ওঁ
লেখক: অমৃক সরকার
শিল্পী: ইন্টারনেট
২২২২ সাল। পৃথিবীর সবথেকে নিকটবর্তী কৃষ্ণগহ্বরের কাছে পৌঁছে যাওয়া রেডিয়ো স্যাটেলাইটে একটি অদ্ভুত ডিসট্রেসকল ধরা দেবে। যা পৃথিবীর বাসিন্দাদের হয়তো জানাটা দরকার ছিল। কিন্তু তৎকালীন পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতাসীন সরকার এবং তাদের সহকর্মী ধর্মগুরুরা একযোগে সিদ্ধান্ত নেবে সেই বার্তার সমস্ত রেকর্ড নষ্ট করে দিতে। অবশ্য দাম্ভিক লোকগুলো বুঝতে পারেনি এই ব্রহ্মাণ্ড তাদের বাবার সম্পত্তি নয়। এ এমন এক স্থান যেখানে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ, এই তিন কাল একই সময়ে অবস্থান করে। তাই তাদের বর্তমান থেকে সেই আর্তনাদ মুছে ফেললেও অতীতের কোন আকাশমুখী দেওয়ালের কান ঠিক সেই বার্তা শুনে ফেলবে এবং ফাঁস করে দেবে আগত ভবিষ্যতের জানালায়।
… … … … … … … … … …
… হ্যালো… হ্যালো… কেউ কি আমার কথা শুনতে পারছ? যদি শুনতে পাও তাহলে ভাষাটা কি বুঝতে পারছ? অবশ্য যদি পারো এবং উত্তরও দাও তাহলেও আমি কিছুই শুনব না। আমার রিসিভারটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই এখন আমি শুধু বলে যাবো, আর সেগুলো তোমাকে শুনতে হবে। এখন আমি শুধু দেখে যাবো, আর সেগুলো তোমাকেও দেখতে হবে। তোমার অপছন্দ, অবিশ্বাস নিয়ে আমার আর কিছুই করার নেই। আমি এখন এই একমুখী যাত্রার একমাত্র শেষ যাত্রী…
… এই যে গোল জানালাটা উপচে চাপ চাপ অন্ধকার অবলীলায় ঢুকে পড়ছে, সেটা এখন আমার বেশ ভালোই লাগছে। অন্ধকারই তো সৃষ্টির সেই আদিম, অকৃত্রিম এবং স্বাভাবিক উপাদান যা আলোর মরিচীকার হাত থেকে চেতনাকে উদ্ধার করে। কোনও দৃষ্টিবিভ্রমের ভয় নেই। কোনও দ্বিতীয় সম্ভবনা নেই। প্রশ্ন নেই, তাই উত্তর নেই। শুধু শান্ত, নিরবিচ্ছিন্ন, ধ্রুব সত্যের মতো ঘন, এক পরম অন্ধকার। সত্যি বলতে কি এই অবারিত আশ্রয় আমার খুব দরকার ছিল। সভ্যতার আলোয়, তা সে বিন্দুর মতো হলেও, আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে। আলোর আশ্রয় সবসময় স্নেহময় হয় না। ওই যে হাজার-লক্ষ-কোটি আলোকবর্ষ দূরে মিটমিটে নক্ষত্রদের দেখা যাচ্ছে। এই দিকহীন মহাশূন্যে ভেসে যেতে যেতে তুমিও তাদের কোন বাতিঘর ভেবে ভুল করবে। হয়তো তোমাকে নিরাপদ আশ্রয়ের দিক নির্দেশ করছে। কিন্তু যতই তাদের কাছাকাছি যাবে, ক্রমশ বুঝতে পারবে চেতনাকে নষ্ট না করে ওরা তোমাকে আশ্রয় দেবে না। অবশ্য তুমি বলে যদি সত্যি তখনও কিছু থাকে! অন্ধকারের কিন্তু এত শর্ত নেই…
…আমি একজন অস্ত্র উদ্ভাবক আর যুদ্ধ একটা হবেই আমি জানতাম। আমরা খুব দ্রুত ইতিহাস ভুলে যাচ্ছিলাম। আমরা প্রয়োজন মতো ইতিহাস উৎপাদন করছিলাম। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদগুলো প্রায় শেষের মুখে চলে এসেছিল। খাবার আর পানীয় জলের যোগান ছিল সীমিত। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও আমরা একে অন্যকে সাহায্য করিনি। এই গ্রহের যে সামান্য স্থলভাগটুকু বসবাসযোগ্য ছিল আমরা সেখানেও কতগুলি কাল্পনিক রেখার সাহায্যে ক্ষমতার সীমানা নির্ধারণ করেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম এই গ্রহ-ভাগের যে যার অংশটুকু নিয়েই অনন্তকাল টিকে থাকা সম্ভব। আমরা ভেবেছিলাম, আমরা যত বেশি বিভক্ত থাকব ততই সুরক্ষিত থাকব। তাই প্রথমে গ্রহের অন্য প্রজাতিদের থেকে নিজেদের আলাদা ভেবেছি। তারপর একের পর এক মানদণ্ড সৃষ্টি করে নিজেরাই নিজেদের থেকে আলাদা হয়ে গেছি।
… আমাদের দলপতিরা শুধু বিজয়ী হওয়ার কথা বলে যাচ্ছিল। ধর্মগুরুরা ব্যস্ত ছিল পরকালে মুক্তি পাওয়া নিয়ে উৎসাহিত করতে। কিন্তু তারা কেউই বেঁচে থাকার কথা বলছিল না। জীবনকে তারা অবজ্ঞাই করত। প্রাণ, সেই আশ্চর্য উপাদান যার উদ্ভব আর বিকাশ এই একমাত্র গ্রহটিকে দৃশ্যমান নক্ষত্রজগতের সমস্ত জড়পিন্ডগুলির থেকে আলাদা করেছে, তার গুরুত্ব তারা কোনওদিনই উপলব্ধি করতে পারেনি। এই ধারণাতীত অসীমের বুকে আমাদের গ্রহের সবটুকু সামরিক শক্তি নিয়েও আসলে আমরা কতখানি অসহায় এবং নিজেদের এই তুচ্ছতম অস্তিত্ব কোনওমতে টিকিয়ে রাখা ছাড়া আর আমাদের দ্বিতীয় কোনও যুদ্ধ নেই–এই সামান্য সত্যটুকু তারা কোনওদিন স্বীকার করেনি।
আমরাও তাদের কথা বিশ্বাস করতাম। আসলে দীর্ঘকাল ধরে তাদের কথা শুনতে শুনতে আমরাও জীবন কে, বেঁচে থাকাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে ভুলে গেছিলাম। তাই একটা যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু প্রশ্নটা ছিল, এটাই শেষতম কিনা?
… আজ থেকে প্রায় তেরো বছর আগে প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তরে বসে যখন আমি আমার নতুন অস্ত্রের কার্যপদ্ধতি বুঝিয়ে দিচ্ছি, ঠিক তখনই খবর আসে পার্শ্ববর্তী স্থলভাগের কিছু গেরিলা-সৈনিক আমাদের সীমানার ভিতরে ঢুকে পরেছে। তাদের উদ্দেশ্য হল সীমানা লাগোয়া জলাধারে কিছু একটা মিশিয়ে দেওয়া। সম্ভবত বিষ। দিনটা ছিল রোজকার মতোই মেঘলা। তবে বৃষ্টির কোনও আশা ছিল না। কারণ এই মেঘ কারখানা আর বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় তৈরি। প্রাণহীন। শহরের আলোকবৃত্তটা ছাড়িয়ে আমাদের গাড়িগুলো তীব্র বেগে ছুটে চলল সীমানার উদ্দেশে। একটু পরেই দিগন্তছোঁয়া আধপোড়া জমি। মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত ভাবে চাষ হওয়া ফসল। মরে যাওয়া নদী। গ্রামের ধ্বংসাবশেষ। তারপর ধূধূ মরুভূমি। কোনও একসময়ে এই এলাকাটা ঘন বনে ভরা থাকত, কিন্তু আপাতত এই মাটি ভরে আছে তেজস্ক্রিয় ধূলিকণায় এবং পশু-পাখির জীবাশ্মে।
সেই রুক্ষপ্রান্তর ছাড়িয়ে আরও বেশ কিছুটা গেলে দেখা যায় থকথকে নর্দমার পাঁক আর দুর্গন্ধ ভরা এক উপত্যকা। শহরের সমস্ত বর্জ্য-নিকাশী পাইপলাইনগুলো এখানে এসেই উন্মুক্ত হয়। তা ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কারখানাগুলো তাদের তেজস্ক্রিয়-রাসায়নিক-অবশেষ এখানেই উগড়ে দেয়। আর এখানেই একটা দ্বীপের মধ্যে রয়েছে আবর্জনা দিয়ে তৈরি কয়েকটা ছোট ছোট ঘর। এইগুলো হল সেই সব প্রাণীর যারা এই সভ্যতার অভিমুখের ক্রমাগত বিরোধিতা করে চলেছে। এই এলাকাটায় বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। দাম্ভিক আলোর বিচ্ছুরণ নেই। শুধু ছোট ছোট অগ্নিকুণ্ড আলোআঁধারির ভারসাম্য বজায় রেখে জ্বলে যাচ্ছে। ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যের আলোয় সমস্ত প্রান্তরটিকে কোনও স্বপ্নের অংশ বলে মনে হচ্ছিল। আমাদের গাড়ি সেই দিকেই এগিয়ে চলল…
… “দলের বারোজনকেই আমরা মেরে ফেলেছি। একজন আত্মসমর্পণ করেছে আর আরেকজনের পেটে গুলি লেগেছে। তাকে ওই দ্বীপের জীবগুলো আশ্রয় দিয়েছে। আমরা ফেরত চাইলে ওরা অস্বীকার করে এবং দ্বীপে যাওয়ার একমাত্র সেতুটাও ওরা খুলে নিয়েছে।” একজন তরুণ সৈনিক একনিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে গেল।
-“আচ্ছা! কি চায় ওরা?” সামরিক প্রধান জানতে চাইলেন।
– “ওরা জানিয়েছে আহত সৈনিকটিকে ওরা চিকিৎসা করবে। এবং আমাদেরও নাকি সেটাই করা উচিৎ!”
– “ওরা কি আমাদের ঢুকতে বাধা দিচ্ছে? ওদের কাছে কোনও অস্ত্র আছে?
– “আহত সৈনিকটির কাছে প্রচুর বিস্ফোরক ছিল।”
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম কয়েকজন দ্বীপের কিনারায় দাঁড়িয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে আর আমাদের উদ্দ্যেশে একটা গান গাইছে।
-“আচ্ছা এই জায়গাতেই তো কয়েক মাস আগে বেশ কিছু নিষিদ্ধ বই আমরা বাজেয়াপ্ত করেছিলাম না?”
-“হ্যাঁ স্যার।”
সামরিক প্রধান অভিজ্ঞ ব্যক্তি। দলপতির সঙ্গে কথা বলে মুহূর্তের মধ্যে কি করতে হবে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন। আমরা সেই আত্মসমর্পণকারী সৈনিকটিকে নিয়ে আবার মূল শহরের দিকে রওনা হলাম…
… অন্যদের মতোই আমারও বাবা-মায়ের কোনও স্মৃতি নেই। আমার জন্মের আগেই কোনও এক যুদ্ধের পর আমার বাবা আর ফিরে আসেনি। আমার মা ছিল সেই শিবিরের একজন সন্তান উৎপাদনকারী। আমার জন্মের কিছুদিন পর নিষিদ্ধ বই রাখার অপরাধে আমার মা গ্রেপ্তার হয় এবং তারপর তার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। দল পরিচালিত একটি শিবিরে আমি বেড়ে উঠছিলাম এবং ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম, আমার জীবনে যা কিছু ঘটছে সেখানে আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। যেহেতু আমি পুরুষ, তাই দল এবং ধর্ম, এই দুইয়ের জন্য প্রাণ দেওয়া অথবা নেওয়াই আমার অস্তিত্বের মূল উদ্দেশ্য–এটা জেনেই আমি বড় হয়ে উঠছিলাম।
কিন্তু হিসেবটাকে জটিল করে তুলল আমার মায়ের রেখে যাওয়া একটা ছোট্ট কৌটো। তার মধ্যে একটি বীজ নাকি ঘুমিয়ে আছে। রোজ যদি তার যত্ন নেওয়া হয় তাহলে সময় হলেই সে আত্মপ্রকাশ করবে। কেন যে কথাটা বিশ্বাস করেছিলাম! হয়তো আমার জন্মদাত্রীর একমাত্র স্মৃতি এর সঙ্গে মিশে আছে বলেই। প্রত্যেকদিন এই ছোট্ট ধারকটিতে নির্দিষ্ট পরিমানে জল দিয়ে গেছি। বিবর্ণ আকাশের নীচে নক্ষত্রের আলো মাখিয়েছি। তারপর প্রায় পনেরো বছরের মাঝামাঝি সময়ে, মাটি ফুঁড়ে প্রথম একটা সবুজ অংশ বেরিয়ে আসে। এটা সম্ভবত আমাদের গ্রহে এই প্রজাতির শেষ গাছ। এর কুঁকড়ে থাকা পাতাটা খোলার অপেক্ষায় আমি বসে থাকতাম। এবং থাকতে থাকতে আমি ক্রমশ “প্রাণ” নামক বিশেষ অবস্থাটির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি।
“… প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তারা ঢুকে পড়ে এবং তাদের আশ্রয় দেয় আমাদেরই স্থলসীমায় বসবাসকারী একদল ঘৃণ্য জীব। তারা সেখানেই ঘাঁটি বানিয়ে আমাদের সেনাদের উদ্দেশে বিস্ফোরক ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু আমাদের বীর সেনাবাহিনী তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে সেই এলাকাটিকেই সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে…” গাড়ির ভিতরে স্ক্রিনের মধ্যে একজন খুব উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল। কিছুটা দূরে ধুলোর ঢিপিতে একটা গাছের কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। যদি তার ঝলসানো ডালে আবার পাতা ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে আমাদের সব নতুন করে শুরু করতে হবে। আমি বুঝতে পারছিলাম এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও উপায় নেই।
-“কোথাও আগাছা জন্মালে যদি তার শিকড় পর্যন্ত জ্বালিয়ে না দাও, তাহলে ফিরে আসার সম্ভবনা থেকেই যায়”, সেনা অধিনায়ক ওষুধ চিবতে চিবতে বলে যাচ্ছিলেন, “এবং এই কাজে আপনার আবিষ্কৃত ক্ষেপ্নাস্ত্রটির কোন তুলনাই হয়না!”। গাড়ির আলোয় বাইরে যতটুকু চোখ যাচ্ছিল সেখানে কিছুই ছিল না। একটা সাদা পাতার মতো ন্যাড়া। কলমের আঁচড়ের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বহুকাল আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
স্ক্রিনে দলপতির মুখটা ভেসে উঠল।
-“একজনকে আমরা জীবন্ত ধরতে সমর্থ হয়েছি। এর বিচারের ভার আমি আপনাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। আপনারা আমাদের মতামত জানানোর রিমোটের সুইচ টিপে এর ভাগ্য নির্ধারণ করুন”।
যার ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে তার বয়েস তেইশ বছর। সে আমাকে চেনে না। আমিও তার নাম জানি না। তবু তার চোখের দৃষ্টি জানিয়ে দিচ্ছে সে আমাদের কতখানি ঘৃণা করে। বারবার জলের দিকে তাকাচ্ছিল। সেটা এগিয়ে দিতেই আমার মুখে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল। সেনানায়ক তার নাকে একটা সজোরে ঘুসি মারে। কিছুটা রক্ত বেরিয়ে আসলে সেটাই জিব দিয়ে চাটতে থাকে। কিছু কিছু তৃষ্ণা জলে মেটে না…
দলের সদর দপ্তরের সামনে প্রচণ্ড ভিড়। সারা শহর জমা হয়েছে একটি তেইশ বছরের শরীর ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করার জন্য। অনেক শীর্ণ শিশুদের দেখালাম একহাতে খেলনা বন্দুক এবং অন্য হাতে দলের পতাকা উঁচিয়ে অভিনন্দন জানাতে। তাদের কারোর মাথায় চুল নেই। জন্ম দিতে দিতে ক্লান্ত মায়েদের দেখলাম শুন্য চোখে তাকিয়ে থাকতে। দলের নীচুতলার কর্মীদের দেখলাম ঘাওয়ালা হাত মুঠো করে দলের নেতাদের সন্মান জানাতে। আসলে এই শহরে নিজের ঘরে নির্বিষ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার ক্ষমতা এবং সাধ্য সবার নেই। দলনেতা এবং প্রধান ধর্মগুরু একসঙ্গে হাসতে হাসতে ভবনের বাইরে বেরিয়ে এল। সবাই প্রচণ্ড চিৎকার করে তাদের নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। আমরা বন্দীটিকে হস্তান্তর করলাম। হাত পিছমোড়া করে বেঁধে তাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
“চিন্তা করো না, পরের জন্মে তুমি আমাদের ধর্মের একজন হয়ে জন্মাবে” প্রধান ধর্মগুরু তাকে আশ্বাস দিলেন।
কয়েক লক্ষ বছরের বিবর্তন অতিক্রম করে এই শরীর আমরা পেয়েছি। আবার নিমেষের মধ্যে তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ঐশ্বরিক সুখও আমরা জেনে ফেলেছি। বড় বড় আলোয় উজ্জ্বল হয়ে থাকা একটা বধ্যভূমি। আমার চোখ পুড়ে যাচ্ছিল। কিছু আলো অন্ধ করে দেওয়ার জন্যই জ্বালানো হয়।
দলপতি এগিয়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
“আমি জানতাম তুমি সবার সেরা। ওহ কি অস্ত্রই না বানিয়েছ! কিন্তু আরও ভালো করতে হবে। এমন কিছু বানাও যা প্রয়োগ করলে আমাদের ছাড়া অন্য কোনও স্থলভাগের যেন অস্তিত্বই না থাকে! শুধু আমরাই থাকব… শুধু আমরা… একমাত্র বিজয়ী”। বলতে বলতে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উপর দিকে তাকিয়ে রইলেন প্রার্থনার ভঙ্গিমায়। আমিও উপর দিকে তাকালাম। ধোঁয়ায় ঢাকা কুৎসিত আকাশটা ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি বোধহয় হাসছিলেন। তার পিছনে ঝাপসা জনরাশির একটা স্রোত, তারাও হাসছিল। ধর্মগুরু, তিনিও। আমার মনে হল বধ্যভূমিতে একা সেই ছেলেটিও হাসছে। সে বুঝতে পেরেছে আসলে সে একা নয়…
আমার মা আমার পোশাকের ভিতর সেলাই করে তার একটা খাতা লুকিয়ে রেখে গেছিল। তার মধ্যে কিছু অদ্ভুত লেখা আমি আবিষ্কার করি। সেগুলি ছিল মূলত কবিতা এবং ছোট গল্প। কিন্তু তার কোনওটাতেই দলের বা ধর্মের প্রশংসা করা হয়নি। বরং একজন আরেকজনের প্রতি কীভাবে আকর্ষণ বোধ করছে এবং সেই আকর্ষণ কীভাবে তার বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা বাড়িয়ে দিচ্ছে তারই বর্ণনা ভরে আছে পাতায় পাতায়। আবার কোনওটাতে শুধুই একটা সকাল বেলার বর্ণনা, বৃষ্টি দিনের ভাবনা, এইসব। সুদূর অতীতে এই গ্রহে এইসব হত।
তবে আমার মনে গেঁথে গেছিল একটাই বিশেষ গল্প। একটি গ্রহের শেষ মুহূর্তের গল্প। যখন আর কেউ বেঁচে নেই শুধু একজন নাস্তিক ছাড়া। ক্রমশ কালো হয়ে যেতে থাকা আকাশের নিচে বসে থাকতে থাকতে সে কিছুতেই বুঝতে পারে না তার কি করা উচিৎ। সে শেষবারের মতো তার প্রিয় শহরটার বুকে হেঁটে বেড়ায়। দলীয় কার্যালয়গুলো পুরোপুরি ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। সম্মানীয় নেতাদের বড় বড় ছবিগুলো কাদা জলে ডুবে যাচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় ছড়ানো ছিটানো মৃতদেহ। ধর্মীয় উপাসনাস্থলগুলোয় উপচে পড়ছে দেহের স্তূপ। এরা সবাই কাউকে বিশ্বাস করে জীবনভিক্ষা চাইতে গেছিল। সে ফিরে যেতে চায় তার ছোটবেলার বাড়িটার দিকে। কিন্তু যেতে পারে না। কারণ গ্রহের সেই অংশটকু ভেঙে আলাদা হয়ে মহাশূন্যে ভেসে গেছে। তার মনে হতে থাকে একটু স্নান করে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তার হঠাৎ খুব খিদে পেয়ে যায় । তারপর ঘুম পায়। নিজের ঠান্ডা বিছানাটায় শুতে ইচ্ছে হয়। প্রবল যৌন ইচ্ছে জেগে ওঠে। তার হঠাৎ মা হতে সাধ হয়। এবং যখন সে বুঝতে পারে আর কোনওদিন এইসব অভিজ্ঞতা তার হবে না, সব কিছু ছাপিয়ে চীৎকার কাঁদতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু কাঁদলেই বা কি, সান্ত্বনা দেওয়ার মতোও তো কেউ নেই। এই গ্রহে সে তো একাই। আর কয়েক মুহূর্ত পরে তার অস্তিত্বও চিরতরে লুপ্ত হয়ে যাবে এই গ্রহটার সঙ্গেই। এ কি মেনে নেওয়া যায়। এত হাজার হাজার বছরের সভ্যতা তাদের। সেই ইতিহাস এই ভাবে এক লহমায় শেষ হয়ে যাবে? এর কোনও মূল্য নেই মহাকালের কাছে? একটুকরো প্রাণের বীজ কোথাও পোঁতা থাকবে না? ঠিক তখনই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে একটি পোকা উড়ে তার বুকের ওপর এসে বসে। খুবই বিষাক্ত একটি পোকা। যাকে কামড়ায় তার শরীরে একধরনের পরজীবী ঢুকিয়ে দেয়। তারা পোষকের শরীরের ভেতর বংশবৃদ্ধি করতেই থাকে এবং সেই পোষক আস্তে আস্তে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। তারা কিন্তু মরে না। সেই মৃতদেহের ভেতরে বহুযুগ ঘুমিয়ে থাকতে পারে, উপযুক্ত পরিবেশের অপেক্ষায়। আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায়। সেই নাস্তিকের মন হঠাৎ শান্ত হয়। সে পতঙ্গটিকে পরম স্নেহে নিজের শরীরে ঠাঁই দেয়। তারপর নিশ্চিন্ত মনে প্রাসাদ ও দেবালয়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে অনেক দূরে, ক্রমশ জমে যেতে থাকা সমুদ্রের বিবর্ণ জলে শরীর ডুবিয়ে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। আর তার শরীর বুকে নিয়ে অনন্ত মহাশূন্যে ভাসতে থাকে একদা প্রাণোচ্ছল একটি গ্রহের টুকরো…
…ওই যে আমার জানলাটা দিয়ে উল্কাটাকে দেখা যাচ্ছে। মহাশূন্যের বুকে আস্তে আস্তে ভেসে আসছে ধ্যানমগ্ন জ্ঞানীর মতো। ওর শরীরে লেগে আছে আমার তৈরি কয়েকটি বিশেষ যন্ত্রাংশ যা ওকে আমাদের গ্রহের বায়ুমণ্ডলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর একটি বিশেষ দূরত্বে পৌঁছলে ঘটবে বিস্ফোরণ। শেষবারের মতন। আর সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার উল্কার টুকরো প্রবল গতিতে আছড়ে পড়বে আমার গ্রহের আনাচে কানাচে। আমার মনে হয় দলনেতা বেশ খুশিই হবে যখন দিগন্তরেখায় প্রথমবার সেই জ্বলন্ত বার্তাবাহকরা আত্মপ্রকাশ করবে। তার সঙ্গে আমার প্রজাতির প্রাণীগুলো, তারাও উল্লসিত হবে অস্ত্রবিজ্ঞানের এই চরম রূপ দেখে। তারা ধ্বংস দেখতে ভালবাসে। আমি তাদের দু’চোখ ভরে সেটাই দেখার সুযোগ করে দিচ্ছি। শেষবারের মতন। সবাই মিলে একসাথে প্রচণ্ড ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠুক সমস্ত গ্রহ জুড়ে। আমার প্রজাতির কাছে আজ এক আনন্দের দিন। শেষবারের মতন। অন্য প্রজাতিরা এই মুহূর্তটাকে কীভাবে গ্রহণ করত আন্দাজ করা শক্ত। কারন বহু আগেই আমরা তাদের স্মৃতিটুকুও শেষ করে ফেলেছি…
কয়েকদিন পর যখন বাষ্পীভূত জল আবার বৃষ্টি হয়ে ফিরে আসবে তার চেনা গ্রহের শরীরে, নোংরা স্থলভাগগুলো ধুইয়ে দেবে মহাসমুদ্র, তখন বজ্রগর্ভ মেঘ ভেদ করে আরও কয়েকটি স্বয়ংক্রিয় ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে যাবে সেই জলরাশির দিকে। তারা আছড়ে পড়বে আগুন স্নান সেরে ওঠা এক বিশুদ্ধ গ্রহের বুকে। তাদের মধ্যে সুরক্ষিত ক্যাপসুলে সঞ্চিত থাকবে কোটি কোটি এককোষী জীবের সম্ভবনাময় জগৎ। আবার শুরু হবে প্রাণের পথচলা। প্রথম পৃষ্ঠা থেকে। আবার উঠে আসবে নতুন নতুন প্রজাতি। আবার লেখা হবে নতুন ইতিহাস। নতুন মূল্যবোধ। এত ভুল করেছি আমরা! এত যুগ ধরে! খুব ইচ্ছে করছে সেই নতুন বিবর্তনের প্রথম বুদ্ধিমান প্রাণীর মুখখানি দেখে যেতে!
…কিন্তু সময়ের ওপর আমার কোনও অধিকার নেই। আমার প্রজাতির অন্য সবার মতোই আমার শরীরেও কিছু কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েই চলেছে। ঠিক যেভাবে আমাদের গ্রহে আমরা বেড়েছি। কোনও পরিকল্পনা ছাড়া। কোনও উদ্দেশ্য, উপযোগিতা ছাড়া। শুধু অভ্যেসবশত বাড়তে হবে বলে। তাই এই গ্রহের মতোই আমার চেতনাকেও আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। আমার মায়ের রেখে যাওয়া সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে। আঠার ঘণ্টা আগে সেখানে একটা ফুল ফুটেছে। আমি এখন ওটা বুকে জড়িয়ে বসে আছি। একটা মৃদু গন্ধ আমার নাকে আসছে। আমার মায়ের গন্ধ। আমি চাই কেউ যদি আমার এই মহাকাশযান খুঁজে পায় তাহলে তার গ্রহে এই গাছটিকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিক।
…এইতো আমার তৈরি শেষ যুদ্ধের শেষ অস্ত্র তার কাঙ্ক্ষিত দূরত্বে পৌঁছে গেছে। চলো, একসঙ্গে নতুন আরম্ভ করা যাক। পাঁচ… চার… তিন… দুই… এক…
Tags: অমৃক সরকার, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী
ডিস্টোপিয়ান ভাবনার সঙ্গে প্রাণের ফিনিক্স রূপের এই মেলবন্ধনটি ভালো লাগল।
\m/
বেশ বাক্যবাগিশ লেখা।