অসুরক্ষিত – সাইমন রিচ

  • লেখক: বাংলা অনুবাদ - শামীম আহমেদ লস্কর
  • শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)

ক কারখানায় আমার জন্ম হয়। তারপর প্লাস্টিকের র‍্যাপারে মুড়ে বাক্সে সিল করা হয় আমাদের, একবাক্সে তিনজন করে।

     প্রথমদিকে আমাদের জায়গা পাল্টায়। কারখানা থেকে গুদামঘরে, সেই গুদাম থেকে ট্রাকে চাপিয়ে তারপর দোকানঘরে।

     একদিন এক তরুণ মানবের নজরে পড়ি। সে খপ করে আমাদের তুলে নিয়ে তার শার্টের নীচে লুকোয়। এবং এরপর সে খুব তাড়াতাড়ি দোকানের বাইরে চলে যায়।

     বাড়িতে পৌঁছে সে সোজা বেডরুমের দিকে ছোটে, সন্তর্পণে দরজা লক করে। প্যাকেট ছিঁড়ে আমায় বের করে তার মানিব্যাগে রাখে।

     এই মানিব্যাগের ভেতর আমি অনেক, অ-নে-ক দিন থাকি। এটি হচ্ছে আমার সেই মানিব্যাগ-জীবনের গল্প।

     মানিব্যাগের ভেতর প্রথম যে বন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা হয় সে হল স্টুডেন্টস আইডি জর্ডি হার্শফেল্ড। সে একখানা কার্ড। জানাল, অনেকদিন ধরেই এখানে আছে। সে আমায় মানিব্যাগের অন্যান্য যেসব বাসিন্দাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় তারা হল, গাড়ি চালানোর লার্নার পারমিট জর্ডি হার্শফেল্ড, ব্লকবাস্টার ভিডিও পার্লারের জর্ডি হার্শফেল্ড, জাম্বা জুস ভ্যালু কার্ড, গেমস্টপ পাওয়ারআপ কার্ড জর্ডি হার্শফেল্ড, ডেন্টিস্ট এর বিজনেস কার্ড অ্যালবার্ট হার্শফেল্ড ও স্কার্সডেল কমিক বুক এক্সপ্লোশন ডিসকাউন্ট কার্ড।

     মানিব্যাগের মাঝখানটায় ডলারগুলো থাকে। ওদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্টতা কম, কারণ তারা সবসময়ই বাইরে যাচ্ছে আর আসছে। সবসময় ছোটাছুটি। তবে মোটের উপর তারা মন্দ নয়। অনেকগুলো এক আর পাঁচ, কিছু দশ, অল্প কিছু কুড়ি-র সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আর একবার তো দেখা হয়েছে আস্ত একশো ডলারের সঙ্গে। সে জানিয়েছিল, একখানা বার্থডে কার্ডের সঙ্গে উপহার হিসেবে সে এসেছিল। একজন বুড়ো মানুষ সেই বার্থডে কার্ড পাঠিয়েছিলেন।

     একজন মেয়েমানুষের ফটোগ্রাফের সঙ্গেও আমার দেখা হয়। ভীষণ সুন্দরী। ব্লকবাস্টার ভিডিও কার্ডের মতো তার চোখ। খুব আকর্ষণীয় নীল রঙের।

     মানিব্যাগে আসার পর শুরুর দিকে আমিই ছিলাম ‘নতুন লোক’। কিন্তু অনেক সময় কেটে গেল। দীর্ঘদিন থাকার পর আমিও আর সেই নতুন থাকলাম না। জাম্বা জুসের সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয় তখন তার গায়ে ছিল দু’খানা স্ট্যাম্প। মানে, তাকে দু’বার ব্যবহার করা হয়েছে আর কী। দেখতে দেখতে সে পাঁচখানা স্ট্যাম্প জুটিয়ে ফেলে – এরপর ছয়, সাতখানা। দশখানা স্ট্যাম্পের পর আর তাকে দেখা যায়নি। একদিন লার্নার্স পারমিটও উধাও হয়ে যায়। ওর জায়গায় আসে ‘নতুন লোক’, ড্রাইভিং লাইসেন্স। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম, দিনকাল খুব দ্রুত পাল্টাচ্ছে।

     এর কিছুকাল পরেই, আমাকেও মানিব্যাগ থেকে বের করা হল। রাতের বেলা। আমি বেজায় ভয় পাচ্ছি। জানিনা কী যে ঘটতে যাচ্ছে। ঠিক তখন আমি একজন মানব তরুণীকে দেখলাম। ফটোগ্রাফের সেই নীল চোখের মেয়ে। বাস্তবেও তাকে দেখতে অবিকল সেই ফটোর মতো, যদিও এবার ওর গায়ে কোনো শার্ট নেই। সে হাসছে, কিন্তু আমাকে দেখার পরই সে যারপরনাই রেগে উঠল, এরপর অনেক কথা কাটাকাটি হয় তাদের মধ্যে। আমাকেও চলে যেতে হয় মানিব্যাগের ভেতরে।

     ক’দিন বাদে, মেয়েমানুষের ছবিটি বিদায় নেয়।

     ওই গ্রীষ্মকালে আমার দু’জন নতুন বন্ধু হয়। একজন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস আইডি কার্ড জর্ডি হার্শফেল্ড ও আরেকজন মেট্রোরেলের মেট্রোকার্ড।

     মেট্রোকার্ড হল নিউইয়র্ক শহরের, আর ও এটা সবসময়ই মনে করিয়ে দিচ্ছে। এ নিয়ে ওর বেজায় অহংকার। সে সাদা ও হলদে রঙের। তার পেছন দিকে ক্যানাডিয়ান সার্কাস-থিয়েটার ‘সার্ক ডু সোলেইল’ এর বিজ্ঞাপনের ছবি।

     একদিন যখন মেট্রোকার্ডের সঙ্গে ভিডিও গেমস টপ্‌ আপ কার্ডের দেখা হল, সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, জর্ডি হার্শফেল্ড তোমাকে এখনো যে কাজে লাগায়নি এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।

     আমি ধন্দে পড়ে যাই। ব্যবহার? আমায় কী কাজে লাগাবে?

     সেই রাতে মেট্রোকার্ডের কাছ থেকে আমার নিজের বিষয়ে অনেক অবাক-করা কথা জানলাম। প্রথমদিকে তো তার কথা তো একদম বিশ্বাসই হয় না! তবে তার জোরালো দাবি, কথাগুলো সত্য। আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ায় সে হাসতে শুরু করল। বলল, তোমার কী মনে হয় তুমি কোন কাজে লাগবে?

     সত্যটা স্বীকার করা আমার পক্ষে খুব লজ্জার – আমি নিজেকে এতোদিন বেলুন মনে করতাম।

     এই সময়টায় আমরা বাসা পাল্টাই। দু’বছরেরও বেশী সময় ধরে আমরা ‘ভেলক্রো ব্যাটম্যান’ মানিব্যাগের ভেতর থাকছিলাম। বেশ সুন্দর আর আরামদায়ক। কিন্তু একদিন বিনা নোটিসে আমরা চলে যাই শক্ত বাদামী চামড়ার ভেতরে। আমি খুব হতাশ, বিশেষ করে যখন দেখলাম যে আমার পুরোনো বন্ধুদের অনেকেই নেই এখানে।

     গেমস্টপ পাওয়ারআপ কার্ড জর্ডি হার্শফেল্ড আর নেই। চলে গেছে ব্লকবাস্টার ভিডিও জর্ডি হার্শফেল্ড। আর নেই স্কার্সডেল কমিকবুক এক্সপ্লোশন ডিসকাউন্ট কার্ড-ও ।

     টিঁকে আছি এই আমরা ক’জন – মেট্রোকার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, স্টুডেন্টস আইডি, আমি নিজে এবং ভিসা নামের একজন গা-ছম্‌ছম্‌ করা মহিলা।

     আমি খুব রেগে আছি। কী খারাপ ছিল ‘ভেলক্রো ব্যাটম্যান’-এ? অনেকগুলো পকেট তো ছিলই আর কী মজার উষ্ণতা সেখানে! আর এখানে যে শুধুই বন্ধুদের জন্য মন কেমন করে, একাকীত্ব বোধ হচ্ছে।

     এর ক’দিন পর, ফিল্ম ফোরাম মেম্বারশিপ জর্ডান হার্শফেল্ডের সঙ্গে দেখা হয়।

     ওইসময় আমি পুরোদস্তুর আতঙ্কে জেরবার। “ফিল্ম ফোরাম” আবার কী? কে এই “জর্ডান হার্শফেল্ড”?

     মেট্রোকার্ড বুঝিয়ে বলল, জর্ডান হার্শফেল্ড আর জর্ডি হার্শফেল্ড একই মানুষ। সে জাস্ট একটু নিজের ‘ইমেজ’ পাল্টানোর চেষ্টা করছে।

     আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম, পুরোনো ইমেজে খারাপটা কী আছে? সেই রাতে আমি মানিব্যাগ থেকে মাথা বের করে পকেটের চারপাশে তাকালাম। চারদিক অন্ধকার থাকলেও আমি দেখলাম আমাদের নয়া প্রতিবেশীকে। ভদ্রলোক তার নাম জানালেন, সিগারেটস্‌ গোলয়েজেজ়। তিনি খুব সজ্জন লোক, যদিও আমার কেমন জানি তাকে অস্বাভাবিক লাগলো।

     প্রায় ওই সময়টাতেই আমার দেখা হল নোটবুকের একখানা পাতার সঙ্গে, তার গায়ে লেখা রয়েছে rachelfeingold@nyu.edu

     মেট্রোকার্ড বলল, এবার আমরা কোথাও যাচ্ছি।

     আমি আমার জীবনে এরচেয়ে বেশি ভয় আর কখনো পাইনি।

     একদিন শনিবারে পাঁচজন কুড়ি ডলারের কড়কড়ে নোট এল। আমি ভাবলাম এরা অনেক দিন থাকবে আমাদের সঙ্গে। কিন্তু না, দু’ঘন্টার মধ্যে তারা চলে গেলো, আর এর বদলে চলে এল ইতালিয়ান রেস্তোরাঁ চেইন ‘লা কুচিনা’র একখানা বিল!

     মেট্রো কার্ড ‘লা কুচিনা’র দিকে তাকায় আর হেসে উঠে। কোনও একটা বিচ্ছিরি রসিকতাও করে বোধহয়। রসিকতাটা বুঝতে না পেরে আমি আরও বিভ্রান্ত ও উদ্বিগ্ন হই।

     পরে, জর্ডি (স্যরি, জর্ডান) আচমকা তার আঙ্গুল দিয়ে আমায় খোঁচা দিল। আমি বেজায় ভয় পেয়ে মেট্রোকার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি?

     সে বাঁকা হাসি হেসে বলল, “জর্ডি শুধু একটু পরখ করে দেখল তুমি আছো কি না। আসন্ন সময়ের জন্য”।

     আমার বন্ধুরা আমায় শান্ত করার চেষ্টা করছে। একজন এক ডলার আমায় শোনাল কীভাবে তার ভেন্ডিং মেশিন পেপসি-র সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাকে ঠেসে ঢোকানো হয়, ফের বার করা হয়, বারবার। এতোবারই যে সে মরতে বসেছিলো। আমি জানি সে আমার উদ্বেগ কাটাতেই এগুলো শোনাচ্ছে। কিন্তু আমি যা বলতে চাই, দোহাই তোমার, দয়া করে এসব নিয়ে কথা বলা বন্ধ করো।

     অবশেষে ওই মুহুর্ত আসে। আগের মতোই আমাকে মানিব্যাগ থেকে বের করে ছুঁড়ে দেওয়া হল বিছানার উপর। চারদিকে খুব অন্ধকার। আমি শুধু একজন মেয়েমানুষের অবয়ব ঠাহর করতে পারলাম।

     সে আমাকে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে তেরছা চোখে খানিকক্ষণ নিরীক্ষণ করল। তারপর সে ল্যাম্পটা জ্বালায়।

     আমি তো বিভ্রান্তই আর সেইসঙ্গে জর্ডান হার্শফেল্ডও।

     সে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে?”

     তার চেহারা তখন জাম্বা জুস ভ্যালু কার্ডের মতো। লাল, লাল রক্তবর্ণের।

     “আমার যা মনে হচ্ছে, বোধহয় এটা এক্সপায়ার্ড” সে উত্তর দিলো।

     তারপর দীর্ঘ নীরবতা।

     হঠাৎ করেই মানুষগুলো হাসতে শুরু করল! মেয়েটি জর্ডানকে বালিশ দিয়ে পেটাতে আরম্ভ করল! জর্ডানও আরেকখানা বালিশ দিয়ে পাল্টা মেয়েটিকে পেটাতে লাগল! আর তারা ক্রমাগত হেসেই গেলো।

     মেয়েটি এবার তার নিজের ব্যাগের দিকে হাত বাড়ায়।

     “চিন্তার কিছু নেই, আমার কাছেও একটা আছে”।

     আমার মনের একটা অংশ চাইছিলো এরপর কী হচ্ছে তা দেখতে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি আমি একগাদা কাপড়ের নিচে চাপা পড়ে গেলাম।

     পরদিন জেগে উঠার পর, আমি আবিষ্কার করলাম যে আমি জর্ডানের হাতে। নিচে জঞ্জাল রাখার ঝুড়ি। সেখানে দেখতে পেলাম সিগারেটস্‌ গোলয়েজেজ় আর ফিল্ম ফোরাম মেম্বারশিপ-কে। তারা ‘দর্শন’ নিয়ে আলোচনা করছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ওদের সঙ্গে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু আমি কি-ই বা করতে পারি? মনে হল এটাই আমার শেষ যাত্রা।

     হঠাৎ, কী মনে হল, জর্ডান আমায় কামরার অন্য পাশে নিয়ে যায়। আমাকে সযত্নে ঢুকিয়ে রাখে তার বিছানার নিচে রাখা এক জুতোর বাক্সে।

     প্রথমদিকে আমি বেজায় ভয় পাই, কারণ জায়গাটা খুব অন্ধকার। এরপর দৃষ্টি সয়ে এলে দেখলাম যে আমি এখানে একা নই। এখানে রয়েছে rachelfeingold@nyu.edu ইমেল আইডি লেখা সেই নোটবুকের পাতা আর ইতালিয়ান রেস্তোরাঁ চেইন ‘লা কুচিনা’র সেই বিল, যার গায়ে এখন লেখা “First Date”

     আমি এই জুতোর বাক্সে বহুদিন কাটাই।

     এখানে আসার পর আমি ছিলাম ‘নতুন লোক’। কিন্তু সময় কাটে আর আমিও হয়ে ওঠি এখানকার এক বর্ষীয়ান বাসিন্দা। আমি স্বাগত জানাই আমার অনেক নতুন বন্ধুকে: বার্থ ডে কার্ড র‍্যাচেল, হ্যাপি ভ্যালেনটাইন্‌স ডে র‍্যাচেল, আর অনেকজন ‘র‍্যাচেল’ নাম লেখা চিরকুট-কে। ‘আই লাভ ইউ জর্ডি। ‘র‍্যাচেল’, ‘গুড মর্নিং জর্ডি। ‘র‍্যাচেল’’

     এখানে সবক’টা স্টিকার-চিরকুটে লেখা র‍্যাচেল।

     আমি জানিনা মানিব্যাগের ভেতরের দিনকাল এখন কেমন। তবে এই জুতোর বাক্সে বসত করে আমি খুশি। আমি টিঁকে থাকতে পেরেছি। আমি আনন্দিত, আমি উষ্ণ, আমি নিরাপদ।

Tags: অনুবাদ, অনুবাদ গল্প, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, ফ্যান্টাসি গল্প, শামীম আহমেদ লস্কর, সাইমন রিচ

One thought on “অসুরক্ষিত – সাইমন রিচ

  • December 31, 2017 at 4:11 am
    Permalink

    বেশ মজার তো।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!