘোড়াশাল থেকে ঘোড়া চুরির ঘটনাটা ওদের জানা থাকে, তাহলে…”
কথাটা শুনে ভীতু জুয়াগিরটি ফ্যাকাশে মুখে কাঁপতে কাঁপতে কোথায় পালাবে, বুঝতে পারল না। এদিক-সেদিক তাকিয়ে সে উপায়ান্তর না দেখে প্রথমে একটা ছোটো দোকান আর পাথরের মূর্তির মাঝে বসে পড়ল। সেই অবস্থাতেই সে গুনগুন করে আরেকবার বলল, “আমার কাজ ছিল তোমায় সাবধান করা, তাই বললাম। আরাম বক্সের বাড়ি গেলেই কিন্তু মরবে।” তারপর পালানোর সুযোগ পাওয়ামাত্র ভোঁ দৌড় দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল।
কোনান তার তলোয়ারসহ মোটা কোমরবন্ধনীটা নেড়েচেড়ে আরেকটু আরামদায়ক অবস্থানে নিয়ে এল, তারপর শান্ত চোখে তাকাল টহলরত রক্ষীদের দলটার দিকে। তারাও তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তবে সে দৃষ্টি জিজ্ঞাসা ও সন্দেহের। স্বাভাবিক। এমনকি জ়াম্বোলার এই বিচিত্র, বহুবর্ণী মানুষে ভরা রাস্তাতেও তাকে আলাদা করে চোখে পড়ে। তার বিশাল বিদেশি গড়ন, হিমশীতল নীল চোখ বুঝিয়ে দেয় যে, সে এই পুব দেশের মানুষদের থেকে অনেকটাই অন্যরকম। কোমর থেকে ঝোলা তার দীর্ঘ সোজা তলোয়ার তাকে পৃথক জাতির মানুষ হিসেবে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করে দেয়।
রক্ষীরা অবশ্য তাকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করল না। সামনের রাস্তা দিয়ে তারা ধীরপায়ে নিজেদের গন্তব্যে চলে গেল। পথের ভিড় দু-পাশে সরে গিয়ে তাদের যেতে দিল। রক্ষীরা ছিল প্যালেস্তিনীয়। তুরানি শাসকেরা তাদের অপছন্দের কাজকর্মগুলোর জন্য এদের ভাড়া করে। বাঁকা নাক, বর্মাবৃত বুক অবধি নেমে-আসা কালচে নীল দাড়ির অধিকারী এই মোটাসোটা ভাড়াটে সৈন্যদের স্থানীয় মানুষেরাও যে খুব একটা পছন্দ করে, এমন বলা যায় না।
কোনান আকাশের দিকে তাকাল। সূর্য পশ্চিমে, বাজারের সমতল ছাত সংবলিত বাড়িগুলোর পিছনে অস্তমিত প্রায়। সে আরেকবার কটিবন্ধটাকে নাড়াচাড়া করল, তারপর আরাম বক্সের সরাইখানার দিকে হাঁটা দিল।
প্রকৃত পাহাড়িদের মতো দৃপ্ত পদক্ষেপে সে সদাপরিবর্তনশীল, রঙিন পথের ভিড় ঠেলে এগোতে লাগল। সেখানে ছেঁড়াখোঁড়া জামা-পরা ভিক্ষুকদের পাশে হেঁটে চলেছিল, লোমশ নকুল-চর্মে সজ্জিত মহার্ঘ খালাত-পরা, অতুল বৈভবের অধিকারী ব্যবসায়ীর দল। দেখা মিলছিল মণিমুক্তায় অলংকৃত, নানান উজ্জ্বল রঙের, রেশমের পোশাক-পরিহিত রাজসভাসদদের। কালো কালো বিশালদেহী নির্লিপ্ত মুখের ক্রীতদাসেরা হাঁটছিল থপথপিয়ে। নীল দাড়ি, চালাক মুখের শেমীয় পরিব্রাজক, আশপাশের মরু অঞ্চল থেকে আসা মলিন পোশাকের যাযাবর, যোদ্ধা থেকে বারবনিতা, কে ছিল না সেখানে। পুবের সব অঞ্চলের প্রতিনিধিরা মিশে যাচ্ছিল সেই কোলাহলমুখর বহমান রাস্তায়।
স্থানীয় মানুষজনও অবশ্য কম বর্ণসংকর নয়। কয়েক শতাব্দী আগে এখানে স্টাইজীয় সেনাবাহিনী আসে। পুবের মরুভূমিতে সাম্রাজ্যবিস্তার ছিল তাদের লক্ষ্য। জ়াম্বোলা তখন মরূদ্যানে ঘেরা এক ছোট্ট বাণিজ্য শহর। এখনকার মরু যাযাবরদের পূর্বপুরুষরা তার বাসিন্দা ছিল। স্টাইজীয়রা সেখানে ঘাঁটি গাড়ল। নতুন নতুন ঘরবাড়ি বানাতে তারা কাজে লাগাল শেমীয়দের আর কুশ থেকে আনা ক্রীতদাসদের। মরুভূমির বুক চিরে-যাওয়া পুব আর পশ্চিমের সংযোগকারী রাস্তা ধরে এসে, এখানে ভিড় জমাল অন্তহীন ক্যারাভ্যানের সারি। তাতে করে এল সব জাতির ধনী ব্যবসায়ীরা। তারপর একদিন তুরানিরা এল। পুবদিক থেকে ধেয়ে-আসা ঝড়ের মতো আক্রমণ করে তারা স্টাইজীয় সাম্রাজ্যের সীমানা পিছিয়ে দিল। তারপর থেকে কয়েক প্রজন্ম ধরে জ়াম্বোলা তুরানের পশ্চিমতম সীমান্ত শহরগুলোর মধ্যে একটা। বর্তমানে তুরানের সম্রাটের প্রতিনিধি হয়ে সত্রাপই এর শাসনভার সামলান।
সঞ্চরণশীল, বহুবর্ণের ভিড়ের মাঝে ভাসছিল কোনান। সারা বিশ্বের সমস্ত প্রাচীন ভাষার কথাবার্তা, চ্যাঁচামেচি তার কানে যেন হাতুড়ি পিটছিল। তার সঙ্গে মাঝে মাঝেই মিশছিল লোহার নাল-বাঁধানো খুরের খটাখট শব্দ। কালো শ্যেনের মতো মুখ নিয়ে, লম্বা, শক্তিশালী, ধাতব বর্ম-পরিহিত, বাঁকা তলোয়ারধারী তুরানি অশ্বারোহীরা সগর্বে ঘোড়া ছোটাচ্ছিল। এই শহরের প্রভু তারা। তাই যেন তাদের বাহনের পদক্ষেপেও ঝরে পড়ছিল দাম্ভিকতা। আর পথের ছায়াচ্ছন্ন অঞ্চল থেকে তাদের দিকে মলিন ও বিষণ্ণ চোখে চেয়ে ছিল কুণ্ঠিত স্টাইজীয়রা। তাদের মনে পড়ে যাচ্ছিল অতীতের গর্বোজ্জ্বল দিনগুলোর কথা। কে তাদের শাসন করছে, তা নিয়ে অবশ্য এ দেশের সাধারণ বর্ণসংকর মানুষের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। শাসক আঁধার-ঘেরা খেমি বা আলোকিত আঘ্রাপুর, যেখানকার বাসিন্দাই হোক-না কেন, তাদের কাছে সবই সমান। এখন যেমন জাহাঙ্গির খান জ়াম্বোলা শাসন করে, আর লোকে বলে, তার সুন্দরী রক্ষিতা নেফারতারি নাকি তাকে শাসন করে। তাতে কার কী-ই-বা গেল-এল। তারা জীবনের রঙে রঙিন রাস্তায় যুগ যুগ ধরে হেঁটে, ভিক্ষা করে, গান গেয়ে, ঝগড়া করে, জুয়া খেলে, দরাদরি করে, প্রেম করে চলেছে; আর সেই সময় জুড়ে খারামুনের বালিতে গড়ে উঠেছে অট্টালিকা ও মিনারের সারি।
কোনান যতক্ষণে আরাম বক্সের বাড়িতে পৌঁছোল, ততক্ষণে রাস্তায় ড্রাগনের কারুকার্য-করা তামার লন্ঠনগুলো জ্বলে উঠেছে। পশ্চিমদিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে, সরাইখানাটা তার একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত। ঘন খেজুর গাছে ভরা একটা বাগান আর সেটাকে ঘিরে একটা উঁচু দেওয়াল, সরাইখানাটাকে পুবদিকের অন্য বাড়িগুলো থেকে একেবারে আলাদা করে রেখেছে। সেটার পশ্চিমে এলোমেলোভাবে বেড়ে-ওঠা অনেকগুলো পাম গাছ ও ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে, আঁকাবাঁকা আরেকটা রাস্তা মরুভূমির দিকে চলে গেছে। পথটা ধরে খানিক এগোলেই দু-পাশে দেখা যাবে কয়েকটা পরিত্যক্ত বাড়িকে। সেগুলোতে কেবল বাদুড় আর শেয়ালের বাস। সেদিকটা খানিক ঘুরে এসে কোনান ভাবল, জ়াম্বোলাতে তো ভিখারির অভাব নেই। তারা খোলা আকাশের নীচে পড়ে না থেকে, এই বাড়িগুলোতে আশ্রয় নেয় না কেন?
রাস্তার আলো খানিক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখানে পান্থশালাটার সামনে ছাড়া আর কোনো আলো ঝুলছে না। অন্ধকার আকাশে তারারা মিটমিট করছে। হালকা বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে শুকনো বালি আর ধুলো। পাম গাছের পাতার মর্মর যেন কোনো অজানা রহস্যের গল্প বলে চলেছে।
আরামের বাড়ির দরজাটা সরাসরি মূল রাস্তার দিকে না হয়ে কিছুটা ওই পাম গাছগুলোর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। কোনান সেখানকার লন্ঠনের পাশে ঝোলা ঘণ্টাটার দড়ি ঘঘন নাড়তে লাগল। তার সঙ্গে লোহার পাতে মোড়া দরজার পাল্লায় তলোয়ারের হাতল ঠুকতে লাগল। এই প্রবল শোরগোল শুনে খানিক পরেই পাল্লার মাঝে একটা ছোটো ফুটো খুলে গেল আর তা দিয়ে উঁকি মারল একটা কালো মুখ।
“এক্ষুনি দরজা খোলো।” কোনান বলল, “আমি অতিথি। এখানের একটা ঘরের জন্যে আমি পয়সা দিয়েছি। তাই ক্রমের দিব্যি, ঘরটা আমি পেয়েই ছাড়ব।”
কালো মানুষটা গর্ত দিয়ে সারসের মতো মাথা বের করে একবার চারপাশটা দেখে নিল, তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে দরজা খুলে দিল। সিমেরীয়টি ভিতরে ঢুকলে সে ভালো করে দরজায় খিল আর শিকল লাগাল। চারপাশের পাঁচিলটা সত্যিই উঁচু। অবশ্য জ়াম্বোলাতে চোর-ডাকাতের অভাব নেই। আর শহরের একপ্রান্তে বলে এখানে রাতের বেলায় যাযাবরদের উৎপাতও অসম্ভব নয়। আকাশভরা তারার নীচে খেজুরের গুচ্ছগুলো মাথা দোলাচ্ছিল। বাগান পার করে কোনান পানঘরে পৌঁছোল। সেখানে এক স্টাইজীয় চোখ বড়ো বড়ো করে এক ন্যাড়ামাথা ছাত্রকে ভয়ানক সব জাদুর গপ্প শোনাচ্ছিল। কোণের একটা টেবিলে মলিন জামাকাপড়-পরা কয়েকটা লোক একমনে ছক্কা চেলে জুয়া খেলছিল।
আরাম বক্স তাকে দেখে লঘুপায়ে, নিঃশব্দে এগিয়ে এল। তার কালো দাড়ি বুক অবধি নেমে এসেছে। কুতকুতে কালো চোখ দুটো সদাই চঞ্চল। অস্বাভাবিক খাড়া নাকটা আলাদা করে চোখে পড়ে।
“খাবার চাই?” হোঁতকা লোকটা জিজ্ঞেস করল, “মদ?”
“সাক থেকে আমি রুটি আর গোরুর মাংস খেয়ে এসেছি। বড়ো এক পাত্তর ঘাজার মদ এনে দাও দেখি। এর চেয়ে বেশি পয়সা আমি এখন খরচা করতে পারব না।” একটা তামার মুদ্রা সে ভেজা টেবিলের ওপর ছুড়ে দিয়ে বলল।
“জুয়ার টেবিলে জিততে পারোনি?”
“কী করে জিতব? খেলার জন্য ছিল তো মাত্র কয়েকটা রুপোর টাকা। ওইজন্যে তোমাকে সকালেই ঘরের টাকাটা দিয়ে দিয়েছিলাম। যদি হেরে যাই। আগে তো রাতে শোয়ার ব্যবস্থাটা করে রাখতে হবে। আমি দেখেছি, জ়াম্বোলার ভিখিরিগুলো পর্যন্ত খোলামেলা জায়গায় না শুয়ে, কোনো ঘেরাটোপের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। ওরা দল বেঁধে শোয়। চারদিকে যা হোক দিয়ে একটা বাধার প্রাচীর বানানোর চেষ্টা করে। এই শহরে নিশ্চয়ই একদল রক্তপিপাসু ডাকাত আছে।”
সে ঢকঢক করে সস্তা পানীয়টা খেয়ে আরামের পিছন পিছন পানঘর থেকে বেরিয়ে এল। তাদের পিছনে জুয়াড়িরা খেলা থামিয়ে কোনানের দিকে একটা অর্থপূর্ণ রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তারা কোনো কথা না বললেও স্টাইজীয়টি হেসে উঠল। এক অদ্ভুত অসূয়া আর বিদ্রুপ মিশে ছিল সেই হাসিতে। সেই হাসি শুনে অন্য যারা ছিল, তারা একে অপরের দিকে তাকাতে না পেরে মাটির দিকে চোখ নামিয়ে নিল। একজন স্টাইজীয় জাদুবিদ যেসব শিক্ষা লাভ করে, তাতে অন্যদের সম্পর্কে তার চিন্তার বহিঃপ্রকাশ পরিশীলিত না হলেও চলে।
কোনান তামার বাতিতে আলোকিত দালান ধরে চলেছিল। তার সরাইওয়ালার এমন শব্দহীন পদচারণে সে মোটেই খুশি হতে পারছিল না। এটা ঠিক, আরামের পায়ে নরম চপ্পল ছিল, আর মেঝেতেও বিছানো ছিল নরম গালিচা, তবুও এই জ়াম্বোলাবাসীটির নিঃশব্দ চারণে কেমন এক রহস্যময়তা, গা-ছমছমে ভাব ফুটে উঠছিল।
পাক-খাওয়া দরদালান পার করে আরাম একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজাটার বাইরের দিকেই একটা লোহার হুড়কো লাগানো ছিল। সেটা নিঃশব্দে খুলল আরাম। পাল্লা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলে দেখা গেল ঘরটা খুব একটা বড়ো না হলেও মন্দ নয়। তবে কোনানের প্রথমেই চোখ গেল জানলাগুলোর দিকে। সেগুলো তুলনামূলকভাবে বেশ ছোটো, আর লোহার গরাদ-দেওয়া। ঘরের ভিতরে অবশ্য একটা সুন্দর আরামদায়ক বিছানা আছে। তার ওপরে গুছিয়ে রাখা আছে অনেকগুলো কম্বল। বসার জন্য রয়েছে কারুকার্যময় কাঠের টুল। মেঝেতে গালিচা। চমৎকার ব্যবস্থাপনা। যে পয়সা সে খরচা করছে, তা দিয়ে জ়াম্বোলার কেন্দ্রস্থলে রাত কাটানোর জন্য এমন একটা ঘরের কথা কল্পনাই করা যায় না। সত্যি বলতে এই কম ভাড়াটাই তাকে প্রথমে আকর্ষণ করে। এক সপ্তাহ আগে জ়াম্বোলায় প্রবেশ করার পর থেকে তার জেবের স্বাস্থ্য ক্রমাগত খারাপই হয়েছে শুধু।
আরাম ঘরের ভিতরে ব্রোঞ্জের লন্ঠনটা জ্বালল। কোনান দেখল, পিছনদিকে আরেকটা দরজা আছে। সেটাতেও খিল লাগানো।
“নিশ্চিন্তে সারারাত ঘুমোও সিমেরীয়।” ভিতরের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে, দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে আরাম বলল।
কোমর থেকে তলোয়ারটা খুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলে কোনান বলল, “তোমার গরাদ, খিল বেশ শক্তপোক্ত দেখছি। তবে আমি বরাবর তলোয়ার সঙ্গে নিয়ে ঘুমোতেই পছন্দ করি।”
আরাম কোনো জবাব দিল না। দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে চওড়া ফলার অস্ত্রটার দিকে চেয়ে থাকল খানিক, তারপর নিঃশব্দেই দরজাটা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। কোনানও ভিতর থেকে সেটায় খিল লাগাল। তারপর ঘর পার করে উলটোদিকের দরজা খুলে বাইরে তাকাল।
দেখা গেল, ঘরটা শহরের পশ্চিমতম প্রান্তে যে পথ মরুভূমির দিকে চলে গেছে, সেদিকেই অবস্থিত। সামনে একটা ছোটো উঠোন। কয়েকটা খেজুর আর তালজাতীয় গাছ দাঁড়িয়ে আছে। তবে এই উঠোনটা সরাইখানার বাকি অংশটা থেকে একটা পাঁচিল দিয়ে আলাদা করা। সে পাঁচিল অনেকটাই উঁচু। কিন্তু উঠোনের শেষ প্রান্তে যে পাঁচিলটা সরাইয়ের সীমানা নির্ধারণ করছে, সেটা বেশ নীচু। সেটার দরজাতেও কোনো তালা আছে বলে মনে হল না।
কোনান ঘরের দরজার মুখে খানিক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার পিছনে ঘরের মধ্যে ব্রোঞ্জের লন্ঠনটা সাধ্যমতো আলো ছড়াচ্ছিল। সেটার কুণ্ঠিত আলোয় দেখা যাচ্ছিল পামজাতীয় গাছের ঘন জঙ্গলে মিলিয়ে-যাওয়া বাঁকা পথটাকে। রাতের বাতাস পাতায় পাতায় ফিশফিশ করে কথা বলছিল। তাদের পার করলে দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমি, তারাভরা অনন্ত আকাশের নীচে চুপ করে পড়ে আছে। এর বিপরীতে, যে পথ শহরগামী, সেদিকে মুখ ফেরালে বহু দূরে মিটমিটে আলোর সারি দেখা যায়। শোনা যায় শহর থেকে ভেসে-আসা টুকরোটাকরা শব্দ। এদিকে শুধু তারার মৃদু আলোর সঙ্গে অন্ধকারের লুকোচুরি, পাতার মর্মর, ভূতের মতো দাঁড়িয়ে-থাকা চ্যাটালো ছাদওয়ালা পরিত্যক্ত বাড়ির সারি। সেগুলো পার করে কোথাও একটা চাপাস্বরে গুমগুম করে মাদল বেজে উঠল।
জুয়াগিরটির সাবধানবাণীর কথা মনে পড়ে গেল কোনানের। তখন সেই ভিড়ে ঠাসা রাস্তায় কথাগুলো যতটা অবাস্তব লাগছিল, এখন আর ততটা লাগছে না। আবার সে নির্জন বাড়িগুলোর দিকে চাইল। ভিখারিরা পর্যন্ত ওগুলোকে এড়িয়ে চলে কেন? সে পিছন ফিরে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।
ঘরের ভিতরের বাতিটা দপদপ করছিল। সেটার কাছে গিয়ে কোনান দেখল, বাতিটার পাম তেলের জ্বালানি শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। সে আরামকে বার দুয়েক চেঁচিয়ে ডাকল। তারপর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে একবার কাঁধ ঝাকিয়ে, বাতিটাকে ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে, টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল নরম বিছানায়। অন্ধকারে তার চোখ সয়ে আসছিল। মোটা গরাদ-দেওয়া জানলা দিয়ে সে তাকিয়ে ছিল আকাশের তারাদের দিকে। কয়েকটা পাম গাছ মাথা দোলাচ্ছিল। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার একটা হাত স্পর্শ করল তলোয়ারের হাতলে। তার কানে আসছিল পাতার মৃদু মর্মর, তার সঙ্গে মিশছিল দূর থেকে ভেসে-আসা মাদলের বোল। তার ঘুম পাচ্ছিল। চোখ বুজে আসছিল। মরুভূমির কোথাও একটা কালো হাতের ছন্দময় আঘাতে, চামড়ায় মোড়া অচেনা মাদল গুমগুমে সুরে কথা বলে চলেছিল, বলে চলেছিল…
নিশুতি রাতের গোপন হানাদার
প্রায় নিঃশব্দে একটা দরজা খোলার মৃদু আওয়াজ তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। ঘুম থেকে জেগে ওঠার মুহূর্তগুলোয় কোনানের মস্তিষ্ক আর পেশি, সাধারণ সভ্য মানুষের মতো শিথিল, আচ্ছন্ন ও অকর্মণ্য অবস্থায় থাকে না। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তার সজাগ স্নায়ু তাকে শব্দটার উৎসস্থল ও কারণ জানিয়ে দিল। অন্ধকারে স্তব্ধ হয়ে শুয়ে থেকে সে দেখল, বাইরের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলছে। পাল্লা দুটোর মাঝে একটা চিড় ক্রমশ প্রশস্ত হল। তারপর তারাভরা রাতের পটভূমিতে একটা বিরাট মিশকালো অবয়বকে দেখা গেল। শুয়ে শুয়ে কোনান একটা ঝুঁকে-পড়া চওড়া কাঁধের ওপর একটা বিশাল কদাকার মাথাকে দেখতে পাচ্ছিল।
টানটান উত্তেজনায় কোনানের পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠেছিল। সে তো ভিতর থেকে হুড়কো লাগিয়েছিল। দরজাটা খুলল কী করে? কোনো জাদুমন্ত্রে? আর তারার আলোয় যতটুকু দেখা যাচ্ছে, কোনো মানুষের অমন একটা বিশাল বিকৃত মাথা হয় কীভাবে? জুয়াগিরদের তাঁবুতে বসে যত প্রেত, পিশাচের গল্প সে শুনেছে, সব ক-টা তার মাথায় ভিড় করে আসতে লাগল। কোনান বুঝতে পারল, ঘামে তার শরীর ভিজে যাচ্ছে।
কিছুটা অগোছালো পদক্ষেপে আর গুঁড়ি মেরে দানবটা নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে এগিয়ে এলে কোনানের নাকে একটা পরিচিত গন্ধ প্রবেশ করল। তবে তাতে সে বিশেষ নিশ্চিন্ত হল না। জুয়াগিরদের প্রবাদের ভূত-পিশাচগুলোও এমন গন্ধ ছড়াতে ওস্তাদ।
কোনান ধীরে ধীরে পা দুটো গুটিয়ে নিল। তার ডান হাত শক্ত করে ধরে ছিল খোলা তলোয়ারটা। তারপর সে যখন হঠাৎ বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ করেছিল, তাতে এক প্রচণ্ড জিঘাংসার বিস্ফোরণ ঘটল। এমনকি এক দানবের পক্ষেও সেই আঘাত প্রতিহত করা অসম্ভব। কোনানের তলোয়ার হাড় ও মাংসকে ভেদ করে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা চাপা আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সে রক্ত-ঝরা অস্ত্র হাতে অন্ধকারে পড়ে-থাকা দেহটার ওপর ঝুঁকে পড়ে, পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিল। মানুষ হোক, পশু হোক, কিংবা দানব; ওটা মরে গেছে। যে-কোনো বন্যজন্তুর মতো সে-ও মৃত্যুকে নিশ্চিতভাবে অনুভব করতে পারে। সে আধখোলা দরজা দিয়ে বাইরের তারার আলোয় আবছায়া উঠোনটার দিকে তাকাল। সেখানে আর কেউ নেই।
কোনান দরজাটা বন্ধ করলেও হুড়কো আটকাল না। অন্ধকারে কিছুটা হাতড়ে সে লন্ঠনটা জ্বালাল। তাতে যা তেল আছে, সেটা আরও মিনিটখানেক জ্বলার কথা। সে আবার রক্তে ডোবা দেহটার কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল।
একটা বিশালদেহী কৃষ্ণাঙ্গ। তার শরীরে পোশাক বলতে কেবলমাত্র একটা ল্যাঙট। ডান হাতে তখনও একটা গিঁট-পাকানো মুগুর ধরা। মাথার চুলগুলো কাদা আর দড়ি দিয়ে অনেকগুলো শিঙের মতো খোঁচা খোঁচা করা। এর ফলেই তারার আলোয় মাথাটাকে অমন বিশাল, বীভৎস, অপার্থিব লাগছিল। কে এটা? ধাঁধার মতো প্রশ্নটার উত্তর মাথায় আসতেই, সে নিশ্চিত হওয়ার জন্য লোকটার পুরু ঠোঁট উলটিয়ে মুখের ভিতরটা দেখল। সেখানকার দাঁতগুলো উকো দিয়ে ঘষে ছুঁচালো করা।
এবারে কোনান বুঝতে পারল, কেন আরাম বক্সের সরাই থেকে অতিথিরা উধাও হয়ে যায়, কেন মরুভূমির প্রান্তে পাম ও খেজুর গাছের জঙ্গলে রাতে মাদল বেজে ওঠে। সে মানসচক্ষে যেন দেখতে পেল, আগুনের কুণ্ডের চারপাশে পোড়া নরমাংস খাওয়ার লোভে অনেকগুলো কালো কালো ছায়া রাক্ষুসে খিদে নিয়ে উবু হয়ে বসে আছে। মেঝেতে পড়ে-থাকা লোকটা আসলে ডারফার থেকে আসা একজন নরখাদক।
এর জাতের মানুষ জ়াম্বোলায় অনেক আছে। এখানের আইন অনুযায়ী নরমাংসভক্ষণ নিষিদ্ধ। কিন্তু এটা এখন পরিষ্কার, কেন শহরবাসীরা দরজার খিল শক্ত করে বন্ধ করে রাখে আর কেন গরিব ভিখারিরা পর্যন্ত একা একা খোলা জায়গায় বা দরজাহীন খণ্ডহরে রাত কাটায় না। সে নিশ্চিত, রাতের আঁধারে এই শহরে ছায়ার মতো নরখাদকেরা শিকারে বের হয়, আর আরাম বক্সের মতো বদমাশরা তাদের সাহায্য করার জন্য দরজা খুলে দেয়। রাগে তার সারা শরীর রি রি করে উঠল। সরাইখানার মালিকটা নিজে নরখাদক না হতে পারে, কিন্তু সে তার চেয়েও খারাপ। ডারফার থেকে আসা এই লোকগুলো পাকা চোর। এ বিষয়ে এখন আর কোনো সন্দেহই নেই যে তাদের লুটের একটা বড়ো অংশ আরাম বক্সের হাতে পৌঁছোয়। তার বিনিময়ে সে মানুষের মাংসের জোগান দেয়।
কোনান আলো নিবিয়ে দরজা খুলল। সে বাইরে বেরিয়ে পাল্লা দুটোর কারুকার্য-করা অংশগুলোতে হাত বোলাতে শুরু করল। একটু পরেই তার স্পর্শে একটা অলংকরণ সরে গেল। সেখান দিয়ে হাত ঢোকালে, ভিতর থেকে আটকানো হুড়কোটা সহজেই খুলে ফেলা যায়। ঘরটা খরগোশের ধরার মতো একটা মানুষ ধরার ফাঁদ। তবে এবারে খরগোশের বদলে একটা ভয়ংকর বাঘ বেচারাদের ফাঁদে পড়েছিল।
কোনান ঘরের অপর প্রান্তের দরজাটার কাছে গেল। ভিতর থেকে টান দিয়ে সেটাকে খোলা যাচ্ছিল না। আরাম উলটোদিক থেকে দরজার হুড়কো আটকে দিয়েছে। শয়তানটা তার ফাঁদে পড়া শিকার বা দুষ্কর্মের সহযোগী, কাউকেই বিশ্বাস করে না। কোনান তরবারি খাপে রেখে কোমরবন্ধটাকে পরল। তারপর বাইরের প্রাঙ্গণে বেরিয়ে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করল। আরাম বক্সের সঙ্গে বোঝাপড়াটা সে অনাবশ্যক দেরি না করে সেরে ফেলতে চাইছিল। কত হতভাগ্য ব্যক্তি যে ঘুমন্ত অবস্থায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়েছে, আর তারপর জঙ্গলের মধ্যে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে কিছু নররাক্ষসের খাদ্যে পরিণত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
ছোটো বাগানটায় নেমে একবার চারদিকে তাকাল সে। দূরের মাদল তখনও গুমগুম শব্দে বেজে চলেছে। বহু দূরের ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে লাল আগুনের আভা দেখা গেল যেন। ডারফারের এইসব কৃষ্ণাঙ্গের কাছে নরমাংসভক্ষণ কেবলমাত্র পেট ভরানোর একটা পদ্ধতি নয়। এটা তাদের পৈশাচিক রীতি ও ধর্মাচরণের একটা অঙ্গ। কালো শকুনগুলো সব আগুনের চারপাশে ঘিরে বসেছে। কিন্তু আর যা-ই হোক, আজ রাতে ওরা তার মাংস খেতে পারবে না।
আরাম বক্সের কাছে পৌঁছোতে গেলে এই ছোটো প্রাঙ্গণ আর বাড়ির মূল অংশের মধ্যে যে উঁচু প্রাচীর আছে, সেটাকে পার করতে হবে। মানুষখেকোগুলো যাতে ঢুকতে না পারে, তার জন্য প্রাচীরটা যথেষ্ট উঁচু করে বানানো হয়েছে। কিন্তু কোনান এই কালো পিশাচদের মতো কোনো গহিন অরণ্যের জলাভূমিতে বেড়ে ওঠেনি। সিমেরিয়ার আকাশস্পর্শী পর্বতমালার কোলে বেড়ে ওঠার ফলে তার পেশিগুলো সব ইস্পাতে পরিণত হয়েছে। এইসব প্রাচীরের ক্ষমতা নেই তাকে আটকে রাখার। সে পাঁচিলটায় চড়তে যাবে, এমন সময় আর্তনাদটা তার কানে ঢুকল।
মুহূর্তে কোনান ছোটো দরজাটার কাছে পৌঁছে, জ্বলন্ত চোখে রাস্তার দিকে চাইল। শব্দটা পরিত্যক্ত কুঁড়েগুলোর দিক থেকে এসেছে। আরেকবার শোনা গেল সেটা। একটা শক্তিশালী কালো হাতের থাবা যদি কারও মুখ থেকে বের-হওয়া মরিয়া আর্তনাদ আটকাতে চায়, তবে যেরকম চাপা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরিয়ে আসে, তেমনটাই শোনা গেল আবার। থমকে দাঁড়াল কোনান। একজন বন্য মানুষের কর্তব্যবোধ, তার প্রতিশোধস্পৃহাকে সরিয়ে, তাকে আক্রান্তের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিল। তখনই সে দেখতে পেল, কয়েকটা ছায়ামূর্তি কুঁড়েগুলোর পিছন থেকে বেরিয়ে একটা মানবদেহকে মরুভূমির দিকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কোনানের চোখ তারার আলোতেও দেখতে অভ্যস্ত। একটু খেয়াল করতেই সে দেখল, তিনটে দৈত্যাকার কালো মানুষের কাঁধে একটা কোমল, শ্বেত নারীদেহ ছটফট করছে। হঠাৎই এক প্রচণ্ড মোচড়ে মেয়েটা তাদের কাঁধ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ল, আর প্রাণ বাঁচানোর চরম প্রচেষ্টায় পিশাচগুলোর হাত ফসকে ছুটে এল মূল রাস্তা ধরে সরাইটার দিকে। কিন্তু দানবগুলো দ্রুততর। কিছু দূর এগোতে-না এগোতেই তারা মেয়েটাকে আবার ধরে ফেলল। এক সব হারানোর হাহাকার বেরিয়ে এল হতভাগিনির গলা দিয়ে।
ক্রোধে অন্ধ হয়ে কোনান রাস্তার আলোছায়াময় অংশটার দিকে দৌড়োতে শুরু করল। ততক্ষণে পিশাচগুলো মেয়েটাকে টেনে আবার কুটিরের পিছনে, অন্ধকার অংশে নিয়ে গেছে।
তার পদশব্দ খেয়াল না-করায় শিকার বা শিকারি কেউই প্রথমে তার উপস্থিতি টের পায়নি। তারা কিছু বোঝার আগেই কোনান পার্বত্য ঝঞ্ঝার মতো তাদের ওপর আছড়ে পড়ল। শেষ মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে দুটো দৈত্য তাদের বিরাট মুগুরগুলো চালানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কোনানের তলোয়ারের প্রবল আঘাত একটা পিশাচের বুক ছিন্নভিন্ন করে দিল। দ্বিতীয়টার মুগুর কোনানের মাথা লক্ষ করে নেমে আসছিল। কিন্তু মাটিতে গড়িয়ে একটা পাক খেয়ে সে শিকারি বিড়ালের মতো লাফিয়ে উঠে পালটা তলোয়ার ঘোরাল। বাতাসে একটা শিসের মতো আওয়াজ হল। আক্রমণকারীর মাথাটা উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে গোলকের মতো গড়াতে লাগল। কাটা গলা থেকে ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্তের ফোয়ারা। কবন্ধ দেহটা ওই অবস্থাতেই হাত তুলে দু-তিন পা এগিয়ে এল, তারপর দড়াম করে আছড়ে পড়ল মাটিতে।
এই কাণ্ড দেখে তৃতীয়টা আতঙ্কে চিৎকার করে, তার শিকারকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে, পিছন ফিরে শহরের দিকে দৌড় দিল। ভয় তাকে প্রাণপণে ছোটাচ্ছিল। কিন্তু পুবতম কুটিরটার পিছনে পৌঁছোতে-না পৌঁছোতে সে টের পেল মৃত্যুকে এড়ানো অসম্ভব। বধ্যভূমির ষাঁড়ের মতো সে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে কোনানকে আক্রমণ করল।
সিংহের মতো এক গর্জন বেরোল কোনানের গলা থেকে। “কালো কুত্তা, নরকে যা।” বলে চিৎকার করে সে এত জোরে তলোয়ার চালাল যে, তার অস্ত্র লোকটার কাঁধের ওপর থেকে খাড়াখাড়ি নেমে এসে বুক অবধি গিয়ে থামল। এক আঘাতেই মরণ আর্তনাদ করে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। কোনান দেহটার দিকে ঘৃণাভরা চোখে তাকিয়ে তার বুকে পা দিয়ে এক হ্যাঁচকায় তলোয়ারটা টেনে বের করল।
হঠাৎ করেই চেপে ধরল নিস্তব্ধতা। গাছের পাতায় হাওয়ার সড়সড় শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। কোনান মাথা দোলাল। যেন এক রক্তস্নাত শিকার শেষে কেশর ঝাঁকাল পশুরাজ। অন্ধকার থেকে আর কোনো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল না। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে দেখা-যাওয়া দূরের স্বল্পালোকিত রাস্তাও জনহীন। এমন সময় তার পিছনে বালির উপর দিয়ে লঘুপদে কারও ছোটার শব্দ শোনা গেল। চকিতে ফিরে দাঁড়াল কোনান। মেয়েটি ছুটে এসে তার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আবেগে কোনানের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু-হাতে জড়িয়ে ধরল তার গলা।
“ঠিক আছে, সব ঠিক আছে।” কোনান তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “তোমাকে ওরা ধরল কী করে?”
এতক্ষণে সে মেয়েটির দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল। তারার আলোয় তাকে দেখে, সে আরাম বক্সের কথা ভুলেই গেল একেবারে। মেয়েটির বিস্রস্ত ভূষণ বেশির ভাগ জায়গাতেই ছিঁড়ে গিয়েছে। ফলে তার শ্বেতশুভ্র, যৌবননন্দিত দেহের অধিকাংশই উন্মুক্ত। তার মাথাভরা ঘন লালচে চুল ঝরনার মতো নেমে এসেছে। নিঃসন্দেহে সুন্দরীটি এখানকার বর্ণসংকর বংশসম্ভূতা। সে দীর্ঘাঙ্গী, তন্বী অথচ কোমল। তার পীবর বক্ষ এবং মসৃণ অঙ্গ কোনানের মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করল। পরিশ্রমের ফলে হাঁপাতে হাঁপাতে সে তখনও ভয়ে কেঁপে চলেছে। কোনান তার সবল বাহু দিয়ে মেয়েটির সরু কোমর বেষ্টন করে বলল, “ভয় পেয়ো না। কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।”
তার স্পর্শ মেয়েটিকে কিছুটা শান্ত করল। সে মাথা ঝাঁকিয়ে, মুখের উপর পড়া চুল সরিয়ে, পিছনের দিকে তাকাল। সেই সঙ্গে আরও ঘনিয়ে এসে যেন কোনানের বুকে আশ্রয় নিতে চাইল।
“ওরা আমায় রাস্তায় ধরেছিল।” বিড়বিড় করে সে বলল। তখনও অল্প অল্প কাঁপছিল সে। “আমি একটা খিলানের পিছনে অন্ধকারে শুয়ে ছিলাম। গোরিলার মতো কয়েকটা কালো লোক আমায় ধরল। সেট আমায় বাঁচিয়েছেন। সারাজীবন এর দুঃস্বপ্ন দেখব আমি।”
“কিন্তু তুমি রাত্রিবেলা রাস্তায় কী করছিলে?” কোনানের আঙুলগুলো যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মেয়েটির মসৃণ ত্বকের উপর চলতে শুরু করেছিল। মেয়েটি মুখ তুলে তার চোখের দিকে তাকাল। কিন্তু কোনানের আদর সে বুঝতে পেরেছে বলে বোধ হল না।
“আমার প্রেমিক,” সে বলল, “আমার প্রেমিক তাড়া করে আমায় রাস্তায় বের করেছে। ও পাগল হয়ে গিয়ে আমায় খুন করতে এসেছিল। আমি পালাই। বাড়ি ফিরতে ভয় লাগছিল। ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। তখনই দৈত্যগুলো আমায় ধরে।”
“তোমার মতো রূপসির জন্য যে-কোনো মানুষই পাগল হয়ে যাবে।” কোনান তার চুলে আঙুল ডুবিয়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল।
মেয়েটি মাথা ঝাঁকাল। তার ভয় অনেকটাই কেটে গিয়েছিল। যেন অর্ধ অচেতন অবস্থা থেকে জেগে উঠেছিল সে।
“না না, তোত্রাস্মেক নামের একটা পাজি পুরুতের জন্য ও পাগল হয়ে গেছে। লোকটা হুম্মানদেবের প্রধান পুরোহিত। ও আমাকে চায়। বুড়ো কুত্তা কোথাকার।”
“ওকে অমনভাবে গালি দিয়ো না।” কোনান লঘুকণ্ঠে বলল, “বুড়োর রুচির প্রশংসা করতে হয়।”
মেয়েটি এই স্তুতিটাকে সযত্নে এড়িয়ে গেল। নিজের অসংবৃত বেশবাস যতটা সম্ভব ঠিক করতে করতে বলল, “আমার প্রেমিক একজন তুরানি সৈনিক। আমাকে পাবার জন্য তোত্রাস্মেক চালাকি করে ওকে পাগল হওয়ার ওষুধ খাইয়ে দেয়। আমারই দোষ। ওটা কীসের শব্দ?” আবার ভয়ে তার গলা কেঁপে গেল।
কোনানও শুনেছিল মৃদু আওয়াজটা। বিড়ালের মতো শব্দহীন পদক্ষেপে সে মেয়েটিকে নিয়ে এল একটা কুটিরের পাশে পাম গাছের অন্ধকার ছায়ায়। নিজের পিছনে তাকে থাকার ইঙ্গিত করে সে সতর্ক হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দূর থেকে ভেসে-আসা চাপা গলার কথোপকথন ক্রমশ স্পষ্টতর হতে লাগল। নয়-দশজন কৃষ্ণাঙ্গের একটা দল রাস্তা দিয়ে শহরের দিক থেকে আসছিল। মেয়েটির আঙুল কোনানের হাতে চেপে বসেছিল। কোনানের দেহের সঙ্গে নিজেকে যতটা সম্ভব মিশিয়ে সাহস আনার চেষ্টা করছিল সে। তবু তার কোমল শরীর থরথর করে কাঁপছিল।
এবারে নিগ্রোগুলোর কথা পরিষ্কার শোনা গেল।
“আমাদের ভাইয়েরা এর মধ্যে নিশ্চয়ই গর্তের আগুনের কাছে পৌঁছে গেছে। আমাদের কপালে তো কিছুই জুটল না। আশা করি, ওরা কোনো ব্যবস্থা করতে পেরেছে।” একজন বলল।
“আরাম কথা দিয়েছিল, আমাদের জন্যে একটা মানুষের ব্যবস্থা করবে।” আরেকজন বলল। সেটা শুনে কোনানও ঠিক করে নিল, আরামের জন্য কী ব্যবস্থা করা যায়।
“আরাম কথা দিলে কথা রাখে।” আরেকটা ঘোঁতঘোঁতে গলা শোনা গেল: “আমরা ওর সরাই থেকে অনেক মানুষ পেয়েছি। তবে তার জন্য ওকে ভালো দামও তো দেওয়া হয়। আমি নিজেই একবার মালিকের থেকে চুরি করে ওকে দশ বেল রেশমের কাপড় দিয়েছি। সেটের দিব্যি, ওগুলো দারুণ ছিল।”
লোকগুলো খালি পায়ে ধুলো উড়িয়ে বকবক করতে করতে মরুভূমির দিকে চলে গেল।
তাদের গলার স্বর মিলিয়ে গেলে কোনান বলল, “আমাদের ভাগ্য ভালো, সব ক-টা মৃতদেহ বাড়িগুলোর পিছনে পড়ে আছে। ওরা পরে আরামের সরাইখানাতেও আরেকটা খুঁজে পাবে।” তারপর বিড়বিড় করে বলল, “চলো, যাওয়া যাক।”
“হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি চলো।” মেয়েটা আতঙ্কিত হয়ে বলল, “আমার প্রেমিক শহরের রাস্তায় পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিগ্রোগুলো ওকেও ধরতে পারে।”
“কী সব নারকীয় কাণ্ড চলে এখানে।” কোনান বিরক্তির সুরে বলল। তারা রাস্তার সমান্তরালে গাছপালার আড়াল দিয়ে শহরের দিকে চলতে শুরু করেছিল। “শহরের লোকেরা এই কালো কুত্তাগুলোকে সাবাড় করে না কেন?”
“ওদের মধ্যে থেকে খুব ভালো ক্রীতদাস, চাকবাকর পাওয়া যায়।” মেয়েটি নীচুস্বরে বলল, “আর সংখ্যায় ওরা এখন এত বেড়ে গেছে যে, ওদের ঘাঁটালে ওরা বিদ্রোহ করতে পারে। জ়াম্বোলার লোকজন জানে যে, ওরা রাত্রিবেলা মানুষ শিকারে বের হয়। তাই সবাই ঘরের ভেতর দরজা বন্ধ করে বা দল বেঁধে থাকে। আমার মতো খুব বিপদে না পড়লে কেউ রাতে একা বের হয় না। ওরা খুব একটা বাছবিচার করে না, তবু দেখেছি, সাধারণত শহরের লোকেদের চেয়ে বিদেশিদের ওপরেই ওদের নজর বেশি। তার অন্যতম প্রধান কারণ, বিদেশিদের নিয়ে স্থানীয়দের কোনো মাথাব্যথা নেই। এই সুযোগে আরামের মতো লোকেরা বিদেশিদের বেচে কিছুটা টাকাপয়সা কামিয়ে নেয়।”
কিছুক্ষণ পরে পথটা একটা চওড়া রাস্তায় মিশল। কোনান তার সঙ্গিনীকে নিয়ে ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এল। চোরের মতো লুকিয়ে চলতে তার ভালো লাগছিল না। রাস্তাটা চওড়া বটে, তবে তার দু-পাশের বাড়িগুলো মন-খারাপের মতো অন্ধকারে ঢাকা।
“এবার কোথায় যাব?” সে জিজ্ঞেস করল। সে মেয়েটির কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। তাতে তার বিশেষ আপত্তি দেখা গেল না।
“আমার বাড়িতে। চাকরবাকরদের জাগাতে হবে।” সে বলল, “আমার প্রেমিককে খুঁজে বের করতে হবে। আমি চাই না, কেউ ওর পাগলামি সম্পর্কে জানুক। পুরুতটাও না। ও একজন তরুণ সৈনিক। ওর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এই পাগলামিটার খবর জানাজানি হলে ওর ক্ষতি হয়ে যাবে। ওকে খুঁজে পেলে হয়তো আমরা ওকে সারিয়ে তুলতে পারব।”
“যদি খুঁজে পাও, তবে। এইসব ঝামেলায় তুমি কিন্তু আমায় জড়ানোর চেষ্টা করবে না।” কোনান বলল।
কোনানের কথা শুনে মেয়েটি তার দিকে এক গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। এ সেই দৃষ্টিপাত, যার জোরে সুন্দরী রমণীরা পুরুষদের অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও বশীভূত করতে পারে।
“আমার কথা শোনো লক্ষীটি।” সে চোখে প্রায় জল এনে কাতরকণ্ঠে বলল, “তুমি ছাড়া আমি আর কাউকে ভরসা করতে পারব না। এতটা দয়া যখন করেছ…”
“ঠিক আছে।” কোনান গরগর করল, “ঠিক আছে। তা তোমার সেই প্রেমিকটির নাম কী?”
“আলাফডাল। আমি জাবিবি। আমি একজন নর্তকী। আমি জ়াম্বোলার সত্রাপ জাহাঙ্গির খানের সামনে নাচি। তাঁর রক্ষিতা নেফারতারির সামনেও। শহরের সব বিখ্যাত, ধনী লোকেরা আমার নাচ দেখতে পছন্দ করে। আমায় দেখে তোত্রাস্মেকের জিব লকলক করে উঠেছিল। কিন্তু ও জানত, আলাফডালকে না সরালে আমায় পাবে না। তাই ও আমাকে বোকা বানিয়ে, ওর ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। আমি তোত্রাস্মেকের মনের খবর জানতাম না। ও আমাকে একটা তরল মিশ্রণ দেয়। বলে ওটা খাওয়ালে নাকি আলাফডাল আরও বলশালী হবে। আমায় পাগলের মতো ভালোবাসবে। আমার সব ইচ্ছা পূরণ করবে। কী বোকা আমি। ওর কথায় ভুলে আমি আজ রাতে, ওকে পানীয়ের সঙ্গে সেটা খাইয়ে দিই। আমাকে ভালোবাসার বদলে ও আমায় খুন করতে উদ্যত হয়। তলোয়ার হাতে আমায় তাড়া করে। শয়তান তোত্রাস্মেক। ওর সর্বনাশ হোক। আরে!”
তারা হাঁটতে হাঁটতে একটা বাজারের অঙ্গনে এসে পৌঁছেছিল। নিশুতি রাত। চারদিকে সব শুনশান। প্রতিটি দোকান বন্ধ। কেবল অঙ্গনের চারটে টিমটিমে আলো প্রেতের চোখের মতো জ্বলছিল। তাতেই দেখা গেল, সেখানে উন্মুক্ত একটা গলির মুখে একজন যুবক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথা অদ্ভুতভাবে সামনে ঝুঁকে পড়েছে। কোনান তার চোখ দুটো দেখতে পেল। সেই নিষ্পলক চোখে এক প্রাণহীন, গা-ছমছমে দৃষ্টি। আলাফডাল। কোনানের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। আলাফডালের হাতে ধরা তলোয়ারটার জন্য নয়, গোটা নিস্তব্ধ দৃশ্যটার ভয়ংকর অপার্থিবতার জন্য। তার দাঁড়িয়ে থাকার অমানুষিক ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যুবকটি উন্মাদ হয়ে গেছে। কোনান হাতের আলতো ধাক্কায় জাবিবিকে পাশে সরিয়ে খাপ থেকে তলোয়ার বের করল।
“ওকে মেরো না।” জাবিবি ফুঁপিয়ে উঠল, “সেটের দিব্যি, মেরো না ওকে। তুমি ওর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। গায়ের জোরে ওকে বন্দি করো।”
“দেখা যাক।” বলে কোনান ডান হাতে তলোয়ার ধরে ও বাম হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এগিয়ে গেল। কয়েক পা এগোতেই যুবকটি তাকে খেয়াল করল। এক ভয়ানক গোঙানিমিশ্রিত পাগলাটে হাসি হাসতে হাসতে সে তলোয়ার উঁচিয়ে ছুটে এল কোনানের দিকে। সিমেরীয়টি অপেক্ষা করল। তুরানিটি তার সর্বশক্তি দিয়ে তলোয়ারটা তার মাথা লক্ষ করে চালাল। এত জোর ছিল তাতে যে, যখন কোনান তরবারি দিয়ে সেই আঘাত প্রতিহত করল, আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়ল চারদিকে। সঙ্গে সঙ্গে সে তার হাতুড়ির মতো বাঁ হাতের মুঠো দিয়ে যুবকটির চিবুকে সজোরে ঘুসি মারল। এক ঘুসিতেই সে ছিটকে পড়ল মাটিতে এবং জ্ঞান হারাল। তার নাক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল রক্তের ধারা।
জাবিবি ছুটে এল। উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, “ও কি… ও কি মরে…”
কোনান আলাফডালকে চিত করে শুইয়ে দিল। নাকের কাছে হাত রেখে বলল, “খুব একটা আহত হয়নি। নাক দিয়ে অল্প রক্ত বেরিয়েছে। চিবুকে ঘুসি খেলে সবারই অমন হয়। হয়তো জ্ঞান ফেরার পর এমনিতেই পাগলামিটা সেরে যাবে। আপাতত ওর কোমরবন্ধ দিয়ে হাত দুটো বেঁধে রাখি। এবারে বলো, ওকে নিয়ে কোথায় যেতে হবে?”
জাবিবি জ্ঞানহীন যুবকটির পাশে চুপ করে বসে ছিল। একবার তার কপালে হাত বুলোল। তারপর যেন হতাশ হয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়াল। কোনানের কাছে এগিয়ে এল সে। কোনানের বুকে হাত রেখে তার চোখে চোখ রাখল। সেই কালো চোখ ভিজে মানিকের মতো জ্বলছিল।
“একমাত্র তুমিই পারবে তোত্রাস্মেককে মারতে। সাহায্য করো আমায়। ওকে হত্যা করো।” সে বলল।
“হ্যাঁ, তারপর তুরানিরা আমায় ফাঁসিতে ঝোলাক।” কোনান বিরক্ত হয়ে জবাব দিল।
“না।” জাবিবির দুই মৃণাল বাহু কোনানের গলা জড়িয়ে ধরেছিল। তার সর্বাঙ্গের স্পর্শ পাচ্ছিল কোনান। “হাইরকানিয়রা তোত্রাস্মেককে ঘেন্না করে। সেটের উপাসকেরা ভয় করে ওকে। আমি সেটকে দেবতা বলে মানি। তুরানিরা এলরিককে। কিন্তু ওর জাতের কোনো ঠিক নেই। পিশাচদেবতা হুম্মানকে পুজো করে ও। ভয়, জাদুবিদ্যা আর কুসংস্কার ওর হাতিয়ার। তুরানিরা কালো জাদুকে ভয় করে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ওকে সহ্য করতে পারে না। কেউ যদি রাতের আঁধারে ওর মন্দিরে ঢুকে ওকে খুন করে যায়, ওরা তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না।”
“ওকে মারতে গেলে প্রাণ হাতে করে ওর জাদুর মুখোমুখি হতে হবে।” কোনান বলল।
“তুমি সৈনিক। মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া তোমার কাজের মধ্যেই পড়ে।”
“হ্যাঁ, কিন্তু সেই কাজের জন্য আমি পারিশ্রমিক পাই।”
“যোগ্য পারিশ্রমিক পাবে তুমি।” গভীর শ্বাস নিয়ে, আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে কোনানের চোখে চোখ রেখে বলল। তার অঙ্গের স্পর্শ কোনানের শিরায় শিরায় আগুনের স্রোত প্রবাহিত করছিল। তার সুগন্ধ তার মস্তিষ্ককে বিবশ করে দিল। কিন্তু যেই কোনান তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল, জাবিবি তার বাহুবন্ধন থেকে পিছলে বেরিয়ে গিয়ে বলল, “দাঁড়াও, আগে কাজ।”
“বলো, কী করতে হবে।”
“ওকে তোলো।”
কোনান আলাফডালকে তুলে কাঁধে ফেলল। তার মনে হল, আলাফডাল তো কিছুই না, তাকে যদি বলা হত সত্রাপের অট্টালিকাখানা কাঁধে তুলে নিতে, তাও সে পারত। মেয়েটি কোমল চোখে, বিড়বিড় করতে করতে যুবকটির গায়ে, মাথায় হাত বোলাচ্ছিল। এর মধ্যে কোনো ভণ্ডামি ছিল না। সে ওকে সত্যিই ভালোবাসে। জাগতিক দেওয়া-নেওয়ার যে চুক্তিই সে কোনানের সঙ্গে করুক-না কেন, এর কোনো প্রভাব, তার আর আলাফডালের ভালোবাসার সম্পর্কে সে পড়তে দেবে না। এ ব্যাপারে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তববাদী।
“আমার পিছনে পিছনে এসো।” জাবিবি বলল। কোনান অনায়াসে অজ্ঞান যুবকটিকে বহন করে তাকে অনুসরণ করল। যে-কোনো অন্ধকার গলি বা তোরণের দিকে সতর্ক দৃষ্টি ছিল তার। কিন্তু সেগুলোতে কাউকেই দেখা গেল না। ডারফারের সব ক-টা পিশাচ নিশ্চয়ই আগুনের গর্তের চারপাশে গিয়ে জুটেছে। মেয়েটি একটা সরু গলিতে ঢুকল। একটা ধনুকাকৃতি দ্বারের সামনে গিয়ে সাবধানে টোকা দিল সে।
আরাম বক্সের সরাইয়ের মতোই দরজার পাল্লায় একটা ছোট্ট জানলা খুলে গেল। কোনান বুঝল, রাতে এখানে কোনো অনাহূত অতিথির জন্য দরজা খোলা হয় না। সেখানে একটা কালো মুখের উদয় হল। জাবিবি ফিশফিশ করে কিছু একটা বলল। ঘটাং ঘটাং করে খিল খোলার শব্দ শোনা গেল। দরজা খুলে দৈত্যাকার কালো মানুষটা বেরিয়ে এল। তার হাতে ধরা লন্ঠনের কাঁপা-কাঁপা আলোয় মিশকালো মুখটা ভয়ংকর লাগছিল। কোনান দেখল কৃষ্ণাঙ্গটি ডারফারের নয়। তার দাঁত উকো দিয়ে ঘষে ছুঁচোলো করা হয়নি, কোঁকড়ানো চুল খুব ছোটো ছোটো করে কাটা। এ ওয়াডাই থেকে এসেছে। ত্বকের রং যে মানুষের চরিত্র নির্ধারণ করে না, সেটা কোনান তার অভিজ্ঞতা থেকেই জানত। এখানেও তা পালিত হচ্ছে দেখে নিশ্চিন্ত হল সে।
জাবিবির নির্দেশে কোনান অচেতন আলাফডালকে লোকটির হাতে তুলে দিল। তাকে একটা নরম শয্যায় শুইয়ে দেওয়া হল। তখনও তার মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। যে ঘুসিটা সে খেয়েছে, তাতে একটা ষাঁড়েরও কাত হয়ে যাওয়ার কথা। জাবিবি ঝুঁকে পড়ে তাকে দেখছিল। বিচলিত হয়ে সে তার দু-হাতের আঙুলগুলো প্যাঁচাচ্ছিল। তারপর সে মন শক্ত করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কোনানের দিকে তাকাল।
সদর দরজাটা আবার মৃদু শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। জাবিবি কোনানের হাত ধরল। মেয়েটির হাত সামান্য কাঁপছে।
“তুমি আমায় বিপদে ফেলে পালাবে না তো?”
কোনান নিঃশব্দে হাসল। নড়ে উঠল তার সিংহের কেশরের মতো চুল।
“তাহলে চলো। আমরা হুম্মানের মন্দিরে যাব। ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন।”
শব্দহীন ছায়াময় পথ ধরে তারা প্রেতের মতো নিঃশব্দে হেঁটে চলেছিল। কোনো কথা ছিল না তাদের মুখে। মেয়েটি সম্ভবত শেজবাতির ম্লান আলোতে আলোকিত বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে-থাকা তার প্রেমিকের কথা ভাবছিল। কিংবা হয়তো হুম্মানের অভিশপ্ত দেউলে কোনো ভয়ানক ভবিষ্যৎ তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে, তা-ই ভেবে শঙ্কিত হচ্ছিল। কিন্তু কোনানের মন আবিষ্ট হয়ে ছিল মেয়েটির কুন্তল থেকে ছড়িয়ে-পড়া সুবাসে। তার প্রায় অলৌকিক, কোমল দেহবল্লরির উপস্থিতি তাকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, অন্য কোনো চিন্তা তার মাথাতে আসছিল না।
হঠাৎই তারা পিতল আর ইস্পাতের বর্মের ঠংঠং শব্দ শুনতে পেল। তৎক্ষণাৎ তারা আশ্রয় নিল একটা অট্টালিকার ছায়া-ঢাকা খিলানের আড়ালে। নৈশপ্রহরীদের একটা দল। তারা সারিবদ্ধভাবে সাবধানে হেঁটে চলেছিল। তাদের বর্শা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমায় রাখা। সব শেষে যে তিনজন ছিল, তাদের পিঠ বিরাট ব্রোঞ্জের ঢাল দিয়ে আড়াল করা। অকস্মাৎ আক্রমণের ভয় তাদের এত সাবধানি করে তুলেছে। নৈশচারী কৃষ্ণাঙ্গ নরখাদকদের অতর্কিত আক্রমণ থেকে সশস্ত্রেরাও সুরক্ষিত নয়। তাদের পদশব্দ মিলিয়ে যেতেই কোনান ও তার সঙ্গিনী অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এসে দ্রুত পা চালাল। খানিক পরেই তারা একটা উঁচু, চৌকো, চ্যাটালো ছাদবিশিষ্ট স্থাপত্যের সামনে এসে দাঁড়াল।
একটা প্রশস্ত চৌকো প্রাঙ্গণের মাঝে, তারাভরা নিস্তব্ধ আকাশের নীচে হুম্মানদেবের মন্দির যেন অজানা শঙ্কার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেউলটা শ্বেতপাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সেটার অগ্রভাগে একটা উঁচু চত্বরের মতো অংশের সামনেই উন্মুক্ত প্রধান প্রবেশপথ। তাতে কোনো দরজা বা বাধা নেই।
“কালো পিশাচগুলো মন্দিরে ঢুকে শিকার করে না কেন?” কোনান চাপাস্বরে বলল, “ওদের বাধা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থাই তো এখানে নেই দেখছি।”
জাবিবি তার কাছে ঘনিয়ে এল। কোনান তার শরীরের কাঁপুনি টের পেল।
“ওরা তোত্রাস্মেককে ভয় পায়। সবাই পায়। জাহাঙ্গির খান আর নেফারতারিও। চলো, তাড়াতাড়ি চলো। মুঠোয় ধরা জলের মতো আমার সাহস হারিয়ে যাওয়ার আগেই মন্দিরে ঢুকি।”
মেয়েটা বাস্তবিকই ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু শেষমেশ সেসব সংশয় ঝেড়ে ফেলতে পেরেছিল। মুক্ত তরবারি হাতে কোনান তার সামনে হাঁটছিল। উন্মুক্ত প্রধান দ্বার দিয়ে তারা প্রবেশ করল। কোনানের পুবের রহস্যময় পুরোহিতদের কাণ্ডকারখানা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা ছিল। সে জানত, এই হুম্মানদেবের মন্দিরে হয়তো তাকে ভয়ংকরতম দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হতে হবে। সে এ-ও জানত এই মন্দির থেকে মেয়েটি, সে, কিংবা দুজনেই; বেঁচে না-ও ফিরতে পারে। কিন্তু সারাজীবনে সে এত ঝুঁকি নিয়েছে যে, প্রাণের ভয় তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারল না।
প্রথমে তাদের সামনে পড়ল শ্বেতপাথরে মোড়া একটা উঠোন। তারার আলোতেই সেটা সাদা আভা ছড়াচ্ছিল। সেটা পার করলেই উঁচু চত্বরটা পড়ে। অনেকগুলো সাদা স্তম্ভ সেটার ছাতটাকে ধরে রেখেছে। চত্বরটায় উঠতে গেলে একটা প্রশস্ত শ্বেতপাথরের সিঁড়ি পার করতে হয়। তারা সেখানে উঠে এল। এখন তাদের সামনে যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে-থাকা হুম্মানদেবের গর্ভগৃহের তাম্রনির্মিত বিশাল দরজা। তবে সে দরজার পাল্লা হাট করে খোলা। ভিতরে কোনো ভক্তই ধূপ জ্বেলে যায়নি। দিনের বেলা কিছু কিছু ভক্ত এসে দেবতার কালো বেদিমূলে নম্রভাবে পূজার উপাচার অর্পণ করে গেলেও, রাতের বেলা সবাই, খরগোশ যেমন সাপের গর্তকে এড়িয়ে চলে, তেমনই এড়িয়ে চলে এই মন্দিরকে।
গর্ভগৃহের ভিতরে কয়েকটা টিমটিমে প্রদীপ পরিবেশটাকে আলোছায়াময়, অপ্রাকৃত করে তুলেছিল।
কালো পূজাবেদির পিছনে আরেকটি উঁচু আসনে বসে আছেন হুম্মানদেব, যুগ যুগ ধরে অপলকে প্রধান দ্বারের দিকে তাকিয়ে। সেই দরজা দিয়ে না জানি কতশত বৎসর ধরে, বিশেষ উপলক্ষ্যে বলি দেওয়ার জন্য, হতভাগ্য মানুষদের লাল শিকলে বেঁধে, টেনেহিঁচড়ে আনা হয়েছে। তার ফলে পাথর ক্ষয়ে দরজার মুখ থেকে পূজাবেদি অবধি একটা চওড়া পটির মতো, হালকা খাঁজের সৃষ্টি হয়েছে। সেই খাঁজে কোনানের পা পড়তেই সে এমনভাবে সরে গেল, যেন অজান্তে সাপের গায়ে পা দিয়েছে।
হুম্মানদেবের সঙ্গে যেন আদিম বিশাল বানরের মিল পাওয়া যায়। যদিও কালো গ্র্যানাইটের মূর্তিটা উবু-হয়ে-থাকা বনমানুষের মতো করে বানানো হয়নি। সেটা বসে আছে মানুষের মতো হাঁটু মুড়ে। লোমশ, পেশিবহুল দু-হাত কোলের ওপর রাখা। প্রতিটি আঙুলে তীক্ষ্ণ, ছুঁচোলো নখ বেরিয়ে রয়েছে। সেটার চওড়া তালুতে নাকি আগে বলির পর নরমুণ্ড রাখা হত। এখনও যে হয় না, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। মূর্তির দুই চোখে লাল চুনি লাগানো। ফলে হুম্মানদেবের মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, তার দুই রাগত চোখে সর্বদা যেন নরকের আগুন জ্বলছে। সেটার বিদ্রুপরত মুখমণ্ডল, ক্ষুধার্ত দৃষ্টিপাত, শারীরিক কদর্যতার ফলে দর্শনার্থীদের মনে এক অসহনীয় অনুভবের সৃষ্টি হয়। যে ধর্ম এমন এক মূর্তির উপাসনা করে, তার রীতিনীতি না জানি কতটা ভয়ানক।
মেয়েটি মূর্তিটাকে পাশ কাটিয়ে পিছনের দেওয়ালের দিকে গেল। যাওয়ার সময় কোনানের হাঁটুর সামান্য ছোঁয়া লেগেছিল তার গায়ে। তাতে সে যেভাবে চমকে উঠল, তাতে বোঝা যায়, ভিতরে ভিতরে সে কতটা আতঙ্কিত হয়ে রয়েছে। মূর্তির পিছনে বেশ খানিকটা জায়গা। পিছনের শ্বেতপাথরের দেওয়াল জুড়ে সোনালি লতাপাতার কারুকাজ। সেই দেওয়ালের দু-পাশে দুটি ধনুকাকৃতি খিলান-দেওয়া প্রবেশদ্বার। সে দুটির কাঠের পাল্লা বন্ধ।
“এই দরজাগুলো দিয়ে ঢুকলে সুড়ঙ্গের মতো দুটো বদ্ধ দরদালান পড়ে। সে দুটো আবার কিছু দূর গিয়ে চুলের কাঁটার মতো একটা বাঁকানো প্রান্তে যুক্ত হয়ে গেছে। আমি একবার এসেছিলাম এখানে। একবারই।” কথাগুলো বলতে গিয়ে তার সারা শরীর কেঁপে উঠল। কোনান বুঝল, এক অশ্লীল, নোংরা স্মৃতি তার মধ্যে প্রচণ্ড অস্বস্তির সৃষ্টি করছে। “যেখানে পথটা ঘোড়ার নালের মতো বাঁক নিয়েছে, সেখান দিয়েই তোত্রাস্মেকের নিজের ঘরে ঢুকতে হয়। এই দুটো গলির মাঝের অংশে ওর ঘরটা পড়ে। কিন্তু সেখানে সরাসরি ঢোকার আরেকটা গোপন পথ আছে। দাঁড়াও।”
মেয়েটা মসৃণ দেওয়াল আর সোনালি লতাপাতার ওপর হাত বোলাতে লাগল। এমনিতে আলাদা করে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। কোনান উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে, জ্বলন্ত চোখে দাঁড়িয়ে ছিল। এই স্তব্ধতা, নির্জন মন্দির, দেওয়ালের অপর পারের অজানা বিপদের সম্ভাবনা, সব কিছু মিলিয়ে তার মনে সেই অবস্থার সৃষ্টি করেছিল, যা ফাঁদের সামনে এসে সেটাকে শোঁকার সময় একটা জংলি জন্তুর মনে উদয় হয়।
“এই তো!” মেয়েটি খুঁজতে খুঁজতে দেওয়ালের কারুকার্যের একটা জায়গায় চাপ দিতেই সেটার খানিকটা দ্রুত পাশে সরে গেল। কিন্তু তারপরেই যা ঘটল, তার জন্য সে বা কোনান কেউই প্রস্তুত ছিল না। একটা বিরাট কদাকার হাত অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে, চুলের মুঠি ধরে প্রবল আকর্ষণে, মুহূর্তের মধ্যে তাকে ভিতরে টেনে নিল। “সেএএট!” বলে আর্তনাদ করে উঠল জাবিবি। লাফিয়ে সামনে এগোল কোনান। সে হাত বাড়িয়েছিল তাকে ধরতে। কিন্তু মেয়েটির পোশাকের একটা অংশ ছিঁড়ে তার হাতে রয়ে গেল। তড়িদ্গতিতে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধ রাগে পাল্লাটাকে আঘাত করতে লাগল সে। ছিটকে উঠতে লাগল পাথরের টুকরো। কিন্তু সেই দ্বার আর খুলল না। দেওয়ালের ওপার থেকে একটা চাপা আর্তনাদ ও অট্টহাসি শোনা গেল।
শয়তানের খপ্পরে
কোনান বুঝল অন্ধ রাগে পাথরের ওপর জোর ফলিয়ে কোনো লাভ নেই। এই দরজা এভাবে খোলা যাবে না। সে প্রচণ্ড আক্রোশে ছুটে গেল বন্ধ দরজা দুটোর একটার দিকে। সেটার পাল্লাগুলোকে কিন্তু ধাক্কা দেওয়ার দরকার হল না। আলতো ঠেলাতেই খুলে গেল সেগুলো। কোনান জ্বলন্ত দৃষ্টিতে দেখল, তার সামনে একটা সুড়ঙ্গের মতো আলো-আবছায়াময় অলিন্দপথ অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। সেটাতে আলোর ব্যবস্থা বলতে, গর্ভগৃহে যেমন সার বেঁধে রাখা আছে, এমনই কিছু প্রদীপ জ্বালানো। অতি সাবধানে ভিতরে ঢুকলে সে দেখল, চৌকাঠের বাজুতে একটা সোনার অর্গল নামানো রয়েছে। সে সন্তর্পণে সেটাতে আঙুল ছোঁয়াল। সাধারণ মানুষের পক্ষে যা বোঝা অসম্ভব, তার তীক্ষ্ণ বন্য ইন্দ্রিয় সেটা তাকে জানিয়ে দিল। খিলটা সামান্য গরম। মানুষের হাতের স্পর্শে এটা হয়। অল্পক্ষণ আগেই কেউ সেটাকে খুলেছে। তার জন্যে নিশ্চিতভাবেই কোনো ফাঁদ অপেক্ষা করে আছে। তার বোঝা উচিত ছিল যে, মন্দিরে কেউ ঢুকলে তোত্রাস্মেক সঙ্গে সঙ্গে সেটা জেনে ফ্যালে।
এবার তাহলে শয়তান পুরুতটার পাতা ফাঁদের মুখোমুখি হওয়ার পালা। চিন্তাটা মাথায় আসা সত্ত্বেও কোনান থমকাল না। এই মন্দিরের প্রায়ান্ধকার অন্দরমহলের কোথাও জাবিবি বন্দিনি হয়ে আছে। আর হুম্মানদেবের প্রধান পুরোহিতের সম্পর্কে যা জানা গেছে, তাতে বলা যায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়েটির সাহায্যের অতি প্রয়োজন। কালো চিতার মতো সাবধানি নিঃশব্দ পদক্ষেপে, সে যে-কোনোরকম আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থেকে এগোতে লাগল।
গলিপথটার বামদিকে পরপর বেশ কয়েকটি হাতির দাঁতের কারুকার্য-করা দরজা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে সেগুলোতে ঠেলা দিয়ে দেখছিল। সব ক-টাই বন্ধ। সে পঁচাত্তর ফুটমতো এগিয়েছে, এমন সময় দেখা গেল, পথটা একটা তীব্র বাঁক নিয়েছে। সে বুঝল এই সেই মেয়েটির দ্বারা উল্লিখিত ঘোড়ার নালের আকৃতির বাঁক। সেখানে একটা দরজা দেখা গেল। কোনানের হাতের আলতো চাপে সেটার পাল্লা দুটো খুলে গেল।
এখন তার সামনে একটা প্রশস্ত, চৌকো ঘর। বাইরের চেয়ে সেটা অনেক বেশি আলোকিত। ঘরটার দেওয়াল শ্বেতপাথরের, মেঝে কাঠের; তাতে হাতির দাঁতের কারুকার্য। ছাদে রুপা দিয়ে লতাপাতা আঁকা। ঘরের মধ্যে সোনার কারুকার্য-করা হাতির দাঁতের বেশ কয়েকটি খাটো টুল, একটা অজানা ধাতুতে বানানো, ঝকঝকে, ডিম্বাকৃতি ভারী টেবিল। এর সঙ্গে রয়েছে দামি রেশমে মোড়া কয়েকটা ছোটো শোয়ার জায়গা। তারই একটায় দরজার দিকে তাকিয়ে, কাত হয়ে শুয়ে ছিল একটি মানুষ। কোনানের চমকে-যাওয়া চোখের দিকে চেয়ে সে হেসে উঠল।
লোকটার পোশাক বলতে কটিতে বাঁধা একটা সিংহের চামড়া, আর অনেকটা উঁচু অবধি পায়ে জড়ানো ফিতেওয়ালা একটা চপ্পল। তার চামড়া বাদামি, কালো চুল ছোটো করে কাটা। চওড়া, অহংকারী মুখে শিকারি চোখ দুটো সদাই চঞ্চল। লোকটা বিরাট লম্বাচওড়া। সামান্য নড়াচড়াতেই তার শক্তিশালী পেশিগুলো ফুলে ফুলে উঠছিল। তার হাতের মতো বড়ো হাত কোনান আগে কখনও দেখেনি। দৈত্যের মতো শক্তির আভাস তার প্রতিটি অঙ্গসঞ্চালনে ফুটে উঠছিল।
“কী হে বর্বর, ঘরে ঢুকছ না কেন?” সে বিদ্রুপের সুরে জিজ্ঞেস করল। তার অঙ্গভঙ্গিতে কুটিল আমন্ত্রণের আহ্বান।
কোনানের দুই চোখে যেন ধিকিধিকি আগুন জ্বলছিল। সে উন্মুক্ত তরবারি হাতে সাবধানে ঘরে প্রবেশ করল।
“তুমি কোন শয়তান?” সে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করল।
“আমি বাআল-পেওর। (বাআল: প্রভু/সেমিটিক প্রজননের দেবতা, পেওর: সব চেয়ে খারাপ) বহু আগে, অন্য দেশে আমার অবশ্য অন্য একটা নাম ছিল। কিন্তু তা হারিয়ে গেছে। তোত্রাস্মেক এই নামটা আমায় দিয়েছে। কেন, তা তুমি তার কুনজরে পড়া যে-কোনো রমণীকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। নামটা আমার ভালোই লাগে।”
“ও, তাহলে তুই ওর পোষা কুত্তা। এবারে ভালোয় ভালোয় বল, যে মেয়েটাকে তুই ভেতরে টেনে নিলি, তাকে কোথায় রেখেছিস।”
“আমার মালিক তার দেখভাল করছে।” হাসল বাআল-পেওর, “শোনো।”
উলটোদিকের একটা বন্ধ দরজার পিছন থেকে একজন নারীর চাপা চিৎকার ভেসে এল।
“জানোয়ারের দল!” গালি দিয়ে কোনান দরজাটার দিকে ছুটে গেল। কিন্তু একটা শয়তানি হাসি তাকে থামিয়ে দিল। তার বন্য ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে সাবধান করেছিল। খাড়া হয়ে উঠেছিল গায়ের রোম। মুহূর্তে সে পিছনে ফিরল। এত জোরে সে তরোয়ালের হাতল চেপে ধরেছিল যে, তার পাঞ্জা রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল। বাআল-পেওর তার দিকে কিছু একটা ছুড়ে মেরেছে। একটা স্ফটিকের বল। ঘরের অজানা আলোয় সেটা যেন জ্বলছিল। সেটাকে এড়ানোর জন্য চিতার মতো ক্ষিপ্র গতিতে কোনান সরে গেল।
কিন্তু কী অদ্ভুত! বলটা মাটিতে পড়ার বদলে, তার থেকে কিছুটা দূরে শূন্যে ভেসে রইল। যেন মেঝে থেকে পাঁচ ফুট ওপরে কেউ সেটাকে এক অদৃশ্য সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। তারপর সেটা ঘুরতে শুরু করল। ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল সেটার গতি ও উজ্জ্বলতা। হতবাক কোনানের চোখের সামনে সেটা ক্রমশ বড়ো হতে লাগল। বড়ো, আরও বড়ো। তারপর সেটা কোনানকে গ্রাস করে ফেলল। গোটা ঘরটাই ঢুকে গেল সেটার মধ্যে। কোনানের মনে হল, সে এক মেঘের মতো নীহারিকাপুঞ্জের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তারপর হারিয়ে গেল ঘরের দেওয়াল, আসবাবপত্র, বাআল-পেওর। এক প্রচণ্ড ঘূর্ণির ঝঞ্ঝাবায় তাকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইল, তাকে মাটি থেকে উপড়ে ফেলতে চাইল। তীব্র নীলচে আলোর ঝলকানি তাকে অন্ধ করে দিতে চাইল। বাতাসের শনশন শব্দ যেন তার কানের পর্দা ফাটিয়ে দিচ্ছিল।
দারুণ আতঙ্কে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার গলা থেকে। সে জান্তব প্রবৃত্তিতে এক-পা এক-পা করে পিছোতে লাগল। তখনই অদৃশ্য দেওয়ালে পিঠ ঠেকল তার। সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেল সেই ঘূর্ণিবাত্যা, সেই বিরাট গোলক। ফেটে পড়ল বুদ্বুদের মতোই। কিন্তু এক ধূসর ধোঁয়ার মেঘ তার পায়ের কাছে পাক খাচ্ছিল। কোনানের গা গুলোচ্ছিল। সে তাকাল রুপালি ছাদের দিকে। সেই মেঘ তাকে ঢেকে ফেলছিল। সে দেখল, বাআল-পেওর তার শয্যায় শুয়ে হাসছে। নিঃশব্দ হাসিতে কাঁপছে তার সারা শরীর।
“কুত্তির বাচ্চা!” কোনান চিৎকার করে উঠল। কিন্তু ততক্ষণে গাঢ় ধোঁয়া তাকে ঢেকে ফেলেছে। সে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিল না। তার মনে হল, এই স্থানকাল থেকে তাকে উপড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্য কোথাও। আবার হারিয়ে গেল বাআল-পেওর ও ঘরভরা আশ্চর্যজনক কুয়াশা। কোনান দেখল সে এক প্রায়ান্ধকার, লতাপাতা ফার্নে ভরা জলাভূমিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঝোপঝাড় ভাঙার শব্দে সে ফিরে দেখল, এক বিরাট বন্য মোষ তার দিকে শিং উঁচিয়ে ছুটে আসছে। তড়িদ্গতিতে সরে গেল কোনান। তারপর তরোয়াল গেঁথে দিল সেটার পাঁজর ভেদ করে। মুখ থুবড়ে পড়ল বনের দানব। কোনান সবিস্ময়ে দেখল, পশুটার জায়গায় কাদামাটিতে পড়ে রয়েছে বাআল-পেওর। এক প্রচণ্ড অভিসম্পাত দিয়ে সে তার মাথা কেটে ফেলল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে মাথাটা গড়াতে গড়াতে শূন্যে উঠে পড়ল। তারপর কিছু ভাববার আগেই উড়ে এসে কামড়ে ধরল কোনানের কণ্ঠনালি। সেটার ক্রমবর্ধমান শ্বদন্ত তার গলায় গেঁথে যেতে লাগল। দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল কোনানের, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। দু-হাতের সমস্ত জোর কাজে লাগিয়ে সে সেটার চোয়াল দুটোকে খুলে ফেলতে চাইছিল। ধীরে ধীরে আলগা হচ্ছিল কামড়। এমন সময় আবার এক ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করল। প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে আবার স্থানচ্যুত হল সে। সংবিৎ ফিরলে সে দেখল, সে সেই আগের ঘরেই রয়েছে। একই রকমভাবে শয্যায় শুয়ে হেসে চলেছে অক্ষত বাআল-পেওর।
“সম্মোহনবিদ্যা!” বিড়বিড় করে উঠল কোনান। পা শক্ত করে মেঝের ওপর চাপ দিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে, তলোয়ার হাতে নতুন আক্রমণের অপেক্ষা করতে লাগল সে।
তার চোখে আগুন জ্বলছিল। বাদামি কুত্তাটা তাকে নিয়ে খেলছে। কিন্তু এই মিথ্যে রসিকতা; কুয়াশা আর ছায়ার এই ছেলেখেলা তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তাকে শুধু ঠিকমতো আক্রমণ করে তরোয়ালের মোক্ষম আঘাত হানতে হবে। তাহলেই তার শয়তান শত্রুটা পায়ের কাছে প্রাণ হারিয়ে পড়ে থাকবে। সে আর এই মরীচিকার মায়ায় ভুলছে না। ভাবল বটে, কিন্তু কোনান আবার ভুলল।
একটা রক্ত-জল-করা হুংকার ভেসে এসেছিল তার পিছনদিক থেকে। চকিতে ঘুরে সে দেখল, সেই বিরাট ধাতব টেবিলের ওপরে একটা কালো চিতা গুঁড়ি মেরে রয়েছে। তার ওপর লাফিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। তীব্র গতিতে জানোয়ারটার মাথা লক্ষ করে নেমে এল কোনানের ইস্পাতের তলোয়ার। কিন্তু আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে চিতাটা ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল, আর তলোয়ারের ফলা টেবিলের ওপর আছড়ে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে আঠার মতো আটকে গেল। কোনান আপ্রাণ চেষ্টা করছিল সেটাকে টেনে ছাড়াতে, কিন্তু কোনো অসীম শক্তি দিয়ে যেন টেবিলটা সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করছিল। দু-হাতে টান দিয়েও তলোয়ারটা মুক্ত করা যাচ্ছিল না। এটা কোনো সম্মোহনের কারিকুরি নয়। অ্যাডামেন্টিয়ামের টেবিলটা আসলে এক প্রচণ্ড শক্তিশালী চুম্বক। এমন সময় কোনান দেখল, এতক্ষণে বাআল-পেওর বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে।
লোকটা তার চেয়ে কিছুটা লম্বা, কিন্তু বেশি ভারী। দৈত্যের মতো পেশিসমৃদ্ধ। তার হাত স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। সে তার বিরাট হাতের পাঞ্জাটা বারবার খুলছিল আর বন্ধ করছিল। কোনান তরোয়ালটা মুক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে তার দিকে সরু চোখে চাইল।
“তোর মাথাটা, বুঝলি সিমেরীয়।” কেমন একটা ফ্যাঁসফেঁসে স্বরে সে কোনানকে বিদ্রুপের সুরে বলল, “তোর মাথাটা আমার চাই। ওটাকে আমি খালি হাতে, মুরগির মাথার মতো ঘুরিয়ে, তোর দেহ থেকে ছিঁড়ে নেব। এভাবেই খোসালার মন্দিরে ইয়াজুরের কাছে বলি চড়ানো হয়। শোন, তুই এখন য়োটা-পঙের একজন শ্বাসরোধী বলিদাতার দিকে তাকিয়ে আছিস। একেবারে ছেলেবেলায় আমাকে ইয়াজুরের পুরোহিতরা বেছে নিয়েছিল। তারপর পুরো কৈশোর, আর তরুণ বয়েস জুড়ে আমি শিখেছি, কীভাবে খালি হাতে লড়তে হয়, আর মানুষের গলা টিপে মেরে তার মাথা ছিঁড়ে নিতে হয়। ইয়াজুর রক্ত ভালোবাসেন, আর এভাবেই আমরা সেটাকে মাটিতে পড়তে দিই না। এভাবেই আমরা তার পুজো চড়াই। যখন ছোটো ছিলাম, ওরা আমায় শিশুদের দিত, গলা টিপে মারার জন্য। একটু বড়ো হলে দিত মেয়েদের। অনেক মহিলা, বুড়ো, কমবয়েসি ছেলেপুলেদের মেরেছি আমি। তবে, পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হওয়ার পর শক্তিশালী লোকেদের মারতে শুরু করলাম। বহু বছর ধরে ইয়াজুরের বেদিতে বলি চড়িয়েছি আমি। বহু মানুষের ঘাড় মটকেছে এই আঙুলগুলো।” সে কোনানের রাগত দৃষ্টির সামনে আঙুলগুলো নাড়াল আর খুলল। “কেন আমি য়োটা-পঙ থেকে পালিয়ে তোত্রাস্মেকের আশ্রয়ে এলাম, তা জেনে তুই আর কী করবি? একটু পরেই তো তুই সব প্রশ্ন আর উত্তরের বাইরে চলে যাবি। এমনিতেই খোসালাতে ইয়াজুরের পুরোহিতরা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। আর আমি তো তাদের সবার চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিলাম। কাজেই, এবার তোকে খালি হাতেই আমি শেষ করব।”
কথাগুলো শুনে যেন কোনানের মাথার ভিতরে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছিল। এত বড়ো সাহস!
এমন সময় দুটি শঙ্খচূড়ের ছোবল মারার মতো, নিমেষে বাআল-পেওরের হাত দুটো তার গলা টিপে ধরল। কোনান কিন্তু সরে গিয়ে বাঁচার, কিংবা সে দুটোকে প্রতিহত করার কোনো চেষ্টা করল না। বরং সে-ও বিদ্যুদ্গতিতে হাত বাড়িয়ে খোসালাবাসীটার মোটা গলা টিপে ধরল। এদিকে, কোনানের গলার দু-পাশে ইস্পাতের মতো শক্ত পেশির উপস্থিতি টের পেয়ে বাল-পেওরের কালো চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গিয়েছিল। মুখ বিকৃত করে সে প্রাণপণে দানবের মতো চাপ দিচ্ছিল। তার হাতের মাংসপেশিগুলো পিণ্ডের মতো, মোটা দড়ির মতো ফুলে উঠেছিল। তার পরই তার গলা দিয়ে একটা দমবন্ধ-করা গোঙানির শব্দ বেরোল। কোনানের আঙুলের জোর সে টের পাচ্ছে। তারা মূর্তির মতো স্থির হয়ে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের মুখ দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছিল, কী ভয়ানক পরিমাণ বল তারা পরস্পরের ওপর প্রয়োগ করছে। তাদের কপালের রগ ফুলে উঠে নীল হয়ে গিয়েছিল। কোনান তার পাতলা ঠোঁট কামড়িয়ে, একটা বিদ্রুপের হাসি-মাখা মুখে তাকিয়েছিল। কিন্তু বাল-পেওরের চোখে ফুটে উঠেছিল বিস্ময়। এই প্রথম তার মুখে ভয়ের ছায়া দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু তাদের কেউই নড়ছিল না। কারও মুখ খেকে কোনো আওয়াজও বেরোচ্ছিল না। নিঃশব্দে চলছিল শক্তির পরীক্ষা। সেই পরিমাণ শক্তি, যা একটা বৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে বা একটা মোষের খুলি চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলতে পারে।
কিছুটা সময় এভাবেই কাটার পর, বাল-পেওরের দাঁতের ফাঁক দিয়ে শিসের মতো শব্দ করে, বাতাস বের হয়ে এল। তার বেগুনি মুখ এখন আতঙ্কিত। তার হাতের আর কাঁধের পেশিগুলো ফেটে পড়ার উপক্রম হয়েছে, তবু কোনানের গলার দু-পাশের ইস্পাতের মতো পেশিগুলো নরম হচ্ছিল না। বাল-পেওরের আঙুলের প্রচণ্ড চাপের বিরুদ্ধে সেগুলো কোনানের শ্বাসনালিকে বর্মের মতো রক্ষা করছিল। কিন্তু তার নিজের পেশির ক্ষমতা কমছিল। কোনানের সাঁড়াশির মতো আঙুলগুলো চেপে বসছিল তার গলায়। তার জুগুলার ধমনি ও শ্বাসনালি বিপর্যস্ত হচ্ছিল।
পাথরের মতো স্থবিরতা হঠাৎই ভেঙে পড়ল। কোনানের গলা ছেড়ে, পাগলের মতো হ্যাঁচকা টান দিয়ে তার কবল থেকে মুক্ত হতে চাইল বাল-পেওর। সে দু-হাতে কোনানের কবজি চেপে ধরেছিল। চেষ্টা করছিল নির্দয় আঙুলগুলোর থেকে মুক্তি পেতে। ক্রমশ শক্তি কমে আসছিল তার।
এই সময় কোনান তাকে ঠেলতে শুরু করেছিল। পিছোতে পিছোতে বাল-পেওরের কোমরের ওপরের অংশটা ঠেকল ভারী টেবিলের ধারে। সে আর পিছোতে পারছিল না। কোনানের চাপে সে পিছনদিকে ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছিল।
কোনানের গলা দিয়ে একটা খনখনে, ক্ষমাহীন হাসি বেরিয়ে এল। সে ফিশফিশ করে বলল, “গাধা কোথাকার! কয়েকটা বাচ্চা, বুড়ো আর শহুরে লোকের গলা মুচড়ে নিজেকে শক্তিশালী ভেবেছিলি। একটা সিমেরীয় ষাঁড়ের ঘাড় মটকাতে গেলে টের পেতিস, আসল শক্তি কাকে বলে। আমি কিন্তু ছেলেবেলাতেই একবার মটকেছি। এইভাবে।”
বলার পরেই সে এমনভাবে বাল-পেওরের ওপর একটা অমানুষিক চাপ দিল যে, তার গলার হাড় শুকনো ডালের মতো মট করে ভেঙে গেল। মাথা আলাদা হয়ে গেল তার মেরুদণ্ড থেকে।
কোনান ল্যাতপেতে মৃতদেহটাকে মাটিতে ফেলে টেবিলে আটকে-থাকা তলোয়ারটার দিকে চাইল। তারপর আবার দু-হাতে সেটার হাতলটাকে চেপে ধরে, টেবিলের কিনারে পায়ের চাপ দিয়ে, প্রচণ্ড জোরে টানতে লাগল। তার বুকে বাল-পেওরের নখের খোঁচায় যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলো থেকে নতুন করে রক্ত বেরিয়ে এল। লড়াইয়ের পরিশ্রমে ঘামে ভিজে গিয়েছিল তার চুল ও মুখমণ্ডল। গলায় শুধু আঙুলের দাগই বসে যায়নি, ক্ষতও সৃষ্টি হয়েছিল বেশ কয়েক জায়গায়। বাল-পেওর সত্যিই প্রবল বলশালী ছিল। তবু সব যন্ত্রণা উপেক্ষা করে সজোরে টান মেরে কোনান তলোয়ারটাকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হল।
ঘরের যে দরজার পিছন থেকে নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে এসেছিল, তার সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে দম নিল সে। তারপর ধাক্কা দিয়ে পাল্লা দুটো খুলল। একই রকম একটা সোজা, বদ্ধ দরদালান। সেটার দেওয়ালে একই রকম হাতির দাঁতের কারুকার্য-করা দরজার সারি। তবে সুড়ঙ্গের মতো অলিন্দের একেবারে শেষ প্রান্তে একটা দুয়ার দেখা গেল, যাতে একটা ভারী মখমলের পর্দা ঝুলছে। সেটার ওপার থেকে এক অস্বাভাবিক, অপার্থিব বাজনার শব্দ ভেসে আসছিল। তেমন বাজনা কোনান কখনও কোনো দুঃস্বপ্নেও শোনেনি। তার সঙ্গে ভেসে আসছিল এক ক্লান্ত নারীর কান্না ও হাঁপানোর শব্দ। কোনানের রোম কোনো অজানা আতঙ্কে খাড়া হয়েছিল। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমেছিল হিমেল স্রোত। তবু সে সতর্ক পদক্ষেপে দালান ধরে এগোতে লাগল।
নাচো মেয়ে, নাচো
যখন জাবিবিকে দুটো সবল হাত দেওয়ালের গর্ত দিয়ে ভিতরে টেনে নিল, প্রথম যে চিন্তাটা তার মাথায় এসেছিল, তা হল তার মরণ আসন্ন। প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই সে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল ঘাতক আঘাতের অপেক্ষায়। কিন্তু তার বদলে তাকে অবহেলায় শ্বেতপাথরের মেঝেতে ছুড়ে ফেলা হল। ফলে তার হাঁটু ও কোমর ছড়ে গেল। সে ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে চারদিকে তাকাল। দেওয়ালের ওপার থেকে আঘাতের চাপা আওয়াজ ভেসে আসছিল। সে দেখল, তার পাশে সিংহচর্ম-পরিহিত একটা দৈত্যাকৃতি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, আর ঘরের অপর প্রান্তে একটা পুরু মখমলের পর্দাকে পিছনে রেখে ছোটো পালঙ্কের ওপর বসে আছে আরেকজন। মোটাসোটা, থলথলে, হোঁতকামতো। লোকটার গোলগাল, ফরসা মুখে দুটো কুতকুতে ধূর্ত চোখ। শিউরে উঠল জাবিবি। তোত্রাস্মেক! হুম্মানদেবের এই প্রধান পুরোহিত দীর্ঘদিন ধরে গোটা জ়াম্বোলা জুড়ে মাকড়সার মতো জাল বিছিয়ে রেখেছে।
“বর্বরটা দেখছি, দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে।” তোত্রাস্মেক কৌতুকের সুরে বলল, “বৃথা চেষ্টা।”
জাবিবি দেখল, দরজাটাকে ভিতর থেকে একটা সোনার খিল দিয়ে বন্ধ করা আছে। ব্যবস্থাটা এমনই, এমনকি একটা হাতির পক্ষেও সে দরজা ভাঙা অসম্ভব।
“যাও বাআল-পেওর, দালানের অন্য প্রান্তের চৌকো ঘরের দরজা খোলো।” তোত্রাস্মেক বলল, “ওখানেই বুনোটাকে শেষ করে দাও।”
খোসালাবাসীটা সেলাম ঠুকে পর্দা সরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জাবিবি উঠে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত চোখে তোত্রাস্মেকের দিকে তাকাল। সে তখন তার লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে মেয়েটিকে লেহন করছিল। জাবিবি সেটাকে উপেক্ষা করল। তার সামনে সম্ভবত আরও বড়ো বিপদ অপেক্ষা করে আছে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।
“তাহলে সুন্দরী, আবার আমার আস্তানায় তোমাকে আসতে হল।” তোত্রাস্মেক ফুরফুরে সুরে বলে উঠল, “কী সৌভাগ্য আমার। আমার ধারণা ছিল, গতবারের অভিজ্ঞতা তোমার একেবারেই পছন্দ হয়নি। আমি অবশ্য তোমার সেবায় নিজেকে সঁপে দিতে সদাই প্রস্তুত।”
যতটা সম্ভব নিজের মনোভাব লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করল নারীটি। তবু তার চোখ দুটি প্রসারিত হল, লাল হল গাল। “আপনি খুব ভালো করেই জানেন, আপনার প্রেমের টানে আমি এখানে আসিনি।”
“না।” খলখল করে হেসে উঠল পুরোহিত, “তুমি একটা নির্বোধ বর্বরকে নিয়ে এসেছ আমায় মারবে বলে। কেন আমার প্রাণ নিতে চাইছ তুমি?”
“আপনি জানেন কেন।” চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটি। তার সব স্থৈর্য খসে পড়েছিল। যদিও সে জানত, এই রাগ দেখানোয় কোনো লাভ হবে না।
“তুমি তোমার প্রেমিকের কথা ভাবছ।” তোত্রাস্মেক হোহো করে হেসে উঠল, “তার মানে তুমি তাকে ওষুধটা খাইয়েছ। আচ্ছা বলো তো, তোমাকে ভালোবাসি বলে যেমন চেয়েছ, তেমন ওষুধই কি আমি তোমায় পাঠাইনি?”
“আমি আপনার কাছে এমন ওষুধ চেয়েছিলাম, যা খেলে ও কয়েক ঘণ্টা নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। অথচ ওর কোনো ক্ষতি না হয়। কিন্তু আপনার চাকর এমন একটা মিশ্রণ আমাকে দিল, যা খেয়ে ও পাগল হয়ে গেছে। আপনি আসলে বন্ধুত্বের মুখোশ-পরা একজন ভণ্ড, শয়তান। আপনার ঘৃণা আর কপটতাকে, মুখোশের আড়ালে আপনি ভালোই লুকিয়ে রেখেছিলেন। আপনাকে বিশ্বাস করা আমার চরম বোকামি হয়েছে।”
“বিশ্বাস?” হোহো করে হেসে উঠল তোত্রাস্মেক, “কে কাকে বিশ্বাস করে? তুমি করো, তোমার প্রেমিককে? কেন তুমি ওকে গভীর ঘুম পাড়াতে চাইছিলে? যাতে সাধারণ অবস্থায় যেটা তুমি ওর কাছ থেকে চুরি করতে পারোনি, সেটা খুলে নিতে পারো। তা-ই না? সেই আংটিটা, যেটা তুমি চাইলেও তোমার প্রেমিক তোমায় দিত না। আমি জানি, আংটিটাতে ‘খোসালার তারা’ নামের রত্নটা লাগানো আছে। ওটা আসলে ওফিরের রানির সম্পত্তি। ওটা পাওয়ার জন্য রানি ঘর ভরতি সোনাদানা দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু তোমার প্রেমিক সেটা তোমাকে দিতে প্রস্তুত ছিল না। আসলে সে জানত, যদি রত্নটাকে নিয়মমতো ব্যবহার করা যায়, তবে যে-কোনো বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে সেটা ধারণকারীর প্রেমে পড়তে বাধ্য করতে পারে। তুমিও সেইজন্যেই সেটা চুরি করতে চেয়েছিলে। তুমি জানতে, তোমার প্রেমিকের জাদুকররা যদি একবার সেটার ব্যবহারবিধি জানতে পারে, তাহলে হয়তো সে বিখ্যাত রানি, রাজকন্যাদের নিজের প্রেমজালে বাঁধতে গিয়ে তোমায় ভুলে যাবে। তবে আমি জানি তোমার ভালোবাসা একমুখী। তুমি সেটা ওফিরের রানিকেই ফেরত দিতে চেয়েছিলে। অবশ্যই প্রচুর সোনাদানার বিনিময়ে।”
“কিন্তু আপনি সেটা পেতে চেয়েছেন কেন?” রাগত মুখে, সন্দিগ্ধস্বরে প্রশ্ন করল জাবিবি।
“জহুরিই তো রত্নের প্রকৃত মর্যাদা বোঝে।” স্থিরদৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল তোত্রাস্মেক, “ওটা আমার শিল্পের ক্ষমতা আরও বাড়াতে পারে।”
“তাহলে স্বীকার করছেন, রত্নটা আপনার কাছেই আছে।”
“কোন রত্ন? খোসালার তারা? আরে না না। তুমি ভুল বুঝছ।”
“মিথ্যে বলে কী লাভ?” মেয়েটি তেতো মুখে বলল, “ও যখন আমায় তাড়া করে, ওর আঙুলে আংটিটা ছিল। আবার যখন ওকে পেলাম, আংটিটা নেই। এর মাঝে আপনার লোকেরা নিশ্চয়ই কোনোভাবে ওটা হাতিয়েছে। আপনি ওটা নিয়ে যা খুশি করুন। আমি আমার প্রেমিককে ফেরত চাই। সুস্থ এবং স্বাভাবিক। আপনি আমাদের অহেতুক অনেক কষ্ট দিয়েছেন। এবার ওকে ঠিক করে দিন। সেটা নিশ্চয়ই আপনার পক্ষে সম্ভব?”
“অবশ্যই।” তোত্রাস্মেকের মুখ-চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, তাদের যন্ত্রণা দিতে পেরে সে খুবই আনন্দিত হয়েছে। হাসি-হাসি মুখে সে তার লম্বা আংরাখার ভিতর থেকে একটা শিশি বের করে আনল। “এর ভিতরে স্বর্ণকমলের রস আছে। তোমার প্রেমিক এটা খেলে একেবারে সেরে যাবে। যাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম। তুমি একাধিকবার আমায় প্রত্যাখ্যান করেছ, অপমানিত করেছ। তোমার প্রেমিক আমার ইচ্ছা, মতামতকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। তবু আমি তোমাদের ক্ষমা করলাম। এসো, এটা নাও।”
মেয়েটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তোত্রাস্মেকের দিকে তাকাল। এত সহজে পুরোহিতটা তাদের ছেড়ে দেবে? সে সত্যিই প্রতিষেধকটা দিতে চাইছে, না তার আড়ালেও লুকিয়ে আছে অন্য কোনো অভিসন্ধি? তবু সেটা তাকে পেতে হবে। হাত বাড়িয়ে, কম্পিত পদক্ষেপে সে পুরোহিতের পালঙ্কের দিকে এগোতে লাগল। যেই সে শিশিটা নিতে গেল, তোত্রাস্মেক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সেটাকে সরিয়ে নিল। তখনই জাবিবির ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাকে সাবধান করল। সে ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখল, চারটে জেড পাথরের ঘড়া ওপর থেকে পড়ছে। নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে সে লাফিয়ে পিছনে সরে গেল। ঘড়াগুলো মেঝেতে আছড়ে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। এমনভাবে সেগুলো পড়েছিল, যেন সেগুলো একটা বিরাট বর্গক্ষেত্রের চারটে কৌণিক বিন্দু সৃষ্টি করেছে। সেগুলোর ধারালো পাথুরে টুকরোগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের মধ্যে। তার মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল জাবিবি। আতঙ্কে বিস্ফারিত চোখে সে দেখল, ভাঙা পাত্রগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছে চারটি ভয়ানকদর্শন শঙ্খচূড়। তার মধ্যে একটা হিসহিস করে তাকে কামড়াতে ছুটে এল। জাবিবি প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে একদিকে লাফিয়ে সরে গেল। কিন্তু সে দেখল, সেখানে আরেকটা সাপ ফণা উঁচিয়ে রয়েছে। সে বারবার সাপগুলোর আক্রমণ থেকে বাঁচতে লাফাচ্ছিল, পাক খাচ্ছিল, তড়িদ্গতিতে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। সেগুলোও চেষ্টা চালাচ্ছিল তার পায়ের পাতা, গোড়ালি, এমনকি পায়ের ওপরের অনাবৃত অংশেও কামড় দেবার। কয়েকবার তাদের দাঁত যেন ছুঁয়েও গেল তার পায়ের বিভিন্ন অংশে।
সে একটা ভয়ানক ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল। তাদের ঘিরে, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ছিল ধারালো পাথরের টুকরো। তার মাঝে শঙ্খচূড়ের কামড় থেকে বাঁচতে দ্রুত স্থান বদলাচ্ছিল জাবিবি। একমাত্র জ়াম্বোলার এক ক্ষিপ্র নর্তকীর পক্ষেই বোধহয় এই পরিবেশে, এমনভাবে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
সে বাঁচার জন্য একটা ছোটো জায়গার মধ্যেই সরে সরে যেতে পারছিল। কয়েকবার একচুলের জন্য সে সাপের কামড় থেকে বেঁচে গেল। তবে সে অবাক হয়ে খেয়াল করছিল, একসঙ্গে একাধিক সাপ তাকে আক্রমণ করছে না। বরং একটা ছোবল মারতে এগোলে অন্যগুলো ফণা তুলে অপেক্ষা করছে। পাহারা দিচ্ছে? ওরা যেন তাকে নিয়ে খেলছিল! নাকি নাচাচ্ছিল? তার চোখের সঙ্গে হাত ও পায়ের অসম্ভব সমন্বয় তাকে রক্ষা করে চলেছিল।
এমন সময় আড়াল থেকে বেজে উঠল বাদ্যযন্ত্র। এমন বিচিত্র মন-খারাপ-করা যন্ত্রসংগীত সে আগে কখনও শোনেনি। মনে হচ্ছিল, মৃত মানুষের খুলির মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে কোনো অশুভ নৈশবায়ু। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শঙ্খচূড়ের হিসহিসানি। জাবিবি দেখল, এখন আঁশযুক্ত দানবগুলোর দুলুনি বা ছোবল মারা আর এলোমেলো নয়। তারা দুলছে, পাক খাচ্ছে, আক্রমণ করছে সেই অপার্থিব বাঁশির সুরেলা ধ্বনির তালে তালে। এর ফলে জাবিবিও প্রাণ বাঁচানোর জন্য তাদের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে নাচতে বাধ্য হল। এ এমন এক নৃত্যের সৃষ্টি করছিল, যার পাশে জাদুর দেশ জামোরার ঝোড়ো নাচকেও নিতান্তই স্বাভাবিক বলে মনে হবে। ভয় এবং কষ্টে বিদ্ধ হতে হতে জাবিবি শুনল, তার নিষ্ঠুর, কুটিল উৎপীড়ক বিদ্রুপের সুরে বলছে, “সুন্দরী, একে বলে শঙ্খচূড়ের নাচ। এমন নৃত্য হুম্মানদেবের মন্দিরে, শতাব্দীপ্রাচীন প্রথা অনুযায়ী দেখা যায়। তবে তুমি যেভাবে নাচছ, তাকে তারিফ না করে পারছি না। নাচো মেয়ে, নাচো। কিন্তু কতক্ষণ নাচবে তুমি? কতক্ষণ পারবে বিষাক্ত দাঁতকে এড়াতে? কয়েক মিনিট? কয়েক ঘণ্টা? একসময় না একসময় তোমায় ক্লান্ত হতেই হবে। তখন তাল কাটবে। কোমর নড়তে চাইবে না। পা দুটো ক্লান্তিতে থেমে আসবে। আর তখনই আমার পোষ্যরা তোমার শ্বেত মর্মরের মতো চামড়ার গভীরে ঢেলে দেবে মারক বিষ।” হাসছিল তোত্রাস্মেক।
ঠিক তখনই পিছনের মখমলের পর্দাটা নড়ে উঠল আর তোত্রস্মেকের হাসি পরিণত হল মরণ আর্তনাদে। জাবিবি সবিস্ময়ে দেখল, তার চোখ দুটো প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বিস্ফারিত হয়েছে আর তার বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে একটা দীর্ঘ তলোয়ারের ফলা।
তৎক্ষণাৎ থেমে গেল বাজনা। মেয়েটা তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিল। সে-ও একটা কাতর চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অসহায় হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল বিষাক্ত নাগের মারণ কামড়ের জন্য। কিন্তু কী আশ্চর্য! দেখা গেল চারটি ভুজঙ্গ পরিণত হয়েছে চারটি ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত তোত্রাস্মেকও পালঙ্ক থেকে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
কোনান পর্দার পিছন থেকে বেরিয়ে এল। তরোয়ালের রক্তাক্ত ফলা মুছে নিল সেটাতেই। সে আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখেছিল, চারটি বিচিত্র ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মাঝে প্রাণপণে নেচে চলেছে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত জাবিবি। সে বুঝেছিল, মেয়েটির কাছে ওগুলো ধোঁয়া নয়, অন্য কিছু। সে এ-ও বুঝেছিল পালঙ্কের ওপর বসে-থাকা লোকটি কে। তোত্রাস্মেককে হত্যা করতে দেরি করেনি সে।
জাবিবি মেঝেতে পড়ে হাঁপাচ্ছিল। কিন্তু যখন কোনান তার কাছে পৌঁছোল, কোনোরকমে উঠে দাঁড়াল সে। তার পা দুটো ক্লান্তিতে থরথর করে কাঁপছিল।
“শিশিটা।” প্রায় খাবি খেতে খেতে সে বলল, “শিশিটা ভাঙেনি তো?”
মৃত তোত্রাস্মেকের মুঠোর মধ্যে সেটা অক্ষতই ছিল। জাবিবি নিষ্ঠুরের মতো প্রচণ্ড বলপ্রয়োগ করে, আঙুলগুলো প্রায় ভেঙে মুঠো থেকে সেটা বের করে আনল। তারপর পাগলিনির মতো তার জামাকাপড় হাতড়াতে লাগল।
“কী খুঁজছ তুমি?” কোনান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আংটি, একটা আংটি। ওটা ওর কাছেই থাকার কথা। সেট-এর শয়তানটা পাগল আলাফডালের কাছ থেকে ওটা চুরি করেছে।”
একসময় সে বুঝল আংটিটা তোত্রাস্মেকের কাছে নেই। তখন সে ঘরটায় তল্লাশি চালাতে শুরু করল। দেরাজ খুলে, ঘরসজ্জার ঘড়া উলটিয়ে, পালঙ্কের গদি ছিঁড়ে সে খুঁজে চলেছিল।
একসময় সে থমকে, ঘামে ভেজা চুল মুখের ওপর থেকে সরিয়ে বলে উঠল, “আমি বাআল-পেওরের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম।”
“ও ওর মটকানো ঘাড় নিয়ে নরকে পৌঁছে গেছে।” কোনান তাকে নিশ্চিন্ত করল।
জাবিবির মুখ দেখেই বোঝা গেল, কতটা পরিতৃপ্ত হয়েছে সে। কিন্তু তারপরই সে ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলে উঠল, “আর এখানে থাকা যাবে না। ভোর হতে খুব বেশি দেরি নেই। সাধারণ ও সহকারী পুরোহিতেরা যে-কোনো সময় মন্দিরে আসতে পারে। মৃতদেহ দুটোর সঙ্গে ওরা যদি আমাদের দেখে ফ্যালে তো সর্বনাশ। হুম্মানদেবের ভক্তরা আমাদের একেবারে ছিঁড়ে ফেলবে। তুরানিরাও আমাদের বাঁচাতে পারবে না।”
সে গুপ্ত দরজার সোনালি খিলটা খুলে ফেলল। কিছুক্ষণ বাদেই তারা হুম্মানদেবের সুপ্রাচীন, শ্মশানের স্তব্ধতা-মাখা মন্দির থেকে দ্রুতপায়ে দূরে চলে যাচ্ছিল।
মন্দিরটা যে প্রাঙ্গণে অবস্থিত, সেখান থেকে বেরোনোর একটা নাতিপ্রশস্ত পথ ধরেছিল তারা। খানিকটা চলার পর কোনান দাঁড়িয়ে পড়ল। তার শক্তিশালী হাত দুটো জাবিবির নগ্ন কাঁধের ওপর রেখে সে বলল, “আমার পুরস্কারটার কথা ভুলে যাওনি তো?”
“না।” কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজেকে মুক্ত করে মেয়েটি বলল, “তবে আগে আলাফডালের কাছে পৌঁছোতে হবে।”
কয়েক মিনিট পরে কালো ক্রীতদাসটা তাদের আবার দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে দিল। অশান্ত তুরানি যুবকটিকে বিছানায় শোয়ানো ছিল। তার হাত ও পা মখমলের দড়ির সাহায্যে বাঁধা। তার চোখ দুটো খোলা ছিল। কিন্তু সে চোখে পাগল কুকুরের দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে ফেনা জমে রয়েছে। জাবিবি কেঁপে উঠল।
“ওকে হাঁ করাও।” সে নির্দেশ দিল। কোনান বিনা বাক্যব্যয়ে তার লোহার মতো আঙুল দিয়ে যুবকটির মুখ খুলল।
জাবিবি শিশির পুরো তরলটা তার মুখে ঢেলে দিল। জাদুর মতো কাজ হল তাতে। সঙ্গে সঙ্গে যুবকটি শান্ত হল। তার চোখ ক্রমশ স্বাভাবিক হল। দৃষ্টিতে ফিরে এল বুদ্ধিমত্তা। সে মেয়েটিকে চিনতে পেরে অবাক হল যেন। তারপর ক্লান্তিতে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল।
এতক্ষণ ছায়ার মতো নীরবে দাঁড়িয়ে-থাকা ক্রীতদাসটিকে নিশ্চিন্ত স্বরে জাবিবি বলল, “যখন জাগবে, ও একেবারে ঠিক হয়ে যাবে।”
ক্রীতদাসটি মাথা অনেকটা নত করে তাকে অভিবাদন জানাল। এরপর তার হাতে একটা চামড়ার ছোটো থলি দিয়ে তার কাঁধে একটা রেশমের স্কন্ধাবরণী জড়িয়ে দিল। কোনানকে নিয়ে সে যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এল, তার হাবভাব পুরো বদলে গিয়েছিল। খিলানযুক্ত দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে এক সদ্যপ্রকাশিত রাজকীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে সে কোনানকে বলল, “এবারে সময় এসেছে সত্যকে প্রকাশিত করার। আমার নাম জাবিবি নয়। আমি নেফারতারি। আর আমার প্রেমিক কোনো সাধারণ তুরানি সেনানায়ক নয়। ও জাহাঙ্গির খান। জ়াম্বোলার সত্রাপ।”
কোনানের মুখের রেখায় কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। সে স্থির চোখে তাকিয়ে ছিল।
“আমি তোমায় মিথ্যে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, কারণ সত্যিটা প্রকাশিত হলে অনেক ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল।” সে বলল, “যখন জাহাঙ্গির খান পাগল হয়ে যায়, আমরা একা ছিলাম। কাজেই অন্য কেউ সেটা জানতে পারেনি। যদি এই খবর প্রকাশিত হত, সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহের আগুন ও দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ত। তোত্রাস্মেক তা-ই চেয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রটাই ও সাজিয়েছিল। আর আমি বোকার মতো তাতে পা দিয়েছিলাম।
“এখন নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছ, তোমার কাঙ্ক্ষিত পুরস্কার কেন আমি দিতে পারব না। সত্রাপের প্রেমিকাকে তুমি পেতে পারো না। কোনোভাবেই না। কিন্তু তার পরিবর্তে অন্য পুরস্কার তোমার জন্য রয়েছে। এই থলিটা ধরো। এতে সোনার মোহর রয়েছে।”
সে চামড়ার থলিটা বাড়িয়ে ধরল।
“এখন যাও। কাল সকালেই জাহাঙ্গির খানকে বলব তোমাকে তার সেনাবাহিনীর ক্যাপটেন বানানোর জন্য। কিন্তু গোপনে তুমি আমার নির্দেশ পালন করবে। তোমার প্রথম কাজ হবে হুম্মানদেবের মন্দিরে গিয়ে কে তোত্রাস্মেককে খুন করল, তার তদন্ত চালানো। আসলে তোমাকে সেখানে গিয়ে ‘খোসালার তারা’টাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমি নিশ্চিত, ওটা ওখানেই কোথাও লুকোনো আছে। আপাতত তোমার ছুটি। কাল সকালে দেখা হচ্ছে।”
কোনান ঘাড় নাড়ল। তারপর নিঃশব্দে হাঁটা দিল। নেফারতারি পিছন থেকে তার পৌরুষপূর্ণ দেহাবয়বের দিকে, তার সিংহের মতো চলনের দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু সিমেরীয়টির আচরণে কোনোরকম রাগ বা মন-খারাপ প্রকাশিত হয়নি বলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হল সে।
…
মোড়টা ঘুরেই পিছন ফিরে একবার তাকাল কোনান। তারপর দিশা বদলিয়ে পদচারণা দ্রুততর করল। কয়েক মিনিট পরে সে ঘোড়ার বাজারের পাশেই একটা বাসাবাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। সেটার দরজায় বেশ কয়েকটা দুমাদুম ঘুসি মারতেই দোতলার একটা জানলা খুলে গেল। লম্বা গলা বাড়িয়ে একটা বিরক্ত মুখে নীচের দিকে তাকিয়ে এই গণ্ডগোলের কারণ জানতে চাইল।
“একটা ঘোড়া চাই।” কোনান জোর গলায় বলল, “সব চেয়ে শক্তিশালী, দ্রুতগামী ঘোড়াটা আমি কিনব।”
“এত রাতে দরজা খোলা যাবে না।” গজগজ করল ঘোড়া ব্যবসায়ী।
কোনান থলি নাড়িয়ে মোহরের ঝনঝনা শোনাতে শোনাতে বলল, “গবেটের মতো কথা বোলো না। দেখছ না আমি সাদা, আর আমার সঙ্গে কেউ নেই। মানে মানে নীচে এসো, নয়তো আমি দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে যাব।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, একটা পিঙ্গলবর্ণের অশ্বের পিঠে চড়ে কোনান আরাম বক্সের সরাইখানার দিকে চলেছে।
সে মূল সড়কটা ছেড়ে খেজুর গাছের বাগান-ঘেরা সরাইটায় যাওয়ার জন্য সরু পথটা ধরল বটে, তবে প্রবেশদ্বারটার সামনে থামল না। প্রাচীরের উত্তর-পূর্ব কোণটায় পৌঁছে সে নিঃশব্দে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দেওয়ালের ধার ঘেঁষে চালাতে লাগল। কিছুটা এগোলে সরাইটার উত্তর-পশ্চিম কোণের কাছাকাছি কয়েকটা গুল্মজাতীয় গাছ ছিল। সেখানে কোনো বড়ো গাছ না-থাকায় একটা পোক্ত গুল্মেই ঘোড়া বাঁধল কোনান। কাজটা শেষ করে রেকাবে পা গলিয়ে, বিশেষ উদ্দেশ্যে সে আবার সেটার পিঠে উঠতে যাচ্ছিল, এমন সময় দেওয়ালের বাঁকের ওপার থেকে কয়েকজন মানুষের চাপা কণ্ঠস্বর যেন শোনা গেল। রেকাব থেকে পা নামিয়ে, সাবধানে এগিয়ে সে কোনাটার এপার থেকে উঁকি দিল। তিনটে লোক। কৃষ্ণাঙ্গ। সরাইটার পশ্চিম সীমানার নীচু দেওয়ালটার সামনে মৃদুস্বরে কথা বলছে। মনে হল, তারা মরুভূমির দিকে রওনা দেবে। কোনান দেওয়ালের আড়াল থেকে খোলা তলোয়ার হাতে বেরিয়ে এল।
কোনানকে দেখে একই সঙ্গে তাদের মুখে ভয় ও লোভ খেলা করে গেল। মাছ দেখলে যেমন বেড়ালের হয়, তেমনই চকচক করে উঠল তাদের চোখ। কিন্তু তারা কোনানকে দেখে এটা বুঝতে পেরেছিল, ওই তলোয়ারের বিরুদ্ধে তাদের মুগুর কোনোভাবেই এঁটে উঠতে পারবে না। তবু সন্ত্রস্তস্বরে একজন জিজ্ঞেস করল, “কে তুমি?”
“সেটা জেনে তোমরা কী করবে? তোমরা এখানে কেন?”
“আরাম বক্সের কাছে এসেছিলাম।”
“কোন কাজে?”
তারা ইতস্তত করছে দেখে কোনান আবার বলল, “আমায় বলতে পারো। আমি এই সরাইয়ের নতুন পাহারাদার।”
“ও আমাদের একটা মানুষ দেবে, বলেছিল। ফাঁদঘরটায় ঢুকে দেখলাম, আমাদের এক ভাই মরে পড়ে আছে। তাই আমরা মরুভূমিতে ফিরে যাচ্ছি, আগুন নেবানোর জন্য সবাইকে বলতে। আজ রাতে আমাদের খাওয়া জুটবে না।” তাদের মধ্যে একজন বিড়বিড় করে বলল।
হাসি দেখা গেল কোনানের ঠোঁটের কোণে। সে বলল, “চিন্তা কোরো না। আরাম বক্স যখন কথা দিয়েছে, সে তোমাদের মানুষ দেবে।” তারপর নীচু পশ্চিম পাঁচিলের দরজাটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওখানে অপেক্ষা করো। আরাম বক্স ওখানেই তোমাদের মানুষ পৌঁছে দেবে।”
কথাগুলো বলার পর কোনান সাবধানে পিছু হটল। নরখাদকগুলোর দিকে পিছন ফেরা নিরাপদ নয়। সে দেখল, লোকগুলো তার কথা মেনে ছোটো দরজাটার কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার ঘোড়াটার কাছে ফিরে এল সে। সেটায় চড়ার আগে উঁকি দিয়ে দেখল, লোকগুলো এদিকে আসছে কি না। ঘোড়াটা একটু ছটফট করছিল। সেটার গলায়, কেশরে হাত বুলিয়ে সেটাকে শান্ত করল সে। তারপর রেকাবে ভর দিয়ে উঠে সে ঘোড়াটার পিঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। উঁচু দেওয়ালটার ওপরের অংশ প্রায় তার বাড়ানো হাতের কাছেকাছি। একটা ছোট্ট লাফে ওপরের প্রান্তটা ধরে নিজেকে দেওয়ালের ওপরে তুলতে তার কোনো কষ্ট হল না। সেখান থেকে সে বাগানের ভিতরে তাকাল। সরাইটা প্রাচীরের ঘেরাটোপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। সেটা নিঃশব্দ ও অন্ধকার। সমস্ত দরজা নিশ্চিতভাবে ভিতর থেকে বন্ধ। ভিতরের বেশির ভাগ জমিতে খেজুর আর পাম গাছের বাগান। সেখানে কেউ পাহারা দিচ্ছে না। সে ভিতরের দিকে নিজের শরীর ঝুলিয়ে হাত ছেড়ে দিল। প্রায় নিঃশব্দেই মূল বাগানের মাটিতে নামল সে।
কোনান জানত, আরাম বক্স যে ঘরে ঘুমোয়, সেদিকে যাওয়ার জন্য একটা সাইপ্রাস গাছের পাড়-দেওয়া পথ আছে। ঘরটার সামনে রয়েছে একটা ছোটো বারান্দা ও বাগানমুখী দরজা। সে ছায়ার মতো পথটা পার করল। তারপর বারান্দায় উঠে দরজাটায় মৃদু আঘাত করতে করতে চাপা গলায় ডাকতে লাগল, “মালিক, মালিক।”
“কী হয়েছে?” ভিতর থেকে আরাম বক্সের ঘুম-জড়ানো ঘড়ঘড়ে কণ্ঠ ভেসে এল।
“বদ কালোগুলো পাঁচিল টপকে সরাইখানায় চুরি করতে ঢুকেছে।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল। আরাম বক্সের এক হাতে একটা লম্বা ছোরা, অন্যটায় তামার লম্ফ। পরনে কেবলমাত্র একটা লম্বা ঢোলা জামা ছাড়া আর কিছু নেই।
“এত সাহস, এখন আমার ঘরেই চুরি…” সে লম্ফ তুলে ধরে সারসের মতো মুখ বাড়াতেই কোনানকে দেখতে পেল। “তুমি?…”
আর কিছু বলার সুযোগ পেল না সে। কোনানের প্রতিশোধপরায়ণ আঙুলগুলো তার গলা টিপে ধরেছিল। আরাম বক্স ছুরি চালানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু অপর হাতে কোনান চেপে ধরেছিল তার কবজি। তারপর তারা দুজনেই ঘরের মেঝের ওপর পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কোনান তার হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে বুকের ওপর চেপে বসল। কোনানের শারীরিক সক্ষমতার সঙ্গে এঁটে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই সরাই মালিকটার ছিল না। তারার আলোয় একবার ছুরিটার ফলা ঝলকে উঠল। কোনান সেটাকে আরাম বক্সের মুখের ভিতর ঢুকিয়ে তার জিব ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। মুখ ভরতি রক্ত নিয়ে সে গলগল করে একটা ভয়ানক আর্তনাদ করে উঠেছিল। আবার ছুরি চালাল কোনান। এবারে সে আরাম বক্সের দাড়ির অধিকাংশ কেটে ফেলেছিল। তারপর সে তাকে গলা চেপে-ধরা অবস্থাতেই দাঁড়াতে বাধ্য করল। গলাটা এভাবে চেপে থাকায় গোঁ গোঁ করে একটা শব্দ ছাড়া কিছুই বেরোচ্ছিল না সরাই মালিকের মুখ দিয়ে। রক্তে মাখমাখি হয়ে গিয়েছিল তার মুখমণ্ডল। অসহায়, প্রায় অচেতন আরাম বক্সকে টানতে টানতে কোনান বড়ো পাঁচিলের দরজা খুলে নীচু পাঁচিলের ছোটো বাগানটায় এসে পৌঁছোল। তারপর এক হাতে পশ্চিম প্রান্তের ছোটো দরজাটা খুলে অপর হাতে তাকে ছুড়ে ফেলল রাস্তায়। সেখানে শকুনের মতো তিনটে ছায়ামূর্তি অপেক্ষায় ছিল। রাস্তায় আছড়ে-পড়া মানুষটাকে দেখেই লোভে তাদের চোখ চকচক করে উঠল। একসঙ্গে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর।
আরাম বক্স চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার সব উচ্চারণই তখন অবোধ্য। নরখাদকগুলোও তাকে চিনতে পারেনি। চিনবে কী করে? তার মুখ ক্ষতবিক্ষত, রক্ত-মাখা। লম্বা দাড়ির সামান্য অংশই অবশিষ্ট আছে। তারা তাকে কাঁধে তুলে নিল। আরাম বক্স তীব্র হাহাকার করে উঠল। কিন্তু সরাই থেকে কেউ উঁকি দিল না। পশ্চিমের রাস্তা থেকে ভেসে-আসা এমন ব্যাকুল চিৎকার শুনতে তারা অভ্যস্ত। জ়াম্বোলাবাসীটি প্রাণপণে লড়াই করছিল মুক্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সে রক্ত-মাখা কাতর চোখে একবার চাইল কোনানের মুখের দিকে। সেই মুখে কোনো দয়া দেখা গেল না। কোনান ভাবছিল সেই হতভাগ্য লোকগুলোর কথা, যারা এই মানুষটার অন্তহীন লোভের জন্য প্রাণ হারিয়েছে।
মহানন্দে নরখাদকগুলো আরাম বক্সকে বয়ে নিয়ে চলেছিল। তারা তার অবোধ্য শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করে মজা করছিল। এক পরিধানহীন, রক্তাক্ত, ছিন্নশ্মশ্রু মানুষ যে সরাইওয়ালাটি হতে পারে, তা এইসব ক্ষুধার্ত নরখাদকের মাথায় আসা সম্ভব নয়। যতক্ষণ না ছায়ামূর্তিগুলো খেজুর গাছ আর ঝোপঝাড়ের আড়ালে মিলিয়ে যাচ্ছে, কোনান স্থিরদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল।
আবার চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল জায়গাটা। কোনান ধীরপায়ে ফিরে এল তার ঘোড়ার কাছে। সেটায় চড়ে সে পশ্চিমে মরুভূমির দিকে রওনা দিল। অভিশপ্ত গাছপালার জটলাটা এড়ানোর জন্য সে একটা দীর্ঘ বাঁকা পথ ধরল। রাতের বাতাসে কিছু একটা অশুভ ইঙ্গিত ছড়িয়ে পড়েছিল। বোধহয় সেজন্যেই অস্থির হয়েছিল কোনানের ঘোড়া। তার গলায় থাপ্পড় মেরে আদর করে তাকে শান্ত করল কোনান। কথা বলতে শুরু করল তার সঙ্গে, “কী কাণ্ড হল, বল দেখি। আমি শুধু ভাবছি, ওকে যে আমি নেফারতারি আর সৈনিকটাকে জাহাঙ্গির খান হিসেবে বহু আগেই চিনতে পেরেছিলাম, সেটা বুঝতে পারার পর ও কী করবে। সত্রাপের হাতে খোসালার তারাটা দেখার পর আমি নিশ্চিত হয়ে যাই। চুপিসারে আংটিটা খুলে নিই আমি। গোটাটা যখন ওরা আন্দাজ করবে, তখন আমায় পাকড়াও করার একটা চেষ্টা করবে বটে, কিন্তু যা সময় আমি পাচ্ছি, ওদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে না।” কোনান কোমরে ঝোলানো একটা ছোটো থলি থেকে আংটিটা বের করে আনল। তাতে বসানো রত্নটা তারার মৃদু আলোতেও ঝলমল করে উঠল। বহুদিন থেকেই এই রত্নের কথা জানত সে। এই প্রথম সে এটাকে এত কাছ থেকে দেখছে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেটাকে দেখতে দেখতে প্রশংসায় পূর্ণ হল তার চোখ। ভবিষ্যতের অতুল সম্পদপ্রাপ্তির ইঙ্গিত করার জন্যই যেন, জিনে ঝোলানো আরেকটা থলিতে সোনার মোহরগুলো চাপা ঝনঝন আওয়াজ তুলেছিল।
সে পিছন ফিরে খেজুর আর পাম গাছের জটলাটার দিকে একবার তাকাল। লাল আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে প্রেতের মতো নিকষকালো গাছগুলোর আড়াল থেকে। সেখান থেকে সমবেত মন্ত্রোচ্চারণের মতো গম্ভীর রব শোনা যাচ্ছিল। তার সঙ্গে মিশেছিল বন্য বাজনার দ্রুতলয়ের বোল। ঠিক তখনই রাত্রির আকাশ চিরে এমন একটা অবোধ্য, তীব্র মরণ আর্তনাদ শোনা গেল, ভাষায় যাকে প্রকাশ করা যায় না। শব্দটা পশ্চিমগামী কোনানের পিছনে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, রবার্ট ই হাওয়ার্ড, সায়ক দত্ত চৌধুরী
