৪৫ মিনিট আগে
লেখক: পরাগ ভূঞ্যা
শিল্পী: সুমন দাস
“…যেন ভূমিকম্প! বিছানাসহ আমি শূন্যে কিছুক্ষণ ভাসলাম। তারপর এক বিকট শব্দে আছড়ে পড়লাম মেঝেতে। ভয়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। কী অবস্থায় ছিলাম বুঝতে পেরেছেন মি. সরকার?”
আলবাত বুঝতে পেরেছি, কথাটা মনে মনেই বলতে হল। কারণ জগন্নাথবাবুর গত পরশু রাতের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা শুনে ভয় পাওয়া দূরের কথা, মাঝে মাঝেই হাসির উদ্রেক হচ্ছে। বললাম, “কী হল তারপর?”
“দেখি ওয়াইজা বোর্ডটা নড়ছে। মাঘ মাসের হাড়-কাঁপানো শীতে ঘেমে স্নান সেরে ফেললাম মশাই। চেয়ে দেখি, দরজার কাছে একটি ছায়া। লম্বায় তালগাছের সমান। সেই সঙ্গে একটি চেনা স্বর কানে এল, আমার বাল্যবন্ধু গোবর্ধনের। বছরতিনেক হল, পরলোকের বাসিন্দা। ভাঙা কর্কশ গলায় আমায় বলল, তুই এটা ঠিক করলি না জগন্নাথ! যেই আমি পটোল তুলেছি ওমনি টাকা ধারের গল্পটা বেমালুম চেপে গেলি। খুব ইচ্ছে ছিল আমার শ্রাদ্ধে হাজারখানেক লোক পেট পুরে খাবে। কিন্তু চারশো লোকের আয়োজন করতেই ছেলে হিমশিম খেয়ে উঠল। সব তোর জন্য জগন্নাথ! তোর আর বেঁচে থেকে লাভ নেই। তোকে আমি সঙ্গে করেই ফিরব।”
“তারপর?” আবার প্রশ্ন করলাম।
“তারপরই চিচিং ফাঁক। কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম জানি না। সকালের রোদ এসে ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল। প্ল্যানচেট আর করব না, মশাই। শখ মিটে গেছে। মৃতদের বিরক্ত না করাই ভালো।”
জগন্নাথবাবু তার ভৌতিক অভিজ্ঞতার ইতি টানলেন, আর আমরাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
আমরা, মানে আমি, সুবিমল সরকার ও আমার সহকারী আবির। অদ্ভুতুড়ে-অলৌকিক রহস্য বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সমাধান করাই আমাদের কাজ। এককথায় আমরা প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর।
আবির প্রায় আমার ছেলের বয়সি। ফিজিক্সে অসাধারণ জ্ঞান এবং আমার যোগ্য উত্তরসূরি। কিন্তু ওর একটাই বদগুণ আছে। ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। রাতারাতি নাম বানাতে চায়। এই নিয়ে প্রায় ওর সঙ্গে আমার মনমালিন্য হয়ে থাকে।
আবির এতক্ষণ জগন্নাথবাবুর গল্প চেয়ারে হেলান দিয়ে চা ও বিস্কুট সহযোগে শুনছিল। ও এবার মুখ খুলল, “ওয়াইজাবোর্ডটা একবার দেখতে পারি?”
জগন্নাথবাবু ইতস্ততভাবে চেয়ার ছেড়ে পাশের ঘরে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে হাতে একটা কাঠের বোর্ড নিয়ে এসে হাজির হলেন।
শিশুদের বর্ণমালার মতন ‘এ’ থেকে ‘জেড’ এবং ‘শূন্য’ থেকে ‘নয়’ লেখা রয়েছে। তিনটি সাদা বৃত্তে ‘ইয়েস’, ‘নো’ ও ‘গুড বাই’ লেখা। বোর্ডটি আর পাঁচটা বোর্ডের মতনই মনে হল, কোনও অভিনব ব্যাপার নেই।
জগন্নাথবাবুর ভয়ে ফ্যাকাসে-হওয়া মুখটা দেখে মায়া হল। বেশি রহস্য ঘনীভূত না করে চটজলদি সমাধানে ফিরলাম।
“জগন্নাথবাবু, আপনি কি ঘরের সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করেই প্ল্যানচেটে বসে ছিলেন?”
উত্তর এলো, “হ্যাঁ।”
“আর মোমবাতি জ্বলছিল, তাই নয় কি?”
জগন্নাথবাবু আরও অবাক হয়ে বললেন, “একদম ঠিক ধরেছেন, আপনি তো মশাই অন্তর্যামী।”
“আসলে আপনি পরশু রাতে যা শুনেছেন বা দেখেছেন পুরোটাই আপনার অলীক কল্পনা। বদ্ধ ঘরে মোমবাতি জ্বলার দরুন কার্বন-ডাই-অক্সাইড ভেঙে কার্বন-মনোক্সাইড তৈরি হয়। হ্যালুসিনেশন, মাথা ধরা, ভূত-দর্শন সবই কার্বন-মনোক্সাইড গ্যাসের বিষক্রিয়া। সত্যি কথা বলতে, পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু হয় কি না সন্দেহ। প্রচলিত যুক্তি-তর্ক দিয়ে মানুষ যা বুঝতে পারে না সেটাই অলৌকিক বলে ধরে নেয়।”
জগন্নাথবাবু আমার কথা শুনে বেশ হতাশ হলেন। তার মনের ধন্ধটা এখনও পরিষ্কার হয়নি। অগত্যা তাঁর মন রাখার জন্য পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটা গোবর্ধনকে মর্ত্যে আনার আয়োজন আরম্ভ করলাম।
ঘরের বৈদ্যুতিক আলো নিবিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে তিনজন টেবিলে গোল হয়ে বসলাম। টেবিলের ওপর ওয়াইজা বোর্ড পাতা হল। জগন্নাথবাবু প্ল্যানচেটে অংশগ্রহণ করবেন না, তাই দর্শকের ভূমিকায়। দেখা যাক গোবর্ধন কতক্ষণ অপেক্ষা করায়।
মিনিট পনেরো পরেও যখন ওয়াইজা বোর্ড ঘিরে কিছু ঘটল না, জগন্নাথবাবুর উল্লাসিত মুখটা বাংলার পাঁচের মতন দেখতে হল। নিজেকে বাঁচানোর জন্য বললেন, “আসলে গোবর্ধন ভীষণ লাজুক স্বভাবের ছিল। তাই সবার মাঝে আসতে ভয় পাচ্ছে।”
ভূত আবার ভয় পায়! মনে মনে হাসলাম। তবে আবিরকে ইতস্তত বলে মনে হল। বোধহয় আরও কিছু ঘটার আশায় ছিল। কেবলমাত্র ওর জেদের বশেই এখানে আগমন।
“জগন্নাথবাবু, এবার আমরা উঠি। আমার মধুমেহ আছে। ইনসুলিন ডোজের টাইমিং একটু এদিক ওদিক হলে যম এসে টানাটানি করবে। ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। নমস্কার।”
চেয়ার ছেড়ে দরজার দিকে এগোব, এমন সময় জগন্নাথবাবুর চিৎকারে পিছন ফিরে তাকাতে হল। ওয়াইজা বোর্ডটা আপনাআপনি শূন্যে ভাসছে। জগন্নাথবাবু এক ঝটকায় পিছিয়ে এলেন। আমার ও আবিরের দশা একই। এর আগে এমন ঘটনার সম্মুখীন হইনি। অস্বীকার করব না, সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম।
হঠাৎ ঘরের বৈদ্যুতিক আলোগুলো নিবে গেল। নিমেষে ঘন অন্ধকার আমাদের গিলে খেল। ‘আবির! জগন্নাথবাবু!’ বলে ডাক দিলাম। আবির ডাক শোনাল, কিন্তু জগন্নাথবাবু কোনও সাড়াশব্দ নেই।
আবির টর্চ জ্বালাল। টর্চের আলোয় টেবিলের ওপর নিথর ওয়াইজাবোর্ডটা প্রথমে নজরে এল। কেমন একটা মাদকতা মিশে আছে। সহজে চোখ ফেরানো যায় না।
ঘরের প্রতিটা অংশ অনুসন্ধান করেও জগন্নাথবাবুর টিকি খুঁজে পেলাম না। সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে প্রশ্নের ঝড় হয়ে শরীরময় কাঁটা দিয়ে উঠছে। আবির বেশ অন্যমনস্ক। অন্যান্য দিনের মত পদে পদে আমায় প্রশ্ন করছে না, আপন খেয়ালে মত্ত।
আবিরের উদ্দেশে বললাম, “আমাদের পুলিশে খবর দেওয়া উচিত। ব্যাপারটা মোটেও সুবিধেজনক ঠেকছে না। লোকটা ফ্রড হলেও হতে পারে।”
পুলিশের কথা শুনে আবির ঘাবড়ে গেল। টেবিলে পড়ে থাকা মোমবাতিটায় পুনরায় অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে বলল, “যা ভালো মনে হয় করুন। আমি বরং বাড়ির বাকি অংশগুলো ঘুরে দেখি, জগন্নাথবাবুর খোঁজ পাওয়া যায় কি না। আপনি এখানেই থাকুন। আপনার হাই ব্লাড প্রেশার এই অবস্থায় বেশি উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়।”
টর্চ হাতে আবির আমাকে একা রেখে চলে যায়। ওর পদধ্বনি ক্রমশ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
পরিবেশটা বড়ই অস্বস্তিকর। হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি, কখন ছ’টা বেজে পনেরো মিনিট হয়ে থমকে গেছে। ঘড়িটা আবিরের দেওয়া গত জন্মদিনের সেরা উপহার। ঘড়ির ডায়াল থেকে শুরু করে ভেতরের কলকবজা সবই কাঠের তৈরি।
পায়ের শব্দে সম্বিত ফিরতেই পেছনে ঘুরে তাকালাম। সম্ভবত আবির! কই, না তো! কেউ নেই পেছনে। কেবল আমার ছায়া পেছনে দেওয়ালে গিয়ে পড়েছে।
সেলফোন বের করে আবিরকে ফোন করতে যাব, এমন সময় কাশির আওয়াজ শুনে সামনে তাকালাম। আমার উল্টোদিকের চেয়ারে জগন্নাথবাবু বসে আছেন। মুখে আগের সেই দেঁতো হাসি নেই, পরিবর্তে গম্ভীর ভাব। তিনি এতক্ষণ যেন মুখোশ পরে বসেছিলেন। মোমবাতির আলোয় এখন তার আসল রূপ প্রকাশ পাচ্ছে। বিশেষ করে তার চোখ দুটো, ঠান্ডা-নিষ্প্রাণ-লাল।
কৌতূহল দমন করা কঠিন। জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?”
প্রত্যুত্তরে জগন্নাথবাবু মুচকি হাসলেন, যেটা আর মোটেও হাস্যকর বলে মনে হল না।
“থামুন! এবার প্রশ্ন করার পালা আমার।”
জগন্নাথবাবুর কণ্ঠের দৃঢ়তা দেখে অবাক হলাম।
আবার প্রশ্ন এল, “মনে করুন মি. সরকার। আমার বাড়িতে আপনি কীভাবে এলেন?”
এ আবার কেমন প্রশ্ন। বেশ মনে আছে, দুপুরবেলা ফোনে আবির জানায় একটা ইন্টারেস্টিং কেস আছে, আমাদের হাতিনাথপুর যেতে হবে। যদিও আমার ইচ্ছে ছিল না। ওর মন রাখার জন্য রাজি হলাম। সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে। দমদমে আবিরকে পিক করলাম। তারপর… আমার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে উঠল… কিছুই মনে পড়ছেন না পরের ঘটনাগুলো… কেবল মনে আছে জগন্নাথবাবুর ডাইনিং রুমে বসে আমরা দুজন চা পান করছি…
“কী! মনে পড়ছে না? আমি আপনাকে একটা গল্প শোনাব। দেখবেন সবকিছু মনে পড়ে যাবে। হাইওয়ে ধরে তীব্র গতিতে গাড়ি চলছে। চালকের আসনে সুবিমল সরকার। পাশে আবির বোস। আবির বারে বারে আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে হাতিনাথপুরে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা সত্যিই অলৌকিক এবং রিসার্চ পেপারে উল্লেখ থাকলে সহজেই প্রচারের আলোয় আসা যাবে। কিন্তু আপনি নাছোড়বান্দা। সত্যি যাচাই না করে কোনও সিদ্ধান্তে আসবেন না। শুরু হয় বাগ্বিতণ্ডা। আবির অল্পতেই মাথা গরম করে ফেলে। রাগে অন্ধ হয়ে ও আপনাকে ধাক্কা দেয়। আপনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। মনে পড়ছে মি. সরকার? পেট্রোলের গন্ধ… ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া…”
“হ্যাঁ! মনে পড়ছে। সব মনে পড়ছে। কিন্তু আপনি কে? আর এই জায়গাটা কোথায়?”
“আপনি এখনও ঠিক করে বুঝতে পারেননি,” অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন জগন্নাথবাবু, “ওয়েলকাম মিঃ সরকার। আমার রাজ্যে আপনাকে স্বাগত জানাই।”
আমি নির্বাক হয়ে ওঁর বদলে যাওয়া রূপটা লক্ষ করছি।
৪৫ মিনিট আগে
“…যেন ভূমিকম্প! বিছানাসহ আমি শূন্যে কিছুক্ষণ ভাসলাম। তারপর এক বিকট শব্দে আছড়ে পড়লাম মেঝেতে। ভয়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। কী অবস্থায় ছিলাম বুঝতে পেরেছেন মি. সরকার?”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আপাদমস্তক জগন্নাথকে লক্ষ করছি। থিয়েটারে স্ট্রাগল করা লোকের অভাব নেই। জগন্নাথ ওরফে শ্যামাপ্রসাদকে খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধে আমার হয়নি। সুবিমল স্যারকে দেখছি দিব্যি লোকটার গাঁজাখুরি গল্প হজম করছে।
সুবিমল সরকারের একটাই দোষ কলিযুগেও যুধিষ্ঠিরগিরি করতে পিছপা হন না। কবে থেকে বলছি একটা ফেক গল্প বানিয়ে সত্যি বলে চালিয়ে দিতে। শখের রিসার্চ করে লাভ নেই। ফ্রেম, টাকা না হলে কিস্যু হবে না। কিন্তু লোকটাকে বোঝানো মুশকিল। সত্যের পূজারী, মিথ্যেকে আশ্রয় দেন না—এগুলো শুনে কান ঝালাপালা হয়ে উঠেছে।
জগন্নাথ হাত পা ছুড়ে দিব্যি অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও সংলাপগুলো আমার দেওয়া। সংলাপগুলো প্রথম দিন শুনেই জগন্নাথ বলেছিল, আরে, অসাধারণ লেখকসত্ত্বা লুকিয়ে আছে আপনার মধ্যে। আপনি স্ক্রিপ্ট লিখুন মশাই! স্ক্রিপ্ট লিখুন!
আপাতত জগন্নাথ পরিকল্পনামাফিক সব কিছু ঘটিয়েছে। কিন্তু গোবর্ধনের প্রসঙ্গ আসতেই ওর ওভার অ্যাক্টিং শুরু হল। সুবিমল বিচক্ষণ লোক, সামান্য এদিক ওদিক হলেই সব বুঝতে পারবে। অতএব, আসল কাজে ফেরা উচিত।
“ওয়াইজা বোর্ডটা একবার দেখতে পারি?” প্রশ্নটা ছুড়েই আমার সঙ্গে জগন্নাথের চোখাচোখি হল। এগুলো প্রি-প্ল্যানড, দুজন মিলে অভিনয়ের মহড়া দিয়েছি বহুবার।
কিছুক্ষণের মধ্যে জগন্নাথ ওয়াইজাবোর্ডটা নিয়ে এল। সুবিমল বেশ খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখল। কিছুই বুঝতে পারল না। বোঝার কথাও নয়, প্রায় নিখুঁতভাবে বোর্ডটি বানানো হয়েছে। খালি চোখে দেখে মনে হবে ওটা কাঠের তৈরি। আসলে ওটার মধ্যে লোহার পাত দেওয়া। ঠিক ওপরের রুমে রাখা হয়েছে এক বিশেষ ধরনের যন্ত্র, যা টেবিল বরাবর একটা চুম্বকক্ষেত্র তৈরি করবে। ফলস্বরূপ ওয়াইজা বোর্ডটা শূন্যে ভাসতে থাকবে। পুরো ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রিমোট আছে, যা এই মুহূর্তে আমার প্যান্টের পকেটে। ফুল-প্রুফ প্ল্যান।
এখন কেবল সঠিক সময়ের অপেক্ষা।
জগন্নাথকে আশ্বস্ত করার জন্য সুবিমল কার্বন-মনোক্সাইডের বিষক্রিয়া নিয়ে লেকচার দিতে ব্যস্ত। এরপর প্ল্যানচেটে বসবে। দশ বছর ধরে সুবিমলের সঙ্গে কাজ করছি। ওর সমস্ত রুটিন আমার জানা।
প্ল্যানচেটে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় একটা পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে এল। এ ঘরে ঢোকার পর থেকে গন্ধটা আমাকে বিব্রত করছে। কোথা থেকে আসছে কে জানে।
সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না একবার নজর বুলিয়ে নিলাম। ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র কাঠের তৈরি। লোহার জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সুবিমল কোমরে বেল্ট ব্যবহার করে না। এমনকী গত জন্মদিনে ওকে উপহার দেওয়া ঘড়িটাও কাঠের তৈরি। সুবিমল ঠিক কথাই বলে, প্রচলিত যুক্তিতর্ক দিয়ে মানুষ যা বুঝতে পারে না, সেটাই অলৌকিক বলে ধরে নেয়। আমিও চাই, ও অলৌকিক কিছুর সাক্ষী থাকুক।
প্ল্যানচেটে বসতে গিয়ে সুবিমলের বুক পকেটে রাখা ফাউন্টেন পেনটাকে দেখে চমকে উঠলাম। হিসেব গরমিল হয়ে যাছে। পেনটা কোন ধাতুর তৈরি, সেই নিয়ে সংশয়। এখন যদি চুম্বকক্ষেত্র সক্রিয় করি তাহলে পেনটাও ওয়াইজা বোর্ডসহ ওপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করবে। যদি কিছু না-ও হয় সুবিমল বুকপকেটে টান অনুভব করবে। যেন-তেন-প্রকারে পেনটা টেবিল থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে পেন চেয়ে নেওয়া মানেই সুবিমলের মনে সন্দেহের দানা বাঁধবে। তীরে এসে তরী ডুববে এ হতে দেওয়া যায় না। কী করবে আবির, এটাই হয়তো তোমার শেষ সুযোগ!
সবুরে মেওয়া ফলে। আরও অপেক্ষা করলাম। প্ল্যানচেট শেষ হল। পরিকল্পনা অনুযায়ী কোনও কিছু না ঘটার জন্য জগন্নাথের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে। লোকটা দারুণ মেকআপ দিল, “আসলে গোবর্ধন ভীষণ লাজুক স্বভাবের ছিল। তাই সবার মাঝে আসতে ভয় পাচ্ছে।”
সুবিমল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর বাড়ি ফেরার পালা। জগন্নাথের সঙ্গে নমস্কার বিনিময় করে দরজার দিকে পা বাড়াবে এমন সময় রিমোটের বোতাম টিপলাম। ওয়াইজা বোর্ডটা শূন্যে ভাসতে থাকল। সুবিমলের মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেলাম। প্ল্যান সাকসেসফুল।
কিন্তু দপ করে ঘরের আলোগুলো নিবে গেল। ওভারলোডের জন্য এমনটা হতে পারে খেয়াল ছিল না। ঘন অন্ধকারের মধ্যে সুবিমল ‘আবির! জগন্নাথবাবু!’ বলে ডাক দিল। সাড়া দিলাম। কিন্তু জগন্নাথের মুখে রা নেই। লোডশেডিং হওয়ায় বেচারা ঘাবড়ে গেছে বোধহয়।
ব্যাগ হাতড়ে টর্চ বের করলাম। টর্চের আলোয় সুবিমলকে দেখতে পেলাম, কিন্তু জগন্নাথ কই। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও জগন্নাথের দেখা পেলাম না। লোকটা গেল কোথায়? যদি ডবল ক্রস করে তাহলে ফেঁসে যাব। সুবিমল আমার ষড়যন্ত্র জেনে ফেললে আমার কেরিয়ার খতম।
“আমাদের পুলিশে খবর দেওয়া উচিত। ব্যাপারটা মোটেও সুবিধেজনক ঠেকছে না। লোকটা ফ্রড হলেও হতে পারে।” সুবিমলের মুখে পুলিশের কথা শুনে আঁতকে উঠলাম। একটাই উপায় কোনওক্রমে সুবিমলকে এই ঘরে আটকে রেখে দোতলায় গিয়ে চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করার যন্ত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। টেবিলের ওপর মোমবাতি জ্বালিয়ে বললাম, “যা ভালো মনে হয় করুন। আমি বরং বাড়ির বাকি অংশগুলো ঘুরে দেখি, জগন্নাথবাবুর খোঁজ পাওয়া যায় কি না। আপনি এখানেই থাকুন। আপনার হাই ব্লাড প্রেশার এই অবস্থায় বেশি উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়।”
তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। জগন্নাথকে না পাওয়া গেলে সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। পোড়া গন্ধটা আবার পেলাম। পেট্রোলের গন্ধের সঙ্গে পোড়া মাংসের গন্ধ মিশে রয়েছে।
দরজা ঠেলে দোতলার ঘরে ঢুকলাম। এখানে দুর্ভেদ্য অন্ধকার। টর্চের আলোও কম পড়ছে। হঠাৎ ঘরের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি টের পেলাম। বোধহয় জগন্নাথ। বেটা এখানে এসে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে।
পায়ের শব্দ লক্ষ করে টর্চের আলো ফেলতেই শিউরে উঠলাম। কী পৈশাচিক দৃশ্য! টর্চটা হাত থেকে পড়ে মেঝেতে গড়াতে লাগল। উল্টোপথে পালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথায় দরজা! কয়েক মুহূর্ত আগে যে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলাম সেখানে এখন নিরেট দেওয়াল।
মেঝেতে টর্চটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। মেঝের সঙ্গে সমান্তরালে টর্চের আলো আমার পায়ে এসে পড়েছে। যাই হয়ে যাক না কেন, পেছনে ঘুরে তাকাব না। ওই দৃশ্য দ্বিতীয়বার দেখার সাহস নেই… অন্ধকারে আমাকে লক্ষ করে এগোচ্ছে… ওই তো, ওর পায়ের শব্দ… আমার কাছে… আমার খুব কাছে এসে পড়েছে… একটা মুন্ডুহীন উলঙ্গ বরফ-সাদা শরীর… যার গোটা দেহে মাছের মতন আঁশ… কেঁচোর মতন অজস্র জন্তু কিলবিল করছে তার মধ্যে… গোটা বুক জুড়ে একটা প্রকাণ্ড চোখ… চোখের মনি পড়ন্ত সূর্যের মতন লাল…
বুঝতে পেরেছি! সব বুঝতে পেরেছি! পোড়া মাংসের গন্ধ মেশানো পেট্রোলের গন্ধটা আমারই গা থেকে আসছে। আজ বিকেলে হাতিনাথপুরের উদ্দেশে আমাদের গাড়ি বেরোলেও আমরা সেখানে পৌঁছোতে পারিনি। পথে সুবিমলের সঙ্গে ঝগড়া… ইঞ্জিনের ধোঁয়া… সুবিমল আর আমার ঝলসে পুড়ে যাওয়া লাশ…
সব মনে পড়ছে!
Tags: চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পরাগ ভূঞ্যা, পূজাবার্ষিকী, সুমন দাস, হরর গল্প
দুর্দান্ত! বর্ণনার গুণে আর পরিমিতিতে অতি চমৎকার এই গল্পটি আমাদের পড়তে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ পরাগ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ দাদা ।
ভাল লেগেছে পড়ে। কিন্তু অনুমতি পেলে একটু সমালোচনাও করতে চাই। ছোট গল্প “শেষ হয়েও হইবে না শেষ”। কিছু প্রশ্ন তার অপ্রাপ্তিনিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সে কথা মাথায় রেখেও বলি যে সেই প্রশ্নাবলি তো কি হতে পারতো তাই নিয়ে মূলত। চরিত্রের পরিচয় নিয়ে নয়। জগন্নাথের দ্বিতীয় অবতারের স্বরূপ আরেকটু উদঘাটিতহলে ভাল হত।
জগন্নাথের দ্বিতীয় স্বরূপ হিসেবে কল্পনাতীত দানব/ডেমন ভেবেছিলাম , যার কিছু উপাদান আবিরের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পের দ্বিতীয় পর্বে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। কিছু কিছু অংশে ইচ্ছে করেই ধোঁয়াশা রেখেছি, পাঠকের কল্পনাশক্তি প্রয়োগের অবকাশ তৈরির জন্য। ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য ।